স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
সপ্তম খণ্ড
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
সপ্তম খণ্ড
১১৫*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… আমি ক্রমাগত এক স্থান থেকে অপর স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সর্বদা কাজ করছি, বক্তৃতা দিচ্ছি, ক্লাস করছি এবং লোককে নানা রকমে বেদান্ত শিক্ষা দিচ্ছি।
আমি যে বই লেখবার সঙ্কল্প করেছিলাম, এখনও তার এক পঙ্ক্তি লিখতে পারিনি। সম্ভবতঃ পরে এ কাজ হাতে নিতে পারব। এখানে উদার মতাবলম্বীদের মধ্যে আমি কতকগুলি পরম বন্ধু পেয়েছি, গোঁড়া খ্রীষ্টানদের মধ্যেও কয়েক জনকে পেয়েছি, আশা করি, শীঘ্রই ভারতে ফিরব। এ দেশ তো যথেষ্ট ঘাঁটা হল, বিশেষতঃ অতিরিক্ত পরিশ্রম আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে। সাধারণের সমক্ষে বিস্তর বক্তৃতা করায় এবং একস্থানে স্থিরভাবে না থেকে ক্রমাগত তাড়াতাড়ি এখান থেকে সেখানে ঘোরার দরুন এই দুর্বলতা এসেছে। … সুতরাং বুঝছ আমি শীঘ্রই ফিরছি। কতকগুলি লোকের আমি খুব প্রিয় হয়ে উঠেছি, আর তাদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে; তারা অবশ্যই চাইবে, আমি বরাবর এখানে থেকে যাই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে—খবরের কাগজে নাম বেরনো এবং সর্বসাধারণের ভেতর কাজ করার দরুন ভুয়ো লোকমান্য তো যথেষ্ট হল—আর কেন? আমার ও-সবের একদম ইচ্ছা নেই।
… কোন দেশের অধিকাংশ লোকই কখনও কেবল সহানুভূতিবশে লোকের উপকার করে না। খ্রীষ্টানদের দেশে কতকগুলি লোক যে সৎকার্যে অর্থব্যয় করে, অনেক সময়ে তার ভেতর কোন মতলব থাকে, কিম্বা নরকের ভয়ে ঐরূপ করে থাকে। আমাদের বাঙলাদেশে যেমন চলিত কথায় বলে, ‘জুতো মেরে গরু দান।’ এখানে সেই রকম দানই বেশী! সর্বত্র তাই। আবার আমাদের জাতের তুলনায় পাশ্চাত্যেরা অধিকতর কৃপণ। আমি অন্তরের সহিত বিশ্বাস করি যে, এশিয়াবাসীরা জগতের সকল জাতের চেয়ে বেশী দানশীল জাত, তবে তারা যে বড় গরীব।
কয়েক মাস আমি নিউ ইয়র্কে বাস করবার জন্য যাচ্ছি। ঐ শহরটি সমস্ত যুক্তরাষ্ট্রের যেন মাথা, হাত ও ধনভাণ্ডারস্বরূপ; অবশ্য বোষ্টনকে ‘ব্রাহ্মণের শহর’ (বিদ্যাচর্চাবহুল স্থান) বলে বটে। আমেরিকায় হাজার হাজার লোক রয়েছে, যারা আমার প্রতি সহানুভূতি করে থাকে। … নিউ ইয়র্কের লোকগুলির খুব খোলা মন। সেখানে আমার কতকগুলি বিশিষ্ট গণ্যমান্য বন্ধু আছেন। দেখি, সেখানে কি করতে পারা যায়। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, এই বক্তৃতা-ব্যবসায়ে আমি দিন দিন বিরক্ত হয়ে পড়ছি। পাশ্চাত্যদেশের লোকের পক্ষে ধর্মের উচ্চাদর্শ বুঝতে এখনও বহুদিন লাগবে। টাকাই হল এদের সর্বস্ব। যদি কোন ধর্মে টাকা হয়, রোগ সেরে যায়, রূপ হয়, দীর্ঘ জীবনলাভের আশা হয়, তবেই সকলে সেই ধর্মের দিকে ঝুঁকবে, নতুবা নয়। … বালাজী, জি. জি এবং আমাদের বন্ধুবর্গের সকলকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবে।
তোমাদের প্রতি চিরপ্রেমসম্পন্ন
বিবেকানন্দ
১১৬*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় কিডি,
তোমার এত শীঘ্র সংসারত্যাগের সংকল্প শুনে আমি বড়ই দুঃখিত হলাম। ফল পাকলে আপনি গাছ থেকে পড়ে যায়; অতএব সময়ের অপেক্ষা কর; তাড়াতাড়ি করো না। বিশেষ, কোন আহাম্মকি কাজ করে অপরকে কষ্ট দেবার অধিকার কারও নেই। সবুর কর, ধৈর্য ধরে থাক, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বালাজী, জি. জি. ও আমাদের অপর সকল বন্ধুকে আমার বিশেষ ভালবাসা জানাবে। তুমিও অনন্তকালের জন্য আমার ভালবাসা জানবে।
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
১১৭*
[মঠের সকলকে লক্ষ্য করিয়া স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
কল্যাণবরেষু,
তোমাদের কয়েকখানা পত্র পাইলাম। শশী প্রভৃতি যে ধূমক্ষেত্র মাচাচ্চে, এতে আমি বড়ই খুশী। ধূমক্ষেত্র মাচাতে হবে, এর কম চলবে না। কুছ পরোয়া নেই। দুনিয়াময় ধূমক্ষেত্র মোচে যাবে, ‘বাহ গুরুকা ফতে!’ আরে দাদা ‘শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি’ (ভাল কাজে অনেক বিঘ্ন হয়), ঐ বিঘ্নের গুঁতোয় বড়লোক তৈরী হয়ে যায়। চারু কে, এখন বুঝতে পেরেছি; তাকে আমি ছেলেমানুষ দেখে এসেছি কিনা, তাই ঠাওরে উঠতে পারিনি। তাকে আমার অনেক আশীর্বাদ। বলি মোহন, মিশনরী-ফিশনরীর কর্ম কি এ ধাক্কা সামলায়? এখন মিশনরীর ঘরে বাঘ সেঁধিয়েছে। এখানকার দিগ্গজ দিগ্গজ পাদ্রীতে ঢের চেষ্টা-বেষ্টা করলে—এ গিরিগোবর্ধন টলাবার যো কি। মোগল পাঠান হদ্দ হল, এখন কি তাঁতীর কর্ম ফার্সি পড়া? ও সব চলবে না ভায়া, কিছু চিন্তা করো না। সকল কাজেই একদল বাহবা দেবে, আর একদল দুষমনাই করবে। আপনার কার্য করে চলে যাও—কারুর কথার জবাব দেবার আবশ্যক কি? ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং, সত্যেনৈব পন্থা বিততো দেবযানঃ।’১ গুরুপ্রসন্নবাবুকে এক পত্র লিখিতেছি। টাকার ভাবনা নাই, মোহন। সব হবে ধীরে ধীরে।
এ দেশে গরমীর দিনে সকলে দরিয়ার কিনারায় যায়—আমিও গিয়েছিলাম, অবশ্য পরের স্কন্ধে। এদের নৌকা আর জাহাজ চালাবার বড়ই বাতিক। ইয়াট বলে ছোট ছোট জাহাজ ছেলে-বুড়ো যার পয়সা আছে, তারই একটা আছে। তাইতে পাল তুলে দরিয়ায় যায় আর ঘরে আসে, খায় দায়—নাচে কোঁদে—গান বাজনা তো দিবারাত্র। পিয়ানোর জ্বালায় ঘরে তিষ্ঠাবার যো নাই।
ঐ যে G. W. Hale (হেল)-এর ঠিকানায় চিঠি দাও, তাদের কথা কিছু বলি। হেল আর তার স্ত্রী, বুড়ো-বুড়ী। আর দুই মেয়ে, দুই ভাইঝি, এক ছেলে। ছেলে রোজগার করতে দোসরা জায়গায় থাকে। মেয়েরা ঘরে থাকে। এদের দেশে মেয়ের সম্বন্ধেই সম্বন্ধ। ছেলে বে করে পর হয়ে যায়—মেয়ের স্বামী ঘন ঘন স্ত্রীর বাপের বাড়ী যায়। এরা বলে—
'Son is son till he gets a wife
The daughter is daughter all her life.'২
চারজনেই যুবতী—বে থা করেনি। বে হওয়া এদেশে বড়ই হাঙ্গাম। প্রথম মনের মত বর চাই। দ্বিতীয় পয়সা চাই। ছোঁড়া বেটারা ইয়ারকি দিতে বড়ই মজবুত—ধরা দেবার বেলা পগার পার। ছুঁড়ীরা নেচে কুঁদে একটা স্বামী যোগাড় করে, ছোঁড়া বেটারা ফাঁদে পা দিতে বড়ই নারাজ। এই রকম করতে করতে একটা ‘লভ্’ হয়ে পড়ে—তখন সাদি হয়। এই হল সাধারণ—তবে হেলের মেয়েরা রূপসী, বড়মানষের ঝি, ইউনিভার্সিটি ‘গার্ল’ (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী)—নাচতে গাইতে পিয়ানো বাজাতে অদ্বিতীয়া—অনেক ছোঁড়া ফেঁ ফেঁ করে—তাদের বড় পসন্দয় আসে না। তারা বোধ হয় বে থা করবে না—তার উপর আমার সংস্রবে ঘোর বৈরিগ্যি উপস্থিত। তারা এখন ব্রহ্মচিন্তায় ব্যস্ত।
মেরী আর হ্যারিয়েট হল মেয়ে, আর এক হ্যারিয়েট আর ইসাবেল হল ভাইঝি। মেয়ে দুইটির চুল সোনালী অর্থাৎ [তারা] ব্লণ্ড, আর ভাইঝি দুটি brunette [ব্রানেট] অর্থাৎ কালো চুল। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—এরা সব জানে। ভাইঝিদের তত পয়সা নেই—তারা একটা Kindergarten School (কিণ্ডারগার্টেন স্কুল) করে, মেয়েরা কিছু রোজগার করে না। এদের দেশের অনেক মেয়ে রোজগার করে। কেউ কারুর উপর নির্ভর করে না। ক্রোড়পতির ছেলেও রোজগার করে, তবে বে করে, আর আপনার বাড়ী ভাড়া করে থাকে। মেয়েরা আমাকে দাদা বলে, আমি তাদের মাকে মা বলি। আমার মালপত্র সব তাদের বাড়ীতে—আমি যেখানেই কেন যাই না। তারা সব ঠিকানা করে। এদেশের ছেলেরা ছোটবেলা থেকেই রোজগার করতে যায়, আর মেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শেখে—তাইতে করে একটা সভায় দেখবে যে 90 per cent. (শতকরা ৯০ জন) মেয়ে। ছোঁড়ারা তাদের কাছে কলকেও পায় না।
এদেশে ভূতুড়ে অনেক। মিডিয়ম (Medium) হল যে ভূত আনে। মিডিয়ম একটা পর্দার আড়ালে যায়, আর পর্দার ভেতর থেকে ভূত বেরুতে আরম্ভ করে—বড় ছোট, হর-রঙের। আমি গোটাকতক দেখলাম বটে, কিন্তু ঠকবাজি বলেই বোধ হল। আর গোটাকতক দেখে তবে ঠিক সিদ্ধান্ত করব। ভূতুড়েরা অনেকে আমাকে শ্রদ্ধাভক্তি করে।
দোসরা হচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ান সায়ান্স—এরাই হচ্চে আজকালকার বড় দল—সর্ব ঘটে। বড়ই ছড়াচ্ছে—গোঁড়া বেটাদের বুকে শেল বিঁধছে। এরা হচ্চে বেদান্তী অর্থাৎ গোটাকতক অদ্বৈতবাদের মত যোগাড় করে তাকে বাইবেলের মধ্যে ঢুকিয়েছে আর ‘সোঽহং সোঽহং’ বলে রোগ ভাল করে দেয়—মনের জোরে। এরা সকলেই আমাকে বড় খাতির করে।
আজকাল গোঁড়া বেটাদের ত্রাহি-ত্রাহি এদেশে। Devil worship৩ আর বড় একখানা চলছে না। আমাকে বেটারা যমের মত দেখে। বলে, কোথা থেকে এ বেটা এল, রাজ্যির মেয়ে-মদ্দ ওর পিছু পিছু ফেরে—গোঁড়ামির জড় মারবার যোগাড়ে আছে। আগুন ধরে গেছে বাবা! গুরুর কৃপায় যে আগুন ধরে গেছে, তা নিববার নয়। কালে গোঁড়াদের দম নিকলে যাবে। কি বাঘ ঘরে ঢুকিয়েছেন, তা বাছাধনেরা টের পাচ্ছেন। থিওসফিষ্টদের জোর বড় একটা নাই। তবে তারাও গোঁড়াদের খুব পিছু লেগে আছে।
এই ক্রিশ্চিয়ান সায়ান্স ঠিক আমাদের কর্তাভজা। বল ‘রোগ নেই’—বস্, ভাল হয়ে গেল, আর বল্ ‘সোঽহং’, বস্—ছুটি, চরে খাওগে। দেশ ঘোর materialist (জড়বাদী)। এই ক্রিশ্চিয়ান দেশের লোক—ব্যামো ভাল কর, আজগুবি কর; পয়সার রাস্তা হয়, তবে ধর্ম মানে—অন্য কিছু বড় বোঝে না। তবে কেউ কেউ বেশ আছে। যত বেটা দুষ্টু বজ্জাত, ঠক-জোচ্চোর মিশনরীরা তাদের ঘাড় ভাঙে আর তাদের পাপ মোচন করে। ... এরা আমাতে এক নূতন ডৌলের মানুষ দেখেছে। গোঁড়া বেটাদের পর্যন্ত আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে, আর এখন সকলে বড়ই ভক্তি করছে—বাবা ব্রহ্মচর্যের চেয়ে কি আর বল আছে?
আমি এখন মান্দ্রাজীদের Address (অভিনন্দন), যা এখানকার সব কাগজে ছেপে ধূমক্ষেত্র মোচে গিয়েছিল, তারই জবাব লিখতে ব্যস্ত। যদি সস্তা হয় তো ছাপিয়ে পাঠাব, যদি মাগগি হয় তো type-writing (টাইপ) করে পাঠিয়ে দেব। তোমাদেরও এক কপি পাঠাব—‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ ছাপিয়ে দিও।
এদেশের অবিবাহিত মেয়েরা বড়ই ভাল, তারা ভয় ডর করে। … এরা হল বিরোচনের জাত। শরীর হল এদের ধর্ম, তাই মাজা, তাই ঘষা—তাই নিয়ে আছে। নখ কাটবার হাজার যন্ত্র, চুল কাটবার দশ হাজার, আর কাপড়-পোষাক গন্ধ-মসলার ঠিক-ঠিকানা কি! ... এরা ভাল মানুষ, দয়াবান্ সত্যবাদী। সব ভাল, কিন্তু ঐ যে ‘ভোগ’, ঐ ওদের ভগবান্—টাকার নদী, রূপের তরঙ্গ, বিদ্যার ঢেউ, বিলাসের ছড়াছড়ি।
কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।
ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্মজা॥—গীতা, ৪।১২
অদ্ভুত তেজ আর বলের বিকাশ—কি জোর, কি কার্যকুশলতা, কি ওজস্বিতা! হাতীর মত ঘোড়া—বড় বড় বাড়ীর মত গাড়ী টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এইখান থেকেই শুরু ঐ ডৌল সব। মহাশক্তির বিকাশ—এরা বামাচারী। তারই সিদ্ধি এখানে, আর কি! যাক—এদের মেয়ে দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম বাবা! আমাকে যেন বাচ্ছাটির মত ঘাটে-মাঠে দোকান-হাটে নিয়ে যায়। সব কাজ করে—আমি তার সিকিও করতে পারিনি। এরা রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী, আমি এদের পুষ্যিপুত্তুর, এরা সাক্ষাৎ জগদম্বা; বাবা! এদের পূজা করলে সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। আরে রাম বল, আমরা কি মানুষের মধ্যে? এই রকম মা জগদম্বা যদি ১০০০ আমাদের দেশে তৈরী করে মরতে পারি, তবে নিশ্চিত হয়ে মরব। তবে তোদের দেশের লোক মানুষের মধ্যে হবে। তোদের পুরুষগুলো এদের মেয়েদের কাছে ঘেঁষবার যুগ্যি নয়—তোদের মেয়েদের কথাই বা কি! হরে হরে, আরে বাবা, কি মহাপাপী! ১০ বৎসরের মেয়ের বর যুগিয়ে দেয়। হে প্রভু, হে প্রভু! কিমধিকমিতি—
আমি এদের এই আশ্চর্যি মেয়ে দেখি। একি মা জগদম্বার কৃপা! একি মেয়ে রে বাবা! মদ্দগুলোকে কোণে ঠেলে দেবার যোগাড় করেছে। মদ্দগুলো হাবুডুবু খেয়ে যাচ্ছে। মা তোরই কৃপা। গোলাপ-মা যা করেছে, তাতে আমি বড়ই খুশী। গোলাপ-মা বা গৌর-মা তাদের মন্ত্র দিয়ে দিক্ না কেন? মেয়ে-পুরুষের ভেদটার জড় মেরে তবে ছাড়ব। আত্মাতে কি লিঙ্গভেদ আছে নাকি? দূর কর মেয়ে আর মদ্দ, সব আত্মা। শরীরাভিমান ছেড়ে দাঁড়া। বলো ‘অস্তি অস্তি’; ‘নাস্তি নাস্তি’ করে দেশটা গেল! সোঽহং সোঽহং শিবোঽহং। কি উৎপাত! প্রত্যেক আত্মাতে অনন্ত শক্তি আছে; ওরে হতভাগাগুলো, নেই নেই বলে কি কুকুর বেড়াল হয়ে যাবি নাকি? কিসের নেই? কার নেই? শিবোঽহং শিবোঽহং। নেই নেই শুনলে আমার মাথায় যেন বজ্র মারে। রাম রাম, গরু তাড়াতে তাড়াতে জন্ম গেল! ঐ যে ছুঁচোগিরি, ‘দীনাহীনা’ ভাব—ও হল ব্যারাম। ও কি দীনতা? ও গুপ্ত অহঙ্কার! ন লিঙ্গং ধর্মকারণং, সমতা সর্বভূতেষু এতন্মুক্তস্য লক্ষণম্। অস্তি অস্তি অস্তি, সোঽহং, সোঽহং চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহং। ‘নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী’৪। ছুঁচোগিরি করবি তো চিরকাল পড়ে থাকতে হবে। ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’৫। শশী, তুই কিছু মনে করিস না—আমি সময়ে সময়ে nervous (দুর্বল) হয়ে পড়ি, দু-কথা বলে দিই। আমায় জানিস তো? তুই যে গোঁড়ামিতে নাই, তাতে আমি বড়ই খুশী। Avalanche৬ এর মত দুনিয়ার উপর পড়—দুনিয়া ফেটে যাক চড় চড় করে, হর হর মহাদেব। ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’ (আপনিই আপনাকে উদ্ধার করবে)।
রামদয়ালবাবু আমাকে এক পত্র লেখেন, আর তুলসীরামের এক পত্র পাইয়াছি। পলিটিক্যাল বিষয় তোমরা কেউ ছুঁয়ো না, এবং তুলসীরামবাবু যেন পলিটিক্যাল পত্র না লেখে। এখন পাবলিক ম্যান, অনর্থক শত্রু বাড়াবার দরকার নাই। তবে যদি পুলিশ-ফুলিশ পেছনে লাগে তোদের—‘দাঁড়িয়ে জান দে’। ওরে বাপ, এমন দিন কি হবে যে, পরোপকারায় জান যাবে? ওরে হতভাগারা, এ দুনিয়া ছেলেখেলা নয়—বড় লোক তাঁরা, যাঁরা আপনার বুকের রক্ত দিয়ে রাস্তা তৈরী করেন। এই হয়ে আসছে চিরকাল। একজন আপনার শরীর দিয়ে সেতু বানায়, আর হাজার লোক তার উপর দিয়ে নদী পার হয়। এবমস্তু, এবমস্তু, শিবোঽহং, শিবোঽহং (এইরূপই হউক, আমিই শিব)। রামদয়ালবাবুর কথামত ১০০ ফটোগ্রাফ পাঠিয়ে দেব। তিনি বেচতে চান। টাকা আমাকে পাঠাতে হবে না, মঠে দিতে বলো। আমার এখানে ঢের টাকা আছে, কোন অভাব নাই—ইওরোপ বেড়াবার আর পুঁথিপত্র ছাপাবার জন্য। এ চিঠি ফাঁস করিস না।
আশীর্বাদক
নরেন্দ্র
এইবার কাজ ঠিক চলবে, আমি দেখতে পাচ্ছি। Nothing succeeds as success (কৃতকার্যতা যে সাফল্য এনে দেয়, আর কিছু তা পারে না)। বলি শশী, তুমি ঘর জাগাও—এই তোমার কাজ। … কালী হোক business manager (বিষয়কার্যের পরিচালক)। মা-ঠাকুরাণীর জন্য একটা জায়গা খাড়া করতে পারলে তখন আমি অনেকটা নিশ্চিন্তি। বুঝতে পারিস? দুই তিন হাজার টাকার মত একটা জায়গা দেখ। জায়গাটা বড় চাই। আপাততঃ মেটে ঘর, কালে তার উপর অট্টালিকা খাড়া হয়ে যাবে। যত শীঘ্র পার জায়গা দেখ। আমাকে চিঠি লিখবে। কালীকৃষ্ণবাবুকে জিজ্ঞাসা করবে, কি রকম করে টাকা পাঠাতে হয়—Cook-এর দ্বারা কি প্রকারে। যত শীঘ্র পার ঐ কাজটা হওয়া চাই। ঐটি হলে বস্, আদ্দেক হাঁপ ছাড়ি। জায়গাটা বড় চাই, তারপর দেখা যাবে। আমাদের জন্য চিন্তা নাই, ধীরে ধীরে সব হবে। কলিকাতার যত কাছে হয় ততই ভাল। একবার জায়গা হলে মা-ঠাকুরাণীকে centre (কেন্দ্র) করে গৌর-মা, গোলাপ-মা একটা বেডোল হুজুক মাচিয়ে দিক্। মান্দ্রাজে হুজুক খুব মেচেছে, ভাল কথা বটে।
তোমাদের একটা কিনা কাগজ ছাপাবার কথা ছিল, তার কি খবর? সকলের সঙ্গে মিশতে হবে, কাউকে চটাতে হবে না। All the powers of good against all the powers of evil৭—এই হচ্ছে কথা। বিজয়বাবুকে খাতির-যত্ন যথোচিত করবে। Do not insist upon everybody's believing in our Guru.৮
আমি গোলাপ-মাকে একটা আলাদা পত্র লিখছি, পৌঁছে দিও। এখন তলিয়ে বুঝ—শশী ঘর ছেড়ে যেতে পারবে না; কালী বিষয়কার্য দেখবে আর চিঠিপত্র লিখবে। হয় সারদা, নয় শরৎ, নয় কালী—এদের সকলে একেবারে বাইরে না যায়—একজন যেন মঠে থাকে। তারপর যারা বাইরে যাবে, তারা যে-সকল লোক আমাদের সঙ্গে sympathy (সহানুভূতি) করবে, তাদের সঙ্গে মঠের যেন যোগ করে দেয়। কালী তাদের সঙ্গে correspondence (পত্রব্যবহার) রাখবে। একটা খবরের কাগজ তোমাদের edit (সম্পাদন) করতে হবে, আদ্দেক বাঙলা, আদ্দেক হিন্দী—পার তো আর একটা ইংরেজীতে। পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছ—খবরের কাগজের subscriber (গ্রাহক) সংগ্রহ করতে ক-দিন লাগে? যারা বাহিরে আছে, subscriber (গ্রাহক) যোগাড় করুক। গুপ্ত৯—হিন্দী দিকটা লিখুক, বা অনেক হিন্দী লিখবার লোক পাওয়া যাবে। মিছে ঘুরে বেড়ালে চলবে না। যে যেখানে যাবে, সেইখানেই একটা permanent (স্থায়ী) টোল পাততে হবে। তবে লোক change (পরিবর্তিত) হতে থাকবে। আমি একটা পুঁথি লিখছি—এটা শেষ হলেই এক দৌড়ে ঘর আর কি! আর আমি বড় nervous (দুর্বল) হয়ে পড়েছি—কিছুদিন চুপ করে থাকার বড় দরকার। মান্দ্রাজীদের সঙ্গে সর্বদা correspondence (পত্রব্যবহার) রাখবে ও জায়গায় জায়গায় টোল খোলবার চেষ্টা করবে। বাকী বুদ্ধি তিনি দিবেন। সর্বদা মনে রেখো যে, পরমহংসদেব জগতের কল্যাণের জন্য এসেছিলেন—নামের বা মানের জন্য নয়। তিনি যা শেখাতে এসেছিলেন, তাই ছড়াও। তাঁর নামের দরকার নেই—তাঁর নাম আপনা হতে হবে। ‘আমার গুরুজীকে মানতেই হবে’ বললেই দল বাঁধবে, আর সব ফাঁস হয়ে যাবে—সাবধান! সকলকেই মিষ্টি বচন—চটলে সব কাজ পণ্ড হয়। যে যা বলে বলুক, আপনার গোঁয়ে চলে যাও—দুনিয়া তোমার পায়ের তলায় আসবে, ভাবনা নেই। বলে—একে বিশ্বাস কর, ওকে বিশ্বাস কর; বলি, প্রথমে আপনাকে বিশ্বাস কর দিকি। Have faith in yourself, all power is in you. Be conscious and bring it out১০—বল্, আমি সব করতে পারি। ‘নেই নেই বললে সাপের বিষ নেই হয়ে যায়।’ খবরদার, No ‘নেই নেই’ (নেই নেই নয়); বল্—‘হাঁ হাঁ,’ ‘সোঽহং সোঽহং’।
কিন্নাম রোদিষি সখে ত্বয়ি সর্বশক্তিঃ
আমন্ত্রয়স্ব ভগবন্ ভগদং স্বরূপম্।
ত্রৈলোক্যমেতদখিলং তব পাদমূলে
আত্মৈব হি প্রভবতে ন জড়ঃ কদাচিৎ॥১১
মহা হুঙ্কারের সহিত কার্য আরম্ভ করে দাও। ভয় কি? কার সাধ্য বাধা দেয়? কুর্মস্তারকচর্বণং ত্রিভুবনমুৎপাটয়ামো বলাৎ। কিং ভো ন বিজানাস্যম্মান্—রামকৃষ্ণদাসা বয়ম্।১২ ডর? কার ডর? কাদের ডর?
ক্ষীণাঃ স্ম দীনাঃ সকরুণা জল্পন্তি মূঢ়া জনাঃ
নাস্তিক্যস্ত্বিদন্তু অহহ দেহাত্মবাদাতুরাঃ।
প্রাপ্তাঃ স্ম বীরা গতভয়া অভয়ং প্রতিষ্ঠাং যদা
আস্তিক্যস্ত্বিদন্তু চিনুমঃ রামকৃষ্ণদাসা বয়ম্॥
পীত্বা পীত্বা পরমপীযূষং বীতসংসাররাগাঃ
হিত্বা হিত্বা সকলকলহপ্রাপিণীং স্বার্থসিদ্ধিম্।
ধ্যাত্বা ধ্যাত্বা শ্রীগুরুচরণং সর্বকল্যাণরূপং
নত্বা নত্বা সকলভবনং পাতুমামন্ত্রয়ামঃ॥
প্রাপ্তং যদ্বৈ ত্বনাদিনিধনং বেদোদধিং মথিত্বা
দত্তং যস্য প্রকরণে হরিহর ব্রহ্মাদিদেবৈর্বলম্।
পূর্ণং যত্তু প্রাণসারৈর্ভৌমনারায়ণানাং
রামকৃষ্ণস্তনুং ধত্তে তৎপূর্ণপাত্রমিদং ভোঃ॥১৩
ইংরেজী লেখাপড়া-জানা young men (যুবক)-দের ভিতর কার্য করতে হবে। ‘ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’ (ত্যাগের দ্বারাই অনেকে অমৃতত্ব লাভ করিয়াছেন)। ত্যাগ, ত্যাগ—এইটি খুব প্রচার করা চাই। ত্যাগী না হলে তেজ হবে না। কার্য আরম্ভ করে দাও। তোমরা যদি একবার গোঁ ভরে কার্য আরম্ভ করে দাও, তা হলে আমি বোধ হয় কিছুদিন বিরাম লাভ করতে পারি। তার জন্যই বোধ হয় কোথাও বসতে পারতুম না—এত হাঙ্গাম করতে হবে না কি? মান্দ্রাজ থেকে আজ অনেক খবর এল। মান্দ্রাজীরা তোলপাড়টা করছে ভাল। মান্দ্রাজের মিটিং-এর খবর সব ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ (Indian Mirror)-এ ছাপিয়ে দিও। আর কি অধিক লিখিব? সব খবর আমাকে খুঁটি-নাটি পাঠাবে। ইতি
বাবুরাম, যোগেন অত ভুগছে কেন?—‘দীনাহীনা’ ভাবের জ্বালায়। ব্যামো-ফ্যামো সব ঝেড়ে ফেলে দিতে বল—এক ঘণ্টার মধ্যে সব ব্যামো-ফ্যামো সেরে যাবে। আত্মাতে কি ব্যামো ধরে না কি? ছুট! ঘণ্টাভর বসে ভাবতে বল—‘আমি আত্মা—আমাতে আবার রোগ কি?’ সব চলে যাবে। তোমরা সকলে ভাব—‘আমরা অনন্ত বলশালী আত্মা’; দেখ দিকি কি বল বেরোয়। ‘দীনহীনা!’ কিসের ‘দীনহীনা’? আমি ব্রহ্মময়ীর বেটা! কিসের রোগ, কিসের ভয়, কিসের অভাব? ‘দীনহীনা’ ভাবকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় কর দিকি। সব মঙ্গল হবে। No negative, all positive, affirmative—I am, God is and everything is in me. I will manifest health, purity, knowledge, whatever I want.১৪ আরে, এরা ম্লেচ্ছগুলো আমার কথা বুঝতে লাগল, আর তোমরা বসে বসে ‘দীনাহীনা’ ব্যামোয় ভোগো? কার ব্যামো—কিসের রোগ? ঝেড়ে ফেলে দে! বলে, ‘আমি কি তোমার মত বোকা?’ আত্মায় আত্মায় কি ভেদ আছে? গুলিখোর জল ছুঁতে বড় ভয় পায়। ‘দীনহীনা’ কি এইসি তেইসি—নেই মাঙ্গতা ‘দীনাক্ষীণা’! ‘বীর্যমসি বীর্যং, বলমসি বলম, ওজোঽসি ওজঃ, সহোঽসি সহো ময়ি ধেহি’।১৫ রোজ ঠাকুরপূজার সময় যে আসন প্রতিষ্ঠা—আত্মানম্ অচ্ছিদ্রং ভাবয়েৎ (আত্মাকে অচ্ছিদ্র ভাবনা করিবে)—ওর মানে কি? বল—আমার ভেতর সব আছে, ইচ্ছা হলে বেরুবে। তুমি নিজের মনে মনে বল, বাবুরাম যোগেন আত্মা—তারা পূর্ণ, তাদের আবার রোগ কি? বল ঘণ্টাখানেক দুচার দিন। সব রোগ বালাই দূর হয়ে যাবে। কিমধিকমিতি—
নরেন্দ্র
১১৮*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
হোটেল বেল ভিউ, ইওরোপীয়ান প্ল্যান
বীকন ষ্ট্রীট, বোষ্টন
২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি আপনার কৃপালিপি দুইখানিই পেয়েছি। আমাকে শনিবারে মেলরোজ ফিরে গিয়ে সোমবার পর্যন্ত সেখানে থাকতে হবে। মঙ্গলবার আপনার ওখানে যাব। কিন্তু ঠিক কোন্ জায়গাটায় আপনার বাড়ী আমি ভুলে গেছি; আপনি অনুগ্রহ করে যদি আমায় লেখেন। আমার প্রতি অনুগ্রহের জন্য আপনাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না—কারণ, আপনি যা দিতে চেয়েছেন, ঠিক সেই জিনিষটাই আমি খুঁজছিলাম—লেখবার জন্য একটা নির্জন জায়গা। অবশ্য আপনি দয়া করে যতটা জায়গা আমার জন্য দিতে চেয়েছেন, তার চেয়ে কম জায়গাতেই আমার চলে যাবে। আমি যেখানে হয় গুড়িসুড়ি মেরে পড়ে আরামে থাকতে পারব।
আপনার সদা বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
১১৯*
[ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
বোষ্টন
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
ভারতের ডাক ও তোমার চিঠি এইমাত্র পেলাম। ভারত থেকে বেশ কিছু সংবাদপত্রের অংশ কেটে আমার কাছে পাঠান হয়েছে। তুমি সেগুলি পড়ে নিরাপদ স্থানে রেখে দেবে, তাই সেগুলি তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ভারতের চিঠি লেখার ব্যাপারে গত কয়েকদিন ধরে ব্যস্ত আছি। আরও দিন কয়েক বোষ্টনে থাকব। প্রীতি ও আশীর্বাদ।
সদা স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
১২০*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… কলিকাতা থেকে আমার বক্তৃতা ও কথাবার্তা সম্বন্ধে যে-সব বই ছাপা হয়েছে, তাতে একটা জিনিষ আমি দেখতে পাচ্ছি। তাদের মধ্যে কতকগুলি এরূপভাবে প্রকাশ করা হয়েছে যে, পড়লে বোধ হয় যেন আমি রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছি। প্রকৃতপক্ষে কিন্তু আমি একজন রাজনীতিক নই, অথবা রাজনৈতিক আন্দোলনকারীও নই। আমার লক্ষ্য কেবল ভেতরের আত্মতত্ত্বের দিকে; সেইটি যদি ঠিক হয়ে যায়, তবে আর সবই ঠিক হয়ে যাবে—এই আমার মত। … অতএব তুমি কলিকাতার লোকদের অবশ্য অবশ্য সাবধান করে দেবে, যেন আমার কোন লেখা বা কথার ভেতর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মিথ্যা করে আরোপিত করা না হয়। কি আহাম্মকি! … শুনলাম, রেভারেণ্ড কালীচরণ বাঁড়ুয্যে নাকি খ্রীষ্টান মিশনরীদের সমক্ষে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, আমি একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি। যদি সর্বসাধারণের সমক্ষে এ কথা বলা হয়ে থাকে, তবে আমার তরফ থেকে তাঁকে প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসা করবে, তিনি কলিকাতার যে-কোন সংবাদপত্রে লিখে হয় তা প্রমাণ করুন, নতুবা তাঁর ঐ বাজে আহাম্মকি কথাটা প্রত্যাহার করুন। এটা অন্য ধর্মাবলম্বীকে অপদস্থ করবার খ্রীষ্টান মিশনরীদের একটা অপকৌশলমাত্র। আমি সাধারণভাবে খ্রীষ্টান-পরিচালিত শাসনতন্ত্রকে লক্ষ্য করে সরলভাবে সমালোচনার ছলে কয়েকটা কড়া কথা বলেছি। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, আমার রাজনৈতিক বা ঐ রকম কিছু চর্চার দিকে কিছু ঝোঁক আছে, অথবা রাজনীতি বা তৎসদৃশ কিছুর সঙ্গে আমার কোনরূপ সম্পর্ক আছে। যাঁরা ভাবেন, ঐ সব বক্তৃতা থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে ছাপান একটা খুব জমকাল ব্যাপার, আর যাঁরা প্রমাণ করতে চান যে আমি একজন রাজনৈতিক প্রচারক, তাঁদের আমি বলি, ‘হে ঈশ্বর, আমার বন্ধুদের হাত থেকে আমায় রক্ষা কর।’
… আমার বন্ধুগণকে বলবে, যাঁরা আমার নিন্দাবাদ করছেন, তাঁদের জন্য আমার একমাত্র উত্তর—একদম চুপ থাকা। আমি তাঁদের ঢিলটি খেয়ে যদি তাঁদের পাটকেল মারতে যাই, তবে তো আমি তাঁদের সঙ্গে এক দরের হয়ে পড়লুম। তাদের বলবে—সত্য নিজের প্রতিষ্ঠা নিজেই করবে, আমার জন্যে তাদের কারও সঙ্গে বিরোধ করতে হবে না। তাদের (আমার বন্ধুদের) এখনও ঢের শিখতে হবে, তারা তো এখনও শিশুতুল্য। তারা বালক—তারা এখনও আহাম্মকের মত সোনার স্বপন দেখছে!
… সাধারণের সহিত জড়িত এই বাজে জীবনে এবং খবরের কাগজের হুজুকে আমি একেবারে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। এখন প্রাণের ভেতর আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে—হিমালয়ের সেই শান্তিময় ক্রোড়ে ফিরে যাই।
তোমার প্রতি চিরস্নেহপূর্ণ
বিবেকানন্দ
১২১*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তুমি যে-সকল কাগজ পাঠাইয়াছিলে, তাহা যথাসময়ে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। আর এত দিনে তুমিও নিশ্চয় আমেরিকার কাগজে যে-সকল মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার কিছু কিছু পাইয়া থাকিবে। এখন সব ঠিক হইয়াছে। সর্বদা কলিকাতায় চিঠিপত্র লিখিবে। বৎস, এ পর্যন্ত তুমি সাহস দেখাইয়া আপনাকে গৌরবমণ্ডিত করিয়াছ। জি. জি-ও বড়ই অদ্ভুত ও সুন্দর কার্য করিয়াছে। হে আমার সাহসী নিঃস্বার্থ সন্তানগণ, তোমরা সকলেই বড় সুন্দর কার্য করিয়াছ। আমি তোমাদের কথা স্মরণ করিয়া বড়ই গৌরব অনুভব করিতেছি। ভারত তোমাদের লইয়া গৌরব অনুভব করিতেছে। তোমাদের যে খবরের কাগজ বাহির করিবার সঙ্কল্প ছিল, তাহা ছাড়িও না। খেতড়ির রাজা ও কাঠিয়াওয়াড়স্থ লিমডির ঠাকুর সাহেব—যাহাতে আমার কার্যের বিষয় সর্বদা সংবাদ পান, তাহা করিবে। আমি মান্দ্রাজ অভিনন্দনের একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর লিখিতেছি। যদি সস্তায় হয়, এখান হইতেই ছাপাইয়া পাঠাইয়া দিব, নতুবা টাইপ করিয়া পাঠাইয়া দিব। ভরসায় বুক বাঁধ—নিরাশ হইও না। এরূপ সুন্দরভাবে কার্য সম্পন্ন হওয়ার পর যদি আবার তোমার নৈরাশ্য আসে, তাহা হইলে তুমি মূর্খ। আমাদের কার্যের আরম্ভ যেরূপ সুন্দর হইয়াছে, আর কোন কার্যের আরম্ভ সেরূপ দেখা যায় না; আমাদের কার্য ভারতে ও তাহার বাহিরে যেরূপ দ্রুত বিস্তৃত হইয়াছে, এ পর্যন্ত ভারতে আর কোন আন্দোলন সেরূপ হয় নাই।
আমি ভারতের বাহিরে কোনরূপ প্রণালীবদ্ধ কার্য বা সভাসমিতি করিতে ইচ্ছা করি না। ঐরূপ করিবার কোন উপকারিতা বুঝি না। ভারতই আমাদের কার্যক্ষেত্র, আর বিদেশে আমাদের কার্য সমাদৃত হওয়ার এইটুকু মূল্য যে, উহাতে ভারত জাগিবে; এই পর্যন্ত। আমেরিকার ব্যাপারে ভারতে আমাদের কার্য করিবার অধিকার ও সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে। এখন ভাববিস্তারের জন্য আমাদের দৃঢ় ভিত্তির প্রয়োজন। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা—এখন এই দুইটি কেন্দ্র হইয়াছে। অতি শীঘ্রই ভারতে আরও শত শত কেন্দ্র হইবে।
যদি পার তবে সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র উভয়ই বাহির কর। আমার যে-সকল ভ্রাতা চারিদিকে ঘুরিতেছেন, তাঁহারা গ্রাহক সংগ্রহ করিবেন; আমিও অনেক গ্রাহক যোগাড় করিব এবং মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু টাকা পাঠাইব। মুহূর্তের জন্যও বিচলিত হইও না, সব ঠিক হইয়া যাইবে।
আপনার গাঁটের ব্যথা এখন প্রায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছে জেনে খুব সুখী হলাম। দয়া করে আপনার ভাইকে আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য মাপ করতে বলবেন। আমি এখানে কিছু সংস্কৃত বই পেয়েছি এবং অধ্যায়নের সাহায্যও জুটেছে। অন্যত্র এরূপ পাবার আশা নাই; সুতরাং শেষ করে যাবার আগ্রহ হয়েছে। কাল আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মনঃসুখারামের সঙ্গে দেখা হল; তিনি তাঁর এক সন্ন্যাসী বন্ধুকে বাড়ীতে রেখেছেন। তিনি আমার প্রতি খুব সহৃদয়; তাঁর পুত্রও তাই।
ইচ্ছাশক্তিই জগৎকে পরিচালিত করিয়া থাকে। হে বৎস, যুবকগণ খ্রীষ্টান হইয়া যাইতেছে বলিয়া দুঃখিত হইও না। আমাদের নিজেদের দোষেই ইহা ঘটিতেছে।
এইমাত্র রাশীকৃত সংবাদপত্র ও পরমহংসদেবের জীবনী আসিল—আমি সমুদয় পড়িয়া তারপর আবার কলম ধরিতেছি। আমাদের সমাজে, বিশেষতঃ মান্দ্রাজে এখন যে প্রকার অযথা নিয়ম ও আচারবন্ধন রহিয়াছে, তাহাতে তাহারা ঐরূপ না হইয়াই বা করে কি? উন্নতির জন্য প্রথম চাই স্বাধীনতা। তোমাদের পূর্বপুরুষেরা আত্মার স্বাধীনতা দিয়াছিলেন, তাই (এদেশে) ধর্মের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও বিকাশ হইয়াছে। কিন্তু তাঁহারা দেহকে যতপ্রকার বন্ধনের মধ্যে ফেলিলেন, কাজে কাজেই সমাজের বিকাশ হইল না। পাশ্চাত্য দেশে ঠিক ইহার বিপরীত—সমাজে যথেষ্ট স্বাধীনতা, ধর্মে কিছুমাত্র নাই। ইহার ফলে তথায় ধর্ম নিতান্ত অপরিণত এবং সমাজ সুন্দর উন্নত হইয়া গড়িয়া উঠিয়াছে। এক্ষণে প্রাচ্যদেশীয় সমাজের চরণ হইতে বন্ধন-শৃঙ্খল ক্রমশঃ দূর হইতেছে, পাশ্চাত্যে ধর্মেরও ঠিক তাহাই হইতেছে। তোমাদিগকে অপেক্ষা করিতে হইবে এবং সহিষ্ণুতার সহিত কাজ করিয়া যাইতে হইবে।
প্রত্যেকের আদর্শ ভিন্ন ভিন্ন। ভারতের আদর্শ ধর্মমুখী বা অন্তর্মুখী, পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক বা বহির্মুখী। পাশ্চাত্য এতটুকু আধ্যাত্মিক উন্নতিও সমাজের উন্নতির ভিতর দিয়া করিতে চায়, আর প্রাচ্য এতটুকু সামাজিক শক্তিও আধ্যাত্মিকতার মধ্য দিয়া লাভ করিতে চায়।
এই জন্য আধুনিক সংস্কারকগণ প্রথমেই ভারতের ধর্মকে নষ্ট না করিয়া সংস্কারের আর কোন উপায় দেখিতে পান না। তাঁহারা উহার চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু বিফলমনোরথ হইয়াছেন। ইহার কারণ কি? কারণ—তাঁহাদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই তাঁহাদের নিজের ধর্ম উত্তমরূপে অধ্যয়ন ও আলোচনা করিয়াছেন; আর তাঁহাদের একজনও ‘সকল ধর্মের প্রসূতি’কে বুঝিবার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, সেই সাধনার মধ্য দিয়া যান নাই! ঈশ্বরেচ্ছায় আমি এই সমস্যার মীমাংসা করিয়াছি বলিয়া দাবী করি। আমি দৃঢ়ভাবে বলিতেছি, হিন্দুসমাজের উন্নতির জন্য ধর্মকে নষ্ট করিবার কোন প্রয়োজন নাই এবং ধর্মের জন্যই যে সমাজের এই অবস্থা তাহা নহে, বরং ধর্মকে সামাজিক ব্যাপারে যেভাবে কাজে লাগান উচিত, তাহা হয় নাই বলিয়াই সমাজের এই অবস্থা। আমি আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ হইতে ইহার প্রত্যেকটি কথা প্রমাণ করিতে প্রস্তুত। আমি ইহাই শিক্ষা দিতেছি, আর আমাদিগকে ইহা কার্যে পরিণত করিবার জন্য সারা জীবন চেষ্টা করিয়া যাইতে হইবে। কিন্তু ইহাতে সময় লাগিবে—অনেক সময় ও দীর্ঘকালব্যাপী আলোচনার প্রয়োজন। সহিষ্ণুতা অবলম্বন কর এবং কাজ করিয়া যাও। ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’।
আমি তোমাদের অভিনন্দনের উত্তর দিবার জন্য ব্যস্ত আছি। ইহা ছাপাইবার বিশেষ চেষ্টা করিবে। তা যদি সম্ভবপর না হয়, খানিকটা খানিকটা করিয়া ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ ও অন্যান্য কাগজে ছাপাইবে।
তোমাদেরই
বিবেকানন্দ
পুঃ—বর্তমান হিন্দুসমাজ কেবল আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন মানুষের জন্য গঠিত এবং অন্য সকলকেই নির্দয়ভাবে পিষিয়া ফেলে। কেন? যাহারা সাংসারিক অসার বিষয়—যথা রূপরসাদি—একটু আধটু সম্ভোগ করিতে চায়, তাহারা কোথা যাইবে? তোমাদের ধর্ম যেমন উত্তম মধ্যম ও অধম—সকল প্রকার অধিকারীকেই গ্রহণ করিয়া থাকে, তোমাদের সমাজেরও তেমনি উচিত উচ্চ-নীচভাবাপন্ন সকলকে গ্রহণ করা। ইহার উপায়—প্রথমে তোমাদিগকে ধর্মের প্রকৃত তত্ত্ব বুঝিতে হইবে, পরে সামাজিক বিষয়ে উহা লাগাইতে হইবে। ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে এই কাজ করিতে হইবে। ইতি—
বি
১২২*
[হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
চিকাগো
সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
অনেক দিন হইল আপনার অনুগ্রহ-পত্র পাইয়াছি, কিন্তু লিখিবার মত কিছুই ছিল না বলিয়া উত্তর দিতে দেরী করিলাম। মিঃ হেল-এর নিকট লিখিত আপনার চিঠি খুবই সন্তোষজনক হইয়াছে, কারণ উহাদের নিকট আমার ঐটুকুই দেনা ছিল। আমি এ সময়টা এদেশের সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইতেছি এবং সব কিছু দেখিতেছি, এবং তাহার ফলে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে একটি মাত্র দেশ আছে, যেখানে মানুষ ধর্ম কি বস্তু তাহা বোঝে—সে দেশ হইল ভারতবর্ষ। হিন্দুদিগের সকল দোষত্রুটি সত্ত্বেও তাহারা নৈতিক চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতায় অন্যান্য জাতি অপেক্ষা বহু ঊর্ধ্বে; আর তাহার নিঃস্বার্থ সন্তানগণের যথাযোগ্য যত্ন চেষ্টা ও উদ্যমের দ্বারা পাশ্চাত্যের কর্মৈষণা ও তেজস্বিতার কিছু উপাদান হিন্দুদের শান্ত গুণাবলীর সহিত মিলিত করিলে—এ যাবৎ পৃথিবীতে যত প্রকার মানুষ দেখা গিয়াছে, তদপেক্ষা অনেক উৎকৃষ্ট ধরনের মানুষ আবির্ভূত হইবে।
কবে ভারতবর্ষে ফিরিতে পারিব, বলিতে পারি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এদেশের যথেষ্ট আমি দেখিয়াছি, সুতরাং শীঘ্রই ইওরোপ রওনা হইতেছি—তারপর ভারতবর্ষ।
আপনার ও আপনার ভ্রাতৃমণ্ডলীর প্রতি আমার ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিতেছি। ইতি—
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
১২৩*
[মঠের সকলকে লক্ষ্য করিয়া স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
বাল্টিমোর, আমেরিকা
২২ অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রেমাস্পদেষু,
তোমার১৬ পত্রপাঠে সকল সমাচার অবগত হইলাম। শ্রীমান অক্ষয়কুমার ঘোষের এক পত্র লণ্ডন নগর হইতে অদ্য পাইলাম, তাহাতেও অনেক বিষয় জ্ঞাত হইলাম।
তোমাদের Address from the Town Hall meeting (টাউন হলের সভা হইতে অভিনন্দন) এস্থানের খবরের কাগজে বাহির হইয়া গিয়াছে। একেবারে Telegraph (টেলিগ্রাফ) করিবার আবশ্যক ছিল না। যাহা হউক, সকল কার্য কুশলে সম্পন্ন হইয়া গিয়াছে—এই পরম মঙ্গল। এ-সকল মিটিং ও Address-এর (অভিনন্দনের) প্রধান উদ্দেশ্য এদেশের জন্য নহে, কিন্তু ভারতবর্ষের জন্য। এক্ষণে তোমরা নিজেদের শক্তির পরিচয় পাইলে—Strike the iron while it is hot.১৭ মহাশক্তিতে কার্যক্ষেত্রে অবতরণ কর। কুঁড়েমির কাজ নয়। ঈর্ষা অহমিকাভাব গঙ্গার জলে জন্মের মত বিসর্জন দাও ও মহাবলে কাজে লাগিয়া যাও। বাকী প্রভু সব পথ দেখাইয়া দিবেন। মহা বন্যায় সমস্ত পৃথিবী ভাসিয়া যাইবে। মাষ্টার মহাশয় ও G. C. Ghosh (গিরিশচন্দ্র ঘোষ) প্রভৃতির দুই বৃহৎ পত্র পাইলাম। তাঁহাদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। But work, work, work (কিন্তু কাজ কর, কাজ কর, কাজ কর)—এই মূলমন্ত্র। আমি আর কিছু দেখিতে পাইতেছি না। এদেশে কার্যের বিরাম নাই—সমস্ত দেশ দাবড়ে বেড়াচ্ছি। যেখানে তাঁর তেজের বীজ পড়িবে, সেইখানেই ফল ফলিবে—অদ্য বা শতাব্দান্তে বা। কারুর সঙ্গেই বিবাদে আবশ্যক নাই। সকলের সঙ্গে সহানুভূতি করিয়া কার্য করিতে হইবে। তবে আশু ফল হইবে।
মীরাটের যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যায় এক পত্র লিখিয়াছেন। তোমাদের দ্বারা যদি তাঁহার কোন সহায়তা হয়, করিবে। জগতের হিত করা আমাদের উদ্দেশ্য, আপনাদের নাম বাজান উদ্দেশ্য নহে। যোগেন ও বাবুরাম বোধ হয় এত দিনে বেশ সারিয়া গিয়াছে। নিরঞ্জন বোধ হয় Ceylon (সিংহল) হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে। সে Ceylon (সিংহল)-এ পালি ভাষা শিক্ষা কেন না করে এবং বৌদ্ধগ্রন্থ অধ্যয়ন কেন না করে, তাহা তো বুঝিতে পারি না। অনর্থক ভ্রমণে কি ফল? এবারকার উৎসব এমন করিবে যে, ভারতে পূর্বে আর হয় নাই। এখন হইতেই তাহার উদ্যোগ কর এবং উক্ত উৎসবের মধ্যে অনেকেই হয়তো কিছু কিছু সহায়তা করিলে আমাদের একটা স্থান হইয়া যাইবে। সকল বড়লোকের কাছে যাতায়াত করিবে। আমি যে-সকল চিঠিপত্র লিখি বা আমার সম্বন্ধে যাহা খবরের কাগজে পাও, তাহা সমস্ত না ছাপাইয়া যাহা বিবাদশূন্য এবং রাজনীতি সম্বন্ধে নহে, তন্মাত্র ছাপাইবে।
পূর্বের পত্রে লিখিয়াছি যে, তোমরা মা-ঠাকুরাণীর জন্য একটা জায়গা স্থির করিয়া আমাকে পত্র লিখিবে। যত শীঘ্র পার। Businessman (কাজের লোক) হওয়া চাই, অন্ততঃ এক জনের। গোপালের এবং সাণ্ডেলের দেনা এখনও আছে কিনা এবং কত দেনা লিখিবে।
তাঁহার যাহারা শরণাগত, তাহাদের ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ পদতলে, মাভৈঃ মাভৈঃ। সকল হইবে ধীরে ধীরে। তোমাদের নিকট এই চাই—হামবড়া বা দলাদলি বা ঈর্ষা একেবারে জন্মের মত বিদায় করিতে হইবে। পৃথিবীর ন্যায় সর্বংসহ হইতে হইবে; এইটি যদি পার, দুনিয়া তোমাদের পায়ের তলায় আসিবে।
এবারকার জন্মোৎসবে বোধ হয় আমি যোগদান করিতে পারিব। আমি পারি বা না পারি, এখন হইতে তার সূত্রপাত করিলে তবে মহা উৎসব হইতে পারিবে। অধিক লোক একত্র হইলে খিচুড়ি প্রভৃতি বসাইয়া খাওয়ান বড়ই অসম্ভব ও খাওয়া দাওয়া করিতেই দিন যায়। এজন্য যদি অধিক লোক হয়, তাহা হইলে দাঁড়া-প্রসাদ, অর্থাৎ একটা সরাতে লুচি প্রভৃতি হাতে হাতে দিলেই যথেষ্ট হইবে। মহোৎসবাদিতে পেটের খাওয়া কম করিয়া মস্তিষ্কের খাওয়া কিছু দিতে চেষ্টা করিবে। যদি ২০ হাজার লোকে চারি আনা করিয়া দেয় তো ৫ হাজার টাকা উঠিয়া যায়। পরমহংসদেবের জীবন এবং তাঁহার শিক্ষা এবং অন্যান্য শাস্ত্র হইতে উপদেশ করিবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাঙলার গ্রামে গ্রামে প্রায় হরিসভা আছে। ঐগুলিকে ধীরে ধীরে লইতে হইবে—বুঝিতে পার কিনা? সর্বদা আমাকে পত্র লিখিবে। অধিক newspaper cutting (খবরের কাগজের অংশ) পাঠাইবার আবশ্যক নাই—অনেক হইয়াছে। ইতি—
বিবেকানন্দ
১২৪*
ওয়াশিংটন
২৩ অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রিয় বিহিমিয়া চাঁদ,
আমি এদেশে বেশ ভাল আছি। এতদিনে আমি ইহাদের নিজেদের ধর্মাচার্যগণের মধ্যে একজন হইয়া দাঁড়াইয়াছি। ইহারা সকলে আমাকে এবং আমার উপদেশ পছন্দ করে। সম্ভবতঃ আমি আগামী শীতে ভারতে ফিরিব। আপনি বোম্বাইয়ে মিঃ গান্ধীকে জানেন কি? তিনি এখনও চিকাগোতেই আছেন। ভারতে যেমন আমার অভ্যাস ছিল, এখানেও সেইরূপ আমি সমস্ত দেশের ভিতর ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছি। প্রভেদ এইটুকু যে, এখানে উপদেশ দিয়া, প্রচার করিয়া বেড়াইতেছি। সহস্র সহস্র ব্যক্তি খুব আগ্রহ ও যত্নের সহিত আমার কথা শুনিয়াছে। এদেশে থাকা খুব ব্যয়সাধ্য, কিন্তু প্রভু সর্বত্রই যোগাড় করিয়া দিতেছেন।
ওখানে (লিমডি, রাজপুতানায়) আমার সমস্ত বন্ধুদের ও আপনাকে ভালবাসা জানাইতেছি। ইতি
বিবেকানন্দ
১২৫*
[মিসেস হেলকে লিখিত]
১১২৫ সেণ্ট পল ষ্ট্রীট
বাল্টিমোর
অক্টোবর, ১৮৯৪
মা,
দেখুন, আমি কোথায় এসে পড়েছি। ‘চিকাগো ট্রিবিউনে’ ভারতের একটি টেলিগ্রাফ লক্ষ্য করেছেন কি? এখান থেকে যাব ওয়াশিংটন; সেখান থেকে ফিলাডেলফিয়া। তারপর নিউ ইয়র্ক। ফিলাডেলফিয়ায় আমাকে মিস মেরীর ঠিকানা পাঠাবেন। নিউ ইয়র্ক যাবার পথে তার সঙ্গে দেখা করে যাব। আশা করি এতদিনে আপনি নিরুদ্বেগ হয়েছেন।
আপনার স্নেহের
বিবেকানন্দ
১২৬*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১৭০৩ ফার্ষ্ট ষ্ট্রীট
ওয়াশিংটন
প্রিয় ভগিনী,
তুমি অনুগ্রহ করে যে পত্র দুখানি লিখেছিলে সেগুলি পেয়েছি। আজ এখানে, কাল বাল্টিমোরে আমার বক্তৃতা হবে; পুনরায় সোমবার বাল্টিমোরে ও মঙ্গলবার এখানে। তার দিন কয়েক পরে যাচ্ছি ফিলাডেলফিয়া। ওয়াশিংটন থেকে যাবার দিন তোমাকে পত্র দেব। অধ্যাপক রাইটের সঙ্গে দেখা করবার জন্যই ফিলাডেলফিয়ায় মাত্র দিনকয়েক থাকব। ওখান থেকে নিউ ইয়র্ক। বার কয়েক নিউ ইয়র্ক—বোষ্টন দৌড়াদৌড়ি করে ডেট্রয়েট হয়ে চিকাগোয় যাব। তারপর প্রবীণ (Senator) পামার যেমন বলেন—‘সাঁ করে ইংলণ্ডে।’
‘ধর্মে’র ইংরেজী প্রতিশব্দ ‘রিলিজন্’। কলিকাতাবাসিগণ পেট্রোর প্রতি রূঢ় ব্যবহার করায় আমি খুব দুঃখিত। আমি এখানে বেশ সদ্ব্যবহার পেয়েছি, কাজও চমৎকার হচ্ছে। ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। কেবল ভারত থেকে বোঝা বোঝা সংবাদপত্র আসায় বিরক্ত হয়েছিলাম। ‘মাদার চার্চ’ ও মিসেস গার্নসিকে সেগুলি গাড়ী বোঝাই করে পাঠিয়ে দিয়ে ভারতে ওদের নিষেধ করে দিলাম, আর যেন সংবাদপত্র না পাঠায়। ভারতে খুব হইচই পড়ে গিয়েছে। আলাসিঙ্গা লিখেছে, দেশ জুড়ে গ্রামে গ্রামে আমার নাম রটেছে। ফলে পূর্বেকার যে শান্তি আর রইল না; এর পর আর কোথাও বিশ্রাম বা অবসর পাওয়া কঠিন। ভারতের এই সংবাদপত্রগুলি আমাকে শেষ না করে ছাড়বে না দেখছি। কবে কি খেয়েছি, কখন হেঁচেছি—সব কিছু ছাপাবে। অবশ্য বোকামি আমারই। প্রকৃতপক্ষে এখানে এসেছিলাম নিঃশব্দে কিছু অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে; কিন্তু ফাঁদে পড়ে গেছি, আর এখন চুপচাপ থাকতে পাব না। সকলে আনন্দে থাক।
তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ
১২৭*
[ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
১৭০৮ ডব্লিউ, ১ ষ্ট্রীট, ওয়াশিংটন
২৬ (?) অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
আমার দীর্ঘ নীরবতার জন্য ক্ষমা করো। ‘মাদার চার্চ’কে কিন্তু আমি নিয়মিত চিঠি লিখে যাচ্ছি। তোমরা সকলে নিশ্চয়ই সুন্দর শীতল আবহাওয়া উপভোগ করছ। আমিও বাল্টিমোর ও ওয়াশিংটনকে খুব উপভোগ করছি। এখান থেকে ফিলাডেলফিয়া যাব। আমার ধারণা ছিল মিস মেরী ফিলাডেলফিয়ায় আছে; সুতরাং আমি তার ঠিকানা চেয়েছিলাম। কিন্তু সে ফিলাডেলফিয়ার কাছাকাছি অন্য কোন জায়গায় আছে। তাই মাদার চার্চের কথামত সে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কষ্ট স্বীকার করুক, এ আমি চাই না।
যে মহিলাটির কাছে আমি আছি, তাঁর নাম মিস টটন, মিস হাউ-এর এক ভাইঝি। এখন এক সপ্তাহ তাঁর অতিথি হয়ে থাকব। সুতরাং তুমি তাঁর ঠিকানায় চিঠি লিখতে পার।
এই শীতে জানুআরী-ফেব্রুআরীর কোন এক সময়ে আমার ইংলণ্ডে যাবার ইচ্ছা। লণ্ডনের এক মহিলার কাছে আমার এক বন্ধু আছেন। মহিলাটি তাঁর আতিথ্যগ্রহণের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ওদিকে ফিরে যাবার জন্য ভারত থেকে প্রতিদিন তাগিদ দিচ্ছে।
কার্টুনে পিটুকে কেমন লাগল? কাউকে কিন্তু দেখিও না। পিটুকে নিয়ে এইভাবে তামাশা করা কিন্তু আমাদের দেশের লোকের অন্যায়। তোমার কাছ থেকে চিঠি পেতে সব সময় আমার কত না আগ্রহ; দয়া করে যদি লেখাকে আর একটু স্পষ্ট করার পরিশ্রম করো। দোহাই, এই প্রস্তাবে চটে যেও না যেন।
তোমার সদা স্নেহময় ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১২৮*
ওয়াশিংটন
২৭ অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনি অনুগ্রহ করে আমায় মিঃ ফ্রেডারিক ডগলাসের নামে যে পরিচয়পত্র দিয়েছেন, সেজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বাল্টিমোরে এক হোটেলওয়ালার নিকট আমি যে দুর্ব্যবহার পেয়েছি, সেজন্য আপনি দুঃখিত হবেন না। যেমন সর্বত্রই হয়েছে, এখানেও তেমনি—আমেরিকার নারীগণ আমাকে এই বিপদ হতে উদ্ধার করেছিলেন, তারপর আমি বেশ স্বচ্ছন্দে ছিলাম। এখানে মিসেস টটনের বাড়ীতে বাস করছি। ইনি আমার চিকাগোর জনৈক বন্ধুর ভ্রাতুষ্পুত্রী। সুতরাং সব দিকেই বেশ সুবিধা হচ্ছে। ইতি
বিবেকানন্দ
১২৯*
ওয়াশিংটন
২৭ অক্টোবর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমার শুভ আশীর্বাদ জানিবে। এতদিনে তুমি নিশ্চয়ই আমার অপর পত্রখানি পাইয়াছ। আমি কখনও কখনও তোমাদিগকে কড়া চিঠি লিখি, সেজন্য কিছু মনে করিও না। তোমাদিগের সকলকে আমি কতদূর ভালবাসি, তাহা তুমি ভালরূপই জান।
তুমি অনেকবার আমি কোথায় কোথায় ঘুরিতেছি, কি করিতেছি, তাহার সমুদয় বিবরণ ও আমার বক্তৃতাগুলির সংক্ষিপ্ত আভাস জানিতে চাহিয়াছ। মোটামুটি জানিয়া রাখ, ভারতেও যাহা করিতাম, এখানে ঠিক তাহাই করিতেছি। ভগবান্ যেখানে লইয়া যাইতেছেন, সেখানেই যাইতেছি—পূর্ব হইতে সঙ্কল্প করিয়া আমার কোন কার্য হয় না। আরও একটি বিষয় স্মরণ রাখিও, আমাকে অবিশ্রান্ত কার্য করিতে হয়, সুতরাং আমার চিন্তারাশি একত্র করিয়া পুস্তকাকারে গ্রথিত করিবার অবসর নাই। এত বেশী কাজ রাতদিন করিতে হইতেছে যে, আমার স্নায়ুগুলি দুর্বল হইয়া পড়িতেছে—আমি ইহা বেশ বুঝিতে পারিতেছি। ভারত হইতে যথেষ্ট কাগজপত্র আসিয়াছে, আর আবশ্যক নাই। তুমি এবং মান্দ্রাজের অন্যান্য বন্ধুগণ আমার জন্য যে নিঃস্বার্থভাবে কঠোর পরিশ্রম করিয়াছ, তাহার জন্য তোমাদের নিকট আমি যে কি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ, তাহা বলিতে পারি না। তবে ইহা জানিয়া রাখ, তোমরা যাহা করিয়াছ, তাহার উদ্দেশ্য আমার নাম বাজান নহে; তোমাদের শক্তি সম্বন্ধে তোমাদিগকে সজাগ করাই ইহার উদ্দেশ্য। সংগঠন-কার্যে আমি পটু নই; ধ্যানধারণা ও অধ্যয়নের উপরই আমার ঝোঁক। আমার মনে হয়, যথেষ্ট কাজ করিয়াছি—এখন একটু বিশ্রাম করিতে চাই। আমি এক্ষণে আমার গুরুদেবের নিকট হইতে যাহা পাইয়াছি, তাহাই লোককে একটু শিক্ষা দিব। তোমরা এখন জানিয়াছ, তোমরা কি করিতে পার। মান্দ্রাজের যুবকগণ, তোমরাই প্রকৃতপক্ষে সব করিয়াছ—আমি তো নামমাত্র নেতা! আমি সংসারত্যাগী (অনাসক্ত সন্ন্যাসী); আমি কেবল একটি জিনিষ চাই। যে ধর্ম বা যে ঈশ্বর বিধবার অশ্রুমোচন করিতে পারে না অথবা অনাথ শিশুর মুখে একমুঠো খাবার দিতে পারে না, আমি সে ধর্মে বা সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। যত উচ্চ মতবাদ হউক, যত সুবিন্যস্ত দার্শনিক তত্ত্বই উহাতে থাকুক, যতক্ষণ উহা মত বা পুস্তকেই আবদ্ধ, ততক্ষণ উহাকে আমি ‘ধর্ম’ নাম দিই না। চক্ষু আমাদের পৃষ্ঠের দিকে নয়, সামনের দিকে—অতএব সম্মুখে অগ্রসর হও, আর যে ধর্মকে তোমরা নিজের ধর্ম বলিয়া গৌরব কর, তাহার উপদেশগুলি কার্যে পরিণত কর—ঈশ্বর তোমাদিগের সাহায্য করুন।
আমার উপর নির্ভর করিও না, নিজেদের উপর নির্ভর করিতে শেখ। আমি যে সর্বসাধারণের ভিতর একটা উৎসাহ উদ্দীপিত করিবার উপলক্ষ হইয়াছি, ইহাতে আমি নিজেকে সুখী মনে করি। এই উৎসাহের সুযোগ লইয়া অগ্রসর হও—এই উৎসাহস্রোতে গা ঢালিয়া দাও, সব ঠিক হইয়া যাইবে।
হে বৎস, যথার্থ ভালবাসা কখনও বিফল হয় না। আজই হউক, কালই হউক, শত শত যুগ পরেই হউক, সত্যের জয় হইবেই, প্রেমের জয় হইবেই। তোমরা কি মানুষকে ভালবাস? ঈশ্বরের অন্বেষণে কোথায় যাইতেছ? দরিদ্র, দুঃখী, দুর্বল—সকলেই কি তোমার ঈশ্বর নহে? অগ্রে তাহাদের উপাসনা কর না কেন? গঙ্গাতীরে বাস করিয়া কূপ খনন করিতেছ কেন? প্রেমের সর্বশক্তিমত্তায় বিশ্বাস কর। নামযশের ফাঁকা চাকচিক্যে কি হইবে? খবরের কাগজে কি বলে না বলে, আমি সে দিকে লক্ষ্য করি না। তোমার হৃদয়ে প্রেম আছে তো? তবেই তুমি সর্বশক্তিমান্। তুমি সম্পূর্ণ নিষ্কাম তো? তাহাই যদি হও, তবে তোমার শক্তি কে রোধ করিতে পারে? চরিত্রবলে মানুষ সর্বত্রই জয়ী হয়। ঈশ্বরই তাঁহার সন্তানগণকে সমুদ্রগর্ভে রক্ষা করিয়া থাকেন! তোমাদের মাতৃভূমি বীর সন্তান চাহিতেছেন—তোমরা বীর হও। ঈশ্বর তোমাদিগকে আশীর্বাদ করুন। সকলেই আমাকে ভারতে আসিতে বলিতেছে। তাহারা মনে করে, আমি গেলে তাহারা বেশী কাজ করিতে পারিবে। বন্ধু, তাহারা ভুল বুঝিয়াছে। আজকাল যে উৎসাহ দেখা যাইতেছে, ইহা একটু স্বদেশহিতৈষণা মাত্র—ইহাতে কোন কাজ হইবে না। যদি উহা খাঁটি হয়, তবে দেখিবে অল্পকালের মধ্যেই শত শত বীর অগ্রসর হইয়া কার্যে লাগিয়া যাইবে। অতএব জানিয়া রাখ যে, তোমরাই সব করিয়াছ, ইহা জানিয়া আরও কার্য করিতে থাক, আমার দিকে তাকাইও না।
অক্ষয় এখন লণ্ডনে আছে—সে লণ্ডনে মিস মূলারের নিকট যাইবার জন্য আমাকে একখানি সুন্দর নিমন্ত্রণপত্র লিখিয়াছে। বোধ হয়, আগামী জানুআরী বা ফেব্রুআরীতে লণ্ডন যাইব। ভট্টাচার্য আমাকে ভারতে যাইতে লিখিতেছেন। এস্থান প্রচারের উপযুক্ত ক্ষেত্র। বিভিন্ন মতবাদ লইয়া কি করিব? আমি ভগবানের দাস। উচ্চ উচ্চ তত্ত্ব প্রচার করিবার উপযুক্ত ক্ষেত্র এদেশ অপেক্ষা আর কোথায় পাইব? এখানে যদি একজন আমার বিরুদ্ধে থাকে তো শত শত জন আমায় সাহায্য করিতে প্রস্তুত। এখানে মানুষ মানুষের জন্য ভাবে, নিজের ভ্রাতাদের জন্য কাঁদে, আর এখানকার মেয়েরা দেবীর মত। মূর্খদিগকেও যদি প্রশংসা করা যায়, তবে তাহারাও কার্যে অগ্রসর হয়। যদি সব দিকে সুবিধা হয়, তবে অতি কাপুরুষও বীরের ভাব ধারণ করে। কিন্তু প্রকৃত বীর নীরবে কার্য করিয়া চলিয়া যান। একজন বুদ্ধ জগতে প্রকাশিত হইবার পূর্বে কত শত বুদ্ধ নীরবে জীবন দিয়া গিয়াছেন!
প্রিয় বৎস আলাসিঙ্গা, আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি, মানুষকে বিশ্বাস করি; দুঃখী দরিদ্রকে সাহায্য করা, পরের সেবার জন্য নরকে যাইতে প্রস্তুত হওয়া—আমি খুব বড় কাজ বলিয়া বিশ্বাস করি। পাশ্চাত্যগণের কথা কি বলিব, তাহারা আমাকে খাইতে দিয়াছে, পরিতে দিয়াছে, আশ্রয় দিয়াছে, তাহারা আমার সহিত পরম বন্ধুর ন্যায় ব্যবহার করিয়াছে—খুব গোঁড়া খ্রীষ্টান পর্যন্ত। তাহাদের একজন পাদ্রী যদি ভারতে যায়, আমাদের দেশের লোক তাহার সহিত কিরূপ ব্যবহার করে? তোমরা তাহাদিগকে স্পর্শ পর্যন্ত কর না, তাহারা যে ম্লেচ্ছ!!! বৎস, কোন ব্যক্তি—কোন জাতিই অপরকে ঘৃণা করিলে জীবিত থাকিতে পারে না। যখনই ভারতবাসীরা ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দ আবিষ্কার করিল ও অপর জাতির সহিত সর্ববিধ সংস্রব পরিত্যাগ করিল, তখনই ভারতের অদৃষ্টে ঘোর সর্বনাশের সূত্রপাত হইল। তোমরা ভারতেতর দেশবাসীদের প্রতি উক্ত ভাবপোষণ সম্বন্ধে বিশেষ সাবধান হইও। বেদান্তের কথা ফস্ ফস্ মুখে আওড়ান খুব ভাল বটে, কিন্তু উহার একটি ক্ষুদ্র উপদেশও কার্যে পরিণত করা কি কঠিন!
আমি শীঘ্রই এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি, সুতরাং এখানে আর খবরের কাগজ পাঠাইবার প্রয়োজন নাই। প্রভু তোমাকে চিরদিনের জন্য আশীর্বাদ করুন।
তোমাদের চিরকল্যাণাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
পুঃ—দুইটি জিনিষ হইতে বিশেষ সাবধান থাকিবে—ক্ষমতাপ্রিয়তা ও ঈর্ষা। সর্বদা আত্মবিশ্বাস অভ্যাস করিতে চেষ্টা কর। ইতি
বি
১৩০*
[শ্রীযুক্ত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
চিকাগো
১৫ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার অনুগ্রহ লিপি পাইয়াছি। আপনি যে এখানেও আমাকে স্মরণ করিয়াছেন, তাহা আপনার সৌজন্যের নিদর্শন। আপনার বন্ধু নারায়ণ হেমচন্দ্রের সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। তিনি বর্তমানে আমেরিকায় নাই বলিয়াই আমার বিশ্বাস। আমি এখানে বহু চমকপ্রদ এবং অপূর্ব দৃশ্যাদি দেখিয়াছি।
আপনার ইওরোপে আসিবার বিশেষ সম্ভাবনা আছে জানিয়া সুখী হইলাম। যে প্রকারেই হউক এ সুযোগ অবশ্য গ্রহণ করিবেন। জগতের অন্যান্য জাতি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া থাকাই আমাদের অধঃপতনের হেতু এবং পুনর্বার সকলের সহিত একযোগে জগতের জীবনধারায় ফিরিয়া যাইতে পারিলেই সে অবস্থার প্রতিকার হইবে। গতিই তো জীবন। আমেরিকা একটি অদ্ভুত দেশ। দরিদ্র ও স্ত্রীজাতির পক্ষে এদেশ যেন স্বর্গের মত। এদেশে দরিদ্র একরূপ নাই বলিলেই চলে এবং অন্য কোথাও মেয়েরা এদেশের মেয়েদের মত স্বাধীন শিক্ষিত ও উন্নত নহে। সমাজে উহারাই সব।
ইহা এক অপূর্ব শিক্ষা। সন্ন্যাসজীবনের কোন ধর্ম—এমন কি দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি জিনিষগুলি পর্যন্ত আমাকে পরিবর্তিত করিতে হয় নাই, অথচ এই অতিথিবৎসল দেশে প্রত্যেকটি গৃহদ্বারই আমার জন্য উন্মুক্ত। যে প্রভু ভারতবর্ষে আমাকে পরিচালিত করিয়াছেন, তিনি কি আর এখানে আমাকে পরিচালিত করিবেন না? তিনি তো করিতেছেনই! একজন সন্ন্যাসীর এদেশে আসিবার কী প্রয়োজন ছিল, আপনি হয়তো তাহা বুঝিতে পারেন না, কিন্তু ইহার প্রয়োজন ছিল। জগতের নিকট আপনাদের পরিচয়ের একমাত্র দাবী—ধর্ম, এবং সেই ধর্মের পতাকাবাহী যথার্থ খাঁটি লোক ভারতের বাহিরে প্রেরণ করিতে হইবে, আর তাহা হইলেই ভারতবর্ষ যে আজও বাঁচিয়া আছে, এ কথা জগতের অন্যান্য জাতি বুঝিতে পারিবে।
বস্তুতঃ যথার্থ প্রতিনিধিস্থানীয় কিছু লোকের এখন ভারতের বাহিরে জগতের অন্যান্য দেশে যাইয়া ইহা প্রতিষ্ঠা করা উচিত যে, ভারতবাসীরা বর্বর কিম্বা অসভ্য নহে। ঘরে বসিয়া হয়তো আপনারা ইহার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করিতে পারিবেন না, কিন্তু আপনাদের জাতীয় জীবনের জন্য ইহার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে—আমার এ-কথা বিশ্বাস করুন।
যে সন্ন্যাসীর অন্তরে অপরের কল্যাণ-সাধন-স্পৃহা বর্তমান নাই, সে সন্ন্যাসীই নহে—সে তো পশুমাত্র!
আমি অলস পর্যটক নহি, কিম্বা দৃশ্য দেখিয়া বেড়ানও আমার পেশা নহে। যদি বাঁচিয়া থাকেন, তবে আমার কার্যকলাপ দেখিতে পাইবেন এবং আজীবন আমাকে আশীর্বাদ করিবেন।
দ্বিবেদী মহাশয়ের প্রবন্ধ ধর্মমহাসভার পক্ষে অত্যন্ত দীর্ঘ হওয়ায় উহাকে কাটিয়া ছাঁটিয়া ছোট করিতে হইয়াছিল। ধর্মমহাসভায় আমি কিছু বলিয়াছিলাম এবং তাহা কতটা ফলপ্রসূ হইয়াছিল তাহার নিদর্শনস্বরূপ আমার হাতের কাছে যে দু-চারিটি দৈনিক ও মাসিক পত্রিকা পড়িয়া আছে, তাহা হইতেই কিছু কিছু কাটিয়া পাঠাইতেছি। নিজের ঢাক নিজে পিটান আমার উদ্দেশ্য নহে, কিন্তু আপনি আমাকে স্নেহ করেন, সেই সূত্রে আপনার নিকট বিশ্বাস করিয়া আমি এ-কথা অবশ্য বলিব যে, ইতোপূর্বে কোন হিন্দু এদেশে এরূপ প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই এবং আমার আমেরিকা আগমনে যদি অন্য কোন কাজ নাও হইয়া থাকে, আমেরিকাবাসিগণ অন্ততঃ এটুকু উপলব্ধি করিয়াছে যে, আজও ভারতবর্ষে এমন মানুষের আবির্ভাব হইয়া থাকে, যাঁহাদের পাদমূলে বসিয়া জগতের সর্বাপেক্ষা সভ্য জাতিও ধর্ম এবং নীতি শিক্ষা লাভ করিতে পারে। আর হিন্দুজাতি যে একজন সন্ন্যাসীকে প্রতিনিধিরূপে এদেশে প্রেরণ করিয়াছিল, তাহার সার্থকতা উহাতেই যথেষ্টরূপে সাধিত হইয়াছে বলিয়া কি আপনার মনে হয় না? বিস্তারিত বিবরণ বীরচাঁদ গান্ধীর নিকট অবগত হইবেন।
কয়েকটি পত্রিকা হইতে অংশবিশেষ আমি নিয়ে উদ্ধৃত করিতেছিঃ
‘সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার অনেকগুলিই বিশেষ বাগ্মিতাপূর্ণ হইয়াছিল সত্য, কিন্তু হিন্দু সন্ন্যাসী ধর্মমহাসভার মূল নীতি ও উহার সীমাবদ্ধতা যেরূপ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন, অন্য কেহই তাহা করিতে পারে নাই। তাঁহার বক্তৃতার সবটুকু আমি উদ্ধৃত করিতেছি এবং শ্রোতৃবৃন্দের উপর উহার প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলিতে পারি যে, দৈবশক্তিসম্পন্ন বক্তা তিনি এবং তাঁহার অকপট উক্তিসমূহ যে মধুর ভাষার মধ্য দিয়া তিনি প্রকাশ করেন, তাহা তদীয় গৈরিক বসন এবং বুদ্ধিদীপ্ত দৃঢ় মুখমণ্ডল অপেক্ষা কম আকর্ষণীয় নয়।’— (নিউ ইয়র্ক ক্রিটিক)
ঐ পৃষ্ঠাতেই পুনর্বার লিখিত আছেঃ
‘তাঁহার শিক্ষা, বাগ্মিতা এবং মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব আমাদের সম্মুখে হিন্দু সভ্যতার এক নূতন ধারা উন্মুক্ত করিয়াছে। তাঁহার প্রতিভাদীপ্ত মুখমণ্ডল, গম্ভীর ও সুললিত কণ্ঠস্বর স্বতই মানুষকে তাঁহার দিকে আকৃষ্ট করে এবং ঐ বিধিদত্ত সম্পদসহায়ে এদেশের বহু ক্লাব ও গীর্জায় প্রচারের ফলে আজ আমরা তাঁর মতবাদের সহিত পরিচিত হইয়াছি। কোন প্রকার নোট প্রস্তুত করিয়া তিনি বক্তৃতা করেন না। কিন্তু নিজ বক্তব্য বিষয়গুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করিয়া অপূর্ব কৌশল ও ঐকান্তিকতা সহকারে তিনি মীমাংসায় উপনীত হন এবং অন্তরের গভীর প্রেরণা তাঁহার বাগ্মিতাকে অপূর্বভাবে সার্থক করিয়া তোলে।’
‘ধর্মমহাসভায় বিবেকানন্দই অবিসংবাদিরূপে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। তাঁহার বক্তৃতা শুনিয়া আমরা বুঝিতেছি যে, এই শিক্ষিত জাতির মধ্যে ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করা কত নির্বুদ্ধিতার কাজ।’—(হের্যাল্ড, এখানকার শ্রেষ্ঠ কাগজ)
আর অধিক উদ্ধৃত করিলাম না, পাছে আমায় দাম্ভিক বলিয়া মনে করেন। কিন্তু আপনাদের বর্তমান অবস্থা প্রায় কূপমণ্ডূকের মত হইয়াছে বলিয়া এবং বহির্জগতে কোথায় কি ঘটিতেছে, তাহার দিকে দৃষ্টি দিবার মত অবস্থা আপনাদের নাই দেখিয়া এটুকু লেখা প্রয়োজন বোধ করিয়াছি। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে আপনার কথা বলিতেছি না—আপনাকে মহাপ্রাণ বলিয়া জানি, কিন্তু জাতির সর্বসাধারণের পক্ষে আমার উক্তি প্রযোজ্য।
আমি ভারতবর্ষে যেমন ছিলাম এখানেও ঠিক তেমনি আছি, কেবল এই বিশেষ উন্নত ও মার্জিত দেশে যথেষ্ট সমাদর ও সহানুভূতি লাভ করিতেছি—যাহা আমাদের দেশের নির্বোধগণ স্বপ্নেও চিন্তা করিতে পারে না। আমাদের দেশে সাধুকে এক টুকরা রুটি দিতেও সবাই কুণ্ঠিত হয় আর এখানে একটি বক্তৃতার জন্য এক হাজার টাকা দিতেও সকলে প্রস্তুত; এবং যে উপদেশ ইহারা লাভ করিল, তাহার জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকে।
এই অপরিচিত দেশের নরনারী আমাকে যতটুকু বুঝিতে পারিতেছে, ভারতবর্ষে কেহ কখনও ততটুকু বোঝে নাই। আমি ইচ্ছা করিলে এখন এখানে পরম আরামের মধ্যে জীবন কাটাতেই পারি, কিন্তু আমি সন্ন্যাসী এবং সমস্ত দোষত্রুটি সত্ত্বেও ভারতবর্ষকে ভালবাসি। অতএব দু-চারি মাস পরেই দেশে ফিরিতেছি এবং যাহারা কৃতজ্ঞতার ধারও ধারে না, তাহাদের মধ্যে পূর্বের মত নগরে নগরে ধর্ম ও উন্নতির বীজ বপন করিতে থাকিব।
আমেরিকার জনসাধারণ ভিন্নধর্মাবলম্বী হইয়াও আমার প্রতি যে সহায়তা সহানুভূতি শ্রদ্ধা ও আনুকূল্য দেখাইয়াছে, তাহার সহিত আমার নিজ দেশের স্বার্থপরতা অকৃতজ্ঞতা ও ভিক্ষুক-মনোবৃত্তির তুলনা করিয়া আমি লজ্জা অনুভব করি এবং সেই জন্যই আপনাকে বলি যে, দেশের বাহিরে আসিয়া অন্যান্য দেশ দেখুন এবং নিজ অবস্থার সহিত তুলনা করুন।
এখন, এই-সকল উদ্ধৃত অংশ পাঠ করিবার পর, ভারতবর্ষ হইতে একজন সন্ন্যাসী এদেশে প্রেরণ করা সমীচীন হইয়াছে বলিয়া আপনার মনে হয় কি?
অনুগ্রহপূর্বক এই চিঠি প্রকাশ করিবেন না। ভারতবর্ষে থাকিতেও যেমন, এখানেও ঠিক তেমনি—অপকৌশল দ্বারা নাম করাকে আমি ঘৃণা করি।
আমি প্রভুর কার্য করিয়া যাইতেছি এবং তিনি যেথায় লইয়া যাইবেন সেখানেই যাইব। ‘মূকং করোতি বাচালং’ ইত্যাদি—যাঁহার কৃপা মূককে বাচাল করে, পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করায়, তিনিই আমাকে সাহায্য করিবেন। আমি মানুষের সাহায্যের অপেক্ষা রাখি না। যদি প্রভুর ইচ্ছা হয়, তবে ভারতবর্ষে কিম্বা আমেরিকায় কিম্বা উত্তর মেরুতে সর্বত্র তিনিই আমাকে সাহায্য করিবেন। আর যদি তিনি সাহায্য না করেন, তবে অন্য কেহই করিতে পারিবে না। চিরকাল প্রভুর জয় হউক। ইতি
আশীর্বাদক
আপনাদের বিবেকানন্দ
১৩১*
৫৪১, ডিয়ারর্বন এভিনিউ, চিকাগো
নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী,
আপনার পত্র পাইয়া বিশেষ প্রীতিলাভ করিয়াছি। পরিহাস আমি ঠিকই বুঝিতে পারি, কিন্তু আমি ক্ষুদ্র শিশুটি নই যে, উহাতেই নিরস্ত হইব।
সংগঠন ও সংযোগশক্তিই পাশ্চাত্য জাতিগুলির সাফল্যের হেতু; আর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, সহযোগিতা ও সহায়তা দ্বারাই ইহা সম্ভব হইয়া থাকে। ... জৈনধর্মাবলন্বী বীরচাঁদ গান্ধীর কথাই ধরুন, তাঁহাকে আপনি বোম্বাইয়ে যথেষ্ট জানিতেন। এই ভদ্রলোকটি এদেশের দুর্জয় শীতেও নিরামিষ ভিন্ন অন্য খাদ্য গ্রহণ করেন না এবং নিজের দেশ ও ধর্মকে প্রাণপণ সমর্থন করেন। এদেশের জনসাধারণ তাঁহাকে বিশেষ পছন্দ করে, কিন্তু যাহারা তাঁহাকে এদেশে পাঠাইয়াছিল, তাহারা আজ কি করিতেছে?—তাহারা বীরচাঁদকে জাতিচ্যুত করিতে সচেষ্ট।
হিংসারূপ পাপ দাসজাতির মধ্যেই স্বভাবতঃ উদ্ভূত হইয়া থাকে এবং উহাই তাহাদিগকে হীনতার পঙ্কে নিমজ্জিত করিয়া রাখে। এদেশে ‘—’রা বক্তৃতা করিয়া অর্থসংগ্রহের চেষ্টা করিতেছিল এবং কিছু সাফল্য লাভ যে করে নাই—এমন নহে, কিন্তু তদপেক্ষা অধিকতর সাফল্য আমি লাভ করিয়াছিলাম; আমি কোনপ্রকারে তাহাদের বিঘ্নস্বরূপ হই নাই। তবে কি কারণে আমার সাফল্য অধিক হইয়াছিল? কারণ উহাই ছিল ভগবানের অভিপ্রায়।
এদেশে কেহ যদি উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে থাকে, তবে সকলেই তাহাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত। আর ভারতবর্ষে কাল যদি কোন একটি পএিকায় আপনি আমার প্রশংসা করিয়া এক ছত্র লেখেন, তবে পরদিন দেশসুদ্ধ সকলে আমার বিপক্ষে দাঁড়াইবে। ইহার হেতু কি? হেতু—দাসসুলভ মনোবৃত্তি। নিজেদের মধ্যে কেহ সাধারণ স্তর হইতে একটু মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইবে, ইহা তাহাদের পক্ষে অসহ্য। এদেশের মুক্তিকামী, স্বাবলম্বী ও ভ্রাতৃভাবে উদ্বুদ্ধ জনগণের সহিত আমাদের দেশের অপদার্থ লোকগুলির কি আপনি তুলনা করিতে চান? আমাদের সহিত যাহাদের নিকটতম সাদৃশ্য আছে, তাহারা এদেশের সদ্যোদাসত্বমুক্ত নিগ্রোগণ।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাংশে প্রায় দুই কোটি নিগ্রো আর মুষ্টিমেয় কয়েকটি শ্বেত আমেরিকান বাস করে; অথচ এই শ্বেতকায় কয়েকজনই নিগ্রোদিগকে দাবাইয়া রাখিয়াছে।
আইন অনুসারে সব ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই দাসজাতির মুক্তির জন্য আমেরিকানরা ভাইয়ে ভাইয়ে এক নৃশংস যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিল। সেই একই দোষ—হিংসা এখানেও রহিয়াছে। একজন নিগ্রো আর একজনের প্রশংসা কিম্বা উন্নতি সহ্য করিতে পারে না; অবিলম্বে তাহাকে নিষ্পেষিত করিবার জন্য আমেরিকানদিগের সহিত যোগ দেয়। ভারত- বর্ষের বাহিরে না আসিলে এ বিষয়ে সম্যক ধারণা হওয়া সম্ভব নহে।
যাহাদের প্রচুর অর্থ ও প্রতিপত্তি আছে, তাহাদের পক্ষে জগৎকে এইভাবে চলিতে দেওয়া ঠিক বটে; কিন্তু যাহারা লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ও নিষ্পেষিত নরনারীর বুকের রক্তদ্বারা অর্জিত অর্থে শিক্ষিত হইয়া এবং বিলাসিতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকিয়াও উহাদের কথা একটিবার চিন্তা করিবার অবসর পায় না—তাহাদিগকে আমি ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলিয়া অভিহিত করি।
কোথায় ইতিহাসের কোন্ যুগে ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়, পুরোহিত ও ধর্মধ্বজিগণ দীনদুঃখীর জন্য চিন্তা করিয়াছে?—তাহাদের ক্ষমতার জীবনীশক্তি ইহাদের নিষ্পেষণ হইতেই উদ্ভূত!
কিন্তু প্রভু মহান্। শীঘ্রই হউক আর বিলম্বেই হউক, এ অন্যায়ের সমুচিত ফলও ফলিয়াছে। যাহারা দরিদ্রের রক্ত শোষণ করিয়াছে, উহাদের অর্জিত অর্থে নিজেরা শিক্ষা লাভ করিয়াছে, এমন কি, যাহাদের ক্ষমতা-প্রতিপত্তির সৌধ দরিদ্রের দুঃখদৈন্যের উপরই নির্মিত—কালচক্রের আবর্তনে তাহাদেরই হাজার হাজার লোক দাসরূপে বিক্রীত হইয়াছে; তাহাদের স্ত্রী-কন্যার মর্যাদা নষ্ট হইয়াছে এবং বিষয়-সম্পত্তি সবই লুণ্ঠিত হইয়াছে। বিগত সহস্র বৎসর যাবৎ ইহাই চলিয়া আসিতেছে। আর ইহার পশ্চাতে কি কোন কারণ নাই বলিয়া আপনি মনে করেন?
ভারতবর্ষে দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশী কেন? এ-কথা বলা মূর্খতা যে, তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তরগ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল। ... বস্তুতঃ জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতিলাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল। আর সেইজন্য বাঙলাদেশে, যেখানে জমিদারের বিশেষ সংখ্যাধিক্য, সেখানে কৃষকসম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানেরই সংখ্যা বেশী।
এই নির্যাতিত ও অধঃপতিত লক্ষ লক্ষ নরনারীর উন্নতির কথা কে চিন্তা করে? কয়েক হাজার ডিগ্রীধারী ব্যক্তিদ্বারা একটি জাতি গঠিত হয় না, অথবা মুষ্টিমেয় কয়েকটি ধনীও একটি জাতি নহে। আমাদের সুযোগ-সুবিধা খুব বেশী নাই—এ-কথা অবশ্য সত্য, কিন্তু যেটুকু আছে, তাহা ত্রিশ কোটি নরনারীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পক্ষে — এমন কি বিলাসিতার পক্ষেও যথেষ্ট।
আমাদের দেশের শতকরা নব্বই জনই অশিক্ষিত, অথচ কে তাহাদের বিষয় চিন্তা করে?—এ-সকল বাবুর দল কিম্বা তথাকথিত দেশহিতৈষীর দল কি?
এ-সকল সত্ত্বেও আমি বলি যে, ভগবান্ অবশ্যই একজন আছেন এবং এ-কথা পরিহাসের বিষয় নহে। তিনিই আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত করিতেছেন; এবং যদিও আমি জানি যে, দাসজাতি তাহার স্বভাবদোষে যথার্থ হিতকারীকেই দংশন করিয়া থাকে, তথাপি ইহাদেরই জন্য আমি প্রার্থনা করি এবং আমার সহিত আপনিও প্রার্থনা করুন। যাহা কিছু সৎ, যাহা কিছু মহৎ, তাহার প্রতি আপনি যথার্থ সহানুভূতিসম্পন্ন। আপনাকে জানিয়া অন্ততঃ এমন একজনকে জানিয়াছি বলিয়া আমি মনে করি, যাঁহার মধ্যে সারবস্তু আছে, যাঁহার প্রকৃতি উদার এবং যিনি অন্তরে বাহিরে অকপট। তাই আমার সহিত ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’—এই প্রার্থনায় যোগ দিতে আমি আপনাকে আহ্বান করি।
লোকে কি বলিল—সেদিকে আমি ভ্রূক্ষেপ করি না। আমার ভগবানকে, আমার ধর্মকে, আমার দেশকে—সর্বোপরি দরিদ্র ভিক্ষুককে আমি ভালবাসি। নিপীড়িত, অশিক্ষিত ও দীনহীনকে আমি ভালবাসি; তাহাদের বেদনা অন্তরে অনুভব করি, কত তীব্রভাবে অনুভব করি, তাহা প্রভুই জানেন। তিনিই আমাকে পথ দেখাইবেন। মানুষের স্তুতি-নিন্দায় আমি দৃকপাতও করি না, তাহাদের অধিকাংশকেই অজ্ঞ কলরবকারী শিশুর মত মনে করি। সহানুভূতি ও নিঃস্বার্থ ভালবাসার ঠিক মর্মকথাটি ইহারা কখনও বুঝিতে পারে না। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদে আমার সে অন্তর্দৃষ্টি আছে।
মুষ্টিমেয় সহকর্মীদের লইয়া এখন আমি কাজ করিতে চেষ্টা করিতেছি, আর উহাদের প্রত্যেকে আমারই মত দরিদ্র ভিক্ষুক। তাহাদিগকে আপনি দেখিয়াছেন। প্রভুর কাজ চিরদিন দীন-দরিদ্রগণই সম্পন্ন করিয়াছে। আশীর্বাদ করিবেন যেন ঈশ্বরের প্রতি, গুরুর প্রতি এবং নিজের প্রতি আমার বিশ্বাস অটুট থাকে।
প্রেম এবং সহানুভূতিই একমাত্র পন্থা। ভালবাসাই একমাত্র উপাসনা।
প্রভু আপনাদের নিরন্তর সহায়তা করুন। আমার আশীর্বাদাদি জানিবেন।
১৩২*
[রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়কে লিখিত]১৮
নিউ ইয়র্ক
১৮ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় মহাশয়,
সম্প্রতি কলিকাতা টাউন হলের সভায় যে প্রস্তাবগুলি গৃহীত হইয়াছে এবং আমার সহ-নাগরিকগণ আমাকে উদ্দেশ করিয়া যে সহৃদয়তাপূর্ণ কথাগুলি পাঠাইয়াছেন, তাহা আমি পাইয়াছি।
মহাশয়, আমার ক্ষুদ্র কার্যও যে আপনারা সাদরে অনুমোদন করিয়াছেন, তজ্জন্য আমার হৃদয়ের গভীরতম কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
আমার দৃঢ় ধারণা—কোন ব্যক্তি বা জাতি অপর জাতি হইতে নিজেকে সম্পূর্ণ পৃথক্ রাখিয়া বাঁচিতে পারে না। আর যেখানেই শ্রেষ্ঠত্ব, পবিত্রতা বা নীতি (policy)-সম্বন্ধীয় ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া এইরূপ চেষ্টা করা হইয়াছে, যেখানেই কোন জাতি আপনাকে পৃথক্ রাখিয়াছে, সেখানেই তাহার পক্ষে ফল অতিশয় শোচনীয় হইয়াছে।
আমার মনে হয়, ভারতের পতন ও অবনতির এক প্রধান কারণ—জাতির চারিদিকে এইরূপ আচারের বেড়া দেওয়া। প্রাচীনকালে এই আচারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল—হিন্দুরা যেন চতুষ্পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধদের সংস্পর্শে না আসে । ইহার ভিত্তি—অপরের প্রতি ঘৃণা।
প্রাচীন বা আধুনিক তার্কিকগণ মিথ্যা যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া যতই ইহা ঢাকিবার চেষ্টা করুন না কেন, অপরকে ঘৃণা করিতে থাকিলে কেহই নিজে অবনত না হইয়া থাকিতে পারে না। ধর্মনীতির এই অব্যর্থ নিয়মের জাজ্বল্যমান প্রমাণস্বরূপ—ইহার অনিবার্য ফল এই হইল যে, যাহারা একদিন প্রাচীন জাতিসমূহের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল, তাহারাই এক্ষণে সমুদয় জাতির উপহাস ও ঘৃণার পাত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমাদেরই পূর্বপুরুষগণ যে নিয়ম প্রথম আবিষ্কার করিয়াছিলেন, আমরাই সেই নিয়ম লঙ্ঘন করিবার দৃষ্টান্তস্থল হইয়া রহিয়াছি।
আদান-প্রদানই প্রকৃতির নিয়ম; ভারতকে যদি আবার উঠিতে হয়, তবে তাহাকে নিজ ঐশ্বর্য-ভাণ্ডার উন্মুক্ত করিয়া পৃথিবীর সমুদয় জাতির ভিতর ছড়াইয়া দিতে হইবে এবং পরিবর্তে অপরে যাহা কিছু দেয়, তাহাই গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। সম্প্রসারণই জীবন—সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু; প্রেমই জীবন—দ্বেষই মৃত্যু। আমরা যেদিন হইতে অপর জাতিসকলকে ঘৃণা করিতে আরম্ত করিলাম, সেইদিন হইতে আমাদের ধ্বংস আরম্ভ হইল; আর যতদিন না আমরা আবার সম্প্রসারণশীল হইতেছি, ততদিন কিছুই আমাদের বিনাশ আটকাইয়া রাখিতে পারিবে না। অতএব আমাদিগকে পৃথিবীর সকল জাতির সহিত মিশিতে হইবে। আর শত শত কুসংস্কারাবিষ্ট ও স্বার্থপর ব্যক্তি (প্রবাদবাক্যের কুকুর যেমন গরুর জাবপাত্রে শুইয়া থাকিয়া, নিজেও তাহা খায় না অথচ গরুরও খাইবার ব্যাঘাত উৎপাদন করে, ইহারাও সেইরূপ) অপেক্ষা প্রত্যেক হিন্দু, যিনি বিদেশে ভ্রমণ করিতে যান, তিনি স্বদেশের অধিকতর কল্যাণসাধন করেন। পাশ্চাত্য জাতিগণ জাতীয় জীবনের যে অপূর্ব সৌধ নির্মাণ করিয়াছেন, সেগুলি চরিত্ররূপ স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। যতদিন না আমরা এইরূপ শত শত উৎকৃষ্ট চরিত্র সৃষ্টি করিতে পারিতেছি, ততদিন এ-জাতি বা ও-জাতির বিরুদ্ধে বিরক্তিপ্রকাশ ও চীৎকার করা বৃথা।
যে অপরকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত নয়, সে কি স্বয়ং স্বাধীনতা পাইবার যোগ্য? আসুন, আমরা বৃথা চীৎকারে শক্তিক্ষয় না করিয়া ধীরতার সহিত মনুষ্যোচিতভাবে কার্যে লাগিয়া যাই। আর আমি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি যে, কেহ কিছু পাইবার ঠিক ঠিক উপযুক্ত হইলে জগতের কোন শক্তিই তাহাকে তাহার প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত করিতে পারে না। আমাদের জাতীয় জীবন অতীতকালে মহৎ ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু আমি অকপটভাবে বিশ্বাস করি যে, আমাদের ভবিষ্যৎ আরও গৌরবান্বিত। শঙ্কর আমাদিগকে পবিত্রতা, ধৈর্য ও অধ্যবসায়ে অবিচলিত রাখুন।
ভবদীয় বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
১৩৩*
[মান্দ্রাজী ভক্তগণের উদ্দেশে শ্রীআলাসিঙ্গা পেরুমলকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৯ নভেম্বর, ১৮৯৪
হে বীরহৃদয় যুবকবৃন্দ,
তোমাদের গত ১১ অক্টোবর তারিখের পত্র কাল পাইয়া অতিশয় আনন্দিত হইলাম। এ পর্যন্ত কোন বিঘ্ন না হইয়া বরং আমাদের কার্যে উন্নতিই হইয়াছে, ইহাতে আমি পরম আনন্দিত। যে-কোনরূপেই হউক, সঙ্ঘের যাহাতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও উন্নতি হইতে পারে, তাহা করিতেই হইবে; আর আমরা ইহাতে নিশ্চয়ই কৃতকার্য হইব—নিশ্চয়ই। ‘না’ বলিলে চলিবে না। আর কিছুরই আবশ্যক নাই, আবশ্যক কেবল প্রেম সরলতা ও সহিষ্ণুতা। জীবনের অর্থ বিস্তার; বিস্তার ও প্রেম একই কথা। সুতরাং প্রেমই জীবন—উহাই জীবনের একমাত্র গতিনিয়ামক; স্বার্থপরতাই মৃত্যু, জীবন থাকিতেও ইহা মৃত্যু, আর দেহাবসানেও এই স্বার্থপরতাই প্রকৃত মৃত্যুস্বরূপ। দেহাবসানে কিছুই থাকে না, এ-কথাও যদি কেহ বলে, তথাপি তাহাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, এই স্বার্থপরতাই যথার্থ মৃত্যু।
পরোপকারই জীবন, পরহিতচেষ্টার অভাবই মৃত্যু। শতকরা নব্বই জন নরপশুই মৃত, প্রেততুল্য, কারণ হে যুবকবৃন্দ, যাহার হৃদয়ে প্রেম নাই, সে মৃত ছাড়া আর কি? হে যুবকবৃন্দ, দরিদ্র অজ্ঞ ও নিপীড়িত জনগণের ব্যথা তোমরা প্রাণে প্রাণে অনুভব কর, সেই অনুভবের বেদনায় তোমাদের হৃদয় রুদ্ধ হউক, মস্তিষ্ক ঘুরিতে থাকুক, তোমাদের পাগল হইয়া যাইবার উপক্রম হউক। তখন গিয়া ভগবানের পাদপদ্মে তোমাদের অন্তরের বেদনা জানাও। তবেই তাঁহার নিকট হইতে শক্তি ও সাহায্য আসিবে—অদম্য উৎসাহ, অনন্ত শক্তি আসিবে। গত দশ বৎসর ধরিয়া আমার মূলমন্ত্র ছিল—এগিয়ে যাও, এখনও বলিতেছি, এগিয়ে যাও। যখন চতুর্দিকে অন্ধকার বৈ আর কিছুই দেখিতে পাই নাই, তখনও বলিয়াছি—এগিয়ে যাও। এখন একটু একটু আলো দেখা যাইতেছে, এখনও বলিতেছি—এগিয়ে যাও। বৎস, ভয় পাইও না। উপরে তারকাখচিত অনন্ত আকাশমণ্ডলের দিকে সভয় দৃষ্টিতে চাহিয়া মনে করিও না, উহা তোমাকে পিষিয়া ফেলিবে। অপেক্ষা কর, দেখিবে—অল্পক্ষণের মধ্যে দেখিবে, সবই তোমার পদতলে। টাকায় কিছুই হয় না, নামেও হয় না, যশেও হয় না, বিদ্যায়ও কিছু হয় না, ভালবাসায় সব হয়—চরিত্রই বাধাবিঘ্নরূপ বজ্রদৃঢ় প্রাচীরের মধ্য দিয়া পথ করিয়া লইতে পারে।
এক্ষণে আমাদের সম্মুখে সমস্যা এই—স্বাধীনতা ব্যতীত কোনরূপ উন্নতিই সম্ভব নহে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধর্মচিন্তায় স্বাধীনতা দিয়াছিলেন, ফলে আমরা এই অপূর্ব ধর্ম পাইয়াছি। কিন্তু তাঁহারা সমাজের পায়ে অতি কঠিন শৃঙ্খল পরাইলেন। এক কথায় বলিতে গেলে আমাদের সমাজ ভয়াবহ, পৈশাচিক। পাশ্চাত্যদেশে সমাজ চিরকাল স্বাধীনতা সম্ভোগ করিয়াছে—তাহাদের সমাজের দিকে লক্ষ্য করিয়া দেখ। আবার অপরদিকে তাহাদের ধর্ম কিরূপ, সেদিকেও দৃষ্টিপাত করিও।
স্বাধীনতাই উন্নতির প্রথম শর্ত। যেমন মানুষের চিন্তা করিবার ও কথা বলিবার স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক, তেমনি তাহার আহার পোষাক বিবাহ ও অন্যান্য সকল বিষয়েই স্বাধীনতা প্রয়োজন—তবে এই স্বাধীনতা যেন অপর কাহারও অনিষ্ট না করে।
আমরা নির্বোধের মত জড় সভ্যতার বিরুদ্ধে চীৎকার করিতেছি। না করিবই বা কেন? হাত বাড়াইয়া না পাইলে ‘আঙুর টক’ বলিব না তো কি! ভারতের আধ্যাত্মিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিলেও ভারতে এক লক্ষ নরনারীর অধিক যথার্থ ধার্মিক লোক নাই, ইহা মানিতেই হইবে। এই মুষ্টিমেয় লোকের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ভারতের ত্রিশ কোটি লোককে অসভ্য অবস্থায় থাকিতে হইবে এবং না খাইয়া মরিতে হইবে? একজন লোকও কেন না খাইয়া মরিবে? মুসলমানগণ হিন্দুদিগকে জয় করিল—এ ঘটনা সম্ভব হইল কেন? বাহ্য সভ্যতা সম্বন্ধে হিন্দুর অজ্ঞতাই ইহার কারণ। বাহ্য সভ্যতা আবশ্যক শুধু তাহাই নহে; প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তুর ব্যবহারও আবশ্যক, যাহাতে গরীব লোকের জন্য নূতন নূতন কাজের সৃষ্টি হয়।
অন্ন! অন্ন! যে ভগবান্ এখানে আমাকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখিবেন—ইহা আমি বিশ্বাস করি না। ভারতকে উঠাইতে হইবে, গরীবদের খাওয়াইতে হইবে, শিক্ষার বিস্তার করিতে হইবে, আর পৌরোহিত্যরূপ পাপ দূরীভূত করিতে হইবে। আরও খাদ্য, আরও সুযোগ প্রয়োজন। আমাদের নির্বোধ যুবকগণ ইংরেজগণের নিকট হইতে অধিক ক্ষমতা লাভের জন্য সভাসমিতি করিয়া থাকে—ইহাতে ইংরেজরা হাসে। যে অপরকে স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত নয়, সে কোনমতেই স্বাধীনতা পাইবার যোগ্য নহে। দাসেরা শক্তি চায় অপরকে দাস করিয়া রাখিবার জন্য। তাই বলি, এই অবস্থা ধীরে ধীরে আনিতে হইবে—লোককে অধিক ধর্মনিষ্ঠ হইতে শিক্ষা দিয়া ও সমাজকে স্বাধীনতা দিয়া। প্রাচীন ধর্ম হইতে এই পৌরোহিত্যের অত্যাচার ও অনাচারের মূলোচ্ছেদ করিয়া ফেল, দেখিবে এই ধর্মই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।
আমার কথা কি বুঝিতেছ? ভারতের ধর্ম লইয়া ইওরোপের সমাজের মত একটি সমাজ গড়িতে পার? আমার বিশ্বাস ইহা কার্যে পরিণত করা খুব সম্ভব, আর এরূপ হইবেই হইবে। ইহা কার্যে পরিণত করিবার প্রধান উপায়—মধ্যভারতে একটি উপনিবেশ স্থাপন। যাহারা তোমাদের ভাব মানিয়া চলিবে, কেবল তাহাদের সেখানে রাখা হইবে। তারপর এই অল্পসংখ্যক লোকের মধ্যে সেই ভাব বিস্তার কর। অবশ্য ইহাতে টাকার দরকার, কিন্ত এ টাকা আসিবে। ইতোমধ্যে একটি কেন্দ্রীয় সমিতি করিয়া সমগ্র ভারতে তাহার শাখা স্থাপন করিয়া যাও। এখন কেবল ধর্মভিত্তিতে এই সমিতি স্থাপন কর; কোনরূপ সামাজিক সংস্কারের কথা এখন প্রচার করিও না। কেবলমাত্র এইটুকু দেখিলেই হইবে যে, অজ্ঞ লোকদিগের কুসংস্কার যেন প্রশ্রয় না পায়। শঙ্করাচার্য, রামানুজ, চৈতন্য প্রভৃতি প্রাচীন নামের মধ্য দিয়া এ-সকল সত্য প্রচারিত হইলে লোকে সহজে গ্রহণ করিয়া থাকে। ঐ সঙ্গে নগরসঙ্কীর্তন প্রভৃতিরও বন্দোবস্ত কর।
মনে কর, প্রথম সমিতি খুলিবার সময় একটি মহোৎসব করিলে। নিশান প্রভৃতি লইয়া রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া নগরসঙ্কীর্তন হইল, বক্তৃতাদি হইল। তারপর প্রতি সপ্তাহে এক বা ততোধিক বার সমিতির অধিবেশন হউক। নিজের ভিতর উৎসাহাগ্নি প্রজ্বলিত কর, আর চারিদিকে বিস্তার করিতে থাক। উঠিয়া পড়িয়া কাজে লাগ। নেতৃত্ব করিবার সময় সেবকভাবাপন্ন হও, নিঃস্বার্থপর হও; আর একজন গোপনে অপরের নিন্দা করিতেছে, তাহা শুনিও না। অনন্ত ধৈর্য ধরিয়া থাক, সিদ্ধি তোমার করতলে। ভারতের কোন কাগজ আর পাঠাইবার আবশ্যকতা নাই। আমার নিকট বিস্তর আসিয়াছে, আর না। এইটুকু বুঝ যে, যেখানে যেখানে তোমরা কোন সাধারণ সভা আহ্বান করিতে পারিয়াছ, সেইখানেই কাজ করিবার একটু সুবিধা পাইয়াছ। সেই সুবিধার সহায়তা লইয়া কাজ কর। কাজ কর, কাজ কর; পরের হিতের জন্য কাজ করাই জীবনের লক্ষণ। আমি আয়ারকে পৃথক্ কোন পত্র লিখি নাই, কিন্তু অভিনন্দন-পত্রের যে উত্তর পাঠাইয়াছি, তাহাই বোধ হয় পর্যাপ্ত হইবে। তাঁহাকে ও অপরাপর বন্ধুগণকে আমার হৃদয়ের ভালবাসা, সহানুভূতি ও কৃতজ্ঞতা জানাইবে। তাঁহারা সকলেই মহাশয় ব্যক্তি। একটি বিষয়ে বিশেষ সাবধান হইবেঃ আমি তোমার নিকটেই আমার সমুদয় পত্র পাঠাই বলিয়া—অন্যান্য বন্ধুগণের নিকট—তুমি নিজে যেন একটা মস্ত লোক, এটা দেখাইতে যাইও না। আমি জানি, তুমি এত নির্বোধ হইতেই পার না। তথাপি তোমাকে এ বিষয়ে সাবধান করিয়া দেওয়া আমার কর্তব্য বলিয়া মনে করি। ইহাতেই সম্প্রদায় ভাঙিয়া যায়। আমি চাই, যেন আমাদের মধ্যে কোনরূপ কপটতা, কোনরূপ লুকোচুরি ভাব, কোনরূপ দুষ্টামি না থাকে। আমি বরাবরই প্রভুর উপর নির্ভর করিয়াছি, দিবালোকের ন্যায় উজ্জ্বল সত্যের উপর নির্ভর করিয়াছি। আমার বিবেকের উপর এই কলঙ্ক লইয়া যেন মরিতে না হয় যে, আমি নামের জন্য, এমন কি, পরের উপকার করিবার জন্য লুকোচুরি খেলিয়াছি। একবিন্দু দুর্নীতি, বদ মতলবের একবিন্দু দাগ পর্যন্ত যেন না থাকে।
গুপ্ত বদমাশি, লুকোন জুয়াচুরি যেন কিছু আমাদের মধ্যে না থাকে; কিছুই লুকাইয়া করা হইবে না। কেহ যেন নিজেকে গুরুর বিশেষ প্রিয়পাত্র মনে করিয়া অভিমানে স্ফীত না হন। এমন কি, আমাদের মধ্যে গুরুও কেহ থাকিবে না; গুরুগিরি চলিবে না। হে বীরহৃদয় বালকগণ, কার্যে অগ্রসর হও। টাকা থাক বা না থাক, মানুষের সহায়তা পাও আর নাই পাও, তোমার তো প্রেম আছে? ভগবান্ তো তোমার সহায় আছেন? অগ্রসর হও, তোমার গতি কেহ রোধ করিতে পারিবে না।
ভারত হইতে প্রকাশিত থিওসফিষ্টদের একখানি কাগজে লিখিতেছে, তাঁহারা আমার সাফল্যের পথ প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন! বটেই তো!!! নিছক বাজে কথা—থিওসফিষ্টরা আমার পথ প্রস্তুত করিয়া দিয়াছে!
সাবধান! আমাদের মধ্যে যাহাতে কিছুমাত্র অসত্য প্রবেশ না করে। সত্যকে ধরিয়া থাক, আমরা নিশ্চয়ই কৃতকার্য হইব। হইতে পারে বিলম্বে, কিন্তু নিশ্চিত কৃতকার্য হইব, এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। কাজ করিয়া যাও। মনে কর, আমি জীবিত নাই। এই মনে করিয়া কাজে লাগ, যেন তোমাদের প্রত্যেকের উপর সমুদয় কাজের ভার। ভাবী পঞ্চাশ শতাব্দী তোমাদের দিকে চাহিয়া আছে। ভারতের ভবিষ্যৎ তোমাদের উপর নির্ভর করিতেছে। কাজ করিয়া যাও।
ইংলণ্ড হইতে অক্ষয়ের একখানি সুন্দর পত্র পাইয়াছি। জানি না, কবে ভারতে যাইতে পারিব। এখানে প্রচারের যেমন সুবিধা, সাহায্যপ্রাপ্তিরও সেইরূপ আশা। ভারতে লোকেরা বড় জোর আমার প্রশংসা করিতে পারে, কিন্তু কেহ একটি পয়সা দিতে রাজী নয়। পাইবেই বা কোথায়? নিজেরা যে ভিক্ষুক! তারপর ভারতবাসীরা বিগত দুই সহস্র বা ততোধিক বর্ষ ধরিয়া লোকহিতকর কার্য করিবার শক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছে। জাতি (Nation), সর্বসাধারণ (Public) প্রভৃতি তত্ত্ব সম্বন্ধে তাহারা এই নূতন ভাব পাইতেছে। সুতরাং তাহাদিগের উপর আমার দোষারোপ করিবার কোন প্রয়োজন নাই। পরে আরও বিস্তারিত লিখিতেছি। তোমাদিগকে অনন্তকালের জন্য আশীর্বাদ । ইতি—
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ফোনগ্রাফ সম্বন্ধে তোমাদের আর খবর লইবার প্রয়োজন নাই। আমি এইমাত্র খেতড়ি হইতে খবর পাইলাম যে, উহা নিরাপদে তথায় পৌঁছিয়াছে। ইতি
বি
১৩৪*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
৩০ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
ফোনগ্রাফ ও পত্রখানি তোমার কাছে নিরাপদে পৌঁছেছে জেনে আনন্দিত হইলাম। আমাকে খবরের কাগজের অংশ কেটে আর পাঠাবার দরকার নেই, কাগজের বন্যা আমায় ভাসিয়ে দিয়েছে—এখন যথেষ্ট হয়েছে, আর আবশ্যক নেই। এখন সঙ্ঘের জন্য খাট। আমি ইতোমধ্যেই নিউ ইয়র্কে একটা সমিতি স্থাপন করেছি, তার সহকারী সভাপতি শীঘ্রই তোমাকে পত্র লিখবেন—তুমিও যত শীঘ্র পার তাঁদের সঙ্গে পত্রালাপ করতে আরম্ভ কর। আশা করি, আমি আরও কয়েক জায়গায় সমিতি স্থাপন করতে সমর্থ হব।
আমাদিগকে আমাদের সব শক্তি সংহত করতে হবে—একটা সম্প্রদায় গড়বার জন্যও নয়, আধ্যাত্মিক ব্যাপারের জন্যও নয়, কিন্তু বৈষয়িক দিকটার জন্য। জোরের সহিত প্রচারকার্য চালাতে হবে। তোমাদের সব মাথাগুলো একত্র কর ও সঙ্ঘবদ্ধ হও।
রামকৃষ্ণের অলৌকিক ক্রিয়া সম্বন্ধে কি পাগলামি হচ্ছে? আমার অদৃষ্টে সারা জীবন দেখছি—গরু-তাড়ানো ঘুচল না। মস্তিষ্কহীন আহাম্মকগুলো কেন যে এই বাজে আজগুবিগুলো লেখে তা জানিও না, বুঝিও না। মদকে ‘ডি. গুপ্তের ঔষধে’ পরিণত করা ছাড়া কি রামকৃষ্ণের জগতে আর কোন কাজ ছিল না? প্রভু আমাকে এই কলিকাতার লোকদের হাত থেকে রক্ষা করুন! কি সব লোক নিয়ে কাজ করতে হবে! যদি এরা শ্রীরামকৃষ্ণের একখানা যথার্থ জীবনচরিত লিখতে পারে—তিনি কি জন্য এসেছিলেন, কি শিক্ষা দিতে এসেছিলেন, সেই দিক্ লক্ষ্য রেখে লিখতে পারে, তবে লিখুক। নতুবা এইসব আবোল-তাবোল লিখে তাঁর জীবনী ও উপদেশকে যেন বিকৃত করা না হয়। এ-সব লোক ভগবানকে জানতে চায়—এদিকে রামকৃষ্ণের ভেতর বুজরুকি ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না! খাজা আহাম্মকি! এ-রকম আহাম্মকি দেখলে আমার রক্ত টগবগ ফুটতে থাকে।
কিডি তাঁর ভক্তি, জ্ঞান ও ধর্মসমন্বয়ের কথা এবং অন্যান্য উপদেশ তর্জমা করুন না? এই লিখতে হবে যে, তাঁর জীবনটা একটা অসাধারণ আলোকবর্তিকা, যার তীব্র রশ্মিসম্পাতে লোকে হিন্দুধর্মের সমগ্র দিক্ বা রূপ সত্যসত্যই বুঝতে সমর্থ হবে। শাস্ত্রে যে-সব জ্ঞান মতবাদরূপে রয়েছে, তিনি তার মূর্ত দৃষ্টান্ত। ঋষি ও অবতারেরা যা বাস্তবিক শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন, তিনি নিজের জীবন দ্বারা তা দেখিয়া গেছেন। শাস্ত্রগুলি মতবাদ মাত্র—তিনি ছিলেন তার প্রত্যক্ষ অনুভূতি। এই ব্যক্তি তাঁর একান্ন-বর্ষব্যাপী একটা জীবনে পাঁচ হাজার বছরের জাতীয় আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করে গেছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষাপ্রদ আদর্শরূপে আপনাকে গড়ে তুলেছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন মত এক একটা অবস্থা বা ক্রম মাত্র, পরধর্ম বা পরমতের প্রতি শুধু দ্বেষভাবশূন্য হলেই চলবে না, আমাদিগকে ঐ ধর্ম বা মতকে আলিঙ্গনও করতে হবে; সত্যই সকল ধর্মের ভিত্তি—তাঁর এই মতবাদ দ্বারা বেদের ব্যাখ্যা ও শাস্ত্রসমূহের সমন্বয় হতে পারে। এসব ভাব নিয়ে তাঁর একখানি সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহী জীবনচরিত লেখা যেতে পারে। সময়ে সবই ঠিক হবে। কুরুচিপূর্ণ অসংলগ্ন ভাষা পরিহার করবে। … অন্যান্য জাতিরা এগুলিকে চূড়ান্ত অশ্লীলতা মনে করে। তাঁর ইংরেজী জীবনচরিত সমগ্র জগৎ পড়বে, সুতরাং সাবধান, ঐপ্রকার শব্দ ও ভাব যেন ওর ভিতর প্রবেশ না করে। আমার নিকট প্রেরিত একখানা জীবনচরিত পড়লাম, তাতে এইরূপ বহু শব্দের প্রয়োগ আছে। … সুতরাং খুব সাবধান—খুব সাবধান হয়ে এরূপ ভাষা বা ভাব বাদ দেবে।
কলিকাতায় বন্ধুদের এদিকে একবিন্দু ক্ষমতা নেই, অথচ হামবড়াইটা খুব আছে—তারা নিজেদের এত বড় মনে করে যে, অপরের পরামর্শ শুনতে একদম নারাজ। এই অদ্ভুত ভদ্রলোকদের নিয়ে যে কি করব তা বুঝি না—তাদের কাছ থেকে বেশী কিছু আশা করি না। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তারা যে বাঙলা বইখানি পাঠিয়েছে, তার জন্য লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হচ্ছে। লেখক হয়তো ভেবেছেন যে, তিনি খোলাখুলিভাবে সত্য লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছেন, পরমহংসদেবের ভাষা পর্যন্ত বজায় রাখছেন; কিন্তু তিনি এটা ভাবেননি যে, শ্রীরামকৃষ্ণ মেয়েদের সামনে কখনও এ-রকম ভাষা ব্যবহার করতেন না। এই লেখক আশা করেন, তাঁর বই স্ত্রীপুরুষ সমভাবে পড়বে। প্রভু আহাম্মকদের হাত থেকে আমায় রক্ষা করুন! তারা আবার নিজের খেয়ালে চলে মনে করে, তারা সকলেই তাঁকে সাক্ষাৎ দেখেছে! দূর ছাই এরূপ মস্তিষ্কহীনদের ভেতর দিয়ে যা কিছু বেরোয়, তা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। নিজেরা ভিখারী—রাজার মত চালচলন দেখাতে চায়। নিজেরা আহাম্মক, মনে করে—আমরা মস্ত জ্ঞানী! নগণ্য দাস সব, মনে করছে—আমরা প্রভু! এই তো তাদের অবস্থা! কি যে করব, কিছু বুঝতে পারি না। প্রভু আমায় রক্ষা করুন! আমার সব আশা-ভরসা তোমাদের উপর। কাজ করে যাও, কলিকাতার লোকদের মতানুসারে চলো না, কেবল তাদের না চটিয়ে খুশী রেখে যাও এই আশায় যে, তাদের মধ্যে কেউ না কেউ ভাল দাঁড়াতে পারে। কিন্তু স্বাধীনভাবে তোমাদের কাজে অগ্রসর হও। ভাত রান্না হলে অনেকেই পাত পেতে বসে যায়। সাবধান—কাজ করে যাও। সতত আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
১৩৫*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
৩০ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় কিডি,
তোমার পত্র পেলাম। তোমার মন যে এদিক ওদিক করছে, তা সব পড়লাম। সুখী হলাম যে, তুমি রামকৃষ্ণকে ত্যাগ করনি। আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি—তাঁর সম্বন্ধে যে-সব অদ্ভুত গল্প প্রকাশিত হয়েছে সেগুলি থেকে আর যে-সব অহাম্মক ওগুলি লিখছে তাদের থেকে তুমি তফাত থাকবে। সেগুলি সত্য বটে, কিন্তু আমি নিশ্চিত বুঝছি, আহাম্মকেরা সব তালগোল পাকিয়ে খিচুড়ি করে ফেলবে। তাঁর কত ভাল ভাল জ্ঞানরাশি শিক্ষা দেবার ছিল! তবে সিদ্ধাইরূপ বাজে জিনিষগুলোর ওপর অত ঝোঁক দাও কেন? অলৌকিক ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করতে পারলেই তো আর ধর্মের সত্যতা প্রমাণিত হয় না—জড়ের দ্বারা তো আর চৈতন্যের প্রমাণ হয় না। ঈশ্বর বা আত্মার অস্তিত্ব বা অমরত্বের সঙ্গে অলৌকিক ক্রিয়ার কি সম্বন্ধ? তুমি ঐ-সব নিয়ে মাথা ঘামিও না, তুমি তোমার ভক্তি নিয়ে থাক আর এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাক যে, আমি তোমার সব দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এটা ওটা নিয়ে মনকে চঞ্চল করো না। রামকৃষ্ণকে প্রচার কর। যে পানীয় পান করে তোমার তৃষ্ণা মিটেছে, তা অপরকে পান করতে দাও। তোমার প্রতি আমার আশীর্বাদ—সিদ্ধি তোমার করতলগত হোক। বাজে দার্শনিক চিন্তা নিয়ে মাথা ঘামিও না, অথবা তোমার গোঁড়ামি দ্বারা অপরকেও বিরক্ত করো না। একটা কাজই তোমার পক্ষে যথেষ্ট—রামকৃষ্ণকে প্রচার করা, ভক্তি প্রচার করা। এই কাজের জন্য তোমায় আশীর্বাদ করছি—কাজ করে যাও। এখন প্রভুর নাম প্রচার করগে।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
১৩৬*
[ডাঃ নাঞ্জুণ্ড রাওকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
৩০ নভেম্বর, ১৮৯৪
প্রেমাস্পদেষু,
তোমার মনোরম পত্রখানি এইমাত্র পেলাম। তুমি যে শ্রীরামকৃষ্ণের মহিমা বুঝতে পেরেছ, তা জেনে আমার বড়ই আনন্দ হল। আরও আনন্দ হল তোমার তীব্র বৈরাগ্যের পরিচয় পেয়ে। এই বৈরাগ্যই তো হল ভগবানলাভের অন্যতম প্রথম সাধন। আমি মান্দ্রাজবাসীর উপর চিরকাল অনেক আশা পোষণ করে এসেছি। এখনও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মান্দ্রাজ থেকেই আধ্যাত্মিক তরঙ্গ উঠে সমগ্র ভারতকে বন্যায় ভাসিয়ে দেবে। আমি কেবল এই প্রার্থনা করতে পারি যে, তোমার শুভ সঙ্কল্প শীঘ্র সিদ্ধ হোক। তবে বৎস, তোমার উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথে বিঘ্নগুলির কথাও আমার বলা উচিত। প্রথমতঃ এটি দেখতে হবে যে, হঠাৎ কিছু করে ফেলা কারও পক্ষে উচিত নয়। দ্বিতীয়তঃ তোমার মা এবং স্ত্রীর জন্যও একটু ভাবা উচিত। অবশ্য তুমি বলতে পার, শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যেরা সংসার ত্যাগ করবার সময় তাঁদের মা-বাপের মতামতে কি সব সময় চলেছিলেন? আমি জানি, নিশ্চিত জানি যে, বড় বড় কাজ খুব স্বার্থত্যাগ ব্যতীত হতে পারে না। আমি নিশ্চিত জানি, ভারতমাতা তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানগণের জীবন বলি চান, আর আমার অকপট আশা এই যে, তুমিও তাঁর কৃপায় তাঁদেরই অন্যতম হবার সৌভাগ্য লাভ করবে।
সমগ্র জগতের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখতে পাবে, মহাপুরুষগণ চিরকাল বড় বড় স্বার্থত্যাগ করেছেন, আর সাধারণ লোক তার সুফল ভোগ করেছে। তুমি যদি তোমার নিজের মুক্তির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ কর, সে আর কি ত্যাগ হল? তুমি কি জগতের কল্যাণের জন্য তোমার নিজের মুক্তিকামনা পর্যন্ত ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছ? তুমি স্বয়ং ব্রহ্মস্বরূপ এ কথাটা ভেবে দেখ। আমি তোমাকে উপস্থিত এই পরামর্শ দিই যে, তুমি কিছুদিন ব্রহ্মচারীর জীবন যাপন কর অর্থাৎ কিছুদিনের জন্য স্ত্রীর সংস্রব একেবারে ছেড়ে দিয়ে তোমার পিতার গৃহেই বাস কর—ইহাই ‘কুটীচক’ অবস্থা। জগতের কল্যাণের জন্য তুমি যে মহা স্বার্থত্যাগ করতে যাচ্ছ, তাতে তোমার স্ত্রীকেও সম্মত করবার চেষ্টা কর। আর তোমার যদি জ্বলন্ত বিশ্বাস, সর্বজয়ী প্রেম ও সর্বশক্তির চিত্তশুদ্ধি থাকে, তবে তুমি যে তোমার উদ্দেশ্যসাধনে শীঘ্রই সফলতা লাভ করবে, সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সন্দেহ নেই। দেহ মন প্রাণ অর্পণ করে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণদেবের উপদেশ-প্রচারকার্যে লেগে যাও দেখি—কারণ, সাধনার প্রথম সোপান হচ্ছে কর্ম। খুব মনোযোগ দিয়ে সংস্কৃত অধ্যয়ন আর খুব সাধনভজনের অভ্যাস কর। তোমাকে মানব-জাতির একজন শ্রেষ্ঠ আচার্য হতে হবে, আর আমার গুরু মহারাজ বলতেন, ‘নিজেকে মারতে হলে একটি নরুন দিয়ে হয়, কিন্তু অপরকে মারতে গেলে ঢাল তরবারের দরকার।’ তেমনি লোকশিক্ষা দিতে হলে অনেক শাস্ত্র পড়তে হয় ও অনেক তর্ক-যুক্তি করে বোঝাতে হয়, কিন্তু নিজের ধর্মলাভ কেবল একটি কথায় বিশ্বাস করলেই হয়। আর যখন ঠিক সময় হবে, তখন তুমি সমগ্র জগতে গিয়ে তাঁর নাম প্রচার করবার অধিকারী হবে। তোমার সঙ্কল্প অতি শুভ ও পবিত্র, সন্দেহ নাই—ভগবান্ শীঘ্র তোমার সঙ্কল্পসিদ্ধির সহায় হোন, কিন্তু হঠাৎ একটা কিছু করে ফেল না। প্রথমে কর্ম ও সাধন-ভজনের দ্বারা নিজেকে পবিত্র কর।
ভারত দীর্ঘকাল ধরে যন্ত্রণা সয়েছে, সনাতন ধর্মের ওপর বহুকাল ধরে অত্যাচার হয়েছে। কিন্তু প্রভু দয়াময়, তিনি আবার তাঁর সন্তানগণের পরিত্রাণের জন্য এসেছেন। পতিত ভারতকে আবার জাগরিত হবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পদতলে বসে শিক্ষা গ্রহণ করলেই কেবল ভারত উঠতে পারবে। তাঁর জীবন, তাঁর উপদেশ চারিদিকে প্রচার করতে হবে, যেন হিন্দুসমাজের সর্বাংশে—প্রতি অণুতে পরমাণুতে এই উপদেশ ওতপ্রোতভাবে ব্যাপ্ত হয়ে যায়। কে এ কাজ করবে? শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পতাকা বহন করে কে সমগ্র জগতের উদ্ধারের জন্য যাত্রা করবে? কে নাম, যশ, ঐশ্বর্যভোগ—এমন কি ইহলোক-পরলোকের সব আশা ত্যাগ করে অবনতির স্রোত রোধ করতে এগোবে? কয়েকটি যুবক দুর্গপ্রাচীরের ভগ্নপ্রদেশে লাফিয়ে পড়েছে—তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। তারা খুব অল্পসংখ্যক; এইরূপ কয়েক সহস্র যুবকের প্রয়োজন। তারা নিশ্চয়ই আসবে।আমি আনন্দিত যে, আমাদের প্রভু তোমার মনে তাঁদের অন্যতম হবার ইচ্ছা জাগিয়ে দিয়েছেন। প্রভু যাকে মনোনীত করবেন, সে-ই ধন্য—সে-ই মহাগৌরবের অধিকারী। তমোহ্রদে মজ্জমান লক্ষ লক্ষ নরনারীকে প্রভুর জ্যোতির্ময় রাজ্যে আনবার জন্য তোমার সঙ্কল্প উত্তম, আশা উচ্চ এবং লক্ষ্য অতি মহৎ।
কিন্তু হে বৎস, এতে অন্তরায় আছে। হঠাৎ কিছু করে ফেলা উচিত নয়। পবিত্রতা, সহিষ্ণুতা ও অধ্যবসায়—এই তিনটি, সর্বোপরি প্রেম সিদ্ধিলাভের জন্য একান্ত আবশ্যক। তোমার সামনে তো অনন্ত সময় পড়ে আছে, অতএব তাড়াতাড়ি হুড়োহুড়ির কোন প্রয়োজন নেই। তুমি যদি পবিত্র ও অকপট হও, সবই ঠিক হয়ে যাবে। তোমার মত শত শত যুবক চাই, যারা সমাজের উপর গিয়ে মহাবেগে পড়বে এবং যেখানে যাবে সেখানেই নবজীবন ও আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চার করবে। ভগবান্ শীঘ্র তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করুন। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
১৩৭**
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১৬৮, ব্র্যাট্ল্ ষ্ট্রীট, কেম্ব্রিজ
৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
এখানে তিন দিন আছি। লেডী হেনরী সমারসেটের একটি সুন্দর বক্তৃতা হল। এখানে রোজ সকালে বেদান্ত বা অপরাপর বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকি। তোমাকে পাঠিয়ে দেবার জন্য একখানি ‘বেদান্তধর্ম’ (Vedantism) ‘মাদার টেম্পলের’ নিকট দিয়েছিলাম। সে-খানি বোধ করি পেয়েছ। আর একদিন স্প্যাল্ডিংদের ওখানে খেতে গিয়েছিলাম। আমার আপত্তি সত্ত্বেও সেদিন তারা ধরে বসল মার্কিনদের সমালোচনা করতে হবে। আলোচনা তাদের অপ্রিয় হয়ে থাকবে; হওয়া স্বাভাবিক বটে—সর্বদা, সর্বত্র। চিকাগোয় ‘মাদার চার্চ’ ও পরিবারস্থ সকলের খবর কি? অনেকদিন হল তাঁদের কোন পত্র পাইনি। সময় পেলে এর পূর্বেই চট করে শহরে গিয়ে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে আসতাম। সারাদিনই বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। তারপর ভয়, গিয়েও যদি দেখা না হয়।
তোমার যদি অবসর থাকে লিখো; আমি সুযোগ পাওয়া মাত্রই তোমার সঙ্গে দেখা করে আসব। অপরাহ্ণের দিকে আমার অবকাশ। সকাল থেকে বেলা ১২টা ১টা পর্যন্ত খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। এইভাবে চলবে—যে পর্যন্ত এখানে আছি অর্থাৎ এই মাসের ২৭ বা ২৮ তারিখ পর্যন্ত। সকলে আমার প্রীতি জানবে। ইতি
তোমার চিরস্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১৩৮*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
কেম্ব্রিজ
ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
এইমাত্র তোমার পত্র পেলাম। তোমাদের সামাজিক প্রথায় যদি না বাধে তা হলে মিসেস ওলি বুল, মিস ফার্মার, এবং মিসেস এডামস্ নামক চিকাগো হতে আগত ব্যায়ামবিশারদের সঙ্গে একবার দেখা করে যাও না কেন?
যে-কোন দিন তাদের সেখানে পাবে।
তোমাদের চিরস্নেহশীল
বিবেকানন্দ
১৩৯*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
কেম্ব্রিজ
২১ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
এর পর তোমার আর কোন পত্র পাইনি। আগামী মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কে চলে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে তুমি মিসেস বুলের পত্র অবশ্য পেয়ে থাকবে। আমি যে-কোন দিন সানন্দে তোমার কাছে যাব; বক্তৃতা শেষ হওয়ায় আমার এখন অবকাশ আছে—আগামী রবিবার ছাড়া।
চিরস্নেহশীল
বিবেকানন্দ
১৪০*
[আলাসিঙ্গা পেরুমলকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২৬ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয়বরেষু,
শুভাশীর্বাদ। তোমার পত্র এই মাত্র পেলাম। নরসিংহ ভারতে পৌঁছেছে শুনে সুখী হলাম। ডাঃ ব্যারোজের ধর্মমহাসভা সম্বন্ধে বিবরণ-পুস্তকখানি তোমায় পাঠাতে পারিনি, সেইজন্য আমি দুঃখিত। পাঠাতে চেষ্টা করব। কথাটা হচ্ছে এই যে, ধর্মমহাসভা সম্বন্ধে সব ব্যাপার এদেশে পুরানো হয়ে গেছে। তিনি সম্প্রতি কোন বই লিখেছেন কিনা জানি না, আর তুমি যে কাগজখানির কথা উল্লেখ করেছ, তার সম্বন্ধেও কখনও কিছু জানিনি। এখন ডাঃ ব্যারোজ, ধর্মমহাসভা, তৎসংক্রান্ত এই পত্র ও অন্য যা কিছু সব প্রাচীন ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, সুতরাং তোমরাও ঐগুলিকে ইতিহাসের সামিল ভাবতে পার।
এখন আমার সম্বন্ধে প্রায়ই শুনে থাকি, কোন না কোন মিশনরী কাগজে আমাকে আক্রমণ করে লিখে থাকে। তার কোনটা আমার দেখবার ইচ্ছাও হয় না। যদি ভারতের ঐ-রকম মিশনরীদের আক্রমণ-সম্বলিত কোন কাগজ আমাকে পাঠাও, তা হলে তা জঞ্জালের সঙ্গে ফেলে দেব। আমাদের কাজের জন্য একটু হুজ্জতের দরকার হয়েছিল—এখন যথেষ্ট হয়েছে। এখন আর লোকে এখানে বা সেখানে আমার পক্ষে বা বিপক্ষে ভালমন্দ কি বলছে, সেদিকে আর লক্ষ্য করো না। তুমি তোমার কাজ করে যাও, আর মনে রেখো—‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিত দুর্গতিং তাত গচ্ছতি।’
এখানে দিন দিন লোকে আমার ভাব নিচ্ছে, আর তোমাকে আলাদা বলছি, তুমি যতটা ভাবছ তার চেয়ে এখানে আমার যথেষ্ট প্রতিপত্তি হয়েছে। সব জিনিষই ধীরে ধীরে অগ্রসর হবে।
বাল্টিমোরের ঘটনা সম্বন্ধে বক্তব্য এই, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ভাগে লোকে নিগ্রোদের সঙ্গে অন্য কৃষ্ণকায় জাতির প্রভেদ জানে না। যখন জানতে পারবে, তখন দেখবে—তারা খুব অতিথিবৎসল। ‘টমাস আ কেম্পিসে’র কথা নিয়ে ব্যাপারটা আমার নিকটও নূতন সংবাদ বটে! আমি তোমায় পূর্বেও লিখেছি, এখনও লিখছি, আমি খবরের কাগজের সুখ্যাতি বা নিন্দায় মোটেই কান দিই না, ঐরূপ কিছু আমার কাছে এলে আমি আগুনে পুড়িয়ে ফেলি, তোমরাও তাই করো। খবরের কাগজের আহাম্মকি বা কোন প্রকার সমালোচনার দিকে মন দিও না। মন মুখ এক করে নিজের কর্তব্য করে যাও—সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যের জয় হবেই হবে! দোহাই, আমাকে খবরের কাগজ, সাময়িক কোন পত্র বা কোন বই পাঠিও না। আমি সর্বদা ঘুরে বেড়াচ্ছি, সুতরাং ঐ সব জিনিষের বোঝা বইতে গেলে আমার কি কষ্ট, তা বুঝতেই পারছ।
মিশনরীদের মিথ্যা উক্তিগুলি গ্রাহ্যের মধ্যেই এনো না—এখানে কোন ভদ্রলোকই তাদের আমল দেয় না। ভারতে তারা হাত-পা চাপড়াক, ডাঃ ব্যারোজও যে এখানে খুব বড় লোক, তা নয়। সম্পূর্ণ নীরবতাই হচ্ছে তাদের উক্তিগুলির প্রতিবাদ, আমার ইচ্ছা—তোমরা তাই কর। সর্বোপরি, আমাকে ভারতীয় খবরের কাগজের বন্যায় ভাসিয়ে দিও না, ওর থেকে আমার যা দরকার ছিল তা হয়ে গেছে, আর না। এখন কাজে মন দাও। সুব্রহ্মণ্য আয়ারকে তোমাদের সভার সভাপতি করো। আমি তাঁর মত অকপট ও মহানুভব লোক আর দেখিনি। তাঁর ভেতর হৃদয় ও বুদ্ধিবৃত্তির খুব সুন্দর সামঞ্জস্য আছে। তাঁকে সভাপতি করে কাজে অগ্রসর হও। আমার ওপর বেশী নির্ভর করো না—নিজেদের ওপর নির্ভর করে যাও। এখনও আমি অকপটভাবে বিশ্বাস করি, মান্দ্রাজ থেকেই শক্তিতরঙ্গ উঠবে। আমার সম্বন্ধে কথা এই, কবে আমি ফিরে যাচ্ছি—জানি না। আমি এখানে এবং ভারতে দু-জায়গাতেই কাজ করছি। মাঝে মাঝে কিছু কিছু টাকা পাঠাতে পারব, এই পর্যন্ত সাহায্য করতে পারি। তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
১৪১*
[লালা গোবিন্দ সহায়কে লিখিত]
C/o. জি. ডবলিউ. হেল, এস্কোয়ার
চিকাগো
১৮৯৪
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
আমার কলিকাতার গুরুভ্রাতাগণের সহিত তোমার পত্রব্যবহার আছে কি? তুমি চরিত্রে, আধ্যাত্মিকতায় এবং সাংসারিক ব্যাপারে বেশ উন্নতি করিতেছ তো? হয়তো শুনিয়া থাকিবে—কিভাবে প্রায় বৎসরাধিক কাল আমি আমেরিকায় হিন্দুধর্ম প্রচার করিতেছি। এখানে বেশ ভালই আছি। যত শীঘ্র পার এবং যতবার ইচ্ছা আমাকে চিঠি লিখিও।
সস্নেহ
বিবেকানন্দ
১৪২*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
১৮৯৪
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
… সাধুতাই শ্রেষ্ঠ নীতি, এবং পরিণামে ধার্মিক লোকের জয় হইবেই। … বৎস, সর্বদা মনে রাখিও আমি যতই ব্যস্ত, যতই দূরে অথবা যত উচ্চপদস্থ লোকের সঙ্গেই থাকি না কেন, আমি সর্বদাই আমার বন্ধুবর্গের প্রত্যেকের, সর্বাপেক্ষা সামান্যপদস্থ ব্যক্তির জন্যও প্রার্থনা করিতেছি এবং তাহাকে স্মরণ রাখিতেছি। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
১৪৩
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
১৮৯৪
কল্যাণবরেষু,
তোমাদের পত্র পাইয়া অতিশয় আনন্দিত হইলাম। মজুমদারের লীলা শুনিয়া বড়ই দুঃখিত। গুরুমারা বিদ্যে করতে গেলে ঐ-রকম হয়। আমার অপরাধ বড় নাই। মজুমদার দশ বংসর আগে এখানে এসেছিল—বড় খাতির ও সম্মান; এবার আমার পোয়াবারো। গুরুদেবের ইচ্ছা, আমি কি করিব? এতে চটে যাওয়া মজুমদারের ছেলেমানষি। যাক, উপেক্ষিতব্যং তদ্বচনং ভবৎসদৃশানাং মহাত্মনাম্। অপি কীটদংশনভীরুকাঃ বয়ং রামকৃষ্ণতনয়াঃ তদ্ধৃদয়রুধিরপোষিতাঃ? ‘অলোকসামান্যমচিন্ত্যহেতুকং নিন্দন্তি মন্দাশ্চরিতং মহাত্মনাং’ ইত্যাদয়ঃ সংস্মৃত্য ক্ষন্তব্যোঽয়ং জাল্মঃ মজুমদারাখ্যঃ।১৯ প্রভুর ইচ্ছা—এ দেশের লোকের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি প্রবোধিত হয়। মজুমদার-ফজুমদারের কর্ম তাঁর গতি রোধ করে? আমার নামের আবশ্যক নাই—I want to be a voice without a form.২০ হরমোহন প্রভৃতি কাহারও আমাকে সমর্থন করিবার আবশ্যক নাই—কোঽহং তৎপাদপ্রসরং প্রতিরোদ্ধুং সমর্থয়িতুং বা, কে বান্যে হরমোহনাদয়ঃ? তথাপি মম হৃদয়কৃতজ্ঞতা তান্ প্রতি। ‘যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে’—নৈষ প্রান্তবান্ তৎপদবীমিতি মত্বা করুণাদৃষ্ট্যা দ্রষ্টব্যোঽয়মিতি।২১ প্রভুর ইচ্ছায় এখনও নামযশের ইচ্ছা হৃদয়ে আসে নাই; বোধ হয় আসিবেও না। আমি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। তিনি এই যন্ত্রদ্বারা সহস্র সহস্র হৃদয়ে এই দূরদেশে ধর্মভাব উদ্দীপিত করিতেছেন। সহস্র সহস্র নরনারী এদেশে আমাকে অতিশয় স্নেহ প্রীতি ও ভক্তি করে, আর শত শত পাদ্রী ও গোঁড়া ক্রিশ্চান শয়তানের সহোদর মনে করে। মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্,২২ আমি তাঁহার কৃপায় আশ্চর্য! যে শহরে যাই, তোলপাড় হয়। এরা আমার নাম দিয়েছে—Cyclonic Hindu.২৩ তাঁর ইচ্ছা মনে রাখিও— I am a voice without a form (আমি অমূর্ত বাণী)।
ইংলণ্ডে যাব কি যমল্যাণ্ডে, প্রভু জানেন। তিনি সব যোগাড় করে দেবেন। এদেশে একটা চুরুটের দাম এক টাকা, একবার ঠিকাগাড়ী চড়লে ৩৲ টাকা, একটা জামার দাম ১০০৲ টাকা। ৯৲ টাকা রোজ হোটেল—প্রভু সব যুগিয়ে দেন। এদেশের সব বড় বড় লোকের বাড়ীতে যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছে। উত্তম খাওয়া-পরা সব আসছে—জয় প্রভু, আমি কিছু জানি না। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।’২৪ ‘বিগতভীঃ’ হওয়া চাই। কাপুরুষে ভয় করে, আত্মসমর্থন করে। কেহ যেন আমাকে সমর্থন করিতে অগ্রসর না হয়। মান্দ্রাজের খবর সব আমি মধ্যে মধ্যে পাই ও রাজপুতানার। ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে দিয়ে আমাকে অনেক ঠাট্টা করেছে—কার কথা কার মুখে দিয়ে! সব খবর পাচ্ছি। আর দাদা—এমন চক্ষু আছে, যা ৭০০০ ক্রোশ দূরে দেখে—এ কথা সত্য বটে। চুপে যেও, কালে কালে সব বেরুবে—যতটুকু তাঁর ইচ্ছা। তাঁর একটা কথাও মিথ্যে হয় না। দাদা, কুকুর-বেড়ালের ঝগড়া দেখে মানুষে কি দুঃখু করে? তেমনি সাধারণ মানুষের ঈর্ষা হিংসা গুঁতাগুঁতি দেখে তোমাদের মনে কোন ভাব হওয়া উচিত নয়। দাদা, আজ ছমাস থেকে বলছি যে, পর্দা হঠছে, সূর্যোদয় হচ্ছে। পর্দা উঠছে—উঠছে ধীরে ধীরে, slow but sure (ধীরে কিন্তু নিশ্চিত), কালে প্রকাশ। তিনি জানেন—‘মনের কথা কইব কি সই, কইতে মানা।’ দাদা, এ সব লিখিবার নহে, বলিবার নহে। আমার পত্র অন্য কেউ যেন না পড়ে, তোমরা ছাড়া। হাল ছেড় না, টিপে ধরে থেক—পাকড় ঠিক বটে, তাতে আর ভুল নাই—তবে পারে যাওয়া আজ আর কাল—এই মাত্র। দাদা, leader (নেতা) কি বানাতে পারা যায়? Leader জন্মায়। বুঝতে পারলে কিনা? লিডারি করা আবার বড় শক্ত—দাসস্য দাসঃ, হাজারো লোকের মন যোগান। Jealousy, selfishness (ঈর্ষা, স্বার্থপরতা) আদপে থাকবে না—তবে leader. প্রথম by birth (জন্মগত), দ্বিতীয় unselfish (নিঃস্বার্থ), তবে leader. সব ঠিক হচ্ছে, সব ঠিক আসবে, তিনি ঠিক জাল ফেলছেন, ঠিক জাল গুটাচ্ছেন—বয়মনুসরামঃ, বয়মনুসরামঃ, প্রীতিঃ পরমসাধনম্২৫ বুঝলে কিনা? Love conquers in the long run,২৬ দিক্ হলে চলবে না—wait, wait (অপেক্ষা কর, অপেক্ষা কর); সবুরে মেওয়া ফলবেই ফলবে। যোগেনের কথা কিছুই লেখ নাই। রাখাল-রাজা ঘুরে ফিরে পুনর্বৃন্দাবনং গচ্ছেদিতি। ...
তোমায় বলি ভায়া, যেমন চলছে চলতে দাও; তবে দেখো কোন form (বাহ্য অনুষ্ঠানপদ্ধতি) যেন necessary (একান্ত আবশ্যক) না হয়, unity in variety (বহুত্বে একত্ব)—সর্বজনীন ভাবের যেন কোনমতে ব্যাঘাত না হয়। Everything must be sacrificed, if necessary, for that one sentiment universality.২৭ আমি মরি আর বাঁচি, আর দেশে যাই বা না যাই, তোমরা বিশেষ করে মনে রাখবে যে, সর্বজনীনতা—perfect acceptance, not tolerance only, we preach and perform. Take care how you trample on the least rights of others.২৮ ঐ দিয়ে বড় বড় জাহাজডুবি হয়ে যায়। পূর্ণ ভক্তি গোঁড়ামি ছাড়া—এইটি দেখাতে হবে, মনে রেখো। তাঁর কৃপায় সব ঠিক চলবে। মঠ কেমন চলছে, উৎসব কেমন হল, গোপাল—বুড়ো ও হুটকো কোথায় কেমন, গুপ্ত কোথায় কেমন—সব লিখবে। মাষ্টার কি বলে? ঘোষজা কি বলে? রামদাদা ঠাণ্ডা ভাব পেয়েছে কি না? দাদা, সকলের ইচ্ছা যে leader (নেতা) হয়, কিন্তু সে যে জন্মায়—ঐটি বুঝতে না পারাতেই এত অনিষ্ট হয়। প্রভুর কৃপায় রামদাদা শীঘ্রই ঠাণ্ডা হবে ও বুঝতে পারবে। তাঁর কৃপা কাউকে ছাড়বে না। জি. সি. ঘোষ কি করছে?
আমাদের মাতৃকাগণ বেঁচে বর্তে আছে তো? গৌর-মা কোথা? এক হাজার গৌর-মার দরকার—ঐ noble stirring spirit (মহান্ ও উদ্দীপনাময় ভাব)। যোগেন-মা প্রভৃতি সকলে ভাল আছে বোধ হয়। ভায়া, আমার পেটটা এমন ফুলছে যে, কালে বোধ হয় দরজা টরজা কাটতে হবে। মহিম চক্রবর্তী কি করছে? তার ওখানে যাওয়া-আসা করিবে। লোকটা ভাল। আমরা সকলকে চাই—It is not at all necessary that all should have the same faith in our Lord as we have, but we want to unite all the powers of goodness against all the powers of evil.২৯ মহেন্দ্র মাষ্টারকে request from me (আমার তরফ থেকে অনুরোধ কর)। He can do it (তিনি এটা করতে পারবেন)। আমাদের একটা বড় দোষ—সন্ন্যাসের গরিমা। ওটা প্রথম প্রথম দরকার ছিল, এখন আমরা পেকে গেছি, ওটার আবশ্যক একেবারেই নাই। বুঝতে পেরেছ? সন্ন্যাসী আর গৃহস্থে কোন ভেদ থাকবে না, তবে যথার্থ সন্ন্যাসী। সকলকে ডেকে বুঝিয়ে দেবে—মাষ্টার, জি. সি. ঘোষ, রামদা, অতুল আর আর সকলকে নিমন্ত্রণ করে যে, ৫|৭টা ছোঁড়াতে মিলে, যাদের এক পয়সাও নাই, একটা কার্য আরম্ভ করলে—যা এখন এমন accelerated (ক্রমবর্ধমান) গতিতে বাড়তে চলল—এ হুজ্জুক, কি প্রভুর ইচ্ছা? যদি প্রভুর ইচ্ছা, তবে তোমরা দলাদলি jealousy (ঈর্ষা) পরিত্যাগ করে united action (সমবেতভাবে কার্য) কর। Shameful (লজ্জার কথা), আমরা universal religion (সর্বজনীন ধর্ম) করছি দলাদলি করে। যদি গিরিশ ঘোষ, মাষ্টার আর রামবাবু ঐটি করতে পারে, তবে বলি বাহাদুর আর বিশ্বাসী, নইলে মিছে nonsense (বাজে)।
সকলে যদি একদিন এক মিনিট বোঝে যে, আমি বড় হব বললেই বড় হওয়া যায় না, যাকে তিনি তোলেন সে উঠে, যাকে তিনি নীচে ফেলেন সে পড়ে যায়, তাহলে সকল ন্যাটা চুকে যায়। কিন্ত ঐ যে ‘অহং’—ফাঁকা ‘অহং’—তার আবার আঙ্গুল নাড়াবার শক্তি নাই, কিন্ত কাউকে উঠতে দেব না—বললে কি চলে? ঐ jealousy (ঈর্ষা), ঐ absence of conjoined action (সঙ্ঘবদ্ধভাবে কার্য করিবার শক্তির অভাব) গোলামের জাতের nature (স্বভাব); কিন্তু আমাদের ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করা উচিত। ঐ terrible jealousy characteristic (ভয়ানক চারিত্রিক বিশেষত্ব ঈর্ষা), আমাদের, বিশেষ বাঙ্গালীর। কারণ, we are the most worthless and superstitious and the most cowardly and lustful of all Hindus.৩০ পাঁচটা দেশ দেখলে ঐটি বেশ করে বুঝতে পারবে। আমাদের সমাত্মা এই গুণে এদের স্বাধীনতাপ্রাপ্ত কাফ্রীরা—যদি তাদের মধ্যে একজনও বড় হয়, অমনি সবগুলোয় পড়ে তার পিছু লাগে—white (শ্বেতাঙ্গ)-দের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাকে পেড়ে ফেলবার চেষ্টা করে। আমরাও ঠিক ঐ রকম। গোলাম কীটগুলো, এক পা নড়বার ক্ষমতা নাই—স্ত্রীর আঁচল ধরে তাস খেলে গুড়ুক ফুঁকে জীবনযাপন করে, আর যদি কেউ ঐগুলোর মধ্যে এক পা এগোয়, সবগুলো কেঁউ কেঁউ করে তার পিছু লাগে—হরে হরে ।
At any cost, any price, any sacrifice (ওর জন্য যতই ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে হোক) ঐটি আমাদের ভিতরে না ঢোকে—আমরা দশ-জন হই, দুজন হই do not care (কুছ পরোয়া নেই), কিন্তু ঐ কয়টা perfect characters (সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ চরিত্র) হওয়া চাই। আমাদের ভিতর যিনি পরস্পরের গুজুগুজু নিন্দা করবেন বা শুনবেন, তাকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। ঐ গুজুগুজু সকল নষ্টের গোড়া—বুঝতে পারছ কি? হাত ব্যথা হয়ে এল … আর লিখতে পারি না। ‘মাঙ্গনা ভালা না বাপ্সে যব্ রঘুবীর রাখে টেক্’। রঘুবীর টেক্ রাখবেন দাদা—সে বিষয় তোমরা নিশ্চিন্ত থেকো। বাঙলাদেশে তাঁর নাম প্রচার হল বা না হল, তাতে আমার অণুমাত্র চেষ্টা নাই—ওগুলো কি মানুষ! রাজপুতানা, পাঞ্জাব, N.W. (উত্তর-পশ্চিম) প্রদেশ,৩১ মান্দ্রাজ—ঐ সকল দেশে তাঁকে ছড়াতে হবে। রাজপুতানায় যেখানে ‘রঘুকুলরীতি সদা চলি আঈ। প্রাণ জাঈ বরু বচন ন জাঈ॥’—এখনও বাস করে।
পাখী উড়তে উড়তে এক জায়গায় পৌছায়, যেখান থেকে অত্যন্ত শান্তভাবে নীচের দিকে দেখে। সে জায়গায় পৌঁছেছে কি? যিনি সেখানে পৌঁছান নাই, তাঁর অপরকে শিক্ষা দিবার অধিকার নাই। হাত পা ছেড়ে দিয়ে ভেসে যাও—ঠিক পৌঁছে যাবে।
ঠাণ্ডার পো ধীরে ধীরে পালাচ্ছেন—শীতকাল কাটিয়ে দেওয়া গেল। শীতকালে এদেশে সর্বাঙ্গে electricity (তড়িৎ) ভরে যায়। Shake-hand (করমর্দন) করতে গেলে shock (ধাক্কা) লাগে আর আওয়াজ হয়—আঙুল দিয়ে গ্যাস জ্বালান যায়। আর শীতের কথা তো লিখেছি। সারা দেশটা দাবড়ে বেড়াচ্ছি, কিন্ত চিকাগো আমার ‘মঠ’—ঘুরে ফিরে আবার চিকাগোয় আসি। এখন পূর্বদিকে যাচ্ছি, কোথায় যে বেড়া পায়ে লাগবে, তিনি জানেন। মা-ঠাকরুন দেশে গেছেন; তাঁর শরীর বোধ হয় সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যলাভ করেছে।
তোমাদের কি করে চলছে, কে চালাচ্ছে? রামকৃষ্ণ,৩২ তার মা, তুলসীরাম প্রভৃতি বোধ হয় উড়িষ্যায়?
দমদম মাষ্টার কেমন আছে? দাশুর তোমাদের উপর সেই প্রীতি আছে কিনা? সে ঘন ঘন আসে কিনা? ভবনাথ কেমন আছে, কি করছে? তোমরা তার কাছে যাও কিনা—তোমরা তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি কর কিনা? হাঁ হে বাপু, সন্ন্যাসী-ফন্ন্যাসী মিছে কথা—মূকং করোতি, ইত্যাদি। বাবা, কার ভেতর কি আছে, বুঝা যায় না। তিনি ওকে বড় করেছেন—ও আমাদের পূজ্য। এত দেখে শুনেও যদি তোমাদের বিশ্বাস না হয়, ধিক তোমাদের! ভবনাথ তোমাদের ভালবাসে কিনা? তাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা প্রীতি ও ভালবাসা দিও। কালীকৃষ্ণবাবুকে আমার ভালবাসা দিও—তিনি অতি উন্নতচিত্ত ব্যক্তি। রামলাল কেমন আছে? তার একটু বিশ্বাস ভক্তি হয়েছে কিনা? তাকে আমার প্রীতিসম্ভাষণ দিও। সাণ্ডেল ঘানিতে ঠিক ঘুরছে বোধ হয়; ধৈর্য ধরিতে কহিবে—ঘানি ঠিক যাবে। সকলকে আমার হৃদয়ের প্রীতি।
অনুরাগৈকহৃদয়ঃ
নরেন্দ্র
পুঃ—মা-ঠাকুরাণীকে তাঁহার জন্মজন্মান্তরের দাসের পুনঃপুনঃ ধূল্যবলুণ্ঠিত সাষ্টাঙ্গ দিবে—তাঁহার আশীর্বাদ আমার সর্বতোমঙ্গল। ইতি
১৪৪
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
(মার্চ বা এপ্রিল), ১৮৯৪
কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্র পাইয়া সাতিশয় আহ্লাদিত হইলাম। তুমি খেতড়িতে থাকিয়া অনেক পরিমাণে স্বাস্থ্যলাভ করিয়াছ, ইহা বড়ই আনন্দের বিষয়।
তারক দাদা মান্দ্রাজে অনেক কার্য করিয়াছেন—বড়ই আনন্দের কথা! তাঁহার সুখ্যাতি অনেক শুনিলাম মান্দ্রাজবাসীদের নিকট। রাখাল ও হরি লক্ষ্ণৌ হইতে এক পত্র লিখিয়াছে, তাহাদের শারীরিক কুশল। মঠের সকল সংবাদ অবগত হইলাম শশীর পত্রে।
রাজপুতানার স্থানে স্থানে ঠাকুরদের ভিতর ধর্মভাব ও পরহিতৈষণা বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিবে। কার্য করিতে হইবে। বসিয়া বসিয়া কার্য হয় না! মালসিসর আলসিসর আর যত ‘সর’ ওখানে আছে, মধ্যে মধ্যে পরিভ্রমণ করিতে থাক; আর সংস্কৃত, ইংরেজী সযত্নে অভ্যাস করিবে। গুণনিধি পাঞ্জাবে আছে বোধ হয়, তাহাকে আমার বিশেষ ভালবাসা জানাইয়া খেতড়িতে আনিবে ও তাহার সাহায্যে সংস্কৃত শিখিবে ও তাহাকে ইংরেজী শিখাইবে। যে প্রকারে পার, তাহার ঠিকানা আমায় দিবে। গুণনিধি অচ্যুতানন্দ সরস্বতী।
খেতড়ি শহরের গরীব নীচ জাতিদের ঘরে ঘরে গিয়া ধর্ম উপদেশ করিবে আর তাদের অন্যান্য বিষয়, ভূগোল ইত্যাদি মৌখিক উপদেশ করিবে। বসে বসে রাজভোগ খাওয়ায়, আর ‘হে প্রভু রামকৃষ্ণ’ বলায় কোন ফল নাই, যদি কিছু গরীবদের উপকার করিতে না পার। মধ্যে মধ্যে অন্য অন্য গ্রামে যাও, উপদেশ কর, বিদ্যা শিক্ষা দাও। কর্ম, উপাসনা, জ্ঞান—এই কর্ম কর, তবে চিত্তশুদ্ধি হইবে, নতুবা সব ভস্মে ঘৃত ঢালার ন্যায় নিষ্ফল হইবে। গুণনিধি আসিলে দুইজনে মিলিয়া রাজপুতানার গ্রামে গ্রামে গরীব দরিদ্রদের ঘরে ঘরে ফের। যদি মাংস খাইলে লোকে বিরক্ত হয়, তদ্দণ্ডেই ত্যাগ করিবে, পরোপকারার্থে ঘাস খাইয়া জীবন ধারণ করা ভাল। গেরুয়া কাপড় ভোগের জন্য নহে, মহাকার্যের নিশান—কায়মনোবাক্য ‘জগদ্ধিতায়’ দিতে হইবে। পড়েছ, ‘মাতৃদেবো ভব, পিতৃদেবো ভব’; আমি বলি, ‘দরিদ্রদেবো ভব, মূর্খদেবো ভব’। দরিদ্র, মূর্খ, অজ্ঞানী, কাতর—ইহারাই তোমার দেবতা হউক, ইহাদের সেবাই পরমধর্ম জানিবে। কিমধিকমিতি—
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
১৪৫
[অনাগারিক ধর্মপালকে লিখিত]
আমেরিকা
১৮৯৪
প্রিয় ধর্মপাল,
আমি তোমার কলিকাতার ঠিকানা ভুলে গিয়েছি, তাই মঠের ঠিকানায় এই পত্র পাঠালাম। আমি তোমার কলিকাতার বক্তৃতার কথা এবং উহা দ্বারা কিরূপ আশ্চর্য ফল হয়েছিল—সে সব শুনেছি।
… এখানকার জনৈক অবসরপ্রাপ্ত মিশনরী আমাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে একখানি পত্র লেখেন, তারপর তাড়াতাড়ি আমার সংক্ষিপ্ত উত্তরটি ছাপিয়ে একটা হুজুগ করবার চেষ্টা করেন। তবে তুমি অবশ্য জান, এখানকার লোকে এরূপ ভদ্রলোকদের কিরূপ ভেবে থাকে। আবার সেই মিশনরীটিই গোপনে আমার কতকগুলি বন্ধুর কাছে গিয়ে তাঁরা যাতে আমার কোন সহায়তা না করেন, সেই চেষ্টা করেন। অবশ্য তিনি তাঁদের কাছ থেকে নিছক ঘৃণাই পেয়েছেন। আমি এই লোকটার ব্যবহারে একেবারে অবাক হয়ে গেছি। একজন ধর্মপ্রচারকের এরূপ কপট ব্যবহার! দুঃখের বিষয়—প্রত্যেক দেশে, প্রত্যেক ধর্মেই এরূপ ভাব!
গত শীতকালে আমি এদেশে খুব বেড়িয়েছি—যদিও শীত অতিরিক্ত ছিল, আমার তত শীত বোধ হয়নি। মনে করেছিলাম—ভয়ানক শীত ভোগ করতে হবে, কিন্তু ভালয় ভালয় কেটে গেছে। ‘ফ্রি রিলিজিয়স সোসাইটি’র (Free Religious Society) সভাপতি কর্ণেল নেগিনসনকে তোমার অবশ্য স্মরণ আছে—তিনি খুব যত্নের সহিত তোমার খবরাখবর সব নিয়ে থাকেন। সেদিন অক্সফোর্ডের ডাঃ কার্পেণ্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। তিনি প্লীমাথে (plymouth) বৌদ্ধধর্মের নীতিতত্ত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতাটি বৌদ্ধধর্মের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ। তিনি তোমার এবং তোমার কাগজের সম্বন্ধে খোঁজ করলেন। আশা করি, তোমার মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। যিনি ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ এসেছিলেন, তুমি তাঁর উপযুক্ত দাস।
অবসরমত দয়া করে আমার সম্বন্ধে সব কথা লিখবে। তোমার কাগজে আমি সময়ে সময়ে ক্ষণিকের জন্য তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে থাকি। ‘ইণ্ডিয়ান মিররের’ মহানুভব সম্পাদক মহাশয় আমার প্রতি সমানভাবে অনুগ্রহ করে আসছেন—সেজন্য তাঁকে অনুগ্রহপূর্বক আমার পরম ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাবে।
কবে আমি এদেশ ছাড়ব জানি না। তোমাদের থিওসফিক্যাল সোসাইটির মিঃ জজ (Mr. Judge) ও অন্যান্য অনেক সভ্যের সহিত আমার পরিচয় হয়েছে। তাঁরা সকলেই খুব ভদ্র ও সরল, আর অধিকাংশই বেশ শিক্ষিত।
মিঃ জজ খুব কঠোর পরিশ্রমী—তিনি থিওসফি প্রচারের জন্য সম্পূর্ণরূপে জীবন সমর্পণ করেছেন। এদেশে তাঁদের ভাব লোকের ভিতর খুব প্রবেশ করেছে, কিন্তু গোঁড়া ক্রিশ্চানরা তাঁদের পছন্দ করে না। সে তো তাদেরই ভুল। ছয় কোটি ত্রিশ লক্ষ লোকের মধ্যে এক কোটি নব্বই লক্ষ লোক কেবল খ্রীষ্টধর্মের কোন না কোন শাখার অন্তর্ভুক্ত। ক্রিশ্চানগণ বাকী লোকদের কোনরকম ধর্মই দিতে পারেন না। যাদের আদতে কোন ধর্ম নেই, থিওসফিষ্টরা যদি তাদের কোন না কোন আকারে ধর্ম দিতে কৃতকার্য হন, তাতে গোঁড়াদেরই বা আপত্তির কারণ কি, তা তো বুঝতে পারি না। কিন্তু খাঁটি গোঁড়া খ্রীষ্টধর্ম এদেশ হতে দ্রুতগতিতে উঠে যাচ্ছে। এখানে খ্রীষ্টধর্মের যে রূপ দেখতে পাওয়া যায়, তা ভারতের খ্রীষ্টধর্ম হতে এত তফাত যে, বলবার নয়। ধর্মপাল, তুমি শুনে আশ্চর্য হবে যে, এদেশে এপিস্কোপ্যাল ৩৩ এমন কি, প্রেসবিটেরিয়ান৩৪ চার্চের ধর্মাচার্যদের মধ্যে আমার অনেক বন্ধু আছেন। তাঁরা তোমারই মত উদার, আবার তাঁদের নিজের ধর্ম অকপটভাবে বিশ্বাস করেন। প্রকৃত ধার্মিক লোক সর্বত্রই উদার হয়ে থাকেন। অন্তরের প্রেমই তাঁকে উদার হতে বাধ্য করে। কেবল যাদের কাছে ধর্ম একটা ব্যবসামাত্র, তারাই ধর্মের ভিতর সংসারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিবাদ ও স্বার্থপরতা এনে ব্যবসার খাতিরে এরূপ সঙ্কীর্ণ ও অনিষ্টকারী হতে বাধ্য হয়।
তোমার চিরভ্রাতৃপ্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
১৪৬*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
একটা পুরানো গল্প শোন। একটা লোক রাস্তা চলতে চলতে একটা বুড়োকে তার দরজার গোড়ায় বসে থাকতে দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে—‘ভাই, অমুক গ্রামটা এখান থেকে কতদূর?’ বুড়োটা কোন জবাব দিলে না। তখন পথিক বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কিন্তু বুড়ো তবু চুপ করে রইল। পথিক তখন বিরক্ত হয়ে আবার রাস্তায় গিয়ে চলবার উদ্যোগ করলে। তখন বুড়ো দাঁড়িয়ে উঠে পথিককে সম্বোধন করে বললে, ‘আপনি অমুক গ্রামটার কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন—সেটা এই মাইল-খানেক হবে।’ তখন পথিক তাকে বললে, ‘তোমাকে এই একটু আগে কতবার ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, তখন তো তুমি একটা কথাও কইলে না—এখন যে বলছ, ব্যাপারখানা কি?’ তখন বুড়ো বললে, ‘ঠিক কথা। কিন্তু প্রথম যখন জিজ্ঞাসা করছিলেন, তখন চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন, আপনার যে যাবার ইচ্ছে আছে, ভাব দেখে তা বোধ হচ্ছিল না—এখন হাঁটতে আরম্ভ করেছেন, তাই আপনাকে বললাম।’
হে বৎস, এই গল্পটা মনে রেখো। কাজ আরম্ভ করে দাও, বাকী সব আপনা-আপনি হয়ে যাবে। গীতায় ভগবান্ বলেছেন—
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্॥ (গীতা, ৯।২২)
অর্থাৎ যারা আর কারও ওপর নির্ভর না করে কেবল আমার ওপর নির্ভর করে থাকে, তাদের যা কিছু দরকার, সব আমি যুগিয়ে দিই।
ভগবানের এ কথাটা তো আর স্বপ্ন বা কবিকল্পনা নয়।
প্রথম কথা হচ্ছে, আমি সময়ে সময়ে তোমায় অল্প স্বল্প করে টাকা পাঠাব। কারণ, প্রথম কলিকাতাতেও আমাকে ঐরকম কিছু কিছু টাকা—বরং মান্দ্রাজের চেয়ে কিছু বেশীই—পাঠাতে হবে। সেখানে আন্দোলন আমার ওপর নির্ভর করে শুধু যে শুরু হয়েছে তা নয়, উদ্দাম বেগে চলেছে। তাদের আগে দেখতে হবে। দ্বিতীয়তঃ কলিকাতা অপেক্ষা মান্দ্রাজে সাহায্য পাবার আশা বেশী আছে। আমার ইচ্ছা—এই দুটো কেন্দ্রই একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করুক। এখন কিছু পূজা পাঠ প্রচার—এই ভাবেই কাজ আরম্ভ করে দিতে হবে। সকলের মেলবার একটা জায়গা কর, সেখানে প্রতিসপ্তাহে কোনরকম একটু পূজা-আর্চা করে সভাষ্য উপনিষদ্ পাঠ হোক—এইরূপে আস্তে আস্তে কাজ আরম্ভ করে দাও। একবার চাকায় হাত লাগাও দেখি—চাকাটি ঠিক ঘুরে যাবে।
‘মিররে’ অভিনন্দনটা ছাপা হয়েছে, দেখলাম—ওরা যে এটা ভালভাবে নিয়েছে, তা ভালই। যার শেষ ভাল, তার সব ভাল।
এখন কাজে লাগ দেখি। জি. জি-র প্রকৃতিটা ভাবপ্রবণ, তোমার মাথা ঠাণ্ডা—দুজনে এক সঙ্গে মিলে কাজ কর। ঝাঁপ দাও—এই তো সবে আরম্ভ। আমেরিকার টাকায় হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের আশা অসম্ভব—প্রত্যেক জাতকে নিজেকে নিজে উদ্ধার করতে হবে। মহীশূরের মহারাজা, রামনাদের রাজা ও আর আর কয়েকজনকে এই কাজের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন করবার চেষ্টা কর। ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ আরম্ভ করে দাও। মান্দ্রাজে একটা জায়গা নেবার চেষ্টা কর—একটা কেন্দ্র যদি করতে পারা যায়, সেইটে একটা মস্ত জিনিষ হল, তারপর সেখান থেকে ছড়াতে থাক। ধীরে ধীরে কাজ আরম্ভ কর—প্রথমটা কয়েকজন গৃহস্থ প্রচারক নিয়ে কাজ আরম্ভ কর, ক্রমশঃ এমন লোক পাবে, যারা এই কাজের জন্য সারা জীবন দেবে। কারও ওপর হুকুম চালাবার চেষ্টা করো না—যে অপরের সেবা করতে পারে, সেই যথার্থ সর্দার হতে পারে। যত দিন না শরীর যাচ্ছে, অকপটভাবে কাজে লেগে থাক। আমার কাজ চাই—নামযশ টাকাকড়ি কিছু চাই না। কাজের আরম্ভটা যখন এমন সুন্দর হয়েছে, তখন তোমরা যদি কিছু না করতে পার, তবে তোমাদের ওপর আমার আর কিছু মাত্র বিশ্বাস থাকবে না। আমাদের আরম্ভটা বেশ সুন্দর হয়েছে। ভরসায় বুক বাঁধ। জি.জি-কে তো তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কিছু করতে হয় না—সে কেন মান্দ্রাজে একটা জায়গার জন্য যাতে কিছু টাকার যোগাড় হয়, সেই উদ্দেশ্যে লোককে একটু তাতায় না? মান্দ্রাজে একটা কেন্দ্র হয়ে গেলে তারপর চারিদিকে কার্যক্ষেত্র বিস্তার করতে থাক। এখন সপ্তাহে একত্র হওয়া; একটু স্তব হল, কিছু শাস্ত্রপাঠ হল—তাহলেই যথেষ্ট। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ হও—তাহলেই সিদ্ধি নিশ্চিত।
নিজেদের কাজে স্বাধীনতা না হারিয়ে কলিকাতার ভ্রাতৃবর্গের ওপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাভক্তি দেখাবে—কারণ, তারা যে সন্ন্যাসী।
কার্যসিদ্ধির জন্য আমার ছেলেদের আগুনে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এখন কেবল কাজ, কাজ, কাজ—বছর কতক বাদে স্থির হয়ে কে কতদূর করলে মিলিয়ে তুলনা করে দেখা যাবে। ধৈর্য, অধ্যবসায় ও পবিত্রতা চাই।
… এখন আমি হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কোন বই লিখছি না—এখন কেবল নিজের ভাবগুলো টুকে যাচ্ছি মাত্র—জানি না কবে সেগুলো পুস্তকাকারে নিবদ্ধ করে প্রকাশ করব।
বইএ আছে কি? জগৎ তো ইতোমধ্যেই নানা বাজে বইরূপ আবর্জনাস্তূপে ভরে গেছে। কাগজটা বার করবার চেষ্টা করো, তাতে কারও সমালোচনার দরকার নেই। তোমার যদি কিছু ভাব দেবার থাকে তা শিক্ষা দাও, তার ওপর আর এগিও না। তোমার যা ভাব দেবার থাকে দিয়ে যাও, বাকী প্রভু জানেন। মিশনরীদের এখানে কে গ্রাহ্য করে? তারা বিস্তর চেঁচিয়ে এখন থেমেছে। আমি তাদের নিন্দাবাদ লক্ষ্যই করি না, আর তাতে আমার ওপর সাধারণের ধারণা ভালই হয়েছে। আমাকে আর খবরের কাগজ পাঠিও না—যথেষ্ট এসেছে। কাজটা যাতে চলে, তার জন্য একটু চাউর হওয়ার দরকার হয়েছিল—খুব হয়ে গেছে। দেখ না অন্যান্য দলেরা কেমন এক রকম বিনা ভিত্তিতেই গড়ে তুলেছে। আর তোমাদের এমন সুন্দর আরম্ভ হয়েও তোমরা যদি কিছু করতে না পার, তবে আমি বড়ই নিরাশ হব। তোমরা যদি আমার সন্তান হও, তবে তোমরা কিছুই ভয় করবে না, কিছুতেই তোমাদের গতিরোধ করতে পারবে না। তোমরা সিংহতুল্য হবে। ভারতকে—সমগ্র জগৎকে জাগাতে হবে। এ না করলে চলবে না, কাপুরুষতা চলবে না—বুঝলে? মৃত্যু পর্যন্ত অবিচলিতভাবে লেগে পড়ে থেকে আমি যেমন দেখাচ্ছি, করে যেতে হবে—তবে তোমার সিদ্ধি নিশ্চিত। আসল কথা হচ্ছে গুরুভক্তি, মৃত্যু পর্যন্ত গুরুর ওপর বিশ্বাস। তা কি তোমার আছে? যদি থাকে, আর আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি আছে—তাহলে তুমি জেনে রাখ যে, তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। অতএব কাজে লেগে যাও—তোমার সিদ্ধি নিশ্চিত। প্রতি পদক্ষেপেই আমার শুভ ইচ্ছা এবং আশীর্বাদ তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। মিলেমিশে কাজ কর, সকলের সঙ্গে ব্যবহারে অত্যন্ত সহিষ্ণু হও। সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে; আমি সর্বদা তোমাদের গতিবিধি লক্ষ্য রাখছি। এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও। এই তো সবে আরম্ভ। এখানে একটু হইচই হলে ভারতে তার প্রবল প্রতিধ্বনি হয়। বুঝলে? সুতরাং তাড়াহুড়ো করে এখান থেকে চলে যাবার আমার দরকার নেই। আমাকে এখানে স্থায়ী একটা কিছু করে যেতে হবে—সেইটে আমি এখন ধীরে ধীরে করছি। দিন দিন আমার প্রতি এখানকার লোকের বিশ্বাস বাড়ছে। তোমাদের বুকের ছাতিটা খুব বেড়ে যাক। সংস্কৃত ভাষা বিশেষতঃ বেদান্তের তিনটে ভাষ্য অধ্যয়ন কর। প্রস্তুত হয়ে থাক। আমার অনেক রকম কাজ করবার মতলব আছে। উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা যাতে করতে পার, তার চেষ্টা কর। যদি তোমার বিশ্বাস থাকে, তবে তোমার সব শক্তি আসবে। কিডিকে এবং ওখানে আমার সকল সন্তানকে এই কথা বলো। তারা সকলেই বড় বড় কাজ করবে—দুনিয়া তা দেখে তাক লেগে যাবে। বুকে ভরসা বেঁধে কাজে লেগে যাও। তোমরা কিছু করে আমায় দেখাও; একটা মন্দির, একটা ছাপাখানা, একখানা কাগজ, থাকবার জন্য একখানা বাড়ী করে আমায় দেখাও। যদি মান্দ্রাজে আমার জন্য একখানা বাড়ী করতে না পার তো কোথায় গিয়ে থাকব? লোকের ভেতর বিদ্যুৎবেগে শক্তি সঞ্চার কর। টাকা ও প্রচারক যোগাড় কর। তোমাদের যা জীবনের ব্রত করেছ, তাতে দৃঢ়ভাবে লেগে থাক। এ পর্যন্ত যা করেছ, খুব ভালই হয়েছে। আরও ভাল কর, তার চেয়ে ভাল কর—এইরূপে এগিয়ে চল, এগিয়ে চল। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, এই পত্রের উত্তরে তুমি লিখবে যে, তোমরা কিছু করেছ। কারও সঙ্গে বিবাদ করো না, কারও বিরুদ্ধে লেগো না। রামা শ্যামা খ্রীষ্টান হয়ে যাচ্ছে, এতে আমার কি এসে যায়? তারা যা খুশী তাই হোক না। কেন বিবাদ-বিসংবাদের ভেতর মিশবে? যার যা ভাবই হোক না কেন, সকলের সকল কথা ধীরভাবে সহ্য কর। ধৈর্য, পবিত্রতা ও অধ্যবসায়ের জয় হবে। ইতি—
তোমাদের
বিবেকানন্দ
১৪৭*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]
আমেরিকা
১৮৯৪
… জনৈক সংস্কৃত কবি বলিয়াছেন, ‘ন গৃহং গৃহমিত্যাহুর্গৃহিণী গৃহমুচ্যতে’—গৃহকে গৃহ বলে না, গৃহিণীকেই গৃহ বলা হয়, ইহা কত সত্য! যে গৃহছাদ তোমায় শীত গ্রীষ্ম বর্ষা হইতে রক্ষা করিয়া থাকে, তাহার দোষগুণ বিচার করিতে হইলে উহা যে স্তম্ভগুলির উপর দাঁড়াইয়া আছে, তাহা দেখিলে চলিবে না—হউক না সেগুলি অতি মনোহর কারুকার্যময় ‘করিন্থিয়ান’ স্তম্ভ। উহার বিচার করিতে হইবে গৃহের কেন্দ্রস্থানীয় সেই চৈতন্যময় প্রকৃত স্তম্ভের দ্বারা, যাহা গৃহস্থালীর প্রকৃত অবলন্বন—আমি নারীগণের কথা বলিতেছি। সেই আদর্শের দ্বারা বিচার করিলে আমেরিকার পারিবারিক জীবন জগতের যে-কোন স্থানের পারিবারিক জীবনের সহিত তুলনায় হীনপ্রভ হইবে না।
আমি আমেরিকার পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে অনেক বাজে গল্প শুনিয়াছি—শুনিয়াছি সেখানে নাকি নারীগণের চালচলন নারীর মত নহে, তাহারা নাকি স্বাধীনতা-তাণ্ডবে উন্মত্ত হইয়া পারিবারিক জীবনের সকল সুখশান্তি পদদলিত করিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ করে, এবং আরও ঐ প্রকারের নানা আজগুবি কথা শুনিয়াছি। কিন্তু একবৎসর কাল আমেরিকার পরিবার ও আমেরিকার নরনারীগণের সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া দেখিতেছি, ঐপ্রকার মতামত কি ভয়ঙ্কর অমূলক ও ভ্রান্ত! আমেরিকার নারীগণ! তোমাদের ঋণ আমি শত জন্মেও পরিশোধ করিতে পারিব না। তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করিয়া উঠিতে পারি না। প্রাচ্য অতিশয়োক্তিই প্রাচ্য মানবের সুগভীর কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপনের একমাত্র উপযুক্ত ভাষা—
‘অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জলং সিন্ধুপাত্রে
সুরতুরুবরশাখা লেখনী পত্রমুর্বী।
লির্খতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং—’৩৫
‘যদি সাগর মস্যাধার, হিমালয় পর্বত মসী, পারিজাতশাখা লেখনী, পৃথিবী পত্র হয়, এবং স্বয়ং সরস্বতী লেখিকা হইয়া অনন্তকাল লিখিতে থাকেন,’ তথাপি তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা-প্রকাশে অসমর্থ হইবে।
গত বৎসর গ্রীষ্মকালে আমি এক বহু দূরদেশ হইতে আগত, নাম-যশ-ধন-বিদ্যাহীন, বন্ধুহীন, সহায়হীন, প্রায় কপর্দকশূন্য পরিব্রাজক প্রচারকরূপে এদেশে আসি। সেই সময় আমেরিকার নারীগণ আমাকে সাহায্য করেন, আহার ও আশ্রয় দেন, তাঁহাদের গৃহে লইয়া যান, এবং আমাকে তাহাদের পুত্ররূপে, সহোদররূপে যত্ন করেন। যখন তাঁহাদের নিজেদের যাজককুল এই ‘বিপজ্জনক বিধর্মী’কে৩৬ ত্যাগ করিবার জন্য তাঁহাদিগকে প্ররোচিত করিতেছিলেন, যখন তাঁহাদের সর্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ বন্ধুগণ এই ‘অজ্ঞাতকুলশীল বিদেশীর, হয়তো বা সাংঘাতিক চরিত্রের লোকটির’ সঙ্গ ত্যাগ করিতে উপদেশ দিতেছিলেন, তখনও তাঁহারা আমার বন্ধুরূপে বর্তমান ছিলেন। এই মহামনা নিঃস্বার্থ পবিত্র নারীগণই—চরিত্র ও অন্তঃকরণ সম্বন্ধে বিচার করিতে অধিকতর নিপুণা, কারণ নির্মল দর্পণেই প্রতিবিম্ব পড়িয়া থাকে ।
কত শত সুন্দর পারিবারিক জীবন আমি দেখিয়াছি; কত শত জননী দেখিয়াছি, যাঁহাদের নির্মল চরিত্রের, যাঁহাদের নিঃস্বার্থ অপত্যস্নেহের বর্ণনা করিবার ভাষা আমার নেই। কত শত কন্যা ও কুমারী দেখিয়াছি, যাহারা ‘ডায়না দেবীর ললাটস্থ তুষারকণিকার ন্যায় নির্মল’—আবার বিলক্ষণ শিক্ষিতা এবং সর্বাধিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতিসম্পন্না। তবে কি আমেরিকার নারীগণ সকলেই দেবীস্বরূপা? তাহা নহে, ভাল মন্দ সকল স্থানেই আছে। কিন্তু যাদের আমরা অসৎ নামে অভিহিত করি, জাতির সেই দুর্বল মানুষগুলির দ্বারা সে সম্বন্ধে ধারণা করিলে চলিবে না; কারণ উহারা তো আগাছার মত পড়িয়াই থাকে। যাহা সৎ উদার ও পবিত্র, তাহা দ্বারাই জাতীয় জীবনের নির্মল ও সতেজ প্রবাহ নিরূপিত হয়।
একটি আপেল গাছ ও তাহার ফলের গুণাগুণ বিচার করিতে হইলে কি যে-সকল অপক্ব অপরিণত কীটদষ্ট ফল মাটিতে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়িয়া থাকে, তাহাদের সাহায্য লও যদিও কখনও কখনও তাহারাই সংখ্যায় অধিক? যদি একটি সুপক্ব ও পরিপুষ্ট ফল পাওয়া যায়, তবে সেই একটির দ্বারাই ঐ আপেল গাছের শক্তি সম্ভাবনা ও উদ্দেশ্য অনুমিত হয়, যে শত শত ফল অপরিণত রহিয়া গিয়াছে, তাহাদের দ্বারা নহে।
তারপর, আমি আমেরিকার আধুনিক রমণীগণের উদার মনের প্রশংসা করি। আমি এদেশে অনেক উদারমনা পুরুষও দেখিয়াছি, তাঁহাদের মধ্যে কেহ আবার অত্যন্ত সঙ্কীর্ণভাবাপন্য সম্প্রদায়ের। তবে একটি প্রভেদ আছে—পুরুষগণের পক্ষে একটি বিপদাশঙ্কা এই যে, তাঁহারা উদার হইতে গিয়া নিজেদের ধর্ম খোয়াইয়া বসিতে পারেন, কিন্তু নারীগণ যেখানে যাহা কিছু ভাল আছে, তাহার প্রতি সহানুভূতিহেতু উদারতা লাভ করিয়া থাকেন, অথচ নিজেদের ধর্ম হইতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না। তাঁহারা প্রাণে প্রাণে স্বতই অনুভব করেন যে, ধর্ম একটি ইতিবাচক (positive) ব্যাপার, নেতিবাচক (negative) নহে; যোগের ব্যাপার, বিয়োগের নহে। তাঁহারা প্রতিদিন এই সত্যটি হুদয়ঙ্গম করিতেছেন যে, প্রত্যেক জিনিষের হাঁ-এর দিকটাই, ইতিবাচক দিকটাই সঞ্চিত থাকে এবং প্রকৃতির এই অস্তিবাচক—এবং এই হেতু গঠনমূলক শক্তিসমূহের একীকরণ দ্বারাই পৃথিবীর নাস্তিবাচক ভাবগুলি বিনষ্ট হইয়া থাকে।
চিকাগোর এই বিশ্ব-মহামেলা কী অদ্ভুত ব্যাপার! আর সেই ধর্মমহামেলা, যাহাতে পৃথিবীর সকল দেশ হইতে লোক আসিয়া নিজ নিজ ধর্মমত ব্যক্ত করিয়াছিল, তাহাও কী অদ্ভুত! ডাক্তার ব্যারোজ ও মিঃ বনির অনুগ্রহে আমিও আমার ভাবগুলি সর্বসমক্ষে উপস্থাপিত করিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম। মিঃ বনি কী অদ্ভুত লোক! একবার ভাবিয়া দেখ দেখি, তিনি কিরূপ দৃঢ়চেতা ব্যক্তি, যিনি মানসনেত্রে এই বিরাট অনুষ্ঠানটির কল্পনা করিয়াছিলেন এবং উহাকে কার্যে পরিণত করিতেও প্রভূত সফলতা লাভ করিয়াছিলেন। তিনি আবার যাজক ছিলেন না; তিনি নিজে একজন উকিল হইয়াও যাবতীয় ধর্মসম্প্রদায়ের পরিচালকগণের নেতা ছিলেন। তিনি মধুরস্বভাব, বিদ্বান ও সহিষ্ণু ছিলেন—তাঁহার হৃদয়ের গভীর মর্মস্পর্শী ভাবসমূহ তাঁহার উজ্জ্বল নয়নদ্বয়ে ব্যক্ত হইত। … ইতি
বিবেকানন্দ
১৪৮
[স্বামী অভেদানন্দকে লিখিত]
আমেরিকা
(নভেম্বর), ১৮৯৪
প্রিয় কালী,
তোমার পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। ‘ট্রিবিউন’ পত্রে উক্ত টেলিগ্রাফ বাহির হওয়ার কোন সংবাদ পাই নাই। চিকাগো নগর ছয়মাস যাবৎ ত্যাগ করিয়াছি, এখনও যাইবার সাবকাশ নাই; এজন্য বিশেষ খবর লইতে পারি নাই। তোমার পরিশ্রম অত্যন্ত হইয়াছে, তার জন্য তোমায় কি ধন্যবাদই বা দিই? অদ্ভুত কার্যক্ষমতা তোমরা দেখাইয়াছ। ঠাকুরের কথা কি মিথ্যা হয়? তোমাদের সকলের মধ্যে অদ্ভুত তেজ আছে। শশী সাণ্ডেলের বিষয় পূর্বেই লিখিয়াছি। ঠাকুরের কৃপায় কিছু চাপা থাকে না। তবে তিনি সম্প্রদায়স্থাপনাদি করুন, হানি কি? ‘শিবা বঃ সন্তু পন্থানঃ’৩৭। দ্বিতীয়তঃ তোমার পত্রের মর্ম বুঝিলাম না।আমি অর্থসংগ্রহ করিয়া আপনাদের মঠ স্থাপন করিব, ইহাতে যদি লোকে নিন্দা করে তো আমার কোন ক্ষতিবৃদ্ধি দেখি না। কূটস্থ বুদ্ধি তোমাদের আছে, কোন হানি হইবে না। তোমাদের পরস্পরের উপর নিরতিশয় প্রেম থাকুক, ইতর-সাধারণের উপর উপেক্ষাবুদ্ধি ধারণ করিলেই যথেষ্ট। কালীকৃষ্ণবাবু অনুরাগী ও মহৎ ব্যক্তি। তাঁহাকে আমার বিশেষ প্রণয় কহিও। যতদিন তোমরা পরস্পরের উপর ভেদবুদ্ধি না করিবে, ততদিন প্রভুর কৃপায় ‘রণে বনে পর্বতমস্তকে বা’ তোমাদের কোন ভয় নাই। ‘শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি’,৩৮ ইহা তো হইবেই। অতি গম্ভীর বুদ্ধি ধারণ কর। বালবুদ্ধি জীবে কে বা কি বলিতেছে, তাহার খবরমাত্রও লইবে না। উপেক্ষা, উপেক্ষা, উপেক্ষা ইতি।
শশীকে পূর্বে লিখিয়াছি সবিশেষ। খবরের কাগজ, পুস্তকাদি পাঠাইও না। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে—দেশেও ঘুরে মরা, এদেশেও তাই, বাড়ার ভাগ বোঝা বওয়া। এদেশে আমি কেমন করে লোকের পুস্তকের খদ্দের জোটাই বল? আমি একটা সাধারণ মানুষ বৈ নয়। এদেশের খবরের কাগজ প্রভৃতিতে যাহা কিছু আমার বিষয় লেখে, আমি তাহা অগ্নিদেবকে সমর্পণ করি। তোমরাও তাহাই কর। তাহাই ব্যবস্থা।
ঠাকুরের কাজের জন্য একটু হাঙ্গামের দরকার ছিল, তা হয়ে গেছে, বেশ কথা; এক্ষণে ইতরগুলো কি বকে না বকে, তাতে কোন রকমে তোমরা কর্ণপাত করিবে না। আমি টাকা রোজগার করি বা যা করি, হেঁজিপেঁজি লোকের কথায় কি তাঁর কাজ আটকাবে? ভায়া, তুমি এখন ছেলেমানুষ। আমার চুলে পাক ধরেছে। হেঁজিপেঁজি লোকদের কথায় আর মতামতের উপর আমার শ্রদ্ধা আঁচে বুঝে লও। তোমরা যতদিন কোমর বেঁধে এককাট্টা হয়ে আমার পিছে দাঁড়াবে, ততদিন পৃথিবী একত্র হলেও কোন ভয় নাই। ফলে এই পর্যন্ত বুঝিলাম যে, আমাকে অতি উচ্চ আসন গ্রহণ করিতে হইবে। তোমাদের ছাড়া আর কাহাকেও পত্র লিখিব না। ইতি।
বলি, গুণনিধি কোথায় আছে, খোঁজ করে তাকে মঠে যত্ন করে আনবার চেষ্টা করিবে। সে লোকটা অতি sincere (অকপট) ও বড়ই পণ্ডিত। তোমরা দুটো জায়গার ঠিকানা করবেই করবে, যে যা বলে, বলে যাক। খবরের কাগজে আমার স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষে কে কি লেখে, লিখুক; গ্রাহ্যমধ্যেই আনবে না। আর দাদা, বার বার ব্যাগত্তা করি,৩৯ আর ঝুড়ি ঝুড়ি খবরের কাগজাদি পাঠাইও না। বিশ্রাম এখন কোথায়? আমরা যখন শরীর ছেড়ে দিব, তখন কিছুদিন বিশ্রাম করিব। ভায়া, ঐ তেজে একবার মহোৎসব কর দিকি। রৈ রৈ হয়ে যাক। ওয়া বাহাদুর! সাবাস! নিধে পেলার দল প্রেমের তরঙ্গে ভেসে চলে যাবে।তোমরা হলে হাতী, পিঁপড়ের কামড়ে কি তোমাদের ভয়?
তোমার প্রেরিত Address (অভিনন্দন) অনেক দিন হল এসেছে এবং তার জবাবও চলে গেছে প্যারীবাবুর নিকট।
এই কথা মনে রেখো—দুটো চোখ, দুটো কান, কিন্তু একটা মুখ। উপেক্ষা, উপেক্ষা, উপেক্ষা। ‘ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি।’৪০ ভয় কার? কাদের ভয় রে ভাই? এখানে মিশনরী-ফিশনরী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ক্ষান্ত হয়ে গেছে—অমনি সকল জগৎ হবে।
‘নিন্দন্তু নীতিনিপুণাঃ যদি বা স্তুবন্তু
লক্ষ্মীঃ সমাবিশতু গচ্ছতু বা যথেষ্টম্।
অদ্যৈব বা মরণমস্তু শতান্তরে বা
ন্যায্যাৎ পথঃ প্রবিচলন্তি পদং ন ধীরাঃ॥’৪১
কিমধিকমিতি। হেঁজিপেঁজিদের সঙ্গে মেশবারও আবশ্যক নাই। ওদের কাছে ভিক্ষেও করতে হবে না। ঠাকুর সব জোটাচ্ছেন এবং জোটাবেন। ভয় কি রে ভাই? সকল বড় কাজ মহা বিঘ্নের মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। হে বীর ‘স্মর পৌরুষমাত্মনঃ উপেক্ষিতব্যাঃ জনাঃ সুকৃপণাঃ কামকাঞ্চনবশগাঃ।’৪২ এক্ষণে আমি এদেশে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ। অতএব আমার সহায়তার আবশ্যক নাই। কিন্তু আমার সহায়তা করিতে যাইয়া ভ্রাতৃস্নেহাৎ তোমাদের মধ্যে যে পৌরুষের আবির্ভাব হইয়াছে, তাহা প্রভুর কার্যে নিযুক্ত কর, এই তোমাদের নিকট আমার প্রার্থনা। মনের ভাব বিশেষ উপকার বোধ না হইলে প্রকাশ করিবে না। প্রিয় হিতবচন মহাশত্রুরও প্রতি প্রয়োগ করিবে।
হে ভাই, নামযশের ধনের ভোগের ইচ্ছা জীবের স্বতই আছে। তাহাতে যদি দুদিক চলে তো সকলেই আগ্রহ করিতে থাকে। ‘পরগুণ-পরমাণুং পর্বতীকৃত্য’ অপিচ, ত্রিভুবনের উপকারমাত্র ইচ্ছা মহাপুরুষেরই হয়। অতএব বিমূঢ়মতি অনাত্মদর্শী তমসাচ্ছন্নবুদ্ধি জীবকে বালচেষ্টা করিতে দাও। গরম ঠেকলেই আপনি পালিয়ে যাবে! চাঁদে থুথু ফেলবার চেষ্টা করুক; ‘শুভং ভবতু তেষাম্’ (তাদের মঙ্গল হউক)। যদি তাদের মধ্যে মাল থাকে, সিদ্ধি কে বারণ করতে পারে? যদি ঈর্ষাপরবশ হয়ে আস্ফালন মাত্র করে তো সব বৃথা হবে।
হরমোহন মালা পাঠিয়েছেন। বেশ কথা। বলি, এদেশে আমাদের দেশের মত ধর্ম চলে না। তবে এদের দেশের মত করে দিতে হয়। এদের হিন্দু হতে বললে এরা সকলে পালিয়ে যাবে ও ঘৃণা করবে, যেমন আমরা খ্রীষ্ট-মিশনরীদের ঘৃণা করি। তবে হিঁদুশাস্ত্রের কতক ভাব এরা ভালবাসে, এই পর্যন্ত। অধিক কিছুই নয় জানিবে। পুরুষেরা অধিকাংশই ধর্ম-টর্ম নিয়ে মাথা বকায় না, মেয়েদের মধ্যে কিছু কিছু, এইমাত্র—বাড়াবাড়ি কিছুই নাই। ২/৪ হাজার লোক অদ্বৈতমতের উপর শ্রদ্ধাবান। তবে পুঁথি, জাতি, মেয়েমানুষ নষ্টের গোড়া—ইত্যাদি বললে দূরে পালিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে সব হয়। Patience, purity, perseverance (ধৈর্য, পবিত্রতা, অধ্যবসায়)। ইতি—
নরেন্দ্র
১৪৯
[স্বামী শিবানন্দকে লিখিত]৪৩
আমেরিকা
১৮৯৪
প্রিয় শিবানন্দ,
এইমাত্র তোমার পত্র পেলাম। সম্ভবতঃ ইতোমধ্যে তুমি আমার অন্য চিঠিগুলি পেয়েছ এবং জেনেছ যে, আর আমেরিকায় কিছু পাঠাবার দরকার নাই। কোন কিছুরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। এই যে খবরের কাগজগুলো আমায় বাড়িয়ে তুলছে, তাতে আমার খ্যাতি হয়েছে সন্দেহ নাই, কিন্তু এর ফল এখানকার চেয়ে ভারতে বেশী। এখানে বরং রাতদিন খবরের কাগজে নাম বাজতে থাকলে উচ্চশ্রেণীর লোকদের মনে বিরক্তি জন্মায়; অতএব যথেষ্ট হয়েছে। এখন এই সকল সভার অনুসরণে ভারতে সঙ্ঘবদ্ধ হতে চেষ্টা কর। আর এদেশে কিছু পাঠাবার দরকার নাই। প্রথমে মাতাঠাকুরাণীর জন্য একটি জায়গা করবার দৃঢ়সঙ্কল্প করেছি, কারণ মেয়েদের জায়গাই প্রথম দারকার। … যদি মায়ের বাড়ীটি প্রথমে ঠিক হয়ে যায়, তাহলে আর আমি কোন কিছুর জন্য ভাবি না। … আমি ইতিপূর্বেই ভারতবর্ষে চলে যেতাম, কিন্তু ভারতবর্ষে টাকা নাই। হাজার হাজার লোক রামকৃষ্ণ পরমহংসকে মানে, কিন্তু কেউ একটি পয়সা দেবে না—এই হচ্ছে ভারতবর্ষ। এখানে লোকের টাকা আছে, আর তারা দেয়। আসছে শীতে আমি ভারতবর্ষে যাচ্ছি। ততদিন তোমরা মিলেমিশে থাক।
জগৎ উচ্চ উচ্চ নীতির (principles) জন্য আদৌ ব্যস্ত নয়; তারা চায় ব্যক্তি (person)। তারা যাকে পছন্দ করে, তার কথা ধৈর্যের সহিত শুনবে, তা যতই অসার হোক না কেন—কিন্তু যাকে তারা পছন্দ করে না, তার কথা শুনবেই না। এইটি মনে রেখো এবং লোকের সহিত সেইমত ব্যবহার করো। সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি শাসন করতে চাও, সকলের গোলাম হয়ে যাও। এই হল আসল রহস্য। কথাগুলি রুক্ষ হলেও ভালবাসায় ফল হবেই। যে-কোন ভাষার আবরণেই থাকুক না কেন, ভালবাসা মানুষ আপনা হতেই বুঝতে পারে।
ভায়া, রামকৃষ্ণ পরমহংস যে ভগবানের বাবা, তাতে আমার সন্দেহমাত্র নাই; তবে তিনি কি বলতেন, লোককে দেখতে দাও; তুমি জোর করে কি দেখাতে পার?—এইমাত্র আমার objection (আপত্তি)।
লোকে বলুক, আমরা কি বলব? দাদা, বেদ-বেদান্ত পুরাণ-ভাগবতে যে কি আছে, তা রামকৃষ্ণ পরমহংসকে না পড়লে কিছুতেই বুঝা যাবে না। His life is a searchlight of infinite power thrown upon the whole mass of Indian religious thought. He was the living commentary to the Vedas and to their aim. He had lived in one life the whole cycle of the national religious existence in India.৪৪
ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ জন্মেছিলেন কিনা, বুদ্ধ চৈতন্য প্রভৃতি একঘেয়ে, রামকৃষ্ণ পরমহংস the latest and the most perfect (সবচেয়ে আধুনিক এবং সবচেয়ে পূর্ণবিকশিত চরিত্র)—জ্ঞান, প্রেম, বৈরাগ্য, লোকহিতচিকীর্ষা, উদারতার জমাট; কারুর সঙ্গে কি তাঁহার তুলনা হয়? তাঁকে যে বুঝতে পারে না, তাঁর জন্ম বৃথা। আমি তাঁর জন্মজন্মান্তরের দাস, এই আমার পরম ভাগ্য, তাঁর একটা কথা বেদবেদান্ত অপেক্ষা অনেক বড়। তস্য দাস দাস-দাসোঽহং। তবে একঘেয়ে গোঁড়ামি দ্বারা তাঁর ভাবের ব্যাঘাত হয়—এইজন্য চটি। তাঁর নাম বরং ডুবে যাক—তাঁর উপদেশ (শিক্ষা) ফলবতী হোক। তিনি কি নামের দাস?
ভায়া, যীশুখ্রীষ্টকে জেলে-মালায় ভগবান্ বলেছিল, পণ্ডিতেরা মেরে ফেললে; বুদ্ধকে বেনে-রাখালে তাঁর জীবদ্দশায় মেনেছিল। রামকৃষ্ণকে জীবদ্দশায়—নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরির (ঊনবিংশ শতাব্দীর) শেষভাগে ইউনিভার্সিটির ভূত ব্রহ্মদত্যিরা ঈশ্বর বলে পূজা করেছে। … হাজার হাজার বৎসর পূর্বে তাঁদের (কৃষ্ণ, বুদ্ধ, খ্রীষ্ট প্রভৃতির) দু-দশটি কথা পুঁথিতে আছে মাত্র। ‘যার সঙ্গে ঘর করিনি, সেই বড় ঘরনী’—এ যে আজন্ম দিনরাত্রি সঙ্গ করেও তাঁদের চেয়ে ঢের বড় বলে বোধ হয়, এই ব্যাপারটা কি বুঝতে পার ভায়া?
মা-ঠাকরুন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে। ভায়া, শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না। আমাদের দেশ সকলের অধম কেন, শক্তিহীন কেন?—শক্তির অবমাননা সেখানে বলে। মা-ঠাকুরাণী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে। দেখছ কি ভায়া, ক্রমে সব বুঝবে। এইজন্য তাঁর মঠ প্রথমে চাই। রামকৃষ্ণ পরমহংস বরং যান, আমি ভীত নই। মা-ঠাকরাণী গেলে সর্বনাশ! শক্তির কৃপা না হলে কি ঘোড়ার ডিম হবে! আমেরিকা ইওরোপে কি দেখছি?—শক্তির পূজা, শক্তির পূজা। তবু এরা অজান্তে পূজা করে, কামের দ্বারা করে। আর যারা বিশুদ্ধভাবে, সাত্ত্বিকভাবে মাতৃভাবে পূজা করবে, তাদের কী কল্যাণ না হবে! আমার চোখ খুলে যাচ্ছে, দিন দিন সব বুঝতে পারছি। সেইজন্য আগে মায়ের জন্য মঠ করতে হবে। আগে মা আর মায়ের মেয়েরা, তারপর বাবা আর বাপের ছেলেরা, এই কথা বুঝতে পার কি?
সকলে ভাল, সকলকে আশীর্বাদ কর। দাদা, দুনিয়াময় তাঁর ঘর ছাড়া আর সকল জায়গাতেই যে ভাবের ঘরে চুরি! দাদা, রাগ করো না, তোমরা এখনও কেউ মাকে বোঝনি। মায়ের কৃপা আমার উপর বাপের কৃপার চেয়ে লক্ষ গুণ বড়। … ঐ মায়ের দিকে আমিও একটু গোঁড়া। মার হুকুম হলেই বীরভদ্র ভূতপ্রেত সব করতে পারে। তারক ভায়া, আমেরিকা আসবার আগে মাকে আশীর্বাদ করতে চিঠি লিখেছিলুম, তিনি এক আশীর্বাদ দিলেন, অমনি হুপ্ করে পগার পার, এই বুঝ। দাদা, এই দারুণ শীতে গাঁয়ে গাঁয়ে লেকচার করে লড়াই করে টাকার যোগাড় করছি—মায়ের মঠ হবে।
বাবুরামের মার বুড়োবয়সে বুদ্ধির হানি হয়েছে। জ্যান্ত দুর্গা ছেড়ে মাটির দুর্গা পূজা করতে বসেছে। দাদা, বিশ্বাস বড় ধন; দাদা, জ্যান্ত দুর্গার পূজা দেখাব, তবে আমার নাম। তুমি জমি কিনে জ্যান্ত দুর্গা মাকে যে দিন বসিয়া দেবে, সেই দিন আমি একবার হাঁফ ছাড়ব। তার আগে আমি দেশে যাচ্ছি না। যত শীঘ্র পারবে—। টাকা পাঠাতে পারলে আমি হাঁফ ছাড়ে বাঁচি; তোমরা যোগাড় করে এই আমার দুর্গোৎসবটি করে দাও দেখি। গিরিশ ঘোষ মায়ের পূজা খুব করছে, ধন্য সে, তার কুল ধন্য। দাদা, মায়ের কথা মনে পড়লে সময় সময় বলি, ‘কো রামঃ?’ দাদা, ও ঐ যে বলছি, ওইখানটায় আমার গোঁড়ামি।
রামকৃষ্ণ পরমহংস ঈশ্বর ছিলেন কি মানুষ ছিলেন, যা হয় বলো দাদা, কিন্তু যার মায়ের উপর ভক্তি নাই, তাকে ধিক্কার দিও।
নিরঞ্জন লাঠিবাজি করে, কিন্তু তার মায়ের উপর বড় ভক্তি। তার লাঠি হজম হয়ে যায়। নিরঞ্জন এমন কার্য করছে যে, তোমরা শুনলে অবাক হয়ে যাবে। আমি খবর রাখছি। তুমিও যে মান্দ্রাজীদের সঙ্গে যোগদান করে কার্য করছ, সে বড়ই ভাল। দাদা, তোমার উপর আমার ঢের ভরসা, সকলকে মিলেমিশে চালাও ভায়া। মায়ের জমিটা যেমন করেছ, অমনি আমি হুপ্ করে আসছি আর কি। জমিটা বড় চাই, building (বাড়ী) আপাততঃ মাটির ঘর ভাল, ক্রমে ভাল building (পাকা) তুলব, চিন্তা নাই।
ম্যালেরিয়ার প্রধান কারণ জল। দুটো তিনটে ফিলটার তৈয়ার কর না কেন? জল সিদ্ধ করে ফিলটার করলে কোন ভয় থাকে না।
হরিশের কথা তো কিছুই শুনতে পাই না। আর দক্ষরাজা কেমন আছে? সকলের বিশেষ খবর চাই। আমাদের মঠের চিন্তা নাই, আমি দেশে গিয়ে সব ঠিকঠাক করব।
দুটো বড় Pasteur's bacteria-proof (পাস্তুরের জীবাণু-প্রতিষেধক) ফিলটার কিনবে; সেই জলে রান্না, সেই জলে খাওয়া—ম্যালেরিয়ার বাপ পালিয়ে যাবে। … On and on; work, work, work; this is only the beginning. (এগিয়ে চল; কাজ, কাজ, কাজ; এই তো সবে আরম্ভ)।
কিমধিকমিতি—
বিবেকানন্দ
১৫০
[মঠে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৪
হে ভ্রাতৃবৃন্দ, ইতঃপূর্বে তোমাদের এক পত্র লিখি, সময়াভাবে তাহা অসম্পূর্ণ। রাখাল ও হরি লক্ষ্ণৌ হইতে এক পত্র লেখেন। তাঁহারা—হিন্দু খবরের কাগজরা আমার সুখ্যাতি করিতেছে, এই কথা লেখেন ও তাঁহারা বড় আনন্দিত যে, ২০ হাজার লোক খিচুড়ি খেয়েছে। যদি কলিকাতা অথবা মান্দ্রাজের হিন্দুরা সভা করে রিজলিউশন পাস করিত যে, ইনি আমাদের প্রতিনিধি এবং আমেরিকার লোকেদের অভিনন্দন করিত—আমাকে যত্ন করিয়াছে বলিয়া, তাহলে অনেক কাজ এগিয়ে যেত। কিন্তু এক বৎসর হয়ে গেল, কই কিছুই হল না! অবশ্য বাঙালীদের উপর আমার কিছুই ভরসা ছিল না; তবে মান্দ্রাজবাসীরাও কিছু করতে পারলে না। ...
আমাদের জাতের কোন ভরসা নাই। কোন একটা স্বাধীন চিন্তা কাহারও মাথায় আসে না—সেই ছেঁড়া কাঁথা, সকলে পড়ে টানাটানি—রামকৃষ্ণ পরমহংস এমন ছিলেন, তেমন ছিলেন; আর আষাঢ়ে গপ্পি—গপ্পির আর সীমা-সীমান্ত নাই। হরে হরে, বলি একটা কিছু করে দেখাও যে তোমরা কিছু অসাধারণ—খালি পাগলামি! আজ ঘণ্টা হল, কাল তার উপর ভেঁপু হল, পরশু তার ওপর চামর হল, আজ খাট হল, কাল খাটের ঠ্যাঙে রূপো বাঁধান হল—আর লোকে খিচুড়ি খেলে আর লোকের কাছে আষাঢ়ে গল্প ২০০০ মারা হল—চক্রগদা- পদ্মশঙ্খ—আর শঙ্খগদাপদ্মচক্র—ইত্যাদি, একেই ইংরেজীতে imbecility (শারীরিক ও মানসিক বলহীনতা) বলে—যাদের মাথায় ঐ রকম বেল্কোমো ছাড়া আর কিছু আসে না, তাদের নাম imbecile (ক্লীব)—ঘণ্টা ডাইনে বাজবে বা বাঁয়ে, চন্দনের টিপ মাথায় কি কোথায় পরা যায়—পিদ্দিম দুবার ঘুরবে বা চারবার—ঐ নিয়ে যাদের মাথা দিন রাত ঘামতে চায়, তাহাদেরই নাম হতভাগা; আর ঐ বুদ্ধিতেই আমরা লক্ষ্মীছাড়া জুতোখেকো, আর এরা ত্রিভুবন বিজয়ী। কুঁড়েমিতে আর বৈরাগ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।
যদি ভাল চাও তো ঘণ্টাফণ্টাগুলোকে গঙ্গার জলে সঁপে দিয়ে সাক্ষাৎ ভগবান্ নর-নারায়ণের—মানবদেহধারী হরেক মানুষের পূজো করগে—বিরাট আর স্বরাট। বিরাট রূপ এই জগৎ, তার পূজো মানে তার সেবা—এর নাম কর্ম; ঘণ্টার উপর চামর চড়ান নয়, আর ভাতের থালা সামনে ধরে দশ মিনিট বসব কি আধ ঘণ্টা বসব—এ বিচারের নাম ‘কর্ম’ নয়, ওর নাম পাগলা-গারদ। ক্রোর টাকা খরচ করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুরঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন, তো এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন, তো এই ঠাকুর আঁটকুড়ির বেটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন; এদিকে জ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা, বিদ্যা বিনা মরে যাচ্ছে। বোম্বায়ের বেনেগুলো ছারপোকার হাসপাতাল বানাচ্ছে—মানুষগুলো মরে যাক। তোদের বুদ্ধি নাই যে, এ-কথা বুঝিস—আমাদের দেশের মহা ব্যারাম—পাগলা-গারদ দেশময়।
যাক, তোমাদের মধ্যে যারা একটু মাথাওয়ালা আছে, তাঁদের চরণে আমার দণ্ডবৎ ও তাঁদের কাছে আমার এই প্রার্থনা যে, তাঁরা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ুন—এই বিরাটের উপাসনা প্রচার করুন, যা আমাদের দেশে কখনও হয় নাই। লোকের সঙ্গে ঝগড়া করা নয়, সকলের সঙ্গে মিশতে হবে। Idea (ভাব) ছড়া গাঁয়ে গাঁয়ে, ঘরে ঘরে যা—তবে যথার্থ কর্ম হবে। নইলে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা আর মধ্যে মধ্যে ঘণ্টা নাড়া, কেবল রোগ বিশেষ। … Independent (স্বাধীন) হ, স্বাধীন বুদ্ধি খরচ করতে শেখ্ … অমুক তন্ত্রের অমুক পটলে ঘণ্টার বাঁটের যে দৈর্ঘ্য দিয়েছে, তাতে আমার কি? প্রভুর ইচ্ছায় ক্রোর তন্ত্র, বেদ, পুরাণ তোদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। … যদি কাজ করে দেখাতে পারিস, যদি এক বৎসরের মধ্যে দু-চার লাখ চেলা ভারতে জায়গায় জায়গায় করতে পারিস, তবে বুঝি। তবেই তোদের উপর আমার ভরসা হবে, নইলে ইতি।
সেই যে বোম্বাই থেকে এক ছোকরা মাথা মুড়িয়ে তারকদার সঙ্গে রামেশ্বরে যায়, সে বলে, আমি রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য। রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য! না দেখা, না শোনা—একি চ্যাংড়াম নাকি? গুরুপরম্পরা ভিন্ন কোন কাজ হয় না—ছেলেখেলা নাকি? সে ছোঁড়াটা যদি দস্তুরমত পথে না চলে, দূর করে দেবে। গুরুপরম্পরা অর্থাৎ সেই শক্তি যা গুরু হতে শিষ্যে আসে, আবার তাঁর শিষ্যে যায়, তা ভিন্ন কিছুই হবার নয়। উড়ধা—আমি রামকৃষ্ণের শিষ্য, একি ছেলেখেলা নাকি? আমাকে জগমোহন বলেছিল যে, একজন বলে তোমার গুরুভাই, আমি এখন ঠাউরে ধরেছি, সেই ছোকরা। গুরুভাই কি রে? হাঁ, চেলা বলতে লজ্জা করে! একদম গুরু বন্বে! দূর করে দিও যদি দস্তুরমত পথে না চলে।
ঐ যে তুলসী ও খোকার মনের অশান্তি, তার মানে কোন কাজ নাই। ঐ যে নিরঞ্জনেরও—তার মানে কোন কাজ নাই। গাঁয়ে গাঁয়ে যা, ঘরে ঘরে যা; লোকহিত, জগতের কল্যাণ কর—নিজে নরকে যাও, পরের মুক্তি হোক—আমার মুক্তির বাপ নির্বংশ। নিজের ভাবনা যখনই ভাববে তুলসী, তখনি মনে অশান্তি। তোমার শান্তির দরকার কি বাবাজী? সব ত্যাগ করেছ, এখন শান্তির ইচ্ছা, মুক্তির ইচ্ছাটাকেও ত্যাগ করে দাও তো বাবা। কোন চিন্তা রেখো না; নরক স্বর্গ ভক্তি বা মুক্তি সব don't care (গ্রাহ্য করো না), আর ঘরে ঘরে নাম বিলোও দিকি বাবাজী। আপনার ভাল কেবল পরের ভালয় হয়, আপনার মুক্তি এবং ভক্তিও পরের মুক্তি ও ভক্তিতে হয়—তাইতে লেগে যাও, মেতে যাও, উন্মাদ হয়ে যাও। ঠাকুর যেমন তোমাদের ভালবাসতেন, আমি যেমন তোমাদের ভালবাসি, তোমরা তেমনি জগৎকে ভালবাস দেখি।
সকলকে একত্র কর। গুণনিধি কোথায়? তাকে তোমাদের কাছে আনবে। তাকে আমার অনন্ত ভালবাসা। গুপ্ত কোথা? সে আসতে চায় আসুক। আমার নাম করে তাকে ডেকে আনো। এই ক-টি কথা মনে রেখো—
১ | আমরা সন্ন্যাসী, ভক্তি ভুক্তি মুক্তি—সব ত্যাগ।
২ | জগতের কল্যাণ করা, আচণ্ডালের কল্যাণ করা—এই আমাদের ব্রত, তাতে মুক্তি আসে বা নরক আসে।
৩| রামকৃষ্ণ পরমহংস জগতের কল্যাণের জন্য এসেছিলেন। তাঁকে মানুষ বল বা ঈশ্বর বল বা অবতার বল, আপনার আপনার ভাবে নাও।
৪| যে তাঁকে নমস্কার করবে, সে সেই মুহূর্তে সোনা হয়ে যাবে। এই বার্তা নিয়ে ঘরে ঘরে যাও দিকি বাবাজী—অশান্তি দূর হয়ে যাবে। ভয় করো না—ভয়ের জায়গা কোথা? তোমরা তো কিছু চাও না—এতদিন তাঁর নাম, তোমাদের চরিত্র চারিদিকে ছড়িয়েছ, বেশ করেছ; এখন organised (সঙ্ঘবদ্ধ) হয়ে ছড়াও—প্রভু তোমাদের সঙ্গে, ভয় নাই।
আমি মরি আর বাঁচি, দেশে যাই বা না যাই, তোমরা ছড়াও, প্রেম ছড়াও। গুপ্তকেও এই কাজে লাগাও। কিন্তু মনে রেখো, পরকে মারতে ঢাল খাঁড়ার দরকার। ‘সন্নিমিত্তে বরং ত্যাগো বিনাশে নিয়তে সতি’—যখন মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, তখন সৎ বিষয়ের জন্য দেহত্যাগই শ্রেয়। ইতি
পুঃ—পূর্বের চিঠি মনে রেখো—মেয়ে-মদ্দ দু-ই চাই, আত্মাতে মেয়েপুরুষের ভেদ নাই। তাঁকে অবতার বললেই হয় না—শক্তির বিকাশ চাই। হাজার হাজার পুরুষ চাই, স্ত্রী চাই—যারা আগুনের মত হিমাচল থেকে কন্যাকুমারী—উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু, দুনিয়াময় ছড়িয়ে পড়বে। ছেলেখেলার কাজ নেই—ছেলেখেলার সময় নেই—যারা ছেলেখেলা করতে চায়, তফাত হও এই বেলা; নইলে মহা আপদ তাদের। Organisation (সঙ্ঘ) চাই—কুঁড়েমি দূর করে দাও, ছড়াও, ছড়াও; আগুনের মত যাও সব জায়গায়। আমার উপর ভরসা রেখো না, আমি মরি বাঁচি, তোমরা ছড়াও, ছড়াও। ইতি
নরেন্দ্র
১৫১
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৪
প্রাণাধিকেষু,
তারকদাদা ও হরির আগের লিখিত এক পত্র শেষে পাই। তাহাতে অবগত হইলাম যে, তাঁহারা কলিকাতায় আসিতেছেন। পূর্বের পত্রে সমস্ত জানিয়াছ। রামদয়ালবাবুর পত্র পাই। তথামত ছবি পাঠান হইবে। মা-ঠাকুরাণীর জন্য জমি খরিদ করিতে হইবে, তাহা ঠিক করিবে—অর্থাৎ বিল্ডিং আপাতত মাটির হউক, পরে দেখা যাইবে। কিন্তু জমিটা প্রশস্ত চাই। কি প্রকারে কাহাকে টাকা পাঠাইব, সমস্ত সন্ধান করিয়া লিখিবে। তোমাদের মধ্যে একজন বৈষয়িক কার্যের ভার লইবে।
সাণ্ডেলকে সমস্ত বৈষয়িক ব্যাপার সন্ধান করিয়া এক পত্র লিখিতে বলিবে। সাণ্ডেল চাকরি-বাকরি করিতেছে কেমন? যদি প্রভুর ইচ্ছা হয়, শীঘ্রই অনেক কাজ করিতে পারিব। হরমোহন কেদারবাবুর টাকার কথা কি লিখিয়াছে। আমি টাকা পত্রপাঠ পাঠাইব; কিন্তু কাহার নামে ও কাহাকে পাঠাইব, জানি না। একজন সেখানে এজেণ্ট না হইলে কোন কাজ চলিতে পারে না।
বিমলা—কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের জামাতা—এক সুদীর্ঘ পত্র লিখিয়াছেন যে, তাঁহার হিন্দুধর্মে এখন যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি। আমাকে প্রতিষ্ঠা হইতে সাবধান হইবার জন্য অনেক সুন্দর উপদেশ দিয়াছেন। এবং তাঁহার গুরু শশীবাবুর সাংসারিক দারিদ্র্যের কথা লিখিতেছেন। শিব, শিব! যাঁহার বড় মানুষ শ্বশুর তিনি কিছুই পারেন না, আর আমার তিন কালে শ্বশুর মোটেই নাই!! শশীবাবুর প্রণীত এক পুস্তক পাঠাইয়াছেন। উক্ত পুস্তকে সূক্ষ্মতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। বিমলার ইচ্ছা যে, এতদ্দেশ হইতে উক্ত পুস্তক ছাপাইবার সাহায্য হয়; তাহার তো কোন উপায় দেখি না, কারণ ইহারা বাঙলা ভাষা তো মোটেই জানে না। তাহার উপর হিন্দুধর্মের সহায়তা ক্রিশ্চানরা কেন করিবে? বিমলা এক্ষণে সহজ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিয়াছেন—পৃথিবীর মধ্যে হিন্দু শ্রেষ্ঠ, তন্মধ্যে ব্রাহ্মণ! ব্রাহ্মণমধ্যে শশী ও বিমলা—এই দুইজন ছাড়া পৃথিবীতে আর কাহারও ধর্ম হইতে পারেই না; কারণ তাহাদের ‘ঊধ্বস্রোতস্বিনীবৃত্তি’ নীচের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে এবং উক্ত দুইজনের কেবল উচ্চদিকে … । এই প্রকারে বিমলা এক্ষণে সনাতন ধর্মের যাহা আসল সার, তাহা খিঁচিয়া লইয়াছেন!
ধর্ম কি আর ভারতে আছে দাদা! জ্ঞানমার্গ, ভক্তিমার্গ, যোগমার্গ সব পলায়ন। এখন আছেন কেবল ছুঁৎমার্গ—আমায় ছুঁয়োনা, আমায় ছুঁয়োনা। দুনিয়া অপবিত্র, আমি পবিত্র। সহজ ব্রহ্মজ্ঞান! ভালা মোর বাপ!! হে ভগবান্! এখন ব্রহ্ম হৃদয়কন্দরেও নাই, গোলোকেও নাই, সর্বভূতেও নাই—এখন ভাতের হাঁড়িতে …। পূর্বে মহতের লক্ষণ ছিল ‘ত্রিভুবনমুপকারশ্রেণীভিঃ প্রীয়মাণঃ’,৪৫ এখন হচ্ছে, আমি পবিত্র আর দুনিয়া অপবিত্র—লাও রূপেয়া, ধরো হামারা পায়েরকা নীচে।
হরমোহন মধ্যে এক দিগ্গজ পত্র লেখেন। তাতে প্রধান খবর প্রায়ই এই রকম, যথা—‘অমুক ময়রার দোকানে অমুক ছেলে আপনার নিন্দা করিল; তাহাতে অসহ্য হওয়ায় আমি লড়াই করি’ ইত্যাদি। কে তাকে লড়াই করিতে বলে, প্রভু জানেন। ....যাক, তাহার ভালবাসাকে বলিহারি যাই এবং তাহার perseverance (অধ্যবসায়)-কে। মধ্যে যদি পার immediately (অবিলম্বে) হাওলাত করে কেদারবাবুর টাকা সুদসমেত দিও, আমি পত্রপাঠ পাঠাইয়া দিব। কাকে টাকা পাঠাই, কোথায় পাঠাই। তোমাদের যে হরিঘোষের গোয়াল। আমার টাকার কিছুই অভাব নাই, … কেদারবাবুর টাকা twice over দিব (দ্বিগুণ পরিশোধ করিব), তাহাকে ক্ষুণ্ণ হইতে মানা করিবে। আমি জানিতাম, উপেন তাহা পরিশোধ করিয়াছে এতদিনে। যাক, উপেনকে কিছুই বলিবার আবশ্যক নাই। আমি পত্রপাঠ পাঠিয়ে দিব।
যে মহাপুরুষ—হুজুক সাঙ্গ করে দেশে ফিরে যেতে লিখছেন, তাঁকে বলো কুকুরের মত কারুর পা চাটা আমার স্বভাব নহে। যদি সে মরদ হয় তো একটা মঠ বানিয়ে আমায় ডাকতে বলো। নইলে কার ঘরে ফিরে যাব? এ দেশে আমার more (অধিক) ঘর—হিন্দুস্থানে কি আছে? কে ধর্মের আদর করে? কে বিদ্যের আদর করে? ঘরে ফিরে এস!!! ঘর কোথা?
এবারকার মহোৎসব এমনি করবে যে, আর কখনও তেমন হয় নাই। আমি একটা ‘পরমহংস মহাশয়ের জীবনচরিত’ লিখে পাঠাব। সেটা ছাপিয়ে ও তর্জমা করে বিক্রী করবে। বিতরণ করলে লোকে পড়ে না, কিছু দাম লইবে। হুজুকের শেষ !!! … এই তো কলির সন্ধ্যে। আমি মুক্তি চাই না, ভক্তি চাই না; আমি লাখ নরকে যাব, ‘বসন্তবল্লোকহিতং চরন্তঃ’ (বসন্তের ন্যায় লোকের কল্যাণ আচরণ করে)—এই আমার ধর্ম। আমি কুঁড়ে, নিষ্ঠুর, নির্দয়, স্বার্থপর ব্যক্তিদের সহিত কোন সংস্রব রাখিতে চাই না। যাহার ভাগ্যে থাকে, সে এই মহাকার্যে সহায়তা করিতে পারে। … সাবধান, সাবধান! এ-সকল কি ছেলেখেলা, স্বপন-দেখা নাকি? মধো, সাবধান! সুরেশ দত্তর ‘রামকৃষ্ণচরিত’ পড়িলাম, মন্দ হয় নাই। শশী সাণ্ডেলের কোন উপকার যদি তোমাদের দ্বারা হয়, করিবে। বেচারা ভক্ত মানুষ, বড়ই কষ্ট পাচ্ছে। আমি তো দাদা এখানে বসে কোন উপায় দেখি না। কিমধিকমিতি।
দাদা, একবার গর্জে গর্জে মধুপানে লেগে যাও দিকি—মাষ্টার, জি. সি. ঘোষ, অতুল, রামদা, নৃত্যগোপাল, শাঁকচুন্নি! বলি, শাঁকচুন্নির কোন কথাই তো তোমরা লেখ না! সে গেল কোথা? মাকে ভক্তি করছে তেমনি কিনা? নৃত্যগোপাল-দাদার শরীর বেশ ভাল হয়েছে কি না, বাবুরাম যোগেন সেরেছে কিনা—ইত্যাদি আমি সকলের বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চাই। শরৎকে কি সাণ্ডেলকে একটি বিশেষ পত্রে সব খুলে লিখতে বলবে। কালীকৃষ্ণ, ভবনাথ, দাশু, সাতু, হরি চাটুয্যে সকলকে তোমরা ভালবাস কিনা—সব লিখবে। … তোরা এক একটা মানুষ হ দিকি রে বাবা! গঙ্গাধর খেতড়ি থেকে তো পালায় নাই?
বলি, আর খবরের কাগজ পাঠাবার আবশ্যক নাই। তার ঢের মেরে গেছে। তোদের কারও organising power (সংগঠন-শক্তি) নাই দেখিতেছি; বড়ই দুঃখের বিষয়। সকলকে আমার ভালবাসা দিবে, সকলের help (সাহায্য) আমি চাই; কারুর সঙ্গে বিবাদবিসংবাদ খবরদার যাতে না হয়। Neither money pays, nor name, nor fame, nor learning; it is character that can cleave through adamantine walls of difficulties,৪৬ —মনে রেখো। লোকের সঙ্গে যাওয়া-আসা, বিশেষ করিয়া মতামত pooh pooh (দুঃ ছাই) করিবে না, তাতে লোক বড়ই চটে। জায়গায় জায়গায় এক একটা সেণ্টার করিতে হইবে—এ তো বড় সহজ! যেমন তোমরা জায়গায় জায়গায় ফের, অমনি একটি সেণ্টার করবে সেখানে। এই রকম করে কার্য হবে। যেখানে পাঁচজন লোক তাঁকে মানে, সেখানেই এক ডেরা—এমনি করে চল এবং সর্বদা সকল জায়গার সঙ্গে communication (যোগাযোগ) রাখিতে হইবে। ইতি
চিরস্নেহাস্পদ
বিবেকানন্দ
১৫২*
ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক ষ্টেশন
২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি নিরাপদে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছি; ল্যাণ্ডস্বার্গ ডিপোয় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে—আমি তখনই ব্রুকলিনের দিকে রওনা হলাম ও সময়মত সেখানে পৌঁছলাম।
সন্ধ্যাকালটা পরমানন্দে কেটে গেল—এথিক্যাল কালচার সোসাইটির (Ethical Culture Society) কতকগুলি ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
আসছে রবিবার একটা বক্তৃতা হবে। ডাঃ জেন্স্ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খুব সহৃদয় ও অমায়িক ব্যবহার করলেন, আর মিঃ হিগিন্সকে পূর্বেরই মত দেখলাম—খুব কাজের লোক। বলতে পারি না কেন, অন্যান্য শহরের চেয়ে এই নিউ ইয়র্ক শহরেই দেখছি—মেয়েদের চেয়ে পুরুষদের ধর্মালোচনায় আগ্রহ বেশী।
আমার ক্ষুরখানা ১৬১ নং বাড়ীতে ফেলে এসেছি, অনুগ্রহপূর্বক সেটা ল্যাণ্ডস্বার্গের নামে পাঠিয়ে দেবেন।
এই সঙ্গে মিঃ হিগিন্স আমার সম্বন্ধে যে পুস্তিকাটি ছাপিয়েছেন, তার এক কপি পাঠালাম—আশা করি, ভবিষ্যতে আরও পাঠাতে পারব।
মিস ফার্মারকে এবং তাঁদের পবিত্র পরিবারের সকলকে আমার ভালবাসা জানাবেন।
সদা বশংবদ
বিবেকানন্দ
১৫৩*
C/o G. W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র তোমার পত্র পেলাম। ভট্টাচার্যের মাতার দেহত্যাগ-সংবাদে বিশেষ দুঃখিত হলাম। তিনি একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন। প্রভু তাঁর কল্যাণ করুন।
আমি যে খবরের কাগজের অংশগুলি তোমায় পাঠিয়েছিলাম, সেগুলি প্রকাশ করতে বলে আমি ভুল করেছি। এ আমার একটা ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেছে। মুহূর্তের জন্য দুর্বলতা আমার হৃদয়কে অধিকার করেছিল, এতে তাই প্রকাশ হচ্ছে।
এ দেশে দু-তিন বছর ধরে বক্তৃতা দিলে টাকা তোলা যেতে পারে। আমি কতকটা চেষ্টা করেছি, আর যদিও সাধারণে খুব আদরের সহিত আমার কথা নিচ্ছে, কিন্তু আমার প্রকৃতিতে এটা একেবারে খাপ খাচ্ছে না, বরং ওতে আমার মনটাকে বেজায় নামিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং আমি এই গ্রীষ্মকালেই ইওরোপ হয়ে ভারতে ফিরে যাব—স্থির করেছি; এতে যা খরচ হবে, তার জন্য যথেষ্ট টাকা আছে। তাঁর ইচ্ছে পূর্ণ হোক।
ভারতের খবরের কাগজ ও তাদের সমালোচনা সম্বন্ধে যা লিখেছ, তা পড়লাম। তারা যে এ-রকম লিখবে, এ তাদের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। প্রত্যেক দাসজাতির মূল পাপ হচ্ছে ঈর্ষা। আবার এই ঈর্ষাদ্বেষ ও সহযোগিতার অভাবই এই দাসত্বকে চিরস্থায়ী করে রাখে। ভারতের বাইরে না এলে আমার এ মন্তব্যের মর্ম বুঝবে না। পাশ্চাত্য জাতিদের কার্যসিদ্ধির রহস্য হচ্ছে—এই সহযোগিতা। এদের শক্তি অদ্ভুত, আর এর ভিত্তি হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর পরস্পরের কার্যের গুণগ্রাহিতা। আর জাতটা যত দুর্বল ও কাপুরুষ হবে, ততই তার ভেতর এই [কাপুরুষতা] পাপটা স্পষ্ট দেখা যাবে। যতই কষ্টকল্পিত হোক, মূলে কতকটা সত্য না থাকলে কোন অপবাদই উঠতে পারে না, আর এখানে আসবার পর মেকলে ও আর আর অনেকে বাঙালী জাতকে যে ভয়ানক গালাগাল দিয়েছেন, তার কারণ কিছু কিছু বুঝতে পারছি। এরা সর্বপেক্ষা কাপুরুষ আর সেই কারণেই এতদূর ঈর্ষাপরায়ণ ও পরনিন্দাপ্রবণ। হে ভ্রাতঃ, এই দাসভাবাপন্ন জাতের নিকট কিছু আশা করা উচিত নয়। ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে দেখলে কোন আশার কারণ থাকে না বটে, তথাপি তোমাদের সকলের সামনে খুলেই বলছি—তোমরা কি এই মৃত জড়পিণ্ডটার ভেতর, যাদের ভেতর ভাল হবার আকাঙ্ক্ষাটা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে, যাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য একদম চেষ্টা নেই, যারা তাদের হিতৈষীদের ওপরই আক্রমণ করতে সদা প্রস্তুত, এরূপ মড়ার ভেতর প্রাণসঞ্চার করতে পার? তোমরা কি এমন চিকিৎসকের আসন গ্রহণ করতে পার, যিনি একটা ছেলের গলায় ঔষধ ঢেলে দেবার চেষ্টা করছেন, এদিকে ছেলেটা ক্রমাগত পা ছুঁড়ে লাথি মারছে এবং ঔষধ খাব না বলে চেঁচিয়ে অস্থির করে তুলছে?
‘—’ সম্পাদক সম্বন্ধে বক্তব্য এই, আমার স্বর্গীয় গুরুদেবের কাছে উত্তম-মধ্যম তাড়া খেয়ে অবধি সে আমাদের ছায়া পর্যন্ত মাড়ায় না। একজন মার্কিন বা ইওরোপীয়ান তার বিদেশস্থ স্বদেশবাসীর পক্ষ সর্বদাই নিয়ে থাকে, কিন্তু হিন্দু—বিশেষ বাঙালী স্বদেশবাসীকে অপমানিত দেখলে খুশী হয়। যাই হোক, ওসব নিন্দা-কুৎসার দিকে একদম খেয়াল করো না। ফের তোমায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি—‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।’—কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়। পাহাড়ের মত অটল হয়ে থাক। সত্যের জয় চিরকালই হয়ে থাকে। রামকৃষ্ণের সন্তানগণের যেন ভাবের ঘরে চুরি না থাকে, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা বেঁচে থাকতে এর কোন ফল দেখে যেতে না পারি; কিন্তু আমরা বেঁচে রয়েছি, এ বিষয়ে যেমন কোন সন্দেহ নেই, সেইরূপ নিঃসন্দেহে শীঘ্র বা বিলম্বে এর ফল হবেই হবে। ভারতের পক্ষে প্রয়োজন—তার জাতীয় ধমনীর ভিতর নূতন বিদ্যুদগ্নি-সঞ্চার। এরূপ কাজ চিরকালই ধীরে ধীরে হয়ে এসেছে, চিরকালই ধীরে হবে; এখন ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে শুধু কাজ করেই খুশী থাক; সর্বোপরি, পবিত্র ও দৃঢ়চিত্ত হও এবং মনে প্রাণে অকপট হও—ভাবের ঘরে যেন এতটুকু চুরি না থাকে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি তোমরা রামকৃষ্ণের শিষ্যদের কারও ভেতর কোন জিনিষ লক্ষ্য করে থাক, সেটি এই—তারা একেবারে সম্পূর্ণ অকপট। আমি যদি ভারতে এই রকম এক-শ জন লোক রেখে যেতে পারি, তাহলে সন্তুষ্ট চিত্তে মরতে পারব—আমি বুঝব, আমার কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে। অজ্ঞ লোকে যা তা বকুক না কেন, তিনিই জানেন—সেই প্রভুই, জানেন কি হবে। আমার লোকের সাহায্য খুঁজে বেড়াই না, অথবা সাহায্য এসে পড়লে ছেড়েও দিই না—আমরা সেই পরমপুরুষের দাস। এই সব ক্ষুদ্র লোকের ক্ষুদ্র চেষ্টা আমরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনি না। এগিয়ে যাও। শত শত যুগের কঠোর চেষ্টার ফলে একটা চরিত্র গঠিত হয়। দুঃখিত হয়ো না; সত্যে প্রতিষ্ঠিত একটি কথা পর্যন্ত নষ্ট হবে না—হয়তো শত শত যুগ ধরে আবর্জনাস্তূপে চাপা পড়ে লোকলোচনের অগোচরে থাকতে পারে, কিন্তু শীঘ্র হোক, বিলম্বে হোক—তা আত্মপ্রকাশ করবেই করবে। সত্য অবিনশ্বর, ধর্ম অবিনশ্বর, পবিত্রতা অবিনশ্বর। আমাকে একটা খাঁটি লোক দাও দেখি, আমি রাশি রাশি বাজে চেলা চাই না। বৎস, দৃঢ়ভাবে ধরে থাক—কোন লোক তোমাকে এসে সাহায্য করবে, এ ভরসা রেখো না—সকল মানুষের সাহায্যের চেয়ে প্রভু কি অনন্ত গুণে শক্তিমান্ নন? পবিত্র হও, প্রভুর ওপর বিশ্বাস রাখ, সর্বদাই তাঁর ওপর নির্ভর কর, তাহলেই তোমার সব ঠিক হয়ে যাবে, কেউ তোমার বিরুদ্ধে লেগে কিছু করতে পারবে না। আগামী পত্রে আরও বিস্তারিত খবর দেব।
এদেশে যাদের গরীব বলা হয়, তাদের দেখছি; আমাদের দেশের গরীবদের তুলনায় এদের অবস্থা অনেক ভাল হলেও কত লোকের হৃদয় এদের জন্য কাঁদছে! কিন্তু ভারতের চিরপতিত বিশ কোটি নরনারীর জন্য কার হৃদয় কাঁদছে? তাদের উদ্ধারের উপায় কি? তাদের জন্য কার হৃদয় কাঁদে বল? তারা অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে পারছে না, তারা শিক্ষা পাচ্ছে না। কে তাদের কাছে আলো নিয়ে যাবে? কে দ্বারে দ্বারে ঘুরে তাদের কাছে আলো নিয়ে যাবে? এরাই তোমাদের ঈশ্বর, এরাই তোমাদের দেবতা হোক, এরাই তোমাদের ইষ্ট হোক। তাদের জন্য ভাব, তাদের জন্য কাজ কর, তাদের জন্য সদাসর্বদা প্রার্থনা কর—প্রভুই তোমাদের পথ দেখিয়ে দেবেন। তাঁদেরই আমি মহাত্মা বলি, যাঁদের হৃদয় থেকে গরীবদের জন্য রক্তমোক্ষণ হয়, তা না হলে সে দুরাত্মা। তাদের কল্যাণের জন্য আমাদের সমবেত ইচ্ছাশক্তি, সমবেত প্রার্থনা প্রযুক্ত হোক—আমরা কাজে কিছু করে উঠতে না পেরে লোকের অজ্ঞাতসারে মরতে পারি—কেউ হয়তো আমাদের প্রতি এতটুকু সহানুভূতি দেখালে না, কেউ হয়তো আমাদের জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেললে না, কিন্তু আমাদের একটা চিন্তাও কখনও নষ্ট হবে না। এর ফল শীঘ্র বা বিলম্বে ফলবেই ফলবে। আমার প্রাণের ভেতর এত ভাব আসছে, আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না—তোমরা আমার হৃদয়ের ভাব মনে মনে কল্পনা করে বুঝে নাও। যতদিন ভারতের কোটি কোটি লোক দারিদ্র্য ও অজ্ঞানান্ধকারে ডুবে রয়েছে, ততদিন তাদের পয়সায় শিক্ষিত অথচ যারা তাদের দিকে চেয়েও দেখছে না, এরূপ প্রত্যেক ব্যক্তিকে আমি দেশদ্রোহী বলে মনে করি। যতদিন ভারতের বিশ কোটি লোক ক্ষুধার্ত পশুর মত থাকবে, ততদিন যে সব বড়লোক তাদের পিষে টাকা রোজগার করে জাঁকজমক করে বেড়াচ্চে অথচ তাদের জন্য কিচ্ছু করছে না, আমি তাদের হতভাগা পামর বলি। হে ভ্রাতৃগণ! আমরা গরীব, আমরা নগণ্য, কিন্তু আমাদের মত গরীবরাই চিরকাল সেই পরমপুরুষের যন্ত্রস্বরূপ হয়ে কাজ করেছে। প্রভু তোমাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন। সকলে আমার বিশেষ ভালবাসা জানবে। ইতি
পুঃ—যদি তোমরা কিছু ছাপিয়ে না থাক তো ছাপা বন্ধ কর—নাম হুজুকের আর দরকার নেই। ইতি—
বিবেকানন্দ
১৫৪*
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
৩ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
গত রবিবার ব্রুকলিনে বক্তৃতা দিয়েছি। সন্ধ্যায় পৌঁছলে মিসেস হিগিন্স আমায় একটু সম্বর্ধনা করেন, এবং ডক্টর জেন্স্ (Janes) প্রভৃতি এথিক্যাল সোসাইটি (Ethical Society)-র কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কয়েকজন মনে করেন যে, এরূপ প্রাচ্যদেশীয় ধর্মপ্রসঙ্গ ব্রুকলিনের জনসাধারণের উপভোগ্য হবে না।
কিন্তু প্রভুর কৃপায় বক্তৃতা খুব সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। ব্রুকলিনের প্রায় আটশত গণ্যমান্য ব্যক্তি যোগদান করেন! যাঁরা মনে করেছিলেন বক্তৃতা সফল হবে না, তাঁরাই ব্রুকলিনে কয়েকটি ধারাবাহিক বক্তৃতার আয়োজন করেছেন। আমার নিউ ইয়র্কের বক্তৃতামালা প্রায় প্রস্তুত, কিন্তু মিস থার্সবি নিউ ইর্য়কে না আসা পর্যন্ত তারিখ ঠিক করতে চাই না। এভাবে মিস ফিলিপ্স্—যিনি মিস থার্সবির বন্ধু, এবং যিনি আমার নিউ ইর্য়কের বক্তৃতামালার আয়োজন করছেন—মিস থার্সবির সহযোগিতায় প্রয়োজনবোধে সেখানে কিছু বন্দোবস্ত করতে চান।
হেল পরিবারের কাছে আমি বিশেষরূপে ঋণী এবং নববর্ষের প্রথম দিনে তাদের কাছে হঠাৎ এসে হাজির হব, ভেবেছিলাম। এখানে একটি নতুন পাগড়ি যোগাড় করবার চেষ্টাতে আছি। পুরানো পাগড়িটি এখানে আছে। কিন্তু বারবার কাচার ফলে সেটা এত ঢিলে হয়ে গিয়েছে যে, সেটা পরে লোকের কাছে যাওয়া যায় না। চিকাগোর ঠিক তেমনি একটা পাগড়ি পাব বলে মনে হয়।
আশা করি আপনার পিতা ইতোমধ্যে ভাল হয়েছেন। মিস ফার্মার, মিঃ ও মিসেস গিবন্স এবং ধার্মিক পরিবারটির সকলকে আমার প্রীতি জানাবেন।
সতত স্নেহের
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ব্রুকলিনে মিস কুরিং-এর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি বরাবরই সদয়। তাঁকে শীঘ্র চিঠি লিখলে আমার প্রীতি জানাবেন।
১৫৫*
[স্যার এস. সুব্রহ্মণ্য আয়ারকে লিখিত]
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
৩ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় মহাশয়,
প্রেম, কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসপূর্ণ হৃদয়ে অদ্য আপনাকে পত্র লিখিতে প্রবৃত্ত হইলাম। প্রথমেই বলিয়া রাখি—আমার জীবনে এমন অল্প কয়েকজনের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে, যাঁহাদের হৃদয় ভাব ও জ্ঞানের অপূর্ব সমম্বয়ে পূর্ণ, সর্বোপরি যাঁহারা মনের ভাবসমূহ কার্যে পরিণত করিবার শক্তি রাখেন, আপনি তাঁহাদের মধ্যে একজন। বিশেষতঃ আপনি অকপট, তাই আমি আপনার নিকট আমার কয়েকটি মনের ভাব বিশ্বাস করিয়া প্রকাশ করিতেছি।
ভারতের কার্য বেশ আরম্ভ হইয়াছে, আর উহা শুধু যে কোনক্রমে বজায় রাখিতে হইবে, তাহা নহে, মহা উদ্যমের সহিত উহার উন্নতি ও বিস্তারসাধন করিতে হইবে। এই সময়। এখন আলস্য করিলে পরে আর কার্যের সুযোগ থাকিবে না। কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে নানাবিধ চিন্তা করিয়া নিম্নলিখিত প্রণালীতে উহা সীমাবদ্ধ করিয়াছিঃ প্রথমে মান্দ্রাজে ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিবার জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে, ক্রমশঃ উহাতে অন্যান্য অবয়ব সংযোজন করিতে হইবে; আমাদের যুবকগণ যাহাতে বেদসমূহ, বিভিন্ন দর্শন ও ভাষ্যসকল সম্পূর্ণরূপে শিক্ষা পায়, তাহা করিতে হইবে; উহার সহিত অন্যান্য ধর্মসমূহের তত্ত্বও তাহাদিগকে শিখাইতে হইবে। সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিদ্যালয়ের মুখপত্রস্বরূপ একখানি ইংরেজী ও একখানি দেশীয় ভাষার কাগজ থাকিবে।
প্রথমেই এটি করিতে হইবে; আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপার হইতেই বড় বড় বিষয় দাঁড়াইয়া থাকে। কয়েকটি কারণে মান্দ্রাজই এক্ষণে এই কার্যের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ক্ষেত্র। বোম্বাইয়ে সেই চিরদিনের জড়ত্ব; বাঙলায় ভয়—এখন যেমন পাশ্চাত্য ভাবের মোহ, তেমনি পাছে তাহার বিপরীত ঘোর প্রতিক্রিয়া হয়। মান্দ্রাজই এক্ষণে এই প্রাচীন ও আধুনিক উভয় জীবন-প্রণালীর যথার্থ গুণ গ্রহণ করিয়া মধ্যপথ অনুসরণ করিতেছে।
সমাজের যে সম্পূর্ণ সংস্কার আবশ্যক—এ বিষয়ে ভারতীয় শিক্ষিত সমাজের সহিত আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু ইহা করিবার উপায় কি? সংস্কারকগণ সমাজকে ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া যেরূপে সমাজসংস্কারের প্রণালী দেখাইলেন, তাহাতে তাঁহারা কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। আমার প্রণালী এইঃ আমি এখনও এটা মনে করি না যে, আমার জাতি এতদিন ধরিয়া কেবল অন্যায় করিয়া আসিতেছে; কখনই নহে। আমাদের সমাজ যে মন্দ, তাহা নহে—আমাদের সমাজ ভাল। আমি কেবল চাই—আরও ভাল হোক। সমাজকে মিথ্যা হইতে উচ্চতর সত্যে যাইতে হইবে, মন্দ হইতে ভালয় নয়; সত্য হইতে উচ্চতর সত্যে, ভাল হইতে আরও ভালয়—আরও ভালয় যাইতে হইবে। আমি আমার স্বদেশবাসীকে বলি—এতদিন তোমরা যাহা করিয়াছ, তাহা বেশ হইয়াছে; এখন আরও ভাল করিবার সময় আসিয়াছে। এই জাতিবিভাগের কথাই ধরুন—সংস্কৃতে ‘জাতি’ শব্দের অর্থ শ্রেণীবিশেষ। এখন সৃষ্টির মূলেই ইহা বিদ্যমান। বিচিত্রতা অর্থাৎ জাতির অর্থই সৃষ্টি। ‘একোঽহং বহু স্যাম্’ (আমি এক—বহু হইব)—বিভিন্ন বেদে এইরূপ কথা দেখা যায়। সৃষ্টির পূর্বে এক থাকে—বহুত্ব বা বিচিত্রতাই সৃষ্টি। যদি এই বিচিত্রতাই না থাকে, তবে সৃষ্টিই লোপ পাইবে।
যতদিন কোন শ্রেণীবিশেষ সক্রিয় ও সতেজ থাকে, ততদিন তাহা নানা বিচিত্রতা প্রসব করিয়া থাকে। যখনই উহা বিচিত্রতা উৎপাদনে বিরত হয়, অথবা যখন উহার বিচিত্রতা বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়, তখনই উহা মরিয়া যায়। মূলে ‘জাতির’ অর্থ ছিল প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ প্রকৃতি, নিজ বিশেষত্ব প্রকাশ করিবার স্বাধীনতা। সহস্র সহস্র বর্ষ ধরিয়া এই অর্থই প্রচলিত ছিল—এমন কি, খুব আধুনিক শাস্ত্রগ্রন্থসমূহেও বিভিন্ন জাতির একত্র ভোজন নিষিদ্ধ হয় নাই; আর প্রাচীনতর গ্রন্থসমূহের কোথাও বিভিন্ন জাতিতে বিবাহ নিষিদ্ধ হয় নাই। তবে ভারতের পতনের কারণ কি? জাতি সম্বন্ধে এই ভাব পরিহার। যেমন গীতা বলিতেছেন, জাতি বিনষ্ট হইলে জগৎও বিনষ্ট হইবে। ইহা কি সত্য বলিয়া বোধ হয় যে, এই বিচিত্রতা বন্ধ করিয়া দিলে জগৎও নষ্ট হইয়া যাইবে? বর্তমান বর্ণবিভাগ (caste) প্রকৃত ‘জাতি’ নহে, বরং উহা জাতির উন্নতির প্রতিবন্ধক। উহা যথার্থই জাতির অর্থাৎ বিচিত্রতার স্বাধীন গতি রোধ করিয়াছে। কোন বদ্ধমূল প্রথা বা জাতিবিশেষের জন্য বিশেষ সুবিধা বা কোন আকারের বংশানুক্রমিক শ্রেণীবিভাগ প্রকৃত ‘জাতি’কে অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হইতে দেয় না, যখনই কোন জাতি আর এইরূপ নানা বিচিত্রতা প্রসব করে না, তখনই উহা অবশ্যই বিনষ্ট হইবে। অতএব আমি আমার স্বদেশবাসিগণকে ইহাই বলিতে চাই যে, ‘জাতি’ উঠাইয়া দেওয়াতেই ভারতের পতন হইয়াছে। প্রাণহীন অভিজাত অথবা সুবিধাভোগী শ্রেণীমাত্রই ‘জাতি’র প্রতিবন্ধক—উহা জাতি নহে। জাতি নিজ প্রভাব বিস্তার করুক, জাতির পথে যাহা কিছু বিঘ্ন আছে, সব ভাঙিয়া ফেলা হউক—তাহা হইলেই আমরা উঠিব। এক্ষণে ইওরোপের দিকে দৃষ্টিপাত করুন। যখনই উহা জাতিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে সমর্থ হইল—প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ ‘জাতি’ গঠন করিতে যে-সকল বাধা আছে, সেই সকল বাধার অধিকাংশই দূর করিয়া দিল—তখনই ইওরোপ উঠিল। আমেরিকায় প্রকৃত ‘জাতি’র বিকাশের সর্বাপেক্ষা অধিক সুবিধা—সেইজন্য তাহারা বড়। প্রত্যেক হিন্দুই জানে যে, জ্যোতিষীরা বালকবালিকার জন্মমাত্র জাতি নির্বাচন করিতে চেষ্টা করিয়া থাকেন। উহাই প্রকৃত ‘জাতি’—প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব; আর জ্যোতিষ ইহা মানিয়া লইয়াছে। ইহা যদি পুনরায় পুরাপুরিভাবে চালু হয়, তবেই আমরা উঠিতে পারিব। এই বৈচিত্র্যের অর্থ বৈষম্য বা কোন বিশেষ অধিকার নয়।
আমার কার্যপ্রণালীঃ হিন্দুদের দেখান যে, তাহাদিগকে কিছুই ছাড়িতে হইবে না, কেবল ঋষি-প্রদর্শিত পথে চলিতে হইবে ও শত শত শতাব্দীব্যাপী দাসত্বের ফলস্বরূপ এই ‘জড়ত্ব’ দূর করিতে হইবে। অবশ্য মুসলমানগণের অত্যাচারের সময় আমাদের উন্নতি বন্ধ হইয়াছিল; তাহার কারণ তখন ছিল জীবনমরণের সমস্যা, উন্নতির সময় ছিল না। এখন আর সেই অত্যাচারের ভয় নাই; এখন আমাদিগকে সম্মুখে অগ্রসর হইতেই হইবে—স্বধর্মত্যাগী ও মিশনরীগণের উপদিষ্ট ধ্বংসের পথে নয়—আমাদের নিজেদের ভাবে, নিজেদের পথে। প্রাসাদের গঠন অসম্পূর্ণ বলিয়াই উহা বীভৎস দেখাইতেছে। বহু শত শতাব্দীর অত্যাচারে প্রাসাদ-নির্মাণ বন্ধ রাখিতে হইয়াছিল। এখন নির্মাণ-কার্য শেষ করা হউক, তাহা হইলে সবই যথাস্থানে সুন্দর দেখাইবে। ইহাই আমার কার্যপ্রণালী। এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।
প্রত্যেক জাতির জীবনে একটি করিয়া মূল প্রবাহ থাকে। ধর্মই ভারতের মূল স্রোত; উহাকে শক্তিশালী করা হউক, তবেই পার্শ্ববর্তী অন্যান্য স্রোতগুলিও উহার সঙ্গে সঙ্গে চলিবে। ইহা আমার ভাবধারার একটা দিক্। আশা করি, যথাসময়ে আমার সমুদয় চিন্তারাশি প্রকাশ করিতে পারিব। কিন্তু বর্তমানে দেখিতেছি, এই দেশেও আমার বিশেষ কাজ রহিয়াছে। অধিকন্তু কেবল এখান হইতেই সাহায্যের প্রত্যাশা করি। কিন্তু এ পর্যন্ত কেবল আমার ভাবপ্রচার ব্যতীত আর কিছু করিতে পারি নাই। এখন আমার ইচ্ছা—ভারতেও একটা চেষ্টা করা হউক। মান্দ্রাজেই সফলতার সম্ভাবনা আছে। আ—ও অন্যান্য যুবকগণ খুব খাটিতে পারে, কিন্তু তাহা হইলেও তাহারা ‘উৎসাহী যুবক’ মাত্র। এই কারণে আমি তাহাদিগকে আপনার নিকট সমর্পণ করিতেছি। যদি আপনি তাহাদের পরিচালক হন, আমার নিশ্চিত ধারণা—উহারা কৃতকার্য হইবে। জানি না—কবে ভারতে যাইব। তিনি যেমন চালাইতেছেন, আমি সেইরূপ চলিতেছি; আমি তাঁহার হাতে।
‘এই জগতে ধনের সন্ধান করিতে গিয়া তোমাকেই শ্রেষ্ঠ রত্নরূপে পাইয়াছি; হে প্রভো, তোমারই নিকট আমি নিজেকে বলি দিলাম।’
‘ভালবাসার পাত্র খুঁজিতে গিয়া একমাত্র তোমাকেই ভালবাসার পাত্র পাইয়াছি। তোমারই নিকট আমি নিজেকে বলি দিলাম।’৪৭
প্রভু আপনাকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন।
ভবদীয় চিরকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ
১৫৬
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
১৮৯৫
প্রিয়তমেষু,
তোমার পত্রে টাকা-পঁহুছান ইত্যাদি সংবাদ পাইয়া অতিশয় আনন্দিত হইলাম। … দেশে আসিবার কথা যে লিখিয়াছ, তাহা ঠিক বটে; কিন্তু এদেশে একটি বীজ বপন করা হইয়াছে, সহসা চলিয়া গেলে উহা অঙ্কুরে নষ্ট হইবার সম্ভাবনা, এজন্য কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইবে। খেতড়ির রাজা, জুনাগড়ের দেওয়ান প্রভৃতি সকলেই দেশে আসিতে লেখেন। সত্য বটে; কিন্তু ভায়া, পরের ভরসা করা বুদ্ধিমানের কার্য নহে। আপনার পায়ের জোর বেঁধে চলাই বুদ্ধিমানের কার্য। সকলই হইবে ধীরে ধীরে; আপাততঃ একটা জায়গা দেখার কথাটা বিস্মৃত হইও না। একটা বিরাট জায়গা চাই—১০ হাজার থেকে ২০ হাজার [টাকা] পর্যন্ত—একদম গঙ্গার উপর হওয়া চাই। যদিও হাতে পুঁজি অল্প, তথাপি ছাতি বড় বেজায়, জায়গার উপর নজরটা রাখবে। একটা নিউ ইয়র্কে, একটা কলিকাতায় এবং একটা মান্দ্রাজে; এখন এই তিনটা আড্ডা চালাতে হবে, তারপর ধীরে ধীরে যেমন প্রভু যোগান।
যে যা করে, করতে দিও (উৎপাত ছাড়া)। টাকাখরচ বিলকুল তোমার হাতে রেখো। … অধিক কি বলিব? তুমি ইদিক ওদিক যাওয়াটা বড় একটা ত্যাগ কর। ঘর জাগিয়ে বসে থাক। … স্বাস্থ্যটার উপর বেজায় নজর রাখা চাই—পরে অন্য কথা। তারকদাদা দেশপর্যটনে উৎসুক—বেশ কথা, তবে এ সব দেশে বড়ই মাগগি, ১০০০ টাকার কমে মাসে চলে না (ধর্মপ্রচারকের)। … এদের দেশের বাঘভাল্লুকে পাদ্রী-পণ্ডিতদের মুখ হতে রুটি ছিনিয়ে নিয়ে খেতে হবে—এই বুঝ। অর্থাৎ বিদ্যের জোরে এদের দাবিয়ে দিতে হবে, নইলে ফু করে উড়িয়ে দেবে। এরা না বোঝে সাধু, না বোঝে সন্ন্যাসী, না বোঝে ত্যাগ-বৈরাগ্য; বোঝে বিদ্যের তোড়, বক্তৃতার ধুম আর মহা উদ্যোগ। আমার মতে কিন্তু যদি তারকদাদা পাঞ্জাব বা মান্দ্রাজে কতকগুলি সভা ইত্যাদি স্থাপন করে বেড়ান ও তোমরা একত্রিত হয়ে organised (সঙ্ঘবদ্ধ) হও তো বড়ই ভাল হয়। নূতন পথ আবিষ্কার করা বড় কাজ বটে, কিন্তু উক্ত পথ পরিষ্কার করা ও প্রশস্ত সুন্দর করাও কঠিন কাজ। আমি যেখানে যেখানে প্রভুর বীজ বপন করে এসেছি; তোমরা যদি সেই সেই স্থানে কিয়ৎকাল বাস করে উক্ত বীজকে বৃক্ষে পরিণত করতে পার, তাহা হইলেও আমার অপেক্ষা অনেক অধিক কাজ তোমরা করবে। উপস্থিত যারা রক্ষা করতে পারে না, তারা অনুপস্থিতে কি করিবে? তৈয়ারী রান্নায় একটু নুন-তেল যদি দিতে না পার, তাহলে কেমন করে বিশ্বাস হয় যে, সকল যোগাড় করবে? না হয় তারকদাদা আলমোড়ায় একটা হিমালয়ান মঠ স্থাপন করুন, এবং সেথায় একটা লাইব্রেরী করুন; আমরা দু-দণ্ড ঠাণ্ডা জায়গায় বাস করি এবং সাধনভজন করি। যা হোক, প্রভু যাকে যেমন বুদ্ধি দেন, আমার তাতে আপত্তি কি? অপিচ Godspeed—শিবা বঃ সন্তু পন্থানঃ। তারকদাদার হৃদয়ে মহা উৎসাহ আছে; এজন্য তাঁহা হতে আমি অনেক আশা করি। তারকদাদার সহিত এক থিওসফিষ্টের মূলাকাত হয়। সে লণ্ডন হতে আমাকে এক চিঠি লেখে। তারপর আর তো তার খবরাখবর নাই। সে ব্যক্তি ধনী বটে, সে তারকদাদার উপর শ্রদ্ধাবানও বটে। তার নামটা ভুলে গেছি। সে তাঁকে লণ্ডনাদি ভ্রমণ করাইতে পারে; এবং আমি যে কার্য করিতে চাই, তাহা সমাধানের জন্য তোমাদের কয়েকজনকে ইওরোপ ও আমেরিকা দেখাইয়া লওয়া অবশ্য কর্তব্য। একচক্র ভ্রমণের পর হৃদয় উদার হবে, তখন আমার idea (ভাব) বুঝতে পারবে ও কাজ করতে পারবে। তবে আমার হাতে টাকা নাই, কি করি? শীঘ্রই প্রভু রাস্তা খুলে দেবেন—এমন ভরসা আছে। এ সকল খবর ও আমার হৃদয়ের ভালবাসা তারকদাদাকে দিও, ও আলমোড়ায় একটা কিছু আড্ডা স্থাপনে বিশেষ যোগাড় দেখতে বলবে।
রাখাল, ঠাকুরের দেহত্যাগের পর মনে আছে, সকলে আমাদের ত্যাগ করে দিলে—হাবাতে গরীব ছোঁড়াগুলো মনে করে; কেবল বলরাম, সুরেশ, মাষ্টার ও চুনীবাবু এরা সকলে বিপদে আমাদের বন্ধু। অতএব এদের ঋণ আমরা কখনও পরিশোধ করতে পারব না। মাভৈঃ! খুব আনন্দ করতে বল—তাঁর আশ্রিতের কি নাশ আছে রে, বোকারাম?
ইতি সদৈকহৃদয়ঃ
নরেন
১৫৭*
চিকাগো
১১ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় জি. জি.,
তোমার ৩রা ডিসেম্বরের পত্র এইমাত্র পেলাম। ঐ সঙ্গেই আলাসিঙ্গার ও মহীশূরের মহারাজার পত্র পেলাম। নরসিংহ যে আমেরিকা এসেছিল, সে ভারতে ফিরে সেখান থেকে মিসেস হেগকে একখানা পত্র লিখেছে—তাতে হিন্দুদের বর্বর আখ্যা দিয়েছে, আর আমার সম্বন্ধে একটা কথাও লেখেনি। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তার মাথার কিছু গোলমাল হয়েছে। যাতে সে আরোগ্যলাভ করে, তার চেষ্টা কর। চিরদিনের জন্য কিছুই নষ্ট হয় না।
ডঃ ব্যারোজ তোমার পত্রের জবাব কেন দিলেন না, জানি না; কলিকাতার লোকদের যা উত্তর দিয়েছেন, তাও দেখিনি।
এখানকার ধর্মমহাসভার উদ্দেশ্য ছিল সব ধর্মের মধ্যে খ্রীষ্টান ধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করা, কিন্তু তা সত্ত্বেও দার্শনিক হিন্দুধর্ম আপন মর্যাদা রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। ডঃ ব্যারোজ ও ঐ ধাঁজের লোকেরা বেজায় গোঁড়া—তাদের সাহায্য আমি চাই না, প্রভুই আমার সহায়। প্রভু এদেশে আমায় যথেষ্ট বন্ধু দিচ্ছেন, আর তাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যারা আমার অনিষ্ট করবার জন্য চেষ্টা করেছে, তারা এখন হয়রান হয়ে ছেড়ে দিয়েছে। প্রভু ওদের মঙ্গল করুন।
ডঃ ব্যারোজ ও ঐ ধরনের অন্যান্য লোকদের সম্বন্ধে এই পর্যন্ত জেনে রাখ, ওদের সঙ্গে আমার কোনপ্রকার সংস্রব নাই। বাল্টিমোরের ঘটনা নিয়ে যে বাজে গুজব রটেছিল, সে সম্বন্ধে বক্তব্য এই, সেখানে এখন আমার অনেক ভাল ভাল বন্ধু রয়েছেন, এবং বরাবরই সেখানে আরও অধিকসংখ্যক বন্ধু পাব। আমি এক মুহূর্তও অলসভাবে কাটাচ্ছি না, এদেশের দুটি প্রধান কেন্দ্র—বন ও নিউ ইয়র্কের মধ্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছি। এর মধ্যে বোষ্টনকে ‘মস্তিষ্ক’ ও নিউ ইয়র্ককে ‘টাকার থলি’ বলা যেতে পারে। এই উভয় স্থানেই আমার কাজ আশাতীতভাবে সফল হয়েছে। যদি সংবাদপ্রেরকগণ তোমাদের নিকট ও-সম্বন্ধে কিছু না পাঠিয়ে থাকে, তাতে আমার কিছু দোষ নেই। যা হোক, বৎসগণ, আমি এই খবরের কাগজের হুজুগে বিরক্ত হয়ে গেছি, আর যে আমি তোমাদের নিকট ওগুলো পাঠাব, সে আশা করো না। কাজ আরম্ভ করবার জন্য একটু হুজুগ দরকার ছিল, এখন যথেষ্ট হয়ে গেছে।
মণি আয়ারকে চিঠি লিখেছি এবং তোমাকে আমার নির্দেশ পূর্বেই জানিয়েছি। এখন আমাকে দেখাও, তোমরা কি করতে পার। আহাম্মকের মত বাজে বকলে চলবে না, এখন আসল কাজ আরম্ভ করতে হবে। কিভাবে কাজ আরম্ভ করতে হবে, তা তোমাদের আগেই জানিয়েছি; আয়ারকেও পত্র লিখেছি। হিন্দুরা যে বড় বড় কথা বলে, তার সঙ্গে আসল কাজ দেখাতে হবে। তা যদি না পারে, তবে তারা কিছুই পাবার যোগ্য নয়। ব্যস্, এই কথা।তোমাদের নানাবিধ খেয়ালের জন্য আমেরিকা টাকা দিতে চাচ্ছে না। কেনই বা দেবে? আমার সম্বন্ধে বক্তব্য এই, আমি যথার্থ সত্য শিক্ষা দিতে চাই; তা এখানেই হোক আর অন্যত্রই হোক—আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না।
আমার বা তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে কে কি বলে, সে দিকে আর কান দিও না। সিংহবিক্রমে কাজ করে যাও, প্রভু তোমাদের আশীর্বাদ করুন। যতদিন না আমার দেহত্যাগ হচ্ছে, অবিশ্রান্ত ভাবে কাজ করে যাব; আর মৃত্যুর পরও জগতের কল্যাণের জন্য কাজ করতে থাকব। অসত্যের চেয়ে সত্যের প্রভাব অনন্তগুণে বেশী; সাধুতারও তাই। তোমাদের যদি ঐ গুণগুলি থাকে, তবে ওরা নিজেদের শক্তিতেই পথ করে নেবে।
থিওসফিষ্টের সঙ্গে আমার কোন সংস্রব নেই। বলছ তারা আমায় সাহায্য করবে। দূর! তোমরা যেমন আহাম্মক! তোমরা কি মনে কর, এখানে লোকে তাদের সঙ্গে আমাকে একদরের মনে করে? এখানে কেউ তাদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না, আর হাজার হাজার ভাল লোক আমার প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন। এইটি জেনে রাখ, এবং প্রভুর প্রতি বিশ্বাসসম্পন্ন হও।
খবরের কাগজে হুজুগ আমাকে যতটা না বাড়াতে পেরেছে, তার চেয়ে এদেশে আমি লোকের ওপর ধীরে ধীরে অনেক বেশী প্রভাব বিস্তার করছি। গোঁড়ারা এটা প্রাণে প্রাণে বুঝেছে, তারা কোনমতে এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না; তাই যাতে আমার প্রভাবটা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়, তার জন্য চেষ্টার কিছুমাত্র ত্রুটি করছে না। কিন্তু তারা তা পেরে উঠবে না—প্রভু এ-কথা বলছেন।
এটা হচ্ছে চরিত্রের ও পবিত্রতার প্রভাব, ও ব্যক্তিত্বের শক্তি। যতদিন এগুলি আমার থাকবে, ততদিন নিশ্চিন্ত থেকো, কেউ আমার মাথার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। প্রভু বলেছেন, যদি কেউ চেষ্টা করে, সে ব্যর্থ হবে।
বইপত্র—বাজে জঞ্জাল লিখে কি হবে? লোকের অন্তর স্পর্শ করতে হলে জীবন চাই, সেইটিই হচ্ছে একমাত্র উপায়; ব্যক্তির ভেতর দিয়ে ভাবের আকর্ষণ অপরের প্রাণে সঞ্চারিত হয়ে যায়। তোমরা তো এখনও ছেলেমানুষ। প্রভু আমাকে প্রতিদিনই গভীর হতে গভীরতর অন্তর্দৃষ্টি দিচ্ছেন। কাজ কর, কাজ কর, কাজ কর।
ওসব বাজে বুকনি ছেড়ে দাও, প্রভুর কথা কও। ভণ্ড ও মাথাপাগলা লোকদের কথা নিয়ে আলোচনা করবার সময় আমাদের নেই—জীবন যে ক্ষণস্থায়ী।
সদাসর্বদা তোমাদের এটি মনে রাখা বিশেষ দরকার যে, প্রত্যেক জাতকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ নিজ চেষ্টায় নিজের উদ্ধারসাধন করতে হবে। সুতরাং অপরের কাছে সাহায্যের প্রত্যাশা করো না। আমি খুব কঠোর পরিশ্রম করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু টাকা পাঠাতে পারি—এই পর্যন্ত। যদি তার ওপর ভরসা করে তোমাদের থাকতে হয়, তবে বরং কাজকর্ম বন্ধ করে দাও। আরও জেনে রাখ যে, আমার ভাব বিস্তার করবার এটি বিশেষ উপযুক্ত জায়গা; আমি যাদের শিক্ষা দেব, তারা হিন্দুই হোক, মুসলমানই হোক, আর খ্রীষ্টানই হোক, আমি তা গ্রাহ্য করি না। যারা প্রভুকে ভালবাসে, তাদেরই সেবা করতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত, জানবে।
আমাকে বাজে খবরের কাগজ আর পাঠিও না, ও দেখলেই আমার গা আঁতকে ওঠে। আমাকে নীরবে ধীরভাবে কাজ করতে দাও—প্রভু আমার সঙ্গে সর্বদা রয়েছেন। যদি ইচ্ছা হয় তো সম্পূর্ণ অকপট, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ, সর্বোপরি সম্পূর্ণ পবিত্র হয়ে আমার অনুসরণ কর। আমার আশীর্বাদ তোমাদের ওপর রয়েছে। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে পরস্পর প্রশংসা-বিনিময় করবার সময় আমাদের নেই। যখন এই জীবনযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে, তখন প্রাণভরে কে কতদূর কি করলাম, তুলনা করব ও পরস্পরের সুখ্যাতি করব। এখন কথা বন্ধ কর; কেবল কাজ—কাজ—কাজ। ভারতে তোমরা স্থায়ী কিছু করেছ, তা তো দেখতে পাচ্ছি না। তোমরা কোন কেন্দ্র স্থাপন করেছ, তাও দেখতে পাচ্ছি না। তোমরা কোন মন্দির বা হল প্রতিষ্ঠা করেছ—তাও তো দেখছি না। অপর কেউ তোমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে, তাও কিছু দেখছি না। কেবল কথা কথা কথা—‘আমরা খুব বড়, আমরা খুব বড়’—পাগল! আমরা ক্লীব—তা ছাড়া আমরা আর কি?
এই জঘন্য নাম-যশ ও অন্যান্য বাজে ব্যাপার—ওগুলিতে আমার কি হবে? ওগুলি কি আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি? আমি দেখতে চাই—শত শত ব্যক্তি এসে প্রভুর আশ্রয় নেবে। কোথায় তারা? আমি তাদের চাই—তাদের দেখতে চাই। তোমরা তো এরূপ লোক আমার কাছে এনে দিতে পারনি—তোমরা আমায় কেবল নাম-যশ দিয়েছ। নাম-যশ চুলোয় যাক। কাজে লাগ, সাহসী যুবকবৃন্দ, কাজে লাগ। আমার ভেতরে যে কি আগুন জ্বলছে, তার সংস্পর্শে এখনও তোমাদের হৃদয় অগ্নিময় হয়ে ওঠেনি। তোমরা এখন পর্যন্ত আমায় বুঝতে পারনি। তোমরা এখনও আলস্য ও ভোগের পুরাতন রাস্তাতেই চলেছ। দূর করে দাও যত আলস্য, দূর করে দাও ইহলোক ও পরলোকে ভোগের বাসনা। আগুনে গিয়ে ঝাঁপ দাও এবং লোককে ভগবানের দিকে নিয়ে এস।
ভগবৎসমীপে প্রার্থনা করি, আমার ভেতরে যে আগুন জ্বলছে, তা তোমাদের ভেতর জ্বলে উঠুক, তোমাদের মন মুখ এক হোক—ভাবের ঘরে চুরি যেন একদম না থাকে। তোমরা যেন জগতের যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের মত মরতে পার—ইহাই সর্বদা বিবেকানন্দের প্রার্থনা।
পুঃ—আলাসিঙ্গা, কিডি, ডাক্তার বালাজী এবং আর আর সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে এবং বলবে—রাম শ্যাম যদু আমাদের পক্ষে বা বিপক্ষে কি বলছে, এই নিয়ে তারা যেন দিনরাত মাথা না ঘামায়, তারা যেন তাদের সমস্ত শক্তি একত্র করে কাজে লাগায়। জগতে যত রাম শ্যাম আছে, সকলকে আশীর্বাদ কর, তারা তো শিশু মাত্র, আর তোমরা কাজে লেগে যাও। ইতি—
বি
পুঃ—সংবাদপত্রের রিপোর্ট সম্বন্ধে বক্তব্য এই, খুব সাবধানে তাদের কথা গ্রহণ করতে হবে। কারণ যদি কোন রিপোর্টারকে দেখা সাক্ষাৎ করতে না দেওয়া হয়, তবে সে গিয়ে যা তা কতকগুলি স্বকপোলকল্পিত বাজে গল্প লিখে ছাপিয়ে দেয়। সেইজন্যই তো তোমরা বাল্টিমোর-সংক্রান্ত বাজে খবরগুলো পেয়েছ। লোকগুলি কি করে ঐসব লেখবার উপাদান পেলে, আমি তো নিজেই তা জানি না। আমেরিকার কাগজগুলো কোন ব্যক্তির সম্বন্ধে যা খুশী তাই লেখে। বক্তৃতার রিপোর্টগুলোও বার আনা বাজে কথায় ভরা। রিপোর্টারেরা নিজেদের কল্পনা থেকে অনেক জিনিষ পূরণ করে দেয়। আমেরিকার কাগজ থেকে কিছু তুলে ছাপবার সময় খুব সাবধান। ইতি—
বি
১৫৮*
আমেরিকা
১২ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি গতকল্য জি. জি-কে পত্র লিখেছি, কিন্তু আরও কতকগুলি কথা বলা দরকার হচ্ছে—তাই তোমায় লিখছিঃ
প্রথমতঃ আমি পূর্বে কয়েকখানি পত্রে তোমাদের লিখেছি যে, বই-টই বা খবরের কাগজ প্রভৃতি আর আমায় পাঠিও না, কিন্তু তবু তোমরা পাঠাচ্ছ—এতে আমি বিশেষ দুঃখিত। কারণ আমার ঐগুলি পড়বার এবং ঐগুলি সম্বন্ধে খেয়াল করবার মোটেই সময় নেই। অনুগ্রহ করে ওগুলি আর পাঠিও না। আমি মিশনরী থিওসফিষ্ট বা ঐ ধরনের লোকদের মোটেই আমল দিই না—তারা সবাই যা পারে তা করুক। তাদের কথা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই তাদের দর বাড়ান হবে। মান্দ্রাজ-অভিনন্দনের উত্তরটা মিসেস—কে পাঠিয়ে ঠিক করনি। তিনি একজন গোঁড়া খ্রীষ্টান, সুতরাং গোঁড়াদের সম্বন্ধে ওতে আমি যে সমালোচনা করেছি, তা তাঁর ভাল লাগবে না। যাই হোক, সব ভাল যার শেষ ভাল।
এখন তোমরা চিরদিনের জন্য জেনে রাখ যে, আমি নাম-যশ বা ঐরূপ বাজে জিনিষ একদম গ্রাহ্য করি না। আমি জগতের কল্যাণের জন্য আমার ভাবগুলি প্রচার করতে চাই। তোমরা খুব বড় কাজ করেছ বটে, কিন্তু কাজ যতদূর হয়েছে, তাতে শুধু আমার নাম-যশই হয়েছে। কেবল জগতের বাহবা নেবার জন্যই জীবন ব্যয় করা অপেক্ষা আমার কাছে আমার জীবনের আরও বেশী মূল্য আছে বলে মনে হয়। ঐসব আহাম্মকির জন্য আমার মোটেই সময় নেই, জানবে। তোমরা ভারতের ভাবগুলি প্রচারের জন্য ও সঙ্ঘবদ্ধ হবার উদ্দেশ্যে কি কাজ করেছ?—কই, কিছুই না।
একটি সঙ্ঘের বিশেষ প্রয়োজন—যা হিন্দুদের পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করতে ও ভাল ভাবগুলি আদর করতে শেখাবে। আমাকে ধন্যবাদ দেবার জন্য কলিকাতার সভায় ৫০০০ লোক জড়ো হয়েছিল—অন্যান্য স্থানেও শত শত লোক সভায় মিলিত হয়েছে—বেশ কথা, কিন্তু তাদের প্রত্যেককে চারটি করে পয়সা সাহায্য করতে বল দেখি—অমনি তারা সরে পড়বে। বালসুলভ নির্ভরতাই আমাদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। যদি কেউ তাদের মুখের কাছে খাবার এনে দেয়, তবে তারা খেতে খুব প্রস্তুত; কারও কারও আবার সেই খাবার গিলিয়ে দিতে পারলে আরও ভাল হয়। আমেরিকা তোমাদের কিছু টাকা-কড়ি পাঠাতে পারবে না—কেনই বা পারবে? যদি তোমরা নিজেরা নিজেদের সাহায্য করতে না পার, তবে তো তোমরা বাঁচবারই উপযুক্ত নও। তুমি যে জানতে চেয়েছ—আমেরিকার কাছ থেকে বছরে কয়েক হাজার টাকা পাবার নিশ্চিন্ত ভরসা করা যেতে পারে কিনা, তাই পড়ে আমি একেবারে হতাশ হয়ে গেছি। এক পয়সাও পাবে না। সব টাকা কড়ি নিজেদেরই যোগাড় করে নিতে হবে—কেমন, পারবে?
জনসাধারণের শিক্ষা সম্বন্ধে আমার যে পরিকল্পনা ছিল, আমি উপস্থিত তা ছেড়ে দিয়েছি; ও ধীরে ধীরে হবে। এখন আমি চাই—একদল অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত প্রচারক। বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা, সংস্কৃত ও কয়েকটি পাশ্চাত্য ভাষা এবং বেদান্তের বিভিন্ন মতবাদ শিক্ষা দেবার জন্য মান্দ্রাজে একটি কলেজ করতেই হবে। ওর মুখপত্রস্বরূপ ইংরেজী ও দেশীয় ভাষায় পত্রিকা হবে, সঙ্গে সঙ্গে ছাপাখানাও থাকবে। এর মধ্যে একটা কিছু কর—তাহলে জানব, তোমরা কিছু করেছ—কেবল আমাকে আকাশে তুলে দিয়ে প্রশংসা করলে কিছু হবে না।
তোমাদের জাতটা দেখাক যে তারা কিছু করতে প্রস্তুত। তোমরা ভারতে যদি এরূপ কিছু করতে না পার, তবে আমাকে একলা কাজ করতে দাও। জগৎকে দেবার জন্য আমার কাছে একটা বাণী আছে, যারা তা আদরপূর্বক নেবে ও কাজে পরিণত করবে, তাদের কাছে সেটি দিয়ে যেতে চাই। কে বা কারা সেটি নেয়, আমি গ্রাহ্য করি না। ‘যারা আমার পিতার কার্য করবে’,৪৮ তারাই আমার আপনার জন।
যাই হোক, আবার বলছি, এইজন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করো—একেবারে ছেড়ে দিও না। আমার নাম খুব বড় করতে হবে না। আমি দেখতে চাই আমার ভাবগুলি যেন কাজে পরিণত হয়। সকল মহাপুরুষের চেলারাই চিরকাল উপদেশগুলির সঙ্গে গুরুকে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ফেলে, এবং অবশেষে ব্যক্তির জন্য তাঁর ভাবগুলি নষ্ট হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যগণ যেন এই প্রকার না করেন। এ বিষয়ে তাঁদের সর্বদাই সাবধান থাকতে হবে। তোমরা ভাবগুলির জন্য কাজ কর, ব্যক্তির জন্য নয়। প্রভু তোমাদের আশীর্বাদ করুন।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
১৫৯
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৫
প্রাণাধিকেষু,
এক্ষণে বহুত খবরের কাগজ এককাট্টা হইয়া গেল। আর পাঠাইবার আবশ্যক নাই। হুজুগ এক্ষণে ভারতের মধ্যেই চলুক। বোধ করি, তোমরা এতদিনে কলিকাতায় আসিয়া থাকিবে। তারকদার পত্র শেষ, তারপর আর কোন সংবাদ নাই।
কালী কলিকাতায় থাকিয়া কাগজপত্র ছাপাইতেছে—সে বড় ভাল কথা, কিন্তু এখানে আর পাঠাইবার আবশ্যক নাই। … কিন্তু এই যে দেশময় একটা হুজুগ উঠিয়াছে, ইহার আশ্রয়ে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়। অর্থাৎ স্থানে স্থানে branch (শাখা) স্থাপন করিবার প্রযত্ন কর। ফাঁকা আওয়াজ না হয়। মান্দ্রাজবাসীদের সহিত যোগদান করিয়া স্থানে স্থানে সভা প্রভৃতি স্থাপন করিতে হইবে। যে খবরের কাগজ বাহির হইবার কথা হইতেছিল, তাহার কি হইল? খবরের কাগজ চালাইবার তোমার ভাবনা কি আমরা জানি না; এখন লোক যে অল্প। চিঠি লিখে, ইত্যাদি করে সকলের ঘাড়ে গতিয়ে দাও; তারপর গড় গড় করে চলে যাবে। বাহাদুরি দেখাও দেখি। দাদা, মুক্তি নাই বা হল, দু-চার বার নরককুণ্ডে গেলেই বা। এ-কথা কি মিথ্যে?—
মনসি বচসি কায়ে পুণ্যপীযূষপূর্ণঃ
ত্রিভুবনমুপকারশ্রেণীভিঃ প্রীয়মাণঃ।
পরগুণপরমাণুং পর্বতীকৃত্য কেচিৎ
নিজহৃদি বিকসন্তঃ সন্তি সন্তঃ কিয়ন্তঃ॥৪৯
নাই বা হল তোমাদের মুক্তি। কি ছেলেমানষি কথা! রাম রাম! আবার ‘নেই নেই’ বললে সাপের বিষ ক্ষয় হয়ে যায় কিনা? ও কোন্ দিশী বিনয়—‘আমি কিছু জানি না, আমি কিছুই নই’—ও কোন্ দিশী বৈরাগ্যি আর বিনয় হে বাপ! ও রকম ‘দীনাহীনা’ ভাবকে দূর করে দিতে হবে! আমি জানিনি তো কোন্ শালা জানে? তুমি জান না তো এতকাল করলে কি? ও-সব নাস্তিকের কথা, লক্ষ্মীছাড়ার বিনয়। আমরা সব করতে পারি, সব করব; যার ভাগ্যে আছে, সে আমাদের সঙ্গে হুহুঙ্কারে চলে আসবে, আর লক্ষ্মীছাড়াগুলো বেড়ালের মত কোণে বসে মেউ মেউ করবে।
এক মহাপুরুষ লিখছেন, ‘আর কেন? হুজুগ খুব হল, ঘরে ফিরে এস।’ বেকুব; তোকে মরদ বলতুম, যদি একটা ঘর করে আমায় ডাকতে পারতিস। ও-সব আমি দশ বৎসর দেখে দেখে পাকা হয়ে গেছি। কথায় আর চিঁড়ে ভেজে না। যার মনে সাহস, হৃদয়ে ভালবাসা আছে, সে আমার সঙ্গে আসুক; বাকী কাউকে আমি চাই না, মার কৃপায় আমি এক লাখ আছি—বিশ লাখ হব। আমার একটি কাজ হয়ে গেলেই আমি নিশ্চিন্ত। রাখাল ভায়া, তুমি উদ্যোগ করে সেইটি করে দেবে—মা-ঠাকুরাণীর জন্য একটা জায়গা। আমার টাকাকড়ি সব মজুত; খালি তুমি উঠে পড়ে লেগে একটা জমি দেখে শুনে কেনো। জমির জন্য ৩।৪ অথবা ৫ হাজার পর্যন্ত লাগে তো ক্ষতি নাই। ঘর-দ্বার এক্ষণে মাটির ভাল। একতলা কোঠার চেয়ে মাটির ঘর ঢের ভাল। ক্রমে ঘর-দ্বার ধীরে ধীরে উঠবে। যে নামে বা রকমে জমি কিনলে অনেক দিন চলবে, তাই উকিলদের পরামর্শে করিবে। আমার দেশে যাওয়া অনিশ্চিত। সেখানেও ঘোরা, এখানেও ঘোরা; তবে এখানে পণ্ডিতের সঙ্গ, সেখানে মূর্খের সঙ্গ—এই স্বর্গ-নরকের ভেদ। এদেশের লোকে এককাট্টা হয়ে কাজ করে, আর আমাদের সকল কাজ বৈরিগ্যি (অর্থাৎ কুঁড়েমি), হিংসা প্রভৃতির মধ্যে পড়ে চুরমার।
হরমোহন, মধ্যে মধ্যে এক দিগ্গজ পত্র লেখেন—তা আমি অর্ধেক পড়তে পারি না, ইহা আমার পক্ষে পরম মঙ্গল। কারণ অধিকাংশ খবরই এই ডৌলের যথা—‘অমুক ময়রার দোকানে বসে অমুক ছেলেরা আপনার বিরুদ্ধে এই-সকল কথা বলিতেছিল, আর তাহাতে আমি অসহ্য বোধে তাহাদের সহিত কলহ করিলাম ইতি।’ আমার পক্ষসমর্থনের জন্য তাহাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু জেলে-মালা আমার সম্বন্ধে কে কি বলিতেছে, ইহা সবিশেষ শুনিবার বিশেষ বাধা এই যে—‘স্বল্পশ্চ কালো বহবশ্চ বিঘ্নাঃ’ (সময় অল্প, বিঘ্ন অনেক)।
একটা Organized Society (সঙ্ঘবদ্ধ সমিতি) চাই। শশী ঘরকন্না দেখুক, সান্যাল টাকাকড়ি বাজারপত্রের ভার নিক, শরৎ সেক্রেটারী হোক অর্থাৎ চিঠিপত্র সব লেখা ইত্যাদি। একটা ঠিকানা কর, মিছে হাঙ্গাম কি করছ—বুঝতে পারলে কিনা? খবরের কাগজে ঢের হয়ে গেছে, এক্ষণে আর দরকার নাই। এক্ষণে তোমরা কিছু কর দিকি দেখি। যদি একটা মঠ বানাতে পার, তবে বলি বাহাদুর, নইলে ঘোড়ার ডিম। মান্দ্রাজের লোকদের সঙ্গে যুক্তি করে কাজ করবে। তাদের কাজ করবার অনেক শক্তি আছে। এবারকার মহোৎসব এমনি হুজুগ করে করবে যে, এমন আর কখনও হয় নাই। খাওয়াদাওয়ার হুজুগ যত কম হয়, ততই ভাল। দাঁড়া-প্রসাদ, মালসা ভোগ যথেষ্ট। সুরেশ দত্ত-র ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনী’ পাঠ করলাম। খুব ভাল; তবে … প্রভৃতি উদাহরণগুলি ছাপিয়েছেন কেন? কি মহাপাপ, ছি ছি!
আমি একটা ইংরেজীতে শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবন very short (অতি সংক্ষিপ্ত) লিখিয়া পাঠাইতেছি। সেটা ছাপাইয়া ও বঙ্গানুবাদ করিয়া মহোৎসবে বিক্রী করিবে, বিতরণ করিলে লোকে পড়ে না। কিঞ্চিৎ দাম চাই। খুব ধূমধামের সঙ্গে মহোৎসব করিবে। কিছু collection (চাঁদা) নেবে। তাতে দু এক হাজার টাকা হতে পারবে। তাহলে মা-ঠাকুরাণীর জমির উপর দস্তুরমত ঘর-দ্বার হয়ে যাবে। ইতি
চৌরস বুদ্ধি চাই, তবে কাজ হয়। যে গ্রামে বা শহরে যাও, যেখানে দশজন লোক পরমহংসদেবকে শ্রদ্ধাভক্তি করে, সেইখানেই একটা সভা স্থাপন করিবে। এত গ্রামে গ্রামে কি ভেরেণ্ডা ভাজলে নাকি? হরিসভা প্রভৃতিগুলোকে ধীরে ধীরে ‘স্বাহা’ করতে হবে। কি বলব তোদের? আর একটা ভূত যদি আমার মত পেতুম! ঠাকুর কালে সব জুটিয়ে দেবেন। … শক্তি থাকলেই বিকাশ দেখাতে হবে। … মুক্তি-ভক্তির ভাব দূর করে দে। এই একমাত্র রাস্তা আছে দুনিয়ায়—পরোপকারায় হি সতাং জীবিতং পরার্থং প্রাজ্ঞ উৎসৃজেৎ (পরোপকারের জন্যই সাধুদিগের জীবন, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি পরের জন্যই তা উৎসর্গ করবেন)। তোমার ভাল করলেই আমার ভাল হয়, দোসরা আর উপায় নেই, একেবারেই নেই। ‘হে ভগবান্, হে ভগবান্!’ আরে ভগবান্ হেন করবেন, তেন করবেন—আর তুমি বসে বসে কি করবে? … তুই ভগবান্, আমি ভগবান্, মানুষ ভগবান্ দুনিয়াতে সব করছে; আবার ভগবান্ কি গাছের উপর বসে আছেন? এই তো বুদ্ধির দৌড়, তারপর— … যদি কল্যাণ চাস, ওসব হিংসে ঝগড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে লেগে যা। যারা তা করতে পারবে না, তাদের বিদায় করে দে।
বিমলা … শশী সাণ্ডেলের লিখিত এক পুস্তক পাঠিয়েছেন এবং লিখেছেন যে, শশীবাবুর সাংসারিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ—তাই জন্য তাঁর পুস্তকের যদি এ দেশে কেহ কেহ সহায়তা করে। দাদা, সে পুঁথি হল বাঙলা ভাষায়—এদেশের লোক কি সাহায্য করবে?—পুঁথি পড়ে বিমলা অবগত হয়েছেন যে, এ দুনিয়াতে যত লোক আছে, তারা সকলে অপবিত্র এবং তাদের প্রকৃতিতে আসলে ধর্ম হবার যো-টি নাই, কেবল ভারতবর্ষের একমুষ্টি ব্রাহ্মণ যাঁরা আছেন, তাঁদের ধর্ম হতে পারবে। আবার তাঁদের মধ্যে শশী (সাণ্ডেল) আর বিমলাচরণ—এঁরা হচ্ছেন চন্দ্রসূর্যস্বরূপ। সাবাস, কি ধর্মের জোর রে বাপ! বিশেষ বাঙলাদেশে ঐ ধর্মটা বড়ই সহজ। অমন সোজা রাস্তা তো আর নাই। তপ-জপের সার সিদ্ধান্ত এই যে, আমি পবিত্র আর সব অপবিত্র! পৈশাচিক ধর্ম, রাক্ষসী ধর্ম, নারকী ধর্ম! যদি আমেরিকার লোকের ধর্ম হতে পারে না, যদি এদেশে ধর্ম প্রচার করা ঠিক নয়, তবে তাহাদের সাহায্য-গ্রহণে আবশ্যক কি? এদিকে অযাচিত বৃত্তির ধুম, আবার পুঁথিময় আক্ষেপ, আমায় কেউ কিছু দেয় না। বিমলা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, যখন ভারতসুদ্ধ লোক শশী (সাণ্ডেল) আর বিমলার পদপ্রান্তে ধনরাশি ঢেলে দেয় না, তখন ভারতের সর্বনাশ উপস্থিত। কারণ, শশীবাবু সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা অবগত আছেন এবং বিমলা তৎপাঠে নিশ্চিত অবগত হয়েছেন যে, তিনি ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কেহই পবিত্র নাই। এ রোগের ঔষধ কি? বলি, শশী- বাবুকে মালাবারে যেতে বলো। সেখানকার রাজা সমস্ত প্রজার জমি ছিনিয়ে নিয়ে ব্রাহ্মণগণের চরণার্পণ করেছেন, গ্রামে গ্রামে বড় বড় মঠ, চর্ব্য চূষ্য খানা, আবার নগদ। … ভোগের সময় ব্রাহ্মণেতর জাতের স্পর্শে দোষ নাই—ভোগ সাঙ্গ হলেই স্নান; কেন না ব্রাহ্মণেতর জাতি অপবিত্র—অন্য সময় তাদের স্পর্শ করাও নাই। এক শ্রেণীর সাধু সন্ন্যাসী আর ব্রাহ্মণ বদমাশ দেশটা উৎসন্ন দিয়েছে। ‘দেহি দেহি’ চুরি-বদমাশি—এরা আবার ধর্মের প্রচারক! পয়সা নেবে, সর্বনাশ করবে, আবার বলে ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না’—আর কাজ তো ভারি—‘আলুতে বেগুনেতে যদি ঠেকাঠেকি হয়, তাহলে কতক্ষণে ব্রহ্মাণ্ড রসাতলে যাবে?’ ‘১৪ বার হাতে-মাটি না করিলে ১৪ পুরুষ নরকে যায়, কি ২৪ পুরুষ?’—এই-সকল দুরূহ প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেছেন আজ দু হাজার বৎসর ধরে। এদিকে 1/4 of the people are starving (সিকি ভাগ লোক না খেতে পেয়ে মরছে)। ৮ বৎসরের মেয়ের সঙ্গে ৩০ বৎসরের পুরুষের বে দিয়ে মেয়ের মা-বাপ আহ্লাদে আটখানা। … আবার ও কাজে মানা করলে বলেন, আমাদের ধর্ম যায়! ৮ বৎসরের মেয়ের গর্ভাধানের যাঁরা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করেন, তাঁদের কোন দেশী ধর্ম? আবার অনেকে এই প্রথার জন্য মুসলমানদের ঘাড়ে দোষ দেন। মুসলমানদের দোষ বটে!! সব গৃহ্যসূত্রগুলো পড়ে দেখ দেখি, ‘হস্তাৎ যোনিং ন গূহতি’ যতদিন, ততদিন কন্যা, এর পূর্বেই তার বে দিতে হবে। সমস্ত গৃহ্যসূত্রেরই এই আদেশ।
বৈদিক অশ্বমেধ যজ্ঞের ব্যাপার স্মরণ কর—‘তদনন্তরং মহিষীং অশ্ব-সন্নিধৌ পাতয়েৎ’ ইত্যাদি! আর হোতা পোতা ব্রহ্মা উদ্গাতা প্রভৃতিরা বেডোল মাতাল হয়ে কেলেঙ্কারী করত। বাবা, জানকী বনে গিয়েছিলেন, রাম একা অশ্বমেধ করলেন—শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেম বাবা!
এ-কথা সমস্ত ব্রাহ্মণেই আছে—সমস্ত টীকাকার স্বীকার করেছেন। না করবার যো-টি কি!
এ সকল কথা বলবার মানে এই—প্রাচীনকালে ঢের ভাল জিনিষ ছিল, খারাপ জিনিষও ছিল। ভালগুলি রাখতে হবে, কিন্তু আসছে যে ভারত—Future India—Ancient India-র (ভবিষ্যৎ ভারত প্রাচীন ভারতের) অপেক্ষা অনেক বড় হবে। যেদিন রামকৃষ্ণ জন্মেছেন, সেইদিন থেকেই Modern India (বর্তমান ভারত)—সত্যযুগের আবির্ভাব! আর তোমরা এই সত্যযুগের উদ্বোধন কর—এই বিশ্বাসে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হও।
তাইতেই যখন তোমরা বলো, রামকৃষ্ণ অবতার, আবার তারপরই বল, আমরা কিছুই জানি না, তখনই আমি বলি, liar (মিথ্যাবাদী), চোর, ঝুঠ বিলকুল। যদি রামকৃষ্ণ পরমহংস সত্য হন, তোমরাও সত্য। কিন্তু দেখাতে হবে। … তোমাদের সকলের ভেতর মহাশক্তি আছে, নাস্তিকের ভেতর ঘোড়ার ডিম আছে। যারা আস্তিক, তারা বীর; তাদের মহাশক্তি বিকাশ হবে। দুনিয়া ভেসে যাবে—‘দয়া দীন উপকার’—মানুষ ভগবান্, নারায়ণ—আত্মায় স্ত্রী পুং নপুং ব্রহ্মক্ষত্রাদি ভেদ নাই—ব্রহ্মাদিস্তম্ব পর্যন্ত নারায়ণ। কীট less manifested (অল্প অভিব্যক্ত), ব্রহ্ম more manifested (অধিক অভিব্যক্ত)। Every action that helps a being manifest its divine nature more and more is good; every action that retards it, is evil.
The only way of getting our divine nature manifested is by helping others do the same.
If there is inequality in nature, still there must be equal chance for all—or if greater for some and for some less—the weaker should be given more chance than the stronger.৫০
অর্থাৎ চণ্ডালের বিদ্যাশিক্ষার যত আবশ্যক, ব্রাহ্মণের তত নহে। যদি ব্রাহ্মণের ছেলের একজন শিক্ষকের আবশ্যক, চণ্ডালের ছেলের দশ জনের আবশ্যক। কারণ যাহাকে প্রকৃতি স্বাভাবিক প্রখর করেন নাই তাহাকে অধিক সাহায্য করিতে হইবে। তেলা মাথায় তেল দেওয়া পাগলের কর্ম। The poor, the down-trodden, the ignorant, let these be your God.৫১
মহা দঁক সামনে—সাবধান! ঐ দঁকে সকলে পড়ে মারা যায়—ঐ দঁক হচ্ছে যে—হিঁদুর (এখনকার) ধর্ম বেদে নাই, পুরাণে নাই, ভক্তিতে নাই, মুক্তিতে নাই—ধর্ম ঢুকেছেন ভাতের হাঁড়িতে। [এখনকার] হিঁদুর ধর্ম বিচারমার্গেও নয়, জ্ঞানমার্গেও নয়—ছুঁৎমার্গে; আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না, ব্যস্। এই ঘোর বামাচার ছুঁৎমার্গে পড়ে প্রাণ খুইও না। ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু’, কি কেবল পুঁথিতে থাকিবে না কি? যারা এক টুকরা রুটি গরীবের মুখে দিতে পারে না, তারা আবার মুক্তি কি দিবে! যারা অপরের নিঃশ্বাসে অপবিত্র হয়ে যায়, তারা আবার অপরকে কি পবিত্র করিবে? ছুঁৎমার্গ is a form of mental disease (একপ্রকার মানসিক ব্যাধি), সাবধান! All expansion is life, all contraction is death. All love is expansion, all selfishness is contraction. Love is therefore the only law of life. He who loves lives, he who is selfish is dying. Therefore love for love's sake, because it is only law of life, just you breathe to live.৫২ This is the secret of নিষ্কাম প্রেম, কর্ম, &c. (ইহাই নিষ্কাম প্রেম, কর্ম প্রভৃতির রহস্য)।
শশীর (সাণ্ডেল) যদি কিছু উপকার করিতে পার চেষ্টা করিবে। সে অতি উদার ব্যক্তি ও নিষ্ঠাবান, তবে সঙ্কীর্ণপ্রাণ। পরদুঃখকাতরতা সকলের ভাগ্যে হয় না। রামকৃষ্ণাবতারে জ্ঞান ভক্তি ও প্রেম। অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত প্রেম, অনন্ত কর্ম, অনন্ত জীবে দয়া। তোরা এখনও বুঝতে পারিসনি। শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ (কেহ কেহ আত্মার বিষয় শুনিয়াও ইঁহাকে জানিতে পারে না)। What the whole Hindu race has thought in ages, he lived in one life. His life is the living commentary to the Vedas of all the nations.৫৩ ক্রমশঃ লোকে বুঝবে—আমার পুরানো বোল—struggle, struggle up to light. Onward, (প্রাণপণ সংগ্রাম করে আলোর দিকে অগ্রসর হও)। অলমিতি—দাস
নরেন্দ্র
১৬০*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
ব্রুকলিন
২০ জানুআরী, ১৮৯৫
… আপনার পিতা যে তাঁর জীর্ণ শরীর ত্যাগ করবেন, আমি পূর্বেই তার কতকটা আভাস পেয়েছিলাম, কিন্তু যখন এরূপ সঙ্গতিহীন মায়ার তরঙ্গ কাউকে আঘাত করবার উপক্রম করে, তখন তাকে সে বিষয় লেখাটা আমার অভ্যাস নয়। তবে এই সময়গুলি জীবনের এক একটা অধ্যায় পাল্টানোর মত—আর আমি জানি, আপনি এতে সম্পূর্ণ অবিচলিত আছেন। সমুদ্রের উপরিভাগটা পর্যায়ক্রমে উঠে নামে বটে, কিন্তু যে আত্মা ধীরভাবে তা পর্যবেক্ষণ করছেন, সেই জ্যোতির তনয়ের নিকট প্রত্যেক পতন ওর ভেতর দিকটা এবং নিম্নদেশস্থ মুক্তার স্তর ও প্রবালসমূহকে বেশী বেশী করে প্রকাশিত করে। আসা যাওয়া সম্পূর্ণ ভ্রমমাত্র। আত্মা কখনও আসেনও না, যানও না। যখন সমুদয় দেশ আত্মার মধ্যেই রয়েছে, তখন সে স্থানই বা কোথায়, আত্মা যেখানে যাবেন? যখন সমুদয় কাল আত্মাতেই রয়েছে, তখন ওর দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করবার ও ছাড়বার সময়ই বা কোথায়?
পৃথিবী ঘুরছে, ঐ ঘোরাতেই এই ভ্রম উৎপন্ন হচ্ছে যে সূর্য ঘুরছে; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে সূর্য ঘুরছে না। সেইরূপ প্রকৃতি বা মায়া বা স্বভাব ঘুরছে, পরিণাম প্রাপ্ত হচ্ছে, আবরণের পর আবরণ উন্মোচন করছে, এই মহান্ গ্রন্থের পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছে—এদিকে সাক্ষিস্বরূপ আত্মা অবিচলিত ও অপরিণামী জ্ঞানসুধাপানে বিভোর আছেন। যত জীবাত্মা পূর্বে ছিল বা বর্তমানে আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে, সকলেই বর্তমান কালে রয়েছে, আর জড় জগতের একটি উপমা ব্যবহার করে বলা যায় যে, তারা সকলেই এক জ্যামিতিক বিন্দুতে রয়েছে। যেহেতু আত্মাতে দেশের ভাব থাকতে পারে না, সেইহেতু যাঁরা সকলে আমাদের ছিলেন, আমাদের রয়েছেন এবং আমাদের হবেন, তাঁরা সকলেই আমাদের সঙ্গে সর্বদাই রয়েছেন, সর্বদাই ছিলেন এবং সর্বদাই থাকবেন। আমরা তাঁদের মধ্যে রয়েছি এবং তাঁরাও আমাদের মধ্যে রয়েছেন।
|
একখানা মেঘ চাঁদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, তাতে এই ভ্রমের উৎপত্তি হচ্ছে যে, চাঁদটাই চলেছে। তেমনি প্রকৃতি, দেহ, জড়বস্তু—এইগুলি সচল, গতিশীল; এদের গতিতেই এই ভ্রম উৎপন্ন হচ্ছে যে, আত্মা গতিশীল। সুতরাং অবশেষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সহজাত জ্ঞান (অথবা প্রেরণা?) দ্বারা সর্বজাতির উচ্চনীচ সব রকমের লোক, মৃতব্যক্তিদের অস্তিত্ব নিজেদের কাছেই অনুভব করে এসেছে, যুক্তির দৃষ্টিতেও তা সত্য।
প্রত্যেক জীবাত্মাই এক একটা নক্ষত্রস্বরূপ, আর ঈশ্বররূপ সেই অনন্ত নির্মল নীল আকাশে এই নক্ষত্ররাজি বিন্যস্ত রয়েছে। সেই ঈশ্বরই প্রত্যেক জীবাত্মার মূলস্বরূপ, তিনি প্রত্যেকের যথার্থ স্বরূপ, প্রত্যেকের প্রকৃত ব্যক্তিত্ব তিনিই। কতকগুলি জীবাত্মারূপ তারকা—যাঁরা আমাদের দিগন্তের বাইরে চলে গেছেন, তাঁদের সন্ধানেই ধর্ম জিনিষটার আরম্ভ; আর এই অনুসন্ধান সমাপ্ত হল—যখন তাঁদের সকলকেই ভগবানের মধ্যে পাওয়া গেল এবং আমরা আমাদের নিজেদেরও যখন তাঁর মধ্যে পেলাম। সুতরাং ভিতরের কথা হচ্ছে এই যে, আপনার পিতা যে জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করেছিলেন, তা ত্যাগ করেছেন এবং অনন্তকাল যেখানে ছিলেন, সেখানেই অবস্থিত রয়েছেন। তিনি কি এ জগতে বা অন্য কোন জগতে আর একটি ঐরূপ বস্ত্র প্রস্তুত করে পরিধান করবেন? আমি ভগবৎসমীপে হৃদয়ের সহিত প্রার্থনা করছি, যে পর্যন্ত না পূর্ণ জ্ঞানের সহিত তিনি তা না করতে পারছেন, তাঁকে যেন আর তা না করতে হয়। প্রার্থনা করি, কাউকে যেন তার নিজকৃত পূর্ব কর্মের অদৃশ্য শক্তিতে পরিচালিত হয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও না যেতে হয়। প্রার্থনা করি, সকলেই যেন মুক্ত হতে পারে অর্থাৎ জানতে পারে যে, আমরা মুক্ত। আর যদি বা আবার স্বপ্ন দেখতে হয়, তবে তাদের সে স্বপ্ন যেন শান্তি ও আনন্দপূর্ণ হয়। ইতি
বিবেকানন্দ
১৬১*
নিউ ইয়র্ক
২৪ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
মনে হয়—এ বৎসর আমার অতিরিক্ত পরিশ্রম হচ্ছে, কারণ অবসাদ অনুভব করছি। এক দফা বিশ্রামের খুব বেশী দরকার। সুতরাং মার্চ মাসের শেষভাগে বোষ্টনের কাজে হাত দেওয়ার সম্বন্ধে আপনার প্রস্তাবটি সমীচীন বটে। এপ্রিলের শেষাশেষি আমি ইংলণ্ড যাত্রা করব।
ক্যাট্স্কিল অঞ্চলে অতি অল্পমূল্যে বিস্তীর্ণ ভূমিখণ্ড পাওয়া যেতে পারে। একশত-এক একর পরিমাণ একটি জমি আছে; মূল্য মাত্র দু-শ ডলার। অর্থ মজুত রয়েছে। কিন্তু জমি আমার নামে তো আর কিনতে পারি না। এ দেশে আপনিই আমার একমাত্র সম্পূর্ণ বিশ্বাসভাজন বন্ধু। আপনি সম্মত হলে ঐ জমিটি আপনার নামে ক্রয় করি। গ্রীষ্মকালে শিক্ষার্থীরা ওখানে গিয়ে ইচ্ছামত কুটীর নির্মাণ বা শিবির রচনা করে ধ্যানাভ্যাস করতে পারবে। পরে অর্থসংগ্রহে সক্ষম হলে তারা সেখানে পাকা ঘর নির্মাণ করতে পারবে।
কাল এ-মাসের শেষ রবিবাসরীয় বক্তৃতা। আগামী মাসের প্রথম রবিবারে বক্তৃতা হবে ব্রুকলিন শহরে, অবশিষ্ট তিনটি নিউ ইয়র্কে। এ-বৎসরের মত নিউ ইয়র্ক-বক্তৃতাবলী এখানেই শেষ করব।
প্রাণ ঢেলে খেটেছি। আমার কাজের মধ্যে সত্যের বীজ যদি কিছু থাকে, কালে তা অঙ্কুরিত হবেই। অতএব আমি নিশ্চিন্ত—সকল বিষয়েই। বক্তৃতা এবং অধ্যাপনায় আমার বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছে। ইংলণ্ডে কয়েক মাস কাজ করার পর ভারতবর্ষে ফিরে গিয়ে বৎসর-কয়েকের জন্য অথবা চিরতরে গা-ঢাকা দেব। আমি যে ‘নিষ্কর্মা সাধু’ হয়ে থাকিনি, সে বিষয়ে অন্তর থেকে আমি নিঃসন্দেহ। একটি লেখবার খাতা আমার আছে। এটি আমার সঙ্গে পৃথিবীময় ঘুরছে। দেখছি সাত বৎসর পূর্বে এতে লেখা রয়েছেঃ এবার একটি একান্ত স্থান খুঁজে নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় পড়ে থাকতে হবে। কিন্তু তাহলে কি হয়, এই সব কর্মভোগ বাকী ছিল! আমার বিশ্বাস, এবার কর্মক্ষয় হয়েছে, এবং ভগবান্ আমাকে প্রচারকার্য তথা শুভকর্মের বন্ধন থেকেও অব্যাহতি দেবেন।
আত্মাই এক এবং অখণ্ড সত্তাস্বরূপ আর সব অসৎ—এই জ্ঞান হয়ে গেলে কি আর কোন ব্যক্তি বা বাসনা মানসিক উদ্বেগের হেতু হতে পারে? মায়ার প্রভাবেই পরোপকার ইত্যাদি খেয়ালগুলো আমার মাথায় ঢুকেছিল, এখন আবার সরে যাচ্ছে। চিত্তশুদ্ধি অর্থাৎ চিত্তকে জ্ঞানলাভের উপযোগী করা ছাড়া কর্মের যে আর কোন সার্থকতা নেই—এ বিষয়ে আমার বিশ্বাস ক্রমশঃ দৃঢ় হচ্ছে।
দুনিয়া তার ভাল মন্দ নিয়ে নানা রূপে চলতে থাকবে। ভাল মন্দ শুধু নূতন নামে ও নূতন স্থানে দেখা দেবে। নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তি ও বিশ্রামের জন্য আমার হৃদয় তৃষিত। ‘একাকী বিচরণ কর! একাকী বিচরণ কর! যিনি একাকী অবস্থান করেন, কাহারও সহিত কদাচ তাঁহার বিরোধ হইতে পারে না। তিনি অপরের উদ্বেগের হেতু হন না, অপরেও তাঁহার উদ্বেগের হেতু হন না।’ সেই ছিন্ন বস্ত্র (কৌপীন), মুণ্ডিত মস্তক, তরুতলে শয়ন ও ভিক্ষান্ন-ভোজন—হায়! এগুলিই এখন আমার তীব্র আকাঙ্ক্ষার বিষয়! শত অপূর্ণতা সত্ত্বেও সেই ভারতভূমিই একমাত্র স্থান, যেখানে আত্মা তার মুক্তির সন্ধান পায়—ভগবানের সন্ধান পায়। পাশ্চাত্যের এ-সব আড়ম্বর সর্বথা অন্তঃসারশূন্য ও আত্মার বন্ধন। জীবনে আর কখনও এর চেয়ে তীব্রভাবে জগতের অসারতা অনুভব করিনি। ভগবান্ সকলের বন্ধন ছিন্ন করে দিন—সকলেই মায়া-মুক্ত হোক, ইহাই বিবেকানন্দের চিরন্তন প্রার্থনা।
১৬২*
[মিস ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
528, 5th Avenue, নিউ ইয়র্ক
২৪ জানুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় মিস বেল,
আশা করি ভাল আছ …
আমার শেষ বক্তৃতাটা পুরুষদের দ্বারা খুব বেশী সমাদৃত হয়নি, কিন্তু দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে মেয়েদের দ্বারা। তুমি জান যে, ব্রুকলিন জায়গাটা নারী-অধিকার আন্দোলনের বিরোধিতা কেন্দ্র, তাই যখন আমি বললাম, মেয়েরা সর্ববিষয়ে অধিকার পাবার যোগ্য এবং তাদের তা পাওয়া উচিত, তখন বলাই বাহুল্য, পুরুষেরা সেটা পছন্দ করল না। তার জন্যে কোন চিন্তা নাই, মেয়েরা খুশীতে আত্মহারা।
আমার আবার একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি গার্নসিদের কাছে যাচ্ছি। শহরতলীতেও একটা ঘর পেয়েছি; সেখানে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে কয়েক ঘণ্টা কাটাব। মাদার চার্চ নিশ্চয়ই এতদিনে সম্পূর্ণ ভাল হয়েছেন এবং তোমরা সকলে আজকালকার সুন্দর আবহাওয়া উপভোগ করছ। মিসেস এডামস্কে আমার পর্বতপ্রমাণ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা দিও, যখন তাঁর সঙ্গে তোমার দেখা হবে। আমার চিঠিগুলি যথারীতি গার্নসিদের কাছে পাঠিয়ে দিও।
সকলের জন্য আমার ভালবাসা।
তোমাদের সদা স্নেহবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১৬৩*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
54W. 33rd Street, N.Y
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
১ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
স্নেহের ভগিনী,
এইমাত্র তোমার সুন্দর পত্রখানি পাইলাম। মাদার চার্চ কনসার্টে যাইতে পারেন নাই শুনিয়া অতীব দুঃখিত হইলাম। নিষ্কামভাবে কাজ করিতে বাধ্য হওয়াও সময়ে সময়ে উত্তম সাধন—যদিও তাহাতে নিজকৃত কর্মের ফলভোগ হইতে বঞ্চিত হইতে হয়।
ভগিনী জোসেফাইন লক্ও একখানি সুন্দর চিঠি লিখিয়াছেন। তোমার সমালোচনাগুলি পড়িয়া আমি মোটেই দুঃখিত হই নাই, বরং বিশেষ আনন্দিত হইয়াছি। সেদিন মিস থার্সবির বাড়ীতে এক প্রেসবিটেরিয়ান ভদ্রলোকের সহিত আমার তুমুল তর্ক হইয়াছিল। যেমন হইয়া থাকে, ভদ্রলোকটি অত্যন্ত উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া গালাগালি আরম্ভ করিলেন। যাহা হউক, মিসেস বুল আমাকে এজন্য পরে খুব ভর্ৎসনা করিয়াছেন, কারণ এগুলি আমার কাজের পক্ষে ক্ষতিকর। তোমারও মত ঐ প্রকার বলিয়া বোধ হইতেছে।
তুমি যে এ সম্বন্ধে ঠিক এই সময়েই লিখিয়াছ, ইহা আনন্দের বিষয়, কারণ আমি ঐ বিষয়ে যথেষ্ট ভাবিতেছি। প্রথমতঃ আমি এই সকল ব্যাপারের জন্য আদৌ দুঃখিত নই; হয়তো তুমি ইহাতে বিরক্ত হইবে—হইবার কথা বটে। সাংসারিক উন্নতির জন্য মধুরভাষী হওয়া যে কত ভাল, তাহা আমি বিলক্ষণ জানি। আমি মিষ্টভাষী হইতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি, কিন্তু যখন অন্তরস্থ সত্যের সহিত একটা ভয়ঙ্কর আপস করিতে হয়, তখনই আমি থামিয়া যাই। আমি বিনম্র দীনতায় বিশ্বাসী নহি—সমদর্শিত্বের ভক্ত!
সাধারণ মানবের কর্তব্য—তাহার ‘ঈশ্বর’—সমাজের সকল আদেশ পালন করা; কিন্তু জ্যোতির তনয়গণ কখনও সেরূপ করেন না। ইহা একটি চিরন্তন নিয়ম। একজন নিজেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সামাজিক মতামতের সহিত খাপ খাওয়াইয়া সর্বকল্যাণপ্রদ সমাজের নিকট হইতে সর্ববিধ সুখসম্পদ পায়; অপর ব্যক্তি একাকী থাকিয়া সমাজকে তাঁহার দিকে টানিয়া লন।
সমাজের সঙ্গে যে নিজেকে খাপ খাওয়াইয়া চলে, তাহার পথ কুসুমাস্তীর্ণ, আর যে তাহা করে না, তাহার পথ কণ্টকাকীর্ণ। কিন্তু লোকমতের উপাসকেরা পলকেই বিনাশপ্রাপ্ত হয়; আর সত্যের তনয়গণ চিরজীবী।
আমি সত্যকে একটা অনন্তশক্তিসম্পন্ন জারক (corrosive) পদার্থের সহিত তুলনা করি; উহা যেখানে পড়ে, সেখানেই ক্ষয় করিতে করিতে নিজের পথ করিয়া লয়—নরম জিনিষে শীঘ্র, শক্ত গ্র্যানাইট পাথরে বিলম্বে; কিন্তু পথ করিয়া লইবেই। যল্লিখিতং তল্লিখিতম্। ভগিনী, আমি যে প্রত্যেকটি ঘোর মিথ্যার সহিত মিষ্টবাক্যে আপস করিতে পারি না, সেজন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু আমি তাহা পারি না। সারাজীবন এজন্য ভুগিয়াছি, তবু তাহা করিতে পারি না। আমি বারবার চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু পারি নাই। ঈশ্বর মহিমময়, তিনি আমাকে মিথ্যাচারী হইতে দিবেন না। অবশেষে উহা ছাড়িয়া দিয়াছি। এক্ষণে যাহা ভিতরে আছে, তাহাই ফুটিয়া উঠুক। আমি এমন কোন পথ পাই নাই, যাহা সকলকে খুশী করিবে; সুতরাং আমি স্বরূপতঃ যাহা, তাহাই আমাকে থাকিতে হইবে—আমায় নিজ অন্তরাত্মার নিকট খাঁটি থাকিতে হইবে। ‘যৌবন ও সৌন্দর্য নশ্বর, জীবন ও ধনসম্পত্তি নশ্বর, নাম-যশও নশ্বর, এমন কি পর্বতও চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া ধূলিকণায় পরিণত হয়; বন্ধুত্ব ও প্রেম ক্ষণস্থায়ী, একমাত্র সত্যই চিরস্থায়ী।’ হে সত্যরূপী ঈশ্বর, তুমিই আমার একমাত্র পথপ্রদর্শক হও। আমার যথেষ্ট বয়স হইয়াছে, এখন আর মিষ্ট মধু হওয়া চলে না। আমি যেমন আছি, যেন তেমনই থাকি। ‘হে সন্ন্যাসী, তুমি নির্ভয়ে দোকানদারি ত্যাগ করিয়া, শত্রু-মিত্র কাহাকেও গ্রাহ্য না করিয়া সত্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ থাক।’ এই মুহূর্ত হইতে আমি ইহামুত্রফলভোগবিরাগী হইলাম—‘ইহলোক এবং পরলোকের যাবতীয় অসার ভোগনিচয়কে পরিত্যাগ কর।’ হে সত্য, একমাত্র তুমিই আমার পথপ্রদর্শক হও। আমার ধনের কামনা নাই, নাম-যশের কামনা নাই, ভোগের কামনা নাই। ভগিনী, এ সকল আমার নিকট অতি তুচ্ছ। আমি আমার ভ্রাতৃগণকে সাহায্য করিতে চাহিয়াছিলাম। কিরূপে সহজে অর্থোপার্জন হয়, সে কৌশল আমার জানা নাই—ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমার হৃদয়স্থিত সত্যের বাণী না শুনিয়া আমি কেন বাহিরের লোকদের খেয়াল অনুসারে চলিতে যাইব? ভগিনী, আমার মন এখনও দুর্বল, বাহ্য জগতের সাহায্য আসিলে সময়ে সময়ে অভ্যাসবশতঃ উহা আঁকড়াইয়া ধরি। কিন্তু আমি ভীত নহি। ভয়ই সর্বাপেক্ষা গুরুতর পাপ—ইহাই আমার ধর্মের শিক্ষা।
প্রেসবিটেরিয়ান যাজকমহাশয়ের সহিত আমার যে শেষ বাগ্যুদ্ধ এবং তৎপরে মিসেস বুলের সহিত যে দীর্ঘ তর্ক হয়, তাহা হইতে আমি স্পষ্ট বুঝিয়াছি, মনু কেন সন্ন্যাসিগণকে উপদেশ দিয়াছেনঃ একাকী থাকিবে, একাকী বিচরণ করিবে। বন্ধুত্ব বা ভালবাসামাত্রই সীমাবদ্ধতা; বন্ধুত্বে—বিশেষতঃ মেয়েদের বন্ধুত্বে চিরকালই ‘দেহি দেহি’ ভাব। হে মহাপুরুষগণ, তোমরাই ঠিক বলিয়াছ। যাহাকে কোন ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করিতে হয়, সে সত্য-স্বরূপ ঈশ্বরের সেবা করিতে পারে না। হৃদয়, শান্ত হও, নিঃসঙ্গ হও, তাহা হইলেই অনুভব করিবে—প্রভু তোমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন। জীবন কিছুই নহে, মৃত্যুও ভ্রমমাত্র! এইসব কিছুই নয়, একমাত্র ঈশ্বরই আছেন। হৃদয়, ভয় পাইও না, নিঃসঙ্গ হও। ভগিনী, পথ দীর্ঘ, সময় অল্প, সন্ধ্যাও ঘনাইয়া আসিতেছে। আমাকে শীঘ্র ঘরে ফিরিতে হইবে। আদবকায়দার শিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার সময় আমার নাই। আমি যে বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছি, তাহাই বলিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তুমি সৎস্বভাবা, পরম দয়াবতী। আমি তোমার জন্য সব করিব; কিন্তু রাগ করিও না, আমি তোমাদের সকলকে শিশুর মত দেখি।
আর স্বপ্ন দেখিও না। হৃদয়, আর স্বপ্ন দেখিও না। এক কথায় জগৎকে আমার নূতন কিছু দিবার আছে। মানুষের মন যোগানর সময় আমার নাই, উহা করিতে গেলেই আমি ভণ্ড হইয়া পড়িব। বরং সহস্রবার মৃত্যু বরণ করিব, তবুও [মেরুদণ্ডহীন] জেলি মাছের মত জীপনযাপন করিয়া নির্বোধ মানুষের চাহিদা মিটাইতে পারিব না—তা আমার স্বদেশেই হোক অথবা বিদেশেই হউক। তুমিও যদি মিসেস বুলের মত ভাবিয়া থাক, আমার কোন বিশেষ কার্য আছে, তাহা হইলে ভুল বুঝিয়াছ, সম্পূর্ণ ভুল বুঝিয়াছ। এ জগতে বা অন্য কোন জগতে আমার কোনই কার্য নাই। আমার কিছু বলিবার আছে, উহা আমি নিজের ভাবে বলিব, হিন্দুভাবেও নয়, খ্রীষ্টানভাবেও নয়, বা অন্য কোনভাবেও নয়; আমি উহাদিগকে শুধু নিজের ভাবে রূপ দিব—এইমাত্র। মুক্তিই আমার একমাত্র ধর্ম, আর যাহা কিছু উহাকে বাধা দিতে চাহে, তাহা আমি পরিহার করিয়া চলিব—তাহার সহিত সংগ্রাম করিয়াই হউক বা তাহা হইতে পলায়ন করিয়াই হউক। কী! আমি যাজককুলের মনস্তুষ্টি করিতে চেষ্টা করিব!! ভগিনী, আমার এ-কথা ভুল বুঝিয়া তুমি ক্ষুণ্ণ হইও না। তোমরা শিশুমাত্র, আর শিশুদের অপরের অধীনে থাকিয়া শিক্ষা করাই কর্তব্য। তোমরা এখনও সেই উৎসবের আস্বাদ পাও নাই, যাহা ‘যুক্তিকে অযুক্তিতে পরিণত করে, মর্ত্যকে অমর করে, এই জগৎকে শূন্যে পর্যবসিত করে এবং মানুষকে দেবতা করিয়া তোলে।’ শক্তি থাকে তো লোকে যাহাকে ‘এই জগৎ’ নামে অভিহিত করে, সেই মূর্খতার জাল হইতে বাহির হইয়া আইস। তখন আমি তোমায় প্রকৃত সাহসী ও মুক্ত বলিব। যাহারা এই আভিজাত্যরূপ মিথ্যা ঈশ্বরকে চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া তাহার চরম কপটতাকে পদদলিত করিতে সাহস করে, তাহাদিগকে যদি তুমি উৎসাহ দিতে না পার, তবে চুপ করিয়া থাক; কিন্তু আপস ও মনস্তুষ্টিকরারূপ মিথ্যা মূর্খতা দ্বারা তাহাদিগকে পুনরায় পঙ্কে টানিয়া আনিবার চেষ্টা করিও না।
আমি এই জগৎকে ঘৃণা করি—এই স্বপ্নকে, এই উৎকট দুঃস্বপ্নকে, তাহার গীর্জা ও প্রবঞ্চনাসমূহকে, তাহার শাস্ত্র ও বদমাশিগুলিকে, তাহার সুন্দর মুখ ও কপট হৃদয়কে, তাহার ধর্মধ্বজিতার আস্ফালন ও অন্তঃসারশূন্যতাকে—সর্বোপরি ধর্মের নামে তাহার দোকানদারিকে আমি ঘৃণা করি। কী! সংসারের ক্রীতদাসেরা কি বলিতেছে, তাহা দ্বারা আমার হৃদয়ের বিচার করিবে! ছিঃ! ভগিনী, তুমি সন্ন্যাসীকে চেনো না। বেদ বলেন, সন্ন্যাসী বেদশীর্ষ, কারণ তিনি গীর্জা, ধর্মমত, ঋষি (prophet), শাস্ত্র প্রভৃতি ব্যাপারের ধার ধারেন না। মিশনরীই হউক বা আপর কেহই হউক, তাহারা যথাসাধ্য চীৎকার ও আক্রমণ করুক, আমি তাহাদিগকে গ্রাহ্য করি না। ভর্তৃহরির ভাষায়ঃ৫৪ ইনি কি চণ্ডাল, অথবা ব্রাহ্মণ, অথবা শূদ্র, অথবা তপস্বী, অথবা তত্ত্ববিচারে পণ্ডিত কোন যোগীশ্বর?—এইরূপে নানা জনে নানা আলোচনা করিতে থাকিলেও যোগিগণ রুষ্টও হন না, তুষ্টও হন না; তাঁহারা আপন মনে চলিয়া যান। তুলসীদাসও বলিয়াছেনঃ
হাতী চলে বাজারমে কুত্তা ভোঁকে হাজার
সাধুওঁকা দুর্ভাব নহী জব্ নিন্দে সংসার।যখন হাতী বাজারের মধ্য দিয়া চলিয়া যায়, তখন হাজার কুকুর পিছু পিছু চীৎকার করিতে আরম্ভ করে, কিন্তু হাতী ফিরিয়াও চাহে না। সেরূপ যখন সংসারী লোকেরা নিন্দা করিতে থাকে, তখন সাধুগণ তাহাতে বিচলিত হন না।
আমি ল্যাণ্ডসবার্গের (Landsberg) বাটীতে অবস্থান করিতেছি। ইনি সাহসী ও মহৎ ব্যক্তি। প্রভু তাঁহাকে আশীর্বাদ করুন। কখনও কখনও আমি গার্নসিদের (Guernseys) ওখানে শয়ন করিতে যাই। ঈশ্বর তোমাদের সকলকে চিরকালের জন্য কৃপা করুন। তিনি তোমাদিগকে শীঘ্র এই জগৎ নামক বিরাট ধাপ্পাবাজি হইতে উদ্ধার করুন। তোমরা যেন কদাপি এই জগৎরূপ জরাজীর্ণ ডাইনীর কুহকে না পড়! শঙ্কর তোমাদিগের সহায় হউন! উমা তোমাদিগের সমক্ষে সত্যের দ্বার উদ্ঘাটিত করিয়া দিন এবং তোমাদের সকল মোহ অপসারিত করুন! স্নেহাশীর্বাদসহ
তোমাদের
বিবেকানন্দ
১৬৪
[শ্রীযুক্ত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালকে লিখিত]
54W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
৯ ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় সান্যাল,
তোমার এক পত্র পাইলাম, তাহাতে টাকা পৌঁছিবার সংবাদ লিখিয়াছ; কিন্তু বোষ্টন হইতে কয়েকটি বন্ধু যে টাকা পাঠান, তাহার সংবাদ এখনও পাই নাই—বোধ হয় দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে পাইব। গোপালদাদা কাশী হইতে এক পত্র লেখে। জমির বিষয় যাহা লিখিয়াছ, তাহা কিছুই নহে। পরঞ্চ রাখাল এক পত্রে জমির বিষয় লিখিতেছেন, তাহাও কিছু বিশেষ নহে। দুটো ঘরওয়ালা যে জমির বিষয় লিখিয়াছ, তাহাতে আমার আপত্তি আছে—অর্থাৎ ঘরের জন্য জমিটার কমি না হয়। জমিটা যাহাতে বড় হয়, তাহার চেষ্টা করিবে। তোমাদের ঐ যে গোঁড়ামি, তাহাতে তোমাদের নিয়ে যে কিছু করা—তা আমার দ্বারা হবে না। পরমহংসদেব আমার গুরু ছিলেন; আমি তাঁকে যাই ভাবি, দুনিয়া তা ভাববে কেন? গুরুপূজার ভাব বাঙলাদেশ ছাড়া অন্যত্র আর নাই—তথাপি অন্য লোকে সে ভাব লইবার জন্য প্রস্তুত নহে। তোমাদের ভেতর একটা মস্ত মূর্খতা আছে যে, তোমরা একটা কি! বলি কলিকাতার দশ ক্রোশ তফাতে—না তোমাদের কেউ জানে, না তোমাদের গুরুকে কেউ জানে। আর তোমরা সেই ‘পরমহংসদেব অবতার’ নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ি। ফল—আমি শশী প্রভৃতিকে কিঞ্চিৎ বোঝাবার চেষ্টা করে দেখলাম যে, সে চেষ্টা নিষ্ফল। অতএব তাদের দিল্লীর লাড়ু দিয়ে সরে পড়াই ভাল।
মা-ঠাকুরাণীর জন্য জমি কিনে দিলে আমি আপনাকে ঋণমুক্ত মনে করব। তারপর আমি আর কিছু বুঝিসুঝি না। তোমরা তো আমার নামটি টেনে নেবার বেলা খুব তৈয়ার—যে আমি তোমাদেরই একজন। কিন্তু আমি একটা কাজ করতে বললে অমনি পেছিয়ে পড়, ‘মতলবকী গরজী জগ্ সারো’—এ জগৎ মতলবের গরজী।
আমি বাঙলাদেশ জানি, ইণ্ডিয়া জানি—লম্বা কথা কইবার একজন, কাজের বেলায়—০ (শূন্য)।
আমি এখানে জমিদারীও কিনি নাই, বা ব্যাঙ্কে লাখ টাকাও জমা নাই। এই ঘোর শীতে পর্বত-পাহাড়ে বরফ ঠেলে—এই ঘোর শীতে রাত্তির দুটো-একটা পর্যন্ত রাস্তা ঠেলে লেকচার করে দু-চার হাজার টাকা করেছি—মা-ঠাকুরাণীর জন্য জায়গা কিনলেই আমি নিশ্চিন্ত। গুঁতোগুঁতির আড্ডা করে দেবার শক্তি আমার নাই। অবতারের বাচ্চারা কোথায়—ছোট ছোট অবতারেরা—ওহে অবতারের পিলেগণ?
অলমিতি। তোমাদের হতে আমার কোন আশা নাই। তোমরাও আমার কোন আশা করো না। যে যার আপনার পথে চলে যাও। শুভমস্তু। এ দুনিয়া এই রকম মতলব-ভরা!
চিঠিপত্র উপরোক্ত ঠিকানায় লিখবে এখন হতে। এই ঠিকানা এখন হতে—আমার নিজের আড্ডা। যদি পার একখানা ‘যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ’—English translation (ইংরেজী অনুবাদ) পাঠাবে। মহিনকে দাম দিতে বলবে। ইতি
পূর্বে যে বইয়ের কথা লিখেছি অর্থাৎ সংস্কৃত নারদ-ও শাণ্ডিল্য-সূত্র, তাহা ভুলো না। ইতি
‘আশা হি পরমং দুঃখং নৈরাশ্যং পরমং সুখম্।’ ইতি
নরেন্দ্র
১৬৫*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
228W. 39th st., নিউ ইয়র্ক
১০
ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
এখনও আমার পত্র পাওনি
জেনে বিস্মিত হলাম। তোমার পত্র পাবার ঠিক পরেই আমি তোমাকে লিখি
এবং নিউ ইয়র্কে দেওয়া আমার তিনটি বক্তৃতা-সংক্রান্ত কয়েকখানি পুস্তিকা
পাঠাই। রবিবাসরীয় ও সাধারণে প্রদত্ত এই ভাষণগুলি সঙ্কেতলিপিতে লিখিত
হয়ে পরে মুদ্রিত হয়েছে। এইরূপ তিনটি বক্তৃতা দুখানি পুস্তিকায় মুদ্রিত হয়,
তারই কয়েকখানি তোমাকে পাঠাই। নিউ ইয়র্কে আরও দুই সপ্তাহ আছি।
অতঃপর ডেট্রয়েট। তারপরে বোষ্টনে সপ্তাহখানেক বা সপ্তাহ দুই।
এ বৎসর অবিরাম কাজের ফলে আমি ভগ্নস্বাস্থ্য। স্নায়ুই বিশেষভাবে আক্রান্ত। সারা শীতে এক রাত্রিও সুনিদ্রা হয়নি। দেখছি—অতিরিক্ত খাটুনি হয়ে যাচ্ছে। আবার সামনে ইংলণ্ডে মস্ত কাজ।
কাজগুলো করতে হবে। তারপর ভারতে ফিরে গিয়ে বাকী জীবন বিশ্রাম! ভগবানের উদ্দেশে কর্মের ফল সমর্পণ করে আমি জগতের কল্যাণের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। এখন বিশ্রামই আমার অভীপ্সিত। আশা করি কিছু অবসর পাব ও ভারতীয়গণ আমাকে নিষ্কৃতি দেবে।
হায়! যদি কয় বছরের জন্য আমি নির্বাক হতে পারতাম এবং আমাকে মোটেই কথা বলতে না হত! বস্তুতঃ এ-সব পার্থিব দ্বন্দ্বের জন্য আমি জন্মাইনি। আমি স্বভাবতই কল্পনাপ্রবণ ও কর্মবিমুখ। আদর্শবাদী হয়েই আমি জন্মেছি এবং স্বপ্নরাজ্যেই আমি বাস করতে পারি। জাগতিক বিষয়সমূহ আমাকে উত্ত্যক্ত করে তোলে এবং আমার দুঃখের কারণ হয়ে থাকে। কিন্তু প্রভুর ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।
তোমরা ভগিনী চারজন আমাকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছ। এ দেশে আমার যা কিছু, তার মূলে তোমরা। তোমরা চিরসুখী ও সৌভাগ্যশালিনী হও। যেখানেই থাকি, গভীর কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ভালবাসা সহ সর্বদাই তোমাদের মনে রাখব। সারা জীবন স্বপ্নের ধারার মত। স্বপ্নের মধ্যে দ্রষ্টার মত থাকাই আমার আকাঙ্ক্ষা। ব্যস্। সকলের প্রতি—ভগিনী জোসেফাইনের প্রতি আমার শুভেচ্ছা। ইতি
তোমার চিরস্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১৬৬*
54 W 33rd St., নিউ ইয়র্ক
১৪
ফেব্রুআরী,১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
… জননীর ন্যায় আপনার
সৎপরামর্শের জন্য আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আশা করি জীবনে
তদনুযায়ী কাজ করতে পারব।
আমি যে বইগুলির কথা আপনাকে লিখেছিলাম, সেগুলি আপনার বিভিন্ন ধর্মের পুস্তক-সম্বলিত গ্রন্থাগারের জন্য। আর আপনারই যখন কোথায় থাকা হবে-না-হবে ঠিক নেই, তখন ওগুলির আর এখন প্রয়োজন নেই। আমার গুরুভাইদেরও প্রয়োজন নেই, কারণ তাঁরা ভারতে ওগুলি পেতে পারেন; আর আমাকেও যখন সর্বদা ঘুরতে হচ্ছে, তখন আমার পক্ষেও সেগুলি সর্বত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনার এই দানের প্রস্তাবের জন্য আপনাকে বহু ধন্যবাদ।
আপনি আমার ও আমার কাজের জন্য ইতোমধ্যেই যা করেছেন, সেজন্য আপনাকে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ যে কি করে করব, তা বলতে পারি না। এই বৎসরও কিছু সাহায্যের প্রস্তাবের জন্য আমার অসংখ্য ধন্যবাদ জানবেন।
তবে আমার অকপট বিশ্বাস এই যে, এ বৎসর আপনার সমুদয় সাহায্য মিস ফার্মারের গ্রীনএকারের কার্যে দেওয়া উচিত। ভারত এখন অপেক্ষা করে বসে থাকতে পারে—শত শতাব্দী ধরে তো অপেক্ষা করছেই। আর হাতের কাছে করবার যে কাজটা রয়েছে, সেটার দিকে সর্বদাই আগে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
আর এক কথা, মনুর মতে—সন্ন্যাসীর পক্ষে একটা সৎকার্যের জন্যও অর্থ সংগ্রহ করা ভাল নয়। আমি এখন বেশ প্রাণে প্রাণে বুঝেছি যে, প্রাচীন ঋষিরা যা বলে গেছেন, তা অতি ঠিক কথাঃ ‘আশা হি পরমং দুঃখং নৈরাশ্যং পরমং সুখম্’—আশাই পরম দুঃখ এবং ত্যাগ করাতেই পরম সুখ। এই যে আমার ‘এ করব, ও করব’, এ রকম ছেলেমানুষি ভাব ছিল, এখন সেগুলিকে সম্পূর্ণ ভ্রম বলে বোধ হচ্ছে। আমার এখন ঐ-সকল বাসনা ত্যাগ হয়ে আসছে। ‘সব বাসনা ত্যাগ করে সুখী হও। কেউ যেন তোমার শত্রু বা মিত্র না থাকে, তুমি একাকী বাস কর। এইরূপে ভগবানের নাম প্রচার করতে করতে শত্রুমিত্রে সমদৃষ্টি হয়ে, সুখদুঃখের অতীত হয়ে, বাসনা ঈর্ষা ত্যাগ করে কোন প্রাণীকে হিংসা না করে, কোন প্রাণীর কোন প্রকার অনিষ্ট বা উদ্বেগের কারণ না হয়ে, আমরা পাহাড়ে পাহাড়ে গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ করে বেড়াব।’
‘ধনী দরিদ্র, উচ্চ নীচ, কারও কাছ থেকে কিছু সাহায্য চেও না—কিছুরই আকাঙ্ক্ষা করো না। এই যে সব দৃশ্য একের পর এক দৃষ্টির সামনে থেকে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে, সেগুলিকে সাক্ষিরূপে দেখ—সেগুলি সব চলে যাক।’
হয়তো এই দেশে আমাকে টেনে নিয়ে আসবার জন্য ঐসব ভাবোন্মত্ত বাসনার প্রয়োজন ছিল। এই অভিজ্ঞতা লাভ করবার জন্য প্রভুকে ধন্যবাদ দিচ্ছি।
এখন বেশ সুখে আছি। আমি আর মিঃ ল্যাণ্ডসবার্গ মিলে কিছু চাল ডাল বা যব রাঁধি—চুপচাপ খাই, তারপর হয়তো কিছু লিখলাম বা পড়লাম, উপদেশপ্রার্থী গরীব লোকদের কেউ দেখা করতে এলে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়। আর এইভাবে থেকে বোধ হচ্ছে, আমি যেন বেশ সন্ন্যাসীর মত জীবনযাপন করছি—আমেরিকায় এসে অবধি এতদিন এ রকম অনুভব করিনি।
‘ধন থাকলে দারিদ্র্যের ভয়, জ্ঞানে অজ্ঞানের ভয়, রূপে বার্ধক্যের ভয়, যশে নিন্দুকের ভয়, অভ্যুদয়ে ঈর্ষার ভয়, এমন কি দেহে মৃত্যুর ভয় আছে। এই জগতের সমুদয়ই ভয়যুক্ত। তিনিই কেবল নির্ভীক, যিনি সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন।’৫৫
আমি সেদিন মিস কর্বিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম—মিস ফার্মার ও মিস থার্সবিও তথায় ছিলেন। আধঘণ্টা ধরে আমাদের বেশ আনন্দে কাটল। মিস কর্বিনের ইচ্ছা—আগামী রবিবার থেকে তাঁর বাড়ীতে কোন রকম ক্লাস খুলি। আমি আর এখন এ-সবের জন্য ব্যস্ত নই। আপনা-আপনি যদি এসে পড়ে, তবে তাতে প্রভুরই জয়জয়কার। আর যদি না আসে, তাহলে প্রভুর আরও জয়জয়কার।
পুনরায় আমার চিরকৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
আপনার অনুগত সন্তান
বিবেকানন্দ
১৬৭*
[ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
54 West 33rd St., নিউ ইয়র্ক
২৫
ফেব্রুআরী, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
তোমার অসুখ হয়েছিল জেনে
আমি দুঃখিত। তোমাকে একটি চিকিৎসা৬৫ বলে দিচ্ছি, যদিও
তোমার স্বীকৃতি আমার মনের অর্ধেক বল হরণ করে নিয়েছে। তুমি যে এর
থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছ, তা ভালই হয়েছে। যার শেষ ভাল, তার সব
ভাল।
বইগুলি বেশ ভাল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে এবং সেগুলির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
তোমার সদা স্নেহবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১৬৮*
19 W. 38 St., নিউ ইয়র্ক
১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… তথাকথিত সমাজসংস্কার
নিয়ে মাথা ঘামিও না, কারণ গোড়ায় আধ্যাত্মিক সংস্কার না হলে কোনপ্রকার
সংস্কারই হতে পারে না। … তাঁর কথা প্রচার করে যাও, সামাজিক কুসংস্কার
এবং গলদ সম্বন্ধে ভালমন্দ কিছু বলো না। হতাশ হয়ো না, গুরুর উপর বিশ্বাস
হারিও না, ভগবানের উপর বিশ্বাস হারিও না—হে বৎস, যতক্ষণ তোমার এই
তিনটি জিনিষ আছে, কিছুই তোমার অনিষ্ট করতে পারবে না। আমি দিন দিন
সবল হয়ে উঠছি। হে সাহসী বালকগণ, কাজ করে যাও।
সাশীর্বাদ
বিবেকানন্দ
১৬৯*
আমেরিকা
৬ মার্চ, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি দীর্ঘকাল নীরব থাকার
দরুন তুমি হয়তো কত কি ভাবছ। কিন্তু হে বৎস! আমার বিশেষ কিছু লেখবার
ছিল না; খবরের মধ্যে সেই পুরাতন কথা—কেবল কাজ, কাজ, কাজ।
তুমি ল্যাণ্ডসবার্গ ও ডাঃ ডের নিকট যে পত্র লিখেছ, তার দুখানাই আমি দেখেছি—সুন্দর লেখা হয়েছে। আমি যে কোনরূপে এখনি ভারতে ফিরে যেতে পারব, তা তো বোধ হয় না। এক মুহূর্তের জন্যও ভেবো না যে, ইয়াঙ্কিরা ধর্মকে কাজে পরিণত করবার এতটুকু মাত্র চেষ্টা করে। এ বিষয়ে কেবল হিন্দুরই—কথা ও আচরণের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। ইয়াঙ্কিরা টাকা রোজগারে খুব কৃতকর্মা। আমি এখান থেকে চলে গেলেই যা কিছু একটু ধর্মভাব জেগেছে, সবটাই উড়ে যাবে। সুতরাং চলে যাবার আগে কাজের ভিত্তিটা পাকা করে যেতে চাই। সব কাজই আধাআধি না করে সম্পূর্ণ করা উচিত।
‘—’ আয়ারকে একখানা পত্র লিখেছিলাম; তাতে যা লিখেছি, তোমরা সেইসব বিষয়ে কি করছ?
রামকৃষ্ণের নাম প্রচার করবার জন্য জেদ করো না। আগে তাঁর ভাব প্রচার কর—যদিও আমি জানি, জগৎ চিরকালই আগে মানুষটিকে মানে, তারপর তার ভাবটি নেয়। কিডি ছেড়ে দিয়েছে; বেশ তো, সে একবার সবদিক চেখে চেখে দেখুক, যা খুশী তাই প্রচার করুক না, কেবল গোঁড়ামি করে যেন অপরের ভাবের ওপর আক্রমণ না করে। তুমি ওখানে তোমার নিজের ক্ষুদ্র শক্তিতে যতটা পার, করবার চেষ্টা কর, আমিও এখানে একটু আধটু সামান্য কাজ করবার চেষ্টা করছি। কিসে ভাল হবে, তা প্রভুই জানেন। আমি তোমাকে যে বইগুলির কথা লিখেছিলাম, সেগুলি পাঠিয়ে দিতে পার? গোড়াতেই একেবারে বড় বড় পরিকল্পনা খাড়া করো না, ধীরে ধীরে আরম্ভ কর। যে মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছ, সেটা কত শক্ত, তা বুঝে অগ্রসর হও, ক্রমে ওপরে ওঠবার চেষ্টা কর।
হে সাহসী বালকগণ! কাজ করে যাও—একদিন না একদিন আমরা আলো দেখতে পাবই পাব।
জি.জি., কিডি, ডাক্তার এবং আর আর বীরহৃদয় মান্দ্রাজী যুবকদের আমার বিশেষ ভালবাসা জানাবে।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুঃ—যদি সুবিধা হয়, কতকগুলি কুশাসন পাঠাবে।
পুঃ—যদি লোকে পছন্দ না করে, তবে সমিতির ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামটা বদলে আর যা খুশী করে দাও না কেন?
সকলের সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে হবে—ল্যাণ্ডসবার্গের সঙ্গে চিঠিপত্র আদান-প্রদান কর। এইরূপে কাজটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকুক। রোমনগর একদিনে নির্মিত হয়নি। মহীশূরের মহারাজার দেহত্যাগ হল; তিনি আমাদের বিশেষ আশার স্থল ছিলেন। যাই হোক, প্রভুই মহান্—তিনিই অপরাপর ব্যক্তিকে আমাদের মহৎ কার্যে সাহায্য করবার জন্য পাঠাবেন।
ইতি—
বি
১৭০*
54 W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
২১ মার্চ,
১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি যথাসময়ে আপনার
কৃপালিপি পেলাম এবং তাতে আপনার এবং মিস থার্সবি ও মিসেস এডামস্
সম্বন্ধে খবরাখবর পেয়ে বিশেষ সুখী হলাম।
আপনার সঙ্গে মিসেস ও মিস হেলের দেখা হয়েছে শুনে খুব সুখী হলাম, চিকাগোয় আমার যে কয়জন বিশিষ্ট বন্ধু আছেন, তন্মধ্যে তাঁরা অন্যতম।
রমাবাঈ-এর দল আমার বিরুদ্ধে যে-সকল নিন্দা প্রচার করছে, তা শুনে আমি আশ্চর্য হলাম। মিসেস বুল! আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না যে, মানুষ যেরূপই চলুক না কেন, এমন কতকগুলি লোক চিরকালই থাকবে যারা তার সম্বন্ধে ঘোরতর মিথ্যা রচনা করে প্রচার করবেই। চিকাগোতে তো আমার বিরুদ্ধে এরূপ কিছু না কিছু লেগে থাকত।
আমাদের বাড়ীটার নীচ তলায় অর্থের বিনিময়ে কয়েকটি বক্তৃতা দেবার সঙ্কল্প করছি। ঐ ঘরে প্রায় ১০০ লোকের জায়গা হবে, এতেই খরচা উঠে যাবে। ভারতবর্ষে টাকা পাঠাবার জন্য বিশেষ ব্যস্ত নই, সেজন্য অপেক্ষা করব।
মিস ফার্মার কি আপনার সঙ্গে আছেন? মিসেস পিক কি চিকাগোয় আছেন? আপনার সঙ্গে কি জোসেফাইন লকের দেখা হয়েছে?
মিস হ্যামলিন আমার প্রতি খুব দয়া প্রকাশ করছেন, আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করছেন।
আমার গুরুদেব বলতেন, হিন্দু খ্রীষ্টান প্রভৃতি বিভিন্ন নাম—মানুষে মানুষে পরস্পর ভ্রাতৃভাবের বিশেষ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। আগে আমাদিগকে ঐগুলি ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করতে হবে। এগুলি পরের মঙ্গল করবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, এখন কেবল অশুভ প্রভাব বিস্তার করছে। এগুলির কুৎসিত কুহকে পড়ে আমাদের মধ্যে যাঁরা সেরা, তাঁরাও অসুরবৎ ব্যবহার করে থাকেন। এখন আমাদিগকে ঐগুলি ভাঙবার জন্য কঠোর চেষ্টা করতে হবে এবং আমরা এ বিষয়ে নিশ্চয়ই কৃতকার্য হব।
তাই তো একটা কেন্দ্র স্থাপন করবার জন্য আমার এতটা আগ্রহ। সঙ্ঘের অনেক দোষ আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তা ছাড়া কিছু হবারও যো নেই। এখানেই ভয়, আপনার সঙ্গে আমার মতভেদ হবে। সেই বিষয়টি এই যে, কেউ সমাজকেও সন্তুষ্ট করবে, অথচ বড় বড় কাজ করবে—তা হতে পারে না।
ভিতর থেকে যেরূপ প্রেরণা আসে, সেভাবে কাজ করা উচিত, আর যদি সেই কাজটা ঠিক ঠিক এবং ভাল হয়, তবে হয়তো মরে যাবার শত শত শতাব্দী পরে সমাজকে নিশ্চয়ই তাঁর দিকে ঘুরে আসতেই হবে। দেহ-মন-প্রাণ দিয়ে সর্বান্তঃকরণে আমাদের কাজে লেগে যেতে হবে। একটা ভাবের জন্য যতদিন পর্যন্ত না আমরা আর যা কিছু সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত হচ্ছি, ততদিন আমরা কোন কালে আলো দেখতে পাব না।
যাঁরা মানবজাতির কোনপ্রকার সাহায্য করতে চান, তাঁদের এ-সকল সুখ-দুঃখ, নাম- যশ, আর যত প্রকার স্বার্থ আছে, সেগুলি একটা পোঁটলা বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দিতে হবে এবং ভগবানের কাছে আসতে হবে। সকল আচার্যই এই কথা বলে গেছেন ও করে গেছেন।
আমি গত শনিবার মিস কর্বিনের কাছে গিয়েছিলাম, আর তাঁকে বলে এসেছি যে, আর ওখানে ক্লাস করতে যেতে পারব না। জগতের ইতিহাসে কি কখনও এরূপ দেখা গেছে যে, ধনীদের দ্বারা কোন বড় কাজ হয়েছে? হৃদয় ও মস্তিষ্ক দ্বারাই চিরকাল যা কিছু বড় কাজ হয়েছে—টাকার দ্বারা নয়। আমার ভাব ও জীবন সবই উৎসর্গ করেছি; ভগবান্ আমার সহায়, আর কারও সাহায্য চাই না। ইহাই সিদ্ধির একমাত্র রহস্য—এ বিষয়ে নিশ্চয়ই আপনি আমার সঙ্গে একমত।
আপনারই চিরকৃতজ্ঞ ও স্নেহের সন্তান
বিবেকানন্দ
পুঃ—মিস ফার্মার ও মিসেস এডামস্কে আমার ভালবাসা জানাবেন।
বি
১৭১*
[ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
54 W. 33 St. N.Y.
২৭ মার্চ, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
তোমার চিঠিখানা পেয়ে এত
আনন্দ হয়েছে যে, তা প্রকাশ করা যায় না। আমিও অনায়াসে চিঠিখানা
আগাগোড়া পড়তে পেরেছি। অবশেষে কমলারঙ ঠাওরিয়ে সেই রঙের একটা
জামা পেয়েছি, কিন্তু গরমের দিনে ব্যবহারের উপযোগী কোন জামা এ-পর্যন্ত
পাইনি। যদি পাও, আমাকে অনুগ্রহ করে জানিও। এখানে নিউ ইয়র্কে তৈরী
করে নেব। তোমার সেই অদ্ভুত ডিয়ারবর্ণ এভিনিউ-এর অযোগ্য দর্জি
সাধু-সন্ন্যাসীর জামাও প্রস্তুত করতে জানে না।
ভগিনী লক্ এক লম্বা চিঠি লিখেছে এবং হয়তো উত্তরের দেরী দেখে আশ্চর্য হয়েছে। উৎসাহে সে অভিভূত হয়ে যায়; তাই আমি অপেক্ষা করছি এবং কি লিখব, জানি না। অনুগ্রহ করে তাকে বলবে—এই মুহূর্তে কোন স্থান নির্ধারণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মিসেস পীক সদাশয়া মহীয়সী ও অত্যন্ত ধর্মশীলা হলেও বৈষয়িক ব্যাপারে আমার মতই বুদ্ধিমান, তবে আমি দিনদিন বুদ্ধিমান হচ্ছি। ওয়াশিংটনে মিসেস পীকের জানা কে একজন তাকে গ্রীষ্মাবাসের জন্য একটি জায়গা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন।
কে জানে, সে প্রতারিত হবে কিনা? প্রতারণার এ এক অদ্ভুত দেশ; অন্যের ওপর সুবিধা নেওয়ার কোন-না-কোন গুপ্ত অভিসন্ধি আছে শতকরা নিরানব্বই জনের। যদি কেউ মুহূর্তের জন্য কেবল একটু চোখ বন্ধ করে, তবেই তার সর্বনাশ! ভগিনী জোসেফাইন অগ্নিশর্মা। মিসেস পীক সাদাসিধে ভাল মহিলা। এখানকার লোকেরা আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছে যে, কিছু করবার আগে কয়েক ঘণ্টা আমাকে চারিদিকে তাকাতে হয়। সবই ঠিক হয়ে যাবে। ভগিনী জোসেফাইনকে একটু ধৈর্য ধরতে বলো। একজন বৃদ্ধার সংসার চালানর চেয়ে প্রতিদিন কিণ্ডারগার্টেন তোমার নিশ্চই আরও ভাল লাগছে। মিসেস বুলকে দেখেছ; তাঁকে এত নিরীহ ও শান্ত দেখে তুমি নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছ। মিসেস এডামসের সঙ্গে মাঝে মাঝে তোমার দেখা হয় কি? তার উপদেশে মিসেস বুল খুব উপকৃত হয়েছে। আমিও কিছু উপদেশ গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু কোন কাজে লাগল না; মিসেস এডামস্ যেমন চাইছে, তাতে সামনের ক্রমবর্ধমান বোঝা নোয়ান যায় না। হাঁটবার সময় যদি সামনে ঝুঁকবার চেষ্টা করি, তাহলে ভারকেন্দ্র পাকস্থলীর উপরিভাগে আসে; কাজেই পুরোভাগে ডিগবাজি খেয়ে চলি।
ক্রোরপতি কেউ আসছে না, ‘কয়েক-সহস্র’পতিও নয়! দুঃখিত, খুব দুঃখিত!!! কি করতে পারি—যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। আমার ক্লাসগুলি যে মহিলাতেই ভর্তি। … বেশ, ধৈর্য ধর। আমি চোখ মেলে রাখব, কখনও সুযোগ হারাব না। তুমি যদি কাকেও না পাও, অন্ততঃ আমার কুঁড়েমির জন্য তা নয়, জেনো।
সেই পুরাতন পথেই জীবন চলেছে। ক্রমাগত বক্তৃতা ও ধর্মপ্রসঙ্গ করে অনেক সময় বিরক্তি আসে, দিনের পর দিন চুপ করে থাকতে ইচ্ছা হয়।
তোমার স্বপ্ন শুভ হোক, কারণ সুখী হবার এটাই একমাত্র পথ।
সতত তোমার স্নেহের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১৭২*
আমেরিকা
৪ এপ্রিল, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র তোমার পত্র পেলাম।
কোন ব্যক্তি আমার অনিষ্ট করবার চেষ্টা করলে তুমি তাতে ভয় পেও না।
যতদিন প্রভু আমাকে রক্ষা করবেন, ততদিন আমি অপরাজেয়। আমেরিকা
সম্বন্ধে তোমার ধারণা বড় অস্পষ্ট। মিসেস হেল ছাড়া গোঁড়া খ্রীষ্টানদের সঙ্গে
আমার কোন সম্বন্ধ নেই। তবে এখানে উদারভাব এবং চিন্তাও যথেষ্ট আছে।
মিঃ লাণ্ড বা ঐ ধাঁজের গোঁড়ারা পালপার্বণে নিজের খরচায় এসে লাফিয়ে
ঝাঁপিয়ে নেচে কুঁদে ফিরে যায়। এ একটা প্রকাণ্ড দেশ, অধিকাংশ লোকই ধর্মের
ধার ধারে না। শতকরা ৯৯.৯ জন লোক ঐ ধরনের। এদেশে খ্রীষ্টধর্ম দাঁড়িয়ে
আছে শুধু একটা জাতীয়তাবোধকে অবলম্বন করে, তা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রিয় বৎস! সাহস হারিও না। আমি আয়ারকে একখানি পত্র লিখেছিলাম, তোমাদের পত্রে তার কোন উল্লেখ না দেখে মনে হয়, তোমরা তার সম্বন্ধে কিছুই জান না; আর আমি তোমাদের নিকট যে কতকগুলি বই চেয়েছিলাম, সে সম্বন্ধেও তুমি কিছু লেখনি। যদি সব সম্প্রদায়ের ভাষ্যসহ বেদান্তসূত্র আমায় পাঠাতে পার তো ভাল হয়। সম্ভবতঃ সামান্না তোমায় এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারে। আমার জন্য একটুও ভয় পেও না। তিনি আমার হাত ধরে রয়েছেন। ভারতে ফিরে গিয়ে কি হবে? ভারত তো আমার ভাবরাশি-বিস্তারের সাহায্য করতে পারবে না। এই দেশ আমার ভাবে খুব আকৃষ্ট হচ্ছে। আমি যখন আদেশ পাব, তখন ফিরে যাব। ইতোমধ্যে তোমরা সকলে ধৈর্যের সঙ্গে ধীরে ধীরে কাজ করে যাও। যদি কেউ আমায় আক্রমণ করে কথা বলে, তাহলে তার অস্তিত্ব পর্যন্ত ভুলে যাও। যদি কেউ ভালমন্দ বলে, পার তো তাকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ দিও, আর কাজ করে যাও। আমার ভাব হচ্ছে, তোমরা এমন একটা শিক্ষালয় স্থাপন কর, যেখানে ছাত্রগণকে ভাষ্যসমেত বেদবেদান্ত সব পড়ান যেতে পারে। উপস্থিত এইভাবে কাজ করে যাও। তাহলেই বোধ হয়, এক্ষণে মান্দ্রাজীদের কাছে খুব বেশী সহানুভূতি পাবে। এইটি জেনে রেখো যে, যখনই তুমি সাহস হারাও, তখনই তুমি শুধু নিজের অনিষ্ট করছ তা নয়, কাজেরও ক্ষতি করছ। অসীম বিশ্বাস ও ধৈর্যই সফলতালাভের একমাত্র উপায়।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুঃ—জি. জি., ডাক্তার, কিডি, বালাজী এবং আর সবাইকে আনন্দ করতে বলো—তারা যেন কারও বাজে কথা শুনে মনকে চঞ্চল না করে। তোমরা সকলে নিজেদের আদর্শ ধরে থাক, আর অন্য কিছুর প্রতি খেয়াল করো না—সত্যের জয় হবেই হবে। সর্বোপরি, তুমি যেন অপরকে চালাতে বা তাদের শাসন করতে, অথবা ইয়াঙ্কিরা যেমন বলে অপরের উপর 'boss' (মাতব্বরি) করতে যেও না; সকলের দাস হও।
—বি
১৭৩*
[মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটকে লিখিত]
১০ এপ্রিল, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
আজ প্রাতে তোমার শেষ
চিঠিখানা এবং রামানুজাচার্যের ভাষ্যের প্রথম ভাগ পেলাম। কয়েকদিন আগে
তোমার আর একখানা পত্র পেয়েছিলাম। মণি আয়ারের কাছ থেকেও একখানা
পত্র পেয়েছি।
আপনার (রিজলি) পল্লীগৃহে সহৃদয় আমন্ত্রণের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা অসম্ভব। আমি এখন একটু ভুলের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি এবং দেখছি আগামীকাল আমার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। আগামীকাল (40 W. 9th Street-এ) মিস এণ্ড্রুজ-এর গৃহে আমার একটা ক্লাস আছে। মিস ম্যাকলাউড আমাকে বলেছিলেন যে, ঐ ক্লাসটা স্থগিত রাখা সম্ভব, সেজন্য আমি কাল সানন্দে আপনাদের সঙ্গে যোগ দেবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি যে, মিস ম্যাকলাউড ভুল করেছেন। মিস এণ্ড্রুজ আমাকে বলে গিয়েছেন যে, কোন উপায়ে কাল তিনি ক্লাস বন্ধ করতে পারেন না বা প্রায় ৫০/৬০ জন সভ্যকে বিজ্ঞপ্তিও দিতে পারেন না।
এই অবস্থায় আমি আমার অক্ষমতার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত এবং আশা করি মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস স্টার্জিস (Mrs. Sturgis) বুঝবেন যে, আমার অনিচ্ছা নয়, এই অনিবার্য পরিস্থিতিই আপনার সহৃদয় আমন্ত্রণ গ্রহণ না করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগামী পরশু অথবা এ সপ্তাহে আপনার সুবিধামত যে-কোন দিন যেতে পারলে খুব আনন্দিত হব।
আপনার চিরবিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
১৭৪
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
১১ এপ্রিল, ১৮৯৫
কল্যাণবরেষু,
… তুমি লিখিয়াছ যে তোমার
অসুখ আরোগ্য হইয়াছে, কিন্তু তোমাকে এখন হইতে অতি সাবধান হইতে
হইবে। পিত্তি পড়া বা অস্বাস্থ্যকর আহার বা পুতিগন্ধময় স্থানে বাস করিলে
পুনশ্চ রোগে ভুগিবার সম্ভাবনা এবং ম্যালেরিয়ার হাত হইতে বাঁচা দুষ্কর।
প্রথমতঃ একটা ছোটখাট বাগান বা বাটী ভাড়া লওয়া উচিত, ৩০।৪০ টাকার
মধ্যে হইতে পারিবে। দ্বিতীয়তঃ খাবার এবং রান্নার জল যেন ফিল্টার করা
হয়। বাঁশের ফিল্টার বড় রকম হইলেই যথেষ্ট। জলেতেই যত রোগ—পরিষ্কার
অপরিষ্কার নহে, রোগবীজপূর্ণ, তাই রোগের কারণ। জল উত্তপ্ত করে ফিল্টার
করা হউক। সকলকে স্বাস্থ্যের দিকে প্রথম নজর দিতে হইবে। একজন রাঁধুনী,
একটা চাকর, পরিষ্কার বিছানা, সময়ে খাওয়া—এ-সকল অত্যাবশ্যক। যে প্রকার
বলছি সমস্তই যেন করা হয়, ইহাতে অন্যথা না হয়। … টাকাকড়ি খরচের সমস্ত
ভার রাখাল যেন লয়, অন্য কেহ তাহাতে উচ্চবাচ্য না করে। নিরঞ্জন, ঘরদ্বার,
বিছানা, ফিল্টার যাতে দস্তুরমত ঠিক সাফ থাকে, তাহার ভার লইবে। … সমস্ত
কার্যের সফলতা তোমাদের পরস্পরের ভালবাসার উপর নির্ভর করিতেছে।
দ্বেষ, ঈর্ষা, অহমিকাবুদ্ধি যতদিন থাকিবে, ততদিন কোন কল্যাণ নাই। … কালীর
Pamphlet (পুস্তিকা) খুব উত্তম হয়েছে, তাতে কোন অতিপ্রসঙ্গ নাই।
ঐ যে কানে কানে গুজোগুজি করা—তাহা মহাপাপ বলে জানবে; ঐটা ভায়া, একেবারে ত্যাগ দিও [করিও]। মনে অনেক জিনিষ আসে, তা ফুটে বলতে গেলেই ক্রমে তিল থেকে তাল হয়ে দাঁড়ায়। গিলে ফেললেই ফুরিয়ে যায়।
মহোৎসব খুব ধুমধামের সহিত হয়ে গেছে, ভাল কথা। আসছে বারে এক লাখ লোক যাতে হয়, তারই চেষ্টা করতে হবে বৈকি। মাষ্টার মহাশয় প্রভৃতি ও তোমরা এককাট্টা হয়ে একটা কাগজ যাতে বার করতে পার, তার চেষ্টা দেখ দিকি। … অনন্ত ধৈর্য, অনন্ত উদ্যোগ যাহার সহায়, সে-ই কার্যে সিদ্ধি হবে। পড়াশুনাটা বিশেষ করা চাই, বুঝলে শশী? মেলা মুখ্যু-ফুখ্যু জড়ো করিসনি বাপু। দুটো চারটে মানুষের মত—এককাট্টা কর দেখি। একটা মিউও যে শুনতে পাইনি। তোমরা মহোৎসবে তো লুচিসন্দেশ বাঁটলে, আর কতকগুলো নিষ্কর্মার দল গান করলে, … তোমরা কী spiritual food (আধ্যাত্মিক খোরাক) দিলে, তা তো শুনলাম না? তোদের যে পুরানো ভাব nil admirari—কেউ কিছুই জানে না ভাব— যতদিন না দূর হবে, ততদিন তোরা কিছুই করতে পারবিনি, ততদিন তোদের সাহস হবে না। Bullies are always cowards. (যারা লোককে তর্জন করে বেড়ায়, তারা চিরকাল কাপুরুষ)।
সকলকে sympathy-র (সহানুভূতির) সহিত গ্রহণ করিবে, রামকৃষ্ণ পরমহংস মানুক বা নাই মানুক। বৃথা তর্ক করতে এলে ভদ্রতার সহিত নিজে নিরস্ত হবে। মাষ্টার মহাশয় কতদিন মুখে বোজলা দিয়ে থাকবেন? বোজলাতেই যে জন্ম গেল দেখছি! সকল মতের লোকের সহিত সহানুভূতি প্রকাশ করিবে। এই সকল মহৎ গুণ যখন তোমাদের মধ্যে আসবে, তখন তোমরা মহাতেজে কাজ করতে পারবে, অন্যথা ‘জয় গুরু-ফুরু’ কিছুই চলবে না। যাহা হউক, এবারকার মহোৎসব অতি উত্তমই হইয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই এবং তার জন্য তোমরা বিশেষ প্রশংসার উপযুক্ত। কিন্তু you must push forward. Do you see? (তোমাদের এগিয়ে পড়তে হবে, বুঝলে কিনা?) শরৎ কি করছে? ‘আমি কি জানি!আমি কি জানি!’—ওরকম বুদ্ধিতে তিন কালেও কিছু জানতে পারবে না। ঠাকুরদাদার কথা—শাঁকচুন্নীর নাকি সুর ভাল বটে, কিন্তু কিছু উঁচুদরের চাই, that will appeal to the intellect of the learned (যা লেখাপড়াজানা লোকেরা পড়ে আনন্দ পাবে)। খালি খোলবাজান হাঙ্গামার কী কাজ? Not only this মহোৎসব will be his memorial, but the central union of an intense propaganda of his doctrines.৫৭ তোকে কি বলব? তোরা এখনও বালক। সব ধীরে ধীরে হবে। তবে সময়ে সময়ে I fret and stamp like a leashed hound.৫৮ Onward and forward (এগিয়ে পড়, এগিয়ে যাও)—আমার পুরানো বুলি। এখন এই পর্যন্ত। আমি আছি ভাল। দেশে তাড়াতাড়ি যেয়ে ফল নাই। তোরা উঠে পড়ে লেগে যা দিকি—সাবাস বাহাদুর! ইতি
নরেন্দ্র
১৭৫*
54 W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
১১ এপ্রিল, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার পত্র পেলাম—ঐ সঙ্গে মনিঅর্ডার ও ‘ট্রান্সক্রিপ্ট’৫৯ কাগজটাও পেলাম। আজ ব্যাঙ্কে যাব—ডলারগুলি ভাঙিয়ে পাউণ্ড করে আনতে। কাল মিঃ লেগেটের কাছে চলে যাচ্ছি কয়েকদিন পল্লীতে বাস করবার জন্য। আশা করি, একটু বিশুদ্ধ বায়ুসেবনে ভালই হবে।
এ বাড়ী এখনই ছেড়ে দেবার কল্পনা ত্যাগ করেছি, কারণ তাতে অত্যন্ত বেশী খরচা পড়বে। অধিকন্তু এখনই বদলান যুক্তিযুক্ত নহে; আমি ধীরে ধীরে সেটি করবার চেষ্টা করছি।
মিস হ্যামলিন আমায় যথেষ্ট সাহায্য করছেন—আমি সেজন্য তাঁর নিকট বিশেষ কৃতজ্ঞ। তিনি আমার প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করছেন—আশা করি, তাঁর ভাবের ঘরেও চুরি নাই। তিনি আমাকে ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চান—আমার ভয় হয়, পূর্বে যেমন একবার শেখান হয়েছিল, ‘নিজেকে সামলে রেখো, যার তার সঙ্গে মিশো না’—এ ব্যাপার তারই দ্বিতীয় সংস্করণ। প্রভু যাঁদের পাঠান, তাঁরাই খাঁটি লোক; আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় এই কথাই তো আমি বুঝেছি। তাঁরাই যথার্থ সাহায্য করতে পারেন, আর তাঁরাই আমাকে সাহায্য করবেন। আর অবশিষ্ট লোকদের সম্বন্ধে বক্তব্য এই, প্রভু তাদের সকলেরই কল্যাণ করুন, আর তাদের হাত থেকে আমায় রক্ষা করুন।
আমার বন্ধুরা সবাই ভেবেছিলেন, একলা একলা দরিদ্রপল্লীতে এভাবে থাকলে এবং প্রচার করলে কিছুই হবে না, আর কোন ভদ্রমহিলা কখনই সেখানে আসবেন না। বিশেষতঃ মিস হ্যামলিন মনে করেছিলেন, তিনি কিম্বা তাঁর মতে যারা ‘ঠিক ঠিক লোক’, তারা যে দরিদ্রোচিত কুটীরে নির্জনবাসী একজন লোকের কাছে এসে তার উপদেশ শুনবে, তা হতেই পারে না। কিন্তু তিনি যাই মনে করুন, যথার্থ ‘ঠিক ঠিক লোক’ ঐ স্থানে দিনরাত আসতে লাগল, তিনিও আসতে লাগলেন। হে প্রভো, মানুষের পক্ষে তোমার ও তোমার দয়ার উপর বিশ্বাস-স্থাপন—কি কঠিন ব্যাপার!! শিব, শিব! মা, তোমায় জিজ্ঞাসা করি, ঠিক ঠিক লোকই বা কোথায়, আর বেঠিক বা মন্দ লোকই বা কোথায়? সবই যে তিনি!! হিংস্র ব্যাঘ্রের মধ্যেও তিনি, মৃগশিশুর ভেতরও তিনি; পাপীর ভেতরও তিনি, পুণ্যাত্মার ভেতরও তিনি—সবই যে তিনি!! সর্বপ্রকারে আমি তাঁর শরণাগত, সারা জীবন তাঁর কোলে আশ্রয় দিয়ে এখন কি তিনি আমায় পরিত্যাগ করবেন? ভগবানের কৃপাদৃষ্টি যদি না থাকে, তবে সমুদ্রে এক ফোঁটা জলও থাকে না, গভীর জঙ্গলে একটা ছোট ডালও পাওয়া যায় না, আর কুবেরের ভাণ্ডারে একমুঠো অন্ন মেলে না; আর তাঁর ইচ্ছা হলে মরুভূমিতে ঝরণা বয়ে যায়, এবং ভিক্ষুকেরও সকল অভাব ঘুচে যায়। একটি চড়ুই পাখী কোথায় উড়ে পড়ছে—তাও তিনি দেখতে পান।৬০ মা, এগুলি কি কেবল কথার কথা—না অক্ষরে অক্ষরে সত্য ঘটনা?
এই ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ কথা এখন থাক। হে আমার শিব, তুমিই আমার ভাল, তুমিই আমার মন্দ। প্রভো, বাল্যকাল থেকেই আমি তোমার চরণে শরণ নিয়েছি। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বা হিমানীমণ্ডিত মেরুপ্রদেশে, পর্বতচূড়ায় বা মহাসমুদ্রের অতল তলে—যেখানেই যাই, তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। তুমিই আমার গতি, আমার নিয়ন্তা, আমার শরণ, আমার সখা, আমার গুরু, আমার ঈশ্বর, তুমিই আমার স্বরূপ। তুমি কখনই আমায় ত্যাগ করবে না—কখনই না, এ আমি ঠিক জানি। হে আমার ঈশ্বর, আমি কখনও কখনও একলা প্রবল বাধাবিঘ্নের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ি, তখন মানুষের সাহায্যের কথা ভাবি। চিরদিনের জন্য ওসব দুর্বলতা থেকে আমায় রক্ষা কর, যেন আমি তোমা ছাড়া আর কারও কাছে কখনও সাহায্য প্রার্থনা না করি। যদি কেউ কোন ভাল লোকের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, সে কখনও তাকে ত্যাগ করে না বা তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে না। প্রভু, তুমি সকল ভালর সৃষ্টিকর্তা—তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে? তুমি তো জান, সারা জীবন আমি তোমার—কেবল তোমারই দাস। তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে—যাতে অপরে আমায় ঠকিয়ে যাবে বা আমি মন্দের দিকে ঢলে পড়ব?
মা, তিনি কখনই আমায় ত্যাগ করবেন না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
আপনার চির আজ্ঞাবহ সন্তান
বিবেকানন্দ
১৭৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
54 W 33rd St., নিউ ইয়র্ক
২৪ এপ্রিল, ১৮৯৫
… জননীর ন্যায় আপনার সৎপরামর্শের জন্য আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। আশা করি জীবনে তদনুযায়ী কাজ করতে পারব।… যে রহস্যময় চিন্তারাশি সম্প্রতি পাশ্চাত্য জগতে অকস্মাৎ আবির্ভূত হইয়াছে, তাহার মূলে যদিও কিছু সত্য আছে, তথাপি আমি সম্যক অবগত আছি, ইহাদের অধিকাংশই বাজে ও কাণ্ডজ্ঞানহীন মতলবে পরিপূর্ণ। আর এইজন্যই ভারতে কিম্বা অন্য কোথাও ধর্মের এই দিকটার সঙ্গে আমি কোন সম্বন্ধ রাখি নাই এবং রহস্যবাদী সম্প্রদায়গুলিও আমার প্রতি বিশেষ অনুকূল নহে।
প্রাচ্যে কিম্বা পাশ্চাত্যে—সর্বত্র একমাত্র অদ্বৈতদর্শনই যে মানবজাতিকে ‘ভূতপূজা’ এবং ঐ জাতীয় কুসংস্কার হইতে মুক্ত করিতে পারে এবং কেবল উহাই যে মানবকে তাহার স্ব স্ব ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়া শক্তিমান্ করিয়া তুলিতে সমর্থ, সে বিষয়ে আমি আপনার সহিত সম্পূর্ণ একমত। পাশ্চাত্য দেশেরই ন্যায় বা তদপেক্ষা অধিক ভারতের নিজেরও এই অদ্বৈতবাদের প্রয়োজন আছে। অথচ কাজটি অত্যন্ত দুরূহ; কারণ প্রথমতঃ আমাদিগকে সকলের মনে রুচি সৃষ্টি করিতে হইবে, তারপর চাই শিক্ষা; সর্বশেষে সমগ্র সৌধটি নির্মাণ করিবার জন্য অগ্রসর হইতে হইবে।
চাই পূর্ণ সরলতা, পবিত্রতা, বিরাট বুদ্ধি এবং সর্বজয়ী ইচ্ছাশক্তি। এই সকল গুণসম্পন্ন মুষ্টিমেয় লোক যদি কাজে লাগে, তবে দুনিয়া ওলটপালট হইয়া যায়। গত বৎসর এদেশে আমি যথেষ্ট বক্তৃতা দিয়াছিলাম, বাহবাও অনেক পাইয়াছিলাম; কিন্তু পরে দেখিলাম, সে-সব কাজ যেন আমি নিছক নিজের জন্যই করিয়াছি। চরিত্রগঠনের জন্য ধীর ও অবিচলিত যত্ন, এবং সত্যোপলব্ধির জন্য তীব্র প্রচেষ্টাই কেবল মানবজাতির ভবিষ্যৎ জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। তাই এ বৎসর আমি সেই ভাবেই আমার কার্যপ্রণালী নিয়মিত করিব, স্থির করিয়াছি। কয়েকজন বাছা বাছা স্ত্রী-পুরুষকে অদ্বৈত- বেদান্তের উপলব্ধি সম্বন্ধে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিব—কতদূর সফল হইব, জানি না। কেহ যদি শুধু নিজের সম্প্রদায় বা দেশের জন্য না খাটিয়া সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে ব্রতী হইতে চায়, তবে পাশ্চাত্য দেশই তাহার উপযুক্ত ক্ষেত্র।
পত্রিকা বাহির করা বিষয়ে আমি আপনার সহিত সম্পূর্ণ একমত, কিন্তু এ-সব করিবার মত ব্যবসাবুদ্ধি আমার একেবারে নাই; আমি শিক্ষাদান ও ধর্মপ্রচার করিতে পারি, মধ্যে মধ্যে কিছু লিখিতে পারি। সত্যের উপর আমার গভীর বিশ্বাস। প্রভুই আমাকে সাহায্য করিবেন এবং তিনিই প্রয়োজনমত কর্মীও পাঠাইবেন, আমি যেন কায়মনোবাক্যে পবিত্র, নিঃস্বার্থ এবং অকপট হইতে পারি।
‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্। সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ॥’ বৃহত্তর জগতের কল্যাণার্থ নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ যে বিসর্জন দিতে পারে, সমগ্র জগৎ তাহার আপনার হইয়া যায়। … আমার ইংলণ্ডে যাওয়া এখনও অনিশ্চিত। সেখানে আমার পরিচিত কেহই নাই; অথচ এখানে কিছু কিছু কাজ হইতেছে। প্রভুই যথাসময়ে আমাকে পথ দেখাইবেন।
১৭৭*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
19 W. 38th Street, নিউ ইয়র্ক
প্রিয় বন্ধু,
আপনার শেষ পত্র আমি যথাসময়ে পাইয়াছি। এই অগষ্ট মাসের শেষভাগে ইওরোপে যাইবার একটা ব্যবস্থা পূর্বেই হইয়াছিল বলিয়া আপনার আমন্ত্রণ ভগবানের আহ্বান বলিয়া মনে করি।
‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্।’ মিথ্যার কিঞ্চিৎ প্রলেপ থাকিলে সত্যপ্রচার সহজ হয় বলিয়া যাঁহারা মনে করেন, তাঁহারা ভ্রান্ত। কালে তাঁহারা বুঝিতে পারেন যে, বিষ—এক ফোঁটা মিশ্রিত হইলেও সমস্ত খাদ্য দূষিত করিয়া ফেলে। যে পবিত্র ও সাহসী, সে-ই জগতে সব কাজ করিতে পারে।
প্রভু আপনাকে সর্বদা মায়ামোহ হইতে রক্ষা করুন। আমি আপনার সহিত কাজ করিতে সর্বদাই প্রস্তুত আছি। যদি আমরা নিজেরা খাঁটি থাকি, তবে প্রভুও আমাদিগকে শত শত বন্ধু প্রেরণ করিবেন। ‘আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুঃ …।’
চিরকালই ইওরোপ হইতে সামাজিক এবং এশিয়া হইতে আধ্যাত্মিক শক্তির উদ্ভব হইয়াছে এবং এই দুই শক্তির বিভিন্ন প্রকার সংমিশ্রণেই জগতের ইতিহাস গড়িয়া উঠিয়াছে। মানবজাতির ইতিহাসের একটি নূতন পৃষ্ঠা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হইতেছে এবং সর্বত্র তাহারই চিহ্ন দেখা যাইতেছে। শত শত নূতন পরিকল্পনার উদ্ভব ও বিলয় হইবে, কিন্তু একমাত্র যোগ্যতমেরই প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত—সত্য ও শিব অপেক্ষা যোগ্যতম আর কি হইতে পারে?
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
১৭৮*
54 W. 33rd Street, নিউ ইয়র্ক
২৫ এপ্রিল, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
গত পরশু মিস ফার্মারের একখানি হৃদ্যতাপূর্ণ পত্র পেলাম—তার সঙ্গে বার্বার হাউসে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলির জন্য একশত ডলারের একখানি চেকও এল। আগামী শনিবার তিনি নিউ ইয়র্কে আসছেন। অবশ্য আমি মিস ফার্মারকে তাঁর বক্তৃতার বিজ্ঞাপনে আমার নাম দিতে মানা করব। বর্তমানে গ্রীনএকারে যেতে পারছি না, সহস্রদ্বীপোদ্যানে (Thousand Island Park) যাবার বন্দোবস্ত করেছি—ঐ স্থান যেখানেই হোক। সেখানে আমার জনৈকা ছাত্রী মিস ডাচারের এক কুটীর আছে। আমরা কয়েকজন সেখানে নির্জন বাস করে বিশ্রাম ও শান্তিতে কাটাব, মনে করেছি। আমার ক্লাসে যাঁরা আসেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে ‘যোগী’ করতে চাই। গ্রীনএকারের মত কর্মচঞ্চল হাট এ কাজের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। অপর জায়গাটি আবার লোকালয় থেকে সম্পূর্ণ দূরে বলে যারা শুধু মজা চায়, তারা কেউ সেখানে যেতে সাহস করবে না।
জ্ঞানযোগের ক্লাসে যাঁরা আসতেন, তাঁদের ১৩০ জনের নাম মিস হ্যামলিন টুকে রেখেছিলেন—এতে আমি খুব খুশী আছি। আরও ৫০ জন বুধবারে যোগ-ক্লাসে আসতেন—আর সোমবারের ক্লাসে আরও ৫০ জন। মিঃ ল্যাণ্ডসবার্গ সব নামগুলি লিখে রেখেছিলেন—আর নাম লেখা থাক বা নাই থাক, এঁরা সকলেই আসবেন। মিঃ ল্যাণ্ডসবার্গ আমার সংস্রব ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু নামগুলি সব এখানে আমার কাছে ফেলে গেছেন। তারা সকলেই আসবে—আর তারা যদি না আসে তো অপরে আসবে। এইরূপেই চলবে— প্রভু, তোমারই মহিমা!!!
নাম টুকে রাখা এবং বিজ্ঞাপন দেওয়া একটা মস্ত কাজ সন্দেহ নেই; আমার জন্য এই কাজ করেছেন বলে তাঁদের উভয়ের কাছে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পেরেছি যে, অপরের ওপর নির্ভর করা আমার নিজেরই আলস্য, সুতরাং উহা অধর্ম—আর আলস্য থেকে সর্বদা অনিষ্টই হয়ে থাকে। সুতরাং এখন থেকে ঐ-সব কাজ আমিই করছি এবং পরেও নিজেই সব করব। তাতে আর ভবিষ্যতে কারও কোন উদ্বেগের কারণ থাকবে না।
যাই হোক, আমি মিস হ্যামলিনের ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ মধ্যে যাকে হোক নিতে পারলে ভারি সুখী হব; কিন্তু আমার দুরদৃষ্টক্রমে তেমন একজনও তো এখনও এল না। আচার্যের চিরন্তন কর্তব্য হচ্ছে অত্যন্ত ‘বেঠিক’ লোকদের ভিতর থেকে ‘ঠিক ঠিক লোক’ তৈরী করে নেওয়া।
মোদ্দা কথাটা এই, মিস হ্যামলিন নামে সম্ভ্রান্ত মহিলাটি আমাকে নিউ ইয়র্কের ‘ঠিক ঠিক লোকগুলির’ সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার আশা ও উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং কার্যতঃ তিনি আমায় যেরূপ সাহায্য করেছিলেন, তার জন্য যদিও আমি তাঁর কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ, তবু মনে করছি আমার যা অল্পস্বল্প কাজ আছে, তা আমার নিজের হাতে করাই ভাল। এখনও অন্যের সাহায্য নেবার সময় হয়নি—কাজ অতি অল্প। আপনার যে উক্ত মিস হ্যামলিন সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারণা, তাতে আমি খুব খুশী। আপনি যে তাঁকে সাহায্য করবেন, এ জেনে অন্যে যা হোক, আমি তো বিশেষ খুশী; কারণ তাঁর সাহায্য প্রয়োজন। কিন্তু মা, রামকৃষ্ণের কৃপায় কোন মানুষের মুখ দেখলেই আমি যেন স্বভাবসিদ্ধ সংস্কারবলে তার ভিতর কি আছে, তা প্রায় অভ্রান্তভাবে জানতে পারি; আর এর ফলে এই দাঁড়িয়েছে যে, আপনি আমার সব ব্যাপার নিয়ে যা খুশী করতে পারেন, আমি তাতে এতটুকু অসন্তোষ পর্যন্ত প্রকাশ করব না। আমি মিস ফার্মারের পরামর্শও খুব আনন্দের সঙ্গেই নেব—তিনি যতই ভূত-প্রেতের কথা বলুন না কেন। এ-সব ভূত-প্রেতের অন্তরালে আমি একটি অগাধপ্রেমপূর্ণ হৃদয় দেখতে পাচ্ছি, কেবল এর ওপর একটা প্রশংসনীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার সূক্ষ্ম আবরণ রয়েছে—তাও কয়েক বৎসরে নিশ্চয় অন্তর্হিত হবে। এমন কি—ল্যাণ্ডস্বার্গও মাঝে মাঝে আমার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে তাতে কোন আপত্তি করব না। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এঁদের ছাড়া অন্য কোন লোক আমায় সাহায্য করতে এলে আমি বেজায় ভয় পাই—এই পর্যন্ত আমি বলতে পারি। আপনি আমাকে যে সাহায্য করেছেন, শুধু তার দরুন নয়—আমার স্বাভাবিক সংস্কারবশতই (অথবা যাকে আমি আমার গুরুমহারাজের প্রেরণা বলে থাকি) আপনাকে আমি আমার মায়ের মত দেখে থাকি। সুতরাং আপনি আমাকে যে-কোন উপদেশ দেবেন, তা আমি সর্বদাই মেনে চলব—কিন্তু ঐ পরামর্শ বা আদেশ সাক্ষাৎ আপনার কাছ থেকে আসা চাই। আপনি যদি আর কাকেও মাঝখানে খাড়া করেন, তাহলে আমি নিজে বেছে নেওয়ার দাবী প্রার্থনা করি। এই কথা আর কি!
আপনার চিরানুগত সন্তান
বিবেকানন্দ
পুঃ—মিস হ্যামলিন এখনও এসে পৌঁছননি। তিনি এলে আমি সংস্কৃত বইগুলি পাঠাব। তিনি কি আপনার কাছে মিঃ নওরোজী-কৃত ভারত সম্বন্ধে একখানি বই পাঠিয়েছেন? আপনি যদি আপনার ভাইকে বইখানি একবার আগাগোড়া দেখতে বলেন, তবে আমি খুব খুশী হব। গান্ধী এখন কোথায়?
বি
১৭৯*
54 W. 33rd St. New York
মে, ১৮৯৫
প্রিয়,
তোমাকে চিঠি লেখবার পর আমার ছাত্রেরা আবার এসেছে আমায় সাহায্য করবার জন্য; ক্লাসগুলি এখন খুবই সুন্দরভাবে চলবে, সন্দেহ নেই।
এতে আমি খুব খুশী হয়েছি, কারণ শেখান ব্যাপারটা আমার জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য ও বিশ্রাম যেমন প্রয়োজন, আমার জীবনে এও তেমনি প্রয়োজন।
তোমার
বিবেকানন্দ
পুনঃ—আমি ইংরেজী পত্রিকা 'The Borderland'-এ—এর বিষয়ে অনেক কিছু পড়েছি— ভারতে খুব ভাল কাজ করছে এবং হিন্দুরা যাতে তাদের ধর্ম বুঝতে পারে, সে বিষয়ে চেষ্টা করছে। আমি —র লেখায় কোনপ্রকার পাণ্ডিত্য দেখতে পাইনি, … অথবা কোন আধ্যাত্মিকতাও নয়। যাই হোক, যে জগতের ভাল করতে চায়, তার উদ্দেশ্য সফল হোক।
কত সহজেই এ সংসার ধাপ্পাবাজিতে ভুলে যায়! এবং সভ্যতার সূচনা থেকেই কত যে জুয়াচুরি বেচারা মানুষের মাথার ওপর জমছে!
১৮০*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]৬১
U. S. A.
মে (?), ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
‘যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি ধর্মের গৌরব পুনঃস্থাপনের জন্য আবির্ভূত হই’—হে মহারাজ, ইহা পবিত্র গীতামুখে উচ্চারিত সেই সনাতন ভগবানের বাক্য, এই কথাগুলি জগতে আধ্যাত্মিক শক্তি-তরঙ্গের উত্থান-পতনের মূল সুর।
ধর্মজগতে এই পরিবর্তন বারংবার তাহার নূতন নূতন বিশিষ্ট ছন্দে প্রকাশিত হইতেছে; যদিও অন্যান্য বিরাট পরিবর্তনের ন্যায় নিজস্ব এলাকার মধ্যগত প্রত্যেকটি বস্তুর উপর এই পরিবর্তনগুলিও প্রভাব বিস্তার করে, তথাপি শক্তি-ধারণে সমর্থ বস্তুর উপরেই তাহাদের কার্যকারিতা সমধিক প্রকাশ পায়।
বিশ্বগতভাবে যেমন জগতের আদিম অবস্থা ত্রিগুণের সাম্যভাব, এই সাম্যভাবের চ্যুতি ও তাহা পুনঃপ্রাপ্তির জন্য সমুদয় চেষ্টা লইয়াই এই প্রকৃতির বিকাশ বা বিশ্বজগৎ; যতদিন না এই সাম্যাবস্থা পুনরায় ফিরিয়া আসে, ততদিন এইভাবেই চলিতে থাকে। সীমাবদ্ধভাবে তেমনি আমাদের এই পৃথিবীতে যতদিন মনুষ্যজাতি এইভাবেই থাকিবে, ততদিন এই বৈষম্য ও তাহার অপরিহার্য পরিপূরক এই সাম্যলাভের চেষ্টা—দুই-ই পাশাপাশি বিরাজ করিবে। তাহাতে পৃথিবীর সর্বত্র ভিন্ন ভিন্ন জাতির ভিতর, উপজাতিগুলির ভিতর, এমন কি প্রত্যেকটি ব্যক্তিতে সুস্পষ্ট বিশেষত্ব থাকিবে।
অতএব নিরপেক্ষভাবে এবং সাম্য রক্ষা করিয়া সকলকে শক্তি প্রদত্ত হইলেও প্রত্যেক জাতিই যেন একটি বিশেষ প্রকার শক্তিসংগ্রহ ও বিতরণের উপযোগী এক-একটি অদ্ভুত যন্ত্র- স্বরূপ; ঐ জাতির অন্যান্য অনেক শক্তি থাকিলেও সেই শক্তিটিই তাহার বিশেষ লক্ষণরূপে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়। মনুষ্যপ্রকৃতিতে একটি ভাবের তরঙ্গ উঠিলে, তাহার প্রভাব অল্প-বিস্তর সকলেই অনুভব করিলেও ঐ ভাব যে-জাতির বিশেষ লক্ষণ এবং সাধারণতঃ যে-জাতিকে কেন্দ্র করিয়া ঐ ভাবের আরম্ভ, সেই জাতির অন্তস্তল পর্যন্ত উহা দ্বারা আলোড়িত হয়। এই কারণেই ধর্মজগতে কোন আলোড়ন উপস্থিত হইলে তাহার ফলে ভারতে অবশ্যই নানাপ্রকার গুরুতর পরিবর্তন হইতে থাকিবে, ভারতকে কেন্দ্র করিয়াই বহুবিস্তৃত ধর্মতরঙ্গসমূহ বারংবার উত্থিত হইয়াছে, কারণ সর্বোপরি ভারত ধর্মের দেশ।
যাহা দ্বারা আদর্শলাভের সহায়তা হয়, মানুষ কেবল সেটিকেই বাস্তব বলে। সাংসারিক মানুষের নিকট যাহা কিছুর বিনিময়ে টাকা পাওয়া যায়, তাহাই বাস্তব; যাহার বিনিময়ে টাকা হয় না, তাহা অবাস্তব। প্রভুত্ব যাহার আকাঙ্ক্ষা, তাহার নিকট যাহাদ্বারা সকলের উপর প্রভুত্ব করিবার বাসনা চরিতার্থ হয়, তাহাই বাস্তব, বাকী সব কিছুই নয়। যাহা জীবনে বিশেষ প্রীতির প্রতিধ্বনি করে না, তাহার মধ্যে মানুষ কিছুই দেখিতে পায়
যাহাদের একমাত্র লক্ষ্য জীবনের সমুদয় শক্তির বিনিময়ে কাঞ্চন, নাম বা অপর কোনরূপ ভোগসুখ অর্জন করা, যাহাদের নিকট সমরসজ্জায় সজ্জিত সৈন্যদলের যুদ্ধযাত্রাই শক্তি-বিকাশের একমাত্র লক্ষণ, যাহাদের নিকট ইন্দ্রিয়সুখই জীবনের একমাত্র সুখ, তাহাদের নিকট ভারত সর্বদাই একটা বিশাল মরুভূমির মত প্রতীয়মান হইবে; তাহাদের কাছে জীবনের বিকাশ বলিয়া যাহা পরিচিত, তাহার পক্ষে ঐ মরুভূমির প্রতিটি দমকা বাতাস মারাত্মক।
কিন্তু যাঁহাদের জীবনতৃষ্ণা ইন্দ্রিয়জগতের অতি দূরে অবস্থিত অমৃতনদীর সলিলপানে একেবারে মিটিয়া গিয়াছে, যাঁহাদের আত্মা সর্পের জীর্ণত্বকমোচনের ন্যায় কাম, কাঞ্চন ও যশঃস্পৃহারূপ ত্রিবিধ বন্ধনকে দূরে ফেলিয়া দিয়াছে, যাঁহারা চিত্তস্থৈর্যের উন্নত শিখরে আরোহণ করিয়া তথা হইতে—ইন্দ্রিয়-বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তিগণের ‘ভোগ’ বলিয়া কথিত আপাতমনোহর বস্তুর জন্য নীচজনোচিত কলহ, বিবাদ, দ্বেষহিংসার প্রতি প্রীতি ও প্রসন্নতার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, সঞ্চিত সৎকর্মের ফলে চক্ষু হইতে অজ্ঞানের আবরণ খসিয়া পড়ায় যাঁহারা অসার নামরূপের পারে প্রকৃত সত্যদর্শনে সমর্থ হইয়াছেন, তাঁহারা যেখানেই থাকুন না কেন, আধ্যাত্মিকতার জন্মভূমি ও অফুরন্ত খনি ভারতবর্ষ তাঁহাদের দৃষ্টিতে ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয়; শূন্যে বিলীয়মান ছায়ার মত এই জগতে যিনি একমাত্র প্রকৃত সত্তা, তাঁহার সন্ধানরত প্রত্যেকটি সাধকের নিকট ভারত আশার আলোকরূপে প্রতীত হয়।
অধিকাংশ মানব তখনই শক্তিকে শক্তি বলিয়া বুঝিতে পারে, যখন অনুভবের উপযোগী করিয়া স্থূল আকারে উহা তাহাদের সম্মুখে ধরা হয়, তাহাদের নিকট যুদ্ধের উত্তেজনা শক্তির প্রত্যক্ষ বিকাশ বলিয়া প্রতীত হয়; আর যাহা কিছু ঝড়ের মত আসিয়া সম্মুখের সব কিছু উড়াইয়া লইয়া যায় না, উহা তাহাদের দৃষ্টিতে মৃত্যুস্বরূপ। সুতরাং শত শত শতাব্দীব্যাপী যে ভারতবর্ষ কোনরূপ বাধাদানে নিশ্চেষ্ট হইয়া বিদেশী বিজেতৃগণের পদতলে পতিত, জনতা সেখানে একতাহীন, স্বদেশপ্রেমের ভাবও যেখানে এতটুকু নাই—সেই ভারত তাহাদের নিকট বিকৃত অস্থিপূর্ণ দেশ, প্রাণহীন পচনশীল পদার্থের স্তূপ বলিয়া প্রতীত হইবে।
বলা হয়, যোগ্যতমই কেবল জীবনসংগ্রামে জয়ী হইয়া থাকে। তবে সাধারণ ধারণানুসারে যে-জাতি সর্বাপেক্ষা অযোগ্য, সে-জাতি দারুণ দুর্ভাগ্য সহ্য করিয়াও কেন বিনাশের কিছুমাত্র চিহ্ন প্রদর্শন করিতেছে না? তথাকথিত বীর্যবান্ ও কর্মপরায়ণ জাতিসমূহের শক্তি দিন দিন কমিয়া আসিতেছে, আর এদিকে ‘দুর্নীতিপরায়ণ (?)’ হিন্দুর শক্তি সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পাইতেছে, ইহা কিরূপে হইতেছে? এক মুহূর্তের মধ্যে যাহারা জগৎকে শোণিতসাগরে প্লাবিত করিয়া দিতে পারে, তাহারা খুব প্রশংসা পাইবার যোগ্য। যাহারা জগতের কয়েক লক্ষ লোককে সুখে-স্বচ্ছন্দে রাখিবার জন্য পৃথিবীর অর্ধেক লোককে অনাহারে রাখিতে পারে, তাহারাও মহৎ গৌরবের অধিকারী! কিন্তু যাহারা অপর কাহারও মুখ হইতে অন্ন কাড়িয়া না লইয়া লক্ষ লক্ষ মানুষকে সুখে রাখিতে পারে, তাহারা কি কোনরূপ সম্মান পাইবার যোগ্য নয়? শত শত শতাব্দী ধরিয়া অপরের উপর বিন্দুমাত্র অত্যাচার না করিয়া লক্ষ লক্ষ লোকের ভাগ্য পরিচালনা করাতে কি কোনরূপ শক্তি প্রদর্শিত হয় না?
সকল প্রাচীন জাতির পুরাণেই দেখা যায়, বীরপুরুষদের প্রাণ তাঁহাদের শরীরের কোন বিশেষ ক্ষুদ্র অংশে ঘনীভূত ছিল। যতদিন সেখানে হাত পড়িত না, ততদিন তাঁহারা দুর্ভেদ্য থাকিতেন। বোধ হয় যেন প্রত্যেক জাতিরও এইরূপ একটি বিশেষ কেন্দ্রে জীবনীশক্তি সঞ্চিত আছে; তাহাতে হাত না পড়া পর্যন্ত কোন দুঃখবিপদই সেই জাতিকে বিনষ্ট করিতে পারে না।
ধর্মেই ভারতের এই জীবনীশক্তি। যতদিন হিন্দুরা তাহাদের পূর্বপুরুষগণের নিকট উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান বিস্মিত না হইতেছে, ততদিন জগতে কোন শক্তি তাহাদের ধ্বংস করিতে পারিবে না।
যে ব্যক্তি সর্বদাই স্বজাতির অতীতের দিকে ফিরিয়া তাকায়, আজকাল সকলেই তাহাকে নিন্দা করিয়া থাকে। অনেকে বলেন, এইরূপ ক্রমাগত অতীতের আলোচনাই হিন্দুজাতির নানারূপ দুঃখের কারণ। কিন্তু আমার বোধ হয়, ইহার বিপরীতটিই সত্য; যতদিন হিন্দুরা তাহাদের অতীত ভুলিয়া ছিল, ততদিন তাহারা হতবুদ্ধি হইয়া অসাড় অবস্থায় পড়িয়াছিল। যতই তাহারা অতীতের আলোচনা করিতেছে, ততই চারিদিকে নূতন জীবনের লক্ষণ দেখা যাইতেছে। অতীতের ছাঁচেই ভবিষ্যৎকে গড়িতে হইবে, এই অতীতই ভবিষ্যৎ হইবে।
অতএব হিন্দুগণ যতই তাঁহাদের অতীত আলোচনা করিবেন, তাঁহাদের ভবিষ্যৎ ততই গৌরবময় হইবে; আর যে-কেহ এই অতীতকে প্রত্যেকের কাছে তুলিয়া ধরিতে চেষ্টা করিতেছেন, তিনিই স্বজাতির পরম হিতকারী। আমাদের পূর্বপুরুষগণের রীতিনীতিগুলি মন্দ ছিল বলিয়া যে ভারতের অবনতি হইয়াছে, তাহা নহে; এই অবনতির কারণ, ঐ রীতিনীতিগুলির যে ন্যায়সঙ্গত পরিণতি হওয়া উচিত ছিল, তাহা হইতে দেওয়া হয় নাই।
প্রত্যেক বিচারশীল পাঠকই জানেন, ভারতের সামাজিক বিধানগুলি যুগে যুগে পরিবর্তিত হইয়াছে। প্রথম হইতেই এই নিয়মগুলি এক বিরাট পরিকল্পনার প্রতিফলনের চেষ্টাস্বরূপ ছিল, কালক্রমে ধীরে ধীরে এগুলি বিকশিত হইবার কথা। প্রাচীন ভারতের ঋষিগণ এত দূরদর্শী ছিলেন যে, তাঁহাদের জ্ঞানের মহত্ত্ব বুঝিতে জগৎকে এখনও অনেক শতাব্দী অপেক্ষা করিতে হইবে। আর তাঁহাদের বংশধরগণের এই মহান্ উদ্দেশ্যের পূর্ণভাব ধারণা করিবার অক্ষমতাই ভারতের একমাত্র কারণ।
শত শত শতাব্দী ধরিয়া প্রাচীন ভারত তাহার প্রধান দুই জাতির—ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের উচ্চাভিলাষপূর্ণ অভিসন্ধি-সাধনের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।
একদিকে পুরোহিতগণ সাধারণ প্রজাদের উপর রাজাদের অবৈধ সামাজিক অত্যাচার নিবারণে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই প্রজাগণকে ক্ষত্রিয়গণ আপনাদের ‘ন্যায়সঙ্গতভক্ষ্য’রূপে ঘোষণা করিতেন। অপর দিকে ক্ষত্রিয়গণই ভারতে একমাত্র শক্তিসম্পন্ন জাতি ছিলেন, যাঁহারা পুরোহিতগণের আধ্যাত্মিক অত্যাচার ও সাধারণ মানুষকে বন্ধন করিবার জন্য তাঁহারা যে ক্রমবর্ধমান নূতন নূতন ক্রিয়াকাণ্ড প্রবর্তন করিতেছিলেন, তাহার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া কিছু পরিমাণে কৃতকার্য হইয়াছিলেন।
অতি প্রাচীনকাল হইতেই উভয় জাতির এই সংঘর্ষ আরম্ভ হইয়াছিল। সমগ্র শ্রুতির ভিতরেই ইহা অতি সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। সাময়িকভাবে এই বিরোধ মন্দীভূত হইল, যখন ক্ষত্রিয়দের এবং জ্ঞানকাণ্ডের নেতা শ্রীকৃষ্ণ সামঞ্জস্যের পথ দেখাইয়া দিলেন। তাহার ফল গীতার শিক্ষা, যাহা ধর্ম দর্শন ও উদারতার সারস্বরূপ। কিন্তু বিরোধের কারণ তখনও বর্তমান ছিল, সুতরাং তার ফলও অবশ্যম্ভাবী।
সাধারণ দরিদ্র মূর্খ প্রজার উপর প্রভুত্ব করিবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্বোক্ত দুই জাতির মধ্যেই বর্তমান ছিল, সুতরাং বিরোধ আবার প্রবলভাবে জাগিয়া উঠিল। আমরা সেই সময়কার যে সামান্য সাহিত্য পাই, তাহা সেই প্রাচীনকালের প্রবল বিরোধের ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মাত্র, কিন্তু অবশেষে ক্ষত্রিয়ের জয় হইল, জ্ঞানের জয় হইল, স্বাধীনতার জয় হইল আর কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য রইল না, ইহার অধিকাংশই চিরকালের জন্য চলিয়া গেল।
এই উত্থানের নাম বৌদ্ধ সংস্কার। ধর্মের দিকে উহা কর্মকাণ্ড হইতে মুক্তি সূচনা করিতেছে, আর রাজনীতির দিকে ক্ষত্রিয় দ্বারা পুরোহিত-প্রাধান্যের বিনাশ সূচিত হইতেছে।
বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, প্রাচীন ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ যে দুই মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁহারা উভয়েই—কৃষ্ণ ও বুদ্ধ—ক্ষত্রিয় ছিলেন। ইহা আরও বেশী লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, এই দুই দেবমানবই স্ত্রী-পুরষ জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের জন্যই জ্ঞানের দ্বার খুলিয়া দিয়াছিলেন।
অদ্ভুত নৈতিক বল সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন মত ধ্বংস করিতে অত্যধিক সমুৎসুক ছিল। উহার অধিকাংশ শক্তিই নেতিমূলক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়াতে বৌদ্ধধর্মকে উহার জন্মভূমি হইতে প্রায় বিলুপ্ত হইতে হইল; আর যেটুকু অবশিষ্ট রহিল, তাহাও বৌদ্ধধর্ম যে-সকল কুসংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ড নিবারণে নিয়োজিত হইয়াছিল, তদপেক্ষা শতগুণ ভয়ানক কুসংস্কার ও ক্রিয়াকাণ্ডে পূর্ণ হইয়া উঠিল। যদিও উহা আংশিকভাবে বৈদিক পশুবলি নিবারণে কৃতকার্য হইয়াছিল, কিন্তু উহা সমুদয় দেশ, মন্দির, প্রতিমা, প্রতীক, যন্ত্র ও সাধুসন্তের অস্থিতে ভরিয়া ফেলিল।
সর্বোপরি বৌদ্ধধর্মের জন্য আর্য মঙ্গোলীয় ও আদিম প্রভৃতি ভিন্ন প্রকৃতির জাতির যে মিশ্রণ হইল, তাহাতে অজ্ঞাতসারে কতকগুলি বীভৎস বামাচারের সৃষ্টি হইল। প্রধানতঃ এই কারণেই সেই মহান্ আচার্যের উপদেশাবলীর এই বিকৃত পরিণতিকে শ্রীশঙ্কর ও তাঁহার সন্ন্যাসি-সম্প্রদায় ভারত হইতে বিতাড়িত করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
এইরূপে মনুষ্যদেহধারিগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভগবান্ বুদ্ধ কর্তৃক প্রবর্তিত জীবন-প্রবাহও পূতিগন্ধময় বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হইল; ভারতকে কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করিতে হইল, যতদিন না ভগবান্ শঙ্করের আবির্ভাব এবং কিছু পরে-পরেই রামানুজ ও মধ্বাচার্যের অভ্যুদয় হইল।
ইতোমধ্যে ভারতেতিহাসের এক সম্পূর্ণ নূতন অধ্যায় আরম্ভ হইয়াছে। প্রাচীন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় জাতি অন্তর্হিত হইয়াছে। হিমালয় ও বিন্ধ্যের মধ্যবর্তী আর্যভূমি, যেখানে কৃষ্ণ ও বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, যাহা মহামান্য রাজর্ষি ও ব্রহ্মর্ষিগণের শৈশবের লীলাভূমি ছিল, তাহা এখন নীরব; আর ভারত উপদ্বীপের সর্বশেষ প্রান্ত হইতে, ভাষায় ও আকারে সম্পূর্ণ বিভিন্ন এক জাতি হইতে, প্রাচীন ব্রাহ্মণগণের বংশধর বলিয়া গৌরবকারী বংশসমূহ হইতে বিকৃত বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইল।
আর্যাবর্তের সেই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ কোথায় গেলেন? তাঁহারা একেবারে বিলুপ্ত, কেবল এখানে ওখানে ব্রাহ্মণত্ব বা ক্ষত্রিয়ত্ব-অভিমানী কতকগুলি মিশ্র জাতি বাস করিতেছে। আর তাঁহাদের ‘এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশদগ্রজন্মনঃ’ পৃথিবীর সকল মানুষ আপন আপন চরিত্র শিক্ষা করিবে,৬২ এইরূপ অহঙ্কৃত, আত্মশ্লাঘাময় উক্তি সত্ত্বেও তাঁহাদিগকে অতি বিনয়ের সহিত দীনবেশে দাক্ষিণাত্যবাসীদের পদতলে বসিয়া শিক্ষা করিতে হইয়াছিল। ইহার ফলে ভারতে পুনরায় বেদের অভ্যুদয় হইল—বেদান্তের পুনরুত্থান হইল; এইরূপ বেদান্তের চর্চা আর কখনও হয় নাই, গৃহস্থেরা পর্যন্ত আরণ্যকপাঠে নিযুক্ত হইলেন।
বৌদ্ধধর্ম-প্রচারে ক্ষত্রিয়েরাই প্রকৃত নেতা ছিলেন এবং দলে দলে তাঁহারাই বৌদ্ধ হইয়াছিলেন। সংস্কার ও ধর্মান্তরকরণের উৎসাহে সংস্কৃত ভাষা উপেক্ষিত হইয়া লোকপ্রচলিত ভাষাসমূহের চর্চা প্রবল হইয়াছিল। আর অধিকাংশ ক্ষত্রিয়ই বৈদিক সাহিত্য ও সংস্কৃত শিক্ষার বহির্ভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। সুতরাং দাক্ষিণাত্য হইতে যে এই সংস্কার-তরঙ্গ আসিল, তাহাতে কিয়ৎপরিমাণে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণগণেরই উপকার হইল। কিন্তু উহা ভারতের অবশিষ্ট লক্ষ লক্ষ লোকের পক্ষে অধিকতর ও নূতনতর বন্ধনের কারণ হইয়াছিল।
ক্ষত্রিয়গণ চিরকালই ভারতের মেরুদণ্ডস্বরূপ, সুতরাং তাঁহারাই বিজ্ঞান ও স্বাধীনতার পরিপোষক। দেশ হইতে কুসংস্কার দূরীভূত করিবার জন্য বারংবার তাঁহাদের বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত হইয়াছে, আর ভারতেতিহাসে প্রথম হইতে তাঁহারাই পুরোহিতকুলের অত্যাচার হইতে সাধারণকে রক্ষা করিবার অভেদ্য প্রাচীররূপে দণ্ডায়মান।
যখন তাঁহাদের অধিকাংশ ঘোর অজ্ঞানে নিমগ্ন হইলেন, এবং অপরাংশ মধ্য এশিয়ার বর্বর জাতিগুলির সহিত শোণিতসম্বন্ধ স্থাপন করিয়া ভারতে পুরোহিতগণের প্রাধান্য-স্থাপনে তরবারি নিয়োজিত করিল, তখনই ভারতে পাপের মাত্রা পূর্ণ হইয়া আসিল, আর ভারতভূমি একেবারে ডুবিয়া গেল। যতদিন না ক্ষত্রিয়-শক্তি জাগরিত হইয়া নিজেকে মুক্ত করে এবং অবশিষ্ট জাতির চরণ-শৃঙ্খল মোচন করিয়া দেয়, ততদিন আর ভারত উঠিবে না। পৌরোহিত্যই ভারতের সর্বনাশের মূল। নিজ ভ্রাতাকে অবনমিত করিয়া মানুষ স্বয়ং কি অবনত না হইয়া থাকিতে পারে?
জানিবেন, রাজাজী, আপনার পূর্বপুরুষগণের দ্বারা আবিষ্কৃত সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যঃ বিশ্বজগতের একত্ব। কোন ব্যক্তি নিজের কিছুমাত্র অনিষ্ট না করিয়া কি অপরের অনিষ্ট করিতে পারে? এই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের অত্যাচার-সমষ্টি চক্রবৃদ্ধিহারে তাঁহাদেরই উপর ফিরিয়া আসিয়াছে, এই সহস্রবর্ষব্যাপী দাসত্ব ও অপমানে তাহারা অনিবার্য কর্মফলই ভোগ করিতেছে।
আপনাদেরই একজন পূর্বপুরুষ বলিয়াছিলেন, ‘ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।’৬৩—যাঁহাদের মন সাম্যে অবস্থিত, তাঁহারা জীবদ্দশাতেই সংসার জয় করিয়াছেন। তাঁহাকে লোকে ভগবানের অবতার বলিয়া বিশ্বাস করিয়া থাকে, আমরা সকলেই ইহা বিশ্বাস করি। তবে তাঁহার এই বাক্য কি অর্থহীন প্রলাপমাত্র? যদি তাহা না হয়, আর আমরা জানি তাঁহার বাক্য প্রলাপ নয়, তবে জাতি লিঙ্গ—এমন কি গুণ পর্যন্ত বিচার না করিয়া সমুদয় সৃষ্ট জগতের এই পূর্ণ সাম্যের বিরুদ্ধে যে-কোন চেষ্টা ভয়ানক ভ্রমাত্মক; আর যতদিন না এই সাম্যভাব আয়ত্ত হইতেছে, ততদিন কেহ কখনই মুক্ত হইতে পারে না।
অতএব হে রাজন, আপনি বেদান্তের উপদেশাবলী পালন করুন—অমুক ভাষ্যকারের বা টীকাকারের ব্যাখ্যানুসারে নহে, আপনার অন্তর্যামী আপনাকে যেরূপ বুঝাইয়াছেন, সেইভাবে। সর্বোপরি এই সর্বভূতে সর্ববস্তুতে সমজ্ঞানরূপ মহান্ উপদেশ পালন করুন—সর্বভূতে সেই এক ভগবানকে দর্শন করুন।
ইহাই মুক্তির পথ; বৈষম্যই বন্ধনের পথ। কোন ব্যক্তি বা কোন জাতি বাহিরের একত্ব-জ্ঞান ব্যতীত বাহিরের স্বাধীনতা লাভ করিতে পারে না, আর সকলের মানসিক একত্ব-জ্ঞান ব্যতীত মানসিক স্বাধীনতাও লাভ করিতে পারে না।
অজ্ঞান অসাম্য ও বাসনা—এই তিনটি মানবজাতির দুঃখের কারণ, আর উহাদের মধ্যে একটির সহিত অপরটির অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। একজন মানুষ নিজেকে অপর কোন মানুষ হইতে, এমন কি পশু হইতেও শ্রেষ্ঠ ভাবিবে কেন? বাস্তবিক সর্বত্রই তো এক বস্তু বিরাজিত। ‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী’৬৪ —তুমি স্ত্রী, তুমি পুরুষ, তুমি কুমার আবার তুমিই কুমারী।
অনেকে বলিবেন, ‘এরূপ ভাবা সন্ন্যাসীর পক্ষে ঠিক বটে, কিন্তু আমরা যে গৃহস্থ!’ অবশ্য গৃহস্থকে অন্যান্য অনেক কর্তব্য করিতে হয় বলিয়া সে পূর্ণভাবে এই সাম্য-অবস্থা লাভ করিতে পারে না, কিন্তু ইহা তাহাদেরও আদর্শ হওয়া উচিত। এই সমত্বভাব লাভ করাই সমগ্র সমাজের, সমুদয় জীবের ও সমগ্র প্রকৃতির আদর্শ। কিন্তু হায়, লোকে মনে করেঃ বৈষম্যই এই সমজ্ঞান-লাভের উপায়; অন্যায় কাজ করিয়া তাহারা যেন ন্যায়ের লক্ষ্যে—সত্যে পৌঁছিতে পারে!
ইহাই মনুষ্যপ্রকৃতিতে বিষবৎ কার্য করে; মনুষ্যজাতির উপর অভিশাপস্বরূপ, সকল দুঃখের মূল কারণ—এই বৈষম্য। ইহাই শরীরিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক সর্ববিধ বন্ধনের মূল।
‘সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্বিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্॥’৬৫
ঈশ্বরকে সর্বত্র সমভাবে অবস্থিত দেখিয়া তিনি আত্মা দ্বারা আত্মাকে হিংসা করেন না, সুতরাং পরম গতি লাভ করেন। এই একটি শ্লোকে অল্প কথার মধ্যে সকলের উপযোগী মুক্তির উপায় বলা হইয়াছে।
রাজপুত আপনারা প্রাচীন ভারতের গৌরবস্বরূপ। আপনাদের অবনতি হইতেই জাতীয় অবনতি আরম্ভ হইল। লুণ্ঠিত ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা ভাগ করিয়া লইবার জন্য নহে, জ্ঞানহীনগণকে জ্ঞানদানের জন্য ও পূর্বপুরুষদের পবিত্র বাসভূমির প্রনষ্ট গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য যদি ক্ষত্রিয়দের বংশধরগণ ব্রাহ্মণের বংশধরগণের সহিত সমবেত চেষ্টায় বদ্ধপরিকর হন, তবেই ভারতের উন্নতি সম্ভব।
আর কে বলিতে পারে, ইহা শুভ মুহূর্ত নহে? কালচক্র আবার ঘুরিয়া আসিতেছে, পুনর্বার ভারত হইতে সেই শক্তিপ্রবাহ বাহির হইয়াছে, যাহা অনতিদূরকালমধ্যে নিশ্চয়ই জগতের দূরতম প্রান্তে পৌঁছিবে। এক মহাবাণী উচ্চারিত হইয়াছে, যাহার প্রতিধ্বনি প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, প্রতিদিনই যাহা অধিক হইতে অধিকতর শক্তিসংগ্রহ করিতেছে, আর এই বাণী পূর্ববর্তী সকল বাণী হইতেই অধিকতর শক্তিশালী, কারণ ইহা পূর্ববর্তী বাণীগুলির সমষ্টিস্বরূপ। যে বাণী একদিন সরস্বতীতীরে ঋষিগণের নিকট প্রকাশিত হইয়াছিল, যাহার প্রতিধ্বনি নগরাজ হিমালয়ের চূড়ায় চূড়ায় প্রতিধ্বনিত হইতে হইতে কৃষ্ণ বুদ্ধ ও চৈতন্যের ভিতর দিয়া সমতল প্রদেশে নামিয়া সমগ্র দেশ প্লাবিত করিয়াছিল, তাহাই আবার উচ্চারিত হইয়াছে। আবার দ্বার উদ্ঘাটিত হইয়াছে!
আর হে প্রিয় মহারাজ, আপনি সেই (ক্ষত্রিয়) জাতির বংশধর, যাঁহারা সনাতন ধর্মের জীবন্ত স্তম্ভস্বরূপ, অঙ্গীকারবদ্ধ রক্ষক ও সাহায্যকারী; আপনি রাম ও কৃষ্ণের বংশধর। আপনি কি এই কর্তব্য পালন না করিয়া দূরে থাকিবেন? আমি জানি, তাহা কখনই হইতে পারে না। আমার নিশ্চয় ধারণা, পুনরায় ধর্মের সাহায্যে আপনারই হস্ত প্রথমে প্রসারিত হইবে। হে রাজা অজিত সিং, যখনই আমি আপনার কথা ভাবি—যাঁহার মধ্যে আপনাদের বংশের সর্বজনবিদিত বৈজ্ঞানিক শিক্ষার সহিত এমন পবিত্র চরিত্র (যাহা থাকিলে একজন সাধুও গৌরবান্বিত হইতে পারেন) এবং সকল মানবের জন্য অসীম প্রেম যুক্ত হইয়াছে—যখন এইরূপ ব্যক্তিগণ সনাতন ধর্মের পুনর্গঠনে ইচ্ছুক, তখন আমি ইহার মহাগৌরবময় পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী না হইয়া থাকিতে পারি না।
চিরকালের জন্য আপনার উপর ও আপনার স্বজনগণের উপর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ বর্ষিত হউক, আর আপনি পরের হিতের জন্য ও সত্যপ্রচারের জন্য দীর্ঘকাল জীবিত থাকুন, ইহাই সর্বদা বিবেকানন্দের প্রার্থনা।
১৮১*
[কলিকাতার জনৈক ব্যক্তিকে লিখিত]
আমেরিকা
২ মে, ১৮৯৫
প্রিয়,
তোমার সহৃদয় সুন্দর পত্রখানি পাইয়া বড়ই আনন্দিত হইলাম। তুমি যে আমাদের কার্য সাদরে অনুমোদন করিয়াছ, সেজন্য তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ। নাগমহাশয় একজন মহাপুরুষ। এরূপ মহাত্মার দয়া যখন তুমি পাইয়াছ, তখন তুমি অতি সৌভাগ্যবান। এই জগতে মহাপুরুষের কৃপালাভই জীবের সর্বোচ্চ সৌভাগ্য। তুমি এই সৌভাগ্যের অধিকারী হইয়াছ। ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’,৬৬ তুমি যখন তাঁহার৬৭ একজন শিষ্যকে তোমার জীবনের পথপ্রদর্শকরূপে পাইয়াছ, তখন তুমি তাঁহাকেই পাইয়াছ জানিবে।
প্রেমে মানুষে মানুষে, আর্যে ম্লেচ্ছে, ব্রাহ্মণে চণ্ডালে, এমন কি—পুরুষে নারীতে পর্যন্ত ভেদ করে না। প্রেম সমগ্র বিশ্বকে আপনার গৃহসদৃশ করিয়া লয়। যথার্থ উন্নতি ধীরে ধীরে হয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবে। যে-সকল যুবক ভারতের নিম্নশ্রেণীর উন্নয়নরূপ একমাত্র কর্তব্যে মনপ্রাণ নিয়োগ করিতে পারে, তাহাদের মধ্যে কাজ কর, তাহাদিগকে জাগাও—সঙ্ঘবদ্ধ কর এবং এই ত্যাগ-মন্ত্রে দীক্ষিত কর। এ-কাজ ভারতের যুবকগণের উপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করিতেছে।
সকল বিষয়ে আজ্ঞাবহতা শিক্ষা কর; নিজ ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করিও না, গুরুজনের অধীন হইয়া চলা ব্যতীত কখনই শক্তির কেন্দ্রীকরণ হইতে পারে না, আর এইরূপ বিচ্ছিন্ন শক্তিগুলিকে কেন্দ্রীভূত না করিলে কোন বড় কাজ হইতে পারে না। কলিকাতার মঠটি প্রধান কেন্দ্র। অন্যান্য সকল শাখার সভ্যদের উচিত এই কেন্দ্রের সহিত একযোগে ও নিয়মানুসারে কার্য করা।
ঈর্ষা ও অহংভাব তাড়াইয়া দাও—সঙ্ঘবদ্ধভাবে অপরের জন্য কাজ করিতে শিখ। আমাদের দেশে এইটির বিশেষ অভাব।
শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
পুঃ—নাগমহাশয়কে আমার অসংখ্য সাষ্টাঙ্গ জানাইবে।
বি
১৮২
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৫ মে, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
যা ভেবেছিলাম, তাই হয়েছে। যদিও অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার তাঁর হিন্দুধর্মবিষয়ক রচনাসমূহের শেষভাগে ক্ষতিকর একটি মন্তব্য না দিয়ে ক্ষান্ত হন না, আমার তবু সর্বদাই মনে হত, কালে সমগ্র তত্ত্বই তিনি বুঝতে পারবেন। যত শীঘ্র পার, ‘বেদান্তবাদ’ (Vedantism) নামে তাঁর শেষ বইখানা সংগ্রহ কর। বইখানিতে দেখবে তিনি সবই সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন—মায় জন্মান্তরবাদ।
আমি তোমাদের এ যাবৎ যা বলেছি, তারই কিছু অংশ এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ; বইখানি তোমার মোটেই দুরূহ বলে মনে হবে না।
অনেক বিষয়ে দেখবে চিকাগোয় আমি যা সব বলেছি, তারই আভাস।
বৃদ্ধ যে সত্য বস্তু ধরতে পেরেছেন—এতে আমি এখন আনন্দিত। কারণ আধুনিক গবেষণা ও বিজ্ঞানের বিরোধিতার মুখে ধর্ম অনুভব করবার এই হল একমাত্র পথ।
আশা করি, টড্-এর ‘রাজস্থান’ ভাল লাগছে। আন্তরিক ভালবাসা জেনো। ইতি
তোমাদের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পুঃ—মেরী কবে বোষ্টনে আসছে?
—বি
১৮৩*
[মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটকে লিখিত]
আমেরিকা
৬ মে, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আজ প্রাতে তোমার শেষ চিঠিখানা এবং রামানুজাচার্যের ভাষ্যের প্রথম ভাগ পেলাম। কয়েকদিন আগে তোমার আর একখানা পত্র পেয়েছিলাম। মণি আয়ারের কাছ থেকেও একখানা পত্র পেয়েছি।
আমি ভাল আছি—কাজকর্ম আগের মতই চলছে। তুমি লাণ্ড বলে একজনের বক্তৃতার কথা লিখেছ; তিনি কে এবং কোথায় থাকেন, তার কিছুই জানি না। হতে পারে তিনি কোন গীর্জার বক্তা। কারণ তিনি যদি বড় বড় সভায় বক্তৃতা দিতেন, তাহলে আমরা নিশ্চয় তাঁর কথা শুনতে পেতাম। হতে পারে তিনি কোন কোন খবরের কাগজে তাঁর বক্তৃতার রিপোর্ট বার করে ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, আর মিশনরীরা তাঁর সাহায্যে নিজেদের ব্যবসা জমাবার চেষ্টা করছে। তোমার চিঠি থেকে তো আমি এই পর্যন্ত অনুমান করছি। এখানে এই ব্যাপারটা নিয়ে সাধারণের ভেতর এমন কিছু সাড়া পড়েনি, যাতে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে। কারণ তাহলে এখানে প্রত্যহ আমাকে শত শত লোকের সঙ্গে লড়াই করতে হয়।
এখন এখানে ভারতের খুব সুনাম, এবং ডাঃ ব্যারোজ ও অন্যান্য গোঁড়ারা সবাই মিলে এই আগুন নেভাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়তঃ ভারতের বিরুদ্ধে গোঁড়াদের এই বক্তৃতাগুলিতে আমার প্রতি রাশি রাশি গালিগালাজ থাকা চাই-ই। … সন্ন্যাসী হয়ে আমাকে কি সেগুলির বিরুদ্ধে ক্রমাগত আত্মসমর্থন করে যেতে হবে? এখানে আমার কয়েকজন প্রভাবশালী বন্ধু আছেন, তাঁরাই মাঝে মাঝে জবাব দিয়ে এঁদের চুপ করিয়ে দেন। আর হিন্দুরা সবাই যদি নিশ্চিন্তে ঘুমায়, তবে হিন্দুধর্ম সমর্থন করবার জন্য আমার এত শক্তি অপচয় করার দরকার কি বল? এখন এখানে ভারতের খুব সুনাম, এবং ডাঃ ব্যারোজ ও অন্যান্য গোঁড়ারা সবাই মিলে এই আগুন নেভাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়তঃ ভারতের বিরুদ্ধে গোঁড়াদের এই বক্তৃতাগুলিতে আমার প্রতি রাশি রাশি গালিগালাজ থাকা চাই-ই। … সন্ন্যাসী হয়ে আমাকে কি সেগুলির বিরুদ্ধে ক্রমাগত আত্মসমর্থন করে যেতে হবে? এখানে আমার কয়েকজন প্রভাবশালী বন্ধু আছেন, তাঁরাই মাঝে মাঝে জবাব দিয়ে এঁদের চুপ করিয়ে দেন। আর হিন্দুরা সবাই যদি নিশ্চিন্তে ঘুমায়, তবে হিন্দুধর্ম সমর্থন করবার জন্য আমার এত শক্তি অপচয় করার দরকার কি বল?
তোমরা ত্রিশ কোটি মানুষ—বিশেষ যারা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধির অহঙ্কারে এত গর্বিত, তারা—কি করছ বল দেখি? লড়াই করবার ভারটা তোমরা নিয়ে আমাকে কেবল প্রচার ও শিক্ষার জন্য ছেড়ে দাও না কেন? এখানে আমি দিনরাত অচেনা বিদেশীদের ভেতরে থেকে প্রাণপণ সংগ্রাম করছি, প্রথমতঃ নিজের অন্নের জন্য, দ্বিতীয়তঃ—যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করে আমার ভারতীয় বন্ধুদের সাহায্য করবার জন্য। ভারত কি সাহায্য পাঠাচ্ছে বল? ভারতবাসীর মত দেশপ্রেমহীন আর কোন জাতি পৃথিবীতে আছে কি? যদি তোমরা বার জন সুশিক্ষিত দৃঢ়চেতা ব্যক্তিকে ইওরোপ-আমেরিকায় প্রচারের জন্য পাঠাতে এবং কয়েক বৎসর তাদের এখানে থাকবার খরচ যোগাতে পারতে, তাহলে তোমরা ভারতের নৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় প্রকার প্রভূত উপকার করতে পারতে। ভারতের প্রতি নৈতিক সহানুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি রাজনৈতিক বিষয়েও ভারতের বন্ধু হয়ে দাঁড়ায়।
পাশ্চাত্যের অনেকে তোমাদিগকে অর্ধনগ্ন বর্বর জাতি মনে করে, সুতরাং ভাবে—খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের সভ্য করে তুলতে হবে। তোমরা এর বিপরীতটা প্রমাণ কর না কেন? তোমরা কুকুর-বিড়ালের মত কেবল বংশবৃদ্ধি করতে পার। … যদি তোমরা ত্রিশ কোটি লোক ভয়ে ভীত হয়ে বসে থাক, একটি কথা বলবারও সাহস না পাও, তবে এই সুদূর দেশে একটা মানুষ আর কত করবে বল? আমি তোমাদের জন্য যতটুকু করেছি, তোমরা ততটুকুরও উপযুক্ত নও। তোমরা আমেরিকার কাগজে হিন্দুধর্ম সমর্থন করে প্রবন্ধ লিখে পাঠাও না কেন? কে তোমাদের বেঁধে রেখেছে? দৈহিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক সব বিষয়ে কাপুরুষের জাত—তোমরা যেমন পশুতুল্য, তেমন ব্যবহার পাচ্ছ। কেবল দুটো জিনিষ তোমাদের লক্ষ্য—কাম ও কাঞ্চন। তোমরা একজন সন্ন্যাসীকে খুঁচিয়ে তুলে দিনরাত লড়াতে চাও, আর তোমরা নিজেরা—সাহেবদের, এমন কি মিশনরীদের ভয়ে ভীত! তোমরা আবার বড় বড় কাজ করবে—ফুঃ! কেন তোমরা কয়েকজন মিলে বেশ উত্তমরূপে হিন্দুধর্ম সমর্থন করে বোষ্টনের এরেনা পাবলিশিং কোম্পানীর কাছে লেখা পাঠাও না? ‘এরেনা’ (Arena) একখানি সাময়িক পত্র—ওরা খুব আনন্দের সঙ্গে তা ছাপাবে, আবার হয়তো পারিশ্রমিকস্বরূপ তোমাদের যথেষ্ট টাকাও দেবে। তাহলেই তো চুকে গেল।
এইটি মনে রেখো যে, এ পর্যন্ত যে-সব হতভাগা হিন্দু এই পাশ্চাত্য দেশে এসেছে, তারা অর্থ বা সম্মানের জন্য নিজের দেশ ও ধর্মের কেবল বিরুদ্ধ সমালোচনাই করেছে। তোমরা জান, আমি এখানে নাম-যশের জন্য আসিনি—আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও এসব এসে পড়েছে। ভারতে গিয়ে আমি কি করব? কে আমায় সাহায্য করবে? ভারতের কি দাসসুলভ স্বভাব বদলেছে? তোমরা ছেলেমানুষ—ছেলেমানুষের মত কথা বলছ—কিসে কি হয়, তোমরা তা জান না। মান্দ্রাজে তেমন লোক কোথায়, যারা ধর্মপ্রচারের জন্য সংসার ত্যাগ করবে? দিবারাত্র বংশবৃদ্ধি ও ঈশ্বরানুভূতি—একদিনও একসঙ্গে চলতে পারে না। আমিই একা সাহস করে নিজের দেশকে সমর্থন করছি; হিন্দুদের কাছ থেকে এরা যা আশাই করেনি, তাই আমি এদের দিয়েছি … । অনেকেই আমার বিরুদ্ধে, কিন্তু আমি কখনও তোমাদের মত কাপুরুষ হব না। আমি কাজ করতে করতেই মরব—পালাব না। কিন্তু এই দেশে হাজার হাজার লোক রয়েছে, যারা আমার বন্ধু এবং শত শত ব্যক্তি রয়েছে, যারা মৃত্যু পর্যন্ত আমার অনুসরণ করবে; প্রতি বৎসরই এদের সংখ্যা বাড়বে। আর যদি এখানে আমি তাদের সঙ্গে থেকে কাজ করি, তবে আমার ধর্মের আদর্শ—জীবনের আদর্শ সফল হবে, বুঝলে?
আমেরিকায় যে সর্বজনীন মন্দির (Temple Universal) স্থাপিত হবার কথা উঠেছিল, সে সম্বন্ধে আর বড় উচ্চবাচ্য শুনতে পাই না। তবে মার্কিন জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ নিউ ইয়র্কে আমার প্রতিষ্ঠা দৃঢ় হয়েছে, এখানে আমার কাজ চলতে থাকবে। আমি আমার শিষ্যদের যোগ, ভক্তি ও জ্ঞান শিক্ষার সমাপ্তির জন্য একটি গ্রীষ্মাবাসে নির্জন স্থানে নিয়ে যাচ্ছি—যাতে তারা কাজ চালিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে।
যা হোক, বৎস, আমি তোমাদের যথেষ্ট তিরস্কার করেছি। তোমাদের তিরস্কার করা দরকার ছিল। এখন কাজে লাগ—কাগজখানার জন্য এখন উঠে পড়ে লাগ। আমি কলিকাতায় কিছু টাকা পাঠিয়েছি; মাসখানেকের ভেতর কাগজটার জন্য তোমাদের কাছেও কিছু টাকা পাঠাতে পারব। এখন অবশ্য অল্পই পাঠাব, পরে নিয়মিতরূপে কিছু কিছু পাঠাতে পারব। এখন কাজে লাগ। হিন্দু ভিখারীদের কাছে আর ভিক্ষা করতে যেও না। আমি নিজের মস্তিষ্ক এবং সবল দক্ষিণ বাহুর সাহায্যে নিজেই সব করব। এখানে বা ভারতে আমি কারও সাহায্য চাই না। কলিকাতা ও মান্দ্রাজ দু-জায়গায় কাজের জন্য যা টাকা দরকার, তা আমি নিজেই রোজগার করব। … রামকৃষ্ণকে অবতার বলে মানবার জন্য লোককে বেশী পীড়াপীড়ি করো না।
এখন তোমাদের কাছে আমার নূতন আবিষ্কারের কথা বলছি। ধর্মের যা কিছু সব বেদান্তের মধ্যেই আছে, অর্থাৎ বেদান্তদর্শনের দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈত—এই তিনটি স্তরে আছে, একটির পর একটি এসে থাকে। এই তিনটি মানবের আধ্যাত্মিক উন্নতির তিনটি ভূমিকা। এদের প্রত্যেকটিরই প্রয়োজন আছে। এই হল ধর্মের সারকথা। ভারতের বিভিন্ন জাতির আচার-ব্যবহার মত ও বিশ্বাসে প্রয়োগের ফলে বেদান্ত যে রূপ নিয়েছে, সেইটি হচ্ছে হিন্দুধর্ম; এর প্রথম স্তর অর্থাৎ দ্বৈতবাদ—ইওরোপীয় জাতিগুলির ভাবের ভেতর দিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে খ্রীষ্টধর্ম, আর সেমেটিক জাতিদের ভেতর হয়ে দাঁড়িয়েছে মুসলমান ধর্ম; অদ্বৈতবাদ উহার যোগানুভূতির আকারে হয়ে দাঁড়িয়েছে বৌদ্ধধর্ম প্রভৃতি। এখন ‘ধর্ম’ বলতে বুঝায় বেদান্ত। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন প্রয়োজন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং অন্যান্য অবস্থা অনুসারে তার প্রয়োগ অবশ্যই বিভিন্ন হবে।
তোমরা দেখতে পাবে যে, মূল দার্শনিক তত্ত্ব যদিও এক, তবু শাক্ত শৈব প্রভৃতি প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিশেষ ধর্মমত ও অনুষ্ঠান-পদ্ধতির ভেতর তাকে রূপায়িত করে নিয়েছে। এখন তোমাদের কাগজে এই তিন ‘বাদ’ সম্বন্ধে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লিখে ওদের মধ্যে একটি অপরটির পর আসে, এইভাবে সামঞ্জস্য দেখাও—আর আনুষ্ঠানিক ভাবটা একেবারে বাদ দাও। অর্থাৎ দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক দিকটাই প্রচার কর; লোকে সেগুলি তাদের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপাদিতে লাগিয়ে নিক। আমি এ বিষয়ে একখানি বই লিখতে চাই—সেজন্য সব ভাষ্যগুলি চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার কাছে এ পর্যন্ত কেবল রামানুজ-ভাষ্যের একখণ্ড মাত্র এসেছে।
আমেরিকান থিওসফিষ্টরা অন্য থিওসফিষ্টদের দল ছেড়ে দিয়েছে ...। ইংলণ্ডের স্টার্ডি সাহেব সম্প্রতি ভারতে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে আমার গুরুভ্রাতা শিবানন্দের সাক্ষাৎ হয়েছিল; তিনি আমাকে এক পত্র লিখে জানতে চেয়েছেন, কবে আমি ইংলণ্ডে যাচ্ছি। তাঁকে একখানি সুন্দর পত্র লিখেছি। বাবু অক্ষয়কুমার ঘোষের খবর কি? আমি তাঁর কাছ থেকে আর কোন খবর পাইনি। মিশনরীগণকে ও অপরাপর সকলকে তাদের যা প্রাপ্য, দিয়ে দাও। আমাদের দেশের কতকগুলি বেশ দৃঢ়চেতা লোককে ধর—ভারতে বর্তমানে ধর্মের নবজাগরণ সম্বন্ধে বেশ সুন্দর ওজস্বী অথচ সুরুচিসঙ্গত একটা প্রবন্ধ লেখ আর সেটি আমেরিকার কোন সাময়িক পত্রে পাঠিয়ে দাও। আমার ঐরকম দু-একখানা কাগজের সঙ্গে জানাশোনা আছে। তোমরা তো জান, আমি বিশেষ লিখিয়ে নই; আর লোকের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ানর অভ্যাসও আমার নেই। আমি চুপচাপ বসে থাকি, আর যা কিছু আসবার আমার কাছে আসে—তার জন্য আমি বিশেষ চেষ্টা করি না। নিউ ইয়র্ক থেকে Metaphysical Magazine বলে একখানা নূতন দার্শনিক পত্রিকা বের হয়েছে—ওখানা বেশ ভাল কাগজ। পল কেরসের কাগজটা মন্দ নয়, তবে ওর গ্রাহকসংখ্যা বড় কম। বৎসগণ! আমি যদি কপট বিষয়ী হতাম, তবে এখানকার কাজ সংগঠিত করে খুব সাফল্য অর্জন করতে পারতাম। হায়, এখানে ধর্ম বলতে তার বেশী কিছু বুঝায় না। টাকার সঙ্গে নাম- যশ—এই হল ধর্মযাজক; আর টাকার সঙ্গে কাম যোগ দিলে হল সাধারণ গৃহস্থ।
আমাকে এখানে একদল নূতন মানুষ সৃষ্টি করতে হবে, যারা ঈশ্বরে অকপট বিশ্বাসী হবে এবং সংসারকে একেবারে গ্রাহ্য করবে না। অবশ্য এটি হবে ধীরে—অতি ধীরে। ইতোমধ্যে তোমরা কাজ করে চল, আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে এবং সাহস থাকে, তবে মিশনরীরা যা পাবার উপযুক্ত, তাদের তাই দাও। যদি আমি তাদের সঙ্গে লড়াই করতে যাই, [এখানে] আমার শিষ্যেরা চমকে যাবে। মিশনরীরা তো আর তর্ক করে না, তারা কেবল গালাগাল করে; সুতরাং ওদের সঙ্গে বিবাদ করলে আমার চলবে না। সেদিন রমাবাঈ নামক খ্রীষ্টান মহিলাটি আমার একজন বিশেষ বন্ধু অধ্যাপক জেমসের কাছ থেকে খুব জোর ধাক্কা খেয়েছেন—কাগজের সেই অংশটা তোমাকে পাঠালাম। সুতরাং তোমরা দেখছ, তারা আমার এখানকার বন্ধুবর্গের কাছ থেকে মাঝে মাঝে এইরূপ ধাক্কা খাবে, আর তোমরাও ভারতে মধ্যে মধ্যে তাদের ঐরূপ দু-চার ঘা দিতে থাক—ঐ দুটোর মধ্যে আমি আমার নৌকো সিধে চালিয়ে নিয়ে যাই।
এখন কাগজখানা কোনরূপে বার করবার খুব ঝোঁক হয়েছে আমার। এই পত্রিকায় গুরুগম্ভীর বিষয় যেন লঘুভাবে আলোচিত না হয়, এর সুর—ধীর গম্ভীর উচ্চ গ্রামে বাঁধা চাই। আমি তোমাদের টাকা পাঠাব … কাজ আরম্ভ করে দাও। আমি এখানে অনেক গ্রাহক যোগাড় করে দেব, আমি নিজে ওর জন্য প্রবন্ধ লিখব এবং সময়ে সময়ে আমেরিকান লেখকদের দিয়ে প্রবন্ধ লিখিয়ে পাঠাব। তোমরাও একদল পাকা নিয়মিত লেখক ধর। তোমার ভগিনীপতি তো একজন খুব ভাল লেখক। তারপর আমি তোমাকে জুনাগড়ের দেওয়ান হরিদাসভাই, খেতড়ির রাজা, লিমডির ঠাকুরসাহেব প্রভৃতির নামে পত্র দেব, তাঁরা কাগজটার গ্রাহক হবেন—তাহলেই ওটা খুব চলে যাবে। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ও দৃঢ়চিত্ত হও এবং কাজ করে যাও। আমরা বড় বড় কাজ করব—ভয় পেও না। এই একটি নিয়ম কর যে, কাগজের প্রত্যেক সংখ্যায় পূর্বোক্ত তিনটি ভাষ্যের মধ্যে কোন না কোন একটির খানিকটা অনুবাদ থাকবে। আর এক কথা—তুমি সকলের সেবক হও, অপরের উপর এতটুকু প্রভুত্ব করতেও চেষ্টা করো না। তাতে ঈর্ষার উদ্রেক হবে ও সব মাটি করে দেবে। কাগজের প্রথম সংখ্যাটার বাইরের চাকচিক্য যেন ভাল হয়। আমি ওর জন্য একটা প্রবন্ধ লিখব। আর ভারতে ভাল ভাল লেখকদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের বেশ ভাল ভাল প্রবন্ধ সংগ্রহ কর। তার মধ্যে একটা যেন দ্বৈত-ভাষ্যের অংশবিশেষের অনুবাদ হয়। পত্রিকার প্রচ্ছদপটে প্রবন্ধ ও লেখকদের নাম থাকবে, আর চারধারে খুব ভাল প্রবন্ধগুলির ও ওদের লেখকদের নাম থাকবে। আগামী মাসের মধ্যেই আমি প্রবন্ধ ও টাকা পাঠাচ্ছি। কাজ করে চল। তুমি এ যাবৎ চমৎকার কাজ করেছ। আমরা সাহায্যের জন্য বসে থাকব না। হে বৎস! আমরাই এটা কাজে পরিণত করব—আত্মনির্ভরশীল ও বিশ্বাসী হও, ধৈর্য ধরে থাক। আশা করি, সামান্না তোমায় কিছু সাহায্য করতে পারে। আমার অপর বন্ধুদের বিরোধিতা করো না—সকলের সঙ্গে মিলেমিশে চল। সকলকে আমার অনন্ত ভালবাসা জানিও।
সদা আশীর্বাদক
তোমাদের বিবেকানন্দ
পুঃ—‘—’ আয়ার এবং অন্যান্য ভদ্রমহোদয়গণের সহিত সকল বিষয়ে পরামর্শ করে চলবে। যদি তুমি নিজেকে নেতারূপে সামনে দাঁড় করাও, তাহলে কেউ তোমায় সাহায্য করতে আসবে না, বোধ হয় এই হচ্ছে তোমার বিফলতার কারণ।—আয়ারের নামটাই যথেষ্ট; তাঁকে যদি না পাও, অন্য কোন বড়লোককে তোমাদের নেতা কর। যদি কৃতকার্য হতে চাও, অহংটাকে আগে নাশ করে ফেল। ইতি
—বি
১৮৪*
54 W. 33rd Street, নিউ ইয়র্ক
৭ মে, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
মিস ফার্মারের সঙ্গে ঐ ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি করে ফেলবার দরুন আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ। ভারতবর্ষ থেকে একখানা খবরের কাগজ পেলাম, তাতে ভারত থেকে ডাঃ ব্যারোজকে ধন্যবাদ পাঠান হয়েছিল, তার সংক্ষিপ্ত উত্তর বেরিয়েছে। মিস থার্সবি আপনাকে সেটা পাঠিয়ে দেবেন।
গতকাল মান্দ্রাজ অভিনন্দন-সভার সভাপতির কাছ থেকে আর একখানা পত্র পেলাম—তাতে তিনি মার্কিনদের ধন্যবাদ দিয়েছেন, আমাকেও একটা অভিনন্দন পাঠিয়েছেন। আমি তাঁকে আমার মান্দ্রাজী বন্ধুদের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে বলেছিলাম। এই ভদ্রলোকটি মান্দ্রাজ শহরের অধিবাসিগণের মধ্যে সর্বপ্রধান, মান্দ্রাজের প্রধান ধর্মাধিকরণের (High Court) একজন বিচারপতি—ভারতে এ একটি অতি উচ্চপদ।
আমি নিউ ইয়র্কে জনসভায় আর দুটি বক্তৃতা দেব; ‘মট্ স্মৃতি-মন্দিরের’ ওপর- তলায় এই দুটি বক্তৃতা হবে। প্রথমটি আগামী সোমবার, বিষয়—‘ধর্মবিজ্ঞান’; দ্বিতীয়টির বিষয়—‘যোগের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা’।
মিস থার্সবি প্রায় ক্লাসে আসেন। মিঃ ফ্লন এক্ষণে আমার কার্যের ওপর বিশেষ অনুরাগ দেখাচ্ছেন ও প্রসারের জন্য যত্ন নিচ্ছেন। ল্যাণ্ডস্বার্গ আসে না। আমার আশঙ্কা হয়, সে আমার ওপর খুব বিরক্ত হয়েছে। মিস হ্যামলিন কি ভারতের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে বইখানি আপনাকে পাঠিয়েছে? আমার ইচ্ছা, আপনার ভাই বইখানি পড়ে দেখেন এবং নিজে নিজে বোঝেন—ভারতে ইংরেজ শাসন বলতে কি বুঝায়।
আপনার চিরকৃতজ্ঞ সন্তান
বিবেকানন্দ
১৮৫*
নিউ ইয়র্ক
১৪ মে, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
বইগুলি সব নিরাপদে পৌঁছেছে। সেজন্য বহু ধন্যবাদ। শীঘ্রই তোমায় কিছু টাকা পাঠাতে পারব—খুব বেশী অবশ্য নয়, এখন কয়েক শতমাত্র; তবে যদি বেঁচে থাকি সময়ে সময়ে কিছু পাঠাব।
এখন নিউ ইয়র্কের ওপর আমার একটা প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে; আশা করছি, একদল স্থায়ী কর্মী পাব, আমি এদেশ ছেড়ে চলে গেলে তারা কাজ চালাবে। বৎস, দেখছ এইসব খবরের কাগজের হুজুগ কিছুই নয়। যখন আমি চলে যাব, তখন এখানে আমার কাজের একটা স্থায়ী দাগ রেখে যাওয়া উচিত; আর প্রভুর আশীর্বাদে তা শীঘ্রই হবে। অবশ্য টাকাকড়ির দিক দিয়ে ধরলে সফলতা হয়নি, বলতে হবে। কিন্তু জগতে সমুদয় ধনরাশির চেয়ে ‘মানুষ’ হচ্ছে বেশী মূল্যবান।
মিস হ্যামলিন আমায় যথেষ্ট সাহায্য করছেন—আমি সেজন্য তাঁর নিকট বিশেষ কৃতজ্ঞ। তিনি আমার প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করছেন—আশা করি, তাঁর ভাবের ঘরেও চুরি নাই। তিনি আমাকে ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চান—আমার ভয় হয়, পূর্বে যেমন একবার শেখান হয়েছিল, ‘নিজেকে সামলে রেখো, যার তার সঙ্গে মিশো না’—এ ব্যাপার তারই দ্বিতীয় সংস্করণ। প্রভু যাঁদের পাঠান, তাঁরাই খাঁটি লোক; আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় এই কথাই তো আমি বুঝেছি। তাঁরাই যথার্থ সাহায্য করতে পারেন, আর তাঁরাই আমাকে সাহায্য করবেন। আর অবশিষ্ট লোকদের সম্বন্ধে বক্তব্য এই, প্রভু তাদের সকলেরই কল্যাণ করুন, আর তাদের হাত থেকে আমায় রক্ষা করুন।
তুমি আমার জন্য ভেবো না—প্রভু আমায় রক্ষা করছেন। আমার এদেশে আসা, আর এত পরিশ্রম ব্যর্থ হতে দেওয়া হবে না। প্রভু দয়াময়—যদিও এমন লোক অনেক আছে, যারা—যে-কোনরূপে হোক—আমার অনিষ্ট করবার চেষ্টা করেছে; আবার এমন লোকও অনেক আছে, যারা শেষ পর্যন্ত আমার সহায়তা করবে। অনন্ত ধৈর্য, অনন্ত পবিত্রতা, অনন্ত অধ্যবসায়—এই তিনটি জিনিষ থাকলে যে-কোন সৎ আন্দোলনে অবশ্যই সফল হতে পারা যায়; এই হল সিদ্ধিলাভের রহস্য।
এই ‘ঠিক ঠিক লোকদের’ কথা এখন থাক। হে আমার শিব, তুমিই আমার ভাল, তুমিই আমার মন্দ। প্রভো, বাল্যকাল থেকেই আমি তোমার চরণে শরণ নিয়েছি। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বা হিমানীমণ্ডিত মেরুপ্রদেশে, পর্বতচূড়ায় বা মহাসমুদ্রের অতল তলে—যেখানেই যাই, তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। তুমিই আমার গতি, আমার নিয়ন্তা, আমার শরণ, আমার সখা, আমার গুরু, আমার ঈশ্বর, তুমিই আমার স্বরূপ। তুমি কখনই আমায় ত্যাগ করবে না—কখনই না, এ আমি ঠিক জানি। হে আমার ঈশ্বর, আমি কখনও কখনও একলা প্রবল বাধাবিঘ্নের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ি, তখন মানুষের সাহায্যের কথা ভাবি। চিরদিনের জন্য ওসব দুর্বলতা থেকে আমায় রক্ষা কর, যেন আমি তোমা ছাড়া আর কারও কাছে কখনও সাহায্য প্রার্থনা না করি। যদি কেউ কোন ভাল লোকের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, সে কখনও তাকে ত্যাগ করে না বা তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে না। প্রভু, তুমি সকল ভালর সৃষ্টিকর্তা—তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে? তুমি তো জান, সারা জীবন আমি তোমার—কেবল তোমারই দাস। তুমি কি আমায় ত্যাগ করবে—যাতে অপরে আমায় ঠকিয়ে যাবে বা আমি মন্দের দিকে ঢলে পড়ব?
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
১৮৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
C/o Miss Mary Philips
19 W. 38th St., নিউ ইয়র্ক
২৮ মে, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এই সঙ্গে আমি একশ’ ডলার অথবা ইংরেজী মুদ্রা হিসাবে ২০ পাউণ্ড ৮ শিলিং ৭ পেন্স পাঠালাম। আশা করি, এতে তোমাদের কাগজটা বার করবার কিঞ্চিৎ সাহায্য হবে, পরে ধীরে ধীরে আরও সাহায্য করতে পারব।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুঃ—পত্রপাঠ নিউ ইয়র্কে উপরের ঠিকানায় প্রাপ্তিস্বীকার করবে। এখন থেকে নিউ ইয়র্ক আমার প্রধান আস্তানা। অবশেষে আমি এদেশে কিছু করে যেতে সমর্থ হলাম।
—বি
১৮৭*
54 W. 33rd St, নিউ ইয়র্ক
মে, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি গতকাল মিস থার্সবিকে ২৫ পাউণ্ড দিয়েছি। ক্লাসগুলি চলছে বটে, কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি—যদিও ক্লাসে বহু ছাত্রের সমাগম হয়, তারা যা দেয়, তাতে ঘরভাড়াটাও ওঠে না। এই সপ্তাহটা চেষ্টা করে দেখব, তারপর ছেড়ে দেব।
আমি সহস্রদ্বীপোদ্যানে (Thousand Island Park) আমার ক্লাসের জনৈকা ছাত্রী মিস ডাচারের কাছে যাচ্ছি। ভারতবর্ষ থেকে বেদান্তের বিভিন্ন ভাষ্য আমার নিকট শীঘ্র পাঠান হচ্ছে। এই গ্রীষ্মে ওখানে থাকাকালে আমি ‘বেদান্তদর্শনের তিনটি বিভিন্ন সোপান’ সম্বন্ধে ইংরেজীতে একখানি বই লিখব মনে করছি; তারপর গ্রীনএকারে যেতে পারি।
মিস ফার্মার আমার কাছে জানতে চান, এই গ্রীষ্মে গ্রীনএকারে কোন্ কোন্ বিষয়ে বক্তৃতা করব, আর কোন্ সময়েই বা সেখানে যাব। আমি এর উত্তরে কি লিখব বুঝতে পাচ্ছি না। আশা করি, আপনি কৌশলে ঐ অনুরোধ কাটিয়ে দেবেন—এ বিষয়ে আপনার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করলাম।
আমি বেশ ভাল আছি—মুদ্রাকর সমিতির (Press Association) জন্য ‘অমরত্ব’ (Immortality) বিষয়ে আমার প্রতিশ্রুত একটি প্রবন্ধ লিখতে বিশেষ ব্যস্ত আছি।
আপনার অনুগত
বিবেকানন্দ
১৮৮*
21 W. 34th St, নিউ ইয়র্ক
জুন, ১৮৯৫
প্রিয় জো,৬৮
নানা ঝড়-ঝাপটা তোমার উপর দিয়ে যাচ্ছে, দেখছি। ফলে নিশ্চয়ই আরও বহু আবরণ অপসৃত হবে।
মিঃ লেগেট তোমার ফনোগ্রাফের কথা বলছিলেন। তাঁকে কয়েকটি চোঙ (cylinders) সংগ্রহ করতে বলেছি। ‘কারও একটি ফনোগ্রাফে ঐগুলি দিয়ে কথা বলি, পরে ঐগুলি জো-কে পাঠিয়ে দি’—আমার এই কথা শুনে তিনি বললেন, ‘আমি তো একটি ফনোগ্রাফ কিনে দিতে পারি। জো যা বলে আমি তাই করি।’ তাঁর অন্তরে একটা কবিত্ব প্রচ্ছন্ন আছে দেখে সুখী হলাম।
আজ গার্নসিদের ওখানে থাকতে যাচ্ছি। ডাক্তার নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে আমাকে রোগমুক্ত করতে চান। অন্য সব পরীক্ষার পর ডাঃ গার্নসি আমার নাড়ী দেখছিলেন; এমন সময় সহসা ল্যাণ্ডস্বার্গ এসে হাজির, আমাকে দেখামাত্র সরে পড়ল। ডাক্তার গার্নসি খুব হেসে উঠে বললেন যে, ঠিক ঐ সময়ে আসার জন্য তিনি লোকটিকে পুরস্কৃত করতে ইচ্ছুক, কারণ সে আসাতে রোগটা ঠিক ঠিক নির্ণয় করা গেল। তার আসবার পূর্ব পর্যন্ত নাড়ীর স্পন্দন ঠিক ছিল, কিন্তু তাকে দেখামাত্র মানসিক উত্তেজনার ফলে স্পন্দন প্রায় থেমে গেল। নিশ্চয় হল—রোগটি স্নায়ুসংক্রান্ত। তিনিও আমাকে ডাক্তার হেল্মারের চিকিৎসাই চালাতে বললেন—জোর করে। তাঁর বিশ্বাস হেল্মার আমাকে রোগমুক্ত করবেন। লোকটি বেশ উদার।
আজই শহরে ‘পবিত্র গাভী’ (the sacred cow) দেখতে যাবার ইচ্ছা। নিউ ইয়র্কে আর দিন-কয়েক আছি। হেল্মার বলেছেন, সপ্তাহে তিনবার করে চার সপ্তাহ, তার পর দু-বার করে আর চার সপ্তাহ চিকিৎসা করালেই সম্পূর্ণ সুস্থ হব। যদি ইতোমধ্যে বোষ্টনে যাই, তিনি ওখানকার এক ওস্তাদ চিকিৎসককে আবশ্যকমত নির্দেশ দেবেন।
ল্যাণ্ডস্বার্গের সঙ্গে সামান্য মিষ্টালাপের পর বেচারীকে অব্যাহতি দেবার জন্য— উপরতলায় মাদার গার্নসির নিকট চলে গেলাম। ইতি
সতত প্রভুপদে তোমাদের
বিবেকানন্দ
১৮৯
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
১৮৯৫
কল্যাণবরেষু,
তোমাদের এক পত্রে অনেক সমাচার জ্ঞাত হইলাম। তবে সকলের বিশেষ সমাচার লিখ নাই। নিরঞ্জনের এক পত্র মধ্যে পাই—সে সিলোন যাইতেছে সংবাদ পাই। সারদা যাহা করিতেছে, তাহাই আমার অভিমত; তবে ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস অবতার’ ইত্যাদি প্রচার করিবার আবশ্যক নাই। তিনি পরোপকার করিতে আসিয়াছিলেন, নিজের নাম ঘোষণা করিতে নহে। চেলারা গুরুর নাম করে; গুরু যা শেখাতে এসেছিলেন, তাতে জলাঞ্জলি দেয়, আর দলাদলি ইত্যাদি তার ফল।
আলাসিঙ্গা লিখেছে চারুবাবুর বিষয়। আমি তাঁহাকে স্মরণ করিতেছি না। চারুবাবুর বিষয় সবিশেষ লিখিবে ও তাঁহাকে আমার ধন্যবাদ দিবে। সকলের বিষয় বিশেষ করিয়া লিখিবে—বৃথা বার্তা করিবার সময় কুলায় না। আমার জীবনে বোধ হয় কারুর সহিত ঠাট্টা-বটকেরা করার অপেক্ষা অনেক কার্য আছে।
কর্মকাণ্ড ত্যাগ করিবার চেষ্টা করিবে; ঘণ্টা নাড়া সন্ন্যাসীর নহে এবং যাবৎ জ্ঞান না হয়, তাবৎ কর্ম। আমিই ঐ অনর্থের মূল। এক্ষণে দেখিতেছি যে, ঐ ঘণ্টা-পত্র লইয়া রামকৃষ্ণ-অবতারের দল বাঁধিবে এবং তাঁহার শিক্ষায় ধূলি নিক্ষেপ হইবে। তোমরা ঘণ্টা ত্যাগ করিতে পার ভালই, নচেৎ আমি তোমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারিব না। দলাদলি, দলবাঁধা, কূপমণ্ডুকের মধ্যে আমি নাই, আর যেথায় আমি থাকি। ইতি
‘—’ থিওসফিষ্ট হইয়াছেন, ভালই, রুচীনাং বৈচিত্র্যং! মঙ্গলমস্তু তেষাং, কিমহংব্রবীমি (রুচির বৈচিত্র্য! তাদের মঙ্গল হউক, আমি আর কি বলিব)? Universal brotherhood (সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব), বেশ কথা—শিবাঃ বঃ সন্তু পন্থানঃ। তার চেয়ে সুখের বিষয় কি আছে? … রামকৃষ্ণ পরমহংসের উদারভাব প্রচার করে আবার দলবাঁধা কেমন করে হয়? দলের বীজ হচ্ছে ঐ ঘণ্টা-পত্র। আমি হাজারবার ঠুকেছি, এবারও ঠুকলাম—ফলে কিছু হয় না। আমার নামে যদি তোমাদের দলবাঁধার সহায়তা হয়, তাহলেই আমি লীডার (নেতা) বটি, নইলে আমি কেউ নই! এই সত্য বটে! আমি ওতে নাই। আমি যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য এবং তোমরাও যে তাই, এইটি বই লিখে ছাপাতে যত্ন তো যথেষ্ট হয়েছে; কিন্তু আমি যে আজ ৬ বৎসর ঘণ্টা-পত্র ত্যাগ করার জন্য বলছি, তাতে কারুর কান পাতা নাই। … আমি একমাত্র কর্ম বুঝি—পরোপকার, বাকী সমস্ত কুকর্ম। তাই শ্রীবুদ্ধদেবের পদানত হই। বুঝতে পারছ? … ফল কথা—আমি বৈদান্তিক; সচ্চিদানন্দ আমার নিজের আত্মার মহান্ রূপ ছাড়া অন্য ঈশ্বর বড় একটা দেখতে পাচ্ছি না। অবতার মানে—যাঁহারা সেই ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন, অর্থাৎ জীবন্মুক্ত। অবতারবিশেষত্ব আমি দেখিতে পাইতেছি না। ব্রহ্মাদিস্তম্ব পর্যন্ত সমস্ত প্রাণী কালে জীবন্মুক্তি প্রাপ্ত হবে এবং আমাদের উচিত সকলের সেই অবস্থা পেতে সহায় হওয়া। এই সহায়তার নাম ধর্ম, বাকী অধর্ম। এই সহায়তার নাম কর্ম, বাকী কুকর্ম; আর আমি কিছুই দেখছি না। অন্যবিধ তান্ত্রিক বা বৈদিক কর্মে ফল থাকিতে পারে, কিন্তু তদবলন্বন কেবল বৃথা জীবনক্ষয়—কারণ কর্মের ফল যে পবিত্রতা, তাহা কেবল পরোপকার মাত্রে ঘটে। যজ্ঞাদি কর্মের ভোগাদি সম্ভব, আত্মার পবিত্রতা অসম্ভব। অতএব সন্ন্যাস অবলম্বন করে, জীবকে উচ্চগতি শিক্ষা না দিয়ে পুনঃ- পুনঃ অনর্থকর কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করা আমার মতে দূষণীয়। মূর্খ গৃহস্থ কর্মপর হউক, তাতে ক্ষতি নাই; কিন্তু ত্যাগী!! … সমস্তই প্রত্যেকের আত্মার বর্তমান। যে বলে আমি মুক্ত, সেই মুক্ত হবে। যে বলে আমি বদ্ধ, সে বদ্ধ হবে। দীন হীন ভাব আমার মতে পাপ এবং অজ্ঞতা। ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’।৬৯ ‘অস্তি ব্রহ্ম বদসি চেদস্তি ভবিষ্যসি, নাস্তি ব্রহ্ম বদসি চেৎ নাস্ত্যেব ভবিষ্যসি’।৭০ যে সদা আপনাকে দুর্বল ভাবে, সে কোন কালে বলবান্ হইবে না; যে আপনাকে সিংহ জানে, সে ‘নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী’।৭১ দ্বিতীয়তঃ রামকৃষ্ণ পরমহংস কোন নূতন তত্ত্ব প্রচার করিতে আইসেন নাই—প্রকাশ করিতে আসিয়াছিলেন বটে, অর্থাৎ He was the embodiment of all past religious thoughts of India. His life alone made me understand what the Shastras really meant, and the whole plan and scope of the old Shastras.৭২
মিশনরী-ফিশনরী এদেশে বড় চলল না। এরা ঈশ্বরেচ্ছায় আমায় খুব ভালবাসে, কারুর কথায় ভোলবার নয়। এরা আমার ideas (ভাব) যেমন বোঝে, আমার দেশের লোক তেমন পারে না, এবং এরা বড় স্বার্থপর নয়। অর্থাৎ ঐ jealousy (ঈর্ষা) আর হামবড়া ভাবগুলো এরা কাজের বেলা দূর করে দেয়, তখন সকলে মিলে একজন কাজের লোকের কথামত চলে। তাতেই এরা এত বড়। তবে এরা হচ্ছে টাকা-দেবতার জাত, সকল কথায় পয়সা; আমাদের দেশের লোক টাকার বিষয়ে বড় উদার, এরা তত নয়। কৃপণ ঘরে ঘরে। ওটি ধর্মের মধ্যে। তবে দুষ্কর্ম করলে পর পাদ্রীদের হাতে পড়ে। তখন টাকা দিয়ে স্বর্গে যায়! এগুলো সব দেশেই সমান—priestcraft (পুরোহিতদের তুকতাক)।
আমি কবে দেশে যাব, কি না যাব, কিছুই বলতে পারি না। এখানে ঘুরে বেড়ান, সেখানেও তাই। তবে এখানে হাজারো লোক আমার কথা শোনে, বোঝে—হাজারো লোকের উপকার হয়; সেখানে কি?
রামকৃষ্ণ পরমহংসের বিষয় মজুমদার যা লিখেছিল, আমি খালি তাই চাহিয়াছিলাম। তা না হয়ে কতকগুলো জার্মান ছেঁড়া পুঁথি পাঠিয়ে দিয়েছ, আর তার মধ্যে দুখানা আমার লেকচার; কি আপদ!!
সারদা যা করছে, তা আমার সম্পূর্ণ অভিমত। তাকে আমার শত শত ধন্যবাদ। বলি, তোমরা যা কিছু করছ, আমি বুঝতে পারি না। … যা হোক, মান্দ্রাজ ও বোম্বেতে আমার মনের মত লোক আছে। তারা বিদ্বান্ এবং সকল কথা বোঝে এবং তারা দয়াল; অতএব পরহিতচিকীর্ষা বুঝিতে পারে। কিমধিকমিতি।
মা-ঠাকুরাণীকে আমার শত শত দণ্ডবৎ দিবে এবং সকলকে আমার যথাযোগ্য সম্ভাষণ দিবে। আমি বই-টই কিছু ছাপাই নাই। এখানে লেকচার করে বেড়াই মাত্র। গুপ্ত, তুলসী প্রভৃতির বিষয় কিছুই লেখ নাই কেন? কালী কি করছে? শরৎ, যোগেন সেরে গেছে কিনা? আমার জীবনের প্রতি দেখে [তাকালে] আমার আপসোস হয় না। দেশে দেশে কিছু না কিছু লোকশিক্ষা দিয়ে বেড়িয়েছি, তার বদলে রুটির টুকরো খেয়েছি। যদি দেখতুম যে, কোন কাজ করিনি, কেবল লোক ঠকিয়ে খেয়েছি, তাহলে আজ গলায় দড়ি দিয়ে মরতুম।
সারদাকে আমায় একটা চিঠি লিখতে বলবে। তার সঙ্গে আমার মত মিলবে বোধ হয়। … আমি রামকৃষ্ণ পরমহংসের চেলা নই, আমি কারুর চেলাপত্র নই ইতি; আমি সারদার চেলা। যারা আমার মনের মত কার্য করবে, আমি তাদের চেলা। যারা তা না করবে, তাদের কোন খবর আমি চাই না, আমার কোন খবর তাদের জন্য নাই। ইতি
নরেন্দ্র
১৯০*
পার্সি, নিউ হ্যাম্পসায়ার
৭ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
অবশেষে আমি এখানে মিঃ লেগেটের কাছে এসে পৌঁছেছি। আমি জীবনে যে-সকল সুন্দরতম স্থান দেখেছি, এটি তাদের অন্যতম। কল্পনা করুন, চতুর্দিকে প্রকাণ্ড বনের দ্বারা আচ্ছাদিত পর্বতশ্রেণী ও তার মধ্যে একটি হ্রদ—আর সেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। কি মনোরম, কি নিস্তব্ধ, কি শান্তিপূর্ণ! শহরের কোলাহলের পর, আমি যে এখানে কি আনন্দ পাচ্ছি, তা আপনি সহজেই অনুমান করতে পারেন।
এখানে এসে আমি যেন নবজীবন লাভ করেছি। আমি একলা বনের মধ্যে যাই, আমার গীতাখানি পাঠ করি এবং বেশ সুখেই আছি। দিন দশেকের মধ্যে এ স্থান ত্যাগ করে সহস্রদ্বীপোদ্যানে (Thousand Island Park) যাব। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন ভগবানের ধ্যান করব এবং একলা নির্জনে থাকব। এই কল্পনাটাই মনকে উঁচু করে দেয়।
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
১৯১*
[ভূর্জপত্রে মিস মেরী হেলকে লিখিত]
পার্সি, N.H.
১৭ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
আগামীকাল৭৩ যাচ্ছি সহস্রদ্বীপোদ্যানে। ঠিকানা—C/o Miss Dutcher, Thousand Island Park, N.Y. তুমি এখন কোথায় আছ? গ্রীষ্মের সময় তোমরা সব কোথায় থাকবে? অগষ্ট মাসে আমার ইওরোপে যাবার সম্ভাবনা আছে। যাবার আগে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব। সুতরাং পত্র দিও। তাছাড়া ভারত হতে কতকগুলি বই ও চিঠি আসবার কথা। অনুগ্রহ করে সেগুলো মিস ফিলিপসের ঠিকানায়—নিউ ইয়র্কে পাঠিয়ে দিও। ভারতবর্ষে যাবতীয় পবিত্র লিপি এই ভূর্জপত্রে লেখা হয়। আমিও সংস্কৃতে লিখলামঃ উমাপতি (শিব) সর্বদা তোমাকে রক্ষা করুন।
তোমরা সকলে অনন্তকাল সুখে থাক।
বিবেকানন্দ
১৯২*
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]
Thousand Island Park, N.Y.
C/o Miss Dutcher
১৮ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
রওনা হবার পূর্বদিন মিসেস স্টার্জিস্-এর এক চিঠি পেয়েছি, ৫০ ডলারের একখানা চেকও সঙ্গে আছে। পরদিনই তাঁর কাছে প্রাপ্তিস্বীকার পৌঁছিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি এর পর যখন তাঁকে চিঠি লিখবে, তখন আমার ধন্যবাদ ও প্রাপ্তিস্বীকারটা তাঁকে জানিয়ে দিও।
প্রাচীন হিন্দু প্রবচন ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’-ছাড়া এখানে বেশ সময় কাটছে। একই কথা, আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। অগষ্টের প্রথম ভাগে চিকাগো যাচ্ছি। তুমি কখন রওনা হচ্ছ?
এখানকার বন্ধুরা সকলেই তোমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। তোমার সর্বাঙ্গীণ সুখ শান্তি ও স্বাস্থ্য কামনা করি।
তোমার স্নেহের
বিবেকানন্দ
১৯৩*
54 W. 33rd St., নিউ ইয়র্ক
জুন, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
আমি এইমাত্র এখানে পৌঁছলাম। এই অল্প ভ্রমণে আমার উপকার হয়েছে। সেখানকার পল্লী ও পাহাড়গুলি—বিশেষতঃ মিঃ লেগেটের নিউ ইয়র্ক প্রদেশের পল্লীভবনটি আমার খুব ভাল লেগেছিল।
ল্যাণ্ডস্বার্গ বেচারী এই থেকে চলে গিয়েছে। সে তার ঠিকানা পর্যন্ত আমাকে জানিয়ে যায়নি। সে যেখানেই যাক, ভগবান্ তার মঙ্গল করুন। আমি জীবনে যে দু-চারজন অকপট লোক দেখবার সৌভাগ্য লাভ করেছি, সে তাদেরই মধ্যে একজন।
যা কিছু ঘটে, সবই ভালর জন্য। সকল প্রকার মিলনের পরেই বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। আশা করি, আমি একাই সুন্দর কাজ করতে পারব। মানুষের কাছ থেকে যত কম সাহায্য নেওয়া যাবে, ভগবানের কাছ থেকে তত বেশী সাহায্য পাওয়া যাবে। এইমাত্র আমি লণ্ডনস্থ জনৈক ইংরেজের একখানি পত্র পেলাম—তিনি আমার দুইজন গুরুভাইয়ের সঙ্গে কিছুদিন ভারতবর্ষের হিমালয় প্রদেশে বাস করেছিলেন। তিনি আমায় লণ্ডনে যেতে বলছেন। আপনাকে চিঠি লেখার পর, আমার ছাত্রেরা খুব সাহায্য করছে এবং এখন যে ক্লাসগুলি খুব ভালভাবে চলবে, তাতে সন্দেহ নাই। আমি এতে খুব আনন্দিত হয়েছি, কারণ খাওয়া-দাওয়ার বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মত শিক্ষাদান করাটা আমার জীবনে একটা অত্যাবশ্যক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুঃ—‘—’ সম্বন্ধে ‘বর্ডারল্যাণ্ড’ নামক ইংরেজী সংবাদপত্রে অনেক বিষয় পড়লাম। তিনি হিন্দুদিগকে তাদের নিজ ধর্মের গুণগুলি গ্রহণ করতে শিখিয়ে ভারতবর্ষে যথার্থই সৎকার্য করেছেন। … উক্ত মহিলার লেখা পড়ে তার মধ্যে কোনরূপ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেলাম না, … কিম্বা কোনরূপ আধ্যাত্মিক ভাবও পেলাম না। যা হোক, যে-কেউ জগতের উপকার করতে চায়, ভগবান্ তারই সহায় হউন।
এই জগৎ কত সহজেই না বুজরুকদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে থাকে! আর সভ্যতার প্রথম উন্মেষের সময় থেকে বেচারা মানুষকে নিরীহ পেয়ে তার উপর কত প্রবঞ্চনাই না চলেছে!
আপনার স্নেহের
তোমাদের বিবেকানন্দ
১৯৪*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
54 W. 33rd Street, নিউ ইয়র্ক
২২ [?] জুন, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
ভারত থেকে প্রেরিত পত্রগুলি ও বই-এর পার্সেল নির্বিঘ্নে পৌঁছেছে। মিঃ স্যামের আগমন-সংবাদে আমি খুবই আনন্দিত। একদিন রাস্তায় মিঃ স্যামের এক বন্ধুর সহিত দেখা হয়। ভদ্রলোক ইংরেজ; বেশ লোক। বললেন, ওহিওর কোন স্থানে মিঃ স্যামের সঙ্গে এক বাড়ীতে আছেন।
আমার দিনগুলো আগের মতই প্রায় একভাবে চলেছে। অবসরমত হয় অনর্গল বকছি, নয়তো একদম চুপচাপ। এ গ্রীষ্মে গ্রীনএকার যাওয়া হয়ে উঠবে কিনা জানি না। সেদিন মিস ফার্মারের সহিত দেখা করি; তখন তিনি স্থানান্তরে যেতে খুব ব্যস্ত, সুতরাং বাক্যালাপ অতি অল্পই হয়। তিনি একজন মহীয়সী নারী।
ক্রিশ্চান সায়ান্সের চর্চা কেমন চলছে? আশা করি তুমি গ্রীনএকার যাচ্ছ। সেখানে ওই দলের ও ভূতুড়েদের (spiritualists) অনেককে দেখবে, তাছাড়া দেখবে হস্তরেখাবিচারক, জ্যোতিষী, আরও কত কি! মিস ফার্মারের নেতৃত্বে সেখানে মিলবে রোগের যাবতীয় প্রতিকার ও ধর্মবিষয়ক যাবতীয় মতবাদ।
ল্যাণ্ডস্বার্গ অন্যত্র চলে গেছে। আমি একাই আছি। আজকাল দুধ, ফল, বাদাম—এইসব আমার আহার। ভাল লাগে, আছিও বেশ। এই গ্রীষ্মের মধ্যেই মনে হয় শরীরের ওজন ৩০/৪০ পাউণ্ড কমবে। শরীরের আকার অনুসারে ওজন ঠিকই হবে। ঐ যাঃ! বেড়ান বিষয়ে মিসেস এডাম্সের উপদেশের কথা একেবারে ভুলে গেছি। তাঁর নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে আবার সেগুলি অভ্যাস করতে হবে।
গান্ধী সম্ভবতঃ বোষ্টন হতে ভারত রওনা হয়েছিলেন। পথে ইংলণ্ড হয়ে যাবেন। তাঁর অভিভাবিকা মিসেস হাওয়ার্ড শোকগ্রস্ত হয়ে কেমন আছেন? কম্বলগুলো যে আটলাণ্টিকগর্ভে মগ্ন হয়নি, সত্যসত্যই এসে পৌঁছেছে—এটা সুখবর বলতে হবে।
বক্তৃতা না দিলেও এ বৎসর মাথা তোলবার সময় পাইনি। ভারত থেকে বেদান্তের উপর দ্বৈত, অদ্বৈত ও বিশিষ্টাদ্বৈত—এই তিন প্রধান সম্প্রদায়ের ভাষ্য পাঠিয়েছে। আশা করি নির্বিঘ্নে এসে পৌঁছবে। চর্চা করে খুব আনন্দ হবে। এই গ্রীষ্মে বেদান্তদর্শন-বিষয়ক এক পুস্তক রচনার সঙ্কল্প। ভালমন্দ, সুখদুঃখের সংমিশ্রণই জগৎ। চক্র চিরকালই উঠবে ও নামবে; ভাঙা গড়া বিধির অলঙ্ঘ্য বিধান। যাঁরা এ সবের পারে যাবার চেষ্টা করছেন, তাঁরাই ধন্য।
মেয়েরা সব ভাল আছে জেনে সুখী হলাম। পরিতাপের বিষয়, এবারকার শীতেও কেউ ধরা পড়ল না। এদিকে শীতের পর শীত চলে যাচ্ছে। আশাও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। এখানে আমার বাসার কাছে অবস্থিত ওয়ালডর্ফ হোটেল। আমেরিকান ধনী-কন্যারা ক্রয় করবেন বলে বহু খেতাবধারী কিন্তু কপর্দকহীন ইওরোপীয় পুরুষের প্রদর্শনী ও আড্ডা এটি। আমদানী এত প্রচুর ও বিবিধ যে, ইচ্ছানুরূপ নির্বাচন বাস্তবিকই সুলভ। কেউ আছেন একেবারেই ইংরেজী বলতে পারেন না, আবার আছেন জনকয়েক যাঁরা আধ আধ ইংরেজী বলেন, যা অন্যের বোধগম্য নয়। ভাল ইংরেজী বলতে পারেন, এমন সব লোকও আছেন। কিন্তু নির্বাকদের তুলনায় তাঁদের আশা বড় কম। কারণ যাঁরা ইংরেজী ভাল বলতে পারেন, মেয়েরা তাঁদের ঠিক ‘বিদেশী’ বলে মনে করে না।
এক মজার বইয়ে পড়লাম, সমুদ্রে এক আমেরিকান জাহাজ ডুবু ডুবু। লোকেরা হতাশ হয়ে অন্তিম সান্ত্বনার জন্য কোনরূপ ধর্মানুষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভব করল। প্রেসবিটেরিয়ান চার্চের এক বিশিষ্ট ধর্মযাজক জাহাজে ছিলেন—জস্ খুড়ো। সকলে তাঁকেই ধরে বসল, ‘আর তো মরতে বসেছি, এখন কিছু ধর্মানুষ্ঠান করুন, দোহাই জস্ খুড়ো।’ খুড়ো মাথার টুপি হাতে উল্টে ধরে তখনই দান সংগ্রহ করতে শুরু করলেন।
ধর্ম বলতে তিনি এর বেশী বুঝতেন না। এই জাতীয় লোকের অধিকাংশেরই এই অবস্থা। এদের বুদ্ধিতে ধর্মের তাৎপর্য দানসংগ্রহ। ভগবান্ এদের মঙ্গল করুন। এখনকার মত আসি। কিছু খেতে যাচ্ছি। বড় খিদে পেয়েছে। ইতি—
তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ
১৯৫*
19 W. 38th St., নিউ ইয়র্ক
২২ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় কিডি,
তোমাকে এক লাইন না লিখে একখানা গোটা চিঠি লিখছি।
তুমি দিন দিন উন্নতি করছ জেনে খুব সুখী হলাম। তুমি যে ভাবছ, আমি আর ভারতে ফিরব না, এটা তোমার ভুল ধারণা। আমি শীঘ্রই ভারতে ফিরব, তবে কোন বিষয়ে ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দেওয়া আমার স্বভাব নয়। এখানে আমি একটি বীজ পুঁতেছি, শীঘ্রই সেটি বৃক্ষে পরিণত হবে—হবেই হবে। তবে আমার আশঙ্কা, যদি আমি তাড়াহুড়ো করে যত্ন নেওয়া বন্ধ করি, গাছটির বাড়ের ক্ষতি হবে। তোমাদের কাগজটা বার করে ফেল। তোমাদের সঙ্গে আমার এখানকার লোকদের যোগাযোগ করে দিয়ে আমি ভারতে যাচ্ছি আর কি।
বৎস, কাজ করে যাও, রোম একদিনে নির্মিত হয়নি। আমি প্রভুর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। সুতরাং শেষে সব ভালই দাঁড়াবে। চিরদিনের জন্য আমার ভালবাসা জানবে।
তোমার
বিবেকানন্দ
১৯৬*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
২৬ জুন, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
ভারতীয় পত্রগুলির (mail) জন্য ধন্যবাদ। এবার অনেক সু-খবর এল। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের ‘আত্মার অমরত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলি মাদার চার্চকে পাঠিয়েছি। আশা করি, এখন সেগুলি পড়ে তুমি আনন্দ পাচ্ছ। বেদান্তের কোন অংশই বৃদ্ধ উপেক্ষা করেননি। সাবাস তাঁর নির্ভীক কৃতিত্ব! ঔষধগুলি এসে পৌঁছেছে শুনে সমধিক সুখী হলাম। শুল্ক কিছু লাগল নাকি? যদি লেগে থাকে, আমি দিয়ে দেব; আপত্তি করো না। খেতড়িরাজের প্রেরিত শাল, কিংখাব আর ছোটখাট কয়েক রকম সুন্দর জিনিসের একটা বড় প্যাকেট আসছে। এগুলি বন্ধুদের উপহার দিতে চাই। তবে এসে পৌঁছতে এখনও অন্ততঃ মাস-কয়েক লাগবে
ভারতের চিঠিগুলোতে দেখবে, আমাকে দেশে ফিরে যাবার জন্য বারংবার অনুরোধ করছে। ওরা অস্থির হয়ে পড়েছে। ইওরোপে যদি যাই তো নিউ ইয়র্ক অঞ্চলের মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটের অতিথি হয়ে যাব। তিনি ছয় সপ্তাহ ধরে জার্মানী, ফ্রান্স, ইংলণ্ড ও সুইজরলণ্ডের সর্বত্র ঘুরবেন। ওখান থেকে ভারতে ফিরব। চাই কি এখানেও ফিরতে পারি। এদেশে যে বীজ বপন করলাম, তার পরিণতি কামনা করি। এইবারের শীতে চমৎকার কাজ হয়েছে নিউ ইয়র্কে। সহসা ভারতে চলে গেলে সব পণ্ড হয়ে যেতে পারে। তাই যাওয়া সম্বন্ধে এখনও মন করিনি।
সহস্রদ্বীপোদ্যানে লক্ষ্য করার মত তেমন কিছু ঘটেনি। দৃশ্য রমণীয় বটে। কয়েকজন বন্ধু রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে ঈশ্বর ও আত্মা সম্বন্ধে ইচ্ছামত প্রসঙ্গ হয়। ফল দুধ প্রভৃতি আহার করি, আর বেদান্তবিষয়ক প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সংস্কৃত গ্রন্থ পড়ি, এগুলি ওরা ভারত থেকে অনুগ্রহ করে পাঠিয়েছে।
চিকাগোয় যদি ফিরি তো ছয় সপ্তাহের পূর্বে নয়, চাই কি আরও দেরী হতে পারে। বেবী যেন আমার জন্য তার ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন না করে। ফিরে যাবার আগে যে-কোন উপায়ে তোমাদের সকলের সঙ্গে দেখা করব—নিশ্চয় জেনো।
মান্দ্রাজ-অভিনন্দনের উত্তর পড়ে তুমি খুবই বিচলিত হয়েছিলে; সেখানে কিন্তু তার খুব ফল হয়েছে। সেদিন মান্দ্রাজ ‘খ্রীষ্টান কলেজে’র অধ্যক্ষ (President) মিঃ মিলার তাঁর এক ভাষণে আমার চিন্তাগুলি অনেকাংশে সন্নিবিষ্ট করে বলেছেন যে, ঈশ্বর ও মানুষ সম্বন্ধে ভারতের তত্ত্বগুলি প্রতীচ্যের খুব উপযোগী, আর যুবকদের সেখানে (পাশ্চাত্যে) গিয়ে প্রচারকার্যে ব্রতী হতে আহ্বান করেছেন। এতে ধর্মযাজক মহলে বেশ ক্রোধের সঞ্চার হয়েছে। ‘এরেনা’ পত্রে প্রকাশিত যে প্রবন্ধের কথা তুমি লিখেছ, আমি তার কিছুই দেখিনি। নিউ ইয়র্কের মহিলারা আমার সম্পর্কে কোনরূপ হইচই করেননি। তোমার বন্ধুটির বিবরণ কল্পনাপ্রসূত। প্রভুত্ব করা তাদের স্বভাব নয়। আশা করি, ফাদার পোপ ও মাদার চার্চ ইওরোপে যাচ্ছেন। দেশভ্রমণ জীবনে খুবই আনন্দদায়ক। আমাকে এক জায়গায় বেশী দিন আটকে রাখলে সম্ভবতঃ মারা পড়ব। পরিব্রাজক-জীবনের তুলনা হয় না।
চতুর্দিকে অন্ধকার যতই ঘনিয়ে আসে, উদ্দেশ্য ততই নিকটবর্তী হয়, ততই জীবনের প্রকৃত অর্থ—জীবন যে স্বপ্ন, তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে; কেন যে মানুষ এটা বুঝতে পারে না তাও বোঝা যায়। সে যে একান্ত অর্থহীনের মধ্যে অর্থসঙ্গতি খুঁজতে চেষ্টা করেছিল! স্বপ্নের মধ্যে বাস্তবের সন্ধান শিশুসুলভ উদ্যম বৈ আর কি! ‘সবই ক্ষণিক, সবই পরিবর্তনশীল’—এইটুকু নিশ্চয় জেনে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখদুঃখ ত্যাগ করে জগদ্বৈচিত্র্যের সাক্ষিমাত্ররূপে অবস্থান করেন, কোন কিছুতে আসক্ত হন না।
‘যাঁদের চিত্ত সাম্যে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরা ইহজীবনেই জন্মমৃত্যুর বন্ধন অতিক্রম করেছেন। ভগবান্ নির্দোষ ও সমদর্শী এবং সকলের প্রতি সমবুদ্ধি; সুতরাং তাঁরা ভগবানেই অবস্থিত।’৭৪ বাসনা, অজ্ঞান ও ভেদদৃষ্টি—এই তিনটিই বন্ধন। জীবনে অনাসক্তি, জ্ঞান ও সমদর্শিতা—এই তিনটি মুক্তি। মুক্তিই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের লক্ষ্য।
না আসক্তি, না বিদ্বেষ; না সুখ, না দুঃখ; না মৃত্যু, না জীবন; না ধর্ম, না অধর্ম; নেতি, নেতি নেতি।
চিরতরে তোমার
বিবেকানন্দ
১৯৭*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
প্রিয় ভগিনী,
ভারতীয় পত্রাদির জন্য বহু ধন্যবাদ। ভাষার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে অক্ষম। মাদার চার্চকে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার-লিখিত ‘অমরত্ব’ নামক যে প্রবন্ধটি পাঠাই, সেটি পড়ে দেখে থাকবে—তাঁর মতে, ইহজীবনে যারা আমাদের প্রীতিভাজন, অতীত জন্মেও তারা নিশ্চয় তেমনি ছিল। তাই মনে হয়, কোন পূর্বজন্মে আমি এই ভক্ত পরিবারেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। ভারত থেকে কয়েকখানি বই আসবার কথা, হয়তো এসে গেছে। যদি এসে থাকে, তবে অনুগ্রহ করে এখানে পাঠিয়ে দিও। ডাকমাশুল বাবদ যদি কিছু দেয় থাকে, সংবাদ পাবামাত্র পাঠাব, জানবে। কম্বলগুলির জন্য শুল্কের কথা তুমি তো কিছু লেখনি। খেতড়ি থেকে আর একটি বড় প্যাকেট আসবে—কার্পেট, শাল, কিংখাব ও অন্যান্য ছোট ছোট জিনিষের। বোম্বাইয়ে আমেরিকান কনসালের মারফৎ শুল্ক ওখানেই দিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে ওখানেই দিয়ে দিতে লিখেছি। নয়তো আমাকেই এখানে দিতে হবে। মনে হয় মাসকয়েকের পূর্বে আসছে না। বইগুলির জন্য উদ্গ্রীব রইলাম। এলেই অনুগ্রহ করে পাঠিয়ে দিও।
মাকে, ফাদার পোপ ও ভগিনীদের সকলকে আমার ভালবাসা। এ স্থানটি বড় ভাল লাগছে। আহার যৎসামান্য, অধ্যয়ন আলোচনা ধ্যানাদি কিন্তু খুব চলছে। অপূর্ব এক শান্তির আবেগে প্রাণ ভরে উঠছে। প্রতিদিনই মনে হচ্ছে—আমার করণীয় কিছু নেই। আমি সর্বদাই পরম শান্তিতে আছি। কাজ তিনিই করছেন। আমরা যন্ত্রমাত্র। তাঁর নাম ধন্য! কাম, কাঞ্চন ও প্রতিষ্ঠারূপ ত্রিবিধ বন্ধন যেন আমা থেকে সাময়িক ভাবে খসে পড়েছে। ভারতে মধ্যে মধ্যে আমার যেমন উপলব্ধি হত, এখানেও আবার তেমনি হচ্ছে—‘আমার ভেদবুদ্ধি, ভালমন্দ বোধ, ভ্রম ও অজ্ঞান বিলুপ্ত হয়েছে, আমি গুণাতীত রাজ্যে বিচরণ করছি। কোন্ বিধিবিশেষ মানব? কোন্টাই বা লঙ্ঘন করব?’ সে উচ্চ ভাবভূমি থেকে মনে হয়, সারা বিশ্ব যেন একটা ডোবা। হরিঃ ওঁ তৎ সৎ; একমাত্র তিনিই আছেন আর কিছু নাই। আমি তোমাতে, তুমি আমাতে। হে প্রভো! তুমি আমার চির আশ্রয় হও। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। সতত প্রীতিশুভেচ্ছাযুক্ত—
তোমাদের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১৯৮*
আমেরিকা
১ জুলাই, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমাদের প্রেরিত মিশনরীদের বইখানা ও রামনাদের রাজার ফটো পেলাম। রাজা ও মহীশূরের দেওয়ান—দুজনকেই পত্র লিখেছি। রমাবাঈয়ের দলের লোকদের সঙ্গে ডাঃ জেনসের বাদ-প্রতিবাদ থেকে বেশ বোধ হয়, মিশনরীদের পুস্তিকাখানা এখানে বহুদিন পূর্বে পৌঁছেছে। ঐ পুস্তিকাতে একটা অসত্য কথা আছে। আমি এদেশে খুব বড় হোটেলে কখনও খাইনি, আর কোনরূপ হোটেলেও খুব কমই গেছি। বাল্টিমোরে ছোট হোটেলওয়ালারা অজ্ঞ—তারা নিগ্রো ভেবে কোন কালা আদমিকে স্থান দেয় না। সেইজন্য ডাঃ ভ্রূম্যান্কে—আমি যাঁর অতিথি ছিলাম—ঐখানে একটা বড় হোটেলে নিয়ে যেতে হয়েছিল; কারণ তারা নিগ্রো ও বিদেশীদের মধ্যে প্রভেদ জানে।
আলাসিঙ্গা, তোমায় বলছি শোন, তোমাদের নিজেদেরই আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হবে। তোমরা কচি খোকার মত ব্যবহার করছ কেন? যদি কেউ তোমাদের ধর্মকে আক্রমণ করে, তোমরা নিজেরাই তার সমর্থন করতে এবং আক্রমণকারীকে মুখের উপর জবাব দিতে পার না কেন? আমার সম্বন্ধে বলছি, তোমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। এখানে আমার শত্রুর চেয়ে মিত্রের সংখ্যা বেশী। আর এদেশের অধিবাসীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মাত্র খ্রীষ্টান; আর শিক্ষিতদের ভেতর খুব অল্পসংখ্যক লোকই মিশনরীদের গ্রাহ্যের মধ্যে আনে। মিশনরীরা কোন কিছুর বিরুদ্ধে লাগলে শিক্ষিতেরা আবার সে বিষয়টি পছন্দ করে। এখন মিশনরীদের শক্তি এখানে অনেক কমে গেছে এবং দিন দিন আরও কমে যাচ্ছে। তারা হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করলে যদি তোমাদের কষ্ট হয়, তবে তোমরা অভিমানী ছেলের মত ঠোঁট ফুলিয়ে আমার কাছে কাঁদুনি গাইতে কেন আস? তোমরা কি লিখতে পার না এবং তাদের ধর্মের দোষ দেখিয়ে দিতে পার না? কাপুরুষতা তো আর ধর্ম নয়!
এখানে ইতোমধ্যেই ভদ্রসমাজের ভেতর একদল লোক আমার ভাব নিয়েছে। আগামী বৎসর তাদের এমনভাবে সঙ্ঘবদ্ধ করব, যাতে তারা কার্যক্ষম হতে পারে; তখন কাজটা চলতে থাকবে। তারপর আমি ভারতে চলে গেলেও এখানে এমন অনেক বন্ধু আছে, যারা এখানকার কাজের পৃষ্ঠপোষক হবে এবং ভারতেও আমায় সাহায্য করবে। সুতরাং তোমাদের ভয় পাবার দরকার নেই। তবে তোমরা যতদিন মিশনরীদের আক্রমণে কেবল চীৎকার করবে এবং কিছু করতে না পেরে লাফিয়ে বেড়াবে, ততদিন আমি তোমাদের দিকে চেয়ে হাসব। তোমরা ছেলেদের হাতের ছোট ছোট পুতুলের মত, তা ছাড়া আর কি? ‘স্বামীজী, মিশনরীরা আমাদের কামড়াচ্ছে—উঃ জলে মলুম! উঃ-উঃ।’ স্বামীজী আর বুড়ো খোকাদের জন্য কি করতে পারে?
বৎস! আমি বুঝছি, আমাকে গিয়ে তোমাদের মানুষ তৈরী করতে হবে। আমি জানি, ভারতে কেবল নারী ও ক্লীবের বাস। সুতরাং বিরক্ত হয়ো না। ভারতে কাজ করার জন্য উপায় উদ্ভাবন আমাকেই করতে হবে। কতকগুলো মস্তিষ্কহীন ক্লীবের হাতে গিয়ে আমি পড়ছি না।
তোমাদের উদ্বিগ্ন হবার দরকার নেই, তোমরা যতটুকু পার করে যাও, তা যত অল্পই হোক না কেন, একলাই আগাগোড়া সব করে যেতে হবে। কলিকাতার লোকদের এত সঙ্কীর্ণভাব! আর তোমরা মান্দ্রাজীরা কুকুরের ডাকে মূর্ছা যাও! ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ।’—দুর্বল কখনও এই আত্মাকে লাভ করতে পারে না। আমার জন্য তোমাদের ভয় পাবার দরকার নেই, প্রভু আমার সঙ্গে রয়েছেন। তোমরা কেবল আত্মরক্ষা করে যাও; আমাকে দেখাও যে, তোমরা ঐটুকু করতে পার, তা হলেই আমি সন্তুষ্ট। কে আমার সম্বন্ধে কি বলছে, তাই নিয়ে আর আমাকে বিরক্ত করো না। আমার সম্বন্ধে কোন আহাম্মকের সমালোচনা শোনবার জন্য আমি বসে নেই। তোমরা শিশু, [জেনে রাখ] কেবল প্রভূত ধৈর্য, অসীম সাহস ও মহতী চেষ্টা দ্বারাই শ্রেষ্ঠ ফল লাভ হয়ে থাকে। আমার ভয় হচ্ছে, কিডির মন মাঝে মাঝে যেমন ডিগবাজি খায়, সেইরকম ডিগবাজি খাচ্ছে। কোণ থেকে বেরিয়ে এসে কলম ধরুক না। ‘স্বামী, স্বামী’ বলে না চেঁচিয়ে ঐ দুষ্টুদের বিরুদ্ধে কি মান্দ্রাজীরা এখন যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে না, যাতে তারা ‘ত্রাহি ত্রাহি’ চীৎকার করতে থাকে?
তোমরা ভয় পাচ্ছ কিসে? সাহসী লোকেরাই কেবল বড় বড় কাজ করতে পারে—কাপুরুষেরা পারে না। হে অবিশ্বাসিগণ, চিরকালের জন্য জেনে রাখ যে, প্রভু আমায় হাত ধরে নিয়ে চলেছেন। যতদিন আমি পবিত্র থাকব, তাঁর দাস হয়ে থাকব, ততদিন কেউ আমার একটি কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না।
তোমাদের কাগজখানা বার করে ফেল। যে-কোন রকমে হোক, আমি খুব শীঘ্র তোমাদের আরও টাকা পাঠাচ্ছি এবং মাঝে মাঝে টাকা পাঠাতে থাকব। তোমরা কাজ করে চল। দেশবাসীর জন্য কিছু কর—তাহলে তারাও তোমাদের সাহায্য করবে, সমগ্র জাতি তোমার পিছনে থাকবে। সাহসী হও, সাহসী হও! মানুষ একবারই মরে। আমার শিষ্যেরা যেন কখনও কোনমতে কাপুরুষ না হয়।
সদা প্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
১৯৯*
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
৭ জুলাই, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
দেখতে পাচ্ছি—আপনি নিউ ইয়র্ক খুব উপভোগ করছেন, সুতরাং একটি চিঠির দ্বারা আপনার মধুর স্বপ্ন ভাঙবার জন্য ক্ষমা করবেন।
মিস ম্যাকলাউড এবং মিসেস স্টার্জিস-এর কাছ থেকে আমি দুটি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। তাঁরা বার্চগাছের ছালের দুটি সুন্দর খাতা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি সংস্কৃত মূল শ্লোক এবং অনুবাদে সে দুটি ভরিয়ে ফেলে আজকের ডাকে পাঠিয়ে দিলাম।
শুনছি, মিসেস ডোরা৭৫ গূঢ় রহস্যাদিতে বিশ্বাসী ‘মহাত্মা’-পদ্ধতিতে চমকপ্রদ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন।
পার্সি৭৬ ছাড়ার পর থেকে আমি লণ্ডনে যাবার জন্য অপ্রত্যাশিত অনেক জায়গা থেকে আমন্ত্রণ পাচ্ছি এবং আমি বহু আশা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি। লণ্ডনে কাজ করার এই সুযোগ হারাতে চাই না। তাই লণ্ডনের আমন্ত্রণের সঙ্গে আপনার আমন্ত্রণকে আরও কাজ করার দৈব আহ্বান বলেই মনে করি।
আমি পুরো এ মাসটা এখানেই থাকব এবং অগষ্ট মাসের কোন সময়ে কয়েকদিনের জন্য মাত্র চিকাগোয় যেতে হবে।
উদ্বিগ্ন হবেন না, ফাদার লেগেট, এই হল আশান্বিত হবার সর্বোৎকৃষ্ট সময়—যখন ভালবাসায় এত নিশ্চয়তা।
প্রভু আপনাকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন, চিরদিনের জন্য সকল শান্তি লাভ করুন, কারণ আপনি তা লাভ করার খুবই উপযুক্ত।
ভালবাসা এবং স্নেহে চিরদিন আপনার
বিবেকানন্দ
১৯০*
19W, 38th St., নিউ ইয়র্ক
৮ জুলাই, ১৮৯৫
স্নেহের অ্যালবার্টা,৭৭
আমি নিশ্চিত যে, তুমি এখন সম্পূর্ণভাবে তোমার সঙ্গীতশিক্ষায় নিমগ্ন। আশা করি ইতোমধ্যে তুমি স্বরগ্রামের সব কিছুই শিখে নিয়েছ। পরের বারে দেখা হলে তোমার কাছ থেকে স্বরগ্রাম সম্বন্ধে পাঠ গ্রহণ করা আমার খুব আনন্দের বিষয় হবে।
পার্সিতে মিঃ লেগেটের সঙ্গে আমাদের দিনগুলি বেশ আনন্দে কেটেছে—তিনি ঋষিকল্প নন কি?
আমি নিশ্চিত যে, হলিস্টারও (Hollister) জার্মান দেশটা খুব উপভোগ করছে এবং আশা করি তোমরা কেউই জার্মান শব্দ উচ্চারণ করার চেষ্টা করতে গিয়ে জিভ জখম করনি—বিশেষ করে সেই সকল শব্দ, যেগুলির আরম্ভ sch, tz, tsz, এবং অন্য সব মধুর জিনিষ দিয়ে।
জাহাজ থেকে লেখা তোমার চিঠিখানি তোমার মায়ের কাছে পড়েছি। আগামী সেপ্টেম্বরে আমি খুব সম্ভবতঃ ইওরোপ যাচ্ছি। আজ পর্যন্ত ইওরোপে যাইনি। মোটের উপর, সেটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব বেশী ভিন্নরকম হবে না, ইতোমধ্যেই আমি এদেশের আচার-ব্যবহার বেশ রপ্ত করে ফেলেছি।
পার্সিতে নৌকায় বেড়াবার সময় আমি দাঁড় চালানর দু-একটি বিষয় শিখে নিয়েছি। মাসীমা ‘জো জো’-কে তাঁর ‘মধুরতা’র জন্য খেসারত দিতে হয়েছে, কারণ মাছি এবং মশাগুলি মুহূর্তের জন্যও তাঁকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না। পরন্তু আমাকে তারা অনেকখানি জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল; আমার মনে হয় এর কারণ মাছিগুলি ছিল গোঁড়া; তাই একজন পৌত্তলিককে তারা স্পর্শ করেনি। আবার আমার মনে হয়, পার্সিতে আমি খুব গান গাইতাম, সেই ভয়েই তারা পালিয়ে গিয়েছে। আমাদের ভারি সুন্দর সুন্দর বার্চ (birch) বৃক্ষ ছিল। তার ছাল থেকে বই তৈরী করার চিন্তা আমার মনে উদিত হল—যেমন প্রাচীনকালে আমাদের দেশে করা হত; তোমার মা ও মাসীমার জন্য আমি কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক লিখেছি।
অ্যালবার্টা, আমি নিশ্চয়ই জানি—তুমি অচিরেই একজন বিস্ময়কর বিদুষী হতে চলেছ। তোমাদের দুজনের জন্য ভালবাসা এবং আশীর্বাদ।
সতত স্নেহবদ্ধ তোমাদের
বিবেকানন্দ
২০১*
[মিসেস স্টার্জিসকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
জুলাই, ১৮৯৫
মা,
আপনি নিশ্চয় ইতোমধ্যে নিউ ইয়র্কে এসে গিয়েছেন এবং সেখানে এখন গরম মোটেই প্রচণ্ড নয়।
এখানে আমাদের বেশ কাটছে। মেরী লুই (Marie Louise) গতকাল এসে পৌঁছেছেন। সুতরাং এখন পর্যন্ত যাঁরা এসেছেন, সবাইকে মিলিয়ে আমরা ঠিক সাতজন।
পৃথিবীর সব ঘুম যেন আমাতে নেমে এসেছে। আমি দিনে অন্ততঃ দু-ঘণ্টা ঘুমাই এবং সমস্ত রাত্রি জড়পিণ্ডের মত অসাড়ে নিদ্রা যাই। মনে হয়, নিউ ইয়র্কের অনিদ্রার এটি একটি প্রতিক্রিয়া। আমি কিছু কিছু লিখছি ও পড়ছি এবং প্রতিদিন প্রাতঃরাশের পর একটি করে ক্লাস নিচ্ছি। কঠোর নিরামিষবিধিতে আহার প্রস্তুত হচ্ছে, এবং আমি খুব উপোস করছি।
এ স্থান ত্যাগ করবার পূর্বে আমার চর্বি থেকে বেশ কয়েক পাউণ্ড উবে যাবে, এ বিষয়ে আমি দৃঢ়নিশ্চয়। এটা মেথডিষ্টদের জায়গা এবং অগষ্ট মাসে তাদের শিবির-সভা হবে। এটা অত্যন্ত সুন্দর স্থান; শুধু ভয়, জায়গাটা এই ঋতুতে অত্যন্ত জনবহুল হয়ে পড়ে।
মিস ‘জো জো’র মাছির ক্ষত নিশ্চয়ই এতদিনে সম্পূর্ণ সেরে গিয়েছে।—মা কোথায়? পরের বারে আপনি যখন তাঁকে চিঠি লিখবেন, দয়া করে তাঁকে আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানাবেন।
পার্সিতে যে-আনন্দে দিনগুলি কেটেছে, তার দিকে আমি সর্বদাই ফিরে ফিরে তাকাব এবং এই ব্যবস্থার জন্য মিঃ লেগেটকে সর্বদাই ধন্যবাদ জানাব। আমি তাঁর সঙ্গে ইওরোপে যেতে পারব। যখন তাঁর সঙ্গে পরের বারে দেখা হবে, দয়া করে তাঁকে আমার চিরন্তন ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাবেন। তাঁর মত মানুষদের ভালবাসা দ্বারাই জগৎ সর্বদা আরও ভাল হবার দিকে যাচ্ছে।
আপনি কি আপনার বন্ধু মিসেস ডোরার (লম্বা জার্মান নাম) সঙ্গে আছেন? তিনি একজন মহাপ্রাণ, খাঁটি ‘মহাত্মা’। দয়া করে তাঁকে আমার ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানাবেন।
আমি এখন একপ্রকার তন্দ্রাচ্ছন্ন—অলস, আনন্দের ভাব নিয়ে আছি, মন্দ লাগছে না।মেরী লুই নিউ ইয়র্ক থেকে তাঁর পোষা একটি কচ্ছপ নিয়ে এসেছেন। এখন এখানে এসে পোষা প্রাণীটি তার স্বাভাবিক পরিবেশ পেয়েছে। সুতরাং বিপুল অধ্যবসায়ে গড়াতে গড়াতে এবং হামাগুড়ি দিতে দিতে সে মেরী লুই-র ভালবাসা ও আদরকে পেছনে—অনেক পেছনে ফেলে চলে গিয়েছে। প্রথমটায় তিনি কিছুটা দুঃখিত হয়েছিলেন, কিন্তু আমরা এত জোরের সঙ্গে স্বাধীনতার জয়গান করতে লাগলাম যে, তাঁকে অবিলম্বে ফিরে আসতে হল।
ঈশ্বর আপনাকে এবং আপনাদের সকলকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন, এই সতত প্রার্থনা।
বিবেকানন্দ
পুনঃ—‘জো জো’ বার্চগাছের ছালের তৈরী বইটি পাঠায়নি। মিসেস বুলকে আমি যেটি পাঠিয়েছি, সেটি পেয়ে তিনি ভারি আনন্দিত।
ভারত থেকে আমি অনেকগুলি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। সেখানে সব ঠিক চলছে। সাগরপারে বিদেশে অবস্থিত শিশুদের আমাদের ভালবাসা পাঠিয়ে দেবেন।
—বি
২০২*
[খেতড়ির মহারাজকে লিখিত]
আমেরিকা.
৯ জুলাই, ১৮৯৫
… আমার ভারতে ফেরা সম্বন্ধে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এইঃ মহারাজ তো বেশ ভালই জানেন, আমি হচ্ছি দৃঢ় অধ্যবসায়ের মানুষ। আমি এ দেশে একটি বীজ পুঁতেছি, সেটি ইতোমধ্যেই চারা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই এটা বৃক্ষে পরিণত হবে। আমি কয়েকশত অনুগামী শিষ্য পেয়েছি; কতকগুলিকে সন্ন্যাসী করব, তারপর তাদের হাতে কাজের ভার দিয়ে ভারতে চলে যাব। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা আমার বিরুদ্ধে যতই লাগছে, ততই তাদের দেশে একটা স্থায়ী দাগ রেখে যাবার রোক আমার বেড়ে যাচ্ছে। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা … তাদের বিদ্যাবুদ্ধি, কলাকৌশল যতই খাটাক না কেন, প্রতিদিনই বুঝছে, আমাকে চেপে মেরে ফেলা তাদের পক্ষে একটু কঠিন কাজ। ইতোমধ্যে লণ্ডনে আমার কয়েকটি বন্ধু জুটেছে। আমি অগষ্টের শেষে সেখানে যাব মনে করেছি—দেখি, ওদিকে পাদ্রীদের কতটা ঘাঁটাতে পারা যায়। যাই হোক, আগামী শীতের কিছুটা লণ্ডনে ও কিছুটা নিউ ইয়র্কে কাটাতে হবে—তারপরই আমার ভারতে ফেরবার বাধা থাকবে না। যদি প্রভুর কৃপা হয়, তবে এই শীতের পর এখানকার কাজ চালাবার জন্য যথেষ্ট লোক পাওয়া যাবে। প্রত্যেক কাজকেই তিনটি অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়—উপহাস, বিরোধ ও পরিশেষে গ্রহণ। যে-কোন ব্যক্তি তার সময়ে প্রচলিত ভাবরাশি ছাড়িয়ে আরও উচ্চতর তত্ত্ব প্রকাশ করে, তাকে নিশ্চয়ই লোকে ভুল বুঝবে। সুতরাং বাধা ও অত্যাচার আসুক, স্বাগতম। কেবল আমাকে দৃঢ় ও পবিত্র হতে হবে এবং ভগবানে গভীর বিশ্বাস রাখতে হবে, তবেই এ-সব উড়ে যাবে। ইতি
বিবেকানন্দ
২০৩*
[মিসেস স্টার্জিসকে লিখিত]
Thousand Island Park
২৯ জুলাই, ১৮৯৫
মা,
আপনার গৌরবময় সময় এসেছে। আপনি নিশ্চয়ই সুস্থ আছেন।
এখানে বেশ ভালভাবে সময় কাটছে। দু-একজন মহিলা সরাসরি ডেট্রয়েট থেকে এখানে এসেছেন আমাদের সঙ্গে থাকতে। তাঁরা বেশ পবিত্র ও ভাল। আমি থাউজ্যাণ্ড আইল্যাণ্ড থেকে ডেট্রয়েটে এবং সেখান থেকে চিকাগোয় যাচ্ছি।
নিউ ইয়র্কে আমার ক্লাস চলছে। আমার অনুপস্থিতিতেও তারা বেশ সাহসের সঙ্গে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছে। ভাল কথা, ডেট্রয়েট থেকে যে দু-জন মহিলা এসেছেন, তাঁরা ক্লাসে যোগদান করেছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁদের ভূতের ভয়। তাঁদের কে শিখিয়েছে, জ্বলন্ত এলকোহলের শিখায় একটু নুন দিলে কাল তলানি পড়ে, তাহলে সেটা হবে ভূতের অস্তিত্বের প্রমাণ। যা হোক, মহিলা দুটি বেশ ভূতের ভয় পেয়েছিলেন। লোকে বলে, এই রকম ভূত বিশ্বজগতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। পিতা লেগেট আপনার অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই খুব নিরুৎসাহ হয়েছেন। কারণ আজ পর্যন্ত তাঁর কোন চিঠি পাইনি। বেশ, দুঃখ আসে আসুক, বিচলিত না হওয়াই শ্রেয়। কাজেই তা নিয়ে আর মাথা ঘামাচ্ছি না।
জো জো-র সমুদ্রযাত্রা খুবই ভয়ঙ্কর হয়ে থাকবে। শেষ রক্ষাই রক্ষা।
শিশুরা৭৮ জার্মানীতে বেশ আনন্দে আছে, নিশ্চয়। তাদের জাহাজ-ভর্তি ভালবাসা জানাবেন।
এখানকার সকলের ভালবাসা জানবেন। ভবিষ্যৎ বংশধরদের নিকট আপনার জীবন আলোক-বর্তিকার মত হোক—এই কামনা করি।
আপনার পুত্র
তোমাদের বিবেকানন্দ
২০৪*
19W, 38th St., নিউ ইয়র্ক
৩০ জুলাই, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তুমি ঠিক করেছ। নাম আর ‘মটো’ (motto)৭৯ ঠিকই হয়েছে। বাজে সমাজসংস্কার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো না, প্রথমে আধ্যাত্মিক সংস্কার না হলে সমাজসংস্কার হতে পারে না। কে তোমায় বললে, আমি সমাজসংস্কার চাই? আমি তো তা চাই না! ভগবানের নাম প্রচার কর, কুসংস্কার ও সমাজের আবর্জনার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলো না।
‘সন্ন্যাসীর গীতি’৮০ এইটিই তোমাদের কাগজে আমার প্রথম প্রবন্ধ। নিরুৎসাহ হয়ো না—তোমার গুরুতে বিশ্বাস হারিও না—ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিও না। হে বৎস! যতদিন তোমার অন্তরে উৎসাহ এবং গুরু ও ঈশ্বরে বিশ্বাস—এই তিনটি জিনিষ থাকবে, ততদিন কিছুতেই তোমায় দমাতে পারবে না। আমি দিন দিন হৃদয়ে শক্তির বিকাশ অনুভব করছি। হে সাহসী বালকগণ, কাজ করে যাও।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
২০৫*
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]
C/o Miss Dutcher
Thousand Island Park, N.Y.
৩১ জুলাই, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
এর পূর্বে আমি আপনাকে একখানা চিঠি লিখেছিলাম; মনে হচ্ছে, সেটি সাবধানে ডাকে দেওয়া হয়নি, তাই আর একখানা লিখছি।
১৪ তারিখের পূর্বে আমি যথাসময়ে গিয়ে পৌঁছব। ১১ তারিখের পূর্বে যে করেই হোক আমাকে নিউ ইয়র্কে যেতে হবে। সুতরাং প্রস্তুত হবার যথেষ্ট সময় হাতে পাওয়া যাবে।
আমি আপনার সঙ্গে পারি-তে যাব, সঙ্গে যাবার প্রধান উদ্দেশ্য আপনাদের বিবাহ দেখা। আপনারা যখন ভ্রমণে বাহির হবেন, তখন আমি লণ্ডন চলে যাব। ব্যস্।
আপনার এবং আপনাদের সকলের প্রতি আমার চিরস্থায়ী ভালবাসা ও আশীর্বাদের পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।
সতত আপনার পুত্র
বিবেকানন্দ
২০৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
19W. 38th St., নিউ ইয়র্ক
২ অগষ্ট, ১৮৯৫
সুহৃদ্বরেষু,
আপনার প্রীতিপূর্ণ পত্রখানি আজ পাইলাম। আমি জনৈক বন্ধুর সহিত প্রথমে পারি-তে যাইতেছি—১৭ অগষ্ট ইওরোপ যাত্রা করিতেছি। পারি-তে আমার বন্ধুর বিবাহ হওয়া পর্যন্ত (মাত্র এক সপ্তাহ) থাকিব, তারপর লণ্ডনে চলিয়া যাইব।
একটা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তোলা সম্বন্ধে আপনার পরামর্শটি চমৎকার, এবং আমি ঐভাবেই অগ্রসর হইতে চেষ্টা করিতেছি।
এখানে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, তাঁহাদের অধিকাংশই দরিদ্র। সুতরাং কাজও মন্থরগতিতে চলিতে বাধ্য। অধিকন্তু নিউ ইয়র্কে উল্লেখযোগ্য কিছু গড়িয়া তোলার আগে আরও কয়েক মাস খাটিতে হইবে। কাজেই এই শীতের গোড়ায় আমাকে নিউ ইয়র্কে ফিরিয়া আসিতে হইবে, এবং গ্রীষ্মে পুনরায় লণ্ডনে যাইব। এখন যতদূর মনে হইতেছে, তাহাতে এবারে সপ্তাহ-কয়েক মাত্র লণ্ডনে থাকিতে পারিব। কিন্তু ভগবানের কৃপায় হয়তো ঐ অল্প সময়েই গুরুতর বিষয়ের সূচনা হইতে পারে। কবে লণ্ডনে পৌঁছিব, তাহা আপনাকে তার করিয়া জানাইব।
থিওসফিষ্ট সম্প্রদায়ের জনকয়েক আমার নিউ ইয়র্কের ক্লাসে আসিয়াছিলেন। কিন্তু মানুষ যখনই বেদান্তের মহিমা বুঝিতে পারে, তখনই তাহাদের হিজি-বিজি ধারণাগুলি দূর হইয়া যায়।
আমার বরাবরের অভিজ্ঞতা, যখন মানুষ বেদান্তের মহান্ গৌরব উপলব্ধি করিতে পারে, তখন মন্ত্রতন্ত্রাদি আপনা হইতে দূর হইয়া যায়। যে মুহূর্তে মানুষ একটি উচ্চতর সত্যের আভাস পায়, সেই মুহূর্তে নিম্নতর সত্যটি স্বতই অন্তর্হিত হয়। সংখ্যাধিক্যে কিছুই যায় আসে না। বিশৃঙ্খলা জনতা শত বৎসরেও যাহা করিতে পারে না, মুষ্টিমেয় কয়েকটি সরল সঙ্ঘবদ্ধ এবং উৎসাহী যুবক এক বৎসরে তদপেক্ষা অধিক কাজ করিতে পারে। এক বস্তুর উত্তাপ নিকটবর্তী অন্যান্য বস্তুতে সঞ্চারিত হয়—ইহাই প্রকৃতির নিয়ম। সুতরাং যে পর্যন্ত আমাদের মধ্যে সেই জ্বলন্ত অনুরাগ, সত্যনিষ্ঠা, প্রেম ও সরলতা সঞ্জীবিত থাকিবে, ততক্ষণ আমাদের সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্, সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।’—এই সনাতন সত্য আমার বৈচিত্র্যময় জীবনে বহুবার পরীক্ষিত হইয়াছে। যিনি সৎস্বরূপে আপনার অন্তরে বিরাজিত, তিনিই সর্বক্ষণ আপনার অভ্রান্ত পথপ্রদর্শক হউন; অচিরে মুক্তির আলোকে আপনি স্বয়ং উদ্ভাসিত হইয়া অন্যকে মুক্ত হইতে সাহায্য করুন।
বিবেকানন্দ
২০৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
19W, 38th St., নিউ ইয়র্ক
১৮৯৫
অভিন্নহৃদয়েষু,
… মা-ঠাকুরাণীকে আমার বহুত সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানাইবে।
শিব শিব !
এখন আমি নিউ ইয়র্ক শহরে। এ শহর গরমিকালে ঠিক কলকেতার মত গরম, অজস্র ঘাম বয়ে পড়ছে, হাওয়ার লেশ নাই। দুই মাস উত্তর দিকে গিয়েছিলাম, সেথায় বেশ ঠাণ্ডা। এ পত্রপাঠ জবাব লিখিবে। এ পত্র পৌঁছিবার পূর্বে আমি ইংলণ্ডে চলিলাম। ইতি
ঠিকানা: C/o Akshoy C. Ghosh
Muller, Juan Duff House, Regent St.,
Cambridge, England
২০৮*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
19W. 38th St., নিউ ইয়র্ক
৯ অগষ্ট, ১৮৯৫
সুহৃদ্বরেষু
… আমার ব্যক্তিগত মতামতের একটু আভাস দেওয়া দরকার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মানব সমাজে ধর্মের অপূর্ব উচ্ছ্বাস মধ্যে মধ্যে উত্থিত হইয়া থাকে এবং তেমনি এক উচ্ছ্বাস বর্তমানেও শিক্ষিত সমাজের মধ্যে দেখা দিয়েছে। প্রত্যেক উচ্ছ্বাসবেগ আবার বহু ক্ষুদ্র শাখায় বিভক্ত বলিয়া বোধ হইলেও মূলতঃ তাহারা যে একই তত্ত্ব বা তত্ত্বসমষ্টি হইতে উদ্ভূত, তাহাও তাহাদের পরস্পরের সাদৃশ্য হইতে বুঝিতে পারা যায়। বর্তমান সময়ে যে ধর্মভাব দিন দিন চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রের মধ্যেই বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিতেছে, তাহার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, যত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মতবাদ উহা হইতে উদ্ভূত হইতেছে, তাহারা সকলেই সেই এক অদ্বৈত-তত্ত্বের অনুভূতি ও অনুসন্ধানেই সচেষ্ট। জাগতিক, নৈতিক এবং আত্মিক সকল ক্ষেত্রেই এই একটি ভাব দেখা যাইতেছে যে, বিভিন্ন মতবাদসমূহ ক্রমেই উদার হইতে উদারতর হইয়া সেই শাশ্বত অদ্বৈত-তত্ত্বের অভিমুখে অগ্রসর হইতেছে। সুতরাং ধরিয়া লইতে পারা যায় যে, বর্তমান যুগের যত ভাবান্দোলন আছে, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সেগুলি এক অপূর্ব ঐক্যমূলক দর্শন—অদ্বৈত বেদান্তের প্রতিরূপ; আর মানব আজ পর্যন্ত যত প্রকার একত্ববাদের দর্শন আবিষ্কার করিয়াছে, তন্মধ্যে ইহাই সর্বোত্তম। আবার ইহাও সর্বদা দেখা যায় যে, প্রতিযুগে এই সমস্ত বিভিন্ন মতবাদের সংঘর্ষের ফলে শেষ পর্যন্ত একটি মাত্র মতবাদই টিকিয়া যায় এবং অন্য তরঙ্গগুলি উঠে শুধু উহারই অঙ্গে মিশিয়ে গিয়া উহাকে একটি বিপুল ভাবতরঙ্গে পরিণত করিবার জন্য। তখন সেই প্রবল ভাবস্রোত সমাজের উপর দিয়া অপ্রতিহত বেগে বহিয়া যায়।
ভারতবর্ষে, আমেরিকায় ও ইংলণ্ডে অর্থাৎ যাহাদের ইতিহাস আমি অবগত আছি, সেই সব দেশে বর্তমান সময়ে এইরূপ শত শত মতবাদের সংঘর্ষ চলিতেছে। ভারতবর্ষে দ্বৈতবাদ এখন ক্রমেই ক্ষীণ হইতেছে, কেবল অদ্বৈতবাদই সর্বক্ষেত্রে প্রতাপবান। আমেরিকাতেও বহু মতবাদের মধ্যে প্রাধান্যলাভের জন্য সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছে। ইহাদের সবগুলিই অল্পবিস্তর অদ্বৈতভাবের প্রতিরূপ, আর যে ভাবপরম্পরা যত দ্রুত বিস্তার লাভ করিতেছে, সেইগুলি অদ্বৈত বেদান্তের তত বেশী অনুরূপ বলিয়া প্রতীত হইতেছে। আর আমি স্পষ্টই বুঝিতেছি যে, অন্য সবগুলিকে গ্রাস করিয়া ভবিষ্যতে একটি মতবাদ মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবেই। কিন্তু সেটি কোন্টি? ইতিহাসের দৃষ্টিতে দেখিতে গেলে, যে অংশটি যোগ্যতম তাহাই শেষ পর্যন্ত টিকিয়া থাকে। আর নিষ্কলুষ চরিত্রের মত অন্য কোন্ শক্তি মানুষকে যথার্থ যোগ্যতা-দানে সমর্থ? অনাগত ভবিষ্যতে অদ্বৈত বেদান্তই যে চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রের ধর্ম বলিয়া বিবেচিত হইবে, তাহাতে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। আবার সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে তাহারাই জয়লাভ করিবে, যাহার জীবন চরিত্রের চরম উৎকর্ষ দেখাইতে পারিবে; সে সম্প্রদায় কোন্ সুদূর ভবিষ্যতে যে আসিবে, তাহা বিবেচ্য নহে।
আমার নিজ জীবনের একটু অভিজ্ঞতা জানাইতেছি। যখন আমার গুরুদেব দেহত্যাগ করিলেন, তখন আমরা দ্বাদশ জন অজ্ঞাত অখ্যাত কপর্দকহীন যুবক মাত্র ছিলাম। আর বহুসংখ্যক শক্তিশালী সঙ্ঘ আমাদিগকে পিষিয়া ফেলিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিল। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সান্নিধ্যে আমরা এক অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হইয়াছি, কেবল বাক্-সর্বস্ব না হইয়া যথার্থ জীবনযাপনের জন্য একটা ঐকান্তিক ইচ্ছা ও বিরামহীন সাধনার অনুপ্রেরণা তাঁহার নিকট আমরা লাভ করিয়াছিলাম। আর আজ সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁহাকে জানে এবং শ্রদ্ধার সহিত তাঁহার পায়ে মাথা নত করে। তৎপ্রচারিত সত্যসমূহ আজ দাবানলের মত দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে। দশ বৎসর পূর্বে তাঁহার জন্মতিথি-উৎসবে এক শত ব্যক্তিকে একত্র করিতে পারি নাই, আর গত বৎসর পঞ্চাশ হাজার লোক তাঁহার জন্মতিথিতে সমবেত হইয়াছিল।
কেবল সংখ্যাধিক্য দ্বারাই কোন মহৎ কার্য সম্পন্ন হয় না; অর্থ, ক্ষমতা, পাণ্ডিত্য কিম্বা বাক্চাতুরী-ইহাদের কোনটিরই বিশেষ কোন মূল্য নাই। পবিত্র, খাঁটি এবং প্রত্যক্ষানুভূতিসম্পন্ন মহাপ্রাণ ব্যক্তিরাই জগতে সকল কার্য সম্পন্ন করিয়া থাকেন। যদি প্রত্যেক দেশে এইরূপ দশ-বারটি মাত্র সিংহবীর্যসম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন, যাঁহারা নিজেদের সমুদয় মায়াবন্ধন ছিন্ন করিয়াছেন, যাঁহারা অসীমের স্পর্শ লাভ করিয়াছেন, যাঁহাদের সমগ্র চিত্ত ব্রহ্মানুধ্যানে নিমগ্ন, অর্থ যশ ও ক্ষমতার স্পৃহামাত্রহীন—তবে এই কয়েকজন ব্যক্তিই সমগ্র জগৎ তোলপাড় করিয়া দিবার পক্ষে যথেষ্ট।
ইহাই নিগূঢ় রহস্য। যোগপ্রবর্তক পতঞ্জলি বলিয়াছেন, ‘মানুষ যখন সমুদয় অলৌকিক যোগবিভূতির লোভ ত্যাগ করিতে সক্ষম হয়, তখনই তাহার ধর্মমেঘ নামক সমাধি লাভ হয়।’৮১ সে অবস্থায়ই তাঁহার ভগবদ্দর্শন হয়, তিনি ভগবৎস্বরূপে স্থিত হন, এবং অপরকে তদ্রূপ হইতে সাহায্য করেন। শুধু এই বাণী দিকে দিকে প্রচার করিতে চাই। জগতে বহু মতবাদ প্রচারিত হইয়াছে, লক্ষ লক্ষ পুস্তকও লিখিত হইয়াছে; কিন্তু হায়, সামান্যমাত্রও যদি কেহ অনুষ্ঠান করিত!
সমাজ ও সঙ্ঘের কথা বলিতে গেলে বলিতে হয় যে, উহারা আপনা-আপনি গড়িয়া উঠিবে। যেখানে হিংসার কোন বিষয় নাই, সেখানে হিংসা থাকিবে কিরূপে? আমাদের অনিষ্ট সাধন করিতে চায়, এইরূপ অসংখ্য লোক মিলিবে। কিন্তু ইহাতেই কি প্রমাণিত হয় না যে, সত্য আমাদেরই পক্ষে? আমি জীবনে যত বাধা পাইয়াছি, ততই আমার শক্তির স্ফুরণ হইয়াছে। এক টুকরা রুটির জন্য আমি গৃহ হইতে গৃহান্তরে বিতাড়িত হইয়াছি; আবার রাজা-মহারাজগণ কর্তৃকও আমি বহুভাবে পূজিত এবং বহুবার নিমন্ত্রিত হইয়াছি। বিষয়ী লোক এবং পুরোহিতকুল সমভাবে আমার উপর নিন্দাবর্ষণ করিয়াছে। কিন্তু তাহাতে আমার কি আসে যায়? ভগবান্ তাহাদের কল্যাণ করুন, তাহারাও আমার আত্মার সহিত সম্পূর্ণ অভিন্ন। বস্তুতঃ ইহারা সকলে আমাকে স্প্রিং বোর্ডেরই (spring board) মত সাহায্য করিয়াছে—ইহাদের প্রতিঘাতে আমার শক্তি উচ্চ হইতে উচ্চতর বিকাশ লাভ করিয়াছে।
বাক্সর্বস্ব ধর্মপ্রচারক দেখিয়া যে আমার ভয় পাইবার কিছুই নাই, তাহা বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করিয়াছি। সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষগণ কখনও কাহারও শত্রুতা করিতে পারেন না। ‘বচনবাগীশ’রা বক্তৃতা করিতে থাকুক! তদপেক্ষা ভাল কিছু তাহারা জানে না। নাম, যশ ও কামিনী-কাঞ্চন লইয়া তাহারা বিভোর ও মত্ত থাকুক। আর আমরা যেন ধর্মোপলব্ধির, ব্রহ্মলাভের ও ব্রহ্ম হওয়ার জন্যই দৃঢ়ব্রত হই। আমরা যেন মৃত্যু পর্যন্ত এবং জীবনের পর জীবন ব্যাপিয়া সত্যকেই আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকি। অন্যের কথায় আমরা যেন মোটেই কর্ণপাত না করি। সমগ্র জীবনের সাধনার ফলে যদি আমাদের মধ্যে একজনও জগতের কঠিন বন্ধনপাশ ছিন্ন করিয়া মুক্ত হইতে পারে, তবেই আমাদের ব্রত উদ্যাপিত হইল। হরিঃ ওঁ।
আর একটি কথা। ভারতকে আমি সত্য-সত্যই ভালবাসি, কিন্তু প্রতিদিন আমার দৃষ্টি খুলিয়া যাইতেছে। আমাদের দৃষ্টিতে ভারতবর্ষ, ইংলণ্ড কিম্বা আমেরিকা ইত্যাদি আবার কি? ভ্রান্তিবশতঃ লোকে যাহাদিগকে ‘মানুষ’ বলিয়া অভিহিত করে, আমরা সেই ‘নারায়ণের’ই সেবক। যে ব্যক্তি বৃক্ষমূলে জলসেচন করে, সে কি প্রকারান্তরে সমস্ত বৃক্ষটিতেই জলসেচন করে না?
কি সামাজিক, কি রাজনৈতিক, কি আধ্যাত্মিক—সকল ক্ষেত্রেই যথার্থ কল্যাণের ভিত্তি একটিই আছে, সেটি—এইটুকু জানা যে, ‘আমি ও আমার ভাই এক।’ সর্বদেশে সর্বজাতির পক্ষেই এ কথা সমভাবে সত্য। আমি বলিতে চাই, প্রাচ্য অপেক্ষা পাশ্চাত্যই এ তত্ত্ব আরও শীঘ্র ধারণা করিতে পারিবে। কারণ এই চিন্তাসূত্রটির প্রণয়নে এবং মুষ্টিমেয় কয়েকজন অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি উৎপন্ন করিয়াই প্রাচ্যের সমুদয় ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষিত।
আমরা যেন নাম, যশ ও প্রভুত্ব-স্পৃহা বিসর্জন দিয়া কর্মে ব্রতী হই। আমরা যেন কাম, ক্রোধ ও লোভের বন্ধন হইতে মুক্ত হই। তাহা হইলেই আমরা সত্য বস্তু লাভ করিব।
ভগবৎপদাশ্রিত
আপনার বিবেকানন্দ
২০৯*
[মিঃ লেগেটকে লিখিত]
Thousand Island Park, N.Y.
অগষ্ট, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
 … মিঃ স্টার্ডির (যাঁর কথা সেদিন আপনাকে লিখেছি) কাছ থেকে আর একখানা পত্র পেলাম। এখানি আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। দেখুন, সমস্ত কেমন আগে থেকে তৈরী হয়ে আসছে! এখানি ও মিঃ লেগেটের নিমন্ত্রণপত্র একসঙ্গে দেখলে, আপনার কি এটি দৈব আহ্বান বলে মনে হয় না? আমি ঐরূপ মনে করি। সুতরাং ঐ আহ্বান অনুসরণ করছি। অগষ্টের শেষাশেষি মিঃ লেগেটের সঙ্গে আমি পারি যাব এবং সেখানে থেকে লণ্ডন। … হেল-পরিবারের সঙ্গে দেখা করবার জন্য চিকাগো যেতে হবে। সুতরাং গ্রীনএকার সম্মিলনীতে যোগ দিতে পারলাম না।
আমার গুরুভাইদের ও আমার কাজের জন্য আপনি যতটুকু সাহায্য করতে পারেন, কেবল সেইটুকু সাহায্যই আমি এখন চাই। আমি আমার স্বদেশবাসীর প্রতি কর্তব্য কতকটা করেছি। এখন জগতের জন্য—যার কাজ থেকে এই দেহ পেয়েছি, দেশের জন্য—যে দেশ আমাকে ভাব দিয়েছে, মনুষ্যজাতির জন্য—যাদের মধ্যে আমি নিজেকে একজন বলতে পারি, কিছু করব। যতই বয়স বাড়ছে, ততই ‘মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী’ হিন্দুদের এই মতবাদের তাৎপর্য বুঝতে পাচ্ছি। মুসলমানেরাও তাই বলেন। আল্লা দেবদূতগণকে (Angels) বলেছিলেন আদমকে প্রণাম করতে। ইবলিস্ করেনি, তাই সে শয়তান (Satan) হল। এই পৃথিবী যাবতীয় স্বর্গাপেক্ষা উচ্চ—ইহাই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষালয়। আর মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের লোকেরা নিশ্চয়ই আমাদের অপেক্ষা নিম্নশ্রেণীর—তারা যখন আমাদের সঙ্গে সংবাদ আদানপ্রদান করতে পারে না। তথাকথিত উচ্চপ্রাণিগণ পরলোকগত অপর এক দেহধারী ব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়; ঐ দেহ সূক্ষ্ম হলেও বস্তুতঃ হস্তপদাদিবিশিষ্ট মানবদেহই। তারা এই পৃথিবীতে অপর কোন লোকে বাস করে, একেবারে অদৃশ্যও নয়। তারা চিন্তা করে, আমাদের ন্যায় তাদেরও জ্ঞান ও অন্যান্য সব কিছুই আছে—সুতরাং তারাও মানুষ। দেবগণ—এঞ্জেলগণও তাই। কিন্তু কেবল মানুষই ঈশ্বর হয় এবং অন্যান্য সকলে পুনরায় মানবজন্ম গ্রহণ করে তবে ঈশ্বরত্ব লাভ করতে পারে। ম্যাক্সমূলারের শেষ প্রবন্ধটি আপনার কেমন লাগল? ইতি
বিবেকানন্দ
২১০*
আমেরিকা
অগষ্ট, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এই পত্রখানি তোমার কাছে পৌঁছবার পূর্বেই আমি পারিতে উপস্থিত হব। সুতরাং কলিকাতা ও খেতড়িতে লিখে দিও যে, উপস্থিত যেন সেখান থেকে আমেরিকার ঠিকানায় চিঠি না লেখে। তবে আগামী শীতেই আবার নিউ ইয়র্কে ফিরছি। সুতরাং যদি বিশেষ কিছু প্রয়োজনীয় সংবাদ থাকে, তবে নিউ ইয়র্কে 19 W. 38th St. ঠিকানায় পাঠাবে। এ বছর আমি অনেক কাজ করেছি, আসছে বছর আরও অনেক কিছু করবার আশা রাখি। মিশনরীদের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিও না। তারা চেঁচাবে, এ স্বাভাবিক। অন্ন মারা গেলে কে না চেঁচায়? গত দুই বৎসর মিশনরী ফণ্ডে মস্ত ফাঁক পড়েছে, আর সে-ফাঁকটা বেড়েই চলেছে। যাই হোক, আমি মিশনরীদের সম্পূর্ণ সাফল্য কামনা করি। যতদিন তোমাদের ঈশ্বর ও গুরুর ওপর অনুরাগ থাকবে, আর সত্যের ওপর বিশ্বাস থাকবে, ততদিন হে বৎস, কিছুতেই তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু এর মধ্যে একটি গেলেই বিপদ। তুমি বেশ বলেছ, আমার ভাবগুলি ভারত অপেক্ষা পাশ্চাত্য দেশে বেশী পরিমাণে কার্যে পরিণত হতে চলেছে। আর প্রকৃতপক্ষে ভারত আমার জন্য যা করেছে, আমি ভারতের জন্য তার চেয়ে বেশী করেছি। এক টুকরো রুটি ও তার সঙ্গে ঝুড়িখানেক গালাগাল—এই তো সেখানে পেয়েছি। আমি সত্যে বিশ্বাসী; আমি যেখানেই যাই না কেন, প্রভু আমার জন্য দলে দলে কর্মী প্রেরণ করেন। আর তারা ভারতীয় শিষ্যদের মত নয়, তারা গুরুর জন্য জীবন ত্যাগ করতে প্রস্তুত। সত্যই আমার ঈশ্বর—সমগ্র জগৎ আমার দেশ। আমি ‘কর্তব্যে’ বিশ্বাসী নই, ‘কর্তব্য’ হচ্ছে সংসারীর পক্ষে অভিশাপ, সন্ন্যাসীর জন্য নয়। ‘কর্তব্য’ একটা বাজে কথামাত্র। আমি মুক্ত, আমার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে—এই শরীর কোথায় যায় বা না যায়, আমি কি তা গ্রাহ্য করি? তোমরা আমাকে বরাবর ঠিক ঠিক সাহায্য করে এসেছ—প্রভু তোমাদের তার পুরস্কার দেবেন। আমি ভারত বা আমেরিকা থেকে কখনও প্রশংসা চাইনি, আর এখনও ঐরূপ ফাঁকা জিনিষ খুঁজছি না। আমি ভগবানের সন্তান, আমার কাছে একটা সত্য আছে—জগৎকে শেখাবার জন্য। আর যিনি আমাকে ঐ সত্য দিয়েছেন, তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে আমাকে সহকর্মী সব প্রেরণ করবেন। তোমরা—হিন্দুরা কয়েক বছরের ভেতরই দেখবে, প্রভু পাশ্চাত্য দেশে কি কাণ্ড করেন! তোমরা সেই প্রাচীনকালের য়াহুদী জাতির মত—জাব পাত্রে শোয়া কুকুরের মত—নিজেরাও খাবে না, অপরকেও খেতে দেবে না। তোমাদের ধর্মভাব মোটেই নেই; রান্নাঘর হচ্ছে তোমাদের ঈশ্বর, শাস্ত্র—ভাতের হাঁড়ি। আর তোমাদের শক্তির পরিচয়—রাশি রাশি সন্তান-উৎপাদনে। তোমরা কয়েকটি ছেলে খুব সাহসী, কিন্তু কখনও কখনও আমার মনে হয়, তোমরাও বিশ্বাস হারাচ্ছ। বৎসগণ, কামড়ে পড়ে থাক, আমার সন্তানগণের মধ্যে কেউ যেন কাপুরুষ না থাকে। তোমাদের মধ্যে যে সর্বাপেক্ষা সাহসী, সর্বদা তার সঙ্গ করবে। বড় বড় ব্যাপার কি কখনও সহজে নিষ্পন্ন হয়? সময়, ধৈর্য ও অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে কাজ হয়। আমি তোমাদের এখন অনেক কথা বলতে পারতাম, যাতে তোমাদের হৃদয় আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, কিন্তু তা আমি বলব না। আমি লৌহবৎ দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও হৃদয় চাই, যা কিছুতেই কম্পিত হয় না। দৃঢ়ভাবে লেগে থাক। প্রভু তোমাদের আশীর্বাদ করুন।
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
২১১*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
Hotel Continental
3 Rue Castiglione, Paris
২৬ অগষ্ট, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
গত পরশু এখানে এসে পৌঁছেছি। একজন আমেরিকান বন্ধুর অতিথি হয়ে এদেশে এসেছি; আগামী সপ্তাহে এখানে তাঁর বিবাহ হবে।
সে সময় পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমাকে এখানে থাকতে হবে তারপরে লণ্ডন যাবার কোন বাধা থাকবে না ।
আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের আনন্দের জন্য ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছি।
সদা সৎস্বরূপে আপনার
বিবেকানন্দ
২১২*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
C/o Miss MacLeod, Hollande
রু দ্য লা প্যায়্, পারি
৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫
সুহৃদবর,
আপনার অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ অনাবশ্যক; কারণ ভাষায় তা ব্যক্ত হবার নয়।
মিস মূলারের এক প্রীতিপূর্ণ আমন্ত্রণ পেয়েছি। আর তাঁর বাসস্থানও আপনার বাড়ীর কাছে। সুতরাং প্রথমে দু-এক দিন তাঁর ওখানে উঠে তারপর আপনার বাড়ী গেলে বেশ হবে, মনে করছি।
আমার শরীর কয়েকদিন যাবৎ বিশেষ অসুস্থ থাকায় পত্র দিতে বিলম্ব হল। অচিরে মনে প্রাণে আপনার সহিত মিলিত হবার সুযোগের অপেক্ষায় আছি। প্রেম ও ঈশ্বরপ্রীতি সূত্রে আপনার সহিত চির আবদ্ধ—
বিবেকানন্দ
২১৩*
পারি
৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র তোমার ও জি.জি-র পত্র আমেরিকা ঘুরে আমার কাছে পৌঁছল।
তোমরা যে মিশনরীদের বাজে কথাগুলোর ওপর এতটা গুরত্ব আরোপ কর, তাতে আমি আশ্চর্য হচ্ছি। অবশ্য আমি সবই খাই। যদি কলিকাতার লোকেরা চায় যে, আমি হিন্দুখাদ্য ছাড়া আর কিছু না খাই, তবে তাদের বলো, তারা যেন আমায় একজন রাঁধুনী ও তাকে রাখবার উপযুক্ত খরচ পাঠিয়ে দেয়। এক কানাকড়ি সাহায্য করবার মুরদ নেই, এদিকে গায়ে পড়ে উপদেশ ঝাড়া—এতে আমার হাসিই পায়।
অপরদিকে যদি মিশনরীরা বলে, আমি সন্ন্যাসীর কামিনী-কাঞ্চন-ত্যাগ-রূপ প্রথম দুই ব্রত কখনও ভঙ্গ করেছি, তবে তাদের বলো যে, তারা মস্ত মিথ্যাবাদী। মিশনরী হিউমকে পরিষ্কাররূপে লিখে জিজ্ঞাসা করবে, তিনি যেন তোমায় লেখেন—তিনি আমার কি কি অসদাচরণ দেখেছিলেন, অথবা তিনি যাদের কাছে শুনেছেন, তাদের নাম যেন তোমায় দেন এবং জানতে চাইবে—তিনি স্বচক্ষে তা দেখেছিলেন কিনা। এইরূপ করলেই প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে, আর তাদের দুষ্টামি ধরা পড়ে যাবে। ডাঃ জেন্স্ ঐ মিথ্যাবাদীদের এইরূপে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
আমার সম্বন্ধে এইটুকু জেনে রেখো, কারও কথায় আমি চলব না। আমার জীবনের ব্রত কি, তা আমি জানি, আর কোন জাতিবিশেষের ওপর আমার তীব্র বিদ্বেষ নেই। আমি যেমন ভারতের, তেমনি সমগ্র জগতের। এ বিষয় নিয়ে বাজে যা-তা বকলে চলবে না, আমি যতটা পারি তোমাদের সাহায্য করেছি—এখন তোমরা নিজেদের সামলাও। কোন্ দেশের আমার উপর বিশেষ দাবী আছে? আমি জাতিবিশেষের ক্রীতদাস না কি? অবিশ্বাসী নাস্তিকগণ, তোমরা আর বাজে বকো না।
আমি এখানে কঠোর পরিশ্রম করেছি—আর যা কিছু টাকা পেয়েছি, সব কলিকাতা ও মান্দ্রাজে পাঠিয়েছি। এখন এত করবার পর তাদের আহাম্মকের মত হুকুমে আমাকে চলতে হবে! তোমরা কি লজ্জিত হচ্ছ না? আমি হিন্দুদের কি ধার ধারি? আমি কি তাদের প্রশংসার এতটুকু তোয়াক্কা রাখি, না—তাদের নিন্দার ভয় করি? বৎস, আমি অসাধারণ প্রকৃতির লোক, তোমরা পর্যন্ত এখনও আমায় বুঝতে পারলে না। তোমাদের কাজ তোমরা করে যাও; তা যদি না পার তো চুপ করে থাক। আমাকে দিয়ে তোমাদের মনোমত কাজ করাবার চেষ্টা করো না। আমার পেছনে এমন একটা শক্তি দেখছি, যা মানুষ দেবতা বা শয়তানের শক্তির চেয়ে অনেকগুণ বড়। কারও সাহায্য চাই না। আমিই তো সারাজীবন অপরকে সাহায্য করে আসছি। আমাকে সাহায্য করেছে, এমন লোক তো আমি এখনও দেখতে পাইনি। বাঙালীরা—তাদের দেশে যত মানুষ জন্মেছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাজে সাহায্যের জন্য কটা টাকা তুলতে পারে না, এদিকে ক্রমাগত বাজে বকছে; আর যার জন্যে তারা কিছুই করেনি, বরং যে তাদের জন্য যথাসাধ্য করেছে, তারই ওপর হুকুম চালাতে চায়! জগৎ এইরূপ অকৃতজ্ঞই বটে!! তোমরা কি বলতে চাও, তোমরা যাদের শিক্ষিত হিন্দু বলে থাক, সেই জাতিভেদচক্রে নিষ্পিষ্ট, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, দয়ালেশশূন্য, কপট, নাস্তিক, কাপুরুষদের মধ্যে একজন হয়ে জীবনধারণ করবার ও মরবার জন্য আমি জন্মেছি? আমি কাপুরুষতাকে ঘৃণা করি। আমি কাপুরুষদের সঙ্গে এবং রাজনৈতিক আহাম্মকির সঙ্গে কোন সংস্রব রাখতে চাই না। আমি কোন প্রকার রাজনীতিতে (Politics) বিশ্বাসী নই। ঈশ্বর ও সত্যই জগতে একমাত্র রাজনীতি, আর সব বাজে।
কাল লণ্ডনে যাচ্ছি। উপস্থিত সেখানে আমার ঠিকানা হবেঃ
C/o ই.টি.স্টার্ডি; হাইভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং, ইংলণ্ড
সদা আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুঃ—আমি ইংলণ্ড ও আমেরিকা উভয়ত্রই কাগজ বার করব, মনে করছি। সুতরাং কাগজের জন্য তোমরা সম্পূর্ণরূপে আমার ওপর নির্ভর কর, তাহলে চলবে না। তোমাদের ছাড়াও আমার অনেক জিনিষ আছে দেখবার।
বি
২১৪
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
হাইভিউ, কেভার্শ্যাম,
রিডিং, ইংলণ্ড ১৮৯৫
প্রেমাস্পদেষু,
ইতঃপূর্বে পত্র পাইয়া থাকিবে। এক্ষণে ইংলণ্ডে আমার যাবতীয় পত্রাদি উপরিউক্ত ঠিকানায় পাঠাইবে। মিঃ স্টার্ডি তারকদাদার পরিচিত। তিনি আমাকে এখানে আনাইয়াছেন এবং আমরা উভয়ে একত্রে ইংলণ্ডে হাঙ্গাম করিবার চেষ্টায় আছি। এবার আমি নভেম্বর মাসে পুনরায় আমেরিকা যাত্রা করিব, অতএব এখানে একজন উত্তম সংস্কৃত ও ইংরেজী, বিশেষতঃ ইংরেজী-জানা লোকের আবশ্যক—শরৎ বা তুমি বা সারদা। তাহার মধ্যে তোমার শরীর যদি একদম আরোগ্য হইয়া থাকে তো বড়ই ভাল। তুমি আসিবে, নতুবা শরৎকে পাঠাইবে। কাজ এই যে, আমি যে-সকল চেলা-পত্র এখানে রাখিয়া যাইব, তাহাদের শিক্ষা দেওয়া ও বেদান্তাদি পড়ান এবং একটু-আধটু ইংরেজীতে তর্জমা করা, মধ্যে মধ্যে লেকচার-পত্র দেওয়া। ‘কর্মণা বাধ্যতে বুদ্ধিঃ।’—র আসিবার বড়ই ইচ্ছা, কিন্তু গোড়া শক্ত করে না গাঁথিলে ফাঁস হইয়া যাইবে। এই পত্রে এক চেক পাঠাইলাম, তাহাতে কাপড়-চোপড় কিনিবে (অর্থাৎ যে আসিবে)। চেক মহেন্দ্রবাবু—মাষ্টার মহাশয়ের নামে পাঠাইলাম। গঙ্গাধরের টিবেটি চোগা মঠে আছে; ঐ ঢঙের এক চোগা গেরুয়া রঙের বানাইয়া লইবে। Collar (কলার)-টা যেন কিছু উপরে হয়, অর্থাৎ গলা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে। … সকলের আগে একটা খুব গরম ওভারকোট; শীত বড়ই প্রবল। জাহাজের উপর ওভারকোট খুব গরম ...। সেকেণ্ড ক্লাসের টিকেট পাঠাইতেছি; অর্থাৎ ফার্ষ্ট ক্লাস সেকেণ্ড ক্লাসে বড় বিশেষ পার্থক্য নাই। … যদি শশীর আসা স্থির হয়, তাহা হইলে পূর্ব হইতে নিরামিষ খাওয়ার বন্দোবস্ত করিয়া লইবে।
বোম্বে যাইয়া মেসার্স কিং কিং এণ্ড কোং, ফোর্ট, বোম্বে অফিসে যাইয়া বলিবে যে, ‘আমি স্টার্ডি সাহেবের লোক’—তাহা হইলে তাহারা তোমাকে এক টিকেট দিবে ইংলণ্ড পর্যন্ত। এখান হইতে এক চিঠি উক্ত কোম্পানীর উপর যাইতেছে। খেতড়ির রাজাকে এক চিঠি লিখিতেছি যে, তাঁহার বোম্বের এজেণ্ট যেন তোমাকে দেখিয়া শুনিয়া book (বুক) করিয়া দেয়। যদি এই ১৫০ টাকায় কাপড়-চোপড় না হয়, রাখাল যেন তোমায় বাকী টাকা দেয়; আমি পরে তাহাকে পাঠাইয়া দিব। তাছাড়া ৫০ টাকা হাত খরচের জন্য রাখিবে—রাখালকে দিতে বলিবে। তারপর আমি পাঠাইয়া দিব। চুনীবাবুর জন্য যে টাকা পাঠাইয়াছি, তাহার খবর আজও পাই নাই। পত্রপাঠ চলিয়া আসিবে। মহেন্দ্রবাবুকে বলিবে, তিনি আমার কলিকাতার এজেণ্ট। তিনি যেন পত্রপাঠ মিঃ স্টার্ডিকে এক চিঠি লিখেন যে, যা কিছু কলিকাতা সম্বন্ধে লেখা পড়া business (বৈষয়িক কার্য) ইত্যাদি আমাদের করিতে হইবে, তাহা তিনি করিতে রাজী আছেন। অর্থাৎ মিঃ স্টার্ডি আমার ইংলণ্ডের সেক্রেটারী, মহেন্দ্র- বাবু কলিকাতার, আলাসিঙ্গা মান্দ্রাজের ইত্যাদি ইত্যাদি। মান্দ্রাজে এ খবর পাঠাইবে। সকলে উঠিয়া পড়িয়া না লাগিলে কি কাজ হয়? ‘উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মীঃ’ (উদ্যোগী পুরুষসিংহেরই লক্ষ্মী লাভ হয়) ইত্যাদি। পেছু দেখিতে হইবে না—forward (এগিয়ে চল)। অনন্ত বীর্য, অনন্ত উৎসাহ, অনন্ত সাহস ও অনন্ত ধৈর্য চাই, তবে মহাকার্য সাধন হইবে। দুনিয়ায় আগুন লাগাইয়ে দিতে হইবে।
আর যে দিন ষ্টীমার ঠিক হইবে, তৎক্ষণাৎ মিঃ স্টার্ডিকে এক পত্র লিখিবে যে, ‘অমুক ষ্টীমারে আমি আসিতেছি।’ নতুবা লণ্ডনে পৌঁছিয়া গোলমাল হইয়া না যাও। যে ষ্টীমার একদম লণ্ডন যায়, তাহাই লইবে; কারণ তাহাতে যদিও দু-চারি দিন অধিক লাগে, পরন্তু ভাড়া কম লাগে। এক্ষণে আমাদের অধিক পয়সা তো নাই। কালে দলে দলে চতুর্দিকে পাঠাইব। কিমধিকমিতি।
বিবেকানন্দ
পুঃ—পত্রপাঠ খেতড়ির রাজাকে লিখিবে যে, তুমি বোম্বে যাইতেছ ইত্যাদি, এবং তাঁহার লোক যেন তোমায় জাহাজে চড়াইয়া দেয়।
বি
এই ঠিকানা একটা পকেট বুকে লিখিয়া সঙ্গে রাখিবে—গোল না হয়।
২১৫
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
রিডিং, ইংলণ্ড
১৮৯৫
কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। তোমার সঙ্কল্প বড়ই উত্তম। কিন্তু তোমাদের জাতির মধ্যে Organization (সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া কার্য করিবার) শক্তির একেবারেই অভাব। ঐ এক অভাবই সকল অনর্থের কারণ। পাঁচজনে মিলে একটা কাজ করিতে একেবারেই নারাজ। Organization—এর (সঙ্ঘজীবনের) প্রথম আবশ্যক এই যে, obedience (আজ্ঞাবহতা), যখন ইচ্ছা হল একটু কিছু করিলাম, তারপর ঘোড়ার ডিম—তাতে কাজ হয় না—plodding industry and perseverance (স্থির ধীর ভাবে পরিশ্রম ও অধ্যবসায়) চাই। Regular correspondence (নিয়মিত পত্রব্যবহার) অর্থাৎ কি কাজ করছ—কি ফল হল, প্রতিমাসে বা মাসে দুইবার রীতিমত লিখিয়া পাঠাইবে। একজন উত্তম ইংরেজী ও সংস্কৃত-জানা সন্ন্যাসী এখানে (ইংলণ্ডে) আবশ্যক। আমি এখান হইতে শীঘ্রই পুনরায় আমেরিকা যাইব, আমার অবর্তমানে সে এখানে কার্য করিবে। শরৎ ও শশী এই দুইজন ছাড়া আমি তো আর কাকেও দেখছি না। শরৎকে টাকা পাঠিয়েছি ও পত্রপাঠ চলে আসতে লিখেছি। রাজাজীকে৮২ লিখেছি যে, তাঁর বোম্বের agent (ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী) যেন শরৎকে দেখে শুনে জাহাজে চাপিয়ে দেয়। আমি লিখতে ভুলে গেছি, তুমি যদি মনে করে পার—শরতের সঙ্গে এক বস্তা মুগের ডাল, ছোলার ডাল, অড়র ডাল ও কিঞ্চিৎ মেথি পাঠিয়ে দিবে।৮৩ পণ্ডিত নারায়ণ দাস, শ্রীশঙ্করলাল, ওঝাজী, ডাক্তার ও সকলকে আমার প্রণয় বলিবে। গোপীর চোখের ওষুধ এখানে কি আছে? পেটেণ্ট ওষুধ সব জুয়াচুরি সর্বত্র। তাকে আমার আশীর্বাদ দেবে ও আর আর সব চেলাগুলোকে। যজ্ঞেশ্বরবাবু মীরাটে একটা কি সভা করেছেন ও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজ করতে চান। ভাল, তাঁর একটা কি কাগজও আছে, কালীকে সেখানে পাঠিয়ে দাও, কালী যদি পারে মীরাটে একটা centre (কেন্দ্র) করুক এবং সেই কাগজটা যাতে হিন্দী ভাষাতে হয়, এমন চেষ্টা করুক—আমি কিছু কিছু টাকা পাঠিয়ে দেব। কালী মীরাট গিয়ে আমাকে যথাযথ রিপোর্ট করলে আমি টাকা পাঠিয়ে দেব। আজমীরে একটা centre (কেন্দ্র) করবার চেষ্টা কর। … সাহারানপুরে পণ্ডিত অগ্নিহোত্রী কি একটা সভা করেছেন। তাঁরা আমাকে এক চিঠি লেখেন। তাঁদের সঙ্গে correspondence (পত্রব্যবহার) রাখিবে। সকলের সঙ্গে মেলামেশা etc., work, work (কাজ কাজ)। এই রকম centre (কেন্দ্র) করতে থাক। কলিকাতায়—মান্দ্রাজে already (পূর্ব হইতেই) আছে, যদি মীরাটে ও আজমীরে পার তো বড়ই ভাল হয়। ঐপ্রকার ধীরে ধীরে জায়গায় জায়গায় centre (কেন্দ্র) করতে থাক। এখানে আমার সকল চিঠিপত্র C/o মিঃ ই. টি. স্টার্ডি, হাইভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং, ইংলণ্ড। আমেরিকায় C/o মিস ফিলিপ্স্ 19 W. 38th St., নিউ ইয়র্ক। ক্রমে দুনিয়া ছাপিয়ে ফেলতে হবে। Obedience (আজ্ঞাবহতা) প্রথম দরকার। আগুনে ঝাঁপ দিতে তৈয়ার হতে হবে—তবে কাজ হয়। … ঐ-রকম রাজপুতানায় গ্রামে গ্রামে সভা কর etc. কিমধিকমিতি—
বিবেকানন্দ
২১৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy, রিডিং,
ইংলণ্ড
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
মিঃ স্টার্ডি এবং আমি ইংলণ্ডে সমিতি গঠন করিবার জন্য অন্ততঃ দুই-চার জন সেরা দৃঢ়চেতা ও মেধাবী লোক চাই, অতএব আমাদিগকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে হইবে। আমাদিগকে প্রথম হইতে সতর্ক হইতে হইবে—যাহাতে কতকগুলি ‘খেয়ালী’ লোকের পাল্লায় না পড়ি। আপনি বোধ হয় জানেন, আমেরিকাতেও আমার উদ্দেশ্য এইরূপ ছিল। মিঃ স্টার্ডি কিছুদিন ভারতবর্ষে আমাদের সন্ন্যাসীদের সহিত তাহাদের রীতিনীতি মানিয়া বাস করিয়াছিলেন। তিনি একজন শিক্ষিত, সংস্কৃত ভাষায় অভিজ্ঞ এবং অতীব উদ্যমশীল লোক। এ পর্যন্ত উত্তম।
পবিত্রতা, অধ্যবসায় এবং উদ্যম—এই তিনটি গুণ আমি একসঙ্গে চাই। যদি এইরূপ ছয়জন লোক এখানে পাই, আমার কাজ চলিতে থাকিবে। এইরূপ দুই-চারজন লোক পাইবার সম্ভাবনা আছে। ইতি—
বিবেকানন্দ
২১৭*
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy, রিডিং, ইংলণ্ড
সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় জো জো,
তোমাকে শীঘ্র চিঠি না দেওয়ার জন্য সহস্র ক্ষমা চাইছি। লণ্ডনে নির্বিঘ্নে পৌঁছেছি। বন্ধুর সন্ধান পেয়েছি, তাঁর বাড়ীতে বেশ আছি। চমৎকার পরিবার। স্ত্রীটি তাঁর বাস্তবিকই দেবীতুল্য, আর তিনি নিজে যথার্থ ভারতপ্রেমিক। সাধুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে তাঁদেরই মত খেয়ে-দেয়ে তিনি ভারতে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। কাজেই তাঁর এখানে আমি খুব আনন্দে আছি। এর মধ্যেই ভারত থেকে ফেরা অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন উচ্চপদস্থ সৈনিককে দেখলাম; তাঁরা আমার সঙ্গে বেশ ভদ্র ব্যবহার করলেন। ‘শ্যামবর্ণ ব্যক্তিমাত্রই নিগ্রো’—আমেরিকানদের এই অদ্ভুত ধারণা এখানে মোটেই দেখা যায় না। রাস্তায় কেউ আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়েও থাকে না। ভারতের বাহিরে আর কোথাও এরূপ সুস্থির বোধ করিনি। ইংরেজরা আমাদের বোঝে, আমরাও তাদের বুঝি। এদেশের শিক্ষা, সভ্যতা বেশ উচ্চ স্তরের; সেজন্য এবং বহুদিনের শিক্ষার ফলে এতটা পার্থক্য।
টার্টল-ডাভেরা ফিরেছেন কি? তাঁদের ও তাঁদের স্বজনের উপর ভগবানের কৃপা সদা বর্ষিত হোক। ‘বেবী’রা কেমন আছে? আর এলবার্টা ও হলিস্টার? তাদের আমার অজস্র ভালবাসা জানাবে এবং তুমি নিজে জানবে।
বন্ধুটি সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত। সুতরাং শঙ্কর প্রভৃতি আচার্যদের ভাষ্যপাঠে আমরা সর্বদা নিযুক্ত আছি। এখানে এখন কেবল ধর্ম ও দর্শন চলেছে, জো জো! অক্টোবর মাসে লণ্ডনে ক্লাস নেবার চেষ্টায় আছি।
চির প্রীতি-স্নেহ-শুভেচ্ছা
সহ
বিবেকানন্দ
২১৮*
রিডিং, ইংলণ্ড
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
মিঃ স্টার্ডিকে সংস্কৃত শিখতে সাহায্য করা ছাড়া এ পর্যন্ত আমি উল্লেখযোগ্য কোন কাজই করিনি। ভারতবর্ষ থেকে আমার গুরুভ্রাতাদের মধ্যে একজন সন্ন্যাসীকে আনবার জন্য তিনি আমায় বলেছেন। আমি আমেরিকায় চলে গেলে সেই সন্ন্যাসী তাঁকে সাহায্য করতে পারেন, আমি ভারতবর্ষে লিখেছি একজনের জন্য। এ পর্যন্ত সব ভালভাবেই চলছে। এখন পরবর্তী ঢেউয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। ‘এড়িয়ে যেও না, খুঁজেও বেড়িও না; ভগবান্ যা পাঠান, তার জন্য অপেক্ষা কর’—এই আমার মূলমন্ত্র। আমি চিঠি খুব কম লিখি বটে, কিন্তু আমার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ। ইতি—
বিবেকানন্দ
২১৯*
রিডিং, ইংলণ্ড
৪ অক্টোবর, ১৮৯৫
স্নেহের মার্গারেট,৮৪
… পবিত্রতা, ধৈর্য ও অধ্যবসায় দ্বারা সকল বিঘ্ন দূর হয়। সব বড় বড় ব্যাপার অবশ্য ধীরে ধীরে হয়ে থাকে। … আমার ভালবাসা জানবে। ইতি—
বিবেকানন্দ
২২০
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
রিডিং
৪ অক্টোবর, ১৮৯৫
অভিন্নহৃদয়েষু,
তুমি অবগত আছ যে, আমি এক্ষণে ইংলণ্ডে। প্রায় এক মাস যাবৎ এস্থানে থাকিয়া পুনঃ আমেরিকা যাত্রা করিব। আগামী গ্রীষ্মকালে পুনঃ ইংলণ্ডে আসিব। এক্ষণে ইংলণ্ডে বিশেষ কিছু হইবার আশা নাই, তবে প্রভু সর্বশক্তিমান্। ধীরে ধীরে দেখা যাউক।
ইতঃপূর্বে শরৎকে আসিবার টাকা পাঠাইয়াছি ও পত্র লিখিয়াছি। শরৎ বা শশী দুইজনের একজন যাহাতে আইসে তাহা করিবে। শশীর রোগ যদি সম্পূর্ণ আরোগ্য হইয়া থাকে, অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে পাঠাইবে। চর্মরোগ শীতপ্রধান দেশে বড় প্রবল হইতে পারে না—উহা এই দারুণ শীতে একদম সারিয়া যাইতে পারে। নতুবা শরৎকে। … Sturdy (স্টার্ডি) সাহেবের টাকা, সে যে-প্রকার লোক চায়, সেই প্রকার আনাইতে হইবে। উক্ত মিঃ স্টার্ডি আমার নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিয়াছে এবং বড়ই উদ্যমী ও সজ্জন। থিওসফির হাঙ্গামায় পড়িয়া বৃথা সময় নষ্ট করিয়াছে বলিয়া বড়ই আপসোস।
প্রথমতঃ এরূপ লোক চাই, যাহার ইংরেজী এবং সংস্কৃতে বিশেষ বোধ। ‘—’ শীঘ্র ইংরেজী শিখিতে পারিবেন এস্থানে আসিলে, সত্য বটে, কিন্তু এদেশে শিখিতে লোক এখনও আনিতে পারি না; যাহারা শিখাইতে পারিবে, তাহাদের প্রথম চাই। দ্বিতীয় কথা এই যে, যাহারা সম্পদে বিপদে আমায় ত্যাগ করিবে না, তাহাদের আমি বিশ্বাস করি। … অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক চাই, তারপর গোড়াপত্তন হয়ে গেলে যার ইচ্ছা গোলমাল কর, ভয় নাই।
… দাদা, না হয় রামকৃষ্ণ পরমহংস একটা মিছে বস্তুই ছিল, না হয় তাঁর আশ্রিত হওয়া একটা বড় ভুল কর্মই হয়েছে, কিন্তু এখন উপায় কি? একটা জন্ম না হয় বাজেই গেল; মরদের বাত কি ফেরে? দশ স্বামী কি হয়? তোমরা যে যার দলে যাও, আমার কোন আপত্তি নাই, কিছুমাত্রও নাই, তবে এ দুনিয়া ঘুরে দেখছি যে, তাঁর ঘর ছাড়া আর সকল ঘরেই ‘ভাবের ঘরে চুরি’। তাঁর জনের উপর আমার একান্ত ভালবাসা, একান্ত বিশ্বাস। কি করিব? একঘেয়ে বল বলবে, কিন্তু ঐটি আমার আসল কথা। যে তাঁকে আত্মসমর্পণ করেছে, তার পায়ে কাঁটা বিঁধলে আমার হাড়ে লাগে, অন্য সকলকে আমি ভালবাসি। আমার মত অসাম্প্রদায়িক জগতে বিরল, কিন্তু ঐটুকু আমার গোঁড়ামি, মাফ করবে। তাঁর দোহাই ছাড়া কার দোহাই দেব? আসছে জন্মে না হয় বড় গুরু দেখা যাবে, এ জন্ম এ শরীর সেই মূর্খ বামুন কিনে নিয়েছে।
পেটের কথা খুলে বললুম দাদা, রাগ করো না। আমি তোমাদের গোলাম, যতক্ষণ তোমরা তাঁর গোলাম—এক চুল তার বাইরে গেলে তোমরা আর আমি এক সমান। … সমাজ-ফমাজ যত দেখছ দেশ-বিদেশে, সব যে তিনি গিলে রেখেছেন দাদা—‘ময়ৈবৈত নিহতাঃ পূর্বমেব নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্।’ আজ বা কাল ও-সব তোমাদের অঙ্গে মিশিয়ে যাবে যে। হায় রে অল্প বিশ্বাস! তাঁর কৃপায় ‘ব্রহ্মাণ্ডং গোষ্পদায়তে।’ নিমকহারাম হয়ো না, ও পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই। নাম যশ সুকাজ—যজ্জুহোসি যত্তপস্যাসি যদশ্নাসি &c. (ইত্যাদি) সব তাঁর পায়ে সঁপে দাও। আমাদের আর কি চাই? তিনি শরণ দিয়েছেন, আবার কি চাই? ভক্তি নিজেই যে ফলস্বরূপা—আবার চাই কি? হে ভাই, যিনি খাইয়ে পরিয়ে বুদ্ধি বিদ্যে দিয়ে মানুষ করলেন, যিনি আত্মার চক্ষু খুলে দিলেন, যাঁকে দিনরাত দেখলে যে জীবন্ত ঈশ্বর, যাঁর পবিত্রতা আর প্রেম আর ঐশ্বর্য রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশু, চৈতন্য প্রভৃতিতে এক কণা মাত্র প্রকাশ, তাঁর কাছে নিমকহারামি!!! তোর বুদ্ধ, কৃষ্ণ প্রভৃতি তিন ভাগ গল্প বৈ তো নয়, … অমন ঠাকুরের দয়া ভোল! … কেষ্ট, যীশু জন্মেছিলেন কিনা, তার কোনই প্রমাণ নাই; আর সাক্ষাৎ ঠাকুরকে দেখেও তোদের মাঝে মাঝে মতিভ্রম হয়! ধিক্ তোদের জীবনে!! আর আমি কি বলিব? দেশে দেশে নাস্তিক পাষণ্ডে তাঁর ছবি পূজা করছে, আর তোদের মতিভ্রম হয় সময়ে সময়ে!!! তোদের মত লাখ লাখ তিনি নিঃশ্বাসে তৈরী করে নেবেন। তোদের জন্ম ধন্য, কুল ধন্য, দেশ ধন্য যে, তাঁর পায়ের ধূলা পেয়েছিস। আমি কি করিব, আমাকে কাজেই গোঁড়া হতে হচ্ছে। আমি যে তাঁর জন ছাড়া আর কোথাও পবিত্রতা ও নিঃস্বার্থতা দেখতে পাই না। সকল জায়গাতেই যে ভাবের ঘরে চুরি, কেবল তাঁর ঘর ছাড়া। তিনি যে রক্ষে করছেন, দেখতে পাচ্ছি যে। ওরে পাগল, পরীর মত মেয়ে সব, লাখ লাখ টাকা—-এ সকল তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে, এ কি আমার জোরে? না, তিনি রক্ষা করছেন? তাঁর জন ছাড়া যে আমি কাউকেই একটা টাকা, একটা মেয়ে মানুষের কাছে বিশ্বাস করিনে। যার তাঁকে বিশ্বাস নাই আর মা-ঠাকুরাণীতে ভক্তি নাই, তার ঘোড়ার ডিমও হবে না, সাদা বাঙলা বললুম, মনে রেখো।
… হরমোহন দুরবস্থা জানিয়েছেন এবং শীঘ্রই স্থান-ছাড়া হতে হবে বলছেন। লেকচার চেয়েছেন—লেকচার-ফেকচার এখন কিছু নাই, তবে কিছু টাকা এখনও গাঁটে আছে—তাঁকে পাঠিয়ে দেব, ভয় নাই। পত্রপাঠ পাঠিয়ে দিতাম, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে যে, আমার টাকা মারা গেছে—সেজন্যই পাঠাই নাই। দ্বিতীয়তঃ কোন্ ঠিকানায় পাঠাব, তা তো জানি না। মান্দ্রাজীরা দেখছি, কাগজ বার করতে পারলে না। বিষয়বুদ্ধি হিন্দুজাতির যে একেবারেই নাই। যে সময়ে যে কাজ প্রতিশ্রুত হও, ঠিক সেই সময়ে তা করা চাই, নতুবা লোকের বিশ্বাস চলে যায়। টাকাকড়ির কথা পত্রপাঠ জবাব দিতে হয়। … মাষ্টার মশায় যদি রাজী হন, তাহলে তাঁকে কলকেতার এজেণ্ট হতে বলবে, কারণ তাঁর উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস এবং তিনি এই সকল বিষয় অনেক বুঝেন, ছেলেমানুষি হুড়দঙ্গুলের কাজ নয়। একটা Centre (কেন্দ্র)—ঠিকানা তাঁকে করতে বলবে, যে ঠিকানা—ঘড়ি-ঘড়ি বদলাবে না ও যে ঠিকানায় আমি কলকেতার সমস্ত চিঠিপত্র পাঠিয়ে দেব। ...
কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
২২১*
রিডিং, ইংলণ্ড
অক্টোবর, ১৮৯৫
প্রিয় জো জো,
তোমার পত্র পেয়ে বড়ই সুখী হলাম। মনে হয়েছিল, বুঝি বা আমায় ভুলে গেলে। লণ্ডনে ও লণ্ডনের কাছেপিঠে কয়েকটি বক্তৃতা দেব; ২২ তারিখে সাড়ে আটটার সময় প্রিন্সেস হলে দেব সাধারণের জন্য একটি।
এখানে চলে এসে একটা ক্লাস গড়ে ফেল না। বলতে গেলে এখানে এখনও কিছুই করে উঠতে পারিনি। কাজ ঠিকমত চালু করতে বেশ সময় লাগে। আমেরিকায় নিউ ইয়র্কে সামান্য যা হয়েছে তাতেই আমার দুই বৎসর লেগে গেল। সকলকে ভালবাসা জানাচ্ছি।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
২২২*
রিডিং
৬ অক্টোবর, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,,
… আমি মিঃ স্টার্ডির সহিত ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে একখানি পুস্তকের অনুবাদ করিতেছি, প্রচুর টীকা সমেত উহা শীঘ্রই প্রকাশিত হইবে। এই মাসে আমাকে লণ্ডনে দুইটি এবং মেডেন-হেডে একটি বক্তৃতা দিতে হইবে। ইহাতে কতকগুলি ক্লাস খুলিবার ও পারিবারিক বক্তৃতার বন্দোবস্ত হইবার সুবিধা হইবে। কতকগুলি হইচই না করিয়া চুপচাপ কাজ করিতে চাই। … আমার শুভেচ্ছাদি জানিবেন।
আপনার
বিবেকানন্দ
২২৩*
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy, Esq.
হাই ভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং ইংলণ্ড
অক্টোবর, ১৮৯৫
মা,
ছেলেকে ভোলেননি তো? আপনি এখন কোথায়? মাসীমা ও শিশুরা? আপনার মন্দিরের ঋষিতুল্য পূজারীর খবর কি? ‘জো জো’ এত শীঘ্র ‘নির্বাণ’ লাভ করছে না, কিন্তু তার গভীর নীরবতা দেখে মনে হয় গভীর ‘সমাধি’।
আপনি কি ঘুরে বেড়াচ্ছেন? আমি ইংলণ্ডকে খুব উপভোগ করছি। আমার বন্ধুর সঙ্গে দর্শনশাস্ত্র আলোচনা করে কাটাচ্ছি—খাবার ও ধূমপান করার জন্য অল্প একটু সময় রেখে। দ্বৈতবাদ অদ্বৈতবাদ এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় ছাড়া আমাদের আর কিছু আলোচ্য নেই।
মনে হয় লম্বা ট্রাউজার পরে হলিস্টার অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন হয়েছে; এবং এলবার্টা জার্মান শিখছে।
এখানে ইংরেজরা খুবই বন্ধুভাবাপন্ন। কতিপয় এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ব্যতিরেকে কেউ কালা আদমীদের ঘৃণা করে না। এমন কি রাস্তায় আমাকে লক্ষ্য করে কেউ কোন ব্যঙ্গরব করে না। মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি, তাহলে কি আমার মুখের রঙ সাদা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আরশিতে সত্য ধরা পড়ে; তবু এখানে সবাই খুব বন্ধুভাবাপন্ন।
আবার যে-সকল ইংরেজ পুরুষ এবং নারী ভারতবর্ষকে ভালবাসে, তারা হিন্দুদের চেয়েও বেশী ‘হিন্দু’। আপনি শুনে বিস্মিত হবেন যে, এখানে আমি নিখুঁত ভারতীয় পদ্ধতিতে প্রস্তুত প্রচুর তরিতরকারী পাচ্ছি। যখন একজন ইংরেজ একটি জিনিষ ধরে, সে তখন তার গভীরতম দেশে প্রবেশ করে। গতকাল জনৈক অধ্যাপক মিঃ ফ্রেজারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে—তিনি এখানে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। তিনি তাঁর অর্ধেক জীবন ভারতে কাটিয়েছেন; প্রাচীন চিন্তা ও জ্ঞানের মধ্যে তিনি এতখানি পুষ্ট হয়েছেন যে, ভারতের বাইরের কোন কিছুর জন্য তিনি মোটেই পরোয়া করেন না। শুনে আশ্চর্য হবেন যে, অনেক চিন্তাশীল ইংরেজ নরনারী মনে করে যে, হিন্দুদের জাতিবিভাগই সামাজিক সমস্যার একমাত্র সমাধান। আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারবেন, সেই ধারণা মাথায় নিয়ে তারা সমাজতন্ত্রী ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রীদের কতখানি ঘৃণা করে!! আবার এখানে পুরুষেরা—অতি উচ্চশিক্ষিতেরা—ভারতীয় চিন্তাধারা সম্পর্কে গভীর আগ্রহশীল, সে তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা খুব কম। আমেরিকার চেয়ে এখানে মেয়েদের জীবনের পরিধিও সংকীর্ণতর। এ পর্যন্ত আমার সব কিছুই ভালয় ভালয় হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী ঘটনাবলী জানাব। গৃহস্বামী, রাণীমাতা, জো জো এবং শিশুদের ভালবাসা।
আপনাদের চিরদিনের
বিবেকানন্দ
২২৪*
রিডিং, ইংলণ্ড
২০ অক্টোবর, ১৮৯৫
প্রিয় জো জো,
এই পত্রে লেগেটদিগকে লণ্ডনে স্বাগত জানাচ্ছি। এক হিসাবে এদেশ আমার মাতৃভূমি, সুতরাং পূর্বেই তোমাদিগকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। পরে আগামী মঙ্গলবার ২২ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় প্রিন্সেস হলে আমি তোমাদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করব।
মঙ্গলবার পর্যন্ত আমি এত ব্যস্ত থাকব যে, এর মধ্যে কোনক্রমেই তোমার সঙ্গে দেখা করে উঠতে পারব না। তারপর যে-কোন দিন দেখা করব। চাই কি মঙ্গলবার দিনও গিয়ে পড়তে পারি।
চিরদিনের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
২২৫*
C/o E. T. Sturdy,রিডিং, ইংলণ্ড
২৪ অক্টোবর,১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
‘ব্রহ্মবাদিনের’ দুটি সংখ্যা পেলাম—বেশ হয়েছে—এইরূপ করে চল। কাগজের প্রচ্ছদপট একটু ভাল করবার চেষ্টা কর, আর সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয় মন্তব্যগুলির ভাষাটা আর একটু হালকা অথচ ভাবগুলি একটু চটকদার করবার চেষ্টা কর। গুরুগম্ভীর ভাষা ও ছাঁদ কেবল প্রধান প্রধান প্রবন্ধগুলির জন্য রেখে দাও। মিঃ স্টার্ডি কয়েকটি প্রবন্ধ লিখবেন। আমি তোমাকে কয়েকখানা কাগজও পাঠাচ্ছি—তার মধ্যে দুখানা যথাক্রমে ধর্মমহাসভা ও মিশনরীগণ সম্বন্ধে। কাগজখানা ইংলিশ চার্চের উন্নতিশীল সম্প্রদায়ের অন্যতম মুখপত্র। আমার অনুমান—সম্পাদকপত্নী আমাকে এগুলি পাঠিয়ে দিয়েছেন, কারণ তাঁর বৈঠকখানায় আমি শীঘ্র বক্তৃতা দেব। সম্পাদকের নাম মিঃ হাউইস—তিনি ইংলিশ চার্চের একজন বিখ্যাত পুরোহিত।
ইতোমধ্যেই এখানে আমার প্রথম বক্তৃতা হয়ে গেছে, আর ‘স্ট্যাণ্ডার্ড’ কাগজের মন্তব্য পড়লেই বুঝতে পারবে, লোকে তা কেমন ভালভাবে নিয়েছে। ‘স্ট্যাণ্ডার্ড’ রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের বিশেষ শক্তিশালী কাগজগুলির মধ্যে অন্যতম। আগামী মঙ্গলবার লণ্ডনে গিয়ে ৮০ ওকলি ষ্ট্রীট, (Chelsea, London, S.W.) ঠিকানায় একমাস থাকব। তারপর আমেরিকায় ফিরে গিয়ে আবার আগামী গ্রীষ্মে এখানে আসব। এ পর্যন্ত দেখছ, ইংলণ্ডে সুন্দরভাবে বীজ বপন করা হয়েছে। আমার অনুপস্থিতিতে মিঃ স্টাডি—আমার এক সন্ন্যাসী গুরুভ্রাতা, যিনি শীঘ্রই এখানে আসছেন, তাঁর সঙ্গে মিলে ক্লাসগুলি চালাবেন।
সাহস অবলম্বন কর ও কাজ করে যাও। ধৈর্য ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাও—এই একমাত্র উপায়। আমি দ্বিতীয়বার আমেরিকা থেকে তোমাদের যে টাকা পাঠিয়েছি, তা সম্ভবতঃ নিরাপদে পৌঁছেছে। ঐ টাকার প্রাপ্তিস্বীকার আমেরিকায় করবে, কারণ এই পত্র তোমাদের নিকট পৌঁছবার পূর্বেই আমি আমেরিকায় ফিরব। তোমাদের অবশ্য আমার 19W. 38th Street, নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা—এই ঠিকানাটা মনে আছে। তোমরা অবশ্য কেভার্শ্যাম ইত্যাদি ঠিকানায় মিঃ স্টার্ডিকে পত্র লিখবে এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ পত্রব্যবহার করবে। মান্দ্রাজের সঙ্গে পত্রব্যবহারের প্রতিনিধি হবে তুমি, কলিকাতায় মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, আমেরিকায় মিস মেরী ফিলিপ্স্, নিউ ইয়র্ক—এইরূপ চলতে থাকুক। এখন কাগজটার দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দাও। এটা যাতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হয়, তার চেষ্টা কর। মিঃ স্টার্ডি সময়ে সময়ে লিখবেন—আমিও লিখব। এখন আমি আর টাকা পাঠাতে পারব না—ইংলণ্ডে বক্তৃতা দিয়ে পয়সা পাওয়া যায় না, সুতরাং আমাকে এখানে সব টাকা খরচ করতে হয়েছে, এক পয়সাও লাভ হয়নি। ক্রমে ক্রমে এখানে এমন বন্ধু পাব, যারা সাময়িক পত্র প্রভৃতির জন্য টাকা খরচ করবে। কাজ করে চল—ধৈর্য, পবিত্রতা, সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাও—এই ক-টি বিষয় মনে রেখো। লণ্ডনে মেননের সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছিল। এখন কাগজখানাকে দাঁড় করবার জন্য সমগ্র শক্তি প্রয়োগ কর। যতদিন পর্যন্ত তুমি সরল ও পবিত্র থাকবে, ততদিন পর্যন্ত কখনও বিফল হবে না; মা তোমায় ত্যাগ করবেন না, তোমার ওপর তাঁর সর্বপ্রকার শুভাশিস বর্ষিত হবে। ইতি
তোমার
বিবেকানন্দ
২২৬
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy, রিডিং,
ইংলণ্ড
১৮৯৫
প্রিয় শশী,
তোমার চিঠি, চুনীবাবুর চিঠি, সাণ্ডেলের চিঠি পূর্বে পাইয়াছি। রাখালের চিঠি আজ পাইলাম। রাখাল gravel-এ (পাথরিতে) ভুগিয়াছে শুনিয়া দুঃখিত হইলাম। বোধ হয়, বদহজমের কারণ হইয়া থাকিবে। … মঠের business (কাজকর্ম) মাষ্টার মহাশয় যদি রাজী হন, তাঁকে দিয়ে করাবে, অথবা হুটকোকে দিয়ে। সাণ্ডেলকে তার সংসার দেখতে বলবে, মঠের কাজে-টাজে বৃথা সময় সে ব্যয় না করে। হুটকোর দেনা শোধ হয়ে গেছে; এখন মাথা মুড়িয়ে নিতে বলবে। … আমি আধা জলে-স্থলে লোক চাই না।
হরমোহনকে বলবে, লেকচার-ফেকচার এখন আমার কিছুই নাই। সুরেশ দত্তের এক ‘নারদসূত্র’ তোমরা পাঠিয়েছিলে। কেন, দুনিয়ায় কি আর নারদসংহিতা ছাপা ছিল না? … হরমোহন কি-একটা Lord (লর্ড) রামকৃষ্ণ পরমহংস করেছে? Lordটা আবার কি—English Lord না Duke?
রাখালকে বলবে, লোকে যা হয় বলুক গে। ‘লোক না পোক’। ভাবের ঘরে তোমাদের চুরি না থাকে এবং Jesuitism-এর (কপটতার) দিক্ মাড়াবে না। Orthodox (আনুষ্ঠানিক) পৌরাণিক হিন্দু আমি কোন্ কালে, বা আচারী হিন্দু কোন্ কালে? I do not pose as one৮৫ বাঙালীরাই আমাকে মানুষ করলে, টাকাকড়ি দিয়ে পাঠালে, এখনও আমাকে এখানে পরিপোষণ করছে—অহ হ!!! তাদের মন জুগিয়ে কথা বলতে হবে—না? বাঙালীরা কি বলে না বলে, ওসব কি গ্রাহ্যের মধ্যে নিতে হয় নাকি? ওদের দেশে বার বছরের মেয়ের ছেলে হয়! যাঁর জন্মে ওদের দেশ পবিত্র হয়ে গেল, তাঁর একটা সিকি পয়সার কিছু করতে পারলে না, আবার লম্বা কথা! বাঙলাদেশে বুঝি যাব আর মনে করেছ? ওরা ভারতবর্ষের নাম খারাপ করেছে। … মঠ করতে হয় পশ্চিমে রাজপুতানায়, পাঞ্জাবে even (এমন কি) বোম্বায়ে। বাঙালী! … লণ্ডনে কতকগুলো কাফ্রির মত—আবার টুপি-টাপা মাথায় দিয়ে ঘুরতে দেখতে পাই। কালো হাতে খানা ছুঁলে ইংরেজরা খায় না—এই আদর! ঝি-চাকরের দলে ইয়ারকি দিয়ে দেশে গিয়ে বড়লোক হয়!! রাম! রাম! আহার গেঁড়ি গুগলি, পান প্রস্রাব-সুবাসিত পুকুরজল, ভোজনপাত্র ছেঁড়া কলাপাতা এবং ছেলের মলমূত্র-মিশ্রিত ভিজে মাটির মেজে, বিহার পেত্নী শাঁকচুন্নীর সঙ্গে, বেশ দিগম্বর কৌপীন ইত্যাদি, মুখে যত জোর! ওদের মতামতে কি আসে যায় রে ভাই? তোরা আপনার কাজ করে যা। মানুষের কি মুখ দেখিস, ভগবানের মুখ দেখ্।
শরৎ ভাষ্য-মাষ্যগুলো Dictionary (অভিধান) দেখে একরকম এদের পড়িয়ে দিতে পারবে তো, গীতা উপনিষদ্?—না শুধুই বৈরাগ্যি? শুধু বৈরাগ্যির কি আর কাল আছে? নিধে পেলা সকলেই কি রামকৃষ্ণ পরমহংস হয় রে ভাই! শরৎ বোধ হয় এতদিনে রওনা হয়েছে। একখানা ‘পঞ্চদশী’, একখানা ‘গীতা’ (যতগুলো পার ভাষ্য-সহিত), একখানা কাশীর ছাপা নারদ ও শাণ্ডিল্য-সূত্র (সুরেশ দত্তর ছাপা এক ছত্রে আঠারটা ভুল, মানে হয় না), পঞ্চদশীর যদি তর্জমা (ভাল, হাবাতে নয়) থাকে ও শাঙ্কর ভাষ্যের কালীবর বেদান্তবাগীশের তর্জমা ও পাণিনিসূত্রের বা কাশিকাবৃত্তি বা ফণিভাষ্যের যদি কোন বাঙলা বা ইংরেজী (এলাহাবাদের শ্রীশ বসুর) তর্জমা থাকে তো পাঠাবে।
—গুলোকে টাকাকড়ির কাজে একদম বিশ্বাস করবে না; অত কাঞ্চন ত্যাগ করতে হবে না। নিজেরা কড়িপাতির খরচ-আদায় সমস্ত করবে। মধো—যা বলি করে যা, ওস্তাদি চালাস না আর আমার ওপর। এখন তোদের বাঙালীদের বল দিকি, আমাকে একখানা 'বাচস্পত্য' অভিধান পাঠিয়ে দিতে—দেখি বচনবাগীশের দল! ইংরেজের দেশে ধর্মকর্মের কাজ বড়ই ধীরে ধীরে। এরা হয় গোঁড়া, না হয় নাস্তিক। গোঁড়াগুলো আবার অমনি ‘নমো নমো’ ধর্ম করে, ‘Patriotism (স্বদেশপ্রীতি) আমাদের ধর্ম,’ —এই মাত্র।
বই আমেরিকায় পাঠাবে। C/o Miss Mary Philips, 19W. 38th Street, New York U.S. America—ঐ হল আমার আমেরিকার address (ঠিকানা)। নভেম্বর মাসের শেষাশেষি আমেরিকায় যাব, অতএব বইপত্র ঐখানে পাঠাবে। শরৎ যদি পত্রপাঠ ছেড়ে থাকে তাহলেই আমার সঙ্গে দেখা হবে, নতুবা নয়। Business is business৮৬—ছেলেখেলা নয়। Sturdy (স্টার্ডি) সাহেব তাকে নিয়ে এসে ঘরে রাখবে ইত্যাদি। আমি এবার ইংলণ্ডে খালি একটু খবর নিতে এসেছি; আসছে গরমিকালে কিছু বেশী রকম হুজুগ করবার চেষ্টা করা যাবে। তারপর next winter India (পরবর্তী শীতে ভারতে)।
তোমার উপর আমার এখনও বিশ্বাস আছে। খেতড়ির রাজা যা কিছু খবর চান, তুমি নিজে লিখবে, অন্য কাউকেই জানতে পর্যন্ত দেবে না। যে সকল লোক আমাদের সহিত interested (আগ্রহান্বিত) তাদের regularly (নিয়মিতভাবে) চিঠিপত্র লিখবে। Interest (আগ্রহ) জাগিয়ে রাখবে। বাঙলাদেশময় জায়গায় জায়গায় centre (কেন্দ্র) করবার চেষ্টা কর। তোমরা তো কোন কিছু এ পর্যন্ত করে উঠতে পারলে না দেখছি; খালি বচন ঝাড়ছ! তোমারই যেন শরীর খারাপ, বাকীগুলো করছে কি? খালি আমরা লর্ড রামকৃষ্ণের শিষ্য! বলি, ও লর্ড রামকৃষ্ণ ব্যাপারটা কি হে? হরমোহনটা তো আধপাগলা বৈ নয়—ও একটা কি লর্ড রামকৃষ্ণ লেখে বল তো? লর্ড, ডিউক আবার কি হে? খেপাগুলোর জ্বালায় অস্থির! এখন এই পর্যন্ত। পরের চিঠিতে হালচাল লিখব। Sturdy (স্টার্ডি) সাহেবটি বড়ই ভাল, ভারি গোঁড়া বৈদান্তিক, সংস্কৃত একটু আধটু বোঝে। বহুৎ পরিশ্রম করলে তবে একটু আধটু কাজ হয় এ-সব দেশে—বড়ই শক্ত কাজ, আর শীতে বাদলে। তার উপর এখানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। ইংরেজরা লেকচার-ফেকচার শুনতে একটি পয়সাও দেয় না। যদি শুনতে আসে তো তোমার ভাগ্যি, যেমন আমাদের দেশে। তার ওপর এদেশে সাধারণে আমায় জানেও না এখন। তার ওপর ভগবান্-টগবান্ বললে ওরা পালিয়ে যায়, বলে—ঐ রে পাদ্রী বুঝি! তুমি বসে বসে একটা কাজ কর—ঋগ্বেদ থেকে আরম্ভ করে সামান্য পুরাণ তন্ত্র পর্যন্ত সৃষ্টি প্রলয় সম্বন্ধে, জাতি সম্বন্ধে, স্বর্গ নরক আত্মা মন বুদ্ধি ইত্যাদি, ইন্দ্রিয় মুক্তি সংসার (পুনর্জন্ম) সম্বন্ধে কে কি বলে, একত্র করতে থাক। ছেলেখেলা করলে কি হয়? Real scholarly work (রীতিমত পাণ্ডিত্যপূর্ণ বই) চাই। Material (উপাদান) যোগাড় হচ্ছে আসল কাজ। সকলকে আমার ভালবাসা। ইতি
নরেন্দ্র
২২৭*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
৮০ ওকলি ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৩১ অক্টোবর, ১৮৯৫, বৈকাল ৫টা
প্রিয় বন্ধু,
এইমাত্র দুইজন যুবক ভদ্রলোক, মিঃ সিলভারলক এবং তাঁহার বন্ধু চলে গেলেন। মিস মূলার তো আজ বিকালে এসেছিলেন এবং এঁদের আসার সঙ্গে সঙ্গে চলে যান।
এঁদের একজন ইঞ্জিনীয়র, আর একজন শস্যের ব্যবসা করেন। দর্শন ও বিজ্ঞানের অনেক গ্রন্থ এঁরা পড়েছেন এবং উভয়ে শাস্ত্রের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলির সঙ্গে হিন্দুদিগের প্রাচীন চিন্তাধারার অপূর্ব মিল দেখে বিস্মিত হয়েছেন। দুজনেই চমৎকার লোক—বেশ বুদ্ধিমান ও পণ্ডিত। একজন গীর্জার সঙ্গে সম্বন্ধ ত্যাগ করেছেন, আর একজন করবেন কিনা আমায় জিজ্ঞাসা করলেন।
এঁদের সঙ্গে আলাপ হবার পর দুটি জিনিষ আমার মনে জাগছে। প্রথমতঃ ঐ বইখানি আমাদের তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। এর ভেতর দিয়ে আমরা এমন একদল লোকের সংস্পর্শে আসতে পারব, যাঁরা দার্শনিক ভিত্তিতে ধর্মকে গ্রহণ করেন এবং অলৌকিকতা একদম পছন্দ করেন না। দ্বিতীয়তঃ এঁরা দুজনেই আমার ধর্মের আনুষ্ঠানিক দিকটা জানতে চান। এতে আমার চোখ খুলেছে। জগতের সাধারণ লোক চায়—কোন প্রকার অবলম্বন। বস্তুতঃ সাধারণভাবে বলতে গেলে অনুষ্ঠানের মধ্যে যখন দর্শন (Philosophy) রূপপরিগ্রহ করে, তখনই তাকে ‘ধর্ম’ বলা হয়। তাই ধর্মমন্দির ও কিছু ক্রিয়াকলাপ থাকা নিতান্তই আবশ্যক অর্থাৎ আমাদের যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি কিছু ক্রিয়াকলাপ ঠিক করে ফেলতে হবে।
যদি আপনি শনিবার সকালে বা তার পূর্বে আসতে পারেন, তবে আমরা ‘এসিয়াটিক সোসাইটিতে’ যাব, কিম্বা আপনিই আমার জন্য ‘হেমাদ্রিকোষ’ নামক গ্রন্থখানি সংগ্রহ করতে পারেন; ঐ পুস্তকে আমরা যা চাই, তা পাব। উপনিষদগুলিও নিয়ে আসবেন। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যুকালের মধ্যে আমরা একটা কিছু অপূর্ব সিদ্ধান্ত সুদৃঢ় করে ধরতে পারব; অসম্বদ্ধ দার্শনিক মতবাদ মানবজীবনের উপর কোনই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
আমরা যদি আমাদের ক্লাসগুলি শেষ হবার আগেই বইটি শেষ করে ফেলতে পারি এবং দু-একটি অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে সেটি সর্বসাধারণের মধ্যে প্রকাশ করতে পারি, তবে বইখানি চালু হয়ে যাবে। এরা চায় সঙ্ঘবদ্ধ হতে, আর চায় ক্রিয়াকলাপ। আর ঠিক এটিই একটি কারণ, যার জন্য ‘—’রা পাশ্চাত্য জনসাধারণের উপর কোনদিনই প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
‘নৈতিক সমিতি’র প্রস্তাবে সম্মত হওয়ায় তারা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আর একখানা পত্র লিখেছে এবং তাদের একখানা ফরমও পাঠিয়েছে। তাদের ইচ্ছা যে, আমি একখানা বই সঙ্গে নিয়ে যাই এবং তা থেকে দশ মিনিট পাঠ করি। আপনি দয়া করে গীতার অনুবাদ এবং বৌদ্ধ জাতকের অনুবাদটি নিয়ে আসবেন কি? আপনার সঙ্গে দেখা না করে আমি এ বিষয়ে কিছুই করব না। আমার ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানবেন। ইতি
বিবেকানন্দ
২২৮*
৮০ ওকলি ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৩১ অক্টোবর, ১৮৯৫
প্রিয় জো জো,
শুক্রবার সানন্দে তোমার ওখানে মধ্যাহ্নভোজন এবং এলবেমার্লে মিঃ কয়েটের সহিত আলাপ করব।
মিসেস ও মিস নেটার নামে দু-জন আমেরিকান মহিলা—মাতা ও কন্যা—গত রাত্রের ক্লাসে যোগদান করেন। তাঁরা যথার্থ অনুরক্ত বলে মনে হয়। মিস চেমিয়ার্সের ওখানে যে ক্লাস হত তা শেষ হল। আগামী শনিবার রাত্রি থেকে আমার বাসাতেই হবে। আমার ক্লাসের জন্য দু-একখানা চলনসই বড় ঘর পাব, আশা করি। মন্কিওর কন্ওয়ের নৈতিক সমিতির (Moncure Conway's Ethical Society) নিমন্ত্রণে ১০ তারিখে তাদের ওখানে বক্তৃতা দেব। আগামী মঙ্গলবার ব্যাল্বোয়া সমিতিতে (Balboa Society) বক্তৃতা। প্রভু সাহায্য করবেন। শনিবার তোমার সঙ্গে বেরুতে পারব কিনা ঠিক নেই। তবুও শহরের বাইরে তোমার খুবই ভাল লাগবে, তা ছাড়া মিঃ ও মিসেস স্টার্ডি অতি চমৎকার লোক।
ভালবাসা, আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—আমার জন্য কিছু নিরামিষ তরকারির ব্যবস্থা রেখ। ভাতের তেমন পক্ষপাতী নই, রুটি হলেও বেশ চলবে। আজকাল যা নিরামিষাশী হয়েছি, বলবার নয়।
২২৯
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
কেভার্শ্যাম, রিডিং, ইংলণ্ড
১৮৯৫
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার ও সান্যালের পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। তোমার চিঠি লেখার দুইটি দোষ—বিশেষ তোমার। প্রথম—যে-সকল কাজের কথা জিজ্ঞাসা করি, প্রায় তার কোনটিরই জবাব থাকে না; দ্বিতীয়—জবাব লেখায় অত্যন্ত বিলম্ব। তোমরা তো ঘরে বসে আছ ভায়া! আমাকে এ বিদেশে পেটের চেষ্টা করতে হয়, আবার দিনরাত খাটতে হয়; তার উপর লাটিমের মত ঘুরে বেড়ান। … আমি এখন বেশ বুঝতে পারছি যে, আমায় একা কাজ করতে হবে।
শশী সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত বটে; কিন্তু তোমরা খালি শশীর আসা সম্ভব কিনা তাই বিচার করছ। … এ সকল হল মহাবিলাসী বাবুর দেশ; নখের কোণে একটু ময়লা থাকলে তাকে স্পর্শ করে না। শরৎ আসতে না চায় সারদাকে পাঠাবে। অথবা মান্দ্রাজে লিখে কোন লোক পাঠাবে। প্রায় দু-মাস পূর্বে আমি এ-বিষয়ে লিখেছি। তারকদা শেষ পত্রে লিখেন যে, পর মেলে (ডাকে) এ-বিষয়ে সবিশেষ জানাবে। কিন্তু এখনও দেখছি তার কিছুই ঠিকানা হয় নাই। আশা ছিল—আমি থাকতে থাকতেই কেউ আসবে; কিন্তু এখনও তো কিছুই ঠিকানা নাই, এবং দু-বছরে এক-একটা সংবাদ আসে। Business is business—অর্থাৎ কাজকর্ম তৎপর করতে হয়, গড়িমসির কাজ নয়। আসছে সপ্তাহের শেষে আমি আমেরিকায় যাব। অতএব যে আসবে, তার সঙ্গে সাক্ষাতের কোন আশা নাই।
গিরিশবাবু আমার কাজে সহায়তা করতে পারবেন—কেমন করে? আমি চাই সংস্কৃত-জানা লোক, অর্থাৎ বই-টই তর্জমা করতে সহায়তা করে স্টার্ডিকে, আমার অনুপস্থিতিতে স্টার্ডির সঙ্গে বইপত্র তর্জমা করে—এই মাত্র। অধিক আমি আশা করি না। … কেবল এই দরকার, আমার অনুপস্থিতিকালে একটু আধটু সংস্কৃত পড়ায় বা তর্জমা করে—এই বস্, আবার কি করবে? গিরিশবাবু এদেশে বেড়িয়ে যান না, বেশ কথা। ইংলণ্ড ও আমেরিকা ঘুরে যেতে ৩০০০ টাকা মাত্র পড়বে। যত লোক এ-সব দেশে আসে, ততই ভাল। তবে ঐ টুপিপরা হতভাগাদের দেখলে গা জ্বলে। ভূত কালো—আবার সাহেব! ভদ্রলোকের মত দেশী কাপড়-চোপড় পর বাবা, তা না হয়ে ঐ জানোয়ারী রূপ!
আর কেন, হরি বল! এখানে সমস্তই ব্যয়, আয় এক পয়সাও নাই। স্টার্ডি আমার জন্য অনেক টাকা খরচ করেছে। এখানে লেকচারে আমাদের দেশের মত উল্টে ঘর থেকে খরচ করতে হয়। তবে অনেকদিন করলে ও খাতির জমে গেলে খরচটা পুষিয়ে যায়। টাকাকড়ি সেই যা প্রথম বৎসর আমেরিকায় করি (তারপর হাতে এক পয়সাও নিই না), তা প্রায় ফুরিয়ে গেল; আমেরিকায় পঁহুছিবার মত মাত্র আছে। আমার এই ঘুরে ঘুরে লেকচার করে শরীর অত্যন্ত nervous (স্নায়ুপ্রধান) হয়ে পড়েছে—প্রায় ঘুম হয় না, ইত্যাদি। তার উপর একলা। দেশের লোকের কথা কি বল? কেউ না একটা পয়সা দিয়ে এ-পর্যন্ত সহায়তা করেছে, না একজন সাহায্য করতে এগিয়েছে। এ সংসারে সকলেই সাহায্য চায়—এবং যত কর ততই চায়। তারপর যদি আর না পার তো তুমি চোর!
… যা লিখতে হয় স্টার্ডিকে লিখবে—লোক পাঠাবার মতামত—যখন আসছে যুগে তোমরা সিদ্ধান্তয় উপস্থিত হবে। … শশীকে আমি বিশ্বাস করি, ভালবাসি। He is the only faithful and true man there (ওখানে সে-ই একমাত্র বিশ্বস্ত ও খাঁটি লোক)। তার ব্যামো-ফ্যামো সব প্রভুর কৃপায় ভাল হয়ে যাবে। তার সব ভার আমার। … ইতি
বিবেকানন্দ
২৩০*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
৮০ ওকলি ষ্ট্রীট, চেলসী
১ নভেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
ব্যালেরেন (Balleren) সোসাইটির টিকিটের সংখ্যা ৩৫। বিষয় হল—ভারতীয় দর্শন ও পাশ্চাত্য সমাজ, সভাপতির স্থান শূন্য।
আপনি সেগুলো আমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেননি, তাই পাঠালাম না।
আপনার চিঠিগুলি ঠিকভাবেই পেয়েছি।
বিবেকানন্দ
২৩১*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
২ নভেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
আমার মনে হয়, আপনিই ঠিক; আমরা আমাদের নিজেদের পথে কাজ করে যাব আর যা ঘটে ঘটুক।
আপনাকে বক্তৃতাটির সারাংশ পাঠাচ্ছি।
রবিবার আসব, যদি বিশেষ কিছু বাধা না ঘটে।
প্রীতির সঙ্গে আপনার
বিবেকানন্দ
২৩২
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
লণ্ডন
১৩ নভেম্বর, ১৮৯৫
কল্যাণবরেষু—
তোমার পত্র পাইয়া সবিশেষ প্রীত হইলাম। যেরূপ কার্য করিতেছ, তাহা অতি উত্তম। রা—অতি উদার ও মুক্তহস্ত, কিন্তু তাই বলিয়া তাঁহার উপর অত্যাচার না হয়। শ্রীমান্—এর অর্থসংগ্রহ উত্তম সঙ্কল্প বটে, কিন্তু ভায়া, এ সংসার বড়ই বিচিত্র, কাম-কাঞ্চনের হাত এড়ান ব্রহ্মা বিষ্ণুরও দুষ্কর। টাকা-কড়ির সম্বন্ধ মাত্রেই গোলমালের সম্ভাবনা। অতএব মঠের নিমিত্ত অর্থ সংগ্রহ করা ইত্যাদি কাহাকেও করিতে দিবে না। রা—ছাড়া ভারতবর্ষের কোন গৃহস্থকে আমি এখনও নিঃসন্দেহে মিত্র বলিয়া জানি না। আমার বা আমাদের নামে কোন গৃহস্থকে মঠ বা কোন উপলক্ষে অর্থ সংগ্রহ করিতেছেন শুনিলেই সন্দেহ করিবে ...। বিশেষ দরিদ্র গৃহস্থ লোকেরা অভাব পূরণের নিমিত্ত বহুবিধ ভান করে। অতএব যদি কখনও কোন ধনী বিশ্বাসী ভক্ত ও হৃদয়বান গৃহস্থ মঠাদি নির্মাণের জন্য উদ্যোগ করেন, অথবা সংগৃহীত অর্থ কোন ধনী এবং বিশ্বাসী গৃহস্থের নিকট জমা হয়—উত্তম কল্প, নতুবা হস্তক্ষেপ করিবে না—(জড়িত হইও না), উপরন্তু অন্যকে এ কার্যে বিরত করিবে। তুমি বালক, কাঞ্চনের মায়া বোঝ না। অবসরক্রমে মহানীতিপরায়ণ লোকও প্রতারক হয়। এই হচ্ছে সংসার। রা—কে টাকাকড়ি সম্বন্ধে কোন কথা বলিবে না।
পাঁচজন মিলে কোন কাজ করা আমাদের স্বভাব আদতেই নয়। এই জন্যই আমাদের দুর্দশা। He who knows how to obey, knows how to command. Learn obedience first. (যিনি হুকুম তামিল করতে জানেন, তিনিই হুকুম করতে জানেন। প্রথমে আজ্ঞাবহতা শিক্ষা কর।) এই সকল মহা স্বাধীনভাবপূর্ণ পাশ্চাত্য জাতিদের মধ্যে Obedience-এর (আজ্ঞাবহতার) ভাব সেই প্রকার বলবান্। আমরা সকলেই হম্বড়া, তাতে কখনও কাজ হয় না। মহা উদ্যম, মহাসাহস, মহাবীর্য এবং সকলের আগে মহতী আজ্ঞাবহতা—এই সকল গুণ ব্যক্তিগত ও জাতিগত উন্নতির একমাত্র উপায়। এই সকল গুণ আমাদের আদৌ নাই।
তুমি যে প্রকার কার্য করছ করে যাও—তবে পড়াশুনার উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখিবে—ইতি। য—বাবু একখানি পত্রিকা হিন্দী ভাষায়—প্রেরণ করিয়াছেন। তাহাতে আমার চিকাগো স্পীচের অনুবাদ আলোয়ারের রা— পণ্ডিত করিয়াছেন। উভয়কেই বিশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাইবে।
তোমার নিমিত্ত এক্ষণে লিখি, রাজপুতানায় একটি center (কেন্দ্র) করিবার বিশেষ যত্ন করিবে। জয়পুর বা আজমীর প্রভৃতি কোন central (মধ্যবর্তী) স্থানে হওয়া উচিত—তদনন্তর আলোয়াড়, খেতড়ি প্রভৃতি শহরে branch (শাখা) স্থাপন করিবে। সকলের সঙ্গে মিশিবে, কাহারও সহিত বিরোধ আবশ্যক নাই। পণ্ডিত না—জীকে আমার প্রেমালিঙ্গন দিবে, ঐ লোকটি খুব উদ্যমী—কালে বিশেষ কার্যক্ষম হইবে। মাঃ— সাহেব ও —জীকেও আমার যথাযোগ্য প্রেমসম্ভাষণ দিও। ঐ ‘ধর্মমণ্ডলী’ বলে কি একটা আজমীরে হয়েছে—সেটা ব্যাপার কি? বিশেষ লিখিবে।—বাবু লিখেন যে, তাঁহারা আমায় পত্রাদি লিখিয়াছেন, এ পর্যন্ত পাই নাই। … মঠ মড়ি কলকেতায় কি করবে? কাশীতে আড্ডা করিতে হইবে। সে-সকল অনেক মতলব আছে, পরন্তু অর্থসাপেক্ষ। ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবে, খবরের কাগজে দেখে থাকবে যে, ইংলণ্ডে হুজ্জুক ধীরে ধীরে মাচছে। এদেশে সকল কাজ ধীরে ধীরে হয়। কিন্তু ইংরেজবাচ্ছা কোন কাজে হাত একবার দিলে আর ছাড়ে না। আমেরিকানরা চটপটে, কিন্তু অনেকটা খড়ের আগুনের মত। রামকৃষ্ণ পরমহংস অবতার ইত্যাদি সাধারণে প্রচার করিবে না। আলোয়াড়ে আমার কতকগুলো চেলাপত্র আছে, সেগুলোকে নিয়ে তদারক করবে, … মহাশক্তি তোমাতে আসবে, ভয় নাই—Be pure, have faith be obedient, (পবিত্র হও, বিশ্বাসী হও, আজ্ঞাবহ হও)।
ছেলের বে-র বিপক্ষে শিক্ষা দিবে! বালকের বে কোন শাস্ত্রে নাই। তবে ছোট ছোট মেয়ের বে-র বিপক্ষে এখন কিছু বলো না। ছেলের বে বন্ধ করতে পারলেই মেয়ের বে আপনা হতে বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়েকে তো আর মেয়ে বে করবে না। লাহোর আর্য-সমাজের সেক্রেটারীকে লিখবে যে, অ-বলে যে একজন সন্ন্যাসী তাঁদের কাছে থাকতেন, তিনি এক্ষণে কোথায়? সে লোকটির বিশেষ সন্ধান করিবে। … ভয় কি?
বিবেকানন্দ
২৩৩*
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
লণ্ডন
১৮ নভেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
‘ব্রহ্মবাদিন্’ সম্বন্ধে আমার গোটাকতক প্রস্তাব আছে। আমি ইতোমধ্যেই খবর পেয়েছি যে, আমেরিকায় ওর অনেকগুলি গ্রাহক হয়েছে। ইংলণ্ডেও তোমায় কতকগুলি গ্রাহক যোগাড় করে দেব। ইংলণ্ডে আমার কাজ বাস্তবিক খুব চমৎকার হয়েছে; আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছি। ইংরেজরা খবরের কাগজে বেশী বকে না; কিন্তু নীরবে কাজ করে। আমেরিকা অপেক্ষা ইংলণ্ডে অনেক বেশী কাজ হবে বলেই আমার স্থির বিশ্বাস। দলে দলে লোক আসছে, কিন্তু এত লোকের জন্য তো আমার জায়গা নেই। সুতরাং বড় বড় সম্ভ্রান্ত মহিলা ও অন্যান্য সকলেই মেঝের উপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে। আমি তাদের কল্পনা করতে বলি যে, তারা যেন ভারতীয় আকাশের তলে শাখাপ্রশাখাসমন্বিত একটি বিস্তীর্ণ বটবৃক্ষের নীচে বসে আছে—তারা অবশ্য এ ভাবটা পছন্দই করে। আমাকে আগামী সপ্তাহেই এখান থেকে চলে যেতে হবে, তাই এরা ভারি দুঃখিত। কেউ কেউ ভাবছে, যদি এত শীঘ্র চলে যাই, তাহলে এখানকার কাজের ক্ষতি হবে। আমি কিন্তু তা মনে করি না। আমি কোন লোক বা জিনিষের উপর নির্ভর করি না—একমাত্র প্রভুই আমার ভরসা এবং তিনি আমার ভেতর দিয়ে কাজ করছেন।
‘ব্রহ্মবাদিনে’র প্রত্যেক সংখ্যায় ভক্তি, যোগ ও জ্ঞান সম্বন্ধে কিছু লেখা বেরুন দরকার। দ্বিতীয়তঃ লেখার ধাঁজটা ভারি কটমটে—একটু যাতে স্বচ্ছ, সরস ও ওজস্বী হয়, তার চেষ্টা কর। গত সংখ্যায় ক্ষত্রিয়দের খুব বাড়ান হয়েছে, পরের সংখ্যায় ব্রাহ্মণদের খুব প্রশংসা কর, তার পরের সংখ্যায় বৈশ্যদের। কপট ও কাপুরুষ না হয়ে সকলকে খুশী কর। দৃঢ়তা ও পবিত্রতার সহিত নিজেদের ভাবগুলি আঁকড়ে ধরে থাক; আর এখন যেরূপ বাধাই আসুক না কেন, জগৎ অবশেষে তোমাদের কথা শুনবেই শুনবে। আরও কিছু বিজ্ঞাপন যোগাড়ের চেষ্টা কর—বিজ্ঞাপনের জোরেই কাগজ চলে। আমি তোমার জন্য ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে বড় একটা কিছু লিখব; কিন্তু এটি মনে রেখো, বাঙালীদের ভাষায়—‘আমার মরবার পর্যন্ত সময় নেই’। দিবারাত্র কাজ, কাজ, কাজ। নিজের রুটির যোগাড় করতে হচ্ছে এবং আমার দেশকে সাহায্য করতে হচ্ছে—সব একলাই; আর তার দরুন শত্রুমিত্র সকলেরই কাছে কেবল গাল খাচ্ছি! যাই হোক, তোমরা তো শিশুমাত্র; আমাকে সব সহ্য করতে হবে।
কলিকাতা থেকে একজন সন্ন্যাসীকে ডেকে পাঠিয়েছি, তাকে লণ্ডনে কাজের জন্য রেখে যাব। আমেরিকার জন্য আর একজন আবশ্যক। তোমরা কি মান্দ্রাজ থেকে উপযুক্ত একজন কাউকে পাঠাতে পার না? অবশ্য তার খরচপত্র সব আমি দেব। তার ইংরেজী ও সংস্কৃত দুই-ই ভাল জানা চাই—ইংরেজীটি একটু বেশী। আবার তার খুব শক্ত লোক হওয়া দরকার—মেয়ে প্রভৃতির পাল্লায় পড়ে যেন বিগড়ে না যায়। অধিকন্তু তাকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বস্ত ও আজ্ঞাবহ হতে হবে। তোমার কি চলনসই সংস্কৃত জানা আছে? জি.জি. কিছু কিছু জানে। আমি আমার নিজের লোক চাই। গুরুভক্তিই সর্বপ্রকার আধ্যাত্মিক উন্নতির মূল। আমার আশঙ্কা, তুমি তোমার কাগজ ফেলে আসতে পারবে না। জি.জি. কি আসতে পারে? আমি দুজন লোককে এই দুই কেন্দ্রে রেখে যেতে চাই, তারপর ভারতে ফিরে গিয়ে তাদের অবসর দেবার জন্য নূতন নূতন লোক পাঠাব। বাস্তবিক আমি অবিরাম কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যেরূপ কঠোর পরিশ্রম করেছি, আর কোন হিন্দুকে এরূপ করতে হলে সে এতদিন রক্তবমি করে মরে যেত। মেনন পূর্বের মতই বিশ্বস্ত ও অনুগত আছেন। তিনি প্রায়ই এসে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করে থাকেন। আমাকে C/o Miss Mary Philips, 19W. 38th Street, New York—ঠিকানায় পত্র লিখো। আমি আগামী সপ্তাহে (আমেরিকা) যাচ্ছি এবং আগামী গ্রীষ্মে (এখানে) আবার ফিরব। ইতোমধ্যে কাকে পাঠাবে ভাবতে থাক। আমি দীর্ঘ বিশ্রামের জন্য ভারতে যেতে চাই। কিডি, ডাক্তার, সেক্রেটারী সাহেব, বালাজী এবং বাকী সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে। সদা আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—‘ব্রহ্মবাদিনে’ বিবিধ সংবাদের একটা স্তম্ভ থাকা উচিত। একটি ভক্ত বৈরাগী shuffled off his mortal coil—এইরূপ ভাষা লিখো না। ভক্ত বৈরাগীর মৃত্যুর সঙ্গে এইরূপ বাক্যযোজনা একটু হাস্যোদ্দীপক।
২৩৪*
লণ্ডন
২১ নভেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
‘ব্রিটানিয়া’ জাহাজে আগামী ২৭ বুধবার (আমেরিকা) রওনা হচ্ছি। এখানে এ পর্যন্ত আমার যতটা কাজ হয়েছে, তা বেশ সন্তোষজনক; আমার বিশ্বাস আগামী গ্রীষ্মে চমৎকার কাজ করতে পারব। … ভালবাসাদি জানবে। ইতি
তোমাদের প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ
২৩৫*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
R. M. S. 'Britannic'৮৭
আশীর্বাদভাজন ও প্রিয়,
এ পর্যন্ত ভ্রমণ খুবই মনোরম হয়েছে। জাহাজের খাজাঞ্চী আমার প্রতি খুব সদয় এবং একখানা কেবিন আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। একমাত্র অসুবিধা হল খাদ্য—মাংস, মাংস, মাংস। আজ তারা আমাকে কিছু তরকারি দেবে বলেছে।
আমরা এখন নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছি। কুয়াশা এত ঘন যে, জাহাজ এগোতে পারছে না। তাই এই সুযোগে কয়েকটি চিঠি লিখছি।
এ এক অদ্ভুত কুয়াশা, প্রায় অভেদ্য, যদিও সূর্য উজ্জ্বলভাবে ও সহাস্য কিরণ দিচ্ছে। আমার হয়ে শিশুকে চুম্বন দেবেন এবং আপনার ও মিসেস স্টার্ডির জন্য ভালবাসা ও আশীর্বাদ।
বিবেকানন্দ
পুনঃ—দয়া করে মিসেস মূলারকে আমার ভালবাসা জানাবেন। আমি এভিনিউ রোডে রাত্রিকালীন কামিজটা (Night Shirt) ফেলে এসেছি। অতএব ট্রাঙ্কটি না আসা পর্যন্ত আমাকে বিনা কামিজেই চালাতে হবে।
২৩৬*
R. M. S. 'Britannic'
বৃহস্পতিবার প্রভাত
৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় এলবার্টা,
কাল সন্ধ্যায় তোমার সুন্দর চিঠিখানা পেয়েছি। আমাকে যে মনে রেখেছ, এটা তোমার সহৃদয়তা। আমি শীঘ্রই ধর্মনিষ্ঠ দম্পতিকে দেখতে যাচ্ছি। মিঃ লেগেট একজন ঋষি, এ-কথা আমি তোমাকে আগেই বলেছি, এবং তোমার মা হলেন একজন আজন্ম সম্রাজ্ঞী, তাঁরও ভেতরে ঋষির হৃদয়।
তুমি আলপস্ পর্বত খুব উপভোগ করছ জেনে আমিও আনন্দিত। আলপস্ নিশ্চয়ই বিস্ময়কর। এরকম জায়গাতেই মানুষের আত্মা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা করে। কোন জাতি আধ্যাত্মিক দিক্ থেকে দীন হলেও বাহ্য স্বাধীনতা কামনা করে। লণ্ডনে একজন সুইস যুবকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে আমার ক্লাসে আসত। লণ্ডনে আমি খুবই কৃতকার্য হয়েছিলাম, এবং যদিও কোলাহলপূর্ণ নগরটা আমার ভাল লাগত না, আমি মানুষদের পেয়ে খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। এলবার্টা, তোমাদের দেশে বৈদান্তিক চিন্তাধারা প্রথমে অজ্ঞ ‘বাতিকগ্রস্ত’ ব্যক্তিদের দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল, সেই প্রবর্তনের ফলে সৃষ্ট নানা অসুবিধার মধ্য দিয়ে কাজের পথ তৈরী করে নিতে হয়। তুমি হয়তো লক্ষ্য করেছ, আমেরিকায় আমার ক্লাসগুলিতে উচ্চশ্রেণীর নরনারী—কখনও কখনও যোগ দিয়েছেন, তাও মুষ্টিমেয়। আবার আমেরিকায় উচ্চশ্রেণীর লোকেরা ধনী হবার ফলে তাঁদের সমস্ত ঐশ্বর্য সম্ভোগ করিতে ও ইওরোপীয়দের অনুকরণ (বোকার মত?) করতে করতে কাটে। অপর পক্ষে, ইংলণ্ডে বৈদান্তিক মতবাদ দেশের সেরা জ্ঞানী ব্যক্তিদের দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছে এবং ইংলণ্ডের উচ্চশ্রেণীর মধ্যে বহু লোক আছেন, যাঁরা বিশেষ চিন্তাশীল। তুমি শুনে অবাক হবে, এখানে আমি ক্ষেত্র সম্পূর্ণ প্রস্তুত পেয়েছিলাম, এবং বিশ্বাস করি যে, আমার কাজ আমেরিকার চেয়ে ইংলণ্ডে বেশী সফল হবে। এর সঙ্গে ইংরেজ চরিত্রের প্রচণ্ড একগুঁয়েমি যোগ দাও এবং নিজেই বিচার কর। এই থেকে তুমি দেখতে পাবে যে, ইংলণ্ড সম্বন্ধে আমার মত অনেকখানি পাল্টে গিয়েছে, এবং আমি সানন্দে তা স্বীকার করি। আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিন্ত যে, আমরা জার্মানীতে আরও ভাল করব। পরবর্তী গ্রীষ্মে ইংলণ্ডে ফিরে আসছি। ইতোমধ্যে আমার কাজ খুবই উপযুক্ত লোকের হাতে আছে। জো জো আমেরিকায় যেমন ছিলেন, তেমনি আমার সদয় মহৎ পবিত্র বন্ধু আছেন এবং তোমাদের পরিবারের কাছে আমার ঋণ অশেষ। হলিস্টার ও তোমাকে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ।
ষ্টমারটি কুয়াশার জন্য নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজের খাজাঞ্চী খুব সদয় হয়ে আমার একার জন্য একটা গোটা কেবিন দিয়েছে। এরা মনে করে, প্রত্যেক হিন্দুই একজন রাজা এবং খুব নম্র—অবশ্য এই মোহ ভেঙে যাবে যখন তারা জানবে যে, ‘রাজা’ কপর্দকশূন্য!! ভালবাসা ও আশীর্বাদ জেনো।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
২৩৭*
228, West 39th St. N.Y.
৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার পত্রে আমায় যে আহ্বান জানিয়েছেন, তার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। দশ দিন অতি বিরক্তিকর দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর আমি গত শুক্রবার এখানে পৌঁছেছি। সমুদ্র ভয়ানক বিক্ষুদ্ধ ছিল এবং জীবনে এই সর্বপ্রথম আমি ‘সমুদ্রপীড়ায়’ (sea-sickness) অতিশয় কষ্ট পেয়েছি। আপনি একটি পৌত্র লাভ করেছেন জেনে আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি; শিশুটির মঙ্গল হোক। দয়া করে মিসেস এ্যাডামসন ও মিস থার্সবিকে আমার ঐকান্তিক ভালবাসা জানাবেন।
ইংলণ্ডে আমি জনকয়েক বিশিষ্ট বন্ধু রেখে এসেছি। আগামী গ্রীষ্মে ফিরে যাব, এই আশায় তাঁরা আমার অনুপস্থিতিকালে কাজ করবেন। এখানে আমি কি প্রণালীতে কাজ করব, তা এখনও স্থির করিনি। ইতোমধ্যে একবার ডেট্রয়েট ও চিকাগো ঘুরে আসবার ইচ্ছা আছে—তারপর নিউ ইয়র্কে ফিরব। সাধারণের কাছে প্রকাশ্যভাবে বক্তৃতা দেওয়াটা আমি একেবারে ছেড়ে দেব স্থির করেছি; কারণ আমি দেখছি, আমার পক্ষে সর্বোৎকৃষ্ট কাজ হচ্ছে—প্রকাশ্য বক্তৃতায় কিম্বা ঘরোয়া ক্লাসে একদম টাকাকড়ির সংস্রব না রাখা। পরিণামে ওতে কাজের ক্ষতি হবে এবং খারাপ দৃষ্টান্ত দেখান হবে।
বিভিন্ন স্থানে স্বতন্ত্র ও স্বাবলম্বী গোষ্ঠীর আমি পক্ষপাতী। তারা নিজেদের কাজ নিজেদের মত করুক, তারা যা খুশী করুক। নিজের সম্বন্ধে আমার এইটুকু বক্তব্য যে, আমি নিজেকে কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়াতে চাই না। আশা করি, আপনার শরীর মন ভাল আছে। ইতি
সদা প্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
২৩৮*
228, West 39th St., New York
৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় জো জো,
এ-যাবৎ যত সমুদ্রযাত্রা করেছি, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক দশদিনব্যাপী সমুদ্রযাত্রার পরে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছি। একাদিক্রমে দিনকয়েক বড়ই পীড়িত ছিলাম।
ইওরোপের তকতকে ঝকঝকে শহরগুলির পরে নিউ ইয়র্কটাকে বড়ই নোংরা ও হতচ্ছাড়া মনে হয়। আগামী সোমবার কাজ আরম্ভ করব। এলবার্টা যাঁদের ‘স্বর্গীয় দম্পতি’ বলে, তাঁদের কাছে তোমার বাণ্ডিলগুলি ঠিক ঠিক পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বরাবরই তাঁরা বড় সহৃদয়। মিঃ ও মিসেস স্যালমন্ ও অপরাপর বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। ঘটনাক্রমে মিসেস গার্নসির ওখানে মিসেস পিকের সঙ্গে দেখা হয়; কিন্তু এ-যাবৎ মিসেস রথিনবার্গারের কোন খবর নেই। ‘স্বর্গের পাখী’দের সঙ্গে এই বড়দিনের সময় রিজলিতে যাচ্ছি; তুমিও ওখানে থাকলে কতই না আনন্দ হত।
লেডী ইসাবেলের সঙ্গে তোমার বেশ আলাপ-পরিচয় হয়ে গেছে বোধ হয়। সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে এবং নিজেও সাগর-প্রমাণ ভালবাসা জানবে। চিঠি ছোট হল বলে কিছু মনে করো না; আগামী বার থেকে বড় বড় সব লিখব।
সদা প্রভুপদাশ্রিত তোমাদের বিবেকানন্দ
২৩৯*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228, West 39th St. নিউ ইয়র্ক
৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
দশ দিনের অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং বিক্ষুব্ধ সমুদ্রযাত্রার পর আমি নিরাপদে নিউ ইয়র্কে এসে পৌঁছেছি। আমার বন্ধুরা ইতোমধ্যেই উপরের ঠিকানায় কয়েকটি ঘর ঠিক করে রেখেছেন। সেখানেই আমি এখন বাস করছি এবং শীঘ্র ক্লাস নেবার ইচ্ছা আছে। ইতোমধ্যে —রা অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে উঠেছে এবং আমাকে আঘাত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
মিসেস লেগেট ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তারা বরাবরের মতই সদয় ও অনুরক্ত।
যে সন্ন্যাসীটি আসছেন, তাঁর সম্বন্ধে ভারত থেকে কোন সংবাদ পেয়েছেন কি? আমি এখানকার কাজের পূর্ণ বিবরণ পরে লিখব।
দয়া করে মিস মূলারকে, মিসেস স্টার্ডিকে এবং অন্য বন্ধুদের আমার ভালবাসা জানাবেন এবং শিশুকে আমার হয়ে চুম্বন দেবেন। ইতি
বিবেকানন্দ
২৪০*
228, West 39th St. নিউ ইয়র্ক
১০ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয়—,
সেক্রেটারীর পত্র পেয়েছি, তাঁর অনুরোধ মত Harvard Philosophical Club (হার্ভার্ড)-এ আনন্দের সহিত বক্তৃতা দেব। তবে অসুবিধা এই যে, আমি এখন এক মনে লিখতে আরম্ভ করেছি; কারণ আমি এমন কতকগুলি পাঠ্যপুস্তক লিখে ফেলতে চাই, যেগুলি আমি চলে গেলে আমার কাজের ভিত্তিস্বরূপ হবে। তার পূর্বে আমাকে চারখানি ছোট ছোট বই তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।
এই মাসে চারটি রবিবাসরীয় বক্তৃতার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। ফেব্রুআরীর প্রথম সপ্তাহে ব্রুকলিনে যে বক্তৃতাগুলি দিতে হবে, ডাক্তার জেন্স্ প্রভৃতি তার বন্দোবস্ত করছেন। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছাদি জানবে। ইতি
তোমাদের শুভার্থী
বিবেকানন্দ
২৪১*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228, West 39th St., নিউ ইয়র্ক
১৬ (?) ডিসেম্বর, ১৮৯৫
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
তোমার সব ক-খানি চিঠি একই ডাকে আজ এসেছে, মিস মূলারও একটি লিখেছেন। তিনি ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় পড়েছেন যে, স্বামী কৃষ্ণানন্দ ইংলণ্ডে আসছেন। যদি তাই হয়, যাদের আমি পেতে পারি, তাদের মধ্যে ইনিই হবেন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী।
এখানে আমার সপ্তাহে ছ-টি করে ক্লাস হচ্ছে; তা ছাড়া প্রশ্নোত্তর ক্লাসও একটি আছে। শ্রোতার সংখ্যা ৭০ থেকে ১২০ পর্যন্ত হয়। এ ছাড়া প্রতি রবিবারে আমি সর্বসাধারণের জন্য একটি বক্তৃতা দিই। গত মাসে যে সভাগৃহে আমার বক্তৃতাগুলি হয়েছিল, তাতে ৬০০ জন বসতে পারে। কিন্তু সাধারণতঃ ৯০০ জন আসত—৩০০ জন দাঁড়িয়ে থাকত, আর ৩০০ জন জায়গা না পেয়ে ফিরে যেত। সুতরাং এ সপ্তাহে একটা বৃহত্তর হল নিয়েছি, যাতে ১২০০ জন বসতে পারবে।
এই বক্তৃতাগুলিতে যোগ দেবার জন্য কোন অর্থাদি চাওয়া হয় না; কিন্তু সভায় যে চাঁদা ওঠে, তাতে বাড়ী-ভাড়াটা পুষিয়ে যায়। এ সপ্তাহে খবরের কাগজগুলির দৃষ্টি আমার উপর পড়েছে এবং এ বৎসর আমি নিউ ইয়র্ককে অনেকটা মাতিয়ে তুলেছি। যদি এই গ্রীষ্মে এখানে থেকে একটি গ্রীষ্মকালীন বাসস্থান করতে পারতাম, তবে এখানকার কাজটা সুদৃঢ় ভিত্তিতে চলতে পারত। কিন্তু মে মাসে ইংলণ্ডে যাবার সঙ্কল্প করেছি বলে এটা অসম্পূর্ণ রেখেই যেতে হবে। অবশ্য কৃষ্ণানন্দ যদি ইংলণ্ডে আসেন এবং তাঁকে তোমার সুদক্ষ ও সুযোগ্য বলে মনে হয় এবং তুমি যদি বুঝতে পার যে, এই গ্রীষ্মে আমার অনুপস্থিতিতে কাজটার ক্ষতি হবে না, তবে গ্রীষ্মটা বরং এখানেই থেকে যাব।
অধিকন্তু ভয় হচ্ছে, অবিরাম কাজের চাপে আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছে। কিছু বিশ্রাম আবশ্যক। এইসব পাশ্চাত্য রীতিতে আমরা অনভ্যস্ত—বিশেষতঃ ঘড়ি-ধরে চলাতে। ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকাখানি এখানে সুন্দর চলছে। আমি ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছি; তা ছাড়া মাসিক কাজের একটা বিবরণও তাদের পাঠাচ্ছি। মিস মূলার আমেরিকায় আসতে চান; আসবেন কিনা জানি না। এখানে জনকয়েক বন্ধু আমার রবিবারের বক্তৃতাগুলি ছাপছেন। প্রথমটির কয়েক কপি তোমায় পাঠয়েছি। আগামী ডাকে পরবর্তী দুটি বক্তৃতার কয়েক কপি পাঠাব, তোমার যদি পছন্দ হয় তবে অনেকগুলি পাঠিয়ে দেব। ইংলণ্ডে কয়েক শত কপি বিক্রীর ব্যবস্থা করতে পার কি?—তাতে ওরা পরবর্তী বক্তৃতাগুলি ছাপতে উৎসাহিত হবে।
আগামী মাসে ডেট্রয়েট যাব, তারপর বোষ্টনে ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। অতঃপর ইংলণ্ডে যাব কিছুদিন বিশ্রাম করে—যদি না তুমি মনে কর যে, আমাকে বাদ দিয়েও কৃষ্ণানন্দের সাহায্যে কাজ চলে যাবে। ইতি
সতত স্নেহাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
২৪২*
228, West 39th St. নিউ ইয়র্ক
২০ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এই সঙ্গে ‘ভক্তিযোগে’র কপি কতকটা পূর্ব থেকেই পাঠাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে ‘কর্ম’ সম্বন্ধেও একটা বক্তৃতা পাঠালাম। এরা এখন একজন সঙ্কেতলিপিকর নিযুক্ত করেছে এবং আমি ক্লাসে যা কিছু বলি, সে সেগুলি টুকে নেয়। সুতরাং এখন তুমি কাগজের জন্য যথেষ্ট মাল পাবে। এগিয়ে চল। স্টার্ডি পরে আরও লিখবে। ইংলণ্ডে এরা নিজেদের একটা কাগজ বের করবে মনে করছে, ‘ব্রহ্মবাদিনে’র জন্য তাই বেশী কিছু করতে পারিনি। কাগজটার বাইরে একটা মানানসই মলাট না দেবার মানেটা কি বল দেখি? এখন কাগজটার ওপর তোমাদের সমুদয় শক্তি প্রয়োগ কর; কাগজটা দাঁড়িয়ে যাক—আমি এটা দেখতে দৃঢ়সঙ্কল্প। ধৈর্য ধরে থাক এবং মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ত হয়ে থাক। নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না। টাকা-কড়ির লেন-দেন বিষযে সম্পূর্ণ খাঁটি হও। তাড়াহুড়ো করে টাকা রোজগারের চেষ্টা করো না—ও-সব ক্রমে হবে। আমরা এখনও বড় বড় কাজ করব, জেনো। প্রতি সপ্তাহে এখান থেকে কাজের একটা রিপোর্ট পাঠান হবে। যতদিন তোমাদের বিশ্বাস, সাধুতা ও নিষ্ঠা থাকবে, ততদিন সব বিষয়ে উন্নতিই হবে। আগামী ডাকে কাগজটা সম্বন্ধে সব কথা আমায় লিখবে।
বৈদিক সূক্তগুলির অনুবাদের সময় ভাষ্যকারদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখো; প্রাচ্যতত্ত্ববিদদের কথায় এতটুকু মনোযোগ দিও না। ওরা আমাদের শাস্ত্রগুলি সম্বন্ধে কিছুই বোঝে না। নীরস ভাষাতত্ত্ববিদেরা ধর্ম বা দর্শন বুঝতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, ঋগ্বেদের ‘আনীদবাতম্’ শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে—‘তিনি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস না নিয়ে বাঁচতে লাগলেন।’ প্রকৃতপক্ষে এখানে মুখ্য প্রাণ সম্বন্ধেই বলা হয়েছে এবং ‘অবাতম্’ শব্দের প্রকৃতিগত অর্থ—অবিচলিতভাবে অর্থাৎ অস্পন্দভাবে। কল্পারম্ভের পূর্বে প্রাণ অর্থাৎ সর্বব্যাপিনী জাগতিক শক্তি যে অবস্থায় থাকে, তারই বর্ণনা দেওয়া হয়েছে (ভাষ্যকারগণ দ্রষ্টব্য)। আমাদের ঋষিদের ভাবানুযায়ী ব্যাখ্যা কর, তথাকথিত পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতানুসারে নয়। তারা কি জানে?
‘ভক্তিযোগ’ সম্বন্ধে লেখাগুলো অনেকটা প্রণালীবদ্ধ আকারে আছে; কিন্তু ক্লাসে যে-সব বলা হয়েছে, সেগুলি অমনি এলোপাতাড়ি—সুতরাং সেগুলি একটু দেখে-শুনে ছাপাতে হবে। তবে আমার ভাবগুলির ওপর বেশী কলম চালিও না। সাহসী ও নির্ভীক হও—তা হলেই রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ‘ভক্তিযোগ’টা বহুদিন ধরে তোমাদের কাগজের খোরাক যোগাবে। তারপর ওটা গ্রন্থাকারে ছাপিও। ভারত, আমেরিকা ও ইংলণ্ডে বইটি খুব বিক্রী হবে। মনে রেখো, থিওসফিষ্টদের সঙ্গে যেন কোন প্রকার সম্বন্ধ না রাখা হয়। তোমরা যদি সকলে আমাকে ত্যাগ না কর, আমার পশ্চাতে ঠিক খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পার এবং ধৈর্য না হারাও, তবে আমি তোমাদের নিশ্চয় করে বলতে পারি, আমরা আরও খুব বড় বড় কাজ করতে পারব! হে বৎস, ইংলণ্ডে ধীরে ধীরে খুব বড় কাজ হবে। আমি বুঝতে পারছি, তুমি মাঝে মাঝে নিরুৎসাহ হয়ে পড়; মনে রেখো, ইতিহাসের এই একমাত্র সাক্ষ্য যে, গুরুভক্ত জগৎ জয় করবে। আমি জি.জি.-র চিঠি পেয়ে ভারি খুশী হয়েছি। বিশ্বাসই মানুষকে সিংহতুল্য বীর্যবান্ করে। তুমি সর্বদা মনে রেখো, আমাকে কত কাজ করতে হয়। কখনও কখনও দিনে দু-তিনটা বক্তৃতা দিতে হয়। এইভাবে সর্বপ্রকার প্রতিকূলতা কাটিয়ে পথ করে নিচ্ছি—কঠিন কাজ! আমার চেয়ে নরম প্রকৃতির লোক হলে এতেই মরে যেত। স্টার্ডির প্রবন্ধটা ছাপিয়েছ কি? মিঃ কৃষ্ণমেনন আমাকে বরাবর বলে এসেছে—সে লিখবে; কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে, সে এখনও কিছু লেখেনি। ইংলণ্ডে সে দুরবস্থায় পড়েছে। আমি তাকে ৮ পাউণ্ড দিয়ে সাহায্য করেছি; এর বেশী কিছু করবার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি বুঝতে পারছি না, সে দেশে ফিরছে না কেন। তার কাছ থেকে কিছু আশা করো না। বিশ্বাস ও দৃঢ়তার সহিত লেগে থাক। সত্যনিষ্ঠ, সাধু ও পবিত্র হও, আর নিজেদের ভেতর বিবাদ করো না। ঈর্ষাই আমাদের জাতির ধ্বংসের কারণ।
ডাক চলে যাচ্ছে—তাড়াতাড়ি চিঠিখানা শেষ করতে হচ্ছে। তোমাকে ও আমাদের সকল বন্ধুবান্ধবকে ভালবাসা জানাচ্ছি। ইতি
বিবেকানন্দ
২৪৩*
[স্বামী সারদানন্দকে লিখিত]
228, W. 39th St. নিউ ইয়র্ক
২৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় শরৎ,
তোমার পত্রপাঠে আমি অত্যন্ত দুঃখিতই হয়েছি। দেখছি, তুমি একেবারে নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছ। আমি তোমাদের সকলকে—তোমাদের ক্ষমতা ও অক্ষমতাকে জানি। তুমি কোন কাজে অপারগ হলে সেই কাজের জন্য তোমায় ডাকতুম না, তোমাকে শুধু সংস্কৃতের প্রাথমিক বিষয়গুলি শেখাতে বলতুম এবং অভিধান প্রভৃতির সাহায্যে অনুবাদ ও অধ্যাপনার কাজে স্টার্ডির সহায়তা করতে বলতুম। তোমাকে ঐ কাজের জন্য গড়ে নিতুম। বস্তুতঃ যে-কেহ ঐ কাজ চালাতে পারত—একান্ত প্রয়োজন ছিল সংস্কৃতের শুধু একটু চলনসই জ্ঞানের। যাক, যা হয় সব ভালর জন্যই। এটা যদি ঠাকুরের কাজ হয়, তবে ঠিক জায়গার জন্য ঠিক লোক যথাসময়ে এসে যাবে। তোমাদের কারও নিজেকে উত্ত্যক্ত মনে করার প্রয়োজন নাই। হাইভিউ, কেভার্শ্যাম, রিডিং, ইংলণ্ড—এই ঠিকানায় স্টার্ডির নিকট টাকা পাঠিয়ে দিও।
‘সা—’র বিষয়ে বক্তব্য এইঃ টাকা কে নিচ্ছে বা না নিচ্ছে, আমি তা গ্রাহ্য করি না, কিন্তু বাল্যবিবাহ আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি। এজন্য ভয়ানক ভুগেছি, আর এই মহাপাপে আমাদের জাতকে ভুগতে হচ্ছে। অতএব এরূপ পৈশাচিক প্রথাকে যদি আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করি, তবে নিজেই নিজের কাছে ঘৃণ্য হব। আমি তোমাকে এ বিষয়ে স্পষ্টই লিখেছিলাম; … বাল্যবিবাহরূপ এই আসুরিক প্রথার উপর আমাকে যথাশক্তি দৃঢ়ভাবে পদাঘাত করতে হবে, সেজন্য তোমার কোন দোষ হবে না। তোমার ভয় হয় তো তুমি দূর হতে নিজেকে বিপদ থেকে বাঁচাও। আমার সঙ্গে তোমার কোন সম্বন্ধ আছে—এটা অস্বীকার করলেই হল; আর আমিও তা দাবী করার জন্য অতিমাত্রায় আগ্রহান্বিত নই। আমি দুঃখিত—অতি দুঃখিত যে ছোট ছোট মেয়েদের বর যোগাড়ের ব্যাপারে আমি মোটেই নিজেকে জড়াতে পারব না; ভগবান্ আমার সহায় হোন! আমি এতে কোনদিন ছিলাম না এবং কোনদিন থাকবও না। ‘ম—’বাবুর কথা ভাবো দেখি! এর চেয়ে বেশী কাপুরুষ বা পশুপ্রকৃতির লোক কখনও দেখেছ কি? মোদ্দা কথা এই—আমার সাহায্যের জন্য এরূপ লোক চাই, যারা সাহসী, নির্ভীক ও বিপদে অপরাঙ্মুখ। আমি খোকাদের ও ভীরুদের চাই না। প্রত্যুত আমি একাই কাজ করব। একটা ব্রত আমায় উদ্যাপন করতে হবে। আমি একাই তা সম্পন্ন করব। কে আসে বা কে যায়, তাতে আমি ভ্রূক্ষেপ করি না। ‘সা—’ ইতোমধ্যেই সংসারে ডুবেছে, আর তোমাতেও দেখছি তার ছোঁয়াচ লাগছে! সাবধান! এখনও সময় আছে। তোমায় এইটুকু মাত্র উপদেশ দেওয়া আমার কর্তব্য মনে করেছিলাম। অবশ্য এখন তোমরাই মস্ত লোক—আমার কথা তোমাদের কাছে মোটেই বিকোবে না। কিন্তু আমি আশা করি—এমন সময় আসবে, যখন তোমরা আরও স্পষ্ট করে দেখতে পাবে, জানতে পারবে এবং সম্প্রতি যেরূপ ভাবছ তা থেকে অন্যরূপ ভাববে।
আমি যোগেনের জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। আমার মনে হয় না যে, কলিকাতা তার পক্ষে অনুকূল। ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে হজমের অপূর্ব উপকার হয়।
এবার আসি। আর তোমাদের বিরক্ত করব না; তোমাদের সকলের সর্বপ্রকার কল্যাণ হোক! আমি অতি আনন্দিত যে, কখনও তোমাদের কাজে লেগেছি—অবশ্য তোমরাও যদি তাই মনে কর। অন্ততঃ গুরুমহারাজ আমার উপর যে কর্তব্য অর্পণ করেছিলেন, তা সম্পন্ন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি—এইভাবে আমি আত্মপ্রসাদ লাভ করছি; ঐ কাজ সুসম্পন্ন হোক আর নাই হোক, আমি চেষ্টা করেছি জেনেই খুশী আছি। সুতরাং তোমাদের নিকট বিদায়! তোমাদের যথেষ্ট শক্তি আছে; আর আমার পক্ষে যতটা হওয়া সম্ভব, তোমরা তার চেয়েও উঁচু; সুতরাং তোমরা নিজেদের পথে চল। ‘সা—’কে বলবে যে, আমি তার উপর মোটেই রাগ করিনি—তবে আমি দুঃখিত, খুব দুঃখিত হয়েছি। এটা টাকার জন্য নয়—টাকাতে আর কি যায় আসে! কিন্তু সে একটা নীতি লঙ্ঘন করেছে এবং আমার উপর ধাপ্পাবাজি করেছে বলেই আমি ব্যথিত হয়েছি। তার কাছে বিদায় নিচ্ছি, আর তোমাদেরও সকলের কাছে। আমার জীবনের একটা পরিচ্ছেদ শেষ হয়ে গেল। অপরেরা তাদের পালা অনুযায়ী আসুক—তারা আমায় প্রস্তুত দেখতে পাবে। তুমি আমার জন্য মোটেই ব্যস্ত হয়ো না। আমি কোন দেশের কোন মানুষের তোয়াক্কা রাখি না। সুতরাং বিদায়। ঠাকুর তোমাদিগকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন! ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
২৪৪*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
ডিসেম্বর, ১৮৯৫
এখানকার কাজ চমৎকার চলিতেছে। এখানে আসার পর হইতেই আমি দৈনিক দুইটি ক্লাসের জন্য অবিরাম খাটিতেছি। আগামীকাল হইতে এক সপ্তাহের অবকাশ লইয়া মিঃ লেগেটের সহিত শহরের বাহিরে যাইতেছি। আপনাদের দেশের জনৈকা প্রসিদ্ধা গায়িকা মাদাম স্টার্লিংকে আপনি জানেন কি? তিনি আমার কাজে বিশেষ আগ্রহান্বিতা।
আমি আমার কাজের বৈষয়িক দিকটা সম্পূর্ণভাবে একটি কমিটির হাতে দিয়া ঐ-সমস্ত ঝঞ্ঝাট হইতে মুক্ত হইয়াছি। বৈষয়িক ব্যবস্থাদি করিবার ক্ষমতা আমার নাই—ঐ-জাতীয় কাজ আমাকে যেন শতধা ভাঙিয়া ফেলে।
নারদসূত্রের কি হইল? আমার বিশ্বাস ঐ বইখানি এখানে প্রচুর বিক্রয় হইবে। আমি এখন ‘যোগসূত্র’ ধরিয়াছি এবং এক একটি সূত্র লইয়া উহার সহিত সকল ভাষ্যকারের মত আলোচনা করিতেছি। এই সমস্তই লিখিয়া রাখিতেছি এবং এই লেখার কাজ শেষ হইলে উহাই ইংরেজীতে পতঞ্জলির পূর্ণাঙ্গ সঠিক অনুবাদ হইবে। অবশ্য গ্রন্থখানি অনেকটা বড় হইয়া যাইবে।
আমার বোধ হয় ট্রুব্নারের দোকানে ‘কূর্মপুরাণের’ একটি সংস্করণ আছে। ভাষ্যকার বিজ্ঞানভিক্ষু পুনঃ পুনঃ ঐ গ্রন্থের বচন উদ্ধৃত করিয়াছেন। আমি গ্রন্থখানি নিজে কখনও দেখি নাই। আপনি কি একবার একটু সময় করিয়া দেখিয়া আসিতে পারেন যে, ঐ গ্রন্থে যোগ সম্বন্ধে গোটা কয়েক পরিচ্ছেদ আছে কিনা? যদি থাকে তবে দয়া করিয়া আমায় একখানি বই পাঠাইয়া দিবেন কি? ‘হঠযোগপ্রদীপিকা’, ‘শিবসংহিতা’ এবং যোগের উপর অন্য কোন গ্রন্থ থাকিলে তাহাও একখানি করিয়া চাই। অবশ্য মূল গ্রন্থগুলিই আবশ্যক। পুস্তকগুলি আসিলেই আমি আপনাকে মূল্য পাঠাইয়া দিব। জন ডেভিসের সম্পাদিত ঈশ্বরকৃষ্ণের ‘সংখ্যাকারিকা’ও একখানি পাঠাইবেন।
এইমাত্র ভারতীয় চিঠিগুলির সহিত আপনার চিঠিও পাইলাম। আসিবার জন্য যে প্রস্তুত, সে অসুস্থ। অন্যেরা বলে যে, তাহারা মুহূর্তের আহ্বানে আসিতে পারে না। এই পর্যন্ত সবই দুরদৃষ্ট মনে হয়। তাহারা না আসিতে পারায় আমি দুঃখিত। কি আর করিব? ভারতে সবই মন্থরগতি।
‘বদ্ধ আত্মায় বা জীবে তাঁহার পূর্ণত্ব অব্যক্ত বা সূক্ষ্মভাবে বিরাজিত; আর যখনই সেই পূর্ণত্বের বিকাশ সাধিত হয়, তখনই জীব মুক্ত হয়’—ইহাই রামানুজের মত। কিন্তু অদ্বৈতবাদী বলেন, ব্যক্ত বা অব্যক্ত কোনটাই প্রকৃত অবস্থা নহে, ঐরূপ প্রতীত হয় মাত্র। উভয় প্রণালীই মায়া—পরিদৃশ্যমান অবস্থা মাত্র।
প্রথমতঃ আত্মা স্বভাবতঃ জ্ঞাতা নহেন। ‘সচ্চিদানন্দ’ সংজ্ঞায় তাঁহাকে আংশিকভাবেই প্রকাশ করা হয় মাত্র, ‘নেতি নেতি’ সংজ্ঞাই তাঁহার স্বরূপ যথাযথ বর্ণনা করে। শোপেনহাওয়ার তাঁহার ‘ইচ্ছাবাদ’ বৌদ্ধদিগের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছেন। বাসনা, তৃষ্ণা বা তঞ্হা (পালি) প্রভৃতি শব্দেও ঐ ভাবটিই প্রকাশিত হইয়াছে। আমরাও ইহা স্বীকার করি যে, বাসনাই সর্ববিধ অভিব্যক্তির কারণ এবং ইহাই কার্যরূপে পরিণত হয়। কিন্তু যাহাই ‘হেতু’ বা ‘কারণ’, তাহাই সেই (সগুণ) ব্রহ্ম এবং মায়া—এই দুইয়ের সংমিশ্রণে উদ্ভূত। এমন কি ‘জ্ঞান’ও একটি যৌগিক পদার্থ বলিয়া অদ্বৈতবস্তু হইতে একটু স্বতন্ত্র। তবে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত সর্বপ্রকার বাসনা হইতেই উহা নিঃসংশয়ে শ্রেষ্ঠ এবং অদ্বিতীয়ের নিকটতম বস্তু। সেই অদ্বৈত-তত্ত্ব প্রথমে জ্ঞান এবং তারপর ইচ্ছার সমষ্টিরূপে প্রতিভাত হন।
উদ্ভিদমাত্রই ‘অচেতন’ অথবা বড়জোর ‘চৈতন্য-বিবর্জিত ক্রিয়াশক্তি মাত্র’ বলিয়া যদি আপত্তি উত্থাপিত হয়, তবে উত্তরে বলা যাইতে পারে যে, এই অচেতন উদ্ভিদশক্তিও সেই বিরাট বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিশক্তি, যাহাকে সাংখ্যকার ‘মহৎ’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন—সেই এক চেতন ইচ্ছারই অভিব্যক্তি।
বস্তু জগতের সব কিছুই সেই ‘এষণা’ বা ‘সঙ্কল্প’রূপ আদি বস্তু হইতে উদ্ভূত—বৌদ্ধদিগের এই মতবাদ অসম্পূর্ণ; কারণ প্রথমতঃ ‘ইচ্ছা’ একটি যৌগিক পদার্থ এবং দ্বিতীয়ঃ জ্ঞান বা চেতনারূপ যে প্রাথমিক যৌগিক পদার্থ, উহা ইচ্ছারও পূর্বে বিরাজ করে। জ্ঞানই ক্রিয়াতে পরিণত হয়। প্রথমে ক্রিয়া, তারপর প্রতিক্রিয়া। মন প্রথমে অনুভব করে এবং তৎপর প্রতিক্রিয়ারূপে উহাতে সঙ্কল্পের উদয় হয়। মনেই সঙ্কল্পের স্থিতি, সুতরাং সঙ্কল্পকে মূল বস্তু বলা ভুল।
ডয়সন্ ডারুইন-মতাবলম্বিগণের হাতে ক্রীড়াপুত্তলিকা মাত্র। বস্তুতঃ ক্রমবিকাশবাদকে উচ্চতর পদার্থবিজ্ঞানের সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। ‘ব্যক্ত’ এবং ‘অব্যক্ত’ ভাব যে পরস্পরকে নিত্য অনুবর্তন করিয়া থাকে—এ তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানই প্রমাণ করিতে পারে। কাজেই ‘বাসনা’ বা ‘সঙ্কল্পের’ যে অভিব্যক্তি, তাহার পূর্বাবস্থায় ‘মহৎ’ বা ‘বিশ্বচেতনা’ গুপ্ত অথবা সূক্ষ্মভাবে বিরাজ করে। জ্ঞান ভিন্ন সঙ্কল্প অসম্ভব। কারণ আকাঙ্ক্ষিত বস্তু সম্বন্ধে যদি কোন জ্ঞান না থাকে, তবে আকাঙ্ক্ষার উদয় হইবে কিরূপে?
বিশ্ব-চেতনা বা মহৎ (Universal Consciousness) | ||
---|---|---|
| অবচেতন (Sub-conscious) | | | সজ্ঞান (Conscious) | | | অতিচেতন (Superconscious) | |
চৈতন্য-বিবর্জিত সঙ্কল্প বা ক্রিয়া (Unconsious Will) | যথার্থ সজ্ঞান সঙ্কল্প (Conscious Will Proper) | অতীন্দ্রিয় জ্ঞান সঙ্কল্প (Superconscious Will) |
এ তত্ত্ব আপাতদৃষ্টিতে যতটা দুর্বোধ্য বলিয়া মনে হয়, জ্ঞানকে ‘চেতন’ ও ‘অবচেতন’ এই দুই অবস্থায় বিভক্ত করিলে ঐ দুর্বোধ্যতা অন্তর্হিত হয়। এবং তাহা না হইবার বা হেতু কি? যদি ‘সঙ্কল্প’ বস্তুটিকেই আমরা ঐরূপে বিশ্লেষণ করিয়া দেখিতে পারি, তবে উহার জনক বস্তুটিকেই বা বিশ্লেষণ করা যাইবে না কেন?
বিবেকানন্দ
২৪৫*
[মিস ফার্মারকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় ভগিনী,
এই জগৎ—যেখানে কিছুই নষ্ট হয় না, যেখানে আমরা জীবনেই মৃত্যুর মধ্যে বাস করি, সেখানে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, জনাকীর্ণ নগরীর পথে বা আদিম যুগের নিবিড় নিভৃত অরণ্যে, যা-কিছু চিন্তা করা হয়েছে, তা-ই থেকে যায়। তারা ক্রমাগত রূপপরিগ্রহ করবার চেষ্টা করছে, এবং যতদিন না প্রকাশ পাচ্ছে, ততদিন অভিব্যক্ত হবার জন্য চেষ্টা করবেই এবং তাদের যতই চাপবার চেষ্টা করা হোক না কেন, তারা কিছুতেই নষ্ট হবে না। কিছুরই বিনাশ নাই—যে-সকল চিন্তা অতীতে অনিষ্টসাধন করেছিল, তারাও রূপপরিগ্রহের চেষ্টা করছে, তারাও পুনঃ পুনঃ প্রকাশের দ্বারা শুদ্ধ হয়ে অবশেষে সম্পূর্ণ সৎ চিন্তায় রূপায়িত হবার চেষ্টা করছে।
সুতরাং বর্তমান কালেও এমন কতকগুলি ভাবরাশি বিদ্যমান, যেগুলি আত্মপ্রকাশে সচেষ্ট। এই অভিনব ভাবরাশি আমাদের বলছে যে, আমাদের অন্তরে যে দ্বৈতবাদের কল্পনা আছে, কোন বস্তু স্বরূপতঃ ভাল বা মন্দ এবংবিধ যে কল্পনা আছে ও তাদের দাবানর জন্য যে ততোধিক উৎকট বৃথা আশা রয়েছে—এ সমস্তকেই পরিহার করতে হবে। ঐ ভাবরাশি আমাদের শেখাচ্ছে, জগতে উন্নতির রহস্য প্রবৃত্তির উচ্ছেদ নহে, পরন্তু উচ্চতর দিকে তার মোড় ফিরিয়ে দেওয়া। ঐ ভাবরাশি শেখাচ্ছে, এই জগৎ ভাল ও মন্দ দিয়ে প্রস্তুত নয়; প্রত্যুত এর উপাদান হচ্ছে ভাল, তার চেয়ে ভাল এবং তার চেয়ে আরও ভাল। সকলে গ্রহণ না করা পর্যন্ত ঐ ভাব শান্ত হয় না। ঐ ভাব শিক্ষা দেয় যে, কোন অবস্থাতেই একেবারে হাল ছেড়ে দেবার দরকার নেই; সুতরাং যে-কোন মনোবৃত্তি, নীতি বা ধর্মকে ঐ ভাব যে-অবস্থায় পায়, সে-অবস্থাতেই সাদরে গ্রহণ করে, এবং সেগুলির উপর বিন্দুমাত্র দোষারোপ না করে বলে, ‘এ পর্যন্ত ভালই করেছ, এখন আরও ভাল করার সময় এসেছে।’ প্রাচীন- কালে চিন্তা করা হত—মন্দকে বর্জন করতে হবে, এই নতুন শিক্ষানুসারে বলা হয়, মন্দ রূপান্তরিত হবে—ভাল থেকে আরও ভাল করবার চেষ্টা করতে হবে। সর্বোপরি এই ভাব শিক্ষা দেয়, যদি পাবার আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে দেখবে যে, স্বর্গরাজ্য আগে থেকেই বিদ্যমান; মানুষের যদি দেখবার সাধ থাকে, তবে সে দেখবে, সে পূর্ব থেকেই পূর্ণ।
বিগত গ্রীষ্মঋতুতে গ্রীনএকারে যে সভাগুলি হয়েছিল, সেগুলি যে এত চমৎকার হয়েছে, তার একমাত্র কারণ, তুমি পূর্বোক্ত ভাবপ্রকাশের উপযুক্ত যন্ত্রস্বরূপ হয়ে অন্তরে ঐ ভাব যাতে অবাধে প্রবেশ করে, তার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত রেখেছিলে, স্বর্গরাজ্য যে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান—নতুন চিন্তাপ্রণালীর এই সর্বোচ্চ শিক্ষারূপ ভিত্তির উপর তুমি দণ্ডায়মান ছিলে।
তুমি এই ভাব জীবনে পরিণত করে দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখাবার উপযুক্ত আধাররূপে প্রভু কর্তৃক মনোনীত ও আদিষ্ট হয়েছ, এবং যে তোমাকে এই অদ্ভুত কার্যে সহায়তা করবে, সে প্রভুরই সেবা করবে।
আমাদের শাস্ত্রে আছে—‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ।’ অর্থাৎ যারা আমার ভক্তগণের ভক্ত, তারা আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত। তুমি প্রভুর সেবিকা; সুতরাং আমি যেখানেই থাকি না কেন, ভগবৎপ্রেরণায় তুমি যে মহোচ্চ ব্রতে দীক্ষিত হয়েছ, তার উদ্যাপনে যে-কোন প্রকারে সহায়তা করতে পারি, শ্রীকৃষ্ণের অনুগামী আমি তৎসাধনে নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করব ও তা সাক্ষাৎ প্রভুরই সেবা বলে মনে করব। ইতি
তোমার চিরস্নেহাবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
২৪৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
রিজলী ম্যানর
২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
বক্তৃতার নকলগুলি ইতোমধ্যে নিশ্চয়ই আপনার কাছে গিয়ে পৌঁছেছে। আশা করি সেগুলি কোন কাজে আসতে পারে।
আমার মনে হয়, প্রথমতঃ অনেক অসুবিধা অতিক্রম করতে হবে; দ্বিতীয়তঃ তারা নিজেদের কোন কাজেরই উপযুক্ত মনে করে না—এই হল ও-দেশের জাতীয় ব্যাধি; তৃতীয়তঃ তারা এখনই শীতের সম্মুখীন হতে সাহস করছে না; তিব্বতের লোকটিকে ইংলণ্ডে কাজ করার মত খুব শক্তসমর্থ বলে তারা মনে করে না। শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক, কেউ না কেউ আসবে।
বিবেকানন্দ
পুনঃ—আমাদের বন্ধুদের আমার বড়দিনের অভিনন্দন জানাবেন—মিসেস ও মিঃ জনসন, লেডী মারগেসন (Lady Margesson), মিসেস ক্লার্ক, মিস হয়েস (Miss Hawes), মিস মূলার, মিস স্টীল (Miss Steel) এবং বাকী সকলকে।
শিশুকে আমার হয়ে চুম্বন ও আশীর্বাদ দিবেন। মিসেস স্টার্ডিকে আমার নমস্কার। আমরা কাজ করবই। ‘ওয়া গুরুজী কি ফতে।’
—বি
২৪৭
[মঠে সকলকে লক্ষ্য করিয়া লিখিত]
১৮৯৫
প্রিয়বরেষু,
সাণ্ডেল যে যে পুস্তক পাঠাইয়াছিল, তাহা পৌঁছিয়াছে—এ-কথা লিখিতে ভুল হয়। তাহাকে জ্ঞাত করিবে। তোমাদের জন্য লিখি—
১| পক্ষপাতই সকল অনিষ্টের মূল কারণ জানিবে। অর্থাৎ যদ্যপি তুমি কাহারও প্রতি অধিক স্নেহ অন্যাপেক্ষা দেখাও, তাহা হইলেই ভবিষ্যৎ বিবাদের মূল পত্তন হইবে।
২| কেহ তোমার নিকট অপর কোন ভাইয়ের নিন্দা করিতে আসিলে তাহা বিলকুল শুনিবে না—শুনাও মহাপাপ, ভবিষ্যৎ বিবাদের সূত্রপাত তাহাতে।
৩| অধিকন্তু সকলের দোষ সহ্য করিবে, লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিবে এবং সকলকে তুমি যদি নিঃস্বার্থভাবে ভালবাস, সকলেই ধীরে ধীরে পরস্পরকে ভালবাসিবে। একের স্বার্থ অন্যের উপর নির্ভর করে, এ-কথা বিশেষরূপে বুঝিতে পারিলেই সকলে ঈর্ষা একেবারে ত্যাগ করিবে; দশজনে মিলিয়া একটা কার্য করা—আমাদের জাতীয় চরিত্রের মধ্যেই নাই, এজন্য ঐ ভাব আনতে অনেক যত্ন চেষ্টা ও বিলম্ব সহ্য করিতে হইবে। আমি তোমাদের মধ্যে তো বড় ছোট দেখিতে পাই না, কাজের বেলায় সকলেই মহাশক্তি প্রকাশ করিতে পারে, আমি দেখিতে পাইতেছি। শশী কেমন স্থান জাগিয়ে বসে থাকে; তার দৃঢ়নিষ্ঠা একটা মহাভিত্তিস্বরূপ। কালী ও যোগেন টাউন-হল মিটিং কেমন উত্তমরূপে সিদ্ধ করিল—কত গুরুতর কার্য! নিরঞ্জন সিলোন (সিংহল) প্রভৃতি স্থানে অনেক কার্য করিয়াছে। সারদা কত দেশ পর্যটন করিয়া বড় বড় কার্যের বীজ বপন করিয়াছে। হরির বিচিত্র ত্যাগ, স্থিরবুদ্ধি ও তিতিক্ষা আমি যখনই মনে করি, তখনই নূতন বল পাই। তুলসী, গুপ্ত, বাবুরাম, শরৎ প্রভৃতি সকলের মধ্যেই এক এক মহাশক্তি আছে। তিনি যে জহুরী ছিলেন, তাতে এখনও যদি সন্দেহ হয়, তাহলে তোমাতে আর উন্মাদে তফাত কি? দেখ এদেশে শত শত নরনারী প্রভুকে সকল অবতারের শ্রেষ্ঠ বলিয়া পূজা করিতে আরম্ভ করিতেছে। ধীরে ধীরে—মহাকার্য ধীরে ধীরে হয়। ধীরে ধীরে বারুদের স্তর পুঁতিতে হয়; তারপর একদিন এক কণা অগ্নি—আর সমস্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে!
তিনি কাণ্ডারী; ভয় কি? তোমরা অনন্তশক্তিমান্—সামান্য ঈর্ষাবুদ্ধি ও অহংপূর্ণবুদ্ধি দমন করিতে তোমাদের ক-দিন লাগে? যখনই ঐ বুদ্ধি আসিবে, প্রভুর কাছে শরণ লও। শরীর মন তাঁর কাছে সঁপে দাও দেখি, হাঙ্গাম মিটে যাবে একদম।
যে বাড়ীতে তোমরা আপাততঃ আছ, তাহাতে স্থান পূর্ণ হইবে না, দেখিতে পাইতেছি। একটা প্রশস্ত বাটীর দরকার, অর্থাৎ সকলে গুঁতোগুঁতি করে একঘরে শোবার আবশ্যক নাই। পারতপক্ষে একঘরে দুই জনের অধিক থাকা উচিত নহে। একটা বড় হল, সেখানে পুঁথি-পাটা রাখিবে।
প্রত্যহ প্রাতঃকালে ও সন্ধ্যাকালে কালী, হরি, তুলসী, শশী প্রভৃতি অদল-বদল করে, যেন কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ শাস্ত্রপাঠ করে, ও পরে সন্ধ্যাকালে আর একবার পাঠ ও ধ্যান-ধারণা একটু ও সঙ্কীর্তনাদি হয়। একদিন যোগ, একদিন ভক্তি, একদিন জ্ঞান ইত্যাদি বিভাগ করিয়া লইলেই হইবে। এইমত একটা routine (পাঠের ক্রম) করিয়া লইলেই বড়ই মঙ্গলের বিষয়—সন্ধ্যাকালের পাঠাদির সময় সাধারণ লোকেরা যাহাতে আসিতে পারে; এবং প্রতি রবিবার দশটা হইতে নাগাত রাত্র ক্রমান্বয়ে পাঠ-কীর্তনাদি হওয়া উচিত, সেটা public-এর (সাধারণের) জন্য। এই নিয়মাদি করে কিছুদিন কষ্ট করে চালিয়ে দিলেই পরে আপনা হতে গড় গড় করে চলে যাবে। উক্ত হলে যেন তামাক খাওয়া না হয়। তামাক খাবার একটা যেন আলাহিদা জায়গা থাকে। এই ভাবটা তুমি যদি পরিশ্রম করে ধীরে ধীরে আনতে পার, তা হলে বুঝতাম অনেক কাজ এগলো। কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
পুনঃ—হরমোহন নাকি একটা কাগজ বার করবার যোগাড় করছিল, তার কি হল? কালী, শরৎ, হরি, মাষ্টার, G. C. Ghose (গিরিশবাবু) যোগাড় করে একটা যদি পার তো ভালই বটে।
—ন
২৪৮
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
১৮৯৫
অভিন্নহৃদয়েষু,
এইমাত্র তোমার পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। ভারতবর্ষে কার্য হোক না হোক, কার্য এদেশে। কাহারও এক্ষণে আসিবার দরকার নাই। আমি দেশে গিয়ে কয়েকজনকে তৈয়ার করে তুলব, তারপর পাশ্চাত্য দেশে কোন ভয় থাকিবে না। গুণনিধির কথাই লিখিয়াছিলাম। হরি সিং প্রভৃতি সকলকে বিশেষ প্রেম আশীর্বাদ দিবে। ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে থাকিবে না। কার সাধ্য খেতড়ির রাজাকে দাবায়? মা জগদম্বা তার শিয়রে। কালীরও চিঠি পেয়েছি—কাশ্মীরে যদি centre (কেন্দ্র) করতে পার তো বড়ই ভাল হয়। যেখানে পার একটা সেণ্টার কর। এখন এদেশে আর বিলেতে আমার গোড়া বেঁধে গেছে; কারু সাধ্যি কি তা টলায়? নিউ ইয়র্ক এবার তোলপাড়! আসছে গরমিতে লণ্ডন তোলপাড়! বড় বড় হাতী দিগ্গজ ভেসে যাবে। পুঁটি-পাঁটার কি খবর রে দাদা? তোরা কোমর বেঁধে লেগে যা দেখি, হুহুঙ্কারে দুনিয়া তোলপাড় করে দেব। এই তো সবে সন্ধ্যা রে ভাই!
দেশে কি মানুষ আছে? ও শ্মশানপুরী। যদি lower classদের education (নিম্নশ্রেণীদের শিক্ষা) দিতে পার, তা হলে উপায় হতে পারে। জ্ঞানবলের চেয়ে বল আর কি আছে—বিদ্যা শেখাতে পার? বড়-মানুষেরা কোন্ কালে কোন্ দেশে কার কি উপকার করেছে? সকল দেশেই বড় বড় কাজ গরীবরা করে। টাকা আসতে কতক্ষণ? মানুষ কই? দেশে কি মানুষ আছে? দেশের লোকগুলো বালক, ওদের সঙ্গে বালকের ন্যায় ব্যবহার করতে হবে। ওদের বুদ্ধিশুদ্ধি দশ বছরের মেয়ে বে করে করে খরচ হয়ে গেছে।
কারুর সঙ্গে ঝগড়া না করে মিলেমিশে চলে যাও—এ দুনিয়া বড়ই ভয়ানক, কাউকেই বিশ্বাস নাই। ভয় নাই, মা আমার সহায়—এমন কাজ এবার হবে যে, তোরা অবাক হয়ে যাবি।
ভয় কি? কার ভয়? ছাতি বজ্র করে লেগে যাও। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
পুনঃ—সারদা কি বাঙলা কাগজ বার করবে বলছে? সেটার বিশেষ সাহায্য করবে, সে মতলবটা মন্দ নয়। কারুর উৎসাহ ভঙ্গ করতে নাই। Criticism (বিরুদ্ধ সমালোচনা) একেবারে ত্যাগ করবে। যতদূর ভাল বোধ হয়, সকলকে সাহায্য করবে; যেখানটা ভাল না বোধ হয়, ধীরে বুঝিয়ে দিবে। পরস্পরকে criticise (বিরুদ্ধভাবে সমালোচনা) করাই সকল সর্বনাশের মূল! দল ভাঙবার ঐটি মূলমন্ত্র। ‘ও কি জানে?’ ‘সে কি জানে?’ ‘তুই আবার কি করবি?’—আর তার সঙ্গে ঐ একটু মুচকে হাসি, ঐগুলো হচ্ছে ঝগড়া-বিবাদের মূলসূত্র।
২৪৯
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৫
কল্যাণবরেষু,
তোমার এক পত্র কাল পাই, তাহাতে কতকমত সমাচার পাই। সবিশেষ কিছুই নাই, এই মাত্র। আমার শরীর এক্ষণে অনেক ভাল। এ বৎসর প্রচণ্ড শীত প্রভুর কৃপায় কিছুই লাগে না; কি দোর্দণ্ড শীত! তবে এদের বিদ্যের জোরে সব দাবিয়ে রাখে। প্রত্যেক বাটীর নীচের তলা মাটির ভেতর, তার মধ্যে বৃহৎ বয়লার—সেখানে হতে গরম হাওয়া বা ষ্টীম ঘরে ঘরে রাতদিন ছুটছে। তাইতে সব ঘর গরম, কিন্তু ইহার এক দোষ যে, ঘরের ভেতর গরমি কাল আর বাইরে জিরোর (শূন্যের) নীচে ৩০|৪০ ডিগ্রী! এদেশের বড় মানুষেরা অনেকেই শীতকালে ইওরোপ পালায়—ইওরোপ অপেক্ষাকৃত গরম দেশ।
যাক, এক্ষণে তোমাকে গোটা-দুই উপদেশ দিই। এই চিঠি তোমার জন্য লেখা হচ্ছে। তুমি এই উপদেশগুলি রোজ একবার করে পড়বে এবং সেই রকম কাজ করবে। সারদার চিঠি পাইয়াছি—সে উত্তম কার্য করিতেছে—কিন্তু এক্ষণে organization (সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া কার্য করা) চাই। তাহাকে আমার বিশেষ প্রেমালিঙ্গন, আশীর্বাদ—তারকদাদা প্রভৃতি সকলকে দিবে। তোমাকে আমার এই ক-টি উপদেশ দিবার কারণ এই যে, তোমাতে organization power (সঙ্ঘগঠন ও পরিচালন-শক্তি) আছে—এ-কথা ঠাকুর আমায় বললেন, কিন্তু এখনও ফোটে নাই। শীঘ্রই তাঁর আশীর্বাদে ফুটবে। তুমি যে কিছুতেই centre of gravity (ভারকেন্দ্র) ছাড়িতে চাও না, ইহাই তাহার নিদর্শন, তবে intensive and extensive (গভীর ও উদার) দুই হওয়া চাই।
১| এ জগতে যে ত্রিবিধ দুঃখ আছে, সর্বশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত এই যে, তাহা নৈসর্গিক (natural) নহে, অতএব অপনেয়।
২| বুদ্ধাবতারে প্রভু বলিতেছেন যে, এই আধিভৌতিক দুঃখের কারণ ‘জাতি’, অর্থাৎ জন্মগত বা গুণগত বা ধনগত সর্বপ্রকার জাতিই এই দুঃখের কারণ। আত্মাতে স্ত্রী-পুং-বর্ণাশ্রমাদি ভাব নাই এবং যে-প্রকার পঙ্ক দ্বারা পঙ্ক ধৌত হয় না, সে-প্রকার ভেদবুদ্ধি দ্বারা অভেদ সাধন হওয়া সম্ভব নহে।
৩| কৃষ্ণাবতারে বলিতেছেন যে, সর্বপ্রকার দুঃখের কারণ ‘অবিদ্যা’। নিষ্কাম কর্ম দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়; কিন্তু ‘কিং কর্ম কিমকর্মেতি’ ইত্যাদি (কোন্টি কর্ম, কোন্টি অকর্ম—এই বিষয়ে জ্ঞানীরাও মোহিত হন)।
৪| যে কর্মের দ্বারা এই আত্মভাবের বিকাশ হয়, তাহাই কর্ম। যদ্দ্বারা অনাত্মভাবের বিকাশ, তাহাই অকর্ম।
৫| অতএব ব্যক্তিগত, দেশগত ও কালগত কর্মাকর্মের সাধন।
৬| যজ্ঞাদি প্রাচীন কালে উপযুক্ত ছিল, তথা জাত্যাদি কর্ম; আধুনিক সময়ের জন্য তাহা নহে।
৭| রামকৃষ্ণাবতারের জন্মদিন হইতেই সত্যযুগোৎপত্তি হইয়াছে।
৮| রামকৃষ্ণাবতারে জ্ঞানরূপ অসি দ্বারা নাস্তিকতারূপ ম্লেচ্ছনিবহ ধ্বংস হইবে এবং ভক্তি ও প্রেমের দ্বারা সমস্ত জগৎ একীভূত হইবে। অপিচ এ অবতারের রজোগুণ অর্থাৎ নামযশাদির আকাঙ্ক্ষা একেবারেই নাই, অর্থাৎ যে তাঁহার উপদেশ গ্রহণ করে, সেই ধন্য; তাঁহাকে মানে বা নাই মানে, ক্ষতি নাই।
৯| প্রাচীন কালে বা আধুনিক কালে সাম্প্রদায়িকেরা ভুল করে নাই। They have done well, but they must do better (তাহারা ভালই করিয়াছে, তবে তাহাদিগকে আরও ভাল করিতে হইবে)। কল্যাণ—তর—তম।
১০| অতএব সকলকে—যেখানে তাহারা আছে, সেইখানেই গ্রহণ করিতে হইবে, অর্থাৎ কাহারও ভাবে ব্যাঘাত না করিয়া উচ্চতর ভাবে লইয়া যাইতে হইবে। তথা সামাজিক অবস্থামধ্যে যাহা আছে, তাহা উত্তম, কিন্তু উৎকৃষ্ট-তর-তম করিতে হইবে।
১১| জগতের কল্যাণ স্ত্রীজাতির অভ্যুদয় না হইলে সম্ভাবনা নাই, এক পক্ষে পক্ষীর উত্থান সম্ভব নহে।
১২| সেইজন্যই রামকৃষ্ণাবতারে ‘স্ত্রীগুরু’-গ্রহণ, সেইজন্যই নারীভাবসাধন, সেইজন্যই মাতৃভাব-প্রচার।
১৩| সেইজন্যই আমার স্ত্রী-মঠ স্থাপনের জন্য প্রথম উদ্যোগ। উক্ত মঠ গার্গী, মৈত্রেয়ী এবং তদপেক্ষা আরও উচ্চতরভাবাপন্না নারীকুলের আকরস্বরূপ হইবে।
১৪| চালাকি দ্বারা কোন মহৎ কার্য হয় না। প্রেম, সত্যানুরাগ ও মহাবীর্যের সহায়তায় সকল কার্য সম্পন্ন হয়। তৎ কুরু পৌরুষম্ (সুতরাং পৌরুষ প্রকাশ কর)।
১৫| কাহারও সহিত বিবাদ-বিতর্কে আবশ্যক নাই। তোমার যাহা শিখাইবার আছে শিখাও—অন্যের খবরে আবশ্যক নাই। Give your message, leave others to their own thoughts (তোমার যাহা শিখাইবার আছে শিখাও, অপরে নিজ নিজ ভাব লইয়া থাকুক)। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতং’—তদা কিং বিবাদেন? (সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার জয় কখনও হয় না; তবে বিবাদের প্রয়োজন কি?)
এক্ষণে তোমাকে কিঞ্চিৎ বিষয়কার্য শিখাই। প্রথমতঃ যখন আমাকে বা অন্য কাহাকেও পত্র লিখিবে, তখন পূর্বপত্র পাঠ করিয়া সকল প্রশ্নের উত্তর দিবে। বাজে খবর দিবে না। গম্ভীর ভাব রাখিতে হইবে। বাল্যগাম্ভীর্যভাব মিশ্রিত করিবে। সকলের সহিত মিশিয়া চলিবে। অহংভাব দূর করিবে, সম্প্রদায়-বুদ্ধিবিহীন হইবে, বৃথা তর্ক মহাপাপ।
ম্যাক্সমূলার তোমাদের এক পুস্তক পাঠাইয়াছেন। তাঁহাকে বিনয়পূর্ণ উত্তর দিয়াছ কিনা, এ-কথা লেখ নাই। আমি কাহাকে টাকা পাঠাইব, তাহা লেখ নাই। কেমন করিয়া পাঠাইব? … প্রায় দেড় মাসে একখানা পত্র আসে, একটা ভুল শোধরাইতে তিন মাস লাগে। এই কথা সদা মনে রাখিবে। সারদার পত্রে অবগত হইলাম N. Ghose (ঘোষ) আমাকে যীশুখ্রীষ্টাদির সহিত তুলনা করিয়াছেন। ও-সকল আমাদের দেশে ভাল বটে; কিন্তু এদেশে ছাপাইয়া পাঠাইলে আমার অবমানের সম্ভাবনা। আমি কাহারও ভাবে ব্যাঘাত করি না, আমি কি মিশনরী? যদি কালী ঐ-সকল কাগজ এতদ্দেশে না পাঠাইয়া থাকে, তাহা হইলে পাঠাইতে নিষেধ করিবে। কেবল Address (অভিনন্দন) পাঠাইলেই যথেষ্ট, proceedings-এ (কার্য বিবরণীতে) কোন আবশ্যক নাই। এক্ষণে এতদ্দেশের অনেক মান্যগণ্য নরনারী আমায় শ্রদ্ধা করেন। মিশনরী প্রভৃতিরা বহু চেষ্টা করিয়া এক্ষণে হার মানিয়া শান্তি অবলম্বন করিয়াছে। সকল কার্যই নানা বিঘ্নের মধ্যে সমাধান হয়। শান্তভাব অবলম্বন করিলেই সত্যের জয় হয়। হাড্সন (Hudson) নামক কে কি বকিয়াছে, তাহাকে আমার জবাব দিবার কোন আবশ্যক নাই। প্রথমতঃ অনাবশ্যক, দ্বিতীয়তঃ তাহা হইলে আমি হাড্সন প্রভৃতি ফেরুপুঞ্জের সমদেশবর্তী হইব। তুমি উন্মাদ নাকি? আমি এখান হইতে কে এক হাড্সনের সহিত লড়াই করিব? প্রভুর কৃপায় হাড্সন বাড্সনের গুরুর গুরুরা আমার কথা ভক্তিভাবে গ্রহণ করে। তুমি কি পাগল নাকি? খবরের কাগজ প্রভৃতি আর পাঠাইও না। ও-সকল দেশে চলুক, হানি নাই। ও-সকল কাগজে নামের প্রয়োজন ছিল, প্রভুর কার্যের জন্য। যখন তাহা সমাহিত হইয়াছে, তখন আর আবশ্যক নাই। আমার প্রত্যেক পত্রাদি গোপন করিবে, ঝট করিয়া কাগজে ছাপাইবে না। নামযশের ঐ দায়—কিছু গোপন রাখা যায় না। আমার চিঠি পূর্বের ভাবের মত হাটের মাঝে পড়িবে না। কথা কানে হাঁটে, মনে রাখিবে। মা-ঠাকুরাণীর জন্য পত্রপাঠ জায়গা অনুসন্ধান করিবে।
ঠাকুরের কাছে সকল কার্যের প্রারম্ভে প্রার্থনা করিবে। তিনি সৎ পন্থা দেখাইবেন। একটা বড় জমি প্রথমে চাই; তার পর বাড়ী ঘর সব হবে। আমাদের মঠ ধীরে ধীরে হবে, ভাবনা নাই। যখন আমাকে চিঠি লিখিবে, বিশেষ চিন্তা করে আবশ্যক সমাচার বিস্তারিতভাবে দিবে—অনাবশ্যক অর্থাৎ ঝগড়াঝাঁটি আমার শুনিবার সময় নাই।
কালী প্রভৃতি সকলেই উত্তম কার্য করিতেছে। সকলকেই আমার প্রেমালিঙ্গন দিও। মান্দ্রাজীদের সহিত মিলে মিশে কাজ করিবে এবং মধ্যে মধ্যে একজন তথায় যাইও। নামযশ কর্তৃত্বের বাসনা জন্মের মত ত্যাগ করিবে। আমি যতদিন পৃথিবীতে আছি, তিনি আমার মধ্যে কার্য করিতেছেন—ইহাতে তোমাদের যতদিন বিশ্বাস থাকিবে, ততদিন কোন অমঙ্গলের সম্ভাবনা নাই।
শাঁকচুন্নী যে ঠাকুরের পুঁথি পাঠাইয়াছে, তাহা পরম সুন্দর। কিন্তু প্রথমে শক্তির বর্ণনা নাই, এই মহাদোষ। দ্বিতীয় edition (সংস্করণ)-এ শুদ্ধ করিতে বলিবে। এই কথা মনে সদা রাখিবে যে, আমরা এক্ষণে জগতের সমক্ষে দণ্ডায়মান। আমাদের প্রত্যেক কার্য, প্রত্যেক কথা লোকে দেখিতেছে, শুনিতেছে—এই ভাব মনে রাখিয়া সকল কার্য করিবে।
যদি তুমি—কাহাকে টাকা পাঠাইব অর্থাৎ—কাহার নামে লিখিতে, তাহা হইলে আজই আমি টাকা পাঠাইতাম। টাকা পাইবামাত্রই জমি খরিদ করিবে। আপাততঃ আমার নামে খরিদ করিবে। পরে আমাদের মঠের জন্য একটা জমি দেখিতে থাক। কাছাকাছি হওয়া চাই, অর্থাৎ দুইটা জমি যাহাতে অতি নিকটে হয়, এমত চেষ্টা করিবে। কলিকাতা হইতে কিছু দূরে হয়, চিন্তা নাই; যেখানে আমরা মঠ বসাইব, সেথাই ধুম মাচিবে।
মহিম চক্রবর্তীর কথায় আমি পরম আনন্দিত হইলাম—এণ্ডিস্ পর্বতে এক্ষণে গয়াক্ষেত্র বনিয়া গেল যে! সে কোথায়? তাহাকে, বিজয় গোস্বামীকে ও আমাদের বন্ধুবর্গকে আমার বিশেষ প্রণয়-সম্ভাষণ দিবে। … পরকে মারিতে গেলে ঢাল খাঁড়া চাই, অতএব ইংরেজী ও সংস্কৃত বিশেষরূপে অধ্যয়ন করিবে। কালীর ইংরেজী দিন দিন বেশ পরিষ্কার হইতেছে। সারদার ইংরেজীর অধোগতি হইতেছে; তাহাকে flowery style (ফেনান ভাষা) পরিত্যাগ করিতে হইবে। বিজাতীয় ভাষায় flowery style লেখা বড়ই দুষ্কর। তাহাকে আমার লক্ষ ‘সাবাস্’—ওহি মরদ্কা কাম; তারকদাদাকেও grammar (ব্যাকরণ)-টা একবার উল্টে নিতে বলবে। তারকদাদার ইংরেজী ক্রমশঃ দুরস্ত হয়ে আসছে। সকলেই well done, ‘সাবাস্, বাহাদুরোঁ’। আরম্ভ অতি সুন্দর হয়েছে। ঐ ডৌলে চল। ঈর্ষা-সর্পিণী যদি না আসে তো কোন ভয় নাই, মাভৈঃ। ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’। সকলে একটু গম্ভীরভাব ধারণ করিবে।
আমি হিন্দুধর্মের উপর কোন পুস্তক এক্ষণে লিখিতেছি না। তবে আমার মনের ভাব লিপিবদ্ধ করিতেছি। Every religion is an expression, a language to express the same truth, and we must speak to each in his own language.৮৮ —সারদা এ কথা বুঝিয়াছে বেশ। হিন্দুধর্ম পরে দেখা যাইবে। হিন্দুধর্ম বললে কি এদেশের লোক আসে? সঙ্কীর্ণ বুদ্ধির নামে সকলে পালায়। আসল কথা, তাঁর ধর্ম; হিন্দুরা বলুক হিন্দুধর্ম—তদ্বৎ সর্বে (সেইরূপ সকলে)। তবে ধীরে ধীরে—শনৈঃ পন্থাঃ। নবাগন্তুক দীননাথকে আমার আশীর্বাদ দিও। লিখিবার সময় বড়ই অল্প, সর্বদাই লেকচার, লেকচার, লেকচার। Purity-patience-perseverance (পবিত্রতা, ধৈর্য, অধ্যবসায়)! মহেন্দ্র মাষ্টার প্রভৃতি সকলকে আমার প্রেমালিঙ্গন দিও। মা-ঠাকুরাণীকে আমার কোটি সাষ্টাঙ্গ। গোলাপ-মা, যোগীন-মা প্রভৃতি সকলকে আমার নমস্কার। অনেকে যে তাঁর কথা এক্ষণে শুনছে, তাদের কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ অর্থসাহায্য করিতে বলিবে; কিছু কিছু ‘পেলা’ না নিলে মঠ চলবে কি প্রকারে? এ-কথা সকলকে খুলে বলতে হবে বৈকি!
বিদেশ হতে যদি কেউ কিছু আমার নামে পাঠায়, তাদের চিঠির জবাব দিবে। ওটা একটা সাধারণ ভদ্রতা। ভবনাথ, কালীকৃষ্ণবাবু প্রভৃতিকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে। সাণ্ডেল অর্থাভাব লিখছেন, তথাহি তারকদাদা। বলি এতগুলো লোক তাঁকে মানে, আর একটা মঠ চলে না? তোমাদের কারুর কারুর মধ্যে একটা গুজোগুজি ভাব এখনও আছে; সেটা যেদিন একেবারে অপসৃত হবে, সেদিন হতেই সকলবিধ কল্যাণ হবে।
এদেশ হতে শীঘ্র দেশে যাওয়ায় কোন লাভ নাই। বলি, প্রথমতঃ এদেশে একটু বাজলে, দেশে মহাধ্বনি হয়; তারপর এদেশের লোকেরা মহাধনী ও ছাতিওয়ালা! দেশের লোকের পয়সাও নাই এবং ছাতি একেবারেই নাই!
ক্রমশঃ প্রকাশ্য। তিনি কি শুধু ভারতের ঠাকুর? ঐ সঙ্কীর্ণ ভাবের দ্বারাই ভারতের অধঃপতন হয়েছে। তার বিনাশ না হলে কল্যাণ অসম্ভব। আমার যদি টাকা থাকিত, তোমাদের প্রত্যেককেই পৃথিবী-পর্যটনে পাঠাতাম। কোণ থেকে না বেরুলে কোন বড় ভাব আসে না। ক্রমে দেখা যাবে। প্রভুর ইচ্ছা। সকল বড় কাজ ধীরে ধীরে হয়। দুটো জমির কথা ভুলবে না এবং তোমাদের মধ্যে কে এ কার্যের ভার লইবে, তাহা লিখিবে; অপিচ গিরিশ ঘোষ ও অতুলের সহিত পরামর্শ করিবে। জমি আমার নামে খরিদ করিবে, অর্থাৎ মোট কথা এই—‘অর্থমনর্থম্’; যার হাতে থাকিলে কারুর মনে ঈর্ষা হবে না, তারই হাতে থাকা ভাল। সাণ্ডেলকে—লাটুকে গরম কাপড় (তার মনের মত) কিনে দিতে বলেছি, এবং গোপালদাদাকে টাকা পাঠাতে বলেছি এবং হুটকোকে টাকা দিতে বলেছি—তার ঋণ-পরিশোধের জন্য।
দক্ষ ও হরিশের কথা কেউ লেখ নাই কেন? তাদের তোমরা খবর নাও কিনা? সাণ্ডেল দুঃখ পাচ্ছে, তার কারণ তার মন এখনও গঙ্গাজলের মতন হয় নাই, নিষ্কাম এখনও হয় নাই, ক্রমে হবে। যদি বাঁকটুকু একদম সিধে করে তো আর কোন দুঃখ থাকিবে না। রাখালকে, হরিকে আমার বিশেষ আলিঙ্গন প্রণাম জানাইবে। তাদের বিশেষ যত্ন করিবে। তোমরা রাখালকে দিন-দুই জবরদস্ত ব্রত করিয়ে দিয়েছ নাকি? কাজটা ভাল কর নাই। যাক, চর্বি মারা যাবে। রাখাল ঠাকুরের ভালবাসার জিনিষ—এ কথা ভুলো না।
কিছুতেই ভয় খেও না। যতদিন তিনি আমার মাথায় হাত রাখছেন, ততদিন কি কারুর দাবাবার যো আছে? ভবেয়ুঃ কণ্ঠাগতাঃ প্রাণাঃ (প্রাণ কণ্ঠাগত হউক), তথাপি ডর পাবে না। সিংহ-বিক্রমের সহিত অথচ ‘কুসুমমিব’ (ফুলের মত) কোমলতার সহিত কার্য করিবে। এবারকার মহোৎসবে খুব ধুম মাতাইবে। খাওয়া দাওয়া অতি সাধারণ—মহাপ্রসাদ, সরাভোগ, দাঁড়াপ্রসাদ ইতি। পরমহংসদেবের জীবনচরিত-পাঠ। বেদ বেদান্ত পুঁথি একত্র করে আরতি করবে, এবং কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ পেলা আদায় করিবে। পুরানো ডৌলে নিমন্ত্রণ ত্যাগ করিবে। ‘আমন্ত্রয়ে ভবন্তং সাশীর্বাদং ভগবতো রামকৃষ্ণস্য বহুমানপুরঃসরঞ্চ’ ইত্যাকার একটা লাইন লিখে তারপর লিখবে যে, ঠাকুরের জন্মতিথি-মহোৎসব এবং মঠ চালাইবার খরচের জন্য আপনার সহায়তা প্রয়োজন। যদি আপনার অভিমত হয় তো অমুক স্থানে অমুকের নিকট টাকা পাঠাইবেন—ইত্যাদি। যদি মনে কর যে, আমার নামে সই করলে লোকে টাকা দেবে তো সই করে দিও অর্থাৎ ছাপিয়ে দিও। যদি না হয়, তো যেমন ordinarily (সাধারণতঃ) ‘রামকৃষ্ণসেবকাঃ সন্ন্যাসিনঃ’ অথবা ঐ প্রকার কোন রকম। আর এক পাতা ইংরেজীতে লিখিবে। ‘লর্ড (প্রভু) রামকৃষ্ণ’ শব্দের কোন অর্থ নাই; উক্ত নাম ত্যাগ করিবে, ইংরেজী অক্ষরে ‘ভগবান্’ লিখিবে। তারপর এক আধ লাইন ইংরেজী লিখিয়া দিবে।
The Anniversary of Bhagaban Sri Ramakrishna
Sir,
We have great pleasure in inviting you to join us in celebrating the —th anniversary of Bhagaban Sri Ramakrishna Paramahamsa. For the celebrating of this great occasion and for the maintenance of the Alambazer Math, funds are absolutely necessary. If you think that the cause is worthy of your sympathy, we shall be very grateful to receive your contribution to the great work.
Yours obediently
(Name)৮৯
(Place)
(Date)
যদি যথেষ্ট অর্থসংগ্রহ হয়, কিয়দংশ খরচ করে বাকী একটা ফাণ্ড করে রাখবে এবং তোমাদের খরচ তা হতে চালাবে।
ভোগের নাম করে সকলকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না। দুটো ফিল্টার তৈয়ার করবে। সেই জলে রান্না ও খাওয়া দুই-ই। ফিল্টার করবার পূর্বে জল ফুটিয়ে নেবে, তা হলে ম্যালেরিয়ার বাপ পলায়ন। সকলের স্বাস্থ্যের উপর প্রথম দৃষ্টি রাখিবে। মাটিতে শোওয়া ত্যাগ করিবে, পার যদি—অর্থাৎ যদি পয়সা জোটে তো বড়ই ভাল। ময়লা কাপড় ব্যারামের প্রধান কারণ। ঐ সকল টাকার কাজ। সারদা তার বন্ধুদের পত্র লিখুক, ঐ প্রকার সকলে চেষ্টা কর। আমি এখানে চেষ্টা করছি বৈকি! কিন্তু খালি আমার উপর কোন কাজে নির্ভর করিবে না। ভোগের বিষয় তোমাকে লিখি—কেবলমাত্র কিঞ্চিৎ পায়সান্ন চড়াইবে; তিনি তাহাই ভালবাসিতেন। ঠাকুরঘর অনেকের সহায়তা করে বটে, কিন্তু রাজসিক তামসিক খাওয়া-দাওয়ার কোন কাজ নাই। আঙুল-বাঁকান এবং ঘণ্টার বিকট আওয়াজ কিঞ্চিৎ কমি করে কিঞ্চিৎ গীতা-উপনিষদাদি পাঠ করিবে। অর্থাৎ Materialism (জড়োপাসনা) যত কম হয় এবং Spirituality (আধ্যাত্মিকতা) যতই বাড়ে, এই কথা আর কি। সাণ্ডেল লিখছেন যে, হাজার হাজার লোক খালি ঘণ্টানাড়া দেখতে আসে। যদি এ কথা সত্য হয় তো ও-প্রকার লোক না আসাই ভাল। ওরা মেঠাই খেতে আসে; এদিকে মঠের লোক না খেতে পেয়ে মারা যায়, তখন হাজার হাজার লোক কোথায়? আর আমরা কি সর্বত্যাগ করে সাণ্ডেলের জন্য ঘণ্টা বাজাতে এসেছি? সাণ্ডেল কাঁসারীপাড়ায় বাস করুক গে, যদি ঘণ্টানাড়া তার এতই ভাল লাগে। অর্থাৎ তিনি তাঁর ছেলেদের মুখে খাচ্ছেন—তোমার ঘণ্টানাড়ার মধ্যে নয়। তাদের একচুল কষ্ট দিয়ে তোমার ঘণ্টানাড়া সমস্তই বিফল হয়, অপিচ অমঙ্গল হয় তোমার নিজের। এ কথাটা রোজ একবার মনে রেখো। তিনি তোমার একলার জন্য বা সাণ্ডেলের জন্য এসেছিলেন, কি জগতের জন্য? যদি জগতের জন্য, তা হলে জগৎসুদ্ধ লোক যাতে তাঁকে বুঝতে পারে, এই ভাবে তাঁকে present করতে (লোকের কাছে ধরতে) হবে। সেইজন্য সুরেশ দত্তের পুঁথিতে যে আবোল-তাবোলগুলো আছে, সেগুলো দূর করে দিতে হবে—বুঝতে পেরেছ কি? ওগুলো ‘—’বাবুর বুদ্ধিতে বোধ হয় সুরেশ দত্ত লিখেছে—হরিবোল হরি! যাক্, তার উদ্দেশ্য ভাল, কেবল সেই ছোট বুদ্ধি। দক্ষিণেশ্বরের ভট্চায্যির জীবনচরিত—মাষ্টার মহাশয় জানে, সুরেশ বাবু লেখে, ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ তারা এখনও দেখতে পায় নাই। দুনিয়া তাদের দক্ষিণেশ্বরের কুটুরি। হে প্রভু, হে প্রভু! তবে you must not identify yourself with any life of Him written by anybody, nor give your sanction to any.৯০ যতক্ষণ আমাদের নামের সঙ্গে না যায়, ততক্ষণ কোন ভয় নেই। এ সকল কথা তোমরা কাউকে বলো না—অর্থাৎ সুরেশ দত্তের উদ্দেশ্য ভাল, বইও বেশ লিখেছে—চলুক, কিছু কাজ হবে। তবে তারা তাঁকে কি ঘোড়ার ডিম বুঝেছে? সাণ্ডেল আমাকে তিন পাতা লেকচার দিয়েছে যে, মা-ঠাকুরাণীকে ভক্তি করতে হবে এবং তিনি আমায় কত দয়া করেন। সাণ্ডেলের এই মহা আবিষ্ক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ! তাঁর [বিষয়ে] একটা কিছু লিখব মনে করি; কিন্তু ভয়ে পেছিয়ে যাই। যাক্, তাঁর ইচ্ছা হয় তো কালে কালে হবে। মহেন্দ্রবাবু মঠ একপ্রকার চালাচ্ছেন; তাঁকে শত শত ধন্যবাদ; তিনি অতি মহৎ। সাণ্ডেলকে বলবে, যদি প্রভুর ইচ্ছা হয়, তার সাড়ে পাঁচ সিকের চাকরি আর তিন কড়ার বুদ্ধি শীঘ্রই ঘুচবে। তবে তার কর্ম বাজার-হাট ইত্যাদি করা; সেই কর্ম মন দিয়ে করলে—অর্থাৎ তাঁর ছেলেপুলের সেবা করলেই তার পরম কল্যাণ হবে। লেকচার-ফেকচার সে এ জন্মের মত সিকেয় তুলে রাখুক, আসছে বারে দেখা যাবে। তাকে নিজের বুদ্ধি খরচ করতে বারণ করো। যেমনটি বলি দাগা বুলিয়ে যাক্, নইলে উল্টো উৎপত্তি করে বসবে। ‘হাঁ জী হাঁ জী করতে রহিও বৈঠি আপনা ঠাম্।’
যোগেন কেমন আছে? হুটকো কি চাকরি করতে যাচ্ছে—কি করছে? হুটকোকে একটু লেখাপড়া শেখাবে—এখনও বয়স আছে। সব খবর খুলে লিখতে হয়—এ-কথা খুব মনে রেখো। গুপ্ত পড়ছে শুনছে কেমন? তুলসী, লেটোকে ঘুমুতে দিও, যা খেতে চায় দিও, তাড়া দিও না বিলকুল। বাবুরাম কি করছে; হরি, রাখাল কেমন আছে ইত্যাদি বিলকুল লিখবে। সকল কথা খোলসা করে শুনবে—আবোল-তাবোল কে কি বললে হরমোহনী ডৌলে লেখবার দরকার নাই। হরমোহনের সাংসারিক অবস্থা কেমন? তারকদাদা খুব কাজ করছে; বাঃ! বাঃ! সাবাস! ঐ-রকম চাই। এক-একটা নক্ষত্রের মত ছুটে পড় দিকি! গঙ্গা কি করছে? রাজপুতানায় কতকগুলো জমিদার তাকে মানে; তাদের কাছ থেকে ভিক্ষে করে মঠের জন্য টাকা পাঠাতে বলো …।
শাঁকচুন্নীর বই এইমাত্র পড়লাম। তাকে আমার লক্ষ-লক্ষাধিক প্রেমালিঙ্গন দিবে। তার কণ্ঠে তিনি আবির্ভাব হচ্ছেন। ধন্য শাঁকচুন্নী! শাঁকচুন্নী ঐ পুঁথি সকলকে শোনাক। মহোৎসবে শাঁকচুন্নীর পুঁথি সকলের সামনে যেন পড়ে। পুঁথি অতি বড় যদি হয় তো চুম্বক চুম্বক করে যেন পড়ে। শাঁকচুন্নী একটাও আবোল-তাবোল তো লিখে নাই। আমি তার পুঁথি পড়ে যে কি আনন্দ পেয়েছি, তা আর কি বলব! শাঁকচুন্নীর পুঁথি যাতে খুব বিক্রী হয়, সকলে পড়ে (মিলে) চেষ্টা করবে। তারপর শাঁকচুন্নীকে গাঁয়ে গাঁয়ে প্রচার করতে যেতে বলো। বাহবা, সাবাস, শাঁকচুন্নী! সে তাঁর কাজ করছে। গাঁয়ে গাঁয়ে যাক, লোককে তাঁর কথা শোনাক—এর চেয়ে তার আর কি ভাগ্য হবে? … শশী, শাঁকচুন্নীর পুঁথি and শাঁকচুন্নী himself (নিজে) must electrify the masses (জনসাধারণের শক্তিসঞ্চার করবে)। আরে মোর শাঁকচুন্নী, তোকে প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করছি ভাই। প্রভু তোর কণ্ঠে বসুন, দ্বারে দ্বারে তাঁর নাম শুনাও। সন্ন্যাসী হবার আবশ্যক কিছুই নাই। শশী, mass (জনসাধারণ)-এর মধ্যে সন্ন্যাসী হওয়া উচিত নয়। শাঁকচুন্নী is the future apostle for the masses of Bengal (বাঙলার জনসাধারণের নিকট ভাবী বার্তাবহ)। শাঁকচুন্নীকে খুব যত্ন করবে! তার বিশ্বাস-ভক্তির ফল ফলেছে। শাঁকচুন্নীকে এই ক-টা কথা লিখতে বলো—তার তৃতীয় খণ্ডে, প্রচার খণ্ডেঃ
‘বেদবেদান্ত, আর আর সব অবতার যা কিছু করে গেছেন, তিনি একলা নিজের জীবনে তা করে দেখিয়ে গেছেন। তাঁর জীবন না বুঝলে বেদবেদান্ত অবতার প্রভৃতি বোঝা যায় না—কেন না, He was the explanation (তিনি ব্যাখ্যাস্বরূপ ছিলেন)। তিনি যেদিন থেকে জন্মেছেন, সেদিন থেকে সত্যযুগ এসেছে। এখন সব ভেদাভেদ উঠে গেল, আচণ্ডাল প্রেম পাবে। মেয়ে-পুরুষ-ভেদ, ধনী-নির্ধনের ভেদ, পণ্ডিত-বিদ্বান-ভেদ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-ভেদ সব তিনি দূর করে দিয়ে গেলেন। আর তিনি বিবাদভঞ্জন—হিন্দু-মুসলমান-ভেদ, ক্রিশ্চান-হিন্দু ইত্যাদি সব চলে গেল। ঐ যে ভেদাভেদে লড়াই ছিল, তা অন্য যুগের; এ সত্যযুগে তাঁর প্রেমের বন্যায় সব একাকার।’
এই ভাবগুলো তার ভাষায় বিস্তার করে লিখতে বলবে। যে তাঁর পূজা করবে, সে অতি নীচ হলেও মুহূর্তমধ্যে অতি মহান্ হবে—মেয়ে বা পুরুষ। আর এবারে মাতৃভাব—তিনি মেয়ে সেজে থাকতেন, তিনি যেন আমাদের মা—তেমনি সকল মেয়েকে মার ছায়া বলে দেখতে হবে। ভারতে দুই মহাপাপ—মেয়েদের পায়ে দলান, আর ‘জাতি জাতি’ করে গরীবগুলোকে পিষে ফেলা। He was the Saviour of women, Saviour of the masses, Saviour of all high and low.৯১ আর শাঁকচুন্নী ঘরে ঘরে তাঁর পূজা করাক। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, মেয়ে বা পুরুষ—তাঁর পূজায় সকলের অধিকার। যে ঘটস্থাপনা বা প্রতিমা করে তাঁর পূজা করবে—মন্ত্র হোক বা না হোক—যেমন করে যে-ভাষায় যার হাত দিয়ে হোক—খালি ভক্তি করে যে পূজা করবে, সেই ধন্য হয়ে যাবে।—এই ডৌলে লিখতে বলো। কুছ পরোয়া নাই; প্রভু তার সহায় হবেন। কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
পুঃ—ম্যাক্সমূলারকে—তিনি ভারতের পরম সহায়—এইভাবে পত্র লিখিবে। বোধ হয় লিখিয়াছ। … সে বই আমি অনেক দিন দেখেছি, তাতে আমার ভাবের আভাসও আছে।
যে অভিধানের বিজ্ঞাপন পাঠিয়ে দিয়েছিলে, তা দু-চার জন বন্ধুকে পাঠিয়েছি—কি ফল হবে, তা জানি না। তুমি একখানা নারদ-আর শাণ্ডিল্যসূত্র এবং একখানা ‘যোগবাশিষ্ঠ’—যা কলকেতায় তর্জমা হয়েছে—তা পাঠিয়ে দিতে সাণ্ডেলকে বলবে। ‘যোগবাশিষ্ঠে’র ইংরেজী তর্জমা, বাঙলা নয়। ইতি
শাঁকচুন্নী যেন আমার opinion (মত) in his book (তাঁর পুঁথিতে) না ছাপে। তাঁকে মুখে তুমি বলবে—অথবা পড়ে শুনাবে। যাকে তাকে আমার correspondence (চিঠিপত্র) পড়তে দিবে না। এ-সমস্ত private (ব্যক্তিগত)। কথা কানে হাঁটে। ইতি
নরেন্দ্র
২৫০*
আমেরিকা
১৮৯৫
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমাদের কোন সঙ্ঘ নেই—আমরা কোন সঙ্ঘ গড়তেও চাই না। স্ত্রী বা পুরুষ যে-কেহ যা কিছু শিক্ষা দিতে, যা কিছু প্রচার করতে চায়, সে-বিষয়ে তার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।
যদি তোমার ভিতরে শক্তি থাকে, তবে তুমি কখনই অপর পাঁচজনকে আকর্ষণ করতে অসমর্থ হবে না। আমরা কখনই থিওসফিষ্টদের কার্যপ্রণালী অনুসরণ করতে পারি না—তার সোজা কারণ এই যে, তারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ সম্প্রদায়, আর আমরা তা নই।
আমার মূলমন্ত্র হচ্ছে—ব্যক্তিত্বের বিকাশ। এক-একটি ব্যক্তিকে শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা ছাড়া আমার অন্য কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আমি অতি অল্পই জানি—সেই অল্পস্বল্প যা জানি, তার কিছু চেপে না রেখেই শিক্ষা দিয়ে যাই। যে বিষয়টা জানি না, স্পষ্টই স্বীকার করি যে, সেটা আমার জানা নেই। আর থিওসফিষ্ট, খ্রীষ্টান, মুসলমান বা জগতের অপর যার কাছ থেকেই হোক, লোক কিছু সাহায্য পাচ্ছে জানলে আমার এত আনন্দ হয়, তা কি বলব। আমি তো সন্ন্যাসী—সুতরাং এ জগতে আমি কারও গুরু বা প্রভু নই, আমি নিজেকে সকলের দাস মনে করি। … যদি লোকে আমায় ভালবাসে বাসুক, তাদের খুশী; ঘৃণা করে করুক—তাদের খুশী।
প্রত্যেককেই নিজের উদ্ধারসাধন নিজেকে করতে হবে—প্রক্যেককেই নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে। আমি কোন সাহায্য খুঁজি না, পেলে তা ত্যাগও করি না; আর জগতে কোন সাহায্য দাবী করবার অধিকারও আমার নেই। কেউ যে আমায় সাহায্য করেছে বা করবে, আমার প্রতি সে তার দয়া, তাতে আমার দাবীদাওয়া কিছু নেই; এ জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।
যখন সন্ন্যাসী হই, তখন বুঝেসুঝেই এ পথ বেছে নিয়েছিলাম; বুঝেছিলাম, অনাহারে মরতে হবে। তাতে কি হয়েছে? আমি তো ভিখারী; আমার বন্ধুরা সব গরীব; গরীবদের আমি ভালবাসি; দারিদ্র্যকে সাদরে বরণ করি। কখনও কখনও যে আমায় উপবাস করে কাটাতে হয়, তাতে আমি খুশী। আমি কারও সাহায্য চাই না—তার প্রয়োজন কি? সত্য নিজের প্রচার নিজেই করবে, আমার সাহায্যের অভাবে নষ্ট হয়ে যাবে না। ‘সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ। ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব’—সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয়, সব সমান মনে করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও (গীতা)।
এইরূপ অনন্ত ভালবাসা, সর্বাবস্থায় এইরূপ অবিচলিত সাম্যভাব থাকলে এবং ঈর্ষা দ্বেষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হলে তবে কাজ হবে। তাতেই কেবল কাজ হবে, আর কিছুতেই নয়। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
২৫১
[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]
জানুআরী, ১৮৯৬
প্রিয় সারদা,
… তোর কাগজের idea (সঙ্কল্প) অতি উত্তম বটে এবং উঠে পড়ে লেগে যা, পরোয়া নেই। ৫০০ টাকা পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেব, ভাবনা নাই টাকার জন্য। আপাতত এই চিঠি দেখিয়ে কারুর কাছে ধার করে নে। এই চিঠির জবাব—চিঠির উত্তরে আমি ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দেব। ৫০০ টাকায় কিছু আসে যায় কি? খ্রীষ্টিয়ান, মুসলমান ধর্ম প্রচারের ঢের লোক আছে, তুই আপনার দেশী ধর্মের প্রচার এখন করে ওঠ দিকি। তবে কোন আরবী জানা মুসলমান-ভায়া ধরে যদি পুরানো আরবী গ্রন্থের তর্জমা করাতে পারে, ভাল হয়। ফার্সী ভাষায় অনেক Indian History (ভারতীয় ইতিহাস) আছে। যদি সেগুলো ক্রমে ক্রমে তর্জমা করাতে পার, একটা বেশ regular item (নিয়মিত বিষয়) হবে। লেখক অনেক চাই। তার পর গ্রাহক যোগাড়ই মুশকিল। উপায়—তোরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াস, বাঙলা ভাষা যেখানে যেখানে আছে, লোক ধরে কাগজ গতিয়ে দিবি। … চালাও কাগজ, কুছ্ পরোয়া নাই। শশী, শরৎ, কালী প্রভৃতি সকলে পড়ে (মিলে) লিখতে আরম্ভ কর। ঘরে বসে ভাত খেলে কি হয়? তুই খুব বাহাদুরি করেছিস। বাহবা, সাবাস! গুঁজগুঁজেগুলো পেছু পড়ে থাকবে হাঁ করে, আর তুই লম্ফ দিয়ে সকলের মাথায় উঠে যাবি। ওরা নিজেদের উদ্ধার করছে—না হবে ওদের উদ্ধার, না হবে আর কারুর। মোচ্ছব (মহোৎসব) এমনি মাচাবি যে, দুনিয়াময় তার আওয়াজ যায়। অনেকে আছেন, যাঁরা কেবল খুঁত কাড়তে পারেন; কিন্তু কাজের বেলা তো ‘খোঁজ খবর নহি পাওয়ে।’ লেগে যা, যত পারিস। পরে আমি ইণ্ডিয়ায় (ভারত) এসে তোলপাড় করে তুলব। ভয় কি? ‘নাই নাই বললে সাপের বিষ উড়ে যায়।’—নাই নাই বলে যে নাই হয়ে যেতে হবে!
গঙ্গাধর খুব বাহাদুরি করছে। সাবাস! কালী তার সঙ্গে কাজে লেগেছে। খুব সাবাস! একজন মান্দ্রাজে যা, একজন বোম্বে যা। তোলপাড় কর—তোলপাড় কর দুনিয়া। কি বলব আপসোস—যদি আমার মত দুটা তিনটা তোদের মধ্যে থাকত—ধরা কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যেতুম। কি করি, ধীরে ধীরে যেতে হচ্ছে। তোলপাড় কর—তোলপাড় কর। একটাকে চীন দেশে পাঠিয়ে দে, একটাকে জাপান দেশে পাঠা। গৃহস্থদের কাজ নয়। … সন্ন্যাসীর দলকে হুঙ্কার দিতে হবেঃ ‘হ—র্, হ—র্, শ—ম্ভো!’ ইতি—
বিবেকানন্দ
২৫২*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৬ জানুআরী, ১৮৯৬
প্রিয় ভগিনী,
নববর্ষে তোমার প্রীতিসম্ভাষণের জন্য বহু ধন্যবাদ। বিশিষ্ট ভদ্রমহোদয়টির ওখানে ছয় সপ্তাহ তোমার বেশ আনন্দে কেটেছে জেনে সুখী হলাম, যদিও তারা কেবল গল্ফ্ই খেলত। ইংলণ্ডে দেখলাম—আমি যথার্থ শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। ইংরেজরা আন্তরিক অভ্যর্থনা করেছে; এই ইংরেজ জাত সম্বন্ধে আমার ধারণাও অনেকখানি বদলেছে। প্রথমেই দেখলাম লাণ্ড্ (Lund) প্রভৃতি যারা আমার সঙ্গে বিরোধের জন্য ইংলণ্ড থেকে এখানে এসেছিল, ওখানে তাদের কোন পাত্তাই নেই। ইংরেজরা তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত উপেক্ষা করে। যারা ইংলিশ চার্চের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের ভদ্র বলে মনে করা হয় না। ঐ চার্চভুক্ত কয়েকজন যথার্থ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠা ও পদমর্যাদায় অগ্রণীদের কেউ কেউ আমার অকৃত্রিম বন্ধু হয়েছেন। আমার ইংলণ্ডের অভিজ্ঞতা আমেরিকার তুলনায় একেবারে অন্য রকমের।
এখানে প্রেসবিটেরিয়ান প্রভৃতি গোঁড়াদের সঙ্গে হোটেলগুলিতে আমার অভিজ্ঞতার কথা শুনে ইংরেজরা তো হেসেই অস্থির। উভয় দেশের মধ্যে শিক্ষা দীক্ষা ও আচার-ব্যবহার প্রভেদ লক্ষ্য করতে দেরী হল না। বুঝলাম কেন আমেরিকার মেয়েরা দলে দলে ইওরোপীয় বিবাহ করতে যায়। সকলের কাছে সদয় ব্যবহার পেয়েছি। স্ত্রী-পুরুষ-নির্বিশেষে অনেক উদারহৃদয় বন্ধু এখন সেখানে বসন্তকালে আমার ফিরে যাওয়ার প্রতীক্ষায় আছে।
সেখানকার কাজ সম্বন্ধে বলি, বেদান্তের ভাব ইংরেজ সমাজের উচ্চ স্তরে প্রবেশ করেছে। বহু শিক্ষিত ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, যাঁদের মধ্যে ধর্মযাজকের সংখ্যাও কম নয়, আমাকে বলেন যে, এ যেন গ্রীস কর্তৃক রোম-বিজয়ের পুনরভিনয় হচ্ছে ইংলণ্ডে।
ভারতে বাস করেছে এমন ইংরেজদের মধ্যে দুটি শ্রেণীঃ এক শ্রেণীর চোখে ভারতীয় যা কিছু সবই হেয়; এরা কিন্তু অশিক্ষিত। অপর শ্রেণীর নিকট ভারত পুণ্যভূমি, ভারতের বায়ু পর্যন্ত পবিত্র; এদের হিন্দুয়ানী হিন্দুদেরও হার মানায়, এরা ঘোর নিরামিষাশী, এমন কি স্বদেশে জাতিভেদ-প্রবর্তনেও উদ্যত। ইংলণ্ডের অধিকাংশ লোকই জাতিভেদের দারুণ পক্ষপাতী। সাধারণ বক্তৃতা ছাড়া সপ্তাহে আরও আটটি করে ক্লাস নিতাম; এত লোকসমাগম হত যে, অনেকে—এমন কি অভিজাত মহিলাগণও নিঃসঙ্কোচে মেজের উপরই বসতেন। ইংলণ্ডে দৃঢ়সঙ্কল্প নরনারী দেখতে পেলাম, তারা দায়িত্ব নিয়ে তাদের জাতি-সুলভ উদ্যম ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ চালাতে থাকবে। এ বৎসর নিউ ইয়র্কে আমার কাজ চমৎকার চলেছে। মিঃ লেগেট নিউ ইয়র্কের একজন সেরা ধনী, তিনি আমার একান্ত অনুরাগী। এদেশে নিউ ইয়র্কবাসীরা অধিকতর দৃঢ়চিত্ত, এবং তাই এখানেই আমার কেন্দ্রস্থাপনের সঙ্কল্প করেছি। এখানকার মেথডিষ্ট ও প্রেসবিটেরিয়ান সম্প্রদায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ আমার উপদেশাদি অসঙ্গত মনে করেন। ইংলণ্ডের ধার্মিক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের কাছে এগুলি উচ্চতম দার্শনিক তত্ত্বরূপে পরিগণিত।
তা ছাড়া মার্কিন নারীর স্বভাবসুলভ পরচর্চা ইংলণ্ডে অজ্ঞাত। ইংরেজ মেয়েরা দেরীতে ভাব গ্রহণ করে, তবে একবার ঠিকমত গ্রহণ করতে পারলে তা আয়ত্ত করে নেবেই। ওখানে ওরা যথারীতি কাজ চালাচ্ছে ও প্রতি সপ্তাহে আমাকে কাজের বিবরণ পাঠাচ্ছে। বুঝে দেখ! আর এখানে সপ্তাহখানেকের জন্য যদি অনুপস্থিত থাকি তো কাজের দফা রফা। সকলকে আমার শুভেচ্ছা জানিও—স্যাম এবং তুমি জেনো। ভগবান্ তোমাকে চিরসুখী করুন। ইতি
তোমাদের স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
২৫৩*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228, W. 39th St. নিউ ইয়র্ক
১৬ জানুআরী, ১৮৯৬
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
বই-কয়খানির জন্য অশেষ ধন্যবাদ। ‘সাংখ্যকারিকা’ অতি সুন্দর গ্রন্থ, এবং ‘কূর্মপুরাণে’ আশানুরূপ সব না পেলেও ওতে যোগ সম্বন্ধে কয়েকটি শ্লোক আছে। আমার পূর্বের চিঠিতে ‘যোগসূত্র’ এই শব্দটি বাদ পড়েছিল। বহু প্রামাণিক গ্রন্থ থেকে পাদটীকা সংযুক্ত করে আমি ঐ গ্রন্থখানি অনুবাদ করছি। ‘কূর্মপুরাণে’র পরিচ্ছেদটি আমার টীকার মধ্যে দিতে চাই। আমি মিস ম্যাকলাউডের কাছ থেকে তোমার ক্লাসগুলির খুব উৎসাহপূর্ণ বিবরণ পেয়েছি। মিঃ গলস্ওয়ার্দি এখন খুব আকৃষ্ট হয়েছেন বলে মনে হয়।
এখানে আমার ক্লাসগুলি ও রবিবারের বক্তৃতাগুলি আরম্ভ করেছি। দুটি কাজই খুব উৎসাহ জাগিয়েছে। এই দুই কাজের জন্য আমি টাকা নিই না; তবে হলের খরচ চালাবার জন্য (সভাদিতে) কিছু চাঁদা ওঠাই। গত রবিবারের বক্তৃতাটি খুব প্রশংসা অর্জন করেছে, এবং সেটি খবরের কাগজে বেরিয়েছে। আগামী সপ্তাহে আমি তোমায় কয়েক সংখ্যা পাঠিয়ে দেব। ওতে আমাদের কাজের একটা সাধারণ পরিকল্পনা ছিল।
আমার বন্ধুরা একজন সাঙ্কেতিক লেখক (গুডউইনকে) নিযুক্ত করায় এই সমস্ত ক্লাসের পাঠগুলি ও বক্তৃতাগুলি লিপিবদ্ধ হচ্ছে। প্রত্যেকটির এক এক কপি তোমাকে পাঠিয়ে দেবার ইচ্ছা আছে। ঐসব থেকে তুমি হয়তো কিছু চিন্তার খোরাক পেতে পার। এখানে আমি তোমার মত এমন একজন শক্তিশালী লোক চাই—যার বুদ্ধি, কর্মে দক্ষতা ও অনুরাগ আছে। এই সর্বজনীন শিক্ষার দেশে সকলকেই যেন একটা সাধারণ মাঝারি স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে; যে কয়জন যোগ্য ব্যক্তি আছে, তারা যেন গতানুগতিক অর্থ-উপার্জনের গুরুভারে পীড়িত।
এবার পল্লী অঞ্চলে আমার একটি জমি পাবার সম্ভাবনা আছে; তাতে কয়েকটি বাড়ী, বহু গাছ ও একটি নদী আছে। গ্রীষ্মকালে ওটিকে ধ্যানের স্থানরূপে ব্যবহার করা চলবে। অবশ্য আমার অনুপস্থিতিতে ওটার দেখাশুনার জন্য এবং টাকাকড়ি লেনদেন, ছাপা ও অন্যান্য কাজের জন্য একটি কমিটির প্রয়োজন হবে।
আমি নিজেকে টাকাকড়ির ব্যাপার থেকে একেবারে আলাদা করে ফেলেছি, অথচ টাকাকড়ি না হলে কোন আন্দোলন চলতে পারে না। সুতরাং বাধ্য হয়ে কার্যপরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব একটি কমিটির হাতে দিতে হয়েছে; তারা আমার অনুপস্থিতিতে এই সব চালিয়ে যাবে। স্থিরভাবে কাজ করে যাওয়া আমেরিকানদের ধাতে নেই; তারা কেবল দলবেঁধেই কাজ করে। সুতরাং তাদের তাই করতে দিতে হবে। প্রচারের দিকটার ব্যবস্থা এই হয়েছে যে, আমার বন্ধুরা প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে এদেশের জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়াবে; এবং তারা স্বতন্ত্র দল গঠন করতে পারবে। ঐ হচ্ছে বিস্তারের সব চেয়ে সহজ উপায়। অতঃপর যখন আমরা যথেষ্ট বলশালী হব, তখন আমাদের শক্তিরাশিকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য আমরা বাৎসরিক সম্মেলন করব।
কমিটি নিছক কাজ চালানর জন্য এবং তা নিউ ইয়র্কেই সীমাবদ্ধ।
সতত স্নেহপরায়ণ ও আশীর্বাদক
তোমাদের বিবেকানন্দ
২৫৪
[মঠে লিখিত, শেষাংশ স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে]
228 W. 39th St., নিউ ইয়র্ক
১৭ জানুআরী, ১৮৯৬
অভিন্নহৃদয়েষু—
তোমার দুইখানি পত্র আসিয়াছে ও রামদয়ালবাবুর দুইখানি পত্র পাইয়াছি। Bill of Lading (বিল) পৌঁছিয়াছে, পরন্তু মাল আসিবার অনেক দেরী। শীঘ্র পৌঁছিবার বন্দোবস্ত না করিয়া পাঠাইলে মাল আসিতে ছয় মাস লাগিয়া যায়। হরমোহন চার মাস পূর্বে লিখেন যে, রুদ্রাক্ষ ও কুশাসন পাঠান হইয়াছে; তাহার খোঁজ-খবর এখনও পাওয়া যায় নাই। অর্থাৎ মাল ইংলণ্ডে পৌঁছিলে এখানকার Agent of the Company (কোম্পানীর এজেণ্ট) আমাকে notice (খবর) দেয়, তারপর মাসখানেক পরে মাল পৌঁছায়। তোমাদের Bill of Lading (বিল) প্রায় তিন সপ্তাহ এসেছে, এখনও notic-এর (খবরের) দেখা নাই! কেবল খেতড়ির রাজার মাল শীঘ্রই পৌঁছায়, বোধ হয় তিনি অনেক খরচ করে পাঠান। যাহা হউক, এ দুনিয়ার অপরদিকে, পাতালপুরে যে মাল নির্ঘাত পৌঁছে যায়, এই পরম ভাগ্য। মাল পৌঁছলেই তোমাদের খবর দেব। এখন তিন মাস অন্ততঃ চুপ করে থাক।
তুমি খবরের কাগজ এখন বার করতে লেগে যাও। রামদয়ালবাবুকে বলিবে যে, তিনি যে-ব্যক্তির কথা লিখিয়াছেন, তিনি উপযুক্ত হইলেও আমেরিকায় এক্ষণে কাহাকেও আনিবার আমার সাধ্য নাই। L'argent, mon ami, l'argent—টাকা, ইয়ার, টাকা কোথায়?
… তোর টিবেটের (তিব্বতের) কি খবর? ‘মিররে’ ছাপা হলে আমাকে একখানা পাঠিয়ে দিস। … হুটোপাটিতে কি কাজ হয়? … লোহার দিল চাই, তবে লঙ্কা ডিঙ্গুবি। বজ্রবাঁটুলের মত হতে হবে, পাহাড় পর্বত ভেদ হয়ে যাতে যায়। আসছে শীতে আমি আসছি। দুনিয়ায় আগুন লাগিয়ে দেব—যে সঙ্গে আসে আসুক, তার ভাগ্যি ভাল; যে না আসবে, সে ইহকাল পরকাল পড়ে থাকবে, থাকুক। তুই কোমর বেঁধে তৈয়ার থাক। তুই শশী আর গঙ্গাধর—এই তিনজন দেখছি faithful. … তোদের মুখে হাতে বাগ্দেবী বসবেন—ছাতিতে অনন্তবীর্য ভগবান্ বসবেন—তোরা এমন কাজ করবি যে দুনিয়া তাক হয়ে দেখবে। তোর নামটা একটু ছোটখাট কর দেখি বাবা, কি নাম রে বাপ! একখানা বই হয়ে যায় এক নামের গুঁতোয়। ঐ যে বলে হরিনামের ভয়ে যম পালায়, তা ‘হরি’—এই নামে নয়। ঐ যে গম্ভীর গম্ভীর নাম ‘অঘভগনরকবিনাশন, ত্রিপুরমদভঞ্জন, অশেষ-নিঃশেষকল্যাণকর’ প্রভৃতি নামের গুঁতোয় যমের চৌদ্দপুরুষ পালায়।—নামটা একটু সরল করলে ভাল হয় নাকি? এখন বোধ হয় আর হবে না, ঢাক বেজে গেছে, কিন্তু কি জাঁহাদারি যমতাড়ানে নামই করেছ! কিমধিকমিতি—
বিবেকানন্দ
পুঃ—বাঙলাদেশটা আর ভারতবর্ষটা চেলে ফেল দেখি। জায়গায় জায়গায় Centre (কেন্দ্র) কর।
ভাগবত এসে পৌঁছেছে—Edition (সংস্করণ) বড়ই সুন্দর—কিন্তু এ-দেশের লোকের সংস্কৃত পড়বার ইচ্ছা আদৌ নাই। এজন্য বিক্রী হবার আশা বড়ই কম। ইংলণ্ডে হতে পারে, কারণ সেখানে অনেক লোকে সংস্কৃত চর্চা করে। প্রণেতাকে আমার বিশেষ ধন্যবাদ দিবে। আশা করি তাঁহার মহৎ উদ্যম সুসম্পন্ন হবে। আমরা যথাসাধ্য যত্ন করব, তাঁর বই যাতে এখানে বিক্রী হয়। তাঁর Prospectus (গ্রন্থাভাস) সমস্ত জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি। দয়ালবাবুকে বলবে যে, মুগের দাল, অড়র দাল প্রভৃতিতে ইংলণ্ড ও আমেরিকায় একটা খুব ব্যবসা চলিতে পারে। দাল-soup will have a go if properly introduced. (ঠিকমত শুরু করাতে পারলে দালের যূষের বেশ কদর হবে)। যদি ছোট ছোট প্যাকেট করে তার গায়ে রাঁধবার direction (প্রণালী) দিয়ে বাড়ীতে বাড়ীতে পাঠান যায়—আর একটা ডিপো করে কতকগুলো মাল পাঠান যায় তো খুব চলতে পারে। ঐ প্রকার বড়িও খুব চলবে। উদ্যম চাই—ঘরে বসে ঘোড়ার ডিম হয়। যদি কেউ একটা Company form (কোম্পানী গঠন) করে, ভারতের মালপত্র এদেশে ও ইংলণ্ডে আনে তো খুব একটা ব্যবসা হয়। নিরুদ্যম হতভাগার দল—দশবৎসরের মেয়ের গর্ভাধান করতে কেবল জানে, আর জানে কি?
২৫৫*
আমেরিকা
২৩ জানুআরী, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এতদিনে তুমি আমার প্রেরিত ‘ভক্তিযোগের’ কপি (ছাপাবার মত) যথেষ্ট পরিমাণে নিশ্চয় পেয়েছ। আমি ‘ব্রহ্মবাদিন্’ কাগজের ২১ ডিসেম্বর তারিখের শেষ সংখ্যা পেয়েছি।
‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর গত কয়েক সংখ্যা পড়ে আমার একটু সন্দেহ জাগছিল, তোমরা থিওসফিষ্টদের দলে যোগ দেবে নাকি? এবারে তোমরা ওদের হাতে একেবারে আত্মসমর্পণ করেছ। তোমাদের মন্তব্যের স্তম্ভে থিওসফিষ্টদের বক্তৃতার একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলে কেন? থিওসফিষ্টদের সঙ্গে আমার কোনরকম যোগ আছে, সন্দেহ করলে ইংলণ্ড ও আমেরিকা উভয়ত্র আমার কাজের ক্ষতি হবে, আর তা হতেই পারে। সুস্থমস্তিষ্ক ব্যক্তিরা সকলেই তাদের ভ্রান্ত মনে করে; আর তারা যে এরূপ মনে করে, তা ঠিকই। তোমরা তা ভালরূপেই জান। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, তোমরা আমার উপর টেক্কা দেবার চেষ্টা করছ। তোমরা মনে করছ, থিওসফিষ্টদের নামে বিজ্ঞাপন দিলে ইংলণ্ডে অনেক গ্রাহক পাবে। তোমরাও যেমন আহাম্মক!
আমি থিওসফিষ্টদের সঙ্গে বিবাদ করতে চাই না; কিন্তু আমার ভাব হচ্ছে, তাদের একদম আমল না দেওয়া। তারা কি বিজ্ঞাপনের জন্য তোমাদের টাকা দিয়েছিল? তোমরা আগ-বাড়িয়ে বিজ্ঞাপন দিতে গেলে কেন? আমি আবার যখন ইংলণ্ডে যাব, তোমাদের জন্য যথেষ্ট গ্রাহক যোগাড় করব।
আমি বিশ্বাসঘাতক কাকেও চাই না। আমি তোমাদের স্পষ্ট বলে রাখছি, কোন ধূর্তের পাল্লায় আমি পড়ছি না। আমার সঙ্গে কপটতা চলবে না। … আমি তোমাদের খুব স্পষ্ট কথাই বলছি। একজন—মাত্র একজন যদি আমায় অনুসরণ করে, সেও ভাল, কিন্তু সে যেন মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বাসী থাকে। সফলতা বা বিফলতা আমি গ্রাহ্যই করি না। সমগ্র জগতে প্রচারকার্যের বৃথা কাজে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যখন ইংলণ্ডে ছিলাম, তখন কি তাদের কেউ আমায় সাহায্য করতে এসেছিল? পাগল আর কি! আমি হয় আমার আন্দোলনটিকে সম্পূর্ণ খাঁটি রাখব, তা না হয় মোটেই আন্দোলন চালাব না। ইতি
তোমার চিরস্নেহাবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
আমাদের শাস্ত্রে আছে—‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ।’ অর্থাৎ যারা আমার ভক্তগণের ভক্ত, তারা আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত। তুমি প্রভুর সেবিকা; সুতরাং আমি যেখানেই থাকি না কেন, ভগবৎপ্রেরণায় তুমি যে মহোচ্চ ব্রতে দীক্ষিত হয়েছ, তার উদ্যাপনে যে-কোন প্রকারে সহায়তা করতে পারি, শ্রীকৃষ্ণের অনুগামী আমি তৎসাধনে নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করব ও তা সাক্ষাৎ প্রভুরই সেবা বলে মনে করব। ইতি
তোমার
বিবেকানন্দ
পুঃ—তোমরা কি ঠিক করলে, তা পত্রপাঠ আমায় লিখবে। আমার এ বিষয়ে মতামত একচুল নড়বার নয়। ইতি
—বি
পুঃ—‘ব্রহ্মবাদিন্’ বেদান্ত প্রচারের জন্য, থিওসফি প্রচারের জন্য নয়। তোমাদের যদি উদ্দেশ্য অন্যরূপ ছিল, তবে গোড়া থেকে আমাকে তা বলা উচিত ছিল। স্পষ্টভাবে নিজেদের অভিপ্রায় না জানিয়ে কার্যকালে অন্যরূপ করতে দেখলে আমি প্রায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলি।
—বি
পুঃ—এই হচ্ছে জগৎ! যাদের তুমি সবচেয়ে ভালবাস এবং সবচেয়ে বেশী সাহায্য কর, তারাই তোমায় ঠকাতে চায়। ঘৃণিত সংসার!!!
—বি
২৫৬
[স্বামী যোগানন্দকে লিখিত]
228W. 39th St., নিউ ইয়র্ক
২৪ জানুআরী, ১৮৯৬
যোগেন ভায়া,
অড়হর দাল, মুগের দাল, আমসত্ত্ব, আমসি, আমতেল, আমের মোরব্বা, বড়ি, মসলা সমস্ত ঠিক ঠিকানায় পৌঁছিয়াছে। Bill of Lading-এতে (মাল-চালানের বিলে) নাম সহি করিবার ভুল হইয়াছিল ও invoice (চালান) ছিল না; তজ্জন্য কিঞ্চিৎ গোল হয়। পরে যাহা হউক ভালয় ভালয় সমস্ত দ্রব্য পৌঁছিয়াছে। বহু ধন্যবাদ! এক্ষণে যদি ইংলণ্ডে স্টার্ডির ঠিকানায়—High View, Caversham, Reading-এতে—ঐ প্রকার দাল ও কিঞ্চিৎ আমতেল পাঠাও তো আমি ইংলণ্ডে পৌঁছিলেই পাইব! ভাজা মুগদাল পাঠাইবার আবশ্যক নাই। ভাজা দাল কিছু অধিক দিন থাকিলে বোধ হয় খারাপ হয়ে যায়। কিঞ্চিৎ ছোলার দাল পাঠাইবে। ইংলণ্ডে duty (শুল্ক) নাই—মাল পৌঁছিবার কোন গোল নাই। স্টার্ডিকে চিঠি লিখিয়া দিলেই সে মাল লইবে।
তোমার শরীর এখনও সারে নাই, বড়ই দঃখের বিষয়। খুব ঠাণ্ডা দেশে যেতে পার, শীতকালে যেখানে বরফ বিস্তর পড়ে—যথা দার্জিলিঙ? শীতের গুঁতোয় পেটভায়া দুরস্ত হয়ে যাবে, যেমন আমার হয়েছে। আর ঘি ও মসলা খাওয়া একদম ছেড়ে দিতে পার? মাখন ঘির চেয়ে শীঘ্র হজম হয়। অভিধান পৌঁছিলেই খবর দিব। আমার বিশেষ ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। নিরঞ্জনের খবর এখনও ঠিকানা করিতে পার নাই? গোলাপ-মা, যোগীন-মা, রামকৃষ্ণের মা, বাবুরামের মা, গৌর-মা প্রভৃতি সকলকে আমার প্রণামাদি জানাইবে। মহেন্দ্রবাবুর স্ত্রীকে আমার প্রণাম দিবে।
তিনমাস বাদে আমি ইংলণ্ডে আসিতেছি, পুনরায় হজুগের বিশেষ চেষ্টা দেখিবার জন্য। তারপর আসছে শীতে ভারতবর্ষে আগমন। পরে বিধাতার ইচ্ছা। সারদা যে কাগজ বার করতে চায়, তার জন্য বিশেষ যত্ন করিবে। শশীকে যত্ন করিতে বলিবে ও কালী প্রভৃতিকে। কাহারও এক্ষণে ইংলণ্ডে আসিবার আবশ্যক নাই। আমি ভারতে যাইয়া তাদের তৈয়ার করিব। তারপর যেথায় ইচ্ছা যাইবে। কিমধিকমিতি—
বিবেকানন্দ
পুঃ—নিজেরা কিছু করে না এবং অপরের কিছু করিতে গেলে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়—এই দোষেই আমাদের জাতের সর্বনাশ হইয়াছে। হৃদয়হীনতা, উদ্যমহীনতা সকল দঃখের কারণ। অতএব ঐ দুটি পরিত্যাগ করিবে। কার মধ্যে কি আছে, কে জানে প্রভু বিনা? সকলকে Opportunity (সুযোগ) দাও। পরে প্রভুর ইচ্ছা। সকলের উপর সমান প্রীতি বড়ই কঠিন; কিন্তু তা না হলে মুক্তি হবে না। ইতি
—বি
২৫৭*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
228W. 39th St., নিউ ইয়র্ক
১০ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬
প্রিয় ভগিনী,
তুমি এখন পর্যন্ত আমার চিঠি পাওনি জেনে অবাক হলাম। তোমার চিঠি পাবার ঠিক পরেই আমি চিঠি লিখেছিলাম এবং নিউ ইয়র্কে আমার তিনটি বক্তৃতাসংক্রান্ত কিছু পুস্তিকা পাঠিয়েছিলাম। এই সভায় প্রদত্ত রবিবারের বক্তৃতাগুলি আজকাল সাঙ্কেতিক লিপিতে নেওয়া হচ্ছে, পরে ছাপা হবে। তিনটি বক্তৃতা নিয়ে দুটি পুস্তিকা হয়েছে, যার অনেকগুলির অনুলিপি আমি তোমাকে পাঠিয়েছিলাম। নিউ ইয়র্কে আরও দু সপ্তাহ থাকব, তারপর ডেট্রয়েট যাব, সেখানে থেকে দু-এক সপ্তাহের জন্য আবার বোষ্টন ফিরে আসব।
নিরন্তর কার্য করার ফলে এ বৎসর আমার স্বাস্থ্য খুবই ভেঙে গেছে। স্নায়ুগুলি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই শীতে আমি একরাত্রিও ভালভাবে ঘুমাইনি। আমি নিশ্চয়ই জানি যে, আমার খাটুনি খুব বেশী হচ্ছে, এখনও ইংলণ্ডে এক বৃহৎ কার্য বাকী আছে।
আমাকে তা সম্পূর্ণ করতে হবে এবং তারপর আশা করি ভারতে ফিরে বাকী জীবনটা বিশ্রাম করে কাটাতে পারব।
এখন আমি বিশ্রামের আকাঙ্ক্ষা করছি। আশা করি, তা কিছুটা পাব এবং ভারতের লোকেরা আমাকে রেহাই দেবে। খুব ইচ্ছা হয়, কয়েক বছরের জন্য বোবা হয়ে যাই এবং একেবারে কথা না বলি!
এই সকল পার্থিব সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বের জন্য আমি জন্মাইনি। স্বভাবতঃ আমি স্বপ্নচারী এবং শান্তিপ্রিয়। আমি আজন্ম আদর্শবাদী, স্বপ্নজগতেই আমার বাস, বাস্তবের সংস্পর্শ আমার স্বপ্নের বিঘ্ন ঘটায় এবং আমাকে অসুখী করে তোলে। ঈশ্বরের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক্!
তোমাদের চার বোনের কাছে আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ; এ দেশে আমি যা কিছু পেয়েছি তার জন্য তোমাদের কাছে ঋণী। তোমরা নিরন্তর পবিত্র ও সুখী হও। আমি যেখানেই থাকি না কেন, তোমাদের সর্বদা গভীরতম কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ভালবাসার সঙ্গে স্মরণ করব। আমার সমগ্র জীবনটাই স্বপ্নের পর স্বপ্নের সমাবেশ। সচেতন স্বপ্নচারী হওয়া আমার উচ্চাভিলাষ, বস্। সকলকে আমার ভালবাসা—ভগিনী জোসেফিনকে।
সতত তোমার স্নেহবদ্ধ ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
২৫৮*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228W.39th St., নিউ ইয়র্ক
১৩ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
ভারতবর্ষ থেকে যে সন্ন্যাসী আসবেন, তিনি তোমাকে অনুবাদের কাজে এবং অন্য কাজেও সাহায্য করবেন নিশ্চয়। অতঃপর আমি যখন (ওখানে) যাব, তখন তাঁকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেব। আজ আর একজন সন্ন্যাসীকে তালিকাভুক্ত করা হল। এবারের আগন্তুকটি একজন পুরুষ; সে খাঁটি আমেরিকান এবং ধর্মপ্রচারক হিসাবে এদেশে তার কিছু খ্যাতি আছে। তার নাম ছিল ডাঃ ষ্ট্রীট; এখন সে যোগানন্দ, কারণ যোগের দিকেই তার সব ঝোঁক।
আমি এখান য়েকে ‘ব্রহ্মবাদিন্’-পত্রিকায় নিয়মিতভাবে কার্যবিবরণ পাঠাচ্ছি। সে-সব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। ভারতে কিছু পৌঁছাতে কি দীর্ঘ সময়ই না লাগে! আমেরিকায় কাজ সুন্দরভাবে গড়ে উঠছে। শুরু থেকেই কোন ভোজবাজি না থাকায় আমেরিকার সমাজের সেরা লোকদের দৃষ্টি বেদান্তের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। ফরাসী অভিনেত্রী সারা বার্নহার্ড এখানে ‘ইৎশীল’ (lziel) অভিনয় করেছেন। এটি কতকটা ফরাসী ধাঁজে উপস্থাপিত বুদ্ধজীবন। এতে রাজনর্তকী ইৎশীল বোধিদ্রুম-মূলে বুদ্ধকে প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট; আর বুদ্ধ তাকে জগতের অসারতা উপদেশ দিচ্ছেন। সে কিন্তু সারাক্ষণ বুদ্ধের কোলেই বসে আছে। যা হোক, শেষ রক্ষাই রক্ষা—নর্তকী বিফল হল! মাদাম বার্নহার্ড ইৎশীলের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
আমি এই বুদ্ধ-ব্যাপারটা দেখতে গিয়েছিলাম। মাদাম কিন্তু শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে আমায় দেখতে পেয়ে আলাপ করতে চাইলেন। আমার পরিচিত এক সম্ভ্রান্ত পরিবার এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। তাতে মাদাম ছাড়া বিখ্যাত গায়িকা মাদাম মোরেল এবং শ্রেষ্ঠ বৈদ্যুতিক টেস্লা ছিলেন। মাদাম (বার্নহার্ড) খুব সুশিক্ষিতা মহিলা এবং দর্শনশাস্ত্র অনেকটা পড়ে শেষ করেছেন। মোরেল ঔৎসুক্য দেখাচ্ছিলেন; কিন্তু মিঃ টেস্লা বৈদান্তিক প্রাণ ও আকাশ এবং কল্পের তত্ত্ব শুনে মুগ্ধ হলেন। তাঁর মতে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কেবল এই তত্ত্বগুলিই গ্রহণীয়। আকাশ ও প্রাণ আবার জগদ্ব্যপী মহৎ, সমষ্টি মন বা ঈশ্বর থেকে উৎপন্ন হয়। মিঃ টেস্লা মনে করেন, তিনি গণিতের সাহায্যে দেখিয়ে দিতে পারেন যে, জড় ও শক্তি উভয়কে অব্যক্ত শক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে। আগামী সপ্তাহে এই নূতন পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেখবার জন্য তাঁর কাছে আমার যাবার কথা আছে।
তা যদি প্রমাণিত হয়ে যায়, তবে বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্ত্ব দৃঢ়তম ভিত্তির উপর স্থাপিত হবে। আমি এক্ষণে বেদান্তের সৃষ্টিতত্ত্ব ও পরলোকতত্ত্ব নিয়ে খুব খাটছি। আমি স্পষ্টই আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে বেদান্তের ঐ তত্ত্বগুলি সম্পূর্ণ ঐক্য দেখছি; তাদের একটা পরিষ্কার হলেই সঙ্গে সঙ্গে অপরটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। পরে প্রশ্নোত্তরাকারে এই বিষয়ে একখানা বই লিখব মনে করছি।৯২ উহার প্রথম অধ্যায়ে থাকবে সৃষ্টিতত্ত্ব—তাতে বেদান্তমতের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সামঞ্জস্য দেখান হবে।
ব্রহ্ম | | = | নিরপেক্ষ পূর্ণসত্তা |
মহৎ বা ঈশ্বর | = | আদ্যা সৃষ্টিশক্তি |
প্রাণ ও আকাশ | শক্তি ও জড় |
পরলোকতত্ত্ব কেবল অদ্বৈতবাদের দিক্ থেকে দেখান হবে। অর্থাৎ দ্বৈতবাদী বলেন—মৃত্যুর পর আত্মা প্রথমে আদিত্যলোকে, পরে চন্দ্রলোকে ও সেখান থেকে বিদ্যুল্লোকে যান; সেখানে একজন পুরুষ এসে তাঁকে ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। (অদ্বৈতবাদী বলেন, তারপর তিনি নির্বাণপ্রাপ্ত হন।)
এখন অদ্বৈতবাদীর মতে আত্মার যাওয়া-আসা নাই, আর এই যে-সব বিভিন্ন লোক বা জগতের স্তরসমূহ—এগুলি আকাশ ও প্রাণের নানাবিধ মিশ্রণে উৎপন্ন মাত্র। অর্থাৎ সর্বনিম্ন বা অতি স্থূল স্তর হচ্ছে আদিত্যলোক বা এই পরিদৃশ্যমান জগৎ—এখানে প্রাণ জড়-শক্তিরূপে ও আকাশ স্থূলভূতরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। তারপর হচ্ছে চন্দ্রলোক—তা আদিত্যলোককে ঘিরে আছে। এ আমাদের এই চন্দ্র একেবারেই নয়, এ দেবগণের আবাসভূমি—অর্থাৎ এখানে প্রাণ মনঃশক্তিরূপে এবং আকাশ তন্মাত্র বা সূক্ষ্মভূতরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। এরও ওপর বিদ্যুল্লোক—অর্থাৎ এমন এক অবস্থা, যেখানে প্রাণ আকাশের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন বললেই হয় আর তখন বলা কঠিন যে, বিদ্যুৎ জিনিষটা জড় না শক্তি। তারপর ব্রহ্মলোক—সেখানে প্রাণও নেই, আকাশও নেই; সেখানে এই উভয়ই মূল মন বা আদ্যাশক্তিতে সম্মিলিত হয়েছে। আর এখানে প্রাণ বা আকাশ না থাকায় (ব্যষ্টি) জীব সমস্ত বিশ্বকে সমষ্টিরূপে অথবা মহতের বা বুদ্ধির সংহতিরূপে কল্পনা করে। এঁকেই পুরুষ বলে বোধ হয়—ইনি সমষ্টি আত্মাস্বরূপ, কিন্তু ইনিও সেই সর্বাতীত নিরপেক্ষ সত্তা নন—কারণ এখানেও বহুত্ব রয়েছে। এইখান থেকেই জীব শেষে তার চরম লক্ষ্যস্বরূপ একত্বকে অনুভব করে। অদ্বৈতমতে জীবের আসা-যাওয়া নেই। এই দৃশ্যগুলি ক্রমাম্বয়ে জীবের সামনে আবিভূর্ত হতে থাকে; আর এই যে বর্তমান দৃশ্যজগৎ দেখা যাচ্ছে, তাও এইরূপেই সৃষ্ট হয়েছে। সৃষ্টি ও প্রলয় অবশ্য এই ক্রমেই হয়ে থাকে—তবে প্রলয় মানে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া, আর সৃষ্টি মানে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে আসা।
আর যখন প্রত্যেক জীব কেবল নিজের জগৎ মাত্র দেখতে পায়, তখন ঐ জগৎ তার বন্ধন অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্ট হয়, এবং তার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়—যদিও অন্যান্য বদ্ধ জীবের পক্ষে ঐ জগৎ থেকে যায়। নাম-রূপ হচ্ছে জগতের উপাদান। সমুদ্রের একটা তরঙ্গকে ততক্ষণই তরঙ্গ বলি, যতক্ষণ তা নাম-রূপের দ্বারা সীমাবদ্ধ। তরঙ্গ শান্ত হলে তা সমুদ্রই হয়ে যায়, আর সেই নাম ও রূপ তখনই চিরকালের মত অন্তর্হিত হয়। সুতরাং যে জলটা নাম-রূপের দ্বারা তরঙ্গাকারে পরিণত হয়েছিল, সেই জল ছাড়া তরঙ্গের নাম-রূপের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, অথচ নাম-রূপকেও তরঙ্গ বলা চলে না। তরঙ্গ জলে পরিণত হলেই নাম-রূপ ধ্বংস হয়ে যায়। তবে অন্যান্য তরঙ্গগুলির অন্যান্য নাম-রূপ থাকে বটে। এই নাম-রূপকেই বলে মায়া, আর জলই ব্রহ্ম। তরঙ্গ জল ছাড়া আর কিছুই ছিল না; অথচ তরঙ্গরূপে তার নাম-রূপ ছিল। আবার এই নাম-রূপ এক মুহূর্তের জন্য তরঙ্গ থেকে পৃথক্ ভাবে থাকতে পারে না, যদিও জলস্বরূপে সেই তরঙ্গটি চিরকালই নাম-রূপ থেকে পৃথক্ থাকতে পারে। কিন্তু যেহেতু তরঙ্গ থেকে নাম-রূপকে কখনই পৃথক্ করা চলে না, সেইহেতু তারা যে ‘আছে’ তা বলা যেতে পারে না। কিন্তু তারা একেবারে যে শূন্য, তাও নয়—একেই বলে মায়া।
আমি এই সকল ভাবকে সাবধানে রূপ দিতে চাই; তুমি নিশ্চয় এক নিমেষেই বুঝে নেবে, আমি ঠিক পথ ধরেছি। মন চিত্ত বুদ্ধি ইত্যাদির তত্ত্ব আরও ভাল করে দেখাতে গেলে শারীর-বিজ্ঞান (Physiology) আরও বেশী করে আলোচনা করতে হবে। উচ্চতর ও নিম্নতর কেন্দ্রগুলির সম্বন্ধে আলোচনা করতে হবে। তবে আমি এখন এ বিষয়ে এমন স্পষ্ট আলোক দেখতে পাচ্ছি, যা সমস্ত ভোজবাজি থেকে মুক্ত। আমি শুষ্ক সুকঠিন যুক্তিকে প্রেমের মধুরতম রসে কোমল করে তীব্র কর্মের মসলাতে সুস্বাদু করে এবং যোগের পাকশালায় রান্না করে পরিবেশন করতে চাই, যাতে শিশুরা পর্যন্ত তা হজম করতে পারে। আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
২৫৯*
১৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র তোমার পত্র পেয়ে এবং তোমরা সকলে সঙ্কল্পে দৃঢ়ব্রত আছ জেনে খুব খুশী হলাম। আমার চিঠিগুলিতে খুব কড়া কথা ব্যবহার করেছি; সেজন্য তুমি কিছু মনে করো না, কারণ তুমি জানই তো মাঝে মাঝে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কাজটি ভয়ানক কঠিন, আর যতই তা বাড়ছে, ততই কঠিনতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার দীর্ঘ বিশ্রামের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অথচ এখনই আমার সম্মুখে ইংলণ্ডে বিস্তর কাজ পড়ে আছে। তোমায় অত্যন্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে জেনে আমি বড়ই দুঃখিত হলাম।
ধৈর্য ধরে থাক, বৎস! কাজ এত বাড়বে যে, তুমি ভাবতেও পার না। আমরা আশা করছি, এখানে শীঘ্রই বহু সহস্র গ্রাহক সংগ্রহ করতে পারব, আর আমি ইংলণ্ডে গেলে সেখানেও অনেক পাব। স্টার্ডি ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য তোড়জোড় করছে। সবই সুন্দর, খুব সুন্দর চলছে। তুমি পত্রিকাখানিকে একটা কমিটির হাতে দেবার যে সঙ্কল্প করেছ, আমি তা মোটেই অনুমোদন করি না। ও-রকম কিছু করো না। পত্রিকার সমস্ত পরিচালনা নিজ হাতে রাখ এবং তুমিই স্বত্বাধিকারী থাক। পরে কি করা যায় দেখা যাবে। তুমি ভয় পেও না। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি—যেমন করেই হোক, আমি ব্যয় নির্বাহ করব। কমিটি করা মানে—নানা রুচির লোক আসবে তাদের বিভিন্ন খেয়াল প্রচার করতে, আর অবশেষে সবটা পণ্ড করবে। তোমার ভগ্নীপতি পত্রিকাখানি সুন্দরভাবে সম্পাদনা করছেন, তিনি বিজ্ঞ পণ্ডিত ও অদম্য কর্মী। তাঁকে আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানাবে এবং আর সব বন্ধুকেও জানাবে। সকল কাজেই কৃতকার্য হবার পূর্বে শত শত বাধা-বিঘ্নের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। যারা লেগে থাকবে, তারা শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক আলো দেখতে পাবে।
১| এ এই যে আমি তোমায় চিঠি লিখছি, এরই সঙ্গে সঙ্গে গত রবিবারের বক্তৃতার ফলে আমার সব কয়খানি হাড়ে ব্যথা চলেছে। আমি এক্ষণে মার্কিন সভ্যতার কেন্দ্রস্বরূপ নিউ ইয়র্ককে জাগাতে সমর্থ হয়েছি; কিন্তু এর জন্য আমাকে ভয়ানক সংগ্রাম করতে হয়েছে। গত দু-বৎসর এক পয়সাও আসেনি। হাতে যা-কিছু ছিল, তা প্রায় সবই এই নিউ ইয়র্ক ও ইংলণ্ডের কাজে ব্যয় করেছি। এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, কাজ চলে যাবে।
তারপর ভাব দেখিঃ হিন্দুভাবগুলি ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করা, আবার শুষ্ক দর্শন, জটিল পুরাণ ও অদ্ভুত মনোবিজ্ঞানের মধ্য থেকে এমন ধর্ম বের করা, যা একদিকে সহজ সরল ও সাধারণের হৃদয়গ্রাহী হবে, আবার অন্যদিকে বড় বড় মনীষিগণের উপযোগী হবে! এ যারা চেষ্টা করেছে, তারাই বলতে পারে—কি কঠিন ব্যাপার! সূক্ষ্ম অদ্বৈততত্ত্বকে প্রাত্যহিক জীবনের উপযোগী জীবন্ত ও কবিত্বময় করতে হবে; অসম্ভবরূপ জটিল পৌরাণিক তত্ত্বসকলের মধ্য থেকে জীবন্ত প্রকৃত চরিত্রের দৃষ্টান্তসকল বের করতে হবে; আর বিভ্রান্তিকর যোগশাস্ত্রের মধ্য থেকে বৈজ্ঞানিক ও কার্যে পরিণত করবার উপযোগী মনস্তত্ত্ব বের করতে হবে, আবার এগুলিকে এমন ভাবে প্রকাশ করতে হবে যাতে একটি শিশুও বুঝতে পারে। এই আমার জীবনব্রত। প্রভুই জানেন, আমি কত দূর কৃতকার্য হব। কর্মে আমাদের অধিকার, ফলে নয়। বড়ই কঠিন কাজ, বৎস, বড়ই কঠিন। যতদিন না অপরোক্ষানুভূতি ও পূর্ণ ত্যাগের ভাব ধারণা করবার উপযুক্ত একদল শিষ্য তৈরী হচ্ছে, ততদিন এই কামকাঞ্চনের ঘূর্ণিপাকের মধ্যে আপনাকে স্থির রেখে নিজ আদর্শ ধরে থাকা প্রকৃতই কঠিন ব্যাপার। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এরই মধ্যে অনেকটা কৃতকার্য হওয়া গেছে। আমাকে না বুঝবার জন্য আমি মিশনরীদের বা অন্যদের আর দোষ দিই না; তারা এ ছাড়া আর কি করতে পারত? তারা তো জীবনে পূর্বে কখনও এমন লোক দেখেনি, যে কামিনীকাঞ্চনের মোটেই ধার ধার না। প্রথমে যখন তারা দেখলে, তারা বিশ্বাস করতে পারলে না—পারবেই বা কিরূপে? তুমি যদি কখনও ভেবে থাক যে, ব্রহ্মচর্য ও পবিত্রতা সম্বন্ধে পাশ্চাত্যজাতিদের ধারণা ভারতীয়দেরই অনুরূপ, তাহলে তুমি নিতান্তই ভ্রান্ত। তাদের অনুরূপ শব্দ হচ্ছে বীর্য ও সাহস (virtue and courage)। তাদের সাধুত্বের আদর্শ ঐ পর্যন্ত। তাদের মতে বিবাহাদি স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম—এর অভাবে মানুষ অসাধু; আর যে ব্যক্তি সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সম্মান না করে সে তো অসৎ। … এখন লোকেরা দলে দলে আমার কছে আসছে। এখন শত শত লোক বুঝেছে যে, এমন লোক আছে, যারা নিজেদের কামবৃত্তিকে সত্যই সংযত করতে পারে; আর সাধুতা ও সংযমের প্রতি তাদের ভক্তিশ্রদ্ধাও বাড়ছে। যারা ধৈর্য ধরে থাকে, তাদের সব কিছুই জুটে যায়। তুমি আমার অফুরন্ত আশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমার
বিবেকানন্দ
২৬০*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
228W., 39th St., নিউ ইয়র্ক
২৯ ফেব্রুআরী, ১৮৯৬
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
সম্ভব হলে মে মাসের আগেই আমি যাচ্ছি। এর জন্য তোমায় উদ্বিগ্ন হতে হবে না। পুস্তকাটি সুন্দর হয়েছে। খবরের কাগজের অংশগুলি পেলে পাঠিয়ে দেব।
পুস্তক-পুস্তিকাগুলি এখানে এভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। নিউ ইয়র্কে একটি সমিতি গঠিত হয়েছে। তারাই সাঙ্কেতিক লেখার ও ছাপার যাবতীয় খরচা দিয়েছে, এই শর্তে যে বইগুলির স্বত্বাধিকার তাদের থাকবে। সুতরাং এই পুস্তিকা ও পুস্তকগুলি তাদের। একখানা বই—‘কর্মযোগ’ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে; তার চেয়ে অনেক বড় ‘রাজযোগ’ ছাপা চলছে; ‘জ্ঞানযোগ’ পরে প্রকাশিত হতে পারে। কথা-বলার ভাষা হবার ফলে বইগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করবে, পূর্বেই তা লক্ষ্য করেছ। আপত্তিকর যা কিছু ছিল—সব ছেঁটে দিয়েছি, এবং এঁরা বইগুলি বার করতে সাহায্য করেছে। বইগুলি সমিতির সম্পদ, মিসেস ওলি বুল এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক, মিসেস লেগেটও আছেন।
এখন বইগুলি যে তাঁদের হবে, এটা তো ন্যায়সঙ্গত। তাঁরাই প্রকাশক বলে অন্য প্রকাশকদের হস্তক্ষেপের কোন ভয় নেই।
যদি ভারত থেকে বই আসে, তবে সেগুলি রেখে দেবে।
সাঙ্কেতিক লেখক গুডউইন একজন ইংরেজ; সে আমার কাজে এতটা আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েছে যে, আমি তাকে ব্রহ্মচারী করে নিয়েছি, সে আমার সঙ্গে ঘুরছে, আমরা একসঙ্গে ইংলণ্ডে যাব। সে বরাবরের মত আমার খুব কাজে লাগবে।
আশীর্বাদ সহ তোমাদের
বিবেকানন্দ
২৬১
বোষ্টন
(১ম সপ্তাহ) মার্চ, ১৮৯৬
Dear Sarada (প্রিয় সারদা),৯৩
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। মহোৎসব উপলক্ষে আমি এক cable (তার) পাঠাই, তাহার কোন সংবাদ তো লিখ নাই দেখিতেছি। কয়েক মাস পূর্বে শশী যে সংস্কৃত অভিধান পাঠাইয়াছিল, তাহা তো আজিও পৌঁছে নাই। … আমি শীঘ্রই ইংলণ্ড যাইতেছি। শরতের এখন আসিবার কোনই আবশ্যক নাই; কারণ আমি নিজেই ইংলণ্ড যাইতেছি। যাদের মনের ঠিকানা করতে ছ-মাস লাগে, তাদের আমার দরকার নাই। তাকে ইওরোপ বেড়াবার জন্য আমি ডাকিও নাই এবং টাকাও আমার নাই। অতএব তাকে আসতে বারণ করবে, কাউকেই আসতে হবে না।
টিবেটের (তিব্বতের) সম্বন্ধে তোমার পত্র পাঠ করে তোমার বুদ্ধির উপর হতশ্রদ্ধা হল। প্রথম—নোটোভিচ-এর বই সত্য—nonsence (বাজে কথা)! তুমি কি original (মূল গ্রন্থ) দেখেছ বা India-য় (ভারতে) এনেছ? দ্বিতীয়—Jesus এবং Samaritan Woman-এর (যীশু ও সামারিয়া-দেশীয় নারীর) ছবি কৈলাসের মঠে দেখেছ। কি করে জানলে সে যীশুর ছবি, ঘিষুর নয়? যদি তাও হয়, কি করে জানলে যে, কোন ক্রিশ্চান লোকের দ্বারা তাহা উক্ত মঠে স্থাপিত হয় নাই? টিবেটিয়ানদের (তিব্বতীদের) সম্বন্ধে তোমার মতামতও অযথার্থ। তুমি heart of Tibet (তিব্বতের ভিতরটা) তো দেখ নাই—only a fringe of the traderoute (শুধু বাণিজ্য-পথের ধারে ধারে একটুখানি দেখিয়াছ)। ঐসকল স্থানে কেবল dregs of nation (জাতের নিকৃষ্ট ভাগটাই) দেখতে পাওয়া যায়। কলকেতার চীনেবাজার আর বড়বাজার দেখে যদি কেউ বাঙালীমাত্রকে চোর বলে, তা কি যযার্থ হয়?
শশীর সঙ্গে বিশেষ পরামর্শ করে article (প্রবন্ধ) প্রভৃতি লিখবে … । ইতি
নরেন্দ্র
২৬২*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৭ মার্চ, ১৮৯৬
প্রেমাস্পদেষু—,
এইমাত্র তোমার শেষ চিঠিখানা পেলাম, খুব ভয় পেয়ে গেছি।
বক্তৃতাগুলি হয়েছিল কয়েকজন বন্ধুর উদ্যোগে, তাঁরা সাঙ্কেতিক লিপির এবং অন্য সব কিছুর খরচ দেন—এই শর্তে যে একমাত্র তাঁদেরই সেগুলি প্রকাশ করার অধিকার থাকবে। সেইমত তাঁরা ইতোমধ্যেই রবিবারের বক্তৃতাগুলি এবং রাজযোগ, কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ বিষয়ে তিনটি বই ছাপিয়েছেন। বিশেষতঃ ‘রাজযোগে’র অনেকখানি পরিবর্তন করা হয়েছে এবং পতঞ্জলির ‘যোগসূত্রে’র অনুবাদসহ ঢেলে সাজান হয়েছে। রাজযোগ লংম্যানদের হাতে। বইগুলি ইংলণ্ডে ছাপানর কথায় এখানকার বন্ধুরা খুব চটে গিয়েছেন; যেহেতু আইনতঃ আমি সেগুলি তাঁদের দিয়ে দিয়েছি। এখন কি করা যায়—বুঝতে পারছি না। পুস্তিকাগুলি প্রকাশের ব্যাপারটা গুরুতর নয়, কিন্তু পুস্তকগুলির এত পুনর্বিন্যাস ও পরিবর্তন করা হয়েছে যে, আমেরিকান সংস্করণ দেখে ইংরেজী সংস্করণ চেনাই যাবে না। এখন অনুরোধ করছি—এই বইগুলি প্রকাশ করো না, অন্যথা আমি বড় অপ্রস্তত হয়ে যাব এবং অফুরন্ত ঝগড়ার সৃষ্টি হয়ে আমার আমেরিকার কাজ পণ্ড হয়ে যাবে।
ভারতের শেষ চিঠিতে জেনেছি যে, একজন সন্ন্যাসী ভারত থেকে রওনা হয়েছেন। আমি মিস মূলারের কাছ থেকে একখানা সুন্দর চিঠি পেয়েছি, মিস ম্যাকলাউডের কাছ থেকেও একখানা; লেগেট পরিবার আমার প্রতি খুব অনুরক্ত হয়ে পড়েছে।
আমি মিঃ চ্যাটার্জি সম্পর্কে কিছুই জানি না। অন্য সূত্র থেকে শুনতে পেলাম যে, তাঁর হল অর্থকষ্ট—থিওসফিষ্টরা তাঁকে টাকা দিতে পারছে না। তাছাড়া ভারত থেকে একজন অপেক্ষাকৃত শক্তিমান্ লোক আসছে, তার তুলনায় তিনি আমাকে যেটুকু সাহায্য করতে পারবেন, তা যৎসামান্য। তাঁর সঙ্গে ঐ পর্যন্তই। আমাদের তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই।
তোমাকে আবার অনুরোধ করছি, এই পুস্তক প্রকাশের ব্যাপারটা ভেবে দেখো, এবং মিসেস বুলকে কয়েকটি চিঠি লেখো ও তাঁর মাধ্যমে আমেরিকার বেদান্তের বন্ধুদের মতামত জিজ্ঞেস কর। মনে রেখো আমাদের প্রচারিত নীতি ‘সকল প্রাণীর একত্ব’; আর জাতীয়তামূলক সমস্ত ভাবই দুষ্ট কুসংস্কার মাত্র। অধিকন্তু আমার নিশ্চিত ধারণা যে, যিনি অপরের মতে সায় দিতে প্রস্তুত, শেষে তিনি তাঁর নিজ মতেরই জয় প্রত্যক্ষ করেন। সর্বদা নতিস্বীকারই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে। আমাদের সকল বন্ধুকে ভালবাসা।
ভালবাসা ও আশীর্বাদসহ তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুনঃ—আমি মার্চ মাসেই যত তাড়াতাড়ি পারি নিশ্চয় যাচ্ছি।
২৬৩*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
প্রিয় ভগিনী,
আমার ভয় হচ্ছে—তুমি ক্ষুণ্ণ হয়েছ, তাই আমার একটি চিঠিরও জাবাব দাওনি। তা এখন হাজার ক্ষমা চাইছি। সৌভাগ্যক্রমে কমলা রঙের কাপড় পেয়ে গেছি এবং যত শীঘ্র পারি একটি কোট তৈরী করে নিচ্ছি। শুনে আনন্দিত হলাম যে, মিসেস বুলের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল। তিনি সত্যি মহীয়সী নারী এবং সহৃদয় বন্ধু। একটি কথা ভগিনী, ঘরে দুটি খুব পাতলা সংস্কৃত পুস্তিকা আছে। যদি অসুবিধা না হয়, সেগুলি দয়া করে পাঠিয়ে দিও। ভারত থেকে বইগুলি নিরাপদে এসে পৌঁছেছে এবং তার জন্য আমাকে কোন শুল্ক দিতে হয়নি। কম্বলগুলি ও গালিচা এখনও এসে পৌঁছয়নি জেনে আমি অবাক হয়েছি। মাদার টেম্পলের সঙ্গে আর দেখা করতে যেতে পারিনি; সময় পাইনি। যখনই একটু সময় পাই গ্রন্থাগারে কাটাই।
তোমাদের সকলকে আমার চিরদিনের ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা।
তোমাদের সতত স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পুঃ—মিঃ হাউ বরাবরই ক্লাসে আসছেন, এই শেষ ক-দিন আসেননি। মিস হাউকে আমার ভালবাসা জানাবে।
—বি
২৬৪*
বোষ্টন
২৩ মার্চ, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমার চিঠির উত্তর আগে দিতে পারিনি; আর এখন আমায় বেজায় তাড়াতাড়ি করতে হচ্ছে। সম্প্রতি যাদের আমি সন্ন্যাস দিয়েছি, তাদের মধ্যে সত্যই একজন স্ত্রীলোক, ইনি মজুরদের নেত্রী ছিলেন; বাকী সব পুরুষ। ইংলণ্ডে আমি আরও কয়েকজনকে সন্ন্যাস দেব, তারপর তাদের আমার সঙ্গে ভারতে নিয়ে যাবার চেষ্টা করব। হিন্দুদের চেয়ে এইসব ‘সাদা মুখ’ সেখানে বেশী প্রভাব বিস্তার করবে; তা ছাড়া তাদের কাজ করবার শক্তিও বেশী, হিন্দুরা তো মরে গেছে। ভারতের একমাত্র ভরসার স্থল জনসাধারণ—অভিজাত সম্প্রদায় তো শারীরিক ও নৈতিক হিসাবে মরে গেছে।
হরমোহন সম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, আমি দীর্ঘকাল পূর্বেই তাকে আমার বক্তৃতাগুলি ছাপাবার স্বাধীনতা দিয়েছিলাম, কারণ সে আমার পুরানো বন্ধু, সাচ্চা ভক্ত ও অত্যন্ত গরীব।
‘ব্রহ্মবাদিন্’-এ লম্বা লম্বা সংস্কৃত প্রবন্ধ থাকায় ইওরোপ ও আমেরিকায় উহা চলার সম্ভাবনা বড়ই অল্প। তুমি এটাকে সংস্কৃতে ছাপালেই তো পার? সংস্কৃত পারিভাষিক শব্দ এবং অফুরন্ত সংস্কৃত শ্লোকাদি উদ্ধৃত করলে হিন্দুদের ও সংস্কৃতজ্ঞ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের হয়তো বেশ সাহায্য হতে পারে, কিন্ত সাধারণ পাশ্চাত্যবাসী তো আর তোমার হিন্দু দর্শনের ধার ধারে না! একান্ত যদি রাখতে চাও তো না হয় একটা প্রবন্ধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ কর—বাকীগুলিতে সংস্কৃত শব্দ না থাকাই উচিত এবং লেখা হালকা হওয়া উচিত। আমার যে সাফল্য হচ্ছে, তার কারণ আমার সহজ ভাষা। আচার্যের মহত্ত্ব হচ্ছে—তাঁর ভাষার সরলতা। তুমি যদি জনসাধারণের উপযুক্ত করে বেদান্ত সম্বন্ধে লিখতে পার, তবে ‘ব্রহ্মবাদিন্’ এখানে জনপ্রিয় হবে—নতুবা নয়। যে কয়জন গ্রাহক হয়েছে, তারা শুধু আমার প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার ফলে।
শ্রীগুরু মহারাজের জন্মতিথিতে আমি ভারতে যে তার পাঠিয়েছিলাম, সেটি তারা পেয়েছে কিনা একটু খোঁজ নিয়ে দেখো তো।
আগামী মাসে ইংলণ্ডে যাচ্ছি। আমার ভয় হয়—আমার খাটুনি অত্যধিক হয়ে পড়ছে; এই দীর্ঘ একটানা পরিশ্রমে আমার স্নায়ুমণ্ডলী যেন ছিঁড়ে গেছে। তোমাদের কাছ থেকে সহানুভূতি আমি কিছুমাত্র চাই না; শুধু এইজন্য লিখছি যে, তোমরা আমার কাছ থেকে বেশী কিছু আশা করো না। যতদূর ভালভাবে সম্ভব কাজ করে যাও। আমার দ্বারা সম্প্রতি কোন বড় কাজ হবে, এমন আশা নেই বলেই মনে হয়। যা হোক সাঙ্কেতিক প্রণালীতে আমার বক্তৃতাগুলি লিখে নেবার ফলে অনেকটা সাহিত্য গড়ে উঠেছে দেখে আমি খুশী। চারিখানি বই তৈরী হয়ে গেছে। একখানি বেরিয়ে গেছে, ‘পাতঞ্জলসূত্রে’র অনুবাদ সহ ‘রাজযোগে’র বইখানি ছাপা হচ্ছে, ‘ভক্তিযোগে’র বইটা তোমার কাছে আছে, আর ‘জ্ঞানযোগে’রটা গুছিয়ে নিয়ে ছাপার জন্য তৈরী হচ্ছে। তা ছাড়া রবিবারের বক্তৃতাগুলিও ছাপা হয়ে গেছে। স্টার্ডি বিরাট কর্মী, সে সব কাজই খুব এগিয়ে দিতে পারে। যা হোক, লোককল্যাণের জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি—এই মনে করেই আমি সন্তুষ্ট; আর কাজ থেকে অবসর নিয়ে আমি যখন গিরিগুহায় ধ্যানে মগ্ন হব, তখন এ বিষয়ে আমার বিবেক সাফ থাকবে।
সকলে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
২৬৫*
আমেরিকা
মার্চ, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এই সঙ্গে পত্রিকার জন্য তোমাকে ১৬০ ডলার পাঠালাম। আমি আমার শিষ্যদের বলেছি, যাতে তারা তোমার জন্য কিছু গ্রাহক সংগ্রহ করে। জনকয়েক ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে। কাজ চালিয়ে যাও। কিন্তু তুমি মনে রেখো যে, আমাকে লণ্ডন নিউ ইয়র্ক কলিকাতা ও মান্দ্রাজে কাজ চালাতে হচ্ছে। এখন আমি লণ্ডনের কাজে যাচ্ছি। প্রভুর ইচ্ছে হলে এখানে ও ইংলণ্ডে গৈরিক-পরিহিত সন্ন্যাসীতে ছেয়ে যাবে। বত্সগণ, কাজ করে যাও।
মনে রেখো, যতদিন তোমাদের গুরুর উপর শ্রদ্ধা থাকবে, ততদিন কেউ তোমাদের বাধা দিতে পারবে না। ভাষ্য তিনখানির ঐ অনুবাদটি পাশ্চাত্যবাসীদের দৃষ্টিতে একটা মস্ত বড় কাজ হবে।
ঐ ‘সর্বজনীন ভাবের মন্দির’টি (Temple of the Universal Spirit) আমি ছেড়ে দিয়েছি—এখন একটা নূতন নাম দিয়েছি … । ইতোমধ্যেই আমার দুইজন সন্ন্যাসী শিষ্য ও কয়েক শত গৃহস্থ শিষ্য হয়েছে; কিন্তু বত্স, জনকয়েক ছাড়া তাদের অধিকাংশই গরীব; তবে জনকয়েক খুব ধনীও আছে। এ সংবাদটি এখনই প্রকাশ করে দিও না যেন। যথাসময়ে আমি জনসাধারণের সামনে আবার আত্মপ্রকাশ করব। স্থির হয়ে থাক, বত্স! স্থির হও, আর কাজ করে যাও। ধৈর্য, ধৈর্য! আগামী বত্সর আমি নিউ ইয়র্কে একটি মন্দির করবার আশা রাখি; তারপর প্রভু জানেন।
এখানে একখানি পত্রিকা চালাব; লণ্ডনে যাচ্ছি এবং যদি প্রভুর কৃপা হয়, তবে ওখানেও তাই করব। আমার ভালাবাসাদি জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
২৬৬*
আমেরিকা
১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
গত সপ্তাহে আমি তোমাকে ‘ব্রহ্মবাদিন্’ সম্বন্ধে লিখেছিলাম। তাতে ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে বক্তৃতাগুলির কথা লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম। ঐগুলি সব একসঙ্গে পুস্তিকাকারে বের করা উচিত। কয়েক শত আমেরিকায় নিউ ইয়র্কে গুডইয়ারের নামে পাঠাতে পার। আমি বিশ দিনের মধ্যে জাহাজে ইংলণ্ড রওনা হচ্ছি। কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও রাজযোগ সম্বন্ধে আমার আরও বড় বড় বই আছে। ‘কর্মযোগ’ ইতোমধ্যেই বেরিয়ে গেছে। ‘রাজযোগ’খানা খুব বড় হবে—তাও যন্ত্রস্থ হয়েছে। ‘জ্ঞানযোগ’খানা বোধ হয় ইংলণ্ড থেকে ছাপাতে হবে।
তোমরা ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এ কৃ—র একখানা পত্র ছেপেছ, কাজটা ভাল হয়নি। … ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর সুরের সঙ্গে ওটি খাপ খায় না। … কোন সম্প্রদায়—ভালই হোক, আর মন্দই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এ কিছু ছাপান যেন না হয়। অবশ্য বুজরুকদের প্রতি গায়ে পড়ে সহানুভূতি দেখাবারও কোন আবশ্যক নেই। আবার তোমাদের জানিয়ে রাখছি, কাগজটা এতই পারিভাষিক হয়ে পড়েছে যে, এখানে এর গ্রাহক বড় হবে না। সাধারণ পাশ্চাত্যদেশবাসী ঐ সব দাঁতভাঙ্গা সংস্কৃত কথা বা পরিভাষা জানেও না, জানবার বিশেষ আগ্রহও রাখে না। এইটুকু আমি দেখছি যে, কাগজটা ভারতের পক্ষে বেশ উপযোগী হয়েছে। কোন একটা মতবিশেষের ওকালতি করা হচ্ছে, এমন একটি কথাও যেন সম্পাদকীয় প্রবন্ধে না থাকে। আর সর্বদা মনে রেখো যে, তোমরা শুধু ভারত নয়, সমগ্র জগৎকে সম্বোধন করে কথা বলছ; আর তোমরা যা বলতে চাইছ, জগৎ তার সম্বন্ধে একেবারে অজ্ঞ। প্রত্যেক অনূদিত সংস্কৃত শব্দ খুব সাবধানে ব্যবহার করো; আর ভাষা যতটা সম্ভব সহজ করবার চেষ্টা করো।
তোমরা এই পত্র পাবার আগেই আমি ইংলণ্ড পৌঁছে যাব। সুতরাং আমাকে স্টার্ডির ঠিকানায়—হাইভিউ, কেভার্শ্যাম, ইংলণ্ড—পত্র লিখবে। ইতি
তোমাদের বিবেকানন্দ
২৬৭*
চিকাগো
৬ এপ্রিল, ১৮৯৬
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার হৃদ্যতাপূর্ণ পত্রখানি যথাসময়ে পেয়েছি। বন্ধুগণের সঙ্গে আমি ইতোমধ্যে অনেক সুন্দর স্থান দেখেছি এবং অনেকগুলি ক্লাস করেছি। আরও কয়েকটি ক্লাস করতে হবে, তারপর আগামী বৃহস্পতিবার রওনা হব।
মিস এডামসের অনুগ্রহে এখানকার সব ব্যবস্থাই সুন্দর হয়েছে; তিনি এত ভাল এবং দরদী! গত দুইদিন যাবৎ সামান্য একটু জ্বরে ভুগছি বলে দীর্ঘ পত্র লিখতে পারলাম না।বোষ্টনের সকলকে আমার ভালবাসা জানাবেন। ইতি
বিবেকানন্দ
২৬৮*
125, East, 44th St, নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬
প্রিয়—,
… এই অনুসন্ধিৎসু ভদ্রলোকটি বোম্বে থেকে একখানি চিঠি নিয়ে এখানে আমার কাছে এসেছেন। ভদ্রলোক যন্ত্রশিল্পে দক্ষ (practical mechanic), এবং তাঁর একমাত্র ইচ্ছা এই যে, তিনি এদেশের ছুরি, কাঁচি ও অন্যান্য লৌহ নির্মিত দ্রব্যগুলির কারখানা দেখে বেড়ান। … আমি তাঁর সম্বন্ধে কিছুই জানি না; তিনি যদি মন্দ লোকও হন, তা হলেও আমার স্বদেশবাসীদের ভেতর এরকম বেপরোয়া সাহসের ভাব দেখলে উৎসাহ দিতেই ইচ্ছা করি। তাঁর নিজের খরচ চালাবার মত যথেষ্ট টাকা আছে।
লোকটি কতদূর সাচ্চা—এ সম্বন্ধে পরীক্ষা করে যদি আপনি সন্তুষ্ট হন, তা হলে তাঁকে সুবিধা দেবেন; তিনি ঐ কারখানাগুলি দেখবার একটা সুযোগ চান মাত্র। আশা করি, তিনি খাঁটি লোক, আর আপনি তাঁকে এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন। আমার আন্তরিক শ্রদ্ধাদি জানবেন। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
২৬৯*
[ডাঃ নাঞ্জুণ্ড রাওকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬
প্রিয় ডাক্তার,
আজ সকালে আপনার চিঠি পেলাম। আগামী কাল আমি ইংলণ্ডে রওনা হচ্ছি, তাই আপনাকে দু-চারটি মাত্র আন্তরিক কথা লিখতে পারব। ছেলেদের প্রস্তাবিত কাগজের বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতিটি আছে এবং তা চালিয়ে যাবার জন্য আমি যথাসাধ্য সাহায্যও করব। আপনার উচিত, ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর ধারা অবলম্বন করে কাগজটাকে স্বাধীনমতাবলম্বী করা; কেবল ভাষা ও লেখাগুলো যাতে আরও সহজবোধ্য হয়, সেদিকে বিশেষ নজর রাখবেন। ধরুন, আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যে যে-সব অপূর্ব গল্প ছড়ান আছে, তা সহজবোধ্য ভাষায় আবার লেখা ও জনপ্রিয় করা দরকার; এই একটা মস্ত সুযোগ রয়েছে, যা হয়তো আপনারা স্বপ্নেও ভাবেননি। এই জিনিষটাই আপনাদের কাগজের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হবে। যেমন সময় পাব, তেমন আপনাদের জন্য আমি যত বেশী পারি—গল্প লিখব। কাগজটাকে খুব পাণ্ডিত্যপূর্ণ করবার চেষ্টা একেবারে ত্যাগ করুন, তার জন্য ‘ব্রহ্মবাদিন্’ রয়েছে। এভাবে চললে কাগজটা ধীরে ধীরে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে নিশ্চয়ই। ভাষাটা যতদূর সম্ভব সহজ করবেন, তা হলেই আপনারা সফল হবেন। গল্পের ভেতর দিয়ে ভাব দেওয়াই হবে প্রধান বৈশিষ্ট্য। কাগজটাকে জটিল দার্শনিক তত্ত্ববহুল মোটেই করবেন না। লেনদেনের দিকটা সম্পূর্ণরূপে নিজের হাতে রাখবেন—অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। ভারতে একটা জিনিষের বড়ই অভাব—একতা বা সংহতিশক্তি, তা লাভ করবার প্রধান রহস্য হচ্ছে আজ্ঞানুবর্তিতা।
কলিকাতায় বাঙলা ভাষায় একখানি পত্রিকা আরম্ভ করতে সাহায্য করব বলে কথা দিয়েছি। কিন্তু ব্যাপার এই—প্রথম দু-বছরই মাত্র বক্তৃতার জন্য টাকা আদায় করেছি; গত দু-বছর আমার কাজের সঙ্গে দেনা-পাওনার কোন সম্পর্ক ছিল না। এর ফলে আপনাকে বা কলিকাতার লোকদের পাঠাবার মত টাকা আমার মোটেই নেই। তথাপি আপনাকে সাহায্য করতে পারে, এমন লোক আমি শীঘ্রই জুটিয়ে দেব। বীরের মত এগিয়ে চলুন। একদিনে বা এক বছরে সফলতার আশা করবেন না। সর্বদা শ্রেষ্ঠ আদর্শকে ধরে থাকুন। দৃঢ় হউন, ঈর্ষা ও স্বার্থপরতা বিসর্জন দিন। নেতার আদেশ মেনে চলুন; আর সত্য, স্বদেশ ও সমগ্র মানবজাতির নিকট চিরবিশ্বস্ত হউন; তা হলেই আপনি জগৎ কাঁপিয়ে তুলবেন। মনে রাখবেন—ব্যক্তিগত ‘চরিত্র’ এবং ‘জীবন’ই শক্তির উৎস, অন্য কিছু নহে। এই চিঠিখানা রেখে দেবেন এবং যখনই উদ্বেগ ও ঈর্ষার ভাব মনে উঠবে, তখনই এই শেষের কটা লাইন পড়বেন। ঈর্ষাই সমস্ত দাসজাতির ধ্বংসের কারণ। এ থেকেই আমাদের জাতির সর্বনাশ। এটি সর্বদা পরিত্যাজ্য। আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হোক; আপনার সাফল্য কামনা করি। ইতি
আপনার স্নেহপরায়ণ
বিবেকানন্দ
২৭০*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
6 West, 43rd St., নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬
স্নেহের ভগিনীগণ,
রবিবার নিরাপদে এসে পৌঁছেছি এবং অসুস্থতার জন্য আগে চিঠি দিতে পারিনি। হোয়াইট স্টার লাইনের ‘জার্মানীক’ জাহাজে আগামী কাল বেলা বারটায় যাত্রা করছি। ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা ও আশীর্বাদের চিরস্থায়ী স্মৃতির সঙ্গে—
তোমাদের চির স্নেহের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
২৭১
[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬
কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইলাম। শরৎ পৌঁছিয়াছে সংবাদ পাইলাম। তোমার প্রেরিত Indian Mirror (ইণ্ডিয়ান মিরর) ও পত্র পাইলাম। লেখা উত্তম হইতেছে, বরাবর লিখিয়া যাও। দোষ দেখা বড়ই সহজ, গুণ দেখাই মহাপুরুষের ধর্ম—এ-কথা ভুলিবে না। ‘মুগের ডাল তৈয়ার হয় নাই’ মানে কি? ভাজা মুগের ডাল পাঠাইতে আমি পূর্বেই নিষেধ করিয়াছি, ছোলার ডাল ও কাঁচা মুগের ডাল পাঠাইতে বলি। ভাজা মুগ এতদূর আসিতে খারাপ ও বিস্বাদ হইয়া যায়, সিদ্ধ হয় না। যদি এবারও ভাজা মুগ হয়, টেমসের জলে যাইবে ও তোমাদের পণ্ডশ্রম। আমার চিঠি না পড়িয়াই কাজ কেন কর? চিঠি হারাও বা কেন? যখন চিঠি লিখবে, পূর্বের পত্র সম্মুখে রাখিয়া লিখিবে। তোমাদের একটু business (কাজ-চালানর) বুদ্ধি আবশ্যক। যে-সকল কথা আমি জিজ্ঞাসা করি, তাহার উত্তর প্রায়ই পাই না—কেবল আবোল-তাবোল! … চিঠি হারায় কেন? ফাইল হয় না কেন? সকল কাজেই ছেলেমানুষি! আমার চিঠি হাটের মাঝে পড়া হয় বুঝি? আর যে আসে, সে-ই ফাইল টেনে চিঠি পড়ে বুঝি? ... You need a little business faculty. … Now what you want is organization—that requires strict obedience and division of labour. I will write out everything in every particular from England, for which I start to-morrow. I am determined to make you decent workers thoroughly organized. ৯৪ …
'Friend' (ফ্রেণ্ড—বন্ধু) শব্দ সকলের প্রতি ব্যবহৃত হয়। ইংরেজী ভাষায় ও-সকল cringing politeness (দীনা হীনা ভদ্রতা) নাই; ঐ সকল বাঙলা শব্দের তর্জমা হাস্যাস্পদ হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংস, ঈশ্বর, ভগবান্—ও-সকল এদেশে কি চলে? M—has a tendency to put that stuff down everybody's throat, but that will make our movement a little sect. You keep separate from such attempts. At the same time, if people worship him as God, no harm. Neither encourage, nor discourage. The masses will always have the person, the higher ones, the principle; we want both. But principles are universal, not persons. Therefore stick to the principles he taught; let people think whatever they like of this person. … Truce to all quarrels and jealousy and bigotry! These will spoil everything. 'The first should be last and the last first'.৯৫
‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’ (আমার ভক্তগণের যাহারা ভক্ত, তাহারাই আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত)। ইতি
বিবেকানন্দ
২৭২*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
Waveney Mansions
Fairhazel Gardens, London
এপ্রিল, ১৮৯৬, বৃহস্পতিবার অপরাহ্ণ
প্রিয় স্টার্ডি,
আমি সকালবেলা তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে, অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার চিঠিতে জানিয়েছেন—যদি আমি অক্সফোর্ডে বক্তৃতা করতে যাই, তিনি যথাসাধ্য সাহায্য করবেন।
তোমার স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুনঃ—শঙ্কর পাণ্ডুরঙ্গ কর্তৃক সম্পাদিত অথর্ববেদ-সংহিতার জন্য তুমি কি চিঠি লিখেছ?
—বি
২৭৩
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
হাইভিউ, কেভার্শ্যাম
রিডিং, ইংলণ্ড
সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ১৮৯৬
কল্যাণবরেষু,
শরতের মুখে সবিশেষ অবগত … হইলাম। ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল’—একথা সর্বদা মনে রাখিবে। … আমি নিজের কর্তৃত্বলাভের আশায় নয়, কিন্তু তোমাদের কল্যাণ ও প্রভুর অবতীর্ণ হইবার উদ্দেশ্য সফলের জন্য লিখিতেছি। তিনি তোমাদের ভার আমার উপর দিয়াছিলেন এবং তোমাদের দ্বারা জগতের মহাকল্যাণ হইবে, যদিও অনেকেই এক্ষণে তাহা অবগত নও; এজন্যই বিশেষ লিখিতেছি, মনে রাখিবে। তোমাদের মধ্যে দ্বেষভাব ও অহমিকা প্রবল হইলে বড়ই দুঃখের বিষয়। যারা দশজনে দশদিন প্রীতির সহিত বাস করিতে সক্ষম নহে, তাহাদের দ্বারা জগতে প্রীতিস্থাপন কি সম্ভব? নিয়মবদ্ধ হওয়া ভাল নয় বটে, কিন্তু অপক্ব অবস্থায় নিয়মের বশে চলা আবশ্যক—অর্থাৎ প্রভু যে প্রকার আদেশ করিতেন যে, কচিগাছের চারিদিকে বেড়া দিতে হয় ইত্যাদি। দ্বিতীয়তঃ অলস মনে অনেক পরচর্চা, দলাদলি প্রভৃতি ভাব সহজেই আসে। সেইজন্য নিম্নলিখিত নির্দেশগুলি লিখিতেছি। তদনুযায়ী কাজ যদি কর, পরম মঙ্গল হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। না যদি কর, শীঘ্রই সমস্ত পরিশ্রম বিফল হইবার সম্ভাবনা।
প্রথমতঃ মঠ চালাইবার সম্বন্ধে লিখিঃ
১। মঠের জন্য একটা যথেষ্ট স্থান সহিত বাটী ভাড়া লইবে অথবা বাগান, যাহাতে প্রত্যেকের জন্য এক একটি ছোট ঘর হয়। একটা বড় হল পুস্তকাদি রাখিবার জন্য, এবং একটি ছোট ঘর—সেখানে লোকজনের সহিত দেখাশুনা করিবে। যদি সম্ভব হয়—আরও একটা বড় হল ঐ বাটীতে থাকার আবশ্যক, যেখানে প্রত্যহ শাস্ত্র ও ধর্মচর্চা সাধারণের জন্য হইবে।
২। কোন লোক মঠে আসিলে সে যার সহিত দেখা করিতে চায়, তারই সঙ্গে দেখা করিয়া চলিয়া যাইবে, অপরকে দিক্ না করে।
৩। এক একজন পরিবর্তন করিয়া প্রত্যহ কয়েক ঘণ্টা উক্ত হলে সর্বসাধারণের নিমিত্ত উপস্থিত থাকিবে—যাহাতে সাধারণ লোক যাহা জিজ্ঞাসা করিতে আসে, তাহার সদুত্তর পায়।
৪। যে যার আপনার ঘরে বাস করিবে—বিশেষ কার্য না পড়িলে আর একজনের ঘরে কিছুতেই যাইবে না। পুস্তকাগারে যাহার পড়িবার ইচ্ছা হইবে, যাইয়া পাঠ করিবে। কিন্তু তথায় তামাক খাওয়া বা অপরের সহিত কথাবার্তা একেবারেই নিষেধ করিবে। নিঃশব্দে পাঠ করিতে হইবে।
৫। সারাদিন সকলে পড়ে (মিলে) একটা বাজে কথা কওয়া ও বাহিরের লোক যে-সে আসছে ও সেই গোলমালে যোগ দিচ্ছে, তাহা একেবারেই নিষেধ।
৬। কেবল যাহারা ধর্মজিজ্ঞাসু, তাহারা শান্তভাবে আসিয়া সাধারণ হলে বসিয়া থাকিবে ও যাহাকে চায় তাহার সহিত দেখা করিয়া চলিয়া যাইবে। অথবা কোন সাধারণ জিজ্ঞাস্য থাকে, সেদিনকার জন্য যিনি সেই কার্যের ভার পাইয়াছেন, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া চলিয়া যাইবে।
৭। একজনের কথা আর একজনকে বলা বা গুজোগুজি, পরনিন্দা একেবারেই ত্যাগ করিবে।
৮। একটা ছোট ঘর অফিস হইবে। যিনি সেক্রেটারী, তিনি সেই ঘরে থাকিবেন ও সেই ঘরে কালি, কাগজ, চিঠি লিখিবার সরঞ্জাম ইত্যাদি সমস্ত থাকিবে। তিনি সমস্ত আয়ব্যয়ের হিসাব রাখিবেন ও যে-সমস্ত চিঠিপত্র ইত্যাদি আসে, তাহা তাঁহার নিকট আসিবে ও তিনি পত্রাদি না খুলিয়া যাহার যাহার নামে তাহাকে তাহাকে বাঁটিয়া দিবেন। পুস্তক ও পত্রিকাদি পুস্তকাগারে যাইবে।
৯। একটা ছোট ঘর থাকিবে তামাক খাইবার জন্য। তদ্ভিন্ন অপর কোন স্থানে তামাক খাইবার আবশ্যক নাই।
১০। যিনি গালিমন্দ বা ক্রোধাদি করিতে চান, তাঁহাকে ঐ সকল কার্য মঠের বাহিরে যাইয়া করিতে হইবে। ইহার অন্যথা তিলমাত্র না হয়।
শাসন সমিতি
১। একজন মহান্ত প্রতি বৎসর নির্বাচন করিবে অধিক লোকের মত লইয়া। দ্বিতীয় বৎসর আর একজন ইত্যাদি।
২। এ বৎসর রাখালকে মহান্ত কর, তদ্বৎ আর একজনকে সেক্রেটারী কর; তদ্বৎ আর একজন পূজাপত্র ও রান্নাবান্নার তদারক করিবার জন্য নির্বাচন কর।
৩। সেক্রেটারীর আর এক কাজ—তিনি সকলের স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখিবেন। এই বিষয়ে তিনটি উপদেশ আছে—
১ম—প্রত্যেক ঘরে প্রত্যেক লোকের জন্য এক একটি নেয়ারের খাটিয়া ও তোষক ইত্যাদি (থাকিবে)। প্রত্যেককে আপনার আপনার ঘর পরিষ্কার করিতে হইবে।
২য়—রান্না ও খাওয়ার জন্য জল যাহাতে পরিষ্কার ও দোষহীন হয়, তাহা অবশ্যই করিবে; কারণ দুষ্ট বা অপরিষ্কৃত জলে ভোগ রাঁধিলে মহাপাপ হয়।
৩য়—শরৎকে যে প্রকার কোট করিয়া দিয়াছ, ঐ প্রকার গেরুয়া আলখাল্লা প্রত্যেককে দুটি করিয়া দিবে এবং কাপড়-চোপড় যাহাতে পরিষ্কার থাকে (তাহা দেখিবে); … বাটী অত্যন্ত পরিষ্কার যাহাতে হয়—নীচের উপরের সমস্ত ঘর—(সেদিকে নজর রাখিবে)।
৪। যে কেউ সন্ন্যাসী হতে চায়, প্রথমে তাহাকে ব্রহ্মচারী করিবে—এক বৎসর মঠে, এক বৎসর বাহিরে—তার পর সন্ন্যাসী করিয়া দিবে।
৫। ঠাকুরপূজার ভার উক্ত ব্রহ্মচারীদের মধ্যে একজনকে দিবে এবং মধ্যে মধ্যে বদলাইয়া দিবে।
বিভাগ
মঠে এই কয়েকটি বিভাগ থাকিবে, যথাঃ (১) বিদ্যা-বিভাগ, (২) প্রচার-বিভাগ, (৩) সাধন-বিভাগ।
বিদ্যা-বিভাগঃ যাহারা পড়িতে চায়, তাহাদের জন্য পুস্তকাদি ও অধ্যাপক সংগ্রহ—এই বিভাগের উদ্দেশ্য। প্রত্যহ প্রাতঃকালে এবং সায়ংকালে তাহাদের জন্য অধ্যাপক উপস্থিত থাকিবে।
প্রচার-বিভাগঃ মঠবাসী ও প্রবাসী। মঠবাসী প্রচারকেরা প্রত্যহ শাস্ত্রাদিপাঠ ও প্রশ্নোত্তরাদি দ্বারা জিজ্ঞাসুদের শিক্ষা দিবে। প্রবাসীরা গ্রামে গ্রামে প্রচার করিবে ও স্থানে স্থানে উক্তরূপ মঠ স্থাপনের চেষ্টা করিবে।
সাধন-বিভাগঃ যাঁহারা সাধন-ভজন করিতে চান, তাঁহাদের আপন আপন ঘরে সাধন-ভজনের যাহা আবশ্যক—তাহার সহায়তা করা ইত্যাদি। কিন্ত একজন সাধন করেন বলিয়া আর কাউকেও যে পড়িতে দিবেন না, অথবা প্রচার করিতে দিবেন না—এ প্রকার না হয়। যিনি উৎপাত করিবেন, তাঁহাকে অন্তর (তফাৎ) হইতে তৎক্ষণাৎ বলিবে—ইহাতে অন্যথা না হয়।
মঠবাসী প্রচারকেরা পর্যায়ক্রমে ভক্তি জ্ঞান যোগ ও কর্মসম্বন্ধে উপদেশ করিবেন, এবং তৎসম্বন্ধে দিবস ও সময় নির্দিষ্ট করিয়া উক্ত শিক্ষাগৃহের দ্বারে লটকাইয়া দিবেন—অর্থাৎ যাহাতে ভক্তিজিজ্ঞাসু জ্ঞানশিক্ষার দিনে আসিয়া আঘাত না পায় ইত্যাদি। বামাচার সাধনে উপযুক্ত তোমরা কেহই নহ; অতএব বামমার্গের নামগন্ধও মঠে যেন না হয়। যিনি এ-কথা না শুনিবেন, তাঁহার স্থান বাহিরে। ওঁ-সাধনের নাম পর্যন্ত যেন মঠে না হয়। ‘তাঁর’ ঘরে যে- দুর্বৃত্ত বিকট বামাচার ঢোকায়, তার ইহ-পরকাল উৎসন্ন হইবে।
কয়েকটি সাধারণ নির্দেশ
১। কোন স্ত্রীলোক যদি কোন সন্ন্যাসীর সহিত দেখা করিতে আইসে, তাহা হইলে সাধারণ গৃহে যাইয়া কথাবার্তা কহিবে। কোন স্ত্রীলোক অন্য কোন ঘরে প্রবেশ করিতে পাইবে না, ঠাকুরঘর ছাড়া।
২। কোন সন্ন্যাসী মেয়েদের মঠে যাইয়া বাস করিতে পাইবে না। যদি না শুনে, মঠ হইতে দূর করিবে। দুষ্ট গরু অপেক্ষা শূন্য গোয়াল (ভাল)। ...
৩। দুশ্চরিত্র লোকের একেবারেই প্রবেশ নিষেধ। কোন অছিলায় তাদের ছায়া যেন আমাদের ঘরে না পড়ে। যদি তোমাদের মধ্যে কেউ দুশ্চরিত্র হয়, যে-কেহ হউক—তৎক্ষণাৎ বিদায় কর। দুষ্ট গরুর দরকার নাই। প্রভু অনেক ভাল ভাল লোক আনিবেন।
৪। শিক্ষা দিবার গৃহে ও সময়ে, এবং প্রচারের গৃহে ও সময়ে যে-কোন স্ত্রীলোক আসিতে পারেন; কিন্তু উক্ত সময় অতীত মাত্রেই চলিয়া যাইতে হইবে।
৫। কোন ক্রোধ বা ঈর্ষা প্রকাশ, বা গোপনে একজনের নিন্দা আর একজনের কাছে কদাচ করিবে না। … একজন আর একজনের দোষ দেখিতে খুব মজবুত—আপনার দোষগুলি কেউ সারাইবেন না!
৬। আহারের নির্দিষ্ট সময় যেন হয়। প্রত্যেকের বসিবার জন্য একটা আসন ও খাইবার জন্য একটা ছোট চৌকি (থাকিবে)—আসনে বসে চৌকির উপর থালা রেখে খাবে—যে প্রকার রাজপুতানায়।
কর্মচারী - সভা (office-bearers)
সমস্ত অফিসার—তোমরা করিয়া লইবে ব্যালটের দ্বারায়, যে প্রকার ‘বুদ্ধ মহারাজে’র আজ্ঞা—অর্থাৎ একজন প্রপোজ (প্রস্তাব) করিল, ‘অমুক এক বৎসরের জন্য মহান্ত হউক।’ সকলে ‘হ্যাঁ’ কি ‘না’ কাগজে লিখিয়া একটা কুম্ভে নিক্ষেপ করিবে। যদি ‘হ্যাঁ’ অধিক হয়, তিনি মহান্ত (হইবেন) ইত্যাদি।
যদিও তোমরা উক্ত প্রকারে অফিসার বাছিয়া লইবে, তথাপি আমি suggest (প্রস্তাব) করি যে, এ বৎসর রাখাল মহান্ত, তুলসী সেক্রেটারী ও ট্রেজারার, গুপ্ত লাইব্রেরিয়ান, শশী কালী হরি ও সারদা পর্যায়ক্রমে পড়াবার ও উপদেশ করবার ভার লউক—ইত্যাদি। সারদা যে কাগজ বার করতে চেয়েছে, সে উত্তম কথা বটে; কিন্তু সকলে মিলেমিশে করতে পার তো আমার সম্মতি আছে।
মতামত সম্বন্ধে এই যে, যদি কেউ পরমহংসদেবকে অবতার ইত্যাদি বলে মানে উত্তম কথা, না মানে উত্তম কথা। সার এই যে, পরমহংসদেব চরিত্রসম্বন্ধে পুরাতন ঠাকুরদের উপরে যান এবং শিক্ষাসম্বন্ধে সকলের চেয়ে উদার ও নূতন এবং Progressive (প্রগতিশীল) অর্থাৎ পুরানোরা সব একঘেয়ে—এ নূতন অবতার বা শিক্ষকের এই শিক্ষা যে, এখন যোগ ভক্তি জ্ঞান ও কর্মের উৎকৃষ্ট ভাব এক করে নূতন সমাজ তৈয়ারী করতে হবে। … পুরানোরা বেশ ছিলেন বটে, কিন্তু এ যুগের এই ধর্ম—একাধারে যোগ জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম—আচণ্ডালে জ্ঞান-ভক্তি দান—আবালবৃদ্ধবনিতা। ও-সকল কেষ্ট বিষ্টু বেশ ঠাকুর ছিলেন; কিন্তু রামকৃষ্ণে একাধারে সব ঢুকে গেছেন। সাধারণ লোকের পক্ষে এবং প্রথম উদ্যোগীর পক্ষে নিষ্ঠা বড়ই আবশ্যক—অর্থাৎ শিক্ষা দাও যে, অন্য সকল দেবকে নমস্কার, কিন্তু পূজা রামকৃষ্ণের। নিষ্ঠা ভিন্ন তেজ হয় না—তা না হলে মহাবীরের ন্যায় প্রচার হয় না। আর ও-সব পুরানো ঠাকুরদেবতা বুড়িয়ে গেছে—এখন নূতন ভারত, নূতন ঠাকুর, নূতন ধর্ম, নূতন বেদ। হে প্রভো, কবে এ পুরানোর হাত থেকে উদ্ধার পাবে আমাদের দেশ! গোঁড়ামি না হলে কল্যাণ দেখছি কই? তবে অপরের দ্বেষ ত্যাগ করতে হবে।
যদি আমার বুদ্ধিতে চলা তোমাদের উচিত বিচার হয় এবং এই সকল নিয়ম পালন কর, তাহলে আমি মঠভাড়ার এবং সমস্ত খরচ-পত্র পাঠিয়ে দেব। নতুবা তোমাদের সঙ্গত্যাগ—একদম। অপিচ গৌর-মা, যোগীন-মা প্রভৃতিকে এই চিঠি দেখিয়ে তাঁহাদের দিয়ে ঐ প্রকার একটা মেয়েদের জন্য স্থাপন করাইবে। সেখানে গৌর-মাকে এক বৎসর মহান্ত করিবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউই সেখানে যেতে পাবে না। তারা আপনারা সমস্ত করিবে, তোমাদের হুকুমে কাউকে চলিতে হবে না। তারও সমস্ত খরচ-পত্র আমি পাঠিয়ে দেব।
প্রভু তোমাদের সৎবুদ্ধি দিন! দু-জন জগন্নাথ দেখতে গেল—একজন দেখলে ঠাকুর, আর একজন দেখলে পুঁই গাছ!!! বাপু হে, তোমরা সকলেই তাঁর সেবায় ছিলে বটে, কিন্তু যখনই মন ফুলে আমড়া গাছ হবে, তখনই মনে করো যে, থাকলে কি হয় তাঁর সঙ্গে?—দেখেছ কেবলই পুঁই গাছ! যদি তা না হত তো এত দিনে প্রকাশ হত। তিনি নিজেই বলতেন, নাচিয়ে গাহিয়ে তারা নরকে যাইবে—ঐ নরকের মূল ‘অহঙ্কার’। ‘আমিও যে, ও-ও সে’—বটে রে মধো? ‘আমাকেও তিনি ভালবাসতেন’—হায় মধুরাম, তাহলে কি তোমার এ দুর্গতি হয়? … এখনও উপায় আছে—সাবধান! মনে রেখ যে, তাঁর কৃপায় বড় বড় দেবতার মত মানুষ তৈয়ারী হয়ে যাবে, যেখানে তাঁর দয়া পড়বে। … এখনও সময় আছে, সাবধান! Obedience is the first duty (আজ্ঞাবহতাই প্রথম কর্তব্য)—যা বলি, করে ফেল দেখি! এই কটা ছোট্ট ছোট্ট কাজ প্রথমে কর দেখি—তারপর বড় বড় কাজ ক্রমে হবে। অলমিতিL
নরেন্দ্র
পুঃ—এই চিঠি সকলকে পড়াবে এবং তদনুযায়ী কাজ করা যদি উচিত বোধ হয়, আমাকে লিখবে। রাখালকে বলবে—যে সকলের দাস, সে-ই সকলের প্রভু। যার ভালবাসায় ছোট বড় আছে, সে কখনও অগ্রণী হয় না। যার প্রেমের বিরাম নাই, উচ্চ নীচ নাই, তার প্রেম জগৎ জয় করে।
নরেন্দ্র
২৭৪
High View, Caversham, Reading
C/o E. T. Sturdy, Esq.,
১৮৯৬
প্রিয়—,
… প্রত্যেকে পূর্ণ উদ্যম প্রকাশ না করলে কি কোন কাজ সম্পন্ন হয়? ‘উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মীঃ’—সিংহহৃদয় কাজের মানুষের কাছেই লক্ষ্মীদেবী এসে থাকেন।
পেছন ফিরে তাকানর প্রয়োজন নেই। আগে চল! আমাদের চাই অনন্ত শক্তি, অফুরন্ত উৎসাহ, সীমাহীন সাহস, অসীম ধৈর্য, তবেই আমরা বড় বড় কাজ করতে পারব। ... ইতি
তোমাদের স্নেহশীল
বিবেকানন্দ
২৭৫*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
হাই ভিউ, রিডিং
২০ এপ্রিল, ১৮৯৬
স্নেহের ভগিনীগণ,
সমুদ্রের অপর পার থেকে তোমাদের অভিনন্দন জানাই। এবার সমুদ্রযাত্রা আনন্দদায়ক হয়েছে এবং কোন পীড়া হয়নি। সমুদ্রপীড়া এড়াবার জন্য আমি নিজেই কিছু চিকিৎসা করেছিলাম। আয়ার্লণ্ডের মধ্য দিয়ে এবং ইংলণ্ডের কয়েকটি পুরানো শহর দেখে এক দৌড়ে ঘুরে এলাম, এখন আবার রিডিং-এ ‘ব্রহ্ম, মায়া, জীব, জীবাত্মা ও পরমাত্মা’ প্রভৃতি নিয়ে আছি। অপর সন্ন্যাসীটি এখানে রয়েছে; আমি যত লোক দেখেছি, তাদের মধ্যে তিনি একজন চমৎকার লোক, বেশ পণ্ডিতও। আমরা এখনও গ্রন্থগুলি সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত। পথে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি—নিতান্তই নীরস, একটানা এবং গদ্যময়, আমার জীবনেরই মত। আমি যখন আমেরিকার বাইরে যাই, তখনই আমেরিকাকে বেশী ভালবাসি। যাই হোক, এ পর্যন্ত যা দেখছি, তার মধ্যে ওখানকার কয়েকটি বছরই সর্বোৎকৃষ্ট।
তোমরা কি ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য কিছু গ্রাহক সংগ্রহের চেষ্টা করছ? মিসেস এডামস্ (Mrs. Adams) ও মিসেস কংগারকে (Mrs. Conger) আমার ভালবাসা জানাবে। যত শীঘ্র পার তোমাদের সকলের কথা আমাকে লিখবে—আর তোমরা কি করছ, তোমাদের পান, ভোজন ও ঘুরে বেড়ানর একঘেয়েমি কি দিয়ে ভাঙছ? এখন একটু তাড়াতাড়ি, পরে এর চেয়ে বড় চিঠি লিখব; সুতরাং বিদায় এবং তোমরা সর্বদা সুখী হও।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুনঃ—আমি সময় পেলেই মাদার চার্চের কাছে লিখব। স্যাম এবং ভগিনী লককে আমার ভালবাসা।
বি
২৭৬*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
মে, ১৮৯৬
প্রিয় ভগিনী,
আবার লণ্ডনে। এখন ইংলণ্ডের আবহাওয়া বেশ চমৎকার ও ঠাণ্ডা; ঘরে অগ্নিকুণ্ডে আগুন রাখতে হয়। তুমি জেন, আমাদের ব্যবহারের জন্য এবার একটা গোটা বাড়ী পাওয়া গেছে। বাড়ীটি ছোট হলেও বেশ সুবিধাজনক। লণ্ডনে বাড়ীভাড়া আমেরিকার মত তত বেশী নয়, তা বোধ হয় তুমি জান। এই তোমার মার কথাই ভাবছিলাম। এইমাত্র তাঁকে একখানা চিঠি লিখে C/o Monroe & Co., 7 Rue Scribe, Paris—এই ঠিকানায় পাঠিয়েছি। এখানে জনকয়েক পুরানো বন্ধুও আছেন। মিস ম্যাকলাউড সম্প্রতি ইওরোপ ভ্রমণ করে লণ্ডনে ফিরেছেন। তাঁর স্বভাবটি সোনার মত খাঁটি এবং তাঁর স্নেহপ্রবণ হৃদয়টির কোন পরির্বতন হয়নি। আমরা এই বাড়ীতে বেশ ছোটখাট একটি পরিবার হয়েছি; আর আমাদের সঙ্গে আছেন ভারতবর্ষ থেকে আগত একজন সন্ন্যাসী। ‘বেচারা হিন্দু’ বলতে যা বুঝায়, তা এঁকে দেখলেই বেশ বুঝতে পারবে। সর্বদাই যেন ধ্যানস্থ রয়েছেন, অতি নম্র ও মধুরস্বভাব। আমার যেমন একটা অদম্য সাহস এবং ঘোর কর্মতৎপরতা আছে, তাঁতে তার কিছুই নেই। ওতে চলবে না। আমি তাঁর ভেতর একটু কর্মশীলতা প্রবেশ করিয়ে দেবার চেষ্টা করব। এখনই আমার দুটি করে ক্লাসের অধিবেশন হচ্ছে। চার-পাঁচ মাস ঐরূপ চলবে—তারপর ভারতে যাচ্ছি; কিন্তু আমেরিকাতেই আমার হৃদয় পড়ে আছে—আমি ইয়াঙ্কি দেশ ভালবাসি। আমি সব নূতন দেখতে চাই। পুরাতন ধ্বংসাবশেষের চারদিকে অলসভাবে ঘুরে বেড়িয়ে সারাজীবন প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে হা-হুতাশ করে আর প্রাচীনকালের লোকদের কথা ভেবে ভেবে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে রাজী নই। আমার রক্তের যা জোর আছে, তাতে ঐরূপ করা চলে না। সকল ভাব প্রকাশের উপযুক্ত স্থান, পাত্র ও সুযোগ কেবল আমেরিকাতেই আছে। আমি আমূল পরিবর্তনের ঘোরতর পক্ষপাতী হয়ে পড়েছি। শীঘ্রই ভারতবর্ষে ফিরব, পরিবর্তনবিরোধী থসথসে জেলি মাছের মত ঐ বিরাট পিণ্ডটার কিছু করতে পারি কিনা দেখতে। তারপর প্রাচীন সংস্কারগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নূতন করে আরম্ভ করব—একেবারে সম্পূর্ণ নূতন, সরল অথচ সবল—সদ্যোজাত শিশুর মত নবীন ও সতেজ। যিনি সনাতন, অসীম, সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ, তিনি কোন ব্যক্তিবিশেষ নন—তত্ত্বমাত্র। তুমি আমি সকলেই সেই তত্ত্বের বাহ্য প্রতিরূপ মাত্র। এই অনন্ত তত্ত্বের যত বেশী কোন ব্যক্তির ভিতর প্রকাশিত হয়েছে, তিনি তত মহৎ; শেষে সকলকেই তার পূর্ণ প্রতিমূর্তি হতে হবে; এরূপে এখনও যদিও সকলেই স্বরূপতঃ এক, তথাপি তখনই প্রকৃতপক্ষে সব এক হয়ে যাবে। ধর্ম এ ছাড়া আর কিছুই নয়; এই একত্ব অনুভব বা প্রেমই এর সাধন; সেকেলে নির্জীব অনুষ্ঠান এবং ঈশ্বরসম্বন্ধীয় ধারণাগুলি প্রাচীন কুসংস্কারমাত্র। বর্তমানেও সেগুলিকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করা কেন? পাশেই যখন জীবন ও সত্যের নদী বয়ে যাচ্ছে, তখন আর তৃষ্ণার্তদের নর্দমার জল খাওয়ান কেন? এটা মানুষের স্বার্থপরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পুরাতন সংস্কারগুলোকে সমর্থন করে করে আমি বিরক্ত হয়ে পড়েছি। … জীবন ক্ষণস্থায়ী, সময়ও ক্ষিপ্রগতিতে চলে যাচ্ছে। যে স্থান ও পাত্রে ভাবরাশি সহজে কার্যে পরিণত হতে পারে, সেই স্থান ও পাত্রই প্রত্যেকের বেছে নেওয়া উচিত। হায়! যদি মাত্র বার জন সাহসী, উদার, মহৎ, সরলহৃদয় লোক পেতাম!
আমি নিজে বেশ আছি এবং জীবনটাকে খুব উপভোগ করছি। আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের বিবেকানন্দ
২৭৭*
লণ্ডন
৩০ মে, ১৮৯৬
প্রিয় মিসেস বুল,
… গত পরশু অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের সঙ্গে আমার বেশ দেখাশুনা হয়ে গেল। তিনি একজন ঋষিকল্প লোক; তাঁর বয়স ৭০ বৎসর হলেও তাঁকে যুবা দেখায়; এমন কি তাঁর মুখে একটি বার্ধক্যের রেখা নেই। হায়! ভারতবর্ষ ও বেদান্তের প্রতি তাঁর যেরূপ ভালবাসা তার অর্ধেক যদি আমার থাকত! তার উপর তিনি যোগশাস্ত্রের প্রতিও অনুকূল ভাব পোষণ করেন এবং তাতে বিশ্বাস করেন। তবে বুজরুকদের তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না।
সর্বোপরি রামকৃষ্ণ পরমহংসের উপর তাঁর শ্রদ্ধা-ভক্তি অগাধ এবং তিনি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’তে (Nineteenth Century) তাঁর সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি তাঁকে জগতের সমক্ষে প্রচার করবার জন্য কি করছেন?’ রামকৃষ্ণ তাঁকে অনেক বৎসর যাবৎ মুগ্ধ করেছেন। এটা কি সুসংবাদ নয়?
এখানে কাজকর্ম ধীরে ধীরে—কিন্তু দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হচ্ছে। আগামী রবিবার থেকে জনসাধারণের জন্য আমার বক্তৃতা আরম্ভ হবে, ঠিক হয়েছে। ইতি—
আপনার চিরকৃতজ্ঞ ও স্নেহের
বিবেকানন্দ
২৭৮*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
৩০ মে, ১৮৯৬
প্রিয় মেরী,
তোমার চিঠি এইমাত্র পেলাম। তুমি অবশ্যই ঈর্ষাপরায়ণ হওনি, কিন্তু দীন-দরিদ্র ভারতবর্ষের প্রতি সহসা যেন তোমার করুণা উথলে উঠেছিল। যা হোক, ভয় পাওয়ার কারণ নেই। … সপ্তাহ কয়েক আগে মাদার চার্চের (Mother Church) কাছে পত্র লিখেছিলাম; আজ পর্যন্ত একছত্র জবাব আদায় করতে পারিনি। ভয় হয়, তিনি দলবলসহ সন্ন্যাস গ্রহণ করে কোন ক্যাথলিক মঠে ঢুকে পড়েছেন; ঘরে চার-চারটি আইবুড়ো মেয়ে থাকলে বুড়ী মায়ের পক্ষে সন্ন্যাস না নিয়ে আর উপায় কি?
অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের সঙ্গে বেশ দেখাশুনা হয়ে গেল। তিনি ঋষিকল্প লোক—বেদান্তের ভাবে ভরপুর। তোমার কি মনে হয়? অনেক বছর যাবৎ তিনি আমার গুরুদেবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাসম্পন্ন। তিনি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’তে গুরুদেবের সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন—তা শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। ভারতসংক্রান্ত নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হল। হায়! ভারতের প্রতি তাঁর প্রেমের অর্ধেকও যদি আমার থাকত!
এখানে আমরা আর একটি ক্ষুদ্র পত্রিকা বার করব। ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর খবর কি? তার প্রচার বাড়াচ্ছ তো? যদি চার জন উৎসাহী আইবুড়ী মিলে একখানা পত্রিকা ভাল রকম চালু করতে না পার তো আমার সকল আশায় জলাঞ্জলি! তুমি মাঝে মাঝে আমার চিঠি পাবে। আমি তো ছুঁচটি নই যে, যেখানে সেখানে হারিয়ে যাব! এখন এখানে ক্লাস খুলেছি। আগামী সপ্তাহ থেকে প্রতি রবিবার বক্তৃতা আরম্ভ করব। ক্লাসগুলি খুব বড় হয়; যে বাড়ীটি সারা মরশুমের জন্য ভাড়া করেছি, সেই বাড়ীতেই ক্লাস হয়। কাল রাত্রে আমি নিজেই রান্না করেছিলাম। জাফরান, লেভেণ্ডার, জয়ত্রী, জায়ফল, কাবাবচিনি, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, মাখন, লেবুর রস, পেঁয়াজ, কিসমিস, বাদাম, গোলমরিচ এবং চাল—এগুলি মিলিয়ে এমনই সুস্বাদু খিচুড়ি বানিয়েছিলাম যে, নিজেই গলাধঃকরণ করতে পারিনি। ঘরে হিং ছিল না, নতুবা তার খানিকটা মিশালে গিলিবার পক্ষে সুবিধা হত।
কাল হালফ্যাশনের এক বিবাহে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু মিস মূলার নাম্নী জনৈকা ধনী মহিলা একটি হিন্দু ছেলেকে দত্তক গ্রহণ করেছেন এবং আমার কাজে সাহায্য করবার জন্য আমি যে বাড়ীতে আছি সেই বাড়ীতেই ঘর ভাড়া করেছেন। তিনিই বিয়ে দেখিবার জন্য আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠান যেন আর শেষ হয় না—কি আপদ! তুমি যে বিয়েতে নারাজ, এতে আমি খুশী। এখন বিদায়। তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানিবে। আর লেখার সময় নাই; এখনি মিস ম্যাকলাউডের বাড়ীতে মধ্যাহ্ন-ভোজনে যাচ্ছি। ইতি
তোমাদের চির শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
২৭৯
ওঁ তৎ সৎ
England
মে (?) ১৮৯৬
প্রিয় শশী,
পূর্বপত্রে যদি ভুল হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই পত্রে লিখি যে, কালী যে দিবস start (যাত্রা) করিবে, সেদিন কিম্বা তাহার আগে যেন E. T. Sturdy (স্টার্ডি)-কে চিঠি লেখে, যাহাতে সে যাইয়া তাহাকে জাহাজ হইতে লইয়া আসে। এ লণ্ডন শহর মানুষের জঙ্গল—দশ পনরটা কলিকাতা একত্রে—অতএব ঐ প্রকার না করিলে গোলমাল হয়ে যাবে। আসতে দেরী যেন না হয়, পত্রপাঠ চলে আসতে বলবে। শরতের বেলার মত যেন না হয়। বাকী বুঝে-সুঝে ঠিক করে নেবে।
কালীকে যাই হোক সত্বর পাঠাবে। যদি শরতের বেলার মত দেরী হয় তো কাহাকেও আসতে হবে না; ও-রকম গড়িমসির কাজ নয়। মহা রজোগুণের কাজ, আমাদের দেশময় খালি তমস্, আমাদের দেশে রজস্ চাই—তারপর সত্ত্ব, সে ঢের দূরের কথা। ইতি
নরেন্দ্র
২৮০*
সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
৫ জুন, ১৮৯৬
প্রিয়—,
‘রাজযোগ’ বইখানার খুব কাটতি হচ্ছে। সারদানন্দ শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্রে যাবে।
আমার পিতা যদিও উকিল ছিলেন, তবু আমি ইচ্ছা করি না, আমাদের বংশের কেউ উকিল হয়। আমার গুরুদেব এর বিরুদ্ধে ছিলেন এবং আমার বিশ্বাস, যে পরিবারে কতকগুলি উকিল আছে, সে পরিবারকে নিশ্চয়ই দুর্দশায় পড়তে হবে। আমাদের দেশ উকিলে ছেয়ে গেছে—প্রত্যেক বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শত শত উকিল বার হচ্ছে। আমাদের জাতের পক্ষে এখন দরকার সাহস ও বৈজ্ঞানিক প্রতিভা। সুতরাং আমার ইচ্ছা ম—তড়িত্তত্ত্ববিৎ হয়। সফল হতে না পারলেও সে যে বড় হবার এবং দেশের যথার্থ উপকারে আসবার চেষ্টা করেছিল—এইটুকু ভেবেই আমি সন্তুষ্ট হব। শুধু আমেরিকার বাতাসেই এমন একটি গুণ আছে যে, সেখানকার প্রত্যেকের ভেতর যা কিছু ভাল সমস্তই ফুটিয়ে তোলে। আমি চাই সে অকুতোভয় ও সাহসী হোক এবং তার নিজের ও স্বজাতির জন্য একটা নূতন পথ বার করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করুক। একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়র ভারতে অনায়াসে করে খেতে পারে।
পুঃ—গুডউইন আমেরিকায় একখানি মাসিক পত্র বার করা সম্বন্ধে তোমাকে এই ডাকে একখানা চিঠি লিখেছে। আমার মনে হয়, কাজটি বজায় রাখতে হলে এই রকমের একটা কিছু দরকার। আর সে যেভাবে কাজ করবার প্রস্তাব করছে, তাকে সেইভাবে ঐ বিষয়ে সাহায্য করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। … আমার মনে হয়, সে খুব সম্ভব সারদানন্দের সঙ্গে যাবে।
তোমাদের প্রেমবদ্ধ
বিবেকানন্দ
২৭১
[স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
১৪ এপ্রিল, ১৮৯৬
কল্যাণীয়া মিস নোব্ল্,
আমার আদর্শকে বস্তুতঃ অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা চলে, আর তা এইঃ মানুষের কাছে তার অন্তর্নিহিত দেবত্বের বাণী প্রচার করতে হবে এবং সর্বকার্যে সেই দেবত্ব-বিকাশের পন্থা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
কুসংস্কারের শৃঙ্খলে এই সংসার আবদ্ধ। যে উৎপীড়িত—সে নর বা নারীই হোক—তাকে আমি করুণা করি; আর যে উৎপীড়নকারী, সে আমার আরও বেশী করুণার পাত্র।
এই একটা ধারণা আমার কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সকল দুঃখের মূলে আছে অজ্ঞতা, তা ছাড়া আর কিছু না। জগৎকে আলো দেবে কে? আত্মবিসর্জনই ছিল অতীতের কর্মরহস্য; হায়! যুগ যুগ ধরে তাই চলতে থাকবে। যাঁরা জগতে সবচেয়ে সাহসী ও বরেণ্য, তাঁদের চিরদিন ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ আত্মবিসর্জন করতে হবে। অনন্ত প্রেম ও করুণা বুকে নিয়ে শত শত বুদ্ধের আবির্ভাব প্রয়োজন।
জগতের ধর্মগুলি এখন প্রাণহীন মিথ্যা অভিনয়ে পর্যবসিত। জগতের এখন একান্ত প্রয়োজন হল চরিত্র। জগৎ এখন তাঁদের চায়, যাঁদের জীবন প্রেমদীপ্ত এবং স্বার্থশূন্য। সেই প্রেম প্রতিটি কথাকে বজ্রের মত শক্তিশালী করে তুলবে।
এটা আর তোমার কাছে কুসংস্কার নয় নিশ্চিত। তোমার মধ্যে একটা জগৎ-আলোড়নকারী শক্তি রয়েছে, ধীরে ধীরে আরও অনেক শক্তি আসবে। আমরা চাই—জ্বালাময়ী বাণী এবং তার চেয়ে জ্বলন্ত কর্ম। হে মহাপ্রাণ, ওঠ, জাগ! জগৎ দুঃখে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে—তোমার কি নিদ্রা সাজে? এস, আমরা ডাকতে থাকি, যতক্ষণ না নিদ্রিত দেবতা জাগ্রত হন, যতক্ষণ না অন্তরের দেবতা বাইরের আহ্বানে সাড়া দেন। জীবনে এর চেয়ে আর বড় কি আছে? এর চেয়ে মহত্তর কোন্ কাজ আছে? আমার এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গেই আনুষঙ্গিক খুঁটিনাটি সব এসে পড়বে। আমি আটঘাট বেঁধে কোন কাজ করি না। কার্যপ্রণালী আপনি গড়ে ওঠে ও নিজের কার্য সাধন করে। আমি শুধু বলি—ওঠ জাগ।
তুমি চিরকাল অফুরন্ত আশীর্বাদ জানবে। ইতি
শুভাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
২৮২
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
২৪ জুন, ১৮৯৬
প্রিয় শশী,
শ্রীজীর৯৬ সম্বন্ধে ম্যাক্সমূলারের লিখিত প্রবন্ধ আগামী মাসে প্রকাশিত হবে। তিনি তাঁর একখানি জীবনী লিখতে রাজী হয়েছেন। তিনি শ্রীজীর সমস্ত বাণী চান। সব উক্তিগুলি সাজিয়ে তাঁকে পাঠাও—অর্থাৎ কর্মসম্বন্ধে সব এক জায়গায়, বৈরাগ্য সম্বন্ধে অন্যত্র, ঐরূপ ভক্তি, জ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি সম্বন্ধে। তোমাকে এ কাজ এখনই শুরু করতে হবে। শুধু যে সব কথা ইংরেজীতে অচল, সেগুলি বাদ দিও।* বুদ্ধি করে সে-সকল জায়গায় যথাসম্ভব অন্য কথা দিবে। ‘কামিনী-কাঞ্চন’কে ‘কাম-কাঞ্চন’ করবে—lust and gold etc.—অর্থাৎ তাঁর উপদেশে সর্বজনীন ভাবটা প্রকাশ করা চাই। এই চিঠি কাহাকেও দেখাবার আবশ্যক নাই। তুমি উক্ত কার্য সমাধা করে সমস্ত উক্তি ইংরেজী তর্জমা ও classify (শ্রেণীবিভাগ) করে ‘প্রফেসর ম্যাক্সমূলার, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইংলণ্ড’—ঠিকানায় পাঠাবে।
শরৎ কাল আমেরিকায় চলল। এখানকার কাজ পেকে উঠেছে। লণ্ডনে একটি centre-এর (কেন্দ্রের) জন্য টাকা already (এর আগেই) উঠে গেছে। আমি next (আগামী) মাসে Switzerland (সুইজরলণ্ড) গিয়ে এক দুই মাস থাকব। তারপর আবার লণ্ডনে। আমার শুধু দেশে গিয়ে কি হবে? এই লণ্ডন হল—দুনিয়ার centre (কেন্দ্র)। India-র heart (ভারতের হৃৎপিণ্ড) এখানে। এখানে একটা গেড়ে না বসিয়ে কি যাওয়া হয়? তোরা পাগল নাকি? সম্প্রতি কালীকে আনাব, তাকে তৈয়ার থাকতে বলো। পত্রপাঠ যেন চলে আসে। দুই চারি দিনের মধ্যে তার জন্য টাকা পাঠাব ও কাপড়-চোপড় প্রভৃতি যা যা দরকার সমস্তই লিখে দেব। সেইমত সমস্ত ঠিক করা হয় যেন।
মাতাঠাকুরাণী প্রভৃতি সকলকে আমার অসংখ্য প্রণাম দিবে। মান্দ্রাজে তারকদাদা যাচ্ছেন—উত্তম কথা।
মহাতেজ, মহাবীর্য, মহা উৎসাহ চাই। মেয়ে-নেকড়ার কি কাজ? যে রকম লিখে- ছিলাম পূর্বপত্রে, সেই রকম ঠিক চলতে চেষ্টা করবে। Organization (সঙ্ঘ) চাই।
Organization is power and the secret of that is obedience (সঙ্ঘই শক্তি, আর আজ্ঞাবহতাই হল তার গূঢ় রহস্য)। কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
২৮৩
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
কেভার্শ্যাম রিডিং,
৩ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয় শশী,
এই পত্রপাঠ কালীকে ইংলণ্ডে পাঠাইয়া দিবে। পূর্বের পত্রে সংবাদ পাইয়াছ। কলিকাতার মেসার্স গ্রিণ্ডলে কোম্পানীর নিকট তাহার 2nd class passage (দ্বিতীয় শ্রেণীর পাথেয় খরচ) গিয়াছে ও কাপড়-চোপড় কিনিতে যাহা কিছু লাগে তাহাও গিয়াছে। কাপড়-চোপড় অধিক কিছু আবশ্যক নাই।
কালীকে কতকগুলি বই আনতে হবে। আমার কাছে কেবল ঋগ্বেদ-সংহিতা আছে। কালী যজুর্বেদ সামবেদ অথর্ব-সংহিতা ও শতপথাদি যতগুলি ব্রাহ্মণ পাওয়া যায় এবং কতকগুলি সূত্র ও যাস্কর নিরুক্ত যদি পায়, সঙ্গে করেই যেন আনে। অর্থাৎ ঐ বইগুলি আমার চাই। ... ঐ বই একটা কাঠের বাক্সয় পুরে আনলেই হবে।
গড়িমসি যেমন শরতের বেলায় হয়েছিল, তা যেন না হয়; পত্রপাঠ চলে আসবে। শরৎ আমেরিকায় চলে গেছে। আর এখানে কোন কাজ ছিল না—অর্থাৎ ছ-মাস বাদে এল, তখন আমি এখানে। সে প্রকার না হয় যেন। চিঠি হারিয়ে যেন না যায়—শরতের বেলার মত। তৎপর পাঠিয়ে দিবে। ইতি
বিবেকানন্দ
২৮৪*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
৬ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয় ফ্র্যাঙ্কিন্সেন্স,৯৭
… আটলাণ্টিকের এপারে এসে আমি বেশ আছি এবং আমার কাজকর্ম খুব ভালভাবেই চলছে।
আমার রবিবারের বক্তৃতাগুলি লোকের খুব হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল, ক্লাসগুলিও বেশ চলেছিল। এখন কাজের মরসুম শেষ হয়ে গেছে—আমিও সম্পূর্ণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এখন মিস মূলারের সঙ্গে সুইজরলণ্ডে বেড়াতে যাচ্ছি। গলস্ওয়ার্দিরা আমার সঙ্গে খুবই সদয় ব্যবহার করেছেন। জো বড় অদ্ভুতভাবে তাঁদের এদিকে ফিরিয়েছেন। আমি জো-র বুদ্ধিমত্তা ও নীরব কার্য-প্রণালীর প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। তিনি একজন মহিলা রাজনীতিবিদ্, একটা রাজ্য চালাতে পারেন। মানুষের ভেতর এমন তীক্ষ্ণ অথচ কল্যাণকর সহজ বুদ্ধি খুব অল্পই দেখেছি।
গত পরশু সন্ধ্যায় আমি মিসেস মার্টিনের বাড়ীতে একটা পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলাম। উক্ত মহিলা সম্বন্ধে তুমি নিশ্চয়ই ইতোমধ্যেই জো-র পত্রে অনেক খবর পেয়েছ।
যা হোক ইংলণ্ডে কাজ খুব আস্তে আস্তে অথচ সুনিশ্চিতভাবে বেড়ে চলেছে। এখানকার অন্ততঃ অর্ধেক নরনারী আমার সঙ্গে দেখা করে আমার কাজ সম্বন্ধে আলোচনা করেছে। এই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যতই ত্রুটি থাকুক, এটি যে চারিদিকে ভাব ছড়াবার সর্বশ্রেষ্ঠ যন্ত্র, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। আমার সংকল্প—এই যন্ত্রের কেন্দ্রস্থলে আমার ভাবরাশি প্রচার করব—তাহলেই সেগুলি সমগ্র জগতে ছড়িয়ে যাবে। অবশ্য সব বড় বড় কাজই খুব আস্তে আস্তে হয়ে থাকে। বিশেষ আমাদের হিন্দুদের—বিজিত জাতি বলে কাজের বাধাবিঘ্নও অনেক। কিন্তু এও বলি, যেহেতু আমরা বিজিত, সেইহেতু আমাদের ভাব চারিদিকে ছড়াতে বাধ্য! কারণ দেখা যায়, আধ্যাত্মিক আদর্শ চিরকালই বিজিত পদদলিত জাতির মধ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দেখ না, য়াহুদীরা তাদের আদর্শে রোম সাম্রাজ্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
তুমি জেনে সুখী হবে যে, আমিও দিন দিন সহিষ্ণুতা ও সর্বোপরি সহানুভূতির শিক্ষা আয়ত্ত করছি। মনে হয়, প্রবল-প্রতাপশালী এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের মধ্যেও যে ভগবান্ রয়েছেন, আমি তা উপলব্ধি করতে আরম্ভ করেছি। মনে হয়, আমি ধীরে ধীরে সেই অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যেখানে শয়তান বলে যদি কেউ থাকে, তাকে পর্যন্ত ভালবাসতে পারব।
বিশ বছর বয়সের সময় আমি এমন গোঁড়া বা একঘেয়ে ছিলাম যে, কারও প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারতাম না—আমার ভাবের বিরুদ্ধে হলে কারও সঙ্গে বনিয়ে চলতে পারতাম না, কলিকাতার যে ফুটপাতে থিয়েটার, সেই ফুটপাতের উপর দিয়ে চলতাম না পর্যন্ত। এখন এই তেত্রিশ বৎসর বয়সে বেশ্যাদের সঙ্গে অনায়াসে এক বাড়ীতে বাস করতে পারি—তাদের তিরস্কার করবার কথা একবার মনেও উঠবে না!, এ কি আমি ক্রমশঃ খারাপ হয়ে যাচ্ছি—না, আমার হৃদয় ক্রমে উদার হয়ে অনন্ত প্রেম বা সাক্ষাৎ সেই ভগবানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে? আবার লোকে বলে, শুনতে পাই, যে ব্যক্তি চারদিকে মন্দ ও অমঙ্গল দেখতে পায় না, সে ভাল কাজ করতে পারে না—এক রকম অদৃষ্টবাদী হয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে যায়! আমি তো তা দেখছি না; বরং আমার কর্মশক্তি প্রবলভাবে বেড়ে যাচ্ছে—সঙ্গে সঙ্গে কাজের সফলতাও খুব হচ্ছে। কখনও কখনও আমার এক ধরনের ভাবাবেশ হয়—মনে হয়, জগতের সবাইকে—সব জিনিষকে আশীর্বাদ করি, সব জিনিষকে ভালবাসি, আলিঙ্গন করি। তখন দেখি—যাকে মন্দ বলে, সেটা একটা ভ্রান্তিমাত্র! প্রিয় ফ্র্যান্সিস, এখন আমি সেই রকম ভাবের ঘোরে রয়েছি, আর তুমি ও মিসেস লেগেট আমায় কত ভালবাস ও আমার প্রতি তোমাদের কত দয়া, তাই ভেবে সত্যসত্যই আনন্দাশ্রু বিসর্জন করছি। আমি যেদিন জন্মগ্রহণ করেছি, সেই দিনটিকে ধন্যবাদ! আমি এখানে কত দয়া, কত ভালবাসা পেয়েছি! আর যে অনন্ত প্রেমস্বরূপ থেকে আমার আবির্ভাব, তিনি আমার ভাল মন্দ (‘মন্দ’ কথাটিতে ভয় পেও না) প্রত্যেক কাজটি লক্ষ্য করে আসছেন। কারণ আমি তাঁর হাতের একটা যন্ত্র বৈ আর কি—কোন্ কালেই বা তা ছাড়া আর কি ছিলাম? তাঁর সেবার জন্য আমি আমার সর্বস্ব ত্যাগ করেছি, আমার প্রিয়জনদের ত্যাগ করেছি, সব সুখের আশা ছেড়েছি, জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছি। তিনি আমার সদালীলাময় আদরের ধন, আমি তাঁর খেলার সাথী। এই জগতের কাণ্ডকারখানার কোনখানে কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না—সব তাঁর খেলা, সব তাঁর খেয়াল। কোন্ কারণে তিনি আবার যুক্তির দ্বারা চালিত হবেন? লীলাময় তিনি—এই জগৎ-নাট্যের সব অংশেই তিনি এই সব হাসিকান্নার অভিনয় করছেন। জো যেমন বলে—ভারি মজা, ভারি মজা!
এ তো বড় মজার জগৎ! আর সকলের চেয়ে মজার লোক তিনি—সেই অনন্ত প্রেমাস্পদ প্রভু! সব জগৎটা খুব মজা নয় কি? আমাদের পরস্পরের ভ্রাতৃভাবই বল আর খেলার সাথীর ভাবই বল, এ যেন জগতের ক্রীড়াক্ষেত্রে একদল স্কুলের ছেলেকে খেলতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, আর সকলে চেঁচামেচি করে খেলা করছে! তাই নয় কি? কাকে সুখ্যাতি করব, কাকে নিন্দা করব? এ যে সবই তাঁর খেলা। লোকে জগতের ব্যাখ্যা চায়, কিন্তু তাঁকে ব্যাখ্যা করবে কেমন করে? তাঁর তো মাথা-মুণ্ডু কিছু নেই—বিচারের কোন ধার ধারেন না। তিনি ছোটখাট মাথা ও বুদ্ধি দিয়ে আমাদের বোকা সাজিয়েছেন; কিন্তু এবার আর আমায় ঠকাতে পারছেন না, আমি এবার খুব হুঁশিয়ার ও সজাগ আছি।
আমি এতদিনে দু-একটা বিষয় শিখেছি। শিখেছি—ভাব, প্রেম, প্রেমাস্পদ সব যুক্তিবিচার বিদ্যা-বুদ্ধি ও বাক্যাড়ম্বরের বাইরে, ও-সব থেকে অনেক দূরে। ‘সাকি’,৯৮ পেয়ালা পূর্ণ কর—আমরা প্রেমমদিরা পান করে পাগল হয়ে যাই। ইতি
তোমারই
সদাপাগল বিবেকানন্দ
২৮৫*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
লণ্ডন
৭ জুলাই, ১৮৯৬
স্নেহের খুকীরা,
এখানকার কাজ আশ্চর্যভাবে এগিয়ে চলেছে। এখানে ভারত থেকে একজন সন্ন্যাসী এসেছিলেন। তাঁকে আমেরিকায় পাঠিয়েছি এবং ভারত থেকে আর একজনকে পাঠাতে বলেছি। এখানকার মরসুম শেষ হয়েছে; সুতরাং ক্লাস ও রবিবারের বক্তৃতাগুলি আগামী ১৬ থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। আর সুইজরলণ্ডের পাহাড়ে শান্তি ও বিশ্রামের জন্য ১৯ তারিখে আমি যাচ্ছি—মাসখানেকের জন্য। আবার শরৎকালে লণ্ডনে ফিরে কাজ আরম্ভ করা যাবে। এখানে কাজ খুবই আশাজনক হয়েছে। এখানে আগ্রহ জাগিয়ে—আমি প্রকৃতপক্ষে ভারতে থেকে যা করতে পারতাম, তার চেয়ে বেশী ভারতের জন্যই করছি। মা (মিসেস হেল) আমাকে লিখেছেন যে, তোমরা যদি ফ্ল্যাট-বাড়ীটা ভাড়া দিতে পার, তাহলে তিনি সানন্দে তোমাদের মিশর দর্শনে নিয়ে যেতে পারেন। আমি তিনজন ইংরেজ বন্ধুর সঙ্গে সুইজরলণ্ডের পাহাড়ে যাচ্ছি। পরে শীতের শেষে কয়েকজন ইংরেজ বন্ধুকে নিয়ে ভারতে যাবার আশা করি। তাঁরাও আমার মঠে থাকতে যাচ্ছেন, মঠ হবার পরিকল্পনা চলছে মাত্র। হিমালয়ের কোথাও সেটা বাস্তবে রূপ নেবার চেষ্টা করছে।
তোমরা কোথায় আছ? এখন তো পুরাদস্তুর গরমিকাল—এমন কি লণ্ডনও খুবই তেতে উঠেছে। দয়া করে মিসেস এডামস্, মিসেস কংগার এবং চিকাগোতে অন্য বন্ধুদের আমার গভীর ভালবাসা জানিও।
তোমাদের স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
২৮৬*
৬৩, সেণ্ট জর্জেস্ রোড, লণ্ডন
৮ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয়—,
ইংরেজ জাতটা খুব উদার। সেদিন মিনিট তিনেকের মধ্যেই আমার ক্লাস থেকে আগামী শরৎকালের কাজের নূতন বাড়ীর জন্য ১৫০ পাউণ্ড (প্রায় ২২৫০ টাকা) চাঁদা উঠেছে। এমন কি, চাইলে তারা সেই মুহূর্তেই ৫০০ পাউণ্ড দিত। কিন্তু আমরা ধীরে ধীরে কাজ করতে চাই—হঠাৎ কতকগুলো খরচপত্র করতে চাই না। এখানে এই কাজটা চালাতে অনেক লোক পাওয়া যাবে, যারা ত্যাগের ভাব কতকটা বোঝে—ইংরেজ-চরিত্রের গভীরতা এখানেই (যে ভাবটা তাদের মাথার ভেতর ঢোকে, সেটা কিছুতেই ছাড়তে চায় না)। ইতি
বিবেকানন্দ
২৮৭*
ইংলণ্ড
১৪ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয় নাঞ্জুণ্ড রাও,
‘প্রবুদ্ধ ভারত’গুলি পৌঁছেছে এবং ক্লাসে বিলি করাও হয়েছে। পত্রিকা খুব সন্তোষজনক হয়েছে; ভারতে এর যথেষ্ট প্রচলন হবে নিশ্চয়। আমেরিকাতেও এর কিছু গ্রাহক হতে পারে। ইতোমধ্যেই আমি আমেরিকায় এই কাগজটার বিজ্ঞাপন দেবার ব্যবস্থা করেছি এবং গুডইয়ার ইতোমধ্যেই তা করে ফেলেছে। কিন্তু এখানে (ইংলণ্ডে) কাজ অপেক্ষাকৃত ধীরে অগ্রসর হবে। এখানে মুশকিল এই যে, এরা সকলেই নিজেদের কাগজ বের করতে চায়। আর এমনই হওয়া উচিত; কারণ সত্যি বলতে গেলে কোন বিদেশীই খাঁটি ইংরেজের মত তেমন ভাল ইংরেজী লিখতে পারে না, এবং খাঁটি ইংরেজীতে লিখলে ভাবের যা বিস্তার হবে, হিন্দু-ইংরেজীতে তা হতে পারে না। তারপর বিদেশী ভাষায় প্রবন্ধ লেখার চেয়ে গল্প লেখা আরও শক্ত।
আমি এখানে গ্রাহক-সংগ্রহের চেষ্টায় আছি; কিন্তু বিদেশী সাহায্যের উপর একদমই একেবারেই নির্ভর করবেন না। ব্যক্তির মত জাতিকেও নিজেকে নিজে সাহায্য করতে হবে। এই হচ্ছে ঠিক ঠিক স্বদেশপ্রেম। যদি কোন জাতি তা করতে না পারে, তবে বলতে হবে—তার এখনও সময় হয়নি, তাকে অপেক্ষা করতে হবে। মান্দ্রাজ থেকেই এই নূতন আলোক ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া চাই—এই উদ্দেশ্য নিয়েই আপনাকে কাজ করতে হবে। একটি বিষয়ে কিন্তু আমার একটু মন্তব্য করতে হল—মলাটটা একেবারে রুচিহীন—অতি বিশ্রী ও কদর্য। সম্ভব হলে এটাকে বদলে ফেলুন। এটাকে ভাবব্যঞ্জক অথচ সরল করুন—আর এতে মানুষের মূর্তি মোটেই রাখবেন না। বটবৃক্ষ মোটেই প্রবুদ্ধ হওয়ার চিহ্ন নয়, পাহাড়ও তা নয়, ঋষিরাও নন, ইওরোপীয় দম্পতিও নন। পদ্মফুলই হচ্ছে পুনরভ্যুত্থানের প্রতীক। চারুশিল্পে আমরা বড়ই পেছিয়ে আছি—বিশেষতঃ চিত্রশিল্পে। বনে বসন্ত জেগেছে, বৃক্ষলতায় নবকিশলয় আর মুকুল দেখা দিয়েছে—এই ভাবের একটি বনের ছবি আঁকুন দেখি। কত ভাবই তো রয়েছে—ধীরে ধীরে তা চিত্রশিল্পে ফুটিয়ে তুলুন। লণ্ডনের গ্রীনম্যান কোম্পানী যে ‘রাজযোগ’ ছেপেছে, তাতে আমার তৈরী প্রতীকটি দেখুন—আপনি বোম্বেতে তা পাবেন। আমি নিউ ইয়র্কে রাজযোগ সম্বন্ধে যে-সব বক্তৃতা দিয়েছিলাম, সেগুলি এই পুস্তকে আছে।
আমি আগামী রবিবার সুইজরলণ্ডে যাচ্ছি, এবং শরৎকালে ইংলণ্ডে ফিরে এসে আবার কাজ শুরু করব। সম্ভব হলে আমি সুইজরলণ্ড থেকে আপনাকে ধারাবাহিকভাবে কতকগুলি প্রবন্ধ পাঠাব। আপনি জানেন, আমার পক্ষে বিশ্রাম খুব দরকার হয়ে পড়েছে।
একান্ত আশীর্বাদক ও শুভানুধ্যায়ী
বিবেকানন্দ
২৮৮*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
স্যান্স গ্রাণ্ড, সুইজরলণ্ড
২৫ জুলাই, ১৮৯৬
প্রিয়—,
আমি জগৎটাকে একেবারে ভুলে যেতে চাই, অন্ততঃ আসছে দু-মাসের জন্য; একটু কঠোর সাধনা করতে চাই। ওই আমার বিশ্রাম। … পাহাড় এবং বরফ দেখলে আমার মনে এক অপূর্ব শান্তির ভাব আসে। এখন আমার যেমন সুনিদ্রা হচ্ছে, এমন অনেক দিন হয়নি।
বন্ধুদের আমার ভালবাসা জানাবেন।
আপনাদের
বিবেকানন্দ
২৮৯*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
গ্র্যাণ্ড হোটেল, ভ্যালে
সুইজরলণ্ড
আমি অল্পস্বল্প পড়াশুনা করছি—উপোস করছি অনেক এবং সাধনা করছি তার চেয়েও বেশী। বনে বনে বেরিয়ে বেড়ানটা অতি আরামপ্রদ। আমাদের বাসস্থানটি তিনটি বিরাট তুষার-প্রবাহের নীচে এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোরম।
ভাল কথা, সুইজরলণ্ডের হ্রদে আর্যদের আদি বাসভূমি সম্বন্ধে আমার মনে যা-ও একটু সন্দেহের ভাব ছিল, তা একেবারে চলে গেছে; তাতারদের মাথা থেকে লম্বা টিকিটা সরিয়ে দিলে যা দাঁড়ায়, সুইজরলণ্ডের অধিবাসীরা হচ্ছে তাই।
স্নেহাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
২৯০*
[লালা বদ্রী শাহকে লিখিত]
C/o E. T. Sturdy
রিডিং, লণ্ডন৯৯
৫অগষ্ট, ১৮৯৬
আপনার সহৃদয় অভিনন্দনের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনার কাছে একটি বিষয় জানবার আছে। দয়া করে সংবাদটি জানালে বিশেষ বাধিত হব। আমি একটা মঠ স্থাপন করতে চাই—আলমোড়ায় বা আলমোড়ার কাছে হলেই ভাল। আমি শুনেছি, মিঃ র্যামজে নামে জনৈক ভদ্রলোক আলমোড়ার কাছে একটি বাংলোতে বাস করতেন, ঐ বাংলোর চারিদিকে একটি বাগান আছে। ঐ বাংলোটি কেনা সম্ভব হবে কি? দাম কত? যদি কেনা সম্ভব না হয়, তবে ভাড়া পাওয়া যাবে কি?
আলমোড়ার কাছে কোন সুবিধামত জায়গা আপনার জানা আছে কি, যেখানে বাগবাগিচা সহ আমাদের মঠ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? সঙ্গে বাগান প্রভৃতি অবশ্যই থাকা চাই। একটা গোটা ছোট পাহাড় হলেই ঠিক আমার মনোমত হয়।
আশা করি, শীঘ্র আপনার উত্তর পাব। আপনি এবং আলমোড়ার অন্যান্য সব বন্ধুরা আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানবেন। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
২৯১*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
৫ অগষ্ট, ১৮৯৬
আজ সকালে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের একখানি পত্র এসেছে; তাতে খবর পেলাম যে, শ্রীরামকৃষ্ণ-সম্বন্ধীয় প্রবন্ধটি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’ পত্রিকার অগষ্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।তুমি কি তা পড়েছ? তিনি ঐ বিষয়ে আমার মত চেয়েছেন। এখনও তা দেখিনি বলে তাঁকে কিছু লিখতে পারছি না। তুমি যদি তা পেয়ে থাক তো দয়া করে আমায় পাঠিয়ে দিও। ‘ব্রহ্মবাদিনে’র কোন সংখ্যা এসে থাকলে তাও পাঠিও। ম্যাক্সমূলার আমাদের কার্যধারা জানতে চান, ... এবং মাসিক পত্রিকা সম্বন্ধেও খবর চান। তিনি যথেষ্ট সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্বন্ধে একখানি গ্রন্থ লিখতে প্রস্তুত আছেন।
আমার মনে হয়, পত্রিকাদি সম্বন্ধে তাঁর সঙ্গে তোমার সরাসরি পত্রালাপ করাই উচিত। ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরী’ পড়ার পরে তাঁর পত্রের উত্তর দিতে যখন আমি তোমাকে তাঁর চিঠিখানি পাঠিয়ে দেব, তখন তুমি দেখতে পাবে যে, আমাদের প্রচেষ্টায় তিনি কত খুশী হয়েছেন এবং যথাসাধ্য সাহায্য করতে রাজী আছেন।
পুনশ্চ—আশা করি, বড় পত্রিকাখানি সম্বন্ধে ভাল করে ভেবে দেখবে। আমেরিকায় কিছু টাকা তুলতে পারা যাবে এবং কাগজখানি নিজেদের হাতেই রাখা যাবে। তুমি ও ম্যাক্সমূলার কি প্রকার কার্যধারা ঠিক কর, তা জেনে আমি আমেরিকায় পত্র লিখব ভেবেছি।
যে গাছের ফল ও ছায়া আছে, তারই আশ্রয় নিতে হয়; ফল যদি নাই বা পাওয়া যায়, ছায়া থেকে তো কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না?১০০ সুতরাং শিক্ষণীয় এই যে, বড় বড় কাজ এভাবেই করা উচিত।
২৯২*
সুইজরলণ্ড
৬ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
‘ব্রহ্মবাদিন্’ কতটা আর্থিক দুরবস্থায় পড়েছে, তা তোমার পত্রে জানলাম। লণ্ডনে যখন ফিরে যাব, তখন তোমায় সাহায্য করতে চেষ্টা করব। তুমি সুর নামিও না যেন—কাগজখানি চালিয়ে যাও; অতি শীঘ্রই তোমায় এমন সাহায্য করতে পারব যে, বাজে শিক্ষকতার কাজ থেকে তুমি অব্যাহতি পাবে। ভয় পেও না; বড় বড় সব কাজ হবে, বৎস! সাহস অবলম্বন কর। ‘ব্রহ্মবাদিন্’ একটি রত্নবিশেষ, একে নষ্ট হতে দেওয়া হবে না। অবশ্য এ-জাতীয় পত্রিকাকে সর্বদাই ব্যক্তিগত বদান্যতার দ্বারা বাঁচিয়ে রাখতে হয়, আর আমরা তাই করব। আরও মাস-কয়েক আঁকড়ে পড়ে থাক।
ম্যাক্সমূলারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধীয় প্রবন্ধটি ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরীতে’ বেরিয়েছে। সেটি পেলেই আমি তোমায় পাঠিয়ে দেব। তিনি আমাকে চমৎকার সব চিঠি লেখেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের একখানি বড় জীবনী লেখবার উপাদান চান।
কলিকাতায় লিখে দাও, যেন তারা যতটা সম্ভব উপাদান যোগাড় করে তাঁকে পাঠায়।
আমেরিকার কাগজে প্রেরিত সংবাদটি আমি আগেই পেয়েছি। ওটি ভারতবর্ষে প্রকাশ করবে না। সংবাদপত্রে এই সব হইচই ঢের হয়ে গেছে; আমার অন্ততঃ এ সবে বিরক্তি এসে গেছে। মূর্খেরা যাই বলুক না কেন, আমরা আমাদের কাজ করে যাব। সত্যকে কেউ চেপে রাখতে পারবে না।
Organization is power and the secret of that is obedience দেখতেই পাচ্ছ, আমি এখন সুইজরলণ্ডে রয়েছি, আর ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছি। পড়া বা কোন লেখার কাজ আমি করতে পারছি না—করাও উচিত নয়। লণ্ডনে আমার এক মস্ত কাজ পড়ে আছে, আগামী মাস থেকে তা শুরু করতে হবে। আগামী শীতে আমি ভারতে ফিরব এবং সেখানকার কাজটাকে দাঁড় করাব।
সকলে আমার ভালবাসা জানবে। সাহসে বুক বেঁধে কাজ করে যাও, পিছু হটো না—‘না’ বলো না। কাজ কর—প্রভু পেছনে আছেন। মহাশক্তি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—ভয় পেও না; টাকা ও আর সব শীঘ্রই আসবে।
২৯৩*
[পাশ্চাত্য শিষ্য স্বামী কৃপানন্দকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
অগষ্ট, ১৮৯৬
পবিত্র হও ও সর্বোপরি অকপট হও; মুহূর্তের জন্যও ভগবানে বিশ্বাস হারিও না—তাহলেই আলো দেখতে পাবে। যা কিছু সত্য, তাই চিরস্থায়ী; কিন্তু যা সত্য নয়, তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। বর্তমান ক্ষিপ্র অনুসন্ধিৎসার যুগে জন্মগ্রহণ করে আমরা অনেকটা সুবিধা পেয়েছি। অন্যে যাই ভাবুক আর করুক, তুমি কখনও তোমার পবিত্রতা, নীতি ও ভগবৎপ্রেমের উচ্চ আদর্শ খর্ব করো না। সর্বোপরি সব রকম গুপ্ত সমিতির বিষয়ে সতর্ক থেক। ভগবৎ-প্রেমিকের পক্ষে চালাকিতে ভীত হবার কিছুই নেই। স্বর্গে ও মর্ত্যে পবিত্রতাই সবচেয়ে মহৎ ও দিব্য শক্তি। ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম, সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ।’—সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার নয়; সত্যের মধ্য দিয়েই দেবযান মার্গ চলেছে। কে তোমার সহগামী হল বা না হল, তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামিও না; শুধু প্রভুর হাত ধরে থাকতে যেন কখনও ভুল না হয়; তাহলেই যথেষ্ট।
গতকাল আমি ‘মণ্টি রোজা’র তুষারপ্রবাহের ধারে গিয়েছিলাম এবং সেই চিরতুষারের প্রায় মাঝখানে জাত কয়েকটি শক্ত পাপড়িবিশিষ্ট ফুল তুলে এনেছিলাম। তারই একটি চিঠির মধ্যে তোমাকে পাঠাচ্ছি—আশা করি, জাগতিক জীবনের সর্বপ্রকার বাধা-বিপর্যয়রূপ হিমরাশি ও তুষারপাতের মধ্যে তুমিও ঐ রকম আধ্যাত্মিক দৃঢ়তা লাভ করবে।
তোমার স্বপ্নটি খুবই সুন্দর। স্বপ্নে আমরা আমাদের মনের এমন একটা স্তরের পরিচয় পাই, যা জাগ্রত অবস্থায় কখনও পাই না, এবং কল্পনা যতই অবাস্তব হোক না কেন, অজ্ঞাত আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ তার পশ্চাতেই অবস্থান করে। সাহস অবলম্বন কর। মানবজাতির কল্যাণের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব—বাকী সব প্রভুই জানেন।
অধীর হয়ো না, তাড়াহুড়ো করো না। ধীর, একনিষ্ঠ এবং নীরব কর্মই সফল হয়। প্রভু অতি মহান্। বৎস, আমরা সফল হবই—সফল হতেই হবে। তাঁর নাম ধন্য হোক।
এখানে ... কোন আশ্রম নেই। একটি থাকলে কী সুন্দরই না হত! আমি তাতে কতই না আনন্দিত হতাম এবং তাতে এদেশের কতই না কল্যাণ হত!
২৯৪*
সুইজরলণ্ড
৮ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
কয়েকদিন পূর্বে তোমায় একখানি পত্র লিখেছি। সম্প্রতি আমার পক্ষে তোমায় জানান সম্ভবপর হয়েছে, ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর জন্য আমি এইটুকু করতে পারবঃ তোমায় দু-এক বছরের জন্য মাসিক ১০০ টাকা হিসাবে অর্থাৎ বছরে ৬০ বা ৭০ পাউণ্ড হিসাবে, যাতে মাসে ১০০ পুরা হয়; এমন সাহায্য করতে পারব, তাতে তুমি নিজে স্বাধীন হয়ে ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর কাজ করতে পারবে ও সেটিকে ভাল করে দাঁড় করাতে পারবে। মণি আয়ার এবং অন্য কয়েকটি বন্ধু কিছু টাকা তুলে পত্রিকার মুদ্রণ প্রভৃতির ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন। গ্রাহকদের চাঁদা থেকে কত আয় হয়? তা খরচ করে ভাল ভাল লেখকদের কাছ থেকে ভাল ভাল প্রবন্ধ সংগ্রহ করা চলে না কি? ‘ব্রহ্মবাদিনে’ যা কিছু বেরুবে, তার সবটাই যে সকলকে বুঝতে হবে, তার কোন মানে নাই; কিন্তু দেশপ্রেম-প্রণোদিত হয়ে ও পুণ্যসঞ্চয়ের জন্য সকলের এ-পত্রিকার গ্রাহক হওয়া উচিত—অবশ্য আমি হিন্দুদের লক্ষ্য করেই এ কথা বলছি।
[তোমাদের] কয়েকটি গুণ থাকা প্রয়োজনঃ
প্রথমতঃ হিসাবপত্র সম্বন্ধে বিশেষ সততা অবলম্বনীয়। এই কথা বলতে গিয়ে আমি এমন কোন আভাস দিচ্ছি না যে, তোমাদের মধ্যে কারও পদস্খলন হবে, পরন্তু কাজকর্মে হিন্দুদের একটা অদ্ভুত অগোছালো ভাব আছে—হিসাবপত্র রাখার বিষয়ে তাদের তেমন সুশৃঙ্খলা বা আঁট নাই; হয়তো কোন বিশেষ ফণ্ডের টাকা নিজের কাজে লাগিয়ে ফেলে এবং ভাবে শীঘ্রই তা ফিরিয়ে দেব—ইত্যাদি।
দ্বিতীয়তঃ ‘ব্রহ্মবাদিন্’টিকে ভালভাবে পরিচালনা করার উপর তোমার মুক্তি নির্ভর করে, এই ভাব নিয়ে উদ্দেশ্য-সিদ্ধি বিষয়ে পূর্ণ নিষ্ঠা প্রয়োজন। এই পত্রিকাই তোমার ইষ্টদেবতাস্বরূপ হোক; তাহলেই দেখবে সাফল্য কেমন করে আসে। এর আগেই অভেদানন্দকে ভারতবর্ষ থেকে ডেকে পাঠিয়েছি। আশা করি, পূর্বের ‘স্বামী’ (সন্ন্যাসী)-কে পাঠাবার সময় যেমন দেরী হয়েছিল, এবারে তেমন হবে না। এই চিঠি পেয়ে তুমি আমায় ‘ব্রহ্মবাদিন্’-এর সমস্ত আয়ব্যয়ের একটা পরিষ্কার হিসাব পাঠিও—যাতে আমি বুঝতে পারি, কি করা উচিত। মনে রেখো—অখণ্ড পবিত্রতা ও গুরুর প্রতি স্বার্থশূন্য একান্ত আজ্ঞাবহতাই সকল সিদ্ধির মূল।
দু-বৎসরের মধ্যে আমরা ‘ব্রহ্মবাদিন্’কে এরূপ দাঁড় করাব যে, পত্রিকার আয় থেকে শুধু যে খরচ চলে যাবে তা নয়, স্বতন্ত্র একটু আয়ও হবে। বিদেশে ধর্ম-পত্রিকার বেশী কাটতি হওয়া অসম্ভব; সুতরাং হিন্দুদের মধ্যে যদি এখনও কিছুমাত্র ধর্মজ্ঞান বা কৃতজ্ঞতা অবশিষ্ট থাকে, তবে এ পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা তাদেরই করতে হবে।
ভাল কথা, এনি বেসাণ্ট (Annie Besant) একদিন আমাকে তাঁদের সমিতিতে ‘ভক্তি’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমি এক সন্ধায় বক্তৃতা দিই—কর্ণেল অল্কট্ (Col. Olcott)-ও উপস্থিত ছিলেন। সকল সম্প্রদায়ের প্রতিই আমার সহানুভূতি আছে, এটি দেখাবার জন্যই আমি এরূপ করেছিলাম; কিন্তু আমি কোন আজগুবিতে যোগ দেব না। আমাদের দেশের আহাম্মকদের বলো, আধ্যাত্মিক বিষয়ে আমরাই জগতে শিক্ষক—বিদেশীরা নয়। ইহলোকের বিষয়ে অবশ্য তাদের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে ম্যাক্সমূলারের প্রবন্ধ পড়েছি। ছয় মাস আগে যখন তিনি ওটি লেখেন, তখন তাঁর কাছে প্রতাপ মজুমদারের ক্ষুদ্র পুস্তিকা ছাড়া লেখবার আর কোন উপাদান ছিল না; সুতরাং সে হিসাবে তাঁর প্রবন্ধটি ভালই হয়েছে, বলতে হবে। সম্প্রতি তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে একখানি বড় বই লেখবার সঙ্কল্প প্রকাশ করে আমাকে একখানি সুন্দর সুদীর্ঘ পত্র লিখেছেন। আমি এর মধ্যেই তাঁকে অনেক উপাদান দিয়েছি; ভারত থেকে আরও উপাদান পাঠাতে হবে। কাজ করে যাও। লেগে থাক, সাহসী হও, ভরসা করে সব বিষয়ে লাগ। ব্রহ্মচর্যের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখবে; তোমার তো ছেলেপুলে যথেষ্ট হয়েছে—আর কেন? এই সংসারটা কেবল দুঃখময়। কি বল? আমার স্নেহাশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
২৯৫*
[মিঃ গুডউইনকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
৮ অগষ্ট, ১৮৯৬
আমি এখন বিশ্রাম ভোগ করছি। বিভিন্ন চিঠিতে কৃপানন্দের১০১ সম্বন্ধে অনেক কথা পড়েছি। আমি তার জন্য দুঃখিত। … তার ভাবে তাকে চলতে দাও; তার জন্য তোমাদের কারও উদ্বেগ অনাবশ্যক।
আমায় ব্যথা দেওয়ার কথা বলছ?—তা দেব বা দানবের সাধ্যাতীত। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাক। অটল ভালবাসা ও একান্ত নিঃস্বার্থ ভাবই সর্বত্র জয়লাভ করে। প্রত্যেক প্রতিকূল অবস্থায় বেদান্তীর উচিত নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করা, ‘আমি এরূপ দেখি কেন? আমি কেন ভালবাসা দিয়ে এর প্রতিকার করতে পারি না?’
স্বামী সারদানন্দ যে অভ্যর্থনা পেয়েছেন, এবং তিনি যে ভাল কাজ করেছেন, আমি তাতে খুশী হয়েছি। বড় কাজ করতে হলে দীর্ঘকাল ধরে লেগে পড়ে থাকতে হয়। জনকয়েক বিফল হলেও আমাদের চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। জগতের ধারাই এই যে, অনেকের পতন হবে, বহু বাধা আসবে, দুর্লঙ্ঘ্য বিপদ উপস্থিত হবে এবং আধ্যাত্মিকতার আগুনে ভস্মীভূত হবার সময়েও মানুষের ভিতরের স্বার্থপরতা ও অন্যান্য দানবীয় ভাব প্রাণপণে লড়াই করে। ‘ভাল’র দিকে যাবার পথটি সবচেয়ে দুর্গম ও বন্ধুর। এটাই আশ্চর্যের কথা যে, এত লোক সফল হয়; অনেকে যে পড়ে যায়, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। সহস্র পদস্খলনের ভেতর দিয়েই চরিত্র গড়ে তুলতে হবে।
এখন আমি অনেকটা চাঙ্গা হয়েছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঠিক সামনেই বিরাট তুষার প্রবাহগুলি দেখি আর অনুভব করি, যেন হিমালয়ে আছি। এখন আমি সম্পূর্ণ শান্ত। আমার স্নায়ুগুলিতে স্বাভাবিক শক্তি ফিরে এসেছে, এবং তুমি যে-জাতীয় বিরক্তিকর ব্যাপারের কথা লিখেছ, তা আমাকে একেবারেই স্পর্শ করে না। এই ছেলেখেলা আমাকে উদ্বিগ্ন করবে কি করে? সারা দুনিয়াটা একটা নিছক ছেলেখেলা—প্রচার, শিক্ষাদান, সবই। ‘যিনি দ্বেষও করেন না, আকাঙ্ক্ষাও করেন না, তাঁকেই সন্ন্যাসী বলে জেনো।’১০২ আর রোগ শোক ও মৃত্যুর চির লীলাভূমি এই সংসাররূপ পঙ্কিল ডোবাতে কি কাম্য বস্তু থাকতে পারে?—‘যিনি সকল বাসনা ত্যাগ করেছেন, তিনিই সুখী।’
সেই শান্তি, সেই অনন্ত অনাবিল শান্তির কিছু আভাস আমি এখন এই মনোরম স্থানে পাচ্ছি। ‘একবার যদি মানুষ জানে যে, আত্মাই আছেন—আর কিছু নেই, তাহলে কিসের কামনায় কার জন্য এই শরীরের দুঃখতাপে দগ্ধ হতে হবে?’১০৩
আমার মনে হয়, লোকে যাকে ‘কাজ’ বলে, তা দ্বারা যতটুকু অভিজ্ঞতা হবার তা আমার হয়ে গেছে। আমার কাজ শেষ হয়েছে, এখন আমি বেরিয়ে যাবার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছি। ‘সহস্র সহস্র লোকের মধ্যে ক্বচিৎ কেউ সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করে; যত্নপরায়ণ বহুর মধ্যেও ক্বচিৎ কেউ আমাকে যথাযথভাবে জানে।’১০৪ কারণ ইন্দ্রিয়গুলি বলবান্, তারা সাধকের মনকে জোর করে নাবিয়ে দেয়।
‘মনোরম জগৎ’, ‘সুখের সংসার’, ‘সামাজিক উন্নতি’—এসব কথা ‘তপ্ত বরফ’, ‘অন্ধকার আলো’ প্রভৃতি কথার মতই। ভালই যদি হত, তবে এটা আর সংসারই হত না। অজ্ঞানবশতঃ জীব অসীমকে সসীম বিষয়ের মধ্যে, অখণ্ড চৈতন্যকে জড় অণুর মধ্যে প্রকাশ করবার কথা চিন্তা করে, কিন্তু শেষে নিজের ভুল ধরতে পেরে পালাতে চায়। এই প্রত্যাবর্তন—এই হল ধর্মের আরম্ভ; আর এর সাধনা হচ্ছে অহং-এর নাশ অর্থাৎ প্রেম। স্ত্রী, পুত্র বা আর কারও জন্য ভালবাসা নয়, পরন্তু নিজের ক্ষুদ্র ‘অহং’কে ছাড়া অপর সকলের জন্য ভালবাসা। আমেরিকায় ‘মানবজাতির উন্নতি’ ইত্যাদি যে-সব বড় বড় বুলি অহরহ শুনতে পাবে, সে-সব বাজে কথা ভুলো না। এক দিকে অবনতি না হলে অন্যদিকে উন্নতি হতে পারে না। এক সমাজে এক রকমের ত্রুটি আছে, অন্য সমাজে অন্য রকমের। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগ সম্বন্ধেও তাই বলা চলে। মধ্যযুগে ডাকাতের প্রাধান্য ছিল, এখন জোচ্চোরের দল বেশী। কোন যুগে দাম্পত্য জীবনের আদর্শ সম্বন্ধে ধারণা কম থাকে, অন্য যুগে বেশ্যাবৃত্তির আধিক্য দেখা যায়। কোন সময় শারীরিক দুঃখের আধিক্য, আবার অন্য সময় মানসিক দুঃখ সহস্রগুণ। জ্ঞান সম্বন্ধেও তাই। আবিষ্কার ও নামকরণের পূর্বেও কি মাধ্যাকর্ষণ প্রকৃতিতে ছিল না? যদি ছিলই, তবে তার অস্তিত্ব জানাতে তফাতটা কি হল? আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের চেয়ে তোমরা কি বেশী সুখী?
একমাত্র মূল্যবান জ্ঞান হচ্ছেঃ এইটি জানা যে, সবই প্রতারণা—ভান মাত্র। কিন্তু কম লোকই কদাচিৎ তা জানতে পারে। ‘সেই একমাত্র আত্মাকেই জান, আর অন্য সব বাক্য ত্যাগ কর।’১০৫ জগতের দিকে দিকে ঘুরে ফিরে শেষ পর্যন্ত আমাদের এইটুকু শিক্ষা লাভ হয়। আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে, সমগ্র মানবজাতিকে এই বলে ডাকা—‘ওঠ’ জাগো, যে পর্যন্ত না লক্ষ্যস্থলে পৌঁছচ্ছ, ততক্ষণ থেমো না।’ ধর্ম মানে ত্যাগ—তা ছাড়া আর কিছু নয়।
জীবসমষ্টিকে নিয়েই ঈশ্বর; মানবদেহের প্রত্যেক কোষ (cell)-এর একটা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকলেও দেহ যেমন একটি অখণ্ড বস্তু, ঈশ্বরও ঠিক তেমন একজন ব্যক্তি। সমষ্টিই ঈশ্বর এবং ব্যষ্টি বা অংশই জীব বা আত্মা। ঈশ্বরের অস্তিত্ব জীবের অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করছে, দেহ যেমন কোষের ওপর নির্ভর করে; বিপরীতও সত্য। জীব ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরস্পরসাপেক্ষ; একজন যতক্ষণ আছেন, ততক্ষণ অন্যকেও থাকতে হবে। আবার, এই পৃথিবী ছাড়া সব উচ্চতর লোকেই যেহেতু মন্দ অপেক্ষা ভালর ভাগ অনেকগুণ বেশী, সমষ্টি পুরুষ বা ঈশ্বরকে সর্বগুণশালী সর্বশক্তিমান্ ও সর্বজ্ঞ বলা চলে। ঈশ্বরের পূর্ণত্ব মানলেই এই সব গুণ স্বতঃসিদ্ধ হয়ে যায়; সেজন্য আর বিচারের প্রয়োজন হয় না।
ব্রহ্ম এই উভয়ের অতীত, কিন্তু কোন অবস্থাবিশেষ নহেন। ব্রহ্মই একমাত্র অদ্বৈত বস্তু; বহুবস্তুসম্ভূত নন। এই সর্বব্যাপী তত্ত্বই দেহ-কোষ থেকে ঈশ্বর পর্যন্ত সর্বত্র অনুস্যূত, এবং একে বাদ দিয়ে কেউ থাকতে পারে না। যা কিছু সত্য, তা এই ব্রহ্মতত্ত্ব ভিন্ন আর কিছু নয়। যখন ভাবি—‘আমি ব্রহ্ম’, তখন শুধু ‘আমিই’ থাকি। তুমি যখন এই চিন্তা কর, তখন তোমার পক্ষেও তাই; এইরূপ সর্বত্র। প্রত্যেকেই ঐ পূর্ণ তত্ত্ব।
দিন কয়েক আগে হঠাৎ কৃপানন্দকে চিঠি লেখবার একটা অদম্য ইচ্ছা হয়েছিল। হয়তো সে আনন্দ পাচ্ছিল না এবং আমাকে স্মরণ করছিল। সুতরাং আমি তাকে খুব স্নেহপূর্ণ একখানি চিঠি লিখেছিলাম। আজ আমেরিকার সংবাদ পেয়ে তার কারণ বুঝতে পারলাম। আমি তুষার প্রবাহের কাছ থেকে তোলা গোটাকয়েক ফুল তাকে পাঠিয়েছি। মিস ওয়াল্ডোকে বলবে, তাকে যেন যথেষ্ট স্নেহ জানিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন। প্রেম কখনও মরে না। সন্তানেরা যাই করুক বা যেমনই হোক না কেন, পিতৃস্নেহের মরণ নেই। সে আমার সন্তান—সে আজ দুঃখে পড়ায় আমার স্নেহ ও সাহায্যের উপর তার দাবী ঠিক তেমনি বা আরও বেশী। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
২৯৬*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
Grand Hotel, Saas Fee
Valais, Switzerland
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
তোমার চিঠির সঙ্গে একটি চিঠির তাড়া এসেছে। এইসঙ্গে ম্যাক্সমূলারের লেখা চিঠিখানা তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এটা তাঁর সহৃদয়তা ও সৌজন্য।
মিস মূলার খুব শীঘ্রই ইংলণ্ডে ফিরে যাবার কথা ভাবছেন। সেক্ষেত্রে পূর্ব-প্রতিশ্রুতিমত সেই ‘পিওরিটি কংগ্রেস’ (Purity Congress) উপলক্ষে বার্নে যেতে পারব না। যদি সেভিয়ার-রা আমাকে সঙ্গে নিতে রাজী হন, তবেই আমি কিয়েল (Kiel) যাব এবং যাবার আগে তোমাকে লিখব। সেভিয়ার-রা মহৎ এবং সহৃদয়, কিন্তু তাঁদের বদান্যতার অযথা সুযোগ নেবার কোন অধিকার আমার নেই। মিস মূলারের ওপরও সে-দাবী করতে পারি না, কারণ সেখানকার খরচের বহর ভয়াবহ। অতএব বার্ন কংগ্রেসের আশা ত্যাগ করাই শ্রেয় মনে করলাম, কারণ সেটা শুরু হতে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি, তার এখনও অনেক দেরী।
তাই ভাবছি জার্মানীর দিকেই যাব, যাত্রা শেষ করব কিয়েল-এ, এবং সেখান থেকে ইংলণ্ডে ফিরব।
তাঁর নাম হচ্ছে বালগঙ্গাধর তিলক (মিঃ তিলক) এবং বইয়ের নাম ‘ওরায়ন’ (Orion)।
তোমাদের
পুনঃ—জেকবীর (Jacobi) লেখাও একখানা আছে—সম্ভবতঃ একই ধারায় ও একই সিদ্ধান্ত সহ অনূদিত।
পুনঃ—আশা করি থাকবার বাড়ী ও হলঘরটি সম্বন্ধে তুমি মিস মূলারের অভিমত জিজ্ঞেস করবে, তাঁর সঙ্গে এবং অন্যান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করা না হলে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হবেন।
—বি
গত রাত্রে মিস মূলার অধ্যাপক ডয়সনকে তার করেছিলেন, আজ ৯ অগষ্ট সকালে উত্তর এসেছে—আমাকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে; ১০ সেপ্টেম্বর আমি কিয়েল-এ ডয়সনের বাড়ীতে উঠব। তাহলে তুমি আমার সঙ্গে কোথায় দেখা করবে? কিয়েল-এ? মিস মূলার সুইজরলণ্ড থেকে ইংলণ্ডে যাচ্ছেন। আমি সেভিয়ারদের সঙ্গে কিয়েল যাচ্ছি। আমি ১০ সেপ্টেম্বর সেখানে পৌঁছব।
পুনঃ—বক্তৃতার বিষয়ে এখনও কিছু স্থির করিনি। আমার পড়াশুনো করার সময় একেবারে নেই। সেলেম সোসাইটি (Salem Society) খুব সম্ভবতঃ একটি হিন্দু সম্প্রদায়—কোন খেয়ালী দল নয়।
—বি
২৯৭*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
সুইজরলণ্ড
১২ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রেমাস্পদেষু,
আজ আমেরিকা থেকে একখানা চিঠি পেলাম, তা তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাদের আমি লিখেছি, আমার অভিপ্রায় এককেন্দ্রীকরণ—বর্তমান কার্যারম্ভে তো বটেই। আমি তাদের এ পরামর্শ দিয়েছি যে, অনেকগুলি কাগজ ছাপাবার বদলে তারা ‘ব্রহ্মবাদিনে’র সঙ্গে আমেরিকার লেখা কয়েক পাতা জুড়ে শুরু করুক এবং কিছু চাঁদা তুলে আমেরিকার খরচটা পুষিয়ে নিক। জানি না, তারা কি করবে।
আগামী সপ্তাহে আমরা এখান থেকে জার্মানীর উদ্দেশ্যে রওনা হব। আমরা সীমান্ত পার হয়ে জার্মানীতে পা দিতে না দিতে মিস মূলার ইংলণ্ডে চলে যাবেন। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং আমি তোমাকে কিয়েল-এ আশা করব।
আমি এখন পর্যন্ত কিছু লিখিওনি, পড়িওনি। বস্তুতঃ আমি নিছক বিশ্রাম নিচ্ছি। ভাবনার কারণ নেই, তুমি শীঘ্রই প্রবন্ধটি প্রস্তুত পাবে। আমি মঠ থেকে একখানা চিঠি পেয়ে জানলাম যে, অপর স্বামীটি১০৬ রওনা হবার জন্য তৈরী। আমি নিশ্চিত যে, তোমরা যে ধরনের লোক চাও, তিনি সেই ধরনের উপযুক্ত হবেন। আমাদের মধ্যে কয়েকজনের সংস্কৃতে বিশেষ অধিকার আছে, তিনি তাদের অন্যতম … এবং শুনলাম তাঁর ইংরেজী বেশ দুরস্ত হয়েছে। আমেরিকা থেকে সারদানন্দ সম্বন্ধে অনেকগুলি খবরের কাগজের অংশ পেয়েছি—তা থেকে জানলাম যে, তিনি সেখানে খুব সাফল্য অর্জন করেছেন। মানুষের মধ্যে যা কিছু আছে, তা ফুটিয়ে তোলার পক্ষে আমেরিকা একটি সুন্দর শিক্ষাকেন্দ্র। ওখানকার হাওয়া কি সহানুভূতিতে পূর্ণ! গুডউইন এবং সারদানন্দের কাছ থেকে আমি চিঠি পেয়েছি।
চিরন্তন ভালবাসা ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ
২৯৮*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
লুসার্ন
২৩ অগষ্ট, ১৮৯৬
স্নেহাশীর্বাদভাজনেষু,
আজ ভারত থেকে লেখা অভেদানন্দের একখানা চিঠি পেলাম, খুব সম্ভবতঃ তিনি ১১ অগষ্ট B. I. S. N-এর ‘S. S. Mombassa’তে রওনা হয়েছেন। এর পূর্বে তিনি কোন জাহাজ পাননি, তা না হলে আরও আগে রওনা হতে পারতেন। খুব সম্ভব তিনি ‘মোম্বাসা’ জাহাজে স্থান পেয়ে যাবেন। ‘মোম্বাসা’ লণ্ডনে পৌঁছবে ১৫ সেপ্টেম্বর নাগাদ। তুমি জেনেছ যে, আমার ডয়সনের কাছে যাবার দিন—মিস মূলার পরিবর্তিত করে ১৯ সেপ্টেম্বর করেছেন। অভেদানন্দকে অভ্যর্থনা করার জন্য আমি লণ্ডনে থাকতে পারব না। তিনি কোন গরম পোষাক ছাড়াই আসছেন; মনে হচ্ছে সে সময়ে ইংলণ্ডে ঠাণ্ডা পড়ে যাবে এবং তাঁর অন্ততঃ কয়েকটি অন্তর্বাস ও একটি ওভারকোট দরকার হবে। এ সব ব্যাপার আমার চেয়ে তুমি অনেক ভাল জান। সুতরাং দয়া করে এই ‘মোম্বাসা’র দিকে একটু নজর রেখো। আমি তার কাছ থেকে আর একটি চিঠি আশা করছি।
বস্তুতঃ আমি বিশ্রী-রকম সর্দিতে ভুগছি। আশা করি রাজার নিকট হতে মহিনের টাকা ইতোমধ্যেই তোমার জিম্মায় এসেছে। এসে থাকলে আমি তাকে যে টাকা দিয়েছিলাম ফেরত চাই না। তুমি তার সবটাই ওকে দিতে পার।
গুডউইন ও সারদানন্দের কাছ থেকে আমি কয়েকখানা চিঠি পেয়েছি। তারা ভাল আছে। মিসেস বুলের কাছ থেকেও একখানা চিঠি পেয়েছি; তিনি কেম্ব্রিজে যে সমিতিটি গঠন করেছেন, আমি ও তুমি ডাক মাধ্যমে তার সভ্য হইনি বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমার বেশ মনে আছে যে, আমি তাঁকে লিখেছিলাম, তোমার ও আমার পক্ষে তার সভ্যপদ গ্রহণ করতে সম্মত হওয়া সম্ভব নয়। আমি এখন পর্যন্ত একটি লাইনও লিখে উঠতে পারিনি। এমন কি পড়বার জন্যও একমুহূর্ত সময় পাইনি, পাহাড়ের উপত্যকায় চড়াই উতরাই করতে করতে সবটা সময় কাটছে। কয়েকদিনের মধ্যেই আবার আমাদের যাত্রা আরম্ভ হবে। মহিন ও ফক্সের সঙ্গে এর পর যখন দেখা হবে, দয়া করে তাদের আমার ভালবাসা জানিও।
আমাদের সকল বন্ধুকে ভালবাসা।
তোমার চিরন্তন
বিবেকানন্দ
২৯৯*
লুসার্ন
২৩ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার শেষ চিঠিখানি আজ পেয়েছি; ইতোমধ্যে আপনার প্রেরিত ৫ পাউণ্ডের রসিদ পেয়ে থাকবেন। আপনি সভ্য হওয়ার কথা, কি লিখেছেন, তা বুঝতে পারলাম না; তবে কোন সমিতির তালিকায় আমার নাম যুক্ত করা বিষয়ে আমার আপত্তি নাই। স্টার্ডির নিজের এ বিষয়ে কি মতামত, তা কিন্তু আমি জানি না। আমি এখন সুইজরলণ্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এখান থেকে জার্মানীতে যাব, তারপর ইংলণ্ডে এবং পরের শীতে ভারতে যাব। সারদানন্দ ও গুডউইন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারকার্য সুন্দররূপে করছে শুনে খুব খুশী হলাম। আমার নিজের কথা এই যে, আমি কোন কাজের প্রতিদানে ঐ ৫০০ পাউণ্ডের ওপর কোন দাবী রাখি না। আমার বোধ হয়, আমি যথেষ্ট খেটেছি। এখন আমি অবসর নেব। আমি ভারত থেকে আর একজন লোক চেয়ে পাঠিয়েছি; তিনি আগামী মাসে আমার সঙ্গে যোগ দেবেন। আমি কাজ আরম্ভ করে দিয়েছি, এখন অন্যে এটাকে চালাক। দেখতেই তো পাচ্ছেন, কাজটা চালিয়ে দেবার জন্য কিছুদিন টাকাকড়ি ও বিষয়-সম্পত্তির সংস্পর্শে আমাকে আসতে হয়েছে। আমার স্থির বিশ্বাস যে, আমার যতটুকু করবার তো শেষ হয়েছে; এখন আমার আর বেদান্ত বা জগতের অন্য কোন দর্শন এমন কি ঐ কাজটার ওপরও কোন টান নেই। আমি চলে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছি—পৃথিবীর এই নরককুণ্ডে আর ফিরে আসছি না। এমন কি, এই কাজের আধ্যাত্মিক প্রয়োজনীয়তার দিকটার ওপরও আমার অরুচি হয়ে আসছে। মা শীঘ্রই আমাকে তার কাছে টেনে নিন! আর যেন কখনও ফিরে আসতে না হয়।
এই সব কাজ করা, উপকার ইত্যাদি শুধু চিত্তশুদ্ধির সাধনা মাত্র। তা আমার যথেষ্ট হয়ে গেছে। জগৎ চিরকাল অনন্তকাল ধরে জগৎই থাকবে। আমরা যে যেমন সে তেমন ভাবেই জগৎটা দেখি। কে কাজ করে, আর কার কাজ? জগৎ বলে কিছু নেই—এ সবই তো স্বয়ং ভগবান্। ভ্রমে আমরা একে জগৎ বলি। এখানে আমি নেই, তুমি নেই, আপনি নেই—আছেন শুধু তিনি, আছেন প্রভু—‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’।
সুতরাং এখন থেকে টাকাকড়ি সম্বন্ধে আমি আর কিছুই জানি না। এ আপনাদের টাকা, আপনারা ইচ্ছামত খরচ করবেন।
শুভানুধ্যায়ী
সদাপ্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—ডাক্তার জেনসের কাজে আমার পূর্ণ সহানুভূতি আছে, আমি তাঁকে তা জানিয়েছি। গুডউইন ও সারদানন্দ যদি আমেরিকায় কাজের প্রসার করতে পারে তো ভগবৎকৃপায় তারা তাই করতে থাকুক। স্টার্ডি, আমার বা অন্য কারও কাছে তো আর তারা নিজেদের বাঁধা দেয়নি! গ্রীনএকারের প্রোগ্রামে একটা ভয়ানক ভুল হয়েছে—ওতে ছাপা হয়েছে, স্টার্ডি কৃপা করে অনুমতি দেওয়ায় সারদানন্দ সেখানে রয়েছে। স্টার্ডি বা অপর কেহ—একজন সন্ন্যাসীকে অনুমতি দেবার কে? স্টার্ডি এটা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে এবং এজন্য দুঃখও করেছে। … এতে স্টার্ডিকে অপমানিত করা হয়েছে; আর এটা যদি ভারতে পৌঁছাত, তবে আমার কাজের পক্ষে সাঙ্ঘাতিক হত। ভাগ্যক্রমে আমি বিজ্ঞাপনগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নর্দমায় ফেলে দিয়েছি। … আমি জগতের কোন সন্ন্যাসী বা প্রভুর চালক নই। যে কাজটা তাঁদের ভাল লাগে, সেইটে তাঁরা করেন এবং আমি যদি তাঁদের সাহায্য করতে পারি—বস্, এইমাত্র তাঁদের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ। আমি পারিবারিক বন্ধনরূপ লোহার শেকল ভেঙেছি—আর ধর্মসঙ্ঘের সোনার শেকল পরতে চাই না। আমি মুক্ত, সর্বদা মুক্ত থাকব। আমার ইচ্ছা সকলেই মুক্ত হয়ে যাক—বাতাসের মত মুক্ত। যদি নিউ ইয়র্ক, বোষ্টন অথবা যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোন স্থান বেদান্তের আচার্য চায়, তবে তাদের উচিত এই আচার্যদের সাদরে গ্রহণ করা, তাঁদের বাসস্থান ও ভরণপোষণের বন্দোবস্ত করে দেওয়া। আর আমার কথা—আমি তো অবসর গ্রহণ করছি বললেই চলে। জগৎ-রঙ্গমঞ্চে আমার যেটুকু অভিনয় করবার ছিল, তা আমি শেষ করেছি। ইতি
আপনাদের
—বি
৩০০
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
Lake Lucerne, সুইজরলণ্ড
২৩ অগষ্ট, ১৮৯৬
কল্যাণবরেষু,
অদ্য রামদয়ালবাবুর এক পত্র পাইলাম। তাহাতে তিনি লিখিতেছেন যে, দক্ষিণেশ্বরের মহোৎসবে অনেক বেশ্যা যাইয়া থাকে এবং সেজন্য অনেক ভদ্রলোকের তথায় যাইবার ইচ্ছা কম হইতেছে। পুনশ্চ—তাঁহার মতে পুরুষদিগের একদিন এবং মেয়েদের আর একদিন হওয়া উচিত। তদ্বিষয়ে আমার বিচার এইঃ
আলমোড়ার কাছে কোন সুবিধামত জায়গা আপনার জানা আছে কি, যেখানে বাগবাগিচা সহ আমাদের মঠ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? সঙ্গে বাগান প্রভৃতি অবশ্যই থাকা চাই। একটা গোটা ছোট পাহাড় হলেই ঠিক আমার মনোমত হয়।
১। বেশ্যারা যদি দক্ষিণেশ্বরের মহাতীর্থে যাইতে না পায় তো কোথায় যাইবে? পাপীদের জন্য প্রভুর বিশেষ প্রকাশ, পুণ্যবানের জন্য তত নহে।
২। মেয়েপুরুষ-ভেদাভেদ, জাতিভেদ, ধনভেদ, বিদ্যাভেদ ইত্যাদি নরক-দ্বাররূপ বহুভেদ সংসারের মধ্যেই থাকুক। পবিত্র তীর্থস্থলে ঐরূপ ভেদ যদি হয়, তাহা হইলে তীর্থ আর নরকে ভেদ কি?
৩। আমাদের মহা জগন্নাথপুরী—যথায় পাপী-অপাপী, সাধু-অসাধু, আবালবৃদ্ধবনিতা নরনারী সকলের অধিকার। বৎসরের মধ্যে একদিন অন্ততঃ সহস্র সহস্র নরনারী পাপবুদ্ধি ও ভেদবুদ্ধির হস্ত হইতে নিস্তার পাইয়া হরিনাম করে ও শোনে, ইহাই পরম মঙ্গল।
৪। যদি তীর্থস্থলেও লোকের পাপবৃত্তি একদিনের জন্য সঙ্কুচিত না হয়, তাহা তোমাদের দোষ, তাহাদের নহে। এমন মহা ধর্মস্রোত তোল যে, যে জীব তাহার নিকট আসবে, সে-ই ভেসে যাক।
৫। যাহারা ঠাকুরঘরে গিয়াও ঐ বেশ্যা, ঐ নীচ জাতি, ঐ গরীব, ঐ ছোটলোক ভাবে, তাহাদের (অর্থাৎ যাহাদের তোমরা ভদ্রলোক বল) সংখ্যা যতই কম হয়, ততই মঙ্গল। যাহারা ভক্তের জাতি বা যোনি বা ব্যবসায় দেখে, তাহারা আমাদের ঠাকুরকে কি বুঝিবে? প্রভুর কাছে প্রার্থনা করি যে, শত শত বেশ্যা আসুক তার পায়ে মাথা নোয়াতে, বরং একজনও ভদ্রলোক না আসে নাই আসুক। বেশ্যা আসুক, মাতাল আসুক, চোর ডাকাত সকলে আসুক তাঁর অবারিত দ্বার। 'It is easier for a camel to pass through the eye of a needle than for a rich man to enter the kingdom of God.'১০৭ এ সকল নিষ্ঠুর রাক্ষসীভাব মনেও স্থান দিবে না।
৬। তবে কতকটা সামাজিক সাবধানতা চাই—সেটা কি প্রকারে করিতে হইবে? জনকতক লোক (বৃদ্ধ হইলেই ভাল হয়) ছড়িদারের কার্য ঐ দিনের জন্য লইবেন। তাঁহারা মহোৎসবস্থলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইবেন, কোন পুরুষ বা স্ত্রীকে কদাচার বা কুকথা ইত্যাদিতে নিযুক্ত দেখিলে তাহাদিগকে উদ্যান হইতে তৎক্ষণাৎ বাহির করিয়া দিবেন। কিন্তু যতক্ষণ তাহারা ভালমানুষের মত ব্যবহার করে, ততক্ষণ তারা ভক্ত ও পূজ্য—মেয়েই হউক বা পুরুষই হউক, গৃহস্থ হউক বা অসতী হউক।
আমি এক্ষণে সুইজরলণ্ডে ভ্রমণ করিতেছি—শীঘ্র জার্মানীতে যাইব অধ্যাপক ডয়সনের সহিত দেখা করিতে। তথা হইতে ইংলণ্ডে প্রত্যাগমন ২৩।২৪ সেপ্টেম্বর নাগাত এবং আগামী শীতে দেশে প্রত্যাবর্তন।
আমার ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩০১*
সুইজরলণ্ড
২৬ অগষ্ট, ১৮৯৬
প্রিয় নাঞ্জুণ্ড রাও,
এইমাত্র আপনার চিঠি পেলাম। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। আল্পস্ পর্বতে খুব চড়াই করছি আর তুষারপ্রবাহ পার হচ্ছি। এখন যাচ্ছি জার্মানীতে। অধ্যাপক ডয়সন কিয়েলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আমায় নিমন্ত্রণ করেছেন। সেখান থেকে ইংলণ্ডে ফিরব। সম্ভবতঃ এই শীতে ভারতে ফিরব।
মলাটের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আমার আপত্তি এই যে, ওটি বড্ড রঙচঙে, চটকদার (tawdry); আর তাতে অনাবশ্যক এক গাদা মূর্তির সমাবেশ করা হয়েছে। নক্সা হওয়া চাই সাদাসিধে, ভাবদ্যোতক অথচ সংক্ষিপ্ত (condensed)।
আমি সানন্দে জানাচ্ছি যে, কাজ সুন্দর চলছে। … যা হোক, একটা পরামর্শ দিচ্ছি—ভারতে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আমরা যত কাজ করি, তার সব একটা দোষে পণ্ড হয়ে যায়। আমরা এখনও কাজের ধারা ঠিক ঠিক শিখিনি। কাজকে ঠিক ঠিক কাজ বলেই ধরতে হবে—এর ভেতর বন্ধুত্বের অথবা চক্ষুলজ্জার স্থান নেই। যার ওপর ভার থাকবে, সে সব টাকাকড়ির অতি পরিষ্কার হিসেব রাখবে; এমন কি যদি কাউকে পরমুহূর্তে না খেয়ে মরতে হয়, তবুও ‘শাকের কড়ি মাছে’ দেবে না। একেই বলে বৈষয়িক সততা। তারপর চাই—অদম্য উৎসাহ। যখন যা কর, তখনকার মত তাই হবে ভগবৎ-সেবা। এই পত্রিকাটি১০৮ এখনকার মত আপনার আরাধ্য দেবতা হোক, তাহলেই সফল হবেন।
যখন এই পত্রিকাটি দাঁড় করিয়ে দিতে পারবেন, তখন তামিল, তেলুগু, কানাড়া প্রভৃতি দেশীয় ভাষায় ঠিক ঐ ভাবের কাগজ বের করুন। মান্দ্রাজীরা খুব সৎ, উৎসাহী ইত্যাদি; তবে আমার মনে হয়, শঙ্করের জন্মভূমি ত্যাগের ভাব হারিয়ে ফেলেছে। নানা বাধা বিপদের মাঝে আমার ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়বে, সংসার ত্যাগ করবে; তবেই তো ভিত্তি শক্ত হবে!
বীরের মত কাজ করে চলুন; (মলাটের) নক্সা-টক্সার চিন্তা এখন থাক, ঘোড়া হলে লাগামের জন্য আটকাবে না। আমরণ কাজ করে যান—আমি আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছি আর আমার শরীর চলে গেলেও আমার শক্তি আপনাদের সঙ্গে কাজ করবে। জীবন তো আসে যায়—ধন, মান, ইন্দ্রিয়ভোগ সবই দুদিনের জন্য। ক্ষুদ্র সংসারী কীটের মত মরার চেয়ে কর্মক্ষেত্রে সত্য প্রচার করে মরা ভাল—ঢের ভাল। চলুন—এগিয়ে চলুন। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ গ্রহণ করুন। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
৩০২*
[মিঃ স্টার্ডিকে লিখিত]
Kiel
১০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
… অবশেষে অধ্যাপক ডয়সনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। … অধ্যাপকের সঙ্গে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে ও বেদান্ত আলোচনা করে কালকের দিনটা খুব চমৎকার কাটান গেছে।
আমার মতে তিনি যেন একজন ‘যুধ্যমান (warring) অদ্বৈতবাদী’। অপর কিছুর সঙ্গে তিনি আপস করতে নারাজ। ‘ঈশ্বর’ শব্দে তিনি আঁতকে উঠেন। ক্ষমতায় কুলালে তিনি এ- সব কিছুই রাখতেন না। তোমার মাসিক পত্রিকার পরিকল্পনায় তিনি খুব আনন্দিত এবং এ- সব বিষয়ে লণ্ডনে তোমার সঙ্গে আলোচলা করতে চান; শীঘ্রই তিনি সেখানে যাচ্ছেন।
৩০৩*
[মিস হ্যারিয়েট হেলকে লিখিত]
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় ভগিনী,
সুইজরলণ্ড থেকে ফিরে এসে এইমাত্র তোমার অতি মনোজ্ঞ খবরটি পেলাম। 'Old Maids Home' (আইবুড়ীদের আশ্রম)-এ লভ্য আরাম সম্বন্ধে তুমি যে অবশেষে মত পরিবর্তন করেছ, তাতে আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছি। তুমি এখন ঠিক পথ ধরেছ, শতকরা নিরানব্বই জন মানুষের পক্ষে বিবাহই জীবনের সর্বোত্তম লক্ষ্য। আর যে মুহূর্তে এই চিরন্তন সত্যটি মানুষ শিখে নেবে এবং মেনে চলতে প্রস্তুত হবে যে, পরস্পরের দোষত্রুটি সহ্য করা অবশ্য কর্তব্য এবং জীবনে আপস করে চলাই রীতি, তখনই তারা সবচেয়ে সুখের জীবন যাপন করতে পারবে।
স্নেহের হ্যারিয়েট, তুমি ঠিক জেনো ‘সর্বাঙ্গসুন্দর জীবন’—একটা স্ববিরোধী কথা; সুতরাং সংসারের কোন কিছু আমাদের উচ্চতম আদর্শের কাছাকাছি নয়—এটা দেখবার জন্য আমাদের সর্বদাই প্রস্তুত থাকতে হবে, এবং এটা জেনে সব জিনিষের যথাসম্ভব সদ্ব্যবহার করতে হবে।
বর্তমান অবস্থায় আমাদের একখানি পুস্তক থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করাই আমার পক্ষে সব চেয়ে ভাল বলে মনে হচ্ছেঃ
‘স্বামীকে ইহজীবনে সমস্ত কাম্যলাভে সহায়তা করে তুমি সর্বদা তাঁহার ঐকান্তিক প্রেমের অধিকারিণী হও; অতঃপর পৌত্র পৌত্রী প্রভৃতির মুখদর্শনের পরে যখন জীবন-নাট্য শেষ হয়ে আসবে, তখন যে সচ্চিদানন্দ-সাগরের জলস্পর্শে সর্বপ্রকার বিভেদ দূর হয়ে যায় এবং আমরা এক হয়ে যাই, সেই সচ্চিদানন্দ-লাভে যেন তোমরা পরস্পরের সহায় হও।’১০৯
আমি তোমাকে যতটুকু জানি, তাতে মনে হয়, তোমার মধ্যে এমন প্রভূত ও সুসংযত শক্তি রয়েছে, যা ক্ষমা ও সহনশীলতায় পূর্ণ। সুতরাং আমি নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যে, তোমার দাম্পত্য-জীবন খুব সুখের হবে।
তোমাকে ও তোমার ভাবী বরকে আমার অনন্ত আশীর্বাদ। ভগবান্ যেন তাকে সর্বদা এ-কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, তোমার মত পবিত্র, সুচরিত্রা, বুদ্ধিমতী, স্নেহময়ী ও সুন্দরী সহধর্মিণী লাভ করে সে কৃতার্থ হয়েছে।
আমি এত শীঘ্র আটলাণ্টিক পাড়ি দেবার ভরসা রাখি না, যদিও তোমার বিয়েতে উপস্থিত থাকতে আমার খুবই সাধ।
তুমি সারাজীবন উমার মত পবিত্র ও নিষ্কলুষ হও, আর তোমার স্বামীর জীবন যেন উমাগতপ্রাণ শিবের মতই হয়। ইতি
তোমার স্নেহের ভাই
বিবেকানন্দ
৩০৪*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
Airlie Lodge
Wimbledon, England
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬
স্নেহের ভগিনী,
সুইজরলণ্ডে দু-মাস পাহাড় চড়ে, পর্যটন করে ও হিমবাহ দেখে আজ লণ্ডনে এসে পৌঁছেছি। এতে আমার একটা উপকার হয়েছে—কয়েক পাউণ্ড অপ্রয়োজনীয় মেদ বাষ্পীয় অবস্থায় ফিরে গিয়েছে। তথাপি তাতেও কোন নিরাপত্তা নেই, কারণ এ জন্মের স্থূল দেহটির খেয়াল হয়েছে মনকে অতিক্রম করে অনন্তে প্রসারিত হবে। এ ভাবে চলতে থাকলে আমাকে অচিরেই সমস্ত ব্যক্তিগত সত্তা হারাতে হবে—এই রক্তমাংসের দেহে থেকেও—অন্ততঃ বাইরের জগৎটার কাছে।
হ্যারিয়েটের চিঠিতে যে শুভ সংবাদটি এসেছে, তাতে যা আনন্দ হল—তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আজ তাকে চিঠি দিলাম। দুঃখ এই যে, তার বিবাহের সময় যেতে পারছি না, তবে সর্বাধিক শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ নিয়ে আমি ‘সূক্ষ্ম দেহে’ উপস্থিত থাকব। ভাল কথা, আমার আনন্দ পূর্ণাঙ্গ করার জন্য আমি তোমার এবং অপর ভগিনীদের নিকট হতেও অনুরূপ সংবাদ আশা করছি। এবার স্নেহের মেরী, আমি জীবনে যে এক মহৎ শিক্ষা লাভ করেছি, তার কথা তোমাকে বলব। সেটা হল এইঃ ‘তোমার আদর্শ যত উচ্চ হবে, তুমি তত দুঃখী’, কারণ ‘আদর্শ’ বলে বস্তুটিতে পৌঁছান এ সংসারে সম্ভব নয়—অথবা এ জীবনেও নয়। যে এ জগতে পরিপূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা করে, সে উন্মাদ বৈ নয়, কারণ তা হবার যো নেই।
সসীম জগতে তুমি কি করে অনন্তের সন্ধান পাবে? সুতরাং আমি তোমাকে বলছি— হ্যারিয়েট বেশ সুখের ও শান্তির জীবন লাভ করবে, কারণ কল্পনাবিলাস ও ভাবপ্রবণতার বশবর্তী হয়ে চলার মত বোকা সে মোটেই নয়। যেটুকু ভাবাবেগ থাকলে জীবন মধুর হয় এবং যেটুকু সাধারণ বুদ্ধি ও কোমলতা থাকলে জীবনের অবশ্যম্ভাবী কাঠিন্যগুলি নরম হয়ে যায়—সেটুকু তার আছে। হ্যারিয়েট ম্যাক্কিণ্ডলিরও ঐ গুণটি আরও বেশী পরিমাণেই আছে। একজন সেরা গৃহিণী হবার মত মেয়ে সে, শুধু এ জগৎটা আহাম্মকদের দ্বারা এতই পরিপূর্ণ যে, খুব কম লোক রক্তমাংসের দেহকে অতিক্রম করে আরও গভীরে প্রবেশ করতে পারে। তোমার ও ইসাবেল-এর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আমি তোমাকে সত্য কথাটি বলব এবং আমার ‘ভাষা সোজা—স্পষ্ট’।
মেরী, তুমি হলে একটি তেজী আরবী ঘোড়ার মত—মহীয়সী ও দীপ্তিময়ী। তোমাকে রাণী হিসেবে চমৎকার মানাবে—দেহে ও মেজাজে। তুমি একজন তেজস্বী, বীর, দুঃসাহসী, নির্ভীক স্বামীর পাশে উজ্জ্বল দীপ্তিতে শোভা পাবে; কিন্তু স্নেহের ভগিনী, গৃহিণী হিসেবে তুমি হবে একেবারেই নিকৃষ্ট। তুমি আমাদের দৈনন্দিন জগতের স্বচ্ছন্দচারী, সাংসারিক, পরিশ্রমী অথচ ঢিলেঢালা স্বামী বেচারাদের জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলবে। ভগিনী, মনে রেখো, যদিও এ-কথা সত্যি যে বাস্তব জীবন উপন্যাসের চেয়ে বেশী রোমাঞ্চকর, কিন্তু সে-রকম ঘটে ক্বচিৎ কখনও। তাই তোমার প্রতি আমার উপদেশ, যতদিন না তোমার আদর্শকে বাস্তব ভূমিতে নামিয়ে আনতে পারছ, ততদিন তোমার বিয়ে করা ঠিক হবে না। যদি কর, তবে তা তোমাদের উভয়ের অশান্তি ডেকে আনবে। কয়েক মাসের মধ্যেই তুমি একজন সাধারণ ভালমানুষ মার্জিত রুচি যুবা পুরুষের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলবে, তখন তোমার কাছে জীবন নীরস বলে বোধ হবে। ভগিনী ইসাবেল-এর মেজাজটাও তোমারই মতন, শুধু কিণ্ডারগার্টেনটি তাকে বেশ কিছুটা ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দিয়েছে। সম্ভবতঃ সে ভাল গৃহিণীই হতে পারবে।
জগতে দু-রকমের লোক আছে। একরকম হল—বলিষ্ঠ, শান্তিপ্রিয়, প্রকৃতির কাছে নতিস্বীকার করে, বেশী কল্পনার ধার ধারে না, কিন্তু সৎ সহৃদয় মধুরস্বভাব ইত্যাদি। তাদেরই জন্য এই পৃথিবী; তারাই সুখী হতে জন্মেছে। আবার অন্য রকমের লোক আছে, যাদের স্নায়ুগুলি উত্তেজনাপ্রবণ, যারা ভয়ানক রকম কল্পনাপ্রিয়, তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন এবং সর্বদা এই মুহূর্তে উঁচুতে উঠছে এবং পরের মুহূর্তে তলিয়ে যাচ্ছে। তাদের বরাতে সুখ নেই। প্রথম শ্রেণীর লোকেরা মাঝামাঝি একটা সুখের সুরে ভেসে যায়। শেষোক্তেরা আনন্দ ও বেদনার মধ্যে ছুটোছুটি করে। কিন্তু এরাই হল প্রতিভার উপাদান। ‘প্রতিভা এক রকমের পাগলামি’—আধুনিক এই মতবাদের মধ্যে অন্ততঃ কিছু সত্য নিহিত আছে।
এখন এই শ্রেণীর লোকেরা যদি বড় হতে চায়, তবে তাদের তা চরিতার্থ করবার জন্য লড়াই করতে হবে—লড়াই-এর জন্যেই, আর বাইরে বেরিয়ে এসে। তাদের কোন দায় থাকবে না—বিবাহ নয়, সন্তান নয়, সেই এক চিন্তা ছাড়া আর কোন অনাবশ্যক আসক্তি নয়; সেই আদর্শের জন্যই জীবনধারণ এবং সেই আদর্শের জন্যই মৃত্যুবরণ। আমি এই শ্রেণীর মানুষ। আমার একমাত্র ভাবাদর্শ হল ‘বেদান্ত’, এবং আমি ‘লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত’। তুমি ও ইসাবেল এই ধাতুতে গড়া; কিন্তু আমি তোমাদের বলছি, যদিও কথাটা রূঢ়, তোমরা তোমাদের জীবনের বৃথাই অপচয় করছ। হয় একটা আদর্শকে ধর, বাইরে ঝাঁপিয়ে পড় এবং তার জন্য জীবন উৎসর্গ কর; কিম্বা অল্পে সন্তুষ্ট থাক ও বাস্তববাদী হও; আদর্শকে খাটো করে বিয়ে কর ও সুখের জীবন যাপন কর। হয় ‘ভোগ’ নয় ‘যোগ’—হয় এই জীবনটাকে উপভোগ কর, অথবা সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে যোগী হও; দুটি একসঙ্গে লাভ করার সাধ্য কারও নেই। এইবেলা না হলে কোনকালেই হবে না, ঝটপট একটাকে বেছে নাও। কথায় বলে, ‘যে খুব বাছবিচার করে, তার বরাতে কিছুই জোটে না’। তাই আন্তরিকভাবে, খাঁটিভাবে আমরণ সংকল্প নিয়ে ‘লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হও’; দর্শন বা বিজ্ঞান, ধর্ম বা সাহিত্য—যে-কোন একটিকে অবলম্বন কর এবং অবশিষ্ট জীবনে সেইটিই তোমার উপাস্য দেবতা হোক। হয় সুখী হও, নয়তো মহৎ হও। তোমার ও ইসাবেলের প্রতি আমার এতটুকু সহানুভূতি নেই; তোমরা না এটায়, না ওটায়। তোমরাও হ্যারিয়েটের মত ঠিক পথটি বেছে নিয়ে সুখী হও, কিম্বা মহীয়সী হও—এই আমি দেখতে চাই। পান ভোজন সজ্জা ও যত বাজে সামাজিক চালচলনের ছেলেমানুষীর জন্য একটা জীবন দেওয়া চলে না—বিশেষতঃ মেরী, তোমার। অদ্ভুত মস্তিষ্ক ও কর্মকুশলতাকে তুমি মরচে পড়তে দিয়ে নষ্ট করে ফেলছ, যার কোন অজুহাত নেই। বড় হবার উচ্চাশা তোমাকে রাখতে হবে। আমি জানি, আমার এই রূঢ় মন্তব্যগুলো তুমি ঠিকভাবে নেবে, কারণ তুমি জান, আমি তোমাদের যে ‘বোন’ বলে ডাকি—তার চেয়েও বেশীই আমি তোমাদের মনে করি। আমার অনেকদিন থেকেই এই কথাটি তোমাকে বলার ইচ্ছা ছিল, এবং অভিজ্ঞতা জমছে, তাই বলার আবেগে বলে ফেললাম। হ্যারিয়েটের আনন্দসংবাদ আমাকে এ-কথা বলতে প্ররোচিত করেছে। আমি শুনতে পেলে খুবই আনন্দিত হব যে, তুমিও বিয়ে করেছ এবং সংসারে যতটা সুখী হওয়া যায় ততটা সুখী হয়েছ, অথবা এ-কথা শুনতে চাই যে তুমি বড় বড় কাজ করছ।
জার্মানীতে অধ্যাপক ডয়সনের কাছে গিয়ে বেশ আনন্দ পেয়েছি। তুমি নিশ্চয়ই এই শ্রেষ্ঠ জার্মান দার্শনিকের নাম শুনেছ। তিনি ও আমি একসঙ্গে ইংলণ্ড ভ্রমণ করেছি ও আজ উভয়ে এখানে আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছি—আমার ইংলণ্ড বাসের অবশিষ্ট দিনগুলি তাঁর কাছেই কাটাব। ডয়সন সংস্কৃত বলতে খুব ভালবাসেন এবং পাশ্চাত্য দেশে সংস্কৃত পণ্ডিতদের মধ্যে একমাত্র তিনিই সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতে পারেন। তিনি সেটা অভ্যাস করতে চান বলে আমার সঙ্গে সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কথা বলেন না।
আমি এখানে বন্ধুদের মধ্যে এসে জুটেছি, কয়েক সপ্তাহ এখানে কাজ করব এবং তারপর শীতকালে ভারতবর্ষে ফিরে যাব।
সতত তোমার স্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
৩০৫*
[মিঃ গুডউইনকে লিখিত]
C/o Miss Muller
Airlie Lodge, Ridgeway
Gardens
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
২২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
ম্যাক্সমূলারের লিখিত শ্রীরামকৃষ্ণ-সম্বন্ধীয় যে প্রবন্ধটি পাঠিয়েছিলাম, তা তুমি পাওনি বলেই মনে হচ্ছে। তিনি ঐ প্রবন্ধে আমার নাম উল্লেখ না করায় তুমি দুঃখিত হয়ো না; কারণ আমার সঙ্গে পরিচয় হবার ছ-মাস আগে তিনি ঐ প্রবন্ধটি লিখেছেন। তা ছাড়া মূল বিষয়ে যদি তিনি ঠিক থাকেন, তবে কার নাম করলেন বা না করলেন, এ নিয়ে কে মাথা ঘামায়!
জার্মানীতে প্রফেসর ডয়সনের সঙ্গে আমার কিছুদিন খুব সুন্দর কেটেছে। তারপর দুজনে লণ্ডনে আসি। ইতোমধ্যেই আমাদের দুজনের মধ্যে খুব সৌহার্দ্য জন্মেছে। আমি শীঘ্রই তোমাকে তাঁর সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠাচ্ছি। দয়া করে এইটুকু শুধু মনে রেখো—আমার প্রবন্ধের প্রারম্ভে পুরানো ঢঙের ‘প্রিয় মহাশয়’ যেন ছাপা না হয়। রাজযোগের বইখানি কি তোমার দেখা হয়েছে? আগামী বৎসরের জন্য তোমায় একটি নক্সা পাঠাব। রাশিয়ার জারের লেখা একটি ভ্রমণ-বিষয়ক পুস্তকের উপর ‘ডেলী নিউজে’ যে প্রবন্ধ বেরিয়েছিল, তা তোমায় পাঠালাম। যে প্যারাগ্রাফে তিনি ভারতবর্ষকে ‘ধর্মভূমি ও জ্ঞানভূমি’ বলেছেন, সেটা তোমার কাগজে উদ্ধৃত করা উচিত; তারপর ওটি ‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ পাঠিয়ে দিও।
জ্ঞানযোগের বক্তৃতাগুলি তুমি অনায়াসে ছাপতে পার, আর ডাক্তার নাঞ্জুণ্ড রাও সহজ বক্তৃতাগুলি ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’ ছাপতে পারেন। তবে ওগুলো খুব ভাল করে দেখে নিয়ে ছাপাবে। আমার বিশ্বাস, পরে আমি আরও বেশী লিখবার সময় পাব। উৎসাহ নিয়ে কাজে লেগে যাও। সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—যে অংশটা ছাপতে হবে, তা দাগ দিয়ে দিয়েছি—বাকীটা অবশ্য পত্রিকার পক্ষে উপযুক্ত নয়।
যথেষ্ট প্রবন্ধ দিয়ে কাগজখানিকে বড় করতে পারবে—এমন ভরসা যদি না থাকে, তবে এখনই ওটাকে মাসিক পত্রিকায় রূপান্তরিত করা আমার ভাল মনে হচ্ছে না। এ পর্যন্ত তো পত্রিকার আকার ও প্রবন্ধগুলি আশানুরূপ নয়। এখনও অনেক বিশাল ক্ষেত্র পড়ে আছে, যেখানে আমরা প্রবেশও করিনি; যথা—তুলসীদাস, কবীর, নানক ও দক্ষিণ ভারতীয় সাধুদের জীবন ও বাণী। অসাবধানে ও যা তা ভাবে না লিখে সঠিক ও পাণ্ডিত্যপূর্ণভাবে এ-সব লেখা উচিত। প্রকৃতপক্ষে এই পত্রিকার আদর্শ বেদান্ত-প্রচার তো হবেই, তা ছাড়া এটি ভারতীয় গবেষণা ও পাণ্ডিত্যের মুখপত্র হবে—অবশ্য ঐ গবেষণাদি হবে ধর্ম সম্বন্ধে। তোমার উচিত কলিকাতা ও বোম্বের শ্রেষ্ঠ লেখকদের সংস্পর্শে আসা ও তাঁদের কাছ থেকে সযত্নে রচিত প্রবন্ধ সংগ্রহ করা। পূর্ণ উদ্যমে কাজে লাগ। ইতি
বি
৩০৬*
১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্স্
ওয়েস্টমিনস্টার, লণ্ডন
১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি প্রায় তিন সপ্তাহ হল সুইজরলণ্ড থেকে ফিরেছি; কিন্তু তোমাকে এ পর্যন্ত বিস্তারিত পত্র লিখতে পারিনি। আমি গত mail (ডাকে)-এ কিয়েল-নিবাসী পল ডয়সন সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছি। স্টার্ডির কাগজ বের করবার মতলব এখনও কাজে পরিণত হয়নি। তুমি দেখতেই পাচ্ছ, আমি সেণ্ট জর্জেস্ রোডের বাসা ছেড়ে এসেছি। আমাদের একটি বক্তৃতা দেবার হল হয়েছে। ৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, C/o E. T. Sturdy—এই ঠিকানায় এক বৎসর পর্যন্ত পত্রাদি এলে আমার কাছে পৌঁছবে। গ্রেকোট গার্ডেনে যে ঘরগুলি আছে, তা আমার ও অপর স্বামীর (সন্ন্যাসীর) থাকবার উদ্দেশ্যে মাত্র তিন মাস ভাড়া নেওয়া হয়েছে। লণ্ডনের কাজ দিন দিন বেড়ে চলেছে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই ক্লাসে বেশী করে লোক সমাগম হচ্ছে। শ্রোতৃ-সংখ্যা যে ঐ হারে ক্রমশঃ বাড়তে থাকবে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। আর ইংরেজ জাতি বড়ই দৃঢ়প্রকৃতি ও নিষ্ঠাবান্। অবশ্য আমি চলে গেলে যতটা গাঁথনি হয়েছে, তার অধিকাংশই পড়ে যাবে। কিন্তু তারপর হয়তো কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে, হয়তো কোন দৃঢ়চেতা ব্যক্তি এসে এই কার্যের ভার গ্রহণ করবে—প্রভুই জানেন, কিসে ভাল হবে।
আমেরিকায় বেদান্ত ও যোগ শিক্ষা দেবার জন্য বিশ জন প্রচারকের স্থান হতে পারে; কিন্তু কোথা থেকেই বা প্রচারক পাওয়া যাবে, আর তাদের আনবার জন্য টাকাই বা কোথায়? যদি কয়েকজন দৃঢ়চেতা খাঁটি লোক পাওয়া যায়, তবে দশ বৎসরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক জয় করে ফেলা যেতে পারে। কোথায় এরূপ লোক? আমরা সবাই যে আহম্মকের দল—স্বার্থপর, কাপুরুষ; মুখে স্বদেশপ্রেমের কতকগুলি বাজে বুলি আওরাই, আর ‘আমরা খুব ধার্মিক’ এই অভিমানে ফুলে আছি! মান্দ্রাজীরা অপেক্ষাকৃত চটপটে ও একনিষ্ঠ; কিন্তু হতভাগাগুলো সকলেই বিবাহিত! বিবাহ, বিবাহ, বিবাহ! পাষণ্ডেরা যেন ঐ একটি কর্মেন্দ্রিয় নিয়েই জন্মেছে! … এ আমি বড় শক্ত কথা বললাম; কিন্তু বৎস, আমি চাই এমন লোক—যাদের পেশীসমূহ লৌহের ন্যায় দৃঢ় ও স্নায়ু ইস্পাত নির্মিত, আর তার মধ্যে থাকবে এমন একটি মন, যা বজ্রের উপাদানে গঠিত। বীর্য, মনুষ্যত্ব—ক্ষাত্রবীর্য, ব্র্হ্মতেজ! আমাদের সুন্দর সুন্দর ছেলেগুলি—যাদের উপর সব আশা করা যায়, তাদের সব গুণ, সব শক্তি আছে—কেবল যদি এই রকম লাখ লাখ ছেলেকে বিবাহ নামে কথিত পশুত্বের যূপকাষ্ঠে হত্যা না করা হত! হে প্রভো, আমার কাতর ক্রন্দনে কর্ণপাত কর। মান্দ্রাজ তখনই জাগবে, যখন তার হৃদয়ের শোণিতস্বরূপ অন্ততঃ একশত শিক্ষিত যুবক সংসার থেকে একেবারে স্বতন্ত্র হয়ে কোমর বাঁধবে এবং দেশে সত্যের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হবে। ভারতের বাইরে এক ঘা দিতে পারলে সেই এক ঘা ভারতের ভিতরের লক্ষ আঘাতের তুল্য হয়। যা হোক, যদি প্রভুর ইচ্ছা হয় তবেই হবে।
আমি তোমাদের যে টাকা দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছিলাম, মিস মূলার সেই টাকা দেবেন বলেছিলেন। আমি তাঁকে তোমার নূতন প্রস্তাবের বিষয় বলেছি, তিনি তা ভেবে দেখেছেন। ইতোমধ্যে আমার বিবেচনায় তাঁকে কিছু কাজ দেওয়া ভাল। তিনি ‘ব্রহ্মবাদিন্’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র এজেণ্ট হতে স্বীকৃত হয়েছেন। তুমি তাঁকে ঐ সম্বন্ধে লিখো যেন। তাঁর ঠিকানা—Airlie Lodge, Ridgeway Gardens, Wimbledon, England. গত কয়েক সপ্তাহ তাঁরই বাড়ীতে ছিলাম। কিন্তু আমি লণ্ডনে না থাকলে লণ্ডনের কাজ চলতে পারে না; সুতরাং বাসা বদলেছি। মিস মূলার এতে একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছেন, আমিও দুঃখিত। কিন্তু কি করব! এঁর পুরা নাম—মিস হেনরিয়েটা মূলার। ম্যাক্সমূলার দিন দিন আরও বেশী করে বন্ধুভাবাপন্ন হচ্ছেন। শীঘ্রই আমাকে অক্সফোর্ডে দুটি বক্তৃতা দিতে হবে।
মহীশূরে তামিল লিপিতে সমগ্র ১০৮ উপনিষদ্-সমন্বিত একখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। অধ্যাপক ডয়সনের পুস্তকাগারে সেটি দেখলাম। ও বইয়ের কি কোন দেবনাগরী সংস্করণ আছে? যদি থাকে তো আমায় একখানি পাঠাবে। যদি না থাকে তো তামিল সংস্করণটিই পাঠাবে এবং একখানা কাগজে তামিল অক্ষরগুলি (সংযুক্ত অক্ষরসহ) পাশে পাশে নাগরীতে লিখে পাঠাবে—যাতে আমি তামিল অক্ষর শিখে নিতে পারি।
সেদিন আমার সঙ্গে সত্যনাথন মহাশয়ের সাক্ষাৎ হল লণ্ডনে। তিনি আমাকে তাঁর বেদান্তের উপর একটি বক্তৃতা এবং তাঁর মৃতা সহধর্মিণীকৃত একখানি উপন্যাস উপহার দিলেন। তিনি বললেন, মান্দ্রাজের প্রধান এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পত্র ‘মান্দ্রাজ মেলে’ রাজযোগ-পুস্তকখানির একটি অনুকূল সমালোচনা বেরিয়েছে। আরও শুনলাম, আমেরিকার প্রধান শারীরতত্ত্ববিৎ উক্ত পুস্তকে প্রকাশিত আমার মত ও ধারণাসমূহ পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছেন। এই সময়ে আবার ইংলণ্ডে কতকগুলি ব্যক্তি আমার মতগুলি নিয়ে উপহাস করেছেন। ভাল কথা! আমার আলোচনা অতি নির্ভীক, আর এগুলির বেশীরভাগই লোকের নিকট চিরকাল অর্থহীন থেকে যাবে। কিন্তু ওতে এমন সব বিষয়ের আভাস দেওয়া হয়েছে, শারীরতত্ত্ববিদ্রা আরও আগেই গ্রহণ করলে ভাল করতেন। যা হোক, যেটুকু ফল হয়েছে, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমার ভাব এই—লোকে আমার বিরুদ্ধে বলুক, তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু কিছু বলুক।
অবশ্য ইংলণ্ডের সমালোচকগণ ভদ্র, আমেরিকার সমালোচকদের মত বাজে বকে না। তারপর ইংলণ্ডের যে-সব মিশনরী ওদেশে দেখতে পাও, তাদের মধ্যে প্রায় সকলেই dissenters (প্রতিষ্ঠিত চার্চের বিরোধী)। … এখানকার ভদ্রলোকগণের মধ্যে যাঁরা ধার্মিক, তাঁরা সকলেই ‘চার্চ অব ইংলণ্ডে’র। ইংলণ্ডে ঐ বিরোধীদের অতি অল্পই প্রতিপত্তি, আর তাদের শিক্ষাও নেই। তুমি আমাকে মধ্যে মধ্যে যাদের বিষয়ে সাবধান করে দাও, তাদের কথা আমি এখানে শুনতেই পাই না। তারা এখানে অজ্ঞাত ও অপরিচিত এবং তারা এখানে বাজে বকতে সাহসও পায় না। আশা করি, রামকৃষ্ণ নাইডু এতদিনে মান্দ্রাজে পৌঁছেছেন এবং তোমাদের সর্বাঙ্গীণ কুশল।
হে বীরহৃদয় বালকগণ, অধ্যবসায় কর। আমাদের কার্য সবেমাত্র আরম্ভ হয়েছে। কখনও নিরাশ হয়ো না, কখনও বলো না, ‘আর না, যথেষ্ট হয়েছে।’ আমি একটু সময় পেলেই ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জন্য কয়েকটি গল্প লিখব। অভেদানন্দ মারফৎ মাননীয় সুব্রহ্মণ্য আয়ার দয়া করে যে সমাচার পাঠিয়েছেন, সেজন্য তাঁকে আমার হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাবে।
তোমার চিরপ্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুনঃ—পাশ্চাত্য দেশে যখনই কেউ আসে এবং বিভিন্ন জাতিদের দেখে, তখনই তার চোখ খুলে যায়। কেবল অনর্থক বকে নয়, পরন্তু ভারতে আমাদের কি আছে আর কি নেই, তা তাদের স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়ে—এভাবেই আমি দৃঢ়চেতা কর্মবীরদের যোগাড় করে থাকি। আমার ইচ্ছা হয়, অন্ততঃ দশ লক্ষ হিন্দু সমগ্র জগতে ভ্রমণ করুক। ইতি
বি
পুনঃ—তোমার ও ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জন্য লোহার ব্লক সমেত নক্সা পাঠাব। ইতি
বি
৩০৭*
C/o Miss Muller
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
৭ অক্টোবর, ১৮৯৬
প্রিয় জো,
আবার সেই লণ্ডনে! আর ক্লাসগুলিও যথারীতি শুরু হয়েছে। সংস্কারবশেই আমার মন চারিদিকে সেই চেনা মুখখানি খুঁজে ফিরছিল, যে মুখে কখনও নিরুৎসাহের রেখা পড়ত না, যা কখনও পরিবর্তিত হত না আর যা ছিল সর্বদা সহায়ক, আনন্দময় ও শক্তিপ্রদ। আজ কয়েক সহস্র মাইলের ব্যবধান সত্ত্বেও সেই মুখখানিই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল; অতীন্দ্রিয় রাজ্যে দূরত্ব আবার কি? যাক্, তুমি তো তোমার বিশ্রাম ও শান্তিপূর্ণ ঘরে ফিরে গেছ—আর আমার ভাগ্যে আছে নিত্যবর্ধমান কর্মের তাণ্ডব! তবু তোমার শুভেচ্ছা সর্বদাই আমার সঙ্গে ফিরছে—নয় কি?
কোন নির্জন পর্বতগুহায় গিয়ে চুপ করে থাকাই হচ্ছে আমার স্বাভাবিক প্রবণতা; কিন্তু পেছন থেকে নিয়তি আমাকে সামনে ঠেলে দিচ্ছে, আর আমি এগিয়ে চলেছি! অদৃষ্টের গতি কে রোধ করবে?
যীশুখ্রীষ্ট তাঁর Sermon on the Mount (শৈলোপদেশ)-এ এরূপ কোন উক্তি কেন করেননি—‘যারা সদা আনন্দময় ও সদা আশাবাদী তারাই ধন্য, কারণ স্বর্গরাজ্যলাভ তো তাদের হয়েই আছে?’ আমার বিশ্বাস তিনি নিশ্চয়ই ঐরূপ বলেছিলেন, কিন্তু তা লিপিবদ্ধ হয়নি; তিনি বিশাল বিশ্বের অনন্ত দুঃখ অন্তরে বহন করে বলেছিলেন, সাধুর হৃদয় শিশুর মত। তাঁর সহস্র বাণীর মধ্যে হয়তো একটি বাণী লিপিবদ্ধ হয়েছে, অর্থাৎ মনে করে রাখা হয়েছে।
বর্তমানে ফল বাদাম প্রভৃতিই আমার প্রধান আহার; এবং ওতেই যেন আমি ভাল আছি। যদি কখনও সেই ‘উঁচু দেশে’র পুরাতন চিকিৎসকটির সঙ্গে তোমার দেখা হয়, তবে সেই রহস্যটি তাঁকে বলো। আমার চর্বি অনেকটা কমে গেছে; তবে যেদিন বক্তৃতা থাকে, সেদিন কিছু পেট ভরা খাবার খেতে হয়। হলিস্টার কেমন আছে? তার চেয়ে মধুর প্রকৃতির বালক আমি দেখিনি। তার সারাটি জীবন সর্বপ্রকার মঙ্গলে পূর্ণ হোক!
তোমার বন্ধু কোলা নাকি জরথুষ্ট্রীয় দর্শন সম্বন্ধে বক্তৃতা দিচ্ছেন? অদৃষ্ট নিশ্চয়ই তাঁর খুব অনুকূল নয়। তোমাদের মিস—এবং আমাদের—এর খবর কি? … আর আমাদের মিস (নাম ভুলে গেছি!) কেমন? শুনলাম, সম্প্রতি আধজাহাজ বোঝাই হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান এবং অন্যান্য আরও কত কি সম্প্রদায়ের লোক আমেরিকায় উপস্থিত হয়েছে; আর একদল লোক গিয়ে ভারতবর্ষে জুটেছে, যারা মহাত্মা খুঁজে বেড়ায়, ধর্মপ্রচার করে ইত্যাদি। চমৎকার! ভারতবর্ষ ও আমেরিকা—এই দুটি দেশই যেন ধর্মবিষয়ক উৎসাহ-উদ্দীপনার লীলাভূমি বলে মনে হয়। কিন্তু জো, সাবধান, এই বিধর্মীদের পাপ অতি ভীষণ! আজ পথে মাদাম-এর সহিত সাক্ষাৎ হল। তিনি আর আজকাল আমার বক্তৃতায় আসেন না। সেটা তাঁর পক্ষে ভালই; অত্যধিক দার্শনিক চিন্তা ভাল নয়।
সেই মহিলাটির কথা কি তোমার মনে আছে—যিনি আমার প্রত্যেক বক্তৃতার শেষে এমন সময় এসে উপস্থিত হতেন, যখন কিছুই শুনতে পেতেন না, কিন্তু বক্তৃতা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে আমাকে ধরে রাখতেন এবং বকাতেন যে, ক্ষুধার জ্বালায় আমার পাকস্থলীতে ওয়াটারলুর মহাসমর উপস্থিত হত? তিনি এসেছিলেন, অপর সকলেও আসছে এবং আরও আসবে। এ সবই আনন্দের বিষয়। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রায় সকলেই এসেছিলেন এবং গলস্ওয়ার্দি পরিবারের বিবাহিতা কন্যাদেরও একজন এসেছিলেন। মিসেস গলস্ওয়ার্দি আজ আসতে পারেননি, কারণ যথেষ্ট আগে খবর পাননি। এখন আমরা একটি ‘হল’—বেশ বড় ‘হল’ পেয়েছি; তাতে দু-শ বা তার চেয়েও বেশী লোকের স্থান হতে পারে। একটা বড় কোণ আছে, সেখানে লাইব্রেরী বসান যাবে। সম্প্রতি আমাকে সাহায্য করবার জন্য ভারতবর্ষ থেকে আর একজন এসেছেন।
সুইজরলণ্ড এবং জার্মানী দুটি জায়গায়ই আমার খুব ভাল লেগেছিল। অধ্যাপক ডয়সন খুব সদয় ব্যবহার করেছিলেন। আমরা উভয়েই লণ্ডনে এসে খুব আনন্দ করেছি। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারও বেশ বন্ধুভাবাপন্ন। মোটের উপর ইংলণ্ডের কাজ বেশ পাকা হচ্ছে, এবং খ্যাতনামা পণ্ডিতগণের আনুকূল্য দেখে মনে হয় যে, আমাদের কাজ শ্রদ্ধাও অর্জন করেছে। সম্ভবতঃ এই শীতে কয়েকজন ইংরেজ বন্ধু সহ আমি ভারতবর্ষে যাব। আমার নিজের সম্বন্ধে আজ এই পর্যন্ত।
সেই নৈষ্ঠিক পরিবারটির সংবাদ কি? সব বেশ চমৎকার ভাবেই চলছে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। এতদিনে ফক্সের সংবাদ তুমি পেয়ে থাকবে। যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে শুরু না করলে সে ম্যাবেলকে বিয়ে করতে পারে না, এ-কথা তাকে যাত্রার আগের দিনে বলে ফেলে আমি হয়তো তাকে খুব মন-মরা করে দিয়েছি। ম্যাবেল কি এখন তোমার ওখানে আছে? তাকে আমার স্নেহ জানিও; আমাকে তোমার বর্তমান ঠিকানাও দিও। মা কেমন আছেন? ফ্র্যাঙ্কিন্সেন্স বরাবরের মত ঠিক সেই খাঁটি অমূল্য সোনাটিই আছে নিশ্চয়! এলবার্টা বোধ হয় ঠিক তার নিয়মমত গান-বাজনা, ভাষাশিক্ষা, হাসিঠাট্টা নিয়ে আছে এবং খুব করে আগের মত আপেল খাচ্ছে?
রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে; সুতরাং জো, আজকের মত বিদায় (নিউ ইয়র্কেও কি আদবকায়দা ঠিক ঠিক পালন করা দরকার?)। প্রভু নিরন্তর তোমার কল্যাণ করুন। … আমার চিরস্নেহ ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—সেভিয়ার-দম্পতি তোমাকে তাঁদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। তাঁদের ঘর (ফ্ল্যাট) থেকেই এই চিঠি লিখছি। ইতি
বি
৩০৮*
[মিস ওয়াল্ডোকে লিখিত]
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
৮ অক্টোবর, ১৮৯৬
প্রিয় ওয়াল্ডো,
… সুইজরলণ্ডে আমি বেশ বিশ্রাম লাভ করেছি এবং অধ্যাপক পল ডয়সনের সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্ব হয়েছে। বাস্তবিক, অন্যান্য স্থানের চেয়ে ইওরোপে আমার কাজ বেশী সন্তোষজনক হচ্ছে এবং ভারতবর্ষে এর একটা খুব প্রতিধ্বনি উঠছে। লণ্ডনের ক্লাস আবার আরম্ভ হয়েছে—আজ তার প্রথম বক্তৃতা। এখন আমার নিজের একটা ‘হল’ হয়েছে—তাতে দুইশত বা ততোধিক লোক ধরে। … তুমি অবশ্য জান, ইংরেজরা একটা জিনিষ কেমন কামড়ে ধরে থাকতে পারে, এবং সকল জাতির মধ্যে তারা পরস্পরের প্রতি সবচেয়ে কম ঈর্ষাপরায়ণ—এই কারণেই তারা জগতের উপর প্রভুত্ব করেছে। দাসসুলভ খোশামুদির ভাব একদম না রেখে কিভাবে আজ্ঞানুবর্তী হওয়া যায়—অপরিসীম স্বাধীনতার সঙ্গে কেমন করে কঠোর নিয়ম মেনে চলা যায়—এ রহস্য তারা বুঝেছে।
অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার এখন আমার বন্ধু। আমি লণ্ডনে ছাপমারা হয়ে গেছি। র—নামক যুবকটি সম্বন্ধে আমি খুব কমই জানি। সে বাঙালী এবং অল্পস্বল্প সংস্কৃত পড়াতে পারবে। তুমি আমার দৃঢ় ধারণা তো জান—কামকাঞ্চন যে জয় করতে পারেনি, তাকে আমি বিশ্বাসই করি না। তুমি তাকে তত্ত্বমূলক (theoretical) বিষয় শেখাতে দিয়ে দেখতে পার; কিন্তু সে যেন রাজযোগ শেখাতে না যায়—যারা রীতিমত শিক্ষা না করেছে, তাদের ওটা নিয়ে খেলা করা মহা বিপজ্জনক। সারদানন্দের সম্বন্ধে কোন ভয় নেই—বর্তমান ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী তার উপর আশীর্বাণী বর্ষণ করেছেন। তুমি শিক্ষা দিতে আরম্ভ কর না কেন? … এই র—বালকটির চেয়ে তোমার হাজার গুণ বেশী দর্শনের জ্ঞান আছে। ক্লাসের নোটিস বার কর এবং নিয়মিতভাবে ধর্মবিষয়ক আলোচনা কর ও বক্তৃতা দিতে থাক। এক-শ হিন্দু, এমন কি, আমার একজন গুরুভাই আমেরিকায় খুব সাফল্য লাভ করেছে শুনলে যে আনন্দ হয়, তোমাদের মধ্যে একজন ওতে হাত দিয়েছ দেখলে আমি তার সহস্রগুণ আনন্দলাভ করব। ‘মানুষ দুনিয়া জয় করতে চায়; কিন্তু নিজ সন্তানদের কাছে পরাজয় ইচ্ছা করে।’ জ্বালাও, জ্বালাও—চারিদিকে জ্ঞানাগ্নি জ্বালাও।
আমার আন্তরিক ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩০৯*
[মিসেস বুলকে লিখিত]
উইম্বল্ডন, ইংলণ্ড
৮ অক্টোবর, ১৮৯৬
প্রিয়—,
জার্মানীতে অধ্যাপক ডয়সনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিয়েল-এ (Kiel) তাঁর অতিথি হয়েছিলাম। দু-জনে একসঙ্গে লণ্ডনে এসেছি এবং এখানেও কয়েকবার দেখাশুনা হয়েছে, খুব আনন্দলাভ করেছি। … ধর্ম ও সমাজ-সম্বন্ধীয় বিভিন্ন কাজের প্রতি যদিও আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে, তবু দেখতে পাচ্ছি যে, প্রত্যেকের কাজের বিশেষ বিশেষ বিভাগ থাকা খুব দরকার। আমাদের বিশেষ কাজ—বেদান্তপ্রচার। অন্যান্য কাজে সাহায্যও এই এক আদর্শের অনুকূল হওয়া চাই। আশা করি, আপনি এটা সারদানন্দের মনে বদ্ধমূল করে দেবেন।
আপনি অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠ করেছেন কি? … এখানে ইংলণ্ডে সবই যেন আমাদের অনুকূল হয়ে উঠেছে। কাজ যে শুধু জনপ্রিয় হচ্ছে তা নয়, পরন্তু তার সমাদরও বাড়ছে।
আপনাদের স্নেহাধীন
বিবেকানন্দ
৩১০*
[‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার জন্য লিখিত]১১০
লণ্ডন
২৮ অক্টোবর, ১৮৯৬
চিকাগো মহামেলার অঙ্গস্বরূপ ধর্মমহাসভার স্বীয় বিরাট কল্পনা সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য মিঃ সি. বনি ডাঃ ব্যারোজকে সহকারী নিযুক্ত করায় দক্ষতম ব্যক্তির হস্তেই কার্যভার অর্পিত হয়েছিল; আর ডাঃ ব্যারোজের নেতৃত্বে ঐ মহাসভাগুলির অন্যতম ধর্মমহাসভা কিরূপ বিশিষ্ট স্থান লাভ করেছিল, তা আজ ইতিহাসের বিষয়।
ডাঃ ব্যারোজের অদ্ভুত সাহস, অক্লান্ত পরিশ্রম, অবিচল সহনশীলতা ও ঐকান্তিক ভদ্রতাই এই মহাসভাকে অপূর্ব সাফল্যে মণ্ডিত করেছিল।
বিস্ময়কর চিকাগো মহাসভাকে অবলম্বন করেই ভারত, ভারতবাসী ও ভারতীয় চিন্তা জগৎসমক্ষে আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বলভাবে প্রকটিত হয়েছে এবং আমাদের জাতীয় যা কিছু কল্যাণ হয়েছে, তার জন্য সেই সভার অন্যান্য সকলের তুলনায় ডাঃ ব্যারোজের কাছেই আমরা বেশী ঋণী।
তা ছাড়া, তিনি আমাদের কাছে ধর্মের পবিত্র নাম, মানবজাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আচার্যের নাম নিয়ে আসছেন এবং আমার বিশ্বাস—ন্যাজারেথের মহাপুরুষের প্রচারিত ধর্মের সম্বন্ধে তাঁর ব্যাখ্যা অতিশয় উদার হবে এবং আমাদের মনকে উন্নত করবে। ঈশার শক্তির যে পরিচয় ইনি ভারতকে দিতে চান, তা পরমত-অসহিষ্ণু প্রভুভাবাপন্ন ও অপরের প্রতি ঘৃণাপূর্ণ মনোবৃত্তিপ্রসূত নয়। পরন্তু ভ্রাতৃরূপে—ভারতে উন্নতিকামী বিভিন্ন দলের সহকর্মী ভ্রাতৃবর্গের অন্যতমরূপে গণ্য হবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি যাচ্ছেন। সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কৃতজ্ঞতা ও আতিথেয়তাই ভারতীয় জীবনের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য; তাই আমার দেশবাসীর কাছে এই বিনীত অনুরোধ—পৃথিবীর অপর দিক্ থেকে আগত এই বিদেশী ভদ্রলোকের প্রতি তাঁরা এমন আচরণ করুন, যেন তিনি দেখতে পান যে, এই দুঃখ দারিদ্র্য ও অধঃপতনের ভেতরেও আমাদের হৃদয় সেই অতীতেরই ন্যায় বন্ধুত্বপূর্ণ আছে, যখন ভারত আর্যভূমি বলে পরিচিত ছিল এবং যখন তার ঐশ্বর্যের কথা জগতের সব জাতের মুখে মুখে ফিরত।
৩১১*
C/o E. T. Sturdy
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
২৮ অক্টোবর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি তোমার ‘ভক্তিযোগ’ ও ‘সর্বজনীন ধর্ম’ পেয়েছি। আমেরিকায় ‘ভক্তিযোগে’র নিশ্চয়ই খুব কাটতি হবে। কিন্তু ইংলণ্ডে স্টার্ডির সংস্করণ আগেই বেরিয়ে যাওয়ায় তোমার বিক্রীর রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে বলে ভয় হয়।
আমি ‘ব্রহ্মবাদিন্’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ সম্বন্ধে তোমায় পূর্বেই সবিশেষ লিখেছি। ‘প্রবুদ্ধ ভারতে’র জন্য একটি গল্প আরম্ভ করেছি; শেষ হলেই তোমায় পাঠিয়ে দেব।
কোন্ মাসে ভারতে পৌঁছব, তার এখনও ঠিক নেই। পরে এ সম্বন্ধে লিখব। গতকাল এক বন্ধুভাবাপন্ন সমিতির সভায় নূতন স্বামী১১১ তাঁর প্রথম বক্তৃতা দিলেন। বেশ হয়েছিল এবং আমার ভাল লেগেছিল। তাঁর ভেতর ভাল বক্তা হবার শক্তি রয়েছে—এ বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত।
‘ভক্তিযোগ’টা ‘সর্বজনীন ধর্ম’-এর মত তেমন সুন্দরভাবে ছাপান হয়নি। মলাটে বোর্ড দিলে বইখানি দেখতে বেশ মোটা হত; আর ক্রেতাদের খুশী করবার জন্য অক্ষরগুলি মোটা করা যেত।
ভাল কথা, আমার ‘কর্মোযোগ’খানি যে প্রকাশ করনি, এটা একটা লজ্জার কথা—অথচ আমার পরামর্শ না নিয়ে বইখানির এক অধ্যায় ছেপে নিয়ে আমায় বেকায়দায় ফেলেছ। আরও দেখ, ভারতে বেশী কাটতির জন্য বইগুলি সস্তা হওয়া দরকার। ইচ্ছা করলে তুমি ‘রাজযোগ’খানি ছাপতে পার, আমি ইচ্ছা করেই ওখানার কপিরাইট নিইনি। যখনই ইচ্ছা হবে, তখনই ওর একটা সস্তা সংস্করণ বের করতে পার কিন্তু আমরা হিন্দুরা এত ঢিমে-তেতালা যে, আমাদের কাজ শেষ হতে না হতেই সুযোগ চলে যায়, আর তাতে আমাদের লোকসানই হয়। ছাপার কাজ ইত্যাদিতে তোমাকে চটপটে হতে হবে। তোমার ‘ভক্তিযোগ’ বেরুল বছরখানেক কথা চালানর পরে। তুমি কি বলতে চাও যে, পাশ্চাত্যবাসীরা মহাপ্রলয় পর্যন্ত ওটার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে? এই গড়িমসির ফলে তোমার ঐ বই-এর কাটতি আমেরিকা ও ইংলণ্ডে তিন-চতুর্থাংশ কমে গেছে। তাহলে তো তুমি ‘কর্মযোগ’ ছাপছ না দেখছি; অথচ তোমার ঘাড়ে কি ভূত চেপেছিল যে, তুমি একটা বক্তৃতা ছেপে বসে আছ? ঐ হরমোহন একটা মূর্খ; বই-ছাপান বিষয়ে সে তোমাদের— মান্দ্রাজীদের চেয়েও ঢিলে, আর তার ছাপা একেবারে বীভৎস। বইগুলো ঐভাবে প্রকাশ করার মানে কি? দুঃখের বিষয়, সে গরীব। আমার টাকা থাকলে তাকে দিতাম; কিন্তু ওভাবে ছাপান তো লোক ঠকান—এ রকম করা উচিত নয়।
খুব সম্ভব মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার আর মিস মূলার ও মিঃ গুডউইনকে সঙ্গে নিয়ে আমি ভারতে ফিরব। মিস মূলারকে তো তুমি জানই; সম্ভবতঃ ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার অন্ততঃ কিছুদিন আলমোড়ায় বাস করবার জন্য যাচ্ছেন; আর গুডউইন সন্ন্যাসী হবে। সে অবশ্য আমার সঙ্গেই ভ্রমণ করবে। আমাদের সব বই-এর জন্য আমরা তার কাছে ঋণী। আমার বক্তৃতাগুলি সে সাঙ্কেতিক প্রণালীতে লিখে রেখেছিল, তাই থেকে বই হয়েছে। কিছুমাত্র প্রস্তুতি ছাড়াই মু্হূর্তের প্রেরণায় এ-সকল বক্তৃতা দেওয়া হয়েছিল। অপরেরা হোটেলে বাস করতে চলে যাবে; কিন্তু গুডউইন আমার সঙ্গে থাকবে। তোমার কি মনে হয়, দেশের লোকেরা এ বিষয়ে বড় বেশী আপত্তি করবে? সে খাঁটি নিরামিষাশী।
তুমি ইচ্ছা করলে আমার ‘জ্ঞানযোগে’র বক্তৃতাগুলি ছাপাতে পার। তবে একটু ভাল করে দেখে দিও। ভাল করে দেখে ছাপান উচিত। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুনঃ—এখানকার সকলে ভালবাসা জানাচ্ছে। ডাক্তার ব্যারোজ সম্বন্ধে ও তাঁকে কি ভাবে অভ্যর্থনা করা উচিত—এই বিষয়ে একটি ছোট লেখা আমি আজ ‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ পাঠিয়েছি। তুমিও তাকে স্বাগত জানিয়ে ‘ব্রহ্মবাদিনে’ দু-চারটি মিষ্টি কথা লিখো। ইতি
—বি
৩১২*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্স্
ওয়েষ্টমিনষ্টার, লণ্ডন
১ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় মেরী,
‘সোনা, রূপা—এ সব কিছু আমার নেই; তবে যা আমার আছে, তা মুক্তহস্তে তোমায় দিচ্ছি’—সেটি এই জ্ঞান যে, স্বর্ণের স্বর্ণত্ব, রৌপ্যের রৌপত্ব, পুরুষের পুরুষত্ব, নারীর নারীত্ব—এক কথায়, প্রত্যেক বস্তুর যথার্থ স্বরূপ—ব্রহ্ম। এই ব্রহ্মকেই আমরা অনাদিকাল থেকে বহির্জগতে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছি; আর এই চেষ্টার ফলে আমাদের মন থেকে এই সকল অদ্ভুত সৃষ্টি বের হয়ে আসছে, যথা—পুরুষ, নারী, শিশু, দেহ, মন, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, জগৎ, ভালবাসা, ঘৃণা, ধন, সম্পত্তি, আর ভূত, প্রেত, গন্ধর্ব, কিন্নর, দেবতা, ঈশ্বর ইত্যাদি।
আসল কথা—এই ব্রহ্ম আমাদের ভেতরেই রয়েছেন এবং আমরাই তিনি (সোঽহং), সেই শাশ্বত দ্রষ্টা, সেই যথার্থ ‘অহম্’, যিনি কখনই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন এবং যাঁকে অন্যান্য জিনিষের মত ইন্দ্রিয়গোচর করার চেষ্টা—সময় ও ধীশক্তির অপব্যবহার মাত্র।
যখন জীবাত্মা এ-কথা বুঝতে পারে, তখনই সে এই জগৎ-কল্পনা থেকে নিবৃত্ত হয়, এবং ক্রমশই বেশী করে নিজের অন্তরাত্মার উপর প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এরই নাম ক্রমবিকাশ—এতে যেমন শারীরবিবর্তন ক্রমশঃ কমে আসতে থাকে, তেমনই অপরদিকে মন উচ্চ থেকে উচ্চতর সোপানে উঠতে থাকে; মানুষই পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিকাশ। ‘মনুষ্য’ কথাটি সংস্কৃত ‘মন্’ ধাতু থেকে সিদ্ধ—সুতরাং ওর অর্থ মননশীল অর্থাৎ চিন্তাশীল প্রাণী—কেবল ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়গ্রহণশীল প্রাণী নয়। ধর্মতত্ত্বে এই ক্রমবিকাশকেই ‘ত্যাগ’ বলা হয়েছে। সমাজ-গঠন, বিবাহ প্রথার প্রবর্তন, সন্তানের প্রতি ভালবাসা, সৎকার্য, সংযম এবং নীতি—এগুলি ত্যাগেরই বিভিন্ন রূপ। প্রত্যেক সমাজে জীবন বলতে বুঝায় ইচ্ছা তৃষ্ণা বা বাসনাসমূহের সংযম। জগতে যত সমাজ ও সামাজিক প্রথা দেখা যায়, সে-সব একটি ব্যাপারেরই বিভিন্ন ধারা এবং স্তরমাত্র; সেটি এই—ইচ্ছার বা কল্পিত ‘আমি’র বিসর্জন, এই যে নিজের ভিতর থেকে যেন বাইরে লাফিয়ে যাবার ভাব রয়েছে, জ্ঞাতা (Subject)-কে যে জ্ঞেয় (Object)-রূপে পরিণত করবার একটা চেষ্টা রয়েছে, সেটিরও বিসর্জন। প্রেম এই আত্মসমর্পণ বা ইচ্ছাশক্তি রোধের সর্বাপেক্ষা সহজ এবং অনায়াস-সাধ্য পথ; ঘৃণা তার বিপরীত।
জনসাধারণকে নানারূপ স্বর্গ, নরক ও আকাশের ঊর্ধ্বলোক-নিবাসী শাসনকর্তার গল্প বা কুসংস্কার দ্বারা ভুলিয়ে এই একমাত্র লক্ষ্য আত্মসমর্পণের পথে পরিচালিত করা হয়েছে। কিন্তু জ্ঞানীরা কুসংস্কারের বশবর্তী না হয়ে বাসনা-বর্জনের দ্বারা জ্ঞাতসারেই এই পন্থার অনুবর্তন করেন।
অতএব দেখা যাচ্ছে বাস্তব (Objective) স্বর্গ বা ‘সুখের সহস্র বর্ষে’র (millennium) অস্তিত্ব কেবল কল্পনাতেই রয়েছে; কিন্তু অধ্যাত্ম-স্বর্গ আমাদের হৃদয়ে এখনই বিদ্যমান। কস্তুরীমৃগ (নাভিস্থ) কস্তুরীর গন্ধের কারণ অনুসন্ধানের জন্য অনেক বৃথা ছুটাছুটির পর অবশেষে আপন শরীরেই তার অস্তিত্ব জানতে পারবে।
বাস্তব জগৎ—সর্বদাই ভালমন্দের মিশ্রণরূপে বিদ্যমান থাকবে; আর মৃত্যুরূপ ছায়াও চিরদিন এই পার্থিব জীবনের অনুসরণ করবে; আর জীবন যতই দীর্ঘ হবে, এই ছায়াও ততই দীর্ঘ হবে। সূর্য যখন ঠিক আমাদের মাথার উপর থাকে, কেবল তখনই আমাদের ছায়া পড়ে না—তেমনি যখন ঈশ্বর এবং শুভ ও অন্যান্য সবকিছুই আমাতেই রয়েছে—এই বোধ হয়, তখন আর অমঙ্গল থাকে না। বাস্তবজগতে প্রত্যেক ঢিলটির সঙ্গে পাটকেলটি খেতে হয়—প্রত্যেক ভালটির সঙ্গে মন্দটিও ছায়ার মত আছে। প্রত্যেক উন্নতির সঙ্গে ঠিক সমপরিমাণ অবনতিও সংযুক্ত হয়ে রয়েছে। তার কারণ এই যে, ভাল-মন্দ পৃথক্ বস্তু নয়, আসলে এক; পরস্পরের মধ্যে প্রকারগত কোন প্রভেদ নেই, প্রভেদ কেবল পরিমাণগত।
আমাদের জীবন নির্ভর করে অপর উদ্ভিদ প্রাণী বা জীবাণুর মৃত্যুর উপর। আর একটি ভুল আমরা প্রতিনিয়তই করে থাকি—তা এই যে, ভাল জিনিষটাকে আমরা ক্রমবর্ধমান বলে মনে করি, কিন্তু মন্দ জিনিষটার পরিমাণ নির্দিষ্ট বলে ভাবি। তা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত করি যে, প্রত্যহ কিছু কিছু মন্দের ক্ষয় হয়ে এমন এক সময় আসবে, যখন কেবল ভালটিই অবশিষ্ট থাকবে। কিন্তু এই অপসিদ্ধান্তটি একটি মিথ্যা যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
জগতে যদি ভালটি বেড়েই চলেছে, তাহলে মন্দটিও বাড়ছে। আমার স্বজাতীয় জনসাধারণের বাসনার চেয়ে আমার নিজের বাসনা অনেক বেড়ে গেছে। তাদের চেয়ে আমার আনন্দ অনেক বেশী—কিন্তু আমার দুঃখও লক্ষগুণ তীব্র হয়ে গেছে। যে শরীরের সাহায্যে তুমি ভালর সামান্যমাত্র সংস্পর্শ অনুভব করতে পারছ, তাই আবার তোমাকে মন্দের অতি সামান্য অংশটুকু অনুভব করাচ্ছে। একই স্নায়ুমণ্ডলী সুখদুঃখ দু-রকম অনুভূতিই বহন করে এবং একই মন উভয়কে অনুভব করে। জগতের উন্নতি বলতে যেমন বেশী সুখভোগ বুঝায়, তেমনি বেশী দুঃখভোগও বুঝায়। এই যে জীবন-মৃত্যু, ভাল-মন্দ, জ্ঞান-অজ্ঞানের সংমিশ্রণ, এই-ই মায়া বা প্রকৃতি। অনন্তকাল ধরে তুমি জগজ্জালের ভেতর সুখের অন্বেষণ করে বেড়াতে পার—তাতে সুখ পাবে অনেক, দুঃখও পাবে অনেক। শুধু ভালটি পাব, মন্দটি পাব না—এ আশা বালসুলভ মূঢ়তা মাত্র।
দুটি পথ খোলা রয়েছে। একটি—(জগতের উন্নতির) সমস্ত আশাভরসা ত্যাগ করে এ জগৎ যেমন চলছে সেভাবেই একে গ্রহণ করা, অর্থাৎ মধ্যে মধ্যে একটু আধটু সুখের আশায় জগতের সমস্ত দুঃখকষ্ট সহ্য করে যাওয়া; অপরটি—সুখকে দুঃখেরই অপর মূর্তি জ্ঞানে একেবারে তার অন্বেষণ পরিহার করে সত্যের অনুসন্ধান করা। যারা এভাবে সত্যের অনুসন্ধান করতে সাহসী, তারা সেই সত্যকে সদা বিদ্যমান এবং নিজের ভেতরেই অবস্থিত বলে দেখতে সমর্থ হয়। তখনই আমরা এও বুঝতে পারি যে, সেই একই সত্য কিভাবে আমাদের বিদ্যা ও অবিদ্যারূপ—এই দুই আপেক্ষিক জ্ঞানের ভেতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। আমরা এও বুঝি যে, সেই সত্য আনন্দস্বরূপ এবং তা ভালমন্দ দুইরূপে জগতে প্রকাশিত; আর তার সঙ্গে সেই যথার্থ সত্তাকেও জানি, যা জগতে জীবন ও মৃত্যু উভয়রূপেই আত্মপ্রকাশ করছে।
এইভাবে আমরা অনুভব করব যে, জগতের বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরা একটি অদ্বিতীয় সৎ-চিৎ-আনন্দ সত্তার দুই বা বহু ভাগে বিভক্ত প্রতিচ্ছায়া মাত্র—সেটি আমার এবং অন্যান্য যাবতীয় পদার্থের যথার্থ স্বরূপ। কেবল তখনই মাত্র মন্দ না করেও ভাল করা সম্ভবপর; কারণ, এইরূপ আত্মা জানতে পেরেছেন, ভালমন্দ—কি উপাদানে গঠিত; সুতরাং ওটি তখন তার আয়ত্তাধীন। এই মুক্ত আত্মা তখন ভালমন্দ যা খুশী তাই বিকাশ করতে পারেন; তবে আমরা জানি যে ইনি তখন কেবল ভালই করেন। এর নাম ‘জীবন্মুক্তি’ অর্থাৎ শরীর রয়েছে, অথচ মুক্ত—এটিই বেদান্ত এবং অপর সমস্ত দর্শনের একমাত্র লক্ষ্য। ইতি
মানবসমাজ ক্রমান্বয়ে চারটি বর্ণ দ্বারা শাসিত হয়—পুরোহিত (ব্রাহ্মণ), সৈনিক (ক্ষত্রিয়), ব্যবসায়ী (বৈশ্য) এবং মজুর (শূদ্র)। প্রত্যেকটির শাসনকালে রাষ্ট্রে (State) দোষগুণ উভয়ই বর্তমান। পুরোহিত-শাসনে বংশজাত ভিত্তিতে ঘোর সংকীর্ণতা রাজত্ব করে—তাঁদের ও তাঁদের বংশধরগণের অধিকার রক্ষার জন্য চারিদিকে বেড়া দেওয়া থাকে—তাঁরা ছাড়া বিদ্যা শিখবার অধিকার কারও নেই, বিদ্যাদানেরও অধিকার কারও নাই। এ যুগের মাহাত্ম্য এই যে, এ সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপিত হয়—কারণ বুদ্ধিবলে অপরকে শাসন করতে হয় বলে পুরোহিতগণ মনের উৎকর্ষ সাধন করে থাকেন।
ক্ষত্রিয়-শাসন বড়ই নিষ্ঠুর ও অত্যাচারপূর্ণ, কিন্তু ক্ষত্রিয়রা এত অনুদার নন। এ যুগে শিল্পের ও সামাজিক কৃষ্টির (culture) চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়ে থাকে।
তারপর বৈশ্যশাসন-যুগ। এর ভেতরে শরীর-নিষ্পেষণ ও রক্ত-শোষণকারী ক্ষমতা, অথচ বাইরে প্রশান্ত ভাব—বড়ই ভয়াবহ! এ যুগের সুবিধা এই যে, বৈশ্যকুলের সর্বত্র গমনাগমনের ফলে পূর্বোক্ত দুই যুগের পুঞ্জীভূত ভাবরাশি চতুর্দিকে বিস্তৃতি লাভ করে। ক্ষত্রিয়যুগ অপেক্ষা বৈশ্যযুগ আরও উদার, কিন্তু এই সময় সভ্যতার অবনতি আরম্ভ হয়।
সর্বশেষে শূদ্রশাসন-যুগের আবির্ভাব হবে—এ যুগের সুবিধা হবে এই যে, এ সময় শারীরিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের বিস্তার হবে, কিন্তু অসুবিধা এই যে, হয়তো সংস্কৃতির অবনতি ঘটবে। সাধারণ শিক্ষার পরিসর খুব বাড়বে বটে, কিন্তু সমাজে অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশই কমে যাবে।
যদি এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারা যায়, যাতে ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ-শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ—এই সবগুলি ঠিক ঠিক বজায় থাকবে অথচ এদের দোষগুলি থাকবে না, তাহলে তা একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। কিন্তু এ কি সম্ভব?
প্রত্যুত প্রথম তিনটির পালা শেষ হয়েছে—এবার শেষটির সময়। শূদ্রযুগ আসবেই আসবে—এ কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না। সোনা অথবা রুপো—কোন্টির ভিত্তিতে দেশের মূদ্রা প্রচলিত হলে কি কি অসুবিধা ঘটে, তা আমি বিশেষ জানি না—(আর বড় একটা কেউ জানেন বলে মনে হয় না)। কিন্তু এটুকু আমি বেশ বুঝতে পারি যে, সোনার ভিত্তিতে সকল মূল্য ধার্য করার ফলে গরীবরা আরও গরীব এবং ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। ব্রায়ান যথার্থই বলেছেন, ‘আমরা এই সোনার ক্রুশে বিদ্ধ হতে নারাজ। রূপার দরে সব দর ধার্য হলে গরীবরা এই অসমান জীবনসংগ্রামে অনেকটা সুবিধা পাবে। আমি যে একজন সমাজতন্ত্রী (socialist),১১২ তার কারণ এ নয় যে, আমি ঐ মত সম্পূর্ণ নির্ভুল বলে মনে করি, কেবল ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’—এই হিসাবে।
অপর কয়টি প্রথাই জগতে চলেছে, পরিশেষে সেগুলির ত্রুটি ধরা পড়েছে। অন্ততঃ আর কিছুর জন্য না হলেও অভিনবত্বের দিক্ থেকে এটিরও একবার পরীক্ষা করা যাক। একই লোক চিরকাল সুখ বা দুঃখ ভোগ করবে, তার চেয়ে সুখদুঃখটা যাতে পর্যায়ক্রমে সকলের মধ্যে বিভক্ত হতে পারে, সেইটাই ভাল। জগতের ভালমন্দের সমষ্টি চিরকালই সমান থাকবে, তবে নূতন নূতন প্রণালীতে এই জোয়ালটি (yoke) এক কাঁধ থেকে তুলে আর এক কাঁধে স্থাপিত হবে, এই পর্যন্ত।
এই দুঃখময় জগতে সব হতভাগ্যকেই এক-একদিন আরাম করে নিতে দাও—তবেই তারা কালে এই তথাকথিত সুখভোগটুকুর পর এই অসার জগৎ-প্রপঞ্চ, শাসনতন্ত্রাদি ও অন্যান্য বিরক্তিকর বিষয়সকল পরিহার করে ব্রহ্মস্বরূপে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে। তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের চিরবিশ্বস্ত ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
৩১৩*
১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্স্ ওয়েষ্টমিনষ্টার
১১ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
খুব সম্ভব আমি ১৬ ডিসেম্বর রওনা হব; দু-এক দিন দেরীও হতে পারে। এখান থেকে ইতালী যাব এবং সেখানে কয়েকটি জায়গা দেখে নেপল্সে জাহাজ ধরব। মিস মূলার, মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার এবং গুডউইন নামে একজন যুবক আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। সেভিয়ার দম্পতি আলমোড়াতে বসবাস করতে যাচ্ছেন, মিস মূলারও তাই। মিঃ সেভিয়ার ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে পাঁচ বৎসর অফিসার ছিলেন; সুতরাং তিনি ভারত সম্বন্ধে অনেকটা পরিচিত। মিস মূলার থিওসফিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং অক্ষয়কে পুত্ররূপে গ্রহণ করেছিলেন। গুডউইন একজন ইংরেজ যুবক; এরই সাঙ্কেতিক লেখা থেকে আমার পুস্তিকাগুলি বের করা সম্ভব হয়েছে।
কলম্বো থেকে আমি প্রথমে মান্দ্রাজে পৌঁছব। অন্য সকলে স্বতন্ত্রভাবে আলমোড়া চলে যাবেন। মান্দ্রাজ থেকে আমি সোজা কলিকাতা যাব। যাত্রারম্ভে আমি তোমাকে সঠিক সংবাদ দেব। ইতি
তোমাদের স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুনশ্চঃ—‘রাজযোগে’র প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হচ্ছে। ভারত ও আমেরিকাতেই সব চেয়ে বেশী কাটতি।
৩১৪*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
গ্রেকোট গার্ডেন্স্ ওয়েষ্টমিনষ্টার
১৩ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় বুল,
… আমি অতি শীঘ্রই, খুব সম্ভব ১৬ ডিসেম্বর, ভারতবর্ষ যাত্রা করছি। পুনরায় আমেরিকা যাবার পূর্বে আমার একবার ভারতবর্ষ দেখবার বিশেষ ইচ্ছা আছে, এবং আমি কয়েকজন ইংরেজ বন্ধুকে আমার সঙ্গে ভারতবর্ষে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি; তাই একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও আমেরিকা হয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
… আমি অতি শীঘ্রই, খুব সম্ভব ১৬ ডিসেম্বর, ভারতবর্ষ যাত্রা করছি। পুনরায় আমেরিকা যাবার পূর্বে আমার একবার ভারতবর্ষ দেখবার বিশেষ ইচ্ছা আছে, এবং আমি কয়েকজন ইংরেজ বন্ধুকে আমার সঙ্গে ভারতবর্ষে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি; তাই একান্ত ইচ্ছা সত্ত্বেও আমেরিকা হয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
৩১৫*
[মিঃ গুডউইনকে লিখিত]
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
২০ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আগামী ১৬ ডিসেম্বর আমি ইংলণ্ড থেকে যাত্রা করছি। ইতালীতে কয়েকটি জায়গা দেখে নেপল্সে জার্মান লয়েড লাইনের 'S. S. Prinz Regent Leopold' নামক জাহাজ ধরব। আগামী ১৪ জানুআরী ষ্টীমার কলম্বো গিয়ে লাগবার কথা। সিংহলে অল্পস্বল্প দেখবার ইচ্ছা আছে, তারপর মান্দ্রাজ যাব।
আমার সঙ্গে যাচ্ছেন আমার ইংরেজ বন্ধু সেভিয়ার দম্পতি ও গুডউইন। মিঃ সেভিয়ার ও তাঁর সহধর্মিণী হিমালয়ে আলমোড়ার কাছে আশ্রয় স্থাপন করতে যাচ্ছেন। ঐ হবে আমার হিমালয়ের কেন্দ্র, আর পাশ্চাত্য শিষ্যেরা সেখানে এসে ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীরূপে বাস করতে পারবে। গুডউইন একজন অবিবাহিত যুবক, সে আমার সঙ্গে থাকবে এবং ভ্রমণ করবে। সে ঠিক সন্ন্যাসীরই মত।
শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবের সময় আমার কলিকাতায় থাকার ভারি ইচ্ছা। সুতরাং খবর নিয়ে উৎসবের তারিখটি জেনে রেখো, যাতে আমায় মান্দ্রাজে বলতে পার।কলিকাতা আর মান্দ্রাজে দুটি কেন্দ্র খুলব—এই হচ্ছে আমার বর্তমান পরিকল্পনা; সেখানে যুবক প্রচারক তৈরী করা হবে। কলিকাতায় কেন্দ্র খোলবার মত অর্থ আমার হাতে আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ আজীবন সেখানেই কাজ করে গেছেন, সুতরাং কলিকাতার উপরেই আমাকে প্রথম নজর দিতে হবে। মান্দ্রাজে কেন্দ্র খোলবার মত টাকাপয়সা, আশা করি ভারতবর্ষ থেকেই উঠবে।
এই তিনটি কেন্দ্র নিয়েই এখন আমরা কাজ আরম্ভ করব; পরে বোম্বাই ও এলাহাবাদে যাব। প্রভুর ইচ্ছা হলে এ-সকল কেন্দ্র হতে আমরা যে শুধু ভারতকেই আক্রমণ করব তা নয়, আমরা পৃথিবীর সমস্ত দেশেই দলে দলে প্রচারক পাঠাব। প্রাণ দিয়ে কাজ করে যাব। মনে রেখো, আমাদিগকে এক সময় একটিমাত্র কাজ নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। কিছুদিনের জন্য ৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট আমার প্রধান ঠিকানা, কারণ ওখান থেকেই কাজ চালান হবে। স্টার্ডি প্রকাণ্ড এক বাক্স ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকা পেয়েছে। আমি আগে জানতাম না, সে এখন ঐ জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করছে।
এখন তো আমাদের ইংরেজী পত্রিকাখানি দাঁড়িয়ে গেছে; অতঃপর ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় কয়েকখানি আরম্ভ করতে পারি। উইম্বল্ডনের মিস নোব্ল্ একজন ভাল কর্মী। তিনিও মান্দ্রাজের দুইটি পত্রিকার জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করতে চেষ্টা করবেন। তিনি তোমায় পত্র লিখবেন। এই সব কাজ ধীরে ধীরে, কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে গড়ে উঠবে। অল্পসংখ্যক অনুগামীরাই এই-জাতীয় কাগজের পৃষ্ঠপোষক হয়। এখন কথা এই—এরূপ আশা করা চলে না যে, তারা একসঙ্গে অত্যধিক কাজের ভার নেবে। ইংলণ্ডের কাজের জন্য তাদের অর্থ সংগ্রহ করতে হবে, বই কিনতে হবে, এখানকার পত্রিকার জন্য গ্রাহক যোগাড় করতে হবে এবং সর্বশেষে ভারতের পত্রিকার চাঁদা দিতে হবে! এতটা করা চলে না। এরূপ করলে তা ধর্মপ্রচার না হয়ে বরং ব্যবসার মতই দেখাবে। সুতরাং তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমার মনে হয়, এখানে জনকয়েক গ্রাহক পাওয়া যাবে। ভারতের লোকেরাই ভারতের কাগজগুলির পৃষ্ঠপোষক হবে। সব জাতির নিকট সমানভাবে গ্রহণীয় কোন কাগজ প্রকাশ করতে হলে সব জাতিরই লেখক সংগ্রহ করতে হবে; আর তার মানে হচ্ছে—বছরে অন্ততঃ লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে। তা ছাড়া আমার অনুপস্থিতিতে এখানকার লোকদের কাজ থাকা চাই; তা না হলে সব ভেঙেচুরে যাবে। অতএব এখানে একখানি পত্রিকা চাই; ক্রমে আমেরিকাতেও চাই।
এ-কথা ভুলে যেও না যে, সব দেশের লোকের প্রতিই আমার টান রয়েছে, শুধু ভারতের প্রতি নয়। আমার শরীর ভাল আছে, অভেদানন্দেরও তাই। তোমরা সকলে আমার আন্তরিক ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩০৬*
[শ্রীযুক্ত লালা বদ্রী শাহকে লিখিত]
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
২১ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় লালাজী,
৭ জানুআরী নাগাদ আমি মান্দ্রাজে পৌঁছব; কয়েক দিন সমতলে থেকে আমার আলমোড়া যাবার ইচ্ছা।
আমার সঙ্গে তিনজন ইংরেজ বন্ধু আছেন; তাঁদের মধ্যে দুজন—সেভিয়ার-দম্পতি—আলমোড়ায় বসবাস করবেন। আপনি হয়তো জানেন, তাঁরা আমার শিষ্য এবং আমার জন্য হিমালয়ে আশ্রম তৈরী করবেন। এই কারণেই একটি উপযুক্ত স্থানের সন্ধান করতে আপনাকে বলেছিলাম। একটি সমগ্র পাহাড় আমাদের নিজেদের জন্য চাই, যেখান থেকে হিমালয়ের তুষারশ্রেণী দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে আশ্রম প্রস্তুত করতে সময় লাগবে। ইতোমধ্যে অনুগ্রহপূর্বক আমার বন্ধুদের জন্য একটি বাড়ী ভাড়া করবেন। বাংলোটিতে তিনজনের স্থান-সঙ্কুলান হওয়া চাই। বড় বাড়ীর কোন প্রয়োজন নেই, আপাততঃ একটি ছোট বাড়ী হলেই চলবে। আমার বন্ধুগণ সেই বাড়ীতে থেকে আশ্রমের জন্য উপযুক্ত স্থান ও বাড়ীর অন্বেষণ করবেন।
এই চিঠির উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। কারণ উত্তর আমার হাতে আসার পূর্বেই আমি ভারতবর্ষের পথে যাত্রা করব। মান্দ্রাজে পৌঁছেই আপনাকে তার করে জানাব।
আপনারা সকলে আমার ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানবেন। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
৩১৭*
[মিস মেরী ও মিস হ্যারিয়েট হেলকে লিখিত]
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৭ ২৮ নভেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় ভগিনীগণ,
আমার মনে হয়, যে-কোন কারণেই হোক, তোমাদের চারজনকেই আমি সবচেয়ে বেশী ভালবাসি এবং আমি সগর্বে বিশ্বাস করি যে, তোমরা চারজনও আমাকে সেই রকম ভালবাস। এইজন্য ভারতবর্ষে যাবার আগে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তোমাদের কয়েক ছত্র লিখছি। লণ্ডনের প্রচারকার্যে খুব সাফল্য হয়েছে। ইংরেজরা আমেরিকানদের মত অত বুদ্ধিমান নয়; কিন্তু একবার যদি কেউ তাদের হৃদয় অধিকার করতে পারে, তাহলে তারা চিরকালের জন্য তার গোলাম হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে আমি তাদের হৃদয় অধিকার করেছি। আশ্চর্যের বিষয়, এই ছ-মাসের কাজেই জনসভায় বক্তৃতার কথা ছেড়ে দিলেও আমার ক্লাসে বরাবর ১২০ জন উপস্থিত হচ্ছে। ইংরেজ কাজের লোক, সুতরাং এখানকার প্রত্যেকেই কাজে কিছু করতে চায়। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং মিঃ গুডউইন কাজ করবার জন্য আমার সঙ্গে ভারতে যাচ্ছেন এবং এই কাজে তাঁরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করবেন। এখানে আরও বহুলোক ঐরূপ করতে প্রস্তুত। সম্ভ্রান্ত বংশের স্ত্রীপুরুষদের মাথায় একবার একটা ভাব ঢুকিয়ে দিতে পারলে, সেটা কার্যে পরিণত করবার জন্য তাঁরা যথাসর্বস্ব ত্যাগ করতেও বদ্ধপরিকর। আনন্দের সংবাদ এই (আর এটা বড় কম কথা নয়) যে, ভারতের কাজ আরম্ভ করবার জন্য অর্থ-সাহায্য পাওয়া গেছে এবং পরে আরও পাওয়া যাবে। ইংরেজ জাতি সম্বন্ধে আমার যে ধারণা ছিল, তার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমি বুঝতে পারছি, অন্য সব জাতের চেয়ে প্রভু তাদের কেন অধিক কৃপা করেছেন। তারা অটল, অকপটতা তাদের অস্থিমজ্জাগত, তাদের অন্তর গভীর অনুভূতিতে পূর্ণ—কেবল বাইরে একটা কঠোরতার আবরণ মাত্র রয়েছে। ঐটে ভেঙে দিতে পারলেই হল—বস্, তোমার মনের মানুষ খুঁজে পাবে।
সম্প্রতি আমি কলিকাতায় একটি ও হিমালয়ে আর একটি কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছি। প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতার এলটি গোটা পাহাড়ের উপর এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হবে। ঐ পাহাড়টি গ্রীষ্মকালে বেশ শীতল থাকবে, আর শীতকালে খুব ঠাণ্ডা হবে। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার ঐখানে থাকবেন এবং ঐটি ইওরোপীয় কর্মিগণের কেন্দ্র হবে। আমি তাদের জোর করে ভারতীয় জীবন-প্রণালী অনুসারে চালিয়ে এবং ভারতের উত্তপ্ত সমতলভূমিতে বাস করিয়ে মেরে ফেলতে চাই না। আমাদের কার্যপ্রণালী হচ্ছে এই যে, শত শত হিন্দু যুবক প্রত্যেক সভ্যদেশে গিয়ে [বেদান্ত] প্রচার করুক, আর সে-সব দেশ থেকে নরনারী পাঠাক ভারতবর্ষে কাজ করতে। এতে পরস্পরের মধ্যে বেশ একটা আদানপ্রদান হবে। কেন্দ্রগুলি প্রতিষ্ঠা করে আমি ‘জবের গ্রন্থে’ বর্ণিত ভদ্রলোকটির মত১১৩ উপরে নীচে চারিদিক ঘুরে বেড়াব।
ডাক ধরতে হবে, আজ এখানেই শেষ। সব দিকেই আমার কাজের সুবিধা হয়ে আসছে—এতে আমি খুশী এবং জানি তোমরাও আমার মত খুশী হবে। তোমরা অশেষ কল্যাণ ও সুখশান্তি লাভ কর। ইতি
তোমাদের চিরস্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুঃ—ধর্মপালের খবর কি? তিনি কি করছেন? তাঁর সঙ্গে দেখা হলে আমার ভালবাসা জানিও।
—বি
৩১৮*
১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্স্
ওয়েষ্টমিনষ্টার, লণ্ডন
৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় এলবার্টা,
‘জো জো’কে লেখা ম্যাবেল (Mabel)-এর একটি চিঠি একসঙ্গে তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি এর মধ্যেকার সংবাদটি খুব উপভোগ করেছি এবং তুমিও নিশ্চয়ই করবে।
এখান থেকে ১৬ যাত্রা করে নেপল্স্-এ গিয়ে আমাকে ষ্টীমার ধরতে হবে। দিনকয়েক আমি ইতালীতে থাকব—চার পাঁচদিন রোমে। বিদায় নেবার আগে তোমার সঙ্গে একবার দেখা হলে খুব খুশী হব।
ইংলণ্ড থেকে ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার আমার সঙ্গে ভারতে যাচ্ছেন, তাঁরা অবশ্য আমার সঙ্গে ইতালীতেও থাকবেন। গত গ্রীষ্মে তুমি তাঁদের দেখেছ। বছরখানেকের মধ্যে আমেরিকা, তারপর ইওরোপে ফিরে আসব, ইচ্ছা করি।
প্রীতি ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ
৩১৯*
[মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত]
দি গ্রেকোট গার্ডেন্স্
ওয়েষ্টমিনষ্টার, লণ্ডন
৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় জো,
তোমার সহৃদয় আমন্ত্রণের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, প্রিয় জো জো কিন্তু বিধি বাম। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং মিঃ গুডউইনের সঙ্গে ১৬ তারিখ ভারতের দিকে যাত্রা করছি। সেভিয়ার-দম্পতি ও আমি নেপল্স্-এ জাহাজ ধরব। রোমে চারদিন সময় পাওয়া যাবে, তার মধ্যে এলবার্টার সঙ্গে দেখা করে বিদায় নেব।
এই মুহূর্তে ব্যাপার খুব জমজমাটি; ৩৯, নং ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীটে বড় হলঘরটি লোকে পরিপূর্ণ এবং এখনও আরও লোক আসছে।
হ্যাঁ আমার সেই পুরাতন প্রিয় দেশটি এখন আমায় ডাকছে; যেতেই হবে আমাকে। সুতরাং এই এপ্রিলে রাশিয়ায় যাবার সকল পরিকল্পনা বিদায়। ভারতে কাজকর্ম কিছুটা গোছগাছ করে দিয়েই আমি চিরসুন্দর আমেরিকা ইংলণ্ড প্রভৃতি স্থানে আবার ফিরে আসছি।
ম্যাবেলের চিঠিখানা পাঠিয়েছ, তোমার সহৃদয়তা—বাস্তবিকই সুসংবাদ। বেচারী ফক্সের জন্য শুধু আমার একটু দুঃখ হয়। যা হোক ম্যাবেল যে তার কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে—এটা ভালই হয়েছে।
নিউ ইয়র্কে কাজকর্ম কি রকম চলছে—কিছু লেখনি। আশা করি সেখানকার খবর সব ভালই। বেচারী কোলা! সে কি এখন কিছু রোজকারের ব্যবস্থা করতে পেরেছে?
গুডউইনের আসাটা একটা সৌভাগ্য, কারণ তার ফলে এখানকার বক্তৃতাগুলি লিপিবদ্ধ হয়ে পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই খরচা পোষাবার মত যথেষ্ট গ্রাহক জুটে গিয়েছে।
আগামী সপ্তাহে তিনটি বক্তৃতা, বস্, তারপর এই মরসুমের মত আমার লণ্ডনের কাজ শেষ। অবশ্য এখানকার সকলেই ভাবছেন, এই সাফল্যের মুখে কাজটা ছেড়ে যাওয়া বোকামি, কিন্তু আমার প্রিয় প্রভু বলছেন, ‘প্রাচীন ভারতের অভিমুখে যাত্রা কর’। আমি তাঁর আদেশ পালন করব।
ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স, মা, হলিস্টার এবং প্রত্যেককে আমার চিরন্তন ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানাবে এবং তোমার জন্যও তাই।
চির আন্তরিকভাবে তোমার
বিবেকানন্দ
৩২০*
৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার অতি উদার দানের প্রতিশ্রুতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা নিষ্প্রয়োজন। কার্যারম্ভেই অনেক অর্থ হাতে নিয়ে আমি নিজেকে বিব্রত করতে চাই না; তবে কাজের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ঐ অর্থকে খাটাতে পারলেই আমি সুখী হব। খুব সামান্যভাবে কাজ আরম্ভ করাই আমার ইচ্ছা। এখনও আমার কোন সঠিক পরিকল্পনা নেই। ভারতবর্ষে কার্যক্ষেত্রে পৌঁছে আমার পবিত্র দায়িত্বের স্বরূপ জানতে পারব। ভারত থেকে আমার পরিকল্পনা এবং উহা কার্যে পরিণত করার উপায় আপনাকে আরও বিশদভাবে জানাব।
আমি ১৬ তারিখে রওনা হব এবং ইতালীতে কয়েকদিন কাটিয়ে নেপল্সে জাহাজ ধরব।
অনুগ্রহ করে মিসেস—, সারদানন্দ এবং ওখানকার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবকে আমার ভালবাসা জানাবেন। আপনার সম্বন্ধে এইটুকু বলতে পারি যে, আপনাকে আমি সর্বদাই সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে করে এসেছি এবং আজীবন তাই করব। আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছাদি জানবেন। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
৩২১*
[জনৈক আমেরিকান মহিলাকে লিখিত]
লণ্ডন
১৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় মহাশয়া,
নীতির ব্যাপারেও ক্রমোন্নতির মাত্রা আছে, এই ভাবটি ধরতে পারলেই আর সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। একটু কম সংসারিত্ব, একটু কম প্রতিকার, একটু কম হিংসার মধ্য দিয়ে আমাদিগকে ক্রমে ক্রমে বৈরাগ্য, অপ্রতিকার, অহিংসা প্রভৃতি আদর্শে উপনীত হতে হবে। এই আদর্শকে সর্বদা চোখের সামনে রেখে তার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যান। প্রতিকার ছাড়া, হিংসা ছাড়া, বাসনা ছাড়া কেউ সংসারে বাস করতে পারে না। জগৎ এখনও সে অবস্থায় আসেনি, যখন ঐ আদর্শকে সমাজে রূপায়িত করতে পারা যায়। অশুভের মধ্য দিয়ে জগতের অগ্রগতি তাকে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে আদর্শের উপযুক্ত করে তুলছে।অধিকাংশ লোককেই এই মন্থর উন্নতির পথে অগ্রসর হতে হবে। বিশেষ শক্তিমান্ পুরুষদের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই আদর্শ লাভ করতে হলে এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সময়োপযোগী কর্তব্যসাধনই শ্রেষ্ঠ পন্থা এবং শুধু কর্তব্যবোধে অনুষ্ঠিত হলে ওতে বন্ধন আসে না।
সঙ্গীত সর্বশ্রেষ্ঠ ললিত কলা এবং যাঁরা বোঝেন, তাঁদের কাছে ওটি সবচেয়ে বড় উপাসনা।
অজ্ঞান ও অশুভ নাশ করবার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। আমাদের শুধু লিখতে হবে যে, শুভ বুদ্ধি দ্বারাই অশুভের নাশ হয়।
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
৩২২*
১৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স,,
তাহলে গোপাল১১৪ মেয়ের রূপ পরিগ্রহ করেছে! এটা হওয়া সঙ্গতই হয়েছে—স্থান-কাল-বিবেচনায়। তার জীবন সকল আশীর্বাদে বিধৃত হোক। সে গভীর আকাঙ্ক্ষা ও প্রার্থনার ধন, আপনার ও আপনার গৃহিণীর জীবনের আশীর্বাদরূপে সে আপনাদের কাছে এসেছে—এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
‘প্রাচ্যদেশের জ্ঞানী পুরুষেরা পাশ্চাত্য শিশুর জন্য প্রীতি-উপহার নিয়ে আসছেন’—সেই প্রচলিত প্রথাটি পালন করবার জন্য যদি এখন আমি আমেরিকায় যেতে পারতাম! তবে আমার অন্তরাত্মা সকল প্রার্থনা ও আশীর্বাদ নিয়ে সেখানে বিরাজ করছে; দেহের চাইতে মনের শক্তি ঢের বেশী।
আমি এ-মাসের ১৬ তারিখে রওনা হব এবং নেপল্স্-এ গিয়ে জাহাজ ধরব। রোমে এলবার্টার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করব। পবিত্র পরিবারটির জন্য সর্ববিধ ভালবাসা। ইতি
আপনাদের সদাপ্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
৩২৩*
হোটেল মিনার্ভা, ফ্লোরেন্স
২০ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় এলবার্টা,
আগামীকাল আমরা রোমে পৌঁছব। খুব সম্ভব আগামী পরশু আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাব, কারণ রোমে যখন পৌঁছব, তখন রাত হয়ে যাবে। আমরা হোটেল কণ্টিনেণ্টাল-এ উঠছি।
সর্ববিধ ভালবাসা ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ
৩২৪*
হোটেল মিনার্ভা, ফ্লোরেন্স
২০ ডিসেম্বর, ১৮৯৬
প্রিয় রাখাল,
এই পত্র দেখেই বুঝতে পারছ যে, আমি এখনও রাস্তায়। লণ্ডন ছাড়বার আগেই আমি তোমার পত্র ও পুস্তিকাখানি পেয়েছিলাম। মজুমদারের পাগলামির দিকে দৃক্পাত করো না। ঈর্ষাবশতঃ তাঁর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। তিনি যেরূপ ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা শুনলে সভ্য দেশের লোকে তাঁকে বিদ্রূপ করবে। এরূপ অশিষ্ট ভাষা প্রয়োগ করে তিনি নিজের উদ্দেশ্য নিজেই বিফল করেছেন।
সে যাই হোক, আমরা কখনও আমাদের নাম করে হরমোহন বা অপর কাকেও ব্রাহ্মদের সঙ্গে লড়াই করতে দিতে পারি না। জনসাধারণ জানুক যে, কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের বিবাদ নেই। যদি কেউ কলহ সৃষ্টি করে, তার জন্য সে নিজেই দায়ী। পরস্পরের সহিত বিবাদ ও পরস্পরকে নিন্দা করা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। অলস, অকর্মণ্য, মন্দভাষী, ঈর্ষাপরায়ণ, ভীরু এবং কলহপ্রিয়—এই তো আমরা বাঙালী জাতি! আমার বন্ধু বলে পরিচয় দিতে গেলে এগুলি ত্যাগ করতে হবে। তা ছাড়া হরমোহনকে আমার বই ছাপতে দিও না। সে যেভাবে ছাপে তাতে লোক ঠকান হয়।
কলিকাতায় কমলানেবু থাকলে আলাসিঙ্গার ঠিকানায় মান্দ্রাজে এক-শ পাঠিয়ে দিও, যাতে আমি মান্দ্রাজে পৌঁছে পেতে পারি।
মজুমদার নাকি লিখেছেন যে, ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকায় প্রকাশিত শ্রীরামকৃষ্ণ-উপদেশ খাঁটি নয়, মিথ্যা। তা যদি হয় তো সুরেশ দত্ত ও রামবাবুকে ‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ এর প্রতিবাদ করতে বলবে। ঐ উপদেশ কিভাবে সংগৃহীত হয়েছে, তা তো আমি জানি না; সেজন্য এ বিষয়ে কিছু বলতে পারি না। ইতি
তোমার প্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুঃ— … বেকুবদের কথা মোটেই ভেবো না; কথায় বলে, ‘বুড়ো বেকুবের মত আর বেকুব নেই।’ ওরা একটু চেঁচাক না।
৩২৫*
ড্যাম্পিয়ার, ‘প্রিন্স-রিজেণ্ট লিওপোল্ড’
৩ জানুআরী, ১৮৯৭
প্রিয় মেরী,
তোমার চিঠি লণ্ডন থেকে ঠিকানা বদল হয়ে রোমে আমার কাছে পৌঁছেছে। তোমার অশেষ সৌজন্য যে, অমন সুন্দর একখানি চিঠি লিখেছ, তার প্রতিটি ছত্র আমি উপভোগ করছি। ইওরোপে অর্কেষ্ট্রার ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না। নেপল্স্ থেকে চারদিন ভয়াবহ সমুদ্রযাত্রার পর পোর্ট সৈয়দের কাছে এসে পড়েছি। জাহাজ খুব দুলছে—অতএব এই অবস্থায় লেখা আমার এই হিজিবিজি তুমি ক্ষমা করো।
সুয়েজ থেকে এশিয়া। আবার এশিয়ায়! আমি কি এশিয়াবাসী, ইওরোপীয় না আমেরিকান? আমার মধ্যে ব্যক্তিত্বের একটা অদ্ভুত সংমিশ্রণ অনুভব করছি। ধর্মপালের গতিবিধি বা কার্যকলাপ সম্বন্ধে কিছু লেখনি। গান্ধীর চেয়ে তার সম্বন্ধেই আমার অনেক বেশী আগ্রহ।
কয়েকদিন পরেই কলম্বোতে নামছি, এবং সিংহলে কিছু একটা করব ভাবছি। এক সময় সিংহলে দু-কোটি অধিবাসী ছিল—তাদের বিরাট রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ প্রায় এক-শ বর্গমাইল জুড়ে পড়ে রয়েছে।
সিংহলীরা দ্রাবিড়জাতি নয়—খাঁটি আর্য। প্রায় ৮০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দে বাঙলাদেশ থেকে সিংহলে উপনিবেশ স্থাপিত হয় এবং সেই সময় থেকে তারা তাদের পরিষ্কার ইতিহাস রেখেছে। এখানেই ছিল প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যবসাকেন্দ্র, আর অনুরাধাপুর ছিল সেকালের লণ্ডন।
পাশ্চাত্যের সব কিছুর মধ্যে আমি রোমকেই সবচেয়ে বেশী উপভোগ করেছি, পম্পিয়াই দেখার পর তথাকথিত ‘আধুনিক সভ্যতা’র ওপর আমি একেবারে শ্রদ্ধা হারিয়েছি। বাষ্প আর বিদ্যুৎ বাদ দিলে ওদের আর সব কিছু ছিল—এবং আধুনিকদের চেয়ে ওদের চারুকলার ধারণা এবং রূপায়ণের শক্তিও অনন্তগুণে বেশী ছিল। মিস লককে বলো, আমি যে তাকে বলেছিলাম ‘মানবমূর্তির ভাস্কর্য গ্রীসে যতটা উন্নত হয়েছিল, ভারতে ততটা হয়নি’—এ মত আমার ভুল।
ফার্গুসন প্রভৃতির প্রামাণিক গ্রন্থে পড়েছি উড়িষ্যার অথবা জগন্নাথে—যেখানে আমার যাওয়া হয়নি, সে-সব জায়গায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যে-সব মানব-মূর্তি রয়েছে, সেগুলি সৌন্দর্যে এবং অবয়বসংস্থানের চাতুর্যে গ্রীসের যে-কোন শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে তুলনীয়। সেখানে মৃত্যুর একটি বিশাল মূর্তি আছে—প্রকাণ্ড একটি লোলচর্ম নারীকঙ্কাল—তার প্রতিটি অবয়বের নিখুঁত সংস্থান ভয়ঙ্কর ও বীভৎস। গ্রন্থকার বলেছেন—অলিন্দে স্থিত একটি নারীমূর্তি ঠিক মেডিচির ভেনাসের মত! এমন আরও কত কি!
মনে রেখো মূর্তিবিদ্বেষী মুসলমানরা প্রায় সবই ধ্বংস করেছে, তবু যা আছে—তা সমগ্র ইওরোপীয় ধ্বংসস্তূপের চেয়ে বেশী! আট বছর ঘুরেছি, তবু শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের অনেকগুলিই দেখা হয়নি।
ভগিনী লককেও বলো—ভারতের অরণ্যে একটি বিধ্বস্ত মন্দির রয়েছে; ফার্গুসন মনে করেন, সেটি আর গ্রীসের পার্থিনন স্থাপত্যশিল্প, যে যার নিজ আদর্শের শিখরসীমা; একটি হল ভাবের, আর একটি হল ভাব ও খুঁটিনাটির। পরবর্তী মোগল সৌধাবলী প্রভৃতি ইন্দো-সারাসেন স্থাপত্যশিল্প প্রাচীনকালের উৎকৃষ্ট নিদর্শনগুলির সামনে তুলনায় একদম দাঁড়াতে পারে না। … স্নেহ ভালবাসা জেনো। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ফ্লোরেন্সে হঠাৎ মাদার চার্চ ও ফাদার পোপের সঙ্গে দেখা। সে তো তুমি জেনেছ।
—বি
৩২৬*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
রামনাদ
শনিবার, ৩০ জানুআরী, ১৮৯৭
স্নেহের মেরী,
চারিদিকের অবস্থা অতি আশ্চর্যরূপে আমার অনুকূল হয়ে আসছে। সিংহলে—কলম্বোয় আমি জাহাজ থেকে নেমেছি এবং এখন ভারতবর্ষের প্রায় শেষ দক্ষিণপ্রান্ত রামনাদে সেখানকার রাজার অতিথিরূপে রয়েছি। এই কলম্বো থেকে রামনাদ পর্যন্ত আমার পর্যটন যেন একটা বিরাট শোভাযাত্রা—হাজার হাজার লোকের ভিড়, আলোকসজ্জা, অভিনন্দন ইত্যাদি! ভারতভূমির যেখানে আমি প্রথম পদার্পণ করি, সেই স্থানে ৪০ ফুট উচ্চ একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী হচ্ছে। রামনাদের রাজা একটি সুন্দর কারুকার্যখচিত খাঁটি সোনার তৈরী বৃহৎ পেটিকায় তাঁর অভিনন্দনপত্র আমাকে দিয়েছেন; তাতে আমাকে His Most Holiness (মহাপবিত্রস্বরূপ) বলে সম্বোধন করা হয়েছে। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা আমার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে, যেন সমগ্র দেশটা আমাকে অভিনন্দন করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সুতরাং তুমি দেখতে পাচ্ছ, মেরী, আমি আমার সৌভাগ্যের উচ্চতম শিখরে উঠেছি। তবু আমার মন চিকাগোর সেই নিস্তব্ধ, প্রশান্ত দিনগুলির দিকেই ছুটছে—কি বিশ্রাম-শান্তি ও প্রেমপূর্ণ দিনগুলি! তাই এখনি তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। আশা করি, তোমরা সকলে বেশ ভাল আছ ও আনন্দে আছ। ডক্টর ব্যারোজকে সাদর অভ্যর্থনা করবার জন্য আমি লণ্ডন থেকে আমার স্বদেশবাসীদের নিকট চিঠি লিখেছিলাম। তারা তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা করেছিল। কিন্তু তিনি লোকের মনের উপর কোন রেখাপাত করতে পারেননি, তার জন্য আমি দোষী নই। কলিকাতার লোকের ভিতর নূতন কিছু ভাব ঢোকান বড় কঠিন। ডক্টর ব্যারোজ আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু ভাবছেন, আমি শুনতে পাচ্ছি; এই তো সংসার! মা, বাবা ও তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমার স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩২৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
মান্দ্রাজ
১২ ফেব্রুআরী, ১৮৯৭
প্রিয় রাখাল,
আগামী রবিবার ‘মোম্বাসা’ জাহাজে আমার রওনা হবার কথা। স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ায় পুণার এবং আরও অনেক স্থানের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে ও গরমে আমার শরীর অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।
থিওসফিষ্টরা ও অন্যান্য সকলে আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল; সুতরাং আমাকেও দু-চারটি কথা—খোলাখুলিভাবে তাদের শোনাতে হয়েছিল। তুমি জান, তাদের দলে যোগ দিতে অস্বীকার করায় তারা আমাকে আমেরিকায় বরাবর নির্যাতিত করেছে। এখানেও তারা তাই শুরু করতে চেয়েছিল। কাজেই আমার মত পরিষ্কার করে বলতে হয়েছিল। এতে আমার কলিকাতার বন্ধুদের কেউ যদি অসন্তুষ্ট হয়ে থাকেন তো ভগবান্ তাঁদের কৃপা করুন। তোমার ভয় পাবার কারণ নেই; আমি নিঃসঙ্গ নই—প্রভু সর্বদাই আমার সঙ্গে আছেন। অন্য কীই বা করতে পারতুম। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—উপযুক্ত আসবাব থাকলে বাড়ীখানি নিও।
—বি
৩২৮*
আলমবাজার মঠ, (কলিকাতা)
২৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯৭
প্রিয় মিসেস বুল,
সারদানন্দ ভারতের দুর্ভিক্ষ-মোচনের জন্য ২০ পাউণ্ড পাঠিয়েছে। কিন্তু কথায় বলে, ‘আগে নিজের ঘর সামলাও’, সুতরাং প্রথমে সেই দুর্ভিক্ষ দূর করাই আমি শ্রেষ্ঠ কর্তব্য বলে মনে করলাম। অতএব ঐ অর্থ যথাযথ কাজেই লাগান হয়েছে।
লোকে যেমন বলে, ‘আমার মরবারও সময় নেই’, সমগ্র দেশময় শোভাযাত্রা, বাদ্যভাণ্ড ও সম্বর্ধনার রকমারী আয়োজনে আমি এখন মৃতপ্রায়। জন্মোৎসব শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি পাহাড়ে পালিয়ে যাব। আমি ‘কেম্ব্রিজ সম্মেলন’ থেকে একটি এবং ‘ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশন’ থেকে আর একটি মানপত্র পেয়েছি। ‘নিউ ইয়র্ক বেদান্ত এসোসিয়েশনে’র যে মানপত্রের কথা ডাঃ জেন্স্ লিখেছেন, তা এখনও পৌঁছয়নি।
ডাঃ জেন্সের আর একখানি চিঠিও এসেছে, তাতে ভারতবর্ষে আপনাদের সম্মেলনের অনুরূপ কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ-সব বিষয়ে মনযোগ দেওয়া আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমি ক্লান্ত—এতই ক্লান্ত যে, যদি বিশ্রাম না পাই, তবে আর ছ-মাসও বাঁচব কিনা সন্দেহ!
বর্তমানে আমাকে দুটি কেন্দ্র খুলতে হবে—একটি কলিকাতায়, আর একটি মান্দ্রাজে। মান্দ্রাজীদের গাম্ভীর্য বেশী, আর তারা অনেক বেশী অকপট এবং আমার বিশ্বাস তারা মান্দ্রাজ থেকেই প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। কলিকাতার লোক, বিশেষতঃ কলিকাতার অভিজাত সম্প্রদায় দেশপ্রেমের হুজুগের বেলায় উৎসাহী; কিন্তু তাদের সহানুভূতি কখনও বাস্তবে পরিণত হবে না। প্রত্যুত, এদেশে হিংসুক ও নির্দয় প্রকৃতির লোকের সংখ্যা বড় বেশী—তারা আমার সব কাজকে লণ্ডভণ্ড করে নষ্ট করতে কোন চেষ্টার ত্রুটি করবে না।
তবে আপনি তো বেশ জানেন, বাধা যত বাড়ে, আমার ভেতরের দৈত্যটাও তত বেশী জেগে ওঠে। সন্ন্যাসীদের জন্য একটি এবং মেয়েদের জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পূর্বেই আমার মৃত্যু হলে আমার জীবনব্রত অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
আমি ইংলণ্ড থেকে ৫০০ পাউণ্ড এবং মিঃ স্টার্ডির কাছ থেকে ৫০০ পাউণ্ড পূর্বেই পেয়েছি। ঐ সঙ্গে আপনার দেওয়া অর্থ যোগ করলে দুটো কেন্দ্রই আরম্ভ করতে পারব নিশ্চয়। সুতরাং যথাসম্ভব সত্বর আপনার টাকা পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। সবচেয়ে নিরাপদ উপায় মনে হচ্ছে—আমেরিকার কোন ব্যাঙ্কে আপনার ও আমার দুজনের নামে টাকাটা জমা দেওয়া, যাতে আমাদের যে-কেউ টাকাটা তুলতে পারে। যদি টাকা তোলবার আগেই আমার মৃত্যু হয়, তবে আপনি ঐ টাকার সবটা তুলে আমার অভিপ্রায় অনুসারে খরচ করতে পারবেন। তাহলে আমার মৃত্যুর পর আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ আর ঐ টাকা নিয়ে গোলমাল করতে পারবে না। ইংলণ্ডের টাকাও ঐভাবে আমার ও মিঃ স্টার্ডির নামে ব্যাঙ্কে রাখা হয়েছে।
সারদানন্দকে আমার ভালবাসা জানাবেন এবং আপনিও আমার অসীম প্রীতি ও চিরকৃতজ্ঞতা জানবেন। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
৩২৯
[শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
দার্জিলিঙ
১৯ মার্চ, ১৮৯৭
শুভমস্তু। আশীর্বাদপ্রেমালিঙ্গনপূর্বকমিদং ভবতু তব প্রীতয়ে। পাঞ্চভৌতিকং মে পিঞ্জরমধুনা কিঞ্চিৎ সুস্থতরম্। অচলগুরোর্হিমানিমণ্ডিতশিখরাণি পুনরুজ্জীবয়ন্তি মৃতপ্রায়ানপি জনান্ ইতি মন্যে। শ্রমবাধাপি কথঞ্চিৎ দূরীভূতেত্যনুভবামি। যত্তে হৃদয়োদ্বেগকরং মুমুক্ষুত্বং লিপিভঙ্গ্যা ব্যঞ্জিতং, তন্ময়া অনুভূতং পূর্বম্। তদেব শাশ্বতে ব্রহ্মণি মনঃ সমাধাতুং প্রসরতি। ‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।’ জ্বলতু সা ভাবনা অধিকমধিকং যাবন্নাধিগতানামেকান্তক্ষয়ঃ কৃতাকৃতানাম্। তদনু সহসৈব ব্রহ্মপ্রকাশঃ সহ সমস্তবিষয়প্রধ্বংসৈঃ। আগামিনী সা জীবন্মুক্তিস্তব হিতায় তবানুরাগদার্ঢ্যেনৈবানুমেয়া। যাচে পুনস্তং লোকগুরুং মহাসমন্বয়াচার্য-শ্রী১০৮রামকৃষ্ণং আবির্ভবিতং তব হৃদয়োদ্দেশং যেন বৈ কৃতকৃতার্থস্ত্বম আবিষ্কৃতমহাশৌর্যঃ লোকান্ সমুদ্ধর্তুং মহামোহসাগরাৎ সম্যগ্ যতিষ্যসে। ভব চিরাধিষ্ঠিত ওজসি। বীরাণামেব করতলগত মুক্তির্ন কাপুরুষাণাম্। হে বীরাঃ, বদ্ধপরিকরাঃ ভবত; সম্মুখে শত্রবঃ মহামোহরূপাঃ। ‘শ্রেয়াংসি বহুবিঘ্নানি’ ইতি নিশ্চিতেঽপি সমধিকতরং কুরুত যত্নম্। পশ্যত ইমান্ লোকান্ মোহগ্রাহগ্রস্তান্। শৃণুত অহো তেষাং হৃদয়ভেদকরং কারুণ্যপূর্ণং শোকনাদম্। অগ্রগাঃ ভবত, অগ্রগাঃ হে বীরাঃ, মোচয়িতুং পাশং বদ্ধানাং, শ্লথয়িতুং ক্লেশভারং দীনানাং, দ্যোতয়িতুং হৃদয়ান্ধকূপম্ অজ্ঞানাম্। অভীরভীরিতি ঘোষয়তি বেদান্তডিণ্ডিমঃ। ভূয়াৎ স ভেদায় হৃদয়গ্রন্থীনাং সর্বেষাং জগন্নিবাসিনামিতি—
তবৈকান্তশুভভাবুকঃ
বিবেকানন্দঃ
(বঙ্গানুবাদ)
শুভ হউক। আশীর্বাদ ও প্রেমালিঙ্গনপূর্ণ পত্রখানি তোমাকে সুখী করুক। অধুনা আমার পাঞ্চভৌতিক দেহপিঞ্জর পূর্বাপেক্ষা কিছু সুস্থ আছে। আমার মনে হয়, পর্বতরাজ হিমালয়ের হিমানীমণ্ডিত শিখরগুলি মৃতপ্রায় মানবদিগকেও সজীব করিয়া তোলে। পথশ্রমের কথঞ্চিৎ লাঘব হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। লিখনভঙ্গীতে তোমার হৃদয়োদ্বেগকর যে মুমুক্ষুত্ব প্রকটিত হইয়াছে, তাহা আমি পূর্বেই অনুভব করিয়াছি। সেই মুমুক্ষুত্বই ক্রমশঃ নিত্যস্বরূপ ব্রহ্মে মনের একাগ্রতা আনিয়া দেয়। মুক্তিলাভের আর অন্য পন্থা নাই। সেই ভাবনা তোমার উত্তরোত্তর বর্ধিত হউক, যতদিন না সমুদয় কৃতকর্ম সম্পূর্ণরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। তখন তোমার হৃদয়ে সহসা ব্রহ্মের প্রকাশ হইবে ও সঙ্গে সঙ্গে সমুদয় বিষয়বাসনা নষ্ট হইয়া যাইবে। তোমার অনুরাগের দৃঢ়তা দ্বারা জানা যাইতেছে, পরমকল্যাণকর সেই জীবন্মুক্তি অবস্থা তুমি শীঘ্রই লাভ করিবে। এক্ষণে সেই লোকগুরু মহাসমন্বয়চার্য শ্রী১০৮রামকৃষ্ণদেবের নিকট প্রার্থনা করি, যেন তিনি তোমার হৃদয়ে আবির্ভূত হন, যাহাতে তুমি কৃতকৃতার্থ ও মহাশৌর্যশালী হইয়া মহামোহসাগর হইতে লোকদিগেরও উদ্ধারের জন্য সম্যক্ যত্ন করিতে পার। চিরতেজস্বী হও। মুক্তি বীরদিগেরই করতলগত, কাপুরুষদিগের নহে। হে বীরগণ! বদ্ধপরিকর হও, মহামোহরূপ শত্রুগণ সম্মুখে। শ্রেয়োলাভে বহু বিঘ্ন ঘটে; ইহা নিশ্চিত হইলেও তাহা লাভ করিতে সমধিক যত্ন কর। দেখ, জীবগণ মোহরূপ কুম্ভীরের কবলে পড়িয়া কি কষ্ট পাইতেছে! আহা! তাহাদের হৃদয়বিদারক করুণ আর্তনাদ শ্রবণ কর। হে বীরগণ, বদ্ধদিগের পাশ মোচন করিতে, দরিদ্রের ক্লেশভার লঘু করিতে ও অজ্ঞজনগণের হৃদয়ান্ধকার দূর করিতে অগ্রসর হও—অগ্রসর হও। ঐ শুন, বেদান্তদুন্দুভি ঘোষণা করিতেছে—‘ভয় নাই, ভয় নাই।’ সেই দুন্দুভিধ্বনি নিখিল জগদ্বাসিগণের হৃদয়গ্রন্থি ভেদ করিতে সমর্থ হউক।
তোমাদের পরমশুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
৩৩০
C/o M. N. Banerjee, দার্জিলিঙ
২০ মার্চ (এপ্রিল?), ১৮৯৭
প্রিয় শশী,
তোমরা অবশ্যই এতদিনে মান্দ্রাজ পঁহুছিয়াছ। বিলিগিরি অবশ্যই অতি যত্ন করিতেছে এবং সদানন্দ তোমার সেবা করিতেছে। পূজা-অর্চা পূর্ণ সাত্ত্বিকভাবে মান্দ্রাজে করিতে হইবে। রজোগুণের লেশমাত্র যেন না থাকে। আলাসিঙ্গা বোধ হয় এতদিনে মান্দ্রাজ পঁহুছিয়াছে। কাহারও সহিত বাদ-বিবাদ করিবে না—সদা শান্তিভাব আশ্রয় করিবে। আপাততঃ বিলিগিরির বাটীতেই ঠাকুর স্থাপনা করিয়া পূজাদি হউক, তবে পূজার ঘটা একটু কমাইয়া সে সময়টা পাঠাদি ও লেকচার প্রভৃতি কিছু কিছু যেন হয়। কান ফুঁকতে যত পার, ততই মঙ্গল জানিবে। কাগজ দুটোর তত্ত্বাবধান করিবে ও যাহা পার সহায়তা করিবে। বিলিগিরির দুটি বিধবা কন্যা আছেন। তাঁদের শিক্ষা দিবে এবং তাঁদের দ্বারা ঐ প্রকার আরও বিধবারা যাহাতে স্বধর্মে থাকিয়া সংস্কৃত ও ইংরেজী শিক্ষা পায়, এ বিষয়ে যত্ন সবিশেষ করিবে। কিন্তু এ সব কার্য তফাৎ হইতে। যুবতীর সাক্ষাতে অতি সাবধান। একবার পড়িলে আর গতি নাই এবং ও অপরাধের ক্ষমা নাই।
গুপ্তকে কুকুরে কামড়াইয়াছে শুনিয়া বড়ই দুঃখিত হইলাম; কিন্তু শুনিতেছি যে, ঐ কুকুর হন্যা নহে—তাহা হইলে ভয়ের কারণ নাই। যাহা হউক, গঙ্গাধরের প্রেরিত ঔষধ সেবন করান যেন হয়। প্রাতঃকালে পূজাদি অল্পে সারা করিয়া সপরিবার বিলিগিরিকে ডাকাইয়া কিঞ্চিৎ গীতাদি পাঠ করিবে। রাধাকৃষ্ণ-প্রেম শিক্ষার কিছুমাত্র আবশ্যক নাই। শুদ্ধ সীতারাম ও হরপার্বতীতে ভক্তি শিখাইবে। এ বিষয়ে কোন ভুল না হয়। যুবক-যুবতীদের [পক্ষে] রাধাকৃষ্ণলীলা একেবারেই বিষের ন্যায় জানিবে। বিশেষ বিলিগিরি প্রভৃতি রামানুজীরা রামোপাসক, তাঁদের শুদ্ধ ভাব যেন কদাচ বিনষ্ট না হয়।
বৈকালে ঐ প্রকার সাধারণ লোকের জন্য কিছু শিক্ষাদি দিবে। এই প্রকার ধীরে ‘পর্বতমপি লঙ্ঘয়েৎ’।
পরমশুদ্ধ ভাব যেন সর্বদা রক্ষিত হয়। ঘুণাক্ষরেও যেন বামাচার না আসে। বাকী প্রভু সকল বুদ্ধি দিবে ভয় নাই। বিলিগিরিকে আমার বিশেষ দণ্ডবৎ ও আলিঙ্গনাদি দিবে। ঐ প্রকার সকল ভক্তদের আমার প্রণামাদি দিও। আমার রোগ অনেকটা এক্ষণে শান্ত হইয়াছে—একেবারে সারিয়া গেলেও যাইতে পারে—প্রভুর ইচ্ছা। আমার ভালবাসা, নমস্কার, আশীর্বাদাদি জানিবে। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ডাক্তার নাঞ্জুণ্ড রাওকে আমার বিশেষ প্রেমালিঙ্গন ও আশীর্বাদ দিবে ও তাঁহাকে যতদূর পার সহায়তা করিও। তামিল অর্থাৎ ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যে যাহাতে সংস্কৃত বিদ্যার বিশেষ চর্চা হয়, তাহা করিবে। ইতি
—বি
৩৩১
[‘ভারতী’-সম্পাদিকাকে ১১৫ লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
রোজ ব্যাঙ্ক
বর্ধমান রাজবাটী, দার্জিলিঙ
৬ এপ্রিল, ১৮৯৭
মান্যবরাসু,
মহাশয়ার প্রেরিত ‘ভারতী’ পাইয়া বিশেষ অনুগৃহীত বোধ করিতেছি এবং যে উদ্দেশ্যে আমার ক্ষুদ্র জীবন ন্যস্ত হইয়াছে, তাহা যে ভবদীয়ার ন্যায় মহানুভবাদের সাধুবাদ সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইয়াছে, তাহাতে আপনাকে ধন্য মনে করিতেছি।
এ জীবনসংগ্রামে নবীন ভাবের সমুদ্গাতার সমর্থক অতি বিরল, উৎসাহয়িত্রীর কথা তো দূরে থাকুক; বিশেষতঃ আমাদের হতভাগ্য দেশে। এজন্য বঙ্গ-বিদুষী নারীর সাধুবাদ সমগ্র ভারতীয় পুরুষের উৎকণ্ঠ ধন্যবাদাপেক্ষাও অধিক শ্লাঘ্য।
প্রভু করুন, যেন আপনার মত অনেক রমণী এদেশে জন্মগ্রহণ করেন ও স্বদেশের উন্নতি-কল্পে জীবন উৎসর্গ করেন।
আপনার লিখিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় মৎসম্বন্ধী প্রবন্ধ বিষয়ে আমার কিঞ্চিৎ মন্তব্য আছে; তাহা এইঃ
পাশ্চাত্যদেশে ধর্মপ্রচার ভারতের মঙ্গলের জন্যই করা হইয়াছে এবং হইবে। পাশ্চাত্যরা সহায়তা না করিলে যে আমরা উঠিতে পারিব না, ইহা চির ধারণা। এদেশে এখনও গুণের আদর নাই, অর্থবল নাই, এবং সর্বাপেক্ষা শোচনীয় এই যে, কৃতকর্মতা (practicality) আদৌ নাই।
উদ্দেশ্য অনেক আছে, উপায় এদেশে নাই। আমাদের মস্তক আছে, হস্ত নাই। আমাদের বেদান্ত-মত আছে, কার্যে পরিণত করিবার ক্ষমতা নাই। আমাদের পুস্তকে মহাসাম্যবাদ আছে, আমাদের কার্যে মহাভেদবুদ্ধি। মহা নিঃস্বার্থ নিষ্কাম কর্ম ভারতেই প্রচারিত হইয়াছে, কিন্তু কার্যে আমরা অতি নির্দয়, অতি হৃদয়হীন, নিজের মাংসপিণ্ড-শরীর ছাড়া অন্য কিছুই ভাবিতে পারি না।
তথাপি উপস্থিত অবস্থার মধ্য দিয়াই কেবল কার্যে অগ্রসর হইতে পারা যায়, অন্য উপায় নাই। ভাল-মন্দ-বিচারের শক্তি সকলের আছে। কিন্তু তিনিই বীর, যিনি এই সমস্ত ভ্রম-প্রমাদ-ও দুঃখপূর্ণ সংসারের তরঙ্গে পশ্চাৎপদ না হইয়া একহস্তে অশ্রুবারি মোচন করেন ও অপর অকম্পিত হস্তে উদ্ধারের পথ প্রদর্শন করেন। একদিকে গতানুগতিক জড়পিণ্ডবৎ সমাজ, অন্যদিকে অস্থির ধৈর্যহীন অগ্নিবর্ষণকারী সংস্কার; কল্যাণের পথ এই দুইয়ের মধ্যবর্তী। জাপানে শুনিয়াছিলাম, সে দেশের বালিকাদিগের বিশ্বাস এই যে, যদি ক্রীড়াপুত্তলিকাকে হৃদয়ের সহিত ভালবাসা যায়, সে জীবিত হইবে। জাপানী বালিকা কখনও পুতুল ভাঙে না। হে মহাভাগে, আমারও বিশ্বাস যে, যদি কেউ এই হতশ্রী বিগতভাগ্য লুপ্তবুদ্ধি পরপদবিদলিত চিরবুভুক্ষিত কলহশীল ও পরশ্রীকাতর ভারতবাসীকে প্রাণের সহিত ভালবাসে, তবে ভারত আবার জাগিবে। যবে শত শত মহাপ্রাণ নরনারী সকল বিলাসভোগসুখেচ্ছা বিসর্জন করিয়া কায়মনোবাক্যে দারিদ্র্য ও মূর্খতার ঘূর্ণাবর্তে ক্রমশঃ উত্তরোত্তর নিমজ্জনকারী কোটি কোটি স্বদেশীয় নরনারীর কল্যাণ কামনা করিবে, তখন ভারত জাগিবে। আমার ন্যায় ক্ষুদ্র জীবনেও ইহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি যে, সদুদ্দেশ্য অকপটতা ও অনন্ত প্রেম বিশ্ব বিজয় করিতে সক্ষম। উক্ত গুণশালী একজন কোটি কোটি কপট ও নিষ্ঠুরের দুর্বুদ্ধি নাশ করিতে সক্ষম।
আমার পুনর্বার পাশ্চাত্যদেশে গমন অনিশ্চিত; যদি যাই, তাহাও জানিবেন ভারতের জন্য। এদেশে লোকবল কোথায়, অর্থবল কোথায়? অনেক পাশ্চাত্য নরনারী ভারতের কল্যাণের জন্য ভারতীয় ভাবে ভারতীয় ধর্মের মধ্য দিয়া অতি নীচ চণ্ডালাদিরও সেবা করিতে প্রস্তুত আছেন। দেশে কয়জন? আর অর্থবল!! আমাকে অভ্যর্থনা করিবার ব্যয়নির্বাহের জন্য কলিকাতাবাসীরা টিকিট বিক্রী করিয়া লেকচার দেওয়াইলেন এবং তাহাতেও সঙ্কুলান না হওয়ায় ৩০০ টাকার এক বিল আমার নিকট প্রেরণ করেন!!! ইহাতে কাহারও দোষ দিতেছি না বা কুসমালোচনাও করিতেছি না, কিন্তু পাশ্চাত্য অর্থবল ও লোকবল না হইলে যে আমাদের কল্যাণ অসম্ভব, ইহারই পোষণ করিতেছি। ইতি
চিরকৃতজ্ঞ ও সদা প্রভুসন্নিধানে
ভবৎ-কল্যাণ-কামনাকারী
বিবেকানন্দ
৩৩২
[‘ভারতী’-সম্পাদিকাকে লিখিত]
C/o M. N. Banerjee, দার্জিলিঙ
২৪ এপ্রিল, ১৮৯৭
মহাশয়াসু,
আপনার সহানুভূতির জন্য হৃদয়ের সহিত আপনাকে ধন্যবাদ দিতেছি, কিন্তু নানা কারণবশতঃ এ সম্বন্ধে আপাততঃ প্রকাশ্য আলোচনা যুক্তিযুক্ত মনে করি না। তন্মধ্যে প্রধান কারণ এই যে, যে-টাকা আমার নিকট চাওয়া হয়, তাহা ইংলণ্ড হইতে আমার সমভিব্যাহারী ইংরেজ বন্ধুদিগের আহ্বানের নিমিত্তই অধিকাংশ খরচ হইয়াছিল। অতএব এ কথা প্রকাশ করিলে যে অপযশের ভয় আপনি করেন, তাহাই হইবে। দ্বিতীয়তঃ তাঁহারা—আমি উক্ত টাকা দিতে অপারগ হওয়ায়—আপনা-আপনির মধ্যে উহা সারিয়া লইয়াছেন, শুনিতেছি।
আপনি কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন—তদ্বিষয়ে প্রথমে বক্তব্য এই যে, ‘ফলানুমেয়াঃ প্রারম্ভাঃ’ই হওয়া উচিত; তবে আমার অতি প্রিয়বন্ধু মিস মূলারের প্রমুখাৎ আপনার উদারবুদ্ধি, স্বদেশবাৎসল্য ও দৃঢ় অধ্যাবসায়ের অনেক কথা শুনিয়াছি এবং আপনার বিদুষীত্বের প্রমাণ প্রত্যক্ষ। অতএব আপনি যে আমার ক্ষুদ্র জীবনের অতি ক্ষুদ্র চেষ্টার কথা জানিতে ইচ্ছা করেন, তাহা পরম সৌভাগ্য মনে করিয়া অত্র ক্ষুদ্র পত্রে যথাসম্ভব নিবেদন করিলাম। কিন্তু প্রথমতঃ আপনার বিচারের জন্য আমার অনুভবসিদ্ধ সিদ্ধান্ত ভবৎসন্নিধানে উপস্থিত করিতেছিঃ আমরা চিরকাল পরাধীন, অর্থাৎ এ ভারতভূমে সাধারণ মানবের আত্মস্বত্ববুদ্ধি কখনও উদ্দীপিত হইতে দেওয়া হয় নাই। পাশ্চাত্যভূমি আজ কয়েক শতাব্দী ধরিয়া দ্রুতপদে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হইতেছে। এ ভারতে কৌলীন্যপ্রথা হইতে ভোজ্যাভোজ্য পর্যন্ত সকল বিষয় রাজাই নির্ধারণ করিতেন। পাশ্চাত্যদেশে সমস্তই প্রজারা আপনারা করেন।
এক্ষণে রাজা সামাজিক কোন বিষয়ে হাত দেন না, অথচ ভারতীয় জনমানবের আত্মনির্ভরতা দূরে থাকুক, আত্মপ্রত্যয় পর্যন্ত এখনও অণুমাত্র হয় নাই। যে আত্মপ্রত্যয় বেদান্তের ভিত্তি, তাহা এখনও ব্যাবহারিক অবস্থায় কিছুমাত্রও পরিণত হয় নাই। এইজন্যই পাশ্চাত্য প্রণালী অর্থাৎ প্রথমতঃ উদ্দিষ্ট বিষয়ের আন্দোলন পরে সকলে মিলিয়া কর্তব্যসাধন, এ দেশে এখনও ফলদায়ক হয় না; এইজন্যই আমরা বিজাতীয় রাজার অধীনে এত অধিক স্থিতিশীল বলিয়া প্রতীত হই। এ কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে সাধারণে আন্দোলনের দ্বারা কোন মহৎকার্য করার চেষ্টা বৃথা, ‘মাথা নেই তার মাথা ব্যথা’—সাধারণ কোথা? তাহার উপর আমরা এতই বীর্যহীন যে, কোন বিষয়ের আন্দোলন করিতে গেলে তাহাতেই আমাদের বল নিঃশেষিত হয়, কার্যের জন্য কিছুমাত্রও বাকী থাকে না; এইজন্যই বোধ হয় আমরা প্রায়ই বঙ্গভূমে ‘বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া’ সতত প্রত্যক্ষ করি। দ্বিতীয়তঃ যে প্রকার পূর্বেই লিখিয়াছি—ভারতবর্ষের ধনীদিগের নিকট কোন আশা করি না। যাহাদের উপর আশা, অর্থাৎ যুবক সম্প্রদায়—ধীর, স্থির অথচ নিঃশব্দে তাহাদিগের মধ্যে কার্য করাই ভাল। এক্ষণে কার্যঃ ‘আধুনিক সভ্যতা’ পাশ্চাত্যদেশের ও ‘প্রাচীন সভ্যতা’ ভারত, মিসর, রোমকাদি দেশের মধ্যে সেইদিন হইতেই প্রভেদ আরম্ভ হইল, যেদিন হইতে শিক্ষা, সভ্যতা প্রভৃতি উচ্চজাতি হইতে ক্রমশঃ নিম্নজাতিদিগের মধ্যে প্রসারিত হইতে লাগিল। প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, যে জাতির মধ্যে জনসাধারণের ভিতর বিদ্যাবুদ্ধি যত পরিমাণে প্রচারিত, সে জাতি তত পরিমাণে উন্নত। ভারতবর্ষের যে সর্বনাশ হইয়াছে, তাহার মূল কারণ ঐটি—রাজশাসন ও দম্ভবলে দেশের সমগ্র বিদ্যাবুদ্ধি এক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ করা। যদি পুনরায় আমাদিগকে উঠিতে হয়, তাহা হইলে ঐ পথ ধরিয়া অর্থাৎ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্যার প্রচার করিয়া। আজ অর্ধ শতাব্দী ধরিয়া সমাজসংস্কারের ধুম উঠিয়াছে। দশ বৎসর যাবৎ ভারতের নানা স্থল বিচরণ করিয়া দেখিলাম, সমাজসংস্কারসভায় দেশ পরিপূর্ণ। কিন্তু যাহাদের রুধিরশোষণের দ্বারা ‘ভদ্রলোক’ নামে প্রথিত ব্যক্তিরা ‘ভদ্রলোক’ হইয়াছেন এবং রহিতেছেন, তাহাদের জন্য একটি সভাও দেখিলাম না! মুসলমান কয়জন সিপাহী আনিয়াছিল? ইংরেজ কয়জন আছে? ছ-টাকার জন্য পিতা নিজের ভ্রাতার গলা কাটিতে পারে, এমন লক্ষ লক্ষ লোক ভারত ছাড়া কোথায় পাওয়া যায়? সাত-শ বৎসর মুসলমান রাজত্বে ছ-কোটি মুসলমান, এক-শ বৎসর ক্রিশ্চান রাজত্বে কুড়ি লক্ষ ক্রিশ্চান—কেন এমন হয়? Originality (মৌলিকতা) একেবারে দেশকে কেন ত্যাগ করিয়াছে? আমাদের দক্ষহস্ত শিল্পী কেন ইওরোপীয়দের সহিত সমকক্ষতা করিতে না পারিয়া দিন দিন উৎসন্ন যাইতেছে? কি বলেই বা জার্মান শ্রমজীবী ইংরেজ শ্রমজীবীর বহুশতাব্দীপ্রোথিত দৃঢ় আসন টলমলায়মান করিয়া তুলিয়াছে?
কেবল শিক্ষা, শিক্ষা, শিক্ষা! ইওরোপের বহু নগর পর্যটন করিয়া তাহাদের দরিদ্রেরও সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও বিদ্যা দেখিয়া আমাদের গরীবদের কথা মনে পড়িয়া অশ্রুজল বিসর্জন করিতাম। কেন এ পার্থক্য হইল? শিক্ষা—জবাব পাইলাম। শিক্ষাবলে আত্মপ্রত্যয়, আত্মপ্রত্যয়বলে অন্তর্নিহিত ব্রহ্ম জাগিয়া উঠিতেছেন; আর আমাদের—ক্রমেই তিনি সঙ্কুচিত হচ্ছেন। নিউ ইয়র্কে দেখিতাম, Irish colonists (আইরিশ ঔপনিবেশিকগণ) আসিতেছে—ইংরেজ-পদ-নিপীড়িত, বিগতশ্রী, হৃতসর্বস্ব, মহাদরিদ্র, মহামূর্খ—সম্বল একটি লাঠি ও তার অগ্রবিলম্বিত একটি ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটুলি। তার চলন সভয়, তার চাউনি সভয়। ছ-মাস পরে আর এক দৃশ্য—সে সোজা হয়ে চলছে, তার বেশভূষা বদলে গেছে; তার চাউনিতে, তার চলনে আর সে ‘ভয় ভয়’ ভাব নাই। কেন এমন হল? আমার বেদান্ত বলছেন যে, ঐ Irishma-কে তাহার স্বদেশে চারিদিকে ঘৃণার মধ্যে রাখা হয়েছিল—সমস্ত প্রকৃতি একবাক্যে বলছিল, ‘প্যাট(Pat),১১৬ তোর আর আশা নাই, তুই জন্মেছিস গোলাম, থাকবি গোলাম।’ আজন্ম শুনিতে শুনিতে প্যাট-এর তাই বিশ্বাস হল, নিজেকে প্যাট হিপনটাইজ (সম্মোহিত) করলে যে, সে অতি নীচ; তার ব্রহ্ম সঙ্কুচিত হয়ে গেল। আর আমেরিকায় নামিবামাত্র চারিদিক থেকে ধ্বনি উঠিল—‘প্যাট, তুইও মানুষ, আমরাও মানুষ, মানুষেই তো সব করেছে, তোর আমার মত মানুষ সব করতে পারে, বুকে সাহস বাঁধ!’ প্যাট ঘাড় তুললে, দেখলে ঠিক কথাই তো; ভিতরের ব্রহ্ম জেগে উঠলেন, স্বয়ং প্রকৃতি যেন বললেন, ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’ ইত্যাদি।
ঐ প্রকার আমাদের বালকদের যে বিদ্যাশিক্ষা হচ্ছে, তাও একান্ত negative (নেতিভাবপূর্ণ)—স্কুল-বালক কিছুই শিখে না, কেবল সব ভেঙেচুরে যায়—ফল ‘শ্রদ্ধাহীনত্ব’। যে শ্রদ্ধা বেদবেদান্তের মূলমন্ত্র, যে শ্রদ্ধা নচিকেতাকে যমের মুখে যাইয়া প্রশ্ন করিতে সাহসী করিয়াছিল, যে শ্রদ্ধাবলে এই জগৎ চলিতেছে, সে ‘শ্রদ্ধা’র লোপ। ‘অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি’—গীতা। তাই আমরা বিনাশের এত নিকট। এক্ষণে উপায়—শিক্ষার প্রচার। প্রথম আত্মবিদ্যা—ঐ কথা বললেই যে জটাজট, দণ্ড, কমণ্ডলু ও গিরিগুহা মনে আসে, আমার মন্তব্য তা নয়। তবে কি? যে জ্ঞানে ভববন্ধন হতে মুক্তি পর্যন্ত পাওয়া যায়, তাতে আর সামান্য বৈষয়িক উন্নতি হয় না? অবশ্যই হয়। মুক্তি, বৈরাগ্য, ত্যাগ—এ সকল তো মহাশ্রেষ্ঠ আদর্শ; কিন্তু ‘স্বল্পমপাস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।’ দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, অদ্বৈত, শৈবসিদ্ধান্ত, বৈষ্ণব, শাক্ত, এমন কি বৌদ্ধ ও জৈন প্রভৃতি যে-কোন সম্প্রদায় এ ভারতে উঠিয়াছে, সকলেই এইখানে একবাক্য যে, এই ‘জীবাত্মা’তেই অনন্ত শক্তি নিহিত আছে, পিপীলিকা হতে উচ্চতম সিদ্ধপুরুষ পর্যন্ত সকলের মধ্যে সেই ‘আত্মা’,—তফাৎ কেবল প্রকাশের তারতম্যে, ‘বরণভেদস্তু ততঃ ক্ষেত্রিকবৎ’— (পাতঞ্জলযোগসূত্রম্)। অবকাশ ও উপযুক্ত দেশ কাল পেলেই সেই শক্তির বিকাশ হয়। কিন্তু বিকাশ হোক বা না হোক, সে শক্তি প্রত্যেক জীবে বর্তমান—আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত। এই শক্তির উদ্বোধন করতে হবে দ্বারে দ্বারে যাইয়া। দ্বিতীয়, এই সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাশিক্ষা দিতে হবে। কথা তো হল সোজা, কিন্তু কার্যে পরিণত হয় কি প্রকারে? এই আমাদের দেশে সহস্র সহস্র নিঃস্বার্থ, দয়াবান, ত্যাগী পুরুষ আছেন; ইঁহাদের মধ্যে অন্ততঃ (এক) অর্ধেক ভাগকে—যেমন তাঁহারা বিনা বেতনে পর্যটন করে ধর্মশিক্ষা দিচ্ছেন—ঐ প্রকার বিদ্যাশিক্ষক করান যেতে পারে। তাহার জন্য চাই, প্রথমতঃ এক এক রাজধানীতে এক এক কেন্দ্র ও সেথা হইতে ধীরে ধীরে ভারতের সর্বস্থানে ব্যাপ্ত হওয়া। মান্দ্রাজ ও কলিকাতায় সম্প্রতি দুটি কেন্দ্র হইয়াছে; আরও শীঘ্র হইবার আশা আছে। তারপর দরিদ্রদের শিক্ষা অধিকাংশই শ্রুতির দ্বারা হওয়া চাই। স্কুল ইত্যাদির এখনও সময় আইসে নাই। ক্রমশঃ ঐ সকল প্রধান কেন্দ্রে কৃষি বাণিজ্য প্রভৃতি শিখান যাবে এবং শিল্পাদিরও যাহাতে এদেশে উন্নতি হয়, তদুপায়ে কর্মশালা খোলা যাবে। ঐ কর্মশালার মালবিক্রয় যাহাতে ইওরোপে ও আমেরিকায় হয়, তজ্জন্য উক্ত দেশসমূহেও সভা স্থাপনা হইয়াছে ও হইবে। কেবল মুশকিল এক, যে প্রকার পুরুষদের জন্য হইবে, ঠিক ঐ ভাবেই স্ত্রীলোকদের জন্য চাই; কিন্তু এদেশে তাহা অতীব কঠিন, আপনি বিদিত আছেন। পুনশ্চ এই সমস্ত কার্যের জন্য যে অর্থ চাই, তাহাও ইংলণ্ড হইতে আসিবে। যে-সাপে কামড়ায়, সে নিজের বিষ উঠাইয়া লইবে, ইহা আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং তজ্জন্য আমাদের ধর্ম ইওরোপ ও আমেরিকায় প্রচার হওয়া চাই! আধুনিক বিজ্ঞান খ্রীষ্টাদি ধর্মের ভিত্তি একেবারে চূর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। তাহার উপর বিলাস—ধর্মবৃত্তিই প্রায় নষ্ট করিয়া ফেলিল। ইওরোপ ও আমেরিকা আশাপূর্ণনেত্রে ভারতের দিকে তাকাইতেছে—এই সময় পরোপকারের, এই সময় শত্রুর দুর্গ অধিকার করিবার।
পাশ্চাত্যদেশে নারীর রাজ্য, নারীর বল, নারীর প্রভুত্ব। যদি আপনার ন্যায় তেজস্বিনী বিদুষী বেদান্তজ্ঞা কেউ এই সময়ে ইংলণ্ডে যান আমি নিশ্চিত বলিতেছি, এক এক বৎসরে অন্ততঃ দশ হাজার নরনারী ভারতের ধর্ম গ্রহণ করিয়া কৃতার্থ হইবে। এক রমাবাঈ অস্মদ্দেশ হইতে গিয়াছিলেন। তাঁহার ইংরেজী ভাষা বা পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিল্পাদিবোধ অল্পই ছিল, তথাপি তিনি সকলকে স্তম্ভিত করিয়াছিলেন। যদি আপনার ন্যায় কেউ যান তো ইংলণ্ড তোলপাড় হইয়া যাইতে পারে, আমেরিকার কা কথা। দেশীয় নারী দেশীয় পরিচ্ছদে ভারতের ঋষিমুখাগত ধর্ম প্রচার করিলে আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, এক মহান্ তরঙ্গ উঠিবে, যাহা সমগ্র পাশ্চাত্যভূমি প্লাবিত করিয়া ফেলিবে। এ মৈত্রেয়ী, খনা, লীলাবতী, সাবিত্রী ও উভয়-ভারতীর জন্মভূমিতে কি আর কোন নারীর এ সাহস হইবে না? প্রভু জানেন। ইংলণ্ড, ইংলণ্ড, ইংলণ্ড-—আমরা ধর্মবলে অধিকার করিব, জয় করিব—‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।’ এ দুর্দান্ত অসুরের হস্ত হইতে কি সভাসমিতি দ্বারা উদ্ধার হয়? অসুরকে দেবতা করিতে হইবে। আমি দীন ভিক্ষুক পরিব্রাজক কি করতে পারি? আমি একা, অসহায়! আপনাদের ধন-বল, বুদ্ধি-বল, বিদ্যা-বল—আপনারা এ সুযোগ ত্যাগ করিবেন কি? এই এখন মহামন্ত্র—ইংলণ্ড-বিজয়, ইওরোপ বিজয় আমেরিকা-বিজয়! তাহাতেই দেশের কল্যাণ। Expansion is the sign of life and we must spread the world over with our spiritual ideals.১১৭ হায় হায়! শরীর ক্ষুদ্র জিনিষ, তায় বাঙালীর শরীর; এই পরিশ্রমেই অতি কঠিন প্রাণহর ব্যাধি আক্রমণ করিল! কিন্তু আশা এই—‘উৎপৎস্যতেঽস্তি মম কোঽপি সমানধর্মা, কালো হ্যয়ং নিরবধির্বিপুলা চ পৃথ্বী।’১১৮
নিরামিষ ভোজন সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই—প্রথমতঃ আমার গুরু নিরামিষাশী ছিলেন; তবে দেবীর প্রসাদ মাংস কেহ দিলে অঙ্গুলি দ্বারা মস্তকে স্পর্শ করিতেন। জীবহত্যা পাপ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই; তবে যতদিন রাসায়নিক উন্নতির দ্বারা উদ্ভিজ্জাদি মনুষ্যশরীরের উপযোগী খাদ্য না হয়, ততদিন মাংসভোজন ভিন্ন উপায় নাই। যতদিন মনুষ্যকে আধুনিক অবস্থার মধ্যে থাকিয়া রজোগুণের কৃপা করিতে হইবে, ততদিন মাংসাদন বিনা উপায় নাই। মহারাজ অশোক তরবারির দ্বারা দশ-বিশ লক্ষ জানোয়ারের প্রাণ বাঁচাইলেন বটে, কিন্তু হাজার বৎসরের দাসত্ব কি তদপেক্ষা আরও ভয়ানক নহে? দু-দশটা ছাগলের প্রাণনাশ বা আমার [অর্থাৎ নিজের] স্ত্রী-কন্যার মর্যাদা রাখিতে অক্ষমতা ও আমার বালকবালিকার মুখের গ্রাস পরের হাত হইতে রক্ষা করিতে অক্ষমতা, এ কয়েকটির মধ্যে কোন্টি অধিকতর পাপ? যাঁহারা উচ্চশ্রেণীর, এবং শারীরিক পরিশ্রম করিয়া অন্ন সংগ্রহ করেন না, তাঁহারা বরং [মাংসাদি] না খান; যাহাদের দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া অন্নবস্ত্রের সংস্থান করিতে হইবে, বলপূর্বক তাহাদিগকে নিরামিষাশী করা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা-বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। উত্তম পুষ্টিকর খাদ্য কি করিতে পারে, জাপান তাহার নিদর্শন। সর্বশক্তিমতী বিশ্বেশ্বরী আপনার হৃদয়ে অবতীর্ণা হউন। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৩৩*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
(দার্জিলিঙ)১১৯
২৮ এপ্রিল, ১৮৯৭
স্নেহের মেরী,
কয়েকদিন পূর্বে তোমার সুন্দর চিঠিখানি পেয়েছি। গতকাল হ্যারিয়েটের বিবাহের সংবাদ বহন করে চিঠি এসেছে। প্রভু নবদম্পতিকে সুখে রাখুন।
এখানে সমস্ত দেশবাসী আমাকে অভ্যর্থনা করবার জন্য যেন একপ্রাণ হয়ে সমবেত হয়েছিল। শত সহস্র লোক—যেখানে যাই সেখানেই উৎসাহসূচক আনন্দধ্বনি করছিল, রাজা-রাজড়ারা আমার গাড়ী টানছিলেন, বড় বড় শহরের সদর রাস্তার উপর তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল, এবং তাতে নানা রকম মঙ্গলবাক্য (motto) জ্বলজ্বল করছিল। সমস্ত ব্যাপারটিই শীঘ্র পুস্তকাকারে বেরুবে এবং তুমিও একখানা পাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমি ইতোপূর্বেই ইংলণ্ডে কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়েছি, আবার এখানে দাক্ষিণাত্যের ভীষণ গরমে অতিরিক্ত পরিশ্রম করায় একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়েছি। কাজেই আমাকে ভারতের অন্যান্য স্থান পরিদর্শন করবার পরিকল্পনা ছেড়ে নিকটতম শৈলনিবাস দার্জিলিঙে চোঁচা দৌড় দিতে হল। সম্প্রতি আমি অনেকটা ভাল আছি এবং আবার মাসখানেক আলমোড়ায় থাকলেই সম্পূর্ণ সেরে যাব। ভাল কথা, সম্প্রতি আমার ইওরোপে যাবার একটা সুবিধা চলে গেল। রাজা অজিত সিং এবং আরও কয়েকজন রাজা আগামী শনিবার ইংলণ্ড যাত্রা করছেন। তাঁরা অবশ্য আমাকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ডাক্তারেরা রাজী নন। তাঁরা চান না আমি এখন কোন শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রম করি, সুতরাং অত্যন্ত ক্ষুণ্ণহৃদয়ে আমাকে এই সুযোগ ছেড়ে দিতে হচ্ছে; তবে যত শীঘ্র পারি যাবার চেষ্টা করব।
আশা করি ডাঃ ব্যারোজ এতদিনে আমেরিকায় পৌঁছেছেন। আহা বেচারা! তিনি অত্যন্ত গোঁড়া মনোভাব নিয়ে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন, সুতরাং যা সাধারণতঃ হয়ে থাকে—কেউ তাঁর কথা শুনল না। অবশ্য লোকে তাঁকে খুব সাদর অভ্যর্থনা করেছিল; তাও আমি চিঠি লিখেছিলাম বলেই। কিন্তু আমি তো আর তাঁর ভিতরে বুদ্ধি ঢোকাতে পারি না! অধিকন্তু, তিনি যেন কি-এক অদ্ভুত ধরনের লোক! শুনলাম, আমি দেশে ফিরে আসলে সমগ্র জাতিটা আনন্দে যে মেতে উঠেছিল, তাতে তিনি ক্ষেপে গিয়েছিলেন। যে করেই হোক, আরও বেশী মাথাওয়ালা একজনকে পাঠান উচিত ছিল, কারণ ডাঃ ব্যারোজ যা বলে গেছেন, তাতে হিন্দুরা বুঝেছে ধর্মমহাসভা ছিল একটা তামাশার ব্যাপারে (farce)। দার্শনিক বিষয়ে জগতের কোন জাতই হিন্দুদের পথপ্রদর্শক হতে পারবে না।
একটা বড় মজার কথা এই যে, খ্রীষ্টান দেশ থেকে যত লোক এদেশে এসেছে, তাদের সকলেরই সেই এক মান্ধাতার আমলে নির্বোধ যুক্তিঃ যেহেতু খ্রীষ্টানরা শক্তিশালী ও ধনবান্ এবং হিন্দুরা তা নয়, সেই হেতুই খ্রীষ্টধর্ম হিন্দুধর্মের চেয়ে ভাল। এরই উত্তরে হিন্দুরা ঠিক জবাব দেয় যে, সেইজন্যই তো হিন্দুধর্মই হচ্ছে ধর্ম, আর খ্রীষ্টানধর্ম ধর্মই নয়। কারণ, এই পশুভাবাপন্ন জগতে পাপেরই জয়জয়কার আর পুণ্যের সর্বদা নির্যাতন! এটা দেখা যাচ্ছে যে, পাশ্চাত্য জাতি জড়বিজ্ঞানের চর্চায় যতই উন্নত হোক না কেন, দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে তারা শিশুমাত্র। জড়বিজ্ঞান শুধু ঐহিক উন্নতি বিধান করতে পারে; কিন্তু অধ্যাত্ম-বিজ্ঞান থেকে আসে অনন্ত জীবন। যদি অনন্ত জীবন নাও থাকে, তাহলেও আদর্শ হিসাবে আধ্যাত্মিক চিন্তাপ্রসূত আনন্দ অধিকতর তীব্র এবং এ-চিন্তা মানুষকে অধিকতর সুখী করে, আর জড়বাদপ্রসূত নির্বুদ্ধিতা থেকে আসে প্রতিযোগিতা, অযথা উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং পরিণামে ব্যষ্টি ও সমষ্টির মৃত্যু।
এই দার্জিলিঙ অতি সুন্দর জায়গা। এখান থেকে মাঝে মাঝে যখন মেঘ সরে যায়, তখন ২৮‚১৪৬ ফুট উচ্চ মহিমামণ্ডিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় এবং নিকটের একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে মাঝে মাঝে ২৯‚০০২ ফুট উচ্চ গৌরীশঙ্করের চকিত দর্শন পাওয়া যায়। এখানকার অধিবাসীরা—তিব্বতীরা, নেপালীরা এবং সর্বোপরি সুন্দরী লেপ্চা মেয়েরা—যেন ছবিটির মত।
তুমি চিকাগোর কল্স্টন টার্নবুল নামে কাউকে চেন কি? আমি ভারতবর্ষে পৌঁছবার পূর্বে কয়েক সপ্তাহ তিনি এখানে ছিলেন। তিনি দেখছি, আমাকে খুব পছন্দ করতেন, আর তার ফলে হিন্দুরা সকলেই তাঁকে অত্যন্ত পছন্দ করত! জো, মিসেস অ্যাডাম্স্, সিষ্টার জোসেফিন এবং আমাদের আর আর বন্ধুদের খবর কি? আমাদের প্রিয় মিল্রা (Mills) কোথায়? তারা ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে ‘পিষে’ চলেছে১২০ বোধ হয়? আমি হ্যারিয়েটকে তার বিবাহে কয়েকটি প্রীতি-উপহার পাঠাব মনে করেছিলাম; কিন্তু তোমাদের যে ভীষণ জাহাজের মাশুল—তাই উপস্থিত পাঠান স্থগিত রাখতে হচ্ছে। হয়তো তাদের সঙ্গে আমার শীঘ্রই ইওরোপে দেখা হবে। এই চিঠিতে যদি তোমারও বিবাহের কথাবার্তা চলছে লিখতে, তাহলে আমি অবশ্য আহ্লাদিত হতাম এবং আধ ডজন কাগজের একখানি চিঠি লিখে আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতাম।
আমার চুল গোছা গোছা পাকতে আরম্ভ করেছে এবং আমার মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে—দেহের এই মাংস কমে যাওয়াতে আমার বয়স যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। এখন আমি দিন দিন ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে যাচ্ছি, তার কারণ আমাকে শুধু মাংস খেয়ে থাকতে হচ্ছে—রুটি নেই, ভাত নেই, আলু নেই, এমন কি আমার কফিতে একটু চিনিও নেই!! আমি এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে বাস করছি—তারা সকলেই নিকার-বোকার পরে, অবশ্য স্ত্রীলোকেরা নয়। আমিও নিকার-বোকার পরে আছি। তুমি যদি আমাকে পাহাড়ী হরিণের মত পাহাড় থেকে পাহাড়ে লাফিয়ে বেড়াতে দেখতে অথবা ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে পাহাড়ে-রাস্তায় চড়াই উতরাই করতে দেখতে, তাহলে খুব আশ্চর্য হয়ে যেতে।
আমি এখানে বেশ ভাল আছি। কারণ সমতলভূমিতে বাস করা আমার পক্ষে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে; সেখানে আমার রাস্তায় পা-টি বাড়াবার যো নেই—অমনি একদল লোক আমায় দেখবে বলে ভিড় করবে!! নামযশটা সব সময়েই বড় সুখের নয়। আমি এখন মস্ত দাড়ি রাখছি; আর তা পেকে সাদা হতে আরম্ভ করেছে—এতে বেশ গণ্যমান্য দেখায় এবং লোককে আমেরিকান কুৎসা-রটনাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে! হে সাদা দাড়ি, তুমি কত জিনিষই না ঢেকে রাখতে পার! তোমারই জয়জয়কার।
ডাক যাবার সময় হয়ে এল, তাই শেষ করলাম। তোমার স্বপ্ন সুখকর হোক, তোমার স্বাস্থ্য সুন্দর হোক এবং তোমার অশেষ কল্যাণ হোক। বাবা, মা ও তোমরা সকলে আমার ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৩৪*
আলমবাজার মঠ, (কলিকাতা)
৫ মে, ১৮৯৭
প্রিয় মিসেস বুল,
ভগ্ন স্বাস্থ্য ফিরে পাবার জন্য একমাস দার্জিলিঙে ছিলাম। আমি এখন বেশ ভাল হয়ে গেছি। ব্যারাম-ফ্যারাম দার্জিলিঙে একেবারেই পালিয়েছে। কাল আলমোড়া নামক আর একটি শৈলবাসে যাচ্ছি—স্বাস্থ্যোন্নতি সম্পূর্ণ করবার জন্য।
আমি আগেই আপনাকে লিখেছি যে, এখানকার অবস্থা বেশ আশাজনক বলে বোধ হচ্ছে না—যদিও সমস্ত জাতটা একযোগে আমাকে সম্মান করেছে এবং আমাকে নিয়ে প্রায় পাগল হয়ে যাবার মত হয়েছিল! কোন বিষয়ে কার্যকারিতার দিকটা ভারতবর্ষে আদৌ দেখতে পাবেন না। কলিকাতার কাছাকাছি জমির দাম আবার খুব বেড়ে গেছে। আমার বর্তমান অভিপ্রায় হচ্ছে তিনটি রাজধানীতে তিনটি কেন্দ্র স্থাপন করা। ঐগুলি আমার শিক্ষকদের শিক্ষণকেন্দ্রস্বরূপ হবে—সেখান থেকেই আমি ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে চাই।
আমি আরও বছর-কয়েক বাঁচি আর নাই বাঁচি, ভারতবর্ষ ইতোমধ্যেই শ্রীরামকৃষ্ণের হয়ে গেছে।
অধ্যাপক জেম্সের একখানি সুন্দর পত্র পেয়েছিলাম; তাতে তিনি অবনত বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে আমার মন্তব্যগুলির উপর বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। আপনিও লিখেছেন যে, ধর্মপাল এতে খুব রেগে গেছেন। ধর্মপাল অতি সজ্জন এবং আমি তাঁকে ভালবাসি। কিন্তু ভারতীয় কোন ব্যাপারে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ অন্যায় হবে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যেটাকে নানাবিধ কুরুচিপূর্ণ আধুনিক হিন্দুধর্ম বলা হয়, তা হচ্ছে অচল অবস্থায় পতিত বৌদ্ধধর্ম মাত্র। এটা স্পষ্ট বুঝলে হিন্দুদের পক্ষে তা বিনা আপত্তিতে ত্যাগ করা সহজ হবে। বৌদ্ধধর্মের যেটি প্রাচীনভাব—যা শ্রীবুদ্ধ নিজে প্রচার করে গেছেন, তার প্রতি এবং শ্রীবুদ্ধের প্রতি আমার গভীরতম শ্রদ্ধা। আর আপনি ভালভাবেই জানেন যে, আমরা হিন্দুরা তাঁকে অবতার বলে পূজা করি। সিংহলের বৌদ্ধধর্মও তত সুবিধার নয়। সিংহলে ভ্রমণকালে আমার ভ্রান্ত ধারণা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। সিংহলে যদি প্রাণবন্ত কেউ থাকে তো এক হিন্দুরাই। বৌদ্ধরা অনেকটা পাশ্চাত্যভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে—এমন কি ধর্মপাল ও তাঁর পিতার ইওরোপীয় নাম ছিল, এখন তাঁরা সেটা বদলেছেন। আজকাল বৌদ্ধেরা ‘অহিংসা পরমো ধর্মঃ’ এই শ্রেষ্ঠ উপদেশের এইমাত্র খাতির করেন যে, যেখানে-সেখানে কষাইয়ের দোকান খোলেন! এমন কি পুরোহিতরা পর্যন্ত ঐ কার্যে উৎসাহ দেন। আমি এক সময়ে ভাবতাম, আদর্শ বৌদ্ধধর্ম বর্তমানকালেও অনেক উপকার করবে। কিন্তু আমি আমার ঐ মত একেবারে ত্যাগ করেছি এবং স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কি কারণে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল।
থিওসফিষ্টদের সম্বন্ধে তোমার প্রথমেই স্মরণ রাখা উচিত যে, ভারতবর্ষে থিওসফিষ্ট ও বৌদ্ধদের সংখ্যা নামমাত্র—নেই বললেই হয়। তারা দুচারখানা কাগজ বের করে খুব একটা হুজুগ করে দুচারজন পাশ্চাত্য-দেশবাসীকে নিজেদের মত শোনাতে পারে; কিন্তু হিন্দুদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে, এমন দুজন বৌদ্ধ বা দশজন থিওসফিষ্ট আমি তো দেখি না।
আমি আমেরিকায় এক মানুষ ছিলাম, এখানে আর এক মানুষ হয়ে গেছি। এখানে সমস্ত (হিন্দু) জাতটা আমাকে যেন তাদের একজন প্রামাণিক ব্যক্তি (authority) বলে মনে করছে; আর সেখানে ছিলাম অতিনিন্দিত প্রচারক মাত্র। এখানে রাজারা আমার গাড়ী টানে—আর সেখানে আমাকে একটা ভাল হোটেলে পর্যন্ত ঢুকতে দিত না। সেইজন্য এখানে যা কিছু বলব, তাতে সমস্ত জাতটার—আমার সমস্ত স্বদেশবাসীর—মঙ্গল হওয়া আবশ্যক, তা সেগুলো দুচারজনের যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন। কপটতাকে কখনই নয়, যা কিছু খাঁটি ও সৎ, সেগুলিকে গ্রহণ করতে হবে, সেগুলির প্রতি উদারভাব পোষণ করতে হবে। থিওসফিষ্টরা আমায় খাতির ও খোসামোদ করতে চেষ্টা করেছিল, কারণ এখন আমি ভারতের একজন প্রামাণিক ব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছি। আর সেইজন্য আমার কাজের দ্বারা যাতে তাঁদের আজগুবিগুলো সমর্থিত না হয় এই উদ্দেশ্যে দু-চারটে কড়া স্পষ্ট কথা বলতে হয়েছিল, আর ঐ কাজ হয়ে গেছে। এতে আমি খুব খুশী। আমি যতদূর যা দেখেছি, তাতে ভারতে ইংলিশ চার্চের যে সব পাদ্রী আছে, তাঁদের উপর বরং আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু থিওসফিষ্ট ও বৌদ্ধদের উপর আদৌ নেই। আমি আবার তোমাকে বলছি, ভারতবর্ষ ইতোপূর্বেই শ্রীরামকৃষ্ণের হয়ে গেছে, এবং বিশুদ্ধ হিন্দুধর্মের জন্য এখানকার কাজ একটু সংগঠিত করে নিয়েছি। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
৩৩৫*
আলমবাজার মঠ (কলিকাতা)
৫ মে, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
তোমার প্রীতি ও উৎসাহপূর্ণ পত্রখানি আমার হৃদয়ে কত যে বলসঞ্চার করেছে, তা তোমার কল্পনারও অতীত। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, জীবনে এমন মুহূর্ত আসে যখন মন একেবারে নৈরাশ্যে ডুবে যায়—বিশেষতঃ কোন আদর্শকে রূপ দেবার জন্য জীবনব্যাপী উদ্যমের পর যখন সাফল্যের ক্ষীণ আলোকরশ্মি দৃষ্টিগোচর হয়, ঠিক সেই সময়ে যদি আসে এক প্রচণ্ড সর্বনাশা আঘাত। দৈহিক অসুস্থতা আমি গ্রাহ্য করি না; দুঃখ হয় এইজন্য যে, আমার আদর্শগুলি কার্যে পরিণত হবার কিছুমাত্র সুযোগ পেল না। আর তুমি তো জানই, অন্তরায় হচ্ছে অর্থাভাব।
হিন্দুরা শোভাযাত্রা এবং আরও কত কিছু করছে; কিন্তু তারা টাকা দিতে পারে না। দুনিয়াতে আর্থিক সাহায্য বলতে আমি পেয়েছি শুধু ইংলণ্ডে মিস — এবং মিঃ —র কাছে। … ওখানে থাকতে আমার ধারণা ছিল যে, এক হাজার পাউণ্ড পেলেই অন্ততঃ কলিকাতার প্রধান কেন্দ্রটি স্থাপন করা যাবে; আমি এই অনুমান করেছিলাম দশ বার বছর আগেকার কলিকাতার অভিজ্ঞতা থেকে। কিন্তু ইতোমধ্যে জিনিষের দাম তিন চার গুণ বেড়ে গেছে।
যাই হোক, কাজ আরম্ভ করা গেছে। একটি পুরানো জরাজীর্ণ বাড়ী ছ-সাত শিলিঙ ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে এবং তাতেই প্রায় ২৪ জন যুবক শিক্ষালাভ করছে। স্বাস্থ্যলাভের জন্য আমাকে এক মাস দার্জিলিঙে থাকতে হয়েছিল। তুমি জেনে সুখী হবে যে, আমি আগের চেয়ে অনেক ভাল আছি। আর তুমি বিশ্বাস করবে কি যে, কোন ঔষধ ব্যবহার না করেও শুধু ইচ্ছাশক্তি দ্বারাই এরূপ ফল পেয়েছি!! আগামী কাল আবার আর একটি শৈলনিবাসে যাচ্ছি, কারণ নীচে এখন বেজায় গরম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের ‘সমিতি’ এখনও টিকে আছে। এখানকার কাজের বিবরণী তোমাকে মাসে অন্ততঃ একবার করে পাঠাব। শুনতে পেলাম লণ্ডনের কাজ মোটেই ভাল চলছে না। প্রধানতঃ এই কারণেই আমি এখন লণ্ডনে যেতে চাই না, যদিও জুবিলী১২১ উৎসব উপলক্ষে ইংলণ্ডযাত্রী আমাদের কয়েকজন রাজা আমাকে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন; ওখানে গেলেই বেদান্ত-বিষয়ে লোকের আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বেজায় খাটতে হত, আর তার ফলে শারীরিক কষ্ট আরও বেশী হত।
যাই হোক অদূর ভবিষ্যতে আমি মাসখানেকের জন্য (ওদেশে) যাচ্ছি। শুধু যদি এখানকার কাজের গোড়াপত্তন দৃঢ় হয়ে যেত, তবে আমি কত আনন্দে ও স্বাধীনভাবেই না ঘুরে বেড়াতে পারতাম!
এ পর্যন্ত তো কেবল কাজের কথা হল। এখন তোমার নিজের কথা পাড়ছি। কল্যাণীয়া মিস নোব্ল্, তোমার যে অনুরাগ ভক্তি বিশ্বাস ও গুণগ্রাহিতা আছে, তা যদি কেউ পায়, তবে সে জীবনে যত পরিশ্রমই করুক না কেন, ওতেই তার শতগুণ প্রতিদান হয়। তোমার সর্বাঙ্গীণ কুশল হোক। আমার মাতৃভাষায় বলতে গেলে, তোমার কাজে সারা জীবন দিতে পারি।
তোমার এবং ইংলণ্ডের অন্যান্য বন্ধুদের চিঠিপত্র আমার কাছে সর্বদাই খুব আনন্দায়ক ছিল এবং ভবিষ্যতেও তা ছাড়া অন্যরূপ হবে না। মিঃ ও মিসেস হ্যামণ্ড দুখানি অতি সুন্দর ও প্রীতিপূর্ণ চিঠি লিখেছেন। অধিকন্তু মিঃ হ্যামণ্ড ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকায় একটি চমৎকার কবিতা পাঠিয়েছেন—যদিও আমি মোটেই এ প্রশস্তির যোগ্য নই। আবার তোমায় হিমালয় থেকে পত্র লিখব; উত্তপ্ত সমভূমির চেয়ে সেখানে তুষারশ্রেণীর সামনে চিন্তা আরও স্বচ্ছ হয়ে যাবে এবং স্নায়ুগুলি আরও শান্ত হবে। মিস মূলার ইতোমধ্যেই আলমোড়ায় পৌঁছেছেন। মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার সিমলা যাচ্ছেন। তাঁরা এতদিন দার্জিলিঙে ছিলেন। দেখ বন্ধু, এইভাবেই জাগতিক ব্যাপারের পরিবর্তন ঘটছে—একমাত্র প্রভুই নির্বিকার, তিনিই প্রেমস্বরূপ। তিনি তোমার হৃদয়সিংহাসনে চির-অধিষ্ঠিত হোন—ইহাই বিবেকানন্দের নিরন্তর প্রার্থনা। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৩৬*
আলমোড়া
২০ মে, ১৮৯৭
প্রিয় সুধীর,
তোমার চিঠি পেয়ে ভারি আনন্দ হল। একটা জিনিষ বোধ হয় তোমাকে বলতে ভুলে গেছি—আমায় যে-সব চিঠি লিখবে, তার নকল রেখো। তা ছাড়া অন্যেরা মঠে যে-সব দরকারী চিঠি লেখে বা মঠ থেকে বিভিন্ন লোকের কাছে যে-সব পত্রাদি যায়, তাও নকল করে রাখা উচিত।
সব জিনিষটা সুচারুভাবে চলছে, ওখানকার কাজে ক্রমে উন্নতি হচ্ছে এবং কলিকাতারও তাই—এই জেনে আমি বড়ই খুশী হয়েছি।
আমি এখন বেশ ভাল আছি; শুধু পথশ্রমটা আছে—তাও দিনকয়েকের মধ্যেই যাবে। সকলে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৩৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২০ মে, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার পত্রে বিশেষ সমাচার অবগত হইলাম। সুধীরের এক পত্র পাইলাম এবং মাষ্টার মহাশয়েরও এক পত্র পাই। নিত্যানন্দের (যোগেন চাটুয্যের) দুই পত্র দুর্ভিক্ষ স্থল হইতে পাইয়াছি।
টাকাকড়ি এখনও যেন জলে ভাসছে … যোগাড় নিশ্চিত হবে। হল, বিল্ডিং, জমি ও ফণ্ড—সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না আঁচালে তো বিশ্বাস নেই—এবং দু-তিন মাস এক্ষণে আমি তো আর গরম দেশে যাচ্ছি না। তারপর একবার tour (ভ্রমণ) করে টাকা যোগাড় করব নিশ্চিত। এ বিধায় যদি তুমি বোধ কর যে, ঐ আট কাঠা frontage (সামনে খোলা জমি) না হয় ..., তাহলে … দালালের বায়না জলে ফেলার মত দিলে ক্ষতি নাই। এ-সব বিষয় নিজে বুদ্ধি করে করবে, আমি অধিক আর কি লিখব? তাড়াতাড়িতে ভুল হওয়ার বিশেষ সম্ভব। … মাষ্টার মহাশয়কে বলিবে, তিনি যে বিষয়ে বলিয়াছেন, তাহা আমার খুব অভিমত।
গঙ্গাধরকে লিখিবে যে, যদি ভিক্ষাই সেখানে (দুর্ভিক্ষ স্থলে) দুষ্প্রাপ্য হয় তো গাঁটের পয়সা খরচ করিয়া খাইবে এবং সপ্তাহে সপ্তাহে এক একটা পত্র উপেনের কাগজে (‘বসুমতী’তে) প্রকাশ করিবে। তাহাতে অন্য লোকেও সহায়তা করিতে পারে।
শশীর এক পত্রে জানিতেছি, … সে নির্ভয়ানন্দকে চায়। যদি উত্তম বিবেচনা কর, নির্ভয়ানন্দকে মান্দ্রাজে পাঠাইয়া গুপ্তকে আনাইবে। মঠের Rules & Regulations-এর (নিয়মাবলীর) ইংরেজী অনুবাদ বা বাঙলা কপি শশীকে পাঠাইবে এবং সেখানে যেন ঐ প্রকার কার্য হয়, তাহা লিখিবে।
কলিকাতায় সভা বেশ চলিতেছে শুনিয়া সুখী হইলাম। এক দুইজন না আইসে কিছুই দরকার নাই (কিছু আসে যায় না)। ক্রমে সকলেই আসিবে। সকলের সঙ্গে সহৃদয়তা প্রভৃতি রাখিবে। মিষ্ট কথা অনেক দূর যায়, নূতন লোক যাহাতে আসে, তাহার চেষ্টা করাই বিশেষ প্রয়োজন। নূতন নূতন মেম্বর চাই।
যোগেন আছে ভাল। আমি—আলমোড়াও অত্যন্ত গরম হওয়ায় ২০ মাইল দূরে এক উত্তম বাগানে আছি; অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা, কিন্তু গরম। গরম কলিকাতা হইতে বিশেষ প্রভেদ কি?
জ্বরভাবটা সব সেরে গেছে। আরও ঠাণ্ডা দেশে যাবার যোগাড় দেখছি। গরমি বা পথশ্রম হলেই দেখছি লিভারে গোল দাঁড়ায়। এখানে হাওয়া এত শুষ্ক যে, দিনরাত্র নাক জ্বালা করছে ও জিভ যেন কাঠের চোকলা। তোমরা আর criticise (সমালোচনা) করো না; নইলে এত দিনে আমি মজা করে ঠাণ্ডা দেশে গিয়ে পড়তুম। … তুমি ও-সব মুখ্যু-ফুখ্যুদের কথা কি শোন? যেমন তুমি আমাকে কলায়ের দাল খেতে দিতে না—starch (শ্বেতসার) বলে!! আবার কি খবর—না, ভাত আর রুটি ভেজে খেলে আর starch (শ্বেতসার) থাকে না!!! অদ্ভুত বিদ্যে বাবা!! আসল কথা আমার পুরানো ধাত আসছেন। ... এইটি বেশ দেখতে পাচ্ছি। এ-দেশে এখন এ-দেশী রঙচঙ ব্যামো সব। সে-দেশে সে-দেশী রঙচঙ সব! রাত্রির খাওয়াটা মনে করছি খুব light (লঘু) করব; সকালে আর দুপুরবেলা খুব খাব, রাত্রে দুধ ফল ইত্যাদি। তাই তো ওৎ করে ফলের বাগানে পড়ে আছি, হে কর্তা!!
তুমি ভয় খাও কেন? ঝট করে কি দানা মরে? এই তো বাতি জ্বলল, এখনও সারা রাত্রি গাওনা আছে। আজকাল মেজাজটাও বড় খিটখিটে নাই, ও জ্বরভাবগুলো সব ঐ লিভার—আমি বেশ দেখছি। আচ্ছা ওকেও দুরস্ত বনাচ্ছি—ভয় কি? … খুব চুটিয়ে বুক বেঁধে কাজ কর দিকি, একবার তোলপাড় করা যাক। কিমধিকমিতি।
মঠের সকলকে আমার ভালবাসা দিবে ও next meeting (আগামী সভা)-কে আমার greeting (সাদর সম্ভাষণ) দিও ও কহিও যে, যদিও আমি শরীরের সহিত উপস্থিত নহি, তথাপি আমার আত্মা সেথায়, যেথায় প্রভুর নামকীর্তন হয়। ‘যাবৎ তব কথা রাম সঞ্চরিষ্যতি মেদিনীম্’ ইত্যাদি (হনুমান)—হে রাম, যেথায় তোমার কথা হয়, সেথায় আমি হাজির। আত্মা সর্বব্যাপী কিনা! ইতি
বিবেকানন্দ
৩৩৮*
আলমোড়া
২৯ মে, ১৮৯৭
প্রিয় শশী ডাক্তার,
তোমার পত্র এবং দু-বোতল ঔষধ যথাসময়ে পেয়েছি। কাল সন্ধ্যা হতে তোমার ঔষধ পরীক্ষা করে দেখছি। আশা করি, একটি ঔষধ অপেক্ষা দুটির মিশ্রণে বেশী ফল পাওয়া যাবে।
আমি সকাল-বিকালে ঘোড়ায় চড়ে যথেষ্ট ব্যায়াম করতে শুরু করেছি এবং তার ফলে সত্যই অনেকটা ভাল বোধ করছি। ব্যায়াম শুরু করে প্রথম সপ্তাহে শরীর এতই ভাল বোধ করিতেছিলাম যে, ছেলেবেলায় যখন কুস্তি করতাম, তারপর তেমনটি কখনও বোধ করিনি। আমার তখন সত্যই বোধ হত যে, শরীর থাকা একটা আনন্দের বিষয়। তখন শরীরের প্রতি ক্রিয়াতে আমি শক্তির পরিচয় পেতাম এবং প্রত্যেক পেশীর নড়াচড়াই আনন্দ দিত। সে উৎফুল্ল ভাব এখন অনেকটা কমে গেছে, তবু আমি নিজেকে বেশ শক্তিমান্ বোধ করি। শক্তি-পরীক্ষায় জি. জি. এবং নিরঞ্জন দুজনকেই আমি মুহূর্তে ভূমিসাৎ করতে পারতাম। দার্জিলিঙে আমার সবসময় মনে হত, আমি যেন কে আর একজন হয়ে গেছি। আর এখানে আমার মনে হয় যেন আমার কোন ব্যাধিই নেই। কেবল একটিমাত্র উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। জীবনে কখনও শোবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমুতে পারি না; অন্তত দু-ঘণ্টা এপাশ-ওপাশ করতে হয়। কেবলমাত্র মান্দ্রাজ থেকে দার্জিলিঙ পর্যন্ত (দার্জিলিঙের প্রথম মাস পর্যন্ত) বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসত। সেই সুলভ নিদ্রার ভাব এখন একেবারে চলে গেছে। আর আমার সেই পুরানো এপাশ-ওপাশ করার ধাত এবং রাত্রির আহারের পর গরম বোধ করার ভাব আবার ফিরে এসেছে। দিনের আহারের পর অবশ্য গরম বোধ করি না।
এখানে একটি ফলের বাগান থাকায় এখানে এসেই বরাবরের চেয়েও আমি বেশী ফল খেতে শুরু করেছি। কিন্তু এখানে এখন খোবানি ছাড়া অন্য কোন ফল পাওয়া যায় না। নৈনীতাল থেকে অন্যান্য ফল আনবার চেষ্টা করছি। এখানকার দিনগুলি যদিও তীব্র গরম, তবু তৃষ্ণা বোধ করি না। … মোটের উপর, এখানে আমার শক্তি স্ফূর্তি এবং স্বাস্থ্যের প্রাচুর্য আবার ফিরে আসছে বলে অনুভব করছি। তবে খুব বেশী দুগ্ধপানের ফলে বোধ হয় অত্যন্ত চর্বি জমতে শুরু করেছে। যোগেন কি লিখছে, তা ভ্রূক্ষেপ করবে না। সে নিজেও যেমন ভয়-তরাসে, অন্যকেও তাই করতে চায়। আমি লখনৌ-এ একটি বরফির ষোল ভাগের এক ভাগ খেয়েছিলাম; আর যোগেনের মতে ঐ হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ! যোগেন বোধ হয় দু-চারদিনের মধ্যেই এখানে আসবে। আমি তার ভার নেব। ভাল কথা, আমি সহজেই ম্যালেরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ি—আলমোড়ায় এসে প্রথম সপ্তাহ যে অসুস্থ ছিলাম, তা হয় তো তরাই অঞ্চল দিয়ে আসার ফলেই হয়ে থাকবে! যা হোক, বর্তমানে আমি নিজেকে খুবই বলবান্ বোধ করছি। ডাক্তার, আমি যখন আজকাল তুষারবৃত পর্বতশৃঙ্গের সম্মুখে ধ্যানে বসে আবৃত্তি করি—‘ন তস্য রোগো ন জরা ন মৃত্যুঃ, প্রাপ্তস্য হি যোগাগ্নিময়ং শরীরম্।’১২২—সেই সময় যদি তুমি আমায় একবার দেখতে!
রামকৃষ্ণ মিশনের কলিকাতার সভাগুলি বেশ সাফল্য লাভ করছে জেনে খুব সুখী হয়েছি। এই মহৎ কার্যের সহায়ক যাঁরা, তাদের সর্বপ্রকার কল্যাণ হোক। … অসীম ভালবাসা জানবে। ইতি
প্রভুপদাশ্রিত তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৩৯
[শ্রীযুক্ত প্রমদাদাস মিত্রকে লিখিত]
আলমোড়া
৩০ মে, ১৮৯৭
সুহৃদ্বরেষু,
শুনিতেছি, অপরিহার্য সাংসারিক দুঃখ আপনার উপর পড়িয়াছে। আপনি জ্ঞানবান্, দুঃখ কি করিতে পারে? তথাপি ব্যাবহারিকে বন্ধু-জন-কর্তব্যবোধে এ কথার উল্লেখ। অপিচ, ঐ সকল ক্ষণ অনেক সময় সমধিক অনুভব আনয়ন করে। কিয়ৎকালের জন্য যেন বাদল সরিয়া যায় ও সত্যসূর্যের প্রকাশ হয়। কাহারও বা অর্ধেক বন্ধন খুলিয়া যায়। সকল বন্ধন অপেক্ষা মানের বন্ধন বড় দৃঢ়—লোকের ভয় যমের ভয় অপেক্ষাও অধিক; তাও যেন একটু শ্লথ হইয়া পড়ে; মন যেন অন্ততঃ মুহূর্তের জন্য দেখিতে পায় যে, লোকের কথা—মতামত অপেক্ষা অন্তর্যামী প্রভুর কথা শুনাই ভাল। আবার মেঘ ঢাকে, এই তো মায়া! যদিও বহু দিবস যাবৎ মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ সম্বন্ধে পত্রাদি ব্যবহার হয় নাই, তথাপি অন্যের নিকট মহাশয়ের সকল সংবাদই প্রায় প্রাপ্ত হই। মধ্যে মহাশয় কৃপাপূর্বক এক গীতার অনুবাদ ইংলণ্ডে আমায় প্রেরণ করেন। তাহার মলাটে একছত্র ভবৎ-হস্তলিপি মাত্র ছিল। শুনিলাম, তাহার উত্তরপত্রে অতি অল্প কথা থাকায় মহাশয়ের মনে—আপনার প্রতি আমার অনুরাগের সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হইয়াছে।
উক্ত সন্দেহ অমূলক জানিবেন। অল্প কথা লিখিবার কারণ এই যে, চারি-পাঁচ বৎসরের মধ্যে ইংরেজী-গীতার মলাটে ঐ একছত্র মাত্র আপনার হস্তলিপি দেখিলাম। তাহাতে বোধ হইল যে, আপনার যখন অধিক লিখিবার অবকাশ নাই, তখন পড়িবার অবকাশ কি হইবে?
দ্বিতীয়ত শুনিলাম, গৌরচর্মবিশিষ্ট হিন্দুধর্ম-প্রচারকেরই আপনি বন্ধু, দেশী নচ্ছার কালা আদমী আপনার নিকট হেয়, সে ভয়ও ছিল। তৃতীয়তঃ আমি ম্লেচ্ছ শূদ্র ইত্যাদি, যা-তা খাই, যার-তার সঙ্গে খাই—প্রকাশ্যে সেখানে এবং এখানে। তা ছাড়া মতেরও বহু বিকৃতি উপস্থিত—এক নির্গুণ ব্রহ্ম বেশ বুঝিতে পারি, আর তারই ব্যক্তিবিশেষে বিশেষ প্রকাশ দেখিতে পাইতেছি—ঐ-সকল ব্যক্তিবিশেষের নাম ‘ঈশ্বর’ যদি হয় তো বেশ বুঝিতে পারি—তদ্ভিন্ন কাল্পনিক জগৎকর্তা ইত্যাদি হাস্যকর প্রবন্ধে বুদ্ধি যায় না।
ঐ প্রকার ‘ঈশ্বর’ জীবনে দেখিয়াছি এবং তাঁহারই আদেশে চলিতেছি। স্মৃতি-পুরাণাদি সামান্যবুদ্ধি মনুষ্যের রচনা—ভ্রম, প্রমাদ, ভেদবুদ্ধি ও দ্বেষবুদ্ধিতে পরিপূর্ণ। তাহার যেটুকু উদার ও প্রীতিপূর্ণ, তাহাই গ্রাহ্য, অপরাংশ ত্যাজ্য। উপনিষদ্ ও গীতা যথার্থ শাস্ত্র—রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, চৈতন্য, নানক, কবীরাদিই যথার্থ অবতার; কারণ ইঁহাদের হৃদয় আকাশের ন্যায় অনন্ত ছিল—সকলের উপর রামকৃষ্ণ; রামানুজ-শঙ্করাদি সঙ্কীর্ণ-হৃদয় পণ্ডিতজী মাত্র। সে প্রীতি নাই, পরের দুঃখে তাঁহাদের হৃদয় কাঁদে নাই—শুষ্ক পাণ্ডিত্যই—আর আপনি তাড়াতাড়ি মুক্ত হইব!! তা কি হয়, মহাশয়? কখনও হয়েছে, না হবে? ‘আমি’র লেশমাত্র থাকতে কি কিছু হবে?
অপর এক মহা বিপ্রতিপত্তি—আমার দিন দিন দৃঢ় ধারণা [হইতেছে] এই যে, জাতি-বুদ্ধিই মহাভেদকারী ও মায়ার মূল—জন্মগত বা গুণগত সর্বপ্রকার জাতিই বন্ধন। কোন কোন বন্ধু বলেন—তা মনে মনে থাক—বাহিরে, ব্যাবহারিকে, জাতি-আদি রাখিতে হইবে বৈকি। … মনে মনে অভেদবুদ্ধি (‘পেটে পেটে’ যার নাম বুঝি), আর বাহিরে পিশাচ-নৃত্য, অত্যাচার, উৎপীড়ন—গরীবের যম; আর চণ্ডালও যদি বড় মানুষ হয়, তিনি ধর্মের রক্ষক!!!
তাতে আমি পড়ে-শুনে দেখছি যে, ধর্মকর্ম শূদ্রের জন্য নহে; সে যদি খাওয়া-দাওয়া বিচার বা বিদেশগমনাদি বিচার করে তো তাতে কোন ফল নাই, বৃথা পরিশ্রম মাত্র। আমি শূদ্র ও ম্লেচ্ছ—আমার আর ও-সব হাঙ্গামে কাজ কি? আমার ম্লেচ্ছের অন্নে বা কি, আর হাড়ীর অন্নে বা কি? আর জাতি ইত্যাদি উন্মত্ততা—যাজকদের লিখিত গ্রন্থেই পাওয়া যায়, ঈশ্বর-প্রণীত গ্রন্থে নাই। যাজকদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি তাহারাই ভোগ করুন, ঈশ্বরের বাণী আমি অনুসরণ করি, তাহাতেই আমার কল্যাণ হইবে।
আর এক কথা বুঝেছি যে, পরোপকারই ধর্ম, বাকী যাগযজ্ঞ সব পাগলাম—নিজের মুক্তি-ইচ্ছাও অন্যায়। যে পরের জন্য সব দিয়েছে, সে-ই মুক্ত হয়, আর যারা ‘আমার মুক্তি, আমার মুক্তি’ করে দিনরাত মাথা ভাবায়, তাহারা ‘ইতো নষ্টস্ততো ভ্রষ্টঃ’ হয়ে বেড়ায়, তাহাও অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি। এই পাঁচ রকম ভেবে মহাশয়কে পত্রাদি লিখিতে ভরসা হয় নাই।
এ সব সত্ত্বেও যদি আপনার প্রীতি আমার উপর থাকে, বড়ই আনন্দের বিষয় বোধ করিব। ইতি
দাস
বিবেকানন্দঃ
৩৪০*
আলমোড়া
১ জুন, ১৮৯৭
প্রিয়—,
তুমি বেদ সম্বন্ধে যে আপত্তিগুলি প্রদর্শন করেছ, সেগুলি যথার্থ বলে স্বীকার করতে পারা যেত, যদি ‘বেদ’ শব্দে কেবল সংহিতা বোঝাত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতের সর্ববাদিসম্মত মতানুসারে সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও উপনিষদ্ এই তিনটির সমষ্টিই বেদ! এদের মধ্যে প্রথম দুটিকে কর্মকাণ্ড বলে এখন একরকম তুলে দেওয়া হয়েছে। কেবল উপনিষদকেই আমাদের সকল দার্শনিক ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতারা গ্রহণ করেছেন।
কেবল সংহিতা-অংশটিই বেদ, এ মত অতি আধুনিক এবং স্বর্গীয় স্বামী দয়ানন্দই এই মতের প্রথম প্রবর্তক! প্রাচীন হিন্দুসমাজের ভেতর এই মতের প্রভাব কিছুমাত্র বিস্তৃত হয়নি।
স্বামী দয়ানন্দের এই মত অবলম্বন করবার কারণ এই যে, তিনি, ভেবেছিলেন, সংহিতার নূতন ধরনের ব্যাখ্যা করে তিনি একটি পূর্বাপরসঙ্গত মতবাদের সৃষ্টি করবেন, কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা-প্রণালীতে গোল সমভাবেই থেকে গেল; শুধু এইটুকু হল যে, তিনি সংহিতার ভেতর যে অসামঞ্জস্য নিবারণের চেষ্টা করলেন, সেই অসামঞ্জস্য—সেই গোলযোগ ‘ব্রাহ্মণে’র উপর গিয়ে পড়ল। আর তাঁর প্রক্ষিপ্তবাদ ও অন্যান্য ব্যাখ্যা-প্রণালী সত্ত্বেও এখনও এমন অনেক স্থল আছে, যার ভেতর গোল তখনও যেমন, এখনও তেমনি রয়েছে।
যদি সংহিতার উপর ভিত্তি করে পূর্বাপর সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ধর্মপ্রণালী গঠন করা সম্ভব হয়, তবে উপনিষদকে ভিত্তি করে যে আরও অনেক বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ ধর্ম স্থাপন করা যেতে পারে, এ-কথা সহস্রগুণে বেশী নিশ্চিত। অধিকন্তু এ পক্ষে সমগ্র জাতির পূর্বপ্রচলিত মতের বিরুদ্ধে যেতে হয় না। এ পক্ষে প্রাচীন সকল আচার্যই তোমার পক্ষে থাকবেন, আর নূতন নূতন পথে অগ্রগতিরও যথেষ্ট অবকাশ থাকবে।
গীতা নিশ্চয়ই এতদিনে হিন্দুধর্মের বাইবেল-স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং উহা সম্পূর্ণরূপেই ঐ সম্মানের উপযুক্ত; কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের মূল চরিত্র বর্তমানে এতটা কুয়াশায় ঢেকে আছে যে, তা থেকে জীবনপ্রদ উদ্দীপনা লাভ করা বর্তমান কালে অসম্ভব। বিশেষতঃ বর্তমান যুগে নূতন নূতন চিন্তাপ্রণালী ও নূতন ভাবে জীবনযাত্রা-নির্বাহের প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। আশা করি, আমার এই ক্ষুদ্র পত্র তোমায় আমার প্রদর্শিত পথে চিন্তার সাহায্য করবে। আমার শুভার্শীবাদ জানবে। ইতি
তোমারই
বিবেকানন্দ
৩৪১
[[স্বামী শুদ্ধানন্দকে লিখিত]]
ওঁ তৎ সৎ
আলমোড়া
১ জুন, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
অবগমং কুশলং তত্রাত্যানাং বার্তাঞ্চ সবিশেষাং মঠস্য তব পত্রিকায়াম্। মমাপি বিশেষোঽস্তি শরীরস্য; সবিশেষঃ জ্ঞাতব্যঃ ভিষক্প্রবরস্য শশিভূষণস্য সকাশাৎ। ব্রহ্মানন্দেন সংস্কৃতয়া এব রীত্যা চলত্বধুনা শিক্ষা; যদি পশ্চাৎ পরিবর্তনমর্হে তদপি কারয়েৎ। সর্বেষাং সম্মতিং গৃহীত্বা তু করণীয়মিতি ন বিস্মর্তব্যম্।
অহমধুনা আলমোড়ানগরস্য কিঞ্চিদুত্তরং কস্যচিদ্ বণিজ উপবনোপদেশে নিবসামি। সম্মুখে হিমশিখরাণি হিমালয়স্য প্রতিফলিতদিবাকরকরৈঃ পিণ্ডীকৃতরজতানীব ভান্তি প্রীণয়ন্তি চ। অব্যাহতবায়ুসেবনেন মিতেন ভোজনেন সমধিকব্যায়ামসেবয়া চ সুদৃঢ়ং সুদৃশ্যং চ সঞ্জাতং মে শরীরম্। যোগানন্দঃ খলু সমধিকমস্বস্থ ইতি শৃণোমি আমন্ত্রয়ামি তমাগন্তুমত্রৈব। বিভেত্যসৌ পুনঃ পার্বত্যাৎ জলাৎ বায়োশ্চ। ‘উষিত্বা কতিপয়ানি দিবসানি অত্রোপবনে যদি ন তাবদ্ বিশেষঃ ব্যাধেঃ গচ্ছ ত্বং কলিকাতায়াম্’ ইত্যহমদ্য তমলিখম্। যথাভিরুচি করিষ্যতি। অচ্যুতানন্দঃ প্রতিদিনং সায়াহ্ণে আলমোড়ানগর্যাং গীতাদিশাস্ত্রপাঠং জনানাহূয় করোতি। বহূনাং নগরবাসিনাং স্কন্ধাবারস্থানাং সৈন্যানাঞ্চ সমাগমোঽস্তি তত্র প্রত্যহম্। সর্বানসৌ প্রীণাতি চেতি শৃণোমি।
‘যাবানর্থঃ ইত্যাদি শ্লোকস্য যো বঙ্গার্থঃ ত্বয়া লিখিতঃ নাসৌ মন্মতে সমীচীনঃ। সতি জলে প্লাবিতে উদপানে নাস্তি অর্থঃ প্রয়োজনম্’ ইতি অস্যার্থঃ—বিষমোঽয়ম্ উপন্যাসঃ, কিং সংপ্লুতোদকে সতি জীবানাং তৃষ্ণা বিলুপ্তা ভবতি? যদ্যেবং ভবেৎ প্রাকৃতিকো নিয়মঃ জলপ্লাবিতায়াং ভূমৌ জলপানং নিরর্থকং—ক্বচিদপি বায়ুমার্গেণ অথবা অন্যেন কেনাপি গূঢ়েনোপায়েন জীবানাং তৃষ্ণানিবারণং স্যাৎ, তদাঽসৌ অপূর্বং অর্থঃ সার্থকঃ ভবিতুমর্হেৎ। নান্যথা। শাঙ্কর এবাবলম্বনীয়ঃ।
ইয়মপি [ব্যাখ্যা] ভবিতুমর্হতি—সর্বতঃ সংপ্লুতোদকায়ামপি ভূমৌ যাবানুদপানে অর্থঃ তৃষ্ণাতুরাণাম্ (অল্পজলমলং ভবেদিত্যর্থঃ) ‘আস্তাং তাবদ্ জলরাশিঃ, মম প্রয়োজনং স্বল্পেঽপি জলে সিধ্যতি’ এবং বিজানতঃ ব্রাহ্মণস্য সর্বেষু বেদেষু অর্থঃ প্রয়োজনম্। যথা সংপ্লুতোদকে পানমাত্রং প্রয়োজনম্ তথা সর্বেষু বেদেষু জ্ঞানমাত্রং প্রয়োজনম্।
ইয়মপি ব্যাখ্যা অধিকতরা সন্নিধিমাপন্না গ্রন্থকারাভিপ্রেতা চ। উপপ্লাবিতায়ামপি ভূমৌ পানায় উপাদেয়ং পানায় হিতং জলমেব অন্বিষ্যন্তি লোকাঃ নানাৎ। নানাবিধানি জলানি সন্তি ভিন্নগুণ-ধর্মাণি উপপ্লাবিতায়া অপি ভূমেস্তারতম্যাৎ। এবং বিজানন্ ব্রাহ্মণো্ঽপি বিবিধজ্ঞানোপপ্লাবিতে বেদাখ্যে শব্দসমুদ্রে সংসারতৃষ্ণানিবারণার্থং তদেব গৃহ্নীয়াৎ যদলং ভবতি নিঃশ্রেয়সায়। ব্রহ্মজ্ঞানং হি তৎ।
ইতি শং সাশীর্বাদং বিবেকানন্দস্য
[বঙ্গানুবাদ]
কল্যাণবরেষু,
তোমার চিঠিতে মঠের সবিশেষ বার্তা ও তত্রত্য সকলের কুশল অবগত হলাম। আমারও শরীরের কিছু উন্নতি হয়েছে। ভিষক্প্রবর শশিভূষণের কাছে সবিশেষ জানবে। ব্রহ্মানন্দ এখন সংশোধিত প্রস্তাবমতই শিক্ষাকার্য চালিয়ে যাক, পরে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তাও যেন করে। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে, সকলের সম্মতি নিয়েই তা করতে হবে।
আমি বর্তমানে আলমোড়া থেকে কিঞ্চিৎ উত্তরে একজন ব্যবসায়ীর একটি বাগান- বাড়ীতে বাস করছি। আমার সম্মুখে তুষারাচ্ছন্ন হিমালয়ের চূড়াগুলি প্রতিফলিত সূর্যালোকে রজতস্তূপের মত দেখাচ্ছে এবং আনন্দ প্রদান করছে। মুক্তবায়ু-সেবন, মিতাহার এবং যথেষ্ট ব্যায়ামের ফলে আমার শরীর বিশেষ সুদৃঢ় ও সুদৃশ্য হয়েছে। কিন্তু শুনতে পেলাম যে, যোগানন্দ খুব অসুস্থ। তাকে এখানে আসবার জন্য আমন্ত্রণ করছি। সে অবশ্য পাহাড়ে জলহাওয়ায় ভয় পায়। আজ তাকে লিখলাম, ‘এই বাগানে কিছুদিন থেকে দেখ—যদি অসুখের কোন উপশম বোধ না কর, তবে কলিকাতা ফিরে যেও।’—এখন সে যেমন ভাল মনে করে, তাই করবে। আলমোড়া শহরে অচ্যুতানন্দ প্রতি সন্ধ্যায় বহুলোক একত্র করে তাদের সম্মুখে গীতা এবং অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করে। শহরের অনেক অধিবাসী, এমন কি সৈন্যাবাস থেকে সৈন্যেরা পর্যন্ত প্রতিদিন আসে; আর শুনছি, তারা আলোচনা বিশেষ উপভোগ করে।
‘যাবানর্থ উদপানে সর্বতঃ স্বংপ্লুতোদকে’ (গীতা, ২।৪৬)—ইত্যাদি শ্লোকের তুমি যে বঙ্গার্থ লিখেছ, তা আমার মতে সমীচীন নয়। তুমি এই অর্থ দিয়েছ—‘যখন দেশ জলপ্লাবিত হয়, তখন পানের জন্য পুষ্করিণী প্রভৃতির প্রয়োজন নাই’—এটা অদ্ভুত কল্পনা। জলপ্লাবন হলে লোকের তৃষ্ণা বিলুপ্ত হয়ে যায় নাকি? প্রাকৃতিক নিয়ম যদি এরূপ হয় যে, কোন স্থান জলপ্লাবিত হবার পর জল পান নিরর্থক হয়ে যায়, আর বায়ু অথবা কোন অদৃশ্য উপায়ে স্বতই তৃষ্ণা দূরীভূত হয়ে যায়—তবেই ঐ অদ্ভুত ব্যাখ্যা সমীচীন হতে পারে, নতুবা নয়। শঙ্করের ব্যাখ্যাই অনুসরণীয়।
অথবা এ ভাবেও শ্লোকটির ব্যাখ্যা হতে পারেঃ সমস্ত দেশ বন্যাপ্লাবিত হলে তৃষ্ণাতুরের নিকট ক্ষুদ্র জলাশয়ের যতটুকু প্রয়োজন (অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ পানীয় জলই তৃষ্ণার্তের পক্ষে যথেষ্ট)—সে যেমন বলে, ‘বিরাট জলরাশি থাকুক বা না থাকুক, সামান্য একটু পানীয় জলই আমার পক্ষে যথেষ্ট’—জ্ঞানী ব্রাহ্মণের পক্ষে সমগ্র বেদগ্রন্থেও ততটুকুই প্রয়োজন। সর্বব্যাপী বন্যার প্রয়োজন যেমন তৃষ্ণানিবারণ মাত্র, তেমনি সমগ্র বেদের প্রয়োজন কেবল জ্ঞান।
এই ব্যাখ্যাটিও অধিকতর স্পষ্ট ও গ্রন্থকারের অভিপ্রায়ানুরূপ—সমস্ত স্থান জলপ্লাবিত হলে মানুষ কেবল পানের জন্য আহরণীয়, পানের যোগ্য জলেরই অনুসন্ধান করে, অন্য জলের নয়। (কারণ) জলপ্লাবন হলেও মৃত্তিকার তারতম্যানুসারে বিভিন্ন গুণের ও বিভিন্ন ধর্মের জল দেখতে পাওয়া যায়। কৌশলী ব্রাহ্মণও সেরূপ জ্ঞানের শতধারাপ্লাবিত ‘বেদ’ নামে খ্যাত বিরাট শব্দসমুদ্র হতে সেই অংশটুকু আহরণ করবেন, যাতে সংসারের দারুণ তৃষ্ণা দূর হয় এবং যা মুক্তি দান করবার শক্তি ধারণ করে। কেবল ব্রহ্মজ্ঞানই তা করতে সক্ষম। আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা জানবে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৪২*
[মেরী হেলবয়েস্টারকে লিখিত]
আলমোড়া
২ জুন, ১৮৯৭
স্নেহের মেরী,
আমার প্রতিশ্রুত খোশগল্পভরা বড় চিঠিখানি শুরু করছি—আকারে তা সত্যি বড় হয়ে উঠুক, এই সদিচ্ছা নিয়ে। তা যদি না হয়ে ওঠে, সে তোমার কর্মফল। তোমার স্বাস্থ্য নিশ্চয়ই খুব ভাল যাচ্ছে। আমার শরীর খুবই খারাপ; আজকাল কিছুটা উন্নতি বোধ করছি—আশা করি খুব শীঘ্রই সেরে উঠব।
লণ্ডনের কাজকর্ম কি রকম চলছে? আমার ভয় হচ্ছে, বুঝি বা সেটা একেবারে ভেঙেচুরে যায়। তুমি মাঝে মাঝে লণ্ডন যাও তো? স্টার্ডির একটি শিশুসন্তান হয়েছে, নয় কি?
ভারতে সমতলভূমিতে এখন দাবদাহ। তা সহ্য করতে না পেরে এখানে এই পাহাড়ে এসেছি—জায়গাটা সমতলের চেয়ে কিছু ঠাণ্ডা।
আলমোড়ার কোন ব্যবসায়ীর একটি চমৎকার বাগানে আছি—এর চারিদিকে বহু ক্রোশ পর্যন্ত পর্বত ও অরণ্য। পরশু রাত্রে একটি চিতাবাঘ এই বাগানে এসে পাল থেকে একটি ছাগল নিয়ে গেছে। চাকরদের প্রাণপণ চেঁচামেচি ও পাহারাদার তিব্বতী কুকুরগুলির ঘেউ ঘেউ শব্দ মিলে ভয়ে প্রাণ ঠাণ্ডা হবার মত অবস্থা ঘটেছিল। আমি এখানে আসা অবধি রোজ রাত্রে এই কুকুরগুলিকে বেশ কিছুটা দূরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে, যাতে তাদের চেঁচামেচিতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। চিতাবাঘটি তাই সুযোগ বুঝে একটি বেশ ভাল আহার্য জুটিয়ে নিল, সম্ভবতঃ অনেক সপ্তাহ এ-রকম জোটেনি। এতে তার প্রভূত কল্যাণ হোক!
মিস মূলারকে তোমার মনে পড়ে কি? কয়েকদিন থাকবার জন্য তিনি এখানে এসেছেন, কিন্তু চিতাবাঘের বৃত্তান্তটি শুনে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে যে, লণ্ডনে পাকা চামড়ার চাহিদা খুব বেশী, আর অন্য কিছুর চেয়ে এই চাহিদাই আমাদের চিতা ও বাঘগুলির মধ্যে ব্যাপক ধ্বংস নিয়ে এসেছে।
তোমাকে লিখতে লিখতে আমার সামনে সারি সারি দিগন্তবিস্তৃত বরফের চূড়াগুলির উপর অপরাহ্নের রক্তিমাভা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। সেগুলি এখান থেকে সোজাসুজি কুড়ি মাইল—আর আঁকাবাঁকা পার্বত্য পথে চল্লিশ মাইল।
আশা করি কাউণ্টেস-এর কাগজে তোমার তর্জমাগুলি সমাদরে গৃহীত হয়েছে। এই জুবিলী-উৎসবের মরসুমে আমাদের দেশীয় কয়েকজন রাজার সঙ্গে আমার ইংলণ্ড যাবার খুব ইচ্ছা ছিল এবং সুযোগও ঘটেছিল, কিন্তু আমার চিকিৎসকেরা এত শীঘ্র আমাকে কাজে নামতে দিতে নারাজ। কারণ ইওরোপ যাওয়া মানে কাজে লাগা। তাই নয় কি? সেখানে ছুটি মেলে রুটি মেলে না। এখানে গেরুয়া-কাপড়খানাই যথেষ্ট, অঢেল খাবার মিলবে। যা হোক, আমি এখন বহুপ্রত্যাশিত বিশ্রাম উপভোগ করছি, আশা করি—এতে আমার পক্ষে ভালই হবে।
তোমার কাজ কিরকম চলছে? আনন্দে না দুঃখে? তোমার কি ইচ্ছা হয় না বেশ কয়েক বছর কোন কাজকর্ম না করে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে? নিদ্রা আহার ব্যায়াম এবং ব্যায়াম আহার নিদ্রা—আরও কয়েক মাস শুধু এই করে আমি কাটাতে যাচ্ছি। মিঃ গুডউইন আমার সঙ্গে আছেন। ভারতীয় পোষাকে তুমি যদি তাকে দেখতে! খুব শীঘ্রই মস্তক মুণ্ডন করিয়ে তাকে একটি পূর্ণ-বিকশিত সন্ন্যাসীতে পরিণত করতে যাচ্ছি।
তুমি এখনও কিছু কিছু যোগাভ্যাস করছ নাকি? তাতে কিছু উপকার পেয়েছ কি? খবর পেলাম—মিঃ মার্টিন মারা গিয়েছেন। মিসেস মার্টিন কেমন আছেন—তাঁকে মাঝে মাঝে দেখতে যাও তো?
মিস নোব্ল্কে তুমি চেন কি? তাঁকে তুমি কখনও দেখেছ? এখানেই আমার চিঠি শেষ করতে হচ্ছে, কারণ বিরাট এক ধূলির ঝড় আমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, লেখা আর সম্ভব হচ্ছে না। এ-সবই তোমার কর্মফল, স্নেহের মেরী, কারণ আমার তো ইচ্ছা ছিল—তোমাকে কত না অদ্ভুত ঘটনা লিখব ও মজার গল্প বলব; এখন সেগুলি আমাকে ভবিষ্যতের জন্য জমা রাখতে হবে, আর তোমাকেও অপেক্ষা করে থাকতে হবে। ইতি
সতত প্রভুসমীপে তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৪৩*
আলমোড়া
৩ জুন, ১৮৯৭
কল্যাণীয়া মিস নোব্ল্,
… আমি নিজে তো বেশ সন্তুষ্ট আছি। আমি আমার স্বদেশবাসীদের অনেককে জাগিয়েছি; আর আমি চেয়েছিলাম তাই। জগৎ আপন ধারায় চলুক এবং কর্মের গতি অপ্রতিরুদ্ধ হোক। এ জগতে আমার আর কোন বন্ধন নেই। সংসারের সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় হয়েছে, এর সবখানিই স্বার্থপ্রণোদিত—স্বার্থের জন্য জীবন, স্বার্থের জন্য প্রেম, স্বার্থের জন্য মান, সবই স্বার্থের জন্য। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করি এবং দেখতে পাই, আমি এমন কোন কাজ করিনি যা স্বার্থের জন্য—এমন কি আমার কোন অপকর্মও স্বার্থপ্রণোদিত নয়; সুতরাং আমি সন্তুষ্ট আছি। অবশ্য আমার এমন কিছু মনে হয় না যে, আমি কোন বিশেষ ভাল বা মহৎ কাজ করেছি; কিন্তু জগৎটা বড়ই তুচ্ছ, সংসার বড়ই জঘন্য এবং জীবনটা এতই হীন যে, এই ভেবে আমি অবাক হই, মনে মনে হাসি যে, যুক্তিপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও মানুষ কেমন করে এই স্বার্থের—এই হীন ও জঘন্য পুরস্কারের পেছনে ছুটতে পারে।
এই হল খাঁটি কথা। আমরা একটা বেড়াজালে পড়ে গেছি এবং যত শীঘ্র কেউ বেরিয়ে যেতে পারে, ততই মঙ্গল। আমি সত্যের সাক্ষাৎ পেয়েছি; এখন দেহটা জোয়ার-ভাটায় ভেসে চলুক—কে মাথা ঘামায়?
আমি এখন যেখানে আছি, সেটি পাহাড়ের উপর এক সুন্দর বাগান। উত্তরে প্রায় সমস্ত দিক্চক্রবাল জুড়ে স্তরে স্তরে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়ের তুষারশৃঙ্গাবলী আর নিবিড় বনরাজি। এখানে তেমন শীত নেই, গরমও বেশী নয়। সকাল ও সন্ধ্যাগুলি বড়ই মনোরম। সারা গ্রীষ্মটা আমার এখানে থাকা উচিত; বর্ষা শুরু হলে সমতলে নেমে গিয়ে কাজ করবার ইচ্ছা।
লোকালয় থেকে দূরে—নিভৃতে নীরবে পুঁথিপত্র নিয়ে পড়ে থাকার সংস্কার নিয়েই আমি জন্মেছি, কিন্তু মায়ের ইচ্ছা অন্যরূপ; তবু সংস্কারের অনুবৃত্তি চলেছে। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৪৪*
[জনৈক আমেরিকান ভক্তকে লিখিত]
আলমোড়া
৩ জুন, ১৮৯৭
আমার জন্য তোমাদের এত চিন্তিত হবার কিছুই নেই। আমার দেহ নানাপ্রকার রোগে বার বার আক্রান্ত হচ্ছে এবং সেই কাল্পনিক পক্ষীবিশেষের (Phoenix) মত আমি আবার বার বার আরোগ্য লাভও করছি। আমার শরীর দৃঢ়বদ্ধ বলে আমি যেমন শীঘ্র আরোগ্য লাভ করতে পারি, তেমনি আবার অতিরিক্ত শক্তি আমার দেহে রোগ নিয়ে আসে। সব বিষয়েই আমি চরমপন্থী—এমন কি আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কেও তাই; হয় আমি লৌহদৃঢ় বৃষের মত অদম্য বলশালী, নতুবা একেবারে ভগ্নদেহ … ।
অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্যই এই রোগের সৃষ্টি হয়েছিল—বিশ্রাম নেওয়ার ফলে সে রোগ প্রায় দূর হয়েছে। দার্জিলিঙে থাকতে আমি সম্পূর্ণ রোগমুক্ত হয়েছিলাম; কিন্তু এখন আলমোড়াতে এসে আর সব বিষয়ে সুস্থ বোধ করলেও অজীর্ণরোগে মাঝে মাঝে ভুগছি, এবং তা সারাবার জন্য 'Christian Science' (নিজের বিশ্বাসবলে রোগ সারানর) মত অনুযায়ী বিশেষ চেষ্টাও করছি। দার্জিলিঙে শুধু মানসিক চিকিৎসা-সহায়েই আমি নীরোগ হয়েছিলাম। আর এখানে আমার নিত্যকর্ম হচ্ছে—যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম করা, পাহাড় চড়াই করা, বহুদূর পর্যন্ত ঘোড়ায় দৌড়ান এবং তারপর আহার ও বিশ্রাম। এখন আমি আগের চেয়ে অনেক সুস্থ বোধ করছি এবং শক্তিও বেশ পাচ্ছি। এর পর যখন দেখা হবে, তখন দেখতে পাবে—আমার চেহারা কুস্তিগিরের মত।
তুমি কেমন আছ এবং কি করছ, মিসেস-এর সময় কেমন কাটছে জানিও। ব্যাঙ্কের জমা কিছু কিছু বাড়াচ্ছ তো? আমার জন্য হলেও তা তোমাকে করতে হবে। যদি শেষ পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তাহলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে—কেমন পারবে তো? ইতি
বিবেকানন্দ
৩৪৫
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
১৪ জুন, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
চারুর যে পত্র তুমি পাঠাইয়াছ, তাহার বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। মহারাণীকে যে Address (মানপত্র) দেওয়া হইবে, তাহাতে এই কথাগুলি থাকা উচিতঃ
১| অতিরঞ্জিত না হয় অর্থাৎ ‘তুমি ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ ইত্যাদি nonsense (বাজে কথা), যাহা আমাদের native (নেটিভ)-এর স্বভাব।
২| তাঁহার রাজত্বকালে সকল ধর্মের প্রতিপালন হওয়ার জন্য ভারতবর্ষে ও ইংলণ্ডে আমরা নির্ভয়ে আমাদের বেদান্ত মত প্রচার করিতে সক্ষম হইয়াছি।
৩| তাঁহার দরিদ্র ভারতবাসীর প্রতি দয়া, যথা—দুর্ভিক্ষে স্বয়ং দান দ্বারা ইংরেজদিগকে অপূর্ব দানে উৎসাহিত করা।
৪| তাঁহার দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা ও তাঁহার রাজ্যে উত্তরোত্তর প্রজাদের সুখসমৃদ্ধি প্রার্থনা।
শুদ্ধ ইংরেজীতে লিখিয়া আমায় আলমোড়ার ঠিকানায় পাঠাইবে। আমি সই করিয়া সিমলায় পাঠাইব। কাহাকে পাঠাইতে হইবে সিমলায়—লিখিবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—মঠ হইতে শুদ্ধানন্দ আমায় সাপ্তাহিক পত্র লিখে, তাহার একটা নকল যেন মঠে রাখে। ইতি
—বি
৩৪৬
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
১৫ জুন, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
তোমার সবিশেষ সংবাদ পাইতেছি ও উত্তরোত্তর আনন্দিত হইতেছি। ঐরূপ কার্যের দ্বারাই জগৎ কিনিতে পারা যায়। মতমতান্তরে আসে যায় কি? সাবাস্—তুমি আমার লক্ষ লক্ষ আলিঙ্গন আশীর্বাদাদি জানিবে। কর্ম কর, কর্ম, হাম আওর কুছ্ নহি মাঙ্গতে হেঁ—কর্ম কর্ম কর্ম even unto death (মৃত্যু পর্যন্ত)। দুর্বলগুলোর কর্মবীর মহাবীর হতে হবে—টাকার জন্য ভয় নাই, টাকা উড়ে আসবে। টাকা, যাদের লইবে, তারা নিজের নামে দিক্, হানি কি? কার নাম—কিসের নাম? কে নাম চায়? দূর কর নামে। ক্ষুধিতের পেটে অন্ন পৌঁছাতে যদি নাম ধাম সব রসাতলেও যায়, অহোভাগ্য-মহোভাগ্যম্। … ভ্যালা মোর ভাইরে, অ্যায়সাই চলো। It is the heart, that conquers, not the brain (হৃদয়, শুধু হৃদয়ই জয়ী হয়ে থাকে—মস্তিষ্ক নয়)। পুঁথিপাতড়া বিদ্যেসিদ্যে, যোগ ধ্যান জ্ঞান—প্রেমের কাছে সব ধূলসমান—প্রেমেই অণিমাদি সিদ্ধি, প্রেমেই ভক্তি, প্রেমেই জ্ঞান, প্রেমেই মুক্তি। এই তো পুজো, নরনারী-শরীরধারী প্রভুর পুজো, আর যা কিছু ‘নেদং যদিদমুপাসতে’। এই তো আরম্ভ ঐরূপে আমরা ভারতবর্ষ—পৃথিবী ছেয়ে ফেলব না? তবে কি প্রভুর মাহাত্ম্য!
লোকে দেখুক, আমাদের প্রভুর পাদস্পর্শে লোকে দেবত্ব পায় কিনা! এরই নাম জীবন্মুক্তি, যখন সমস্ত ‘আমি’—স্বার্থ চলে গেছে।
ওয়া বাহাদুর, গুরুকী ফতে! ক্রমে বিস্তারের চেষ্টা কর। তুমি যদি পার তো কলিকাতায় এসে আরও কতকগুলো ছেলেপুলে নিয়ে একটা ফণ্ড তুলে তাদের দু-একজনকে নিয়ে কাজে লাগিয়ে এক জায়গায়—আবার এক জায়গায় যাও! ঐ রকমে বিস্তার কর আর তাদের তুমি inspect (তত্ত্বাবধান) করে বেড়াও—ক্রমে দেখবে যে, ঐ কার্যটা permanent (স্থায়ী) হবে—সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম ও বিদ্যাপ্রচার আপনা-আপনিই হবে। আমিই কলিকাতাতে বিশেষ লিখেছি। ঐ রকম কাজ করলেই আমি মাথায় করে নাচি—ওয়া বাহাদুর! ক্রমে দেখবে এক-একটা ডিষ্ট্রিক্ট (জেলা) এক-একটা centre (কেন্দ্র) হবে—permanent (স্থায়ী)। আমি শীঘ্রই plain-এ (সমতলে) নাবছি। বীর আমি, যুদ্ধক্ষেত্রে মরব, এখানে মেয়েমানুষের মত বসে থাকা কি আমার সাজে? ইতি
তোমাদের চিরপ্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩৪৭*
আলমোড়া
২০ জুন, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
… তোমাকে সরলভাবে জানাচ্ছি যে, তোমার প্রত্যেকটি কথা আমার কাছে মূল্যবান, তোমার প্রত্যেকখানি চিঠি আমাকে খুবই আনন্দ দেয়। যখনই ইচ্ছা ও সুযোগ হবে, তখনই তুমি নিঃসঙ্কোচে লিখো এবং জেনো যে, তোমার একটি কথাও আমি ভুল বুঝব না, একটি কথাও উপেক্ষা করব না। অনেক কাল কাজের কোন খবর পাইনি। তুমি আমায় কিছু জানাতে পার কি? ভারতে আমাকে নিয়ে যতই মাতামাতি করুক না কেন, আমি এখানে কোন সাহায্যের আশা রাখি না। এরা এত দরিদ্র!
তবে আমি নিজেও যেভাবে শিক্ষালাভ করেছিলাম, ঠিক সেইভাবেই গাছের তলা আশ্রয় করে এবং কোনরকমে অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করে কাজ শুরু করে দিয়েছি। কাজের ধারাও অনেকটা বদলেছে। আমার কয়েকটি ছেলেকে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত অঞ্চলে পাঠিয়েছি। এতে যাদুমন্ত্রের মত কাজ হয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আর আমার চিরকালের ধারণাও ছিল তাই যে, হৃদয়—শুধু হৃদয়েরই ভেতর দিয়ে সকলের মর্মস্থল স্পর্শ করতে পারা যায়। সুতরাং বর্তমান পরিকল্পনা এই যে, বহু যুবককে গড়ে তুলতে হবে—(উচ্চশ্রেণীকে নিয়েই আরম্ভ করব, নিম্নশ্রেণীকে নিয়ে নয়; ওদের জন্য আমায় একটু অপেক্ষা করতে হবে)—এবং কোন একটি জেলায় তাদের জনকয়েককে পাঠিয়ে দিয়ে আমার প্রথম অভিযান শুরু করব। ধর্মরাজ্যের এই অগ্রগামী কর্মিগণ যখন পথ পরিষ্কার করে ফেলবে, তখন তত্ত্ব ও দর্শন বলার সময় আসবে।
জনকয়েক ছেলে ইতোমধ্যেই শিক্ষা পাচ্ছে; কিন্তু কাজের জন্য যে জীর্ণ আশ্রয়টি১২৩ আমরা পেয়েছিলাম, গত ভূমিকম্পে তা ভেঙে গেছে; তবে বাঁচোয়া একটু যে, এটা ভাড়া-বাড়ী ছিল। যাক, ভাববার কিছু নেই; বিপত্তি ও নিরাশ্রয়তার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এ পর্যন্ত আমাদের সম্বল শুধু মুণ্ডিত মস্তক, ছেঁড়া কাপড় ও অনিশ্চিত আহার। কিন্তু এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবেও নিশ্চয়; কারণ আমরা মনে-প্রাণে এই কাজে লেগেছি।
এক হিসাবে এটা সত্য যে, এদেশের লোকের ত্যাগ করবার কিছু নেই বললেই চলে, তবু ত্যাগ আমাদের মজ্জাগত। যে-সব ছেলেরা শিক্ষা পাচ্ছে, তাদের একজন একটি জেলার ভারপ্রাপ্ত একজিকিউটিভ ইঞ্জিনীয়ার (Executive Engineer) ছিল। ভারতে এটি একটি উচ্চ পদ। সে খড়কুটোর মত ঐ পদ ত্যাগ করেছে। … আমার অসীম ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের সত্যাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩৪৮
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২০ জুন, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার শরীর পূর্বাপেক্ষা ভাল আছে শুনিয়া সুখী হইলাম। যোগেন ভায়ার কথাবার্তা? তিনি সঠিকে কন না, এজন্য সে-সকল শুনে কোন চিন্তা করিও না। আমি সেরেসুরে গেছি। শরীরে জোরও খুব; তৃষ্ণা নাই, আর রাত্রে উঠিয়া প্রস্রাব বন্ধ। … কোমরে বেদনা-ফেদনা নাই; লিভারও ভাল। শশীর ঔষধে কি ফল হল বুঝতে পারলাম না—কাজেই বন্ধ। আম খুব খাওয়া যাচ্ছে। ঘোড়াচড়াটা বেজায় রপ্ত হচ্ছে—কুড়ি-ত্রিশ মাইল একনাগাড়ে দৌড়ে গিয়েও কিছুমাত্র বেদনা বা exhaustion (অবসাদ) হয় না। দুধ একদম বন্ধ করেছি—পেট মোটার ভয়ে। কাল আলমোড়ায় এসেছি। আর বাগানে যাব না। … বাড়ী ভাড়া-টাড়া যা করতে হয় করবে; এতে আর অত জিজ্ঞাস-পড়া কি করবে!
শুদ্ধানন্দ লিখছে—কি Ruddock's Practice of Medicine পাঠ হচ্ছে। ও-সব কি nonsense (বাজে জিনিষ) ক্লাসে পড়ান? একসেট Physics (পদার্থবিদ্যা) আর Chemistry-র (রসায়নের) সাধারণ যন্ত্র ও একটা সাধারণ telescope (দূরবীক্ষণ) ও একটা microscope (অণুবীক্ষণ) ১৫০|২০০ টাকার মধ্যে সব হবে। শশীবাবু সপ্তাহে একদিন এসে Chemistry Practical (ফলিত রসায়ন)-এর উপর লেকচার দিতে পারেন ও হরিপ্রসন্ন Physics ইত্যাদির ওপর। আর বাঙলা ভাষায় যে-সকল উত্তম Scientific (বিজ্ঞান-সম্বন্ধীয়) পুস্তক আছে, তা সব কিনবে ও পাঠ করাবে। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
৩৪৯
[শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
৩ জুলাই, ১৮৯৭
যস্য বীর্যেণ কৃতিনো বয়ং চ ভুবনানি চ।
রামকৃষ্ণং সদা বন্দে শর্বং স্বতন্ত্রমীশ্বরম্||
‘প্রভবতি ভগবান্ বিধি’-রিত্যাগমিনঃ অপ্রয়োগনিপুণাঃ প্রয়োগনিপুণাশ্চ পৌরুষং বহুমন্যমানাঃ। তয়োঃ পৌরুষাপৌরুষেয়প্রতীকারবলয়োঃ বিবেকাগ্রহনিবন্ধনঃ কলহ ইতি মত্বা যতস্বায়ুষ্মন্ শরচ্চন্দ্র আক্রমিতুম্ জ্ঞানগিরিগুরোর্গরিষ্ঠং শিখরম্।
যদুক্তং ‘তত্ত্বনিকষগ্রাবা বিপদিতি’ উচ্যেত তদপি শতশঃ; ‘তৎ ত্বমসি’ তত্ত্বাধিকারে। ইদমের তন্নিদানং বৈরাগ্যরুজঃ। ধন্যং কস্যাপি জীবনং তল্লক্ষণাক্রান্তস্য। অরোচিষ্ণু অপি নির্দিশামি পদং প্রাচীনং—‘কালঃ কশ্চিৎ প্রতীক্ষ্যতাম্’ ইতি। সমারূঢ়ক্ষেপণীক্ষেপণশ্রমঃ বিশ্রাম্যতাং তন্নির্ভরঃ। পূর্বাহিতো বেগঃ পারং নেষ্যতি নাবম্। তদেবোক্তং—‘তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।’ ‘ন ধনেন ন প্রজয়া ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’ ইত্যত্র ত্যাগেন বৈরাগ্যমেব লক্ষ্যতে। তদ্বৈরাগ্যং বস্তুশূন্যং বস্তুভূতং বা। প্রথমং যদি, ন তত্র যতেত কোঽপি কীটভক্ষিতমস্তিষ্কে বিনা; যদ্যপরং তদেদম্ আপততি—ত্যাগঃ মনসঃ সঙ্কোচনম্ অন্যস্মাৎ বস্তুনঃ, পিণ্ডীকরণঞ্চ ঈশ্বরে বা আত্মনি। সর্বেশ্বরস্তু ব্যক্তিবিশেষো ভবিতুং নার্হতি, সমষ্টিরিত্যেব গ্রহণীয়ম্। আত্মেতি বৈরাগ্যবতো জীবাত্মা ইতি নাপদ্যতে, পরন্তু সর্বগঃ সর্বান্তর্যামী সর্বস্যাত্মরূপেণাবস্থিতঃ সর্বেশ্বর এব লক্ষ্যীকৃতঃ। স তু সমষ্টীরূপেণ সর্বেষাং প্রত্যক্ষঃ। এবং সতি জীবেশ্বরয়োঃ স্বরূপতঃ অভেদভাবাৎ তয়োঃ সেবাপ্রেমরূপকর্মণোরভেদঃ। অয়মেব বিশেষঃ—জীবে জীববুদ্ধ্যা যা সেবা সমর্পিতা সা দয়া, ন প্রেম; যদাত্মবুদ্ধ্যা জীবঃ সেব্যতে, তৎ প্রেম। আত্মনা হি প্রেমাস্পদত্বং শ্রুতিস্মৃতিপ্রত্যক্ষপ্রসিদ্ধত্বাৎ। তদ্ যুক্তমেব যদবাদীৎ ভগবান্ চৈতন্যঃ, ‘প্রেম ঈশ্বরে, দয়া জীবে’ ইতি। দ্বৈতবাদিত্বাৎ তত্রভগবতঃ সিদ্ধান্তো জীবেশ্বরয়োর্ভেদবিজ্ঞাপকঃ সমীচীনঃ। অস্মাকন্তু অদ্বৈতপরাণাং জীববুদ্ধির্বন্ধনায় ইতি। তদস্মাকং প্রেম এব শরণং, ন দয়া। জীবে প্রযুক্তঃ দয়াশব্দোঽপি সাহসিকজল্পিত ইতি মন্যামহে। বয়ং ন দয়ামহে, অপি তু সেবামহে; নানুকম্পানুভূতিরস্মাকং অপি তু প্রেমানুভবঃ স্বানুভবঃ সর্বস্মিন্।
সৈব সর্ববৈষম্যসাম্যকারী ভবব্যাধি-নীরুজকরী প্রপঞ্চাবশ্যম্ভাব্যত্রিতাপহরণকরী সর্ববস্তুস্বরূপপ্রকাশকরী মায়াধ্বান্তবিধ্বংসকরী আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তস্বাত্মরূপপ্রকটনকরী প্রেমানুভূতির্বৈরাগ্যরূপা ভবতু তে শর্মণে শর্মন্।
ইতানুদিবসং প্রার্থয়তি
ত্বয়ি ধৃতচিরপ্রেমবন্ধ বিবেকানন্দঃ
(বঙ্গানুবাদ)
ঔঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
যাঁহার শক্তিতে আমরা এবং সমুদয় জগৎ কৃতার্থ, সেই শিবস্বরূপ স্বাধীন ঈশ্বর শ্রীরামকৃষ্ণকে আমি সদা বন্দনা করি।
হে আয়ুষ্মন্ শরচ্চন্দ্র, যে-সকল শাস্ত্রকার উদ্যোগশীল নহেন, তাঁহারা বলেন ভগবদ্-বিধিই প্রবল, তিনি যাহা করেন তাহাই হয়; আর যাঁহারা উদ্যোগী ও কর্মকুশল, তাঁহারা পুরুষকারকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেন। এই যে কেহ পুরুষকারকে দুঃখ-প্রতীকারের উপায় মনে করিয়া সেই বলের উপর নির্ভর করেন, আবার কেহ কেহ বা দৈববলের উপর নির্ভর করেন, তাঁহাদের বিবাদ কেবল অজ্ঞানজনিত, ইহা জানিয়া তুমি জ্ঞানরূপ গিরিবরের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের জন্য যত্ন কর।
‘বিপদই তত্ত্বজ্ঞানের কষ্টিপাথর-স্বরূপ’—নীতিশাস্ত্রে এই যে বাক্য কথিত হইয়াছে, ‘তত্ত্বমসি’-জ্ঞান সম্বন্ধেও সে কথা শত শত বার বলা যাইতে পারে। ইহাই (অর্থাৎ বিপদে অবিচলিত ভাবই) বৈরাগ্যের লক্ষণ।
ধন্য তিনি, যাঁহার জীবনে ইহার লক্ষণসমূহ প্রকাশ পাইয়াছে। তোমার ভাল না লাগিলেও আমি সেই প্রাচীন উক্তি তোমায় বলিতেছি, ‘কিছু সময় অপেক্ষা কর।’ দাঁড় চালাইতে তোমার শ্রম হইয়াছে, এক্ষণে দাঁড়ের উপর নির্ভর করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর; পূর্বের বেগই নৌকাকে পারে লইয়া যাইবে। এইজন্যই বলা হইয়াছে, ‘যোগে সিদ্ধ হইলে কালে আত্মায় আপনা-আপনি সেই জ্ঞানের প্রকাশ হইয়া থাকে।’ আর এই যে কথিত হইয়াছে, ‘ধন বা সন্তান দ্বারা অমরত্ব লাভ হয় না, কিন্তু একমাত্র ত্যাগ দ্বারাই অমরত্ব লাভ হয়’, এখানে ‘ত্যাগ’ শব্দের দ্বারা বৈরাগ্যকে লক্ষ্য করা হইয়াছে। সেই বৈরাগ্য দুই প্রকার হইতে পারে—হয় বস্তুশূন্য বা অভাবাত্মক, নয় বস্তুভূত বা ভাবাত্মক। যদি বৈরাগ্য অভাবাত্মক হয়, তবে কীটভক্ষিতমস্তিষ্ক ব্যক্তি ভিন্ন কেহই তাহা লাভ করিতে যত্ন করিবে না। আর যদি বৈরাগ্য ভাবাত্মক হয়, তবে ত্যাগের অর্থ অন্যবস্তুসমূহ হইতে মনকে সরাইয়া আনিয়া ঈশ্বর বা আত্মায় সংলগ্ন করা। সর্বেশ্বর যিনি, তিনি ব্যক্তিবিশেষ হইতে পারেন না, তিনি সকলের সমষ্টিস্বরূপ। বৈরাগ্যবান ব্যক্তির নিকট আত্মা বলিতে জীবাত্মা বুঝায় না, কিন্তু সর্বব্যাপী সর্বান্তর্যামী—সকলের আত্মারূপে অবস্থিত সর্বেশ্বরই বুঝিতে হইবে। তিনি সমষ্টিরূপে সকলের প্রত্যক্ষ। অতএব যখন জীব ও ঈশ্বর স্বরূপতঃ অভিন্ন, তখন জীবের সেবা ও ঈশ্বর প্রেম দুই একই। বিশেষ এই, জীবকে জীববুদ্ধিতে যে সেবা করা হয়, তাহা দয়া, প্রেম নহে; আর আত্মবুদ্ধিতে যে জীবের সেবা করা হয় তাহা প্রেম। আত্মা যে সকলেরই প্রেমাস্পদ তাহা শ্রুতি, স্মৃতি, প্রত্যক্ষ—সর্বপ্রকার প্রমাণ দ্বারাই জানা যাইতেছে। এইজন্য ভগবান্ শ্রীচৈতন্য যে ঈশ্বরে প্রেম ও জীবে দয়া করিতে উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহা যুক্তিযুক্ত। দ্বৈতবাদী ছিলেন বলিয়া তাঁহার এই সিদ্ধান্ত—যাহা জীব ও ঈশ্বরের ভেদ সূচনা করে—তাহা সমীচীনই হইয়াছে। অদ্বৈতনিষ্ঠ আমাদের কিন্তু জীববুদ্ধি বন্ধনের কারণ। অতএব আমাদের অবলম্বন প্রেম, দয়া নহে। জীবে প্রযুক্ত ‘দয়া’ শব্দও আমাদের বোধ হয় জোর করিয়া বলা মাত্র। আমরা দয়া করি না, সেবা করি। কাহাকেও দয়া করিতেছি, এ অনুভব আমাদের নাই; তৎপরিবর্তে আমরা সকলের মধ্যে প্রেমানুভূতি ও আত্মানুভব করিয়া থাকি।
হে শর্মন্ (ব্রাহ্মণ), সেই বৈরাগ্যরূপ প্রেমানুভব, যাহাতে সমস্ত বৈষম্যের সমতা সাধন করে, যাহা দ্বারা ভবরোগ আরোগ্য হয়, যাহা দ্বারা—এই জগৎপ্রপঞ্চে (মানবজীবনে) অবশ্যম্ভাবী ত্রিতাপ নাশ হয়, যাহা দ্বারা সমুদয় বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ বুঝিতে পারা যায়, যাহা দ্বারা মায়ারূপ অন্ধকার একেবারে নাশ হইয়া যায়, যাহা দ্বারা আব্রহ্মস্তম্ব সমুদয় জগৎকেই আত্মস্বরূপ বলিয়া বোধ হয়, তাহাই তোমার কল্যাণের জন্য তোমার হৃদয়ে উদিত হউক। ইহাই তোমার প্রতি চিরপ্রেমে আবদ্ধ বিবেকানন্দ দিবারাত্র প্রার্থনা করিতেছে।
৩৫০*
আলমোড়া
৪ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
আশ্চর্যের কথা, আজকাল ইংলণ্ড থেকে আমার উপর ভাল ও মন্দ দুই প্রকার প্রভাবেরই ক্রিয়া চলছে; প্রত্যুত তোমার চিঠিগুলি উৎসাহ ও আশার আলোকে পূর্ণ এবং আমার হৃদয়ে বল ও আশার সঞ্চার করে—আর আমার এখন এগুলি বড়ই প্রয়োজন। প্রভুই জানেন।
আমি যদিও এখনও হিমালয়ে আছি এবং আরও অন্ততঃ এক মাস থাকব, আমি আসার আগেই কলিকাতায় কাজ শুরু করে দিয়ে এসেছি এবং প্রতি সপ্তাহে কাজের বিবরণ পাচ্ছি।
এখন আমি দুর্ভিক্ষের কাজে ব্যস্ত আছি, এবং জনকয়েক যুবককে ভাবী কাজের জন্য গড়ে তোলা ছাড়া শিক্ষাকার্যে অধিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারিনি। অন্নসংস্থানের ব্যাপারেই আমার সমস্ত শক্তি ও সম্বল নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। যদিও এ পর্যন্ত অতি সামান্য ভাবেই কাজ করতে পেরেছি, তবু অপ্রত্যাশিত ফল দেখা যাচ্ছে। বুদ্ধের পরে এই আবার প্রথম দেখা যাচ্ছে যে, ব্রাহ্মণসন্তানেরা অন্ত্যজ বিসূচিকা-রোগীর শয্যাপার্শ্বে সেবায় নিরত।
ভারতে বক্তৃতা ও অধ্যাপনায় বেশী কাজ হবে না। প্রয়োজন সক্রিয় ধর্মের। আর মুসলমানদের কথায় বলতে গেলে ‘খোদার মর্জি হলে’—আমি তাই দেখাতে বদ্ধপরিকর। … তোমাদের সমিতির কার্য-প্রণালীর সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত; এবং ভবিষ্যতে তুমি যা-ই কর না কেন, তুমি ধরে নিতে পার, তাতে আমার সম্মতি থাকবে। তোমার ক্ষমতা ও সহানুভূতির উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। এর মধ্যেই আমি তোমার কাছে প্রভূত ঋণে ঋণী, এবং প্রতিদিন আরও অশেষভাবে বাধিত করছ। এইটুকুই আমার সান্ত্বনা যে, এই সমস্তই পরের জন্য। নতুবা উইম্বল্ডনের বন্ধুরা আমার প্রতি যে অপূর্ব অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন, আমি মোটেই তার উপযুক্ত নই। তোমরা ইংরেজরা বড় ভাল, বড় স্থির, বড় খাঁটি—ভগবান্ তোমাদের সর্বদা আশীর্বাদ করুন। আমি দূর থেকে প্রতিদিন তোমার আরও বেশী গুণগ্রাহী হচ্ছি। দয়া করে—কে আমার চির স্নেহ জানাবে এবং সেখানকার সব বন্ধুদের জানাবে। আমার অসীম ভালবাসা জেনো। ইতি
তোমাদের চিরসত্যাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩৫১*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
আলমোড়া
৯ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় ভগিনী,
তোমার পত্রখানি পড়ে ও ভিতরে একটি নৈরাশ্যব্যঞ্জক ভাব ফল্গুনদীর মত বইছে দেখে বড় দুঃখিত হলাম, আর তার কারণটা কি তাও আমি বুঝতে পারছি। তুমি যে আমাকে সাবধান করে দিয়েছ, তাঁর জন্য প্রথমেই তোমায় বিশেষ ধন্যবাদ; তোমার ওরূপ লেখার উদ্দেশ্য আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি রাজা অজিত সিংহের সঙ্গে ইংলণ্ডে যাবার বন্দোবস্ত করেছিলাম, কিন্তু ডাক্তাররা অনুমতি দিলে না, কাজেই যাওয়া ঘটল না। হ্যারিয়েটের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে জানতে পারলে আমি খুব খুশী হব। তিনিও তোমাদের যার সঙ্গেই হোক না কেন, দেখা হলে খুব আনন্দিত হবেন।
আমি অনেকগুলি আমেরিকান কাগজের টুকরো অংশ (cuttings) পেয়েছি; তাতে দেখলাম মার্কিন মেয়েদের সম্বন্ধে আমার উক্তিসমূহের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে—তাতে আরও এক অদ্ভুত খবর পেলাম যে, আমাকে এখানে জাতিচ্যুত করা হয়েছে! আমার আবার জাত হারাবার ভয়—আমি যে সন্ন্যাসী!
জাত তো কোনরকম যায়ইনি, বরং সমুদ্রযাত্রার উপর সমাজের যে একটা বিরুদ্ধ ভাব ছিল, আমার পাশ্চাত্য দেশে যাওয়ার দরুন তা বহুল পরিমাণে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমাকে যদি জাতিচ্যুত করতে হয়, তাহলে ভারতের অর্ধেক রাজন্যবর্গ ও সমুদয় শিক্ষিত লোকের সঙ্গে আমাকে জাতিচ্যুত করতে হবে। তা তো হয়ইনি, বরং আমি সন্ন্যাস নেবার পূর্বে আমার যে জাতি ছিল, সেই জাতিভুক্ত এক প্রধান রাজা আমাকে সম্মানপ্রদর্শনের জন্য একটি সামাজিক ভোজের আয়োজন করেছিলেন; তাতে ঐ জাতির অধিকাংশ বড় বড় লোক যোগ দিয়েছিলেন। অন্য দিক্ থেকে ধরলে আমরা সন্ন্যাসীরা তো নারায়ণ—দেবতারা সামান্য নরলোকের সঙ্গে একত্র খেলে তাঁদের মর্যাদাহানি হয়। আর প্রিয় মেরী, শত শত রাজার বংশধরেরা এই পা ধুইয়ে মুছিয়ে দিয়েছে, পুজো করেছে—আর সমস্ত দেশের ভিতর যেরূপ আদর অভ্যর্থনা অভিনন্দনের ছড়াছড়ি হয়েছে, ভারতে আর এ রকমটি কারও হয়নি।
এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, রাস্তায় বেরুতে গেলেই এত লোকের ভিড় হত যে, শান্তিরক্ষার জন্য পুলিশের দরকার হত—জাতিচ্যুত করাই বটে! অবশ্য আমার এরূপ অভ্যর্থনায় মিশনরী-ভায়াদের প্রভাব বেশ ক্ষয় করে দিয়েছে। আর তারা এখানে কে? কেউ না। তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই আমাদের খেয়াল নেই!
আমি এক বক্তৃতায় এই মিশনরী-ভায়াদের সম্বন্ধে—ইংলিশ চার্চের অন্তর্ভুক্ত ভদ্র মিশনরীগণকে বাদ দিয়ে—সাধারণ মিশনরীর দল কোন্ শ্রেণীর লোক থেকে সংগৃহীত, সে সম্বন্ধে কিছু বলেছিলাম। সেই সঙ্গে আমেরিকার চার্চের অতিরিক্ত গোঁড়া স্ত্রীলোকদের সম্বন্ধে এবং তাদের কুৎসা সৃষ্টি করবার শক্তি সম্বন্ধেও আমায় কিছু বলতে হয়েছিল। মিশনরী-ভায়ারা আমার আমেরিকার কাজটা নষ্ট করবার জন্য এইটিকেই সমগ্র মার্কিন নারীর উপর আক্রমণ বলে ঢাক পেটাচ্ছে—কারণ তারা বেশ জানে, শুধু তাদের (মিশনরীদের) বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা খুশীই হবে। প্রিয় মেরী, ধর যদি ইয়াঙ্কিদের বিরুদ্ধে আমি খুব ভয়ানক কথা বলেই থাকি—তারা আমাদের মা-বোনদের বিরুদ্ধে যে-সব কথা বলে, তাতে কি তার লক্ষ ভাগের এক ভাগেরও প্রতিশোধ হয়? ভারতবাসী ‘হিদেন’দের (বিধর্মী) উপর খ্রীষ্টান ইয়াঙ্কি নরনারী যে ঘৃণা পোষণ করে, তা ধুয়ে ফেলতে বরুণ-দেবতার সব জলেও কুলোবে না। আমরা তাদের কি অনিষ্ট করেছি? অন্যে সমালোচনা করলে ইয়াঙ্কিরা ধৈর্যের সঙ্গে তা সহ্য করতে শিখুক, তারপর তারা অপরের সমালোচনা করুক। এটি একটি মনোবিজ্ঞানসম্মত সর্বজনবিদিত সত্য যে, যারা সর্বদা অপরকে গালিগালাজ করতে উদ্যত, তারা অপরের এতটুকু সমালোচনার ঘা সহ্য করতে পারে না। আর তারপর তাদের আমি কি ধার ধারি? তোমাদের পরিবার, মিসেস বুল, লেগেটরা এবং আর কয়েকজন সমুদয় ব্যক্তি ছাড়া আর কে আমার প্রতি সদয় ব্যবহার করেছে? কে আমার ভাবগুলি কাজে পরিণত করবার সাহায্য করতে এসেছিল? আমায় কিন্তু ক্রমাগত খাটতে হয়েছে, যাতে মার্কিনরা অপেক্ষাকৃত উদার ও ধর্মপ্রাণ হয় তার জন্য আমেরিকায় আমার সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে এখন আমি মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত।
ইংলণ্ডে আমি কেবল ছ-মাস কাজ করেছি, একবার ছাড়া কখনও কোন নিন্দার রব ওঠেনি—সে নিন্দা-রটনাও একজন মার্কিন মহিলার কাজ, এই কথা জানতে পেরে আমার ইংরেজ বন্ধুরা বিশেষ আশ্বস্ত হলেন। আক্রমণ তো কোন রকম হয়ইনি বরং অনেকগুলি ভাল ভাল ইংলিশ চার্চের পাদ্রী আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলেন—আর না চেয়েই আমি আমার কাজের জন্য যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছি এবং নিশ্চয়ই আরও পাব। ওখানকার একটা সমিতি আমার কাজের প্রসার লক্ষ্য করে আসছে এবং সেজন্য সাহায্যের যোগাড় করছে। ওখানকার চারজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমার কাজে সাহায্যের জন্য সব রকম অসুবিধা সহ্য করেও আমার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে এসেছেন। আরও অনেকে আসবার জন্য প্রস্তুত ছিল; এর পর যখন যাব, আরও শত শত লোক প্রস্তুত হবে।
প্রিয় মেরী, আমার জন্য কিছু ভয় করো না। মার্কিনরা বড়—কেবল ইওরোপের হোটেলওয়ালা ও কোটিপতিদের চোখে এবং নিজেদের কাছে। পৃথিবীতে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে—ইয়াঙ্কিরা চটলেও আমার জায়গার অভাব হবে না। যাই হোক না কেন, আমি যতটুকু কাজ করেছি, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি কখনও কোন জিনিষ মতলব করে করিনি। আপনা-আপনি যেমন যেমন সুযোগ এসেছে, আমি তারই সহায়তা নিয়েছি। কেবল একটা ভাব আমার মাথার ভিতর ঘুরছিল—ভারতবাসী জনসাধারণের উন্নতির জন্য একটা যন্ত্র প্রস্তুত করে চালিয়ে দেওয়া। আমি সে বিষয়ে কতকটা কৃতকার্য হয়েছি। তোমার হৃদয় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠত, যদি তুমি দেখতে আমার ছেলেরা দুর্ভিক্ষ, ব্যাধি ও দুঃখকষ্টের ভেতর কেমন কাজ করছে, কলেরা-আক্রান্ত ‘পারিয়া’র মাদুরের বিছানার পাশে বসে কেমন তাদের সেবাশুশ্রূষা করছে এবং অনশনক্লিষ্ট চণ্ডালের মুখে কেমন অন্ন তুলে দিচ্ছে—প্রভু আমাকে সাহায্য করছেন, তাদেরও সাহায্য পাঠাচ্ছেন। মানুষের কথা আমি কি গ্রাহ্য করি? সেই প্রেমাস্পদ প্রভু আমার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন, যেমন আমেরিকায়, যেমন ইংলণ্ডে, যেমন ভারতের রাস্তায় যখন ঘুরে বেড়াতাম—কেউ আমায় চিনত না—তখন যেমন সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। লোকেরা কি বলে না বলে, তাতে আমার কি এসে যায়—ওরা তো ছেলেমানুষ! ওরা আর ওর চেয়ে বেশী বুঝবে কি করে? কি! আমি পরমাত্মাকে সাক্ষাৎ করেছি, সমুদয় পার্থিব বস্তু যে অসার, তা প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করেছি—আমি সামান্য বালকদের কথায় আমার নির্দিষ্ট পথ থেকে চ্যুত হব?—আমাকে দেখে কি তেমনি মনে হয়?
আমাকে আমার নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলতে হল—কারণ তোমাদের কাছে না বললে যেন আমার কর্তব্য শেষ হত না। আমি বুঝতে পারছি—আমার কাজ শেষ হয়েছে। জোর তিন-চার বছর জীবন অবশিষ্ট আছে। আমার নিজের মুক্তির ইচ্ছা সম্পূর্ণ চলে গেছে। আমি সাংসারিক সুখের প্রার্থনা কখনও করিনি। আমি দেখতে চাই যে, আমার যন্ত্রটা বেশ প্রবলভাবে চালু হয়ে গেছে; আর এটা যখন নিশ্চয় বুঝব যে, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে অন্ততঃ ভারতে এমন একটা যন্ত্র চালিয়ে গেলাম, যাকে কোন শক্তি দাবাতে পারবে না, তখন ভবিষ্যতের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে আমি ঘুমাব। আর নিখিল আত্মার সমষ্টিরূপে যে ভগবান্ বিদ্যমান—একমাত্র যে ভগবানে আমি বিশ্বাসী, সেই ভগবানের পূজার জন্য যেন আমি বার বার জন্মগ্রহণ করি এবং সহস্র যন্ত্রণা ভোগ করি; আর সর্বোপরি আমার উপাস্য পাপী-নারায়ণ, তাপী-নারায়ণ, সর্বজাতির দরিদ্রনারায়ণ! এরাই বিশেষভাবে আমার আরাধ্য।
‘যিনি তোমার অন্তরে ও বাহিরে, যিনি সব হাত দিয়ে কাজ করেন ও সব পায়ে চলেন, তুমি যাঁর একাঙ্গ, তাঁরই উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।
‘যিনি উচ্চ ও নীচ, সাধু ও পাপী, দেব ও কীট সর্বরূপী, সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞেয় সত্য ও সর্বব্যাপীর উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।
‘যাতে পূর্বজন্ম নাই, পরজন্ম নাই, বিনাশ নাই, গমনাগমন নাই, যাতে অবস্থিত থেকে আমরা সর্বদা অখণ্ডত্ব লাভ করছি এবং ভবিষ্যতেও করব, তাঁরই উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।
‘হে মূর্খগণ, যে-সকল জীবন্ত নারায়ণে ও তাঁর অনন্ত প্রতিবিম্বে জগৎ পরিব্যাপ্ত, তাঁকে ছেড়ে তোমরা কাল্পনিক ছায়ার পেছনে ছুটেছ! তাঁর—সেই প্রত্যক্ষ-দেবতারই—উপাসনা কর এবং আর সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।’
আমার সময় অল্প। এখন আমার যা কিছু বলবার আছে, কিছু না চেপে বলে যেতে হবে; ওতে কারও হৃদয় আঘাত লাগবে বা কেউ বিরক্ত হবে—এ বিষয়ে লক্ষ্য করলে চলবে না। অতএব প্রিয় মেরী, আমার মুখ থেকে যাই বের হোক না কেন, কিছুতেই ভয় পেও না। কারণ যে শক্তি আমার পশ্চাতে থেকে কাজ করছে, তা বিবেকানন্দ নয়—তা স্বয়ং প্রভু; কিসে ভাল হয়, তিনিই বেশী বোঝেন। যদি আমায়—জগৎকে সন্তুষ্ট করতে হয়, তাহলে তাতে জগতের অনিষ্টই হবে। অধিকাংশ লোক যা বলে তা ভুল, কারণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, জগৎ শাসন করছে তারাই, অথচ জগতের অবস্থা অতি শোচনীয়। যে-কোন নূতন ভাব প্রচারিত হবে, তারই বিরুদ্ধে লোকে লাগবে; সভ্য যাঁরা, তাঁরা শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন না করে উপহাসের হাসি হাসবেন; আর যারা সভ্য নয়, তারা শিষ্টাচার-বিরুদ্ধ চীৎকার করবে ও কুৎসিত নিন্দা রটাবে।
সংসারের এ-সব কীটদেরও একদিন খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে—জ্ঞানহীন বালকদেরও একদিন জ্ঞানালোক পেতে হবে। মার্কিনরা অভ্যুদয়ের নূতন সুরাপানে এখন মত্ত। অভ্যুদয়ের শত শত বন্যা আমাদের দেশের উপর এসেছে ও চলে গেছে। তাতে আমরা এমন শিক্ষা পেয়েছি, যা কোন বালকস্বভাব জাতি এখনও বুঝতে অসমর্থ। আমরা জেনেছিঃ এ সবই মিছে; এই বীভৎস জগৎটা মায়ামাত্র। ত্যাগ কর এবং সুখী হও। কামকাঞ্চন ত্যাগ কর। এ ছাড়া অন্য কোন বন্ধন নাই। বিবাহ, স্ত্রীপুরুষ সম্বন্ধ, টাকাকড়ি—এগুলি মূর্তিমান পিশাচস্বরূপ। পার্থিব ভালবাসা দেহ থেকেই প্রসূত—কামকাঞ্চন সম্বন্ধে সব ছেড়ে দাও—ঐগুলি যেমন চলে যাবে, অমনি দিব্যদৃষ্টি খুলে যাবে—তখন আত্মা তাঁর অনন্ত শক্তি ফিরে পাবেন।
আমার বড়ই ইচ্ছা ছিল হ্যারিয়েটের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ইংলণ্ডে যাই।—আমার আর একটি মাত্র ইচ্ছা আছে, মৃত্যুর আগে তোমাদের চার বোনের সঙ্গে একবার দেখা করা; আমার সে ইচ্ছা পূর্ণ হবেই হবে। ইতি
তোমাদের চিরস্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩৫২
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
১০ জুলাই, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
আজ এখান হইতে সভার উদ্দেশ্যের যে proof (প্রুফ) পাঠাইয়াছিলে, তাহা সংশোধন করিয়া পাঠাইলাম। Rules and regulations (নিয়মাবলী)-টুকু—যেটুকু আমাদের meeting hall-এ (সভায়) মশায়রা পড়িয়াছিলেন—ভ্রমপূর্ণ। বিশেষ যত্নের সহিত সংশোধিত করিয়া পুনর্মুদ্রিত করিবে, নইলে লোক হাসিবে।
বহরমপুরে যে প্রকার কার্য১২৪ হইতেছে, তাহা অতীব সুন্দর। ঐ সকল কার্যের দ্বারাই জয় হইবে—মতামত কি অন্তর স্পর্শ করে? কার্য কার্য—জীবন জীবন—মতে-ফতে এসে যায় কি? ফিলসফি, যোগ, তপ, ঠাকুরঘর, আলোচাল, কলা মূলো—এ সব ব্যক্তিগত ধর্ম, দেশগত ধর্ম; পরোপকারই সর্বজনীন মহাব্রত—আবালবৃদ্ধবনিতা, আচণ্ডাল, আপশু সকলেই এ ধর্ম বুঝিতে পারে। শুধু negative (নিষেধাত্মক) ধর্মে কি কাজ হয়? পাথরে ব্যভিচার করে না, গরুতে মিথ্যা কথা কয় না, বৃক্ষেরা চুরি ডাকাতি করে না, তাতে আসে যায় কি? তুমি চুরি কর না, মিথ্যা কথা কও না, ব্যভিচার কর না, চার ঘণ্টা ধ্যান কর, আট ঘণ্টা ঘণ্টা বাজাও—‘মধু, তা কার কি?’ ঐ যে কাজ, অতি অল্প হলেও ওতে বহরমপুর একেবারে কেনা হয়ে গেল—এখন যা বলবে, লোকে তাই শুনবে। এখন ‘রামকৃষ্ণ ভগবান্’ লোককে আর বোঝাতে হবে না। তা নইলে কি লেকচারের কর্ম—কথায় কি চিঁড়ে ভেজে? ঐ রকম যদি দশটা district (জেলায়) পারতে, তাহলে দশটাই কেনা হয়ে যেত। অতএব বুদ্ধিমান, এখন ঐ কর্মবিভাগটার উপরই খুব ঝোঁক, আর ঐটারই উপকারিতা বাড়াতে প্রাণপণে চেষ্টা কর। কতকগুলো ছেলেকে দ্বারে দ্বারে পাঠাও—আলখ জাগিয়ে টাকাপয়সা, ছেঁড়া কাপড়, চালডাল, যা পায় নিয়ে আসুক, তারপর সেগুলো ডিষ্ট্রীবিউট (বিতরণ) করবে। ঐ কাজ, ঐ কাজ। তারপর লোকের বিশ্বাস হবে, তারপর যা বলবে শুনবে।
কলিকাতায় মিটিং-এর খরচ-খরচা বাদে যা বাঁচে, ঐ famine-এতে (দুর্ভিক্ষে) পাঠাও বা কলিকাতার ডোমপাড়া, হাড়িপাড়া বা গলিঘুঁজিতে অনেক গরীব আছে, তাদের সাহায্য কর—হল্-ফল্—ঘোড়ার ডিম থাক্, প্রভু যা করবার তা করবেন। আমার এখন শরীর বেশ সেরে গেছে।
মেটিরিয়াল (মালমসলা) যোগাড় করছ না কেন? আমি এসে নিজেই কাগজ start (আরম্ভ) করব। দয়া আর ভালবাসায় জগৎ কেনা যায়; লেকচার, বই, ফিলসফি—সব তার নীচে। শশীকে ঐ রকম একটা কর্মবিভাগ গরীবদের সাহায্যের জন্য করতে লিখবে। আর ঠাকুরপুজো-ফুজোতে যেন টাকাকড়ি বেশী ব্যয় না করে। … তুমি মঠের ঠাকুরপুজোর খরচ দু-এক টাকা মাসে করে ফেলবে। ঠাকুরের ছেলেপুলে না খেয়ে মারা যাচ্ছে। … শুধু জল-তুলসীর পুজো করে ভোগের পয়সাটা দরিদ্রদের শরীরস্থিত জীবন্ত ঠাকুরকে ভোগ দিবে—তা হলে সব কল্যাণ হবে। যোগেনের শরীর এখানে খারাপ হয়েছিল, সে আজ যাত্রা করিল—কলিকাতায়। আমি কাল পুনশ্চ দেউলধার যাত্রা করিব। আমার ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৫৩*
[মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত]
আলমোড়া
১০ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় জো জো,
তোমার চিঠিগুলি পড়ার ফুরসত আমার আছে, এটা যে তুমি আবিষ্কার করে ফেলেছ, তাতে আমি খুশী।
বক্তৃতা ও বাগ্মিতা করে করে হয়রান হয়ে পড়ায় আমি হিমালয়ে আশ্রয় নিয়েছি। ডাক্তাররা আমায় খেতড়ির রাজার সঙ্গে ইংলণ্ডে যেতে না দেওয়ার আমি বড়ই দুঃখিত; আর স্টার্ডি এতে ক্ষেপে গেছে।
সেভিয়ার-দম্পতি সিমলাতে আছেন, আর মিস মূলার এখানে আলমোড়ায়। প্লেগ কমেছে; কিন্তু দুর্ভিক্ষ এখনও চলছে, তার উপর এ যাবৎ বৃষ্টি না হওয়ায় এ দুর্ভিক্ষ আরও করালরূপ ধারণ করবে বলে মনে হচ্ছে।
আমাদের কর্মীরা দুর্ভিক্ষগ্রস্ত বিভিন্ন জেলায় যে কাজে নেমেছে, এখান থেকে তার পরিচালনায় আমি খুবই ব্যস্ত।
যেমন করেই হোক তুমি এসে পড়; শুধু এইটুকু মনে রেখো—ইওরোপীয়দের ও হিন্দুদের (অর্থাৎ ইওরোপীয়েরা যাদের ‘নেটিভ’ বলেন তাদের) বসবাসের ব্যবস্থা যেন তেল-জলের মত; নেটিভদের সঙ্গে মেলামেশা করা ইওরোপীয়দের পক্ষে সর্বনেশে ব্যাপার। (প্রাদেশিক) রাজধানীগুলোতে পর্যন্ত বলবার মত কোন হোটেল নেই। তোমাকে অনেক চাকর-বাকর সঙ্গে নিয়ে চলা-ফেরা করতে হবে (খরচ হোটেলের চেয়ে কম)। কটিমাত্র-বস্ত্রাবৃত লোকের ছবি তোমায় সয়ে যেতে হবে; আমাকেও তুমি ঐ রূপেই দেখতে পাবে। সর্বত্রই ময়লা ও নোংরা, আর সব ‘কালা আদমী’। কিন্তু তোমার সঙ্গে দার্শনিক আলোচনা করবার মত লোক ঢের পাবে। এখানে যদি ইংরেজদের সঙ্গে বেশী মেলামেশা কর, তবে তুমি আরাম পাবে বেশী; কিন্তু হিন্দুদের ঠিক ঠিক পরিচয় পাবে না। হয়তো আমি তোমার সঙ্গে বসে খেতে পাব না; কিন্তু তোমায় কথা দিচ্ছি যে, আমি তোমার সঙ্গে বহু জায়গায় ভ্রমণ করব এবং তোমার ভ্রমণকে সুখময় করবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। এই সবই তোমার ভাগ্যে জুটবে—যদি কিছু ভাল জুটে যায় তো সে বাড়তির ভাগ। হয়তো মেরী হেল তোমার সঙ্গে এসে পড়তে পারে। অর্চার্ড লেক্, অর্চার্ড দ্বীপ, মিসিগান—এই ঠিকানায় মিস ক্যাম্পবেল নাম্নী একটি সম্ভ্রান্তবংশীয়া কুমারী বাস করেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ ভক্ত, উপবাস ও প্রার্থনাদি অবলম্বন করে এই দ্বীপে নির্জনে বাস করেন, ভারতবর্ষ দর্শন করার জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনি বড়ই গরীব। তুমি যদি তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আস, তবে যেমন করেই হোক, আমি তাঁর খরচ দেব। মিসেস বুল যদি বুড়ো ল্যাণ্ডস্বার্গকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেন, তবে সে বেঁচে যায়!
খুব সম্ভব আমি তোমার সঙ্গে আমেরিকায় ফিরব। হলিস্টার ও শিশুটিকে আমার চুমো দিও। এলবার্টা, লেগেট-দম্পতি ও ম্যাবেলকে আমার ভালবাসা জানিও। ফক্স কি করছে? তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে আমার ভালবাসা জানিও। মিসেস বুল ও সারদানন্দকে ভালবাসা জানাচ্ছি। আমি আগেকার মতই সবল আছি; কিন্তু কেমন থাকব, তা নির্ভর করছে ভবিষ্যতে সব ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার উপর। আর দৌড়ঝাঁপ করা চলবে না।
এ বছর তিব্বতে যাবার খুবই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এরা যেতে দিল না; কারণ ঐ পথে চলা ভয়ানক শ্রমসাপেক্ষ। যা হোক আমি খাড়া পাহাড়ের উপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পাহাড়ী ঘোড়া ছুটিয়েই সন্তুষ্ট আছি। তোমার বাই-সাইকেলের চেয়ে এটা আরও বেশী উন্মাদনাপূর্ণ; অবশ্য উইম্বল্ডনে আমার সে অভিজ্ঞতাও হয়ে গেছে। মাইলের পর মাইল চড়াই ও মাইলের পর মাইল উতরাই—রাস্তাটা কয়েক ফুট মাত্র চওড়া, খাড়া পাহাড়ের গায়ে যেন ঝুলে আছে, আর বহু সহস্র ফুট নীচে খাদ!
সদা প্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
পুঃ—ভারতে আসার সবচেয়ে ভাল সময় হচ্ছে—অক্টোবরের মধ্যে বা নভেম্বরের প্রথমে; ডিসেম্বর, জানুআরী ও ফেব্রুআরী তুমি সব দেখবে এবং ফেব্রুআরীর শেষাশেষি ফিরে যাবে। মার্চ থেকে গরম পড়তে শুরু হয়। দক্ষিণ ভারত সব সময়েই গরম।
মান্দ্রাজে শীঘ্রই একখানি পত্রিকা আরম্ভ করা হবে; গুডউইন তারই কাজে সেখানে গেছে।
বি
৩৫৪*
[স্বামী শুদ্ধানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
১১ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় শুদ্ধানন্দ,
তুমি সম্প্রতি মঠের যে কার্য-বিবরণ পাঠিয়েছ, তা পেয়ে ভারি খুশী হলাম। তোমার রিপোর্ট সম্বন্ধে আমার সমালোচনার বড় কিছু নেই—কেবল বলতে চাই, আর একটু পরিষ্কার করে লিখো।
যতদূর পর্যন্ত কাজ হয়েছে, তাতে আমি খুব সন্তুষ্ট; কিন্তু আরও এগিয়ে যেতে হবে। আগে আমি একবার লিখেছিলাম, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধীয় কতকগুলি যন্ত্র যোগাড় করলে ভাল হয় এবং ক্লাস খুলে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন, বিশেষতঃ শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে সাদাসিদে ও হাতেকলমে শিক্ষা দিলে ভাল হয়; কই, সে-সম্বন্ধে তো কোন উচ্চবাচ্য এ পর্যন্ত শুনিনি।
আর একটা কথা লিখেছিলাম—যে-সব বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বাঙলা ভাষায় অনুবাদ হয়ে গেছে, সেইগুলি কিনে ফেলা উচিত; তার সম্বন্ধেই বা কি হল?
এখন মনে হচ্ছে—মঠে একসঙ্গে অন্ততঃ তিন জন করে মহান্ত নির্বাচন করলে ভাল হয়; একজন বৈষয়িক ব্যাপার চালাবেন, একজন আধ্যাত্মিক দিক্ দেখবেন, আর একজন জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করবেন।
শিক্ষাবিভাগের উপযুক্ত পরিচালক পাওয়াই দেখছি কঠিন। ব্রহ্মানন্দ ও তুরীয়ানন্দ অনায়াসে অপর দুটি বিভাগের ভার নিতে পারেন। মঠ দর্শন করতে কেবল কলিকাতার বাবুর দল আসছেন জেনে বড় দুঃখিত হলাম। তাঁদের দ্বারা কিছু হবে না। আমরা চাই সাহসী যুবকের দল—যারা কাজ করবে; আহাম্মকের দলকে দিয়ে কি হবে?
ব্রহ্মানন্দকে বলবে, তিনি যেন অভেদানন্দ ও সারদানন্দকে—মঠে তাদের সাপ্তাহিক কার্য-বিবরণী পাঠাতে লেখেন; যেন তা পাঠাতে ত্রুটি না হয়, আর যে বাঙলা কাগজটা বার করবার কথা হচ্ছে, তার জন্য প্রবন্ধ ও প্রয়োজনীয় উপাদান যেন তারা পাঠায়। গিরিশবাবু কি কাগজটার জন্য যোগাড়যন্ত্র করছেন? অদম্য ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে কাজ করে যাও ও প্রস্তুত থাক।
অখণ্ডানন্দ মহুলাতে অদ্ভুত কর্ম করছে বটে, কিন্তু কার্য-প্রণালী ভাল বলে বোধ হচ্ছে না। মনে হয়, তারা একটা ছোট গ্রামেই তাদের শক্তিক্ষয় করছে, তাও কেবল চাল-বিতরণের কার্যে। এই চাল দিয়ে সাহায্যের সঙ্গে সঙ্গে কোনরূপ প্রচারকার্যও হচ্ছে—কই, এরূপ তো শুনতে পাচ্ছি না। জনসাধারণকে যদি আত্মনির্ভরশীল হতে শেখান না যায়, তবে জগতের সমগ্র ঐশ্বর্য ভারতের একটা ক্ষুদ্র গ্রামের পক্ষেও পর্যাপ্ত সাহায্য হবে না।
আমাদের কাজ হওয়া উচিত প্রধানতঃ শিক্ষাদান—চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষসাধনের জন্য শিক্ষা-বিস্তার। আমি সে-সম্বন্ধে তো কোন কথা শুনছি না—কেবল শুনছি, এতগুলি ভিক্ষুককে সাহায্য দেওয়া হয়েছে! ব্রহ্মানন্দকে বলো, বিভিন্ন জেলায় কেন্দ্র খুলতে, যাতে আমাদের সামান্য সম্বলে যতদূর সম্ভব অধিক জায়গায় কাজ করা যায়। আরও মনে হচ্ছে, এ পর্যন্ত ঐ কার্যে ফল কিছু হয়নি; কারণ তাঁরা এখনও পর্যন্ত স্থানীয় লোকদের মধ্যে তেমন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে পারেননি, যাতে তারা দেশের লোকের শিক্ষার জন্য সভাসমিতি স্থাপন করতে পারে এবং ঐ শিক্ষার ফলে তারা আত্মনির্ভরশীল ও মিতব্যয়ী হতে পারে, বিবাহের দিকে অস্বাভাবিক ঝোঁক না থাকে, এবং এইভাবে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। দয়ায় লোকের হৃদয় খুলে যায়; কিন্তু সেই দ্বার দিয়ে তার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ যাতে হয়, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
সবচেয়ে সহজ উপায় এইঃ একটা ছোট কুঁড়ে নিয়ে গুরু-মহারাজের মন্দির কর। গরীবরা সেখানে আসুক, তাদের সাহায্যও করা হোক, তারা সেখানে পূজা-অর্চাও করুক। প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যায় সেখানে ‘কথা’ হোক। ঐ কথার সাহায্যেই তোমরা লোককে যা কিছু শেখাতে ইচ্ছা কর, শেখাতে পারবে। ক্রমে ক্রমে তাদের নিজেদেরই ঐ বিষয়ে একটা আস্থা ও আগ্রহ বাড়তে থাকবে—তখন তারা নিজেরাই সেই মন্দিরের ভার নেবে, আর হতে পারে, কয়েক বৎসরের ভেতর ঐ ছোট মন্দিরটিই একটি প্রকাণ্ড আশ্রমে পরিণত হবে। যাঁরা দুর্ভিক্ষমোচন-কার্যে যাচ্ছেন, তাঁরা প্রথমে প্রত্যেক জেলার কেন্দ্রস্থলে একটা জায়গা নির্বাচন করুন—এইরূপ একটি কুঁড়ে নিয়ে সেখানে ঠাকুরঘর স্থাপন করুন—যেখান থেকে আমাদের অল্প-স্বল্প কাজ আরম্ভ হতে পারে।
মনের মত কাজ পেলে অতি মূর্খও করতে পারে। যে সকল কাজকেই মনের মত করে নিতে পারে, সে-ই বুদ্ধিমান। কোন কাজই ছোট নয়, এ সংসারে যাবতীয় বস্তু বটের বীজের মত, সর্ষপের মত ক্ষুদ্র দেখালেও অতি বৃহৎ কাজকেই মহৎ করে তোলে।১২৫
যাঁরা দুর্ভিক্ষমোচন করছেন, তাঁদের এটিও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, জুয়াচোরেরা যেন গরীবের প্রাপ্য নিয়ে যেতে না পারে। ভারতবর্ষ এমন অলস জুয়াচোরে পূর্ণ এবং দেখে আশ্চর্য হবে, তারা কখনও না খেয়ে মরে না—কিছু না কিছু খেতে পায়ই। ব্রহ্মানন্দকে বলো, যাঁরা দুর্ভিক্ষে কাজ করছেন, তাঁদের সকলকে এই কথা লিখতেঃ যাতে কোন ফল নেই, এমন কিছুর জন্য টাকা খরচ করতে তাঁদের কখনই দেওয়া হবে না—আমরা চাই, যতদূর সম্ভব অল্প খরচে যত বেশী সম্ভব স্থায়ী সৎকার্যের প্রতিষ্ঠা।
এখন তোমরা বুঝতে পারছ, তোমাদের নূতন নূতন মৌলিক চিন্তার চেষ্টা করতে হবে—তা না হলে আমি মরে গেলেই গোটা কাজটা চুরমার হয়ে যাবে। এই রকম করতে পারঃ তোমরা সকলে মিলে একটা সভায় এই বিষয় আলোচনা কর, আমাদের হাতে যে অল্পস্বল্প সম্বল আছে, তা থেকে কি করে সবচেয়ে ভাল স্থায়ী কাজ হতে পারে। কিছুদিন আগে থেকে সকলকে এই বিষয়ে খবর দেওয়া হোক, সকলেই নিজের মতামত—বক্তব্য বলুক, সেইগুলি নিয়ে বিচার হোক, বাদপ্রতিবাদ হোক, তারপর আমাকে তার একটা বিবরণ পাঠাও।
উপসংহারে বলি, তোমরা মনে রেখো, আমি আমার গুরুভাইদের চেয়ে আমার সন্তানদের নিকট বেশী আশা করি—আমি চাই, আমার সব ছেলেরা, আমি যত বড় হতে পারতাম, তার চেয়ে শতগুণ বড় হোক। তোমাদের প্রত্যেককেই এক একটা ‘দানা’ হতেই হবে—আমি বলছি—অবশ্যই হতে হবে। আজ্ঞাবহতা, উদ্দেশ্যের উপর অনুরাগ ও সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকা—এই তিনটি যদি থাকে, কিছুতেই তোমাদের হটাতে পারবে না। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
স্নেহাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
৩৫৫
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
দেউলধার, আলমোড়া
১৩ জুলাই, ১৮৯৭
প্রেমাস্পদেষু,
এখান হইতে আলমোড়ায় যাইয়া যোগেন-ভায়ার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিলাম। কিন্তু ভায়া একটু আরাম বোধ করিয়াই দেশে যাত্রা করিলেন। সুভালা-ভ্যালি পৌঁছে সংবাদ দিবেন।... ডাণ্ডি আদি পাওয়া অসম্ভব বিধায় লাটুর যাওয়া হইল না। আমি ও অচ্যুত পুনরায় এ স্থানে আসিয়াছি। আমার শরীর এই ঘোড়ার পিঠে রৌদ্রে ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়ের দরুন একটু আজ খারাপ আছে। শশীবাবুর ঔষধ প্রায় দুই সপ্তাহ খাইলাম—বিশেষ কিছুই দেখি না।—লিভারের বেদনাটা গিয়াছে ও খুব কসরত করার দরুন হাত-পা বিশেষ muscular (পেশীবহুল) হইয়াছে, কিন্তু পেটটা বিষম ফুলিতেছেঃ উঠতে বসতে হাঁপ ধরে। বোধ হয় দুধ খাওয়াই তার কারণ। শশীকে জিজ্ঞাসা করিবে যে, দুগ্ধ ছাড়িয়া দেওয়া যায় কিনা। পূর্বে আমার দুইবার sun-stroke (সর্দি-গরমি) হয়। সেই অবধি রৌদ্র লাগিলেই চোখ লাল হয়, দুই-তিন দিন শরীর খারাপ যায়।
মঠের খবর শুনিয়া বিশেষ সুখী হইলাম ও দুর্ভিক্ষের কার্য উত্তমরূপে হইতেছে শুনিলাম। দুর্ভিক্ষের জন্য ‘ব্রহ্মবাদিন্’ আফিস হইতে টাকা আসিয়াছে কিনা লিখিবে এবং এখান হইতেও শীঘ্র টাকা যাইবে। দুর্ভিক্ষ আরও অনেক স্থানে তো আছে। একটি গ্রামে এতদিন থাকিবার আবশ্যক নাই। উহাদিগকে অন্যত্র যাইতে বলিবে এবং এক এক জনকে এক এক জায়গায় যাইতে লিখিবে। ঐ সকল কাজই আসল কাজ; ঐরূপ ক্ষেত্র কর্ষিত হইলে পর ধর্মের বীজ রোপণ করা যাইতে পারে। ঐ যে গোঁড়ারা আমাদের গালি করিতেছে, ঐ রকম (সেবা) কার্যই তাহার একমাত্র উত্তর—এইটি সদা মনে রাখিবে। শশী ও সারদা যে প্রকার বলিতেছে, সেই প্রকার ছাপাইতে আমার কোন আপত্তি নাই।
মঠের নাম কি হইবে এইটা স্থির তোমরাই কর। … টাকা সাত সপ্তাহের মধ্যেই পৌঁছিবে; জমির তো কোন খবর নাই। এ বিষয়ে কাশীপুরের কেষ্টগোপালের বাগানটা নিলে ভাল হয় না? পরে বড় কার্য ক্রমে হবে। যদি মত হয়, এ বিষয় কাহাকেও—মঠস্থ বা বাহিরের—না বলিয়া চুপি চুপি অনুসন্ধান করিও। দুই-কান হইলেই কাজ খারাপ হয়। যদি ১৫|১৬ হাজারের ভিতর হয় তো তৎক্ষণাৎ কিনিবে (যদি ভাল বোঝ)। যদি কিছু বেশী হয় তো বায়না করিয়া ঐ সাত সপ্তাহ অপেক্ষা করিও। আমার মতে আপাততঃ ওটা লওয়াই ভাল। বাকী ধীরে ধীরে হবে। ও বাগানের সহিত আমাদের সমস্ত association (স্মৃতি জড়িত)। বাস্তবিক এটাই আমাদের প্রথম মঠ। অতি গোপনে—‘ফলানুমেয়াঃ প্রারম্ভাঃ সাংস্কারাঃ প্রাক্তনা ইব’।১২৬
কাশীপুরের বাগানের অবশ্য জমির দাম বেড়ে গেছে; কিন্তু কড়ি তেমনি কমে গেছে। যা হয় একটা করো ও শীঘ্র করো। গয়ং গচ্ছ করতে করতে যত কাজ মাটি হয়। ওটাও তো নিতেই হবে, আজ না হয় কাল—আর যত বড়ই গঙ্গাতীরে মঠ হউক না। অন্য লোক দিয়ে কথা পাড়লে আরও ভাল হয়। আমাদের কেনা টের পেলে লম্বা দর হাঁকবে। চেপে কাজ করে চল। অভীঃ, ঠাকুর সহায়। ভয় কি? সকলকে আমার ভালবাসা দিবে।
বিবেকানন্দ
(খামের উপরে লিখিত)
… কাশীপুরের বিশেষ চেষ্টা দেখ। … বেলুড়ের জমি ছেড়ে দাও।
হুজুরদের নামের জ্বালায় কি গরীবগুলো শুকিয়ে মরবে? সব নাম ‘মহাবোধি’ নেয় তো নিক। গরীবদের উপকার হোক। কাজ বেশ চলছে—উত্তম কথা। আরও লেগে যাও। আমি প্রবন্ধ পাঠাতে আরম্ভ করছি। Saccharine & lime (স্যাকারিন ও নেবু) এসেছে।
বি
৩৫৬*
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২৩ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
আমার সংক্ষিপ্ত চিঠির জন্য কিছু মনে করো না। আমি এখন পাহাড় থেকে সমতলের দিকে চলেছি, কোন একটা জায়গা পৌঁছে তোমাকে বিস্তারিত চিঠি দেব।
ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও সরলতা থাকতে পারে—তোমার এ কথার যে কি অর্থ, তা তো আমি বুঝি না। আমার দিক্ থেকে আমি বলতে পারি যে, প্রাচ্য লৌকিকতার সামান্য যা এখনও আমার আছে, তার শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত মুছে ফেলে দিয়ে শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে কথা বলার জন্য আমি প্রস্তুত। আহা, যদি একটি দিনের জন্যও স্বাধীনতার পূর্ণ আলোকে বাস করা যায়, এবং সরলতার মুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করা যায়! তাই কি শ্রেষ্ঠ পবিত্রতা নয়?
এ সংসারে অন্যের ভয়ে আমরা কাজ করি, ভয়ে কথা বলি, ভয়ে, চিন্তা করি। হায়, শত্রুপরিবেষ্টিত জগতে আমাদের জন্ম! ‘শত্রুর গুপ্তচর বিশেষভাবে আমাকেই লক্ষ্য করে ফিরছে’—এমনি একটা ভীতির হাত থেকে কে নিষ্কৃতি পেয়েছে? আর যে জীবনে এগিয়ে যেতে চায়, তার ভাগ্যে আছে দুর্গতি! এ সংসার কখনও কি আপনার জনে পূর্ণ হবে? কে জানে? আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি।
কাজ শুরু হয়ে গেছে এবং বর্তমানে দুর্ভিক্ষনিবারণই আমাদের কাছে প্রধান কর্তব্য। কয়েকটি কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং কাজ চলছে—দুর্ভিক্ষসেবা, প্রচার এবং সামান্য শিক্ষাদান। এখন পর্যন্ত অবশ্য খুব সামান্য ভাবেই চলছে, যে-সব ছেলেরা শিক্ষাধীন, তাদের সুবিধামত কাজে লাগান হচ্ছে।
বর্তমানে মান্দ্রাজ ও কলিকাতাই আমাদের কাজের জায়গা। গুডউইন মান্দ্রাজে কাজ করছে। কলম্বোতেও একজন গেছে। যদি ইতোমধ্যেই পাঠান না হয়ে থাকে, তবে আগামী সপ্তাহ থেকে তোমাকে সমস্ত কাজের একটি করে মাসিক বিবৃতি পাঠান হবে। আমি বর্তমানে কর্মকেন্দ্র থেকে দূরে আছি; তাই সবই একটু ঢিলে চলছে, তা দেখতেই পাচ্ছ। কিন্তু মোটের উপর কাজ সন্তোষজনক।
তুমি এখানে না এসে ইংলণ্ডে থেকেই আমাদের জন্য বেশী কাজ করতে পারবে। দরিদ্র ভারতবাসীর কল্যাণে তোমার বিপুল আত্মত্যাগের জন্য ভগবান্ তোমাকে আশীর্বাদ করুন!
আমি ইংলণ্ডে গেলে সেখানকার কাজ অনেকটা জেঁকে উঠবে, তোমার মত আমিও তা বিশ্বাস করি। তথাপি এখানকার কর্মচক্র খানিক ঘুরতে আরম্ভ না করলে এবং আমার অনুপস্থিতিতে কাজ চালাবার মত অনেকে আছে, এটি না জেনে আমার পক্ষে ভারতবর্ষ ত্যাগ করা ঠিক হবে না। মুসলমানরা যেমন বলে, ‘খোদার মর্জিতে’—তা কয়েক মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে। আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্মী খেতড়ির রাজা এখন ইংলণ্ডে আছেন। তিনি শীঘ্র ভারতে আসবেন, এবং তিনি অবশ্যই আমার বিশেষ সহায়ক হবেন।
আমার অনন্ত ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৫৭
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
২৪ জুলাই, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সবিশেষ অবগত হইয়া বিশেষ আনন্দিত হইলাম। Orphanage (অনাথাশ্রম) সম্বন্ধে তোমার যে অভিপ্রায় অতি উত্তম ও শ্রী-মহারাজ তাহা অচিরাৎ পূর্ণ করিবেন নিশ্চিত। একটা স্থায়ী centre (কেন্দ্র) যাহাতে হয়, তাহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিবে। … টাকার চিন্তা নাই—কল্য আমি আলমোড়া হইতে plain-এতে (সমতল প্রদেশে) নামিব, যেখানে হাঙ্গাম হইবে সেইখানে একটা চাঁদা করিব—famine-এর (দুর্ভিক্ষের) জন্য—ভয় নাই। যে প্রকার আমাদের কলিকাতার মঠ, ঐ নমুনায় প্রত্যেক জেলায় যখন এক-একটি মঠ হইবে, তখনই আমার মনস্কামনা পূর্ণ হইবে। প্রচারের কার্যও যেন বন্ধ না হয় এবং প্রচারাপেক্ষাও বিদ্যাশিক্ষাই প্রধান কার্য; গ্রামের লোকদের lecture (বক্তৃতা) আদি দ্বারা ধর্ম, ইতিহাস ইত্যাদি শিক্ষা দিতে হইবে—বিশেষ ইতিহাস। ইংলণ্ডে আমাদের এই শিক্ষাকার্যের সহায়তার জন্য একটি সভা আছে; ঐ সভার কার্য অতি উত্তম চলিতেছে, সংবাদ পাইয়া থাকি। এই প্রকার চতুর্দিক হইতে ক্রমশঃ সহায় আসিবে। ভয় কি? যারা ভাবে যে, সহায়তা এলে তারপর কার্য করব, তাদের দ্বারা কোন কার্য হয় না। যারা ভাবে যে, কার্যক্ষেত্রে নামলেই সহায় আসবে, তারাই কার্য করে।
সব শক্তি তোমাতে আছে বিশ্বাস কর, প্রকাশ হতে বাকী থাকবে না। আমার প্রাণের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিবে ও ব্রহ্মচারীকে জানাইবে। তুমি মঠে খুব উৎসাহপূর্ণ চিঠি মধ্যে মধ্যে লিখিবে, যাহাতে সকলে উৎসাহিত হয়ে কার্য করে। ওয়া গুরুকী ফতে। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
৩৫৮*
[মেরী হেলবয়েস্টারকে লিখিত]
আলমোড়া
২৫ জুলাই, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
এবার আমার প্রতিশ্রুতি পালনের সময়, ইচ্ছা ও সুযোগ হয়েছে। তাই এ চিঠি লিখতে বসেছি। কিছুকাল আমার শরীরটা খুব দুর্বল ছিল, এবং নানা কারণে এই (জুবিলী) উৎসবের মরসুমে আমার ইংলণ্ড যাওয়া স্থগিত রাখতে হল।
আমার অকপট ও প্রেমাস্পদ বন্ধুদের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হতে পারলাম না বলে প্রথমটায় মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দেখলাম কর্মফল এড়াবার যো নেই, তাই আমার এই হিমালয়কে নিয়েই পরিতুষ্ট থাকতে হল। তবে এ বিনিময়ে মোটেই খুশী হতে পারিনি, কারণ মানুষের মুখচ্ছবিতে জীবন্ত আত্মার প্রতিফলনে যে সৌন্দর্য, জড় জগতের যাবতীয় সৌন্দর্যের চেয়ে তা অনেক বেশী আনন্দদায়ক।
আত্মাই কি জগতের আলোকস্বরূপ নয়?
নানা কারণে লণ্ডনের কাজ একটু ঢিমে-তেতালায় চলেছে; তার একটি মুখ্য কারণ হল—কাঞ্চন, বুঝলে? আমি সেখানে থাকলে টাকাকড়ি যে-কোন উপায়ে জুটে যায়, এবং কাজ এগিয়ে যায়। এখন কেউই কাঁধ পাতছে না। আমাকে আবার যেতেই হবে, এবং কাজটাকে আবার গড়ে তোলার জন্য প্রাণপাত চেষ্টা করতে হবে।
আজকাল বেশ খানিকটা ব্যায়াম করছি ও ঘোড়ায় চড়ছি, কিন্তু চিকিৎসকের ব্যবস্থা মত আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে সর-তোলা দুধ খেতে হয়েছিল আর তারই ফলে আমি পিছনের চেয়ে সামনের দিকে বেশী এগিয়ে গিয়েছি। যদিও আমি সবসময়ই আগুয়ান কিন্তু এখনই এতটা অগ্রগতি চাই না, তাই দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
জেনে খুশী হলাম খাবার সময় তোমার বেশ ক্ষুধা হয়।
উইম্বল্ডনের মিস মার্গারেট নোব্ল্কে তুমি জান কি? সে আমার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। যদি পার তো তার সঙ্গে ডাকে যোগাযোগ করো, তা হলে সেখানে তুমি আমার কাজে অনেকটা সহায়তা করতে পারবে। তার ঠিকানা—Brantwood, Worple Road, Wimbledon.
তাহলে আমার ছোট বন্ধু মিস অর্চার্ড (Miss Orchard)-কে তুমি দেখেছ এবং তাকে তোমার বেশ ভালও লেগেছে—বেশ কথা। তার সম্বন্ধে আমার অনেক আশা। যখন আমি খুব বুড়ো হয়ে যাব, তখন তোমার বা মিস অর্চার্ডের মত আমার বিশেষ প্রিয় ছোট ছোট বন্ধুদের জয়বার্তা পৃথিবীর বুকে ঘোষিত হচ্ছে দেখে কতই না আনন্দের সঙ্গে জীবনের যাবতীয় কাজকর্ম থেকে চিরদিনের মত অবসর গ্রহণ করব!
কথায় কথায় বলে রাখি, আমার চুল পাকতে শুরু করেছে—এত তাড়াতাড়ি যে বুড়ো হতে চলেছি, তাতে আনন্দই হচ্ছে। সোনালীর মধ্যে—অর্থাৎ কালোর মধ্যে—রূপালী কেশ অতি দ্রত এসে যাচ্ছে।
ধর্মপ্রচারকের অল্পবয়সী হওয়া ভাল নয়, তোমার তাই মনে হয় না কি? আমি কিন্তু তাই মনে করি, সারা জীবন ধরেই মনে করেছি। একজন বৃদ্ধের প্রতি মানুষ অনেক বেশী আস্থা এবং তাঁকে দেখে অনেক বেশী শ্রদ্ধা জাগে। তথাপি এ জগতে বুড়ো বদমাসগুলিই সবচেয়ে মারাত্মক, তাই নয় কি? এই দুনিয়ার বিচারের একটা নিজস্ব নিয়ম আছে, এবং হায়, সত্য থেকে তা কতই না স্বতন্ত্র!
তাহলে তোমার ‘বিশ্বজনীন ধর্ম’ (প্রবন্ধ) রিভিউ দ্য দ্যো মোঁদে (Revue de deux Mondes) পত্রিকা নাকচ করে দিয়েছে। মুষড়ে পড়ো না, আবার অন্য কোন কাগজে চেষ্টা কর। আমি নিশ্চিত যে একবার গৃহীত হলে তুমি খুব দ্রুত প্রবেশাধিকার পাবে। আমি খুবই আনন্দিত যে, কাজটিকে তুমি খুব ভালবাস; কাজ তার নিজের পথ তৈরী করে নেবে, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। স্নেহের মেরী, আমাদের ভাবাদর্শের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, এবং অদূর ভবিষ্যতেই তার সার্থক রূপায়ণ হবে।
মনে হয় এ চিঠিখানা পারি-তে গিয়ে তোমার সঙ্গে মিলিত হবে—তোমার সৌন্দর্যময় পারি—এবং আশা করি ফরাসী দেশের সাংবাদিকতা ও সেখানকার আসন্ন ‘বিশ্ব মেলা’ সম্পর্কে তুমি আমাকে অনেক কিছু লিখবে।
বেদান্ত ও যোগের সাহায্যে তুমি উপকৃত হয়েছ, এ-কথা জেনে আমি খুবই খুশী। দুর্ভাগ্যক্রমে মাঝে মাঝে আমার নিজেকে সার্কাস-দলের ক্লাউনের মত মনে হয়, সে কেবল অন্যকে হাসায়, কিন্তু তার নিজের দশা সকরুণ।
স্বভাবতই তোমার বেশ হাসিখুশী মেজাজ। তোমার মনে কোন কিছুরই যেন প্রভাব পড়ে না। তা ছাড়া তুমি খুবই পরিণামদর্শী, কারণ খুব সাবধানে তুমি ‘প্রেম’ বা প্রেমঘটিত যাবতীয় বাজে জিনিষ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছ। তাহলেই দেখতে পাচ্ছ, তুমি শুভকর্ম করেছ এবং তোমার জীবনব্যাপী কল্যাণের বীজ বপন করেছ। আমাদের জীবনের ত্রুটি হল এই যে, আমরা বর্তমানের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হই—ভবিষ্যতের দ্বারা নয়। যা এই মুহূর্তে আমাদের ক্ষণিক আনন্দ দেয়, তারই পিছনে আমরা ছুটি; ফলে দেখা যায়, বর্তমানের ক্ষণিক আনন্দের বিনিময়ে আমরা ভবিষ্যতের বিপুল দুঃখ সঞ্চার করে বসি।
যদি ভালবাসবার মত কেউ আমার না থাকত! যদি আমি শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হতাম! আমার আপনার লোকেরাই আমার পক্ষে সবচেয়ে বেশী দুঃখের কারণ হয়েছে—আমার ভ্রাতা, ভগ্নী, জননী ও অন্য সব আপন জন। আত্মীয়স্বজনরাই মানুষের উন্নতির পথে কঠিন বাধাস্বরূপ। আর এটা খুব আশ্চর্য নয় কি যে, মানুষ তৎসত্ত্বেও বিবাহ করবে ও নূতন মানুষের জন্ম দিতে থাকবে!!!
যে মানুষ একাকী, সে-ই সুখী। সকলের কল্যাণ কর, সকলকে তোমার ভাল লাগুক, কিন্তু কাউকে ভালবাসতে যেও না। এটা একটা বন্ধন, আর বন্ধন শুধুই দুঃখ ডেকে আনে। তোমার অন্তরে তুমি একাকী বাস কর—তাতে সুখী হবে। যার দেখাশুনো করবার কেউ নেই এবং কারও তত্ত্বাবধান নিয়ে যে মাথা ঘামায় না, সেই মুক্তির পথে এগিয়ে যায়।
তোমার মনের গঠন দেখে আমার ঈর্ষা হয়—শান্ত, নম্র, হাসিখুশী অথচ গভীর ও বন্ধনহীন। তুমি মুক্ত হয়ে গেছ, মেরী, তুমি মুক্ত হয়ে আছ; তুমি তো জীবন্মুক্ত। আমার প্রকৃতিতে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের গুণ বেশী, আর তোমার মধ্যে মেয়েদের চাইতে পুরুষের গুণ বেশী। আমি সব সময়ই অন্যের দুঃখ-বেদনা শুধু-শুধুই নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছি, অথচ কারও কোন কল্যাণ করতেও পারছি না—ঠিক যেমন মেয়েদের সন্তান না হলে একটি বেড়াল পুষে তার প্রতি সকল ভালবাসা ঢেলে দেয়।
তোমার কি মনে হয়, তার মধ্যে কোন আধ্যাত্মিকতা আছে? একদম না, এগুলি হল জড় স্নায়বিক বন্ধন—হ্যাঁ, ঠিক তাই। হায়, পঞ্চভূতে গড়া এই দেহের দাসত্ব ঘোচান—সে কি সহজ কথা!
তোমার বন্ধু মিসেস মার্টিন প্রতি মাসে অনুগ্রহ করে তাঁর পত্রিকাটি আমাকে পাঠাচ্ছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে, স্টার্ডির থার্মোমিটার এখন শূন্য ডিগ্রীর নীচে। এই গ্রীষ্মে আমার ইংলণ্ডে যাওয়া হল না বলে তিনি খুবই নিরাশ হয়ে পড়েছেন। আমার কি-ই বা করার ছিল?
আমরা এখানে দুটি মঠের পত্তন করেছি—একটি কলিকাতায়, অপরটি মান্দ্রাজে। কলিকাতার মঠটি (একটি জীর্ণ ভাড়াটে বাড়ী) সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ভয়ানক আন্দোলিত হয়েছে।
আমরা বেশ কয়েকটি যুবককে পেয়েছি, তাদের এখন শিক্ষানবিশী চলছে। তা ছাড়া আমরা বিভিন্ন জায়গায় দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের জন্য সেবাকেন্দ্র খুলেছি, এবং কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে আমরা ঐরকম কেন্দ্র স্থাপন করার চেষ্টা করব।
কয়েকদিন বাদেই আমি সমতলে যাচ্ছি এবং সেখান থেকে যাব—এই পর্বতের পশ্চিম খণ্ডে। সমভূমিতে যখন একটু ঠাণ্ডা পড়বে, তখন দেশময় একবার বক্তৃতা দিয়ে বেড়াব—দেখব কি পরিমাণ কাজ করা যায়।
এখন আর লিখবার সময় নেই, অনেক লোক অপেক্ষা করছে—তাই স্নেহের মেরী, তোমার জন্য সর্ববিধ আনন্দ ও সুখ কামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি। হাড়মাসের দেহ কখনও যেন তোমাকে প্রলুব্ধ করতে না পারে, সতত এই প্রার্থনা।
সর্বদা প্রভুসমীপে তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৫৯*
[মিসেস লেগেটকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
২৮ জুলাই, ১৮৯৭
মা,
আপনার সুন্দর ও সহৃদয় লিপিখানির জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার কতই না ইচ্ছা ছিল খেতড়ির রাজার সঙ্গে লণ্ডনে গিয়ে সেখানকার আমন্ত্রণ গ্রহণ করার। গত মরসুমে লণ্ডনে আমার অনেকগুলি ভোজের নিমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু কপালে তা নেই; আমার ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্যই রাজার সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হল না।
এলবার্টা তাহলে আবার আমেরিকায় স্বগৃহে ফিরে এসেছে। রোমে আমার জন্য সে যা করেছে, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ। হলি (Hollister) কেমন আছে? তাদের উভয়কে আমার ভালবাসা জানাবেন এবং আমার সর্বকনিষ্ঠ নবজাত ভগিনীটিকে আমার হয়ে চুম্বন দেবেন।
ন-মাস হল আমি হিমালয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়েছি। এবার আবার কাজের লাগাম ধরতে সমতলে ফিরে যাচ্ছি।
ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স, জো জো ও ম্যাবেলকে আমার ভালবাসা এবং আপনাকেও চিরন্তনভাবে।
সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ
৩৬০*
আলমোড়া
২৯ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
স্টার্ডির একখানি চিঠি কাল পেয়েছি। তাতে জানলাম যে, তুমি ভারতে আসতে এবং সব কিছু চাক্ষুষ দেখতে দৃঢ়সঙ্কল্প। কাল তার উত্তর দিয়েছি। কিন্তু মিস মূলারের কাছ থেকে তোমার কর্মপ্রণালী সম্বন্ধে যা জানতে পারলাম, তাতে এ পত্রখানিও আবশ্যক হয়ে পড়েছে; মনে হচ্ছে, সরাসরি তোমাকে লেখা ভাল।
তোমাকে খোলাখুলি বলছি, এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে যে, ভারতের কাজে তোমার এক বিরাট ভবিষ্যৎ রয়েছে। ভারতের জন্য, বিশেষতঃ ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষের চেয়ে নারীর—একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন। ভারতবর্ষ এখনও মহীয়সী মহিলার জন্মদান করতে পারছে না, তাই অন্য জাতি থেকে তাকে ধার করতে হবে। তোমার শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, অসীম ভালবাসা, দৃঢ়তা—সর্বোপরি তোমার ধমনীতে প্রবাহিত কেল্টিক রক্তের জন্য তুমি ঠিক সেইরূপ নারী, যাকে আজ প্রয়োজন।
কিন্তু বিঘ্নও আছে বহু। এদেশের দুঃখ, কুসংস্কার, দাসত্ব প্রভৃতি কি ধরনের, তা তুমি ধারণা করতে পার না। এদেশে এলে তুমি নিজেকে অর্ধ-উলঙ্গ অসংখ্য নর-নারীতে পরিবেষ্টিত দেখতে পাবে। তাদের জাতি ও স্পর্শ সম্বন্ধে বিকট ধারণা; ভয়েই হোক বা ঘৃণাতেই হোক—তারা শ্বেতাঙ্গদের এড়িয়ে চলে এবং তারাও এদের খুব ঘৃণা করে। পক্ষান্তরে, শ্বেতাঙ্গেরা তোমাকে খামখেয়ালী মনে করবে এবং তোমার প্রত্যেকটি গতিবিধি সন্দেহের চক্ষে দেখবে।
ভারতে তা ছাড়া, জলবায়ু অত্যন্ত গ্রীষ্মপ্রধান। এদেশের প্রায় সব জায়গার শীতই তোমাদের গ্রীষ্মের মত; আর দক্ষিণাঞ্চলে তো সর্বদাই আগুনের হল্কা চলছে।
শহরের বাইরে কোথাও ইওরোপীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিছুমাত্র পাবার উপায় নেই। এসব সত্ত্বেও যদি তুমি কর্মে প্রবৃত্ত হতে সাহস কর, তবে অবশ্য তোমাকে শতবার স্বাগত জানাচ্ছি। সর্বত্র যেমন, এখানেও তেমনি আমি কেউ নই; তবু আমার যেটুকু প্রভাব আছে, সেটুকু দিয়ে আমি অবশ্যই তোমায় সাহায্য করব।
কর্মে ঝাঁপ দেবার পূর্বে বিশেষভাবে চিন্তা করো এবং কাজের পরে যদি বিফল হও কিম্বা কখনও কর্মে বিরক্তি আসে, তবে আমার দিক্ থেকে নিশ্চয় জেনো যে, আমাকে আমরণ তোমার পাশেই পাবে—তা তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ কর আর নাই কর, বেদান্ত-ধর্ম ত্যাগই কর আর ধরেই থাক। ‘মরদ্কী বাত হাতীকা দাঁত’—একবার বেরুলে আর ভিতরে যায় না; খাঁটি লোকের কথারও তেমনি নড়চড় নেই—এই আমার প্রতিজ্ঞা। আবার তোমাকে একটু সাবধান করা দরকার—তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, মিস মূলার কিম্বা অন্য কারও পক্ষপুটে আশ্রয় নিলে চলবে না। তাঁর নিজের ভাবে মিস মূলার চমৎকার মহিলা; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই ধারণা ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মাথায় ঢুকেছে যে, তিনি আজন্ম নেত্রী আর দুনিয়াকে ওলটপালট করে দিতে টাকা ছাড়া অন্য কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। এই মনোভাব তাঁর অজ্ঞাতসারেই বারবার মাথা তুলছে এবং দিন কয়েকের মধ্যেই তুমি বুঝতে পারবে যে, তাঁর সঙ্গে বনিয়ে চলা অসম্ভব। তাঁর বর্তমান সঙ্কল্প এই যে, তিনি কলিকাতায় একটি বাড়ী ভাড়া নেবেন—তোমার ও নিজের জন্য, এবং ইওরোপ ও আমেরিকা থেকে যে-সব বন্ধুদের আসার সম্ভাবনা আছে তাঁদেরও জন্য। এটা অবশ্য তাঁর সহৃদয়তা ও অমায়িকতার পরিচায়ক; কিন্তু তাঁর মঠাধ্যক্ষাসুলভ সঙ্কল্পটি দুটি কারণে সফল হবে না—তাঁর রুক্ষ মেজাজ এবং অদ্ভুত অস্থিরচিত্ততা। কারও কারও সঙ্গে দূর থেকে বন্ধুত্ব করাই ভাল; যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, তার সবই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।
মিসেস সেভিয়ার নারীকুলের রত্নবিশেষ; এত ভাল, এত স্নেহময়ী তিনি! সেভিয়ার-দম্পতিই একমাত্র ইংরেজ, যাঁরা এদেশীয়দের ঘৃণা করেন না; এমন কি স্টার্ডিকেও বাদ দেওয়া চলে না। একমাত্র সেভিয়াররাই আমাদের উপর মুরুব্বিয়ানা করতে এদেশে আসেননি। কিন্তু তাঁদের এখনও কোন নির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী নেই। তুমি এলে তোমার সহকর্মীরূপে তাঁদের পেতে পার এবং তাতে তোমার ও তাঁদের—উভয়েরই সুবিধা হবে। কিন্তু আসল কথা এই যে, নিজের পায়ে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।
আমেরিকার সংবাদে জানলাম যে, আমার দুজন বন্ধু—মিস ম্যাকলাউড ও বোষ্টনের মিসেস বুল এই শরৎকালেই ভারত-পরিভ্রমণে আসছেন। মিস ম্যাকলাউডকে তুমি লণ্ডনেই দেখছ—সেই পারি-ফ্যাশনের পোষাক-পরিহিতা মহিলাটি! মিসেস বুলের বয়স প্রায় পঞ্চাশ এবং তিনি আমেরিকায় আমার বিশেষ উপকারী বন্ধু ছিলেন। তাঁরা ইওরোপের হয়ে এদেশে আসছেন; সুতরাং আমার পরামর্শ এই যে, তাঁদের সঙ্গে এলে তোমার পথের একঘেয়েমি দূর হতে পারে।
মিঃ স্টার্ডির কাছ থেকে শেষ পর্যন্ত একখানা চিঠি পেয়ে সুখী হয়েছি। কিন্তু চিঠিটি বড় শুষ্ক এবং প্রাণহীন। লণ্ডনের কাজ পণ্ড হওয়ায় তিনি হতাশ হয়েছেন বলে মনে হয়।
অনন্ত ভালবাসা জানবে। ইতি
সদা ভগবৎ-পদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
৩৬১
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২৯ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় শশী,
তোমার কাজকর্ম বেশ চলছে, খবর পাইলাম। তিনটি ভাষ্য বেশ করে পড়ে রাখবে, আর ইওরোপীয় দর্শনাদিও বেশ করে পড়বে, ইহাতে অন্যথা না হয়। পরকে মারতে গেলে ঢাল-তলওয়ার চাই, এ কথা যেন ভুল একদম না হয়। সুকুল এক্ষণে পৌঁছিয়াছে, তোমার সেবাদিও বেশ চলছে বোধ হয়। সদানন্দ যদি সেখানে থাকিতে না চায়, কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবে, এবং প্রতি সপ্তাহে একটা রিপোর্ট—আয়-ব্যয় প্রভৃতি সব সমেত মঠে পাঠাইতে ভুল যেন না হয়। আলাসিঙ্গার বোনাই এখানে বদ্রী শা-র নিকট হতে চারিশত টাকা ধার করিয়া লইয়া গিয়াছে; পৌঁছিবামাত্র পাঠাইবার কথা, এখনও কেন পাঠাইল না। আলাসিঙ্গাকে জিজ্ঞাসিবে এবং সত্বর পাঠাইতে কহিবে; কারণ আমি পরশুদিন এখান হতে যাচ্ছি—মসূরী পাহাড় বা অন্য কোথাও যাই পরে ঠিক করব। কাল এখানে ইংরেজ-মহলে এক লেকচার হয়েছিল, তাতে বড়ই খুশী। কিন্তু তার আগের দিন হিন্দীতে এক বক্তৃতা করি, তাতে আমি বড়ই খুশী—হিন্দীতে যে oratory (বাগ্মিতা) করতে পারব তা তো আগে জানতাম না। মঠে ছেলেপুলে যোগাড় হচ্ছে কি? যদি হয় তো কলিকাতায় যেভাবে কার্য হচ্ছে, ঠিক সেইভাবে করে যাও। নিজের বুদ্ধি এখন কিছুদিন বেশী খরচ করবে না, পাছে ফুরিয়ে যায়—কিছুদিন পরে করো।
তোমার শরীরের উপর বিশেষ লক্ষ্য রাখবে—তবে বিশেষ আতুপুতুতে শরীর উল্টা আরও খারাপ হয়ে যায়। বিদ্যের জোর না থাকলে কেউ ঘণ্টা-ফণ্টা মানবে না—এ-কথাটা নিশ্চিত, এবং এইটি মনে স্থির রেখে কার্য করবে।
আমার হৃদয়ের ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিবে ও গুডউইন প্রভৃতিকে জানাইবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৬২
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
৩০ জুলাই, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
তোমার কথামত ডিষ্ট্রীক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট লেভিঞ্জ সাহেবকে এক পত্র লিখিলাম। অপিচ তুমি তাঁহার বিশেষ বিশেষ কার্যকলাপ বিবৃত করিয়া শশী-ডাক্তারকে দিয়া দেখাইয়া ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এ একটি লম্বাচওড়া পত্র লিখিবে ও তাহার এক কপি উক্ত মহোদয়কে পাঠাইবে। আমাদের মূর্খগুলো খালি দোষ অনুসন্ধান করে, গুণও কিঞ্চিৎ দেখুক।
আমি আগামী সোমবার এস্থান হইতে প্রস্থান করিতেছি।
Orphan (অনাথ বালক) যোগাড়ের কি করছ? মঠ হতে চারি-পাঁচজনকে না হয় ডাকিয়া লও, গাঁয়ে গাঁয়ে খুঁজিলে দুদিনেই মিলিবার সম্ভাবনা।
Permanent Centre (স্থায়ী কেন্দ্র) করিতে হইবে বৈকি। আর—দেবকৃপা না হলে এদেশে কি কাজ হয়? রাজনীতি ইত্যাদিতে কোন যোগ দিবে না অথবা সংস্রব রাখিবে না। অথচ তাদের সহিত কোন বিবাদাদিতেও কাজ নাই। একটা কার্যে তন্ মন ধন। এখানে একটি—সাহেবমহলে-ইংরেজী বক্তৃতা হইয়াছিল, ও একটি—দেশী লোকদিগকে হিন্দীতে। হিন্দীতে আমার এই প্রথম, কিন্তু সকলের তো খুব ভাল লাগল। সাহেবরা অবশ্যই যেমন আছে, নাল গড়িয়ে গেল, ‘কালো মানুষ!’ ‘তাই তো কি আশ্চর্য’ ইত্যাদি। আগামী শনিবার আর একটি বক্তৃতা ইংরেজীতে, দেশী লোকের জন্য। এখানে একটি বৃহৎ সভা স্থাপন করা গেল—ভবিষ্যতে কতদূর কার্য হয় দেখা যাক। সভার উদ্দেশ্য বিদ্যা ও ধর্ম শিক্ষা দেওয়া।
সোমবার বেরেলি-যাত্রা, তারপর সাহারানপুর, তারপর আম্বালা, সেখান হইতে ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের সঙ্গে বোধ হয় মসূরী, আর একটু ঠাণ্ডা পড়লেই দেশে পুনরাগমন ও রাজপুতানায় গমন ইত্যাদি।
তুমি খুব চুটিয়ে কাজ করে যাও, ভয় কি? আমিও ‘ফের লেগে যা’ আরম্ভ করেছি। শরীর তো যাবেই, কুঁড়েমিতে কেন যায়? It is better to wear out than rust out. (মরচে পড়ে পড়ে মরার চেয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরা ভাল)। মরে গেলেও হাড়ে হাড়ে ভেল্কি খেলবে, তার ভাবনা কি? দশ বৎসরের ভেতর ভারতবর্ষটাকে ছেয়ে ফেলতে হবে—‘এর কমে হবেই না।’ তাল ঠুকে লেগে যাও—‘ওয়া গুরুকী ফতে!’ টাকা-ফাকা সব আপনা-আপনি আসবে। মানুষ চাই, টাকা চাই না। মানুষ সব করে, টাকায় কি করতে পারে? মানুষ চাই—যত পাবে ততই ভাল। … এই—তো ঢের টাকা যোগাড় করেছিল, কিন্তু মানুষ নাই—কি কাজ করলে বল? কিমধিকমিতি।
বিবেকানন্দ
৩৬৩*
[মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত]
আলমোড়া
১১ অগষ্ট, ১৮৯৭
প্রিয় জো,
… হ্যাঁ, জগন্মাতার কার্য পড়ে থাকবে না, কারণ তা সত্য, আন্তরিকতা ও পবিত্রতার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এখনও তা থেকে বিচ্যুতি ঘটেনি। ঐকান্তিক অকপটতাই হল এর মূলনীতি।
ভালবাসা সহ তোমার
বিবেকানন্দ
৩৬৪
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
আম্বালা
১৯ অগষ্ট, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
মান্দ্রাজের কাজ অর্থাভাবে উত্তমরূপে চলিতেছে না শুনিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলাম। আলাসিঙ্গা ও তাহার ভগিনীপতির টাকা আলমোড়ায় পৌঁছিয়াছে শুনিয়া সুখী হইয়াছি। গুডউইন লিখিতেছে, যে টাকা বাকী আছে লেকচার-এর দরুন—তাহা হইতে কিছু লইবার জন্য, Reception Committee (অভ্যর্থনা সমিতি)-কে চিঠি লিখিতে বলিতেছে। … উক্ত লেকচার-এর টাকা Reception-এ (অভ্যর্থনায়) খরচ করা অতি নীচ কার্য—তাহার বিষয়ে আমি কোন কথা কাহাকেও বলিতে ইচ্ছা করি না। টাকা সম্বন্ধে আমাদের দেশীয় লোক যে কিরূপ, তাহা আমি বিলক্ষণ বুঝিয়াছি। … তুমি নিজে বন্ধুদের—আমার তরফ হইতে এ-কথা বুঝাইয়া বলিবে এবং তাঁহারা যদি খরচ চালান ভাল, নতুবা তোমরা কলিকাতার মঠে চলিয়া আসিবে, অথবা রামনাদে মঠ উঠাইয়া লইয়া যাইবে।
আমি এক্ষণে ধর্মশালার পাহাড়ে যাইতেছি। নিরঞ্জন, দীনু, কৃষ্ণলাল, লাটু ও অচ্যুত অমৃতসরে থাকিবে। সদানন্দকে এতদিন মঠে কেন পাঠাও নাই? যদি সেখানে এখনও থাকে, পরে অমৃতসর হইতে নিরঞ্জন পত্র লিখিলেই তাহাকে পাঞ্জাবে পাঠাইবে। আমি কিছুদিন আরও পাঞ্জাবী পাহাড়ে বিশ্রাম করিয়া পাঞ্জাবে কার্য আরম্ভ করিব। পাঞ্জাব ও রাজপুতানাই কার্যের ক্ষেত্র। কার্য আরম্ভ করিয়াই তোমাদের পত্র লিখিব।
আমার শরীর মধ্যে বড় খারাপ হইয়াছিল। এক্ষণে ধীরে ধীরে শুধরাইতেছে। পাহাড়ে দিনকতক থাকিলেই ঠিক হইয়া যাইবে। আলাসিঙ্গা, জি. জি, গুডউইন, গুপ্ত, সুকুল প্রভৃতি সকলকে আমার ভালবাসা দিও, তুমিও জানিও। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৬৫*
মঠ, (বেলুড়?)১২৭
১৩ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় মিসেস বুল,
আমার শরীর বিশেষ ভাল যাচ্ছে না; যদিও খানিকটা বিশ্রাম পেয়েছি, তবু আগামী শীতের আগে পূর্ব শক্তি ফিরে পাব বলে বোধ হয় না। জো-র একখানি পত্রে জানলাম যে, আপনারা দুজন ভারতবর্ষে আসছেন। বলাই বাহুল্য আপনাদের এখানে দেখতে পেলে আমি আনন্দিত হব; কিন্তু গোড়া থেকেই জেনে রাখা ভাল যে, ভারতবর্ষ পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর। বড় নগরাদি ছাড়া অন্যত্র ইওরোপীয় জীবনযাত্রার সুখ-সুবিধা নেই বললেই চলে।
ইংলণ্ড থেকে সংবাদ পেলাম যে, মিঃ স্টার্ডি অভেদানন্দকে নিউ ইয়র্কে পাঠাচ্ছেন। আমাকে বাদ দিয়ে ইংলণ্ডের কাজ চলা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। এক্ষণে একটি মাত্র পত্রিকা মিঃ স্টার্ডি চালাবেন। এই মরসুমেই আমি ইংলণ্ডে যাবার আগেই ব্যবস্থা করেছিলাম, কিন্তু ডাক্তারদের বোকামিতে বাধা পেলাম। ভারতবর্ষের কাজ চলছে।
ইওরোপ কিম্বা আমেরিকার কেউ ঠিক এখনই এদেশের কোন কাজে আসবে বলে আমার তো মনে হয় না। তা ছাড়া কোন পাশ্চাত্য দেশবাসীর পক্ষে এদেশের জলবায়ু সহ্য করা বিশেষ কষ্টসাধ্য। এনি বেস্যাণ্টের অসাধারণ শক্তি থাকলেও তিনি কেবল থিওসফিষ্টদের মধ্যে কাজ করেন; ফলে এদেশে ম্লেচ্ছদের যে-রকম সমাজবর্জিত হয়ে থাকা প্রভৃতি নানা অসম্মান ভোগ করতে হয়, তাঁকেও তাই করতে হচ্ছে। এমন কি গুডউইন পর্যন্ত মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ওঠে এবং তাকে ঠিক করে দিতে হয়। গুডউইন বেশ কাজ করছে, সে পুরুষ বলে লোকের সঙ্গে মিশতে বাধা নেই। কিন্তু এদেশে পুরুষদের সমাজে মেয়েদের কোন স্থান নেই, মেয়েরা শুধু নিজেদের মধ্যেই কাজ করতে পারে। যে-সব ইংরেজ বন্ধু এদেশে এসেছেন, তাঁরা এ যাবৎ কোন কাজেই লাগেননি; ভবিষ্যতেও তাঁদের দ্বারা কিছু হবে কিনা, জানি না। এ সকল জেনেও যদি কেউ চেষ্টা করতে রাজী থাকে, তবে তাকে সাদরে আহ্বান করি।
সারদানন্দ যদি আসতে চায় তো চলে আসুক, আমার স্বাস্থ্য এখন ভেঙে গেছে; সুতরাং সে এলে সব কাজ গুছোতে বিশেষ সাহায্য হবে, সন্দেহ নেই।
দেশে ফিরে গিয়ে যাতে এদেশের জন্য কাজ করতে পারেন—এই উদ্দেশ্যে মিস মার্গারেট নোব্ল্ নামে একটি ইংরেজ মেয়ে ভারতে এসে এখানকার অবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়-লাভের জন্য খুব উৎসুক হয়েছে। আপনারা যদি লণ্ডন হয়ে আসেন, তবে আপনার সঙ্গে আসার জন্য তাকে লিখেছি। বড় অসুবিধা এই যে, দূর থেকে কখনও আপনারা এখানকার অবস্থা পুরোপুরি বুঝতে পারবেন না। দুটি দেশের ধরন এতই স্বতন্ত্র যে, আমেরিকা কিম্বা ইংলণ্ড থেকে তার কোন ধারণা করা অসম্ভব।
ভাববেন যে, আপনারা যেন আফ্রিকার অভ্যন্তরে যাবার জন্য বেরিয়েছেন, তারপর যদি দৈবাৎ উৎকৃষ্ট কিছু পান তো সেটা আশাতিরিক্ত। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
৩৬৬
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
অমৃতসর
২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
যোগেন এক পত্রে … বাগবাজারে … বাটী ২০,০০০ টাকায় … কিনিতে বলেন। … ঐ বাড়ী কিনিলেও বেশ হাঙ্গাম আছে, যথা—ভেঙেচুরে বৈঠকখানাটিকে একটি হল করা এবং অন্যান্য বন্দোবস্ত করা। আবার ঐ বাটী অতি প্রাচীন ও জীর্ণ। যাহা হউক গিরিশবাবু ও অতুলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া যাহা ভাল হয় করিবে। আমি সদলে অদ্য কাশ্মীরে চলিলাম দুইটার গাড়ীতে। মধ্যে ধর্মশালা পাহাড়ে যাইয়া শরীর অনেক সুস্থ হইয়াছে এবং টনসিল, জ্বর প্রভৃতি একেবারে আরাম হইয়া গিয়েছে। ...
তোমার এক পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। নিরঞ্জন, লাটু, কৃষ্ণলাল, দীননাথ, গুপ্ত ও অচ্যুত আমার সঙ্গে কাশ্মীর যাইতেছে।
মান্দ্রাজ হইতে যে ব্যক্তি famine work-এ (দুর্ভিক্ষ-সেবাকার্যে) ১৫০০ টাকা দিয়াছে, সে চায় যে তাহার বিশেষ টাকা কি কি খরচে গেল—তাহার একটি তালিকা। উহা তাহাকে পাঠাইবে। আমরা এক রকম আছি ভাল। ইতি
বিবেকানন্দ
পুঃ—মঠের সকলকে আমার ভালবাসা দিবে।
৩৬৭
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়
প্রধান বিচারপতি, শ্রীনগর, কাশ্মীর
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
এক্ষণে কাশ্মীর। এদেশ সম্বন্ধে যে প্রশংসা শুনিয়াছ, তাহা সত্য। এমন সুন্দর দেশ আর নাই, আর লোকগুলিও সুন্দর, তবে ভাল চক্ষু হয় না। কিন্তু এমন নরককুণ্ডের মত ময়লা গ্রাম ও শহর আর কোথাও নাই। শ্রীনগরে ঋষিবরবাবুর বাড়ীতে ওঠা গেছে। তিনি বিশেষ যত্নও করছেন। আমার চিঠিপত্র তাঁর ঠিকানায় পাঠাইবে। আমি দু-এক দিনের মধ্যে অন্যত্র বেড়াইতে যাইব; কিন্তু আসিবার সময় পুনরায় শ্রীনগর হইয়া আসিব এবং চিঠিপত্রও পাইব। গঙ্গাধর সম্বন্ধে যে চিঠি পাঠাইয়াছ, তা দেখিলাম। তাহাকে লিখিবে যে মধ্যপ্রদেশে অনেক orphan (অনাথ) রহিয়াছে ও গোরখপুরে। সেখান হইতে পাঞ্জাবীরা অনেক ছেলেপুলে আনাইতেছে। মহেন্দ্রবাবুকে বলিয়া কহিয়া একটা এ-বিষয়ে agitation (আন্দোলন) করা উচিত—যাহাতে কলিকাতার লোকে ঐ-সকল orphan-এর charge (ভার) নেয়, সে বিষয়ে একটা আন্দোলন হওয়া উচিত—বিশেষতঃ যাহাতে মিশনরীরা যে-সকল orphan (অনাথ) লইয়াছে, তাহাদের যেন ফিরাইয়া দেয়—সে-বিষয়ে গভর্ণমেণ্টকে Memorial (স্মারকলিপি) দেওয়া উচিত। গঙ্গাধরকে আসিতে বল এবং রামকৃষ্ণ-সভার তরফ হইতে এ-বিষয়ে একটা বিষম হুজ্জুক করা উচিত। কোমর বেঁধে বাড়ী বাড়ী গিয়ে হুজ্জুক কর। Mass meeting (জনসভা) করাও ইত্যাদি। সিদ্ধি হউক না হউক—একটা বিষম গোলমাল কর। Central Province (মধ্যপ্রদেশ) এবং গোরখপুর ইত্যাদিতে যে-সব প্রধান বাঙালী আছে, তাদের পত্র লিখে সব facts (বিবরণ) জানাও এবং তুমুল আন্দোলন কর। রামকৃষ্ণ-সভা একদম জেঁকে যাক। হুজুকের উপর হুজ্জুক—বিরাম না যেন হয়, এই হল secret (রহস্য)। সারদার কার্যের পরিপাটি দেখে খুব খুশী হলাম। গঙ্গাধর এবং সারদা যেখানে যেখানে গেছে, সেই সেই জেলায় এক একটা centre (কেন্দ্র) না করে আর যেন বিরত না হয়।
এইমাত্র গঙ্গাধরের পত্র পাইলাম। সে ঐ জেলায় centre (কেন্দ্র) করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—বেশ কথা। তাহাকে লিখিও যে, তাহার বন্ধু ম্যাজিষ্ট্রেট আমার পত্রের অতি সুন্দর উত্তর দিয়াছেন। কাশ্মীর হইতে নামিয়াই লাটু, নিরঞ্জন, দীনু ও খোকাকে পাঠাইয়া দিব; কারণ উহাদের এখানে আর কোন কার্য সম্ভব নয়, এবং কুড়ি-পঁচিশ দিনের মধ্যে শুদ্ধানন্দ, সুশীল ও আর একজনকে পাঠাইবে। তাহাদের আম্বালায় ক্যাণ্টনমেণ্ট মেডিকেল হল, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে পাঠাইবে। আমি সেখান হতে লাহোরে যাইব। দুটো করে গেরুয়া রঙের মোটা গেঞ্জি, পাতবার আর মুড়ি দেবার দুই দুই কম্বল, আর গায়ে দেবার একটা করে গরম কাপড় ইত্যাদি লাহোরে কিনিয়া দিব। যদি ‘রাজযোগ’ বইয়ের অনুবাদ হইয়া গিয়া থাকে তো তাহা ছাপাইবে ঘরের পয়সায়। … ভাষা যেখানে দুরূহ আছে, তাহা অতি সরল করিবে এবং যদি পারে—তুলসী তাহার একটা হিন্দী তর্জমা করুক। ঐ বইগুলি বাহির হইলে মঠের অনেক সাহায্য হয়।
তোমার শরীর—বোধ হয় এক্ষণে বেশ আছে। আমার শরীর ধর্মশালা … যাওয়া অবধি এখনও বেশ আছে। ঠাণ্ডাটিই বেশ লাগে এবং শরীর ভাল থাকে। কাশ্মীরের দু-একটা জায়গা দেখিয়া একটা উত্তম স্থানে চুপ করিয়া বসিব—এই প্রকার ইচ্ছা, অথবা জলে জলে ঘুরিব। যাহা ডাক্তারবাবু বলেন, তাহাই করিব। এখানে রাজা এখন নাই। তাঁহার মেজভাই সেনাপতি আছেন। তাঁহার সম্পাদকতায় একটা বক্তৃতা হইবার উদ্যোগ হইতেছে। যাহা হয় পরে লিখিব। দু-এক দিনের মধ্যে যদি হয় তো থাকিব; নহিলে আমি বেড়াইতে চলিলাম। সেভিয়ার মরীতেই রহিল। তাহার শরীর বড়ই অসুস্থ—টাঙ্গার ঝটকায়। মরীর বাঙালী বাবুরা বড়ই ভাল এবং ভদ্র।
জি. সি. ঘোষ, অতুল, মাষ্টার মহাশয় প্রভৃতি সকলকে আমার সাষ্টাঙ্গ দিবে ও সকলকে তাতাইয়া রাখিবে। যোগেন যে বাটী কিনিবার কথা বলিয়াছিল, তাহার খবর কি? আমি এখান হইতে অক্টোবর মাসে নামিয়া পাঞ্জাবে দু-চারটি লেকচার দিব। তাহার পর সিন্ধু হইয়া কচ্ছ, ভুজ ও কাথিয়াওয়াড়—সুবিধা হইলে পুণা পর্যন্ত, নহিলে বরোদা হইয়া রাজপুতানা। রাজপুতানা হইয়া N. W. P (উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ) ও নেপাল, তারপর কলিকাতা—এই তো প্রোগ্রাম এখন; পরে প্রভু জানেন। সকলকে আমার প্রণাম আশীর্বাদ ইত্যাদি।
বিবেকানন্দ
৩৬৮*
[মেরী হেলবয়েস্টারকে লিখিত]
C/o ঋষিবর মুখোপাধ্যায়
প্রধান বিচারপতি, শ্রীনগর, কাশ্মীর
১৫ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
প্রিয় শুদ্ধানন্দ,
অবশেষে আমরা কাশ্মীরে এসে পড়েছি। এ জায়গার সব সৌন্দর্যের কথা তোমায় লিখে আর কি হবে? আমার মতে এই হচ্ছে একমাত্র দেশ, যা যোগীদের অনুকূল। কিন্তু এদেশের যারা বর্তমান অধিবাসী, তাদের অপূর্ব দৈহিক সৌন্দর্য থাকলেও তারা অত্যন্ত অপরিষ্কার! এদেশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখবার জন্য এবং শারীরিক শক্তিলাভের জন্য আমি এক মাস জলে জলে ঘুরে বেড়াব। কিন্তু নগরটিতে এখন ভয়ানক ম্যালেরিয়া এবং সদানন্দ ও কৃষ্ণলালের জ্বর হয়েছে। সদানন্দ আজ ভাল আছে, কিন্তু কৃষ্ণলালের এখনও জ্বর আছে। ডাক্তার আজ এসে তার জোলাপের ব্যবস্থা করে গেছেন। আমরা আশা করি, সে কালকের মধ্যে সেরে উঠবে এবং আমরা যাত্রাও করব কাল। কাশ্মীর গভর্ণমেণ্ট আমাকে তাঁদের একখানি বজরা ব্যবহার করতে দিয়েছেন, বজরাটি বেশ সুন্দর, আরামপ্রদ। তাঁরা জেলার তহশিলদারদের উপরও আদেশ জারি করেছেন। এদেশের লোকেরা আমাদের দেখবার জন্য দল বেঁধে আসছে; আমাদের সুখে রাখার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই করছে।
আমেরিকায় কোন কাগজে প্রকাশিত ডাক্তার ব্যারোজের একটি প্রবন্ধ ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এ উদ্ধৃত হয়েছে; কে একজন নিজের নাম না দিয়ে ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এর ঐ অংশ আমায় পাঠিয়েছে এবং এর কি উত্তর হবে জানতে চেয়েছে। আমি অংশটুকু ব্রহ্মানন্দকে পাঠাচ্ছি এবং যে অংশগুলি নিছক মিথ্যা, তার উত্তরও লিখে দিচ্ছি।
তুমি ওখানে ভাল আছ এবং তোমার দৈনন্দিন কার্য চালিয়ে যাচ্ছ জেনে সুখী হলাম। আমি শিবানন্দের কাছ থেকেও একখানি পত্র পেয়েছি; তাতে ওখানকার কাজের সবিশেষ খবর আছে।
একমাস পরে পাঞ্জাব যাচ্ছি; তোমাদের তিনজনকে আমি আম্বালাতে পাব আশা করি। যদি কোন কেন্দ্র স্থাপিত হয় তো তোমাদের একজনকে কার্যভার দিয়ে যাব। নিরঞ্জন, কৃষ্ণলাল ও লাটুকে ফেরত পাঠিয়ে দেব।
আমার ইচ্ছা আছে, একবার চট করে পাঞ্জাব ও সিন্ধু হয়ে কাথিয়াওয়াড় ও বরোদার ভেতর দিয়ে রাজপুতানায় ফিরব, সেখান থেকে নেপাল যাব, সর্বশেষ কলিকাতায়।
আমাকে শ্র্রীনগরে ঋষিবরবাবুর বাড়ীর ঠিকানায় পত্র দিও। আমি ফিরিবার পথে পত্র পাব। সকলকে আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানিও। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৩৬৯
[শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে লিখিত]
শ্রীনগর
কাশ্মীর, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
আজ ৯ মাস যাবৎ শরীর অত্যন্ত অসুস্থ থাকায় এবং গ্রীষ্মাধিক্য অত্যন্ত বৃদ্ধি হওয়ায় পর্বতে পর্বতে ভ্রমণ করিতেছি। এক্ষণে কাশ্মীরে। আমি অনেক পর্যটন করিয়াছি; কিন্তু এমন দেশ তো কখনও দেখি নাই। এক্ষণে শীঘ্রই পাঞ্জাবে যাইব এবং পুনরায় কার্য আরম্ভ করিব। সদানন্দের মুখে তোমাদের সমস্ত সমাচার পাইলাম এবং [মধ্যে মধ্যে] পাইয়া থাকি। আমি নিশ্চিত পাঞ্জাব হইয়া করাচিতে আসিতেছি, সেথায় সাক্ষাৎ হইবে। ইতি
সাশীর্বাদং
বিবেকানন্দস্য
৩৭০
[শ্রীমতী ইন্দুমতী মিত্রকে লিখিত]
কল্যাণবরেষু,
মা, আমি (পত্র) লিখিতে পারি নাই এবং বেলগাঁও আসিতে পারি নাই বলিয়া উদ্বিগ্ন হইও না। আমি রোগে অত্যন্ত ভুগিতেছিলাম, এবং তখন আমার যাওয়া অসম্ভব ছিল। এখন হিমালয়ে ভ্রমণ করিয়া সমধিক স্বাস্থ্য লাভ করিয়াছি। কার্য শীঘ্রই পুনরায় আরম্ভ করিব। দুই সপ্তাহের মধ্যেই পাঞ্জাবে যাইব এবং লাহোর অমৃতসরে দুই-একটি লেকচার দিয়াই করাচি, গুজরাট, কচ্ছ ইত্যাদি। করাচিতে নিশ্চিত তোমাদের সহিত সাক্ষাৎ করিব।
এ কাশ্মীর বাস্তবিকই ভূস্বর্গ—এমন দেশ পৃথিবীতে আর নাই। যেমন পাহাড়, তেমনি জল, তেমনি গাছপালা, তেমনি স্ত্রীপুরুষ, তেমনি পশুপক্ষী। এতদিন দেখি নাই বলিয়া মনে দুঃখ হয়। তুমি কেমন আছ—শারীরিক ও মানসিক, বিশেষ খবর লিখিও। আমার বিশেষ আশীর্বাদ জানিবে, এবং সর্বদাই তোমাদের কল্যাণ কামনা করিতেছি, নিশ্চিত জানিও। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৭১
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]১২৮
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
এক্ষণে কাশ্মীর দেখিয়া ফিরিতেছি। দু-এক দিনের মধ্যে পাঞ্জাব যাত্রা করিব। এবার শরীর অনেক সুস্থ হওয়ায় পূর্বের (পূর্বের) ভাবে পুনরায় ভ্রমণ করিব, মনস্থ করিয়াছি। Lecture (লেকচার)-ফেকচার বড় বেশী নয়—যদি একটা-আদটা পাঞ্জাবে হয় তো হইবে, নহিলে নয়। এদেশের লোক তো এখনও এক পয়সা গাড়ীভাড়া পর্যন্ত দিলে না—তাহাতে মণ্ডলী লইয়া চলা যে কি কষ্টকর বুঝিতেই পার। কেবল ঐ ইংরেজ শিষ্যদের নিকট হাত পাতাও লজ্জাকর কথা। অতএব পূর্বের (পূর্বের) ভাব ‘কম্বলবন্ত’ হইয়া চলিলাম। এ হালে Goodwin (গুডউইন) প্রভৃতি কাহারও প্রয়োজন নাই বুঝিতেই পারিতেছ।
Ceylone (সিলোন) হইতে একটি সাধু P. C. Jinavara Vamer (পি. সি. জিনবর বমার) নামক—আমাকে এক চিঠি লিখিয়াছেন; তিনি ভারতবর্ষে আসিতে চান ইত্যাদি। বোধ হয় ইনিই সেই Siamese (শ্যামদেশীয়) রাজকুমার সাধু। ইঁহার ঠিকানা Wallawatta, Ceylone. যদি সুবিধা হয় ইঁহাকে Madras-এ (মান্দ্রাজ) নিমন্ত্রণ কর। ইঁহার বেদান্তে বিশ্বাস আছে। মান্দ্রাজ থেকে ইঁহাকে অন্যান্য স্থানে পাঠান তত কঠিন কার্য নহে। আর অমন একটা লোক সম্প্রদায়ে থাকাও ভাল। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ সকলকে জানাইবে ও জানিবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুঃ—খেতড়ির রাজা 10th Oct. (১০ অক্টোবর) বোম্বে পৌঁছিবে—Address (অভিনন্দন) দিতে ভুলিও না।
V.
৩৭২
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
গোপাল-দাদার এক পত্রে অবগত হইলাম যে, তোমরা কোন্নগরে জমি দেখিয়া আসিয়াছ। জমি নাকি ষোল বিঘা নিষ্কর এবং দাম আট-দশ হাজারের কম। স্বাস্থ্য ইত্যাদি সকল বিবেচনা করিয়া যেমন ভাল হয় করিবে। আমি দু-এক দিনের মধ্যে পাঞ্জাব চলিলাম। অতএব এ স্থানে চিঠিপত্র আর লিখিও না। Next (পরবর্তী) ঠিকানা আমি ‘তার’ করিব। হরিপ্রসন্নকে পাঠাইবার কথা যেন ভুলো না। গোপাল-দাদাকে বলিবে যে, ‘তাঁহার শরীর শীঘ্রই ভাল হইয়া যাইবে—শীত আসছে, ভয় কি?—খুব খাও দাও, মৌজ উড়াও।’ যোগেনের শরীর কেমন থাকে তদ্বিষয়ে মিসেস সি. সেভিয়ার, স্প্রিং ডেল, মরী, ঠিকানায় এক চিঠি লিখিবে এবং তাহার উপর To wait arrival (না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করিবে) লিখিয়া দিও। সকলকে ভালবাসা আশীর্বাদ ইত্যাদি দিও। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
পুঃ—খেতড়ির রাজা ১০ অক্টোবর বোম্বাই আসিবে, Address (অভিনন্দন)-টা ভুলিও না।
৩৭৩*
(স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত)
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার স্নেহপূর্ণ চিঠিখানি পেয়েছি, মঠের চিঠিও পেয়েছি। দু-তিন দিনের মধ্যেই আমি পাঞ্জাব রওনা হচ্ছি। বিলাতী ডাক এসেছে। মিস নোব্ল্ তার পত্রে যে-সব প্রশ্ন করেছে সেগুলি সম্বন্ধে আমার উত্তর এইঃ
(১) প্রায় সব শাখা-কেন্দ্রই খোলা হয়েছে, তবে এখনও আন্দোলনের আরম্ভ মাত্র।
(২) সন্ন্যাসীদের অধিকাংশই শিক্ষিত, যারা তা নয় তারাও লৌকিক শিক্ষা পাচ্ছে। কিন্তু অকপট নিঃস্বার্থপরতাই সৎকার্যের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। সে উদ্দেশ্যে অন্য সব শিক্ষার চেয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষার দিকেই সমধিক মনোযোগ দেওয়া হয়।
(৩) লৌকিক বিদ্যার শিক্ষকবৃন্দঃ আমরা যাদের কর্মিরূপে পাচ্ছি তাদের অধিকাংশই শিক্ষিত। এক্ষণে আবশ্যক—শুধু তাহাদিগকে আমাদের কার্য-প্রণালী শেখান এবং চরিত্র গঠন করা। শিক্ষার উদ্দেশ্য—তাহাদিগকে আজ্ঞানুবর্তী ও নির্ভীক করা; আর তার প্রণালী হচ্ছে—প্রথমতঃ গরীবদের জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা এবং ক্রমে মানসিক উচ্চতর স্তরগুলির দিকে এগিয়ে যাওয়া।
শিল্প ও কলাঃ অর্থাভাবহেতু আমাদের কর্মতালিকার অন্তর্গত এই অংশ এখনও আরম্ভ করতে পারছি না। বর্তমানে যে সোজা কাজটুকু করা চলে, তা হচ্ছে—ভারতবাসীদিগকে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা এবং ভারতীয় শিল্পদ্রব্যাদি যাতে ভারতের বাইরে বিক্রয় হয়, তার জন্য বাজার সৃষ্টি করা। যারা নিজেরা দালাল নয়, পরন্তু এই শাখার সমস্ত লভ্যাংশ শিল্পীদের উপকারের জন্য ব্যয় করতে প্রস্তুত, কেবল তাদের দ্বারাই এ কাজ করান উচিত।
(৪) জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ান ততদিনই প্রয়োজন হবে, যতদিন না জনসাধারণ শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। অন্য সব কিছু অপেক্ষা পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদের ধর্মভাব ও ধর্মজীবন সমধিক কার্যকর হবে।
(৫) সকল জাতির মধ্যে আমাদের প্রভাব বিস্তারিত হবে। এ পর্যন্ত উচ্চ স্তরের মধ্যেই কেবল কাজ হয়েছে; কিন্তু দুর্ভিক্ষ-সাহায্যকেন্দ্রগুলিতে আমাদের কর্মবিভাগের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে নিম্নতর জাতিগুলিকেও আমরা প্রভাবিত করতে পারছি।
(৬) প্রায় সকল হিন্দুই আমাদের কাজ সমর্থন করেন; কিন্তু এই জাতীয় কার্যে প্রত্যক্ষ সহায়তা করতে তাঁরা অভ্যস্ত নহেন।
(৭) হাঁ, আমরা গোড়া থেকেই আমাদের দান ও অন্যান্য সৎকার্যে ভারতীয় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে ইতরবিশেষ করি না।১২৯
এই সূত্র আনুসারে মিস নোব্ল্কে চিঠি লিখলেই হবে। যোগেনের চিকিৎসার যেন কোন ত্রুটি না হয়—আসল ভেঙেও টাকা খরচ করবে। ভবনাথের স্ত্রীকে দেখতে গিয়েছিলে কি?
ব্রহ্মচারী হরিপ্রসন্ন যদি আসতে পারে তো বড় ভাল হয়। মিঃ সেভিয়ার একটা স্থানের জন্য বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে—যা হয় একটা শীঘ্র করে ফেলতে পারলে হয়। হরিপ্রসন্ন ইঞ্জিনীয়ার মানুষ, ঝট করে কিছু করতে পারবে। আর জায়গা-টায়গা সে ব্যক্তি বোঝেও ভাল। দেরাদুন মসূরীর নিকট একটা জায়গা হওয়া তাদের পছন্দ—অর্থাৎ যেখানে বেশী শীত না হয় এবং বার মাস থাকা চলে। হরিপ্রসন্নকে অতএব একদম আম্বালায় শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী, মেডিকেল হল, আম্বালা ক্যাণ্টনমেণ্ট-এ পাঠাবে পত্রপাঠ। আমি পাঞ্জাবে নেমেই সেভিয়ারকে তার সঙ্গে দিয়ে পাঠাব। আমি ঝাঁ করে পাঞ্জাবটা হয়ে করাচি দিয়ে কাথিয়াওয়াড় গুজরাট না হয়ে রাজপুতানার ভিতর দিয়ে নেপাল হয়ে চট করে চলে আসছি। তুলসী যে মধ্যভারতে গেছে—সে কি দুর্ভিক্ষকার্যের জন্য? এখানে আমরা সব ভাল আছি ...। সাধারণ স্বাস্থ্য খুব ভাল ও ডায়েবেটিস অনেকদিন ভাগলওয়া হয়েছেন—আর কোন ভয় করব না। সকলকে আমার আশীর্বাদ, প্রণাম ও ভালবাসা দিও। কালী নিউ ইয়র্কে পৌঁছিয়াছে, খবর পাইয়াছি; কিন্তু সে কোন চিঠিপত্র লিখে নাই। স্টার্ডি লিখছে, তার Work (কাজ) এত বেড়ে উঠেছিল যে, লোকে অবাক হয়ে যায়—আবার দু-চারজন তার খুব প্রশংসা করে চিঠিও লিখেছে। যা হোক, আমেরিকাতে অত গোল নাই—এক রকম চলে যাবে। শুদ্ধানন্দ এবং তার ভাইকেও হরিপ্রসন্নর সঙ্গে পাঠাবে—এ দলের মধ্যে খালি গুপ্ত আর অচ্যুত আমার সঙ্গে থাকবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৭৪*
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
শ্রীনগর, কাশ্মীর
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৭
প্রিয় মিস ম্যাকলাউড,
তোমার আসার যদি ইচ্ছাই থাকে, তবে তাড়াতাড়ি চলে এস। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুআরীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে ঠাণ্ডা, তারপরে গরম। তুমি যা দেখতে চাও, তা ঐ সময়ের মধ্যেই হয়ে যাবে; কিন্তু সব কিছু দেখতে গেলে অবশ্য বছর-কয়েক লাগবে।
সময় বড় অল্প; তাই তাড়াতাড়ি এই কার্ড লেখার জন্য মনে কিছু করো না। অনুগ্রহ করে মিসেস বুলকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবে এবং গুডউইন যেন শীঘ্র সেরে ওঠে, সেজন্য আমার শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক প্রার্থনা জানাচ্ছি। মা, এলবার্টা, ছোট্ট শিশুটি ও হলিস্টারকে আমার ভালবাসা জানাবে; এবং সর্বশেষে, কিন্তু তাই বলে সব চেয়ে কম নয়, ফ্র্যাঙ্কিকেও আমার অনুরূপ ভালবাসাই জানাবে। ইতি
সতত ভগবদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
সন্ন্যাসীর গীতি১
উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,
হিমাদ্রিশিখরে উঠিল যে গান—
গভীর অরণ্যে পর্বত-প্রদেশে
সংসারের তাপ যথা নাহি পশে,
যে সঙ্গীত-ধ্বনি-প্রশান্ত-লহরী
সংসারের রোল উঠে ভেদ করি;
কাঞ্চন কি কাম কিম্বা যশ-আশ
যাইতে না পারে কভু যার পাশ;
যথা সত্য-জ্ঞান-আনন্দ-ত্রিবেণী
—সাধু যায় স্নান করে ধন্য মানি,
উঠাও সন্ন্যাসি, উঠাও সে তান,
গাও গাও গাও, গাও সেই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১
ভেঙে ফেল শীঘ্র চরণ-শৃঙ্খল—
সোনার নির্মিত হলে কি দুর্বল,
হে ধীমান্, তারা তোমার বন্ধনে?
ভাঙ শীঘ্র তাই ভাঙ প্রাণপণে।
ভালবাসা-ঘৃণা, ভাল-মন্দ-দ্বন্দ্ব,
ত্যজহ উভয়ে, উভয়েই মন্দ।
আদর’ দাসেরে, কশাঘাত কর,
দাসত্ব-তিলক ভালের উপর;
স্বাধীনতা-বস্তু কখনও জানে না,
স্বাধীন আনন্দ কভু তো বুঝে না।
তাই বলি, ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
দূর কর দুয়ে অতীব সত্বর;
কর কর গান, কর নিরন্তর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ২
যাক অন্ধকার, যাক সেই তমঃ,
আলেয়ার মত বুদ্ধির বিভ্রম
ঘটায়ে আঁধার হইতে আঁধারে
লয়ে যায় এই ভ্রান্ত জীবাত্মারে।
জীবনের এই তৃষা চিরতরে
মিটাও জ্ঞানের বারি পান করে।
এই তম-রজ্জু জীবাত্মা-পশুরে
জন্মমৃত্যু-মাঝে আকর্ষণ করে।
সে-ই সব জিনে—নিজে জিনে যেই,
ফাঁদে পা দিও না—জেনে তত্ত্ব এই।
বলহ সন্ন্যাসি, বল বীর্যবান্—
করহ আনন্দে কর এই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৩
‘কৃত কর্মফল ভুঞ্জিতে হইবে’
বলে লোকে, ‘হেতু কার্য প্রসবিবে,
শুভ কর্মে—শুভ, মন্দে—মন্দ ফল,
এ নিয়ম রোধে নাহি কারও বল।
এ মর-জগতে সাকার যে জন,
শৃঙ্খল তাহার অঙ্গের ভূষণ।’
সত্য সব, কিন্তু নামরূপ-পারে
নিত্যমুক্ত আত্মা আনন্দে বিহরে।
জান ‘তত্ত্বমসি’, করো না ভাবনা‚
করহ সন্ন্যাসি, সদাই ঘোষণা—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৪
সত্য কিবা তারা জানে না কখনও,
সবাই যাহারা দেখয়ে স্বপন—
পিতা মাতা জায়া অপত্য বান্ধব—
আত্মা তো কখনও নহে এই সব;
নাহি তাহে কোন লিঙ্গালিঙ্গভেদ,
নাহিক জনম, নাহি খেদাখেদ।
কার পিতা তবে, কাহার সন্তান?
কার বন্ধু শত্রু কাহার ধীমান?
একমাত্র যেবা—যেবা সর্বময়,
যাহা বিনা কোন অস্তিত্বই নয়,
‘তত্ত্বমসি’ ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
উচ্চরবে তাই এই তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৫
একমাত্র মুক্ত জ্ঞাতা আত্মা হয়,
অনাম অরূপ অক্লেদ নিশ্চয়;
তাঁহার আশ্রয়ে এ মোহিনী মায়া
দেখিছে এ সব স্বপনের ছায়া;
সাক্ষীর স্বরূপ—সদাই বিদিত,
প্রকৃতি-জীবাত্মারূপে প্রকাশিত;
‘তত্ত্বমসি’ ওহে সন্ন্যাসিপ্রবর,
ধর ধর ধর, উচ্চ তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৬
অন্বেষিছ মুক্তি কোথা বন্ধুবর?
পাবে না তো হেথা, কিম্বা এর পর;
শাস্ত্রে বা মন্দিরে বৃথা অন্বেষণ;
নিজ হস্তে রজ্জু—যাহে আকর্ষণ।
ত্যজ অতএব বৃথা শোকরাশি,
ছেড়ে দাও রজ্জু, বল হে সন্ন্যাসি—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৭
দাও দাও দাও সবারে অভয়,
বল—‘প্রাণিজাত, করো নাকো ভয়;
ত্রিদিব পাতাল থাক যে যেখান,
সকলের আত্মা আমি বিদ্যমান;
স্বরগ নরক, ইহামুত্রফল
আশা ভয় আমি ত্যজিনু সকল।’
এইরূপে কাটো মায়ার বন্ধন,
গাও গাও গাও করে প্রাণপণ—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৮
ভেবো না দেহের হয় কিবা গতি,
থাকে কিম্বা যায়—অনন্ত নিয়তি;
কার্য অবশেষ হয়েছে উহার,
এবে ওতে প্রারব্ধের অধিকার;
কেহ বা উহারে মালা পরাইবে,
কেহ বা উহারে পদ প্রহারিবে;
চিত্তের প্রশান্তি ভেঙো না কখনও,
সদাই আনন্দে রহিবে মগন;
কোথা অপযশ—কোথা বা সুখ্যাতি?
স্তাবক-স্তাব্যে একত্ব-প্রতীতি,
অথবা নিন্দুক-নিন্দ্যের যেমতি।
জানি এ একত্ব আনন্দ-অন্তরে,
গাও হে সন্ন্যাসি, নির্ভীক অন্তরে—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ৯
পশিতে পারে না কভু তথা সত্য,
কাম-লোভ-বশে যেই হৃদি মত্ত;
কামিনীতে করে স্ত্রীবুদ্ধি যে জন,
হয় না তাহার বন্ধন-মোচন;
কিম্বা কিছু দ্রব্যে যার অধিকার,
হউক সামান্য—বন্ধন অপার;
ক্রোধের শৃঙ্খল কিম্বা পায়ে যার,
হইতে না পারে কভু মায়া পার।
ত্যজ অতএব এ সব বাসনা,
আনন্দে সদাই কর হে ঘোষণা—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১০
সুখ তরে গৃহ করো না নির্মাণ,
কোন্ গৃহ তোমা ধরে, হে মহান্?
গৃহছাদ তব অনন্ত আকাশ,
শয়ন তোমার সুবিস্তৃত ঘাস;
দৈববশে প্রাপ্ত যাহা তুমি হও,
সেই খাদ্যে তুমি পরিতৃপ্ত রও;
হউক কুৎসিত, কিম্বা সুরন্ধিত,
ভুঞ্জহ সকলি হয়ে অবিকৃত।
শুদ্ধ আত্মা যেই জানে আপনারে,
কোন্ খাদ্য-পেয় অপবিত্র করে?
হও তুমি চল-স্রোতস্বতী মত,
স্বাধীন উন্মুক্ত নিত্য-প্রবাহিত।
উঠাও আনন্দে উঠাও সে তান,
গাও গাও গাও সদা এই গান—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১১
তত্ত্বজ্ঞের সংখ্যা মুষ্টিমেয় হয়,
অ-তত্ত্বজ্ঞ তোমা হাসিবে নিশ্চয়;
হে মহান্, তোমা করিবেক ঘৃণা,
তাহাদের দিকে চেয়েও দেখো না।
স্বাধীন উন্মুক্ত—যাও স্থানে স্থানে,
অজ্ঞান হইতে উদ্ধারো অজ্ঞানে—
মায়া-আবরণে ঘোর অন্ধকারে,
নিয়তই যারা যন্ত্রণায় মরে।
বিপদের ভয় করো না গণনা,
সুখ অন্বেষণে যেন হে মেতো না;
যাও এ উভয় দ্বন্দ্ব-ভূমিপারে,
গাও গাও গাও, গাও উচ্চস্বরে—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১২
এইরূপে বন্ধো, দিন পর দিন,
করমের শক্তি হয়ে যাবে ক্ষীণ;
আত্মার বন্ধন ঘুচিয়া যাইবে,
জনম তাহার আর না হইবে;
‘আমি’ বা ‘আমার’ কোথায় তখন?
ঈশ্বর—মানব—তুমি—পরিজন—
সকলেতে ‘আমি’, আমাতে সকল—
আনন্দ, আনন্দ, আনন্দ কেবল।
সে আনন্দ তুমি, ওহে বন্ধুবর,
তাই হে আনন্দে ধর তান ধর—
ওঁ তৎ সৎ ওঁ। ১৩
প্রবুদ্ধ ভারতের প্রতি২
জাগো আরও একবার!
মৃত্যু নহে, এ যে নিদ্রা তব,
জাগরণে পুনঃ সঞ্চারিতে
নবীন জীবন, আরও উচ্চ
লক্ষ্য ধ্যান তরে, প্রদানিতে
বিরাম পঙ্কজ-আঁখি-যুগে।
হে সত্য! তোমার তরে হের
প্রতীক্ষায় আছে বিশ্বজন,
—তব মৃত্যু নাহি কদাচন। ১
হও পুনঃ অগ্রসর,
তব সেই ধীর পদক্ষেপে
নাহি যাহে হরে শান্তি তার,
নিরুদ্বেগে পথিপার্শ্বে স্থিত
দীন হীন ধূলি-কণিকার;
শক্তিমান্ তবু, মতি স্থির,
আনন্দ-মগন, মুক্ত, বীর;
হে সুপ্তিনাশন, চিরাগ্রণি!
ব্যক্ত কর তব বজ্রবাণী। ২
লুপ্ত সে জনম-গৃহ,
যেথা বহু স্নেহসিক্ত হিয়া
পালিলা শৈশবে, হর্ষভরে
নিরখিলা যৌবন-উন্মেষ;
কিন্তু হের নিয়তি সে ধরে
অমোঘ প্রভাব—সৃষ্ট যাহা
প্রকৃতি-নিয়মে সবে-ফিরে
যেথা স্থান উদ্ভব-কারণ
লভিবারে প্রাণশক্তি পুনঃ। ৩
উরহ আবার তবে,
সেই তব জন্মস্থান হতে,
হিম-স্তূপ অভ্রকটিহার
আশীষিবে যেথায় সতত,
শক্তি দিবে করিয়া সঞ্চার
নব নব অসাধ্য সাধনে;
যেথা সুরনদী তব স্বর
বাঁধিবে অমর গীতি-সুরে;
দেবদারু ছায়া বিধানিবে
নিত্য শান্তি যেথা তব শিরে। ৪
সর্বোপরি, যিনি উমা
শান্তপূতা হিমগিরিসুতা
শক্তিরূপে প্রাণরূপে আর
জননী যে সর্বভূতে স্থিতা,
কার্য যাহা সবি কার্য যাঁর,
এক ব্রহ্ম করে প্রপঞ্চিত,
কৃপা যাঁর সত্যের দুয়ার
খুলি এক বহুতে দেখায়,
দিবে শক্তি সে জননী তোমা
ক্লান্তিহীন, স্বরূপ যাঁহার
অসীম, সে প্রেম পারাবার। ৫
আশীষিবে তোমা তাঁরা,
পরমর্ষি সবে, যাঁহাদের
কোন দেশ, কোন কাল নারে
শুধু আপনার বলিবারে,
—এ জাতির জনয়িতৃগণ—
সত্যের মরম যাঁরা সবে,
একই রূপ করি অনুভব,
নিঃসঙ্কোচে প্রচারিল ভবে
ভাল মন্দ যেমন ভাষায়,
তুমি দাস তাঁহাদের, তায়
লভিয়াছ রহস্য সে মূল।
—বস্তু এক, ইথে নাহি ভুল। ৬
হে প্রেম! কহ সে তব
শান্ত স্নিগ্ধবাণী, মায়া-সৃষ্টি
যাহার স্পন্দনে লয় পায়,
স্তরে স্তরে ছায়াস্বপ্ন আর
হের সব শূন্যেতে মিলায়,
অবশেষে সত্য নিরমল
‘স্বে মহিম্নি’ বিরাজে কেবল। ৭
কহ আর বিশ্বজনে …
উঠ, জাগ, স্বপ্ন নহে আর।
স্বপন-রচনা শুধু ভবে—
কর্ম হেথা গাঁথে মালা যার
নাহি সূত্র বৃন্তমূলহীন
ভাল মন্দ পুষ্প ভাবনার,
জন্ম লভে, গর্ভে অসতের,
সত্যের মৃদুল শ্বাসে ধায়
আদিতে যে শূন্য ছিল তায়!
অভী হও, দাঁড়াও নির্ভয়ে
সত্যগ্রাহী, সত্যের আশ্রয়ে,
মিশি সত্যে যাও এক হয়ে,
মিথ্যা কর্ম-স্বপ্ন ঘুচে যাক—
কিম্বা থাকে স্বপ্নলীলা যদি,
হের সেই, সত্যে গতি যার,
থাক স্বপ্ন নিষ্কাম সেবার
আর থাক প্রেম নিরবধি। ৮
মৃত্যুরূপা মাতা৩
নিঃশেষে নিভেছে তারাদল, মেঘ এসে আবরিছে মেঘে,
স্পন্দিত ধ্বনিত অন্ধকার, গরজিছে ঘূর্ণ-বায়ুবেগে!
লক্ষ লক্ষ উন্মাদ পরাণ, বহির্গত বন্দীশালা হতে,
মহাবৃক্ষ সমূলে উপাড়ি’ ফুৎকারে উড়ায়ে চলে পথে!
সমুদ্র সংগ্রামে দিল হানা, উঠে ঢেউ গিরিচূড়া জিনি’
নভস্তল পরশিতে চায়! ঘোররূপা হাসিছে দামিনী,
প্রকাশিছে দিকে দিকে তার মৃত্যুর কালিমা মাখা গায়।
লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর! দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়,
নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়!
করালি! করাল তোর নাম, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে!
কালি, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো আয় মোর পাশে।
সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,
কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।
খেলা মোর হল শেষ৪
কভু উঠি, কখনও বা পড়ি কালের তরঙ্গ সনে
গড়াইয়া চলিয়াছি হায়,
ক্ষণস্থায়ী এক দৃশ্য হতে স্বল্পস্থায়ী দৃশ্যান্তরে
জীবনের জোয়ার-ভাঁটায়।
অন্তহীন এই প্রহসনে তিক্ত আজি প্রাণ মোর;
আর ইহা নাহি লাগে ভাল,
মিছে ছোটা, পাব নাতো কভু, দেখা নাহি যায় দূরে,
সাগরের পারে তীর কালো!
জন্ম হতে জন্মান্তরাবধি দুয়ারে দাঁড়ায়ে আছি,
কভু দ্বার খুলিল না হায়,
আঁখি মম ক্ষীণ হল তবু, বৃথা আশা ধরিবারে
সে আলোর একটি ছটায়।
অতি ক্ষুদ্র এই জীবনের সমুচ্চ সঙ্কীর্ণ সেই
সেতু ’পরে দাঁড়াইয়া চাহি—
অগণিত জনগণ নীচে যুঝিছে, কাঁদিছে কেহ
হাসিতেছে—কেন জানি নাহি,
সম্মুখেতে ভীষণ কপাট ভ্রূভঙ্গে চাহিয়া বলে,
‘আর নাহি হও অগ্রসর,
এই সীমা অদৃষ্টের তব; প্রলুদ্ধ করো না আর,
যত পার সব সহ্য কর।
মিশে যাও ইহাদের সাথে পান কর হলাহল
নাচো গাও উহাদের সনে
জানিবারে বাসনা যাহার, দুঃখ আছে তার ভালে,
অতএব রহ এই স্থানে।’
আমি কিন্তু থাকিতে না চাই, জলবুদ্বুদের সম
ভাসমান এই পৃথ্বীতল,
শূন্যগর্ভ গঠন ইহার, শূন্যগর্ভ নাম তার,
জন্মমৃত্যু-শূন্য সে সকল।
মোর কাছে মিছা এই সব, আমি চাই ভেদিবারে
নামরূপ মিথ্যা অবয়বে,
খুলিবারে চাহি আমি ওই সম্মুখের প্রশস্ত কপাট—
মোর লাগি খুলিতেই হবে।
দুয়ার খুলিয়া দাও মাতঃ! হেরি পথ আলোক-ছটায়
খেলা মোর হইয়াছে শেষ—
অতি শ্রান্ত পুত্র তব মা গো, আকুল আকাঙ্ক্ষা হৃদে
গৃহে আজি করিবে প্রবেশ।
ঘন ঘোর অন্ধকার মাঝে খেলিতে ছাড়িয়া দিয়ে
বিভীষিকা দেখাও আমারে,
আশা মোর হল আজি শেষ, ভয় আসি দেখা দিল
খেলার আনন্দ গেল দূরে।
তপ্ত স্ফীত সাগর সমান গভীর দুঃখের মাঝে
রিপুদল প্রবল তাড়নে,
তরঙ্গে বিক্ষিপ্ত হেথা সেথা কত কষ্ট পাই মা গো
ভবিষ্যৎ সুখের ছলনে।
জীবনের অর্থ হেথা হায় জীবন্ত মরণ, আর
মরণ যে কেবা বলো জানে—
সুখদুঃখ নিয়ত-চক্রের পুনঃ সেই প্রবর্তন
নব আবর্তন নাহি আনে।
শিশু দেখে মধুর স্বপন— স্বর্ণসম সমুজ্জ্বল,
ধূলিতে তা হয় পরিণত,
পশ্চাতে ফিরিয়া দেখে হায়— ভগ্ন তার শত আশা,
পুঞ্জীভূত মরিচার মত।
জীবনের শেষপ্রান্তে যবে বিলম্বে লভিয়া জ্ঞান
চক্র ছাড়ি যাই মোরা চলি,
অন্যজন নবতেজ লয়ে সে চক্র ঘুরাতে আসে
দিন যায় বর্ষ পড়ে ঢলি।
ঘোরে চক্র অবিরত বেগে মায়া-ক্রীড়নক মাত্র
কামনা ইহার কেন্দ্রস্থল,
বৃথা আশা দেয় গতিবেগ এ চক্রের দণ্ড যত
সুখ দুঃখ অনিত্য কেবল।
ভাসিয়া চলেছি আজ আমি, কোথা তাহা নাহি জানি,
এ অনলে বাঁচাও গো আসি,
করুণা-আধার তুমি মা গো, রক্ষা কর মোরে, যেন
কামনা-সাগরে নাহি ভাসি।
ফিরায়ো না দেখায়ো না মোরে, ভয়ঙ্কর মুখ তব
সহিতে পারি না আমি এত,
ক্ষমা কর দেহ মা অভয় সদয়া হও গো আজি
দোষ মম নাহি ধর মাতঃ!
নিয়ে যাও জননি গো মোরে সেই দূরে পরপারে,
যেথায় সকল দ্বন্দ্ব শেষ,
সকল দুঃখের পারে, অশ্রু যেথা নাহি দেখা দেয়
পার্থিব সুখেরও নাহি লেশ।
যাহার গরিমা রবি শশী, অনন্ত তারকারাজি
উজলিত আকাশের পটে,
ক্ষণপ্রভা রূপের ছটায় প্রকাশিতে নাহি পারে
মাত্র তার প্রতিবিম্ব রটে।
দেখো যেন মিছা স্বপ্নে মা গো তোমার মু’খানি হতে
আমারে আড়াল নাহি করে,
খেলা মোর হল আজি শেষ, শৃঙ্খল ভাঙিয়া দাও,
মুক্ত আজি কর মা আমারে।
দোষ কারও নয়৫
দিনমণি ডুবে অস্তাচলে,
রেখে যায় রক্তরাঙা কর,
আলোকিত ক্ষীণ দিনমানে
এই যেন শেষ অবসর!
রাখি আঁখি দেখি সচকিতে
বিজয়ের রাশি পিছে রয়,
জয়ে গণি হীন লজ্জা বলে
আমি ছাড়া দোষী কেহ নয়।
জীবনেরে গড়ি দিন দিন
কিম্বা উহা করে চলি ক্ষয়,
যথাকর্ম সেইরূপ ফল—
শুভে শুভ, মন্দে মন্দ হয়।
স্রোত যদি একবার ধায়
রোধ কিম্বা নিয়ন্ত্রণ তার
সাধ্য নহে কভু আর কারও,
আমা ছাড়া দোষ তবে কার?
আমি হই রূপধারী সেই,
ছিল যাহা অতীত আমার,
সৃষ্টিবীজ সুপ্ত সেখানেই
বিকশিতে ভুবনে আবার।
ইচ্ছা, চিন্তা—যে অতীত ধরি
মনোমাঝে সদা ব্যক্ত হয়,
বাহিরের আকৃতিও তাই,
আমি ছাড়া দোষী কেহ নয়।
প্রেমরূপে ফিরে আসে প্রেম
ঘৃণা আনে ঘৃণা তীব্রতর,
পরিমাপ নিজে তারা করে
রেখে যায় ছাপ মোর ’পর।
জীবনের শেষে মরণেও
তাহাদের দাবী জমা রয়,
এই ভোগ—দায় আমারি তো
আমি ছাড়া দোষী কেহ নয়।
ত্যজিলাম মিছে ভয়রাশি
বৃথা যত পরিতাপ আর
বুঝিয়াছি গূঢ় অনুভবে
স্বকর্মের কিবা অধিকার।
হর্ষ-ব্যথা অপমান যশ—
মোর কর্মে জাত প্রেতচয়,
ইহাদের সম্মুখে দাঁড়ানু
আমি ছাড়া কেহ দোষী নয়।
ভাল মন্দ প্রেম আর ঘৃণা
সুখ তথা দুঃখ যাহা বলি
একে ছাড়ি অন্য নাহি থাকে,
যুগ্মভাবে বাঁধা তো সকলি।
দুঃখ ছাড়া সুখস্বপ্ন দেখি
ভ্রান্তি শুধু! সত্য নাহি হয়,
আসিল না, আসিবে না কভু
আমি ছাড়া কেহ দোষী নয়।
অতএব ত্যজিলাম ঘৃণা
ত্যজিলাম তুচ্ছ ভালবাসা,
দূর করি দ্বন্দ্বের সংঘাত
মিটিয়াছে জীবনের তৃষা।
চিরমৃত্যু—ইহাই তো চাই
—নির্বাণ এ জীবন-শিখার,
ঘুচে-যাওয়া কর্মের আশ্রয়
রহিবে না দোষী কেহ আর।
একমাত্র নরবর, এক সেই প্রভু
একমাত্র সিদ্ধ আত্মা যিনি
কুহেলী-সন্দেহঘেরা যত পথ ছিল
ঘৃণাভরে ত্যজিলেন তিনি,
অসীম সাহসভরে করিয়া মনন,
অসঙ্কোচে উদ্দেশ্য দেখান—
‘মৃত্যু মহা-অভিশাপ, জীবনেও তাই
শ্রেষ্ঠ বস্তু জানিও নির্বাণ।’
ওঁ নমো ভগবতে সম্বুদ্ধায়
ওঁ নতি মোর ভগবান্ বুদ্ধ যিনি তাঁয়।
ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়৬
সূর্য যদি মেঘাচ্ছন্ন হয় কিছুক্ষণ
যদি বা আকাশ হের বিষণ্ণ গম্ভীর,
ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়,
জয় তব জেনো সুনিশ্চয়।
শীত যায়, গ্রীষ্ম আসে তার পাছে পাছে,
ঢেউ পড়ে, ওঠে পুন তারি সাথে সাথে,
আলো ছায়া আগাইয়া দেয় পরস্পরে;
হও তবে ধীর, স্থির, বীর।
জীবনকর্তব্য-ধর্ম বড় তিক্ত জানি,
জীবনের সুখচয় বৃথা ও চঞ্চল,
লক্ষ্য আজ বহুদূরে ছায়ায় মলিন;
তবু চল অন্ধকারে হে বীর হৃদয়,
সবটুকু শক্তি সাথে লয়ে।
কর্ম নষ্ট নাহি হবে, কোন চেষ্টা হবে না বিফল,
আশা হোক উন্মূলিত, শক্তি অস্তমিত,
কটিদেশ হতে তব জনমিবে উত্তরপুরুষ,
ধৈর্য ধর কিছুকাল হে বীর হৃদয়
কল্যাণের নাহিক বিলয়।
জ্ঞানী গুণী মুষ্টিমেয় জীবনের পথে—
তবুও তাঁরাই হেথা হন কর্ণধার,
জনগণ তাঁহাদের বোঝে বহু পরে;
চাহিও না কারও পানে, ধীরে লয়ে চল।
সাথে তব ক্রান্তদর্শী দূরদর্শী যাঁরা,
সাথে তব ভগবান্ সর্বশক্তিমান্,
আশিস ঝরিয়া পড়ে তব শিরে—তুমি মহাপ্রাণ—
সত্য হোক, শিব হোক সকলি তোমার।
অজানা দেবতা৭
১
অন্ধকার নিরাশার বিসর্পিল পথে ক্লান্ত পদে
এ নির্মম নিরানন্দ জীবনের ভারনত
চলেছে পথিক।
হৃদয়ের মননের কোন প্রান্ত হতে
কোথাও মেলে না প্রাণে
নিমেষের প্রেরণা-স্পন্দন।
অবশেষে একদা যখন
লুপ্তপ্রায় সীমারেখা
ভালমন্দ সুখদুঃখ জন্মমরণের—
অকস্মাৎ উদ্ভাসিল পুণ্যরজনীতে
অপরূপ জ্যোতিরেখা হৃদয়েতে তার।
কোন্ উৎস হতে এল অচেনা এ আলো—
কিছুই তো জানে না সে।
তবুও জানাল
আলোক-ঈশ্বরে তার প্রাণের প্রণাম।
অজানা আশার বাণী
ব্যাপ্ত হল সমগ্র সত্তায়,
স্বপ্নাতীত মহিমায়
পূর্ণ করে দিল তার সমস্ত ভুবন,
সে ভুবন পার হয়ে আভাসিল আর এক জগৎ।
বলিলেন মৃদু হেসে পণ্ডিতের দল—
‘অন্ধ এ বিশ্বাস।’
সে আলোর দীপ্ত শান্তি অনুভব করি’
বলিল সে নম্র প্রত্যুত্তরে,
‘ধন্য মানি এ অন্ধবিশ্বাস।’
২
স্বাস্থ্য, শক্তি, সম্পদের সুরামত্ত
আর এক পথিক,
জীবনের ঘূর্ণাবর্তে ছুটে চলে
উন্মাদের মত,
অবশেষে একদা যখন
এ পৃথিবী মনে হয় বিলাস-কানন
খেলার পুতুল যত কীটসম মানুষের দল,
নিয়তচঞ্চল যত বিলাসের বিচ্ছুরিত আলো
দৃষ্টিরে আচ্ছন্ন করে, ইন্দ্রিয় অবশ,
সুখদুঃখ একাকার, অনুভূতিহীন;
প্রমোদমদিরামত্ত মহামূল্য এ দেহচেতনা
শবসম লগ্ন হয়ে থাকে তার দুই বাহুপাশে,
যত সে ছাড়াতে চায়,
তত তার বক্ষ জুড়ে আসে;
উন্মাদ-কল্পনা-ভরে বহুরূপে মৃত্যুরে সে চায়,
ফিরে আসে আরবার মুগ্ধ আকর্ষণে।
তারপর একদিন
দুর্ভাগ্যের দাহ এল নেমে—
হৃতশক্তি, সম্পদবিহীন,
বেদনায়, অশ্রুধারে, মর্মযন্ত্রণায়—
আত্মীয়তা ফিরে পেল সারা নিখিলের।
বন্ধুজন করে পরিহাস।
কৃতজ্ঞ হৃদয় তার করে উচ্চারণঃ
‘ধন্য দুঃখ; ধন্য এ বেদনা।’
৩
সুন্দর সুঠাম দেহ,
শুধু মন তার শক্তিহীন
দুর্বার গভীর কোন আবেগ-সংযমে,
অমোঘ-প্রবৃত্তি-স্রোত
রুদ্ধ করা অসাধ্য তাহার।
সংসারে সবাই তারে—
সদাশয়, ভাল—বলে জানে।
পরম নিশ্চিন্ত ছিল আপনারে নিয়ে।
দূর হতে দেখেছে সে চেয়ে—
সংসার-তরঙ্গসাথে বৃথা যুদ্ধে রত
নরনারী যত।
দেখিতে দেখিতে মন, মক্ষিকার মত
কেবলি ক্লেদাক্ত দেখে সকল সংসার,
সব গ্লানিময়।
তারপর একদা কখন,
সহসা সৌভাগ্যসূর্য দেখা দিল হেসে,
তারি সঙ্গে ঘটে গেল নির্মম পতন।
সেই তার দৃষ্টি-উন্মোচন।
বুঝিল সেঃ নিয়ম ভাঙে না কভু
তরু ও প্রস্তর,
তবু তারা প্রস্তর ও তরু হয়ে থাকে।
নিয়মবন্ধন হতে ঊর্ধ্বে এসে
সংগ্রামসাধনা দিয়ে
ভাগ্যেরে সে করে নেবে জয়—
এ পরম অধিকার মানুষেরই তরে।
চিত্তের জড়তা ঘুচি নবীন জীবন
হল মুক্ত, প্রসারিত—
সংগ্রাম-সমুদ্রপারে যে অনন্ত শান্তি বিরাজিত
তাহারি আলোক-রশ্মি
উদ্ভাসিল জীবনের দিগন্ত-রেখায়।
পশ্চাতে রয়েছে পড়ি’
অতীতের
অকৃতার্থ নিষ্ফল জীবন,
তরু ও প্রস্তর সম চেতনাবিহীন,
আর একদিকে তার স্খলনপতন,
যার লাগি’ বর্জন করেছে তারে সমস্ত সংসার।
সানন্দ-অন্তরে তবু
ধন্য মানি এ অধঃপতন
ঘোষিল সেঃ ‘ধন্য এই পাপ।’
হে স্বপন!৮
ভাল মন্দ যাই হয় হোক,
সুখের সুস্মিত হাসি দেখা দেয় যদি,
অথবা উদ্বেল হয় দুঃখ-পারাবার,
সবারি আপন অংশ আছে অভিনয়ে,
কারও হাসি কারও কান্না, যখন যেমন,
রয়েছে আপন সাজ প্রত্যেকের তরে—
রৌদ্র জলে আবর্তিয়া চলে দৃশ্যান্তর।
হে স্বপন! সার্থক স্বপন!
কাছে দূরে প্রসারিত কর মায়াজাল,
পেলব কোমল কর তীব্র রেখা যত,
সব রুক্ষতারে তুমি নম্র করে তোলো।
তোমারি মাঝারে আছে সব ইন্দ্রজাল।
তোমারি পরশে
প্রাণপুষ্পে হিল্লোলিত
জাগে মরুভূমি,
মধুর সঙ্গীতে ভরে
ঘনঘোর অশনি-গর্জন,
মৃত্যু আনে মধুময় মুক্তির আস্বাদ।
অকালে ফোটা একটি ফুলের প্রতি৯
তুষার-কঠিন মাটিই না হয় হোক না তোমার শয্যা,
আবরণ তব শীতার্ত ঝঞ্ঝার,
জীবনের পথে নাই বা জুটিল বন্ধুজনার হর্ষ,
ব্যর্থ তোমার সৌরভ-বিস্তার;
প্রেম যদি হয় নিজেই ব্যর্থ তবু কী-বা আসে যায়
না হয় ব্যর্থ সৌরভসঞ্চার—
অকল্যাণের জয় যদি হয়, কল্যাণ পরাজিত,
পুণ্যের ’পরে পাপের অত্যাচার;
তবু প্রশান্ত বিকশিত থাক, পবিত্র মধুময়
থাক অবিচল আপনার মহিমায়,
দাও, ঢেলে দাও স্নিগ্ধ উদার মধু সৌরভ তব
চির-প্রসন্ন অযাচিত করুণায়।
কে জানে মায়ের খেলা!১০
কে জানে—হয়তো তুমি ক্রান্তদর্শী ঋষি!
সাধ্য কার স্পর্শ করে সে অতল গভীর গহন,
যেখানে লুকান রয় মা’র হাতে অমোঘ অশনি!
হয়তো পড়েছে ধরা উৎসুক করুণনেত্র শিশুর দৃষ্টিতে,
দৃশ্যের আড়ালে কোন ছায়ার সঙ্কেত,
মুহূর্তে যা হতে পারে দুর্নিবার ঘটনাপ্রবাহ।
আসে তারা কখন কোথায়, মা ছাড়া কে জানে!
হয়তো বা জ্ঞানদীপ্ত মহান্ তাপস,
বলেছেন যতটুকু,
তারও বেশী পেয়েছেন প্রাণে।
কে জানে কখন,
কার হৃদি-সিংহাসনে
মা আমার পাতেন আসন।
মুক্তিরে বাঁধিবে কোন্ নিয়মশৃঙ্খলে,
ইচ্ছারে ফিরাবে তাঁর কোন্ পুণ্যবলে,
সংসারের শ্রেষ্ঠ বিধি—খেয়াল তাঁহার
ইচ্ছামাত্র অমোঘ বিধান।
হয়তো শিশুর চোখে দিব্যদৃষ্টি জাগে,
স্বপ্নেও ভাবেনি যাহা পিতার হৃদয়,
হয়তো সহস্র শক্তি কন্যার অন্তরে
রেখেছেন বিশ্বমাতা সযত্ন সঞ্চয়।
পানপাত্র১১
এই তব পানপাত্র, তোমারি উদ্দেশে
সৃষ্টির উন্মেষ হতে এ পাত্র-রচনা।
জানি জানি এ পানীয় কালকূট ঘোর,
তোমারি মন্থিত সুরা—দূর অতীতের
বাসনা বেদনা ভ্রান্তি যুগযুগান্তের।
দুর্গম দুঃসহ পন্থা—এই তব পথ,
প্রতি পদে অবিশ্রান্ত উপল-সঙ্ঘাত
সে আমারি দান। দিয়েছি বন্ধুরে তব
স্নিগ্ধ স্বচ্ছ পত্রখানি সানন্দযাত্রার।
তোমারি মতন সেও পাবে মোর বক্ষে
পরম আশ্রয়। তোমারে চলিতে হবে
এই পথ ধরে—এ নির্মম নিরানন্দ
নিঃসঙ্গ সাধন—আর কারও তরে নয়,
এ শুধু তোমার। মোর বিশ্বরচনায়
আছে তারও স্থান। লও এই পানপাত্র—
বুঝিতে বলিনি আমি, কি অর্থ ইহার,
শুধু চোখ বুঝে দেখ স্বরূপ আমার।
জাগ্রত দেবতা ১২
সেই এক বিরাজিত অন্তরে বাহিরে,
সব হাতে তাঁরি কাজ,
সব পায়ে তাঁরি চলা,
তাঁরি দেহ তোমরা সবাই,
কর তাঁর উপাসনা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।
মহামহীয়ান যিনি, দীন হতে দীন,
একাধারে কীট ও দেবতা যিনি,
পাপী পুণ্যবান,
দৃশ্যমান, জ্ঞানগম্য, সর্বব্যাপী, প্রত্যক্ষ মহান্,
কর তাঁর উপাসনা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।
অতীত জীবনধারা নাই তাঁর মাঝে,
অথবা আগামী কোন জনম মরণ,
নিয়ত ছিলাম মোরা তাঁহাতে বিলীন,
চিরকাল এক হয়ে রব তাঁরি বুকে।
কর তাঁর উপাসনা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।
ওরে মূর্খদল!
জীবন্ত দেবতা ঠেলি’,
অবহেলা করি’
অনন্ত প্রকাশ তাঁর এ ভুবনময়,
চলেছিস ছুটে মিথ্যা মায়ার পিছনে
বৃথা দ্বন্দ্ব কলহের পানে—
কর তাঁর উপাসনা, একমাত্র প্রত্যক্ষ দেবতা,
ভেঙে ফেলো আর সব পুতুল প্রতিমা।
আলোক ১৩
সম্মুখে পশ্চাতে চেয়ে দেখি—
সব ঠিক, সকলি সার্থক।
বেদনার গভীর আমার
জ্বলে এক চিন্ময় আলোক।
শান্তিতে সে লভুক বিশ্রাম১৪
চল আত্মা, শীঘ্রগতি, তারকা-খচিত তব পথে,
ধাও হে আনন্দময়, যেথা নাহি বাঁধে মনোরথে;
দেশকাল দৃষ্টিপথ যেথা নাহি করে আবরণ!
চিরশান্তি আশীর্বাদ যেথা করে তোমারে বরণ!
সার্থক তোমার সেবা, পরিপূর্ণ তব আত্মদান,
অপার্থিব প্রেমপূর্ণ হৃদয়েতে হোক তব স্থান;
মধুময় তব স্মৃতি দেশকাল দিয়াছে মিলায়ে,
বেদীতলে পুষ্পসম রেখে গেলে সৌরভ বিছায়ে!
টুটেছে বন্ধন তব, পেয়েছ সে আনন্দ-সন্ধান,
জন্মমৃত্যুরূপে যিনি, তাঁর সাথে হলে একপ্রাণ,
তুমি যে সহায় ছিলে, স্বার্থত্যাগী চির এ ধরায়,
আগে চল, সংসার-সংগ্রামে আনো প্রীতির সহায়
আশীর্বাদ ১৫
বীরের সঙ্কল্প আর মায়ের হৃদয়,
দক্ষিণের সমীরণ—মৃদুমধুময়,
আর্যবেদী ’পরে দীপ্ত মুক্ত হোমানলে
যে পুণ্য সৌন্দর্য আর যে শৌর্য বিরাজে—
সকলই তোমার হোক, আরও, আরও কিছু
স্বপ্নেও ভাবেনি যাহা অতীতের কেহ।
ভারতের ভবিষ্যৎ সন্তানের তরে
তুমি হও বন্ধু, দাসী, গুরু—একাধারে।
মুক্তি১৬
ওই দেখ মিলাইয়া যায় কালো মেঘপুঞ্জ যত
রাত্রির আঁধারে আরও ঘন করি, ধরণীর ’পরে
তাহারা থমকি ছিল, অবসন্ন বিষাদ কালিমা!
তোমার মোহন-স্পর্শে জগৎ জাগিয়া উঠে ওই!
পাখীরা তুলিছে তান—ফুলদল তুলে ধরে তার
শিশির-খচিত শত তারার মুকুট; সুস্বাগত
জানায় তোমায় তারা দুলিয়া দুলিয়া। সরোবর
প্রেমভরে মেলিয়াছে শত শত আঁখিশতদল—
তোমারে বরিয়া নিতে, তার সারা গভীরতা দিয়া।
এস, এস, এস তুমি, আলোকের ওগো অধিরাজ!
তোমারি লাগিয়া আজ অন্তরের স্বাগত আহ্বান!
ওগো সূর্য, আজ তুমি ছড়াইছ মুক্তি দিকে দিকে!
ভাব দেখি, কেমন পৃথিবী আছিল প্রতীক্ষারত
কত কাল; তোমারি সন্ধানে প্রতি দেশে প্রতি যুগে
কত না ছাড়িল গৃহ, কত প্রিয় পরিজন প্রীতি
তোমারি লাগিয়া তারা চলিয়াছে আত্ম-নির্বাসিত
ভয়ঙ্কর সাগর চিরিয়া—আদিম বনানী মাঝে;
প্রতি পদক্ষেপে তার দেয় তাল জীবন মরণ।
তারপর এল দিন—সফলিয়া উঠিল যখন
সকল সাধনা কর্ম পূজা প্রেম আত্মবলিদান—
গ্রহণ করিলে আসি—সব হল—সম্পূর্ণ সার্থক!
তখন উঠিলে তুমি—হে প্রসন্ন, ছড়াবার তরে
মুক্তির আলোক শুভ্র—সারা বিশ্ব-মানবের ’পরে!
চল প্রভু, চল তব বাধাহীন পথে ততদিন—
যতদিন ওই তব মাধ্যন্দিন প্রখর প্রভায়
প্লাবিত না হয় বিশ্ব, পৃথিবীর প্রতি দেশে দেশে
সেই আলো না হয় ফলিত, যতদিন নরনারী
তুলি উচ্চ শির—নাহি দেখে টুটেছে শৃঙ্খলভার—
না জানে শিহরানন্দে তাহাদের জীবন নূতন।
শান্তি ১৭
ওই দেখ—আসে মহাবেগে
মহাশক্তি, যাহা শক্তি নয়-—
অন্ধকারে আলোকস্বরূপ
তীব্রালোকে ছায়ার আভাস
আনন্দ যা হয়নি প্রকাশ,
অবেদিত দুঃখ সুগভীর,
অযাপিত অমৃত জীবন—
অশোচিত মৃত্যু সনাতন।
দুঃখ নয়, আনন্দও নয়
মাঝে তার তারে বোধ হয়,
রাত্রি নয়, ঊষাও সে নয়—
উভয়ের মাঝে জুড়ে রয়।
সঙ্গীতের মাঝে মধু সম—
সুপবিত্র ছন্দ মাঝে যতি,
নীরবতা কথার অন্তরে,
মাঝে দুই রিপু তাড়নার
হৃদয়ের শান্ত ভাব সে যে!
অদেখা সে সৌন্দর্যসম্ভার,
সে যে প্রেম একাকী অদ্বয়,
অগাহিত জাগে মহাগান—
অজানিত পরিপূর্ণ জ্ঞান!
মৃত্যু দুই জীবনের মাঝে,
স্তব্ধতা সে ঝঞ্ঝাদ্বয় মাঝে,
শুদ্ধতা সে ঝঞ্ঝাদ্বয় মাঝে,
মহাশূন্য—যা হতে সৃজন—
যাহে পুনঃ আসিছে ফিরিয়া।
এরি লাগি ঝরে আঁখিজল
সারা বিশ্বে হাসি ছড়াবারে,
এ যে শান্তি—লক্ষ্য জীবনের
—
একমাত্র আশ্রয় নিশ্চয়।
জীবন্মুক্তের গীতি ১৮
বিস্তারে বিশাল ফণা দলিতা ফণিনী;
প্রজ্বলিত হুতাশন যথা সঞ্চালনে,
শূন্য ব্যোম-পথে যথা উঠে প্রতিধ্বনি
মর্মাহত কেশরীর কুপিত গর্জনে।
প্লাবনের ধারা ঢালে যথা মহা ঘন,
দামিনী ঝলকে তার হৃদি বিদারিয়া,
আত্মার গভীর দেশে করিলে স্পন্দন,
মহাপ্রাণ উচ্চ তত্ত্ব দেয় প্রকাশিয়া।
স্তিমিত হউক নেত্র, অন্তর মূর্ছিত,
বিফল বন্ধুত্ব—প্রেম প্রতারণা হোক,
নিয়তি পাঠাক তার ভীতি অগণিত
পুঞ্জীকৃত অন্ধকারে পথ রুদ্ধ হোক।
রোষ-দীপ্ত মূর্তি ধরি আসুক জগৎ
চূর্ণিতে তোমায়—তবু জানিও নিশ্চয়,
হে আত্মা, তুমি হে দেব, তুমি সে মহৎ,
মুক্তিই গন্তব্য তব—অন্য গতি নয়।
নহি স্বর্গবাসী আমি—নর পশু নয়,
পুরুষ কি নারী নহি, নহি দেহ মন,
স্তম্ভিত নির্বাক যত জ্ঞান-গ্রন্থচয়,
স্বরূপ বর্ণিতে মোর—আমি সেই, ‘সোঽহম্’।
সূর্য সোম বসুন্ধরা জন্মে নাই যবে,
তারাদল ধূমকেতু জন্মেনি যখন,
কালের-ও উদ্ভব যবে হয়নি এ ভবে,
ছিলাম, আছি ও আমি থাকিব তখন।
মেদিনী সুষমাময়ী, ভাস্বর তপন,
এই শান্ত সুধাকর, উজ্জ্বল আকাশ
নিমিত্ত-অধীনে করে গমনাগমন,
জীবন তাদের-ও বদ্ধ, বন্ধনে বিনাশ।
বিশ্ব-মন বিস্তারিয়া অনিত্যের জাল
ধরিয়া তাদের রাখে দৃঢ়বদ্ধ করে,
পৃথিবী নরক স্বর্গ—মন্দ আর ভাল
সে চিন্তা-তন্তুর মাঝে উঠে আর পড়ে।
দেশ আর কাল, আর কার্য ও কারণ,
এ সকলি হয় মাত্র বহিরাবরণ!
ইন্দ্রিয়-মনের পারে মোর অবস্থান।
আমি দ্রষ্টা এ বিশ্বের—সাক্ষী সে মহান্!
নহে দ্বৈত, নহে বহু—অদ্বৈতের ভূমি,
একত্বে মিলিত তাই সকলি আমায়।
ভেদ ঘৃণা নাহি মোর, নহি ভিন্ন আমি,
থাকি আমি মগ্ন মাত্র প্রেমের চিন্তায়।
ভাঙ মায়া, মুক্ত হও বন্ধন হইতে,
ভীত নাহি হও—বুঝ রহস্য পরম!
নিজ প্রতিবিম্ব মোরে নারে সন্ত্রাসিতে,
জেনো স্থির—আমি সেই, ‘সোঽহং, সোঽহং’।
আমারই আত্মাকে ১৯
ধরে থাক আরও কিছুকাল, অটল হৃদয়,
ছিন্ন করো নাকো এই আজন্ম বন্ধন,
যদিও অস্পষ্ট ক্ষীণ এই বর্তমান—ভবিষ্যৎ ঘনতমোময়!
কেটে গেছে যেন এক যুগ—তোমাতে আমাতে মিলে
যাত্রা শুরু করিলাম—জীবনের উঁচু-নীচু পথে,
অপূর্ব সমুদ্রে কভু ভেসে যাই শান্ত ধীর পালে,
আমি মোর তব কাছে, তার চেয়ে তুমি আরও কাছে, মাঝে মাঝে,
মনের তরঙ্গগুলি উঠিবার আগে প্রকাশিত করেছ তুমিও!
অবিকল প্রতিভাস! তোমার স্পন্দন মেলান আমার সাথে,
সূক্ষ্মতম চিন্তা, তবু পূর্ণরূপে ধ্বনিত তোমাতে।
হে সংস্কার-লিপিকার! এখন কি আমাদের বিদায়ের পালা?
তোমাতেই রহিয়াছে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস,
অশুভ বাসনা যবে ফেনাইয়া ওঠে, সতর্ক করেছ তুমি,
সাবধান-বাণী তব হেলায় দিয়েছি ফেলে,
তবু তুমি সত্য শুভ শক্তি মোর—পূর্বের মতন!
আমন্ত্রণ ২০
রোদন কি হেতু সখা? সর্বশক্তি তোমারি তো অন্তরে নিহিত!
জ্ঞান-বীর্য-প্রদ সেই নিজ দিব্য স্বরূপেরে কর উদ্বোধিত—
ত্রিলোকে যা কিছু আছে সবই তব পাদমূলে আসিবে তখন!
আত্মার শক্তিই হয় চিরজয়ী—জড়শক্তি নহে কদাচন।
ত্রিভুবন উপাড়িব, তারকা চিবায়ে খাব [করি অট্টহাস]!
জান না কি কেবা মোরা? বীর গতভয় মোরা রামকৃষ্ণ দাস।
দেহকেই ‘আমি’ ভাবে—নাস্তিক্য ইহারি নাম—যারা অনিক্ষণ
‘ক্ষীণ মোরা, দীন মোরা’ বলি করে তাহারাই করুণ ক্রন্দন।
রামকৃষ্ণ-দাস মোরা—[দেহাতীত অবিকারী অমৃত অভয়
সত্তাকেই ‘আমি’ জানি] অভয়-পদেতে স্থিত হয়েছি যখন—
আস্তিক্য ইহারি নাম—হইয়াছি মোরা সবে বীর, গতভয়।
সংসার-আসক্তি ত্যজি, ত্যজি সর্ব-দ্বন্দ্ব-মূল স্বার্থপরতায়,
পরামৃত পান করি, ধ্যান করি সর্ববিধ কল্যাণ-নিলয়
শ্রীগুরু-চরণাম্বুজ, ধরাবাসী সবাকারে করি নমস্কার
অমৃতের পূর্ণপাত্রে পান তরে আমন্ত্রণ করি বারংবার—
পূর্ণ যেই পাত্রখানি অনাদি-অনন্ত-বেদ-
পয়োধি-মন্থন-লব্ধ অতুলন ধনে,
যাহে শক্তি প্রদানিলা প্রজাপতি-নারায়ণ-
মহেশাদি শক্তিমান্ সর্ব দেবগণে,
পরিপূর্ণ যাহা সর্ব-অবতার-প্রাণসারে—
পূর্ণ যহা সবাকার মিলিত সত্তায়—
সে অমৃত-পূর্ণপাত্র ধরিয়া মানবদেহ
রামকৃষ্ণ-রূপ লয়ে এসেছে ধরায়।
২০৫ক*
[মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটকে লিখিত]
সহস্রদ্বীপোদ্যান (যুক্তরাষ্ট্র)
অগষ্ট, ১৮৯৫
প্রিয় বন্ধু,
আপনার চিঠি যথাসময়ে পেয়েছি।
আমার ইচ্ছামত আপনি আমায় লণ্ডনে যেতে বলেছেন—এ আপনার বিশেষ অনুগ্রহ ও মহত্ত্বের পরিচায়ক। সেজন্য অজস্র ধন্যবাদ। কিন্তু আমার লণ্ডনে যাবার কোন তাড়া নেই। তাছাড়া, আমি আপনাকে প্যারিসে বিবাহিত দেখতে চাই; তারপর আমি লণ্ডনে যাব।
আমি ঠিক সময়ে হাতের কাছে প্রস্তুত ... থাকব, ভয় নেই।
ইতি
আপনার চিরবিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
২৬০ক*
[গিরিধারীদাস মঙ্গলদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
২২৮ ওয়েষ্ট ৩৯ ষ্ট্রীট
নিউ ইয়র্ক
২ মার্চ, ১৮৯৬
প্রিয় বন্ধু,
আপনার সুন্দর পত্রখানির উত্তর দিতে দেরী হওয়ার জন্য ক্ষমা করবেন।
আপনার পিতৃব্য মহাত্মা ছিলেন, তাঁর সমগ্র জীবন দেশের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত। আশা করি আপনারা সবাই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন।
এই শীতে ভারতে ফিরছি—হরিদাস ভাইকে আর দেখতে পাব না ভেবে কী যে দুঃখ হচ্ছে, তা প্রকাশ করতে আমি অপারগ।
তিনি একজন দৃঢ়নিষ্ঠ উন্নতচরিত্র বন্ধু ছিলেন, তাঁকে হারিয়ে ভারতের খুবই ক্ষতি হল।
শিগ্গির ইংলণ্ডে যাচ্ছি—গ্রীষ্মকালটা সেখানে কাটাবার ইচ্ছা, আর পরের শীতকালে ভারতে যাব।
আপনার পিতৃব্য ও বন্ধুদের আমার কথা জানাবেন।
আপনার পরিবারবর্গের চির শুভানুধ্যায়ী
বিবেকানন্দ
পুনঃ—আমার ইংলণ্ডের ঠিকানাঃ কেয়ার অব ই.টি.স্টার্ডি এস্কোয়ার, হাই ভিউ, কেভার্শ্যাম, রীডিং, ইংলণ্ড।
৩২৪ক*
[‘লাইট অব দ্য-ইষ্ট’ পত্রিকার সম্পাদককে লিখিত]*
প্রিয় মহাশয়,
‘লাইট অব দ্য-ইষ্ট’ পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যা অনুগ্রহ করে আমাকে পাঠানর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। পত্রিকাটির সম্পূর্ণ সাফল্য কামনা করি।
যেহেতু পত্রিকাটির উন্নতিকল্পে আপনি আমার পরামর্শ চেয়েছেন আমি খোলাখুলি বলি, একাজে আমার আজীবন অভিজ্ঞতায় আমি সব সময়ে দেখেছি যে অলৌকিকের চর্চা ক্ষতিকর, তা মানুষকে দুর্বল করে। আমাদের যা চাই তা হল শক্তি। অন্যান্য জাতির চেয়ে ভারতবাসী—আমাদের বেশী দরকার বলিষ্ঠ তেজস্বী চিন্তার। সর্ববিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মের অনুশীলন আমাদের যথেষ্ট হয়েছে। যুগ যুগ ধরে আমাদের ভেতরে রহস্যময় বস্তু ঠেসে পোরা হয়েছে। তার ফলে, আমাদের বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক পরিপাকশক্তি এমনভাবে নষ্ট হয়ে গেছে যা প্রায় চিকিৎসার অসাধ্য এবং জাতিটাকে অকর্মণ্য মানসিক জড়তার এমন এক নিম্নস্তরে টেনে নামান হয়েছে যার অভিজ্ঞতা এর আগে বা পরে অন্য কোন সভ্য সমাজকে লাভ করতে হয়নি। একটা বলশালী জাতি গড়ে তুলতে হলে তার পেছনে তরতাজা ও বলিষ্ঠ চিন্তা থাকা দরকার।[তা] আছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপনিষদের মধ্যে, যা সারা পৃথিবীকে শক্তিশালী করতে পারে। অদ্বৈতবাদ হচ্ছে শক্তির শাশ্বত আকর। কিন্তু তাকে কাজে লাগান দরকার। প্রথমে বেদান্তকে পণ্ডিতীর কঠিন আবরণ থেকে মুক্ত করতে হবে; তারপরে তার সমস্ত সরলতা সৌন্দর্য ও ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়েও তা প্রয়োগ করে দেশের সর্বত্র শিক্ষা দিতে হবে। ‘এটা একটা বিরাট কাজের ফরমাশ’, কিন্তু তাহলেও, যেন আগামী কালই একাজ নিষ্পন্ন হবে এভাবে এই উদ্দেশ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।’ একটা বিষয়ে আমি সুনিশ্চিতঃ যে কেউ অকপট ভালবাসা দিয়ে, নিঃস্বার্থপর হয়ে মানুষের সেবা করতে চায় সে অসাধ্য সাধন করতে পারবে।
ইতি
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
৩৩০ক*
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
(দার্জিলিঙ থেকে লেখা)
আলমবাজার মঠ, কলকাতা
২৬ মার্চ, ১৮৯৭
প্রিয় মিসেস বুল,
আমাকে নিয়ে জাতীয় উল্লাস-উদ্দীপনা প্রদর্শন শেষ হয়েছে; অন্ততঃ আমাকে সে সব সংক্ষেপে সারতে হয়েছে, যেহেতু আমার স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়েছিল। পশ্চিমে একটানা খাটুনি ও ভারতে এক মাস প্রচণ্ড পরিশ্রমের পরিণাম বাঙালীর ধাতে—বহুমূত্র রোগ। এ একটি বংশগত শত্রু এবং বড়জোর কয়েক বছরের মধ্যে এই রোগে আমার দেহাবসান পূর্বনির্দিষ্ট। শুধু মাংস খাওয়া, জল একেবারে না খাওয়া এবং সর্বোপরি, মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ বিশ্রামই, বোধ হয়, জীবনের মেয়াদ বাড়াবার একমাত্র উপায়। মগজটাকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম আমি দিচ্ছি, দার্জিলিঙে যেখান থেকে এখন আপনাকে চিঠি লিখছি।
সারদানন্দের সাফল্যের খবর পেয়ে আমি খুব খুশী হয়েছি। তাকে আমার আন্তরিক ভালবাসা জানাবেন এবং তাকে অত্যধিক কাজ করতে দেবেন না। বাঙালীর শরীর মার্কিনদের মত নয়।
শ্রীযুক্ত চট্টোপাধ্যায় (মোহিনী) কলিকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন এবং খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেন। আপনার প্রেরিত বার্তা তাঁকে দিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে কাজ করতে বেশ আগ্রহী। আর বেশী কিছু লেখবার নেই, আমি শুধু আমার মঠটি চালু করতে দৃঢ়সংকল্প এবং সে কাজ সারা হওয়া মাত্র আমি আবার আমেরিকায় আসব।
প্রসঙ্গতঃ গার্টুড অর্চাড (Gertrude Orchard) নামে ইংলণ্ডের এক মহিলাকে আপনার কাছে পাঠাব। তিনি গৃহশিক্ষিকার কাজ করেছেন, কিন্তু ললিতকলাদিতে তাঁর ব্যুৎপত্তি আছে এবং আমার ইচ্ছে, তিনি আমেরিকায় গিয়ে ভাগ্যপরীক্ষা করে দেখুন। আপনার ও মিসেস (ফ্লোরেন্স) এ্যাডাম্স-এর উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি তাঁকে দেব।
মিসেস এ্যাডাম্স, মিস থার্সবী, মিস ফার্মার (মহীয়সী ভগিনী) এবং অন্যান্য সুহৃদ্গণকে আমার ভালবাসা জানাবেন।
আপনি আমার অসীম প্রীতি ও চিরকৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
আপনার স্নেহের
বিবেকানন্দ
৩৩১ক*
[লালা বদ্রী শাহকে লিখিত]
দার্জিলিঙ
৭ এপ্রিল, ১৮৯৭
প্রিয় লালাজী,
এইমাত্র তারযোগে আপনার সহৃদয় আমন্ত্রণ পেলাম। বোধহয় আপনি ইতোমধ্যে শুনেছেন যে আমি মারাত্মক বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়েছি।
তাতে আমাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল এবং আমাকে ছুটতে হল দার্জিলিঙে—এ জায়গায় খুব ঠাণ্ডা এবং এই রোগের পক্ষে হিতকর বলে।
সেই থেকে আমি অনেক ভাল বোধ করছি এবং ডাক্তাররা চান না যে আমি ঘোরাফেরা করি, কেন না তাতে রোগ আবার বাড়বে। আমার স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা যদি মাস দুয়েক চলে তাহলে মনে হয় আমি সমতল ভূমিতে নেমে আসতে সমর্থ হব এবং আপনাদের সকলের সঙ্গে দেখা করতে আলমোড়ায় যেতে পারব। আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি বলে আমি বিশেষ দুঃখিত। কিন্তু আপনি বুঝছেন, এছাড়া গত্যন্তর ছিল না; শরীরটা আমার আয়ত্বে ছিল না।
আপনি ও আলমোড়ার অন্যান্য সব বন্ধুরা আমার ভালবাসা জানবেন।
ইতি
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দঃ
৩৪৮ক*
[কলম্বোর মিঃ টি.শোকনাথনকে লিখিত]*
আলমোড়া
৩০ জুন, ১৮৯৭
প্রিয় বন্ধু,
সিংহলে (অধুনা শ্রীলঙ্কা) থাকার সময়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সে অনুসারে পত্রবাহক স্বামী শিবানন্দকে সেখানে পাঠান হল। যে কাজ তাঁর তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত হবে তিনি তার বিশেষ উপযুক্ত, অবশ্য আপনার সহৃদয় সহায়তা পেলে।
আশা করি আপনি তাঁকে সিংহলের অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেবেন। ইতি
সতত প্রভুসমীপে আপনার
বিবেকানন্দ
[পত্রাবলীতে উল্লিখিত ব্যক্তিগণের পরিচয়]
অক্ষয় | অক্ষয়কুমার ঘোষ, কলিকাতার সম্ভ্রান্ত বংশের যুবক। খাণ্ডোয়ায় স্বামীজীর সহিত তাঁহার বিশেষ পরিচয় হয়। পরে তিনি কলিকাতা হাইকোর্টের এটর্নি হইয়াছিলেন। ইংলণ্ডে মিস মূলারের তত্ত্বাবধানে যখন তিনি ছিলেন, স্বামীজী তাঁহাদের বাটীতে অতিথি হন। |
অক্ষয়কুমার সেন | শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথি’-প্রণেতা। স্বামীজী তাঁহাকে ‘শাঁকচুন্নী মাষ্টার’ বলিতেন। স্বামীজী শ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথির প্রভূত প্রশংসা করিয়া বলেনঃ এই গ্রন্থ জনসাধারণের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও বাণী প্রচার করিবে। |
অখণ্ডানন্দ স্বামী (গঙ্গাধর, গঙ্গা) | শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী-শিষ্য; শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের তৃতীয় অধ্যক্ষ (১৯৩৪-৩৭)। তিনি পরিব্রাজক অবস্থায় উত্তরাখণ্ডের দুর্গম তীর্থরাজি দর্শন করিতে করিতে হিমালয় অতিক্রম করিয়া তিব্বতে যান। সেখানে বৌদ্ধমঠে কিছুকাল কাটাইয়া কাশ্মীর হইয়া দেশে ফিরিয়া আসেন। অতঃপর স্বামীজী তাঁহাকে হিমালয় ভ্রমণে সাথী করেন। স্বামীজী-পরিকল্পিত সেবার আদর্শকে তিনিই প্রথম কার্যে রূপায়িত করেন—প্রথমে খেতড়িতে, পরে মুর্শিদাবাদে। |
অচ্যুতানন্দ সরস্বতী (অচু, অচ্যুত, গুণনিধি) | দয়ানন্দ-প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজের প্রচারক। পূর্বনাম গুণনিধি ভট্টাচার্য। স্বামীজীর সহিত কাশ্মীর ভ্রমণকালে তিনি যে ডায়েরী লিখিয়াছিলেন, তাহা হইতে স্বামীজীর জীবনের সেই সময়কার অনেক ঘটনা জানা যায়। |
অজয় (অজয়হরি) | স্বরূপানন্দ দ্রষ্টব্য। |
অজিত সিং | রাজপুতানায় খেতড়ি রাজ্যের রাজা, স্বামীজীর শিষ্য। পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজী তাঁহার প্রাসাদে কিছুদিন বাস করেন। স্বামীজীর আমেরিকা যাত্রাকালে তিনি তাঁহার আলখাল্লা পাগড়ি প্রভৃতি কিনিয়া দেন এবং যথেষ্ট অর্থাদি সাহায্য করিয়াছিলেন। স্বামী অখণ্ডানন্দের সহিতও তাঁহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। স্বামীজীর প্রেরণায় উভয়ে খেতড়ি রাজ্যে বহু জনহিতকর কার্যের প্রবর্তন করেন। নিজ ব্যয়ে মোগলযুগের একটি প্রাচীন কীর্তির সংস্কারকার্য পরিদর্শনকালে মিনারের উপর হইতে পড়িয়া গিয়া তাঁহার মৃত্যু হয়। কথিত আছে তাঁহারই অনুরোধে স্বামীজী ‘বিবেকানন্দ’ নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। |
অতুলবাবু | অতুলচন্দ্র ঘোষ, নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বিশেষ ভক্ত, কলিকাতা হাইকোর্টের উকিল। |
অদ্বৈতানন্দ, স্বামী (গোপালদাদা, বুড়োগোপাল) | শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী-শিষ্যদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁহার প্রদত্ত কয়েকখানি গেরুয়াবস্ত্র নরেন্দ্রনাথ প্রমুখ ত্যাগী যুবক ভক্তদের দিয়াছিলেন। |
অদ্ভুতানন্দ, স্বামী (লাটু) | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী-শিষ্য। তাঁহার অক্ষর-পরিচয় ছিল না; শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপায় তিনি জ্ঞানের অধিকারী হইয়াছিলেন। |
অভয়ানন্দ | মেরী লুই দ্রষ্টব্য |
অভেদানন্দ, স্বামী (কালী) | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী-শিষ্য। স্বামীজীর নির্দেশে তিনি প্রথমে লণ্ডনে ও পরে নিউ ইয়র্কে বেদান্ত প্রচার করিতে যান; এবং ২৫ বৎসর কাল ঐ কার্যে আমেরিকায় কাটান। |
অলকট, কর্ণেল | বিখ্যাত থিওসফিষ্ট নেতা, কলিকাতায় থিওসফিক্যাল সোসাইটির স্থাপয়িতা। |
অসীম | শ্রীরামকৃষ্ণের বাগবাজারনিবাসী ভক্ত, চুনীলালবাবুর পুত্র। |
আত্মানন্দ, স্বামী (সুকুল) | স্বামীজীর সন্ন্যাসী-শিষ্য। পূর্বনাম গোবিন্দপ্রসাদ সুকুল। ছাত্রজীবনে শ্রীশ্রীমায়ের নিকট মন্ত্রদীক্ষা লাভ করেন। ১৮৯৬ খ্রীঃ আলমবাজার মঠে যোগদান করেন। ১৮৯৯ খ্রীঃ বেলুড়ে সন্ন্যাসদীক্ষা হয়। ১৮৯৮ খ্রীঃ কলিকাতায় প্লেগ মহামারীতে স্বামী সদানন্দের সহিত সেবাকার্যে যোগ দেন। কিছুকাল ‘উদ্বোধন’ পত্রিকা-পরিচালনায় স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের সহকারী ছিলেন; মান্দ্রাজে প্রচারকার্যেও তিনি স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের সহকারী ছিলেন; বাঙ্গালোর, ঢাকা প্রভৃতি মঠে অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯২৩ খ্রীঃ কাশীধামে তাঁহার দেহত্যাগ হয়। |
আলাসিঙ্গা , পেরুমল | স্বামীজীর বিশেষ অনুগত শিষ্য। ইঁহারই নেতৃত্বে মান্দ্রাজী যুবকগণ দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া স্বামীজীর আমেরিকা-যাত্রার পাথেয় সংগ্রহ করিয়াছিল। ইনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করিতেন, পরে মান্দ্রাজ হইতে প্রকাশিত ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। |
ইঙ্গারসোল (১৮৩৩-৯৯) | রবার্ট ইঙ্গারসোল, আমেরিকাবাসী বিখ্যাত অজ্ঞেয়বাদী লেখক ও বক্তা। বক্তৃতা- কোম্পানীর কার্যোপলক্ষে ইঁহার সহিত স্বামীজীর পরিচয় এবং ধর্মদর্শনাদি বিষয়ে আলোচনা হয়। ইঁহার স্পষ্টবাদিতা ও আন্তরিকতার জন্য স্বামীজী ইঁহাকে প্রীতির চক্ষে দেখিতেন। ইঁহার রচিত গ্রন্থাবলীঃ The gods and other Lectures; Some mistakes of Moses. |
ইন্দু | শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্যা বলরামবাবুর দৌহিত্রী। |
ইন্দুমতী মিত্র | হরিপদ মিত্রের স্ত্রী, স্বামীজীর শিষ্যা। |
ঈশান মুখোপাধ্যায় | স্বামীজীর বাল্যবন্ধু সতীশচন্দ্রের পিতা। শ্রীরামকৃষ্ণ ইঁহাদের বাড়ীতে কয়েকবার গিয়াছেন। |
উডস্, মিসেস ট্যানাট | চিকাগো বক্তৃতার পূর্বে ১৮৯৩ খ্রীঃ অগষ্ট মাসে মিসেস ট্যানাট উডস্ সেলেমে তাঁহার বাড়ীতে স্বামীজীকে আমন্ত্রণ করেন। স্বামীজী সেখানে এক সপ্তাহ কাটান এবং বক্তৃতা দেন; ধর্মযাজকগণ তাঁহার বিরুদ্ধ সমালোচনা করেন। মিসেস উডস্ ভাল বক্তৃতা দিতে পারিতেন, রচনার জন্যও তাঁহার সুনাম ছিল। |
উপেন | ‘বসুমতী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত। |
ঋষিবর মুখোপাধ্যায় | কাশ্মীরের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি, কাশ্মীর ভ্রমণকালে শ্রীনগরে স্বামীজী তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করেন। |
এবট, লীম্যান | ব্রুকলিনের প্লীমাথ কংগ্রিগেশন্যাল চার্চ-এর ধর্মযাজক এবং সাময়িক পত্র 'Outlook'-এর সম্পাদক। সমাজ ও শিল্পসংস্কারে এবং ধর্ম-আন্দোলনে তিনি উদ্যোগী ছিলেন। চিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগদান করেন, সেখানেই স্বামীজীর সহিত তাঁহার পরিচয় হয়। |
এলবার্টা | মিস এলবার্ট স্টার্জিস, মিসেস লেগেটের প্রথম বিবাহের কন্যা; পরে কাউণ্টেস অব স্যাণ্ডউইচ। |
এস্পিনেল, মিসেস এমিলি | স্বামীজী যখন ১৯০০ খ্রীঃ সানফ্রান্সিস্কো টার্ক ষ্ট্রীট ফ্ল্যাটে বাস করিতেছিলেন, তখন এই ভদ্রমহিলা সেই ঘরের কাজকর্ম দেখাশুনা করিতেন। |
ওকাকুরা মিঃ | কাকাজু ওকাকুরা, বিখ্যাত জাপানী প্রাচ্যশিল্প-বিশেষজ্ঞ; স্বামীজীকে জাপানে লইয়া যাইবার জন্য ভারতে আসিয়াছিলেন; স্বামীজীর সহিত বুদ্ধগয়া, কাশী প্রভৃতি তীর্থ ভ্রমণ করেন। |
ওয়াইকফ | (মিসেস কেরী মিড্ ওয়াইকফ)—স্বামীজী তাঁহার গৃহে কিছুদিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। পরে স্বামী তুরীয়ানন্দের দ্বারা প্রভাবিত হইয়া তিনি ‘ভগিনী ললিতা’ নামে পরিচিতা হন। তাঁহার লস্ এঞ্জেলেস-এর বাড়ী ‘বিবেকানন্দ হোম’ নামে খ্যাত। ভগিনী ললিতার ঐ বাটীতেই হলিউড বেদান্ত সমিতি প্রতিষ্ঠিত। |
ওয়াল্ডো, মিস এস্. ই. | স্বামীজীর ব্রুকলিন-বাসিনী শিষ্যা, ‘ভগিনী হরিদাসী’ নামে পরিচিতা। থাউজ্যাণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে স্বামীজীর সহিত কথোপকথনগুলি তিনি লিপিবদ্ধ করেন। পরে ঐগুলি 'Inspired Talks' (বাঙলায় ‘দেববাণী’) নামে প্রকাশিত। তিনি কিছুকাল নিউ ইয়র্ক বেদান্ত সমিতির পরিচালনা করেন এবং স্বামীজীকে প্রচারকার্যে ও গ্রন্থ-সম্পাদনায় সাহায্য করিয়াছিলেন। |
কর্বিন, মিস | মিস থার্সবির বন্ধু। নিউ ইর্য়ক বেদান্ত সমিতির সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন। |
কানাই | নির্ভয়ানন্দ দ্রষ্টব্য। |
কংগার, মিসেস | চিকাগো জন বি লায়নের বিধবা কন্যা। ধর্মমহাসভার প্রতিনিধিরূপে স্বামীজীকে লায়ন পরিবারের গৃহে স্থান দেওয়া হয়। উক্ত কন্যা পিতৃগৃহে বাস করিতেন এবং স্বামীজীর ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া জীবনে সান্ত্বনা লাভে সমর্থ হন। |
কালভে, মাদাম | ফরাসীদেশীয় বিখ্যাত গায়িকা। জীবনের এক সঙ্কট মুহূর্তে স্বামীজীর সহিত দেখা হয়, স্বামীজী তাঁহার মনের অশান্তি দূর করেন; পশ্চিম ইওরোপ, তুর্কীস্থান, মিসর প্রভৃতি দেশ-ভ্রমণে তাঁহার সাথী হন। বহুদিন পরে মাদাম কালভে বেলুড় মঠ দর্শন করিতে আসেন। আত্মজীবনীর একটি অধ্যায়ে তিনি স্বামীজী সম্বন্ধে লিখিয়াছেন। |
কালী (কালী তপস্বী) | অভেদানন্দ দ্রষ্টব্য। |
কালীচরণ বাঁড়ুজ্যে, রেভাঃ | খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী প্রসিদ্ধ ধর্মযাজক। একসময়ে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার ছিলেন। |
কালীকৃষ্ণ | বিরজানন্দ দ্রষ্টব্য। |
কালীকৃষ্ণ বাবু | কালীকৃষ্ণ দত্ত, একটি ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার। |
কিডি | স্বামীজীর শিষ্য সিঙ্গারভেলু মুদালিয়র, মান্দ্রাজে ক্রিশ্চান কলেজের বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। স্বামীজী তাঁহাকে বিশেষ ভালবাসিতেন। তিনি পাখীর মত স্বল্পাহারী ছিলেন বলিয়া স্বামীজী তাঁহাকে ‘কিডি’ বলিয়া ডাকিতেন। তামিল ভাষায় ‘কিডি’ শব্দের অর্থ পাখী। মান্দ্রাজ হইতে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকা যখন প্রকাশিত হইত, তখন তিনি উহার অবৈতনিক কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। |
কৃপানন্দ, স্বামী | ল্যাণ্ডসবার্গ দ্রষ্টব্য। |
কৃপানন্দ, স্বামী | বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল দ্রষ্টব্য। |
কৃষ্ণময়ী | ভক্ত বলরাম বসুর কনিষ্ঠা কন্যা। |
কৃষ্ণলাল (কেষ্টলাল ব্রহ্মচারী) | পরে স্বামী ধীরানন্দ; শ্রীশ্রীমায়ের মন্ত্রশিষ্য, মঠে প্রথম দুর্গাপূজার পূজারী ছিলেন। |
কৃষ্ণনন্দ, স্বামী | পূর্বনাম কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন, বিখ্যাত বক্তা ও হিন্দুধর্ম-প্রচারক। ভগবদ্ গীতার টীকা-লেখক। |
কৃষ্টিন ভগিনী(ক্রিশ্চিন) | ডেট্রয়েটের মিস কৃষ্টিন গ্রীনষ্টিডেল, স্বামীজীর শিষ্যা। ভারতীয় নারীশিক্ষা-কার্যে ভগিনী নিবেদিতার সহকর্মিণী; স্বামীজী তাঁহার আধ্যাত্মিকতার বিশেষ প্রশংসা করিতেন। |
খগেন | বিমলানন্দ দ্রষ্টব্য। |
খোকা (সুবোধ) | সুবোধানন্দ দ্রষ্টব্য। |
গঙ্গাধর (গঙ্গা, গ্যাঞ্জেস) | অখণ্ডানন্দ দ্রষ্টব্য। |
গগনবাবু | গাজীপুরনিবাসী গগনচন্দ্র রায়। স্বামীজী ও অন্যান্য গুরুভ্রাতাগণ পরিব্রাজক অবস্থায় তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করেন। তিনিই পওহারী বাবার সহিত স্বামীজীর পরিচয় করাইয়া দেন। |
গার্নসি, মিসেস | নিউ ইয়র্ক-বাসিনী শিষ্যা, স্বামীজী ১৮৯৪ খ্রীঃ কিছুদিনের জন্য গার্নসি-পরিবারে বাস করিয়াছিলেন। |
গিরিশবাবু | গিরিশচন্দ্র ঘোষ, বিখ্যাত নট ও নাট্যকার, শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম প্রধান ভক্ত। স্বামীজী তাঁহাকে ‘জি. সি.’ (G. C.) বলিয়া ডাকিতেন। |
গুডইয়ার | নিউ ইয়র্কের মিঃ ও মিসেস ওয়াল্টার গুডইয়ার; আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারকার্যে স্বামীজীকে সাহায্য করেন। |
গুডউইন, মিঃ জে. জে | স্বামীজীর একজন প্রিয় অনুগত ইংরেজ শিষ্য। স্বামীজীর বহু বক্তৃতা ইনি সাঙ্কেতিকলিপিতে লিখিয়া রাখেন, সেইজন্যই ঐগুলি পাওয়া সম্ভব হইয়াছে। স্বামীজী বলিতেন— Faithful Goodwin (বিশ্বস্ত গুডউইন)। স্বামীজীর সহিত তিনি আমেরিকা, ইওরোপ ও ভারতের অনেক স্থানে ভ্রমণ করেন। দক্ষিণ ভারতে উতকামণ্ডে তাঁহার অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে ব্যথিত হইয়া স্বামীজী 'Requiescat in Pace' কবিতাটি লেখেন। |
গুণনিধি | অচ্যুতানন্দ দ্রষ্টব্য। |
গুপ্ত (শরৎচন্দ্র গুপ্ত) | সদানন্দ দ্রষ্টব্য। |
গুরুমহারাজ | শ্রীরামকৃষ্ণদেব। |
গেডিস, অধ্যাপক | স্কটল্যাণ্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক প্যাট্রিক গেডিস; কিছুকাল বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপনা করিয়াছিলেন, পরে ফ্রান্সে একটি কলেজ স্থাপন করেন। |
গোপালদাদা (বুড়োগোপাল) | অদ্বৈতানন্দ দ্রষ্টব্য। |
গোপালের মা | কামারহাটি-নিবাসিনী অঘোরমণি দেবী, উচ্চ-অনুভূতিসম্পন্না বাৎসল্যভাবে সিদ্ধা সাধিকা। শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে তিনি গোপালভাবে দেখিতেন এবং সেইভাবের অদ্ভুত দর্শনাদি তাঁহার হইত। স্বামীজী তাঁহার অতি স্নেহের পাত্র ছিলেন। |
গোবিন্দচন্দ্র বসু, ডাঃ | এলাহাবাদের ডাক্তার; তীর্থপর্যটনকালে (১৮৮৮ খ্রীঃ) স্বামীজী ও অন্যান্য গুরুভ্রাতাগণ তাঁহার বাড়ীতে কয়েকদিন অবস্থান করিয়াছিলেন। |
গোবিন্দলাল শা | স্বামীজীর আলমোড়া-নিবাসী ভক্ত। |
গোবিন্দ সহায় | আলোয়ার-নিবাসী স্বামীজীর শিষ্য। |
গোলাপ-মা (গোলাপমণি দেবী) | শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যা; তিনি বহু বৎসর শ্রীশ্রীমায়ের সেবা করিয়াছিলেন। ‘শোকাতুরা ব্রাহ্মণী’ এই নামেই ‘কথামৃতে’ তাঁহার পরিচয় দেওয়া আছে। |
গৌর-মা (গৌরীমা, গৌরদাসী) | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিষ্যা; সন্ন্যাসিনী। |
গ্রিফিন, লেপেল | স্যর লেপেল গ্রিফিন ভারতীয়দের বিরুদ্ধবাদী ছিলেন। রবীন্দ্ররচনাবলীতে ‘সমূহ’-গ্রন্থের পরিশিষ্টে তাহার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। |
চক্রবর্তী, জ্ঞানেন্দ্রনাথ | এলাহাবাদে অধ্যাপক ছিলেন; পরবর্তী কালে লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস- চ্যান্সেলার হন। ১৮৯৩ খ্রীঃ থিওসফি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরূপে চিকাগো ধর্মসম্মেলনে যোগদান করেন। |
চারু | চারুচন্দ্র বসু, পালিভাষায় পণ্ডিত; প্রসিদ্ধ পালি গ্রন্থ ‘ধম্মপদে’র বাঙলা অনুবাদক ও ‘অশোক- অনুশাসন’ প্রভৃতি পুস্তকের লেখক। |
চুনীবাবু | বাগবাজার-নিবাসী চুনীলাল বসু; শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী ভক্ত। |
ছবিল দাস | বোম্বাই-এর বিখ্যাত ব্যারিষ্টার শেঠ রামদাস ছবিল দাস। আমেরিকা যাত্রার প্রাক্কালে স্বামীজী তাঁহার অতিথি হইয়াছিলেন। |
জগমোহন | মুন্সী জগমোহন লাল, খেতড়ি মহারাজের প্রাইভেট সেক্রেটারী, স্বামীজীর অনুগত ভক্ত, আমেরিকা যাত্রার সময় তিনিই স্বামীজীকে জাহাজে তুলিয়া দেন। |
জজ | থিওসফিক্যাল সোসাইটির আমেরিকা-কেন্দ্রের অধ্যক্ষ। |
জনসন, মিসেস | ইংলণ্ডে বেদান্ত-প্রচারকার্যে স্বামীজীকে নানাপ্রকারে সাহায্য করিয়াছিলেন। |
জনষ্টন, মিঃ (জনসন) | চার্লস জনসন; ব্রহ্মচর্যব্রত-গ্রহণের পর ‘ব্রহ্মচারী অমৃতানন্দ’ নামে পরিচিত হন। মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে কয়েক বৎসর বাস করিয়াছিলেন। |
জিনি, ভগিনী | স্বামীজী যখন মিঃ হিউ এল. বিঙ্কলির অতিথি হইয়া মেমফিসের একটি বোর্ডিং হাউসে গিয়াছিলেন, উহার মালিক ছিলেন মিস ভার্জিনিয়া মুন, সকলে তাঁহাকে আদর করিয়া ‘ভগিনী জিনি’ বলিয়া ডাকিতেন। মিস মুন উক্ত বোর্ডিং হাউসে স্বামীজীর জন্য একটি সভার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। |
জি. জি | বাঙ্গালোরের জি. জি. নরসিংহাচারিয়ার স্বামীজীর অনুগত ভক্ত। মান্দ্রাজ হইতে প্রকাশিত ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকার সহিত যুক্ত ছিলেন। |
জুল, বোয়া | ফরাসী দেশের বিখ্যাত দার্শনিক ও সাংবাদিক। স্বামীজী প্যারিসে কিছুদিনের জন্য তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি স্বামীজীর সঙ্গে ইওরোপের নানাস্থান ভ্রমণ করেন। |
জেমস্, ডক্টর লুই জি. | প্রসিদ্ধ বক্তা ও পণ্ডিত; তিনি ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ‘স্কুল অব কম্পারেটিভ রিলিজিয়নে’র প্রধান পরিচালক; এসোসিয়েশনে হিন্দুধর্ম-প্রসঙ্গে ধারাবাহিক বক্তৃতা করিবার জন্য স্বামীজীকে আহ্বান করিয়াছিলেন। > |
জেমস্, ডক্টর উইলিয়ম | হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, প্রসিদ্ধ দার্শনিক পণ্ডিত; 'Varieties of Religious Experience' প্রভৃতি দার্শনিক গ্রন্থের লেখক। স্বামীজীর সহিত ব্যক্তিগত পরিচয় ও আলাপের ফলে ইনি স্বামীজীর দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হন। |
জো | মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড দ্রষ্টব্য। |
টাটা, স্যর জামসেদজী | বোম্বাইয়ের প্রসিদ্ধ ধনকুবের। জামসেদপুরে বৃহৎ লৌহ ও ইস্পাতের কারখানা, বাঙ্গালোরে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠাতা। |
টার্নবুল, ডাঃ | ১৮৯৬ খ্রীঃ শেষভাগে চিকাগোর ডাঃ টার্নবুল নামক স্বামীজীর এক আমেরিকান ভক্ত কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। তিনি আলমবাজার মঠে আসিয়া সংস্কৃত ব্যাকরণ শিখিতেন, জ্যোতিষ জানিতেন এবং শ্রীরামকৃষ্ণের কোষ্ঠী বিচার করিয়া বলেন, ‘ইনি জীবের উদ্ধারকর্তা ও অজ্ঞানান্ধকার-নাশক।’ |
টেসলা | মিঃ নিকোলা টেসলা; আমেরিকার একজন বিখ্যাত তড়িৎ-তত্ত্ববিদ। স্বামীজীর মুখে সাংখ্যদর্শনের ব্যাখ্যা শুনিয়া মুগ্ধ হন; উহাতে বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্ব শ্রেষ্ঠ বলিয়া স্বীকার করেন। |
ঠাকুর সাহেব | গুজরাটের অন্তর্গত লিমডির মহারাজা এবং স্বামীজীর শিষ্য। স্বামীজী তাঁহার প্রাসাদে আতিথ্য স্বীকার করিয়াছিলেন। |
ডয়সন, অধ্যাপক | পল ডয়সন জার্মানীর প্রসিদ্ধ প্রাচ্যদর্শনবিদ; কিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক। তিনি শাঙ্করভাষ্য-সমেত বেদান্ত-সূত্র, ৬০ খানি উপনিষদ্ ও মহাভারতের কতকাংশ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি স্বামীজীকে স্বীয় বাসভবনে আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। স্বামীজী তাঁহার সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেন। |
ডাক্তার | নাঞ্জুণ্ড রাও দ্রষ্টব্য। |
ডাচার, মিস | স্বামীজীর শিষ্যা; সেণ্ট লরেন্স নদীবক্ষে সহস্রদ্বীপোদ্যানে ইঁহারই নির্জন আবাসে স্বামীজী কিছুদিন অবস্থান করিয়া দ্বাদশজন শিষ্যশিষ্যাকে বেদান্ত শিক্ষা দিয়াছিলেন। |
ডে, ডাক্তার | স্বামীজীর ভক্ত ডাঃ এলেন ডে। |
তারক (তারকদাদা) | শিবানন্দ দ্রষ্টব্য। |
তুরীয়ানন্দ, স্বামী (হরিনাথ) | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী-শিষ্য; আবাল্য বৈদান্তিক; স্বামীজী দ্বিতীয়বার আমেরিকায় যাইবার সময় তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া গিয়াছিলেন। আমেরিকার ‘শান্তি আশ্রম’ তাঁহারই প্রতিষ্ঠিত। তাঁহার উদ্দীপনাপূর্ণ পত্রগুলি সাধনজীবনের পথনির্দেশক। স্বামীজী তাঁহাকে ‘হরি-ভাই’ বলিতেন। |
তুলসী | নির্মলানন্দ দ্রষ্টব্য। |
তুলসীবাবু | তুলসীরাম ঘোষ, স্বামী প্রেমানন্দের জ্যেষ্ঠভ্রাতা; তিনি শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে বহুবার দর্শন করিয়াছিলেন। |
ত্রিগুণাতীতান ন্দ, স্বামী (সারদা) | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী-শিষ্য। স্বামীজীর নির্দেশে তিনি ‘উদ্বোধন’ পত্রিকা প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন এবং আমেরিকা-যাত্রার পূর্ব পর্যন্ত উহার সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকার প্রকাশ ও প্রচারের জন্য তাঁহাকে অত্যন্ত পরিশ্রম করিতে হইত। আমেরিকাতেও তিনি 'Voice of Freedom' নামক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সানফ্রান্সিস্কোর বেদান্তমন্দির তাঁহারই প্রতিষ্ঠিত। আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে বেদান্তকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব অনেকখানি তাঁহারই। আমেরিকাতেই তাঁহার দেহত্যাগ হয়। |
থার্সবি, মিস এম্মা | বিখ্যাত গায়িকা, পাশ্চাত্যে বেদান্ত প্রচারকার্যে তিনি নানা প্রকারে স্বামীজীকে সাহায্য করেন। তিনি মিসেস বুলের বন্ধু এবং মিস ফিলিপস্ ও মিস স্মিথের সহিত নিউ ইয়র্ক বেদান্ত সমিতির সভ্য হইয়াছিলেন। |
দক্ষ (দক্ষরাজা) | স্বামী জ্ঞানানন্দ; কিছুকালের জন্য বরাহনগর মঠে ছিলেন। |
দমদম মাষ্টার | যজ্ঞেশ্বরচন্দ্র ঘোষ; দমদমের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করিতেন বলিয়া তাঁহাকে ‘দমদম মাষ্টার’ বলা হইত। বরাহনগর ও আলমবাজার মঠে যাতায়াত করিতেন। |
দয়ানন্দ, স্বামী | আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৪-৮৩)। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত সন্ন্যাসী—বেদকে অবলম্বন করিয়া ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারে অগ্রণী হন। কলিকাতায় অবস্থানকালে একবার শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত তাঁহার দেখা হয়। ১৮৭৫ খ্রীঃ বোম্বাই-এ আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। |
দাশু | দাশরথি সান্যাল, স্বামীজীর সহপাঠী ও বিশেষ বন্ধু; পরে কলিকাতা হইকোর্টের বিখ্যাত উকিল হইয়াছিলেন। |
দীননাথ (দীনু) | সচ্চিদানন্দ দ্রষ্টব্য। |
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহর্ষি | কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা; ঊনবিংশ শতকের অন্যতম চিন্তানায়ক এবং রামমোহনের ভাবাদর্শে আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা। ইঁহারই উদ্যোগে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। |
ধর্মপাল | অনাগারিক ধর্মপাল; কলিকাতা মহাবোধি সোসাইটি এবং সারনাথ মহাবোধি মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৯৩ খ্রীঃ চিকাগো ধর্মমহাসভায় বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধিরূপে উপস্থিত ছিলেন। ১৮৯৮ খ্রীঃ স্বামীজীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে বেলুড় মঠে আসেন। |
ধীরামাতা (স্থিরামাতা) | বুল (মিসেস ওলি) দ্রষ্টব্য। |
ন-ঘোষ | নগেন্দ্রনাথ ঘোষ; মেট্রোপলিটান কলেজের অধ্যক্ষ এবং ‘ইণ্ডিয়ান নেশন’ পত্রিকার সম্পাদক। |
নগরকার, বি. বি. | বোম্বাই হইতে প্রার্থনা সমাজের প্রতিনিধিরূপে চিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগদান করেন এবং উক্ত মহাসভার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। |
নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত | লাহোরের ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক। আমেরিকা হইতে ফিরিয়া কাশ্মীর ও পাঞ্জাব ভ্রমণকালে স্বামীজী তাঁহার অতিথি হইয়াছিলেন। |
নাঞ্জুণ্ড রাও, ডাক্তার | মান্দ্রাজের (ময়লাপুর) অধিবাসী তদানীন্তন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক; স্বামীজীর অনুগত ভক্ত। ইনিই মান্দ্রাজ হইতে প্রকাশিত ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। |
নরসিংহাচারিয়ারর, জি. জি. | জি. জি. দ্রষ্টব্য। |
নরসিংহাচারিয়ারর, রাও বাহাদুর | মহীশূর সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডিরেক্টর। |
নরসিংহাচার্য (নরসিমা) | ইনি বৈষ্ণব ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরূপে চিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগদান করেন। আমেরিকায় স্বামীজীর সহিত পরিচয় হয়। |
ন্যাদা (নাদু) | স্বামীজীর ভাগিনেয়। মঠের ব্রহ্মচারী। |
নাগমহাশয় | পূর্ববঙ্গের দুর্গাচরণ নাগ, শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম প্রধান গৃহী ভক্ত। ইনি গৃহী হইয়াও সন্ন্যাসীর মত জীবন যাপন করিতেন এবং অত্যন্ত ভক্তিমান সাধক ও দীনতার প্রতিমূর্তি ছিলেন। পাশ্চাত্য দেশ হইতে স্বামীজী কলিকাতায় ফিরিলে নাগমহাশয় স্বামীজীকে দর্শন করিতে আসেন। স্বামীজীও পূর্ববঙ্গ ভ্রমণকালে নাগমহাশয়ের দেওভোগ গ্রামের বাড়ীতে গিয়াছিলেন। |
নারায়ণ দাস | সংস্কৃত বৈয়াকরণ ও খেতড়ির রাজা অজিত সিংহের সভাপণ্ডিত; স্বামীজী তাঁহার নিকট পতঞ্জলি-কৃত পাণিনিসূত্রের টীকা ‘মহাভাষ্য’ অধ্যয়ন করেন এবং পত্রাবলীতে ‘মদীয় অধ্যাপক’ বলিয়া শ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়াছেন। |
নিত্যগোপাল | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্ত; পরে জ্ঞানানন্দ অবধূত। |
নিত্যানন্দ স্বামী (যোগেন চাটুজ্যে) | স্বামীজীর সন্ন্যাসী শিষ্য। বরাহনগরের অধিবাসী, মঠের সূচনা হইতেই যাতায়াত করিতেন। ১৮৯৭ খ্রীঃ আলমবাজার মঠে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। দুর্ভিক্ষ-পীড়িত মুর্শিদাবাদের মহুলা গ্রামে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম সেবাকার্যে তিনি স্বামী অখণ্ডানন্দের অন্যতম সহকারী ছিলেন। |
নিবেদিতা , ভগিনী | মিস মার্গারেট ই. নোব্ল্; স্বামীজীর শিষ্যা। স্বামীজী কর্তৃক অনুপ্রাণিত হইয়া ভারতের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেন। এদেশে স্ত্রীশিক্ষাবিস্তারের কার্যে আত্মনিয়োগ করেন এবং ভারতের মুক্তি-আন্দোলনের সহিতও জড়িত ছিলেন। The Master as I saw Him, Notes of some Wanderings with the Swami Vivekananda, Web of Indian Life, Cradle Tales of Hinduism প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িত্রী। ১৯১১ খ্রীঃ দার্জিলিঙে দেহত্যাগ করেন। কলিকাতায় বাগবাজার অঞ্চলে ভারতীয় আদর্শে স্ত্রীশিক্ষাদানের জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন; ঐ বিদ্যালয় বর্তমানে ‘নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়’ নামে পরিচিত। |
নিরঞ্জনানন্দ, স্বামী (নিরঞ্জন) | পূর্বনাম নিত্যনিরঞ্জন ঘোষ। শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী-শিষ্য। নির্ভীক ও সরল-প্রকৃতি ছিলেন বলিয়া স্বামীজী তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। |
নির্ভয়, নির্ভয়ানন্দ | পূর্বাশ্রমের নাম কানাই সেন। স্বামীজীর সন্ন্যাসী-শিষ্য। |
নির্মলানন্দ, স্বামী (তুলসী) | কলিকাতা বাগবাজার অঞ্চলের অধিবাসী। তিনি কয়েকবার শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করিয়াছিলেন। বরাহনগর মঠে স্বামীজীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ১৯০৩ খ্রীঃ আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারকার্যে প্রেরিত হইয়াছিলেন। পরে বাঙ্গালোরে ও দক্ষিণ ভারতের নানা স্থানে ধর্মপ্রচার করেন। |
নীলাম্বরবাবু | নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়, কাশ্মীর রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বেলুড়ে গঙ্গাতীরস্থ তাঁহার বাড়ীতে শ্রীশ্রীমা কিছুকাল বাস করিয়াছিলেন এবং পরে ১৮৯৮ খ্রীঃ আলমবাজার হইতে মঠ সেখানে স্থানান্তরিত হয়। |
নোব্ল্, মিস | ভগিনী নিবেদিতা দ্রষ্টব্য। |
পণ্ডিতজী মহারাজ | শঙ্করলাল দ্রষ্টব্য। |
পল কেরস্, ডাঃ | প্রসিদ্ধ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী; বুদ্ধ সম্বন্ধে গ্রন্থাদির রচয়িতা। |
পওহারী বাবা | গাজীপুরের বিখ্যাত যোগী; স্বামীজী তাঁহার নিকট হইতে হঠযোগ শিক্ষা করিতে ইচ্ছা করিয়া কিছুদিন যাতায়াত করিয়াছিলেন। স্বামীজীর লেখা ‘পওহারী বাবা’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য ৮ম খণ্ড। |
পামার, টমাস | বিশ্ব মহামেলার (World's Fair Commission) সভাপতি মিঃ টমাস পামারের ডেট্রয়েটের বাড়ীতে অতিথিরূপে স্বামীজী এক পক্ষকাল বাস করেন। ইনি পূর্বে স্পেনদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাজদূত ছিলেন, এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটার হইয়াছিলেন। |
পুরুষোত্তম যোশী | চিকাগো ধর্মসভায় প্রতিনিধিরূপে যোগদান করেন। |
পূর্ণচন্দ্র ঘোষ | শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী ভক্ত। বাল্যকালেই ‘কথামৃত’-কার শ্রীম-র সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করেন। পরে সরকারী অর্থবিভাগে চাকরি করিতেন। |
প্যারীবাবু | উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়। চিকাগো বক্তৃতার পর স্বামীজীকে সমর্থন করার জন্য কলিকাতা টাউন হলে ১৮৯৫ খ্রীঃ যে সভা হয়, তাহার সভাপতি ছিলেন। |
প্রকাশানন্দ (সুশীল) | স্বামী শুদ্ধানন্দের ভ্রাতা; স্বামীজীর সন্ন্যাসী-শিষ্য। ১৮৯৬ খ্রীঃ আলমবাজার মঠে যোগদান ও ১৮৯৭ খ্রীঃ স্বামীজীর নিকট সন্ন্যাসদীক্ষা। পরে ‘সানফ্রান্সিস্কো বেদান্ত সোসাইটি’র অধ্যক্ষ। ১৯২৭ খ্রীঃ সেখানেই দেহত্যাগ। |
প্রতাপ মজুমদার | কেশবচন্দ্র সেন-প্রতিষ্ঠিত ‘নববিধান’ ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম নেতা, শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট তিনি বহুবার যাতায়াত করিয়াছেন এবং তাঁহার সম্বন্ধে 'Hindu Saint' নামক একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। চিকাগো ধর্মমহাসভায় তিনি ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধিরূপে যোগদান করেন। 'Oriental Christ' লিখিয়া যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁহার লিখিত 'Paramahamsa Ramakrishna' পুস্তিকা উদ্বোধন আফিস হইতে প্রকাশিত। |
প্রমদাদাস মিত্র | কাশীর জমিদার; পাণ্ডিত্য, ধর্মানুরাগ ও শ্রীরামকৃষ্ণের উপর বিশ্বাস এবং ভক্তির জন্য স্বামীজী তাঁহাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন। পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজী ও অপর গুরুভ্রাতারা কাশীতে তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে লিখিত একটি স্তবে বেদান্তজ্ঞানের সহিত তাঁহার অপূর্ব ভক্তি ও বিশ্বাস প্রকটিত হইয়াছে। |
প্রেমানন্দ, স্বামী (বাবুরাম) | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী-শিষ্য। তাঁহার ভক্তিমতী মাতার আমন্ত্রণে স্বামীজী ও অন্যান্য গুরুভ্রাতাগণ আঁটপুরে গিয়াছিলেন। বলরামবাবু এই ভক্তপরিবারেরই জামাতা। |
ফকির | যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্য, বলরাম বসুর পুত্র রামকৃষ্ণ বসুর গৃহশিক্ষক। স্বামীজী তাঁহাকে ‘ফকিরুদ্দীন হালদার’ বলিতেন। |
ফার্মার, মিস | মিস সারা ফার্মার বিখ্যাত তরিৎতত্ত্ববিদ্ গেরিস ফার্মারের কন্যা। নিউ ইয়র্কে স্বামীজীকে আমন্ত্রণ জানান। ইনিই ‘গ্রীনএকার রিলিজিয়াস কনফারেন্সে’র প্রতিষ্ঠাত্রী। স্বামীজী তাঁহারই বাড়ীতে কিছুকাল বাস করেন। |
বদ্রীসা, লালা | আলমোড়া-নিবাসী ব্যবসায়ী, স্বামীজীর ভক্ত। |
বনি, মিঃ চার্লস ক্যারল | আমেরিকার বিখ্যাত আইনজ্ঞ; ১৮৯০ খ্রীঃ হইতে 'International Law and Order League'-এর সভাপতি; ১৮৯০ খ্রীঃ ৩০ অক্টোবর গঠিত World's Congress Auxiliary of the Columbian Exposition-এর সভাপতি হন। বিভিন্ন মানবিক বিষয় আলোচনার জন্য কতকগুলি সম্মেলন-অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার কথা তিনিই প্রথম চিন্তা করেন। |
বলরামবাবু | বলরাম বসু, শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী ভক্ত ও রসদদার। শ্রীরামকৃষ্ণ বাগবাজারে তাঁহার বাড়ীতে বহুবার গিয়াছেন এবং শ্রীমা ও স্বামীজী প্রমুখ গুরুভ্রাতৃগণ তথায় মাঝে মাঝে বাস করিয়াছেন। ১৮৯৭ খ্রীঃ এই বাড়ীতেই একটি সভায় ‘শ্রীরামকৃষ্ণ মিশনে’র সূত্রপাত হয়। |
বসু, ডাক্তার | বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু। প্যারিসে ধর্মেতিহাস সম্মেলনে স্বামীজীর সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল। |
বাবুরাম | প্রেমানন্দ দ্রষ্টব্য। |
বার্বার, মিসেস | একজন সমাজনেত্রী; ১৮৯৫ খ্রীঃ ইঁহার পৃষ্ঠপোষকতায় স্বামীজী কতকগুলি ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়াছিলেন। সেগুলি ‘বার্বার্স্ লেকচার’ নামে প্রসিদ্ধ। |
বালগঙ্গাধর তিলক | মহারাষ্ট্রদেশীয় বিখ্যাত মনীষী ও রাজনীতিক নেতা। একদা ট্রেনে স্বামীজীর সহিত সাক্ষাৎ হয়। তিনি স্বামীজীর প্রসঙ্গে স্মৃতিকথা লিখিয়াছেন। ভারতের জাতীয় মহাসমিতির (Indian Nationnal Congress) অধিবেশন উপলক্ষে যখন তিনি কলিকাতায় আসেন, তখন বেলুড় মঠে স্বামীজীর সহিত দেখা করিয়াছিলেন। |
বালাজী | ডি. আর. বালাজী রাও; ইনি পরে মান্দ্রাজ ইণ্ডিয়ান ব্যাঙ্কের সেক্রেটারী হইয়াছিলেন। |
বিজয় গোস্বামী | বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী; স্বামীজীর সমসাময়িক বাঙলাদেশের একজন ধর্মনেতা। শ্রীরামকৃষ্ণের অতি প্রিয়পাত্র। পূর্বে ব্রাহ্মসমাজের আচার্য ছিলেন। তাঁহার অনেক শিষ্য ও ভক্ত আছেন। |
বিজ্ঞানানন্দ, স্বামী (হরিপ্রসন্ন) | শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য; শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের চতুর্থ অধ্যক্ষ (১৯৩৭-৩৮)। প্রথম জীবনে ইনি ইঞ্জিনীয়র ছিলেন। ১৮৯৭ খ্রীঃ শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘে যোগদান করেন। স্বামীজীর আদেশে তাঁহারই পরিকল্পনা লইয়া তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ-মন্দিরের নকশা করিয়াছিলেন, তদনুযায়ী বেলুড় মঠে মন্দির নির্মিত হয়। মঠে স্বামীজীর মন্দির তাঁহার পরিকল্পনা অনুসারে নির্মিত হয়। |
বিনয়কৃষ্ণ, রাজা | কলিকাতা শোভাবাজার রাজপরিবারের রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব। আমেরিকা হইতে প্রত্যাবর্তন করিলে স্বামীজীকে কলিকাতায় যে সভায় অভিনন্দনপত্র দেওয়া হয় ( ফেব্রুআরী ১৮৯৭ খ্রীঃ), ইনি সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন। |
বিমলা | কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের জামাতা। |
বিমলানন্দ (খগেন) | স্বামীজীর শিষ্য। ১৮৯৯ খ্রীঃ ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকার পরিচালকরূপে স্বামীজী কর্তৃক মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে প্রেরিত হন। ১৯০৮ খ্রীঃ মায়াবতীতে তাঁহার দেহত্যাগ হয়। |
বিরজানন্দ (কালীকৃষ্ণ) | স্বামীজীর সেবক ও সন্ন্যাসী-শিষ্য। শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ষষ্ঠ অধ্যক্ষ (১৯৩৮- ৫১)। স্বামীজীর ইংরেজী জীবনী ও রচনাসংগ্রহের সম্পাদনা ও প্রকাশনায় তাঁহার অবদান অবিস্মরণীয়। |
বিলিগিরি | বিলিগিরি আয়েঙ্গার; আমেরিকা হইতে প্রত্যাবর্তনের পর স্বামীজী মান্দ্রাজে সমুদ্রতীরস্থ ‘ক্যাসল কার্নান বা আইস হাউস’ নামক বিলিগিরির প্রাসাদোপম গৃহে ছিলেন। পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের অধ্যক্ষতায় এখানে প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ (মান্দ্রাজ কেন্দ্র) স্থাপিত হয়। |
বিহিমিয়া চাঁদ | লিমডির (কাথিয়াওয়াড়) অধিবাসী। |
বীরচাঁদ গান্ধী | বোম্বাই-এর ব্যারিষ্টার বীরচাঁদ গান্ধী। ইনি জৈনধর্মের প্রতিনিধিরূপে চিকাগো ধর্মসম্মেলনে যোগদান করেন; সেইখানেই স্বামীজীর সঙ্গে তাঁহার পরিচয় হয়। |
বুল, মিসেস ওলি | স্বামীজীর শিষ্যা, নরওয়েবাসী বিখ্যাত বেহালাবাদক মিঃ ওলি বুলের স্ত্রী। তাঁহার নিজ নাম সারা (Sarah)। বহু পত্রে স্বামীজী তাঁহাকে ‘মা’ বা ‘ধীরামাতা’ বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন। বেলুড় মঠ স্থাপনের সময় তিনি স্বামীজীকে অর্থসাহায্য করিয়াছিলেন এবং অন্যভাবেও ভারতে ও পাশ্চাত্যে তাঁহার কাজে সহায়তা করেন। |
বেল, মিস লিভিয়া | সানফ্রান্সিস্কো ক্যালিফোর্নিয়া ষ্ট্রীটে হোম অব ট্রুথের নেত্রী ছিলেন। ওকল্যাণ্ড ইউনিটেরিয়ান চার্চে স্বামীজীর বক্তৃতা শুনিয়া প্রভাবান্বিত হন এবং ক্যাম্প আইর্ভিং-এর ব্যবস্থা ইঁহারই চেষ্টায় হয়। |
বেসান্ত, ডঃ মিসেস এনি | থিওসফিক্যাল সোসাইটির নেত্রী ও বক্তা; কাশী হিন্দু কলেজ ও স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রী। চিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামীজীর সহিত তাঁহার পরিচয় হয়। তাঁহার ভাষায় স্বামীজী একজন ‘যোদ্ধা সন্ন্যাসী’ (warrior monk)। ইংলণ্ডে তাঁহার বাসভবনে স্বামীজী ভক্তি সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন। পরে আলমোড়াতে দু-একবার উভয়ের সাক্ষাৎ হয়। |
বৈকুণ্ঠনাথ, সান্যাল | ‘স্বামী কৃপানন্দ’ নাম গ্রহণ করিয়া কিছুকাল পরিব্রাজকরূপে উত্তরাখণ্ডে ভ্রমণ করেন। স্বামীজী তাঁহাকে ‘সাণ্ডেল’ বলিতেন। |
বোয়া, জুল | জুল বোয়া দ্রষ্টব্য। |
ব্যারোজ, ডক্টর | চিকাগোর প্রেসবিটেরিয়ান চার্চের ধর্মযাজক রেভারেণ্ড জে, এইচ ব্যারোজ। চিকাগো ধর্মসম্মেলনের জেনারেল কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হইয়াছিলেন। |
ব্যাগলি, মিসেস | মিশিগানের গভর্ণর ব্যাগলির পত্নী। ১৮৯৩ খ্রীঃ চিকাগো বিশ্বমেলাতে (World's Fair) মিসেস ব্যাগলি একজন মহিলা-কর্মাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ডেলিগেটদের সম্বর্ধনাসভায় স্বামীজীর সঙ্গে তাঁহার পরিচয় হয় এবং ১৮৯৪ খ্রীঃ ফেব্রুআরী মাসে স্বামীজী ডেট্রয়েটে মিসেস ব্যাগলির গ্র্যাণ্ড সার্কাস পার্কের বাড়ীতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। মিসেস ব্যাগলি ডেট্রয়েটের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের কর্ণধারগণের উপস্থিতিতে স্বামীজীর জন্য এক সম্বর্ধনার আয়োজন করিয়াছিলেন। |
ব্রহ্মানন্দ, স্বামী (রাখাল) | শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্র ও সন্ন্যাসী-শিষ্য; শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘে ‘রাজা মহারাজা’ নামে পরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ (১৮৯৯-১৯২২); ইনিই স্বামীজীর পরিকল্পিত সঙ্ঘকে গড়িয়া তোলেন। |
ব্রীড, মিসেস | লীনের (আমেরিকা) একজন সমাজনেত্রী এবং ‘নর্থ শোর ক্লাবে’র একজন চার্টার সভ্যা। স্বামীজী তাঁহার বাড়ীতে এক সপ্তাহ অবস্থান করেন এবং উক্ত ক্লাব ও অক্সফোর্ড হলে জনসাধারণের সমক্ষে বক্তৃতা করেন। মিসেস ব্রীড হার্ভার্ডেও স্বামীজীর বক্তৃতার ব্যবস্থা করেন। |
ব্র্যাডলি, অধ্যাপক | ডঃ রাইটের বন্ধু অধ্যাপক ব্র্যাডলির সঙ্গে এভানষ্টনে স্বামীজীর বন্ধুত্ব হয়। ১৮৯৪ খ্রীঃ অগষ্টে এনিস্কোয়ামে মিসেস ব্যাগলির অতিথি থাকাকালে উভয়ের মধ্যে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হইয়াছিল। |
ব্লজেট, মিসেস এস কে | স্বামীজী ১৯০০ খ্রীঃ লস এঞ্জেলেসে এই বৃদ্ধার গৃহে প্রায় মাসাবধি কাল বাস করেন। ধর্মমহাসভায় এই বৃদ্ধা স্বামীজীর বক্তৃতা শুনিয়া তাঁহার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধান্বিতা হইয়াছিলেন। |
ভগবানদাস বাবাজী | কালনার বিশিষ্ট বৈষ্ণব সাধক ও সিদ্ধপুরুষ বলিয়া কথিত। |
ভট্টাচার্য | মান্দ্রাজের এসিষ্ট্যাণ্ট একাউণ্টেণ্ট-জেনারেল মন্মথনাথ ভট্টাচার্য। পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজী তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করেন। তিনি কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পণ্ডিত মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের পুত্র ও স্বামীজীর কলেজ-বন্ধু। |
ভট্টাচার্য, রঘুনাথ | হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। টিহিরী রাজ্যে স্বামীজী ১৮৯০ খ্রীঃ রঘুনাথবাবুর অতিথি হইয়াছিলেন। |
ভবনাথ | বরাহনগর-নিবাসী ভবনাথ চট্টোপাধ্যায়, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গৃহী ভক্ত। স্বামীজীর (নরেন্দ্রনাথের) বিশেষ বন্ধু। |
ভাটে সাহেব | পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজী বেলগাঁও-এ উপস্থিত হইয়া একজন বিশিষ্ট মারাঠী ভদ্রলোকের অতিথি হইয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র অধ্যাপক জি. এম. ভাটে তাঁহাদের অভিনব অতিথি সম্পর্কে এক সুদীর্ঘ স্মৃতিকথা লিখিয়াছেন। |
ভাস্কর সেতুপতি | রামনাদের রাজা ভাস্কর সেতুপতি, স্বামীজীর শিষ্য; তিনি স্বামীজীকে আমেরিকা প্রেরণের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন। স্বামীজী আমেরিকা হইতে ফিরিয়া ভারতের মাটিতে যেখানে প্রথম পদার্পণ করেন, সেখানে ইনি একটি ৪০ ফুট উচ্চ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। |
ভ্রূম্যান, ডাঃ | স্বামীজী বাল্টিমোরে রেভাঃ ওয়াল্টার ভ্রূম্যান এবং তাঁহার ভ্রাতৃবৃন্দের অতিথি ছিলেন। বাল্টিমোরে তাঁহার ভ্রাতাদের আয়োজনে স্বামীজী কয়েকটি বক্তৃতা দেন। ওয়াল্টার, হিরাম ও কার্ল এই তিন ভাই স্বামীজীর বক্তৃতার ব্যবস্থা করেন। |
মজুমদার | প্রতাপচন্দ্র মজুমদার দ্রষ্টব্য। |
মধুসূদন চট্টোপাধ্যায় | হায়দরাবাদের ষ্টেট ইঞ্জিনীয়র। তাঁহার অনুরোধে স্বামীজী মান্দ্রাজ হইতে হায়দরাবাদে গিয়াছিলেন এবং আমেরিকা যাইবার প্রাক্কালে একটি বক্তৃতাও দেন। |
মণি আয়ার | সুব্রহ্মণ্য আয়ার দ্রষ্টব্য। |
মণিভাই | বরোদা রাজ্যের দেওয়ান বাহাদুর মণিলাল নাড়ুভাই। হরিদাস বিহারীদাসের বন্ধু। স্বামীজী ইঁহার বাড়ীতে তিন সপ্তাহ অতিথি ছিলেন। |
মণিলাল দ্বিবেদী | উত্তর প্রদেশের এই ব্রাহ্মণ বৈদিক হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিরূপে চিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগদান করেন। |
মতি | সচ্চিদানন্দ দ্রষ্টব্য। |
মহিম (মহিন) | মহেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বামীজীর মধ্যম সহোদর। |
মহিম, মহিমাচরণ চক্রবর্তী | শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট যাতায়াত করিতেন। |
মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (M. N. Banerji) | ইনি দার্জিলিঙের সরকারী উকিল। স্বামীজী দার্জিলিঙে তাঁহার বাড়ীতে কিছুদিন বাস করেন। |
মাতাঠাকুরাণী | শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘজননী শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী। |
মাদার চার্চ | মিসেস হেল দ্রষ্টব্য। |
মার্গট, মার্গারেট, মার্গো, মার্গোরাইট | ভগিনী নিবেদিতা দ্রষ্টব্য। |
মাষ্টারমহাশয় | মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী-ভক্তদের অন্যতম। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ প্রণেতা। ‘কথামৃতে’ তিনি মাষ্টার, মণি, শ্রীম প্রভৃতি ছদ্মনামে পরিচিত। বিদ্যাসাগর স্কুলে শিক্ষকতা করিতেন এবং ছাত্রদের শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে লইয়া আসিতেন, তাই শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে ‘ছেলে-ধরা মাষ্টার’ বলিতেন। |
মিত্র, ডাক্তার | আশুতোষ মিত্র, কাশ্মীরের বিশিষ্ট রাজকর্মচারী ছিলেন। |
মূলার, মিস হেনরিয়েটা | স্বামীজীর ভক্ত ইংরেজ মহিলা। ১৮৯৬ খ্রীঃ স্বামীজী কিছুদিন তাঁহার অতিথি ছিলেন। বেলুড়ে মঠস্থাপনকার্যেও তিনি অর্থসাহায্য করিয়াছিলেন। |
মৃণালিনী বসু | স্বামীজীর শিষ্যা, দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়া; নিবাস বড় জাগুলিয়া। |
ম্যাককিণ্ডলি , মিস (ইসাবেল) | মিস হেল-দের সম্পর্কিত ভগিনী। অন্য ভগিনীর নাম হ্যারিয়েট। |
ম্যাকলাউড , মিস, জোসেফাইন | স্বামীজীর পাশ্চাত্য-দেশীয় প্রধান অনুরাগী ভক্তদিগের অন্যতমা। তিনি স্বামীজীকে তাঁহার কার্যে সর্বদা সহায়তা করিতেন। তাঁহার জীবন স্বামীজীর ভাবে অনুপ্রাণিত ছিল। স্বামীজী তাঁহাকে ‘জো’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। মিস ম্যাকলাউড বেলুড় মঠে আসিয়া অনেকবার অতিথিরূপে বাস করিয়াছেন। ১৯৪৯ খ্রীঃ আমেরিকায় হলিউড শহরে তাঁহার দেহত্যাগ হয়। |
ম্যাক্সমূলার, এফ | অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যদর্শন ও সংস্কৃতভাষাবিৎ প্রসিদ্ধ জার্মান অধ্যাপক। তিনি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অর্থসাহায্যে ঋগ্বেদ প্রকাশ করেন। এতদ্ব্যতীত Sacred Books of the East (পঞ্চাশ খণ্ডে সম্পূর্ণ) গ্রন্থমালার তিনি সম্পাদনা করিয়াছিলেন। তাঁহার রচিত Ramakrishna: His Life and Sayings ১৮৯৮ খ্রীঃ প্রকাশিত হয়। |
ম্যাক্সিম, হিরাম | স্বামীজীর বন্ধু। স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের কারখানার মালিক। |
যজ্ঞেশ্বরবাবু | মীরাটে যজ্ঞেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের অতিথিরূপে স্বামীজী প্রমুখ গুরুভ্রাতাগণ কিছুকাল কাটান। পরে ইনি ‘জ্ঞানানন্দ’ নাম লইয়া (ভারতধর্ম মহামণ্ডলে) সন্ন্যাসী হন। |
যোগানন্দ, স্বামী (যোগেন, যোগীন্দ্রনাথ) | শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী-শিষ্য। তাঁহার প্রধান কাজ ছিল শ্রীশ্রীমায়ের সেবা। ১৮৯৫ খ্রীঃ কলিকাতা টাউন হলে স্বামীজীর সমর্থনে অনুষ্ঠিত সভার তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। |
যোগীন-মা | যোগীন্দ্রমোহিনী বিশ্বাস, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিষ্যা, শ্রীশ্রীমায়ের অন্তরঙ্গ সেবিকা। |
রঘুনাথ ভট্টাচার্য | টিহিরী রাজ্যের দেওয়ান, পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অগ্রজ। |
রঙ্গাচার্য, অধ্যাপক | আলাসিঙ্গা পেরুমলের ভগিনীপতী, ত্রিবান্দ্রম কলেজের রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন; দক্ষিণ ভারতে বৈজ্ঞানিক ও পণ্ডিত হিসাবে তাঁহার বিশেষ খ্যাতি ছিল। |
রবি বর্মা | কেরলদেশীয় চিত্রশিল্পী, পাশ্চাত্য শিল্পরীতি অনুকরণ করিয়া সুখ্যাতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করেন। স্বামীজীর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থে রবি-বর্মা প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য। |
রমা বাঈ | মহারাষ্ট্রদেশীয় বিদুষী হিন্দু বিধবা; খ্রীষ্টানধর্ম গ্রহণ করেন; স্বামীজীর আমেরিকা-গমনের কিছু পূর্বে তিনি সে দেশে ভারতীয় বালবিধবাদের জন্য অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্যে নানাস্থানে সমিতি গঠন করেন; এবং ভারতীয় নারীদের দুর্দশার কথা অতিরঞ্জিত করিয়া বর্ণনা করেন। স্বামীজী ‘ব্রুকলিন রমাবাঈ সার্ক্ল্'-এর মহিলাদের নিকট ‘ভারত ও ভারতীয় নারীদের যথার্থ অবস্থা’ বিবৃত করেন। |
রাইট, জন হেনরী | ডক্টর রাইট ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীক ভাষার অধ্যাপক। স্বামীজীর সহিত আলাপ হইবার পর তাঁহার গভীর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হইয়া চিকাগো ধর্মমহাসম্মেলনে যোগদানের জন্য স্বামীজীকে প্রদত্ত পরিচয়পত্রে লিখিয়াছিলেন, ‘ইনি এমন একজন মানুষ, যাঁহার পাণ্ডিত্যকেও হার মানায়।’ স্বামীজী কয়েকবার তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। |
রাখাল (রাজা) | ব্রহ্মানন্দ দ্রষ্টব্য। |
রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ডাক্তার | প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক, কলিকাতা এসিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। |
রাম | রামকৃষ্ণ বসু, বলরাম বসুর পুত্র। |
রামকৃষ্ণানন্দ, স্বামী (শশী) | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী-শিষ্য। কাশীপুরে গুরুসেবায় আত্মনিয়োগ করেন; শ্রীরামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের পর শ্রীরামকৃষ্ণ-পূজায় তাঁহার নিষ্ঠা অতুলনীয়। স্বামীজীর আদেশে মান্দ্রাজে যাইয়া দাক্ষিণাত্যে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের অন্যতম বৃহৎ কেন্দ্রের সূত্রপাত করেন। |
রামদয়াল, রামদয়ালবাবু | আঁটপুর-নিবাসী রামদয়াল চক্রবর্তী, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্ত; বলরাম বসুর পুরোহিতবংশীয়; কলিকাতা হোর মিলার কোম্পানীতে কাজ করিতেন। |
রামবাবু | রামচন্দ্র দত্ত; শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অন্যতম প্রধান গৃহী-ভক্ত; কাঁকুড়গাছি ‘যোগোদ্যান’-এর প্রতিষ্ঠাতা। |
রামলাল | রামলাল চট্টোপাধ্যায়; শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভ্রাতুষ্পুত্র। |
লগান, ডাক্তার | স্বামীজীর শিষ্য, সানফ্রান্সিস্কো বেদান্ত সোসাইটির সভাপতি। |
লাটু | অদ্ভুতানন্দ দ্রষ্টব্য। |
লালাজী | বদ্রী শা দ্রষ্টব্য। |
লালা হংসরাজ | আর্যসমাজভুক্ত লালা হংসরাজ সাহানী, লাহোরের একটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ধর্মবিষয়ে স্বামীজীর সহিত তাঁহাদের অনেক আলোচনা হইয়াছিল। |
লুই, মিস মেরী | ফরাসী মহিলা, স্বামীজীর শিষ্যা; ‘থাউজ্যাণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে’ স্বামীজী তাঁহাকে সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত করিয়া নাম দেন ‘স্বামী অভয়ানন্দ’। |
লেগেট, মিঃ | ফ্রান্সিস এইচ. লেগেট, নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং নানাভাবে তাঁহার সহায়তা করেন। কখনও কখনও স্বামীজী আদর করিয়া মিঃ লেগেটকে ‘ফ্র্যাঙ্কিন্সেন্স’ নামে ডাকিতেন। |
লেগেট, মিসেস | মিস ম্যাকলাউডের বিধবা ভগিনী মিসেস স্টার্জিস, মিঃ লেগেটের সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। এই দম্পতিকে স্বামীজী বিশেষভাবে আশীর্বাদ করিয়াছিলেন। তাঁহারাও সর্বতোভাবে স্বামীজীকে সাহায্য করিতেন। প্রথম বিবাহের পুত্র হলিস্টার ও কন্যা এলবার্ট। |
লেভিঞ্জ সাহেব | মুর্শিদাবাদের তদানীন্তন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ই. ভি. লেভিঞ্জ স্বামী অখণ্ডানন্দকে দুর্ভিক্ষ সেবাকার্যে ও অনাথ আশ্রম-স্থাপনে যথেষ্ট সাহায্য করেন। এই ব্যাপারে স্বামীজীর সহিত তাঁহার পত্রালাপ হয়। |
ল্যাণ্ডসবার্গ | হের লিয়ন ল্যাণ্ডসবার্গ ছিলেন আমেরিকান নাগরিক, জন্মগতভাবে রাশিয়ান য়াহুদী। ল্যাণ্ডসবার্গ স্বামীজীর প্রচারকার্যে সাহায্য করিয়াছিলেন, তবে কিছুদিনের জন্য স্বামীজীকে ছাড়িয়া চলিয়া যান। পরে ‘থাউজ্যাণ্ড আইল্যাণ্ড পার্কে’ আবার আসেন এবং সেখানে স্বামীজী তাঁহাকে সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষা দিয়া নাম দেন ‘স্বামী কৃপানন্দ’। |
শঙ্কর পাণ্ডুরঙ্গ | পোরবন্দরের বেদজ্ঞ পণ্ডিত। লিমডির রাজপ্রাসাদে অবস্থানকালে স্বামীজী তাঁহার নিকট বেদান্তের ব্যাসসূত্র অধ্যয়ন করেন। |
শঙ্করলাল, পণ্ডিত | স্বামীজীর খেতড়ি-নিবাসী ভক্ত। স্বামীজী তাঁহাকে ‘পণ্ডিতজী মহারাজ’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। |
শরৎ | সারদানন্দ দ্রষ্টব্য। |
শরৎচন্দ্র গুপ্ত | সদানন্দ দ্রষ্টব্য। |
শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী | স্বামীজীর গৃহী-শিষ্য; ‘স্বামী-শিষ্য-স়ংবাদ’, ‘সাধু নাগ মহাশয়’ প্রভৃতি গ্রন্থের লেখক। পূর্ববঙ্গের অধিবাসী বলিয়া স্বামীজী কখনও কখনও তাঁহাকে সস্নেহে ‘বাঙ্গাল’ বলিয়া ডাকিতেন। |
শশী | রামকৃষ্ণানন্দ দ্রষ্টব্য। |
শশী ডাক্তার | কলিকাতা বাগবাজার-নিবাসী ডাক্তার শশিভূষণ ঘোষ। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন, এবং পরে তাঁহার একখানি বাঙলা জীবনী লেখেন। তিনি বলরাম মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন সভার ‘আণ্ডার সেক্রেটারী’ ছিলেন। |
শশী, সান্ন্যাল | কাশীনিবাসী জনৈক ব্রাহ্মণ; তাঁহার অনেক শিষ্য ছিল। |
শার্মান, মিসেস ফ্লোরেন্স | ডেট্রয়েটের মিসেস ব্যাগলির বিবাহিতা কন্যা। |
শাঁকচুন্নী | অক্ষয়কুমার সেন দ্রষ্টব্য। |
শিবানন্দ, স্বামী (তারক, তারকদা) | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী-শিষ্য; শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ (১৯২২-৩৪)। স্বামীজী তাঁহাকে ‘মহাপুরুষ’ বলিতেন, সেইজন্য মঠে তিনি ‘মহাপুরুষ মহারাজ’ নামে পরিচিত। |
শিবনাথ শাস্ত্রী | সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত তাঁহার কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়। |
শিবু | শিবরাম চট্টোপাধ্যায়; শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভ্রাতুষ্পুত্র। |
শুদ্ধানন্দ, স্বামী (সুধীর) | স্বামীজীর সন্ন্যাসী-শিষ্য; শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় সম্পাদক (১৯২৭-৩৪) এবং পঞ্চম অধ্যক্ষ (১৯৩৮)। স্বামীজীর বহু লেখা ও বক্তৃতা তিনি বঙ্গভাষায় অনুবাদ করেন। ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার সূচনা হইতেই তাঁহার পরিচালনায় তিনি স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের প্রধান সহকারী ছিলেন, পরে উদ্বোধনের সম্পাদক হন। স্বামীজীর রচিত ‘মঠের নিয়মাবলী’র তিনি ছিলেন লিপিকার। |
শ্রীম | মাষ্টার দ্রষ্টব্য। |
শ্রীশবাবু | এলাহাবাদ-নিবাসী শ্রীশচন্দ্র বসু। ইনি তাঁহার ভ্রাতা মেজর বি. ডি. বসুর সহিত এলাহাবাদে পাণিনি প্রেস স্থাপন করেন ও অনেক বহুমূল্য শাস্ত্রগ্রন্থ প্রকাশ করেন। |
সচ্চিদানন্দ (১), স্বামী | স্বামী সারদানন্দের শিষ্য; মঠে ‘বুড়ো বাবা’ বলিয়া পরিচিত। |
সচ্চিদানন্দ (২), স্বামী | পূর্বনাম মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়; স্বামীজীর সন্ন্যাসী-শিষ্য। ১৮৯৮ খ্রীঃ রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে যোগদান করেন। স্বামীজীর আদেশে আমেরিকায় কয়েক বৎসর বেদান্ত প্রচার করেন। |
সতীশচন্দ্র | ডন সোসাইটির বিখ্যাত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, স্বামীজীর বাল্যবন্ধু; হাইকোর্টে ওকালতি করেন এবং 'Dawn' পত্রিকা প্রকাশ করেন। আলমবাজার মঠের সহিত তাঁহার যোগাযোগ ছিল। |
সদানন্দ, স্বামী (গুপ্ত, শরৎচন্দ্র গুপ্ত) | স্বামীজীর সন্ন্যাসী-শিষ্য। হাতরাস রেল ষ্টেশনে সহকারী ষ্টেশন মাষ্টার ছিলেন। ১৮৮৮ খ্রীঃ পরিব্রাজক স্বামীজীকে দর্শন করার পর সর্বস্ব ত্যাগ করিয়া তিনি স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং কিছুকাল একসঙ্গে ভ্রমণান্তে বরাহনগর মঠে আসেন। ১৮৯৯ খ্রীঃ কলিকাতায় প্লেগ-মহামারীতে তাঁহার সেবাকার্য উল্লেখযোগ্য। ১৯১১ খ্রীঃ দেহত্যাগ করেন। |
(মঃ) সরফরাজ হোসেন | নৈনীতালের মুসলমান ভদ্রলোক, স্বামীজীর ভক্ত। |
সরলা ঘোষাল | পরে সরলাদেবী চৌধুরাণী নামে পরিচিতা হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগিনেয়ী। ‘জীবনের ঝারাপাতা’য় (আত্মচরিতে) স্বামীজীর কথা কিছু লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। |
সান্যাল (সাণ্ডেল) | বৈকুণ্ঠনাথ দ্রষ্টব্য। |
সারদা | ত্রিগুণাতীতানন্দ দ্রষ্টব্য। |
সারদানন্দ, স্বামী (শরৎ) | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী-শিষ্য; শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম সম্পাদক (১৮৯৯- ১৯২৭)। স্বামীজীর আদেশে ইংলণ্ড ও আমেরিকায় বেদান্ত প্রচার করেন। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’-রচনা তাঁহার অক্ষয় কীর্তি। স্বামী যোগানন্দের পর তিনি শ্রীশ্রীমায়ের সেবার ভার গ্রহণ করেন। |
সারা বার্নহার্ড | ফরাসীদেশীয়া বিখ্যাত অভিনেত্রী। ১৮৯৫ খ্রীঃ নিউ ইয়র্কে এবং ১৯০০ খ্রীঃ প্যারিসে স্বামীজীর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়, তিনি স্বামীজীকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিতেন। |
সারা সি. বুল | (মিসেস ওলি) বুল দ্রষ্টব্য। |
সুকুল | আত্মানন্দ দ্রষ্টব্য। |
সুধীর | শুদ্ধানন্দ দ্রষ্টব্য। |
সুবোধানন্দ, স্বামী | (খোকা, সুবোধ)—শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী-শিষ্য। তিনি অত্যন্ত সরল ছিলেন; মঠে তিনি ‘খোকা মহারাজ’ নামে পরিচিত। |
সুব্রহ্মণ্য আয়ার | মান্দ্রাজের প্রসিদ্ধ বিচারপতি স্যর সুব্রহ্মণ্য আয়ার। স্বামীজীর অনুগামী; মান্দ্রাজ অভিনন্দন-সভার সভাপতি ছিলেন। |
সুরেন | সুরেশ্বরানন্দ দ্রষ্টব্য। |
সুরেন্দ্র ঠাকুর | কবি রবীন্দ্রনাথের মধ্যম ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র। |
সুরেশবাবু | সুরেন্দ্রনাথ মিত্র; শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অন্যতম গৃহী-ভক্ত। ঠাকুর তাঁহাকে ‘সুরেশ’ বলিয়া বা ‘সুরেন্দর’ বলিয়া ডাকিতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কাশীপুরে অবস্থানকালে এবং পরে বরাহনগর মঠের ব্যয়নির্বাহে সাহায্য করিতেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের চারজন রসদদারের অন্যতম। |
সুরেশ দত্ত | শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গৃহী-ভক্ত। তিনি ‘পরমহংসদেবের উক্তি’ নামে একটি উপদেশ-পুস্তক প্রকাশ করেন। হাটখোলার প্রসিদ্ধ দত্তবংশের সন্তান, প্রথমে ব্রাহ্মসমাজভুক্ত ছিলেন। |
সুরেশ্বরানন্দ | স্বামীজীর সন্ন্যাসী-শিষ্য। ১৮৯৮ খ্রীঃ সন্ন্যাসদীক্ষা গ্রহণ করেন। স্বামী অখণ্ডানন্দ কর্তৃক মুর্শিদাবাদের মহুলাতে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য ১৮৯৭ খ্রীঃ যে সেবাকার্য হয়, সেখানে স্বামীজীর নির্দেশে তিনি সহকারিরূপে প্রেরিত হইয়াছিলেন। |
সুশীল | প্রকাশানন্দ দ্রষ্টব্য। |
সেভিয়ার, মিঃ (ক্যাপ্টেন জে. এইচ.) ও মিসেস | স্বামীজীর বিখ্যাত ইংরেজ শিষ্য ও শিষ্যা; বেদান্তপ্রচারকার্যে তাঁহাদের জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন এবং স্বামীজীর ইচ্ছানুসারে ‘মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ১৯০০ খ্রীঃ মায়াবতীতে দেহত্যাগ করেন। মিসেস সেভিয়ার বহু বৎসর মায়াবতীতে এবং শ্যামলাতালে বাস করিয়া পরে ১৯৩১ খ্রীঃ ইংলণ্ডে দেহত্যাগ করেন। রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘে তিনি ‘মাদার’ (Mother) বলিয়া পরিচিতা। |
সোরাবাজী , মিস | মিস জিনি সোরাবজী নাম্নী পার্শী মহিলা পুণা হইতে পার্শী ধর্মের প্রতিনিধিরূপে চিকাগো সম্মেলনে যোগদান করেন। |
স্টার্ডি, মিঃ ই. টি. | একজন ইংরেজ ভক্ত; প্রথম জীবনে ভারতবর্ষে ছিলেন এবং আলমোড়ায় তপস্যা করেন। ইংলণ্ডে বেদান্ত-প্রচারকার্যে তিনি স্বামীজীকে সাহায্য করেন। |
স্মিথ, মিসেস | স্বামীজী ১৮৯৪ খ্রীঃ ২৪ এপ্রিল Woldorf Hotel-এ মিসেস আর্থার স্মিথের আলোচনা-চক্রে ‘ভারতবর্ষ ও হিন্দুধর্ম’ প্রসঙ্গে বক্তৃতা দেন। ঐ বক্তৃতাকালেই মিঃ ও মিসেস গার্নসির সঙ্গে স্বামীজীর বন্ধুত্ব হয়। মিস ফিলিপস্ ও মিসেস এমা থার্সবির সঙ্গে মিসেস আর্থার স্মিথও পরে নিউ ইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটির সভ্য হন। |
স্যানবর্ন, (মিস) কেট | এই বর্ষীয়সী বাগ্মী লেখিকা আমেরিকায় স্বামীজীর সাহায্যার্থে প্রথম অগ্রণী হন। বোষ্টনের পথে ট্রেনে প্রথম পরিচয়ের পর তিনি স্বামীজীকে ম্যাসাচুসেটস্-এ তাঁহার ‘ব্রীজি মেডোজ’ নামক ফার্মে (গোলাবাড়ীতে) লইয়া যান। |
স্যানবর্ন, মিঃ ফ্রাঙ্কলিন বেঞ্জামিন | মিসেস কেট স্যানবর্নের সম্পর্কিত ভ্রাতা, ইনি ‘হিন্দু সন্ন্যাসী’র বিরুদ্ধে প্রথমে সন্দেহ পোষণ করিয়াছিলেন। পরে ব্রীজি মেডোজ-এ স্বামীজীর সহিত সাক্ষাতের পরই তাঁহার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়। নিউ ইয়র্কের সারাটোগা স্প্রিং-এ আমেরিকান সোশ্যাল সায়ান্স এসোসিয়েশনের এক সম্মিলনীতে বক্তৃতা দিবার জন্য তিনি স্বামীজীকে আমন্ত্রণ করেন। |
স্বরূপানন্দ, স্বামী (অজয়হরি) | স্বামীজীর সন্ন্যাসী-শিষ্য। বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের ভাড়াটিয়া মঠবাড়ীতে সন্ন্যাস-দীক্ষা (১৮৯৮ খ্রীঃ) গ্রহণ করেন। পূর্বাশ্রমে বহু সদনুষ্ঠানের সহিত যুক্ত ছিলেন ও সুবিখ্যাত 'Dawn' পত্রিকার সতীশ মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমের তিনি প্রথম অধ্যক্ষ এবং ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকার দ্বিতীয় সম্পাদক। স্বামীজীর ইংরেজী গ্রন্থাবলী সংগ্রহে এবং তাহার কিয়দংশের মুদ্রণে তাঁহার অক্লান্ত শ্রম চিরস্মরণীয়। ১৯০৬ খ্রীঃ ২৭ জুন নৈনীতালে তাঁহার দেহত্যাগ হয়। |
হরমোহন | হরমোহন মিত্র; শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্ত এবং স্বামীজীর বন্ধু। ইনি স্বামীজীর কয়েকখানি বই ভারতে সর্বপ্রথম প্রকাশ করেন। |
হরি | তুরীয়ানন্দ দ্রষ্টব্য। |
হরিদাস বিহারীদাস দেশাই | জুনাগড়ের দেওয়ান; স্বামীজী তাঁহাকে ‘দেওয়ানজী সাহেব’ এবং কখনও কখনও ‘হরিদাস ভাই’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। তাঁহার সাহায্যে ভারতের বহু রাজার সহিত স্বামীজীর পরিচয় হয়। |
হরিদাসী, ভগিনী | ওয়াল্ডো দ্রষ্টব্য। |
হরিপদ মিত্র | বেলগাঁয়ের ফরেষ্ট অফিসার, স্বামীজীর শিষ্য; পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজী কয়েকদিনের জন্য তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার ভৈটা গ্রামে। স্বামীজীর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎকার ও কথোপকথন ‘স্বামীজীর কথা’য় দ্রষ্টব্য। |
হরিপ্রসন্ন (হরিপদ ব্রহ্মচারী) | বিজ্ঞানানন্দ দ্রষ্টব্য। |
হরি সিং | ঠাকুর হরি সিং লাডকানি। তিনি একসময়ে জয়পুর রাজ্যের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। তিনি স্বামীজীর ভক্ত ছিলেন। পরিব্রাজক অবস্থায় ভ্রমণকালে স্বামীজী কিছুদিন তাঁহার আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। |
হরিশ | হরিশচন্দ্র মুস্তফী, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্ত। |
হাউ, মিসেস | Battle Hymn of the Republic গ্রন্থের লেখিকা বিখ্যাত জুলিয়া ওয়ার্ড হাউ। মিসেস হাউ- এর 'Women's Club'-এ স্বামীজী ১৮৯৪ খ্রীঃ ১৭ মে বক্তৃতা দিয়াছিলেন। |
হলিস্টার | মিসেস বেটি স্টার্জিসের পুত্র। এলবার্টার ভ্রাতা। |
হাউইস, মিঃ | চিকাগো মেলাতে অ্যাংলিক্যান চার্চের অন্যতম নেতা মিঃ ক্যানন হাউইস-এর সঙ্গে স্বামীজী পরিচিত হন। তিনি স্বামীজীর বক্তৃতা শুনিয়া মুগ্ধ হন। The Dead Pulpit নামক প্রবন্ধে তিনি Vivekanandaism-প্রসঙ্গ আলোচনা করিয়াছেন। |
হিউম, রেভাঃ | ভারতেই জন্মগ্রহণ করেন এবং ভারতের খ্রীষ্টান মিশনের ডিরেক্টার ছিলেন। স্বামীজী ১৮৯৪ খ্রীঃ ১১ মার্চ ডেট্রয়েটের অপেরা হাউসে ভারতের খ্রীষ্টান মিশনরীদের কার্যকলাপের সমালোচনা করিয়া একটি বক্তৃতা দেন। রেভাঃ হিউম তাহার প্রতিবাদ করিয়া স্বামীজীকে কয়েকটি পত্র লেখেন এবং একটি আন্দোলন সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। |
হিগিন্স্, মিঃ চার্লস্ | ব্রুকলিন এথিক্যাল এসোসিয়েশনের একজন কর্মচারী। ১৮৯৪ খ্রীঃ নভেম্বরে তিনি স্বামীজীর সম্বন্ধে একটি দশ পৃষ্ঠার পুস্তিকা ছাপাইয়া প্রাচ্যধর্ম-অধ্যয়নে উৎসাহীদের মধ্যে বিতরণ করেন। মিঃ হিগিন্স্ নিজের বাড়ীতে স্বামীজীকে আমন্ত্রণ করেন। আমেরিকান ও ভারতীয় উভয় দেশের সংবাদপত্রগুলি হইতে স্বামীজী সম্বন্ধে তথ্য অবলম্বনে পুস্তিকাটি লিখিত। |
হিগিন্সন, কর্ণেল ওয়েণ্টওয়ার্থ | ধর্মমহাসভার প্রতিনিধি এবং সেই যুগের একজন উদারমতাবলম্বী লেখক। ১৮৯৪ খ্রীঃ অগষ্ট প্লীমাথে অনুষ্ঠিত ফ্রি রিলিজিয়স এসোসিয়েশনের সভায় বক্তৃতার জন্য স্বামীজীকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। |
হুটকো (হুটকো গোপাল) | গোপালচন্দ্র ঘোষ, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্ত। মাঝে মাঝে হঠাৎ আসিতেন বলিয়া ঐ নাম হইয়াছিল। |
হেল, মিঃ ও মিসেস | তাঁহারা উভয়েই স্বামীজীকে বিশেষ ভালবাসিতেন। চিকাগো ধর্মমহাসভা আরম্ভ হইবার পূর্বদিন স্বামীজী যখন দেখিলেন, এই অপরিচিত দেশে তিনি নিতান্তই অসহায়, ঠিক সেই সময় মিসেস হেলের সঙ্গে ঘটনাচক্রে তাঁহার দেখা হয়। তিনি বিশেষ যত্নসহকারে স্বামীজীকে তাঁহার বাড়ীতে আসিতে বলেন এবং ধর্মমহাসভায় যাহাতে স্বামীজী হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিরূপে গৃহীত হইতে পারেন, তাহার ব্যবস্থা করিয়া দেন। স্বামীজী মিসেস হেলকে ‘মা’ এবং তাঁহার কন্যাদের ‘ভগিনী’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন; কখনও কখনও মিসেস হেলকে ‘মাদার চার্চ’ এবং মিঃ হেলকে ‘ফাদার পোপ’ বলিতেন। হেল-পরিবারের সকলের সহিত তাঁহার বিশেষ অন্তরঙ্গতা হইয়াছিল। প্রথম দিকে এই বাড়ীই ছিল স্বামীজীর আমেরিকার ঠিকানা। স্যাম ইঁহাদের একমাত্র পুত্র। |
হেলবয়স্টার (Marie Halboister) | ফরাসী ক্যানেডিয়ান মহিলা। ইওরোপে স্বামীজীর সহিত সাক্ষাৎ হয়। স্বামীজীর নিকট যোগ ও বেদান্তের শিক্ষা লাভ করেন। রাজযোগ গ্রন্থের ফরাসী অনুবাদ আরম্ভ করিয়াছিলেন। |
হেল, মিস মেরী | হেল পরিবারের কন্যা। স্বামীজী তাঁহাকে ভগিনীর মত স্নেহ করিতেন। |
হেল, মিস , হ্যারিয়েট | ঐ |
হেলেন, মিস | স্বামীজীর লস্ এঞ্জেলেস-নিবাসিনী শিষ্যা; ভগিনী ললিতার (ওয়াইকফ্) ভগিনী। |
হ্যানস্বরো, এলিস (মিসেস হ্যানস্বরো, হ্যানস্বার্গ) | স্বামীজীর লস্ এঞ্জেলেস-নিবাসিনী শিষ্যা; ভগিনী ললিতার আর এক ভগিনী। ক্যালিফোর্নিয়া ভ্রমণকালে তিনি কিছুকাল স্বামীজীর সেক্রেটারী-রূপে কাজ করিয়াছিলেন। |
হ্যাম্লিন, মিস | স্বামীজীর ভক্ত; নিউ ইয়র্কে ক্লাস চালাইবার কাজে স্বামীজীকে বিশেষ সাহায্য করিয়াছিলেন। |
হ্যামণ্ড, মিঃ ও মিসেস | ইংলণ্ডের মিঃ এরিক হ্যামণ্ড ও তাঁহার পত্নী উভয়েই স্বামীজীর অনুগত ভক্ত ছিলেন। মিঃ হ্যামণ্ড স্বামীজীর সম্বন্ধে কবিতা, স্মৃতিকথা প্রভৃতি লিখিয়াছিলেন, সেগুলি ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। |
হ্যারি | সেভিয়ার দ্রষ্টব্য। |
১ | সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার কখনও জয় হয় না; সত্যবলেই দেবযানমার্গে গতি হয়। |
২ | পুত্রের যতদিন না বিবাহ হয় ততদিনই সে পুত্র, কিন্তু কন্যা চিরদিনই কন্যা থাকে। |
৩ | ভূতোপাসনা—গোঁড়া খ্রীষ্টানরা হিন্দু প্রভৃতি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীকে ‘ভূতোপাসক’ বলিয়া ঘৃণ্য করিয়া থাকে। |
৪ | বাহ্যচিহ্ণ ধর্মের কারণ নহে, সর্বভূতে সমভাব—ইহাই মুক্ত পুরুষের লক্ষণ। [বলো]—অস্তি অস্তি (তিনি আছেন, তিনি আছেন); আমিই সেই, আমি চিদানন্দস্বরূপ শিব। সিংহ যেমন পিঞ্জর হইতে বহির্গত হয়, সেইরূপ তিনি জগজ্জাল হইতে বহির্গত হন। |
৫ | বলহীন ব্যক্তি এই আত্মাকে লাভ করিতে পারে না। |
৬ | পর্বতগাত্রস্খলিত বিপুল তুষারস্তূপ। |
৭ | সমুদয় অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সমুদয় শুভ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। |
৮ | সকলকে জোর করে আমাদের গুরুর ওপর বিশ্বাস করতে বলো না। |
৯ | স্বামী সদানন্দ। |
১০ | নিজের উপর বিশ্বাস রাখ, সমুদয় শক্তি তোমার ভিতরে—এইটি জান এবং ঐ শক্তিকে অভিব্যক্ত কর। |
১১ | হে সখে, কেন কাঁদিতেছ? তোমাতেই তো সব শক্তি রহিয়াছে। হে ভগবন্, তোমার ঐশ্বর্যশালী স্বরূপ জাগ্রত কর। এই ত্রিভুবন সমস্তই তোমার পাদমূলে। জড়ের কোন ক্ষমতা নাই—আত্মার শক্তিই প্রবল। |
১২ | তারকা চর্বণ করিব, ত্রিভুবন বলপূর্বক উৎপাটন করিব, আমাদের কি জান না? আমরা রামকৃষ্ণদাস। |
১৩ | দেহকেই যাহারা আত্মা বলিয়া জানে, তাহারা কাতর হইয়া সকরুণভাবে বলে—আমরা ক্ষীণ ও দীন; ইহাই নাস্তিক্য। আমরা যখন অভয়পদে অবস্থিত, তখন আমরা ভয়শূন্য এবং বীর হইব। ইহাই আস্তিক্য। আমরা রামকৃষ্ণদাস। সংসারে আসক্তিশূন্য হইয়া, সকল কলহের মূল স্বার্থসিদ্ধি ত্যাগ করিয়া পরমামৃত পান করিতে করিতে সর্বকল্যাণস্বরূপ শ্রীগুরুর চরণ ধ্যান করিয়া সমস্ত পৃথিবীকে প্রণাম করিয়া, তাহাদিগকে ঐ অমৃত পান করিতে আহ্বান করিতেছি। অনাদি অনন্ত বেদরূপ সমুদ্র মন্থন করিয়া যাহা পাওয়া গিয়াছে, ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বরাদি দেবতা যাহাতে শক্তি প্রদান করিয়াছেন, যাহা নারায়ণ অর্থাৎ ভগবানের অবতারগণের প্রাণসারের দ্বারা পূর্ণ, শ্রীরামকৃষ্ণ সেই অমৃতের পূর্ণপাত্রস্বরূপ দেহধারণ করিয়াছেন। |
১৪ | নাস্তিভাবদ্যোতক কিছু থাকিবে না, সবই অস্তিভাবদ্যোতক হওয়া চাই—যথাঃ আমি আছি, ঈশ্বর আছেন, আর সমুদয় আমার মধ্যে আছে। আমার যা কিছু প্রয়োজন—স্বাস্থ্য, পবিত্রতা, জ্ঞান সবই আমি আমার ভিতর অভিব্যক্ত করব। |
১৫ | তুমি বীর্যস্বরূপ, আমায় বীর্যবান্ কর; তুমি বলস্বরূপ, আমায় বলবান্ কর; তুমি ওজঃস্বরূপ, আমায় ওজস্বী কর, তুমি সহ্যশক্তি, আমায় সহনশীল কর। |
১৬ | স্বামী ব্রহ্মানন্দের। |
১৭ | গরম থাকিতে থাকিতে লোহার উপর ঘা মার অর্থাৎ যথাসময়ে সঙ্কল্প কার্যে পরিণত কর। |
১৮ | চিকাগোর ধর্মমহাসভায় ১৮৯৩ খ্রীঃ সেপ্টেম্বর মাসে স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য সভ্য জাতিসমূহের নিকট হিন্দুধর্মের গৌরব প্রতিষ্ঠিত করেন। ইহার প্রায় এক বৎসর পরে কলিকাতার সম্ভ্রান্ত জনসাধারণ টাউন হলে সভা করিয়া স্বামীজী ও আমেরিকাবাসিগণকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ঐ সভায় কতকগুলি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হইয়া আমেরিকায় প্রেরিত হয়। এই পত্রখানি তাহার উত্তরস্বরূপ উক্ত সভার সভাপতি রাজা প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায়কে স্বামীজী লিখিয়াছিলেন। |
১৯ | তোমাদের ন্যায় মহাত্মাগণের তাহার কথা উপেক্ষা করা উচিত। আমরা রামকৃষ্ণতনয়, তাঁহার হৃদয়ের রক্ত দিয়া তিনি আমাদিগকে পুষ্ট করিয়াছেন, আমরা সামান্য পোকার কামড়ে ভয় পাইব? ‘মন্দবুদ্ধি ব্যক্তিগণ মহাত্মাগণের অসাধারণ ও যাহার কোন কারণ সহজে নির্দেশ করিতে পারা যায় না, এইরূপ আচরণের নিন্দা করিয়া থাকে।’ (কুমারসম্ভব)—ইত্যাদি স্মরণ করিয়া এই মজুমদার নামক ব্যক্তিকে ক্ষমা করা উচিত। |
২০ | আমি অমূর্ত (বা অশরীরী) বাণী হইতে চাই। |
২১ | তাঁহার প্রভাববিস্তারের গতিতে বাধা দিবার বা সাহায্য করিবার আমি কে? হরমোহন প্রভৃতিই বা কে? তথাপি তাহাদের প্রতি আমাদের হৃদয় হইতে কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি। ‘যে অবস্থা লাভ হইলে লোক গুরুতর দুঃখেও বিচলিত হয় না’ (গীতা)—সেই অবস্থা এ ব্যক্তি এখনও লাভ করে নাই মনে করিয়া ইহার প্রতি সদয় দৃষ্টি দেওয়া উচিত। |
২২ | বোবাকে বাক্শক্তিসম্পন্ন ও খোঁড়াকে পর্বত লঙ্ঘন করিতে সমর্থ করে। |
২৩ | ঝঞ্ঝাসদৃশ হিন্দু। |
২৪ | সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার কখনও জয় হয় না; সত্যবলেই দেবযানমার্গ লাভ হয়—(মুণ্ডকোপনিষদ্)। বেদান্তমতে মৃত্যুর পর যে বিভিন্ন গতি হয়, তন্মধ্যে দেবযানের দ্বারা গতি শ্রেষ্ঠ গতি। অরণ্যে উপাসনা ও ভিক্ষাপরায়ণ নিষ্কাম সন্ন্যাসিগণেরই এই গতি হয়। |
২৫ | আমরা কেবল তাঁহার অনুসরণ করিব—প্রীতিই পরম সাধন। |
২৬ | আখেরে প্রেম জয়ী হইয়া থাকে। |
২৭ | প্রয়োজন হয়, তবে সেটি একটি ভাব—‘সর্বজনীনতা’ রক্ষার জন্য সমস্তই ছাড়িতে হইবে। |
২৮ | সকল ধর্মকে সত্য বলিয়া গ্রহণ, কেবল পরধর্মসহিষ্ণুতা নহে—ইহাই আমরা প্রচার করি এবং কার্যেও পরিণত করি। বিশেষ সাবধান, যেন অপরের ক্ষুদ্রতম অধিকারও পদদলিত করিও না। |
২৯ | আমাদের মত সকলেরই যে ঠাকুরের উপর সমান বিশ্বাস থাকিবে, এমন কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, কিন্তু আমরা জগতের সমুদয় অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সমগ্র শুভ শক্তি সমবেত করিতে চাই। |
৩০ | হিন্দুগণের ভিতর আমরাই সবচেয়ে অপদার্থ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, কাপুরুষ ও কামুক। |
৩১ | বর্তমান U.P. (উত্তর প্রদেশ)। |
৩২ | বলরাম বসুর পুত্র। |
৩৩ | এপিস্কোপ্যাল চার্চে শাসনভার বিশপগণের হস্তে ন্যস্ত থাকে। এঁদের অধীনে আর দুই শ্রেণীর যাজক থাকেন। |
৩৪ | প্রেসবিটেরিয়ান চার্চে শাসনভার সমানপদস্থ যাজকগণের হস্তে ন্যস্ত থাকে। |
৩৫ | শিবমহিম্নঃ স্তোত্রম্ ৩২। |
৩৬ | Dangerous heathen. |
৩৭ | তোমাদের পথ মঙ্গলময় হউক।—অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ |
৩৮ | ভাল কাজে অনেক বিঘ্ন হইয়া থাকে। |
৩৯ | ব্যাকুলভাবে বলি। |
৪০ | কল্যাণকারীর কখনও দুর্গতি হয় না।—গীতা |
৪১ | নীতিনিপুণগণ নিন্দাই করুক আর স্তুতিই করুন, লক্ষ্মী আসুন বা যেখানে ইচ্ছা যান, আজই মরণ হউক বা শত বৎসর পরেই হউক, ধীরব্যক্তিগণ ন্যায়পথ হইতে কখনও বিচলিত হন না।—ভর্তৃহরি। |
৪২ | হে বীর, স্বীয় পৌরুষ স্মরণ কর, হীনবুদ্ধি কামকাঞ্চনাসক্ত লোকদের উপেক্ষা করাই উচিত। |
৪৩ | এই পত্রখানির প্রথম দুই প্যারা ও চতুর্থ প্যারার শেষার্ধ ইংরেজীতে লিখিত। |
৪৪ | তাঁহার জীবন অনন্তশক্তিপূর্ণ একটি সন্ধানী আলো; ইহা ভারতের সমগ্র ধর্মভাবের উপর বিচ্ছুরিত হইয়াছে। তিনি বেদ ও বেদান্তের জীবন্ত ভাষ্যস্বরূপ ছিলেন এবং এক জীবনে ভারতের জাতীয় ধর্মজীবনের সমগ্র কল্পটি অতিবাহিত করিয়াছেন। |
৪৫ | ত্রিভুবনের হিত করিতে যিনি ভালবাসেন। |
৪৬ | টাকায় কিছু হয় না, নামযশে কিছু হয় না, বিদ্যায় কিছু হয় না, চরিত্রই বাধাবিঘ্নের বজ্রদৃঢ় প্রাচীর ভেদ করতে পারে। |
৪৭ | যজুর্বেদ সংহিতা। |
৪৮ | He who doeth the will of my Father etc.—N. T., Bible. |
৪৯ | কতকগুলি সাধু আছেন, যাঁহারা কায়মনোবাক্যে পুণ্যরূপ অমৃতে পূর্ণ হইয়া, নানাপ্রকার উপকার করিয়া, ত্রিভুবনকে প্রীত করিয়া পরের গুণ পরমাণুতুল্য অল্প হইলেও উহাকে পাহাড়ের মত বাড়াইয়া নিজ হৃদয়ের বিকাশ সাধন করেন। |
৫০ | যে-কোন কাজ জীবের ব্রহ্মভাব পরিস্ফুট করবার সহায়তা করে, তাই ভাল। যে-কোন কাজ তার বাধা হয়, তাই মন্দ। আমাদের ব্রহ্মভাব পরিস্ফুট করবার একমাত্র উপায়—অপরকে ঐ বিষয়ে সাহায্য করা। প্রকৃতিতে বৈষম্য থাকলেও সকলের সমান সুবিধা থাকা উচিত। কিন্তু যদি কাকেও অধিক, কাকেও কম সুবিধা দিতেই হয়, তবে বলবান্ অপেক্ষা দুর্বলকে অধিক সুবিধা দিতে হবে। |
৫১ | দরিদ্র, পদদলিত, অজ্ঞ—ইহারাই তোমার ঈশ্বর হউক। |
৫২ | সর্বপ্রকার বিস্তারই জীবন, সর্বপ্রকার সঙ্কীর্ণতাই মৃত্যু। যেখানে প্রেম, সেখানেই বিস্তার; যেখানে স্বার্থপরতা, সেখানেই সঙ্কোচ। অতএব প্রেমই জীবনের একমাত্র বিধান। যিনি প্রেমিক, তিনিই জীবিত, যিনি স্বার্থপর, তিনি মরণোন্মুখ। অতএব ভালবাসার জন্য ভালবাস, কারণ প্রেমই জীবনের একমাত্র নীতি, বাঁচিয়া থাকার জন্য যেমন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস। |
৫৩ | সমগ্র হিন্দুজাতি যুগ যুগ ধরিয়া যে চিন্তা করিয়া আসিয়াছে, তিনি এক জীবনেই সেই সমুদয় ভাব উপলব্ধি করিয়াছেন। তাঁহার জীবন সকল জাতির শাস্ত্রসমূহের জীবন্ত ভাষ্য। |
৫৪ | চণ্ডালঃ কিময়ং দ্বিজাতিরথবা শূদ্রোঽয়ং কিং তাপসঃ কিম্বা তত্ত্ববিবেকপেশলমতির্যোগীশ্বরঃ কোঽপি কিম্। ইত্যুৎপন্নবিকল্পজল্পমুখরৈঃ সম্ভাষ্যমাণা জনৈ- র্ন ক্রুদ্ধাঃ পথি নৈব তুষ্টমনসো যান্তি স্বয়ং যোগীনঃ॥—বৈরাগ্যশতকম্, ৯৬ |
৫৫ | ভোগে রোগভয়ং কুলে চ্যুতিভয়ংবিত্তে নৃপালাদ্ভয়ং
মানে দৈন্যভয়ং বলে রিপুভয়ং রূপে জরায়া ভয়ম্। শাস্ত্রে বাদিভয়ং গুণে খলভয়ং কায়ে কৃতান্তাদ্ভয়ং সর্বং বস্তু ভয়াম্বিতং ভুবি নৃণাং বৈরাগ্যমেবাভয়ম্॥—বৈরাগ্যশতকম্ |
৫৬ | স্বামীজী হেল ভগিনীগণকে তাদের ‘ক্রিশ্চান সায়ান্স’ পাঠ ও অভ্যাস নিয়ে মৃদু কটাক্ষ করে মজা করতেন; ক্রিশ্চান সায়েণ্টিষ্টরা রোগকে আদপেই স্বীকার না করার অভ্যাসই করে থাকে। |
৫৭ | এই মহোৎসব যে শুধু তাঁর স্মারকই হবে তা নয়, কিন্তু তাঁর ধর্মমতসমূহের বহুল প্রচারের এক মূল কেন্দ্রস্বরূপ হবে। |
৫৮ | একটা শিকারী কুকুর শিকারের সামনে ছাড়া না পেলে যেমন করে, তেমনি ছটফট করি। |
৫৯ | Boston Evening Transcript. |
৬০ | 'He seeth the sparrow's fall'.—N. T. Bible. |
৬১ | রাজপুতানার অন্তর্গত খেতড়ির মহারাজার ৪ মার্চ, ১৮৯৫ তারিখে লিখিত অভিনন্দনপত্রের উত্তর। |
৬২ | এতদ্দেশপ্রসূতস্য সকাশাদগ্রজন্মনঃ। স্বং স্বং চরিত্রং শিক্ষেরণ্ পৃথিব্যাং সর্বমানবাঃ।—মনু —এই আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণের নিকট পৃথিবীর সকলে শিক্ষা করিবে। |
৬৩ | গীতা, ৫।১৯ |
৬৪ | শ্বেতাশ্বতর উপ., ৪।৩ |
৬৫ | গীতা, ১৩।২৯ |
৬৬ | আমার ভক্তদের যে ভক্ত, সেই আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত। |
৬৭ | শ্রীরামকৃষ্ণের। |
৬৮ | স্বামীজী তাঁহার মার্কিন ভক্ত মিস জোসেফাইন ম্যাকলাউডকে এই নামে ডাকিতেন। |
৬৯ | দুর্বল ব্যক্তি এই আত্মাকে লাভ করিতে পারে না। |
৭০ | যদি বল ব্রহ্ম আত্মা আছেন তো অস্তিই হইবে, আর যদি বল ব্রহ্ম আত্মা নাই তো নাস্তিই হইয়া যাইবে। |
৭১ | পিঞ্জর হইতে সিংহের ন্যায় জগজ্জাল ভেদ করিয়া নির্গত হইয়া যায়। |
৭২ | তিনি ভারতের সমগ্র অতীত চিন্তার মূর্ত বিগ্রহস্বরূপ। প্রাচীন শাস্ত্রসমূহের প্রকৃত তাৎপর্য, তাহারা কি প্রণালীতে—কি উদ্দেশ্যে রচিত, তাহা আমি কেবল তাঁহার জীবন হইতেই বুঝিতে পারিয়াছি। |
৭৩ | সহস্রদ্বীপোদ্যানে প্রদত্ত স্বামীজীর উপদেশগুলি 'Inspired Talks' (দেববাণী) নামে লিপিবদ্ধ; সেগুলির তারিখ ১৯ জুন থেকে ৫ অগষ্ট। ১৮ জুন থেকে ৬ অগষ্ট পর্যন্ত স্বামীজী এখানে ছিলেন, কিন্তু এই কালে লেখা অনেকগুলি চিঠিতে নিউ ইয়র্কের স্থায়ী ঠিকানাই আছে। |
৭৪ | গীতা, ৫।১৯ |
৭৫ | Mrs. Dora Rosthlesberger স্বামীজীর সঙ্গে দুই ভগিনী মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস স্টার্জিস-এর পরিচয় করিয়ে দেন। |
৭৬ | নিউ হ্যাম্পশায়ারে মিঃ লেগেটের ক্যাম্প। সেখান থেকে স্বামীজী Thousand Island Park-এ যান। |
৭৭ | Miss Alberta Sturgis—মিসেস স্টার্জিসের কন্যা। |
৭৮ | মিসেস স্টার্জিসের পুত্র হলিস্টার ও কন্যা অ্যালবার্টা তখন জার্মানীতে পড়াশুনা করিতেছিল। |
৭৯ | স্বামীজীর উৎসাহে মান্দ্রাজ হইতে এই সময়ে (১৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫) পাক্ষিক (পরে মাসিক) ইংরেজী পত্রিকা প্রতিষ্ঠিত হয়। উহার নাম ‘ব্রহ্মবাদিন্’, ইহার মটো— ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’। |
৮০ | এইকালে রচিত স্বামীজীর 'Song of the Sannyasin' নামক বিখ্যাত কবিতা ‘ব্রহ্মবাদিন্’, পত্রের ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যায় (২৮ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫) প্রকাশিত হয়। |
৮১ | প্রসংখ্যানেঽপ্যকুসীদস্য সর্বথা বিবেকখ্যাতেধর্মমেঘঃ সমাধিঃ। |
৮২ | খেতড়ির মহারাজা। |
৮৩ | এই সময়ে স্বামীজী একেবারেই নিরামিষাশী ছিলেন। |
৮৪ | Miss Margaret Noble (পরে ভগিনী নিবেদিতা)। |
৮৫ | এরূপ একজন লোক বলে তো নিজেকে জাহির করি না। |
৮৬ | কাজকর্ম তৎপরতার সহিত করিতে হয়। |
৮৭ | Britannia? |
৮৮ | প্রত্যেক ধর্ম সত্যের এক-একটি প্রকাশ, সেই একই সত্যকে প্রকাশ করিবার এক-একটি ভাষা, এবং আমাদিগকে প্রত্যেক নরনারীর সহিত তাহার নিজ ভাষায় কথা কহিতে হইবে। |
৮৯ | ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসব মহাশয়, আমরা আপনাকে ভগবান্ রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের —তম জন্মোৎসবে আমাদের সহিত যোগদানের জন্য সানন্দে আমন্ত্রণ করিতেছি। এই পুণ্যদিনের অনুষ্ঠানের জন্য এবং আলমবাজারের মঠ পরিচালনার জন্য অর্থের একান্ত আবশ্যক। আপনি যদি মনে করেন যে, এই উদ্দেশ্যটি আপনার সহানুভূতির যোগ্য; তবে এই মহৎ কার্যে আপনার সাহায্য পাইলে আমরা বিশেষ কৃতার্থ হইব। (স্থান)(তারিখ) ভবদীয় বিনয়াবনত |
৯০ | তাঁর জীবনচরিত যে-কেউ লিখবে, তার সঙ্গে তোমরা নিজেদের জড়িত করো না, বা তা অনুমোদন করো না। |
৯১ | তিনি নারীজাতির উদ্ধারকর্তা, জনসাধারণের উদ্ধারকর্তা, উচ্চ-নীচ সকলের উদ্ধারকর্তা। |
৯২ | ঠিক এইভাবে লেখা স্বামীজীর কোন পুস্তক নাই, তবে এই সময়ের অনেক বৃক্তৃতায় (বিশেষতঃ ১৮৯৬ খ্রীঃ লণ্ডন-বক্তৃতামালায়) এই তত্ত্বগুলির কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায়। |
৯৩ | স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ। |
৯৪ | তোমাদের একটু কাজ-চালানর বুদ্ধি থাকা প্রয়োজন। এখন তোমাদের চাই সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া। সেজন্য সম্পূর্ণ আজ্ঞাবহতা এবং শ্রম-বিভাগের প্রয়োজন। আমি প্রত্যেকটি বিষয় খুঁটিনাটিভাবে ইংলণ্ড থেকে লিখে পাঠাব, কাল ইংলণ্ড যাত্রা করছি। তোমাদের আমি সঙ্ঘবদ্ধ সুন্দর কর্মীতে পরিণত করবই। |
৯৫ | সকলকে জোর করে ঐ ভাবটা গেলাবার চেষ্টা ম-এর আছে। কিন্তু তাতে আমরা একটা ছোট সম্প্রদায়ে পরিণত হব। তোমরা এ-সকল প্রয়াস থেকে পৃথক্ থাকবে। অথচ যদি লোকে তাঁকে ঈশ্বর বলে পূজা করে, ক্ষতি নাই। তাদের উৎসাহও দিও না, নিরুৎসাহও করো না। সাধারণ মানুষ চিরকাল ব্যক্তিই চাইবে, উচ্চশ্রেণীরা তত্ত্বটি গ্রহণ করবে। আমরা দুই-ই চাই, কিন্তু তত্ত্ব সার্বভৌম, ব্যক্তি নহে। সুতরাং তাঁর প্রচারিত তত্ত্বগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাক; এখন লোকে তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে যা খুশী ভাবুক না কেন। সর্বপ্রকার বিবাদ, ঈর্ষা ও গোঁড়ামির বিরাম হোক; এগুলি থাকলে সব পণ্ড হবে। ‘যে প্রথম আছে, সে শেষে যাবে; যে শেষে আছে, সে প্রথম হবে।’ |
৯৬ | শ্রীরামকৃষ্ণের। |
* | পত্রটির এই পর্যন্ত ইংরেজীর অনুবাদ। |
৯৭ | Frankincense—ধূপধুনাজাতীয় সুগন্ধি দ্রব্যবিশেষ, মিঃ ফ্রান্সিস লেগেটকে স্বামীজী কখনও কখনও সস্নেহে এই বলিয়া সম্বোধন করিতেন। |
৯৮ | প্রাচীন পারসিকদিগের মধ্যে যে ব্যক্তি অভ্যাগতগণের পানপাত্রে সুরা ঢালিয়া দিত, তাহাকে ‘সাকি’ বলা হইত। হাফেজ, ওমর খৈয়ম প্রভৃতির কবিতায় এই শব্দের বহুল প্রয়োগ দেখা যায়। |
৯৯ | স্বামীজী তখন সুইজরলণ্ডে থাকিলেও ইহা তাঁহার ইংলণ্ডের স্থায়ী ঠিকানা। |
১০০ | সেবিতব্যো মহাবৃক্ষঃ ফলচ্ছায়াসমন্বিতঃ। যদি দৈবাৎ ফলং নাস্তি ছায়া কেন নিবার্যতে॥ |
১০১ | Mr. Landsberg. |
১০২ | জেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি। গীতা—৫।৩ |
১০৩ | আত্মানং চেদ বিজানীয়াদয়মস্মীতি পুরুষঃ।
কিমিচ্ছন্ কস্য কামায় শরীরমনুসংজ্বরেৎ॥ বৃহদারণ্যকোপনিষদ্, ৪।৪।১২ |
১০৪ | মনুষ্যাণাংসহস্রেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে।
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ॥ গীতা—৭।৩ |
১০৫ | তমেবৈকং জানথ আত্মানম্, অন্যা বাচো বিমুঞ্চথ। —মুণ্ডক উপ., ২।২।৫ |
১০৬ | সন্ন্যাসী। |
১০৭ | ধনী ব্যক্তির ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ অপেক্ষা একটি উষ্ট্রের পক্ষে সূচের ছিদ্রের মধ্যে (খুব সরু পথে) প্রবেশও অপেক্ষাকৃত সহজ।—বাইবেল |
১০৮ | Prabuddha Bharata. |
১০৯ | কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নাটকে বর্ণিত শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার পূর্বে কণ্ব মুনির আশীর্বাদের ভাবার্থ। |
১১০ | ১৮৯৬ খ্রীঃ ডাঃ ব্যারোজ ভারতে বক্তৃতা দিতে আসিলে তাঁহাকে অভিনন্দিত করিবার জন্য দেশবাসীর নিকট অনুরোধ করিয়া স্বামীজী যে পত্র দেন, ইহা তাহারই কিয়দংশ। |
১১১ | স্বামী অভেদানন্দ। |
১১২ | Socialist—সোশ্যালিজম্-মতবাদী। এই মতাবলম্বীরা রাষ্ট্রের হস্তে ভূমি ও বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলির স্বত্ব অর্পণ করে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে যে বিষম বৈষম্য আছে, তা যথাসম্ভব দূর করে সমাজের আমূল পুনর্গঠনের পক্ষপাতী। |
১১৩ | 'Book of Job'—Old Testament: শয়তান একবার ঈশ্বরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইলে ঈশ্বর জিজ্ঞাসা করেন, ‘কোথা হইতে আসিতেছ?’ শয়তান বলিয়াছিল, ‘এই পৃথিবীর এধার ওধার ঘুরিয়া এবং ইহার উপরে নীচে ভ্রমণ করিয়া আসিতেছি।’ |
১১৪ | প্রত্যাশিত পুত্রের পরিবর্তে কন্যা জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাই স্বামীজী এ কথা উল্লেখ করেছেন। |
১১৫ | শ্রীমতী সরলা ঘোষাল। |
১১৬ | Patrick, প্যাট্রিক—আইরিশম্যান (চলিত ভাষায়)। |
১১৭ | বিস্তারই জীবনের চিহ্ন, আমাদের আধ্যাত্মিক আদর্শ লইয়া আমাদিগকে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িতে হইবে। |
১১৮ | আমার সমানধর্মা অন্য কোন ব্যক্তি আছেন বা উৎপন্ন হইবেন; কারণ কালের অন্ত নাই এবং পৃথিবীও বিপুল—‘মালতী-মাধব’, ভবভূতি। |
১১৯ | মূল পত্রে স্থায়ী ঠিকানা হিসাবে ‘মঠ, আলমবাজার’ লিখিত আছে। |
১২০ | স্বামীজী Mill কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘পেষা’র উপুর কৌতুক করে ইংরেজীতে এই কথা বলেছেন, অর্থাৎ তারা ধীরে সুস্থে আপন কাজ সমাধা করছে। |
১২১ | মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালের হীরক-জয়ন্তী—ষাট বর্ষপূর্তি। |
১২২ | যে যোগাগ্নিময় দেহ লাভ করেছে, তার রোগ জরা মৃত্যু কিছুই নেই।—শ্বে. উপ., (২।১২) |
১২৩ | আলমবাজার মঠ। |
১২৪ | স্বামী অখণ্ডানন্দের উদ্যমে অনুষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম দুর্ভিক্ষ সেবাকার্য। |
১২৫ | এই অনুচ্ছেদটি বাঙলায় লিখিত। |
১২৬ | ফল দেখেই কাজের বিচার সম্ভব হয়; যেমন ফল দেখে পূর্ব সংস্কারের অনুমান করা হয়। |
১২৭ | চিঠিখানি আম্বালা হইতে লিখিত; কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা হিসাবে ‘বেলুড়’ লিখিত আছে, তখন আলমবাজার হইতে মঠ বেলুড়ে স্থানান্তরিত হইবার কথা চলিতেছে। |
১২৮ | প্রতিলিপি দ্রষ্টব্যঃ বানান চিঠির মত রাখা হইল। |
১২৯ | পত্রের এই পর্যন্ত ইংরেজীতে, পরবর্তী অংশ বাঙলায় লিখিত। |
১ | The Song of the Sannyasin: ১৮৯৫, জুলাই Thousand Island Park-এ রচিত। অনুবাদঃ স্বামী শুদ্ধানন্দ। |
২ | To the Awakened India: ১৮৯৮, অগষ্ট 'Prabuddha Bharata' পত্রিকা মান্দ্রাজ হইতে আলমোড়ায় স্থানান্তরিত হওয়া উপলক্ষে রচিত। অনুবাদঃ স্বামী প্রজ্ঞানন্দ। |
৩ | Kali the Mother: কাশ্মীরে ক্ষীরভবানী দর্শনের পর ১৮৯৮, সেপ্টেম্বর শ্রীনগরে লিখিত। অনুবাদঃ কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। |
৪ | My Play is Done: ১৮৯৫, বসন্তকালে নিউ ইয়র্কে লিখিত। অনুবাদঃ প্রফুল্লনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। |
৫ | No One to Blame: ১৮৯৫, ১৬ মে নিউ ইয়র্কে লিখিত। অনুবাদঃ স্বামী জীবানন্দ। |
৬ | Hold on Yet a While, Brave Heart: খেতড়ি-মহারাজকে লিখিত। অনুবাদঃ ব্রহ্মচারী পূর্ণচৈতন্য। |
৭ | Angels Unawares: ১৮৯৮, নভেম্বর কলিকাতায় লিখিত। অনুবাদঃ প্রণবরঞ্জন ঘোষ। |
৮ | Thou Blessed Dreams: ১৯০০, ১৭ অগষ্ট প্যারিস হইতে ভগিনী ক্রিষ্টিনকে লিখিত। অনুবাদঃ প্রণবরঞ্জন ঘোষ। |
৯ | To An Early Violet: ১৮৯৬, ৬ জানুআরী নিউ ইয়র্ক হইতে জনৈক পাশ্চাত্য শিষ্যাকে লিখিত। অনুবাদঃ প্রণবরঞ্জন ঘোষ। |
১০ | Who Knows How Mother Play: অনুবাদঃ প্রণবরঞ্জন ঘোষ। |
১১ | The Cup: অনুবাদঃ প্রণবরঞ্জন ঘোষ। |
১২ | The Living God: ১৮৯৭, ৯ জুলাই আলমোড়া হইতে মেরী হেলকে লিখিত পত্রের অংশ। অনুবাদঃ প্রণবরঞ্জন ঘোষ। |
১৩ | Light: ১৯০০, ২৬ ডিসেম্বর মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত। অনুবাদঃ প্রণবরঞ্জন ঘোষ। |
১৪ | 'Requiescat in Pace': ১৮৯৮, অগষ্ট স্বামীজীর শিষ্য গুডউইনের মৃত্যু উপলক্ষে রচিত ও শোকার্ত জননীর নিকট প্রেরিত। অনুবাদঃ কিরণচন্দ্র দত্ত। |
১৫ | A Benediction: ১৯০০, ২২ সেপ্টেম্বর ভগিনী নিবেদিতাকে লিখিত। অনুবাদঃ প্রণবরঞ্জন ঘোষ। |
১৬ | To the Fourth of July: আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৮৯৮, ৪ জুলাই কাশ্মীরে রচিত। অনুবাদঃ ব্রহ্মচারী পূর্ণচৈতন্য। |
১৭ | Peace: ১৮৯৯, রিজলী ম্যানর, নিউ ইয়র্কে রচিত। অনুবাদঃ ব্রহ্মচারী পূর্ণচৈতন্য। |
১৮ | Song of the Free: ১৮৯৫, ১৫ ফেব্রুআরী নিউ ইয়র্কে মেরী হেলকে লিখিত। অনুবাদঃ কিরণচন্দ্র দত্ত। |
১৯ | To My own Soul: রচনার স্থান ও কাল অজ্ঞাত। |
২০ | স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে ২৫. ৯. ১৮৯৪ তারিখে লেখা পত্রের মধ্যে স্বামীজীর সংস্কৃত রচনা। অনুবাদকঃ স্বামী বিশ্বাশ্রয়ানন্দ। |