পুস্তক প্রকাশকের নিবেদন
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
ষষ্ঠ খণ্ড
স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা
ষষ্ঠ খণ্ড
[এই প্রবন্ধটি ‘হিন্দুধর্ম কি?’ নামে ১৩০৪ সালে ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পঞ্চষষ্টিতম জন্মোৎসবের সময় পুস্তিকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়।]
শাস্ত্র শব্দে অনাদি অনন্ত ‘বেদ’ বুঝা যায়। ধর্মশাসনে এই বেদই একমাত্র সক্ষম।
পুরাণাদি অন্যান্য পুস্তক স্মৃতি-শব্দবাচ্য; এবং তাহাদের প্রামাণ্য—যে পর্যন্ত তাহারা শ্রুতিকে অনুসরণ করে, সেই পর্যন্ত।
‘সত্য’ দুই প্রকার। এক—যাহা মানব-সাধারণের পঞ্চেন্দ্রিয়-গ্রাহ্য ও তদুপস্থাপিত অনুমানের দ্বারা গ্রাহ্য। দুই—যাহা অতীন্দ্রীয় সূক্ষ্ম যোগজ শক্তির গ্রাহ্য।
প্রথম উপায় দ্বারা সঙ্কলিত জ্ঞানকে ‘বিজ্ঞান’ বলা যায়। দ্বিতীয় প্রকারের সঙ্কলিত জ্ঞানকে ‘বেদ’ বলা যায়।
‘বেদ’-নামধেয় অনাদি অনন্ত অলৌকিক জ্ঞানরাশি সদা বিদ্যমান, সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং যাহার সহায়তায় এই জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করিতেছেন।
এই অতীন্দ্রিয় শক্তি যে পুরুষে আবির্ভূত হন, তাঁহার নাম ঋষি, ও সেই শক্তির দ্বারা তিনি যে অলৌকিক সত্য উপলব্ধি করেন, তাহার নাম ‘বেদ’।
এই ঋষিত্ব ও বেদদ্রষ্টৃত্ব লাভ করাই যথার্থ ধর্মানুভূতি। যতদিন ইহার উন্মেষ না হয়, ততদিন ‘ধর্ম’ কেবল ‘কথার কথা’ ও ধর্মরাজ্যের প্রথম সোপানেও পদস্থিতি হয় নাই, জানিতে হইবে।
সমস্ত দেশকালপাত্র ব্যাপিয়া বেদের শাসন অর্থাৎ বেদের প্রভাব দেশবিশেষে, কালবিশেষে বা পাত্রবিশেষে বদ্ধ নহে।
সার্বজনীন ধর্মের ব্যাখ্যাতা একমাত্র ‘বেদ’।
অলৌকিক জ্ঞানবেত্তৃত্ব কিঞ্চিৎ পরিমাণে অস্মদ্দেশীয় ইতিহাস-পুরাণাদি পুস্তকে ও ম্লেচ্ছাদিদেশীয় ধর্মপুস্তকসমূহে যদিও বর্তমান, তথাপি অলৌকিক জ্ঞানরাশির সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ এবং অবিকৃত সংগ্রহ বলিয়া আর্যজাতির মধ্যে প্রসিদ্ধ ‘বেদ’-নামধেয় চতুর্বিভক্ত অক্ষরাশি সর্বতোভাবে সবোর্চ্চ স্থানের অধিকারী, সমগ্র জগতের পূজার্হ এবং আর্য বা ম্লেচ্ছ সমস্ত ধর্মপুস্তকের প্রমাণভূমি।
আর্যজাতির আবিষ্কৃত উক্ত ‘বেদ’ নামক শব্দরাশির সম্বন্ধে ইহাও বুঝিতে হইবে যে, তন্মধ্যে যাহা লৌকিক, অর্থবাদ বা ঐতিহ্য নহে, তাহাই ‘বেদ’।
এই বেদরাশি জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড—দুইভাগে বিভক্ত। কর্মকাণ্ডের ক্রিয়া ও ফল মায়াধিকৃত জগতের মধ্যে বলিয়া দেশকালপাত্রাদি-নিয়মাধীনে তাহার পরিবর্তন হইয়াছে, হইতেছে ও হইবে। সামাজিক রীতিনীতিও এই কর্মকাণ্ডের উপর উপস্থাপিত বলিয়া কালে কালে পরিবর্তিত হইতেছে ও হইবে। লোকাচারসকলও সৎশাস্ত্রবিগর্হিত ও সদাচারবিরোধী একমাত্র লোকাচারের বশবর্তী হওয়াই আর্যজাতির অধঃপতনের এক প্রধান কারণ।
জ্ঞানকাণ্ড অথবা বেদান্তভাগই—নিষ্কামকর্ম, যোগ, ভক্তি ও জ্ঞানের সহায়তায় মুক্তিপ্রদ এবং মায়া-পার–নেতৃত্বপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া, দেশকালপাত্রাদির দ্বারা অপ্রতিহত বিধায়— সার্বলৌকিক, সার্বভৌম ও সার্বকালিক ধর্মের একমাত্র উপদেষ্টা।
মন্বাদি তন্ত্র কর্মকাণ্ডকে আশ্রয় করিয়া দেশকালপাত্রভেদে অধিকভাবে সামাজিক কল্যাণকর কর্মের শিক্ষা দিয়াছেন। পুরাণাদি তন্ত্র বেদান্তনিহিত তত্ত্ব উদ্ধার করিয়া অবতারাদির মহান্ চরিত-বর্ণন-মুখে ঐ-সকল তত্ত্বের বিস্তৃত ব্যাখ্যান করিতেছেন, এবং অনন্তভাবময় প্রভু ভগবানের কোন কোন ভাবকে প্রধান করিয়া সেই সেই ভাবের উপদেশ করিয়াছেন।
কিন্তু কালবশে সদাচারভ্রষ্ট, বৈরাগ্যবিহীন, একমাত্র-লোকাচারনিষ্ঠ ও ক্ষীণবুদ্ধি আর্যসন্তান এই-সকল ভাববিশেষের বিশেষ শিক্ষার জন্য আপাত-প্রতিযোগীর ন্যায় অবস্থিত ও অল্পবুদ্ধি মানবের জন্য স্থূল ও বহুবিস্তৃত ভাষায় স্থূলভাবে বৈদান্তিক সূক্ষ্মতত্ত্বের প্রচারকারী পুরাণাদি তন্ত্রেরও মর্মগ্রহে অসমর্থ হইয়া, অনন্তভাবসমষ্টি অখণ্ড সনাতন ধর্মকে বহুখণ্ডে বিভক্ত করিয়া, সাম্প্রদায়িক ঈর্ষা ও ক্রোধ প্রজ্বলিত করিয়া, তন্মধ্যে পরস্পরকে আহুতি দিবার জন্য সতত চেষ্টিত থাকিয়া যখন এই ধর্মভূমি ভারতবর্ষকে প্রায় নরকভূমিতে পরিণত করিয়াছেন—
তখন আর্যজাতির প্রকৃত ধর্ম কি এবং সততবিবদমান, আপাত-প্রতীয়মান-বহুধা- বিভক্ত, সর্বথা-প্রতিযোগী, আচারসঙ্কুল সম্প্রদায়ে সমাচ্ছন্ন, স্বদেশীর ভ্রান্তিস্থান ও বিদেশীর ঘৃণাস্পদ হিন্দুধর্ম-নামক যুগযুগান্তরব্যাপী বিখণ্ডিত ও দেশকাল-যোগে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ধর্মখণ্ডসমষ্টির মধ্যে যথার্থ একতা কোথায়—এবং কালবশে নষ্ট এই সনাতন ধর্মের সার্বলৌকিক, সার্বকালিক ও সার্বদৈশিক স্বরূপ স্বীয় জীবনে নিহিত করিয়া, লোকসমক্ষে সনাতন ধর্মের জীবন্ত উদাহরণস্বরূপ আপনাকে প্রদর্শন করিতে লোকহিতের জন্য শ্রীভগবান্ রামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হইয়াছেন।
অনাদি-বর্তমান, সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-কর্তার সহযোগী শাস্ত্র কি প্রকারে সংক্ষিপ্তসংস্কার ঋষিহৃদয়ে আবির্ভূত হন, তাহা দেখাইবার জন্য ও এবম্প্রকারে শাস্ত্র প্রমাণীকৃত হইলে ধর্মের পুনরুদ্ধার, পুনঃস্থাপন ও পুনঃপ্রচার হইবে, এই জন্য বেদমূর্তি ভগবান্ এই কলেবরে বহিঃশিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করিয়াছেন।
বেদ অর্থাৎ প্রকৃত ধর্মের এবং ব্রাহ্মণত্ব অর্থাৎ ধর্মশিক্ষকত্বের রক্ষার জন্য ভগবান্ বারংবার শরীর ধারণ করেন, ইহা স্মৃত্যাদিতে প্রসিদ্ধ আছে।
প্রপতিত নদীর জলরাশি সমধিক বেগবান্ হয়; পুনরুত্থিত তরঙ্গ সমধিক বিস্ফারিত হয়। প্রত্যেক পতনের পর আর্যসমাজও শ্রীভগবানের কারুণিক নিয়ন্তৃত্বে বিগতাময় হইয়া পূর্বাপেক্ষা অধিকতর যশস্বী ও বীর্যবান্ হইতেছে—ইহা ইতিহাস-প্রসিদ্ধ।
প্রত্যেক পতনের পর পুনরুত্থিত সমাজ অন্তর্নিহিত সনাতন পূর্ণত্বকে সমধিক প্রকাশিত করিতেছেন এবং সর্বভূতান্তর্যামী প্রভুও প্রত্যেক অবতারে আত্মস্বরূপ সমধিক অভিব্যক্ত করিতেছেন।
বারংবার এই ভারতভূমি মূর্ছাপন্না হইয়াছিলেন এবং বারংবার ভারতের ভগবান্ আত্মাভিব্যক্তির দ্বারা ইঁহাকে পুনরুজ্জীবিত করিয়াছেন।
কিন্তু ঈষন্মাত্রযামা গতপ্রায়া বর্তমান গভীর বিষাদ-রজনীর ন্যায় কোন অমানিশা এই পুণ্যভূমিকে সমাচ্ছন্ন করে নাই। এ পতনের গভীরতায় প্রাচীন পতন-সমস্ত গোষ্পদের তুল্য।
এবং সেই জন্য এই প্রবোধনের সমুজ্জ্বলতায় অন্য সমস্ত পুনর্বোধন সূর্যালোকে তারকাবলীর ন্যায়। এই পুনরুত্থানের মহাবীর্যের সমক্ষে পুনঃপুনর্লদ্ধ প্রাচীন বীর্য বাললীলাপ্রায় হইয়া যাইবে।
পতনাবস্থায় সনাতন ধর্মের সমগ্র ভাব-সমষ্টি অধিকারিহীনতায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়-আকারে পরিরক্ষিত হইতেছিল এবং অনেক অংশ লুপ্ত হইয়াছিল।
এই নবোত্থানে নব বলে বলীয়ান্ মানবসন্তান বিখণ্ডিত ও বিক্ষিপ্ত অধ্যাত্মবিদ্যা সমষ্টীকৃত করিয়া ধারণা ও অভ্যাস করিতে সমর্থ হইবে এবং লুপ্ত বিদ্যারও পুনরাবিষ্কার করিতে সমর্থ হইবে; ইহার প্রথম নিদর্শনস্বরূপ শ্রীভগবান্ পরমকারুণিক, সর্বযুগাপেক্ষা সমধিক সম্পূর্ণ, সর্বভাব-সমন্বিত, সর্ববিদ্যা-সহায় যুগাবতাররূপ প্রকাশ করিলেন।
অতএব এই মহাযুগের প্রত্যুষে সর্বভাবের সমন্বয় প্রচারিত হইতেছে এবং এই অসীম অনন্ত ভাব, যাহা সনাতন শাস্ত্র ও ধর্মে নিহিত থাকিয়াও এতদিন প্রচ্ছন্ন ছিল, তাহা পুনরাবিষ্কৃত হইয়া উচ্চনিনাদে জনসমাজে ঘোষিত হইতেছে।
এই নবযুগধর্ম সমগ্র জগতের, বিশেষতঃ ভারতবর্ষের কল্যাণের নিদান এবং এই নবযুগধর্ম-প্রবর্তক শ্রীভগবান্ পূর্বগ শ্রীযুগধর্মপ্রবর্তকদিগের পুনঃসংস্কৃত প্রকাশ। হে মানব, ইহা বিশ্বাস কর ও ধারণ কর।
মৃতব্যক্তি পুনরাগত হয় না। গতরাত্রি পুনর্বার আসে না। বিগতোচ্ছ্বাস সে রূপ আর প্রদর্শন করে না। জীব দুইবার এক দেহ ধারণ করে না। হে মানব, মৃতের পূজা হইতে আমরা তোমাদিগকে জীবন্তের পূজাতে আহ্বান করিতেছি। গতানুশোচনা হইতে বর্তমান প্রযত্নে আহ্বান করিতেছি। লুপ্ত পন্থার পুনরুদ্ধারে বৃথা শক্তিক্ষয় হইতে সদ্যোনির্মিত বিশাল ও সন্নিকট পথে আহ্বান করিতেছি; বুদ্ধিমান্, বুঝিয়া লও।
যে শক্তির উন্মেষমাত্রে দিগ্দিগন্তব্যাপী প্রতিধ্বনি জাগরিত হইয়াছে, তাহার পূর্ণাবস্থা কল্পনায় অনুভব কর; এবং বৃথা সন্দেহ, দুর্বলতা ও দাসজাতিসুলভ ঈর্ষাদ্বেষ ত্যাগ করিয়া এই মহাযুগচক্র-পরিবর্তনের সহায়তা কর।
আমরা প্রভুর দাস, প্রভুর পুত্র, প্রভুর লীলার সহায়ক—এই বিশ্বাস দৃঢ় করিয়া কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হও।
[অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার-লিখিত পুস্তকের সমালোচনা]
অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞদিগের অধিনায়ক। যে ঋগ্বেদ-সংহিতা পূর্বে সমগ্র কেহ চক্ষেও দেখিতে পাইত না, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বিপুল ব্যয়ে এবং অধ্যাপকের বহুবর্ষব্যাপী পরিশ্রমে এক্ষণে তাহা অতি সুন্দররূপে মুদ্রিত হইয়া সাধারণের পাঠ্য। ভারতের দেশদেশান্তর হইতে সংগৃহীত হস্তলিপি-পুঁথির অধিকাংশ অক্ষরগুলিই বিচিত্র এবং অনেক কথাই অশুদ্ধ; বিশেষ, মহাপণ্ডিত হইলেও বিদেশীর পক্ষে সেই অক্ষরের শুদ্ধ্যশুদ্ধি নির্ণয় এবং অতি স্বল্পাক্ষর জটিল ভাষ্যের বিশদ অর্থ বোধগম্য করা কি কঠিন, তাহা আমরা সহজে বুঝতে পারি না। অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের জীবনে এই ঋগ্বেদ-মুদ্রণ একটি প্রধান কার্য। এতদ্ব্যতীত আজীবন প্রাচীন সংস্কৃত-সাহিত্যে তাঁহার বসবাস—জীবন-যাপন; কিন্তু তাহা বলিয়াই যে অধ্যাপকের কল্পনার ভারতবর্ষ—বেদ-ঘোষ-প্রতিধ্বনিত, যজ্ঞধূম-পূর্ণাকাশ, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র-জনক-যাজ্ঞবল্ক্যাদি-বহুল, ঘরে ঘরে গার্গী-মৈত্রেয়ী-সুশোভিত, শ্রৌত ও গৃহ্যসূত্রের নিয়মাবলী-পরিচালিত, তাহা নহে। বিজাতি-বিধর্মি-পদদলিত, লুপ্তাচার, লুপ্তক্রিয়, ম্রিয়মান, আধুনিক ভারতের কোন্ কোণে কি নূতন ঘটনা ঘটিতেছে, তাহাও অধ্যাপক সদাজাগরূক হইয়া সংবাদ রাখেন। এদেশের অনেক অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান—অধ্যাপকের পদযুগল কখনও ভারত-মৃত্তিকা-সংলগ্ন হয় নাই বলিয়া ভারতবাসীর রীতিনীতি আচার ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁহার মতামতে নিতান্ত উপেক্ষা প্রদর্শন করেন। কিন্তু তাঁহাদের জানা উচিত যে, আজীবন এদেশে বাস করিলেও অথবা এদেশে জন্মগ্রহণ করিলেও যে-প্রকার সঙ্গ সেই সামাজিক শ্রেণীর বিশেষ বিবরণ ভিন্ন অন্য শ্রেণীর বিষয়ে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান রাজপুরুষকে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ থাকিতে হয়। বিশেষ, জাতিবিভাগে বিভক্ত এই বিপুল সমাজে একজাতির পক্ষে অন্য জাতির আচারাদি বিশিষ্টরূপে জানাই কত দুরূহ। কিছুদিন হইল, কোনও প্রসিদ্ধ অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান কর্মচারীর লিখিত ‘ভারতাধিবাস’ নামধেয় পুস্তকে এরূপ এক অধ্যায় দেখিয়াছি—‘দেশীয় পরিবার-রহস্য’। মনুষ্যহৃদয়ে রহস্যজ্ঞানেচ্ছা প্রবল বলিয়াই বোধ হয় ঐ অধ্যায় পাঠ করিয়া দেখি যে, অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান-দিগ্গজ তাঁহার মেথর, মেথরানী ও মেথরানীর জার-ঘটিত ঘটনা-বিশেষ বর্ণনা করিয়া স্বজাতিবৃন্দের দেশীয়-জীবন-রহস্য সম্বন্ধে উগ্র কৌতূহল চরিতার্থ করিতে বিশেষ প্রয়াসী এবং ঐ পুস্তকের অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান সমাজে সমাদর দেখিয়া লেখক যে সম্পূর্ণরূপে কৃতার্থ, তাহাও বোধ হয়। ‘শিবা বঃ সন্তু পন্থানঃ’—আর বলি কি? তবে শ্রীভগবান্ বলিয়াছেন—‘সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে’ ইত্যাদি। যাক অপ্রাসঙ্গিক কথা; তবে অধ্যাপক ম্যাক্সমূলারের আধুনিক ভারতবর্ষের, দেশদেশান্তরের রীতিনীতি ও সাময়িক ঘটনাজ্ঞান দেখিলে আশ্চর্য হইতে হয়, ইহা আমাদের প্রত্যক্ষ।
বিশেষতঃ ধর্ম সম্বন্ধে ভারতের কোথায় কি নূতন তরঙ্গ উঠিতেছে, অধ্যাপক সেগুলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবেক্ষণ করেন এবং পাশ্চাত্য জগৎ যাহাতে সে বিষয়ে বিজ্ঞপ্ত হয়, তাহারাও বিশেষ চেষ্টা করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন কর্তৃক পরিচালিত ব্রাহ্মসমাজ, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী-প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ, থিওসফি সম্প্রদায় অধ্যাপকের লেখনী-মুখে প্রশংসিত বা নিন্দিত হইয়াছে। সুপ্রতিষ্ঠিত ‘ব্রহ্মবাদিন্’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-নামক পত্রদ্বয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি ও উপদেশের প্রচার দেখিয়া এবং ব্রাহ্মধর্ম-প্রচারক বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার-লিখিত শ্রীরামকৃষ্ণের বৃত্তান্তপাঠে১ রামকৃষ্ণ-জীবন তাঁহাকে আকর্ষণ করে। ইতোমধ্যে ‘ইণ্ডিয়া হাউস’-এর লাইব্রেরিয়ান টনি মহোদয়-লিখিত ‘রামকৃষ্ণচরিত’ও ইংলণ্ডীয় প্রসিদ্ধ মাসিক পত্রিকায়২ মুদ্রিত হয়। মান্দ্রাজ ও কলিকাতা হইতে অনেক বিবরণ সংগ্রহ করিয়া অধ্যাপক ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’-নামক ইংরেজী ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকায় শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও উপদেশ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করেন। তাহাতে ব্যক্ত করিয়াছেন যে, বহু শতাব্দী যাবৎ পূর্বমনীষিগণের ও আধুনিক কালে পাশ্চাত্য বিদ্বদ্বর্গের প্রতিধ্বনিমাত্রকারী ভারতবর্ষে নূতন ভাষায় নূতন মহাশক্তি পরিপূরিত করিয়া নূতন ভাবসম্পাতকারী নূতন মহাপুরুষ সহজেই তাঁহার চিত্তাকর্ষণ করিলেন। পূর্বতন ঋষি-মুনি-মহাপুরুষদিগের কথা তিনি শাস্ত্রপাঠে বিলক্ষণই অবগত ছিলেন; তবে এ যুগে এ ভারতে—আবার তাহা হওয়া কি সম্ভব? রামকৃষ্ণ-জীবনী এ প্রশ্নের যেন মীমাংসা করিয়া দিল। আর ভারতগতপ্রাণ মহাত্মার ভারতের ভাবী মঙ্গলের, ভাবী উন্নতির আশালতার মূলে বারিসেচন করিয়া নূতন প্রাণ সঞ্চার করিল।
পাশ্চাত্য জগতে কতকগুলি মহাত্মা আছেন, যাঁহারা নিশ্চিত ভারতের কল্যাণাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু ম্যাক্সমূলারের অপেক্ষা ভারতহিতৈষী ইওরোপখণ্ডে আছেন কিনা, জানি না।ম্যাক্সমূলার যে শুধু ভারতহিতৈষী, তাহা নহেন—ভারতের দর্শন-শাস্ত্রে, ভারতের ধর্মে তাঁহার বিশেষ আস্থা; অদ্বৈতবাদ যে ধর্মরাজ্যের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্ক্রিয়া, তাহা অধ্যাপক সর্বসমক্ষে বারংবার স্বীকার করিয়াছেন। যে সংসারবাদ৩ দেহাত্মবাদী খ্রীষ্টিয়ানের বিভীষিকাপ্রদ, তাহাও তিনি স্বীয় অনুভূতিসিদ্ধ বলিয়া দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করেন; এমন কি, বোধ হয় যে, ইতঃপূর্ব-জন্ম তাঁহার ভারতেই ছিল, ইহাই তাঁহার ধারণা এবং পাছে ভারতে আসিলে তাঁহার বৃদ্ধ শরীর সহসা-সমুপস্থিত পূর্বস্মৃতিরাশির প্রবল বেগ সহ্য করিতে না পারে, এই ভয়ই অধুনা ভারতাগমনের প্রধান প্রতিবন্ধক। তবে গৃহস্থ মানুষ, যিনিই হউন, সকল দিক্ বজায় রাখিয়া চলিতে হয়। যখন সর্বত্যাগী উদাসীনকে অতি বিশুদ্ধ জানিয়াও লোকনিন্দিত আচারের অনুষ্ঠানে কম্পিতকলেবর দেখা যায়, ‘শূকরীবিষ্ঠা’ মুখে বলিয়াও যখন ‘প্রতিষ্ঠা’র লোভ, অপ্রতিষ্ঠার ভয় মহা-উগ্রতাপসেরও কার্য-প্রণালীর পরিচালক, তখন সর্বদা লোকসংগ্রহেচ্ছু বহুলোকপূজ্য গৃহস্থের যে অতি সাবধানে নিজের মনোগত ভাব প্রকাশ করিতে হইবে, ইহাতে কি বিচিত্রতা? যোগশক্তি ইত্যাদি গূঢ় বিষয় সম্বন্ধেও যে অধ্যাপক একেবারে অবিশ্বাসী, তাহাও নহেন।
‘দার্শনিক-পূর্ণ ভারতভূমিতে যে-সকল ধর্ম-তরঙ্গ উঠিতেছে’ তাহাদের কিঞ্চিৎ বিবরণ ম্যাক্সমূলার প্রকাশ করেন, কিন্তু আক্ষেপের বিষয় অনেকে ‘উহার মর্ম বুঝিতে অত্যন্ত ভ্রমে পড়িয়াছেন এবং অত্যন্ত অযথা বর্ণন করিয়াছেন’। ইহা প্রতিবিধানের জন্য এবং ‘এসোটেরিক বৌদ্ধমত, থিওসফি প্রভৃতি বিজাতীয় নামের পশ্চাতে ভারতবাসী সাধুসন্ন্যাসীদের অলৌকিক ক্রিয়াপূর্ণ অদ্ভুত যে-সকল উপন্যাস ইংলণ্ড ও আমেরিকার সংবাদপত্রসমূহে উপস্থিত হইতেছে, তাহার মধ্যে কিঞ্চিৎ সত্য আছে’,৪ ইহা দেখাইবার জন্য অর্থাৎ ভারতবর্ষ যে কেবল পক্ষিজাতির ন্যায় আকাশে উড্ডীয়মান, পদভরে জলসঞ্চরণকারী মৎস্যানুকারী জলজীবী, মন্ত্রতন্ত্র-ছিটাফোঁটা-যোগে রোগাপনয়নকারী, সিদ্ধিবলে ধনীদিগের বংশরক্ষক, সুবর্ণাদি-সৃষ্টিকারী সাধুগণের নিবাসভূমি, তাহা নহে; কিন্তু প্রকৃত আধ্যাত্মতত্ত্ববিৎ, প্রকৃত ব্রহ্মবিৎ, প্রকৃত যোগী, প্রকৃত ভক্ত যে ঐ দেশে একেবারে বিরল নহেন এবং সমগ্র ভারতবাসী যে এখনও এতদূর পশুভাব প্রাপ্ত হন নাই যে, শেষোক্ত নরদেবগণকে ছাড়িয়া পূর্বোক্ত বাজীকরগণের পদলেহন করিতে আপামর-সাধারণ দিবানিশি ব্যস্ত—ইহাই ইওরোপীয় মনীষিগণকে জানাইবার জন্য ১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দের অগষ্টসংখ্যক ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’-নামক পত্রিকায় অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার ‘প্রকৃত মহাত্মা’-শীর্ষক প্রবন্ধে৫ শ্রীরামকৃষ্ণ-চরিতের অবতারণা করেন।
ইওরোপ ও আমেরিকার বুধমণ্ডলী অতি সমাদরে এ প্রবন্ধটি পাঠ করেন এবং উহার বিষয়ীভূত শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রতি অনেকেই আস্থাবান্ হইয়াছেন। আর সুফল হইয়াছে কি?—এই ভারতবর্ষ নরমাংসভোজী, নগ্নদেহ, বলপূর্বক বিধবা-দাহনকারী, শিশুঘাতী, মূর্খ, কাপুরুষ, সর্বপ্রকার পাপ ও অন্ধতা-পরিপূর্ণ, পশুপ্রায় নরজাতিপূর্ণ বলিয়া পাশ্চাত্য সভ্য জাতিরা ধারণা করিয়া রাখিয়াছিলেন; এই ধারণার প্রধান সহায় পাদরী-সাহেবগণ—ও বলিতে লজ্জা হয়, দুঃখ হয়, কতকগুলি আমাদের স্বদেশী। এই দুই দলের প্রবল উদ্যোগে যে একটি অন্ধতামসের জাল পাশ্চাত্যদেশ-নিবাসীদের সম্মুখে বিস্তৃত হইয়াছিল, সেইটি ধীরে ধীরে খণ্ড খণ্ড হইয়া যাইতে লাগিল। ‘যে দেশে শ্রীভগবান্ রামকৃষ্ণের ন্যায় লোকগুরুর উদয়, সে দেশ কি বাস্তবিক যে-প্রকার কদাচারপূর্ণ আমরা শুনিয়া আসিতেছি, সেই প্রকার? অথবা কুচক্রীরা আমাদিগকে এতদিন ভারতের তথ্য সম্বন্ধে মহাভ্রমে পাতিত করিয়া রাখিয়াছিল?’—এ প্রশ্ন স্বতই পাশ্চাত্য মনে সমুদিত।
পাশ্চাত্য জগতে ভারতীয় ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-সাম্রাজ্যের চক্রবর্তী অধ্যাপক ম্যাক্সমূলার যখন শ্রীরামকৃষ্ণ-চরিত অতি ভক্তিপ্রবণ হৃদয়ে ইওরোপ ও আমেরিকার অধিবাসীদিগের কল্যাণের জন্য সংক্ষেপে ‘নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’তে প্রকাশ করিলেন, তখন পূর্বোক্ত দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভীষণ অন্তর্দাহ উপস্থিত হইল, তাহা বলা বাহুল্য।
মিশনরী মহোদয়েরা হিন্দুদেবদেবীর অতি অযথা বর্ণন করিয়া তাঁহাদের উপাসকদিগের মধ্যে যে যথার্থ ধার্মিক লোক কখনও উদ্ভূত হইতে পারে না—এইটি প্রমাণ করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছিলেন; প্রবল বন্যার সমক্ষে তৃণগুচ্ছের ন্যায় তাহা ভাসিয়া গেল, আর পূর্বোক্ত স্বদেশী সম্প্রদায় শ্রীরামকৃষ্ণের শক্তিসম্প্রসারণরূপ প্রবল অগ্নি নির্বাণ করিবার উপায় চিন্তা করিতে করিতে হতাশ হইয়া পড়িয়াছেন। ঐশী শক্তির সমক্ষে জীবের শক্তি কি?
অবশ্য দুই দিক্ হইতেই এক প্রবল আক্রমণ বৃদ্ধ অধ্যাপকের উপর পতিত হইল। বৃদ্ধ কিন্তু হটিবার নহেন; এ সংগ্রামে তিনি বহুবার পারোর্ত্তীর্ণ। এবারও হেলায় উর্ত্তীর্ণ হইয়াছেন এবং ক্ষুদ্র আততায়িগণকে ইঙ্গিতে নিরস্ত করিবার জন্য এবং উক্ত মহাপুরুষ ও তাঁহার ধর্ম যাহাতে সর্বসাধারণে জানিতে পারে, সেইজন্য তাঁহার অপেক্ষাকৃত সম্পূর্ণ জীবনী ও উপদেশ সংগ্রহপূর্বক ‘রামকৃষ্ণ ও তাঁহার উক্তি’ নামক পুস্তক প্রকাশ করিয়া উহার ‘রামকৃষ্ণ’ নামক অধ্যায়ে নিম্নলিখিত কথাগুলি বলিয়াছেনঃ
‘উক্ত মহাপুরুষ ইদানীং ইওরোপ ও আমেরিকার বহুল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন, তথায় তাঁহার শিষ্যেরা মহোৎসাহে তাঁহার উপদেশ প্রচার করিতেছেন এবং বহু ব্যক্তিকে, এমন কি, খ্রীষ্টিয়ানদের মধ্য হইতেও রামকৃষ্ণ-মতে আনয়ন করিতেছেন, একথা আমাদের নিকট আশ্চর্যবৎ এবং কষ্টে বিশ্বাসযোগ্য ... তথাপি প্রত্যেক মনুষ্যহৃদয়ে ধর্ম-পিপাসা বলবতী, প্রত্যেক হৃদয়ে প্রবল ধর্মক্ষুধা বিদ্যমান, যাহা বিলম্বে বা শীঘ্রই শান্ত হইতে চাহে। এই-সকল ক্ষুধার্ত প্রাণে রামকৃষ্ণের ধর্ম বাহিরের কোন শাসনাধীনে আসে না বলিয়াই অমৃতবৎ গ্রাহ্য হয়। ... অতএব রামকৃষ্ণ-ধর্মানুচারীদের যে প্রবল সংখ্যা আমরা শুনিতে পাই, তাহা কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত যদ্যপি হয়, তথাপি যে ধর্ম আধুনিক সময়ে এতাদৃশী সিদ্ধিলাভ করিয়াছে এবং যাহা বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে সম্পূর্ণ সত্যতার সহিত জগতের সর্বপ্রাচীন ধর্ম ও দর্শন বলিয়া ঘোষণা করে এবং যাহার নাম ‘বেদান্ত’ অর্থাৎ বেদশেষ বা বেদের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য, তাহা অস্মদাদির অতিযত্নের সহিত মনঃসংযোগার্হ।’৬
এই পুস্তকের প্রথম অংশে মহাত্মা পুরুষ, আশ্রম-বিভাগ, সন্ন্যাসী, যোগ, দয়ানন্দ সরস্বতী, পওহারী বাবা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাধাস্বামী সম্প্রদায়ের নেতা রায় শালিগ্রাম সাহেব বাহাদুর প্রভৃতির উল্লেখ করিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনীর অবতারণা করা হইয়াছে।
অধ্যাপকের বড়ই ভয়, পাছে সকল ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বন্ধে যে দোষ আপনা হইতেই আসে—অনুরাগ বা বিরাগাধিক্যে অতিরঞ্জিত হওয়া—সেই দোষ এ জীবনীতে প্রবেশ করে। তজ্জন্য ঘটনাবলী-সংগ্রহে তাঁহার বিশেষ সাবধানতা। বর্তমান লেখক শ্রীরামকৃষ্ণের ক্ষুদ্র দাস—তৎসঙ্কলিত রামকৃষ্ণ-জীবনীর উপাদান যে অধ্যাপকের যুক্তি ও বুদ্ধি-উদূখলে বিশেষ কুট্টিত হইলেও ভক্তির আগ্রহে কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত হওয়া সম্ভব, তাহাও বলিতে ম্যাক্সমূলার ভুলেন নাই এবং ব্রাহ্মধর্ম-প্রচারক শ্রীযুক্ত বাবু প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ব্যক্তিগণ শ্রীরামকৃষ্ণের দোষোদ্ঘোষণ করিয়া অধ্যাপককে যাহা কিছু লিখিয়াছেন, তাহার প্রত্যুত্তরমুখে দুই চারিটি কঠোর মধুর কথা যাহা বলিয়াছেন, তাহাও পরশ্রীকাতর ও ঈর্ষাপূর্ণ বাঙ্গালীর বিশেষ মনোযোগের বিষয়, সন্দেহ নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ-কথা অতি সংক্ষেপে সরল ভাষায় পুস্তকমধ্যে অবস্থিত। এ জীবনীতে সভয় ঐতিহাসিকের প্রত্যেক কথাটি যেন ওজন করিয়া লেখা—‘প্রকৃত মহাত্মা’-নামক প্রবন্ধে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মধ্যে মধ্যে দেখা যায়, এবার তাহা অতি যত্নে আবরিত। একদিকে মিশনরী, অন্যদিকে ব্রাহ্ম-কোলাহল—এ উভয় আপদের মধ্য দিয়া অধ্যাপকের নৌকা চলিয়াছে। ‘প্রকৃত মহাত্মা’ উভয় পক্ষ হইতে বহু ভর্ৎসনা, বহু কঠোর বাণী অধ্যাপকের উপর আনে; আনন্দের বিষয়—তাহার প্রত্যুত্তরের চেষ্টাও নাই, ইতরতা নাই, আর গালাগালি সভ্য ইংলণ্ডের ভদ্র লেখক কখনও করেন না; কিন্তু বর্ষীয়ান্ মহাপণ্ডিতের উপযুক্ত ধীর-গম্ভীর, বিদ্বেষ-শূন্য অথচ বজ্রবৎ দৃঢ় স্বরে—মহাপুরুষের অলৌকিক হৃদয়োত্থিত অমানব ভাবের উপর যে আক্ষেপ হইয়াছিল, তাহা অপসারিত করিয়াছেন।
আক্ষেপগুলিও আমাদের বিস্ময়কর বটে। ব্রাহ্ম-সমাজের গুরু স্বর্গীয় আচার্য শ্রীকেশবচন্দ্রের শ্রীমুখ হইতে আমরা শুনিয়াছি যে, শ্রীরামকৃষ্ণের সরল মধুর গ্রাম্য ভাষা অতি অলৌকিক পবিত্রতা-বিশিষ্ট; আমরা যাহাকে অশ্লীল বলি, এমন কথার সমাবেশ তাহাতে থাকিলেও তাঁহার অপূর্ব বালবৎ কামগন্ধহীনতার জন্য ঐ-সকল শব্দ-প্রয়োগ দোষের না হইয়া ভূষণস্বরূপ হইয়াছে। অথচ ইহাই একটি প্রবল আক্ষেপ!!
অপর আক্ষেপ এই যে, তিনি সন্ন্যাসগ্রহণ করিয়া স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছিলেন। তাহাতে অধ্যাপক উত্তর দিতেছেন যে, তিনি স্ত্রীর অনুমতি লইয়া সন্ন্যাসব্রত ধারণ করেন এবং যতদিন মর্ত্যধামে ছিলেন, তাঁহার সদৃশী স্ত্রী পতিকে গুরুভাবে গ্রহণ করিয়া স্বেচ্ছায় পরমানন্দে তাঁহার উপদেশ অনুসারে আকুমার ব্রহ্মচারিণীরূপে ভগবৎসেবায় নিযুক্তা ছিলেন। আরও বলেন যে, শরীরসম্বন্ধ না হইলে কি বিবাহে এতই অসুখ? ‘আর শরীরসম্বন্ধ না রাখিয়া ব্রহ্মচারিণী পত্নীকে অমৃতস্বরূপ ব্রহ্মানন্দের ভাগিনী করিয়া ব্রহ্মচারী পতি যে পরম পবিত্রভাবে জীবন অতিবাহিত করিতে পারেন, এ বিষয়ে উক্ত ব্রতধারণকারী ইওরোপ-নিবাসীরা সফলকাম হয় নাই, আমরা মনে করিতে পারি, কিন্তু হিন্দুরা যে অনায়াসে ঐ প্রকার কামজিৎ অবস্থায় কালাতিপাত করিতে পারে, ইহা আমরা বিশ্বাস করি।’৭ অধ্যাপকের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক! তিনি বিজাতি, বিদেশী হইয়া আমাদের একমাত্র ধর্মসহায় ব্রহ্মচর্য বুঝিতে পারেন, এবং ভারতবর্ষে যে এখনও বিরল নহে, বিশ্বাস করেন; আর আমাদের ঘরের মহাবীরেরা বিবাহে শরীরসম্বন্ধ বই আর কিছুই দেখিতে পাইতেছেন না!! যাদৃশী ভাবনা যস্য ইত্যাদি।
আবার অভিযোগ এই যে, তিনি বেশ্যাদিগকে অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন না। ইহাতে অধ্যাপকের উত্তর বড়ই মধুর; তিনি বলেন, শুধু রামকৃষ্ণ নহেন, অন্যান্য ধর্মপ্রবর্তকেরাও এ অপরাধে অপরাধী।
আহা! কি মিষ্ট কথা—শ্রীভগবান্ বুদ্ধদেবের কৃপাপাত্রী বেশ্যা অম্বাপালী ও হজরত ঈশার দয়াপ্রাপ্তা সামরীয়া নারীর কথা মনে পড়ে। আরও অভিযোগ, মদ্যপানের উপরও তাঁহার তাদৃশ ঘৃণা ছিল না। হরি! হরি! ‘একটু মদ খেয়েছে বলে সে লোকটার ছায়াও স্পর্শ করা হবে না’—এই না অর্থ? দারুণ অভিযোগই বটে! মাতাল, বেশ্যা, চোর, দুষ্টদের মহাপুরুষ কেন দূর দূর করিয়া তাড়াইতেন না, আর চক্ষু মুদ্রিত করিয়া ছাঁদি ভাষায় সানাইয়ের পোঁ-র সুরে কেন কথা কহিতেন না! আবার সকলের উপর বড় অভিযোগ—আজন্ম স্ত্রী-সঙ্গ কেন করিলেন না!!!
আক্ষেপকারীদের এই অপূর্ব পবিত্রতা এবং সদাচারের আদর্শে জীবন গড়িতে না পারিলেই ভারত রসাতলে যাইবে! যাক রসাতলে, যদি ঐ প্রকার নীতিসহায়ে উঠিতে হয়।
জীবনী অপেক্ষা উক্তি-সংগ্রহ এ পুস্তকের অধিক স্থান অধিকার করিয়াছে। ঐ উক্তিগুলি যে সমস্ত পৃথিবীর ইংরাজী-ভাষী পাঠকের মধ্যে অনেক ব্যক্তির চিত্তাকর্ষণ করিতেছে, তাহা পুস্তকের ক্ষিপ্র বিক্রয় দেখিয়াই অনুমিত হয়। উক্তিগুলি তাঁহার শ্রীমুখের বাণী বলিয়া মহাশক্তিপূর্ণ এবং তজ্জন্যই নিশ্চিত সর্বদেশে আপনাদের ঐশী শক্তি বিকাশ করিবে। ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ মহাপুরুষগণ অবতীর্ণ হন—তাঁহাদের জন্ম-কর্ম অলৌকিক এবং তাঁহাদের প্রচারকার্যও অত্যাশ্চর্য।
আর আমরা? যে দরিদ্র ব্রাহ্মণকুমার আমাদিগকে স্বীয় জন্ম দ্বারা পবিত্র, কর্ম দ্বারা উন্নত এবং বাণী দ্বারা রাজজাতিরও প্রীতি-দৃষ্টি আমাদের উপর পাতিত করিয়াছেন, আমরা তাঁহার জন্য করিতেছি কি? সত্য সকল সময়ে মধুর হয় না, কিন্তু সময়বিশেষে তথাপি বলিতে হয়—আমরা কেহ কেহ বুঝিতেছি আমাদের লাভ, কিন্তু ঐ স্থানেই শেষ। ঐ উপদেশ জীবনে পরিণত করিবার চেষ্টা করাও আমাদের অসাধ্য—যে জ্ঞান-ভক্তির মহাতরঙ্গ শ্রীরামকৃষ্ণ উত্তোলিত করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে অঙ্গ বিসর্জন করা তো দূরের কথা। যাঁহারা বুঝিয়াছেন এ খেলা, বা বুঝিতে চেষ্টা করিতেছেন, তাঁহাদিগকে বলি যে শুধু বুঝিলে হইবে কি? বোঝার প্রমাণ কার্যে। মুখে বুঝিয়াছি বা বিশ্বাস করি—বলিলেই কি অন্যে বিশ্বাস করিবে? সকল হৃদ্গত ভাবই ফলানুমেয়; কার্যে পরিণত কর—জগৎ দেখুক।
যাঁহারা আপনাদিগকে মহাপণ্ডিত জানিয়া এই মূর্খ দরিদ্র পূজারী ব্রাহ্মণের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, তাঁহাদের প্রতি আমাদের নিবেদন এই যে, যে দেশের এক মূর্খ পূজারী সপ্তসমুদ্রপার পর্যন্ত আপনাদের পিতৃপিতামহাগত সনাতন ধর্মের জয়ঘোষণা নিজ শক্তিবলে অত্যল্প কালেই প্রতিধ্বনিত করিল, সেই দেশের সর্বলোকমান্য শূরবীর মহাপণ্ডিত আপনারা—আপনারা ইচ্ছা করিলে আরও কত অদ্ভুত কার্য স্বদেশের, স্বজাতির কল্যাণের জন্য করিতে পারেন। তবে উঠুন, প্রকাশ হউন, দেখান মহাশক্তির খেলা—আমরা পুষ্প-চন্দন-হস্তে আপনাদের পূজার জন্য দাঁড়াইয়া আছি। আমরা মূর্খ, দরিদ্র, নগণ্য, বেশমাত্র-জীবী ভিক্ষুক; আপনারা মহারাজ, মহাবল, মহাকুল-প্রসূত, সর্ববিদ্যাশ্রয়—আপনারা উঠুন, অগ্রণী হউন, পথ দেখান, জগতের হিতের জন্য সর্বত্যাগ দেখান, আমরা দাসের ন্যায় পশ্চাদ্গমন করি। আর যাঁহারা শ্রীরামকৃষ্ণনামের প্রতিষ্ঠা ও প্রভাবে, দাসজাতিসুলভ ঈর্ষা ও দ্বেষে জর্জরিত-কলেবর হইয়া বিনা কারণে বিনা অপরাধে নিদারুণ বৈর প্রকাশ করিতেছেন, তাঁহাদিগকে বলি যে—হে ভাই, তোমাদের এ চেষ্টা বৃথা। যদি এই দিগদিগন্তব্যাপী মহাতরঙ্গ—যাহার শুভ্রশিখরে এই মহাপুরুষমূর্তি বিরাজ করিতেছেন—আমাদের ধন, জন বা প্রতিষ্ঠা-লাভের উদ্যোগের ফল হয়, তাহা হইলে তোমাদের বা অপর কাহারও চেষ্টা করিতে হইবে না, মহামায়ার অপ্রতিহত নিয়মপ্রভাবে অচিরাৎ এ তরঙ্গ মহাজলে অনন্তকালের জন্য লীন হইয়া যাইবে; আর যদি জগদম্বা-পরিচালিত মহাপুরুষের নিঃস্বার্থ প্রেমোচ্ছ্বাসরূপ এই বন্যা জগৎ উপপ্লাবিত করিতে আরম্ভ করিয়া থাকে, তবে হে ক্ষুদ্র মানব, তোমার কি সাধ্য মায়ের শক্তিসঞ্চার রোধ কর?
[স্বামীজী আমেরিকা যাইবার বহুপূর্বে বাঙলা ১২৯৬ সালে, অধুনালুপ্ত ‘সাহিত্য- কল্পদ্রুম’ নামক মাসিক পত্রে ‘Imitation of Christ’ নামক জগদ্বিখ্যাত পুস্তকের ‘ঈশা-অনুসরণ’ নাম দিয়া অনুবাদ করিতে আরম্ভ করেন। উক্ত পত্রের ১ম বর্ষের ১ম হইতে ৫ম সংখ্যা অবধি অনুবাদের ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদটি পর্যন্ত প্রকাশিত হইয়াছিল।আমরা সমুদয় (প্রকাশিত) অনুবাদটিই এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করিলাম। সূচনাটি স্বামীজীর মৌলিক রচনা।]
সূচনা
‘খ্রীষ্টের অনুসরণ’ নামক এই পুস্তক সমগ্র খ্রীষ্টজগতের অতি আদরের ধন। এই মহাপুস্তক কোন ‘রোম্যান ক্যাথলিক’ সন্ন্যাসীর লিখিত—লিখিত বলিলে ভুল হয়, ইহার প্রত্যেক অক্ষর উক্ত ঈশা-প্রেমে সর্বত্যাগী মহাত্মার হৃদয়ের শোণিতবিন্দুতে মুদ্রিত। যে মহাপুরুষের জ্বলন্ত জীবন্ত বাণী আজি চারি শত বৎসর কোটি কোটি নরনারীর হৃদয় অদ্ভুত মোহিনীশক্তিবলে আকৃষ্ট করিয়া রাখিয়াছে, রাখিতেছে এবং রাখিবে, যিনি আজি প্রতিভা ও সাধনবলে কত শত সম্রাটেরও নমস্য হইয়াছেন, যাঁহার অলৌকিক পবিত্রতার নিকটে পরস্পরে সতত যুধ্যমান অসংখ্য সম্প্রদায়ে বিভক্ত খ্রীষ্ট-সমাজ চিরপুষ্ট বৈষম্য পরিত্যাগ করিয়া মস্তক অবনত করিয়া রহিয়াছে—তিনি এ পুস্তকে আপনার নাম দেন নাই। দিবেন বা কেন? যিনি সমস্ত পার্থিব ভোগ এবং বিলাসকে, ইহজগতের সমুদয় মান-সম্ভ্রমকে বিষ্ঠার ন্যায় ত্যাগ করিয়াছিলেন—তিনি কি সামান্য নামের ভিখারী হইতে পারেন? পরবর্তী লোকেরা অনুমান করিয়া ‘টমাস আ কেম্পিস্’ নামক একজন ক্যাথলিক সন্ন্যাসীকে গ্রন্থকার স্থির করিয়াছেন, কতদূর সত্য ঈশ্বর জানেন। যিনিই হউন, তিনি যে জগতের পূজ্য তাহাতে আর সন্দেহ নাই।
এখন আমরা খ্রীষ্টিয়ান রাজার প্রজা। রাজ-অনুগ্রহে বহুবিধ-নামধারী স্বদেশী বিদেশী খ্রীষ্টিয়ান দেখিলাম। দেখিতেছি, যে মিশনরী মহাপুরুষেরা ‘অদ্য যাহা আছে খাও, কল্যকার জন্য ভাবিও না’ প্রচার করিয়া আসিয়াই আগামী দশ বৎসরের হিসাব এবং সঞ্চয়ে ব্যস্ত—দেখিতেছি, ‘যাঁহার মাথা রাখিবার স্থান নাই’ তাঁহার শিষ্যেরা—তাঁহার প্রচারকেরা বিলাসে মণ্ডিত হইয়া, বিবাহের বরটি সাজিয়া, এক পয়সার মা-বাপ হইয়া ঈশার জ্বলন্ত ত্যাগ, অদ্ভুত নিঃস্বার্থতা প্রচার করিতে ব্যস্ত, কিন্তু প্রকৃত খ্রীষ্টিয়ান দেখিতেছি না। এ অদ্ভুত বিলাসী, অতি দাম্ভিক, মহা অত্যাচারী, বেরুস এবং ব্রুমে চড়া, প্রোটেষ্ট্যাণ্ট খ্রীষ্টিয়ান সম্প্রদায় দেখিয়া খ্রীষ্টিয়ান সম্বন্ধে আমাদের যে অতি কুৎসিত ধারণা হইয়াছে, এই পুস্তক পাঠ করিলে তাহা সম্যক্রূপে দূরীভূত হইবে।
‘সব্ সেয়ানকী এক মত’—সকল যথার্থ জ্ঞানীরই একপ্রকার মত। পাঠক এই পুস্তক পড়িতে পড়িতে গীতায় ভগবদুক্ত ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’ উপদেশের শত শত প্রতিধ্বনি দেখিতে পাইবেন। দীনতা, আর্তি এবং দাস্যভক্তির পরাকাষ্ঠা এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে মুদ্রিত এবং পাঠ করিতে করিতে জ্বলন্ত বৈরাগ্য, অত্যদ্ভুত আত্মসমর্পণ এবং নির্ভরের ভাবে হৃদয় উদ্বেলিত হইবে। যাঁহারা অন্ধ গোঁড়ামির বশবর্তী হইয়া খ্রীষ্টিয়ানের লেখা বলিয়া এ পুস্তককে অশ্রদ্ধা করিতে চাহেন, তাঁহাদিগকে ন্যায়দর্শনের একটি সূত্র বলিয়া ক্ষান্ত হইবঃ ‘আপ্তোপদেশঃ শব্দঃ’—সিদ্ধপুরুষদিগের উপদেশ প্রামাণ্য এবং তাহারই নাম শব্দপ্রমাণ। এস্থলে ভাষ্যকর ঋষি বাৎস্যায়ন৮ বলিতেছেন যে, এই আপ্ত পুরুষ আর্য এবং ম্লেচ্ছ উভয়ত্রই সম্ভব।
যদি ‘যবনাচার্য’ প্রভৃতি গ্রীক জ্যোতিষী পণ্ডিতগণ পুরাকালে আর্যদিগের নিকট এতাদৃশ প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া গিয়া থাকেন, তাহা হইলে এই ভক্তসিংহের পুস্তক যে এদেশে আদর পাইবে না, তাহা বিশ্বাস হয় না।
যাহা হউক, এই পুস্তকের বঙ্গানুবাদ আমরা পাঠকগণের সমক্ষে ক্রমে ক্রমে উপস্থিত করিব। আশা করি, রাশি রাশি অসার নভেল-নাটকে বঙ্গের সাধারণ পাঠক যে সময় নিয়োজিত করেন, তাহার শতাংশের একাংশ ইহাতে প্রয়োগ করিবেন।
অনুবাদ যতদূর সম্ভব অবিকল করিবার চেষ্টা করিয়াছি—কতদূর কৃতকার্য হইয়াছি, বলিতে পারি না। যে-সকল বাক্য ‘বাইবেল’-সংক্রান্ত কোন বিষয়ের উল্লেখ করে, নিম্নে তাহার টীকা প্রদত্ত হইবে। কিমধিকমিতি!
প্রথম পরিচ্ছেদ
খ্রীষ্টের অনুসরণ’ এবং সংসার ও যাবতীয় সাংসারিক অন্তঃসারশূন্য পদার্থে ঘৃণা
১। প্রভু বলিতেছেন, ‘যে কেহ আমার অনুগমন করে, সে অন্ধকারে পদক্ষেপ করিবে না।’৯
যদ্যপি আমরা যথার্থ আলোক প্রাপ্ত হইবার ইচ্ছা করি এবং সকল প্রকার হৃদয়ের অন্ধকার হইতে মুক্ত হইবার বাসনা করি, তাহা হইলে খ্রীষ্টের এই কয়েকটি কথা স্মরণ করাইতেছে যে, তাঁহার জীবন ও চরিত্রের অনুকরণ আমাদিগের অবশ্য কর্তব্য।
অতএব ঈশার জীবন মনন করা আমাদের প্রধান কর্তব্য।১০
২। তিনি যে শিক্ষা দিয়াছেন, তাহা অন্য সকল মহাত্মাপ্রদত্ত শিক্ষাকে অতিক্রম করে এবং যিনি পবিত্র আত্মার দ্বারা পরিচালিত, তিনি ইহারই মধ্যে লুক্কায়িত ‘মান্না’১১ প্রাপ্ত হইবেন।
কিন্তু এ প্রকার অনেক সময়ে হয় যে, অনেকেই খ্রীষ্টের সুসমাচার বারংবার শ্রবণ করিয়াও তাহা লাভের জন্য কিছুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করে না, কারণ তাহারা খ্রীষ্টের আত্মার দ্বারা অনুপ্রাণিত নহে। অতএব যদ্যপি তুমি আনন্দ-হৃদয়ে এবং সম্পূর্ণভাবে খ্রীষ্ট-বাক্যতত্ত্বে অনুপ্রবেশ করিতে চাও, তাহা হইলে তাঁহার জীবনের সহিত তোমার জীবনের সম্পূর্ণ সৌসাদৃশ্য-স্থাপনের জন্য সমধিক যত্নশীল হও।১২
৩। ‘ত্রিত্ববাদ’১৩ সম্বন্ধে গভীর গবেষণায় তোমার কি লাভ হইবে, যদি সেই সমস্ত সময় তোমার নম্রতার অভাব সেই ঐশ্বরিক ত্রিত্বকে অসন্তুষ্ট করে?
নিশ্চয়ই উচ্চ বাক্যচ্ছটা মনুষ্যকে পবিত্র এবং অকপট করিতে পারে না; কিন্তু ধার্মিক জীবন তাহাকে ঈশ্বরের প্রিয় করে।১৪
অনুতাপে হৃদয়শল্য বরং ভোগ করিব—তাহার সর্বলক্ষণাক্রান্ত বর্ণনা জানিতে চাহি না।
যদি সমগ্র বাইবেল এবং সমস্ত দার্শনিকদিগের মত তোমার জানা থাকে, তাহাতে তোমার কি লাভ হইবে, যদি তুমি ঈশ্বরের প্রেম এবং কৃপা-বিহীন হও?১৫
‘অসার হইতেও অসার, সকলেই অসার; সার একমাত্র তাঁহাকে ভালবাসা, সার একমাত্র তাঁহার সেবা।’১৬
তখনই সর্বোচ্চ জ্ঞান তোমার হইবে, যখন তুমি স্বর্গরাজ্য প্রাপ্ত হইবার জন্য সংসারকে ঘৃণা করিবে।
৪। অসারতা—অতএব ধন অন্বেষণ করা এবং সেই নশ্বর পদার্থে বিশ্বাস স্থাপন করা।
অসারতা—অতএব মান অন্বেষণ করা ও উচ্চ পদলাভের চেষ্টা করা।
অসারতা—অতএব শারীরিক বাসনার অনুবর্তী হওয়া এবং যাহা অন্তে কঠিন দণ্ড ভোগ করাইবে তাহার জন্য ব্যাকুল হওয়া।
অসারতা—অতএব জীবনের সদ্ব্যবহারের চেষ্টা না করিয়া দীর্ঘজীবন লাভের ইচ্ছা করা।
অসারতা—অতএব পরকালের সম্বলের চেষ্টা না করিয়া কেবল ইহজীবনের বিষয় চিন্তা করা।
অসারতা—অতএব যথায় অবিনাশী আনন্দ বিরাজমান, দ্রতবেগে সে স্থানে উপস্থিত হইবার চেষ্টা না করিয়া অতিশীঘ্র-বিনাশশীল বস্তুকে ভালবাসা।
৫। উপদেশকের এ বাক্য সর্বদা স্মরণ কর—‘চক্ষু দেখিয়া তৃপ্ত হয় না, কর্ণ শ্রবণ করিয়া তৃপ্ত হয় না।’১৭
পরিদৃশ্যমান পার্থিব পদার্থ হইতে মনের অনুরাগকে উপরত করিয়া অদৃশ্য রাজ্যে হৃদয়ের সমুদয় ভালবাসা প্রতিষ্ঠিত করিতে বিশেষ চেষ্টা কর, যেহেতু ইন্দ্রিয়সকলের অনুগমন করিলে তোমার বুদ্ধিবৃত্তি কলঙ্কিত হইবে এবং তুমি ঈশ্বরের কৃপা হারাইবে।১৮
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আপনার জ্ঞান সম্বন্ধে হীনভাব
১। সকলেই স্বভাবত জ্ঞানলাভের ইচ্ছা করে, কিন্তু ঈশ্বরের ভয় না থাকিলে সে জ্ঞানে লাভ কি?
আপনার আত্মার কল্যাণচিন্তা পরিত্যাগ করিয়া যিনি নক্ষত্রমণ্ডলীর গতিবিধি পর্যালোচনা করিতে ব্যস্ত, সেই গর্বিত পণ্ডিত অপেক্ষা কি—যে দীন কৃষক বিনীতভাবে ঈশ্বরের সেবা করে, সে নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ নহে?
যিনি আপনাকে উত্তমরূপে জানিয়াছেন, তিনিই আপনার চক্ষে আপনি অতি হীন এবং তিনি মনুষ্যের প্রশংসাতে অণুমাত্রও আনন্দিত হইতে পারেন না। যদি আমি জগতের সমস্ত বিষয়ই জানি, কিন্তু আমার নিঃস্বার্থ সহানুভূতি না থাকে, তাহা হইলে যে ঈশ্বর আমার কর্মানুসারে আমার বিচার করিবেন, তাঁহার সমক্ষে আমার জ্ঞান কোন্ উপকারে আসিবে?
২। অত্যন্ত জ্ঞান-লালসাকে পরিত্যাগ কর, কারণ তাহা হইতে অত্যন্ত চিত্তবিক্ষেপ ও ভ্রম আগমন করে।
পণ্ডিত হইলেই বিদ্যা প্রকাশ করিতে এবং প্রতিভাশালী বলিয়া কথিত হইতে বাসনা হয়।
এ প্রকার অনেক বিষয় আছে, যদ্বিষয়ক জ্ঞান আধ্যাত্মিক কোন উপকারে আইসে না এবং তিনি অতি মূর্খ, যিনি যে-সকল বিষয় তাঁহার পরিত্রাণের সহায়তা করিবে, তাহা পরিত্যাগ করিয়া এই-সকল বিষয়ে মন নিবিষ্ট করেন।
বহু বাক্যে আত্মা তৃপ্ত হয় না, পরন্তু সাধুজীবন অন্তঃকরণে শান্তি প্রদান করে এবং পবিত্র বুদ্ধি ঈশ্বরে সমধিক নির্ভর স্থাপিত করে।
৩। তোমার জ্ঞান এবং ধারণাশক্তি যে পরিমাণে অধিক, তোমার তত কঠিন বিচার হইবে, যদি সমধিক জ্ঞানের ফলস্বরূপ তোমার জীবনও সমধিক পবিত্র না হয়।
অতএব, তোমার দক্ষতা এবং বিদ্যার জন্য বহুপ্রশংসিত হইতে ইচ্ছা করিও না; বরং যে জ্ঞান তোমাকে প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাকে ভয়ের কারণ বলিয়া জান।
যদি এ প্রকার চিন্তা আইসে যে, তুমি বহু বিষয় জান এবং বিলক্ষণ বুঝ, স্মরণ রাখিও—যে-সকল বিষয় তুমি জান না, তাহারা সংখ্যায় অনেক অধিক।
জ্ঞানগর্বে স্ফীত হইও না, বরং আপনার অজ্ঞতা স্বীকার কর। তোমা অপেক্ষা কত পণ্ডিত রহিয়াছে, ঈশ্বরাদিষ্ট শাস্ত্রজ্ঞানে তোমা অপেক্ষা কত অভিজ্ঞ লোক রহিয়াছে। ইহা দেখিয়াও কেন তুমি অপরের পূর্বদান অধিকার করিতে চাও?
যদি নিজ কল্যাণপ্রদ কোন বিষয় জানিতে এবং শিখিতে চাও, জগতের নিকট অপরিচিত এবং অকিঞ্চিৎকর থাকিতে ভালবাস।
৪। আপনাকে আপনি যথার্থরূপে জানা অর্থাৎ আপনাকে অতি হীন মনে করা সর্বাপেক্ষা মূল্যবান এবং উৎকৃষ্ট শিক্ষা। আপনাকে নীচ মনে করা এবং অপরকে সর্বদা শ্রেষ্ঠ মনে করা এবং তাহার মঙ্গল কামনা করাই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও সম্পূর্ণতার চিহ্ন।
যদি দেখ, কেহ প্রকাশ্যরূপে পাপ করিতেছে অথবা কেহ কোন অপরাধ করিতেছে, তথাপি আপনাকে উৎকৃষ্ট বলিয়া জানিও না।
আমাদের সকলেরই পতন হইতে পারে; তথাপি তোমার দৃঢ় ধারণা থাকা উচিত যে, তোমা অপেক্ষা অধিক দুর্বল কেহই নাই।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সত্যের শিক্ষা
১। সুখী সেই মনুষ্য, সাঙ্কেতিক চিহ্ন এবং নশ্বর শব্দ পরিত্যাগ করিয়া সত্য স্বয়ং ও স্ব-স্বরূপে যাহাকে শিক্ষা দেয়।
আমাদিগের মত এবং ইন্দ্রিয়সকল প্রায়শ আমাদিগকে প্রতারিত করে; কারণ বস্তুর প্রকৃত তত্ত্বে আমাদের দৃষ্টির গতি অতি অল্প।
গুপ্ত এবং গূঢ় বিষয়সকল ক্রমাগত অনুসন্ধান করিয়া লাভ কি? তাহা না জানার জন্য শেষ বিচারদিনে১৯ আমরা নিন্দিত হইব না।
উপকারক ও আবশ্যক বস্তু পরিত্যাগ করিয়া স্ব-ইচ্ছায় যাহা কেবল কৌতূহল উদ্দীপিত করে এবং অপকারক—এ প্রকার বিষয়ের অনুসন্ধান করা অতি নির্বোধের কার্য; চক্ষু থাকিতেও আমরা দেখিতেছি না!
২। ন্যায়শাস্ত্রীয় পদার্থ-বিচারে আমরা কেন ব্যাপৃত থাকি? তিনিই বহু সন্দেহপূর্ণ তর্ক হইতে মুক্ত হয়েন, সনাতন বাণী২০ যাঁহাকে উপদেশ করেন।
সেই অদ্বিতীয় বাণী হইতে সকল পদার্থ বিনিঃসৃত হইয়াছে, সকল পদার্থ তাঁহাকেই নির্দেশ করিতেছে; তিনিই আদি, তিনিই আমাদিগকে উপদেশ করেন।
তাঁহাকে ছাড়িয়া কেহ কিছু বুঝিতে পারে না অথবা কোন বিষয়ে যথার্থ বিচার করিতে পারে না।
তিনিই অচলভাবে প্রতিষ্ঠিত—তিনিই ঈশ্বরে সংস্থিত, যাঁহার উদ্দেশ্য একটি মাত্র, যিনি সকল পদার্থ এক অদ্বিতীয় কারণে নির্দেশ করেন এবং যিনি এক জ্যোতিতে সমস্ত পদার্থ দর্শন করেন।
হে ঈশ্বর, হে সত্য, অনন্ত প্রেমে আমাকে তোমার সহিত একীভূত করিয়া লও।
বহু বিষয় পাঠ এবং শ্রবণ করিয়া আমি অতি ক্লান্ত হইয়া পড়ি; আমার সকল অভাব, সকল বাসনা তোমাতেই নিহিত।
আচার্যসকল নির্বাক্ হউক, জগৎ তোমার সমক্ষে স্তব্ধ হউক; প্রভো, কেবল তুমি [আমার সহিত কথা] বল।
৩। মানুষের মন যতই সংযত অন্তঃপ্রদেশ হইতে সরল হয়, ততই সে গভীর বিষয়সকলে অতি সহজে প্রবেশ করিতে পারে; কারণ তাহার মন আলোক পায়।
যে ব্যক্তি ঈশ্বরের মাহাত্ম্য-প্রকাশের জন্য সকল কার্য করে, আপনার সম্বন্ধে কার্যহীন থাকে এবং সকল প্রকার স্বার্থশূন্য হয়, সেই প্রকার পবিত্র, সরল ও অটল ব্যক্তি বহু কার্য করিতে হইলেও আকুল হইয়া পড়ে না। হৃদয়ের অনুন্মূলিত আসক্তি অপেক্ষা কোন্ পদার্থ তোমায় অধিকতর বিরক্ত করে বা বাধা দেয়?
ঈশ্বরানুরাগী সাধু ব্যক্তি অগ্রে আপনার মনে যে-সকল বাহিরের কর্তব্য করিতে হইবে, তাহা নির্দিষ্ট করিয়া লন; সেই-সকল কার্য করিতে তিনি কখনও বিকৃত আসক্তি-জনিত ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হন না; পরন্তু সম্যক বিচার দ্বারা আপনার কার্যসকলকে নিয়মিত করেন।
আত্মজয়ের জন্য যিনি চেষ্টা করিতেছেন, তদপেক্ষা কঠিনতর সংগ্রাম কে করে?
আপনাকে আপনি জয় করা, দিন দিন আপনার উপর আধিপত্য বিস্তার করা এবং ধর্মে বর্ধিত হওয়া—ইহাই আমাদিগের একমাত্র কর্তব্য।
৪। এ জগতে সকল পূর্ণতার মধ্যেই অপূর্ণতা আছে এবং আমাদিগের কোন তত্ত্বানুসন্ধানই একেবারে সন্দেহরহিত হয় না।
গভীর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বানুসন্ধান অপেক্ষা আপনাকে অকিঞ্চিৎকর বলিয়া জ্ঞান করা ঈশ্বরপ্রাপ্তির নিশ্চিত পথ।
কিন্তু বিদ্যা গুণমাত্র বলিয়া অথবা কোন বিষয়ের জ্ঞানদায়ক বলিয়া বিবেচিত হইলে নিন্দিত নহে; কারণ উহা কল্যাণপ্রদ ও ঈশ্বরাদিষ্ট।
কিন্তু ইহাই বলা হইতেছে যে, সদ্বুদ্ধি এবং সাধুজীবন বিদ্যা অপেক্ষা প্রার্থনীয়।
অনেকেই সাধু হওয়া অপেক্ষা বিদ্বান হইতে অধিক যত্ন করে; তাহার ফল এই হয় যে, অনেক সময় তাহারা কুপথে বিচরণ করে এবং তাহাদের পরিশ্রম অত্যল্প ফল উৎপাদন করে অথবা নিষ্ফল হয়।
৫। অহো! সন্দেহ উত্থাপিত করিতে মানুষ যে প্রকার যত্নশীল, পাপ উন্মূলিত করিতে ও পুণ্য রোপণ করিতে যদি সেই প্রকার হইত, তাহা হইলে পৃথিবীতে এবম্প্রকার অমঙ্গল ও পাপকার্যের বিবরণ [আলোচনা] থাকিত না এবং ধার্মিকদিগের [ধর্মসংস্থাগুলির] মধ্যে এতাদৃশী উচ্ছৃঙ্খলতা থাকিত না।
নিশ্চিত শেষ-বিচারদিনে—‘কি পড়িয়াছি’, তাহা জিজ্ঞাসিত হইবে না; ‘কি করিয়াছি’ তাহাই জিজ্ঞাসিত হইবে। কি পটুতাসহকারে বাক্যবিন্যাস করিয়াছি, তাহা জিজ্ঞাসিত হইবে না; ধর্মে কতদূর জীবন কাটাইয়াছি, তাহাই জিজ্ঞাসিত হইবে।
যাঁহাদের সহিত জীবদ্দশায় তুমি উত্তমরূপে পরিচিত ছিলে এবং যাঁহারা আপন আপন ব্যবসায়ে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, সেই-সকল পণ্ডিত এবং অধ্যাপকেরা কোথায় বলিতে পার?
অপরে তাঁহাদিগের স্থান অধিকার করিতেছে এবং নিশ্চিত বলিতে পারি, তাহারা তাঁহাদের বিষয় একবার চিন্তাও করে না!
জীবদ্দশায় তাঁহারা সারবান্ বলিয়া বিবেচিত হইতেন, এক্ষণে কেহ তাঁহাদের কথাও কহেন না।
৬। অহো! সাংসারিক গরিমা কি শীঘ্রই চলিয়া যায়! আহা! তাঁহাদের জীবন যদি তাঁহাদের জ্ঞানের সদৃশ হইত, তাহা হইলে বুঝিতাম যে তাঁহাদের পাঠ এবং চিন্তা কার্যের হইয়াছে।
ঈশ্বরের সেবাতে কোন যত্ন না করিয়া বিদ্যামদে এ সংসারে কত লোকই বিনষ্ট হয়!
জগতে তাহারা দীনহীন হইতে চাহে না, তাহারা মহৎ বলিয়া পরিচিত হইতে চায়; সেইজন্যই আপনার কল্পনা-চক্ষে আপনি অতি গর্বিত হয়।
তিনিই বাস্তবিক মহান্, যাঁহার নিঃস্বার্থ সহানুভূতি আছে।
তিনিই বাস্তবিক মহান্, যিনি আপনার চক্ষে আপনি অতি ক্ষুদ্র এবং উচ্চপদলাভ রূপ সম্মানকে অতি তুচ্ছ বোধ করেন।
তিনিই যথার্থ জ্ঞানী, যিনি খ্রীষ্টকে প্রাপ্ত হইবার জন্য সকল পার্থিব পদার্থকে বিষ্ঠার ন্যায় জ্ঞান করেন।
তিনিই যথার্থ পণ্ডিত, যিনি ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরিচালিত হন এবং আপনার ইচ্ছাকে পরিত্যাগ করেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
কার্যে বুদ্ধিমত্তা
১। প্রত্যেক প্রবাদ অথবা মনোবেগজনিত ইচ্ছাকে বিশ্বাস করা আমাদের কখনও উচিত নহে, পরন্তু সতর্কতা এবং ধৈর্যসহকারে উক্ত বিষয়ের ঈশ্বরের সহিত সম্বন্ধ বিচার করিবে।
আহা! আমরা এমনি দুর্বল যে, আমরা প্রায়ই অতি সহজে অপরের সুখ্যাতি অপেক্ষা নিন্দা বিশ্বাস করি এবং রটনা করি। যাঁহারা পবিত্রতায় উন্নত, তাঁহারা সহসা সকল মন্দ প্রবাদে বিশ্বাস স্থাপন করেন না; কারণ তাঁহারা জানেন যে, মনুষ্যের দুর্বলতা মনুষ্যকে অপরের মন্দ রটাইতে এবং মিথ্যা বলিতে অত্যন্ত প্রবণ করে।
২। যিনি কার্যে হঠকারী নহেন এবং সবিশেষ বিপরীত প্রমাণ সত্ত্বে (থাকিলে) আপন মতে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন না, যিনি যাহাই শুনেন তাহাই বিশ্বাস করেন না এবং শুনিলেও তাহা তৎক্ষণাৎ রটনা করেন না, তিনি অতি বুদ্ধিমান্।
৩। বুদ্ধিমান্ ও সদ্বিবেচক লোকদিগের নিকট হইতে উপদেশ অন্বেষণ করিবে এবং নিজ বুদ্ধির অনুসরণ না করিয়া তোমা অপেক্ষা যাঁহারা অধিক জানেন, তাঁহাদের দ্বারা উপদিষ্ট হওয়া উত্তম বিবেচনা করিবে।
সাধুজীবন মনুষ্যকে ঈশ্বরের গণনায় বুদ্ধিমান্ করে এবং এই প্রকার ব্যক্তি যথার্থ বহুদর্শন লাভ করে। যিনি আপনাকে আপনি যত অকিঞ্চিৎকর বলিয়া জানেন এবং যিনি যত পরিমাণে ঈশ্বরের ইচ্ছার অধীন, তিনি সর্বদা তত পরিমাণে বুদ্ধিমান্ এবং শান্তিপূর্ণ হইবেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
শাস্ত্রপাঠ
১। সত্যের অনুসন্ধান শাস্ত্রে করিতে হইবে, বাক্চাতুর্যে নহে। যে পরমাত্মার প্রেরণায় বাইবেল লিখিত হইয়াছে, তাহারই সাহায্যে বাইবেল সর্বদা পড়া উচিত।২১
শাস্ত্রপাঠকালে কূটতর্ক পরিত্যাগ করিয়া আমাদের কল্যাণমাত্র অনুসন্ধান করা কর্তব্য।
যে-সকল পুস্তকে পাণ্ডিত্যসহকারে এবং গভীরভাবে প্রস্তাবিত বিষয় লিখিত আছে, তাহা পড়িতে আমাদের যে-প্রকার আগ্রহ, অতি সরলভাবে লিখিত যে-কোন ভক্তির গ্রন্থে সেই প্রকার আগ্রহ থাকা উচিত।
গ্রন্থকারের প্রসিদ্ধি অথবা অপ্রসিদ্ধি যেন তোমার মনকে বিচলিত না করে। কেবল সত্যের প্রতি তোমার ভালবাসা দ্বারা পরিচালিত হইয়া তুমি পাঠ কর।২২
‘কে লিখিয়াছে’ সে তত্ত্ব না লইয়া ‘কি লিখিয়াছে’ তাহাই যত্নপূর্বক বিচার করা উচিত।
২। মানুষ চলিয়া যায়, কিন্তু ঈশ্বরের সত্য চিরকাল থাকে।
নানারূপে ঈশ্বর আমাদিগকে বলিতেছেন, তাঁহার কাছে ব্যক্তিবিশেষের আদর নাই।
অনেক সময় শাস্ত্র পড়িতে পড়িতে যে-সকল কথা আমাদের কেবল দেখিয়া যাওয়া উচিত, সেই-সকল কথার মর্মভেদ ও আলোচনা করিবার জন্য আমরা ব্যগ্র হইয়া পড়ি। এই প্রকারে আমাদের কৌতূহল আমাদের অনেক সময় বাধা দেয়।
যদি উপকার বাঞ্ছা কর, নম্রতা সরলতা ও বিশ্বাসের সহিত পাঠ কর এবং কখনও পণ্ডিত বলিয়া পরিচিত হইবার বাসনা রাখিও না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অত্যন্ত আসক্তি
১। যখন কোন মানুষ কোন বস্তুর জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হয়, তখনই তাহার আভ্যন্তরিক শান্তি নষ্ট হয়।২৩
অভিমানী এবং লোভীরা কখনও শান্তি পায় না, কিন্তু অকিঞ্চন এবং বিনীত লোকেরা সদা শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করে। যে মানুষ স্বার্থ সম্বন্ধে এখনও সম্পূর্ণ মৃত হয় নাই, সে শীঘ্রই প্রলোভিত হয় এবং অতি সামান্য ও অকিঞ্চিৎকর বিষয়সকল তাহাকে পরাভূত করে।২৪
যাহার আত্মা দুর্বল ও এখনও কিয়ৎপরিমাণে ইন্দ্রিয়ের বশীভূত এবং যে-সকল পদার্থ কালে উৎপন্ন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভবের উপর যাহাদের সত্তা বিদ্যমান, সেই-সকল বিষয়ে আসক্তিসম্পন্ন পার্থিব বাসনা হইতে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করা তাহার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ। সেই জন্যই যখন সে অনিত্য পদার্থসকল কোনরূপে পরিত্যাগ করে, তখনও সর্বদা তাহার মন বিমর্ষ থাকে এবং কেহ তাহাকে বাধা দিলে সহজেই ক্রুদ্ধ হয়।
তাহার উপর যদি সে কামনার অনুগমন করিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার মন পাপের ভার অনুভব করে; কারণ যে শান্তি সে অনুসন্ধান করিতেছিল, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পরাভূত হইয়া তাহার দিকে আর সে অগ্রসর হইতে পারিল না।
অতএব মনের যথার্থ শান্তি ইন্দ্রিয়জয়ের দ্বারাই হয়; ইন্দ্রিয়ের অনুগমন করিলে হয় না। অতএব যে ব্যক্তি সুখাভিলাষী, তাহার হৃদয়ে শান্তি নাই; যে ব্যক্তি অনিত্য বাহ্য বিষয়ের অনুসরণ করে, তাহারও মনে শান্তি নাই; কেবল যিনি আত্মারাম এবং যাঁহার অনুরাগ তীব্র, তিনিই শান্তি ভোগ করেন।২৫
[‘উদ্বোধন’-এর প্রস্তাবনা]
ভারতের প্রাচীন ইতিবৃত্ত—এক দেবপ্রতিম জাতির অলৌকিক উদ্যম, বিচিত্র চেষ্টা, অসীম উৎসাহ, অপ্রতিহত শক্তিসংঘাত ও সর্বাপেক্ষা অতি গভীর চিন্তাশীলতায় পরিপূর্ণ। ইতিহাস অর্থাৎ রাজা-রাজড়ার কথা ও তাঁহাদের কাম-ক্রোধ-ব্যসনাদির দ্বারা কিয়ৎকাল পরিক্ষুব্ধ, তাঁহাদের সুচেষ্টা-কুচেষ্টায় সাময়িক বিচলিত সামাজিক চিত্র হয়তো প্রাচীন ভারতে একেবারেই নাই। কিন্তু ক্ষুৎপিপাসা-কাম-ক্রোধাদি-বিতাড়িত, সৌন্দর্যতৃষ্ণাকৃষ্ট ও মহান্ অপ্রতিহতবুদ্ধি, নানাভাব-পরিচালিত একটি অতি বিস্তীর্ণ জনসঙ্ঘ, সভ্যতার উন্মেষের প্রায় প্রাক্কাল হইতেই নানাবিধ পথ অবলম্বন করিয়া যে স্থানে সমুপস্থিত হইয়াছিলেন—ভারতের ধর্মগ্রন্থরাশি, কাব্যসমুদ্র, দর্শনসমূহ ও বিবিধ বৈজ্ঞানিক তন্ত্রশ্রেণী, প্রতি ছত্রে তাঁহার প্রতি পদবিক্ষেপ, রাজাদিপুরুষবিশেষবর্ণনাকারী পুস্তকনিচয়াপেক্ষা লক্ষগুণ স্ফুটীকৃতভাবে দেখাইয়া দিতেছে। প্রকৃতির সহিত যুগযুগান্তরব্যাপী সংগ্রামে তাঁহারা যে রাশীকৃত জয়পতাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন, আজ জীর্ণ ও বাত্যাহত হইয়াও সেগুলি প্রাচীন ভারতের জয় ঘোষণা করিতেছে।
এই জাতি মধ্য-এশিয়া, উত্তর ইওরোপ বা সুমেরু-সন্নিহিত হিমপ্রধান প্রদেশ হইতে শনৈঃ-পদসঞ্চারে পবিত্র ভারতভূমিকে তীর্থরূপে পরিণত করিয়াছিলেন বা এই তীর্থভূমিই তাঁহাদের আদিম নিবাস—এখনও জানিবার উপায় নাই।
অথবা ভারতমধ্যস্থ বা ভারতবহির্ভূত-দেশবিশেষনিবাসী একটি বিরাট জাতি নৈসর্গিক নিয়মে স্থান ভ্রষ্ট হইয়া ইওরোপাদি ভূমিতে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছেন এবং তাঁহারা শ্বেতকায় বা কৃষ্ণকায়, নীলচক্ষু বা কৃষ্ণচক্ষু, কৃষ্ণকেশ বা হিরণ্যকেশ ছিলেন—কতিপয় ইওরোপীয় জাতির ভাষার সহিত সংস্কৃত ভাষার সাদৃশ্য ব্যতিরেকে, এই-সকল সিদ্ধান্তের আর কোন প্রমাণ নাই। আধুনিক ভারতবাসী তাঁহাদের বংশধর কিনা, অথবা ভারতের কোন্ জাতি কত পরিমাণে তাঁহাদের শোণিত বহন করিতেছেন, এ-সকল প্রশ্নেরও মীমাংসা সহজ নহে।
অনিশ্চিতত্বেও আমাদের বিশেষ ক্ষতি নাই।
তবে যে জাতির মধ্যে সভ্যতার উন্মীলন হইয়াছে, যেথায় চিন্তাশীলতা পরিস্ফুট হইয়াছে, সেই স্থানে লক্ষ লক্ষ তাঁহাদের বংশধর—মানসপুত্র—তাঁহাদের ভাবরাশির, চিন্তারাশির উত্তরাধিকারী উপস্থিত। নদী, পর্বত, সমুদ্র, উল্লঙ্খন করিয়া, দেশকালের বাধা যেন তুচ্ছ করিয়া, সুপরিস্ফুট বা অজ্ঞাত অনির্বচনীয় সূত্রে ভারতীয় চিন্তারুধির অন্য জাতির ধমনীতে পঁহুছিয়াছে এবং এখনও পঁহুছিতেছে।
হয়তো আমাদের ভাগে সার্বভৌম পৈতৃক সম্পত্তি কিছু অধিক।
ভূমধ্যসাগরের পূর্বকোণে সুঠাম সুন্দর দ্বীপমালা-পরিবেষ্টিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-বিভূষিত একটি ক্ষুদ্র দেশে অল্পসংখ্যক অথচ সর্বাঙ্গসুন্দর, পূর্ণাবয়ব অথচ দৃঢ়স্নায়ুপেশীসমন্বিত, লঘুকায় অথচ অটল-অধ্যাবসায়-সহায়, পার্থিব সৌন্দর্যসৃষ্টির একাধিরাজ, অপূর্ব ক্রিয়াশীল, প্রতিভাশালী এক জাতি ছিলেন। অন্যান্য প্রাচীন জাতিরা ইঁহাদিগকে ‘যবন’ বলিত; ইহাদের নিজ নাম—গ্রীক।
মনুষ্য-ইতিহাসে এই মুষ্টিমেয় অলৌকিক বীর্যশালী জাতি এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। যে দেশে মনুষ্য পার্থিব বিদ্যায়—সমাজনীতি, যুদ্ধনীতি, দেশশাসন, ভাস্কর্যাদি শিল্পে—অগ্রসর হইয়াছেন বা হইতেছেন, সেই স্থানেই প্রাচীন গ্রীসের ছায়া পড়িয়াছে। প্রাচীন কালের কথা ছাড়িয়া দেওযা যাউক, আমরা আধুনিক বাঙ্গালী—আজ অর্ধশতাব্দী ধরিয়া ঐ যবন গুরুদিগের পদানুসরণ করিয়া ইওরোপীয় সাহিত্যের মধ্য দিয়া তাঁহাদের যে আলোটুকু আসিতেছে, তাহারই দীপ্তিতে আপনাদিগের গৃহ উজ্জ্বলিত করিয়া স্পর্ধা অনুভব করিতেছি।
সমগ্র ইওরোপ আজ সর্ববিষয়ে প্রাচীন গ্রীসের ছাত্র এবং উত্তরাধিকারী; এমন কি, একজন ইংলণ্ডীয় পণ্ডিত বলিয়াছেন, ‘যাহা কিছু প্রকৃতি সৃষ্টি করেন নাই, তাহা গ্রীক মনের সৃষ্টি।’
সুদূরস্থিত বিভিন্নপর্বত-সমুৎপন্ন এই দুই মহানদীর মধ্যে মধ্যে সঙ্গম উপস্থিত হয়; এবং যখন ঐ প্রকার ঘটনা ঘটে, তখনই জনসমাজে এক মহা আধ্যাত্মিক তরঙ্গে উত্তোলিত সভ্যতা-রেখা সুদূর-সম্প্রসারিত [হয়] এবং মানবমধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন দৃঢ়তর হয়।
অতি প্রাচীনকালে একবার ভারতীয় দর্শনবিদ্যা গ্রীক উৎসাহের সম্মিলনে রোমক, ইরানী প্রভৃতি মহা-জাতিবর্গের অভ্যুদয় সূত্রিত করে। সিকন্দরসাহের দিগ্বিজয়ের পর এই দুই মহাজলপ্রপাতের সংঘর্ষে প্রায় অর্ধ ভূভাগ ঈশাদি-নামাখ্যাত অধ্যাত্ম-তরঙ্গরাজি উপপ্লাবিত করে। আরবদিগের অভ্যুদয়ের সহিত পুনরায় ঐ প্রকার মিশ্রণ আধুনিক ইওরোপীয় সভ্যতার ভিত্তিস্থাপন করে এবং বোধ হয়, আধুনিক সময়ে পুনর্বার ঐ দুই মহাশক্তির সম্মিলন-কাল উপস্থিত।
এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ।
ভারতের বায়ু শান্তিপ্রধান, যবনের প্রাণ শক্তিপ্রধান; একের গভীর চিন্তা, অপরের অদম্য কার্যকারিতা; একের মূলমন্ত্র ‘ত্যাগ’, অপরের ‘ভোগ’; একের সর্বচেষ্টা অন্তর্মুখী, অপরের বহির্মুখী; একের প্রায় সর্ববিদ্যা অধ্যাত্ম, অপরের অধিভূত; একজন মুক্তিপ্রিয়, অপর স্বাধীনতাপ্রাণ; একজন ইহলোক-কল্যাণলাভে নিরুৎসাহ, অপর এই পৃথিবীকে স্বর্গভূমিতে পরিণত করিতে প্রাণপণ; একজন নিত্যসুখের আশায় ইহলোকের অনিত্য সুখকে উপেক্ষা করিতেছেন, অপর নিত্যসুখে সন্দিহান হইয়া বা দূরবর্তী জানিয়া যথাসম্ভব ঐহিক সুখলাভে সমুদ্যত।
এ যুগে পূর্বোক্ত জাতিদ্বয়ই অন্তর্হিত হইয়াছেন, কেবল তাঁহাদের শারীরিক বা মানসিক বংশধরেরা বর্তমান।
ইওরোপ-আমেরিকা যবনদিগের সমুন্নত মুখোজ্জ্বলকারী সন্তান; আধুনিক ভারতবাসী আর্যকুলের গর্ব নহেন।
কিন্তু ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় এই আধুনিক ভারতবাসীতেও অন্তর্নিহিত পৈতৃক শক্তি বিদ্যমান। যথাকালে মহাশক্তির কৃপায় তাহার পুনঃস্ফুরণ হইবে।
প্রস্ফুরিত হইয়া কি হইবে?
পুনর্বার কি বৈদিক যজ্ঞধূমে ভারতের আকাশ তরলমেঘাবৃত প্রতিভাত হইবে, বা পশুরক্তে রন্তিদেবের কীর্তির পুনরুদ্দীপন হইবে? গোমেধ, অশ্বমেধ, দেবরের দ্বারা সুতোৎপত্তি আদি প্রাচীন প্রথা পুনরায় কি ফিরিয়া আসিবে বা বৌদ্ধোপপ্লাবনে পুনর্বার সমগ্র ভারত একটি বিস্তীর্ণ মঠে পরিণত হইবে? মনুর শাসন পুনরায় কি অপ্রতিহত-প্রভাবে প্রতিষ্ঠিত হইবে বা দেশভেদে বিভিন্ন ভক্ষ্যাভক্ষ্য-বিচারই আধুনিক কালের ন্যায় সর্বতোমুখী প্রভুতা উপভোগ করিবে? জাতিভেদ বিদ্যমান থাকিবে?—গুণগত হইবে বা চিরকাল জন্মগত থাকিবে? জতিভেদে ভক্ষ্যসম্বন্ধে স্পৃষ্টাস্পৃষ্ট-বিচার বঙ্গদেশের ন্যায় থাকিবে, বা মান্দ্রাজাদির ন্যায় কঠোরতর রূপ ধারণ করিবে, অথবা পঞ্জাবাদি প্রদেশের ন্যায় একেবারে তিরোহিত হইয়া যাইবে? বর্ণভেদে যৌন২৬ সম্বন্ধ মনূক্ত ধর্মের ন্যায় এবং নেপালাদি দেশের ন্যায় অনুলোমক্রমে পুনঃপ্রচলিত হইবে বা বঙ্গাদি দেশের ন্যায় একবর্ণ-মধ্যে অবান্তর বিভাগেও প্রতিবদ্ধ হইয়া অবস্থান করিবে? এ-সকল প্রশ্নের সিদ্ধান্ত করা অতীব দুরূহ। দেশভেদে, এমন কি, একই দেশে জাতি এবং বংশভেদে আচারের ঘোর বিভিন্নতা দৃষ্টে মীমাংসা আরও দুরূহতর প্রতীত হইতেছে।
তবে হইবে কি?
যাহা আমাদের নাই, বোধ হয় পূর্বকালেও ছিল না। যাহা যবনদিগের ছিল, যাহার প্রাণস্পন্দনে ইওরোপীয় বিদ্যুদাধার হইতে ঘন ঘন মহাশক্তির সঞ্চার হইয়া ভূমণ্ডল পরিব্যাপ্ত করিতেছে, চাই তাহাই। চাই—সেই উদ্যম, সেই স্বাধীনতাপ্রিয়তা, সেই আত্মনির্ভর, সেই অটল ধৈর্য, সেই কার্যকারিতা, সেই একতাবন্ধন, সেই উন্নতিতৃষ্ণা; চাই—সর্বদা-পশ্চাদ্দৃষ্টি কিঞ্চিৎ স্থগিত করিয়া অনন্ত সম্মুখসম্প্রসারিত দৃষ্টি, আর চাই—আপাদমস্তক শিরায় শিরায় সঞ্চারকারী রজোগুণ।
ত্যাগের অপেক্ষা শান্তিদাতা কে? অনন্ত কল্যাণের তুলনায় ক্ষণিক ঐহিক কল্যাণ নিশ্চিত অতি তুচ্ছ। সত্ত্বগুণাপেক্ষা মহাশক্তিসঞ্চয় আর কিসে হয়? অধ্যাত্মবিদ্যার তুলনায় আর সব ‘অবিদ্যা’—সত্য বটে, কিন্তু কয়জন এ জগতে সত্ত্বগুণ লাভ করে—এ ভারতে কয়জন? সে মহাবীরত্ব কয়জনের আছে যে, নির্মম হইয়া সর্বত্যাগী হন? সে দূরদৃষ্টি কয়জনের ভাগ্যে ঘটে, যাহাতে পার্থিব সুখ তুচ্ছ বোধ হয়? সে বিশাল হৃদয় কোথায়, যাহা সৌন্দর্য ও মহিমাচিন্তায় নিজ শরীর পর্যন্ত বিস্মৃত হয়? যাঁহারা আছেন, সমগ্র ভারতের লোকসংখ্যার তুলনায় তাঁহারা মুষ্টিমেয়।—আর এই মুষ্টিমেয় লোকের মুক্তির জন্য কোটি কোটি নরনারীকে সামাজিক আধ্যাত্মিক চক্রের নীচে নিষ্পিষ্ট হইতে হইবে?
এ পেষণেরই বা কি ফল?
দেখিতেছ না যে, সত্ত্বগুণের ধুয়া ধরিয়া ধীরে ধীরে দেশ তমোগুণসমুদ্রে ডুবিয়া গেল। যেথায় মহাজড়বুদ্ধি পরাবিদ্যানুরাগের ছলনায় নিজ মূর্খতা আচ্ছাদিত করিতে চাহে; যেথায় জন্মালস বৈরাগ্যের আবরণ নিজের অকর্মণ্যতার উপর নিক্ষেপ করিতে চাহে; যেথায় ক্রুরকর্মী তপস্যাদির ভান করিয়া নিষ্ঠুরতাকেও ধর্ম করিয়া তুলে; যেথায় নিজের সামর্থ্যহীনতার উপর দৃষ্টি কাহারও নাই—কেবল অপরের উপর সমস্ত দোষনিক্ষেপ; বিদ্যা কেবল কতিপয় পুস্তক-কণ্ঠস্থে, প্রতিভা চর্বিত-চর্বণে এবং সর্বোপরি গৌরব কেবল পিতৃপুরুষের নাম-কীর্তনে—সে দেশ তমগুণে দিন দিন ডুবিতেছে, তাহার কি প্রমাণান্তর চাই?
অতএব সত্ত্বগুণ এখনও বহুদূর। আমাদের মধ্যে যাঁহারা পরমহংসপদবীতে উপস্থিত হইবার যোগ্য নহেন বা ভবিষ্যতে [হইবার] আশা রাখেন, তাঁহাদের পক্ষে রজোগুণের আবির্ভাবই পরম কল্যাণ। রজোগুণের মধ্য দিয়া না যাইলে কি সত্ত্বে উপনীত হওয়া যায়? ভোগ শেষ না হইলে যোগ কি করিবে? বিরাগ না হইলে ত্যাগ কোথা হইতে আসিবে?
অপর দিকে তালপত্রবহ্নির ন্যায় রজোগুণ শীঘ্রই নির্বাণোন্মুখ, সত্ত্বের সন্নিধান নিত্যবস্তুর নিকটতম, সত্ত্ব প্রায় নিত্য, রজোগুণপ্রধান জাতি দীর্ঘজীবন লাভ করে না, সত্ত্বগুণপ্রধান যেন চিরজীবী; ইহার সাক্ষী ইতিহাস।
ভারতে রজোগুণের প্রায় একান্ত অভাব; পাশ্চাত্যে সেই প্রকার সত্ত্বগুণের। ভারত হইতে সমানীত সত্ত্বধারার উপর পাশ্চাত্য জগতের জীবন নির্ভর করিতেছে নিশ্চিত, এবং নিম্নস্তরে তমোগুণকে পরাহত করিয়া রজোগুণপ্রবাহ প্রতিবাহিত না করিলে আমাদের ঐহিক কল্যাণ যে সমুৎপাদিত হইবে না ও বহুধা পারলৌকিক কল্যাণের বিঘ্ন উপস্থিত হইবে, ইহাও নিশ্চিত।
এই দুই শক্তির সম্মিলনের ও মিশ্রণের যথাসাধ্য সহায়তা করা ‘উদ্বোধন’-এর জীবনোদ্দেশ্য।
যদ্যপি ভয় আছে যে, এই পাশ্চাত্যবীর্যতরঙ্গে আমাদের বহুকালার্জিত রত্নরাজি বা ভাসিয়া যায়; ভয় হয়, পাছে প্রবল আবর্তে পড়িয়া ভারতভূমিও ঐহিক ভোগলাভের রণভূমিতে আত্মহারা হইয়া যায়; ভয় হয়, পাছে অসাধ্য অসম্ভব এবং মূলোচ্ছেদকারী বিজাতীয় ঢঙের অনুসরণ করিতে যাইয়া আমরা ‘ইতোনষ্টস্ততোভ্রষ্টঃ’ হইয়া যাই। এই জন্য ঘরের সম্পত্তি সর্বদা সম্মুখে রাখিতে হইবে; যাহাতে অসাধারণ সকলে তাহাদের পিতৃধন সর্বদা জানিতে ও দেখিতে পারে, তাহার প্রযত্ন করিতে হইবে ও সঙ্গে সঙ্গে নির্ভীক হইয়া সর্বদ্বার উন্মুক্ত করিতে হইবে। আসুক চারিদিক হইতে রশ্মিধারা, আসুক তীব্র পাশ্চাত্য কিরণ। যাহা দুর্বল দোষমুক্ত, তাহা মরণশীল—তাহা লইয়াই বা কি হইবে? যাহা বীর্যবান্ বলপ্রদ, তাহা অবিনশ্বর; তাহার নাশ কে করে?
কত পর্বতশিখর হইতে কত হিমনদী, কত উৎস, কত জলধারা উচ্ছ্বসিত হইয়া বিশাল সুর-তরঙ্গিণীরূপে মহাবেগে সমুদ্রাভিমুখে যাইতেছে। কত বিভিন্ন প্রকারের ভাব, কত শক্তিপ্রবাহ—দেশদেশান্তর হইতে কত সাধুহৃদয়, কত ওজস্বী মস্তিষ্ক হইতে প্রসূত হইয়া নর-রঙ্গক্ষেত্র কর্মভূমি—ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছে। লৌহবর্ত্ম-বাষ্পপোতবাহন ও তড়িৎসহায় ইংরেজের আধিপত্যে বিদ্যুদ্বেগে নানাবিধ ভাব—রীতিনীতি দেশমধ্যে বিস্তীর্ণ হইয়া পড়িতেছে। অমৃত আসিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে গরলও আসিতেছে; ক্রোধ-কোলাহল, রুধিরপাতাদি সমস্তই হইয়া গিয়াছে—এ তরঙ্গরোধের শক্তি হিন্দুসমাজে নাই। যন্ত্রোদ্ধৃত জল হইতে মৃতজীবাস্থি-বিশোধিত শর্করা পর্যন্ত সকলই বহু-বাগাড়ম্বরসত্ত্বেও, নিঃশব্দে গলাধঃকৃত হইল; আইনের প্রবল প্রভাবে, ধীরে ধীরে, অতি যত্নে রক্ষিত রীতিগুলিরও অনেকগুলি ক্রমে ক্রমে খসিয়া পড়িতেছে—রাখিবার শক্তি নাই। নাই বা কেন? সত্য কি বাস্তবিক শক্তিহীন? ‘সত্যমেব জয়তে নানৃতম্’—এই বেদবাণী কি মিথ্যা? অথবা যেগুলি পাশ্চাত্য রাজশক্তি বা শিক্ষাশক্তির উপপ্লাবনে ভাসিয়া যাইতেছে, সেই আচরণগুলিই অনাচার ছিল? ইহাও বিশেষ বিচারের বিষয়।
‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ নিঃস্বার্থভাবে ভক্তিপূর্ণহৃদয়ে এই-সকল প্রশ্নের মীমাংসার জন্য ‘উদ্বোধন’ সহৃদয় প্রেমিক বুধমণ্ডলীকে আহ্বান করিতেছে এবং দ্বেষ-বুদ্ধিবিরহিত ও ব্যক্তিগত বা সমাজগত বা সম্প্রদায়গত কুবাক্যপ্রয়োগে বিমুখ হইয়া সকল সম্প্রদায়ের সেবার জন্যই আপনার শরীর অর্পণ করিতেছে।
কার্যে আমাদের অধিকার, ফল প্রভুর হস্তে; আমরা কেবল বলি—হে ওজঃস্বরূপ! আমাদিগকে ওজস্বী কর; হে বীর্যস্বরূপ! আমাদিগকে বীর্যবান্ কর; হে বলস্বরূপ! আমাদিগকে বলবান্ কর।
[১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে ২০ ফেব্রুআরী আমেরিকা হইতে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার সম্পাদককে স্বামীজী যে পত্র লিখেন, তাহা হইতে উদ্ধৃত।]
আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃতয় সমস্ত বিদ্যা থাকার দরুন, বিদ্বান এবং সাধারণের মধ্যে একটা অপার সমুদ্র দাঁড়িয়ে গেছে। বুদ্ধ থেকে চৈতন্য রামকৃষ্ণ পর্যন্ত—যাঁরা ‘লোকহিতায়’ এসেছেন, তাঁরা সকলেই সাধারণ লোকের ভাষায় সাধারণকে শিক্ষা দিয়েছেন। পাণ্ডিত্য অবশ্য উৎকৃষ্ট; কিন্তু কটমট ভাষা—যা অপ্রাকৃতিক, কল্পিত মাত্র, তাতে ছাড়া কি আর পাণ্ডিত্য হয় না? চলিত ভাষায় কি আর শিল্পনৈপুণ্য হয় না? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের করে কি হবে? যে ভাষায় ঘরে কথা কও, তাতেই তো সমস্ত পাণ্ডিত্য গবেষণা মনে মনে কর; তবে লেখবার বেলা ও একটা কি কিম্ভূতকিমাকার উপস্থিত কর? যে ভাষায় নিজের মনে দর্শন-বিজ্ঞান চিন্তা কর, দশজনে বিচার কর—সে ভাষা কি দর্শন-বিজ্ঞান লেখবার ভাষা নয়? যদি না হয় তো নিজের মনে এবং পাঁচজনে ও-সকল তত্ত্ববিচার কেমন করে কর? স্বাভাবিক যে ভাষায় মনের ভাব আমরা প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ দুঃখ ভালবাসা ইত্যাদি জানাই, তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হতে পারেই না; সেই ভাব, সেই ভঙ্গি, সেই সমস্ত ব্যবহার করে যেতে হবে। ও ভাষার যেমন জোর, যেমন অল্পের মধ্যে অনেক, যেমন যে-দিকে ফেরাও সে-দিকে ফেরে, তেমন কোন তৈরী ভাষা কোন কালে হবে না। ভাষাকে করতে হবে—যেমন সাফ্ ইস্পাত, মুচড়ে মুচড়ে যা ইচ্ছে কর—আবার যে-কে-সেই, এক চোটে পাথর কেটে দেয়, দাঁত পড়ে না। আমাদের ভাষা—সংস্কৃত গদাই-লস্করি চাল—ঐ এক-চাল নকল করে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ভাষা হচ্ছে উন্নতির প্রধান উপায়—লক্ষণ।
যদি বল ও-কথা বেশ; তবে বাঙ্গালা দেশের স্থানে স্থানে রকমারী ভাষা, কোন্টি গ্রহণ করব? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান্ হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকেতার ভাষা। পূর্ব-পশ্চিম, যেদিক হতেই আসুক না, একবার কলকেতার হাওয়া খেলেই দেখছি সেই ভাষাই লোকে কয়। তখন প্রকৃতি আপনিই দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, কোন্ ভাষা লিখতে হবে, যত রেল এবং গতাগতির সুবিধা হবে, তত পূর্ব-পশ্চিমী ভেদ উঠে যাবে, এবং চট্টগ্রাম হতে বৈদ্যনাথ পর্যন্ত ঐ কলকেতার ভাষাই চলবে। কোন্ জেলার ভাষা সংস্কৃতর বেশী নিকট, সে কথা হচ্ছে না—কোন্ ভাষা জিতছে সেইটি দেখ। যখন দেখতে পাচ্ছি যে, কলকেতার ভাষাই অল্প দিনে সমস্ত বাঙ্গলা দেশের ভাষা হয়ে যাবে, তখন যদি পুস্তকের ভাষা এবং ঘরে-কথা-কওয়া ভাষা এক করতে হয় তো বুদ্ধিমান্ অবশ্যই কলকেতার ভাষাকে ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ করবেন। এথায় গ্রাম্য ঈর্ষাটিকেও জলে ভাসান দিতে হবে। সমস্ত দেশের যাতে কল্যাণ, সেথা তোমার জেলা বা গ্রামের প্রাধান্যটি ভুলে যেতে হবে। ভাষা ভাবের বাহক। ভাবই প্রধান; ভাষা পরে। হীরেমতির সাজ-পরান ঘোড়ার উপর বাঁদর বসালে কি ভাল দেখায়? সংস্কৃতর দিকে দেখ দিকি। ‘ব্রাহ্মণ’-এর সংস্কৃত দেখ, শবরস্বামীর ‘মীমাংসাভাষ্য’ দেখ, পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ দেখ, শেষ আচার্য শঙ্করের ভাষ্য দেখ, আর অর্বাচীন কালের সংস্কৃত দেখ। এখুনি বুঝতে পারবে যে, যখন মানুষ বেঁচে থাকে, তখন জ্যান্ত-কথা কয়, মরে গেলে মরা-ভাষা কয়। যত মরণ নিকট হয়, নূতন চিন্তাশক্তির যত ক্ষয় হয়, ততই দু-একটা পচা ভাব রাশীকৃত ফুল-চন্দন দিয়ে ছাপবার চেষ্টা হয়। বাপ রে, সে কি ধুম—দশপাতা লম্বা লম্বা বিশেষণের পর দুম করে—‘রাজা আসীৎ’!!! আহাহা! কি প্যাঁচওয়া বিশেষণ, কি বাহাদুর সমাস, কি শ্লেষ!!—ও সব মড়ার লক্ষণ। যখন দেশটা উৎসন্ন যেতে আরম্ভ হল, তখন এই সব চিহ্ন উদয় হল। ওটি শুধু ভাষায় নয়, সকল শিল্পতেই এল। বাড়ীটার না আছে ভাব, না ভঙ্গি; থামগুলোকে কুঁদে কুঁদে সারা করে দিলে। গয়নাটা নাক ফুঁড়ে ঘাড় ফুঁড়ে ব্রহ্মরাক্ষসী সাজিয়ে দিলে, কিন্তু সে গয়নায় লতা-পাতা চিত্র-বিচিত্রর কি ধুম!!! গান হচ্ছে, কি কান্না হচ্ছে, কি ঝগড়া হচ্ছে—তার কি ভাব, কি উদ্দেশ্য, তা ভরত ঋষিও বুঝতে পারেন না; আবার সে গানের মধ্যে প্যাঁচের কি ধুম! সে কি আঁকাবাঁকা ডামাডোল—ছত্রিশ নাড়ীর টান তায় রে বাপ! তার উপর মুসলমান ওস্তাদের নকলে দাঁতে দাঁত চেপে, নাকের মধ্য দিয়ে আওয়াজে সে গানের আবির্ভাব! এগুলো শোধরাবার লক্ষণ এখন হচ্ছে, এখন ক্রমে বুঝবে যে, যেটা ভাবহীন প্রাণহীন—সে ভাষা, সে শিল্প, সে সঙ্গীত কোন কাজের নয়। এখন বুঝবে যে, জাতীয় জীবনে যেমন যেমন বল আসবে, তেমন তেমন ভাষা শিল্প সঙ্গীত প্রভৃতি আপনা-আপনি ভাবময় প্রাণপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। দুটো চলিত কথায় যে ভাবরাশি আসবে, তা দু-হাজার ছাঁদি বিশেষণেও নাই। তখন দেবতার মূর্তি দেখলেই ভক্তি হবে, গহনা-পরা মেয়ে-মাত্রই দেবী বলে বোধ হবে, আর বাড়ী ঘর দোর সব প্রাণস্পন্দনে ডগমগ করবে।
ব্রহ্মা—দেবতাদিগের প্রথম ও প্রধান—শিষ্যপরম্পরায় জ্ঞান প্রচার করিলেন; উৎসর্পিণী ও অবসর্পিণী২৭ কালচক্রের মধ্যে কতিপয় অলৌকিক সিদ্ধপুরুষ—জিনের প্রাদুর্ভাব হয়, ও তাঁহাদের হইতে মানবসমাজে জ্ঞানের পুনঃপুনঃ স্ফূর্তি হয়, সেই প্রকার বৌদ্ধমতে সর্বজ্ঞ বুদ্ধনামধেয় মহাপুরুষদিগের বারংবার আবির্ভাব; পৌরাণিকদিগের অবতারের অবতরণ আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে বিশেষরূপে, অন্যান্য নিমিত্ত-অবলম্বনেও; মহামনা স্পিতামা জরথুষ্ট্র২৮ জ্ঞানদীপ্তি মর্ত্যলোকে আনয়ন করিলেন; হজরত মুশা, ঈশা ও মহম্মদও তদ্বৎ অলৌকিক উপায়শালী হইয়া অলৌকিক পথে অলৌকিক জ্ঞান মানব-সমাজে প্রচার করিলেন।
কয়েকজন মাত্র জিন হন, তাহা ছাড়া আর কাহারও জিন হইবার উপায় নাই, অনেকে মুক্ত হন মাত্র; বুদ্ধনামক অবস্থা সকলেই প্রাপ্ত হইতে পারেন; ব্রহ্মাদি পদবীমাত্র, জীবমাত্রেরই হইবার সম্ভাবনা; জরথুষ্ট্র, মুশা, ঈশা, মহম্মদ লোক-বিশেষ কার্য-বিশেষের জন্য অবতীর্ণ; তদ্বৎ পৌরাণিক অবতারগণ—সে আসনে অন্যের দৃষ্টিনিক্ষেপ বাতুলতা। ‘আদম’ ফল খাইয়া জ্ঞান পাইলেন, ‘নু’ (Noah) যিহোবাদেবের অনুগ্রহে সামাজিক শিল্প শিখিলেন। ভারতে সকল শিল্পের অধিষ্ঠাতা—দেবগণ বা সিদ্ধপুরুষ; জুতা সেলাই হইতে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সমস্তই অলৌকিক পুরুষদিগের কৃপা। ‘গুরু বিন্ জ্ঞান নহি’; শিষ্য-পরম্পরায় ঐ জ্ঞানবল গুরু-মুখ হইতে না আসিলে, গুরুর কৃপা না হইলে আর উপায় নাই।
আবার দার্শনিকেরা—বৈদান্তিকেরা বলেন, জ্ঞান মনুষ্যের স্বভাব-সিদ্ধ ধন—আত্মার প্রকৃতি; এই মানবাত্মাই অনন্ত জ্ঞানের আধার, তাহাকে আবার কে শিখাইবে? কুকর্মের দ্বারা ঐ জ্ঞানের উপর যে একটা আবরণ পড়িয়াছে—তাহা কাটিয়া যায় মাত্র। অথবা ঐ ‘স্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান’ অনাচারের দ্বারা সঙ্কুচিত হইয়া যায়, ঈশ্বরের কৃপায় সদাচারের দ্বারা পুনর্বিস্ফারিত হয়। অষ্টাঙ্গ যোগাদির দ্বারা, ঈশ্বরে ভক্তির দ্বারা, নিষ্কাম কর্মের দ্বারা, জ্ঞানচর্চার দ্বারা অন্তর্নিহিত অনন্ত শক্তি ও জ্ঞানের বিকাশ—ইহাও পড়া যায়।
আধুনিকেরা অপরদিকে অনন্তস্ফূর্তির আধারস্বরূপ মানব-মন দেখিতেছেন, উপযুক্ত দেশকালপাত্র পরস্পরের উপর ক্রিয়াবান হইতে পারিলেই জ্ঞানের স্ফূর্তি হইবে, ইহাই সকলের ধারণা। আবার দেশকালের বিড়ম্বনা পাত্রের তেজে অতিক্রম করা যায়। সৎপাত্র কুদেশে কুকালে পড়িলেও বাধা অতিক্রম করিয়া আপনার শক্তির বিকাশ করে। পাত্রের উপর—অধিকারীর উপর যে সমস্ত ভার চাপান হইয়াছিল, তাহাও কমিয়া আসিতেছে। সেদিনকার বর্বর জাতিরাও যত্নগুণে সুসভ্য ও জ্ঞানী হইয়া উঠিতেছে—নিম্নস্তর উচ্চতম আসন অপ্রতিহত গতিতে লাভ করিতেছে। নিরামিষভোজী পিতা-মাতার সন্তানও সুবিনীত বিদ্বান হইয়াছে, সাঁওতাল-বংশধরেরাও ইংরেজের কৃপায় বাঙ্গালীর পুত্রদিগের সহিত বিদ্যালয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্থাপন করিতেছে। পিতৃপিতামহাগত গুণের পক্ষপাতিতা ঢের কমিয়া আসিয়াছে।
একদল আছেন, যাঁহাদের বিশ্বাস—প্রাচীন মহাপুরুষদিগের অভিপ্রায় পূর্বপুরুষপরম্পরাগত পথে তাঁহারাই প্রাপ্ত হইয়াছেন এবং সকল বিষয়ের জ্ঞানের একটি নির্দিষ্ট ভাণ্ডার অনন্ত কাল হইতে আছে, ঐ খাজানা পূর্বপুরুষদিগের হস্তে ন্যস্ত হইয়াছিল। তাঁহারা উত্তরাধিকারী, জগতের পূজ্য। যাঁহাদের এ প্রকার পূর্বপুরুষ নাই, তাঁহাদের উপায়?—কিছুই নাই। তবে যিনি অপেক্ষাকৃত সদাশয়, উত্তর দিলেন—আমাদের পদলেহন কর, সেই সুকৃতিফলে আগামী জন্মে আমাদের বংশে জন্মগ্রহণ করিবে।—আর এই যে আধুনিকেরা বহুবিদ্যার আবির্ভাব করিতেছেন—যাহা তোমরা জান না, এবং তোমাদের পূর্বপুরুষেরা জানিতেন, তাহারও প্রমাণ নাই। পূর্বপুরুষেরা জানিতেন বৈকি! তবে লোপ হইয়া গিয়াছে, এই শ্লোক দেখ—।
অবশ্য প্রত্যক্ষবাদী আধুনিকেরা এ সকল কথায় আস্থা প্রকাশ করেন না।
অপরা ও পরা বিদ্যায় বিশেষ আছে নিশ্চিত; আধিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানে বিশেষ আছে নিশ্চিত; একের রাস্তা অন্যের না হইতে পারে; এক উপায় অবলম্বনে সকল প্রকার জ্ঞান-রাজ্যের দ্বার উদ্ঘাটিত না হইতে পারে, কিন্তু সেই বিশেষণ (difference) কেবল উচ্চতার তারতম্য, কেবল অবস্থাভেদ, উপায়ের অবস্থানুযায়ী প্রয়োজনভেদ; বাস্তবিক সেই অখণ্ড জ্ঞান ব্রহ্মাদিস্তম্ব পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ড-পরিব্যাপ্ত।
‘জ্ঞান-মাত্রেই পুরুষবিশেষের দ্বারা অধিকৃত এবং ঐ-সকল বিশেষ পুরুষ, ঈশ্বর বা প্রকৃতি বা কর্মনির্দিষ্ট হইয়া যথাকালে জন্মগ্রহণ করেন, তদ্ভিন্ন কোন বিষয়ে জ্ঞানলাভের আর কোন উপায় নাই’—এইটি স্থির সিদ্ধান্ত হইলে সমাজ হইতে উদ্যোগ-উৎসাহাদি অন্তর্হিত হয়, উদ্ভাবনী-শক্তি চর্চাভাবে ক্রমশঃ বিলীন হয়, নূতন বস্তুতে আর কাহারও আগ্রহ হয় না, হইবার উপায়ও সমাজ ক্রমে বন্ধ করিয়া দেন। যদি ইহাই স্থির হইল যে, সর্বজ্ঞ পুরুষবিশেষগণের দ্বারায় মানবের কল্যাণের পন্থা অনন্তকালের নিমিত্ত নির্দিষ্ট হইয়াছে, তাহা হইলে সেই সকল নির্দেশের রেখামাত্র ব্যতিক্রম হইলেই সর্বনাশ হইবার ভয়ে সমাজ কঠোর শাসন দ্বারা মনুষ্যগণকে ঐ নির্দিষ্ট পথে লইয়া যাইতে চেষ্টা করে। যদি সমাজে এ বিষয়ে কৃতকার্য হয়, তবে মনুষ্যের পরিণাম যন্ত্রের ন্যায় হইয়া যায়। জীবনের প্রত্যেক কার্যই যদি অগ্র হইতে সুনির্দিষ্ট হইয়া রহিয়াছে, তবে চিন্তাশক্তির পর্যালোচনার আর ফল কি? ক্রমে ব্যবহারের অভাবে উদ্ভাবনী-শক্তির লোপ ও তমোগুণপূর্ণ জড়তা আসিয়া পড়ে; সে সমাজ ক্রমশই অধোগতিতে গমন করিতে থাকে।
অপরদিকে সর্বপ্রকারে নির্দেশবিহীন হইলেই যদি কল্যাণ হইত, তাহা হইলে চীন, হিন্দু, মিশর, বাবিল, ইরান, গ্রীস, রোম ও তাহাদের বংশধরদিগকে ছাড়িয়া সভ্যতা ও বিদ্যাশ্রী জুলু, কাফ্রি, হটেণ্টট্, সাঁওতাল, আন্দামানী ও অষ্ট্রেলিয়ান্ প্রভৃতি জাতিগণকেই আশ্রয় করিত।
অতএব মহাপুরুষদিগের দ্বারা নির্দিষ্ট পথেরও গৌরব আছে, গুরু-পরম্পরাগত জ্ঞানেরও বিশেষ বিধেয়তা আছে, জ্ঞানের সর্বান্তর্যামিত্বও একটি অনন্ত সত্য। কিন্তু বোধ হয়, প্রেমের উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হইয়া ভক্তেরা মহাজনদিগের অভিপ্রায়—তাঁহাদের পূজার সমক্ষে বলিদান করেন এবং স্বয়ং হতশ্রী হইলে মনুষ্য স্বভাবতঃ পূর্বপুরুষদিগের ঐশ্বর্য স্মরণেই কালাতিপাত করে, ইহাও প্রত্যক্ষসিদ্ধ। ভক্তিপ্রবণ হৃদয় সর্বপ্রকারে পূর্বপুরুষদিগের পদে আত্মসমর্পণ করিয়া স্বয়ং দুর্বল হইয়া যায় এবং পরবর্তী কালে ঐ দুর্বলতাই শক্তিহীন গর্বিত হৃদয়কে পূর্বপুরুষদিগের গৌরব-ঘোষণারূপ জীবনাধার-মাত্র অবলম্বন করিতে শিখায়।
পূর্ববর্তী মহাপুরুষেরা সমুদয়ই জানিতেন, কালবশে সেই জ্ঞানের অধিকাংশই লোপ হইয়া গিয়াছে, এ কথা সত্য হইলেও ইহাই সিদ্ধান্ত হইবে যে, ঐ লোপের কারণ, পরবর্তীদের নিকট ঐ লুপ্ত জ্ঞান থাকা না থাকা সমান; নূতন উদ্যোগ করিয়া, পুনর্বার পরিশ্রম করিয়া তাহা আবার শিখিতে হইবে।
আধ্যাত্মিক জ্ঞান যে বিশুদ্ধচিত্তে আপনা হইতেই স্ফুরিত হয়, তাহাও চিত্তশুদ্ধিরূপ বহু আয়াস ও পরিশ্রম-সাধ্য। আধিভৌতিক জ্ঞানে যে-সকল গুরুতর সত্য মানব-হৃদয়ে পরিস্ফুটিত হইয়াছে, অনুসন্ধানে জানা যায় যে, সেগুলিও সহসা উদ্ভূত দীপ্তির ন্যায় মনীষীদের মনে সমুদিত হইয়াছে, কিন্তু বন্য অসভ্য মনুষ্যের মনে তাহা হয় না। ইহাই প্রমাণ যে, আলোচনা ও বিদ্যাচর্চারূপ কঠোর তপস্যাই তাহার কারণ।
অলৌকিকত্বরূপ যে অদ্ভুত বিকাশ, চিরোপার্জিত লৌকিক চেষ্টাই তাহার কারণ; লৌকিক ও অলৌকিক—কেবল প্রকাশের তারতম্যে।
মহাপুরুষত্ব, ঋষিত্ব, অবতারত্ব বা লৌকিক বিদ্যায় মহাবীরত্ব সর্বজীবের মধ্যে আছে, উপযুক্ত গবেষণা ও কালাদিসহায়ে তাহা প্রকাশিত হয়। যে সমাজে ঐ প্রকার বীরগণের একবার প্রাদুর্ভাব হইয়া গিয়াছে, সেথায় পুনর্বার মনীষিগণের অভ্যুত্থান অধিক সম্ভব। গুরুসহায় সমাজ অধিকতর বেগে অগ্রসর হয়, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু গুরুহীন সমাজে কালে গুরুর উদয় ও জ্ঞানের বেগপ্রাপ্তি তেমনই নিশ্চিত।
(১)
ঠাকুর-দর্শনে এক ব্যক্তি আসিয়া উপস্থিত। দর্শনলাভে তাহার যথেষ্ট প্রীতি ও ভক্তির উদয় হইল। তখন সে বুঝি আদানপ্রদান-সামঞ্জস্য করিবার জন্য গীত আরম্ভ করিল। দালানের এক কোণে থামে হেলান দিয়া চোবেজী ঝিমাইতেছিলেন। চোবেজী মন্দিরের পূজারী, পহলওয়ান, সেতারী—দুই লোটা ভাঙ দুবেলা উদরস্থ করিতে বিশেষ পটু এবং অন্যান্য আরও অনেক সদ্গুণশালী। সহসা একটা বিকট নিনাদ চোবেজীর কর্ণপটহ প্রবলবেগে ভেদ করিতে উদ্যত হওয়ায় সম্বিদা-সমুৎপন্ন বিচিত্র জগৎ ক্ষণকালের জন্য চোবেজীর বিয়াল্লিশ ইঞ্চি বিশাল বক্ষস্থলে ‘উত্থায় হৃদি লীয়ন্তে’ হইল। তরুণ-অরুণ-কিরণবর্ণ ঢুলুঢুলু দুটি নয়ন ইতস্ততঃ বিক্ষেপ করিয়া মনশ্চাঞ্চল্যের কারণানুসন্ধায়ী চোবেজী আবিষ্কার করিলেন যে, এক ব্যক্তি ঠাকুরজীর সামনে আপনভাবে আপনি বিভোর হইয়া কর্মবাড়ীর কড়া-মাজার ন্যায় মর্মস্পর্শী স্বরে নারদ, ভরত, হনুমান, নায়ক—কলাবতগুষ্টির সপিণ্ডীকরণ করিতেছে। সম্বিদানন্দ-উপভোগের প্রত্যক্ষ বিঘ্নস্বরূপ পুরুষকে মর্মাহত চোবেজী তীব্রবিরক্তিব্যঞ্জক-স্বরে জিজ্ঞাসা করিতেছেন—‘বলি বাপু হে, ও বেসুর বেতাল কি চীৎকার করছ!’ ক্ষিপ্র উত্তর এল—‘সুর-তানের আমার আবশ্যক কি হে? আমি ঠাকুরজীর মন ভিজুচ্চি।’ চোবেজী—‘হুঁ, ঠাকুরজী এমনই আহম্মক কি না! পাগল তুই, আমাকে ভিজুতে পারিসনি, ঠাকুর কি আমার চেয়েও বেশী মূর্খ?’
* * *
ভগবান্ অর্জুনকে বলেছেনঃ তুমি আমার শরণ লও, আর কিছু করবার দরকার নাই, আমি তোমায় উদ্ধার করব। ভোলাচাঁদ তাই লোকের কাছে শুনে মহাখুশী; থেকে থেকে বিকট চীৎকারঃ আমি প্রভুর শরণাগত, আমার আবার ভয় কি? আমার কি আর কিছু করতে হবে? ভোলাচাঁদের ধারণা—ঐ কথাগুলি খুব বিটকেল আওয়াজে বারংবার বলতে পারলেই যথেষ্ট ভক্তি হয়, আবার তার ওপর মাঝে মাঝে পূর্বোক্ত স্বরে জানানও আছে যে, তিনি সদাই প্রভুর জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। এ ভক্তির ডোরে যদি প্রভু স্বয়ং না বাঁধা পড়েন, তবে সবই মিথ্যা। পার্শ্বচর দু-চারটা আহাম্মকও তাই ঠাওরায়। কিন্তু ভোলাচাঁদ প্রভুর জন্য একটিও দুষ্টামি ছাড়তে প্রস্তুত নন। বলি, ঠাকুরজী কি এমনই আহাম্মক? এতে যে আমরাই ভুলিনি!!
* * *
ভোলাপুরী বেজায় বেদান্তী—সকল কথাতেই তাঁর ব্রহ্মত্বসম্বন্ধে পরিচয়টুকু দেওয়া আছে। ভোলাপুরীর চারিদিকে যদি লোকগুলো অন্নাভাবে হাহাকার করে—তাঁকে স্পর্শও করে না; তিনি সুখদুঃখের অসারতা বুঝিয়ে দেন। যদি রোগে শোকে অনাহারে মরে ঢিপি হয়ে যায়, তাতেই বা তাঁর কি? তিনি অমনি আত্মার অবিনশ্বরত্ব চিন্তা করেন! তাঁর সামনে বলবান্ দুর্বলকে যদি মেরেও ফেলে, ভোলাপুরী ‘আত্মা মরেনও না, মারেনও না’—এই শ্রুতিবাক্যের গভীর অর্থসাগরে ডুবে যান! কোন প্রকার কর্ম করতে ভোলাপুরী বড়ই নারাজ। পেড়াপীড়ি করলে জবাব দেন যে, পূর্বজন্মে ওসব সেরে এসেছেন। এক জায়গায় ঘা পড়লে কিন্তু ভোলাপুরীর আত্মৈক্যানুভূতির ঘোর ব্যাঘাত হয়—যখন তাঁর ভিক্ষার পরিপাটিতে কিঞ্চিৎ গোল হয় বা গৃহস্থ তাঁর আকাঙ্ক্ষানুযায়ী পূজা দিতে নারাজ হন, তখন পুরীজীর মতে গৃহস্থের মত ঘৃণ্য জীব জগতে আর কেহই থাকে না এবং যে গ্রাম তাঁহার সমুচিত পূজা দিলে না, সে গ্রাম যে কেন মুহূর্তমাত্রও ধরণীর ভারবৃদ্ধি করে, এই ভাবিয়া তিনি আকুল হন।
ইনিও ঠাকুরজীকে আমাদের চেয়ে আহাম্মক ঠাওরেছেন।
* * *
‘বলি, রামচরণ! তুমি লেখাপড়া শিখলে না, ব্যবসা-বাণিজ্যেরও সঙ্গতি নাই, শারীরিক শ্রমও তোমা দ্বারা সম্ভব নহে, তার উপর নেশা-ভাঙ এবং দুষ্টামিগুলাও ছাড়তে পার না, কি করে জীবিকা কর, বল দেখি?’ রামচরণ—‘সে সোজা কথা, মশায়—আমি সকলকে উপদেশ করি।’
রামচরণ ঠাকুরজীকে কি ঠাওরেছেন?
(২)
লক্ষ্ণৌ সহরে মহরমের ভারি ধুম! বড় মসজেদ ইমামবারায় জাঁকজমক রোশনির বাহার দেখে কে! বে-সুমার লোকের সমাগম। হিন্দু, মুসলমান, কেরানী, য়াহুদী, ছত্রিশ বর্ণের স্ত্রী-পুরুষ বালক-বালিকা, ছত্রিশ বর্ণের হাজার জাতের লোকের ভিড় আজ মহরম দেখতে। লক্ষ্ণৌ ‘সিয়া’দের রাজধানী, আজ হজরত ইমাম্ হাসেন হোসেনের নামে আর্তনাদ গগন স্পর্শ করছে—সে ছাতিফাটান মর্সিয়ার কাতরানি কার বা হৃদয় ভেদ না করে? হাজার বৎসরের প্রাচীন কারবালার কথা আজ ফের জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এ দর্শকবৃন্দের ভিড়ের মধ্যে দূর গ্রাম হতে দুই ভদ্র রাজপুত তামাসা দেখতে হাজির। ঠাকুর-সাহেবদের—যেমন পাড়াগেঁয়ে জমিদারের হয়ে থাকে—‘বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচ’। সে মোসলমানি সভ্যতা, কাফ্-গাফের বিশুদ্ধ উচ্চারণসমেত লস্করী জবানের পুষ্পবৃষ্টি, আবা-কাবা চুস্ত-পায়জামা তাজ-মোড়াসার রঙ্গ-বেরঙ্গ সহরপসন্দ ঢঙ্গ অতদূর গ্রামে গিয়ে ঠাকুর-সাহেবদের স্পর্শ করতে আজও পারেনি। কাজেই ঠাকুররা সরল-সিধে, সর্বদা শিকার করে জমামরদ্ কড়াজান্ আর বেজায় মজবুত দিল্।
ঠাকুরদ্বয় তো ফটক পার হয়ে মসজেদ মধ্যে প্রবেশোদ্যত, এমন সময় সিপাহী নিষেধ করলে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় জবাব দিলে যে, এই যে দ্বারপার্শ্বে মুরদ খাড়া দেখছ, ওকে আগে পাঁচ জুতা মার, তবে ভিতরে যেতে পাবে। মূর্তিটি কার? জবাব এল—ও মহাপাপী ইয়েজ্বিদের মূর্তি। ও হাজার বৎসর আগে হজরত হাসেন হোসেনকে মেরে ফেলে, তাই আজ এ রোদন, শোকপ্রকাশ। প্রহরী ভাবলে, এ বিস্তৃত ব্যাখ্যার পর ইয়েজ্বিদ-মূর্তি পাঁচ জুতার জায়গায় দশ তো নিশ্চিত খাবে। কিন্তু কর্মের বিচিত্র গতি। উলটা সমঝ্লি রাম—ঠাকুরদ্বয় গললগ্নীকৃতবাস ভূমিষ্ঠ হয়ে ইয়েজ্বিদ-মূর্তির পদতলে কুমড়ো গড়াগড়ি আর গদ্গদস্বরে স্তুতি—‘ভেতরে ঢুকে আর কাজ কি, অন্য ঠাকুর আর কি দেখ্ব? ভল্ বাবা অজিদ, দেবতা তো তুঁহি হ্যায় অস্ মারো শারোকো কি অভি তক্ রোবত।’ (ধন্য বাবা ইয়েজ্বিদ, এমনি মেরেচ শালাদের—কি আজও কাঁদছে!!)
* * *
সনাতন হিন্দুধর্মের গগনস্পর্শী মন্দির—সে মন্দিরে নিয়ে যাবার রাস্তাই বা কত! আর সেথা নাই বা কি? বেদান্তীয় নির্গুণ ব্রহ্ম হতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, শক্তি, সূয্যিমামা, ইঁদুরচড়া গণেশ, আর কুচোদেবতা ষষ্ঠী, মাকাল প্রভৃতি—নাই কি? আর বেদ-বেদান্ত দর্শন পুরাণ তন্ত্রে তো ঢের মাল আছে, যার এক-একটা কথায় ভববন্ধন টুটে যায়। আর লোকেরই বা ভিড় কি, তেত্রিশ কোটি লোক সে দিকে দৌড়েছে। আমারও কৌতূহল হল, আমিও ছুটলুম। কিন্তু গিয়ে দেখি, এ কি কাণ্ড! মন্দিরের মধ্যে কেউ যাচ্ছে না, দোরের পাশে একটা পঞ্চাশ মুণ্ডু, একশত হাত, দু-শ পেট, পাঁচ-শ ঠ্যাঙওয়ালা মূর্তি খাড়া! সেইটার পায়ের তলায় সকলেই গড়াগড়ি দিচ্ছে। একজনকে কারণ জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পেলুম যে, ওই ভেতরে যে-সকল ঠাকুরদেবতা, ওদের দূর থেকে একটা গড় বা দুটি ফুল ছুঁড়ে ফেললেই যথেষ্ট পূজা হয়। আসল পূজা কিন্তু এঁর করা চাই—যিনি দ্বারদেশে; আর ঐ যে বেদ, বেদান্ত, দর্শন, পুরাণ—শাস্ত্রসকল দেখছ, ও মধ্যে মধ্যে শুনলে হানি নাই, কিন্তু পালতে হবে এঁর হুকুম। তখন আবার জিজ্ঞাসা করলুম—তবে এ দেবতার নাম কি? উত্তর এল—এঁর নাম ‘লোকাচার’। আমার লক্ষ্ণৌ-এর ঠাকুরসাহেবের কথা মনে পড়ে গেলঃ ‘ভল্ বাবা “লোকাচার” অস্ মারো’ ইত্যাদি।
গুড়গুড়ে কৃষ্ণব্যাল ভট্টাচার্য—মহাপণ্ডিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের খবর তাঁর নখদর্পণে। শরীরটি অস্থিচর্মসার; বন্ধুরা বলে তপস্যার দাপটে, শত্রুরা বলে অন্নাভাবে! আবার দুষ্টেরা বলে, বছরে দেড়কুড়ি ছেলে হলে ঐ রকম চেহারাই হয়ে থাকে। যাই হোক, কৃষ্ণব্যাল মহাশয় না জানেন এমন জিনিষটিই নাই, বিশেষ টিকি হতে আরম্ভ করে নবদ্বার পর্যন্ত বিদ্যুৎপ্রবাহ ও চৌম্বকশক্তির গতাগতিবিষয়ে তিনি সর্বজ্ঞ। আর এ রহস্যজ্ঞান থাকার দরুন দুর্গাপূজার বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকা হতে মায় কাদা, পুনর্বিবাহ২৯, দশ বৎসরের কুমারীর গর্ভাধান পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতে তিনি অদ্বিতীয়। আবার প্রমাণ-প্রয়োগ সে তো বালকেও বুঝতে পারে, তিনি এমনি সোজা করে দিয়েছেন। বলি, ভারতবর্ষ ছাড়া অন্যত্র ধর্ম হয় না, ভারতের মধ্যে ব্রাহ্মণ ছাড়া ধর্ম বুঝবার আর কেউ অধিকারীই নয়, ব্রাহ্মণের মধ্যে আবার কৃষ্ণব্যালগুষ্টি ছাড়া বাকী সব কিছুই নয়, আবার কৃষ্ণব্যালদের মধ্যে গুড়গুড়ে!!! অতএব গুড়গুড়ে কৃষ্ণব্যাল যা বলেন, তাহাই স্বতঃপ্রমাণ। মেলা লেখাপড়ার চর্চা হচ্ছে, লোকগুলো একটু চমচমে হয়ে উঠেছে, সকল জিনিষ বুঝতে চায়, চাকতে চায়, তাই কৃষ্ণব্যাল মহাশয় সকলকে আশ্বাস দিচ্ছেন যে, মাভৈঃ, যে-সকল মুশকিল মনের মধ্যে উপস্থিত হচ্ছে, আমি তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করছি, তোমরা যেমন ছিলে তেমনি থাক। নাকে সরষের তেল দিয়ে খুব ঘুমোও। কেবল আমার বিদায়ের কথাটা ভুলো না। লোকেরা বললে—বাঁচলুম, কি বিপদই এসেছিল বাপু! উঠে বসতে হবে, চলতে ফিরতে হবে, কি আপদ!! ‘বেঁচে থাক্ কৃষ্ণব্যাল’ বলে আবার পাশ ফিরে শুলো। হাজার বছরের অভ্যাস কি ছোটে? শরীর করতে দেবে কেন? হাজারো বৎসরের মনের গাঁট কি কাটে! তাই না কৃষ্ণব্যালদলের আদর! ‘ভল্ বাবা “অভ্যাস” অস্ মারো’ ইত্যাদি।
[পারি প্রদর্শনীতে স্বামীজীর এই বক্তৃতাদির বিবরণ স্বামীজী স্বয়ং লিখিয়া ‘উদ্বোধন’-এ পাঠাইয়াছিলেন।]
এই মাসের৩০ প্রথমাংশে কয়েক দিবস যাবৎ পারি (Paris) মহাপ্রদর্শনীতে “কংগ্রেস দ’ লিস্তোয়ার দে রিলিজিঅঁ” [Congress of the History of Religions, August 1900] অর্থাৎ ধর্মেতিহাস-নামক সভার অধিবেশন হয়। উক্ত সভায় অধ্যাত্ম-বিষয়ক এবং মতামতসম্বন্ধী কোন চর্চার স্থান ছিল না, কেবলমাত্র বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস অর্থাৎ তদঙ্গসকলের তথ্যানুসন্ধানই উদ্দেশ্য ছিল। এ বিধায়, এ সভায় বিভিন্ন ধর্মপ্রচারক-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির একান্ত অভাব। চিকাগো মহাসভা এক বিরাট ব্যাপার ছিল। সুতরাং সে সভায় নানা দেশের ধর্মপ্রচারকমণ্ডলীর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এ সভায় জনকয়েক পণ্ডিত, যাঁহারা বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তি-বিষয়ক চর্চা করেন, তাঁহারাই উপস্থিত ছিলেন। ধর্মসভা না হইবার কারণ এই যে, চিকাগো মহামণ্ডলীতে ক্যাথলিক সম্প্রদায় বিশেষ উৎসাহে যোগদান করিয়াছিলেন; ভরসা—প্রোটেষ্টাণ্ট সম্প্রদায়ের উপর অধিকার বিস্তার; তদ্বৎ সমগ্র খ্রীষ্টান জগৎ—হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান প্রভৃতি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিবর্গকে উপস্থিত করাইয়া স্বমহিমা-কীর্তনের বিশেষ সুযোগ নিশ্চিত করিয়াছিলেন। কিন্তু ফল অন্যরূপ হওয়ায় খ্রীষ্টান সম্প্রদায় সর্বধর্মসমন্বয়ে একেবারে নিরুৎসাহ হইয়াছেন; ক্যাথলিকরা এখন ইহার বিশেষ বিরোধী। ফ্রান্স ক্যাথলিক-প্রধান; অতএব যদিও কর্তৃপক্ষদের যথেষ্ট বাসনা ছিল, তথাপি সমগ্র ক্যাথলিক জগতের বিপক্ষতায় ধর্মসভা করা হইল না।
যে প্রকার মধ্যে মধ্যে Congress of Orientalists অর্থাৎ সংস্কৃত, পালি, আরব্যাদি ভাষাভিজ্ঞ বুধমণ্ডলীর মধ্যে মধ্যে উপবেশন হইয়া থাকে, সেইরূপ উহার সহিত খ্রীষ্টধর্মের প্রত্নতত্ত্ব যোগ দিয়া পারি-তে এ ধর্মেতিহাস-সভা আহূত হয়।
জম্বুদীপ হইতে কেবল দুই-তিনজন জাপানী পণ্ডিত আসিয়াছিলেন; ভারতবর্ষ হইতে স্বামী বিবেকানন্দ।
বৈদিক ধর্ম—অগ্নিসূর্যাদি প্রাকৃতিক বিস্ময়াবহ জড়বস্তুর আরাধনা-সমুদ্ভূত, এইটি অনেক পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞের মত।
স্বামী বিবেকানন্দ উক্ত মত খণ্ডন করিবার জন্য ‘পারি ধর্মেতিহাস-সভা’ কর্তৃক আহূত হইয়াছিলেন এবং তিনি উক্ত বিষয়ে এক প্রবন্ধ পাঠ করিবেন, প্রতিশ্রুত ছিলেন। কিন্তু শারীরিক প্রবল অসুস্থতানিবন্ধন তাঁহার প্রবন্ধাদি লেখা ঘটিয়া উঠে নাই; কোনমতে সভায় উপস্থিত হইতে পারিয়াছিলেন মাত্র। উপস্থিত হইলে ইওরোপ অঞ্চলের সকল সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতই তাঁহাকে সাদরে অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন; উঁহারা ইতঃপূর্বেই স্বামীজীর রচিত পুস্তকাদি পাঠ করিয়াছিলেন।
সে সময় উক্ত সভায় ওপর্ট নামক এক জার্মান পণ্ডিত শালগ্রাম-শিলার উৎপত্তি সম্বন্ধে এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। তাহাতে তিনি শালগ্রামের উৎপত্তি ‘যোনি’ চিহ্ন বলিয়া নির্ধারিত করেন। তাঁহার মতে শিবলিঙ্গ পুংলিঙ্গের চিহ্ন এবং তদ্বৎ শালগ্রাম-শিলা স্ত্রীলিঙ্গের চিহ্ন।শিবলিঙ্গ এবং শালগ্রাম উভয়ই লিঙ্গ-যোনিপূজার অঙ্গ।
স্বামী বিবেকানন্দ উক্ত মতদ্বয়ের খণ্ডন করিয়া বলেন যে, শিবলিঙ্গের নরলিঙ্গতা সম্বন্ধে অবিবেক মত প্রসিদ্ধ আছে; কিন্তু শালগ্রাম সম্বন্ধে এ নবীন মত অতি আকস্মিক।
স্বামীজী বলেন যে, শিবলিঙ্গ-পূজার উৎপত্তি অথর্ববেদসংহিতার যূপ-স্তম্ভের প্রসিদ্ধ স্তোত্র হইতে। উক্ত স্তোত্রে অনাদি অনন্ত স্তম্ভের অথবা স্কম্ভের বর্ণনা আছে এবং উক্ত স্কম্ভই যে ব্রহ্ম, তাহাই প্রতিপাদিত হইয়াছে। যজ্ঞের অগ্নি, শিখা, ধূম, ভস্ম, সোমলতা ও যজ্ঞকাষ্ঠের বাহক বৃষ যে প্রকার মহাদেবের অঙ্গকান্তি, পিঙ্গল জটা, নীলকণ্ঠ, ও বাহনাদিতে পরিণত হইয়াছে, সেই প্রকার যূপ-স্কম্ভও শ্রীশঙ্করে লীন হইয়া মহিমান্বিত হইয়াছে।
অথর্বসংহিতায় তদ্বৎ যজ্ঞোচ্ছিষ্টেরও ব্রহ্মত্ব-মহিমা প্রতিপাদিত হইয়াছে।
লিঙ্গাদি পুরাণে উক্ত স্তবকেই কথাচ্ছলে বর্ণনা করিয়া মহাস্তম্ভের মহিমা ও শ্রীশঙ্করের প্রাধান্য ব্যাখ্যাত হইয়াছে।
পরে, হইতে পারে যে, বৌদ্ধাদির প্রাদুর্ভাবকালে বৌদ্ধস্তূপ-সমাকৃতি দরিদ্রার্পিত ক্ষুদ্রাবয়ব স্মারক-স্তূপও সেই স্তম্ভে অর্পিত হইয়াছে। যে প্রকার অদ্যাপি ভারতখণ্ডে কাশ্যাদি তীর্থস্থলে অপারগ ব্যক্তি অতি ক্ষুদ্র মন্দিরাকৃতি উৎসর্গ করে, সেই প্রকারে বৌদ্ধেরাও ধনাভাবে অতি ক্ষুদ্র স্তূপাকৃতি শ্রীবুদ্ধের উদ্দেশে অর্পণ করিত।
বৌদ্ধস্তূপের অপর নাম ধাতুগর্ভ। স্তূপমধ্যস্থ শিলাকরণ্ডমধ্যে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষুকদিগের ভস্মাদি রক্ষিত হইত। তৎসঙ্গে স্বর্ণাদি ধাতুও প্রোথিত হইত। শালগ্রাম-শিলা উক্ত অস্তিভস্মাদি-রক্ষণ-শিলার প্রাকৃতিক প্রতিরূপ। অতএব প্রথমে বৌদ্ধ-পূজিত হইয়া বৌদ্ধমতের অন্যান্য অঙ্গের ন্যায় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে প্রবেশ লাভ করিয়াছে। অপিচ নর্মদাকূলে ও নেপালে বৌদ্ধপ্রাবল্য দীর্ঘস্থায়ী ছিল। প্রাকৃতিক নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গ ও নেপালপ্রসূত শালগ্রামই যে বিশেষ সমাদৃত, ইহাও বিবেচ্য।
শালগ্রাম সম্বন্ধে যৌনব্যাখ্যা অতি অশ্রুতপূর্ব এবং প্রথম হইতেই অপ্রাসঙ্গিক; শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে যৌনব্যাখ্যা ভারতবর্ষে অতি অর্বাচীন এবং উক্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ঘোর অবনতির সময় সংঘটিত হয়। ঐ সময়ের ঘোর বৌদ্ধতন্ত্রসকল এখনও নেপালে ও তিব্বতে খুব প্রচলিত।
অন্য এক বক্তৃতা—স্বামীজী ভারতীয় ধর্মমতের বিস্তার-বিষয়ে দেন। তাহাতে বলা হয় যে, ভারতখণ্ডের বৌদ্ধাদি সমস্ত মতের উৎপত্তি বেদে। সকল মতের বীজ তন্মধ্যে প্রোথিত আছে। ঐ সকল বীজকে বিস্তৃত ও উন্মীলিত করিয়া বৌদ্ধাদি মতের সৃষ্টি। আধুনিক হিন্দুধর্মও ঐ সকলের বিস্তার—সমাজের বিস্তার ও সঙ্কোচের সহিত কোথাও বিস্তৃত, কোথাও অপেক্ষাকৃত সঙ্কুচিত হইয়া বিরাজমান আছে। তৎপরে স্বামীজী শ্রীকৃষ্ণের বুদ্ধ-পূর্ববর্তিত্ব সম্বন্ধে কিছু বলিয়া পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের বলেন যে, যে প্রকার বিষ্ণুপুরাণোক্ত রাজকুলাদির ইতিহাস ক্রমশঃ প্রত্নতত্ত্ব-উদ্ঘাটনের সহিত প্রমাণীকৃত হইতেছে, সেই প্রকার ভারতের কিংবদন্তীসমস্ত সত্য। বৃথা প্রবন্ধ-কল্পনা না করিয়া পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা যেন উক্ত কিংবদন্তীর রহস্য-উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেন। পণ্ডিত ম্যাক্সমূলার এক পুস্তকে লিখিতেছেন যে, যতই সৌসাদৃশ্য থাকুক না কেন, যতক্ষণ না ইহা প্রমাণিত হইবে যে, কোন গ্রীক সংস্কৃত ভাষা জানিত, ততক্ষণ সপ্রমাণ হইল না যে, ভারতবর্ষের সাহায্য প্রাচীন গ্রীস প্রাপ্ত হইয়াছিল। কিন্তু কতকগুলি পাশ্চাত্য পণ্ডিত ভারতীয় জ্যোতিষের কয়েকটি সংজ্ঞা গ্রীক জ্যোতিষের সংজ্ঞার সদৃশ দেখিয়া এবং গ্রীকরা ভারতপ্রান্তে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য সংস্থাপন করিয়াছিল অবগত হইয়া, ভারতের যাবতীয় বিদ্যায়—সাহিত্যে, জ্যোতিষে, গণিতে—গ্রীক সহায়তা দেখিতে পান। শুধু তাহাই নহে, একজন অতি সাহসিক লিখিয়াছেন যে, ভারতের যাবতীয় বিদ্যা গ্রীকদের বিদ্যার ছায়া!!
এক, ‘ম্লেচ্ছা বৈ যবনাস্তেষু এষা বিদ্যা প্রতিষ্ঠিতা। ঋষিবৎ তেঽপি পূজ্যন্তে’—এই শ্লোকের উপর পাশ্চাত্যেরা কতই না কল্পনা চালাইয়াছেন। উক্ত শ্লোকে কি প্রকারে প্রমাণীকৃত হইল যে, আর্যেরা ম্লেচ্ছের নিকট শিখিয়াছেন? ইহাও বলা যাইতে পারে যে, উক্ত শ্লোকে আর্যশিষ্য ম্লেচ্ছদিগকে উৎসাহবান করিবার জন্য বিদ্যার আদর প্রদর্শিত হইয়াছে।
দ্বিতীয়তঃ ‘গৃহে চেৎ মধু বিন্দেত, কিমর্থং পর্বতং ব্রজেৎ?’ আর্যদের প্রত্যেক বিদ্যার বেদে রহিয়াছে এবং উক্ত কোন বিদ্যার প্রত্যেক সংজ্ঞাই বেদ হইতে আরম্ভ করিয়া বর্তমানকালের গ্রন্থসকলে পর্যন্ত দেখানো যাইতে পারে। এ অপ্রাসঙ্গিক যবনাধিপত্যের আবশ্যকতাই নাই।
তৃতীয়তঃ আর্য জ্যোতিষের প্রত্যেক গ্রীকসদৃশ শব্দ সংস্কৃত হইতে সহজেই ব্যুৎপন্ন হয়, উপস্থিত ব্যুৎপত্তি ত্যাগ করিয়া যাবনিক ব্যুৎপত্তি গ্রহণে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের যে কি অধিকার, তাহাও বুঝি না।
ঐ প্রকার কালিদাসাদিকবি-প্রণীত নাটকে ‘যবনিকা’ শব্দের উল্লেখ দেখিয়া যদি ঐ সময়ের যাবতীয় কাব্যনাটকের উপর যবনাধিপত্য আপত্তি হয়, তাহা হইলে প্রথমে বিবেচ্য যে, আর্যনাটক গ্রীকনাটকের সদৃশ কিনা। যাঁহারা উভয় ভাষায় নাটকরচনা-প্রণালী আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহাদের অবশ্যই বলিতে হইবে যে, ঐ সৌসাদৃশ্য কেবল প্রবন্ধকারের কল্পনাজগতে, বাস্তবিক জগতে তাহার কস্মিন্কালেও বর্তমানত্ব নাই। সে গ্রীক কোরস্ কোথায়? সে গ্রীক যবনিকা নাট্যমঞ্চের একদিকে, আর্যনাটকে তাহার ঠিক বিপরীতে। সে রচনা-প্রণালী এক, আর্যনাটকের আর এক।
আর্যনাটকের সাদৃশ্য গ্রীক নাটকে আদৌ তো নাই, বরং শেক্সপীয়র-প্রণীত নাটকের সহিত ভূরি ভূরি সৌসাদৃশ্য আছে।
অতএব এমনও সিদ্ধান্ত হইতে পারে যে, শেক্সপীয়র সর্ববিষয়ে কালিদাসাদির নিকট ঋণী এবং সমগ্র পাশ্চাত্য সাহিত্যে ভারতের সাহিত্যের ছায়া।
শেষ—পণ্ডিত ম্যাক্সমূলারের আপত্তি তাঁহারই উপর প্রয়োগ করিয়া ইহাও বলা যায় যে, যতক্ষণ ইহা না প্রমাণিত হয় যে, কোন হিন্দু কোন কালে গ্রীক ভাষায় অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিল, ততক্ষণ ঐ গ্রীক প্রভাবের কথা মুখে আনাও উচিত নয়।
তদ্বৎ আর্যভাস্কর্যে গ্রীক প্রাদুর্ভাব-দর্শনও ভ্রম মাত্র।
স্বামীজী ইহাও বলেন যে, শ্রীকৃষ্ণারাধনা বুদ্ধাপেক্ষা অতি প্রাচীন এবং গীতা যদি মহাভারতের সমসাময়িক না হয়, তাহা হইলে তদপেক্ষাও প্রাচীন—নবীন কোন মতে নহে। গীতার ভাষা মহাভারতের ভাষা এক। গীতায় যে-সকল বিশেষণ অধ্যাত্মসম্বন্ধে প্রয়োগ হইয়াছে, তাহার অনেকগুলিই বনাদি পর্বে বৈষয়িক সম্বন্ধে প্রযুক্ত। ঐ সকল শব্দের প্রচুর প্রচার না হইলে এমন ঘটা অসম্ভব। পুনশ্চ সমস্ত মহাভারতের মত আর গীতার মত একই এবং গীতা যখন তৎসাময়িক সমস্ত সম্প্রদায়েরই আলোচনা করিয়াছেন, তখন বৌদ্ধদের উল্লেখমাত্রও কেন করেন নাই?
বুদ্ধের পরবর্তী যে-কোন গ্রন্থে বিশেষ চেষ্টা করিয়াও বৌদ্ধোল্লেখ নিবারিত হইতেছে না। কথা, গল্প, ইতিহাস বা কটাক্ষের মধ্যে কোথাও না কোথাও বৌদ্ধমতের বা বুদ্ধের উল্লেখ প্রকাশ্য বা লুক্কায়িতভাবে রহিয়াছে—গীতার মধ্যে কে সে প্রকার দেখাইতে পারেন? পুনশ্চ গীতা ধর্মসমন্বয়-গ্রন্থ, সে গ্রন্থে কোন মতের অনাদর নাই, সে গ্রন্থকারের সাদর বচনে এক বৌদ্ধমতই বা কেন বঞ্চিত হইলেন, ইহার কারণ-প্রদর্শনের ভার কাহার উপর?
উপেক্ষা—গীতায় কাহাকেও নাই। ভয়?—তাহারও একান্ত অভাব। যে ভগবান্ বেদপ্রচারক হইয়াও বৈদিক হঠকারিতার উপর কঠিন ভাষা প্রয়োগেও কুণ্ঠিত নহেন, তাঁহার বৌদ্ধমতের আবার কি ভয়?
পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা যে প্রকার গ্রীক ভাষার এক এক গ্রন্থের উপর সমস্ত জীবন দেন, সেই প্রকার এক এক প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের উপর জীবন উৎসর্গ করুন; অনেক আলোক জগতে আসিবে। বিশেষতঃ এ মহাভারত ভারতেতিহাসের অমূল্য গ্রন্থ। ইহা অত্যুক্তি নহে যে, এ পর্যন্ত উক্ত সর্বপ্রধান গ্রন্থ পাশ্চাত্য জগতে উত্তমরূপে অধীতই হয় নাই।
বক্তৃতার পর অনেকেই মতামত প্রকাশ করেন। অনেকেই বলিলেনঃ স্বামীজী যাহা বলিতেছেন, তাহার অধিকাংশই আমাদের সম্মত এবং স্বামীজীকে আমরা বলি যে, সংস্কৃত-প্রত্নতত্ত্বের আর সে দিন নাই। এখন নবীন সংস্কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়ের মত অধিকাংশই স্বামীজীর সদৃশ এবং ভারতের কিংবদন্তী পুরাণাদিতে যে বাস্তব ইতিহাস রহিয়াছে, তাহাও আমরা বিশ্বাস করি।
অন্তে—বৃদ্ধ সভাপতি মহাশয় অন্য সকল বিষয় অনুমোদন করিয়া এক গীতার মহাভারত-সমসাময়িকত্বে দ্বৈত মত অবলম্বন করিলেন। কিন্তু প্রমাণ-প্রয়োগ এইমাত্র করিলেন যে, অধিকাংশ পাশ্চাত্য পণ্ডিতের মতে গীতা মহাভারতের অঙ্গ নহে।
অধিবেশনের লিপিপুস্তকে উক্ত বক্তৃতার সারাংশ ফরাসী ভাষায় মুদ্রিত হইবে।
[স্বামীজীর দেহত্যাগের বহুকাল পরে স্বামীজীর ঘরের কাগজপত্র গুছাইবার সময় তাঁহার হাতে লেখা এই অসমাপ্ত গল্পটি পাওয়া যায়।]
জার্মানীর এক জেলায় ব্যারন ‘ক’য়ের বাস। অভিজাত বংশে জাত ব্যারন ‘ক’ তরুণ যৌবনে উচ্চপদ, মান, ধন, বিদ্যা, এবং বিবিধ গুণের অধিকারী। যুবতী, সুন্দরী, বহুধনের অধিকারিণী, উচ্চকুল-প্রসূতা অনেক মহিলা ব্যারন ‘ক’য়ের প্রণয়াভিলাষিণী। রূপে, গুণে, মানে, বংশে, বিদ্যায়, বয়সে এমন জামাই পাবার জন্য কোন্ মা-বাপের না অভিলাষ? কুলীনবংশজা এক সুন্দরী যুবতী যুবা ব্যারন ‘ক’য়ের মনও আকর্ষণ করেছেন, কিন্তু বিবাহের এখনও দেরী। ব্যারনের মান ধন সব থাকুক, এ জগতে আপনার জন নাই—এক ভগ্নী ছাড়া। সে ভগ্নী পরমা সুন্দরী বিদুষী। সে ভগ্নী নিজের মনোমত সুপাত্রকে মাল্যদান করবেন। ব্যারন বহুধনধান্যের সহিত ভগ্নীকে সুপাত্রে সমর্পণ করবেন—তার পর নিজে বিবাহ করবেন, এই প্রতিজ্ঞা। মা বাপ ভাই সকলের স্নেহ সে ভগ্নীতে; তাঁর বিবাহ না হলে নিজে বিবাহ করে সুখী হতে চান না। তার উপর এ পাশ্চাত্য দেশের নিয়ম হচ্ছে যে, বিবাহের পর বর, মা, বাপ, ভগ্নী, ভাই—কারুর সঙ্গে আর বাস করেন না; তাঁর স্ত্রী তাঁকে নিয়ে স্বতন্ত্র হন। বরং স্ত্রীর সঙ্গে শ্বশুরঘরে গিয়া বাস সমাজসম্মত, কিন্তু স্ত্রী স্বামীর পিতামাতার সঙ্গে বাস করতে কখনও আসতে পারেন না। কাজেই নিজের বিবাহ—ভগ্নীর বিবাহ পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে।
আজ মাস কতক হল সে ভগ্নীর কোন খবর নাই। দাসদাসী-পরিষেবিত নানাভোগের আলয় অট্টালিকা ছেড়ে, একমাত্র ভাইয়ের অপার স্নেহবন্ধন তাচ্ছিল্য করে সে ভগ্নী অজ্ঞাতভাবে গৃহত্যাগ করে কোথায় গিয়েছে! নানা অনুসন্ধান বিফল। সে শোক ব্যারন ‘ক’য়ের বুকে বিদ্ধশূলবৎ হয়ে রয়েছে। আহার-বিহারে তাঁর আস্থা নাই—সদাই বিমর্ষ, সদাই মলিনমুখ। ভগ্নীর আশা ছেড়ে দিয়ে আত্মীয়জনেরা ব্যারন ‘ক’য়ের মানসিক স্বাস্থ্যসাধনে বিশেষ যত্ন করতে লাগলেন। আত্মীয়েরা তাঁর জন্য বিশেষ চিন্তিত—প্রণয়িনী সদাই সশঙ্ক।
প্যারিসে মহাপ্রদর্শনী। নানাদিগ্দেশাগত গুণিমণ্ডলীর এখন প্যারিসে সমাবেশ; নানাদেশের কারুকার্য, শিল্পরচনা প্যারিসে আজ কেন্দ্রীভূত। সে আনন্দতরঙ্গের আঘাতে শোকে জড়ীকৃতহৃদয় আবার স্বাভাবিক বেগবান স্বাস্থ্য লাভ করবে, মন দুঃখচিন্তা ছেড়ে বিবিধ আনন্দজনক চিন্তায় আকৃষ্ট হবে—এই আশায় আত্মীয়দের পরামর্শে বন্ধুবর্গ-সমভিব্যাহারে ব্যারন ‘ক’ প্যারিসে যাত্রা করলেন। ...
হে পাঠক। প্রাচীন পরিব্রাজক আশীর্বাণী উচ্চারণ করিয়া দ্বারে দণ্ডায়মান। তোমারও কুলগত আতিথ্য চিরপ্রথিত। অতিথি যতিকে পূর্বের ন্যায় সম্মানপূর্বক আহ্বান করিয়া গৃহমধ্যে স্থান দিবে কি? এবার কেবল ভারতভ্রমণ নহে, পৃথিবীর নানাস্থান পর্যটনের অভিজ্ঞতা-দানে তিনি প্রস্তুত। তাঁহার শ্রীমুখ হইতে সে-সকল কথা শুনিলে বুঝিবে, তাঁহার ভ্রমণ উদ্দেশ্যবিহীন নহে। কিসে ভারতে বর্তমান অমানিশার অবসান হইয়া পূর্বগৌরব পুনরায় উজ্জ্বলতর বর্ণে উদ্ভাসিত হইবে—এই চিন্তা ও চেষ্টাই তাঁহার প্রতি পাদবিক্ষেপের মূলে। আবার ভারতের দুর্দশা কোথা হইতে আসিল, কোন্ শক্তিবলে উহা অপগত হইবে, কোথায়ই বা সে সুপ্তশক্তি নিহিত রহিয়াছে এবং উহার উদ্বোধন ও প্রয়োগের উপকরণই বা কি—এ-সকল গুরুতর বিষয়ের মীমাংসা করিয়াই যে তাঁহাকে ক্ষান্ত দেখিবে তাহা নহে; কিন্তু বদ্ধপরিকর যতি স্বদেশে-বিদেশে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়া মীমাংসিত বিষয়সকলের সত্যতাও যথাসম্ভব প্রমাণিত করিয়াছেন, তাহার নিদর্শনও প্রাপ্ত হইবে। বুদ্ধিমান বিদেশী তাঁহার উপদেশ কার্যে পরিণত করিয়া বলপুষ্ট হইতে চলিল; হে স্বদেশী! তুমিও কি এইবার তোমারই জন্য বহুশ্রমে সমাহৃত সারগর্ভ সত্যগুলি হৃদয়ে ধারণ এবং কার্যে পরিণত করিয়া সফলকাম হইবে? ইতি—
বিনীত
সারদানন্দ
১ মাঘ, ১৩১২
পরিব্রাজকের কাগজ-পত্র অনুসন্ধানের ফলে আমরা তাঁহার অস্ট্রিয়া হইতে তুর্কি হইয়া ইজিপ্ট প্রত্যাগমনাবধি ভ্রমণকাহিনী কতক সবিস্তারে এবং কতক ‘ডায়েরি’র আকারে প্রাপ্ত হইয়াছি। তন্মধ্যে সার্ভিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশের সবিস্তার বর্ণিতাংশটি বর্তমান সংস্করণে পুস্তকমধ্যে সন্নিবেশিত এবং ‘ডায়েরি’র নোটগুলি পরিশিষ্টের মধ্যে মুদ্রিত করা হইল। … ইতি—
বশংবদ
পুস্তক প্রকাশক
[১৮৯৯ খ্রীঃ ২০ জুন স্বামী বিবেকানন্দ কলিকাতা হইতে গোলকোণ্ডা জাহাজে দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্যদেশে যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিলেন স্বামী তুরীয়ানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতা। ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার সম্পাদক স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের অনুরোধে স্বামীজী নিয়মিতভাবে তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠাইতে সম্মত হন। পত্রাকারে লিখিত সেই নানা অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ভ্রমণকাহিনীই উদ্বোধনের ১ম ও ২য় বর্ষের বিভিন্ন সংখ্যায় ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’রূপে প্রকাশিত হয়। কয়েক বৎসর পরে স্বামী সারদানন্দের তত্ত্বাবধানে ‘পরিব্রাজক’রূপে ইহা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। এই লেখায় ‘তু-ভায়া’ স্বামী তুরীয়ানন্দকে বুঝাইতেছে। স্বামীজী’ বলিয়া এখানে পত্রে স্বামী বিবেকানন্দ সম্বোধন করিতেছেন স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে।]
ভূমিকা
স্বামীজি! ওঁ নমো নারায়ণায়—‘মো’কারটা হৃষীকেশী ঢঙের উদাত্ত করে নিও ভায়া। আজ সাতদিন হল আমাদের জাহাজ চলেছে, রোজই তোমায় কি হচ্ছে না হচ্ছে, খবরটা লিখব মনে করি, খাতা পত্র কাগজ কলমও যথেষ্ট দিয়েছ, কিন্তু—ঐ বাঙালী ‘কিন্তু’ বড়ই গোল বাধায়। একের নম্বর—কুড়েমি। ডায়েরী, না কি তোমরা বল, রোজ লিখব মনে করি, তার পর নানা কাজে সেটা অনন্ত ‘কাল’ নামক সময়েতেই থাকে; এক পা-ও এগুতে পারে না। দুয়ের নম্বর—তারিখ প্রভৃতি মনেই থাকে না। সেগুলো সব তোমরা নিজগুণে পূর্ণ করে নিও। আর যদি বিশেষ দয়া কর তো, মনে কর যে, মহাবীরের মত বার তিথি মাস মনে থাকতেই পারে না—রাম হৃদয়ে বলে। কিন্তু বাস্তবিক কথাটা হচ্ছে এই যে, সেটা বুদ্ধির দোষ এবং ঐ কুড়েমি। কি উৎপাত! ‘ক্ব সূর্যপ্রভবো বংশঃ’—থুড়ি, হল না ‘ক্ব সূর্যপ্রভববংশচূড়ামণিরামৈকশরণো বানরেন্দ্রঃ’ আর কোথা আমি দীন—অতি দীন। তবে তিনিও শত যোজন সমুদ্র পার এক লাফে হয়েছিলেন, আর আমরা কাঠের বাড়ীর মধ্যে বন্ধ হয়ে, ওছল পাছল করে, খোঁটাখুঁটি ধরে চলৎশক্তি বজায় রেখে, সমুদ্র পার হচ্চি। একটা বাহাদুরি আছে—তিনি লঙ্কায় পৌঁছে রাক্ষস-রাক্ষুসীর চাঁদমুখ দেখেছিলেন, আর আমরা রাক্ষস-রাক্ষুসীর দলের সঙ্গে যাচ্চি! খাবার সময় সে শত ছোরার চকচকানি আর শত কাঁটার ঠকঠকানি দেখে শুনে তু-ভায়ার তো আক্কেল গুড়ুম। ভায়া থেকে থেকে সিঁটকে ওঠেন, পাছে পার্শ্ববর্তী রাঙাচুলো বিড়ালাক্ষ ভুলক্রমে ঘ্যাঁচ করে ছুরিখানা তাঁরই গায়ে বা বসায়—ভায়া একটু নধরও আছেন কিনা। বলি হ্যাঁগা, সমুদ্র পার হতে হনুমানের সী-সিক্নেস্ ১ হয়েছিল কিনা, সে বিষযে পুঁথিতে কিছু পেয়েছ? তোমরা পোড়ো-পণ্ডিত মানুষ, বাল্মীকি-আল্মীকি কত জান; আমাদের ‘গোঁসাইজী’ তো কিছুই বলছেন না। বোধ হয়—হয়নি; তবে ঐ যে, কার মুখে প্রবেশ করেছিলেন, সেইখানটায় একটু সন্দেহ হয়। তু-ভায়া বলছেন, জাহাজের গোড়াটা যখন হুস্ করে স্বর্গের দিকে উঠে ইন্দ্রের সঙ্গে পরামর্শ করে, আবার তৎক্ষণাৎ ভুস্ করে পাতালমুখো হয়ে বলি রাজাকে বেঁধবার চেষ্টা করে, সেই সময়টা তাঁরও বোধ হয় যেন কার মহা বিকট বিস্তৃত মুখের মধ্যে প্রবেশ করছেন। মাফ ফরমাইয়ো ভাই—ভালা লোককে কাজের ভার দিয়েছ। রাম কহো! কোথায় তোমার সাতদিন সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা দেব, তাতে কত রঙ চঙ মসলা বার্নিশ থাকবে, কত কাব্যরস ইত্যাদি, আর কিনা আবল-তাবল বকছি! ফলকথা, মায়ার ছালটি ছাড়িয়ে ব্রহ্মফলটি খাবার চেষ্টা চিরকাল করা গেছে, এখন খপ করে স্বভাবের সৌন্দর্যবোধ কোথা পাই বল। ‘কাঁহা কাশী, কাঁহা কাশ্মীর, কাঁহা খোরাশান গুজরাত’২ আজন্ম ঘুরছি। কত পাহাড়, নদ, নদী, গিরি, নির্ঝর, উপত্যকা, অধিত্যকা, চিরনীহারমণ্ডিত মেঘমেখলিত পর্বতশিখর, উত্তুঙ্গতরঙ্গভঙ্গকল্লোলশালী কত বারিনিধি দেখলুম, শুনলুম, ডিঙুলুম, পার হলুম। কিন্তু কেরাঞ্চি ও ট্রামঘড়ঘড়ায়িত ধূলিধূসরিত কলিকাতার বড় রাস্তার ধারে—কিম্বা পানের পিক-বিচিত্রিত দ্যালে, টিকটিকি-ইঁদুর-ছুঁচো- মুখরিত একতলা ঘরের মধ্যে দিনের বেলায় প্রদীপ জ্বেলে—আঁব-কাঠের তক্তায় বসে, থেলো হুঁকো টানতে টানতে কবি শ্যামাচরণ হিমাচল, সমুদ্র, প্রান্তর, মরুভূমি প্রভৃতি যে—হুবহু ছবিগুলি—চিত্রিত করে বাঙালীর মুখ উজ্জ্বল করেছেন, সে দিকে লক্ষ্য করাই আমাদের দুরাশা। শ্যামাচরণ ছেলেবেলায় পশ্চিমে বেড়াতে গিয়েছিলেন, যেথায় আকণ্ঠ আহার করে একঘটি জল খেলেই বস্—সব হজম, আবার খিদে, সেখানে শ্যামাচরণের প্রাতিভদৃষ্টি এই সকল প্রাকৃতিক বিরাট ও সুন্দর ভাব উপলব্ধি করেছে। তবে একটু গোল যে, ঐ পশ্চিম—বর্ধমান পর্যন্ত নাকি শুনতে পাই।
তবে একান্তই তোমাদের উপরোধ, আর আমিও যে একেবারে ‘ও রসে বঞ্চিত গোবিন্দদাস’ নহি, সেটা প্রমাণ করবার জন্য শ্রীদুর্গা স্মরণ করে আরম্ভ করি; তোমরাও খোঁটাখুঁটি ছেড়ে দিয়ে শোনোঃ
নদীমুখ বা বন্দর হতে জাহাজ রাত্রে প্রায় ছাড়ে না—বিশেষত কলিকাতার ন্যায় বাণিজ্যবহুল বন্দর, আর গঙ্গার ন্যায় নদী। যতক্ষণ না জাহাজ সমুদ্রে পৌঁছায়, ততক্ষণই আড়কাটীর৩ অধিকার; তিনিই কাপ্তেন, তাঁরই হুকুম; সমুদ্রে বা আসবার সময় নদীমুখ হতে বন্দরে পৌঁছে দিয়ে তিনি খালাস। আমাদের গঙ্গার মুখে দুটি প্রধান ভয়ঃ একটি বজবজের কাছে জেম্স্ ও মেরী নামক চোরা বালি, দ্বিতীয়টি ডায়মণ্ড হারবারের মুখে চড়া। পুরো জোয়ারে, দিনের বেলায় পাইলট অতি সন্তর্পণে জাহাজ চালান, নতুবা নয়। কাজেই গঙ্গা থেকে বেরুতে আমাদের দুদিন লাগল।
হৃষীকেশের গঙ্গা মনে আছে? সেই নির্মল নীলাভ জল—যার মধ্যে দশ হাত গভীরের মাছের পাখনা গোনা যায়, সেই অপূর্ব সুস্বাদু হিমশীতল ‘গাঙ্গ্যং বারি মনোহারি’ আর সেই অদ্ভুত ‘হর হর হর’ তরোঙ্গত্থ ধ্বনি, সামনে গিরিনির্ঝরের ‘হর হর’ প্রতিধ্বনি, সেই বিপিনে বাস, মাধুকরী ভিক্ষা, গঙ্গাগর্ভে ক্ষুদ্র দ্বীপাকার শিলাখণ্ডে ভোজন, করপুটে অঞ্জলি অঞ্জলি সেই জল পান, চারিদিকে কণপ্রত্যাশী মৎস্যকুলের নির্ভয় বিচরণ? সে গঙ্গাজল-প্রীতি, গঙ্গার মহিমা, সে গাঙ্গ্যবারির বৈরাগ্যপ্রদ স্পর্শ, সে হিমালয়বাহিনী গঙ্গা, শ্রীনগর, টিহিরি, উত্তরকাশী, গঙ্গোত্রী, তোমাদের কেউ কেউ গোমুখী পর্যন্ত দেখেছ; কিন্তু আমাদের কর্দমাবিলা, হরগাত্রবিঘর্ষণশুভ্রা, সহস্রপোতবক্ষা এ কলিকাতার গঙ্গায় কি এক টান আছে তা ভোলবার নয়। সে কি স্বদেশপ্রিয়তা বা বাল্যসংস্কার কে জানে? হিন্দুর সঙ্গে মায়ের সঙ্গে একি সম্বন্ধ!—কুসংস্কার কি?—হবে! গঙ্গা গঙ্গা করে জন্ম কাটায়, গঙ্গাজলে মরে, দূর দূরান্তরে লোক গঙ্গাজল নিয়ে যায়, তাম্রপাত্রে যত্ন করে রাখে, পালপার্বণে বিন্দু বিন্দু পান করে। রাজারাজড়ারা ঘড়া পুরে রাখে, কত অর্থব্যয় করে গঙ্গোত্রীর জল রামেশ্বরের উপর নিয়ে গিয়ে চড়ায়; হিন্দু বিদেশ যায়—রেঙ্গুন, জাভা, হংকং, জাঞ্জীবর, মাডাগাস্কর, সুয়েজ, এডেন, মালটা—সঙ্গে গঙ্গাজল, সঙ্গে গীতা। গীতা গঙ্গা—হিঁদুর হিঁদুয়ানি। গেলবারে আমিও একটু নিয়ে গিয়েছিলুম—কি জানি। বাগে পেলেই এক আধ বিন্দু পান করতাম। পান করলেই কিন্তু সে পাশ্চাত্য জনস্রোতের মধ্যে, সভ্যতার কল্লোলের মধ্যে, সে কোটি কোটি মানবের উন্মত্তপ্রায় দ্রুতপদসঞ্চারের মধ্যে মন যেন স্থির হয়ে যেত! সে জনস্রোত, সে রজোগুণের আস্ফালন, সে পদে পদে প্রতিদ্বন্দ্বিসংঘর্ষ, সে বিলাসক্ষেত্র, অমরাবতীসম প্যারিস, লণ্ডন, নিউ ইয়র্ক, বার্লিন, রোম—সব লোপ হয়ে যেত, আর শুনতাম—সেই ‘হর হর হর’, দেখতাম—সেই হিমালয়ক্রোড়স্থ বিজন বিপিন, আর কল্লোলিনী সুরতরঙ্গিণী যেন হৃদয়ে মস্তকে শিরায় শিরায় সঞ্চার করছেন, আর গর্জে গর্জে ডাকছেন—‘হর হর হর!!’
এবার তোমরাও পাঠিয়েছ দেখছি মাকে মান্দ্রাজের জন্য। কিন্তু একটা কি অদ্ভুত পাত্রের মধ্যে মাকে প্রবেশ করিয়েছ ভায়া। তু-ভায়া বালব্রহ্মচারী ‘জ্বলন্নিব ব্রহ্মময়েন তেজসা’; ছিলেন ‘নমো ব্রহ্মণে’, হয়েছেন ‘নমো নারায়ণায়’ (বাপ, রক্ষা আছে!), তাই বুঝি ভায়ার হস্তে ব্রহ্মার কমণ্ডলু ছেড়ে মায়ের বদ্নায় প্রবেশ। যা হোক, খানিক রাত্রে উঠে দেখি, মায়ের সেই বৃহৎ বদ্নাকার কমণ্ডলুর মধ্যে অবস্থানটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। সেটা ভেদ করে মা বেরুবার চেষ্টা করছেন। ভাবলুম সর্বনাশ, এইখানেই যদি হিমাচল-ভেদ, ঐরাবত-ভাসান, জহ্নুর কুটীর ভাঙা প্রভৃতি পর্বাভিনয় হয় তো—গেছি। স্তব স্তুতি অনেক করলুম, মাকে অনেক বুঝিয়ে বললুম—মা! একটু থাক, কাল মান্দ্রাজে নেমে যা করবার হয় কর, সে দেশে হস্তী অপেক্ষাও সূক্ষ্মবুদ্ধি অনেক আছেন, সকলেরই প্রায় জহ্নুর কুটির, আর ঐ যে চকচকে কামানো টিকিওয়ালা মাথাগুলি, ওগুলি সব প্রায় শিলাখণ্ডে তৈয়ারী, হিমাচল তো ওর কাছে মাখম, যত পার ভেঙো, এখন একটু অপেক্ষা কর। উঁহু; মা কি শোনে! তখন এক বুদ্ধি ঠাওরালুম, বললুম—মা দেখ, ঐ যে পাগড়ি মাথায় জামাগায়ে চাকরগুলি জাহাজে এদিক ওদিক করছে, ওরা হচ্ছে নেড়ে—আসল গরুখেকো নেড়ে, আর ঐ যারা ঘরদোর সাফ করে ফিরছে, ওরা হচ্ছে আসল মেথর, লালবেগের৪ চেলা। যদি কথা না শোন তো ওদের ডেকে তোমায় ছুঁইয়ে দিইছি আর কি! তাতেও যদি না শান্ত হও, তোমায় এক্ষুণি বাপের বাড়ী পাঠাব; ঐ যে ঘরটি দেখছ, ওর মধ্যে বন্ধ করে দিলেই তুমি বাপের বাড়ীর দশা পাবে, আর তোমার ডাক হাঁক সব যাবে, জমে একখানি পাথর হয়ে থাকতে হবে। তখন বেটী শান্ত হয়। বলি, শুধু দেবতা কেন, মানুষেরও ঐ দশা—ভক্ত পেলেই ঘাড়ে চড়ে বসেন।
কি বর্ণনা করতে কি বকছি আবার দেখ! আগেই তো বলে রেখেছি, আমার পক্ষে ওসব একরকম অসম্ভব, তবে যদি সহ্য কর তো আবার চেষ্টা করতে পারি।
আপনার লোকের একটি রূপ থাকে, তেমন আর কোথাও দেখা যায় না। নিজের খ্যাঁদা বোঁচা ভাইবোন ছেলেমেয়ের চেয়ে গন্ধর্বলোকেও সুন্দর পাওয়া যাবে না সত্য। কিন্তু গন্ধর্বলোক বেড়িয়েও যদি আপনার লোককে যথার্থ সুন্দর পাওয়া যায়, সে আহ্লাদ রাখবার কি আর জায়গা থাকে? এই অনন্তশষ্পশ্যামলা সহস্রস্রোতস্বতীমাল্যধারিণী বাঙলা দেশের একটি রূপ আছে। সে—রূপ কিছু আছে মলয়ালমে (মালাবার), আর কিছু কাশ্মীরে। জলে কি আর রূপ নাই? জলে জলময় মুষলধারে বৃষ্টি কচুর পাতার উপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্চে, রাশি রাশি তাল-নারিকেল-খেজুরের মাথা একটু অবনত হয়ে সে ধারাসম্পাত বইছে, চারিদিকে ভেকের ঘর্ঘর আওয়াজ—এতে কি রূপ নাই? আর আমাদের গঙ্গার কিনার—বিদেশ থেকে না এলে, ডায়মণ্ড হারবারের মুখ দিয়ে না গঙ্গায় প্রবেশ করলে সে বোঝা যায় না। সে নীল-নীল আকাশ, তার কোলে কালো মেঘ, তার কোলে সাদাটে মেঘ, সোনালী কিনারাদার, তার নীচে ঝোপ-ঝোপ তাল-নারিকেল-খেজুরের মাথা বাতাসে যেন লক্ষ লক্ষ চামরের মত হেলছে, তার নীচে ফিকে ঘন ঈষৎ পীতাভ, একটু কালো মেশানো—ইত্যাদি হরেক রকম সবুজের কাঁড়ি ঢালা আঁব-নিচু-জাম-কাঁটাল—পাতাই পাতা—গাছ ডালপালা আর দেখা যাচ্চে না, আশে পাশে ঝাড় ঝাড় বাঁশ হেলছে, দুলছে, আর সকলের নীচে—যার কাছে ইয়ারকান্দি ইরানী তুর্কিস্তানী গালচে-দুলচে কোথাও হার মেনে যায়! সেই ঘাস, যতদূর চাও—সেই শ্যাম-শ্যাম ঘাস, কে যেন ছেঁটে ছুঁটে ঠিক করে রেখেছে; জলের কিনারা পর্যন্ত সেই ঘাস; গঙ্গার মৃদুমন্দ হিল্লোল যে অবধি জমিকে ঢেকেছে, যে অবধি অল্প অল্প লীলাময় ধাক্কা দিচ্চে, সে অবধি ঘাসে আঁটা। আবার তার নীচে আমাদের গঙ্গাজল। আবার পায়ের নীচে থেকে দেখ, ক্রমে উপরে যাও, উপর উপর মাথার উপর পর্যন্ত, একটি রেখার মধ্যে এত রঙের খেলা! একটি রঙে এত রকমারী, আর কোথাও দেখেছ? বলি, রঙের নেশা ধরেছে কখনও কি—যে রঙের নেশায় পতঙ্গ আগুনে পুড়ে মরে, মৌমাছি ফুলের গারদে অনাহারে মরে? হুঁ, বলি—এই বেলা এ গঙ্গা-মা-র শোভা যা দেখবার দেখে নাও, আর বড় একটা কিছু থাকছে না। দৈত্য-দানবের হাতে পড়ে এ সব যাবে। ঐ ঘাসের জায়গায় উঠবেন—ইঁটের পাঁজা, আর নাববেন ইঁট-খোলার গর্তকুল। যেখানে গঙ্গার ছোট ছোট ঢেউগুলি ঘাসের সঙ্গে খেলা করছে, সেখানে দাঁড়াবেন পাট-বোঝাই ফ্ল্যাট, আর সেই গাধাবোট; আর ঐ তাল-তমাল-আঁব-নিচুর রঙ, ঐ নীল আকাশ, মেঘের বাহার—ওসব কি আর দেখতে পাবে? দেখবে—পাথুরে কয়লার ধোঁয়া আর তার মাঝে মাঝে ভূতের মত অস্পষ্ট দাঁড়িয়ে আছেন কলের চিমনি!!!
এইবার জাহাজ সমুদ্রে পড়ল। ঐ যে ‘দূরাদয়শ্চক্র’ ফক্র ‘তমালতালী-বনরাজি’৫ ইত্যাদি ওসব কিছু কাজের কথা নয়। মহাকবিকে নমস্কার করি, কিন্তু তিনি বাপের জন্মে হিমালয়ও দেখেননি, সমুদ্রও দেখেননি, এই আমার ধারণা।৬
এইখানে ধলায় কালোয় মেশামেশি, প্রয়াগের কিছু ভাব যেন সর্বত্র দুর্লভ হলেও ‘গঙ্গাদ্বারে প্রয়াগে চ গঙ্গাসাগরসঙ্গমে।’ তবে এ জায়গা বলে ঠিক গঙ্গার মুখ নয়। যা হোক আমি নমস্কার করি, ‘সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখং’ বলে।
কি সুন্দর! সামনে যতদূর দৃষ্টি যায়, ঘন নীলজল তরঙ্গায়িত, ফেনিল, বায়ুর সঙ্গে তালে তালে নাচ্চে। পেছনে আমাদের গঙ্গাজল, সেই বিভূতিভূষণা, সেই ‘গঙ্গাফেনসিতা জটা পশুপতেঃ’৭। সে জল অপেক্ষাকৃত স্থির। সামনে মধ্যবর্তী রেখা। জাহাজ একবার সাদা জলের, একবার কালো জলের উপর উঠছে। ঐ সাদা জল শেষ হয়ে গেল। এবার খালি নীলাম্বু, সামনে পেছনে আশে পাশে খালি নীল নীল নীল জল, খালি তরঙ্গভঙ্গ। নীলকেশ, নীলকান্ত অঙ্গ-আভা, নীল পট্টবাস পরিধান। কোটি কোটি অসুর দেবভয়ে সমুদ্রের তলায় লুকিয়েছিল; আজ তাদের সুযোগ, আজ তাদের বরুণ সহায়, পবনদেব সাথী; মহা গর্জন, বিকট হুঙ্কার, ফেনময় অট্টহাস, দৈত্যকুল আজ মহোদধির উপর রণতাণ্ডবে মত্ত হয়েছে! তার মাঝে আমাদের অর্ণবপোত; পোতমধ্যে যে জাতি সসাগরা-ধরাপতি, সেই জাতির নরনারী—বিচিত্র বেশভূষা, স্নিগ্ধ চন্দ্রের ন্যায় বর্ণ, মূর্তিমান্ আত্মনির্ভর, আত্মপ্রত্যয়, কৃষ্ণবর্ণের নিকট দর্প ও দম্ভের ছবির ন্যায় প্রতীয়মান—সগর্ব পাদচারণ করিতেছে। উপরে বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের জীমূতমন্দ্র, চারিদিকে শুভ্রশির তরঙ্গকুলের লম্ফ-ঝম্প গুরুগর্জন, পোতশ্রেষ্ঠের সমুদ্রবল-উপেক্ষাকারী মহাযন্ত্রের হুহুঙ্কার—সে এক বিরাট সম্মিলন—তন্দ্রাচ্ছন্নের ন্যায় বিস্ময়রসে আপ্লুত হইয়া ইহাই শুনিতেছি; সহসা এ সমস্ত যেন ভেদ করিয়া বহু স্ত্রীপুরুষকণ্ঠের মিশ্রণোৎপন্ন গভীর নাদ ও তার-সম্মিলিত ‘রুল ব্রিটানিয়া রুল দি ওয়েভস্’, মহাগীতধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল! চমকিয়া চাহিয়া দেখি—
জাহাজ বেজায় দুলছে, আর তু-ভায়া দুহাত দিয়ে মাথাটি ধরে অন্নপ্রাশনের অন্নের পুনরাবিষ্কারের চেষ্টায় আছেন।
সেকেণ্ড ক্লাসে দুটি বাঙালী ছেলে—পড়তে যাচ্চে। তাদের অবস্থা ভায়ার চেয়েও খারাপ। একটি তো এমনি ভয় পেয়েছে যে, বোধ হয় তীরে নামতে পারলে একছুটে চোঁচা দেশের দিকে দৌড়ায়। যাত্রীদের মধ্যে তারা দুটি আর আমরা দুজন ভারতবাসী—আধুনিক ভারতের প্রতিনিধি। যে দুদিন জাহাজ গঙ্গার মধ্যে ছিল, তু-ভায়া ‘উদ্বোধন’ সম্পাদকের গুপ্ত উপদেশের ফলে ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধ শীঘ্র শীঘ্র শেষ করবার জন্য দিক্ করে তুলতেন! আজ আমিও সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ভায়া, বর্তমান ভারতের অবস্থা কিরূপ?’ ভায়া একবার সেকেণ্ড ক্লাসের দিকে চেয়ে, একবার নিজের দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলেন, ‘বড়ই শোচনীয়—বেজায় গুলিয়ে যাচ্চে!’
এত বড় পদ্মা ছেড়ে গঙ্গার মাহাত্ম্য হুগলি নামক ধারায় কেন বর্তমান, তার কারণ অনেকে বলেন যে, ভাগীরথী-মুখই গঙ্গার প্রধান এবং আদি জলধারা। পরে গঙ্গা পদ্মা-মুখ করে বেরিয়ে গেছেন। ঐ প্রকার ‘টলিজ নালা’ নামক খাল ও আদিগঙ্গা হয়ে গঙ্গার প্রাচীন স্রোত ছিল। কবিকঙ্কণ পোতবণিক-নায়ককে ঐ পথেই সিংহল দ্বীপে নিয়ে গেছেন। পূর্বে ত্রিবেণী পর্যন্ত বড় বড় জাহাজ অনায়াসে প্রবেশ করত। সপ্তগ্রাম নামক প্রাচীন বন্দর এই ত্রিবেণী ঘাটের কিঞ্চিৎ দূরেই সরস্বতীর উপর ছিল। অতি প্রাচীনকাল হতেই এই সপ্তগ্রাম বঙ্গদেশের বহির্বাণিজ্যের প্রধান বন্দর। ক্রমে সরস্বতীর মুখ বন্ধ হতে লাগল। ১৫৩৭ খ্রীষ্টাব্দে ঐ মুখ এত বুজে এসেছে যে, পোর্তুগিজেরা আপনাদের জাহাজ আসবার জন্যে কতকদূর নীচে গিয়ে গঙ্গার উপর স্থান নিল। উহাই পরে বিখ্যাত হুগলী-নগর। ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভ হতেই স্বদেশী বিদেশী সওদাগরেরা গঙ্গায় চড়া পড়বার ভয়ে ব্যাকুল; কিন্তু হলে কি হবে; মানুষের বিদ্যাবুদ্ধি আজও বড় একটা কিছু করে উঠতে পারেনি। মা গঙ্গা ক্রমশই বুজে আসছেন। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে এক ফরাসী পাদ্রী লিখছেন, সূতির কাছে ভাগীরথী- মুখ সে সময়ে বুজে গিয়েছিল। অন্ধকূপের হলওয়েল—মুর্শিদাবাদ যাবার রাস্তায় শান্তিপুরে জল ছিল না বলে ছোট নৌকা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দে কাপ্তেন কোলব্রুক সাহেব লিখছেন যে, গ্রীষ্মকালে ভাগীরথী আর জলাঙ্গী৮ নদীতে নৌকা চলে না। ১৮২২ থেকে ১৮৮৪ পর্যন্ত গরমিকালে ভাগীরথীতে নৌকার গমাগম বন্ধ ছিল। ইহার মধ্যে ২৪ বৎসর দুই বা তিন ফিট জল ছিল। ১৭ শতাব্দীতে ওলন্দাজেরা হুগলীর এক মাইল নীচে চুঁচড়ায় বাণিজ্যস্থান করলে; ফরাসীরা আরও পরে এসে তার নীচে চন্দননগর স্থাপন করলে। জার্মান অষ্টেণ্ড কোম্পানী ১৭২৩ খ্রীষ্টাব্দে চন্দননগরের পাঁচ মাইল নীচে অপর পারে বাঁকীপুর নামক জায়গায় আড়ত খুললে। ১৬১৬ খ্রীষ্টাব্দে দিনেমারেরা চন্দননগর হতে আট মাইল দূরে শ্রীরামপুরে আড়ত করলে। তার পর ইংরেজরা কলকেতা বসালেন আরও নীচে। পূর্বোক্ত সমস্ত জায়গায়ই আর জাহাজ যেতে পারে না। কলকেতা এখনও খোলা, তবে ‘পরেই বা কি হয়’ এই ভাবনা সকলের।
তবে শান্তিপুরের কাছাকাছি পর্যন্ত গঙ্গায় যে গরমিকালেও এত জল থাকে, তার এক বিচিত্র কারণ আছে। উপরের ধারা বন্ধপ্রায় হলেও রাশীকৃত জল মাটির মধ্য দিয়ে চুইয়ে গঙ্গায় এসে পড়ে। গঙ্গার খাদ এখনও পাড়ের জমি হতে অনেক নীচু। যদি ঐ খাদ ক্রমে মাটি বসে উঁচু হয়ে উঠে, তাহলেই মুশকিল। আর এক ভয়ের কিংবদন্তী আছে; কলকেতার কাছেও মা গঙ্গা ভূমিকম্প বা অন্য কারণে মধ্যে মধ্যে এমন শুকিয়ে গেছেন যে, মানুষে হেঁটে পার হয়েছে। ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে নাকি ঐরকম হয়েছিল। আর এক রিপোর্টে পাওয়া যায় যে, ১৭৩৪ খ্রীষ্টাব্দের ৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দুপুরবেলায় ভাঁটার সময় গঙ্গা একদম শুকিয়ে গেলেন। ঠিক বারবেলায় এইটে ঘটলে কি হত, তোমারই বিচার কর—গঙ্গা বোধ হয় আর ফিরতেন না।
এই তো গেল উপরের কথা। নীচে মহাভয়—‘জেমস্ আর মেরী’ চড়া। পূর্বে দামোদর নদ কলকেতার ৩০ মাইল উপরে গঙ্গায় এসে পড়ত, এখন কালের বিচিত্রগতিতে তিনি ৩১ মাইলের উপর দক্ষিণে এসে হাজির। তার প্রায় ছ মাইল নীচে রূপনারায়ণ জল ঢালছেন, মণিকাঞ্চনযোগে তাঁরা তো হুড়মুড়িয়ে আসুন, কিন্তু এ কাদা ধোয় কে? কাজেই রাশীকৃত বালি। সে স্তূপ কখনও এখানে, কখনও ওখানে, কখনও একটু শক্ত, কখনও বা নরম হচ্ছেন। সে ভয়ের সীমা কি! দিনরাত তার মাপজোখ হচ্ছে, একটু অন্যমনস্ক হলেই—দিনকতক মাপজোখ ভুললেই, জাহাজের সর্বনাশ। সে চড়ায় ছুঁতে না ছুঁতেই অমনি উলটে ফেলা, না হয় সোজাসুজিই গ্রাস!! এমনও হয়েছে, মস্ত তিন-মাস্তুল জাহাজ লাগবার আধ ঘণ্টা বাদেই খালি একটু মাস্তুলমাত্র জেগে রইলেন। এ চড়া দামোদর-রূপনারায়ণের মুখই বটেন। দামোদর এখন সাঁওতালি গাঁয়ে তত রাজী নন, জাহাজ-ষ্টীমার প্রভৃতি চাটনি রকমে নিচ্চেন। ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে কলকেতা থাকে ‘কাউণ্টি অফ ষ্টারলিং’ নামক এক জাহাজে ১৪৪৪ টন গম বোঝাই নিয়ে যাচ্ছিল। ঐ বিকট চড়ায় যেমন লাগা আর তার আট মিনিটের মধ্যেই ‘খোঁজ খবর নাহি পাই’। ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে ২৪০০ টন বোঝাই একটি ষ্টীমারের দশ মিনিটের মধ্যে ঐ দশা হয়। ধন্য মা তোমার মুখ! আমরা যে ভালয় ভালয় পেরিয়ে এসেছি, প্রণাম করি।
তু-ভায়া বললেন, ‘মশায়! পাঁটা মানা উচিত মাকে’; আমিও বলি, ‘তথাস্তু, একদিন কেন ভায়া, প্রত্যহ।’ পরদিন তু-ভায়া আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মশায়, তার কি হল? সেদিন আর জবাব দিলুম না। তার পরদিন আবার জিজ্ঞাসা করতেই খাবার সময় তু-ভায়াকে দেখিয়ে দিলুম, পাঁটা মানার দৌড়টা কতদূর চলছে। ভায়া কিছু বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘ও তো আপনি খাচ্চেন’। তখন অনেক যত্ন করে বোঝাতে হল যে—কোন গঙ্গাহীন দেশে নাকি কলকেতার এক ছেলে শ্বশুরবাড়ী যায়; সেখানে খাবার সময় চারিদিকে ঢাকঢোল হাজির; আর শাশুড়ীর বেজায জেদ, ‘আগে একটু দুধ খাও।’ জামাই ঠাওরালে বুঝি দেশাচার, দুধের বাটিতে যেই চুমুকটি দেওয়া—অমনি চারিদিকে ঢাকঢোল বেজে ওঠা। তখন তার শাশুড়ী আনন্দাশ্রুপরিপ্লুতা হয়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললে, ‘বাবা! তুমি আজ পুত্রের কাজ করলে, এই তোমার পেটে গঙ্গাজল আছে, আর দুধের মধ্যে ছিল তোমার শ্বশুরের অস্থি গুঁড়া করা—শ্বশুর গঙ্গা পেলেন।’ অতএব হে ভাই! আমি কলকেতার মানুষ এবং জাহাজে পাঁটার ছড়াছড়ি, ক্রমাগত মা গঙ্গায় পাঁটা চড়ছে, তুমি কিছুমাত্র চিন্তিত হয়ো না। ভায়া যে গম্ভীরপ্রকৃতি, বক্তৃতাটা কোথায় দাঁড়াল—বোঝা গেল না।
এ জাহাজ কি আশ্চার্য ব্যাপার! যে সমুদ্র—ডাঙা থেকে চাইলে ভয় হয়, যাঁর মাঝখানে আকাশটা নুয়ে এসে মিলে গেছে বোধ হয়, যাঁর গর্ভ হতে সূর্যমামা ধীরে ধীরে উঠেন আবার ডুবে যান, যাঁর একটু ভ্রূভঙ্গে প্রাণ থরহরি, তিনি হয়ে দাঁড়ালেন রাজপথ, সকলের চেয়ে সস্তা পথ! এ জাহাজ করলে কে? কেউ করেনি; অর্থাৎ মানুষের প্রধান সহায়স্বরূপ যে সকল কলকব্জা আছে, যা নইলে একদণ্ড চলে না, যার ওলটপালটে আর সব কলকারখানার সৃষ্টি, তাদের ন্যায়—সকলে মিলে করেছে। যেমন চাকা; চাকা নইলে কি কোন কাজ চলে? হ্যাঁকচ হোঁকচ গরুর গাড়ী থেকে ‘জয় জগন্নাথে’র রথ পর্যন্ত, সূতো-কাটা চরকা থেকে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কারখানার কল পর্যন্ত কিছু চলে? এ চাকা প্রথম করলে কে? কেউ করেনি, অর্থাৎ সকলে মিলে করেছে। প্রাথমিক মানুষ কুড়ুল দিয়ে কাঠ কাটছে, বড় বড় গুঁড়ি ঢালু জায়গায় গড়িয়ে আনছে, ক্রমে তাকে কেটে নিরেট চাকা তৈরী হল, ক্রমে অরা নাভি ইত্যাদি ইত্যাদি—আমাদের চাকা। কত লাখ বৎসর লেগেছিল কে জানে? তবে এ ভারতবর্ষ যা হয়, তা থেকে যায়। তার যত উন্নতি হোক না কেন, যত পরিবর্তন হোক না কেন, নীচের ধাপগুলিতে ওঠবার লোক কোথা না কোথা থেকে এসে জোটে, আর সব ধাপগুলি রয়ে যায়। একটা বাঁশের গায়ে একটা তার বেঁধে বাজনা হল; তার ক্রমে একটা বালাঞ্চির ছড়ি দিয়ে প্রথম বেহালা হল, ক্রমে কত রূপ বদল হল, কত তার হল, তাঁত হল, ছড়ির নাম রূপ বদলাল, এসরাজ সারঙ্গি হলেন। কিন্তু এখনও কি গাড়োয়ান মিঞারা ঘোড়ার গাছকতক বালাঞ্চি নিয়ে একটা ভাঁড়ের মধ্যে বাঁশের চোঙ বসিয়ে ক্যাঁকো করে ‘মজওয়ার কাহারের’ জাল বুনবার বৃত্তান্ত৯ জাহির করে না? মধ্যপ্রদেশে দেখগে, এখনও নিরেট চাকা গড়গড়িয়ে যাচ্ছে! তবে সেটা নিরেট বুদ্ধির পরিচয় বটে, বিশেষ এ রবার-টায়ারের দিনে।
অনেক পুরাণকালের মানুষ, অর্থাৎ সত্যযুগের যখন আপামর সাধারণ এমনি সত্যনিষ্ট ছিলেন যে, পাছে ভেতরে একখান ও বাহিরে আর একখান হয় বলে কাপড় পর্যন্ত পরতেন না। পাছে স্বার্থপরতা আসে বলে বিবাহ করতেন না; এবং ভেদবুদ্ধিরহিত হয়ে কোঁৎকা লোড়া-লুড়ির সহায়ে সর্বদাই ‘পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ’ বোধ করতেন; তখন জলে বিচরণ করবার জন্য তাঁরা গাছের মাঝখানটা পুড়িয়ে ফেলে অথবা দু-চারখানা গুঁড়ি একত্রে বেঁধে সালতি ভেলা ইত্যাদির সৃষ্টি করেন। উড়িষ্যা হতে কলম্বো পর্যন্ত কট্টুমারন (Catamaran) দেখেছ তো? ভেলা কেমন সমুদ্রেও দূর দূর পর্যন্ত চলে যায় দেখেছ তো? উনিই হলেন— ‘ঊর্ধ্বমূলম্’।
আর ঐ যে বাঙ্গাল মাঝির নৌকা—যাতে চড়ে দরিয়ার পাঁচ পীরকে ডাকতে হয়; ঐ যে চাটগেঁয়ে-মাঝি-অধিষ্ঠিত বজরা—যা একটু হাওয়া উঠলেই হালে পানি পায় না এবং যাত্রীদের আপন আপন ‘দ্যাব্তার নাম নিতে বলে; ঐ যে পশ্চিমে ভড়—যার গায়ে নানা চিত্রবিচিত্র-আঁকা পেতলের চোক দেওয়া, দাঁড়ীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড় টানে, ঐ যে শ্রীমন্ত সদাগরের নৌকা (কবিকঙ্কণের মতে শ্রীমন্ত দাঁড়ের জোরেই বঙ্গোপসাগর পার হয়েছিলেন এবং গলদা চিঙড়ির গোঁপের মধ্যে পড়ে, কিস্তি বানচাল হয়ে ডুবে যাবার যোগাড় হয়েছিলেন; তথাপি কড়ি দেখে পুঁটিমাছ ঠাউরেছিলেন ইত্যাদি) ওরফে গঙ্গাসাগুরে ডিঙি—উপরে সুন্দর ছাওয়া, নীচে বাঁশের পাটাতন, ভেতরে সারি সারি গঙ্গাজলের জালা (যাতে ‘মেতুয়া গঙ্গাসাগর’—থুড়ি, তোমরা গঙ্গাসাগর যাও আর কনকনে উত্তরে হাওয়ার গুঁতোয় ‘ডাব নারিকেল চিনির পানা’ খাও না); ঐ যে পানসি নৌকা, বাবুদের আপিস নিয়ে যায় আর বাড়ী আনে, বালির মাঝি যার নায়ক, বড় মজবুত, ভারি ওস্তাদ—কোন্নগুরে মেঘ দেখেছে কি কিস্তি সামলাচ্চে, এক্ষণে যা জওয়ানপুরিয়া জওয়ানের দখলে চলে যাচ্চে (যাদের বুলি—‘আইলা গাইলা বানে বানি’, যাদের ওপর তোমাদের মহন্ত মহারাজের ‘বঘাসুর’ ধরে আনতে হুকুম হয়েছিল, যারা ভেবেই আকুল—‘এ স্বামিনাথ! এ বঘাসুর কঁহা মিলেব? ইত হাম জানব না’)। ঐ যে গাধাবোট—যিনি সোজাসুজি যেতে জানেনই না, ঐ যে হুড়ি, এক থেকে তিন মাস্তুল—লঙ্কা, মালদ্বীপ বা আরব থেকে নারকেল, খেজুর, শুঁটকি মাছ ইত্যাদি বোঝাই হয়ে আসে; আর কত বলব, ওরা সব হলেন—‘অধঃশাখা প্রশাখা।’
পালভরে জাহাজ চালান একটি আশ্চর্য আবিষ্ক্রিয়া। হাওয়া যে দিকে যাক না কেন, জাহাজ আপনার গম্যস্থানে পৌঁছবেই পৌঁছবে। তবে হাওয়া বিপক্ষ হলে একটু দেরী। পালওয়ালা জাহাজ কেমন দেখতে সুন্দর, দূরে বোধ হয়, যেন বহুপক্ষবিশিষ্ট পক্ষিরাজ আকাশ থেকে নামছেন। পালের জাহাজ কিন্তু সোজা চলতে বড় পারেন না; হাওয়া একটু বিপক্ষ হলেই এঁকে বেঁকে চলতে হয়, তবে হাওয়া একেবারে বন্ধ হলেই মুশকিল—পাখা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। মহা-বিষুবরেখার নিকটবর্তী দেশসমূহে এখনও মাঝে মাঝে এইরূপ হয়। এখন পাল-জাহাজেও কাঠ-কাঠরা কম, তিনিও লৌহনির্মিত। পাল-জাহাজের কাপ্তানি করা ষ্টীমার অপেক্ষা অনেক শক্ত, এবং পাল-জাহাজে অভিজ্ঞতা না থাকলে ভাল কাপ্তান কখনও হয় না। প্রতি পদে হাওয়া চেনা, অনেক দূর থেকে সঙ্কট জায়গার জন্য হুঁশিয়ার হওয়া, ষ্টীমার অপেক্ষা এ দুটি জিনিষ পাল-জাহাজে অত্যাবশ্যক। ষ্টীমার অনেকটা হাতের মধ্যে, কল মুহূর্তমধ্যে বন্ধ করা যায়। সামনে পিছনে যেমন ইচ্ছা অল্প সময়ের মধ্যে ফিরানো যায়। পাল-জাহাজ হাওয়ার হাতে। পাল খুলতে, বন্ধ করতে, হাল ফেরাতে হয়তো জাহাজ চড়ায় লেগে যেতে পারে, ডুবো পাহাড়ের উপর চড়ে যেতে পারে, অথবা অন্য জাহাজের সহিত ধাক্কা লাগতে পারে। এখন আর যাত্রী বড় পাল-জাহাজে যায় না, কুলী ছাড়া। পাল-জাহাজ প্রায় মাল নিয়ে যায়, তাও নুন প্রভৃতি খেলো মাল। ছোট ছোট পাল-জাহাজ, যেমন হুড়ি প্রভৃতি, কিনারায় বাণিজ্য করে। সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে টানবার জন্য ষ্টীমার ভাড়া করে হাজার হাজার টাকা টেক্স দিয়ে পাল-জাহাজের পোষায় না। পাল-জাহাজ আফ্রিকা ঘুরে ছ-মাসে ইংলণ্ডে যায়। পাল-জাহাজের এই সকল বাধার জন্য তখনকার জল-যুদ্ধ সঙ্কটের ছিল। একটু হাওয়ার এদিক ওদিক, একটু সমুদ্র-স্রোতের এদিক ওদিকে হার জিত হয়ে যেত। আবার সে-সকল জাহাজ কাঠের ছিল। যুদ্ধের সময় ক্রমাগত আগুন লাগত, আর সে আগুন নিবুতে হত। সে জাহাজের গঠনও আর একরকমের ছিল। একদিক ছিল চেপ্টা আর অনেক উঁচু, পাঁচ-তলা ছ-তলা। যেদিকটা চেপ্টা, তারই উপর তলায় একটা কাঠের বারান্দা বার করা থাকত। তারই সামনে কমাণ্ডারের ঘর—বৈঠক। আশে পাশে অফিসারদের। তারপর একটা মস্ত ছাত—উপর খোলা। ছাতের ওপাশে আবার দু-চারটি ঘর। নীচের তলায়ও ঐ রকম ঢাকা দালান, তার নীচেও দালান; তার নীচে দালান এবং মাল্লাদের শোবার স্থান, খাবার স্থান ইত্যাদি। প্রত্যেক তলার দালানের দু-পাশে তোপ বসানো, সারি সারি দ্যালের গায়ে কাটা, তার মধ্যে দিয়ে তোপের মুখ—দু-পাশে রাশীকৃত গোলা (আর যুদ্ধের সময় বারুদের থলে)। তখনকার যুদ্ধ-জাহাজের প্রত্যেক তলাই বড় নীচু ছিল; মাথা হেঁট করে চলতে হত। তখন নৌ-যোদ্ধা যোগাড় করতেও অনেক কষ্ট পেতে হত। সরকারের হুকুম ছিল যে, যেখান থেকে পার ধরে, বেঁধে, ভুলিয়ে লোক নিয়ে যাও। মায়ের কাছ থেকে ছেলে, স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামী—জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যেত। একবার জাহাজে তুলতে পারলে হয়, তারপর—বেচারা কখনও হয়তো জাহাজে চড়েনি—একেবারে হুকুম হল, মাস্তুলে ওঠ। ভয় পেয়ে হুকুম না শুনলেই চাবুক। কতক মরেও যেত। আইন করলেন আমীরেরা, দেশ-দেশান্তরের বাণিজ্য লুটপাট করবার জন্য; রাজস্ব ভোগ করবেন তাঁরা, আর গরীবদের খালি রক্তপাত, শরীরপাত, যা চিরকাল এ পৃথিবীতে হয়ে আসছে!! এখন ও-সব আইন নেই, এখন আর ‘প্রেস গ্যাঙ্গের’ নামে চাষা-ভুষোর হৃৎকম্প হয় না। এখন খুশীর সওদা; তবে অনেকগুলি চোর-ছ্যাঁচড় ছোঁড়াকে জেলে না দিয়ে এই যুদ্ধ-জাহাজে নাবিকের কর্ম শেখানো হয়।
বাষ্পবল এ সমস্তই বদলে ফেলেছে। এখন ‘পাল’—জাহাজে অনাবশ্যক বাহার। হাওয়ার সহায়তায় উপর নির্ভর বড়ই অল্প। ঝড়-ঝাপটার ভয়ও অনেক কম। কেবল জাহাজ না পাহাড়-পর্বতে ধাক্কা খায়, এই বাঁচাতে হয়। যুদ্ধ-জাহাজ তো একেবারে পূর্বের অবস্থার সঙ্গে বিলকুল পৃথক্। দেখে তো জাহাজ বলে মনেই হয় না। এক একটি ছোট বড় ভাসন্ত লোহার কেল্লা। তোপও সংখ্যায় অনেক কমে গেছে। তবে এখনকার কলের তোপের কাছে সে প্রাচীন তোপ ছেলেখেলা বৈ তো নয়। আর এ যুদ্ধ-জাহাজের বেগই বা কি! সব চেয়ে ছোটগুলি ‘টরপিডো’ ছুঁড়বার জন্য, তার চেয়ে একটু বড়গুলি শত্রুর বাণিজ্যপোত দখল করতে, আর বড়-বড়গুলি হচ্ছেন বিরাট যুদ্ধের আয়োজন।
আমেরিকার ইউনাইটেড স্টেট্সের সিভিল ওয়ারের সময়, ঐকরাজ্যপক্ষেরা১০ একখান কাঠের জঙ্গি জাহাজের গায় কতকগুলো লোহার রেল সারি সারি বেঁধে ছেয়ে দিয়েছিল। বিপক্ষের গোলা তার গায়ে লেগে, ফিরে যেতে লাগল, জাহাজের কিছুই বড় করতে পারলে না। তখন মতলব করে, জাহাজের গা লোহা দিয়ে জোড়া হতে লাগল, যাতে দুষমনের গোলা কাষ্ঠ ভেদ না করে। এদিকে জাহাজি তোপেরও তালিম বাড়তে চলল—তা-বড় তা-বড় তোপ; তোপ—যাতে আর হাতে সরাতে, হটাতে, ঠাসতে, ছুঁড়তে হয় না, সব কলে হয়। পাঁচ-শ লোক যাকে একটুকুও হেলাতে পারে না, এমন তোপ, এখন একটা ছোট ছেলে কল টিপে যে দিকে ইচ্ছে মুখ ফেরাচ্চে, নাবাচ্চে ও ঠাসছে, ভরছে, আওয়াজ করছে—আবার তাও চকিতের ন্যায়! যেমন জাহাজের লোহার দ্যাল মোটা হতে লাগল, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে বজ্রভেদী তোপেরও সৃষ্টি হতে চলল। এখন জাহাজখানি ইস্পাতের দ্যালওয়ালা কেল্লা, আর তোপগুলি যমের ছোট ভাই। এক গোলার ঘায়ে, যত বড় জাহাজই হন না, ফেটে চুটে চৌ-চাকলা! তবে এই ‘লুয়ার বাসর ঘর’, যা নকিন্দরের বাবা স্বপ্নেও ভাবেনি; এবং যা ‘সাতালি পর্বতের’ ওপর না দাঁড়িয়ে সত্তর হাজার পাহাড়ে ঢেউয়ের মাথায় নেচে নেচে বেড়ায়, ইনিও ‘টরপিডো’র ভয়ে অস্থির। তিনি হচ্ছেন কতকটা চুরুটের চেহারা একটি নল; তাঁকে ত্যাগ করে ছেড়ে দিলে তিনি জলের মধ্যে মাছের মত ডুবে ডুবে চলে যান। তারপর যেখানে লাগবার, সেখানে ধাক্কা যেই লাগা, অমনি তার মধ্যের রাশীকৃত মহাবিস্তারশীল পদার্থসকলের বিকট আওয়াজ ও বিস্ফোরণ, সঙ্গে সঙ্গে যে জাহাজের নীচে এই কীর্তিটা হয়, তার ‘পুনর্মূষিকো ভব’ অর্থাৎ লৌহত্বে ও কাঠকুটোত্বে কতক এবং বাকীটা ধূমত্বে ও অগ্নিত্বে পরিণমন! মনিষ্যিগুলো, যারা এই টরপিডো ফাটবার মুখে পড়ে যায়, তাদেরও যা খুঁজে পাওয়া যায়, তা প্রায় ‘কিমা’তে পরিণত অবস্থায়! এই সকল জঙ্গি জাহাজ তৈয়ার হওয়া অবধি জলযুদ্ধ আর বেশী হতে হয় না। দু-একটা লড়াই আর একটা বড় জঙ্গি ফতে বা একদম হার। তবে এই রকম জাহাজ নিয়ে লড়াই হবার পূর্বে, লোকে যেমন ভাবত যে, দু-পক্ষের কেউ বাঁচবে না, আর একদম সব উড়ে পুড়ে যাবে, তত কিছু হয় না।
ময়দানি জঙ্গের সময়, তোপ বন্দুক থেকে উভয় পক্ষের উপর যে মুষলধারা গোলাগুলি সম্পাত হয়, তার এক হিস্সে যদি লক্ষ্যে লাগে তো উভয় পক্ষের ফৌজ মরে দু- মিনিটে ধুন হয়ে যায়। সেই প্রকার, দরিয়াই জঙ্গের জাহাজের গোলা, যদি ৫০০ আওয়াজের একটা লাগত তো উভয় পক্ষের জাহাজের নাম-নিশানাও থাকত না। আশ্চর্য এই যে, যত তোপ-বন্দুক উৎকর্ষ লাভ করছে, বন্দুকের যত ওজন হাল্কা হচ্ছে, যত নালের কিরকিরার পরিপাটি হচ্ছে, যত পাল্লা বেড়ে যাচ্চে, যত ভরবার ঠাসবার কলকব্জা হচ্ছে, যত তাড়াতাড়ি আওয়াজ হচ্ছে, ততই যেন গুলি ব্যর্থ হচ্ছে! পুরানো ঢঙের পাঁচ হাত লম্বা তোড়াদার জজেল, যাকে দোঠেঙ্গো কাঠের উপর রেখে, তাগ করতে হয়, এবং ফুঁ ফাঁ দিয়ে আগুন দিতে হয়, তাই-সহায় বারাখজাই, আফ্রিদ আদমী অব্যর্থসন্ধান—আর আধুনিক সুশিক্ষিত ফৌজ, নানা-কল-কারখানা-বিশিষ্ট বন্দুক হাতে, মিনিটে ১৫০ আওয়াজ করে খালি হাওয়া গরম করে! অল্প স্বল্প কলকব্জা ভাল। মেলা কলকব্জা মানুষের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপাপত্তি করে জড়পিণ্ড তৈয়ার করে। কারখানায় লোকগুলো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর, সেই একঘেয়ে কাজই কচ্চে—এক এক দলে এক একটা জিনিষের টুকরোই গড়ছে। পিনের মাথাই গড়ছে, সুতোর জোড়াই দিচ্চে, তাঁতের সঙ্গে এগু-পেছুই কচ্চে—আজন্ম। ফল, ঐ কাজটিও খোয়ানো, আর তার মরণ—খেতেই পায় না। জড়ের মত একঘেয়ে কাজ করতে করতে জড়বৎ হয়ে যায়। স্কুলমাষ্টারি, কেরানীগিরি করে ঐ জন্যই হস্তিমূর্খ জড়পিণ্ড তৈয়ার হয়!
বাণিজ্য-যাত্রী জাহাজের গড়ন অন্য ঢঙের। যদিও কোন কোন বাণিজ্য-জাহাজ এমন ঢঙে তৈয়ার যে, লড়ায়ের সময় অত্যল্প আয়াসেই দু-চারটা তোপ বসিয়ে অন্যান্য নিরস্ত্র পণ্যপোতকে তাড়াহুড়ো দিতে পারে এবং তজ্জন্য ভিন্ন ভিন্ন সরকার হতে সাহায্য পায়, তথাপি সাধারণতঃ সমস্তগুলিই যুদ্ধপোত হতে অনেক তফাত। এ সকল জাহাজ প্রায়ই এখন বাষ্পপোত এবং প্রায় এত বৃহৎ ও এত দাম লাগে যে, কোম্পানী ভিন্ন একলার জাহাজ নাই বললেই হয়। আমাদের দেশের ও ইওরোপের বাণিজ্যে পি. এণ্ড ও. কোম্পানী সকলের অপেক্ষা প্রাচীন ও ধনী; তারপর, বি. আই. এস্. এন্. কোম্পানী; আরও অনেক কোম্পানী আছে। ভিন্ন সরকারের মধ্যে মেসাজারি মারিতীম (Messageries Maritimes) ফরাসী, অষ্ট্রীয়ান লয়েড, জার্মান লয়েড এবং ইতালীয়ান রুবাটিনো কোম্পানী প্রসিদ্ধ। এতন্মধ্যে পি. এণ্ড ও. কোম্পানী যাত্রী-জাহাজ সর্বাপেক্ষা নিরাপদ ও ক্ষিপ্রগামী—লোকের এই ধারণা। মেসাজারির ভক্ষ্য-ভোজ্যের বড়ই পারিপাট্য।
এবার আমরা যখন আসি, তখন ঐ দুই কোম্পানীই প্লেগের ভয়ে কালা আদমী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এবং আমাদের সরকারের একটা আইন আছে যে, যেন কোন কালা আদমী এমিগ্রাণ্ট অফিসের সার্টিফিকেট ভিন্ন বাহিরে না যায়। অর্থাৎ আমি যে স্ব-ইচ্ছায় বিদেশে যাচ্চি, কেউ আমায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোথাও বেচবার জন্য বা কুলী করবার জন্য নিয়ে যাচ্চে না, এইটি তিনি লিখে দিলে তবে জাহাজে আমায় নিলে। এই আইন এতদিন ভদ্র-লোকের বিদেশ যাওয়ার পক্ষে নীরব ছিল, এক্ষণে প্লেগের ভয়ে জেগে উঠেছে; অর্থাৎ যে কেউ ‘নেটিভ’ বাহিরে যাচ্চে, তা যেন সরকার টের পান। তবে আমরা দেশে শুনি, আমাদের ভেতর অমুক ভদ্র জাত, অমুক ছোট জাত; সরকারের কাছে সব ‘নেটিভ’। মহারাজা, রাজা, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—সব এক জাত—‘নেটিভ’। কুলির আইন, কুলীর যে পরীক্ষা, তা সকল ‘নেটিভের’ জন্য—ধন্য ইংরেজ সরকার! একক্ষণের জন্যও তোমার কৃপায় সব ‘নেটিভের’ সঙ্গে সমত্ব বোধ করলেম। বিশেষ, কায়স্থকুলে এ শরীরের পয়দা হওয়ায়, আমি তো চোরের দায়ে ধরা পড়েছি।
এখন সকল জাতির মুখে শুনছি, তাঁরা নাকি পাকা আর্য! তবে পরস্পরের মধ্যে মতভেদ আছে—কেউ চার পো আর্য, কেউ এক ছটাক কম, কেউ আধ কাঁচ্চা! তবে সকলেই আমাদের পোড়া জাতের চেয়ে বড়, এতে একবাক্য! আর শুনি, ওঁরা আর ইংরেজরা নাকি এক জাত, মাসতুতো ভাই; ওঁরা কালা আদমী নন। এ দেশে দয়া করে এসেছেন, ইংরেজের মত। আর বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, মূর্তিপূজা, সতীদাহ, জেনানা পর্দা ইত্যাদি ইত্যাদি—ও-সব ওদের ধর্মে আদৌ নাই। ও-সব ঐ কায়েতফায়েতের বাপ-দাদা করেছে। আর ওঁদের ধর্মটা ঠিক ইংরেজদের ধর্মের মত। ওঁদের বাপ-দাদা ঠিক ইংরেজদের মত ছিল; কেবল রোদ্দুরে বেড়িয়ে বেড়িয়ে কালো হয়ে গেল! এখন এস না এগিয়ে? ‘সব নেটিভ’ সরকার বলছেন। ও কালোর মধ্যে আবার এক পোঁচ কম-বেশী বোঝা যায় না; সরকার বলছেন, সব নেটিভ। সেজেগুজে বসে থাকলে কি হবে বল? ও টুপি-টাপা মাথায় দিয়ে আর কি হবে বল? যত দোষ হিঁদুর ঘাড়ে ফেলে সাহেবের গা ঘেঁষে দাঁড়াতে গেলে, লাথি-ঝাঁটার চোটটা বেশী বৈ কম পড়বে না। ধন্য ইংরেজরাজ! তোমার ধনে-পুত্রে লক্ষী লাভ তো হয়েছেই, আরও হোক, আরও হোক। কপনি, ধুতির টুকরো পরে বাঁচি। তোমার কৃপায় শুধু-পায়ে শুধু-মাথায় হিল্লী দিল্লী যাই, তোমার দয়ায় হাত চুবড়ে সপাসপ দাল-ভাত খাই। দিশি সাহেবিত্ব লুভিয়েছিল আর কি, ভোগা দিয়েছিল আর কি। দিশি কাপড় ছাড়লেই, দিশি ধর্ম ছাড়লেই, দিশি চাল-চলন ছাড়লেই ইংরেজ রাজা মাথায় করে নাকি নাচবে শুনেছিলুম, করতেও যাই আর কি, এমন সময় গোরা পায়ের সবুট লাথির হুড়োহুড়ি, চাবুকের সপাসপ! পালা পালা, সাহেবিতে কাজ নেই, নেটিভ কব্লা। ‘সাধ করে শিখেছিনু সাহেবানি কত, গোরার বুটের তলে সব হৈল হত।’ ধন্য ইংরেজ সরকার! তোমার ‘তখ্ৎ তাজ অচল রাজধানী’ হউক।
আর যা কিছু সাহেব হবার সাধ ছিল, মিটিয়ে দিলে মার্কিন ঠাকুর। দাড়ির জ্বালায় অস্থির, কিন্তু নাপিতের দোকানে ঢোকবামাত্রই বললে ‘ও চেহারা এখানে চলবে না!’ মনে করলুম, বুঝি পাগড়ি-মাথায় গেরুয়া রঙের বিচিত্র ধোকড়া-মন্ত্র গায়, অপরূপ দেখে নাপিতের পছন্দ হল না; তা একটা ইংরেজী কোট আর টোপা কিনে আনি। আনি আর কি—ভাগ্যিস একটি ভদ্র মার্কিনের সঙ্গে দেখা; সে বুঝিয়ে দিলে যে বরং ধোকড়া আছে ভাল, ভদ্রলোকে কিছু বলবে না, কিন্তু ইওরোপী পোষাক পরলেই মুশকিল, সকলেই তাড়া দেবে। আরও দু-একটা নাপিত ঐ প্রকার রাস্তা দেখিয়ে দিলে। তখন নিজের হাতে কামাতে ধরলুম। খিদেয় পেট জ্বলে যায়, খাবার দোকানে গেলুম, ‘অমুক জিনিষটা দাও’; বললে ‘নেই’। ‘ঐ যে রয়েছে।’ ‘ওহে বাপু সাদা ভাষা হচ্চে, তোমার এখানে বসে খাবার জায়গা নেই।’ ‘কেন হে বাপু?’ ‘তোমার সঙ্গে যে খাবে, তার জাত যাবে।’ তখন অনেকটা মার্কিন মুলুককে দেশের মত ভাল লাগতে লাগল। যাক পাপ কালা আর ধলা, আর এই নেটিভের মধ্যে উনি পাঁচ পো আর্য রক্ত, উনি চার পো, উনি দেড় ছটাক কম, ইনি আধ ছটাক, আধ কাঁচ্চা বেশী ইত্যাদি—বলে ‘ছুঁচোর গোলাম চামচিকে, তার মাইনে চোদ্দ সিকে।’ একটা ডোম বলত, ‘আমাদের চেয়ে বড় জাত কি আর দুনিয়ার আছে? আমরা হচ্চি ডম্ম্ম্ম্!’ কিন্তু মজাটি দেখছ? জাতের বেশী বিটলেমিগুলো—যেখানে গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল, সেইখানে!
বাষ্পপোত বায়ুপোত অপেক্ষা অনেক বড় হয়। যে সকল বাষ্পপোত আটলাণ্টিক পারাপার করে, তার এক একখান আমাদের এই ‘গোলকোণ্ডা’১১ জাহাজের ঠিক দেড়া। যে জাহাজে করে জাপান হতে পাসিফিক্ পার হওয়া গিয়েছিল, তাও ভারি বড় ছিল। খুব বড় জাহাজের মাঝখানে প্রথম শ্রেণী, দুপাশে খানিকটা জায়গা, তারপর দ্বিতীয় শ্রেণী ও ‘ষ্টীয়ারেজ’ এদিক ওদিকে। আর এক সীমায় খালাসীদের ও চাকরদের স্থান। ষ্টীয়ারেজ যেন তৃতীয় শ্রেণী; তাতে খুব গরীব লোক যায়, যারা আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে উপনিবেশ করতে যাচ্চে। তাদের থাকবার স্থান অতি সামান্য এবং হাতে হাতে আহার দেয়। যে সকল জাহাজ হিন্দুস্থান ও ইংলণ্ডের মধ্যে যাতায়াত করে, তাদের ষ্টীয়ারেজ নাই, তবে ডেকযাত্রী আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যে খোলা জায়গা, সেই স্থানটায় তারা বসে শুয়ে যায়। তা দূর-দূরের যাত্রায় তো একটিও দেখলুম না। কেবল ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে চীনদেশে যাবার সময়, বোম্বে থেকে কতকগুলি চীনে লোক বরাবর হংকং পর্যন্ত ডেকে গিয়েছিল।
ঝড়-ঝাপট হলেই ডেকযাত্রীর বড় কষ্ট, আর কতক কষ্ট যখন বন্দরে মাল নাবায়। এক উপরে ‘হরিকেন ডেক’ ছাড়া সব ডেকের মধ্যে একটা করে মস্ত চৌকা কাটা আছে, তারই মধ্য দিয়ে মাল নাবায় এবং তোলে। সেই সময় ডেকযাত্রীর একটু কষ্ট হয়। নতুবা কলকেতা হতে সুয়েজ পর্যন্ত এবং গরমের দিনে ইওরোপেও ডেকে বড় আরাম। যখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রীরা তাঁদের সাজান গুজান কামরার মধ্যে গরমের চোটে তরলমূর্তি ধরবার চেষ্টা করছেন, তখন ডেক যেন স্বর্গ। দ্বিতীয় শ্রেণী—এসব জাহাজের বড়ই খারাপ।কেবল এক নূতন জার্মান লয়েড কোম্পানী হয়েছে; জার্মানীর বের্গেন নামক শহর হতে অষ্ট্রেলিয়ায় যায়; তাদের দ্বিতীয় শ্রেণী বড় সুন্দর, এমন কি ‘হরিকেন ডেকে’ পর্যন্ত ঘর আছে এবং খাওয়া-দাওয়া প্রায় গোলকোণ্ডার প্রথম শ্রেণীর মত। সে লাইন কলম্বো ছুঁয়ে যায়। এ গোলকোণ্ডা জাহাজে ‘হরিকেন ডেকে’র উপর কেবল দুটি ঘর আছে; একটি এ পাশে, একটি ও পাশে। একটিতে থাকেন ডাক্তার, আর একটি আমাদের দিয়েছিল। কিন্তু গরমের ভয়ে আমরা নীচের তলায় পালিয়ে এলুম। ঐ ঘরটি জাহাজের ইঞ্জিনের উপর। জাহাজ লোহার হলেও যাত্রীদের কামরাগুলি কাঠের; ওপর নীচে, সে কাঠের দেয়ালে বায়ুসঞ্চারের জন্য অনেকগুলি ছিদ্র থাকে। দ্যালগুলিতে ‘আইভরি পেণ্ট’ লাগানো; এক একটি ঘরে তার জন্য প্রায় পঁচিশ পাউণ্ড খরচ পড়েছে। ঘরের মধ্যে একখানি ছোট কার্পেট পাতা। একটি দ্যালের গায়ে দুটি খুরোহীন লোহার খাটিয়ার মত এঁটে দেওয়া; একটির উপর আর একটি। অপর দ্যালের ঐ রকম একখানি ‘সোফা’। দরজার ঠিক উল্টা দিকে মুখ হাত ধোবার জায়গা, তার উপর একখানি আরশি, দুটো বোতল, খাবার জলের দুটো গ্লাস। ফি-বিছানার গায়ের দিকে একটি করে জালতি পেতলের ফ্রেমে লাগানো। ঐ জালতি ফ্রেম সহিত দ্যালের গায়ে লেগে যায়, আবার টানলে নেবে আসে। রাত্রে যাত্রীদের ঘড়ি প্রভৃতি অত্যাবশ্যক জিনিষপত্র তাইতে রেখে শোয়। নীচে বিছানার নীচে সিন্দুক প্যাঁটরা রাখবার জায়গা। সেকেণ্ড ক্লাসের ভাবও ঐ, তবে স্থান সংকীর্ণ ও জিনিষপত্র খেলো। জাহাজী কারবারটা প্রায় ইংরেজের একচেটে। সে জন্য অন্যান্য জাতেরা যে সকল জাহাজ করেছে, তাতেও ইংরেজযাত্রী অনেক বলে খাওয়া-দাওয়া অনেকটা ইংরেজদের মত করতে হয়। সময়ও ইংরেজী-রকম করে আনতে হয়। ইংলণ্ডে, ফ্রান্সে, জার্মানীতে, রুশিয়াতে খাওয়া-দাওয়ায় এবং সময়ে অনেক পার্থক্য আছে। যেমন আমাদের ভারতবর্ষে—বাঙলায়, হিন্দুস্থানে, মহারাষ্ট্রে, গুজরাতে, মান্দ্রাজে তফাত। কিন্তু এ সকল পার্থক্য জাহাজে অল্প দেখা যায়। ইংরেজীভাষী যাত্রীর সংখ্যাধিক্যে ইংরাজী ঢঙে সব গড়ে যাচ্চে।
বাষ্পপোতে সর্বেসর্বা কর্তা হচ্ছেন ‘কাপ্তেন’। পূর্বে ‘হাই সী’তে১২ কাপ্তেন জাহাজে রাজত্ব করতেন; কাউকে সাজা দিতেন, ডাকাত ধরে ফাঁসি দিতেন, ইত্যাদি। এখন অত নাই, তবে তাঁর হুকুমই আইন—জাহাজে তাঁর নীচে চারজন ‘অফিসার’ বা (দিশী নাম) ‘মালিম’, তারপর চার পাঁচ জন ইঞ্জিনীয়র। তাদের যে ‘চীফ্’, তার পদ অফিসারের সমান, সে প্রথম শ্রেণীতে খেতে পায়। আর আছে চার পাঁচ জন ‘সুকানি’—যারা হাল ধরে থাকে পালাক্রমে, এরাও ইওরোপী। বাকী সমস্ত চাকর-বাকর, খালাসী, কয়লাওয়ালা হচ্ছে দেশী লোক, সকলেই মুসলমান। হিন্দু কেবল বোম্বাইয়ের তরফে দেখেছিলুম, পি. এণ্ড ও. কোম্পানীর জাহাজে। চাকররা এবং খালাসীরা কলকেতার, কয়লাওয়ালারা পূর্ববঙ্গের, রাঁধুনীরাও পূর্ববঙ্গের ক্যাথলিক ক্রিশ্চান। আর আছে চারজন মেথর। কামরা হতে ময়লা জল সাফ প্রভৃতি মেথররা করে, স্নানের বন্দোবস্ত করে, আর পায়খানা প্রভৃতি দুরস্ত রাখে। মুসলমান চাকর-খালাসীরা ক্রিশ্চানের রান্না খায় না; তাতে আবার জাহাজে প্রত্যহ শোর তো আছেই। তবে অনেকটা আড়াল দিয়ে কাজ সারে। জাহাজের রান্নাঘরের তৈয়ারী রুটি প্রভৃতি স্বচ্ছন্দে খায়, এবং যে সকল কলকেত্তাই চাকর নয়া রোশনাই পেয়েছে, তারা আড়ালে খাওয়া-দাওয়া বিচার করে না। লোকজনদের তিনটা ‘মেস’ আছে। একটা চাকরদের, একটা খালাসীদের, একটা কয়লাওয়ালাদের; একজন করে ভাণ্ডারী অর্থাৎ রাঁধুনী আর একটি চাকর কোম্পানী ফি-মেসকে দেয়। ফি-মেসের একটা রাঁধবার স্থান আছে। কলকেতা থেকে কতক হিঁদু ডেকযাত্রী কলম্বোয় যাচ্ছিল; তারা ঐ ঘরে চাকরদের রান্না হয়ে গেলে রেঁধে খেত। চাকরবাকররা জলও নিজেরা তুলে খায়। ফি-ডেকে দ্যালের গায় দুপাশে দুটি ‘পম্প’; একটি নোনা, একটি মিঠে জলের, সেখান হতে মিঠে জল তুলে মুসলমানেরা ব্যবহার করে। যে সকল হিঁদুর কলের জলে আপত্তি নাই, খাওয়া-দাওয়ার সম্পূর্ণ বিচার রক্ষা করে এই সকল জাহাজে বিলাত প্রভৃতি দেশে যাওয়া তাদের অত্যন্ত সোজা। রান্নাঘর পাওয়া যায়, কারুর ছোঁয়া জল খেতে হয় না, স্নানের পর্যন্ত জল অন্য কোন জাতের ছোঁবার আবশ্যক নাই; চাল ডাল শাক পাত মাছ দুধ ঘি সমস্তই জাহাজে পাওয়া যায়, বিশেষ এই সকল জাহাজে দেশী লোক সমস্ত কাজ করে বলে ডাল চাল মূলো কপি আলু প্রভৃতি রোজ রোজ তাদের বার করে দিতে হয়। এক কথা—‘পয়সা’। পয়সা থাকলে একলাই সম্পূর্ণ আচার রক্ষা করে যাওয়া যায়।
এই সকল বাঙালী লোকজন প্রায় আজকাল সব জাহাজে—যেগুলি কলকেতা হতে ইওরোপে যায়। এদের ক্রমে একটা জাত সৃষ্টি হচ্ছে; কতকগুলি জাহাজী পারিভাষিক শব্দেরও সৃষ্টি হচ্ছে। কাপ্তেনকে এরা বলে—‘বাড়ীওয়ালা’, ‘অফিসার’—‘মালিম’, মাস্তুল— ‘ডোল’, পাল—‘সড়’, নামাও—‘আরিয়া’, ওঠাও—‘হাবিস’ (heave) ইত্যাদি।
খালাসীদের এবং কয়লাওয়ালাদের একজন করে সর্দার আছে, তার নাম ‘সারেঙ্গ’, তার নীচে দুই তিন জন ‘টিণ্ডাল’, তারপর খালাসী বা কয়লাওয়ালা।
খানসামাদের (boy) কর্তার নাম ‘বট্লার’ (butler); তার ওপর একজন গোরা ‘ষ্টুয়ার্ড’। খালাসীদের জাহাজ ধোওয়া-পোঁছা, কাছি ফেলা তোলা, নৌকা নামানো ওঠানো, পাল তোলা, পাল নামানো (যদিও বাষ্পপোতে ইহা কদাপি হয়) ইত্যাদি কাজ করে। সারেঙ্গ ও টিণ্ডালরা সর্বদাই সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে, এবং কাজ করছে। কয়লাওয়ালা ইঞ্জিন-ঘরে আগুন ঠিক রাখছে; তাদের কাজ দিনরাত আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা, আর ইঞ্জিন ধুয়ে পুঁছে সাফ রাখা। সে বিরাট ইঞ্জিন, আর তার শাখা-প্রশাখা সাফ রাখা কি সোজা কাজ? ‘সারেঙ্গ’ এবং তার ‘ভাই’ আসিস্টাণ্ট সারেঙ্গ কলকেতার লোক, বাঙলা কয়, অনেকটা ভদ্রলোকের মত; লিখতে পড়তে পারে, স্কুলে পড়েছিল, ইংরেজীও কয়—কাজ চালানো। সারেঙ্গের তের বছরের ছেলে কাপ্তেনের চাকর—দরজায় থাকে আর্দালী। এই সকল বাঙালী খালাসী, কয়লাওয়ালা, খানসামা প্রভৃতির কাজ দেখে, স্বজাতির উপর যে একটা হতাশ বুদ্ধি আছে, সেটা অনেকটা কমে গেল। এরা কেমন আস্তে আস্তে মানুষ হয়ে আসছে, কেমন সবলশরীর হয়েছে, কেমন নির্ভীক অথচ শান্ত! সে নেটিভি পা-চাটা ভাব মেথরগুলোরও নেই—কি পরিবর্তন!
দেশী মাল্লারা কাজ করে ভাল, মুখে কথাটি নাই, আবার সিকিখানা গোরার মাইনে। বিলাতে অনেকে অসন্তুষ্ট; বিশেষ—অনেক গোরার অন্ন যাচ্চে দেখে, খুশী নয়। তারা মাঝে মাঝে হাঙ্গামা তোলে। আর তো কিছু বলবার নেই; কাজে গোরার চেয়ে চটপটে। তবে বলে, ঝড়-ঝাপ্টা হলে, জাহাজ বিপদে পড়লে এদের সাহস থাকে না। হরিবোল হরি! কাজে দেখা যাচ্চে—ও অপবাদ মিথ্যা। বিপদের সময় গোরাগুলো ভয়ে মদ খেয়ে, জড় হয়ে, নিকম্মা হয়ে যায়। দেশী খালাসী এক ফোঁটা মদ জন্মে খায় না, আর এ পর্যন্ত কোন মহা বিপদে একজনও কাপুরুষত্ব দেখায়নি। বলি, দেশী সেপাই কি কাপুরুষত্ব দেখায়? তবে নেতা চাই। জেনারেল ষ্ট্রঙ্ নামক এক ইংরেজ বন্ধু সিপাহী-হাঙ্গামার সময় এদেশে ছিলেন। তিনি ‘গদরে’র গল্প অনেক করতেন। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করা গেল যে, সিপাহীদের এত তোপ বারুদ রসদ হাতে ছিল, আবার তারা সুশিক্ষিত ও বহুদর্শী, তবে এমন করে হেরে মলো কেন? জবাব দিলেন যে, তার মধ্যে যারা নেতা হয়েছিল, সেগুলো অনেক পেছনে থেকে ‘মারো বাহাদুর’—‘লড়ো বাহাদুর’ করে চেঁচাচ্ছিল; অফিসার এগিয়ে মৃত্যুমুখে না গেলে কি সিপাহী লড়ে? সকল কাজেই এই। ‘শিরদার তো সরদার’; মাথা দিতে পার তো নেতা হবে। আমরা সকলেই ফাঁকি দিয়ে নেতা হতে চাই; তাইতে কিছুই হয় না, কেউ মানে না!
আর্য বাবাগণের জাঁকই কর, প্রাচীন ভারতের গৌরব ঘোষণা দিনরাতই কর; আর যতই কেন তোমরা ‘ডম্ম্ম্’ বলে ডম্ফই কর, তোমরা উচ্চবর্ণেরা কি বেঁচে আছ? তোমরা হচ্চ দশ হাজার বছরের মমি!! যাদের ‘চলমান শ্মশান’ বলে তোমাদের পূর্বপুরুষেরা ঘৃণা করেছেন, ভারতে যা কিছু বর্তমান জীবন আছে, তা তাদেরই মধ্যে। আর ‘চলমান শ্মশান’ হচ্চ তোমরা। তোমাদের বাড়ী-ঘর-দুয়ার মিউজিয়ম, তোমাদের আচার-ব্যবহার, চালচলন দেখলে বোধ হয়, যেন ঠানদিদির মুখে গল্প শুনছি! তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ করেও ঘরে এসে মনে হয়, যেন চিত্রশালিকায় ছবি দেখে এলুম। এ মায়ার সংসারের আসল প্রহেলিকা, আসল মরু-মরীচিকা তোমরা—ভারতের উচ্চবর্ণেরা! তোমরা ভূত কাল—লুঙ্ লঙ্ লিট্ সব এক সঙ্গে। বর্তমান কালে তোমাদের দেখছি বলে যে বোধ হচ্ছে, ওটা অজীর্ণতাজনিত দুঃস্বপ্ন। ভবিষ্যতের তোমরা শূন্য, তোমরা ইৎ—লোপ লুপ্। স্বপ্নরাজ্যের লোক তোমরা, আর দেরী করছ কেন? ভূত-ভারত-শরীরের রক্তমাংসহীন-কঙ্কালকুল তোমরা, কেন শীঘ্র শীঘ্র ধূলিতে পরিণত হয়ে বায়ুতে মিশে যাচ্চ না? হুঁ, তোমাদের অস্থিময় অঙ্গুলিতে পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত কতকগুলি অমূল্য রত্নের অঙ্গুরীয়ক আছে, তোমাদের পূতিগন্ধ শরীরের আলিঙ্গনে পূর্বকালের অনেকগুলি রত্নপেটিকা রক্ষিত রয়েছে। এতদিন দেবার সুবিধা হয় নাই। এখন ইংরেজ রাজ্যে—অবাধ বিদ্যাচর্চার দিনে উত্তরাধিকারীদের দাও, যত শীঘ্র পার দাও। তোমরা শূন্যে বিলীন হও, আর নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে। বেরুক ঝোড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে। এরা সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে; নীরবে সয়েছে—তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা। সনাতন দুঃখ ভোগ করছে—তাতে পেয়েছে অটল জীবনীশক্তি। এরা এক মুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উল্টে দিতে পারবে; আধখানা রুটি পেলে ত্রৈলোক্যে এদের তেজ ধরবে না; এরা রক্তবীজের প্রাণসম্পন্ন। আর পেয়েছে অদ্ভুত সদাচারবল, যা ত্রৈলোক্যে নাই। এত শান্তি, এত প্রীতি, এত ভালবাসা, এত মুখটি চুপ করে দিনরাত খাটা এবং কার্যকালে সিংহের বিক্রম!! অতীতের কঙ্কালচয়! এই সামনে তোমার উত্তরাধিকারী ভবিষ্যৎ ভারত। ঐ তোমার রত্নপেটিকা, তোমার মানিকের আংটি—ফেলে দাও এদের মধ্যে, যত শীঘ্র পার ফেলে দাও, আর তুমি যাও হাওয়ায় বিলীন হয়ে, অদৃশ্য হয়ে যাও, কেবল কান খাড়া রেখো; তোমার যাই বিলীন হওয়া, অমনি শুনবে কোটি-জীমূতস্যন্দী ত্রৈলোক্যকম্পনকারী ভবিষ্যৎ ভারতের উদ্বোধন-ধ্বনি—‘ওয়াহ গুরু কি ফতে।’১৩
জাহাজ বঙ্গোপসাগরে যাচ্চে। এ সমুদ্র নাকি বড়ই গভীর। যেটুকু অল্প জল ছিল, সেটুকু মা গঙ্গা হিমালয় গুঁড়িয়ে পশ্চিম ধুয়ে এনে, বুজিয়ে জমি করে নিয়েছেন। সে জমি আমাদের বাঙলা দেশ। বাঙলা দেশ আর বড় এগুচ্চেন না, ঐ সোঁদরবন পর্যন্ত। কেউ বলেন, সোঁদরবন পূর্বে গ্রাম-নগরময় ছিল, উচ্চ ছিল। অনেকে এখন ও-কথা মানতে চায় না। যা হোক ঐ সোঁদরবনের মধ্যে আর বঙ্গোপসাগরের উত্তরভাগে অনেক কারখানা হয়ে গেছে। এই সকল স্থানেই পোর্তুগীজ বোম্বেটেদের আড্ডা হয়েছিল; আরকানরাজের এই সকল স্থান অধিকারের বহু চেষ্টা মোগল প্রতিনিধির গঞ্জালেজ প্রমুখ পোর্তুগীজ বোম্বেটেদের শাসিত করবার নানা উদ্যোগ; বারংবার ক্রিশ্চান, মোগল, মগ, বাঙালীর যুদ্ধ।
একে বঙ্গোপসাগর স্বভাবচঞ্চল, তাতে আবার এই বর্ষাকালে, মৌসুমের সময়, জাহাজ খুব হেলতে দুলতে যাচ্চেন। তবে এই তো আরম্ভ, পরে বা কি আছে! যাচ্চি মান্দ্রাজ। এই দাক্ষিণাত্যের বেশীর ভাগই এখন মান্দ্রাজ। জমিতে কি হয়? ভাগ্যবানের হাতে পড়ে মরুভূমিও স্বর্গ হয়। নগণ্য ক্ষুদ্র মান্দ্রাজ শহর যার নাম চিন্নাপট্টনম্, অথবা মান্দ্রাসপট্টনম্, চন্দ্রগিরির রাজা একদল বণিককে বেচেছিল। তখন ইংরেজের ব্যবসা জাভায়। বান্তাম শহর ইংরেজদিগের এশিয়ার বাণিজ্যের কেন্দ্র। মান্দ্রাজ প্রভৃতি ইংরেজী কোম্পানির ভারতবর্ষের সব বাণিজ্যস্থান বান্তামের দ্বারা পরিচালিত। সে বান্তাম কোথায়? আর সে মান্দ্রাজ কি হয়ে দাঁড়াল! শুধু ‘উদ্যোগিনং পুরুষসিংহমুপৈতি লক্ষ্মীঃ’ নয় হে ভায়া; পেছনে মায়ের বল। তবে উদ্যোগী পুরুষকেই মা বল দেন—এ-কথাও মানি। মান্দ্রাজ মনে পড়লে খাঁটি দক্ষিণদেশ মনে পড়ে। যদিও কলকেতার জগন্নাথের ঘাটেই দক্ষিণদেশের আমেজ পাওয়া যায় (সেই থর-কামানো মাথা, ঝুটি বাঁধা, কপালে অনেক চিত্র বিচিত্র, শুঁড়-ওল্টানো চটিজুতো, যাতে কেবল পায়ের আঙুল-কটি ঢোকে, আর নস্যদরবিগলিত নাসা, ছেলেপুলের সর্বাঙ্গে চন্দনের ছাপা লাগাতে মজবুত) উড়ে বামুন দেখে। গুজরাতী বামুন, কালো কুচকুচে দেশস্থ বামুন, ধপধপে ফর্সা বেরালচোখো চৌকা-মাথা কোকনস্থ বামুন, সব ঐ এক প্রকার বেশ, সব দক্ষিণী বলে পরিচিত—অনেক দেখেছি, কিন্তু ঠিক দক্ষিণী ঢঙ মান্দ্রাজীতে। সে রামানুজী তিলক-পরিব্যাপ্ত ললাটমণ্ডল—দূর থেকে যেন ক্ষেত চৌকি দেবার জন্য কেলে হাঁড়িতে চুন মাখিয়ে পোড়া কাঠের ডগায় বসিয়েছে, যে তিলকের শাগরেদ রামানন্দী তিলকের মহিমা সম্বন্ধে লোকে বলে, ‘তিলক তিলক সব কোই কহে, পর রামানন্দী তিলক দিখত গঙ্গা-পারসে যম গৌদ্বারকে খিড়ক্!’ (আমাদের দেশে চৈতন্যসম্প্রদায়ের সর্বাঙ্গে ছাপ দেওয়া গোঁসাই দেখে মাতাল চিতেবাঘ ঠাওরেছিল—এ মান্দ্রাজী তিলক দেখে চিতেবাঘ গাছে চড়ে!); আর সে তামিল তেলেগু মলয়ালম্ বুলি—যা ছয় বৎসর শুনেও এক বর্ণ বোঝবার যো নাই, যাতে দুনিয়ার রকমারী ল-কার ও ড-কারের কারখানা; আর সেই ‘মুড়গ্তন্নির রসম্’১৪ সহিত ভাত সাপড়ানো—যার এক এক গরাসে বুক ধড়ফড় করে ওঠে (এমনি ঝাল আর তেঁতুল!); সে ‘মিঠে-নিমের পাতা, ছোলার দাল, মুগের দাল, ফোড়ন, দধ্যোদন’ ইত্যাদি ভোজন; আর সে রেড়ির তেল মেখে স্নান, রেড়ির তেলে মাছ ভাজা—এ না হলে কি দক্ষিণ মুলুক হয়?
আবার এই দক্ষিণ মুলুক, মুসলমান রাজত্বের সময় এবং তার কত দিনের আগে থেকেও হিন্দুধর্ম বাঁচিয়ে রেখেছে। এই দক্ষিণ মুলুকেই—সামনে টিকি, নারকেল-তেলখেকো জাতে—শঙ্করাচার্যের জন্ম; এই দেশেই রামানুজ জন্মেছিলেন; এই মধ্বমুনির জন্মভূমি। এঁদেরই পায়ের নীচে বর্তমান হিন্দুধর্ম। তোমাদের চৈতন্যসম্প্রদায় এ মধ্বসম্প্রদায়ের শাখামাত্র; ঐ শঙ্করের প্রতিধ্বনি কবীর, দাদু, নানক, রামসনেহী প্রভৃতি সকলেই; ঐ রামানুজের শিষ্যসম্প্রদায় অযোধ্যা প্রভৃতি দখল করে আছে। এই দক্ষিণী ব্রাহ্মণরা হিন্দুস্থানের ব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করে না, শিষ্য করতে চায় না, সেদিন পর্যন্ত সন্ন্যাস দিত না। এই মান্দ্রাজীরাই এখনও বড় বড় তীর্থস্থান দখল করে বসে আছে। এই দক্ষিণদেশেই—যখন উত্তরভারতবাসী ‘আল্লা হু আক্বর, দীন্ দীন্’ শব্দের সামনে ভয়ে ধনরত্ন ঠাকুর-দেবতা স্ত্রী-পুত্র ফেলে ঝোড়ে জঙ্গলে লুকুচ্ছিল, [তখন] রাজচক্রবর্তী বিদ্যানগরাধিপের অচল সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দক্ষিণদেশেই সেই অদ্ভুত সায়ণের জন্ম্—যাঁর যবনবিজয়ী বাহুবলে বুক্করাজের সিংহাসন, মন্ত্রণায় বিদ্যানগর সাম্রাজ্য, নয়মার্গে ১৫ দাক্ষিণাত্যের সুখ-সাচ্ছন্দ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল, যাঁর অমানব প্রতিভা ও অলৌকিক পরিশ্রমের ফলস্বরূপ সমগ্র বেদরাশির টীকা, যাঁর আশ্চর্য ত্যাগ বৈরাগ্য ও গবেষণার ফলস্বরূপ ‘পঞ্চদশী’ গ্রন্থ—সেই সন্ন্যাসী বিদ্যারণ্যমুনি সায়ণের১৬ এই জন্মভূমি। মান্দ্রাজ সেই ‘তামিল’ জাতির আবাস, যাদের সভ্যতা সর্বপ্রাচীন, যাদের ‘সুমের’ নামক শাখা ‘ইউফ্রেটিস’ তীরে প্রকাণ্ড সভ্যতা-বিস্তার—অতি প্রাচীনকালে করেছিল, যাদের জ্যোতিষ, ধর্মকথা, নীতি, আচার প্রভৃতি আসিরি বাবিলি সভ্যতার ভিত্তি, যাদের পুরাণসংগ্রহ বাইবেলের মূল, যাদের আর এক শাখা মালাবার উপকূল হয়ে অদ্ভুত মিসরি সভ্যতার সৃষ্টি করেছিল, যাদের কাছে আর্যেরা অনেক বিষয়ে ঋণী। এদেরই প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মন্দির দাক্ষিণাত্যে বীরশৈব বা বীরবৈষ্ণবসম্প্রদায়ের জয় ঘোষণা করেছে। এই যে এত বড় বৈষ্ণবধর্ম—এ-ও এই ‘তামিল’ নীচবংশোদ্ভূত শঠকোপ হতে উৎপন্ন, যিনি ‘বিক্রীয় সূর্পং স চচার যোগী’। এই তামিল আলওয়াড় বা ভক্তগণ এখনও সমগ্র বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের পূজ্য হয়ে রয়েছেন। এখনও এদেশে বেদান্তের দ্বৈত, বিশিষ্ট বা অদ্বৈত—সমস্ত মতের যেমন চর্চা, তেমন আর কুত্রাপি নাই। এখনও ধর্মের অনুরাগ এদেশে যত প্রবল, তেমন আর কোথাও নাই।
চব্বিশে জুন রাত্রে আমাদের জাহাজ মান্দ্রাজে পৌঁছাল। প্রাতঃকালে উঠে দেখি, সমুদ্রের মধ্যে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে-নেওয়া মান্দ্রাজের বন্দরে রয়েছি। ভেতরে স্থির জল; আর বাইরে উত্তাল তরঙ্গ গজরাচ্চে, আর এক বার বন্দরের দ্যালে লেগে দশ বার হাত লাফিয়ে উঠছে, আর ফেনময় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। সামনে সুপরিচিত মান্দ্রাজের ষ্ট্র্যাণ্ড রোড। দুজন ইংরেজ পুলিশ ইন্স্পেক্টর, একজন মান্দ্রাজী জমাদার, এক ডজন পাহারাওয়ালা জাহাজে উঠল। অতি ভদ্রতাসহকারে আমায় জানালে যে, কালা আদমীর কিনারায় যাবার হুকুম নাই, গোরার আছে। কালা যেই হোক না কেন, সে যেরকম নোংরা থাকে, তাতে তার প্লেগবীজ নিয়ে বেড়াবার বড়ই সম্ভাবনা, তবে আমার জন্য মান্দ্রাজীরা বিশেষ হুকুম পাবার দরখাস্ত করেছে, বোধ হয় পাবে। ক্রমে দু-চারটি করে মান্দ্রাজী বন্ধুরা নৌকায় চড়ে জাহাজের কাছে আসতে লাগল। ছোঁয়াছুঁয়ি হবার যো নাই, জাহাজ থেকে কথা কও। আলাসিঙ্গা, বিলিগিরি, নরসিংহাচার্য, ডাক্তার নঞ্জুণ্ডরাও, কিডি প্রভৃতি সকল বন্ধুদেরই দেখতে পেলুম। আঁব, কলা, নারিকেল, রাঁধা দধ্যোদন, রাশীকৃত গজা, নিমকি ইত্যাদির বোঝা আসতে লাগল। ক্রমে ভীড় হতে লাগল—ছেলে, মেয়ে, বুড়ো—নৌকায় নৌকা। আমার বিলাতী বন্ধু মিঃ শ্যামিএর, ব্যারিষ্টার হয়ে মান্দ্রাজে এসেছেন, তাঁকেও দেখতে পেলেম। রামকৃষ্ণানন্দ আর নির্ভয়১৭ বারকতক আনাগোনা করলে। তারা সারাদিন সেই রৌদ্রে নৌকায় থাকবে—শেষে ধমকাতে তবে যায়। ক্রমে যত খবর হল যে আমাকে নাবতে হুকুম দেবে না, তত নৌকায় ভীড় আরও বাড়তে লাগল। শরীরও ক্রমাগত জাহাজের বারাণ্ডায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবসন্ন হয়ে আসতে লাগল। তখন মান্দ্রাজী বন্ধুদের কাছে বিদায় চাইলাম, কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করলাম। আলাসিঙ্গা ‘ব্রহ্মবাদিন্’ ও মান্দ্রাজী কাজকর্ম সম্বন্ধে পরামর্শ করবার অবসর পায় না; কাজেই সে কলম্বো পর্যন্ত জাহাজে চলল। সন্ধ্যার সময় জাহাজ ছাড়লে। তখন একটা রোল উঠল। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, হাজারখানেক মান্দ্রাজী স্ত্রী-পুরুষ, বালক-বালিকা বন্দরের বাঁধের উপর বসেছিল—জাহাজ ছাড়তেই, তাদের এই বিদায়-সূচক রব! মান্দ্রাজীরা আনন্দ হলে বঙ্গদেশের মত হুলু দেয়।
মান্দ্রাজ হতে কলম্বো চার দিন। যে তরঙ্গভঙ্গ গঙ্গাসাগর থেকে আরম্ভ হয়েছিল, তা ক্রমে বাড়তে লাগল। মান্দ্রাজের পর আরও বেড়ে গেল। জাহাজ বেজায় দুলতে লাগল। যাত্রীরা মাথা ধরে ন্যাকার করে অস্থির। বাঙালীর ছেলে দুটিও ভারি ‘সিক্’। একটি তো ঠাউরেছে মরে যাবে; তাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেওয়া গেল যে কিছু ভয় নেই, অমন সকলেরই হয়, ওতে কেউ মরেও না, কিছুই না। সেকেণ্ড কেলাসটা আবার ‘ষ্ক্রুর’ ঠিক উপরে। ছেলে-দুটিকে কালা আদমী বলে, একটা অন্ধকূপের মত ঘর ছিল, তারই মধ্যে পুরেছে। সেখানে পবনদেবেরও যাবার হুকুম নাই, সূর্যেরও প্রবেশ নিষেধ। ছেলে-দুটির ঘরের মধ্যে যাবার যো নাই; আর ছাতের উপর—সে কি দোল। আবার যখন জাহাজের সামনেটা একটা ঢেউয়ের গহ্বর বসে যাচ্চে, আর পেছনটা উঁচু হয়ে উঠছে, তখন ষ্ক্রুটা জল ছাড়া হয়ে শূন্যে ঘুরছে, আর সমস্ত জাহাজটা ঢক ঢক ঢক ঢক করে নড়ে উঠছে। সেকেণ্ড কেলাসটা ঐ সময় যেমন বেড়ালে ইঁদুর ধরে এক একবার ঝাড়া দেয়, তেমনি করে নড়ছে।
যাই হোক এখন মন্সুনের সময়। যত—ভারত মহাসাগরে—জাহাজ পশ্চিমে চলবে, ততই বাড়বে এই ঝড়ঝাপট। মান্দ্রাজীরা অনেক ফলপাকড় দিয়েছিল; তার অধিকাংশ, আর গজা দধ্যোদন প্রভৃতি সমস্তই ছেলেদের দেওয়া গেল। আলাসিঙ্গা তাড়াতাড়ি একখানা টিকিট কিনে শুধু পায়ে জাহাজে চড়ে বসল। আলাসিঙ্গা বলে, সে কখনও কখনও জুতো পায়ে দেয়। দেশে দেশে রকমারী চাল। ইওরোপে মেয়েদের পা দেখানো বড় লজ্জা; কিন্তু আধখানা গা আদুড় রাখতে লজ্জা নেই। আমাদের দেশে মাথাটা ঢাকতে হবেই হবে, তা পরনে কাপড় থাক বা না থাক। আলাসিঙ্গা পেরুমল, এডিটার ‘ব্রহ্মবাদিন্’, মাইসোরী রামানুজী ‘রসম্’-খেকো ব্রাহ্মণ, কামানো মাথায় সমস্ত কপাল জুড়ে, ‘তেংকলে’ তিলক, ‘সঙ্গের সম্বল গোপনে অতি যতনে’ এনেছেন কি দুটো পুঁটলি! একটায় চিঁড়ে ভাজা, আর একটায় মুড়ি-মটর। জাত বাঁচিয়ে, ঐ মুড়ি-মটর চিবিয়ে, সিলোনে যেতে হবে! আলাসিঙ্গা আর একবার সিলোনে গিয়েছিল। তবে বেরাদারিলোক একটু গোল করবার চেষ্টা করে; কিন্তু পেরে ওঠেনি। ভারতবর্ষে ঐটুকুই বাঁচোয়া। বেরাদারি যদি কিছু না বলল তো আর কারও কিছু বলবার অধিকার নেই। আর সে দক্ষিণী বেরাদারি—কোনটায় আছেন সবশুদ্ধ পাঁচ-শ, কোনটায় সাত-শ, কোনটায় হাজারটি প্রাণী—কনের অভাবে ভাগনীকে বে করে! যখন মাইসোরে প্রথম রেল হয়, যে যে ব্রাহ্মণ দূর থেকে রেলগাড়ী দেখতে গিছল, তারা জাতচ্যুত হয়! যাই হোক, এই আলাসিঙ্গার মত মানুষ পৃথিবীতে অতি অল্প; অমন নিঃস্বার্থ, অমন প্রাণপণ খাটুনি, অমন গুরু-ভক্ত আজ্ঞাধীন শিষ্য জগতে অল্প হে ভায়া! মাথা কামানো ঝুটি-বাঁধা, শুধু-পায়, ধুতি-পরা মান্দ্রাজী ফার্ষ্টক্লাসে উঠল; বেড়াচ্চে-চেড়াচ্চে, খিদে পেলে মুড়ি-মটর চিবুচ্চে! চাকররা মাদ্রাজীমাত্রকেই ঠাওরায় ‘চেট্টি’, আর [বলে] ‘ওদের অনেক টাকা আছে, কিন্তু কাপড়ও পরবে না, আর খাবেও না’! তবে আমাদের সঙ্গে পড়ে ওর জাতের দফা ঘোলা হচ্ছে—চাকররা বলছে। বাস্তবিক কথা—তোমাদের পাল্লায় পড়ে মান্দ্রাজীদের জাতের দফা অনেকটা ঘোলা কেন, থক্থকিয়ে এসেছে!
আলাসিঙ্গার ‘সী-সিকনেস্’ হল না। তু-ভায়া প্রথমে একটু আধটু গোল করে সামলে বসে আছেন। চারদিন—কাজেই নানা বার্তালাপে ‘ইষ্ট-গোষ্ঠী’তে কাটল। সামনে কলম্বো। এই সিংহল, লঙ্কা। শ্রীরামচন্দ্র সেতু বেঁধে পার হয়ে লঙ্কার রাবণ-রাজাকে জয় করেছিলেন। সেতু তো দেখেচি—সেতুপতি মহারাজার বাড়ীতে, যে পাথরখানির উপর ভগবান্ রামচন্দ্র তাঁর পূর্বপুরুষকে প্রথম সেতুপতি-রাজা করেন, তাও দেখেচি। কিন্তু এ পাপ বৌদ্ধ সিলোনি লোকগুলো তো মানতে চায় না! বলে—আমাদের দেশে ও কিংবদন্তী পর্যন্ত নাই। আর নাই বললে কি হবে?—‘গোঁসাইজী পুঁথিতে লিখছেন যে।’ তার ওপর ওরা নিজের দেশকে বলে—সিংহল। লঙ্কা বলবে না, বলবে কোত্থেকে? ওদের না কথায় ঝাল, না কাজে ঝাল, না প্রকৃতিতে ঝাল!! রাম বল—ঘাগরা-পরা, খোঁপা-বাঁধা, আবার খোঁপায় মস্ত একখানা চিরুনী দেওয়া মেয়েমান্ষী চেহারা! আবার—রোগা-রোগা, বেঁটে-বেঁটে, নরম-নরম শরীর! এরা রাবণ-কুম্ভকর্ণের বাচ্চা? গেছি আর কি! বলে—বাঙলা দেশ থেকে এসেছিল—তা ভালই করেছিল। ঐ যে একদল দেশে উঠেছে, মেয়েমানুষের মত বেশভূষা, নরম-নরম বুলি কাটেন, এঁকে-বেঁকে চলেন, কারুর চোখের উপর চোখ রেখে কথা কইতে পারেন না, আর ভূমিষ্ঠ হয়ে অবধি পিরীতের কবিতা লেখেন, আর বিরহের জ্বালায় ‘হাঁসেন-হোঁসেন’ করেন—ওরা কেন যাক না বাপু সিলোনে। পোড়া গবর্ণমেণ্ট কি ঘুমুচ্চে গা? সেদিন পুরীতে কাদের ধরাপাকড়া করতে গিয়ে হুলুস্থূল বাধালে; বলি রাজধানীতে পাকড়া করে প্যাক করবারও যে অনেক রয়েছে।
একটা ছিল মহা দুষ্টু বাঙালী রাজার ছেলে—বিজয়সিংহ বলে! সেটা বাপের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে, নিজের মত আরও কতকগুলো সঙ্গী জুটিয়ে জাহাজে করে ভেসে ভেসে লঙ্কা নামক টাপুতে হাজির। তখন ওদেশে বুনো জাতের আবাস, যাদের বংশধরেরা এক্ষণে ‘বেদ্দা’ নামে বিখ্যাত। বুনো রাজা বড় খাতির করে রাখলে, মেয়ে বে দিলে। কিছুদিন ভাল মান্ষের মত রইল; তারপর একদিন মাগের সঙ্গে যুক্তি করে হঠাৎ রাত্রে সদলবলে উঠে বুনো রাজাকে সর্দারগণ সহিত কতল করে ফেললে। তারপর বিজয়সিংহ হলেন রাজা, দুষ্টুমির এইখানেই বড় অন্ত হলেন না। তারপর আর তাঁর বুনোর-মেয়ে রাণী ভাল লাগল না। তখন ভারতবর্ষ থেকে আরও লোকজন, আরও অনেক মেয়ে আনলেন। অনুরাধা বলে এক মেয়ে তো নিজে করলেন বিয়ে, আর সে বুনোর মেয়েকে জলাঞ্জলি দিলেন; সে জাতকে জাত নিপাত করতে লাগলেন। বেচারীরা প্রায় সব মারা গেল, কিছু অংশ ঝাড়-জঙ্গলে আজও বাস করছে। এই রকম করে লঙ্কার নাম হল সিংহল, আর হল বাঙালী বদমাশের উপনিবেশ! ক্রমে অশোক মহারাজার আমলে, তাঁর ছেলে মাহিন্দো আর মেয়ে সংঘমিত্তা সন্ন্যাস নিয়ে ধর্ম প্রচার করতে সিংহল টাপুতে উপস্থিত হলেন। এঁরা গিয়ে দেখলেন যে লোকগুলো বড়ই আদাড়ে হয়ে গিয়েছে। আজীবন পরিশ্রম করে, সেগুলোকে যথাসম্ভব সভ্য করলেন, উত্তম উত্তম নিয়ম করলেন; আর শাক্যমুনির সম্প্রদায়ে আনলেন। দেখতে দেখতে সিলোনিরা বেজায় গোঁড়া বৌদ্ধ হয়ে উঠল। লঙ্কাদ্বীপের মধ্যভাগে এক প্রকাণ্ড শহর বানালে, তার নাম দিলে অনুরাধাপুরম্, এখনও সে শহরের ভগ্নাবশেষ দেখলে আক্কেল হয়রান হয়ে যায়। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড স্তূপ, ক্রোশ ক্রোশ পাথরের ভাঙা বাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। আরও কত জঙ্গল হয়ে রয়েছে, এখনও সাফ হয় নাই। সিলোনময় নেড়া মাথা, করোয়াধারী, হলদে চাদর মোড়া ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ছড়িয়ে পড়ল। জায়গায় জায়গায় বড় বড় মন্দির উঠল—মস্ত মস্ত ধ্যানমূর্তি, জ্ঞানমুদ্রা করে প্রচারমূর্তি, কাত হয়ে শুয়ে মহানির্বাণ মূর্তি—তার মধ্যে। আর দ্যালের গায়ে সিলোনিরা দুষ্টুমি করলে নরকে তাদের কি হাল হয়, তাই আঁকা; কোনটাকে ভূতে ঠেঙাচ্চে, কোনটাকে করাতে চিরচে, কোনটাকে পোড়াচ্চে, কোনটাকে তপ্ত তেলে ভাজচে, কোনটার ছাল ছাড়িয়ে নিচ্চে—সে মহা বীভৎস কারখানা! এ ‘অহিংসা পরমো ধর্মে’র ভেতরে যে এমন কারখানা কে জানে বাপু! চীনেও ঐ হাল; জাপানেও ঐ। এদিকে তো অহিংসা আর সাজার পরিপাটি দেখলে আত্মাপুরুষ শুকিয়ে যায়। এক ‘অহিংসা পরমো ধর্মে’র বাড়ীতে ঢুকেচে—চোর। কর্তার ছেলেরা তাকে পাকড়া করে বেদম পিটছে। তখন কর্তা দোতলার বারাণ্ডায় এসে, গোলমাল দেখে, খবর নিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, ‘ওরে মারিসনি, মারিসনি; অহিংসা পরমো ধর্মঃ।’ বাচ্চা-অহিংসারা মার থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘তবে চোরকে কি করা যায়? ‘কর্তা আদেশ করলেন, ‘ওকে থলিতে পুরে জলে ফেলে দাও।’ চোর জোড় হাত করে আপ্যায়িত হয়ে বললে, ‘আহা, কর্তার কি দয়া!’
বৌদ্ধরা বড় শান্ত, সকল ধর্মের উপর সমদৃষ্টি—এই তো শুনেছিলুম। বৌদ্ধ প্রচারকেরা আমাদের কলকেতায় এসে রঙ-বেরঙের গাল ঝাড়ে; অথচ আমরা তাদের যথেষ্ট পূজা করে থাকি। অনুরাধাপুরে প্রচার করছি একবার, হিঁদুদের মধ্যে—বৌদ্ধদের মধ্যে নয়—তাও খোলা মাঠে, কারুর জমিতে নয়। ইতোমধ্যে দুনিয়ার বৌদ্ধ ‘ভিক্ষু’-গৃহস্থ, মেয়ে-মদ্দ, ঢাক- ঢোল কাঁসি নিয়ে এসে সে যে বিটকেল আওয়াজ আরম্ভ করলে, তা আর কি বলব! লেকচার তো ‘অলমিতি’ হল; রক্তারক্তি হয় আর কি! অনেক করে হিঁদুদের বুঝিয়ে দেওয়া গেল যে, আমরা নয় একটু অহিংসা করি এস—তখন শান্ত হয়।
ক্রমে উত্তর দিক্ থেকে হিঁদু তামিলকুল ধীরে ধীরে লঙ্কায় প্রবেশ করলে। বৌদ্ধরা বেগতিক দেখে রাজধানী ছেড়ে, কান্দি নামক পার্বত্য শহর স্থাপন করলে। তামিলরা কিছুদিনে তাও ছিনিয়ে নিলে এবং হিন্দুরাজা খাড়া করলে। তারপর এল ফিরিঙ্গীর দল, স্পানিয়ার্ড, পোর্তুগীজ, ওলন্দাজ। শেষ ইংরেজ রাজা হয়েছেন। কান্দির রাজবংশ তাঞ্জোরে প্রেরিত হয়েছেন, পেনশন আর মুড়গ্তন্নির ভাত খাচ্ছেন।
উত্তোর সিলোনে হিঁদুর ভাগ অনেক অধিক; দক্ষিণ ভাগে বৌদ্ধ আর রঙ-বেরঙের দোআঁশলা ফিরিঙ্গী। বৌদ্ধদের প্রধান স্থান—বর্তমান রাজধানী কলম্বো, আর হিন্দুদের জাফনা। জাতের গোলমাল ভারতবর্ষ হতে এখানে অনেক কম। বৌদ্ধদের একটু আছে বে-থার সময়। খাওয়া-দাওয়ায় বৌদ্ধদের আদতে নেই; হিঁদুদের কিছু কিছু। যত কসাই, সব বৌদ্ধ ছিল। আজকাল কমে যাচ্ছে; ধর্মপ্রচার হচ্ছে। বৌদ্ধদের অধিকাংশ ইওরোপী নাম ইন্দ্রম-পিন্দ্রম এখন বদলে নিচ্ছে। হিঁদুদের সব রকম জাত মিলে একটা হিঁদু জাত হয়েছে; তাতে অনেকটা পাঞ্জাবী জাঠদের মত সব জাতের মেয়ে, মায় বিবি পর্যন্ত বে করা চলে। ছেলে মন্দিরে গিয়ে ত্রিপুণ্ড্র কেটে ‘শিব শিব’ বলে হিঁদু হয়! স্বামী হিঁদু, স্ত্রী ক্রিশ্চান। কপালে বিভূতি মেখে ‘নমঃ পার্বতীপতয়ে’ বললেই ক্রিশ্চান সদ্য হিঁদু হয়ে যায়। তাতেই তোমাদের উপর এখানকার পাদ্রীরা এত চটা। তোমাদের আনাগোনা হয়ে অবধি, বহুৎ ক্রিশ্চান বিভূতি মেখে ‘নমঃ পার্বতীপতয়ে’ বলে হিঁদু হয়ে জাতে উঠেছে। অদ্বৈতবাদ আর বীরশৈববাদ এখানকার ধর্ম। হিঁদু-শব্দের জায়গায় ‘শৈব’ বলতে হয়। চৈতন্যদেব যে নৃত্যকীর্তন বঙ্গদেশে প্রচার করেন, তার জন্মভূমি দাক্ষিণাত্য, এই তামিল জাতির মধ্যে। সিলোনের তামিল ভাষা খাঁটি তামিল। সিলোনের ধর্ম, খাঁটি তামিল ধর্ম—সে লক্ষ লোকের উন্মাদ কীর্তন, শিবের স্তবগান, সে হাজারো মৃদঙ্গের আওয়াজ আর বড় বড় কত্তালের ঝাঁজ, আর এই বিভূতি-মাখা, মোটা মোটা রুদ্রাক্ষ গলায়, পহলওয়ানি চেহারা, লাল চোখ, মহাবীরের মত, তামিলদের মাতোয়ারা নাচ না দেখলে বুঝতে পারবে না।
কলম্বোর বন্ধুরা নাববার হুকুম আনিয়ে রেখেছিল, অতএব ডাঙায় নেবে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখাশুনা হল। স্যর কুমারস্বামী হিন্দুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, তাঁর স্ত্রী ইংরেজ, ছেলেটি শুধু-পায়ে, কপালে বিভূতি। শ্রীযুক্ত অরুণাচলম্ প্রমুখ বন্ধু-বান্ধবেরা এলেন। অনেক দিনের পর মুড়গ্তন্নি খাওয়া হল, আর কিং-কোকোনাট। ডাব কতকগুলো জাহাজে তুলে দিলে। মিসেস হিগিন্সের সঙ্গে দেখা হল, তাঁর বৌদ্ধ মেয়েদের বোর্ডিং স্কুল দেখলাম। কাউণ্টেসের বাড়ীটি মিসেস্ হিগিন্সের অপেক্ষা প্রশস্ত ও সাজান। কাউণ্টেস্ ঘর থেকে টাকা এনেছেন, আর মিসেস্ হিগিন্স ভিক্ষে করে করেছেন। কাউণ্টেস্ নিজে গেরুয়া কাপড় বাঙলার শাড়ীর মত পরেন। সিলোনের বৌদ্ধদের মধ্যে ঐ ঢঙ খুব ধরে গেছে দেখলাম। গাড়ী গাড়ী মেয়ে দেখলাম, সব ঐ ঢঙের শাড়ী পরা।
বৌদ্ধদের প্রধান তীর্থ কান্দিতে দন্ত-মন্দির। ঐ মন্দিরে বুদ্ধ-ভগবানের একটি দাঁত আছে। সিলোনীরা বলে, ঐ দাঁত আগে পুরীতে জগন্নাথ-মন্দিরে ছিল, পরে নানা হাঙ্গামা হয়ে সিলোনে উপস্থিত হয়। সেখানেও হাঙ্গামা কম হয় নাই। এখন নিরাপদে অবস্থান করছেন! সিলোনীরা আপনাদের ইতিহাস উত্তমরূপে লিখে রেখেছে। আমাদের মত নয়—খালি আষাঢ়ে গল্প। আর বৌদ্ধদের শাস্ত্র নাকি প্রাচীন মাগধী ভাষায়, এই দেশেই সুরক্ষিত আছে। এ স্থান হতেই ব্রহ্ম শ্যাম প্রভৃতি দেশে ধর্ম গেছে। সিলোনী বৌদ্ধরা তাদের শাস্ত্রোক্ত এক শাক্যমুনিকেই মানে, আর তাঁর উপদেশ মেনে চলতে চেষ্টা করে; নেপালী, সিকিম, ভুটানী, লাদাকী, চীনে, জাপানীদের মত শিবের পূজা করে না; আর ‘হ্রীং তারা’ ওসব জানে না। তবে ভূতটুত নামানো আছে। বৌদ্ধেরা এখন উত্তর আর দক্ষিণ দু-আম্নায় হয়ে গেছে। উত্তর আম্নায়েরা নিজেদের বলে ‘মহাযান’; আর দক্ষিণী অর্থাৎ সিংহলী ব্রহ্ম সায়ামি প্রভৃতিদের বলে ‘হীনযান’। মহাযানওয়ালারা বুদ্ধের পূজা নামমাত্র করে; আসল পূজা তারাদেবীর, আর অবলোকিতেশ্বরের (জাপানী, চীনে ও কোরিয়ানরা বলে ক্বানয়ন্); আর ‘হ্রীং ক্লীং’ তন্ত্র-মন্ত্রের বড় ধুম। টিবেটীগুলো আসল শিবের ভূত। ওরা সব হিঁদুর দেবতা মানে, ডমরু বাজায়, মড়ার খুলি রাখে, সাধুর হাড়ের ভেঁপু বাজায়, মদ-মাংসের যম। আর খালি মন্ত্র আওড়ে রোগ ভূত প্রেত তাড়াচ্ছে। চীন আর জাপানে সব মন্দিরের গায়ে ‘ওঁ হ্রীং ক্লীং’—সব বড় বড় সোনালী অক্ষরে লেখা দেখেছি। সে অক্ষর বাঙলার এত কাছাকাছি যে, বেশ বোঝা যায়।
আলাসিঙ্গা কলম্বো থেকে মান্দ্রাজে ফিরে গেল। আমরাও কুমারস্বামীর (কার্তিকের নাম—সুব্রহ্মণ্য, কুমারস্বামী ইত্যাদি; দক্ষিণ দেশে কার্তিকের ভারী পূজা, ভারী মান; কার্তিক ওঁ-কারের অবতার বলে।) বাগানের নেবু, কতকগুলো ডাবের রাজা (কিং-কোকোনাট), দু বোতল সরবৎ ইত্যাদি উপহার সহিত আবার জাহাজে উঠলাম।
আটাশে জুন প্রাতঃকাল জাহাজ কলম্বো ছাড়ল। এবার ভরা মনসুনের মধ্য দিয়ে গমন। জাহাজ যত এগিয়ে যাচ্ছে, ঝড় ততই বাড়ছে, বাতাস ততই বিকট নিনাদ করছে—উভশ্রান্ত বৃষ্টি, অন্ধকার, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঢেউ গর্জে গর্জে জাহাজের উপর এসে পড়ছে; ডেকের ওপর তিষ্ঠুনো দায়। খাবার টেবিলের উপর আড়ে লম্বায় কাঠ দিয়ে চৌকো চৌকো খুবরি করে দিয়েছে, তার নাম ‘ফিডল’। তার উপর দিয়ে খাবার দাবার লাফিয়ে উঠছে। জাহাজ ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ করে উঠছে, যেন বা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কাপ্তেন বলছেন, ‘তাইতো এবারকার মনসুনটা তো ভারি বিটকেল!’ কাপ্তেনটি বেশ লোক; চীন ও ভারতবর্ষের নিকটবর্তী সমুদ্রে অনেক দিন কাটিয়েছেন; আমুদে লোক, আষঢ়ে গল্প করতে ভারি মজবুত। কত রকম বোম্বেটের গল্প—চীনে কুলি জাহাজের অফিসারদের মেরে ফেলে কেমন করে জাহাজ শুদ্ধ লুটে নিয়ে পালাত—এই রকম বহুৎ গল্প করছেন। আর কি করা যায়; লেখা পড়া এ দুলুনির চোটে মুশকিল। কেবিনের ভেতর বসা দায়; জানালাটা এঁটে দিয়েছে—ঢেউয়ের ভয়ে। এক দিন তু-ভায়া একটু খুলে রেখেছিলেন, একটা ঢেউয়ের এক টুকরো এসে জলপ্লাবন করে গেল! উপরে সে ওছল-পাছলের ধুম কি! তারি ভেতরে তোমার ‘উদ্বোধনে’র কাজ অল্প স্বল্প চলছে মনে রেখো। জাহাজে দুই পাদ্রী উঠেছেন। একটি আমেরিকান—সস্ত্রীক, বড় ভাল মানুষ, নাম বোগেশ। বোগেশের সাত বৎসর বিয়ে হয়েছে; ছেলে-মেয়েতে ছটি সন্তান; চাকররা বলে, খোদার বিশেষ মেহেরবানি—ছেলেগুলোর সে অনুভব হয় না বোধ হয়। একখানা কাঁথা পেতে বোগেশ-ঘরণী ছেলেপিলেগুলিকে ডেকের উপর শুইয়ে চলে যায়। তারা নোংরা হয়ে কেঁদেকেটে গড়াগড়ি দেয়। যাত্রীরা সদাই সভয়। ডেকে বেড়াবার যো নেই; পাছে বোগেশের ছেলে মাড়িয়ে ফেলে। খুব ছোটটিকে একটি কানাতোলা চৌকা চুবড়িতে শুইয়ে, বোগেশ আর বোগেশের পাদ্রিনী জড়াজড়ি হয়ে কোণে চার ঘণ্টা বসে থাকে। তোমার ইওরোপীয় সভ্যতা বোঝা দায়। আমরা যদি বাইরে কুলকুচো করি, কি দাঁত মাজি—বলে কি অসভ্য! আর জড়ামড়িগুলো গোপনে করলে ভাল হয় না কি? তোমরা আবার এই সভ্যতার নকল করতে যাও! যাহোক প্রোটেষ্টাণ্ট ধর্মে উত্তর ইওরোপের যে কি উপকার করেছে, তা পাদ্রী পুরুষ না দেখলে তোমরা বুঝতে পারবে না। যদি এই দশ ক্রোর ইংরেজ সব মরে যায়, খালি পুরোহিতকুল বেঁচে থাকে, বিশ বৎসরে আবার দশ ক্রোরের সৃষ্টি !
জাহাজের টাল-মাটালে অনেকেরই মাথা ধরে উঠেছে। টুটল্ বলে একটি ছোট মেয়ে বাপের সঙ্গে যাচ্ছে; তার মা নেই। আমাদের নিবেদিতা টুটলের ও বোগেশের ছেলেপিলের মা হয়ে বসেছে। টুটল্ বাপের কাছে মাইসোরে মানুষ হয়েছে। বাপ প্লাণ্টার। টুটল্কে জিজ্ঞাসা করলুম ‘টুটল্! কেমন আছ?’ টুটল্ বললে, ‘এ বাঙলাটা ভাল নয়, বড্ড দোলে, আর আমার অসুখ করে।’ টুটলের কাছে ঘর দোর সব বাঙলা। বোগেশের একটি এঁড়ে লাগা ছেলের বড় অযত্ন; বেচারা সারাদিন ডেকের কাঠের ওপর গড়িয়ে বেড়াচ্ছে! বুড়ো কাপ্তেন মাঝে মাঝে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে চামচে করে সুরুয়া খাইয়ে যায়, আর তার পা-টি দেখিয়ে বলে, ‘কি রোগা ছেলে, কি অযত্ন!’
অনেকে অনন্ত সুখ চায়। সুখ অনন্ত হলে দুঃখও যে অনন্ত হত, তার কি? তা হলে কি আর আমরা এডেন পৌঁছুতুম। ভাগ্যিস সুখ দুঃখ কিছুই অনন্ত নয়, তাই ছয় দিনের পথ চৌদ্দ দিন করে দিনরাত বিষম ঝড়-বাদলের মধ্য দিয়েও শেষটা এডেনে পৌঁছে গেলুম। কলম্বো থেকে যত এগুনো যায় ততই ঝড় বাড়ে, ততই আকাশ পুকুর, ততই বৃষ্টি, ততই বাতাসের জোর, ততই ঢেউ; সে বাতাস, সে ঢেউ ঠেলে কি জাহাজ চলে? জাহাজের গতি আদ্দেক হয়ে গেল—সকোত্রা দ্বীপের কাছাকাছি গিয়ে বেজায় বাড়ল। কাপ্তেন বললেন, ‘এইখানটা মনসুনের কেন্দ্র; এইটা পেরুতে পারলেই ক্রমে ঠাণ্ডা সমুদ্র।’ তাই হল। এ দুঃস্বপ্নও কাটল।
৮ই সন্ধ্যাকালে এডেন। কাউকে নামতে দেবে না, কালা-গোরা মানে না। কোন জিনিষ ওঠাতে দেবে না, দেখবার জিনিষও বড় নেই। কেবল ধুধু বালি, রাজপুতানার ভাব—বৃক্ষহীন তৃণহীন পাহাড়। পাহাড়ের ভেতরে ভেতরে কেল্লা; ওপরে পল্টনের ব্যারাক। সামনে অর্ধচন্দ্রাকৃতি হোটেল; আর দোকানগুলি জাহাজ থেকে দেখা যাচ্চে। অনেকগুলি জাহাজ দাঁড়িয়ে। একখানি ইংরেজী যুদ্ধজাহাজ, একখানি জার্মান এল; বাকীগুলি মালের বা যাত্রীর জাহাজ। গেল বারে এডেন দেখা আছে। পাহাড়ের পেছনে দিশী পল্টনের ছাউনি, বাজার। সেখান থেকে মাইল কতক গিয়ে পাহাড়ের গায় বড় বড় গহ্বর তৈয়ারী করা, তাতে বৃষ্টির জল জমে। পূর্বে ঐ জলই ছিল ভরসা। এখন যন্ত্রযোগে সমুদ্রজল বাষ্প করে আবার জমিয়ে, পরিষ্কার জল হচ্ছে; তা কিন্তু মাগ্গি। এডেন ভারতবর্ষেরই একটি শহর যেন—দিশী ফৌজ, দিশী লোক অনেক। পারসী দোকানদার, সিদ্ধি ব্যাপারী অনেক। এ এডেন বড় প্রাচীন স্থান—রোমান বাদশা কনষ্টান্সিউস (Constantius) এখানে এক দল পাদ্রী পাঠিয়ে ক্রিশ্চান ধর্ম প্রচার করান। পরে আরবেরা সে ক্রিশ্চানদের মেরে ফেলে। তাতে রোমি সুলতান প্রাচীন ক্রিশ্চান হাবসি দেশের বাদশাকে তাদের সাজা দিতে অনুরোধ করেন। হাবসি-রাজ ফৌজ পাঠিয়ে এডেনের আরবদের খুব সাজা দেন। পরে এডেন ইরানের সামানিডি বাদশাদের হাতে যায়। তাঁরাই নাকি প্রথমে জলের জন্য ঐ সকল গহ্বর খোদান। তারপর মুসলমান ধর্মের অভ্যুদয়ের পর এডেন আরবদের হাতে যায়। কতক কাল পরে পোর্তুগীজ সেনাপতি ঐ স্থান দখলের বৃথা উদ্যম করেন। পরে তুরস্কের সুলতান ঐ স্থানকে—পোর্তুগীজদের ভারত মহাসাগর হতে তাড়াবার জন্য—দরিয়াই জঙ্গের জাহাজের বন্দর করেন।
আবার উহা নিকটবর্তী আরব-মালিকের অধিকারে যায়। পরে ইংরেজরা ক্রয় করে বর্তমান এডেন করেছেন। এখন প্রত্যেক শক্তিমান জাতির যুদ্ধপোতনিচয় পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্চে। কোথায় কি গোলযোগ হচ্ছে, তাতে সকলেই দু-কথা কইতে চায়। নিজেদের প্রাধান্য, স্বার্থ, বাণিজ্য রক্ষা করতে চায়। কাজেই মাঝে মাঝে কয়লার দরকার। পরের জায়গায় কয়লা লওয়া যুদ্ধকালে চলবে না বলে, আপন আপন কয়লা নেওয়ার স্থান করতে চায়। ভাল ভালগুলি ইংরেজ তো নিয়ে বসেছেন; তারপর ফ্রান্স, তারপর যে যেথায় পায়—কেড়ে, কিনে, খোশামোদ করে—এক একটা জায়গা করেছে এবং করছে। সুয়েজ খাল হচ্ছে এখন ইওরোপ-এশিয়ার সংযোগ স্থান। সেটা ফরাসীদের হাতে। কাজেই ইংরেজ এডেনে খুব চেপে বসেছে, আর অন্যান্য জাতও রেড-সীর ধারে ধারে এক একটা জায়গা করেছে। কখনও বা জায়গা নিয়ে উল্টো উৎপাত হয়ে বসে। সাত-শ বৎসরের পর-পদদলিত ইতালী কত কষ্টে পায়ের উপর খাড়া হল, হয়েই ভাবলে—কি হলুম রে! এখন দিগ্বিজয় করতে হবে। ইওরোপের এক টুকরোও কারও নেবার যো নাই; সকলে মিলে তাকে মারবে! এশিয়ার বড় বড় বাঘা-ভাল্কো—ইংরেজ, রুশ, ফ্রেঞ্চ, ডচ—এরা আর কি কিছু রেখেছে? এখন বাকী আছে দু-চার টুকরো আফ্রিকার। ইতালী সেই দিকে চলল। প্রথমে উত্তর আফ্রিকায় চেষ্টা করলে। সেথায় ফ্রান্সের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এল। তারপর ইংরেজরা রেড-সীর ধারে একটি জমি দান করলে। মতলব—সেই কেন্দ্র হতে ইতালী হাবসি-রাজ্য উদরসাৎ করেন। ইতালীও সৈন্যসামন্ত নিয়ে এগুলেন। কিন্তু হাবসি বাদশা মেনেলিক্ এমনি গো-বেড়েন দিলে যে, এখন ইতালীর আফ্রিকা ছেড়ে প্রাণবাঁচানো দায় হয়েছে। আবার রুশের ক্রিশ্চান এবং হাবসির ক্রিশ্চানি নাকি এক রকমের—তাই রুশের বাদশা ভেতরে ভেতরে হাবসিদের সহায়।
জাহাজ তো রেড-সীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পাদ্রী বললেন, ‘এই—এই রেড-সী, য়াহুদী নেতা মুসা সদলবলে পদব্রজে পার হয়েছিলেন। আর তাদের ধরে নিয়ে যাবার জন্যে মিসরি বাদশা ‘ফেরো’ যে ফৌজ পাঠিয়েছিলেন, তারা কাদায় রথচক্রে ডুবে—কর্ণের মত আটকে—জলে ডুবে মারা গেল’। পাদ্রী আরও বললেন যে, এ-কথা এখন আধুনিক বিজ্ঞান—যুক্তির দ্বারা প্রমাণ হতে পারে। এখন সব দেশে ধর্মের আজগুবীগুলি বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করবার এক ঢেউ উঠেছে। মিঞা! যদি প্রাকৃতিক নিয়মে ঐ সবগুলি হয়ে থাকে তো আর তোমার য়াভে-দেবতা মাঝখান থেকে আসেন কেন? বড়ই মুশকিল! যদি বিজ্ঞানবিরুদ্ধ হয় তো ও-কেরামতগুলি আজগুবী এবং তোমার ধর্ম মিথ্যা। যদি বিজ্ঞানসম্মত হয়, তাহলেও তোমার দেবতার মহিমাটি বাড়ার ভাগ, ও আর সব প্রাকৃতিক ঘটনার ন্যায় আপনা-আপনি হয়েছে। পাদ্রী বোগেশ বললে, ‘আমি অত শত জানিনি, আমি বিশ্বাস করি।’ এ-কথা মন্দ নয়—এ সহ্যি হয়। তবে ঐ যে একদল আছে—পরের বেলা দোষটি দেখাতে, যুক্তিটি আনতে কেমন তৈয়ার; নিজের বেলায় বলে, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমার মন সাক্ষ্য দেয়’—তাদের কথাগুলো একদম অসহ্য। আ মরি! ওঁদের আবার মন! ছটাকও নয়, আবার মণ! পরের বেলায় সব কুসংস্কার, বিশেষ যেগুলো সাহেবে বলেছে; আর নিজে একটা কিম্ভূত-কিমাকার কল্পনা করে কেঁদেই অস্থির!!
জাহাজ ক্রমেই উত্তরে চলেছে। এই রেড-সীর কিনারা—প্রাচীন সভ্যতার এক মহাকেন্দ্র। ঐ—ওপারে আরবের মরুভূমি; এপারে—মিশর। এই—সেই প্রাচীন মিশর; এই মিসরীরা পন্ট্ দেশ (সম্ভবতঃ মালাবার) হতে রেড-সী পার হয়ে, কত হাজার বৎসর আগে, ক্রমে ক্রমে রাজ্য বিস্তার করে উত্তরে পৌঁছেছিল। এদের আশ্চর্য শক্তিবিস্তার, রাজ্যবিস্তার, সভ্যতাবিস্তার। যবনেরা এদের শিষ্য। এদের বাদশাদের পিরামিড নামক আশ্চর্য সমাধিমন্দির, নারীসিংহী মূর্তি। এদের মৃতদেহগুলি পর্যন্ত আজও বিদ্যমান। বাবরি-কাটা চুল, কাছাহীন ধপ্ধপে ধুতি পরা, কানে কুণ্ডল, মিসরী লোক সব, এই দেশে বাস করত। এই—হিক্স বংশ, ফেরো বংশ, ইরানী বাদশাহী, সিকন্দর, টলেমী বংশ এবং রোমক ও আরব বীরদের রঙ্গভূমি—মিশর। সেই ততকাল আগে এরা আপনাদের বৃত্তান্ত পাপিরস্ পত্রে, পাথরে, মাটির বাসনের গায়ে চিত্রাক্ষরে তন্ন তন্ন করে লিখে গেছে।
এই ভূমিতে আইসিসের পূজা, হোরসের প্রাদুর্ভাব। এই প্রাচীন মিসরীদের মতে—মানুষ মলে তার সূক্ষ্ম শরীর বেড়িয়ে বেড়ায়, কিন্তু মৃত দেহের কোন অনিষ্ট হলেই সূক্ষ্ম শরীরে আঘাত লাগে, আর মৃত শরীরের ধ্বংস হলেই সূক্ষ্ম শরীরের একান্ত নাশ, তাই শরীর রাখবার এত যত্ন। তাই রাজা-বাদশাদের পিরামিড। কত কৌশল! কি পরিশ্রম! সবই আহা বিফল!! ঐ পিরামিড খুঁড়ে, নানা কৌশলে রাস্তার রহস্য ভেদ করে রত্নলোভে দস্যুরা সে রাজ-শরীর চুরি করেছে। আজ নয়, প্রাচীন মিসরীরা নিজেরাই করেছে। পাঁচ সাত-শ বৎসর আগে এই সকল শুকনো মরা—য়াহুদী ও আরব ডাক্তারেরা মহৌষধি-জ্ঞানে ইওরোপ-সুদ্ধ রোগীকে খাওয়াত। এখনও উহা বোধ হয় ইউনানি হাকিমির আসল ‘মামিয়া’!!
এই মিসরে টলেমী বাদশার সময়ে সম্রাট্ ধর্মাশোক ধর্মপ্রচারক পাঠান। তারা ধর্ম প্রচার করত, রোগ ভাল করত, নিরামিষ খেত, বিবাহ করত না, সন্ন্যাসী শিষ্য করত। তারা নানা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করলে—থেরাপিউট, অসসিনী, মানিকী ইত্যাদি—যা হতে বর্তমান ক্রিশ্চানী ধর্মের সমুদ্ভব। এই মিসরই টলেমীদের রাজত্বকালে সর্ববিদ্যার আকর হয়ে উঠেছিল। এই মিসরেই সে আলেকজান্দ্রিয়া নগর, যেখানকার বিদ্যালয়, পুস্তাকাগার, বিদ্বজ্জন জগৎপ্রসিদ্ধ হয়েছিল। সে আলেকজান্দ্রিয়া মূর্খ গোঁড়া ইতর ক্রিশ্চানদের হাতে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল—পুস্তকালয় ভস্মরাশি হল—বিদ্যার সর্বনাশ হল! শেষ বিদুষী নারীকে১৮ ক্রিশ্চানেরা নিহত করে, তাঁর নগ্নদেহ রাস্তায় রাস্তায় সকল প্রকার বীভৎস অপমান করে টেনে বেড়িয়ে, অস্থি হতে টুকরা টুকরা মাংস আলাদা করে ফেলেছিল!
আর দক্ষিণে—বীরপ্রসূ আরবের মরুভূমি। কখনও আলখাল্লা-ঝোলানো—পশমের গোছা দড়ি দিয়ে একখানা মস্ত রুমাল মাথায় আঁটা—বদ্দু আরব দেখেছ?—সে চলন, সে দাঁড়াবার ভঙ্গী, সে চাউনি, আর কোন দেশে নাই। আপাদমস্তক দিয়ে মরুভূমির অনবরুদ্ধ হাওয়ার স্বাধীনতা ফুটে বেরুচ্ছে—সেই আরব। যখন ক্রিশ্চানদের গোঁড়ামি আর গথদের বর্বরতা প্রাচীন ইউনান১৯ ও রোমান সভ্যতালোককে নির্বাণ করে দিলে, যখন ইরান অন্তরের পূতিগন্ধ ক্রমাগত সোনার পাত দিয়ে মোড়বার চেষ্টা করছিল, যখন ভারতে—পাটলিপুত্র ও উজ্জয়িনীর গৌরবরবি অস্তাচলে, উপরে মূর্খ ক্রূর রাজগর্ব, ভিতরে ভীষণ অশ্লীলতা ও কামপূজার আবর্জনারাশি—সেই সময়ে এই নগণ্য পশুপ্রায় আরবজাতি বিদ্যুদ্বেগে ভূমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ল।
ঐ ষ্টীমার মক্কা হতে আসছে—যাত্রী ভরা; ঐ দেখ—ইওরোপী পোষাকপরা তুর্ক, আধা ইওরোপীবেশে মিসরী, ঐ সূরিয়াবাসী মুসলমান ইরানীবেশে, আর ঐ আসল আরব ধুতিপরা—কাছা নেই। মহম্মদের পূর্বে কাবার মন্দিরে উলঙ্গ হয়ে প্রদক্ষিণ করতে হত; তাঁর সময় থেকে একটা ধুতি জড়াতে হয়। তাই আমাদের মুসলমানেরা নমাজের সময় ইজারের দড়ি খোলে, ধুতির কাছা খুলে দেয়। আর আরবদের সেকাল নেই। ক্রমাগত কাফ্রি, সিদি, হাবসি রক্ত প্রবেশ করে চেহারা উদ্যম—সব বদলে গেছে, মরুভূমির আরব পুনর্মূষিক হয়েছেন। যারা উত্তরে, তারা তুরস্কের রাজ্যে বাস করে—চুপচাপ করে। কিন্তু সুলতানের ক্রিশ্চান প্রজারা তুরস্ককে ঘৃণা করে, আরবকে ভালবাসে, ‘আরবরা লেখাপড়া শেখে, ভদ্রলোক হয়, অত উৎপেতে নয়’—তারা বলে। আর খাঁটি তুর্করা ক্রিশ্চানদের উপর বড়ই অত্যাচার করে।
মরুভূমি অত্যন্ত উত্তপ্ত হলেও সে গরম দুর্বল করে না। তাতে কাপড়ে গা-মাথা ঢেকে রাখলেই আর গোল নেই। শুষ্ক গরমি—দুর্বল তো করেই না, বরং বিশেষ বলকারক। রাজপুতানার, আরবের, আফ্রিকার লোকগুলি এর নিদর্শন। মারোয়াড়ের এক এক জেলায় মানুষ, গরু, ঘোড়া—সবই সবল ও আকারে বৃহৎ। আরবী মানুষ ও সিদিদের দেখলে আনন্দ হয়। যেখানে জোলো গরমি, যেমন বাঙলা দেশ, সেখানে শরীর অত্যন্ত অবসন্ন হয়ে পড়ে, আর সব দুর্বল।
রেড-সীর নামে যাত্রীদের হৃৎকম্প হয়—ভয়ানক গরম, তায় এই গরমি কাল। ডেকে বসে যে যেমন পারছে, একটা ভীষণ দুর্ঘটনার গল্প শোনাচ্ছে। কাপ্তেন সকলের চেয়ে উঁচিয়ে বলছেন। তিনি বললেন, ‘দিন কতক আগে একখানা চীনি যুদ্ধজাহাজ এই রেড-সী দিয়ে যাচ্ছিল, তার কাপ্তেন ও আট জন কয়লাওয়ালা খালাসী গরমে মরে গেছে।’
বাস্তবিক কয়লাওয়ালা—একে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, তায় রেড-সীর নিদারুণ গরম। কখনও কখনও খেপে ওপরে দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিয়ে জলে পড়ে, আর ডুবে মরে; কখনও বা গরমে নীচেই মারা যায়।
এই সকল গল্প শুনে হৃৎকম্প হবার তো যোগাড়। কিন্তু অদৃষ্ট ভাল, আমরা বিশেষ গরম কিছুই পেলুম না। হাওয়া দক্ষিণী না হয়ে উত্তর থেকে আসতে লাগল—সে ভূমধ্যসাগরের ঠাণ্ডা হাওয়া।
১৪ই জুলাই রেড-সী পার হয়ে জাহাজ সুয়েজ পৌঁছুল। সামনে—সুয়েজ খাল। জাহাজে—সুয়েজে নাবাবার মাল আছে। তার উপর এসেছেন মিসরে প্লেগ, আর আমরা আনছি প্লেগ সম্ভবতঃ—কাজেই দোতরফা ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়। এ ছুঁৎছাঁতের ন্যাটার কাছে আমাদের দিশী ছুঁৎছাঁত কোথায় লাগে! মাল নাববে, কিন্তু সুয়েজের কুলি জাহাজ ছুঁতে পারবে না। জাহাজে খালাসী বেচারাদের আপদ আর কি! তারাই কুলি হয়ে ক্রেনে করে মাল তুলে, আলটপ্কা নীচে সুয়েজী নৌকায় ফেলছে—তারা নিয়ে ডাঙায় যাচ্চে। কোম্পানীর এজেণ্ট ছোট লঞ্চে করে জাহাজের কাছে এসেছেন, ওঠবার হুকুম নেই। কাপ্তেনের সঙ্গে জাহাজে নৌকায় কথা হচ্ছে। এ তো ভারতবর্ষ নয় যে, গোরা আদমী প্লেগ আইন-ফাইন সকলের পার—এখানে ইওরোপের আরম্ভ। স্বর্গে ইঁদুর-বাহন প্লেগ পাছে ওঠে, তাই এত আয়োজন। প্লেগ-বিষ—প্রবেশ থেকে দশ দিনের মধ্যে ফুটে বেরোন; তাই দশ দিনের আটক। আমাদের কিন্তু দশ দিন হয়ে গেছে—ফাঁড়া কেটে গেছে। কিন্তু মিসরী আদমীকে ছুঁলেই আবার দশ দিন আটক—তাহলে নেপল্সেও লোক নাবানো হবে না, মার্সাইতেও নয়; কাজেই যা কিছু কাজ হচ্ছে, সব আলগোছে; কাজেই ধীরে ধীরে মাল নাবাতে সারাদিন লাগবে। রাত্রিতে জাহাজ অনায়াসেই খাল পার হতে পারে, যদি সামনে বিজলী-আলো পায়; কিন্তু সে আলো পরাতে গেলে, সুয়েজের লোককে জাহাজ ছুঁতে হবে, বস্—দশ দিন কারাঁটীন্ (quarantine)। কাজেই রাতেও যাওয়া হবে না, চব্বিশ ঘণ্টা এইখানে পড়ে থাকো—সুয়েজ বন্দরে।
এটি বড় সুন্দর প্রাকৃতিক বন্দর, প্রায় তিন দিকে বালির ঢিপি আর পাহাড়—জলও খুব গভীর। জলে অসংখ্য মাছ আর হাঙ্গর ভেসে ভেসে বেড়াচ্চে। এই বন্দরে আর অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি বন্দরে যত হাঙ্গর, এমন আর দুনিয়ার কোথাও নাই—বাগে পেলেই মানুষকে খেয়েছে। জলে নাবে কে? সাপ আর হাঙ্গরের ওপর মানুষেরও জাতক্রোধ; মানুষও বাগে পেলে ওদের ছাড়ে না।
সকাল বেলা খাবার-দাবার আগেই শোনা গেল যে, জাহাজের পেছনে বড় বড় হাঙ্গর ভেসে ভেসে বেড়াচ্চে। জল-জ্যান্ত হাঙ্গর পূর্বে আর কখনও দেখা যায়নি—গতবারে আসবার সময়ে সুয়েজে জাহাজ অল্পক্ষণই ছিল, তা-ও আবার শহরের গায়ে। হাঙ্গরের খবর শুনেই, আমরা তাড়াতাড়ি উপস্থিত। সেকেণ্ড কেলাসটি জাহাজের পাছার উপর—সেই ছাদ হতে বারান্দা ধরে কাতারে কাতারে স্ত্রী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে ঝুঁকে হাঙ্গর দেখছে। আমরা যখন হাজির হলুম, তখন হাঙ্গর—মিঞারা একটু সরে গেছেন; মনটা বড়ই ক্ষুণ্ণ হল। কিন্তু দেখি যে, জলে গাঙ্ধাড়ার মত এক প্রকার মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ভাসছে। আর এক রকম খুব ছোট মাছ জলে থিক্ থিক্ করছে। মাঝে মাঝে এক একটা বড় মাছ, অনেকটা ইলিশ মাছের চেহারা, তীরের মত এদিক ওদিক করে দৌড়ুচ্চে। মনে হল, বুঝি উনি হাঙ্গরের বাচ্চা। কিন্তু জিজ্ঞাসা করে জানলুম—তা নয়, ওঁর নাম বনিটো। পূর্বে ওর বিষয় পড়া গেছল বটে; এবং মালদ্বীপ হতে উনি শুঁটকিরূপে আমদানী হন হুড়ি চড়ে—তাও পড়া ছিল। ওর মাংস লাল ও বড় সুস্বাদ—তাও শোনা আছে। এখন ওর তেজ আর বেগ দেখে খুশী হওয়া গেল। অত বড় মাছটা তীরের মত জলের ভিতর ছুটছে, আর সে সমুদ্রের কাঁচের মত জল, তার প্রত্যেক অঙ্গ-ভঙ্গি দেখা যাচ্চে। বিশ মিনিট, আধঘণ্টা-টাক, এই প্রকার বনিটোর ছুটোছুটি আর ছোট মাছের কিলিবিলি তো দেখা যাচ্চে। আধ ঘণ্টা, তিন কোয়ার্টার—ক্রমে তিতিবিরক্ত হয়ে আসছি, এমন সময়ে একজন বললে—ঐ ঐ! দশ বার জনে বলে উঠল—ঐ আসছে, ঐ আসছে!! চেয়ে দেখি, দূরে একটা প্রকাণ্ড কালো বস্তু ভেসে আসছে, পাঁচ সাত ইঞ্চি জলের নীচে। ক্রমে বস্তুটা এগিয়ে আসতে লাগল। প্রকাণ্ড থ্যাবড়া মাথা দেখা দিলে; সে গদাইলস্করি চাল, বনিটোর সোঁ সোঁ তাতে নেই; তবে একবার ঘাড় ফেরালেই একটা মস্ত চক্কর হল। বিভীষণ মাছ; গম্ভীর চালে চলে আসছে—আর আগে আগে দু-একটা ছোট মাছ; আর কতকগুলো ছোট মাছ তার পিঠে গায়ে পেটে খেলে বেড়াচ্ছে। কোন কোনটা বা জেঁকে তার ঘাড়ে চড়ে বসছে। ইনিই সসাঙ্গোপাঙ্গ হাঙ্গর। যে মাছগুলি হাঙ্গরের আগে আগে যাচ্ছে, তাদের নাম ‘আড়কাটী মাছ—পাইলট ফিস্।’ তারা হাঙ্গরকে শিকার দেখিয়ে দেয়, আর বোধ হয় প্রসাদটা-আসটা পায়। কিন্তু হাঙ্গরের সে মুখ-ব্যাদান দেখলে তারা যে বেশী সফল হয়, তা বোধ হয় না। যে মাছগুলি আশেপাশে ঘুরছে, পিঠে চড়ে বসছে, তারা হাঙ্গর-‘চোষক’। তাদের বুকের কাছে প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা ও দুই ইঞ্চি চওড়া চেপ্টা গোলপানা একটি স্থান আছে। তার মাঝে, যেমন ইংরেজী অনেক রবারের জুতোর তলায় লম্বা লম্বা জুলি-কাটা কিরকিরে থাকে, তেমনি জুলি-কাটাকাটা। সেই জায়গাটা ঐ মাছ, হাঙ্গরের গায়ে দিয়ে চিপসে ধরে; তাই হাঙ্গরের গায়ে পিঠে চড়ে চলছে দেখায়। এরা নাকি হাঙ্গরের গায়ের পোকা-মাকড় খেয়ে বাঁচে। এই দুইপ্রকার মাছ পরিবেষ্টিত না হয়ে হাঙ্গর চলেন না। আর এদের, নিজের সহায়-পারিষদ জ্ঞানে কিছু বলেনও না। এই মাছ একটা ছোট হাতসুতোয় ধরা পড়ল। তার বুকে জুতোর তলা একটু চেপে দিয়ে পা তুলতেই সেটা পায়ের সঙ্গে চিপসে উঠতে লাগল; ঐ রকম করে সে হাঙ্গরের গায়ে লেগে যায়।
সেকেণ্ড কেলাসের লোকগুলির বড়ই উৎসাহ। তাদের মধ্যে একজন ফৌজি লোক—তার তো উৎসাহের সীমা নেই। কোথা থেকে জাহাজ খুঁজে একটা ভীষণ বঁড়শির যোগাড় করলে, সে ‘কুয়োর ঘটি তোলার’ ঠাকুরদাদা। তাতে সেরখানেক মাংস আচ্ছা দড়ি দিয়ে জোর করে জড়িয়ে বাঁধলে। তাতে এক মোটা কাছি বাঁধা হল। হাত চার বাদ দিয়ে, একখানা মস্ত কাঠ ফাতনার জন্য লাগানো হল। তারপর ফাতনা-সুদ্ধ বঁড়শি, ঝুপ করে জলে ফেলে দেওয়া হল। জাহাজের নীচে একখান পুলিশের নৌকা—আমরা আসা পর্যন্ত চৌকি দিচ্ছিল, পাছে ডাঙার সঙ্গে আমাদের কোন রকম ছোঁয়াছুঁয়ি হয়। সেই নৌকার উপর আবার দুজন দিব্বি ঘুমুচ্ছিল, আর যাত্রীদের যথেষ্ট ঘৃণার কারণ হচ্ছিল। এক্ষণে তারা বড় বন্ধু হয়ে উঠল। হাঁকাহাঁকির চোটে আরব মিঞা চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালেন। কি একটা হাঙ্গামা উপস্থিত বলে কোমর আঁটবার যোগাড় করছেন, এমন সময়ে বুঝতে পারলেন যে অত হাঁকাহাঁকি, কেবল তাঁকে—কড়িকাষ্ঠরূপ হাঙ্গর ধরবার ফাতনাটিকে টোপ সহিত কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়ে দেবার অনুরোধ-ধ্বনি। তখন তিনি নিঃশ্বাস ছেড়ে, আকর্ণ-বিস্তার হাসি হেসে একটা বল্লির ডগায় করে ঠেলেঠুলে ফাতনাটাকে তো দূরে ফেললেন; আর আমরা উদ্গ্রীব হয়ে, পায়ের ডগায় দাঁড়িয়ে বারান্দায় ঝুঁকে, ঐ আসে ঐ আসে—শ্রীহাঙ্গরের জন্য ‘সচকিতনয়নং পশ্যতি তব পন্থানং’ হয়ে রইলাম; এবং যার জন্যে মানুষ ঐ প্রকার ধড়্ফড়্ করে, সে চিরকাল যা করে, তাই হতে লাগল—অর্থাৎ ‘সখি শ্যাম না এল’। কিন্তু সকল দুঃখেরই একটা পার আছে। তখন সহসা জাহাজ হতে প্রায় দুশ’ হাত দূরে, বৃহৎ ভিস্তির মসকের আকার কি একটা ভেসে উঠল; সঙ্গে সঙ্গে, ‘ঐ হাঙ্গর, ঐ হাঙ্গর’ রব। ‘চুপ্ চুপ্—ছেলের দল! হাঙ্গর পালাবে।’ ‘বলি, ওহে! সাদা টুপিগুলো একবার নাবাও না, হাঙ্গরটা যে ভড়কে যাবে’—ইত্যাকার আওয়াজ যখন কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে, তাবৎ সেই হাঙ্গর লবণসমুদ্রজন্মা, বঁড়শিসংলগ্ন শোরের মাংসের তালটি উদরাগ্নিতে ভস্মাবশেষ করবার জন্যে, পালভরে নৌকার মত সোঁ করে সামনে এসে পড়লেন। আর পাঁচ হাত—এইবার হাঙ্গরের মুখ টোপে ঠেকেছে। সে ভীম পুচ্ছ একটু হেলল—সোজা গতি চক্রাকারে পরিণত হল। যাঃ হাঙ্গর চলে গেল যে হে! আবার পুচ্ছ একটু বাঁকল, আর সেই প্রকাণ্ড শরীর ঘুরে, বঁড়শিমুখো দাঁড়াল। আবার সোঁ করে আসছে—ঐ হাঁ করে বঁড়শি ধরে ধরে! আবার সেই পাপ লেজ নড়ল, আর হাঙ্গর শরীর ঘুরিয়ে দূরে চলল। আবার ঐ চক্র দিয়ে আসছে, আবার হাঁ করছে; ঐ—টোপটা মুখে নিয়েছে, এইবার—ঐ ঐ চিতিয়ে পড়ল; হয়েছে, টোপ খেয়েছে—টান্ টান্ টান্, ৪০।৫০ জনে টান, প্রাণপণে টান। কি জোর মাছের! কি ঝটাপট—কি হাঁ। টান্ টান্। জল থেকে এই উঠল, ঐ যে জলে ঘুরছে, আবার চিতুচ্ছে, টান্ টান্। যাঃ টোপ খুলে গেল! হাঙ্গর পালাল। তাই তো হে, তোমাদের কি তাড়াতাড়ি বাপু! একটু সময় দিলে না টোপ খেতে! যেই চিতিয়েছে অমনি কি টানতে হয়? আর—‘গতস্য শোচনা নাস্তি’; হাঙ্গর তো বঁড়শি ছাড়িয়ে চোঁচা দৌড়। আড়কাটী মাছকে উপযুক্ত শিক্ষা দিলে কিনা তা খবর পাইনি, মোদ্দা—হাঙ্গর তো চোঁচা। আবার সেটা ছিল ‘বাঘা’—বাঘের মত কালো কালো ডোরা কাটা। যা হোক ‘বাঘা’ বঁড়শি-সন্নিধি পরিত্যাগ করবার জন্য, স-‘আড়কাটী’- ‘রক্তচোষা’ অন্তর্দধে।
কিন্তু নেহাত হতাশ হবার প্রয়োজন নেই—ঐ যে পলায়মান ‘বাঘার’ গা ঘেঁষে আর একটা প্রকাণ্ড ‘থ্যাব্ড়ামুখো’ চলে আসছে! আহা হাঙ্গরদের ভাষা নেই। নইলে ‘বাঘা’ নিশ্চিত পেটের খবর তাকে দিয়ে সাবধান করে দিত। নিশ্চিত বলত, ‘দেখ হে সাবধান, ওখানে একটা নূতন জানোয়ার এসেছে, বড় সুস্বাদ সুগন্ধ মাংস তার, কিন্তু কি শক্ত হাড়! এতকাল হাঙ্গর-গিরি করছি, কত রকম জানোয়ার—জ্যান্ত, মরা, আধমরা—উদরস্থ করেছি, কত রকম হাড়-গোড়, ইঁট-পাথর, কাঠ-টুকরো পেটে পুরেছি, কিন্তু এ হাড়ের কাছে আর সব মাখম হে—মাখম!! এই দেখ না—আমার দাঁতের দশা, চোয়ালের দশা কি হয়েছে’—বলে একবার সেই আকটিদেশ-বিস্তৃত মুখ ব্যাদান করে আগন্তুক হাঙ্গরকে অবশ্যই দেখাত। সেও প্রাচীনবয়স-সুলভ অভিজ্ঞতা সহকারে—চ্যাঙ-মাছের পিত্তি, কুঁজো-ভেটকির পিলে, ঝিনুকের ঠাণ্ডা সুরুয়া ইত্যাদি সমুদ্রজ মহৌষধির কোন-না-কোনটা ব্যবহারের উপদেশ দিতই দিত। কিন্তু যখন ওসব কিছুই হল না, তখন হয় হাঙ্গরদের অত্যন্ত ভাষার অভাব, নতুবা ভাষা আছে, কিন্তু জলের মধ্যে কথা কওয়া চলে না! অতএব যতদিন না কোন প্রকার হাঙ্গুরে অক্ষর আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন সে ভাষার ব্যবহার কেমন করে হয়?—অথবা ‘বাঘা’ মানুষ-ঘেঁষা হয়ে মানুষের ধাত পেয়েছে, তাই ‘থ্যাব্ড়াকে আসল খবর কিছু না বলে, মুচ্কে হেসে, ‘ভাল আছ তো হে’ বলে সরে গেল।—‘আমি একাই ঠকব?’
‘আগে যান ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়ে, পাছু পাছু যান গঙ্গা ... ’—শঙ্খধ্বনি তো শোনা যায় না, কিন্তু আগে আগে চলেছেন ‘পাইলট ফিস্’, আর পাছু পাছু প্রকাণ্ড শরীর নাড়িয়ে আসছেন ‘থ্যাব্ড়া’; তাঁর আশেপাশে নেত্য করছেন ‘হাঙ্গর-চোষা’ মাছ। আহা ও লোভ কি ছাড়া যায়? দশ হাত দরিয়ার উপর ঝিক্ ঝিক্ করে তেল ভাসছে, আর খোসবু কত দূর ছুটেছে, তা ‘থ্যাব্ড়াই’ বলতে পারে। তার উপর সে কি দৃশ্য—সাদা, লাল, জরদা—এক জায়গায়! আসল ইংরেজী শুয়োরের মাংস, কালো প্রকাণ্ড বঁড়শির চারি ধারে বাঁধা, জলের মধ্যে, রঙ-বেরঙের গোপীমণ্ডলমধ্যস্থ কৃষ্ণের ন্যায় দোল খাচ্চে!
এবার সব চুপ—নোড়ো চোড়ো না, আর দেখ—তাড়াতাড়ি কর না। মোদ্দা—কাছির কাছে কাছে থেকো। ঐ, বঁড়শির কাছে কাছে ঘুরছে; টোপটা মুখে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে! দেখুক। চুপ চুপ—এইবার চিৎ হল—ঐ যে আড়ে গিলছে; চুপ—গিলতে দাও। তখন ‘থ্যাব্ড়া’ অবসরক্রমে, আড় হয়ে, টোপ উদরস্থ করে যেমন চলে যাবে, অমনি পড়ল টান! বিস্মিত ‘থ্যাব্ড়া’ মুখ ঝেড়ে, চাইলে সেটাকে ফেলে দিতে—উল্টো উৎপত্তি!! বঁড়শি গেল বিঁধে, আর ওপরে ছেলে বুড়ো, জোয়ান, দে টান্—কাছি ধরে দে টান্। ঐ হাঙ্গরের মাথাটা জল ছাড়িয়ে উঠল—টান্ ভাই টান্। ঐ যে—প্রায় আধখানা হাঙ্গর জলের ওপর! বাপ্ কি মুখ! ও যে সবটাই মুখ আর গলা হে! টান্—ঐ সবটা জল ছাড়িয়েছে। ঐ যে বঁড়শিটা বিঁধেছে—ঠোঁট এফোঁড় ওফোঁড়—টান্। থাম্ থাম্—ও আরব পুলিস-মাঝি, ওর ল্যাজের দিকে একটা দড়ি বেঁধে দাও তো—নইলে যে এত বড় জানোয়ার টেনে তোলা দায়। সাবধান হয়ে ভাই, ও-ল্যাজের ঝাপটায় ঘোড়ার ঠ্যাং ভেঙে যায়। আবার টান্—কি ভারি হে? ও মা, ও কি? তাই তো হে, হাঙ্গরের পেটের নীচে দিয়ে ও ঝুলছে কি? ও যে—নাড়ি-ভুঁড়ি! নিজের ভারে নিজের নাড়ি-ভুঁড়ি বেরুল যে! যাক্, ওটা কেটে দাও, জলে পড়ুক, বোঝা কমুক; টান্ ভাই টান্। এ যে রক্তের ফোয়ারা হে! আর কাপড়ের মায়া করলে চলবে না। টান্—এই এল। এইবার জাহাজের ওপর ফেলো; ভাই হুঁশিয়ার খুব হুঁশিয়ার, তেড়ে এক কামড়ে একটা হাত ওয়ার—আর ঐ ল্যাজ সাবধান। এইবার, এইবার দড়ি ছাড়—ধুপ্! বাবা, কি হাঙ্গর! কি ধপাৎ করেই জাহাজের উপর পড়ল! সাবধানের মার নেই—ঐ কড়িকাঠখানা দিয়ে ওর মাথায় মারো। ওহে ফৌজি-ম্যান, তুমি সেপাই লোক, এ তোমারি কাজ। —‘বটে তো’। রক্ত-মাখা গায়-কাপড়ে ফৌজি যাত্রী কড়িকাঠ উঠিয়ে দুম্ দুম্ দিতে লাগল হাঙ্গরের মাথায়, আর মেয়েরা ‘আহা কি নিষ্ঠুর! মেরো না’ ইত্যাদি চীৎকার করতে লাগল—অথচ দেখতেও ছাড়বে না। তারপর সে বীভৎস কাণ্ড এইখানেই বিরাম হোক। কেমন করে সে হাঙ্গরের পেট চেরা হল, কেমন রক্তের নদী বইতে লাগল, কেমন সে হাঙ্গর ছিন্ন-অন্ত্র ভিন্ন-দেহ ছিন্ন-হৃদয় হয়েও কতক্ষণ কাঁপতে লাগল, নড়তে লাগল; কেমন করে তার পেট থেকে অস্থি, চর্ম, মাংস, কাঠ-কুটরো এক রাশ বেরুল—সে সব কথা থাক। এই পর্যন্ত যে, সেদিন আমার খাওয়া-দাওয়ার দফা মাটি হয়ে গিয়েছিল। সব জিনিষেই সেই হাঙ্গরের গন্ধ বোধ হতে লাগল।
এ সুয়েজ খাল খাতস্থাপত্যের এক অদ্ভুত নিদর্শন। ফার্ডিনেণ্ড লেসেপ্স নামক এক ফরাসী স্থপতি এই খাল খনন করেন। ভূমধ্যসাগর আর লোহিতসাগরের সংযোগ হয়ে ইওরোপ আর ভারতবর্ষের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের অত্যন্ত সুবিধা হয়েছে। মানব-জাতির উন্নতির বর্তমান অবস্থার জন্য যতগুলি কারণ প্রাচীনকাল থেকে কাজ করছে, তার মধ্যে বোধ হয় ভারতের বাণিজ্য সর্বপ্রধান। অনাদি কাল হতে, উর্বরতায় আর বাণিজ্য-শিল্পে ভারতের মত দেশ কি আর আছে? দুনিয়ার যত সূতি কাপড়, তুলা, পাট, নীল, লাক্ষা, চাল, হীরে, মতি ইত্যাদির ব্যবহার ১০০ বৎসর আগে পর্যন্ত ছিল, তা সমস্তই ভারতবর্ষ হতে যেত। তা ছাড়া উৎকৃষ্ট রেশমী পশমিনা কিংখাব ইত্যাদি এদেশের মত কোথাও হত না। আবার লবঙ্গ এলাচ মরিচ জায়ফল জয়িত্রী প্রভৃতি নানাবিধ মসলার স্থান—ভারতবর্ষ। কাজেই অতি প্রাচীনকাল হতেই যে দেশ যখন সভ্য হত, তখন ঐ সকল জিনিষের জন্য ভারতের উপর নির্ভর। এই বাণিজ্য দুটি প্রধান ধারায় চলত; একটি ভাঙাপথে আফগানি ইরানী দেশ হয়ে, আর একটি জলপথে রেড-সী হয়ে। সিকন্দর শা ইরান-বিজয়ের পর নিয়ার্কুস নামক সেনাপতিকে জলপথে সিন্ধুনদের মুখ হয়ে সমুদ্র পার হয়ে লোহিতসমুদ্র দিয়ে রাস্তা দেখতে পাঠান। বাবিল ইরান গ্রীস রোম প্রভৃতি প্রাচীন দেশের ঐশ্বর্য যে কত পরিমাণে ভারতের বাণিজ্যের উপর নির্ভর করত, তা অনেকে জানে না। রোম-ধ্বংসের পর মুসলমানী বোগদাদ ও ইতালীর ভিনিস্ ও জেনোয়া ভারতীয় বাণিজ্যের প্রধান পাশ্চাত্য কেন্দ্র হয়েছিল। যখন তুর্কেরা রোম সাম্রাজ্য দখল করে ইতালীয়দের ভারত-বাণিজ্যের রাস্তা বন্ধ করে দিলে, তখন জেনোয়ানিবাসী কলম্বাস (Christophoro Columbo) আটলাণ্টিক পার হয়ে ভারতে আসবার নূতন রাস্তা বার করবার চেষ্টা করেন, ফল—আমেরিকা মহাদ্বীপের আবিষ্ক্রিয়া। আমেরিকায় পৌঁছেও কলম্বাসের ভ্রম যায়নি যে, এ ভারতবর্ষ নয়। সেই জন্যেই আমেরিকার আদিম নিবাসীরা এখনও ‘ইণ্ডিয়ান’ নামে অভিহিত। বেদে সিন্ধুনদের ‘সিন্ধু’ ‘ইন্দু’ দুই নামই পাওয়া যায়; ইরানীরা তাকে ‘হিন্দু’, গ্রীকরা ‘ইণ্ডুস’ করে তুললে; তাই থেকে ইণ্ডিয়া—ইণ্ডিয়ান। মুসলমানী ধর্মের অভ্যুদয়ে ‘হিন্দু’ দাঁড়াল—কালা (খারাপ), যেমন এখন—‘নেটিভ’।
এদিকে পোর্তুগীজরা ভারতের নূতন পথ—আফ্রিকা বেড়ে আবিষ্কার করলে। ভারতের লক্ষ্মী পোর্তুগালের উপর সদয়া হলেন; পরে ফরাসী, ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজ। ইংরেজের ঘরে ভারতের বাণিজ্য, রাজস্ব—সমস্তই; তাই ইংরেজ এখন সকলের উপর বড় জাত। তবে এখন আমেরিকা প্রভৃতি দেশে ভারতের জিনিষপত্র অনেক স্থলে ভারত অপেক্ষাও উত্তম উৎপন্ন হচ্ছে, তাই ভারতের আর তত কদর নাই। এ-কথা ইওরোপীয়েরা স্বীকার করতে চায় না; ভারত—নেটিভপূর্ণ, ভারত যে তাদের ধন, সভ্যতার প্রধান সহায় ও সম্বল, সে কথা মানতে চায় না, বুঝতেও চায় না। আমরাও বোঝাতে কি ছাড়ব? ভেবে দেখ—কথাটা কি। ঐ যারা চাষাভূষা তাঁতি-জোলা ভারতের নগণ্য মনুষ্য—বিজাতিবিজিত স্বজাতিনিন্দিত ছোট জাত, তারাই আবহমানকাল নীরবে কাজ করে যাচ্চে, তাদের পরিশ্রমফলও তারা পাচ্চে না! কিন্তু ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নিয়মে দুনিয়াময় কত পরিবর্তন হয়ে যাচ্চে। দেশ, সভ্যতা, প্রাধান্য ওলটপালট হয়ে যাচ্চে।
হে ভারতের শ্রমজীবী! তোমরা নীরব অনবরত-নিন্দিত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বাবিল, ইরান, আলেকজান্দ্রিয়া, গ্রীস, রোম, ভিনিস, জেনোয়া, বোগদাদ, সমরকন্দ, স্পেন, পোর্তুগাল, ফরাসী, দিনেমার, ওলন্দাজ ও ইংরেজের ক্রমান্বয়ে আধিপত্য ও ঐশ্বর্য। আর তুমি?—কে ভাবে এ-কথা। স্বামীজী! তোমাদের পিতৃপুরুষ দুখানা দর্শন লিখেছেন, দশখানা কাব্য বানিয়েছেন, দশটা মন্দির করেছেন—তোমাদের ডাকের চোটে গগন ফাটছে; আর যাদের রুধিরস্রাবে মনুষ্যজাতির যা কিছু উন্নতি—তাদের গুণগান কে করে? লোকজয়ী ধর্মবীর রণবীর কাব্যবীর সকলের চোখের উপর, সকলের পূজ্য; কিন্তু কেউ যেখানে দেখে না, কেউ যেখানে একটা বাহবা দেয় না, যেখানে সকলে ঘৃণা করে, সেখানে বাস করে অপার সহিষ্ণুতা, অনন্ত প্রীতি ও নির্ভীক কার্যকারিতা; আমাদের গরীবরা ঘরদুয়ারে দিনরাত যে মুখ বুজে কর্তব্য করে যাচ্চে, তাতে কি বীরত্ব নাই? বড় কাজ হাতে এলে অনেকেই বীর হয়, দশ হাজার লোকের বাহবার সামনে কাপুরুষও অক্লেশে প্রাণ দেয়, ঘোর স্বার্থপরও নিষ্কাম হয়; কিন্তু অতি ক্ষুদ্র কার্যে সকলের অজান্তেও যিনি সেই নিঃস্বার্থতা, কর্তব্যপরায়ণতা দেখান, তিনিই ধন্য—সে তোমরা ভারতের চিরপদদলিত শ্রমজীবী! —তোমাদের প্রণাম করি।
এ সুয়েজ খালও অতি প্রাচীন জিনিষ। প্রাচীন মিসরের ফেরো বাদশাহের সময় কতকগুলি লবণাম্বু জলা খাতের দ্বারা সংযুক্ত করে উভয়সমুদ্রস্পর্শী এক খাত তৈয়ার হয়। মিসরে রোমরাজ্যের শাসনকালেও মধ্যে মধ্যে ঐ খাত মুক্ত রাখবার চেষ্টা হয়। পরে মুসলমান সেনাপতি অমরু মিসর বিজয় করে ঐ খাতের বালুকা উদ্ধার ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বদলে এক প্রকার নূতন করে তোলেন।
তারপর বড় কেউ কিছু করেননি। তুরস্ক সুলতানের প্রতিনিধি, মিসর-খেদিব ইস্মায়েল ফরাসীদের পরামর্শে অধিকাংশ ফরাসী অর্থে এই খাত খনন করান। এ খালের মুশকিল হচ্ছে যে, মরুভূমির মধ্য দিয়ে যাবার দরুন পুনঃপুনঃ বালিতে ভরে যায়। এই খাতের মধ্যে বড় বাণিজ্য-জাহাজ একখানি একবারে যেতে পারে। শুনেছি যে, অতি বৃহৎ রণতরী বা বাণিজ্য-জাহাজ একেবারেই যেতে পারে না। এখন একখানি জাহাজ যাচ্চে আর একখানি আসছে, এ দুয়ের মধ্যে সংঘাত উপস্থিত হতে পারে—এই জন্যে সমস্ত খালটি কতকগুলি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এবং প্রত্যেক ভাগের দুই মুখে কতকটা স্থান এমন ভাবে প্রশন্ত করে দেওয়া আছে, যাতে দুই-তিনখানি জাহাজ একত্র থাকতে পারে। ভূমধ্যসাগরমুখে প্রধান আফিস, আর প্রত্যেক বিভাগেই রেল ষ্টেশনের মত ষ্টেশন। সেই প্রধান আফিসে জাহাজটি খালে প্রবেশ করবামাত্রই ক্রমাগত তারে খবর যেতে থাকে। কখানি আসছে, কখানি যাচ্চে এবং প্রতি মুহূর্তে তারা কে কোথায়—তা খবর যাচ্চে এবং একটি বড় নকশার উপর চিহ্নিত হচ্ছে। একখানির সামনে যদি আর একখানি আসে, এজন্য এক ষ্টেশনের হুকুম না পেলে আর এক ষ্টেশন পর্যন্ত জাহাজ যেতে পায় না।
এই সুয়েজ খাল ফরাসীদের হাতে। যদিও খাল-কোম্পানীর অধিকাংশ শেয়ার এখন ইংরেজদের, তথাপি সমস্ত কার্য ফরাসীরা করে—এটি রাজনৈতিক মীমাংসা।
এবার ভূমধ্যসাগর। ভারতবর্ষের বাহিরে এমন স্মৃতিপূর্ণ স্থান আর নেই—এশিয়া, আফ্রিকা—প্রাচীন সভ্যতার অবশেষ। একজাতীয় রীতিনীতি খাওয়া-দাওয়া শেষ হল, আর এক প্রকার আকৃতি-প্রকৃতি, আহার-বিহার, পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার আরম্ভ হল—ইওরোপ এল। শুধু তাই নয়—নানা বর্ণ, জাতি, সভ্যতা, বিদ্যা ও আচারের বহুশতাব্দীব্যাপী যে মহা-সংমিশ্রণের ফলস্বরূপ এই আধুনিক সভ্যতা, সে সংমিশ্রণের মহাকেন্দ্র এইখানে। যে ধর্ম, যে বিদ্যা, যে সভ্যতা, যে মহাবীর্য আজ ভূমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত হয়েছে, এই ভূমধ্যসাগরের চতুষ্পার্শ্বই তার জন্মভূমি। ঐ দক্ষিণে—ভাস্কর্যবিদ্যার আকর, বহুধনধান্যপ্রসূ অতি প্রাচীন মিশর; পূর্বে ফিনিসিয়ান, ফিলিষ্টিন, য়াহুদী, মহাবল বাবিল, আসির ও ইরানী সভ্যতার প্রাচীন রঙ্গভূমি—এশিয়া মাইনর; উত্তরে—সর্বাশ্চর্যময় গ্রীকজাতির প্রাচীন লীলাক্ষেত্র।
স্বামীজী! দেশ নদী পাহাড় সমুদ্রের কথা তো অনেক শুনলে, এখন প্রাচীন কাহিনী কিছু শোন। এ প্রাচীন কাহিনী বড় অদ্ভুত। গল্প নয়—সত্য; মানবজাতির যথার্থ ইতিহাস। এই সকল প্রাচীন দেশ কালসাগরে প্রায় লয় হয়েছিল। যা কিছু লোকে জানত, তা প্রায় প্রাচীন যবন ঐতিহাসিকের অদ্ভুত গল্পপূর্ণ প্রবন্ধ অথবা বাইবেল-নামক য়াহুদী পুরাণের অত্যদ্ভূত বর্ণনা মাত্র। এখন পুরানো পাথর, বাড়ী, ঘর, টালিতে লেখা পুঁথি, আর ভাষাবিশ্লেষ শত মুখে গল্প করছে। এ গল্প এখন সবে আরম্ভ হয়েছে, এখনই কত আশ্চর্য কথা বেরিয়ে পড়েছে, পরে কি বেরুবে কে জানে? দেশ-দেশান্তরের মহা মহা মণ্ডিত দিনরাত এক টুকরো শিলালেখ বা ভাঙা বাসন বা একটা বাড়ী বা একখান টালি নিয়ে মাথা ঘামাচ্চেন, আর সেকালের লুপ্ত বার্তা বার করছেন।
যখন মুসলমান নেতা ওসমান কনষ্টাণ্টিনোপল দখল করলে, সমস্ত পূর্ব ইওরোপে ইসলামের ধ্বজা সগর্বে উড়তে লাগল, তখন প্রাচীন গ্রীকদের যে সকল পুস্তক, বিদ্যাবুদ্ধি তাদের নির্বীর্য বংশধরদের কাছে লুকানো ছিল, তা পশ্চিম-ইওরোপে পলায়মান গ্রীকদের সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রীকেরা রোমের বহুকাল পদানত হয়েও বিদ্যা-বুদ্ধিতে রোমকদের গুরু ছিল। এমন কি, গ্রীকরা ক্রিশ্চান হওয়ায় এবং গ্রীক ভাষায় ক্রিশ্চানদের ধর্মগ্রন্থ লিখিত হওয়ায় সমগ্র রোমক সাম্রাজ্যে ক্রিশ্চান ধর্মের বিজয় হয়। কিন্তু প্রাচীন গ্রীক, যাদের আমরা যবন বলি, যারা ইওরোপী সভ্যতার আদ্গুরু, তাদের সভ্যতার চরম উত্থান ক্রিশ্চানদের অনেক পূর্বে। ক্রিশ্চান হয়ে পর্যন্ত তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি সমস্ত লোপ পেয়ে গেল, কিন্তু যেমন হিন্দুদের ঘরে পূর্বপুরুষদের বিদ্যা-বুদ্ধি কিছু কিছু রক্ষিত আছে, তেমনি ক্রিশ্চান গ্রীকদের কাছে ছিল; সেই সকল পুস্তক চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাতেই ইংরেজ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ প্রভৃতি জাতির মধ্যে প্রথম সভ্যতার উন্মেষ। গ্রীকভাষা, গ্রীকবিদ্যা, শেখবার একটা ধুম পড়ে গেল। প্রথমে যা কিছু ঐ সকল পুস্তকে ছিল, তা হাড়সুদ্ধ গেলা হল। তারপর যখন নিজেদের বুদ্ধি মার্জিত হয়ে আসতে লাগল এবং ক্রমে ক্রমে পদার্থ-বিদ্যার অভ্যুত্থান হতে লাগল, তখন ঐ সকল গ্রন্থের সময়, প্রণেতা, বিষয়, যাথাতথ্য ইত্যাদির গবেষণা চলতে লাগল। ক্রিশ্চানদের ধর্মগ্রন্থগুলি ছাড়া প্রাচীন অ-ক্রিশ্চান গ্রীকদের সমস্ত গ্রন্থের উপর মতামত প্রকাশ করতে তো আর কোন বাধা ছিল না, কাজেই বাহ্য এবং আভ্যন্তর সমালোচনার এক বিদ্যা বেরিয়ে পড়ল।
মনে কর, একখানা পুস্তকে লিখেছে যে অমুক সময় অমুক ঘটনা ঘটেছিল। কেউ দয়া করে একটা পুস্তকে যা হয় লিখেছেন বললেই কি সেটা সত্য হল? লোকে, বিশেষ সে কালের, অনেক কথাই কল্পনা থেকে লিখত। আবার প্রকৃতি, এমন কি, আমাদের পৃথিবী সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান অল্প ছিল; এই সকল কারণে গ্রন্থোক্ত বিষয়ের সত্যাসত্যের নির্ধারণে বিষম সন্দেহ জন্মাতে লাগল।
প্রথম উপায়—মনে কর, একজন গ্রীক ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, অমুক সময়ে ভারতবর্ষে চন্দ্রগুপ্ত বলে একজন রাজা ছিলেন। যদি ভারতবর্ষের গ্রন্থেও ঐ সময়ে ঐ রাজার উল্লেখ দেখা যায়, তা হলে বিষয়টা অনেক প্রমাণ হল বৈকি। যদি চন্দ্রগুপ্তের কতকগুলো টাকা পাওয়া যায় বা তাঁর সময়ের একটা বাড়ী পাওয়া যায়, যাতে তাঁর উল্লেখ আছে, তা হলে আর কোন গোলই রইল না।
দ্বিতীয় উপায়—মনে কর, আবার একটা পুস্তকে লেখা আছে যে একটা ঘটনা সিকন্দর বাদশার সময়ের, কিন্তু তার মধ্যে দু-একজন রোমক বাদশার উল্লেখ রয়েছে, এমন ভাবে রয়েছে যে প্রক্ষিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়—তা হলে সে পুস্তকটি সিকন্দর বাদশার সময়ের নয় বলে প্রমাণ হল।
তৃতীয় উপায় ভাষা—সময়ে সময়ে সকল ভাষারই পরিবর্তন হচ্ছে, আবার এক এক লেখকের এক একটা ঢঙ থাকে। যদি একটা পুস্তকে খামকা একটা অপ্রাসঙ্গিক বর্ণনা লেখকের বিপরীত ঢঙে থাকে, তা হলেই সেটা প্রক্ষিপ্ত বলে সন্দেহ হবে। এই প্রকার নানা প্রকারে সন্দেহ, সংশয়, প্রমাণ প্রয়োগ করে গ্রন্থতত্ত্ব-নির্ণয়ের এক বিদ্যা বেরিয়ে পড়ল।
চতুর্থ উপায়—তার উপর আধুনিক বিজ্ঞান দ্রুতপদসঞ্চারে নানা দিক্ হতে রশ্মি বিকিরণ করতে লাগল; ফল—যে পুস্তকে কোন অলৌকিক ঘটনা লিখিত আছে, তা একেবারেই অবিশ্বাস্য হয়ে পড়ল।
সকলের উপর—মহাতরঙ্গরূপ সংস্কৃত ভাষার ইওরোপে প্রবেশ এবং ভারতবর্ষে, ইউফ্রেটিস নদীতটে ও মিসরদেশে প্রাচীন শিলালেখের পুনঃপঠন; আর বহুকাল ভূগর্ভে বা পর্বতপার্শ্বে লুক্কায়িত মন্দিরাদির আবিষ্ক্রিয়া ও তাহাদের যথার্থ ইতিহাসের জ্ঞান। পূর্বে বলেছি যে, এ নূতন গবেষণা-বিদ্যা ‘বাইবেল’ বা ‘নিউ টেষ্টামেণ্ট’ গ্রন্থগুলিকে আলাদা রেখেছিল। এখন মারধোর, জ্যান্ত পোড়ানো তো আর নেই, কেবল সমাজের ভয়; তা উপেক্ষা করে অনেকগুলি পণ্ডিত উক্ত পুস্তকগুলিকেও বেজায় বিশ্লেষ করেছেন। আশা করি, হিন্দু প্রভৃতির ধর্মপুস্তককে ওঁরা যেমন বেপরোয়া হয়ে টুকরো টুকরো করেন, কালে সেই প্রকার সৎ-সাহসের সহিত য়াহুদী ও ক্রিশ্চান পুস্তকাদিকেও করবেন। একথা বলি কেন, তার একটা উদাহরণ দিই—মাসপেরো (Maspero) বলে এক মহাপণ্ডিত, মিসর প্রত্নতত্ত্বের অতিপ্রতিষ্ঠ লেখক, ‘ইস্তোয়ার আঁসিএন ওরিআঁতাল’২০ বলে মিসর ও বাবিলদিগের এক প্রকাণ্ড ইতিহাস লিখেছেন। কয়েক বৎসর পূর্বে উক্ত গ্রন্থের এক ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদের ইংরেজীতে তর্জমা পড়ি। এবার ব্রিটিশ মিউজিয়ামের (British Museum) এক অধ্যক্ষকে কয়েকখানি মিসর ও বাবিল-সম্বন্ধীয় গ্রন্থের বিষয় জিজ্ঞাসা করায় মাসপেরোর গ্রন্থের কথা উল্লেখ হয়। তাতে আমার কাছে উক্ত গ্রন্থের তর্জমা আছে শুনে তিনি বললেন যে ওতে হবে না, অনুবাদক কিছু গোঁড়া ক্রিশ্চান; এজন্য যেখানে যেখানে মাসপেরোর অনুসন্ধান খ্রীষ্টধর্মকে আঘাত করে, সে সব গোলমাল করে দেওয়া আছে! মূল ফরাসী ভাষায় গ্রন্থ পড়তে বললেন। পড়ে দেখি তাইতো—এ যে বিষম সমস্যা। ধর্মগোঁড়ামিটুকু কেমন জিনিষ জান তো?—সত্যাসত্য সব তাল পাকিয়ে যায়। সেই অবধি ও-সব গবেষণাগ্রন্থের তর্জমার ওপর অনেকটা শ্রদ্ধা কমে গেছে।
আর এক নূতন বিদ্যা জন্মেছে, যার নাম জাতিবিদ্যা (ethnology), অর্থাৎ মানুষের রঙ, চুল, চেহারা, মাথার গঠন, ভাষা প্রভৃতি দেখে শ্রেণীবদ্ধ করা।
জার্মানরা সর্ববিদ্যায় বিশারদ হলেও সংস্কৃত আর প্রাচীন আসিরীয় বিদ্যায় বিশেষ পটু; বর্নফ (Burnouf) প্রভৃতি জার্মান পণ্ডিত ইহার নিদর্শন। ফরাসীরা প্রাচীন মিসরের তত্ত্ব উদ্ধারে বিশেষ সফল—মাসপেরো-প্রমুখ পণ্ডিতমণ্ডলী ফরাসী। ওলন্দাজেরা য়াহুদী ও প্রাচীন খ্রীষ্টধর্মের বিশ্লেষণে বিশেষপ্রতিষ্ঠ—কুনা (Kuenen) প্রভৃতি লেখক জগৎপ্রসিদ্ধ। ইংরেজরা অনেক বিদ্যার আরম্ভ করে দিয়ে তারপর সরে পড়ে।
এই সকল পণ্ডিতদের মত কিছু বলি। যদি ভাল না লাগে, তাদের সঙ্গে ঝগড়া-ঝাঁটি কর, আমায় দোষ দিও না।
হিঁদু, য়াহুদী, প্রাচীন বাবিলী, মিসরী প্রভৃতি প্রাচীন জাতিদের মতে, সমস্ত মানুষ এক আদিম পিতামাতা হতে অবতীর্ণ হয়েছে। এ-কথা এখন লোকে বড় মানতে চায় না।
কালো কুচকুচে, নাকহীন, ঠোঁটপুরু, গড়ানে কপাল, আর কোঁকড়াচুল কাফ্রি দেখেছ? প্রায় ঐ ঢঙের গড়ন, তবে আকারে ছোট, চুল অত কোঁকড়া নয়, সাঁওতালী আণ্ডামানী ভিল দেখেছ? প্রথম শ্রেণীর নাম নিগ্রো (Negro)। এদের বাসভূমি আফ্রিকা। দ্বিতীয় জাতির নাম নেগ্রিটো (Negrito)—ছোট নিগ্রো; এরা প্রাচীন কালে আরবের কতক অংশে, ইউফ্রেটিস্ তটের অংশে, পারস্যের দক্ষিণভাগে, ভারতবর্ষময়, আণ্ডামান প্রভৃতি দ্বীপে, মায় অষ্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বাস করত। আধুনিক সময়ে কোন কোন ঝোড়-জঙ্গলে, আণ্ডামানে এবং অষ্ট্রেলিয়ায় এরা বর্তমান।
লেপচা, ভুটিয়া, চীনি, প্রভৃতি দেখেছ?—সাদা রঙ বা হলদে, সোজা কালো চুল? কালো চোখ, কিন্তু চোখ কোনাকুনি বসানো, দাঁড়ি গোঁফ অল্প, চেপ্টা মুখ, চোখের নীচের হাড় দুটো ভারি উঁচু।
নেপালী, বর্মী, সায়ামী, মালাই, জাপানী দেখেছ? এরা ঐ গড়ন, তবে আকারে ছোট।
এ শ্রেণীর দুই জাতির নাম মোগল (Mongols) আর মোগলইড্ (ছোট মোগল)। ‘মোগল’ জাতি এক্ষণে অধিকাংশ এশিয়াখণ্ড দখল করে বসেছে। এরাই মোগল, কাল্মুখ (Kalmucks), হুন, চীন, তাতার, তুর্ক, মানচু, কিরগিজ প্রভৃতি বিবিধ শাখায় বিভক্ত হয়ে এক চীন ও তিব্বতী সওয়ায়২১ তাঁবু নিয়ে আজ এদেশ, কাল ওদেশ করে ভেড়া ছাগল গরু ঘোড়া চরিয়ে বেড়ায়, আর বাগে পেলেই পঙ্গপালের মত এসে দুনিয়া ওলট-পালট করে দেয়। এদেশের আর একটি নাম তুরানী। ইরান তুরান—সেই তুরান!
রঙ কালো, কিন্তু সোজা চুল, সোজা নাক, সোজা কালো চোখ—প্রাচীন মিশর, প্রাচীন বাবিলোনিয়ায় বাস করত এবং অধুনা ভারতময়—বিশেষ দক্ষিণদেশে বাস করে; ইওরোপেও এক-আধ জায়গায় চিহ্ন পাওয়া যায়—এ এক জাতি। এদের পারিভাষিক নাম দ্রাবিড়ী।
সাদা রঙ, সোজা চোখ, কিন্তু কান নাক—রামছাগলের মুখের মত বাঁকা আর ডগা মোটা, কপাল গড়ানে, ঠোঁট পুরু—যেমন উত্তর আরবের লোক, বর্তমান য়াহুদী, প্রাচীন বাবিলী, আসিরী, ফিনিক প্রভৃতি; এদের ভাষাও এক প্রকারের; এদের নাম সেমিটিক। আর যারা সংস্কৃতের সদৃশ ভাষা কয়, সোজা নাক মুখ চোখ, রঙ সাদা, চুল কালো বা কটা, চোখ কালো বা নীল, এদের নাম আরিয়ান।
বর্তমান সমস্ত জাতিই এই সকল জাতির সংমিশ্রণে উৎপন্ন। ওদের মধ্যে যে জাতির ভাগ অধিক যে দেশে, সে দেশের ভাষা ও আকৃতি অধিকাংশই সেই জাতির ন্যায়। উষ্ণদেশ হলেই যে রঙ কালো হয় এবং শীতল দেশ হলেই যে বর্ণ সাদা হয়, এ-কথা এখনকার অনেকেই মানেন না। কালো এবং সাদার মধ্যে যে বর্ণগুলি, সেগুলি অনেকের মতে, জাতি-মিশ্রণে উৎপন্ন হয়েছে। মিসর ও প্রাচীন বাবিলের সভ্যতা পণ্ডিতদের মতে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। এ সকল দেশে খ্রীঃ পূঃ ৬০০০ বৎসর বা ততোধিক সময়ের বাড়ী-ঘর-দোর পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে জোর চন্দ্রগুপ্তের সময়ের যদি কিছু পাওয়া গিয়ে থাকে—খ্রীঃ পূঃ ৩০০ বৎসর মাত্র। তার পূর্বের বাড়ী-ঘর এখনও পাওয়া যায় নাই।২২ তবে তার বহু পূর্বের পুস্তকাদি আছে, যা অন্য কোন দেশে পাওয়া যায় না। পণ্ডিত বালগঙ্গাধর তিলক প্রমাণ করেছেন যে, হিন্দুদের ‘বেদ’ অন্তত খ্রীঃ পূঃ পাঁচ হাজার বৎসর আগে বর্তমান আকারে ছিল।
এই ভূমধ্যসাগর-প্রান্ত—যে ইওরোপী সভ্যতা এখন বিশ্বজয়ী, তার জন্মভূমি। এই তটভূমিতে মিশরী, বাবিলী, ফিনিক, য়াহুদী প্রভৃতি সেমিটিক জাতিবর্গ ও ইরানী, যবন, রোমক প্রভৃতি আর্যজাতির সংমিশ্রণে বর্তমান ইওরোপী সভ্যতা।
‘রোজেট্টা স্টোন’২৩ নামক একখণ্ড বৃহৎ শিলালেখ মিসরে পাওয়া যায়। তার উপর জীবজন্তুর লাঙ্গুল ইত্যাদি রূপ চিত্রলিপিতে২৪ লিখিত এক লেখ আছে, তার নীচে আর এক প্রকার লেখ, সকলের নিম্নে গ্রীক ভাষার অনুযায়ী লেখ। একজন পণ্ডিত ঐ তিন লেখ-কে এক অনুমান করেন। কপ্ত (Copts) নামক যে ক্রিশ্চান জাতি এখনও মিসরে বর্তমান এবং যারা প্রাচীন মিসরীদের বংশধর বলে বিদিত, তাদের লেখের সাহায্যে তিনি এই প্রাচীন মিসরী লিপির উদ্ধার করেন। ঐরূপ বাবিলদের ইঁট এবং টালিতে খোদিত ভল্লাগ্রের ন্যায় লিপিও ক্রমে উদ্ধার হয়। এদিকে ভারতবর্ষের লাঙ্গলাকৃতি কতকগুলি লেখ মহারাজা অশোকের সমসাময়িক লিপি বলে আবিষ্কৃত হয়। এতদপেক্ষা প্রাচীন লিপি ভারতবর্ষে পাওয়া যায় নাই। মিসরময় নানা প্রকার মন্দির, স্তম্ভ, শবাধার ইত্যাদিতে যে সকল চিত্রলিপি লিখিত ছিল, ক্রমে সেগুলি পঠিত হয়ে প্রাচীন মিসরতত্ত্ব বিশদ করে ফেলেছে।
মিসরীরা সমুদ্রপার ‘পুন্ট্’ (Punt) নামক দক্ষিণ দেশ হতে মিসরে প্রবেশ করেছিল। কেউ কেউ বলেন যে, ঐ ‘পুন্ট্’-ই বর্তমান মালাবার, এবং মিসরীরা ও দ্রাবিড়িরা এক জাতি। এদের প্রথম রাজার নাম ‘মেনুস’(Menes)। এদের প্রাচীন ধর্মও কোন কোন অংশে আমাদের পৌরাণিক কথার ন্যায়। ‘শিবু’ (Shibu) দেবতা ‘নুই’-কে (Nui) দেবীর দ্বারা আচ্ছাদিত হয়েছিলেন, পরে আর এক দেবতা ‘শু’ (Shu) এসে বলপূর্বক ‘নুই’-কে তুলে ফেললেন। ‘নুই’র শরীর আকাশ হল, দুহাত আর দুপা হল সেই আকাশের চার স্তম্ভ। আর ‘শিবু’ হলেন পৃথিবী। ‘নুই’র পুত্র-কন্যা ‘অসিরিস’ আর ‘ইসিস’—মিসরের প্রধান দেব-দেবী এবং তাঁদের পুত্র ‘হোরস্’ সর্বোপাস্য। এই তিনজন একসঙ্গে উপাসিত হতেন। ‘ইসিস’ আবার গো-মাতা রূপে পূজিত।
পৃথিবীতে ‘নীল’ নদের ন্যায়, আকাশে ঐ প্রকার নীলনদ আছেন—পৃথিবীর নীলনদ তাঁহার অংশ মাত্র। সূর্যদেব এদের মতে নৌকায় করে পৃথিবী পরিভ্রমণ করেন; মধ্যে মধ্যে ‘অহি’ নামক সর্প তাঁকে গ্রাস করে, তখন গ্রহণ হয়।
চন্দ্রদেবকে এক শূকর মধ্যে মধ্যে আক্রমণ করে এবং খণ্ড খণ্ড করে ফেলে, পরে পনর দিন তাঁর সরাতে লাগে। মিসরের দেবতাসকল কেউ শৃগালমুখ, কেউ বাজের মুখযুক্ত, কেউ গোমুখ ইত্যাদি।
সঙ্গে সঙ্গেই ইউফ্রেটিস-তীরে আর এক সভ্যতার উত্থান হয়েছিল, তাদের মধ্যে ‘বাল’, ‘মোলখ’, ‘ইস্তারত’ ও ‘দমুজি’২৫ প্রধান। ইস্তারত দমুজি-নামক মেষপালকের প্রণয়ে আবদ্ধ হলেন। এক বরাহ দমুজিকে মেরে ফেললে। পৃথিবীর নীচে পরলোকে ইস্তারত দমুজির অন্বেষণে গেলেন। সেথায় ‘আলাৎ’ নামক ভয়ঙ্করী দেবী তাঁকে বহু যন্ত্রণা দিলে। শেষে ইস্তারত বললেন যে, আমি দমুজিকে না পেলে মর্ত্যলোকে আর যাব না। মহা মুশকিল; উনি হলেন কামদেবী, উনি না এলে মানুষ, জন্তু, গাছপালা আর কিছুই জন্মাবে না। তখন দেবতারা সিদ্ধান্ত করলেন যে, প্রতি বৎসর দমুজি চার মাস থাকবেন পরলোকে—পাতালে, আর আট মাস থাকবেন মর্ত্যলোকে। তখন ইস্তারত ফিরে এলেন—বসন্তের আগমন হল, শস্যাদি জন্মাল।
এই ‘দমুজি’ আবার ‘আদুনোই’ বা ‘আদুনিস’২৬ নামে বিখ্যাত। সমস্ত সেমিটিক জাতিদের ধর্ম কিঞ্চিৎ অবান্তরভেদে প্রায় এক রকমই ছিল। বাবিলী, য়াহুদী, ফিনিক ও পরবর্তী আরবদের একই প্রকার উপাসনা ছিল। প্রায় সকল দেবতারই নাম ‘মোলখ’ (যে শব্দটি বাঙলা ভাষতে মালিক, মুল্লুক ইত্যাদি রূপে এখনও রয়েছে) অথবা ‘বাল’, তবে অবান্তরভেদ ছিল। কারও কারও মত—এ ‘আলাৎ’ দেবতা পরে আরবিদিগের আল্লা হলেন। এই সকল দেবতার পূজার মধ্যে কতকগুলি ভয়ানক ও জঘন্য ব্যাপারও ছিল। মোলখ বা বালের নিকট পুত্রকন্যাকে জীবন্ত পোড়ানো হত। ইস্তরতের মন্দিরে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক কামসেবা প্রধান অঙ্গ ছিল।
য়াহুদী জাতির ইতিহাস বাবিল অপেক্ষা অনেক আধুনিক। পণ্ডিতদের মতে ‘বাইবেল’ নামক ধর্মগ্রন্থ খ্রীঃ পূঃ ৫০০ হতে আরম্ভ হয়ে খ্রীঃ পর পর্যন্ত লিখিত হয়। বাইবেলের অনেক অংশ যা পূর্বের বলে প্রথিত, তা অনেক পরের। এই বাইবেলের মধ্যে স্থূল কথাগুলি ‘বাবিল’ জাতির। বাবিলদের সৃষ্টিবর্ণনা, জলপ্লাবনবর্ণনা অনেক স্থলে বাইবেল গ্রন্থে সমগ্র গৃহীত। তার উপর পারসী বাদশারা যখন এশিয়া মাইনরের উপর রাজত্ব করতেন, সেই সময় অনেক ‘পারসী’ মত য়াহুদীদের মধ্যে প্রবেশ করে। বাইবেলের প্রাচীন ভাগের মতে এই জগৎই সব—আত্মা বা পরলোক নাই। নবীন ভাগে পারসীদের পরলোকবাদ, মৃতের পুনরুত্থান ইত্যাদি দৃষ্ট হয়; এবং শয়তানবাদটি একেবারে পারসীদের।
য়াহুদীদের ধর্মের প্রধান অঙ্গ ‘য়াভে’ নামক ‘মোলখের’২৭ পূজা। এই নামটি কিন্তু য়াহুদী ভাষার নয়, কারও কারও মতে ঐটি মিসরী শব্দ। কিন্তু কোথা থেকে এল, কেউ জানে না। বাইবেলে বর্ণনা আছে যে, য়াহুদীরা মিসরে আবদ্ধ হয়ে অনেকদিন ছিল—সে সব এখন কেউ বড় মানে না এবং ‘ইব্রাহিম’, ‘ইসহাক’, ‘ইয়ুসুফ’ প্রভৃতি গোত্রপিতাদের রূপক বলে প্রমাণ করে।
য়াহুদীরা ‘য়াভে’ এ নাম উচ্চারণ করত না, তার স্থানে ‘আদুনোই’ বলত। যখন য়াহুদীরা ইস্রেল আর ইফ্রেম২৮ দুই শাখায় বিভক্ত হল, তখন দুই দেশে দুটি প্রধান মন্দির নির্মিত হল। জেরুসালেমে ইস্রেলদের যে মন্দির নির্মিত হল, তাতে ‘য়াভে’ দেবতার একটি নরনারী সংযোগমূর্তি এক সিন্দুকের মধ্যে রক্ষিত হত। দ্বারদেশে একটি বৃহৎ পুংচিহ্ন স্তম্ভ ছিল। ইফ্রেমে ‘য়াভে’ দেবতা—সোনামোড়া বৃষের মূর্তিতে পূজিত হতেন।
উভয় স্থানেই জ্যেষ্ঠ পুত্রকে দেবতার নিকট জীবন্ত অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হত এবং একদল স্ত্রীলোক ঐ দুই মন্দিরে বাস করত; তারা মন্দিরের মধ্যেই বেশ্যাবৃত্তি করে যা উপার্যন করত, তা মন্দিরের ব্যয়ে লাগত।
ক্রমে য়াহুদীদের মধ্যে একদল লোকের প্রাদুর্ভাব হল; তাঁরা গীত বা নৃত্যের দ্বারা আপনাদের মধ্যে দেবতার আবেশ করতেন। এঁদের নাম নবী বা Prophet (ভাববাদী)। এদের মধ্যে অনেকে ইরানীদের সংসর্গে মূর্তিপূজা, পুত্রবলি, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদির বিপক্ষ হয়ে পড়লেন। ক্রমে বলির জায়গায় হল ‘সুন্নত’; বেশ্যাবৃত্তি, মূর্তি আদি ক্রমে উঠে গেল; ক্রমে ঐ নবী-সম্প্রদায়ের মধ্য হতে ক্রিশ্চান ধর্মের সৃষ্টি হল।
‘ঈশা’ নামক কোন পুরুষ কখনও জন্মেছিলেন কিনা, এ নিয়ে বিষম বিতণ্ডা। ‘নিউ টেষ্টামেণ্টের’ যে চার পুস্তক, তার মধ্যে ‘সেণ্ট-জন’ নামক পুস্তক তো একেবারে অগ্রাহ্য হয়েছে। বাকী তিনখানি—কোন এক প্রাচীন পুস্তক দেখ লেখা, এই সিদ্ধান্ত; তাও ‘ঈশা’- হজরতের যে সময় নির্দিষ্ট আছে, তার অনেক পরে।
তার উপর যে সময় ঈশা জন্মেছিলেন বলে প্রসিদ্ধি, সে সময় ঐ য়াহুদীদের মধ্যে দুইজন ঐতিহাসিক জন্মেছিলেন—‘জোসিফুস্’ আর ‘ফিলো’২৯। এঁরা য়াহুদীদের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়েরও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ঈশা বা ক্রিশ্চানদের নামও নাই; অথবা রোমান জজ তাঁকে ক্রুশে মারতে হুকুম দিয়েছিল, এর কোন কথাই নাই। জোসিফুসের পুস্তকে এক ছত্র ছিল, তা এখন প্রক্ষিপ্ত বলে প্রমাণ হয়েছে।
রোমকরা ঐ সময়ে য়াহুদীদের উপর রাজত্ব করত, গ্রীকরা সকল বিদ্যা শেখাত। এঁরা সকলেই য়াহুদীদের সম্বন্ধে অনেক কথাই লিখেছেন, কিন্তু ঈশা বা ক্রিশ্চানদের কোন কথাই নাই।
আবার মুশকিল যে, যে সকল কথা, উপদেশ বা মত নিউ টেষ্টামেণ্ট গ্রন্থে প্রচার আছে, ও-সমস্তই নানা দিগ্দেশ হতে এসে খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই য়াহুদীদের মধ্যে বর্তমান ছিল এবং ‘হিলেল্’৩০ প্রভৃতি রাব্বিগণ (উপদেশক) প্রচার করেছিলেন। পণ্ডিতরা তো এইসব বলছেন, তবে অন্যের ধর্ম সম্বন্ধে—যেমন সাঁ করে এক কথা বলে ফেলেন, নিজেদের দেশের ধর্ম সম্বন্ধে তা বললে কি আর জাঁক থাকে? কাজেই শনৈঃ শনৈঃ যাচ্ছেন। এর নাম ‘হায়ার ক্রিটিসিজম্’ (Higher Criticism)।
পাশ্চাত্য বুধমণ্ডলী এই প্রকার দেশ-দেশান্তরের ধর্ম, নীতি, জাতি ইত্যাদির আলোচনা করছেন। আমাদের বাঙলা ভাষায় কিছুই নাই। হবে কি করে?—এক বেচারা ১০ বৎসর হাড়গোড়ভাঙা পরিশ্রম করে যদি এই রকম একখানা বই তর্জমা করে তো সে নিজেই বা খায় কি, আর বই বা ছাপায় কি দিয়ে?
একে দেশ অতি দরিদ্র, তাতে বিদ্যা একেবারে নেই বললেই হয়। এমন দিন কি হবে যে, আমরা নানাপ্রকার বিদ্যার চর্চা করব? ‘মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্, যৎ কৃপা ... !’—মা জগদম্বাই জানেন।
জাহাজ নেপল্সে লাগল—আমরা ইতালীতে পৌঁছুলাম। এই ইতালীর রাজধানী রোম! এই রোম, সেই প্রাচীন মহাবীর্য রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী—যার রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, উপনিবেশ-সংস্থাপন, পরদেশ-বিজয় এখনও সমগ্র পৃথিবীর আদর্শ!
নেপল্স ত্যাগ করে জাহাজ মার্সাইতে লেগেছিল, তারপর একেবারে লণ্ডন।
ইওরোপ সম্বন্ধে তোমাদের তো নানা কথা শোনা আছে—তারা কি খায়, কি পরে, কি রীতিনীতি আচার ইত্যাদি—তা আর আমি কি বলব! তবে ইওরোপী সভ্যতা কি, এর উৎপত্তি কোথায়, আমাদের সঙ্গে এর কি সম্বন্ধ, এ সভ্যতার কতটুকু আমাদের লওয়া উচিত—এসব সম্বন্ধে অনেক কথা বলবার রইল। শরীর কাউকে ছাড়ে না ভায়া, অতএব বারান্তরে সেসব কথা বলতে চেষ্টা করব। অথবা বলে কি হবে? বকাবকি বলা-কওয়াতে আমাদের (বিশেষ বাঙালীর) মত কে বা মজবুত? যদি পার তো করে দেখাও। কাজ কথা কউক, মুখকে বিরাম দাও। তবে একটা কথা বলে রাখি, গরীব নিম্নজাতিদের মধ্যে বিদ্যা ও শক্তির প্রবেশ যখন থেকে হতে লাগল, তখন থেকেই ইওরোপ উঠতে লাগল। রাশি রাশি অন্য দেশের আবর্জনার ন্যায় পরিত্যক্ত দুঃখী গরীব আমেরিকায় স্থান পায়, আশ্রয় পায়; এরাই আমেরিকার মেরুদণ্ড! বড়মানুষ, পণ্ডিত, ধনী—এরা শুনলে বা না শুনলে, বুঝলে বা না বুঝলে, তোমাদের গাল দিলে বা প্রশংসা করলে কিছুই এসে যায় না; এঁরা হচ্ছেন শোভামাত্র, দেশের বাহার। কোটি কোটি গরীব নীচ যারা, তারাই হচ্ছে প্রাণ। সংখ্যায় আসে যায় না, ধন বা দারিদ্র্যে আসে যায় না; কায়-মন-বাক্য যদি এক হয়, একমুষ্টি লোক পৃথিবী উল্টে দিতে পারে—এই বিশ্বাসটি ভুলো না। বাধা যত হবে, ততই ভাল। বাধা না পেলে কি নদীর বেগ হয়? যে জিনিষ যত নূতন হবে, যত উত্তম হবে, সে জিনিষ প্রথম তত অধিক বাধা পাবে। বাধাই তো সিদ্ধির পূর্ব লক্ষণ। বাধাও নাই, সিদ্ধিও নাই। অলমিতি।
আমাদের দেশে বলে, পায়ে চক্কর থাকলে সে লোক ভবঘুরে হয়। আমার পায়ে বোধ হয় সমস্তই চক্কর। বোধ হয় বলি কেন? —পা নিরীক্ষণ করে, চক্কর আবিষ্কার করবার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে চেষ্টা একেবারে বিফল; সে শীতের চোটে পা ফেটে খালি চৌ-চাকলা, তার চক্কর ফক্কর বড় দেখা গেল না। যা হোক—যখন কিংবদন্তী রয়েছে তখন মেনে নিলুম যে, আমার পা চক্করময়। ফল কিন্তু সাক্ষাৎ—এত মনে করলুম যে, পারি-তে বসে কিছুদিন ফরাসী ভাষা ও সভ্যতা আলোচনা করা যাবে; পুরানো বন্ধু-বান্ধব ত্যাগ করে, এক গরীব ফরাসী নবীন বন্ধুর বাসায় গিয়ে বাস করলুম—(তিনি জানেন না ইংরেজী, আমার ফরাসী—সে এক অদ্ভুত ব্যাপার!) বাসনা যে, বোবা হয়ে বসে থাকার না-পারকতায়—(কাজে কাজেই) ফরাসী বলবার উদ্যোগ হবে, আর গড়গড়িয়ে ফরাসী ভাষা এসে পড়বে। [তা নয়] কোথায় চললুম ভিয়েনা, তুর্কী, গ্রীস, ইজিপ্ত, জেরুসালেম পর্যটন করতে! ভবিতব্য কে ঘোচায় বল। তোমায় পত্র লিখছি মুসলমান-প্রভুত্বের অবশিষ্ট রাজধানী কনষ্টাণ্টিনোপল হতে।
সঙ্গের সঙ্গী তিন জন—দুজন ফরাসী, একজন আমেরিক। আমেরিক তোমাদের পরিচিতা মিস্ ম্যাক্লাউড, ফরাসী পুরুষ বন্ধু মস্যিয় জুল বোওয়া৩১ —ফ্রান্সের একজন সুপ্রতিষ্ঠিত দার্শনিক ও সাহিত্যলেখক; আর ফরাসিনী বন্ধু জগদ্বিখ্যাত গায়িকা মাদ্মোয়াজেল কালভে৩২। ফরাসী ভাষায় ‘মিষ্টর’ হচ্ছেন ‘মস্যিয়’, আর ‘মিস্’ হচ্ছেন ‘মাদ্মোয়াজেল’—‘জ’টা পূর্ববাঙলার ‘জ’। মাদ্মোয়াজেল কালভে আধুনিক কালের সর্বশ্রেষ্ঠা গায়িকা—অপেরা গায়িকা। এঁর গীতের এত সমাদর যে, এঁর তিন লক্ষ, চার লক্ষ টাকা বাৎসরিক আয়, খালি গান গেয়ে। এঁর সহিত আমার পরিচয় পূর্ব হতে।
পাশ্চাত্য দেশের সর্বশ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী মাদাম সারা বার্নহার্ড৩৩, আর সর্বশ্রেষ্ঠা গায়িকা কালভে—দুজনেই ফরাসী, দুজনেই ইংরেজী ভাষার সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা, কিন্তু ইংলণ্ড ও আমেরিকায় মধ্যে মধ্যে যান ও অভিনয় [করে] আর গীত গেয়ে লক্ষ লক্ষ ডলার সংগ্রহ করেন। ফরাসী ভাষা সভ্যতার ভাষা—পাশ্চাত্য জগতের ভদ্রলোকের চিহ্ন—সকলেই জানে, কাজেই এদের ইংরেজী শেখবার অবকাশ এবং প্রবৃত্তি নাই।
মাদাম বার্নহার্ড বর্ষীয়সী; কিন্তু সেজে মঞ্চে যখন ওঠেন, তখন যে বয়স, যে লিঙ্গ [স্ত্রী বা পুরুষ চরিত্র] অভিনয় করেন, তার হুবহু নকল! বালিকা বালক, যা বল তাই—হুবহু, আর সে আশ্চর্য আওয়াজ! এরা বলে তাঁর কণ্ঠে রূপার তার বাজে! বার্নহার্ডের অনুরাগ—বিশেষ ভারতবর্ষের উপর, আমায় বারংবার বলেন, তোমাদের দেশ ‘ত্রেজাঁসিএন, ত্রেসিভিলিজে’ (tre′s ancien tre′s civilise′)—অতি প্রাচীন, অতি সুসভ্য। এক বৎসর ভারতবর্ষ-সংক্রান্ত এক নাটক অভিনয় করেন; তাতে মঞ্চের উপর বিলকুল এক ভারতবর্ষের রাস্তা খাড়া করে দিয়েছিলেন—মেয়ে, ছেলে, পুরুষ, সাধু, নাগা—বিলকুল ভারতবর্ষ!! আমায় অভিনয়ান্তে বলেন, ‘আমি মাসাবধি প্রত্যেক মিউজিয়ম বেড়িয়ে ভারতের পুরুষ, মেয়ে, পোষাক, রাস্তা, ঘাট পরিচয় করেছি’। বার্নহার্ডের ভারত দেখবার ইচ্ছা বড়ই প্রবল—‘সে মঁ র্যাভ (C’est mon rave) সে মঁ র্যাভ’—সে আমার জীবনস্বপ্ন। আবার প্রিন্স অব ওয়েল্স্৩৪ তাঁকে বাঘ হাতী শিকার করাবেন প্রতিশ্রুত আছেন। তবে বার্নহার্ড বললেন—সে দেশে যেতে গেলে, দেড় লাখ দুলাখ টাকা খরচ না করলে কি হয়? টাকার অভাব তাঁর নাই—‘লা দিভিন সারা!!’ (La divine Sarah)—দৈবী সারা, তাঁর আবার টাকার অভাব কি?—যাঁর স্পেশাল ট্রেন ভিন্ন গতায়াত নেই!—সে ধুম বিলাস, ইওরোপের অনেক রাজারাজড়া পারে না; যাঁর থিয়েটারে মাসাবধি আগে থেকে দুনো দামে টিকিট কিনে রাখলে তবে স্থান হয়, তাঁর টাকার বড় অভাব নেই, তবে সারা বার্নহার্ড বেজায় খরচে। তাঁর ভারতভ্রমণ কাজেই এখন রইল।
মাদ্মোয়াজেল কালভে এ শীতে গাইবেন না, বিশ্রাম করবেন—ইজিপ্ত প্রভৃতি নাতিশীত দেশে চলেছেন। আমি যাচ্ছি—এঁর অতিথি হয়ে। কালভে যে শুধু সঙ্গীতের চর্চা করেন, তা নয়; বিদ্যা যথেষ্ট, দর্শনশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্রের বিশেষ সমাদর করেন। অতি দরিদ্র অবস্থায় জন্ম হয়; ক্রমে নিজের প্রতিভাবলে, বহু পরিশ্রমে, বহু কষ্ট সয়ে এখন প্রভূত ধন—রাজা-বাদশার সম্মানের ঈশ্বরী।
মাদাম মেলবা, মাদাম এমা এমস্ প্রভৃতি বিখ্যাত গায়িকাসকল আছেন; জাঁ দ্য রেজকি, প্লাঁস৩৫ প্রভৃতি অতি বিখ্যাত গায়কসকল আছেন; এঁরা সকলেই দুই তিন লক্ষ টাকা বাৎসরিক রোজগার করেন! কিন্তু কালভের বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে এক অভিনব প্রতিভা! অসাধারণ রূপ, যৌবন, প্রতিভা আর দৈবী কণ্ঠ—এসব একত্র সংযোগে কালভেকে গায়িকামণ্ডলীর শীর্ষস্থানীয়া করেছে। কিন্তু দুঃখ দারিদ্র্য অপেক্ষা শিক্ষক আর নেই! সে শৈশবের অতি কঠিন দারিদ্র্য দুঃখ কষ্ট—যার সঙ্গে দিনরাত যুদ্ধ করে কালভের এই বিজয়লাভ, সে সংগ্রাম তাঁর জীবনে এক অপূর্ব সহানুভূতি, এক গভীর ভাব এনে দিয়েছে। আবার এ দেশে উদ্যোগ যেমন, উপায়ও তেমন। আমাদের দেশে উদ্যোগ থাকলেও উপায়ের একান্ত অভাব। বাঙালীর মেয়ের বিদ্যা শেখবার সমধিক ইচ্ছা থাকলেও উপায়াভাবে বিফল; বাঙলা ভাষায় আছে কি শেখবার? বড় জোর পচা নভেল-নাটক!! আবার বিদেশী ভাষায় বা সংস্কৃত ভাষায় আবদ্ধ বিদ্যা, দু-চার জনের জন্য মাত্র। এ সব দেশে নিজের ভাষায় অসংখ্য পুস্তক; তার উপর যখন যে ভাষায় একটা নূতন কিছু বেরুচ্চে, তৎক্ষণাৎ তার অনুবাদ করে সাধারণের সমক্ষে উপস্থিত করছে।
মস্যিয় জুল বোওয়া প্রসিদ্ধ লেখক; ধর্মসকলের, কুসংস্কারসকলের ঐতিহাসিক তত্ত্ব-আবিষ্কারে বিশেষ নিপুণ। মধ্যযুগে ইওরোপে যে সকল শয়তানপূজা, জাদু, মারণ, উচাটন, ছিটেফোঁটা মন্ত্রতন্ত্র ছিল এবং এখনও যা কিছু আছে, সে সকল ইতিহাসবদ্ধ করে এঁর এক প্রসিদ্ধ পুস্তক। ইনি সুকবি এবং ভিক্তর হ্যুগো, লা মার্টিন প্রভৃতি ফরাসী মহাকবি এবং গ্যেটে, শিলার প্রভৃতি জার্মান মহাকবিদের ভেতর যে ভারতের বেদান্তভাব প্রবেশ করেছে, সেই ভাবের পোষক। বেদান্তের প্রভাব ইওরোপে—কাব্য এবং দর্শনশাস্ত্রে সমধিক। ভাল কবি মাত্রই দেখছি বেদান্তী; দার্শনিক তত্ত্ব লিখতে গেলেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেদান্ত। তবে কেউ কেউ স্বীকার করতে চায় না নিজের সম্পূর্ণ নূতনত্ব বাহাল রাখতে চায়—যেমন হারবার্ট স্পেন্সার প্রভৃতি; কিন্তু অধিকাংশরাই স্পষ্ট স্বীকার করে। এবং না করে যায় কোথা—এ তার, রেলওয়ে, খবরকাগজের দিনে? ইনি অতি নিরভিমান, শান্তপ্রকৃতি, এবং সাধারণ অবস্থার লোক হলেও অতি যত্ন করে আমায় নিজের বাসায় প্যারিসে রেখেছিলেন। এখন একসঙ্গে ভ্রমণে চলেছেন।
কনষ্টাণ্টিনোপল পর্যন্ত পথের সঙ্গী আর এক দম্পতি—পেয়র হিয়াসান্থ৩৬ এবং তাঁর সহধর্মিণী। পেয়র (অর্থাৎ পিতা) হিয়াসান্থ ছিলেন ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের এক কঠোর তপস্বি-শাখাভুক্ত সন্ন্যাসী। পাণ্ডিত্য ও অসাধারণ বাগ্মিতাগুণে এবং তপস্যার প্রভাবে ফরাসী দেশে এবং সমগ্র ক্যাথলিক সম্প্রদায়ে এঁর অতিশয় প্রতিষ্ঠা ছিল। মহাকবি ভিক্তর হ্যুগো দুজন লোকের ফরাসী ভাষার প্রশংসা করতেন—তার মধ্যে পেয়র হিয়াসান্থ একজন। চল্লিশ বৎসর বয়ঃক্রমকালে পেয়র হিয়াসান্থ এক আমেরিক নারীর প্রণয়াবদ্ধ হয়ে তাকে করে ফেললেন বে—মহা হুলস্থূল পড়ে গেল; অবশ্য ক্যাথলিক সমাজ তৎক্ষণাৎ তাঁকে ত্যাগ করলে। শুধু পা, আলখাল্লা-পরা তপস্বি-বেশ ফেলে পেয়র হিয়াসান্থ গৃহস্থের হ্যাট কোট বুট পরে হলেন—মস্যিয় লয়জন্।৩৭ আমি কিন্তু তাঁকে তাঁর পূর্বের নামেই ডাকি। সে অনেক দিনের কথা, ইওরোপ-প্রসিদ্ধ হাঙ্গাম! প্রোটেষ্টাণ্টরা তাঁকে সমাদরে গ্রহণ করলে, ক্যাথলিকরা ঘৃণা করতে লাগল। পোপ লোকটার গুণাতিশয্যে তাঁকে ত্যাগ করতে না চেয়ে বললেন, ‘তুমি গ্রীক ক্যাথলিক পাদ্রী হয়ে থাক (সে শাখার পাদ্রী একবার মাত্র বে করতে পায়, কিন্তু বড় পদ পায় না), কিন্তু রোমান চার্চ ত্যাগ কর না।’ কিন্তু লয়জন্-গেহিনী তাঁকে টেনে হিঁচড়ে পোপের ঘর থেকে বার করলে। ক্রমে পুত্র পৌত্র হল; এখন অতি স্থবির লয়জন্ জেরুসালেমে চলেছেন—ক্রিশ্চান আর মুসলমানের মধ্যে যাতে সদ্ভাব হয়, সেই চেষ্টায়। তাঁর গেহিনী বোধ হয় অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, লয়জন্ বা দ্বিতীয় মার্টিন্ লুথার হয়, পোপের সিংহাসন উল্টে বা ফেলে দেয়—ভূমধ্যসাগরে! সে সব তো কিছুই হল না; হল—ফরাসীরা বলে, ‘ইতোনষ্টস্ততোভ্রষ্টঃ’। কিন্তু মাদাম লয়জনের—সে নানা দিবাস্বপ্ন চলেছে!! বৃদ্ধ লয়জন্ অতি মিষ্টভাষী, নম্র ভক্ত প্রকৃতির লোক। আমার সঙ্গে দেখা হলেই কত কথা—নানা ধর্মের, নানা মতের। তবে ভক্ত মানুষ—অদ্বৈতবাদে একটু ভয় খাওয়া আছে। গিন্নীর ভাবটা বোধ হয় আমার উপর কিছু বিরূপ। বৃদ্ধের সঙ্গে যখন আমার ত্যাগ বৈরাগ্য সন্ন্যাসের চর্চা হয়, স্থবিরের প্রাণে—সে চিরদিনের ভাব জেগে ওঠে, আর গিন্নীর বোধ হয় গা কস্ কস্ করে। তার উপর মেয়ে-মদ্দ সমস্ত ফরাসীরা যত দোষ গিন্নীর উপর ফেলে; বলে, ‘ও মাগী আমাদের এক মহাতপস্বী সাধুকে নষ্ট করে দিয়েছে!!’ গিন্নীর কিছু বিপদ বৈকি—আবার বাস হচ্ছে প্যারিসে, ক্যাথলিকের দেশে। বে-করা পাদ্রীকে ওরা দেখলে ঘৃণা করে, মাগ-ছেলে নিয়ে ধর্মপ্রচার এ ক্যাথলিক আদতে সহ্য করবে না। গিন্নীর আবার একটু ঝাঁজ আছে কি না। একবার গিন্নী এক অভিনেত্রীর উপর ঘৃণা প্রকাশ করে বললেন, ‘তুমি বিবাহ না করে অমুকের সঙ্গে বাস করছ, ‘তুমি বড় খারাপ।’ সে অভিনেত্রী ঝট জবাব দিলে, ‘আমি তোমার চেয়ে লক্ষ গুণে ভাল। আমি একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাস করি, আইন-মত বে না হয় নাই করেছি; আর তুমি মহাপাপী—এত বড় একটা সাধুর ধর্ম নষ্ট করলে!! যদি তোমার প্রেমের ঢেউ এতই উঠেছিল, তা না হয় সাধুর সেবা-দাসী হয়ে থাকতে; তাকে বে করে—গৃহস্থ করে তাকে উৎসন্ন কেন দিলে?’ ‘পচাকুমড়ো শরীরের’ কথা শুনে যে দেশে হাসতুম, তার আর এক দিক্ দিয়ে মানে হয়—দেখছ?
যাক, আমি সমস্ত শুনি, চুপ করে থাকি। মোদ্দা—বৃদ্ধ পেয়র হিয়াসান্থ বড়ই প্রেমিক আর শান্ত; সে খুশী আছে তার মাগ-ছেলে নিয়ে; দেশ সুদ্ধ লোকের তাতে কি? তবে গিন্নীটি একটু শান্ত হলেই বোধ হয় সব মিটে যায়। তবে কি জান ভায়া, আমি দেখছি যে, পুরুষ আর মেয়ের মধ্যে সব দেশেই বোঝবার ও বিচার করবার রাস্তা আলাদা। পুরুষ একদিক দিয়ে বুঝবে; মেয়েমানুষ আর একদিক দিয়ে বুঝবে। পুরুষের যুক্তি এক রকম, মেয়েমানুষের আর এক রকম। পুরুষে মেয়েকে মাফ করে, আর পুরুষের ঘাড়ে দোষ দেয়; মেয়েতে পুরুষকে মাফ করে, আর সব দোষ মেয়ের ঘাড়ে দেয়।
এদের সঙ্গে আমার বিশেষ লাভ এই যে, ঐ এক আমেরিক ছাড়া এরা কেউ ইংরেজী জানে না; ইংরেজী ভাষায় কথা একদম বন্ধ,৩৮ কাজেই কোন রকম করে আমায় কইতে হচ্ছে ফরাসী এবং শুনতে হচ্ছে ফরাসী।
প্যারিস নগরী হতে বন্ধুবর ম্যাকসিম্ নানাস্থানে চিঠিপত্র যোগাড় করে দিয়েছেন, যাতে দেশগুলো যথাযথ রকমে দেখা হয়। ম্যাকসিম্—বিখ্যাত ম্যাকসিম্ গানের নির্মাতা; যে তোপে ক্রমাগত গোলা চলতে থাকে—আপনি ঠাসে, আপনি ছোঁড়ে—বিরাম নাই। ম্যাকসিম্ আদতে আমেরিকান; এখন ইংলণ্ডে বাস, তোপের কারখানা ইত্যাদি—। ম্যাকসিম্ তোপের কথা বেশী কইলে বিরক্ত হয়, বলে, ‘আরে বাপু, আমি কি আর কিছুই করিনি—ঐ মানুষ-মারা কলটা ছাড়া?’ ম্যাকসিম্ চীন-ভক্ত, ভারত-ভক্ত, ধর্ম ও দর্শনাদি সম্বন্ধে সুলেখক। আমার বইপত্র পড়ে অনেক দিন হতে আমার উপর বিশেষ অনুরাগ—বেজায় অনুরাগ। আর ম্যাকসিম্ সব রাজারাজড়াকে তোপ বেচে, সব দেশে জানাশুনা, কিন্তু তাঁর বিশেষ বন্ধু লি হুং চাঙ, বিশেষ শ্রদ্ধা চীনের উপর, ধর্মানুরাগ কংফুছে মতে। চীনে নাম নিয়ে মধ্যে মধ্যে কাগজে ক্রিশ্চান পাদ্রীদের বিপক্ষে লেখা হয়—তারা চীনে কি করতে যায়, কেন বা যায়, ইত্যাদি; ম্যাকসিম্ পাদ্রীদের চীনে ধর্মপ্রচার আদতে সহ্য করতে পারে না! ম্যাকসিমের গিন্নীটিও ঠিক অনুরূপ—চীন-ভক্তি, ক্রিশ্চানী-ঘৃণা! ছেলেপুলে নেই, বুড়ো মানুষ—অগাধ ধন।
যাত্রার ঠিক হল—প্যারিস থেকে রেলযোগে ভিয়েনা, তারপর কনষ্টাণ্টিনোপল, তারপর জাহাজে এথেন্স, গ্রীস, তারপর ভূমধ্যসাগরপার ইজিপ্ত, তারপর এশিয়া মাইনর, জেরুসালেম ইত্যাদি। ‘ওরিআঁতাল এক্সপ্রেস ট্রেন’ প্যারিস হতে স্তাম্বুল পর্যন্ত ছোটে প্রতিদিন। তায় আমেরিকার নকলে শোবার বসবার খাবার স্থান। ঠিক আমেরিকার মত সুসম্পন্ন না হলেও কতক বটে। সে গাড়ীতে চড়ে ২৪শে অক্টোবর প্যারিস ছাড়তে হচ্ছে।
আজ ২৩শে অক্টোবর; কাল সন্ধ্যার সময় প্যারিস হতে বিদায়। এ বৎসর এ প্যারিস সভ্যজগতে এক কেন্দ্র, এ বৎসর মহাপ্রদর্শনী। নানা দিগ্দেশ-সমাগত সজ্জনসঙ্গম। দেশ-দেশান্তরের মনীষিগণ নিজ নিজ প্রতিভাপ্রকাশে স্বদেশের মহিমা বিস্তার করছেন, আজ এ প্যারিসে। এ মহাকেন্দ্রের ভেরীধ্বনি আজ যাঁর নাম উচ্চারণ করবে, সে নাদ তরঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বদেশকে সর্বজনসমক্ষে গৌরবান্বিত করবে। আর আমার জন্মভূমি—এ জার্মান ফরাসী ইংরেজ ইতালী প্রভৃতি বুধমণ্ডলী-মণ্ডিত মহা রাজধানীতে তুমি কোথায়, বঙ্গভূমি? কে তোমার নাম নেয়? কে তোমার অস্তিত্ব ঘোষণা করে? সে বহু গৌরবর্ণ প্রাতিভমণ্ডলীর মধ্য হতে এক যুবা যশস্বী বীর বঙ্গভূমির—আমাদের মাতৃভূমির নাম ঘোষণা করলেন, সে বীর জগৎপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডাক্তার জে সি বোস! একা যুবা বাঙালী বৈদ্যুতিক আজ বিদ্যুদ্বেগে পাশ্চাত্য-মণ্ডলীকে নিজের প্রতিভামহিমায় মুগ্ধ করলেন—সে বিদ্যুৎসঞ্চার, মাতৃভূমির মৃতপ্রায় শরীরে নবজীবন-তরঙ্গ সঞ্চার করলে! সমগ্র বৈদ্যুতিকমণ্ডলীর শীর্ষস্থানীয় আজ জগদীশ বসু—ভারতবাসী, বঙ্গবাসী, ধন্য বীর! বসুজ ও তাঁহার সতী সাধ্বী সর্বগুণসম্পন্না গেহিনী যে দেশে যান, সেথায়ই ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেন—বাঙালীর গৌরব বর্ধন করেন। ধন্য দম্পতি!
আর মিঃ লেগেট প্রভূত অর্থব্যয়ে তাঁর প্যারিসস্থ প্রাসাদে ভোজনাদি-ব্যপদেশে নিত্য নানা যশস্বী ও যশস্বিনী নর-নারীর সমাগম সিদ্ধ করেছেন, তারও আজ শেষ। কবি, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, নৈতিক, সামাজিক, গায়ক, গায়িকা, শিক্ষক, শিক্ষয়িত্রী, চিত্রকর, শিল্পী, ভাস্কর, বাদক—প্রভৃতি নানা জাতির গুণিগণ-সমাবেশ মিষ্টর লেগেটের আতিথ্য-সমাদর-আকর্ষণে তাঁর গৃহে। সে পর্বতনির্ঝরবৎ কথাচ্ছটা, অগ্নিস্ফুলিঙ্গবৎ চতুর্দিক-সমুত্থিত ভাববিকাশ, মোহিনী সঙ্গীত, মনীষি-মনঃসংঘর্ষ-সমুত্থিত চিন্তামন্ত্রপ্রবাহ সকলকে দেশকাল ভুলিয়ে মুগ্ধ করে রাখত!—তারও শেষ।
সকল জিনিষেরই অন্ত আছে। আজ আর একবার পুঞ্জীকৃতভাবরূপ স্থিরসৌদামিনী, এই অপূর্ব ভূস্বর্গ-সমাবেশ প্যারিস-এগজিবিশন দেখে এলুম।
আজ দু-তিন দিন ধরে প্যারিসে ক্রমাগত বৃষ্টি হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রতি সদা সদয় সূর্যদেব আজ ক-দিন বিরূপ। নানাদিগ্দেশাগত শিল্প, শিল্পী, বিদ্যা ও বিদ্বানের পশ্চাতে গূঢ়ভাবে প্রবাহিত ইন্দ্রিয়বিলাসের স্রোত দেখে ঘৃণায় সূর্যের মুখ মেঘকলুষিত হয়েছে, অথবা কাষ্ঠ বস্ত্র ও নানারাগরঞ্জিত এ মায়া অমরাবতীর আশু বিনাশ ভেবে তিনি দুঃখে মেঘাবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকলেন।
আমরাও পালিয়ে বাঁচি—এগজিবিশন ভাঙা এক বৃহৎ ব্যাপার। এই ভূস্বর্গ, নন্দনোপম প্যারিসের রাস্তা এক হাঁটু কাদা চুন বালিতে পূর্ণ হবেন। দু-একটা প্রধান ছাড়া এগজিবিশনের সমস্ত বাড়ী-ঘর-দোরই, কাটকুটরো, ছেঁড়া ন্যাতা, আর চুনকামের খেলা বৈ তো নয়—যেমন সমস্ত সংসার! তা যখন ভাঙতে থাকে সে চুনের গুঁড়ো উড়ে দম আটকে দেয়; ন্যাতাচোতায়, বালি প্রভৃতিতে পথ ঘাট কদর্য করে তোলে; তার উপর বৃষ্টি হলেই সে বিরাট কাণ্ড!
২৪শে অক্টোবর সন্ধ্যার সময় ট্রেন প্যারিস ছাড়ল; অন্ধকার রাত্রি—দেখবার কিছুই নাই। আমি আর মস্যিয় বোওয়া এক কামরায়—শীঘ্র শীঘ্র শয়ন করলুম। নিদ্রা হতে উঠে দেখি, আমরা ফরাসী সীমানা ছাড়িয়ে জার্মান সাম্রাজ্যে উপস্থিত। জার্মানী পূর্বে বিশেষ করে দেখা আছে; তবে ফ্রান্সের পর জার্মানী—বড়ই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাব। ‘যাত্যেকতোঽস্তশিখরং পতিরোষধীনাং’—এক দিকে ভুবনস্পর্শী ফ্রান্স, প্রতিহিংসানলে পুড়ে পুড়ে আস্তে আস্তে খাক হয়ে যাচ্ছে; আর এক দিকে কেন্দ্রীকৃত নূতন মহাবল জার্মানী মহাবেগে উদয়শিখরাভিমুখে চলেছে। কৃষ্ণকেশ, অপেক্ষাকৃত খর্বকায়, শিল্পপ্রাণ, বিলাসপ্রিয়, অতি সুসভ্য ফরাসীর শিল্পবিন্যাস; আর এক দিকে হিরণ্যকেশ, দীর্ঘকার, দিঙ্নাগ জার্মানীর স্থূলহস্তাবলেপ। প্যারিসের পর পাশ্চাত্য জগতে আর নগরী নাই; সব সেই প্যারিসের নকল—অন্ততঃ চেষ্টা। কিন্তু ফরাসীতে সে শিল্পসুষমার সূক্ষ্ম সৌন্দর্য; জার্মানে, ইংরেজে, আমেরিকে সে অনুকরণ স্থূল। ফরাসী বলবিন্যাসও যেন রূপপূর্ণ; জার্মানীর রূপবিকাশ-চেষ্টাও বিভীষণ। ফরাসী প্রতিভার মুখমণ্ডল ক্রোধাক্ত হলেও সুন্দর; জার্মান প্রতিভার মধুর হাস্য-বিমণ্ডিত আননও যেন ভয়ঙ্কর। ফরাসীর সভ্যতা স্নায়ুময়, কর্পূরের মত—কস্তুরীর মত এক মুহূর্তে উড়ে ঘর দোর ভরিয়ে দেয়; জার্মান সভ্যতা পেশীময়, সীসার মত—পারার মত ভারী, যেখানে পড়ে আছে তো পড়েই আছে। জার্মানের মাংসপেশী ক্রমাগত অশ্রান্তভাবে ঠুকঠাক হাতুড়ি আজন্ম মারতে পারে; ফরাসীর নরম শরীর—মেয়েমানুষের মত, কিন্তু যখন কেন্দ্রীভূত হয়ে আঘাত করে, সে কামারের এক ঘা; তার বেগ সহ্য করা বড়ই কঠিন।
জার্মান ফরাসীর নকলে বড় বড় বাড়ী অট্টালিকা বানাচ্ছেন, বৃহৎ বৃহৎ মূর্তি—অশ্বারোহী, রথী—সে প্রাসাদের শিখরে স্থাপন করছেন, কিন্তু জার্মানের দোতলা বাড়ী দেখলেও জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হয়, এ বাড়ী কি মানুষের বাসের জন্য, না হাতী-উটের ‘তবেলা’? আর ফরাসীর পাঁচতলা হাতী-ঘোড়া রাখবার বাড়ী দেখে ভ্রম হয় যে, এ বাড়ীতে বুঝি পরীতে বাস করবে!
আমেরিকা জার্মান-প্রবাহে অনুপ্রাণিত, লক্ষ লক্ষ জার্মান প্রত্যেক শহরে। ভাষা ইংরেজী হলে কি হয়, আমেরিকা আস্তে আস্তে ‘জার্মানীত’৩৯ হয়ে যাচ্ছে। জার্মানীর প্রবল বংশবিস্তার; জার্মান বড়ই কষ্টসহিষ্ণু। আজ জার্মানী ইওরোপের আদেশদাতা, সকলের উপর! অন্যান্য জাতের অনেক আগে জার্মানী প্রত্যেক নরনারীকে রাজদণ্ডের ভয় দেখিয়ে বিদ্যা শিখিয়েছে; আজ সে বৃক্ষের ফল ভোজন করছে। জার্মানীর সৈন্য প্রতিষ্ঠায় সর্বশ্রেষ্ঠ; জার্মানী প্রাণপণ করেছে যুদ্ধপোতেও সর্বশ্রেষ্ঠ হতে; জার্মানীর পণ্যনির্মাণ ইংরেজকেও পরাভূত করেছে! ইংরেজের উপনিবেশেও জার্মান পণ্য, জার্মান মনুষ্য ধীরে ধীরে একাধিপত্য লাভ করছে; জার্মানীর সম্রাটের আদেশে সর্বজাতি চীনক্ষেত্রে৪০ অবনত মস্তকে জার্মান সেনাপতির অধীনতা স্বীকার করছেন!
সারাদিন ট্রেন জার্মানীর মধ্য দিয়ে চলল; বিকাল বেলা জার্মান আধিপত্যের প্রাচীন কেন্দ্র—এখন পররাজ্য—অষ্ট্রীয়ার সীমানায় উপস্থিত। এ ইওরোপে বেড়াবার কতকগুলি জিনিষের উপর বেজায় শুল্ক; অথবা কোন কোন পণ্য সরকারের একচেটে, যেমন তামাক। আবার রুশ ও তুর্কীতে তোমার রাজার ছাড়পত্র না থাকলে একেবারে প্রবেশ নিষেধ; ছাড়পত্র অর্থাৎ পাসপোর্ট একান্ত আবশ্যক। তা ছাড়া রুশ এবং তুর্কীতে, তোমার বইপত্র কাগজ সব কেড়ে নেবে; তারপর তারা পড়ে শুনে যদি বোঝে যে তোমার কাছে তুর্কীর বা রুশের রাজত্বের বা ধর্মের বিপক্ষে কোন বই-কাগজ নেই, তা হলে তা তখন ফিরিয়ে দেবে—নতুবা সে সব বইপত্র বাজেয়াপ্ত করে নেবে। অন্য অন্য দেশে এ পোড়া তামাকের হাঙ্গামা বড়ই হাঙ্গামা। সিন্দুক, প্যাঁটরা, গাঁটরি—সব খুলে দেখাতে হবে, তামাক প্রভৃতি আছে কি না। আর কনষ্টাণ্টিনোপল আসতে গেলে দুটো বড়—জার্মানী আর অষ্ট্রীয়া এবং অনেকগুলো ক্ষুদ্র দেশের মধ্য দিয়ে আসতে হয়; ক্ষুদেগুলো পূর্বে তুরস্কের পরগণা ছিল, এখন স্বাধীন ক্রিশ্চান রাজারা একত্র হয়ে মুসলমানের হাত থেকে যতগুলো পেরেছে, ক্রিশ্চানপূর্ণ পরগণা ছিনিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষুদে পিঁপড়ের কামড় ডেওদের চেয়েও অনেক অধিক।
২৫শে অক্টোবর সন্ধ্যার পর ট্রেন অষ্ট্রীয়ার রাজধানী ভিয়েনা নগরীতে পৌঁছুল। অষ্ট্রীয়া ও রুশিয়ার রাজবংশীয় নর-নারীকে আর্ক-ড্যুক ও আর্ক-ডচেস বলে। এ ট্রেনে দুজন আর্ক-ড্যুক ভিয়েনায় নাববেন; তাঁরা না নাবলে অন্যান্য যাত্রীর আর নাববার অধিকার নাই। আমরা অপেক্ষা করে রইলুম। নানাপ্রকার জরিবুটা-র উর্দি-পরা জনকতক সৈনিক পুরুষ এবং পর-লাগানো (feathered) টুপি মাথায় জন-কতক সৈন্য আর্ক-ড্যুকদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আর্ক-ড্যুকদ্বয় নেমে গেলেন। আমরাও বাঁচলুম— তাড়াতাড়ি নেমে সিন্দুকপত্র পাস করবার উদ্যোগ করতে লাগলুম। যাত্রী অতি অল্প; সিন্দুকপত্র দেখিয়ে ছাড় করাতে বড় দেরী লাগল না। পূর্ব হতে এক হোটেল ঠিকানা করা ছিল; সে হোটেলের লোক গাড়ী নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আমরাও যথাসময়ে হোটেলে উপস্থিত হলুম। সে রাত্রে আর দেখা শুনা কি হবে—পরদিন প্রাতঃকালে শহর দেখতে বেরুলুম।
সমস্ত হোটেলেই এবং ইওরোপের ইংলণ্ড ও জার্মানী ছাড়া প্রায় সকল দেশেই ফরাসী চাল। হিঁদুদের মত দুবার খাওয়া। প্রাতঃকালে দুপ্রহরের মধ্যে; সায়ংকালে ৮টার মধ্যে। প্রত্যূষে অর্থাৎ ৮।৯ টার সময় একটু কাফি পান করা। চায়ের চাল—ইংলণ্ড ও রুশিয়া ছাড়া অন্যত্র বড়ই কম। দিনের ভোজনের ফরাসী নাম ‘দেজুনে’৪১ অর্থাৎ উপবাসভঙ্গ, ইংরেজী ‘ব্রেকফাষ্ট’। সায়ংভোজনের নাম ‘দিনে’, ইং—‘ডিনার’। চা পানের ধুম রুশিয়াতে অত্যন্ত—বেজায় ঠাণ্ডা, আর চীন-সন্নিকট। চীনের চা খুব উত্তম চা—তার অধিকাংশ যায় রুশে। রুশের চা-পানও চীনের অনুরূপ, অর্থাৎ দুগ্ধ মেশানো নেই। দুধ মেশালে চা বা কাফি বিষের ন্যায় অপকারক। আসল চা-পায়ী জাতি চীনে. জাপানী, রুশ, মধ্য এশিয়াবাসী বিনা দুগ্ধে চা পান করে; তদ্বৎ আবার তুর্ক প্রভৃতি আদিম কাফিপায়ী জাতি বিনা দুগ্ধে কাফি পান করে। তবে রুশিয়ায় তার মধ্যে একটু পাতিনেবু এবং এক ডেলা চিনি চায়ের মধ্যে ফেলে দেয়। গরীবেরা এক ডেলা চিনি মুখের মধ্যে রেখে তার উপর দিয়ে চা পান করে এবং একজনের পান শেষ হলে আর এক জনকে সে চিনির ডেলাটা বার করে দেয়। সে ব্যক্তিও সে ডেলাটা মুখের মধ্যে রেখে পূর্ববৎ চা পান করে।
ভিয়েনা শহর—প্যারিসের নকলে ছোট শহর। তবে অষ্ট্রীয়ানরা হচ্ছে জাতিতে জার্মান। অষ্ট্রীয়ার বাদশা এতকাল প্রায় সমস্ত জার্মানীর বাদশা ছিলেন। বর্তমান সময়ে প্রুশরাজ ভিলহেলমের দূরদর্শিতায়, মন্ত্রিবর বিসমার্কের অপূর্ব বুদ্ধিকৌশলে, আর সেনাপতি ফন মল্টকির যুদ্ধপ্রতিভায় প্রুশরাজ অষ্ট্রীয়া ছাড়া সমস্ত জার্মানীর একাধিপতি বাদশা। হতশ্রী হতবীর্য অষ্ট্রীয়া কোন মতে পূর্বকালের নাম-গৌরব রক্ষা করছেন। অষ্ট্রীয় রাজবংশ—হ্যাপসবর্গ বংশ, ইওরোপের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও অভিজাত রাজবংশ। যে জার্মান রাজন্যকুল ইওরোপের প্রায় সর্বদেশেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত, যে জার্মানীর ছোট ছোট করদ রাজা ইংলণ্ড ও রুশিয়াতেও মহাবল সাম্রাজ্যশীর্ষে সিংহাসন স্থাপন করেছে, সেই জার্মানীর বাদশা এতকাল ছিল এই অষ্ট্রীয় রাজবংশ। সে মান, সে গৌরবের ইচ্ছা সম্পূর্ণ অষ্ট্রীয়ার রয়েছে—নাই শক্তি। তুর্ককে ইওরোপে ‘আতুর বৃদ্ধ পুরুষ’৪২ বলে; অষ্ট্রীয়াকে ‘আতুরা বৃদ্ধা স্ত্রী’ বলা উচিত।
অষ্ট্রীয়া ক্যাথলিক সম্প্রদায়ভুক্ত; সেদিন পর্যন্ত অষ্ট্রীয়ার সাম্রাজ্যের নাম ছিল—‘পবিত্র রোম সাম্রাজ্য’। বর্তমান জার্মানী প্রোটেষ্টাণ্ট-প্রবল; অষ্ট্রীয় সম্রাট্ চিরকাল পোপের দক্ষিণ হস্ত, অনুগত শিষ্য, রোমক সম্প্রদায়ের নেতা। এখন ইওরোপে ক্যাথলিক বাদশা কেবল এক অষ্ট্রীয় সম্রাট্; ক্যাথলিক সঙ্ঘের ‘বড় মেয়ে’ ফ্রান্স এখন প্রজাতন্ত্র; স্পেন পোর্তুগাল অধঃপাতিত! ইতালী পোপের সিংহাসনমাত্র স্থাপনের স্থান দিয়েছে; পোপের ঐশ্বর্য, রাজ্য, সমস্ত কেড়ে নিয়েছে; ইতালীর রাজা আর রোমের পোপে মুখ-দেখাদেখি নাই, বিশেষ শত্রুতা। পোপের রাজধানী রোম এখন ইতালীর রাজধানী; পোপের প্রাচীন প্রাসাদ দখল করে রাজা বাস করছেন; পোপের প্রাচীন ইতালীরাজ্য এখন পোপের ভ্যাটিকান (Vatican)-প্রাসাদের চতুঃসীমায় আবদ্ধ! কিন্তু পোপের ধর্মসম্বন্ধে প্রাধান্য এখনও অনেক—সে ক্ষমতার বিশেষ সহায় অষ্ট্রীয়া। অষ্ট্রীয়ার বিরুদ্ধে অথবা পোপ-সহায় অষ্ট্রীয়ার বহুকালব্যাপী দাসত্বের বিরুদ্ধে—নব্য ইতালীর অভ্যুত্থান। অষ্ট্রীয়া কাজেই বিপক্ষ, ইতালী খুইয়ে বিপক্ষ। মাঝখান থেকে ইংলণ্ডের কুপরামর্শে নবীন ইতালী মহাসৈন্য-বল, রণপোত-বল সংগ্রহে বদ্ধপরিকর হল। সে টাকা কোথায়? ঋণজালে জড়িত হয়ে ইতালী উৎসন্ন যাবার দশায় পড়েছে; আবার কোথা হতে উৎপাত—আফ্রিকায় রাজ্য বিস্তার করতে গেল। হাবশী বাদশার কাছে হেরে, হতশ্রী হতমান হয়ে বসে পড়েছে। এ দিকে প্রুশিয়া মহাযুদ্ধে হারিয়ে অষ্ট্রীয়াকে বহুদূর হঠিয়ে দিলে। অষ্ট্রীয়া ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে, আর ইতালী নব জীবনের অপব্যবহারে তদ্বৎ জালবদ্ধ হয়েছে।
অষ্ট্রীয়ার রাজবংশের এখনও ইওরোপের সকল রাজবংশের অপেক্ষা গুমর! তাঁরা অতি প্রাচীন, অতি বড় বংশ! এ বংশের বে-থা বড় দেখে শুনে হয়। ক্যাথলিক না হলে সে বংশের সঙ্গে বে-থা হয়ই না। এই বড় বংশের ভাঁওতায় পড়ে মহাবীর ন্যাপোলঅঁর অধঃপতন!! কোথা হতে তাঁর মাথায় ঢুকল যে, বড় রাজবংশের মেয়ে বে করে পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে এক মহাবংশ স্থাপন করবেন। যে বীর, ‘আপনি কোন্ বংশে অবতীর্ণ?’—এ প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন যে, ‘আমি কারু বংশের সন্তান নই, আমি মহাবংশের স্থাপক’, অর্থাৎ আমা হতে মহিমান্বিত বংশ চলবে, আমি কোন পূর্বপুরুষের নাম নিয়ে বড় হতে জন্মাইনি, সেই বীরের এ বংশমর্যাদারূপ অন্ধকূপে পতন হল!
রাজ্ঞী জোসেফিনকে পরিত্যাগ, যুদ্ধে পরাজয় করে অষ্ট্রীয়ার বাদশার কন্যা-গ্রহণ, মহা-সমারোহে অষ্ট্রীয় রাজকন্যা মেরী লুইসের সহিত বোনাপার্টের বিবাহ, পুত্রজন্ম, সদ্যোজাত শিশুকে রোমরাজ্যে অভিষিক্ত-করণ, ন্যাপোলঅঁর পতন, শ্বশুরের শত্রুতা, লাইপজিগ, ওয়াটারলু, সেণ্ট হেলেনা, রাজ্ঞী মেরী লুইসের সপুত্র পিতৃগৃহে বাস, সামান্য সৈনিকের সহিত বোনাপার্ট-সম্রাজ্ঞীর বিবাহ, একমাত্র পুত্র রোমরাজের মাতামহগৃহে মৃত্যু—এ সব ইতিহাস-প্রসিদ্ধ কথা।
ফ্রান্স এখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থায় পড়ে প্রাচীন গৌরব স্মরণ করছে—আজকাল ন্যাপোলঅঁর-সংক্রান্ত পুস্তক অনেক। সার্দ৪৩ প্রভৃতি নাট্যকার গত ন্যাপোলঅঁর সম্বন্ধে অনেক নাটক লিখছেন; মাদাম বার্নহার্ড, রেজাঁ প্রভৃতি অভিনেত্রী, কফেলাঁ প্রভৃতি অভিনেতাগণ সে সব পুস্তক অভিনয় করে প্রতি রাত্রে থিয়েটার ভরিয়ে ফেলেছে। সম্প্রতি ‘লেগলঁ’৪৪ (গরুড়-শাবক) নামক এক পুস্তক অভিনয় করে মাদাম বার্নহার্ড প্যারিস নগরীতে মহা আকর্ষণ উপস্থিত করেছেন।
‘গরুড় শাবক’ হচ্ছে বোনাপার্টের একমাত্র পুত্র, মাতামহ-গৃহে ভিয়েনার প্রাসাদে এক রকম নজরবন্দী। অষ্ট্রীয় বাদশার মন্ত্রী, চাণক্য মেটারনিক বালকের মনে পিতার গৌরবকাহিনী—যাতে একেবারে না স্থান পায়, সে বিষয়ে সদা সচেষ্ট। কিন্তু দুজন পাঁচজন বোনাপার্টের পুরাতন সৈনিক নানা কৌশলে সানব্রান-প্রাসাদে (Schonbrunn Palace) অজ্ঞাতভাবে বালকের ভৃত্যত্বে গৃহীত হল; তাদের ইচ্ছা—কোন রকমে বালককে ফ্রান্সে হাজির করা এবং সমবেত ইওরোপীয় রাজন্যগণ-পুনঃস্থাপিত বুর্বঁ বংশকে তাড়িয়ে দিয়ে বোনাপার্ট-বংশ স্থাপন করা। শিশু মহাবীর-পুত্র; পিতার রণ-গৌরবকাহিনী শুনে সে সুপ্ত তেজ অতি শীঘ্রই জেগে উঠল। চক্রান্তকারীদের সঙ্গে বালক সানব্রান-প্রাসাদ হতে একদিন পলায়ন করলে; কিন্তু মেটারনিকের তীক্ষ্ণবুদ্ধি পূর্ব হতেই টের পেয়েছিল, সে যাত্রা বন্ধ করে দিলে। বোনাপার্ট-পুত্রকে সানব্রান-প্রাসাদে ফিরিয়ে আনলে—বদ্ধপক্ষ ‘গরুড় শিশু’ ভগ্নহৃদয়ে অতি অল্পদিনেই প্রাণত্যাগ করলে!
এ সানব্রান-প্রাসাদ সাধারণ প্রাসাদ; অবশ্য ঘর-দোর খুব সাজান বটে; কোন ঘরে খালি চীনের কাজ, কোন ঘরে খালি হিন্দু হাতের কাজ, কোন ঘরে অন্য দেশের—এই প্রকার; প্রাসাদস্থ উদ্যান অতি মনোরম বটে, কিন্তু এখন যত লোক এ প্রাসাদ দেখতে যাচ্ছে, সব ঐ বোনাপার্ট-পুত্র যে ঘরে শুতেন, যে ঘরে পড়তেন, যে ঘরে তাঁর মৃত্য হয়েছিল—সেই সব দেখতে যাচ্ছে। অনেক আহম্মক ফরাসী-ফরাসিনী রক্ষিপুরুষকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘এগ্লঁ’র ঘর কোন্টা, কোন্ বিছানায় শুতেন!! মর্ আহাম্মক, এরা জানে বোনাপার্টের ছেলে। এদের মেয়ে জুলুম করে কেড়ে নিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ; সে ঘৃণা এদের আজও যায় না। নাতি—রাখতে হয়, নিরাশ্রয়—রেখেছিল। তারা ‘রোমরাজ’ প্রভৃতি কোন কোন উপাধিই দিত না; খালি অষ্ট্রীয়ার নাতি—কাজেই ড্যুক, বস্। তাকে এখন ‘গরুড় শিশু’ করে এক বই লিখেছিস, আর তার উপর নানা কল্পনা জুটিয়ে, মাদাম বার্নহার্ডের প্রতিভায় একটা খুব আকর্ষণ হয়েছে; কিন্তু এ অষ্ট্রীয় রক্ষী সে নাম কি করে জানবে বল? তার উপর সে বইয়ে লেখা হয়েছে যে ন্যাপোলঅঁর-পুত্রকে অষ্ট্রীয়ার বাদশা মেটারনিক মন্ত্রীর পরামর্শে একরকম মেরেই ফেললেন। রক্ষী—‘এগ্লঁ’ শুনে, মুখ হাঁড়ি করে, গজগজ করতে করতে ঘর-দোর দেখাতে লাগল; কি করে, বকশিশটা ছাড়া বড়ই মুশকিল। তার উপর, এসব অষ্ট্রীয়া প্রভৃতি দেশে সৈনিক বিভাগে বেতন নাই বললেই হল, এক রকম পেটভাতায় থাকতে হয়; অবশ্য কয়েক বৎসর পরে ঘরে ফিরে যায়। রক্ষীর মুখ অন্ধকার হয়ে স্বদেশপ্রিয়তা প্রকাশ করলে, হাত কিন্তু আপনা হতেই বকশিশের দিকে চলল। ফরাসীর দল রক্ষীর হাতকে রৌপ্য-সংযুক্ত করে, ‘এগ্লঁ’র গল্প করতে করতে আর মেটারনিককে গাল দিতে দিতে ঘরে ফিরল; রক্ষী লম্বা সেলাম করে দোর বন্ধ করলে। মনে মনে সমগ্র ফরাসী জাতির বাপন্ত-পিতন্ত অবশ্যই করেছিল।
ভিয়েনা শহরে দেখবার জিনিষ মিউজিয়ম, বিশেষ বৈজ্ঞানিক মিউজিয়ম। বিদ্যার্থীর বিশেষ উপকারক স্থান। নানাপ্রকার প্রাচীন লুপ্ত জীবের অস্থ্যাদি সংগ্রহ অনেক। চিত্রশালিকায় ওলন্দাজ চিত্রকারদের চিত্রই অধিক। ওলন্দাজী সম্প্রদায়ে রূপ বার করবার চেষ্টা বড়ই কম; জীবপ্রকৃতির অবিকল অনুকরণেই এ সম্প্রদায়ের প্রাধান্য। একজন শিল্পী বছর কতক ধরে এক ঝুড়ি মাছ এঁকেছে, না হয় এক থান মাংস, না হয় এক গ্লাস জল—সে মাছ, মাংস, গ্লাসে জল, চমৎকারজনক! কিন্তু ওলন্দাজ সম্প্রদায়ের মেয়ে-চেহারা সব যেন কুস্তিগির পালোয়ান!!
ভিয়েনা শহরে জার্মান পাণ্ডিত্য বুদ্ধিবল আছে, কিন্তু যে কারণে তুর্কী ধীরে ধীরে অবসন্ন হয়ে গেল, সেই কারণ এথায়ও বর্তমান—অর্থাৎ নানা বিভিন্ন জাতি ও ভাষার সমাবেশ। আসল অষ্ট্রীয়ার লোক জার্মান-ভাষী, ক্যাথলিক; হুঙ্গারির লোক তাতারবংশীয়, ভাষা আলাদা; আবার কতক গ্রীকভাষী, গ্রীকমতের ক্রিশ্চান। এ সকল বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একীভূতকরণের শক্তি অষ্ট্রীয়ার নেই। কাজেই অষ্ট্রীয়ার অধঃপতন।
বর্তমানকালে ইওরোপখণ্ডে জাতীয়তার এক মহাতরঙ্গের প্রাদুর্ভাব। এক ভাষা, এক ধর্ম, এক জাতীয় সমস্ত লোকের একত্র সমাবেশ। যেথায় ঐ প্রকার একত্র সমাবেশ সুসিদ্ধ হচ্ছে, সেথায়ই মহাবলের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে; যেথায় তা অসম্ভব, সেথায়ই নাশ। বর্তমান অষ্ট্রীয় সম্রাটের মৃত্যুর পর অবশ্যই জার্মান অষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যের জার্মানভাষী অংশটুকু উদরসাৎ করবার চেষ্টা করবে, রুশ প্রভৃতি অবশ্যই বাধা দেবে; মহা আহবের সম্ভাবনা; বর্তমান সম্রাট্, অতি বৃদ্ধ—সে দুর্যোগ আশুসম্ভাবী। জার্মান সম্রাট্ তুর্কীর সুলতানের আজকাল সহায়; সে সময়ে যখন জার্মানী অষ্ট্রীয়া-গ্রাসে মুখ-ব্যাদান করবে, তখন রুশ-বৈরী তুর্ক, রুশকে কতক-মতক বাধা তো দেবে, কাজেই জার্মান সম্রাট্ তুর্কের সহিত বিশেষ মিত্রতা দেখাচ্ছেন।
ভিয়েনায় তিন দিন—দিক্ করে দিলে! প্যারিসের পর ইওরোপ দেখা-চর্ব্যচুষ্য খেয়ে তেঁতুলের চাটনি চাকা; সেই কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া, সেই সব এক ঢঙ, দুনিয়াসুদ্ধ সেই এক কিম্ভূত কালো জামা, সেই এক বিকট টুপি! তার উপর—উপরে মেঘ আর নীচে পিল পিল করছে এই কালো টুপি, কালো জামার দল; দম যেন আটকে দেয়। ইওরোপসুদ্ধ সেই এক পোষাক, সেই এক চাল-চলন হয়ে আসছে! প্রকৃতির নিয়ম—ঐ সবই মৃত্যুর চিহ্ন! শত শত বৎসর কসরত করিয়ে আমাদের আর্যেরা আমাদের এমনি কাওয়াজ করিয়ে দেছেন যে, আমরা এক ঢঙে দাঁত মাজি, মুখ ধুই, খাওয়া খাই, ইত্যাদি ইত্যাদি; ফল—আমরা ক্রমে ক্রমে যন্ত্রগুলি হয়ে গেছি; প্রাণ বেরিয়ে গেছে, খালি যন্ত্রগুলি ঘুরে বেড়াচ্চি! যন্ত্র ‘না’ বলে না, ‘হ্যাঁ’ বলে না, নিজের মাথা ঘামায় না, ‘যেনাস্য পিতরো যাতাঃ’—(বাপ দাদা যে দিক্ দিয়ে গেছে) সে দিকে চলে যায়, তার পর পচে মরে যায়। এদেরও তাই হবে! ‘কালস্য কুটিলা গতিঃ’—সব এক পোষাক, এক খাওয়া, এক ধাঁজে কথা কওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি—হতে হতে ক্রমে সব যন্ত্র, ক্রমে সব ‘যেনাস্য পিতরো যাতাঃ’ হবে, তার পর পচে মরা!!
২৮শে অক্টোবর রাত্রি ৯টার সময় সেই ওরিয়েণ্ট এক্সপ্রেস ট্রেন আবার ধরা হল। ৩০শে অক্টোবর ট্রেন পৌঁছুল কনষ্টাণ্টিনোপলে। এ দু-রাত একদিন ট্রেন চলল হুঙ্গারি, সর্বিয়া এবং বুলগেরিয়ার মধ্য দিয়ে। হুঙ্গারির অধিবাসী অষ্ট্রীয় সম্রাটের প্রজা। কিন্তু অষ্ট্রীয় সম্রাটের উপাধি ‘অষ্ট্রীয়ার সম্রাট্ ও হুঙ্গারির রাজা’। হুঙ্গারির লোক এবং তুর্কীরা একই জাত, তিব্বতীর কাছাকাছি। হুঙ্গাররা কাস্পিয়ান হ্রদের উত্তর দিয়ে ইওরোপে প্রবেশ করেছে, আর তুর্করা আস্তে আস্তে পারস্যের পশ্চিম প্রান্ত হয়ে এশিয়া-মিনর৪৫ হয়ে ইওরোপ দখল করেছে। হুঙ্গারির লোক ক্রিশ্চান, তুর্ক মুসলমান। কিন্তু সে তাতার রক্তে যুদ্ধপ্রিয়তা উভয়েই বিদ্যমান। হুঙ্গাররা অষ্ট্রীয়া হতে তফাত হবার জন্য বারংবার যুদ্ধ করে এখন কেবল নামমাত্র একত্র। অষ্ট্রীয়া সম্রাট্ নামে হুঙ্গারির রাজা। এদের রাজধানী বুডাপেস্ত অতি পরিষ্কার সুন্দর শহর। হুঙ্গার জাতি আনন্দপ্রিয়, সঙ্গীতপ্রিয়—প্যারিসের সর্বত্র হুঙ্গারিয়ান ব্যাণ্ড।
সর্বিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি তুর্কীর জেলা ছিল—রুশযুদ্ধের পর প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন; তবে সুলতান এখনও বাদশা, এবং সর্বিয়া-বুলগেরিয়ার পররাষ্ট্রসংক্রান্ত কোন অধিকার নেই। ইওরোপে তিন জাত সভ্য—ফরাসী, জার্মান, আর ইংরেজ। বাকীদের দুর্দশা আমাদেরই মত, অধিকাংশ এত অসভ্য যে, এশিয়ায় এত নীচ কোন জাত নেই। সর্বিয়া-বুলগেরিয়াময় সেই মেটে ঘর, ছেঁড়া ন্যাকড়া-পরা মানুষ, আবর্জনারাশি—মনে হয় বুঝি দেশে এলুম! আবার ক্রিশ্চান কি না—দু-চারটা শূয়োর অবশ্যই আছে। দুশো অসভ্য লোকে যা ময়লা করতে পারে না, একটা শোরে তা করে দেয়। মেটে ঘর, তার মেটে ছাদ, ছেঁড়া ন্যাতা-চোতা পরনে, শূকরসহায় সর্বিয়া বা বুলগার! বহু রক্তস্রাবে, বহু যুদ্ধের পর, তুর্কের দাসত্ব ঘুচেছে; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিষম উৎপাত—ইওরোপী ঢঙে ফৌজ গড়তে হবে, নইলে কারু একদিনও নিস্তার নেই। অবশ্য দুদিন আগে বা পরে ওসব রুশের উদরসাৎ হবে, কিন্তু তবুও সে দুদিন জীবন অসম্ভব—ফৌজ বিনা! ‘কনসক্রিপশন্’ চাই।
কুক্ষণে ফ্রান্স জার্মানীর কাছে পরাজিত হল। ক্রোধে আর ভয়ে ফ্রান্সদেশযুদ্ধ লোককে সেপাই করলে। পুরুষমাত্রকেই কিছুদিনের জন্য সেপাই হতে হবে—যুদ্ধ শিখতে হবে; কারু নিস্তার নেই। তিন বৎসর বারিকে (barrack) বাস করে—ক্রোড়পতির ছেলে হোক না কেন, বন্দুক ঘাড়ে যুদ্ধ শিখতে হবে। গবর্ণমেণ্ট খেতে পরতে দেবে, আর বেতন রোজ এক পয়সা। তারপর তাকে দু-বৎসর সদা প্রস্তুত থাকতে হবে নিজের ঘরে; তার পর আরও ১৫ বৎসর তাকে দরকার হলেই যুদ্ধের জন্য হাজির হতে হবে। জার্মানী সিঙ্গি খেপিয়েছে—তাকেও কাজেকাজেই তৈয়ার হতে হল; অন্যান্য দেশেও এর ভয়ে ও, ওর ভয়ে এ—সমস্ত ইওরোপময় ঐ কনসক্রিপশন্, এক ইংলণ্ড ছাড়া। ইংলণ্ড দ্বীপ, জাহাজ ক্রমাগত বাড়াচ্ছে; কিন্তু এ বোয়ার যুদ্ধের শিক্ষা পেয়ে বোধ হয় কনসক্রিপশন্ বা হয়। রুশের লোকসংখ্যা সকলের চেয়ে অধিক, কাজেই রুশ সকলের চেয়ে বেশী ফৌজ খাড়া করে দিতে পারে। এখন এই যে সর্বিয়া বুলগেরিয়া প্রভৃতি বেচারাম দেশ-সব তুর্কীকে ভেঙে ইওরোপীরা বানাচ্ছে, তাদের জন্ম না হতে হতেই আধুনিক সুশিক্ষিত সুসজ্জিত ফৌজ তোপ প্রভৃতি চাই; কিন্তু আখেরে সে পয়সা যোগায় কে? চাষা কাজেই ছেঁড়া ন্যাতা গায়ে দিয়েছে—আর শহরে দেখবে কতকগুলো ঝাব্বাঝুব্বা পরে সেপাই। ইওরোপময় সেপাই, সেপাই—সর্বত্রই সেপাই। তবু স্বাধীনতা এক জিনিষ, গোলামী আর এক; পরে যদি জোর করে করায় তো অতি ভাল কাজও করতে ইচ্ছা যায় না। নিজের দায়িত্ব না থাকলে কেউ কোন বড় কাজ করতে পারে না। স্বর্ণশৃঙ্খলযুক্ত গোলামীর চেয়ে একপেটা ছেঁড়া ন্যাকড়া-পরা স্বাধীনতা লক্ষগুণে শ্রেয়ঃ। গোলামের ইহলোকেও নরক, পরলোকেও তাই। ইওরোপের লোকেরা ঐ সর্বিয়া বুলগার প্রভৃতিদের ঠাট্টা বিদ্রূপ করে—তাদের ভুল অপারগতা নিয়ে ঠাট্টা করে। কিন্তু এতকাল দাসত্বের পর কি এক দিনে কাজ শিখতে পারে? ভুল করবে বৈকি—দু-শ করবে; করে শিখবে, শিখে ঠিক করবে। দায়িত্ব হাতে পড়লে অতি-দুর্বল সবল হয়, অজ্ঞান বিচক্ষণ হয়।
রেলগাড়ী হুঙ্গারী, রোমানী৪৬ প্রভৃতি দেশের মধ্য দিয়ে চলল। মৃতপ্রায় অষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যে যে সব জাতি বাস করে, তাদের মধ্যে হুঙ্গারীয়ানে জীবনীশক্তি এখনও বর্তমান। যাকে ইওরোপীয় মনীষিগণ ইন্দো-ইওরোপীয়ান বা আর্যজাতি বলেন, ইওরোপে দু-একটি ক্ষুদ্র জাতি ছাড়া আর সমস্ত জাতি সেই মহাজাতির অন্তর্গত। যে দু-একটি জাতি সংস্কৃত-সম ভাষা বলে না, হুঙ্গারীয়ানেরা তাদের অন্যতম। হুঙ্গারীয়ান আর তুর্কী একই জাতি। অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ে এই মহাপ্রবল জাতি এশিয়া ও ইওরোপ খণ্ডে আধিপত্য বিস্তার করেছে।
যে দেশকে এখন তুর্কীস্থান বলে, পশ্চিমে হিমালয় ও হিন্দুকোশ পর্বতের উপরে স্থিত সেই দেশই এই তুর্কী জাতির আদি নিবাসভূমি। ঐ দেশের তুর্কী নাম ‘চাগওই’। দিল্লীর মোগলবাদশাহ-বংশ, বর্তমান পারস্য-রাজবংশ, কনষ্টাণ্টিনোপলপতি তুর্কবংশ ও হুঙ্গারীয়ান জাতি—সকলেই সেই ‘চাগওই’ দেশ হতে ক্রমে ভারতবর্ষ আরম্ভ করে ইওরোপ পর্যন্ত আপনাদের অধিকার বিস্তার করেছে এবং আজও এই সকল বংশ আপনাদের ‘চাগওই’ বলে পরিচয় দেয় এবং এক ভাষায় কথাবার্তা কয়। এই তুর্কীরা বহুকাল পূর্বে অবশ্য অসভ্য ছিল। ভেড়া ঘোড়া গরুর পাল সঙ্গে, স্ত্রীপুত্র ডেরা-ডাণ্ডা সমেত, যেখানে পশুপালের চরবার উপযোগী ঘাস পেত, সেইখানে তাঁবু গেড়ে কিছু দিন বাস করত। ঘাস-জল সেখানকার ফুরিয়ে গেলে অন্যত্র চলে যেত। এখনও এই জাতির অনেক বংশ মধ্য-এশিয়াতে এই ভাবেই বাস করে। মোগল প্রভৃতি মধ্য-এশিয়াস্থ জাতিদের সহিত এদের ভাষাগত সম্পূর্ণ ঐক্য—আকৃতিগত কিছু তফাত, মাথার গড়নে ও হনুর উচ্চতায় তুর্কের মুখ মোগলের সমাকার, কিন্তু তুর্কের নাক খ্যাঁদা নয়, অপিচ সুদীর্ঘ চোখ সোজা এবং বড়, কিন্তু মোগলদের মত দুই চোখের মাঝে ব্যবধান অনেকটা বেশী। অনুমান হয় যে, বহুকাল হতে এই তুর্কী জাতির মধ্যে আর্য এবং সেমিটিক রক্ত প্রবেশ লাভ করেছে; সনাতন কাল হতে এই তুরস্ক জাতি বড়ই যুদ্ধপ্রিয়। আর এই জাতির সহিত সংস্কৃতভাষী, গান্ধারী ও ইরানীর মিশ্রণে—আফগান, খিলিজী, হাজারা, বরকজাই, ইউসাফজাই প্রভৃতি যুদ্ধপ্রিয়, সদা রণোন্মত্ত, ভারতবর্ষের নিগ্রহকারী জাতিসকলের উৎপত্তি। অতি প্রাচীনকালে এই জাতি বারংবার ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তস্থ দেশসকল জয় করে বড় বড় রাজ্য সংস্থাপন করেছিল। তখন এরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিল, অথবা ভারতবর্ষ দখল করবার পর বৌদ্ধ হয়ে যেত। কাশ্মীরের প্রাচীন ইতিহাসে হুষ্ক, যুষ্ক, কনিষ্ক নামক তিন প্রসিদ্ধ তুরস্ক সম্রাটের কথা আছে; এই কনিষ্কই ‘মহাযান’ নামে উত্তরাম্নায় বৌদ্ধধর্মের সংস্থাপক।
বহুকাল পরে ইহাদের অধিকাংশই মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে এবং বৌদ্ধধর্মের মধ্য-এশিয়াস্থ গান্ধার, কাবুল প্রভৃতি প্রধান প্রধান কেন্দ্রসকল একেবারে উৎসন্ন করে দেয়। মুসলমান হওয়ার পূর্বে এরা যখন যে দেশ জয় করত, সে দেশের সভ্যতা বিদ্যা গ্রহণ করত; এবং অন্যান্য দেশের বিদ্যাবুদ্ধি আকর্ষণ করে সভ্যতা বিস্তারের চেষ্টা করত। কিন্তু মুসলমান হয়ে পর্যন্ত এদের যুদ্ধপ্রিয়তাটুকুই কেবল বর্তমান; বিদ্যা ও সভ্যতার নামগন্ধ নেই, বরং যে দেশ জয় করে, সে দেশের সভ্যতা ক্রমে ক্রমে নিভে যায়। বর্তমান আফগান, গান্ধার প্রভৃতি দেশের স্থানে স্থানে তাদের বৌদ্ধ পূর্বপুরুষদের নির্মিত অপূর্ব স্তূপ, মঠ, মন্দির, বিরাট মূর্তিসকল বিদ্যমান। তুর্কী-মিশ্রণ ও মুসলমান হবার ফলে সে সকল মন্দিরাদি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে এবং আধুনিক আফগান প্রভৃতি এমন অসভ্য মূর্খ হয়ে গেছে যে, সে সকল প্রাচীন স্থাপত্য নকল করা দূরে থাকুক, জিন প্রভৃতি অপদেবতাদের নির্মিত বলে বিশ্বাস করে এবং মানুষের যে অত বড় কারখানা করা সাধ্য নয়, তা স্থির ধারণা করেছে।
বর্তমান পারস্য দেশের দুর্দশার প্রধান কারণ এই যে, রাজবংশ হচ্ছে প্রবল অসভ্য তুর্কীজাতি ও প্রজারা হচ্ছে অতি সুসভ্য আর্য—প্রাচীন পারস্য জাতির বংশধর। এই প্রকারে সুসভ্য আর্যবংশোদ্ভব গ্রীক ও রোমদিগের শেষ রঙ্গভূমি কনষ্টাণ্টিনোপল সাম্রাজ্য মহাবল বর্বর তুরস্কের পদতলে উৎসন্ন গেছে। কেবল ভারতবর্ষের মোগল বাদশারা এ নিয়মের বহির্ভূত ছিল—সেটা বোধ হয় হিন্দু ভাব ও রক্ত-সংমিশ্রণের ফল। রাজপুত বারট ও চারণদের ইতিহাসগ্রন্থে ভারতবিজেতা সমস্ত মুসলমান বংশই তুরস্ক নামে অভিহিত। এ অভিধানটি বড় ঠিক, কারণ ভারতবিজেতা মুসলমানবাহিনীচয় যে-কোন জাতিতেই পরিপূর্ণ থাক না কেন, নেতৃত্ব সর্বদা এই তুরস্ক জাতিতেই ছিল।
বৌদ্ধধর্মত্যাগী মুসলমান তুরস্কদের নেতৃত্বে—বৌদ্ধ বা বৈদিকধর্মত্যাগী তুরস্কাধীন এবং তুরস্কের বাহুবলে মুসলমানকৃত হিন্দুজাতির অংশবিশেষের দ্বারা পৈতৃক ধর্মে স্থিত অপর বিভাগদের বারংবার বিজয়ের নাম ‘ভারতবর্ষে মুসলমান আক্রমণ, জয় ও সাম্রাজ্য-সংস্থাপন’। এই তুরস্কদের ভাষা অবশ্যই তাদের চেহারার মত বহু মিশ্রিত হয়ে গেছে, বিশেষতঃ যে সকল দল মাতৃভূমি চাগওই হতে যত দূরে গিয়ে পড়েছে, তাদের ভাষা তত মিশ্রিত হয়ে গেছে। এবার পারস্যের শা প্যারিশ প্রদর্শনী দেখে কনষ্টাণ্টিনোপল হয়ে রেলযোগে স্বদেশে গেলেন। দেশকালের অনেক ব্যবধান থাকলেও, সুলতান ও শা সেই প্রাচীন তুর্কী মাতৃভাষায় কথোপকথন করলেন। তবে সুলতানের তুর্কী—ফার্সী, আরবী ও দু-চার গ্রীক শব্দে মিশ্রিত; শা-এর তুর্কী—অপেক্ষাকৃত শুদ্ধ।
প্রাচীনকালে এই চাগওই-তুরস্কের দুই দল ছিল। এক দলের নাম ‘সাদা-ভেড়ার’ দল, আর এক দলের নাম ‘কালো-ভেড়ার’ দল। দুই দলই জন্মভূমি কাশ্মীরের উত্তর ভাগ হতে ভেড়া চরাতে চরাতে ও দেশ লুটপাট করতে করতে ক্রমে কাস্পিয়ান হ্রদের ধারে এসে উপস্থিত হল। সাদা-ভেড়ারা কাস্পিয়ান হ্রদের উত্তর দিয়ে ইওরোপে প্রবেশ করলে এবং ধ্বংসাবশিষ্ট এক টুকরা নিয়ে হুঙ্গারী নামক রাজ্য স্থাপন করলে। কালো-ভেড়ারা কাস্পিয়ান হ্রদের দক্ষিণ দিয়ে ক্রমে পারস্যের পশ্চিমভাগ অধিকার করে, ককেশাস পর্বত উল্লঙ্ঘন করে, ক্রমে এশিয়া-মিনর প্রভৃতি আরবদের রাজ্য দখল করে বসল; ক্রমে খলিফার সিংহাসন অধিকার করলে; ক্রমে পশ্চিম রোম সম্রাজ্যের যেটুকু বাকী ছিল, সেটুকু উদরসাৎ করলে। অতি প্রাচীনকালে এই তুরস্ক জাতি বড় সাপের পূজা করত। বোধ হয় প্রাচীন হিন্দুরা এদেরই নাগ-তক্ষকাদি বংশ বলত। তারপর এরা বৌদ্ধ হয়ে যায়; পরে যখন যে দেশ জয় করত, প্রায় সেই দেশের ধর্মই গ্রহণ করত। অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে—যে দু-দলের কথা আমরা বলছি, তাদের মধ্যে সাদা ভেড়ারা ক্রিশ্চানদের জয় করে ক্রিশ্চান হয়ে গেল, কালো-ভেড়ারা মুসলমানদের জয় করে মুসলমান হয়ে গেল। তবে এদের ক্রিশ্চানী বা মুসলমানীতে—অনুসন্ধান করলে—নাগপূজার স্তর এবং বৌদ্ধ স্তর এখনও পাওয়া যায়।
হুঙ্গারীয়ানরা জাতি এবং ভাষায় তুরস্ক হলেও ধর্মে ক্রিশ্চান—রোমান ক্যাথলিক। সেকালে ধর্মের গোঁড়ামি—ভাষা, রক্ত, দেশ প্রভৃতি কোন বন্ধনী মানত না। হুঙ্গারীয়ানদের সাহায্য না পেলে অষ্ট্রীয়া প্রভৃতি ক্রিশ্চান রাজ্য অনেক সময়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হত না। বর্তমানকালে বিদ্যার প্রচার, ভাষাতত্ত্ব, জাতিতত্ত্বের আবিষ্কার দ্বারা রক্তগত ও ভাষাগত একত্বের উপর অধিক আকর্ষণ হচ্ছে; ধর্মগত একত্ব ক্রমে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। এইজন্য কৃতবিদ্য হুঙ্গারীয়ান ও তুরস্কদের মধ্যে একটা স্বজাতীয়ত্ব ভাব দাঁড়াচ্ছে।
অষ্ট্রীয়া-সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হলেও হুঙ্গারী বারংবার তা হতে পৃথক্ হবার চেষ্টা করেছে। অনেক বিপ্লব-বিদ্রোহের ফলে এই হয়েছে যে হুঙ্গারী এখন নামে অষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ আছে বটে, কিন্তু কার্যে সম্পূর্ণ স্বাধীন। অষ্ট্রীয় সম্রাটের নাম ‘অষ্ট্রীয়ার বাদশা ও হুঙ্গারীর রাজা’। হুঙ্গারীর সমস্ত আলাদা, এবং এখানে প্রজাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ। অষ্ট্রীয় বাদশাকে এখানে নামমাত্র নেতা করে রাখা হয়েছে, এটুকু সম্বন্ধও বেশী দিন থাকবে বলে বোধ হয় না। তুর্কী-স্বভাবসিদ্ধ রণকুশলতা, উদারতা প্রভৃতি গুণ হুঙ্গারীয়ানে প্রচুর বিদ্যমান। অপিচ মুসলমান না হওয়ায়—সঙ্গীতাদি দেবদুর্লভ শিল্পকে শয়তানের কুহক বলে না ভাবার দরুন সঙ্গীত-কলায় হুঙ্গারীয়ানরা অতি কুশলী ও ইওরোপময় প্রসিদ্ধ।
পূর্বে আমার বোধ ছিল, ঠাণ্ডা দেশের লোক লঙ্কার ঝাল খায় না, ওটা কেবল উষ্ণপ্রধান দেশের কদভ্যাস। কিন্তু যে লঙ্কা খাওয়া হুঙ্গারীতে আরম্ভ হল ও রোমানী বুলগারী প্রভৃতিতে সপ্তমে পৌঁছল, তার কাছে বোধ হয় মান্দ্রাজীও হার মেনে যায়।
(১) কনষ্টাণ্টিনোপল
কনষ্টাণ্টিনোপলের প্রথম দৃশ্য রেল হতে পাওয়া গেল। প্রাচীন শহর—পগার (পাঁচিল ভেদ করে বেরিয়েছে), অলিগলি, ময়লা, কাঠের বাড়ী ইত্যাদি, কিন্তু ঐ সকলে একটা বিচিত্রতাজনিত সৌন্দর্য আছে। ষ্টেশনে বই নিয়ে বিষম হাঙ্গামা। মাদমোয়াজেল কাল্ভে ও জুল বোওয়া ফরাসী ভাষায় চুঙ্গীর কর্মচারীদের ঢের বুঝালে, ক্রমে উভয় পক্ষের কলহ। কর্মচারীদের ‘হেড অফিসার’ তুর্ক, তার খানা হাজির—তাই ঝগড়া অল্পে অল্পে মিটে গেল, সব বই দিলে—দুখানা দিলে না। বললে, ‘এই হোটেলে পাঠাচ্ছি’—সে আর পাঠানো হল না। স্তাম্বুল বা কনষ্টাণ্টিনোপলের শহর বাজার দেখা গেল। ‘পোণ্ট’ (Pont) বা সমুদ্রের খাড়ি-পারে ‘পেরা’ (Pera) বা বিদেশীদিগের কোয়ার্টার, হোটেল ইত্যাদি—সেখান হতে গাড়ী করে শহর বেড়ানো ও পরে বিশ্রাম। সন্ধ্যার পর উড্স্ পাশার দর্শন গমন। পরদিন বোট চড়ে বাস্ফোর ভ্রমণে যাত্রা। বড্ড ঠাণ্ডা, জোর হাওয়া, প্রথম ষ্টেশনেই আমি আর মিস্ ম্যা—নেবে গেলাম। সিদ্ধান্ত হল—ওপারে স্কুটারিতে গিয়ে পেয়র হিয়াসান্থের সঙ্গে দেখা করা। ভাষা না জানায় বোটভাড়া ইঙ্গিতে করে পারে গমন ও গাড়ী ভাড়া। পথে সুফী ফকিরের ‘তাকিয়া’ দর্শন, এই ফকিরেরা লোকের রোগ ভাল করে। তার প্রথা এইরূপ—প্রথম কল্মা পড়া ঝুঁকে ঝুঁকে, তারপর নৃত্য, তারপর ভাব, তারপর রোগ আরাম—রোগীর শরীর মাড়িয়ে দিয়ে।
পেয়র হিয়াসান্থের সঙ্গে আমেরিকান কলেজ-সম্বন্ধীয় অনেক কথাবার্তা। আরবের দোকান ও বিদ্যার্থী টর্ক (Turkish student) দর্শন। স্কুটারী হতে প্রত্যাবর্তন। নৌকা খুঁজে পাওয়া—সে কিন্তু ঠিক জায়গায় যেতে না-পারক। যা হোক, যেখানে নাবালে সেইখান হতেই ট্রামে করে ঘরে (স্তাম্বুলের হোটেলে) ফেরা। মিউজিয়ম—স্তাম্বুলের যেখানে প্রাচীন অন্দরমহল ছিল গ্রীক বাদশাদের—সেইখানেই প্রতিষ্ঠিত। অপূর্ব sarcophagi (শবদেহ রক্ষা করবার প্রস্তর-নির্মিত আধার) ইত্যাদি দর্শন। তোপখানার (Tophaneh) উপর হতে শহরের মনোহর দৃশ্য। অনেক দিন পরে এখানে ছোলাভাজা খেয়ে আনন্দ। তুর্কী পোলাও কাবাব ইত্যাদি এখানকার খাবার ভোজন। স্কুটারীর কবরখানা। প্রাচীন পাঁচিল দেখতে যাওয়া। পাঁচিলের মধ্যে জেল—ভয়ঙ্কর। উডস্ পাশার সহিত দেখা ও বাস্ফোর যাত্রা। ফরাসী পররাষ্ট্রসচিবের (Chrage d’ Affairs) অধীনস্থ কর্মচারীর সহিত ভোজন (dinner)—জনৈক গ্রীক পাশা ও একজন আলবানী ভদ্রলোকের সহিত দেখা। পেয়র হিয়াসান্থের লেকচার পুলিশ বন্ধ করেছে, কাজেই আমার লেকচারও বন্ধ। দেবন্মল ও চোবেজীর (এক জন গুজরাতী বামুন) সহিত সাক্ষাৎ। এখানে হিন্দুস্থানী, মুসলমান ইত্যাদি অনেক ভারতবর্ষীয় লোক আছে। তুর্কী ফিললজি। নুর বের (Noor Bey) কথা—তার ঠাকুরদাদা ছিল ফরাসী। এরা বলে, কাশ্মীরীর মত সুন্দর! এখানকার স্ত্রীলোকদিগের পর্দা-হীনতা। বেশ্যাভাব মুসলমানী। খুর্দ পাশা আর্মানী (Arian?) ও আরমিনীয়ান হত্যার কথা শুনেছি। আরমিনীয়ানদের বাস্তবিক কোন দেশ নাই। যে সব স্থানে তারা বাস করে, সেথায় মুসলমানই অধিক। আরমিনীয়া বলে কোন স্থান অজ্ঞাত। বর্তমান সুলতান খুর্দদের হামিদিয়ে রেসল্লা (Hamidian cavarly) তৈরী করছেন, তাদের কজাকদের (Cossacks) মত শিক্ষা দেওয়া হবে এবং তার conscription হতে খালাস হবে।
বর্তমান সুলতান, আরমিনীয়ান এবং গ্রীক পেট্রিয়ার্কদের ডেকে বলেন যে, তোমরা tax (টেক্স) না দিয়ে সেপাই হও (conscription), তোমাদের জন্মভূমি রক্ষা কর। তাতে তারা জবাব দেয় যে, ফৌজ হয়ে লড়ায়ে গিয়ে মুসলমান সিপাইদের সহিত একত্র মলে ক্রিশ্চান সিপাইদের কবরের গোলমাল হবে। উত্তরে সুলতান বললেন যে, প্রত্যেক পল্টনে না হয় মোল্লা ও ক্রিশ্চান পাদ্রী থাকবে, এবং লড়ায়ে যখন ক্রিশ্চান ও মুসলমান ফৌজের শবদেহসকল একত্র এক গাদায় কবরে পুঁততে বাধ্য হবে, তখন না হয় দুই ধর্মের পাদ্রীই শ্রাদ্ধমন্ত্র (funeral service) পড়ল; না হয় এক ধর্মের লোকের আত্মা, বাড়ার ভাগ অন্য ধর্মের শ্রাদ্ধমন্ত্রগুলো শুনে নিলে। ক্রিশ্চানরা রাজী হল না—কাজেই তারা tax (টেক্স) দেয়। তাদের রাজী না হবার ভেতরের কারণ হচ্ছে, ভয় যে মুসলমানের সঙ্গে একত্র বসবাস করে পাছে সব মুসলমান হয়ে যায়। বর্তমান স্তাম্বুলের বাদশা বড়ই ক্লেশসহিষ্ণু—প্রাসাদে থিয়েটার ইত্যাদি আমোদ-প্রমোদ পর্যন্ত সব কাজ নিজে বন্দোবস্ত করেন। পূর্ব-সুলতান মুরাদ বাস্তবিক নিতান্ত অকর্মণ্য ছিল—এ বাদশা অতি বুদ্ধিমান। যে অবস্থায় ইনি রাজ্য পেয়েছিলেন, তা থেকে এত সামলে উঠেছেন যে আশ্চর্য! পার্লামেণ্ট হেথায় চলবে না।
(২) এথেন্স, গ্রীস
বেলা দশটায় সময় কনষ্টাণ্টিনোপল ত্যাগ। এক রাত্রি এক দিন সমুদ্রে। সমুদ্র বড়ই স্থির। ক্রমে Golden Horn (সুবর্ণ শৃঙ্গ) ও মারমোরা। দ্বীপপুঞ্জ মারমোরার একটিতে গ্রীক ধর্মের মঠ দেখলুম। এখানে পুরাকালে ধর্মশিক্ষার বেশ সুবিধা ছিল—কারণ একদিকে এশিয়া আর একদিকে ইওরোপ। মেডিটরেনি দ্বীপপুঞ্জ প্রাতঃকালে দেখতে গিয়ে প্রোফেসার লেপরের সহিত সাক্ষাৎ, পূর্বে পাচিয়াপ্পার কলেজে মান্দ্রাজে এঁর সহিত পরিচয় হয়। একটি দ্বীপে এক মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দেখলুম—নেপচুনের মন্দির আন্দাজ, কারণ—সমুদ্রতটে। সন্ধ্যার পর এথেন্স পৌঁছলুম। এক রাত্রি কারানটাইনে থেকে সকালবেলা নাববার হুকুম এল! বন্দর পাইরিউস (Peiraeus)-টি ছোট শহর। বন্দরটি বড়ই সুন্দর, সব ইওরোপের ন্যায়, কেবল মধ্যে মধ্যে এক-আধ জন ঘাগরা-পরা গ্রীক। সেথা হতে পাঁচ মাইল গাড়ী করে শহরের প্রাচীন প্রাচীর, যাহা এথেন্সকে বন্দরের সহিত সংযুক্ত করত, তাই দেখতে যাওয়া গেল। তারপর শহর দর্শন—আক্রোপলিস, হোটেল, বাড়ী-ঘর-দোর অতি পরিষ্কার। রাজবাটীটি ছোট। সে দিনই আবার পাহাড়ের উপর উঠে আক্রোপলিস, বিজয়ার (Wingless Victory) মন্দির, পারথেনন ইত্যাদি দর্শন করা গেল। মন্দিরটিতে সাদা মর্মরের কয়েকটি ভগ্নাবশেষ স্তম্ভও দণ্ডায়মান দেখলুম। পরদিন পুনর্বার মাদ্মোয়াজেল মেলকাবির সহিত ঐ সকল দেখতে গেলাম—তিনি ঐ সকলের সম্বন্ধে নানা ঐতিহাসিক কথা বুঝিয়ে দিলেন। দ্বিতীয় দিন ওলিম্পিয়ান জুপিটারের মন্দির, থিয়েটার ডাইওনিসিয়াস ইত্যাদি সমুদ্রতট পর্যন্ত দেখা গেল। তৃতীয় দিন এলুসি যাত্রা। উহা গ্রীকদের প্রধান ধর্মস্থান। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ এলুসি-রহস্যের (Eleusinian Mysteries) অভিনয় এখানেই হত। এখানকার প্রাচীন থিয়েটারটি এক ধনী গ্রীক নূতন করে দিয়েছে। Olympian games-এর (অলিম্পিক খেলার) পুনরায় বর্তমানকালে প্রচলন হয়েছে। সে স্থানটি স্পার্টার নিকট। তায় আমেরিকানরা অনেক বিষয়ে জেতে। গ্রীকরা কিন্তু দৌড়ে সে স্থান হতে এথেন্সের এই থিয়েটার পর্যন্ত আসায় জেতে। তুর্কের কাছে ঐ গুণের (দৌড়ের) বিশেষ পরিচয়ও তারা এবার দিয়েছে। চতুর্থ দিন বেলা দশটার সময় রুশী ষ্টীমার ‘জার’-আরোহণে ইজিপ্ত-যাত্রী হওয়া গেল। ঘাটে এসে জানলুম ষ্টীমার ছাড়বে ৪টার সময়—আমরা বোধ হয় সকাল সকাল এসেছি অথবা মাল তুলতে দেরী হবে। অগত্যা ৫৭৬ হতে ৪৮৬ খ্রীঃ পূর্বে আবির্ভূত এজেলাদাস (Ageladas) এবং তাঁর তিন শিষ্য ফিডিয়াস (Phidias), মিরন (Myron) ও পলিক্লেটের (Polycletus) ভাস্কর্যের কিছু পরিচয় নিয়ে আসা গেল। এখুনি খুব গরম আরম্ভ। রুশিয়ান জাহাজে ষ্ক্রুর উপর ফার্ষ্ট ক্লাস। বাকী সবটা ডেক—যাত্রী, গরু আর ভেড়ায় পূর্ণ। এ জাহাজে আবার বরফও নেই।
(৩) পারি লুভার (Louvre) মিউজিয়মে
মিউজিয়ম দেখে গ্রীক কলার তিন অবস্থা বুঝতে পারলুম। প্রথম ‘মিসেনী’ (Mycenoean), দ্বিতীয় যথার্থ গ্রীক। আচেনী রাজ্য (Achaean) সন্নিহিত দ্বীপপুঞ্জে অধিকার বিস্তার করেছিল, আর সেই সঙ্গে ঐ সকল দ্বীপে প্রচলিত, এশিয়া হতে গৃহীত সমস্ত কলাবিদ্যারও অধিকারী হয়েছিল। এইরূপেই প্রথমে গ্রীসে কলাবিদ্যার আবির্ভাব। অতি-পূর্ব অজ্ঞাতকাল হতে খ্রীঃ পূঃ ৭৭৬ বৎসর যাবৎ ‘মিসেনী’ শিল্পের কাল। এই ‘মিসেনী’ শিল্প প্রধানতঃ এশিয়া শিল্পের অনুকরণেই ব্যাপৃত ছিল। ৭৭৬ খ্রীঃ পূঃ কাল হতে ১৪৬ খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত ‘হেলেনিক’ বা যথার্থ গ্রীক শিল্পের সময়। দোরিয়ন জাতির দ্বারা আচেনী-সাম্রাজ্য ধ্বংসের পর ইওরোপখণ্ডস্থ ও দ্বীপপুঞ্জনিবাসী গ্রীকরা এশিয়াখণ্ডে বহু উপনিবেশ স্থাপন করলে। তাতে বাবিল ও ইজিপ্তের সহিত তাদের ঘোরতর সংঘর্ষ উপস্থিত হল, তা হতেই গ্রীক আর্টের উৎপত্তি হয়ে, ক্রমে এশিয়া-শিল্পের ভাব ত্যাগ করে স্বভাবের যথাযথ অনুকরণ-চেষ্টা এখানকার শিল্পে জন্মে। গ্রীক আর অন্য প্রদেশের শিল্পের তফাত এই যে, গ্রীক শিল্প প্রাকৃতিক স্বাভাবিক জীবনের যাথাতথ্য জীবন্ত ঘটনাসমূহ বর্ণনা করছে।
খ্রীঃ পূঃ ৭৭৬ হতে খ্রীঃ পূঃ ৪৭৫ পর্যন্ত ‘আর্কেইক’ গ্রীক শিল্পের কাল। এখনও মূর্তিগুলি শক্ত (stiff), জীবন্ত নয়। ঠোঁট অল্প খোলা, যেন সদাই হাসছে। এ বিষয়ে ঐগুলি ইজিপ্তের শিল্পিগঠিত মূর্তির ন্যায়। সব মূর্তিগুলি দু-পা সোজা করে, খাড়া (কাঠ) হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুল দাড়ি সমস্ত সরলরেখাকারে (regular lines) খোদিত; বস্ত্র সমস্ত মূর্তির গায়ের সঙ্গে জড়ানো, তালপাকানো—পতনশীল বস্ত্রের মত নয়।
‘আর্কেইক’ গ্রীক শিল্পের পরেই ‘ক্লাসিক’ গ্রীক শিল্পের কাল—৪৭৫ খ্রীঃ পূঃ হতে ৩২৩ খ্রীঃ পূঃ পর্যন্ত। অর্থাৎ এথেন্সের প্রভুত্বকাল হতে আরদ্ধ হয়ে সম্রাট্ আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুকাল পর্যন্ত উক্ত শিল্পের উন্নতি ও বিস্তার-কাল। পিলোপনেশাস এবং আটিকা রাজ্যেই এই সময়কার শিল্পের চরম উন্নতি-স্থান। এথেন্স আটিকা রাজ্যেরই প্রধান শহর ছিল। কলাবিদ্যানিপুণ একজন ফরাসী পণ্ডিত লিখেছেন, “(ক্লাসিক) গ্রীক শিল্প, চরম উন্নতিকালে বিধিবদ্ধ প্রণালীশৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীনভাব প্রাপ্ত হইয়াছিল। উহা তখন কোন দেশের কলাবিধিবন্ধনই স্বীকার করে নাই বা তদনুযায়ী আপনাকে নিয়ন্ত্রিত করে নাই। ভাস্কর্যের চূড়ান্ত নিদর্শনস্বরূপ মূর্তিসমূহ যে কালে নির্মিত হইয়াছিল, কলাবিদ্যার সমুজ্জল সেই খ্রীঃ পূঃ পঞ্চম শতাব্দীর কথা যতই আলোচনা করা যায়, ততই প্রাণে দৃঢ় ধারণা হয় যে, বিধিনিয়মের সম্পূর্ণ বহির্ভূত হওয়াতেই গ্রীক শিল্প সজীব হইয়া উঠে।” এই ‘ক্লাসিক’ গ্রীক শিল্পের দুই সম্প্রদায়—প্রথম আটিক, দ্বিতীয় পিলোপনেশিয়েন। আটিক সম্প্রদায়ে আবার দুই প্রকার ভাবঃ প্রথম, মহাশিল্পী ফিডিয়াসের প্রতিভাবল। “অপুর্ব সৌন্দর্যমহিমা এবং বিশুদ্ধ দেবভাবের গৌরব, যাহা কোনকালে মানব-মনে আপন অধিকার হারাইবে না”—এই বলে যাকে জনৈক ফরাসী পণ্ডিত নির্দেশ করেছেন। স্কোপাস আর প্র্যাক্সিটেলেস (Praxiteles) আটিক সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় ভাবের প্রধান শিক্ষক। এই সম্প্রদায়ের কার্য শিল্পকে ধর্মের সঙ্গ হতে একেবারে বিচ্যুত করে কেবলমাত্র মানুষের জীবন-বিবরণে নিযুক্ত রাখা।
‘ক্লাসিক’ গ্রীক শিল্পের পিলোপনেশিয়েন নামক দ্বিতীয় সম্পদায়ের প্রধান শিক্ষক পলিক্লেটাস এবং লিসিপাস (Lysippus)। এঁদের একজন খ্রীঃ পূঃ পঞ্চম শতাব্দীতে এবং অন্য জন খ্রীঃ পূঃ চতুর্থ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন। এঁদের প্রধান লক্ষ্য—মানবশরীরে গড়নপরিমাণের আন্দাজ (proportion) শিল্পে যথাযথ রাখবার নিয়ম প্রবর্বিত করা।
৩২৩ খ্রীঃ পূঃ হইতে ১৪৬ খ্রীঃ পূঃ কাল পর্যন্ত অর্থাৎ আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর হতে রোমানদিগের দ্বারা আর্টিকা-বিজয়কাল পর্যন্ত গ্রীক শিল্পের অবনতি-কাল! জাঁকজমকের বেশী চেষ্টা এবং মূর্তিসকল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড করবার চেষ্টা এই সময়ে গ্রীক শিল্পে দেখতে পাওয়া যায়। তারপর রোমানদের গ্রীস অধিকার-সময়ে গ্রীক শিল্প তদ্দেশীয় পূর্ব পূর্ব শিল্পীদের কার্যের নকল মাত্র করেই সন্তুষ্ট। আর নূতনের মধ্যে হুবহু কোন লোকের মুখ নকল করা।
[স্বামীজীর এই মৌলিক রচনাটি প্রথমে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ২য় ও ৩য় বর্ষে ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এবং পরে পুস্তকাকারে মুদ্রিত হয়।]
সলিলবিপুলা উচ্ছ্বাসময়ী নদী, নদীতটে নন্দনবিনিন্দিত উপবন, তন্মধ্যে অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত রত্নখচিত মেঘস্পর্শী মর্মরপ্রাসাদ; পার্শ্বে, সম্মুখে, পশ্চাতে ভগ্নমৃণ্ময়প্রাচীর জীর্ণচ্ছাদ দৃষ্টবংশকঙ্কাল কুটীরকুল, ইতস্ততঃ শীর্ণদেহ ছিন্নবসন যুগযুগান্তরের নিরাশাব্যঞ্জিতবদন নরনারী, বালকবালিকা; মধ্যে মধ্যে সমধর্মী সমশরীর গো-মহিষ-বলীবর্দ; চারিদিকে আবর্জনারাশি—এই আমাদের বর্তমান ভারত।
অট্টালিকাবক্ষে জীর্ণ কুটীর, দেবালয়ক্রোড়ে আবর্জনাস্তূপ, পট্টশাটাবৃতের পার্শ্বচর কৌপীনধারী, বহ্বন্নতৃপ্তের চতুর্দিকে ক্ষুৎক্ষাম জ্যোতির্হীন চক্ষুর কাতর দৃষ্টি—আমাদের জন্মভূমি।
বিসূচিকার বিভীষণ আক্রমণ, মহামারীর উৎসাদন, ম্যালেরিয়ার অস্থি-মজ্জা-চর্বণ, অনশন-অর্ধাশন-সহজভাব, মধ্যে মধ্যে মহাকালরূপ দুর্ভিক্ষের মহোৎসব, রোগশোকের কুরুক্ষেত্র, আশা-উদ্যম-আনন্দ-উৎসাহের কঙ্কাল-পরিপ্লুত মহাশ্মশান, তন্মধ্যে ধ্যানমগ্ন মোক্ষপরায়ণ যোগী—ইওরোপী পর্যটক এই দেখে।
ত্রিংশকোটি মানবপ্রায় জীব—বহুশতাব্দী যাবৎ স্বজাতি বিজাতি স্বধর্মী বিধর্মীর পদভরে নিষ্পীড়িত-প্রাণ, দাসসুলভ-পরিশ্রম-সহিষ্ণু, দাসবৎ উদ্যমহীন, আশাহীন, অতীতহীন, ভবিষ্যদ্বিহীন, ‘যেন তেন প্রকারেণ’ বর্তমান প্রাণধারণমাত্র-প্রত্যাশী, দাসোচিত ঈর্ষাপরায়ণ, স্বজনোন্নিত-অসহিষ্ণু, হতাশবৎ শ্রদ্ধাহীন, বিশ্বাসহীন, শৃগালবৎ নীচ-চাতুরী-প্রতারণা-সহায়, স্বার্থপরতার আধার, বলবানের পদলেহক, অপেক্ষাকৃত দুর্বলের যমস্বরূপ, বলহীন, আশা-হীনের সমুচিত কদর্য বিভীষণ-কুসংস্কারপূর্ণ, নৈতিক-মেরুদণ্ডহীন, পূতিগন্ধপূর্ণ-মাংসখণ্ডব্যাপী কীটকুলের ন্যায় ভারতশরীরে পরিব্যাপ্ত—ইংরেজ রাজপুরুষের চক্ষে আমাদের ছবি।
নববলমধুপানমত্ত হিতাহিতবোধহীন হিংস্রপশুপ্রায় ভয়ানক, স্ত্রীজিত, কামোন্মত্ত, আপাদমস্তক সুরাসিক্ত, আচারহীন, শৌচহীন, জড়বাদী, জড়-সহায়, ছলে-বলে-কৌশলে পরদেশ-পরধনাপহরণপরায়ণ, পরলোকে বিশ্বাসহীন, দেহাত্মবাদী, দেহপোষণৈকজীবন—ভারতবাসীর চক্ষে পাশ্চাত্য অসুর।
এই তো গেল উভয় পক্ষের বুদ্ধিহীন বহির্দৃষ্টি লোকের কথা। ইওরোপী বিদেশী সুশীতল সুপরিষ্কৃত সৌধশোভিত নগরাংশে বাস করেন, আমাদের ‘নেটিভ’ পাড়াগুলিকে নিজেদের দেশের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহরের সঙ্গে তুলনা করেন। ভারতবাসীদের যা সংসর্গ তাঁদের হয়, তা কেবল একদলের লোক—যারা সাহেবের চাকরি করে। আর দুঃখ-দারিদ্র্য তো বাস্তবিক ভারতবর্ষের মত পৃথিবীর আর কোথাও নাই! ময়লা-আবর্জনা চারিদিকে তো পড়েই রয়েছে। ইওরোপী চক্ষে এ ময়লার, এ দাসবৃত্তির, এ নীচতার মধ্যে যে কিছু ভাল থাকা সম্ভব, তা বিশ্বাস হয় না।
আমরা দেখি—শৌচ করে না, আচমন করে না, যা-তা খায়, বাছবিচার নাই, মদ খেয়ে মেয়ে বগলে ধেই নাচ—এ জাতের মধ্যে কি ভাল রে বাপু!
দুই দৃষ্টিই বহির্দৃষ্টি, ভেতরের কথা বুঝতে পারে না। বিদেশীকে আমরা সমাজে মিশতে দিই না, ‘ম্লেচ্ছ’ বলি—ওরাও ‘কালো দাস’ বলে আমাদের ঘৃণা করে।
এ দুয়ের মধ্যে কিছু সত্য অবশ্যই আছে, কিন্তু দু-দলেই ভেতরের আসল জিনিষ দেখেনি।
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা ভাব আছে; বাহিরের মানুষটা সেই ভাবের বহিঃপ্রকাশ মাত্র—ভাষা মাত্র। সেইরূপ প্রত্যেক জাতের একটা জাতীয় ভাব আছে! এই ভাব জগতের কার্য করেছে—সংসারের স্থিতির জন্য আবশ্যক। যে-দিন সে আবশ্যকতাটুকু চলে যাবে, সেদিন সে জাত বা ব্যক্তির নাশ হবে। আমরা ভারতবাসী যে এত দুঃখ-দারিদ্র্য, ঘরে-বাইরে উৎপাত সয়ে বেঁচে আছি, তার মানে আমাদের একটা জাতীয় ভাব আছে, যেটা জগতের জন্য এখনও আবশ্যক। ইওরোপীয়দের তেমনি একটা জাতীয় ভাব আছে, যেটা না হলে সংসার চলবে না; তাই ওরা প্রবল। একেবারে নিঃশক্তি হলে কি মানুষ আর বাঁচে? জাতিটা ব্যক্তির সমষ্টিমাত্র; একেবারে নির্বল নিষ্কর্মা হলে জাতটা কি বাঁচবে? হাজার বছরের নানা রকম হাঙ্গামায় জাতটা মলো না কেন? আমাদের রীতিনীতি যদি এত খারাপ, তো আমরা এতদিনে উৎসন্ন গেলাম না কেন? বিদেশী বিজেতাদের চেষ্টায় ত্রুটি কি হয়েছে? তবু সব হিঁদু মরে লোপাট হল কেন—অন্যান্য অসভ্য দেশে যা হয়েছে? ভারতের ক্ষেত্র জনমানবহীন হয়ে কেন গেল না, বিদেশীরা তখুনি তো এসে চাষ-বাস করত, যেমন আমেরিকায় অষ্ট্রেলিয়ায় আফ্রিকায় হয়েছে এবং হচ্ছে?
তবে বিদেশী, তুমি যত বলবান নিজেকে ভাব, ওটা কল্পনা। ভারতেও বল আছে, মাল আছে—এইটি প্রথম বোঝ। আর বোঝ যে আমাদের এখনও জগতের সভ্যতা-ভাণ্ডারে কিছু দেবার আছে, তাই আমরা বেঁচে আছি। এটি তোমরাও বেশ করে বোঝ—যারা অন্তর্বহিঃ সাহেব সেজে বসেছ এবং ‘আমরা নরপশু, তোমরা হে ইওরোপী লোক, আমাদের উদ্ধার কর’ বলে কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছ। আর যীশু এসে ভারতে বসেছেন বলে ‘হাঁসেন হোঁসেন’ করছ। ওহে বাপু, যীশুও আসেননি, যিহোবাও আসেননি, আসবেনও না। তাঁরা এখন আপনাদের ঘর সামলাচ্ছেন, আমাদের দেশে আসবার সময় নাই। এদেশে সেই বুড়ো শিব বসে আছেন, মা কালী পাঁঠা খাচ্ছেন, আর বংশীধারী বাঁশী বাজাচ্ছেন। ঐ বুড়ো শিব ষাঁড় চড়ে ভারতবর্ষ থেকে একদিকে সুমাত্রা, বোর্নিও, সেলিবিস, মায় অষ্ট্রেলিয়া আমেরিকার কিনারা পর্যন্ত ডমরু বাজিয়ে এককালে বেড়িয়েছেন, আর একদিকে তিব্বত, চীন, জাপান সাইবেরিয়া পর্যন্ত বুড়ো শিব ষাঁড় চরিয়েছেন, এখনও চরাচ্ছেন; ঐ যে মা কালী—উনি চীন, জাপান পর্যন্ত পূজা খাচ্ছেন, ওঁকেই যীশুর-মা মেরী করে ক্রিশ্চানরা পূজা করছে। ঐ যে হিমালয় পাহাড় দেখছ, ওরই উত্তরে কৈলাস, সেথা বুড়ো শিবের প্রধান আড্ডা। ও কৈলাস দশমুণ্ড-কুড়িহাত রাবণ নাড়াতে পারেননি, ও কি এখন পাদ্রী-ফাদ্রীর কর্ম!! ঐ বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পাঁঠা খাবেন, আর কৃষ্ণ বাঁশী বাজাবেন—এ দেশে চিরকাল। যদি না পছন্দ হয়, সরে পড় না কেন? তোমাদের দু-চারজনের জন্য দেশসুদ্ধ লোককে হাড়-জ্বালাতন হতে হবে বুঝি? চরে খাওগে না কেন? এত বড় দুনিয়াটা পড়ে তো রয়েছে। তা নয়। মুরদ কোথায়? ঐ বুড়ো শিবের অন্ন খাবেন, আর নিমকহারামী করবেন, যীশুর জয় গাইবেন—আ মরি!! ঐ যে সাহেবদের কাছে নাকি-কান্না ধর যে, ‘আমরা অতি নীচ, আমরা অতি অপদার্থ, আমাদের সব খারাপ,’এ কথা ঠিক হতে পারে—তোমরা অবশ্য সত্যবাদী; তবে ঐ ‘আমরা’র ভেতর দেশসুদ্ধকে জড়াও কেন? ওটা কোন্ দিশি ভদ্রতা হে বাপু?
প্রথম বুঝতে হবে যে, এমন কোন গুণ নেই, যা কোন জাতিবিশেষের একাধিকার। তবে কোন ব্যক্তিতে যেমন, তেমনি কোন জাতিতে কোন কোন গুণের আধিক্য—প্রাধান্য।
আমাদের দেশে ‘মোক্ষলাভেচ্ছার’ প্রাধান্য, পাশ্চাত্যে ‘ধর্মের’। আমরা চাই কি?—‘মুক্তি’। ওরা চায় কি?—‘ধর্ম’। ধর্ম-কথাটা মীমাংসকদের মতে ব্যবহার হচ্ছে।
ধর্ম কি?—যা ইহলোক বা পরলোকে সুখভোগের প্রবৃত্তি দেয়। ধর্ম হচ্ছে ক্রিয়ামূলক। ধর্ম মানুষকে দিনরাত সুখ খোঁজাচ্ছে, সুখের জন্য খাটাচ্ছে।
মোক্ষ কি?—যা শেখায় যে, ইহলোকের সুখও গোলামী, পরলোকেরও তাই। এই প্রকৃতির নিয়মের বাইরে তো এ-লোকও নয়, পরলোকও নয়, তবে সে দাসত্ব—লোহার শিকল আর সোনার শিকল। তারপর প্রকৃতির মধ্যে বলে বিনাশশীল সে-সুখ থাকবে না। অতএব মুক্ত হতে হবে, প্রকৃতির বন্ধনের বাইরে যেতে হবে, শরীর-বন্ধনের বাইরে যেতে হবে, দাসত্ব হলে চলবে না। এই মোক্ষমার্গ কেবল ভারতে আছে, অন্যত্র নাই। এইজন্য ঐ যে কথা শুনেছ, মুক্তপুরুষ ভারতেই আছে, অন্যত্র নেই, তা ঠিক। তবে পরে অন্যত্রও হবে। সে তো আনন্দের বিষয়। এককালে এই ভারতবর্ষে ধর্মের আর মোক্ষের সামঞ্জস্য ছিল। তখন যুধিষ্ঠির, অর্জুন, দুর্যোধন, ভীষ্ম, কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাস, শুক, জনকাদিও বর্তমান ছিলেন। বৌদ্ধদের পর হতে ধর্মটা একেবারে অনাদৃত হল, খালি মোক্ষমার্গই প্রধান হল। তাই অগ্নিপুরাণে রূপকচ্ছলে বলেছে যে, গয়াসুর (বুদ্ধ)১ সকলকে মোক্ষমার্গ দেখিয়ে জগৎ ধ্বংস করবার উপক্রম করেছিলেন, তাই দেবতারা এসে ছল করে তাঁকে চিরদিনের মত শান্ত করেছিলেন। ফল কথা, এই যে দেশের দুর্গতির কথা সকলের মুখে শুনছ, ওটা ঐ ধর্মের অভাব। যদি দেশসুদ্ধ লোক মোক্ষধর্ম অনুশীলন করে, সে তো ভালই; কিন্তু তা হয় না, ভোগ না হলে ত্যাগ হয় না, আগে ভোগ কর, তবে ত্যাগ হবে। নইলে খামকা দেশসুদ্ধ লোক মিলে সাধু হল—না এদিক, না ওদিক। যখন বৌদ্ধরাজ্যে এক এক মঠে এক এক লাখ সাধু, তখনই দেশটি ঠিক উৎসন্ন যাবার মুখে পড়েছে। বৌদ্ধ, ক্রিশ্চান, মুসলমান, জৈন—ওদের একটা ভ্রম যে সকলের জন্য সেই এক আইন, এক নিয়ম। ঐটি মস্ত ভুল; জাতি-ব্যক্তি-প্রকৃতি-ভেদে শিক্ষা-ব্যবহার-নিয়ম সমস্ত আলাদা। জোর করে এক করতে গেলে কি হবে? বৌদ্ধরা বললে, ‘মোক্ষের মত আর কি আছে, দুনিয়াসুদ্ধ মুক্তি নেবে চল’। বলি, তা কখনও হয়? ‘তুমি গেরস্থ মানুষ, তোমার ওসব কথায় বেশী আবশ্যক নাই, তুমি তোমার স্বধর্ম কর’—এ-কথা বলছেন হিঁদুর শাস্ত্র। ঠিক কথাই তাই। এক হাত লাফাতে পার না, লঙ্কা পার হবে! কাজের কথা? দুটো মানুষের মুখে অন্ন দিতে পার না, দুটো লোকের সঙ্গে একবুদ্ধি হয়ে একটা সাধারণ হিতকর কাজ করতে পার না—মোক্ষ নিতে দৌড়ুচ্ছ!! হিন্দুশাস্ত্র বলছেন যে, ‘ধর্মের’ চেয়ে ‘মোক্ষ’টা অবশ্য অনেক বড়, কিন্তু আগে ধর্মটি করা চাই। বৌদ্ধরা ঐখানটায় গুলিয়ে যত উৎপাত করে ফেললে আর কি! অহিংসা ঠিক, ‘নির্বৈর’ বড় কথা; কথা তো বেশ, তবে শাস্ত্র বলছেন—তুমি গেরস্থ, তোমার গালে এক চড় যদি কেউ মারে, তাকে দশ চড় যদি না ফিরিয়ে দাও, তুমি পাপ করবে। ‘আততায়িনমায়ান্তং’২ ইত্যাদি। হত্যা করতে এসেছে এমন ব্রহ্মবধেও পাপ নাই—মনু বলেছেন। এ সত্য কথা, এটি ভোলবার কথা নয়। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা—বীর্য প্রকাশ কর, সাম-দান-ভেদ-দণ্ড-নীতি প্রকাশ কর, পৃথিবী ভোগ কর, তবে তুমি ধার্মিক। আর ঝাঁটা-লাথি খেয়ে চুপটি করে ঘৃণিত-জীবন যাপন করলে ইহকালেও নরক-ভোগ, পরলোকেও তাই। এইটি শাস্ত্রের মত। সত্য, সত্য, পরম সত্য—স্বধর্ম কর হে বাপু! অন্যায় কর না, অত্যাচার কর না, যথাসাধ্য পরোপকার কর। কিন্তু অন্যায় সহ্য করা পাপ, গৃহস্থের পক্ষে; তৎক্ষণাৎ প্রতিবিধান করতে চেষ্টা করতে হবে। মহা উৎসাহে অর্থোপার্জন করে স্ত্রী-পরিবার দশজনকে প্রতিপালন—দশটা হিতকর কার্যানুষ্ঠান করতে হবে। এ না পারলে তো তুমি কিসের মানুষ? গৃহস্থই নও—আবার ‘মোক্ষ’!!
পূর্বে বলেছি যে, ‘ধর্ম’ হচ্ছে কার্যমূলক। ধার্মিকের লক্ষণ হচ্ছে সদা কার্যশীলতা। এমন কি, অনেক-মীমাংসকের মতে বেদে যে স্থলে কার্য করতে বলছে না, সে স্থানগুলি বেদই নয়—‘আম্নায়স্য ক্রিয়ার্থত্বাদ্ আনর্থক্যম্ অতদর্থানাং’৩। ‘ওঁকারধ্যানে সর্বার্থসিদ্ধি’, ‘হরিনামে সর্বপাপনাশ’, ‘শরণাগতের সর্বাপ্তি’—এ সমস্ত শাস্ত্রবাক্য সাধুবাক্য অবশ্য সত্য; কিন্তু দেখতে পাচ্ছ যে, লাখো লোক ওঁকার জপে মরচে, হরিনামে মাতোয়ারা হচ্ছে, দিনরাত ‘প্রভু যা করেন’ বলছে এবং পাচ্ছে—ঘোড়ার ডিম। তার মানে বুঝতে হবে যে, কার জপ যথার্থ হয়, কার মুখে হরিনাম বজ্রবৎ অমোঘ, কে শরণ যথার্থ নিতে পারে—যার কর্ম করে চিত্তশুদ্ধি হয়েছে অর্থাৎ যে ‘ধার্মিক’।
প্রত্যেক জীব শক্তিপ্রকাশের এক-একটি কেন্দ্র। পূর্বের কর্মফলে সে শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে, আমরা তাই নিয়ে জন্মেছি। যতক্ষণ সে শক্তি কার্যরূপে প্রকাশ না হচ্ছে, ততক্ষণ কে স্থির থাকবে বল? ততক্ষণ ভোগ কে ঘোচায় বল? তবে কুকর্মের চেয়ে সুকর্মটা ভাল নয়? পূজ্যপাদ শ্রীরামপ্রসাদ বলেছেন, ‘ভাল মন্দ দুটো কথা, ভালটা তার করাই ভাল।’
এখন ভালটা কি? ‘মুক্তিকামের ভাল’ অন্যরূপ, ‘ধর্মকামের ভাল’ আর একপ্রকার। এই গীতাপ্রকাশক শ্রীভগবান্ এত করে বুঝিয়েছেন, এই মহাসত্যের উপর হিঁদুর স্বধর্ম, জাতিধর্ম ইত্যাদি। ‘অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এব চ’—ইত্যাদি ভগবদ্বাক্য মোক্ষকামের জন্য। আর ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ’ ইত্যাদি, ‘তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব’ ইত্যাদি ধর্মলাভের উপায় ভগবান্ দেখিয়েছেন! অবশ্য, কর্ম করতে গেলেই কিছু না কিছু পাপ আসবেই। এলই বা; উপোসের চেয়ে আধপেটা ভাল নয়? কিছু না করার চেয়ে, জড়ের চেয়ে ভাল-মন্দ-মিশ্র কর্ম করা ভাল নয়? গরুতে মিথ্যা কথা কয় না, দেওয়ালে চুরি করে না; তবু তারা গরুই থাকে, আর দেওয়ালই থাকে। মানুষে চুরি করে, মিথ্যা কয়, আবার সেই মানুষই দেবতা হয়। সত্ত্বপ্রাধান্য-অবস্থায় মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়, পরমাধ্যানাবস্থা প্রাপ্ত হয়, রজঃপ্রাধান্যে ভালমন্দ ক্রিয়া করে, তমঃপ্রাধান্যে আবার নিষ্ক্রিয় জড় হয়। এখন বাইরে থেকে—এই সত্ত্বপ্রধান হয়েছে, কি তমঃপ্রধান হয়েছে, কি করে বুঝি বল? সুখদুঃখের পার ক্রিয়াহীন শান্তরূপ সত্ত্ব-অবস্থায় আমরা আছি, কি প্রাণহীন জড়প্রায় শক্তির অভাবে ক্রিয়াহীন মহাতামসিক অবস্থায় পড়ে চুপ করে ধীরে ধীরে পচে যাচ্ছি, এ কথার জবাব দাও?—নিজের মনকে জিজ্ঞাসা কর। জবাব কি আর দিতে হয়। ‘ফলেন পরিচীয়তে’। সত্ত্বপ্রাধান্যে মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়, শান্ত হয়, কিন্তু সে নিষ্ক্রিয়ত্ব মহাশক্তি কেন্দ্রীভূত হয়ে হয়, সে শান্তি [শান্তভাব] মহাবীর্যের পিতা। সে মহাপুরুষের আর আমাদের মত হাত পা নেড়ে কাজ করতে হয় না, তাঁর ইচ্ছামাত্রে অবলীলাক্রমে সব কার্য সম্পন্ন হয়ে যায়। সেই পুরুষই সত্ত্বগুণপ্রধাণ ব্রাহ্মণ, সর্বলোকপূজ্য; তাঁকে কি আর ‘পূজা কর’ বলে পাড়ায় পাড়ায় কেঁদে বেড়াতে হয়? জগদম্বা তাঁর কপালফলকে নিজের হাতে লিখে দেন যে, এই মহাপুরুষকে সকলে পূজা কর, আর জগৎ অবনতমস্তকে শোনে। সেই মহাপুরুষকেই ‘অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এব চ’ ইত্যাদি। আর ঐ যে মিনমিনে পিনপিনে, ঢোক গিলে গিলে কথা কয়, ছেঁড়ান্যাতা সাতদিন উপবাসীর মত সরু আওয়াজ, সাত চড়ে কথা কয় না—ওগুলো হচ্ছে তমোগুণ, ওগুলো মৃত্যুর চিহ্ন, ও সত্ত্বগুণ নয়, ও পচা দুর্গন্ধ। অর্জুন ঐ দলে পড়েছিলেন বলেই তো ভগবান্ এত করে বোঝাচ্ছেন না গীতায়? প্রথম ভগবানের মুখ থেকে কি কথা বেরুল দেখ—‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ’; শেষ—‘তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব’। ঐ জৈন বৌদ্ধ প্রভৃতির পাল্লায় পড়ে আমরা ঐ তমোগুণের দলে পড়েছি—দেশসুদ্ধ পড়ে কতই ‘হরি’ বলছি, ভগবান্কে ডাকছি, ভগবান্ শুনছেনই না আজ হাজার বৎসর। শুনবেই বা কেন? আহাম্মকের কথা মানুষই শোনে না, তা ভগবান্। এখন উপায় হচ্ছে ঐ ভগবদ্বাক্য শোনা—‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ’; ‘তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব’।
এখন চলুক পাশ্চাত্য আর প্রাচ্যের কথা। প্রথমে একটা তামাসা দেখ। ইওরোপীয়দের ঠাকুর যীশু উপদেশ করছেন যে, নির্বৈর হও, এক গালে চড় মারলে আর এক গাল পেতে দাও, কাজ কর্ম বন্ধ কর, পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে বসে থাক, আমি এই আবার আসছি, দুনিয়াটা এই দু-চার দিনের মধ্যেই নাশ হয়ে যাবে। আর আমাদের ঠাকুর বলছেন, মহা উৎসাহে সর্বদা কার্য কর, শত্রু নাশ কর, দুনিয়া ভোগ কর। কিন্তু ‘উল্টা সমঝ্লি রাম’ হল; ওরা-ইওরোপীরা যীশুর কথাটি গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলে না। সদা মহা রজোগুণ, মহাকার্যশীল, মহা উৎসাহে দেশ-দেশান্তরের ভোগসুখ আকর্ষণ করে ভোগ করছে। আর আমরা কোণে বসে, পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে, দিনরাত মরণের ভাবনা ভাবছি, ‘নলিনীদলগতজলমতিতরলং তদ্বজ্জীবনমতিশয়চপলম্’৪ গাচ্ছি; আর যমের ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধুচ্ছে। আর পোড়া যমও তাই বাগ পেয়েছে, দুনিয়ার রোগ আমাদের দেশে ঢুকছে। গীতার উপদেশ শুনলে কে? না ইওরোপী। আর যীশুখ্রীষ্টের ইচ্ছার ন্যায় কাজ করছে কে? না—কৃষ্ণের বংশধরেরা!! এ-কথাটা বুঝতে হবে। মোক্ষমার্গ তো প্রথম বেদই উপদেশ করেছেন। তারপর বুদ্ধই বল, আর যীশুই বল, সব ঐখান থেকেই তো যা কিছু গ্রহণ। আচ্ছা, তাঁরা ছিলেন সন্ন্যাসী—‘অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এব চ’—বেশ কথা, উত্তম কথা। তবে জোর করে দুনিয়াসুদ্ধকে ঐ মোক্ষ মার্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা কেন? ঘষে মেজে রূপ, আর ধরে বেঁধে পিরীত কি হয়? যে মানুষটা মোক্ষ চায় না, পাবার উপযুক্ত নয়, তার জন্য বুদ্ধ বা যীশু কি উপদেশ করেছেন বল—কিছুই নয়। ‘হয় মোক্ষ পাবে বল, নয় তুমি উৎসন্ন যাও’ এই দুই কথা! মোক্ষ ছাড়া যে কিছু চেষ্টা করবে, সে আটঘাট তোমার বন্ধ। তুমি যে এ দুনিয়াটা একটু ভোগ করবে, তার কোন রাস্তা নাই, বরং প্রতিবাদে বাধা। কেবল বৈদিক ধর্মে এই চতুর্বর্গ সাধনের উপায় আছে—ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। বুদ্ধ করলেন আমাদের সর্বনাশ; যীশু করলেন গ্রীস-রোমের সর্বনাশ!!! তারপর ভাগ্যফলে ইওরোপীগুলো প্রোটেষ্টাণ্ট (Protestant) হয়ে যীশুর ধর্ম ঝেড়ে ফেলে দিলে; হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভারতবর্ষে কুমারিল্ল ফের কর্মমার্গ চালালেন, শঙ্কর আর রামানুজ চতুর্বর্গের সমন্বয়স্বরূপ সনাতন বৈদিক মত ফের প্রবর্তন করলেন, দেশটার বাঁচবার আবার উপায় হল। তবে ভারতবর্ষে ত্রিশ ক্রোর লোক, দেরী হচ্ছে! ত্রিশ ক্রোর লোককে চেতানো কি একদিনে হয়?
বৌদ্ধধর্মের আর বৈদিক ধর্মের উদ্দেশ্য এক। তবে বৌদ্ধমতের উপায়টি ঠিক নয়। উপায় যদি ঠিক হত তো আমাদের এ সর্বনাশ কেন হল? ‘কালেতে হয়’ বললে কি চলে? কাল কি কার্যকারণসম্বন্ধ ছেড়ে কাজ করতে পারে?
অতএব উদ্দেশ্য এক হলেও উপায়হীনতায় বৌদ্ধরা ভারতবর্ষকে পাতিত করেছে। বৌদ্ধবন্ধুরা চটে যাও, যাবে; ঘরের ভাত বেশী করে খাবে। সত্যটা বলা উচিত। উপায় হচ্ছে বৈদিক উপায়—‘জাতিধর্ম’ ‘স্বধর্ম’ যেটি বৈদিক ধর্মের—বৈদিক সমাজের ভিত্তি। আবার অনেক বন্ধুকে চটালুম, অনেক বন্ধু বলছেন যে, এ দেশের লোকের খোশামুদি হচ্ছে। একটা কথা তাঁদের জন্যে বলে রাখা যে, দেশের লোকের খোশামোদ করে আমার লাভটা কি? না খেতে পেয়ে মরে গেলে দেশের লোকে একমুঠো অন্ন দেয় না; ভিক্ষে-শিক্ষে করে বাইরে থেকে এনে দুর্ভিক্ষগ্রস্ত অনাথকে যদি খাওয়াই তো তার ভাগ নেবার জন্য দেশের লোকের বিশেষ চেষ্টা; যদি না পায় তো গালাগালির চোটে অস্থির!! হে স্বদেশীয় পণ্ডিতমণ্ডলী! এই আমাদের দেশের লোক, তাদের আবার কি খোশামোদ? তবে তারা উন্মাদ হয়েছে, উন্মাদকে যে ঔষধ খাওয়াতে যাবে, তার হাতে দু-দশটা কামড় অবশ্যই উন্মাদ দেবে; তা সয়ে যে ঔষধ খাওয়াতে যায়, সে-ই যথার্থ বন্ধু।
এই ‘জাতিধর্ম’ ‘স্বধর্মই’ সকল দেশে সামাজিক কল্যাণের উপায়—মুক্তির সোপান। ঐ ‘জাতিধর্ম’ ‘স্বধর্ম’ নাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশটার অধঃপতন হয়েছে। তবে নিধুরাম সিধুরাম বা জাতিধর্ম স্বধর্ম বলে বুঝেছেন, ওটা উল্টো উৎপাত; নিধু জাতিধর্মের ঘোড়ার ডিম বুঝেছেন, ওঁর গাঁয়ের আচারকেই সনাতন আচার বলে ধারণা করছেন, নিজের কোলে ঝোল টানছেন, আর উৎসন্ন যাচ্ছেন। আমি গুণগত জাতির কথা বলছি না, বংশগত জাতির কথা বলছি, জন্মগত জাতির কথা বলছি। গুণগত জাতিই আদি, স্বীকার করি; কিন্তু গুণ দু-চার পুরুষে বংশগত হয়ে দাঁড়ায়। সেই আসল জায়গায় ঘা পড়ছে, নইলে সর্বনাশ হল কেন? ‘সঙ্করস্য চ কর্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ।’৫ কেমন করে এ ঘোর বর্ণসাঙ্কর্য উপস্থিত হল—সাদা রঙ কালো কেন হল, সত্ত্বগুণ রজোগুণপ্রধান তমোগুণে কেন উপস্থিত হল—সে সব অনেক কথা, বারান্তরে বলবার রইল। আপাততঃ এইটি বোঝ যে, জাতিধর্ম যদি ঠিক ঠিক থাকে তো দেশের অধঃপতন হবেই না। এ-কথা যদি সত্য হয়, তা হলে আমাদের অধঃপতন কেন হল? অবশ্যই জাতিধর্ম উৎসন্নে গেছে। অতএব যাকে তোমরা জাতিধর্ম বলছ, সেটা ঠিক উল্টো। প্রথম পুরাণ পুঁথি-পাটা বেশ করে পড়গে, এখনি দেখতে পাবে যে, শাস্ত্র যাকে জাতিধর্ম বলছে, তা সর্বত্রই প্রায় লোপ পেয়েছে। তারপর কিসে সেইটি ফের আসে, তারই চেষ্টা কর; তা হলেই পরম কল্যাণ নিশ্চিত। আমি যা শিখেছি, যা বুঝেছি তাই তোমাদের বলছি; আমি তো আর বিদেশ থেকে তোমাদের হিতের জন্য আমদানী হইনি যে, তোমাদের আহম্মকিগুলিকে পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে হবে? বিদেশী বন্ধুর কি? বাহবা লাভ হলেই হল। তোমাদের মুখে চুনকালি পড়লে যে আমার মুখে পড়ে, তার কি?
পূর্বেই বলেছি যে, প্রত্যেক জাতির একটা জাতীয় উদ্দেশ্য আছে। প্রাকৃতিক নিয়মাধীনে বা মহাপুরুষদের প্রতিভাবলে প্রত্যেক জাতির সামাজিক রীতিনীতি সেই উদ্দেশ্যটি সফল করবার উপযোগী হয়ে গড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক জাতির জীবন ঐ উদ্দেশ্যটি এবং তদুপযোগী উপায়রূপ আচার ছাড়া, আর সমস্ত রীতিনীতিই বাড়ার ভাগ। এই বাড়ার ভাগ রীতিনীতিগুলির হ্রাস-বৃদ্ধিতে বড় বেশী এসে যায় না; কিন্তু যদি সেই আসল উদ্দেশ্যটিতে ঘা পড়ে, তখুনি সে জাতির নাশ হয়ে যাবে।
ছেলেবেলায় গল্প শুনেছ যে, রাক্ষসীর প্রাণ একটা পাখীর মধ্যে ছিল। সে পাখীটার নাশ না হলে রাক্ষসীর কিছুতেই নাশ হয় না; এও তাই। আবার দেখবে যে, যে অধিকারগুলো জাতীয় জীবনের জন্য একান্ত আবশ্যক নয়, সে অধিকারগুলো সব যাক না, সে জাতি বড় তাতে আপত্তি করে না, কিন্তু যখন যথার্থ জাতীয় জীবনে ঘা পড়ে, তৎক্ষণাৎ মহাবলে প্রতিঘাত করে।
তিনটি বর্তমান জাতির তুলনা কর, যাদের ইতিহাস তোমরা অল্পবিস্তার জান—ফরাসী, ইংরেজ, হিন্দু। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফরাসী জাতির চরিত্রের মেরুদণ্ড। প্রজারা সব অত্যাচার অবাধে সয়, করভারে পিষে দাও, কথা নেই; দেশসুদ্ধকে টেনে নিয়ে জোর করে সেপাই কর, আপত্তি নেই; কিন্তু যেই সে স্বাধীনতার উপর হাত কেউ দিয়েছে, অমনি সমস্ত জাতি উন্মাদবৎ প্রতিঘাত করবে। কেউ কারু উপর চেপে বসে হুকুম চালাতে পাবে না, এইটিই ফরাসীচরিত্রের মূলমন্ত্র। ‘জ্ঞানী, মূর্খ, ধনী, দরিদ্র, উচ্চ বংশ, নীচ বংশ, রাজ্য-শাসনে সামাজিক স্বাধীনতায় আমাদের সমান অধিকার।’—এর উপর হাত কেউ দিতে গেলেই তাঁকে ভুগতে হয়।
ইংরেজ-চরিত্রে ব্যবসাবুদ্ধি, আদান-প্রদান প্রধান; যথাভাগ ন্যায়বিভাগ—ইংরেজের আসল কথা। রাজা, কুলীনজাতি-অধিকার, ইংরেজ ঘাড় হেঁট করে স্বীকার করে; কেবল যদি গাঁট থেকে পয়সাটি বার করতে হয় তো তার হিসাব চাইবে। রাজা আছে, বেশ কথা—মান্য করি, কিন্তু টাকাটি যদি তুমি চাও তো তার কার্য-কারণ, হিসাবপত্রে আমি দু-কথা বলব, বুঝব, তবে দেব। রাজা জোর করে টাকা আদায় করতে গিয়ে মহাবিপ্লব উপস্থিত করালেন; রাজাকে মেরে ফেললে।
হিন্দু বলছেন কি যে, রাজনৈতিক সামাজিক স্বাধীনতা—বেশ কথা, কিন্তু আসল জিনিষ হচ্ছে পারমার্থিক স্বাধীনতা—‘মুক্তি’। এইটিই জাতীয় জীবনোদ্দেশ্য; বৈদিক বল, জৈন বল, বৌদ্ধ বল, অদ্বৈত বিশিষ্টাদ্বৈত বা দ্বৈত যা কিছু বল, সব ঐখানে এক মত। ঐখানটায় হাত দিও না, তা হলেই সর্বনাশ; তা ছাড়া যা কর, চুপ করে আছি। লাথি মার, ‘কালো’ বল, সর্বস্ব কেড়ে লও—বড় এসে যাচ্ছে না; কিন্তু ঐ দোরটা ছেড়ে রাখ। এই দেখ, বর্তমান কালে পাঠান বংশরা আসছিল যাচ্ছিল, কেউ সুস্থির হয়ে রাজ্য করতে পারছিল না; কেন না, ঐ হিঁদুর ধর্মে ক্রমাগত আঘাত করছিল। আর মোগল রাজা কেমন সুদৃঢ়প্রতিষ্ঠ, কেমন মহাবল হল। কেন? না—মোগলরা ঐ জায়গাটায় ঘা দেয়নি। হিঁদুরাই তো মোগলের সিংহাসনের ভিত্তি, জাহাঙ্গীর, শাজাহান, দারাসেকো—এদের সকলের মা যে হিঁদু। আর দেখ, যেই পোড়া আরঙ্গজেব আবার ঐখানটায় ঘা দিলে, অমনি এত বড় মোগল রাজ্য স্বপ্নের ন্যায় উড়ে গেল। ঐ যে ইংরেজের সুদৃঢ় সিংহাসন, এ কিসের উপর? ঐ ধর্মে হাত কিছুতেই দেয় না বলে। পাদরী-পুঙ্গবেরা একটু আধটু চেষ্টা করেই তো ’৫৭ সালের হাঙ্গামা উপস্থিত করেছিল। ইংরেজরা যতক্ষণ এইটি বেশ করে বুঝবে এবং পালন করবে, ততক্ষণ ওদের ‘তকত তাজ অচল রাজধানী’। বিজ্ঞ বহুদর্শী ইংরেজরাও এ-কথা বোঝে, লর্ড রবার্টসের ‘ভারতবর্ষে ৪১ বৎসর’৬ নামক পুস্তক পড়ে দেখ।
এখন বুঝতে পারছ তো, এ রাক্ষসীর প্রাণপাখীটি কোথায়?—ধর্মে। সেইটির নাশ কেউ করতে পারেনি বলেই জাতটা এত সয়ে এখনও বেঁচে আছে। আচ্ছা, একজন দেশী পণ্ডিত বলছেন যে, ওখানটায় প্রাণটা রাখবার এত আবশ্যক কি? সামাজিক বা রাজনৈতিক স্বাধীনতায় রাখ না কেন?—যেমন অন্যান্য অনেক দেশে। কথাটি তো হল সোজা; যদি তর্কচ্ছলে স্বীকার করা যায় যে, ধর্ম কর্ম সব মিথ্যা, তাহলেও কি দাঁড়ায়, দেখ। অগ্নি তো এক, প্রকার বিভিন্ন। সেই এক মহাশক্তিই ফরাসীতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, ইংরেজে বাণিজ্য সুবিচার-বিস্তার, আর হিঁদুর প্রাণে মুক্তিলাভেচ্ছারূপে বিকাশ হয়েছে। কিন্তু এই মহাশক্তির প্রেরণায় শতাব্দী-কতক নানা সুখ-দুঃখের ভিতর দিয়ে ফরাসী বা ইংরেজ চরিত্র গড়ে গেছে এবং তারই প্রেরণায় লক্ষ শতাব্দীর আবর্তনে হিঁদুর জাতীয় চরিত্রের বিকাশ। বলি, আমাদের লাখো বৎসরের স্বভাব ছাড়া সোজা, না তোমার বিদেশীর দু-পাঁচশ বৎসরের স্বভাব ছাড়া সোজা? ইংরেজ কেন ধর্মপ্রাণ হোক না, মারামারি কাটাকাটিগুলো ভুলে শান্ত শিষ্টটি হয়ে বসুক না?
আসল কথা হচ্ছে, যে নদীটা পাহাড় থেকে ১,০০০ ক্রোশ নেমে এসেছে, সে কি আর পাহাড়ে ফিরে যায়, না যেতে পারে? যেতে চেষ্টা যদি একান্ত করে তো ইদিক উদিকে ছড়িয়ে পড়ে মারা যাবে, এইমাত্র। সে নদী যেমন করে হোক সমুদ্রে যাবেই দু-দিন আগে বা পরে, দুটো ভাল জায়গার মধ্যে দিয়ে, না হয় দু-একবার আঁস্তাকুড় ভেদ করে। যদি এ দশ হাজার বৎসরের জাতীয় জীবনটা ভুল হয়ে থাকে তো আর এখন উপায় নেই, এখন একটা নূতন চরিত্র গড়তে গেলেই মরে যাবে বৈ তো নয়।
কিন্তু এ বুদ্ধিটি আগাপাস্তলা ভুল, মাপ কর, অল্পদর্শীর কথা। দেশে দেশে আগে যাও এবং অনেক দেশের অবস্থা বেশ করে দেখ, নিজের চোখে দেখ, পরের চোখে নয়, তারপর যদি মাথা থাকে তো ঘামাও, তার উপর নিজেদের পুরাণ পুঁথি-পাটা পড়, ভারতবর্ষের দেশ-দেশান্তর বেশ করে দেখ, বুদ্ধিমান পণ্ডিতের চোখে দেখ, খাজা আহাম্মকের চোখে নয়, সব দেখতে পাবে যে, জাতটা ঠিক বেঁচে আছে, প্রাণ ধকধক করছে, ওপরে ছাই চাপা পড়েছে মাত্র। আর দেখবে যে, এ দেশের প্রাণ ধর্ম, ভাষা ধর্ম, ভাব ধর্ম; আর তোমার রাজনীতি, সমাজনীতি, রাস্তা ঝেঁটান, প্লেগ নিবারণ, দুর্ভিক্ষগ্রস্তকে অন্নদান, এসব চিরকাল এদেশে যা হয়েছে তাই হবে, অর্থাৎ ধর্মের মধ্য দিয়ে হয় তো হবে; নইলে ঘোড়ার ডিম, তোমার চেঁচামেচিই সার, রামচন্দ্র!
তা ছাড়া উপায় তো সব দেশেই সেই এক, অর্থাৎ গোটাকতক শক্তিমান্ পুরুষ যা করছে, তাই হচ্ছে; বাকীগুলো খালি ‘ভেড়িয়া-ধসান’৭ বৈ তো নয়। ও তোমার ‘পার্লেমেণ্ট’ দেখলুম, ‘সেনেট’ দেখলুম, ভোট ব্যালট মেজরিটি সব দেখলুম, রামচন্দ্র! সব দেশেই ঐ এক কথা। শক্তিমান্ পুরুষেরা যে দিকে ইচ্ছে সমাজকে চালাচ্ছে, বাকীগুলো ভেড়ার দল। তবে ভারতবর্ষে, শক্তিমান্ পুরুষ কে? না—ধর্মবীর। তাঁরা আমাদের সমাজকে চালান। তাঁরাই সমাজের রীতিনীতি বদলাবার দরকার হলে বদলে দেন। আমরা চুপ করে শুনি আর করি। তবে এত তোমার বাড়ার ভাগ ঐ মেজরিটি ভোট প্রভৃতি হাঙ্গামগুলো নেই, এই মাত্র।
অবশ্য ভোট-ব্যালটের সঙ্গে প্রজাদের যে একটি শিক্ষা হয়, সেটা আমরা পাই না, কিন্তু রাজনীতির নামে যে চোরের দল দেশের লোকের রক্ত চুষে সমস্ত ইওরোপী দেশে খাচ্ছে, মোটা তাজা হচ্ছে, সে দলও আমাদের দেশে নেই। সে ঘুষের ধুম, সে দিনে ডাকাতি, যা পাশ্চাত্যদেশে হয়, রামচন্দ্র! যদি ভেতরের কথা দেখতে তো মানুষের উপর হতাশ হয়ে যেতে। ‘গো-রস গলি গলি ফিরে, সুরা বৈঠি বিকায়। সতীকো না মিলে ধোতি, কস্বিন্ পহনে খাসা॥’৮ যাদের হাতে টাকা, তারা রাজ্যশাসন নিজেদের মুঠোর ভেতর রেখেছে, প্রজাদের লুঠছে শুষছে, তারপর সেপাই করে দেশ-দেশান্তরে মরতে পাঠাচ্ছে, জিত হলে তাদের ঘর ভরে ধনধান্য আসবে। আর প্রজাগুলো তো সেইখানেই মারা গেল; হে রাম! চমকে যেও না, ভাঁওতায় ভুলো না।
একটা কথা বুঝে দেখ। মানুষে আইন করে, না আইনে মানুষ করে? মানুষে টাকা উপায় করে, না টাকা মানুষ করতে পারে? মানুষে নাম-যশ করে, না নাম-যশে মানুষ করে?
মানুষ হও, রামচন্দ্র! অমনি দেখবে ও-সব বাকী আপনা-আপনি গড়গড়িয়ে আসছে। ও পরস্পরের নেড়িকুত্তোর খেয়োখেয়ী ছেড়ে সদুদ্দেশ্য, সদুপায়, সৎসাহস, সদ্বীর্য অবলম্বন কর। যদি জন্মেছ তো একটা দাগ রেখে যাও। ‘তুলসী যব জগমে আয়ো জগ হসে তুম রোয়। এয়সী করনী কর্ চলো কি তুম্ হসে জগ রোয়॥’৯—যখন তুমি জন্মেছিলে, তুলসী, সকলে হাসতে লাগলে, তুমি কাঁদতে লাগলে; এখন এমন কাজ করে চল যে, তুমি হাসতে হাসতে মরবে, আর জগৎ তোমার জন্য কাঁদবে। এ পার তবে তুমি মানুষ, নইলে কিসের তুমি?
আর এক কথা বোঝ দাদা, অবশ্য আমাদের অন্যান্য জাতের কাছে অনেক শেখবার আছে। যে মানুষটা বলে আমার শেখবার নেই, সে মরতে বসেছে; যে জাতটে বলে আমরা সবজান্তা, সে জাতের অবনতির দিন অতি নিকট! ‘যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি।’ তবে দেখ, জিনিষটা আমাদের ঢঙে ফেলে নিতে হবে, এইমাত্র। আর আসলটা সর্বদা বাঁচিয়ে বাকী জিনিষ শিখতে হবে। বলি—খাওয়া তো সব দেশেই এক; তবে আমরা পা গুটিয়ে বসে খাই, বিলাতীরা পা ঝুলিয়ে বসে খায়। এখন মনে কর যে, আমি এদের রকমে রান্না খাওয়া খাচ্ছি; তা বলে কি এদের মত ঠ্যাং ঝুলিয়ে থাকতে হবে? আমার ঠ্যাং যে যমের বাড়ী যাবার দাখিলে পড়ে—টানাটানিতে যে প্রাণ যায়, তার কি? কাজেই পা গুটিয়ে, এদের খাওয়া খাব বৈকি। ঐ রকম বিদেশী যা কিছু শিখতে হবে, সেটা আমাদের মত করে—পা গুটিয়ে আসল জাতীয় চরিত্রটি বজায় রেখে। বলি, কাপড়ে কি মানুষ হয়, না মানুষে কাপড় পরে? শক্তিমান্ পুরুষ যে পোষাকই পরুক না কেন, লোকে মানে; আর আমার মত আহাম্মক ধোপার বস্তা ঘাড়ে করে বেড়ালেও লোকে গ্রাহ্য করে না।
এখন গৌরচন্দ্রিকাটা বড্ড বড় হয়ে পড়ল; তবে দু-দেশ তুলনা করা সোজা হবে, এই ভণিতার পর। এরাও ভাল, আমরাও ভাল; ‘কাকো নিন্দো, কাকো বন্দো, দুয়ো পাল্লা ভারী।’ তবে ভালর রকমারী আছে, এইমাত্র।
মানুষের মধ্যে আছেন, আমাদের মতে, তিনটি জিনিষ। শরীর আছেন, মন আছেন, আত্মা আছেন। প্রথম শরীরের কথা দেখা যাক, যা সকলকার চেয়ে বাইরের জিনিষ।
শরীরে শরীরে কত ভেদ, প্রথম দেখ। নাক মুখ গড়ন, লম্বাই চৌড়াই, রঙ চুল—কত রকমের তফাত।
আধুনিক পণ্ডিতদের মতে রঙের তফাত বর্ণসাঙ্কর্যে উপস্থিত হয়। গরম দেশ, ঠাণ্ডা দেশ ভেদে কিছু পরিবর্তন অবশ্য হয়; কিন্তু কালো-সাদার আসল কারণ পৈতৃক। অতি শীতল দেশেও ময়লারঙ জাতি দেখা যাচ্ছে, এবং অতি উষ্ণ দেশেও ধপধপে ফর্সা জাতি বাস করছে। কানাডা-নিবাসী আমেরিকার আদিম মানুষ ও উত্তরমেরুসন্নিহিত দেশ-নিবাসী এস্কিমো প্রভৃতির খুব ময়লা রঙ, আর মহাবিষুবরেখার উপরিস্থিত দ্বীপও সাদারঙ আদিম জাতির বাস; বোর্নিও, সেলিবিস প্রভৃতি দ্বীপপুঞ্জ ইহার নিদর্শন।
এখন আমাদের শাস্ত্রকারদের মতে, হিঁদুর ভেতর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন জাত এবং চীন, হূন, দরদ্, পহ্লব, যবন ও খশ্—এই সকল ভারতের বহিঃস্থিত জাতি—এঁরা হচ্ছেন আর্য। শাস্ত্রোক্ত চীনজাতি—এ বর্তমান ‘চীনেম্যান’ নয়; ওরা তো সেকালে নিজেদের ‘চীনে’ বলতেই না। ‘চীন’ বলে এক বড় জাত কাশ্মীরের উত্তরপূর্বভাগে ছিল; দরদ্রাওৱ—যেখানে এখন ভারত আর আফগানিস্থানের মধ্যে পাহাড়ী জাতসকল, ঐখানে ছিল। প্রাচীন চীন জাতির দু-দশটা বংশধর এখনও আছে। দরদিস্থান এখনও বিদ্যমান। ‘রাজতরঙ্গিণী’ নামক কাশ্মীরের ইতিহাসে বারংবার দরদ্রাজের প্রভুতার পরিচয় পাওয়া যায়। হূন নামক প্রাচীন জাতি অনেকদিন ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিমাংশে রাজত্ব করেছিল। এখন টিবেটীরা নিজেদের হূন বলে; কিন্তু সেটা বোধ হয় ‘হিউন’। ফল—মনূক্ত হূন আধুনিক তিব্বতী তো নয়; তবে এমন হতে পারে যে, সেই আর্য হূন এবং মধ্য আশিয়া হতে সমাগত কোন মোগলাই জাতির সংমিশ্রণে বর্তমান তিব্বতীর উৎপত্তি। প্রজাবলস্কি (Prjevalski) এবং ড্যুক ড অরলিআ (Due d’ Orleans) নামক রুশ ও ফরাসী পর্যটকদের মতে তিব্বতের স্থানে স্থানে এখনও আর্য-মুখ-চোখ-বিশিষ্ট জাতি দেখতে পাওয়া যায়।
যবন হচ্ছে গ্রীকদের নাম। এই নামটার উপর অনেক বিবাদ হয়ে গেছে। অনেকের মতে—যবন এই নামটা ‘য়োনিয়া’(Ionia) নামক স্থানবাসী গ্রীকদের উপর প্রথম ব্যবহার হয়, এজন্য মহারাজ অশোকের পালি লেখে ‘যোন’ নামে গ্রীকজাতি অভিহিত। পরে ‘যোন’ হতে সংস্কৃত যবন শব্দের উৎপত্তি। আমাদের দিশী কোন কোন প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে ‘যবন’ শব্দ গ্রীকবাচী নয়। কিন্তু এ সমস্তই ভুল। ‘যবন’ শব্দই আদি শব্দ, কারণ শুধু যে হিঁদুরাই গ্রীকদের যবন বলত তা নয়; প্রাচীন মিসরী ও বাবিলরাও গ্রীকদের যবন নামে আখ্যাত করত। ‘পহ্লব’ শব্দে পেহলবী-ভাষাবাদী প্রাচীন পারসী জাতি। ‘খশ্’ শব্দে এখনও অর্ধসভ্য পার্বত্যদেশবাসী আর্যজাতি—এখনও হিমালয়ে ঐ নাম ঐ অর্থে ব্যবহার হয়। বর্তমান ইওরোপীরাও এই অর্থে খশ্দের বংশধর। অর্থাৎ যে সকল আর্যজাতি প্রাচীনকালে অসভ্য অবস্থায় ছিল, তারা সব খশ্।
আধুনিক পণ্ডিতদের মতে আর্যদের লালচে সাদা রঙ, কালো বা লাল চুল, সোজা নাক চোখ ইত্যাদি; এবং মাথার গড়ন, চুলের রঙ ভেদে একটু তফাত। যেখানে রঙ কালো, সেখানে অন্যান্য কালো জাতের সঙ্গে মিশে এইটি দাঁড়িয়েছে। এঁদের মতে হিমালয়ের পশ্চিমপ্রান্তস্থিত দু-চার জাতি এখনও পুরো আর্য আছে, বাকী সমস্ত খিচুরিজাত,১০ নইলে কালো কেন হল? কিন্তু ইওরোপী পণ্ডিতদের এখনও ভাবা উচিত যে, দক্ষিণ ভারতেও অনেক শিশুর লাল চুল জন্মায়, কিন্তু দু-চার বৎসরেই চুল ফের কালো হয়ে যায় এবং হিমালয়ে অনেক লাল চুল, নীল বা কটা চোখ।
এখন পণ্ডিতেরা লড়ে মরুন! আর্য নাম হিঁদুরাই নিজেদের উপর চিরকাল ব্যবহার করেছে। শুদ্ধ হোক, মিশ্র হোক, হিঁদুদের নাম আর্য, বস্। কালো বলে ঘৃণা হয়, ইওরোপীরা অন্য নাম নিনগে। আমাদের তায় কি?
কিন্তু কালো হোক, গোরা হোক, দুনিয়ার সব জাতের চেয়ে এই হিঁদুর জাত সুশ্রী সুন্দর। এ-কথা আমি নিজের জাতের বড়াই করে বলছি না, কিন্তু এ-কথা জগৎপ্রসিদ্ধ। শতকরা সুশ্রী নরনারীর সংখ্যা এদেশের মত আর কোথায়? তার উপর ভেবে দেখ, অন্যান্য দেশে সুশ্রী হতে যা লাগে, আমাদের দেশে তার চেয়ে ঢের বেশী; কেন না, আমাদের শরীর অধিকাংশই খোলা। অন্য দেশে কাপড় চোপড় ঢেকে বিশ্রীকে ক্রমাগত সুশ্রী করবার চেষ্টা।
কিন্তু স্বাস্থ্য সম্বন্ধে পাশ্চাত্যেরা আমাদের অপেক্ষা অনেক সুখী। এ-সব দেশে ৪০ বৎসরের পুরুষকে জোয়ান বলে—ছোঁড়া বলে; ৫০ বৎসরের স্ত্রীলোক যুবতী। অবশ্য এরা ভাল খায়, ভাল পরে, দেশ ভাল এবং সর্বাপেক্ষা আসল কথা হচ্ছে—অল্প বয়সে বে করে না। আমাদের দেশেও যে দু-একটা বলবান্ জাতি আছে, তাদের জিজ্ঞাসা করে দেখ, কত বয়সে বে করে। গোরখা, পাঞ্জাবী, জাঠ, আফ্রিদি প্রভৃতি পার্বত্যদের জিজ্ঞাসা কর। তারপর শাস্ত্র পড়ে দেখ ৩০, ২৫, ২০ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের বে-র বয়স। আয়ু, বল, বীর্য এদের আর আমাদের অনেক ভেদ; আমাদের ‘বল, বুদ্ধি, ভরসা—তিন পেরুলেই ফর্সা’; এরা তখন সব গা ঝেড়ে উঠছে।
আমরা নিরামিষাশী, আমাদের অধিকাংশ রোগ পেটে; উদরভঙ্গে বুড়োবুড়ী মরে। এরা মাংসাশী, এদের অধিক রোগই বুকে। হৃদরোগে ফুসফুস রোগে এদের বুড়োবুড়ী মরে। একজন এদেশী বিজ্ঞ ডাক্তার-বন্ধু জিজ্ঞাসা করছেন যে, পেটের রোগগ্রস্ত লোকেরা কি প্রায় নিরুৎসাহ, বৈরাগ্যবান্ হয়? হৃদয়াদি উপরের শরীরের রোগে আশা-বিশ্বাস পুরো থাকে। ওলাউঠা রোগী গোড়া থেকেই মৃত্য ভয়ে অস্থির হয়। যক্ষ্মারোগী মরবার সময় পর্যন্ত বিশ্বাস রাখে যে, সে সেরে উঠবে। অতএব সে জন্যেই কি ভারতের লোক সর্বদাই ‘মরণ মরণ’ আর ‘বৈরাগ্য বৈরাগ্য’ করছে? আমি তো এখনও উত্তর দিতে পারি নাই; কিন্তু কথাটা ভাববার বটে।
আমাদের দেশে দাঁতের রোগ, চুলের রোগ খুব কম। এ সব দেশে অতি অল্প লোকেরই নিজের স্বাভাবিক দাঁত আর টাকের ছড়াছড়ি। আমরা নাক ফুঁড়ছি, কান ফুঁড়ছি গহনা পরবার জন্য। এরা এখন ভদ্রলোকে বড় নাক-কান ফোঁড়ে না; কিন্তু কোমর বেঁধে বেঁধে, শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে, পিলে যকৃৎকে স্থানভ্রষ্ট করে শরীরটাকে বিশ্রী করে বসে। ‘গড়ন গড়ন’ করে এরা মরে, তায় ঐ বস্তাবন্দী কাপড়ের উপর গড়ন রাখতে হবে।
এদের পোষাক কাজকর্ম করবার অত্যন্ত উপযোগী; ধনী লোকের স্ত্রীদের সামাজিক পোষাক ছাড়া [সাধারণ] মেয়েদের পোষাকও হতচ্ছাড়া। আমাদেরে মেয়েদের শাড়ী আর পুরুষদের চোগা-চাপকান-পাগড়ির সৌন্দর্যের এ পৃথিবীতে তুলনা নেই। ভাঁজ ভাঁজ পোষাকে যত রূপ, তত আঁটাসাটায় হয় না। আমাদের পোষাক সমস্তই ভাঁজ ভাঁজ, কিন্তু আমাদের কাজকর্মের পোষাক নেই; কাজ করতে গেলেই কাপড়-চোপড় বিসর্জন যায়। এদের ফ্যাশন কাপড়ে, আমাদের ফ্যাশন গয়নায়; এখন কিছু কিছু কাপড়েও হচ্ছে।
ফ্যাশনটা কি, না—ঢঙ; মেয়েদের কাপড়ের ঢঙ—প্যারিস শহর থেকে বেরোয়; পুরুষদের—লণ্ডন থেকে। আগে প্যারিসের নর্তকীরা এই ঢঙ ফেরাত। একজন বিখ্যাত নটী যা পোষাক পরলে, সকলে অমনি দৌড়ুল তাই করতে। এখন দোকানীর ঢঙ [সৃষ্টি] করে। কত ক্রোর টাকা যে এই পোষাক করতে লাগে প্রতি বৎসর, তা আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। এ পোষাক গড়া এক প্রকাণ্ড বিদ্যে হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন্ মেয়ের গায়ের চুলের রঙের সঙ্গে কোন্ রঙের কাপড় সাজন্ত হবে, কার শরীরের কোন্ গড়নটা ঢাকতে হবে, কোন্টা বা পরিস্ফুট করতে হবে, ইত্যাদি অনেক মাথা ঘামিয়ে পোষাক তৈরী করতে হয়। তারপর দু-চারজন উচ্চপদস্থ মহিলা যা পরেন, বাকী সকলকে তাই পরতে হয়, না পরলে জাত যায়!! এর নাম ফ্যাশন! আবার এই ফ্যাশন ঘড়ি-ঘড়ি বদলাচ্ছে, বছরে চার ঋতুতে চার বার বদলাবেই তো, তা ছাড়া অন্য সময়েও আছে।
যারা বড় মানুষ, তারা দরজী দিয়ে পোষাক করিয়ে নেয়; যারা মধ্যবিৎ ভদ্রলোক-—তারা কতক নিজের হাতে, কতক ছুটকো-ছাটকা মেয়ে-দরজী দিয়ে নূতন ধরনের পোষাক গড়িয়ে নেয়। পরবর্তী ফ্যাশন যদি কাছাকাছি রকমের হয় তো পুরানো কাপড় বদলে-সদলে নেয়, নতুবা নূতন কেনে। বড় মানুষেরা ফি-ঋতুতে কাপড়গুলি চাকর-বাকরদের দান করে। মধ্যবিত্তেরা বেচে ফেলে; তখন সে কাপড়গুলি ইওরোপী লোকদের যে সমস্ত উপনিবেশ আছে—আফ্রিকা, এশিয়া, অষ্ট্রেলিয়ায়—সেথায় গিয়ে হাজির হয়, এবং তারা পরে। যারা খুব ধনী, তাদের কাপড় প্যারিস হতে তৈয়ার হয়ে আসে; বাকীরা নিজেদের দেশে সেগুলি নকল করে পরে! কিন্তু মেয়েদের টুপিটি আসল ফরাসী হওয়া চাই-ই চাই। যার তা নয় সে লেডি নয়।
ইংরেজের মেয়েদের আর জার্মান মেয়েদের পোষাক বড় খারাপ; ওরা বড় প্যারিস ঢঙে পোষাক পরে না—দু-দশজন বড় মানুষ ছাড়া; এইজন্য অন্যান্য দেশের মেয়েরা ওদের ঠাট্টা করে। ইংরেজ পুরুষরা খুব ভাল পোষাক পরে—অনেকেই। আমেরিকার মেয়ে পুরুষ সকলেই খুব ঢঙসই পোষাক পরে। যদিও আমেরিকান গভর্ণমেণ্ট প্যারিস বা লণ্ডনের আমদানী পোষাকের উপর খুব মাশুল বসায়, যাতে বিদেশী মাল এ দেশে না আসে, তথাপি মাশুল দিয়েও মেয়েরা প্যারিস ও পুরুষরা লণ্ডনের তৈরী পোষাক পরে। নানা রকমের নানা রঙের পশমিনা, বনাত, রেশমী কাপড় রোজ রোজ বেরুচ্ছে, লক্ষ লক্ষ লোক তাইতে লেগে আছে, লক্ষ লক্ষ লোক তাই কেটে ছেঁটে পোষাক করছে। ঠিক ঢঙের পোষাক না হলে জেণ্টলম্যান বা লেডির রাস্তায় বেরুনই মুশকিল।
আমাদের দেশে এ ফ্যাশনের হাঙ্গাম কিছু কিছু গহনায় ঢুকছে। এ-সব দেশের পশম-রেশম-তাঁতীদের নজর দিনরাত—কি বদলাচ্ছে বা না বদলাচ্ছে, লোকে কি রকম পছন্দ করছে, তার উপর; অথবা নূতন একটা করে লোকের মন আকর্ষণ করবার চেষ্টা করছে। একবার আন্দাজ লেগে গেলেই সে ব্যবসাদার বড়মানুষ। যখন তৃতীয় ন্যাপলেঅঁ ফরাসী দেশের বাদশা ছিলেন, তখন সম্রাজ্ঞী অজেনি (Eugenie) পাশ্চাত্য জগতের বেশভূষার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁর কাশ্মীরী শাল বড় পছন্দ ছিল। কাজেই লাখো টাকার শাল ইওরোপ প্রতি বৎসর কিনত। তাঁর পতন অবধি সে ঢঙ বদলে গেছে। শাল আর বিক্রী হয় না। আর আমাদের দেশের লোক দাগাই বুলোয়; নূতন একটা কিছু করে সময়মত বাজার দখল করতে পারলে না; কাশ্মীর বেজায় ধাক্কা খেলে, বড় বড় সদাগর গরীব হয়ে গেল।
এ সংসার—‘দেখ্ তোর, না দেখ মোর’, কেউ কারু জন্য দাঁড়িয়ে আছে? ওরা দশ চোখ, দুশ হাত দিয়ে দেখছে, খাটছে; আমরা—‘গোঁসাইজী যা পুঁথিতে’ লেখেননি—তা কখনই করব না, করবার শক্তিও গেছে। অন্ন বিনা হাহাকার!! দোষ কার? প্রতিবিধানের চেষ্টা তো অষ্টরম্ভা; খালি চীৎকার হচ্ছে; বস্! কোণ থেকে বেরোও না—দুনিয়াটা কি, চেয়ে দেখ না। আপনা-আপনি বুদ্ধিসুদ্ধি আসবে।
দেবাসুরের গল্প তো জানই। দেবতারা আস্তিক—আত্মায় বিশ্বাস, ঈশ্বরে—পরলোকে বিশ্বাস রাখে। অসুররা বলছে—ইহলোকে এই পৃথিবী ভোগ কর, এই শরীরটাকেই সুখী কর। দেবতা ভাল, কি অসুর ভাল, সে কথা হচ্ছে না। বরং পুরাণের অসুরগুলোই তো দেখি মনিষ্যির মত, দেবতাগুলো অনেকাংশে হীন। এখন যদি বোঝ যে তোমরা দেবতার বাচ্চা আর পাশ্চাত্যেরা অসুরবংশ, তা হলেই দু-দেশ বেশ বুঝতে পারবে।
দেখ, শরীর নিয়ে প্রথম। বাহ্যাভ্যন্তর শুদ্ধি হচ্ছে—পবিত্রতা। মাটি জল প্রভৃতির দ্বারা শরীর শুদ্ধ হয়—উত্তম। দুনিয়ার এমন জাত কোথাও নেই যাদের শরীর হিঁদুদের মত সাফ। হিঁদু ছাড়া আর কোন জাত জলশৌচাদি করে না। তবু পাশ্চাত্যদের—চীনেরা কাগজ ব্যবহার করাতে শিখিয়েছে, কিছু বাঁচোয়া। স্নান নেই বললেই হয়। এখন ইংরেজরা ভারতে এসে স্নান ঢুকিয়েছে দেশে। তবুও যে-সব ছেলেরা বিলেতে পড়ে এসেছে তাদের জিজ্ঞাসা কর, স্নানের কি কষ্ট! যারা স্নান করে—সে সপ্তায় এক দিন—সে-দিন ভেতরের কাপড় আণ্ডারওয়ার বদলায়। অবশ্য এখন পয়সাওয়ালাদের ভেতর অনেকে নিত্যস্নায়ী। আমেরিকানরা একটু বেশী! জার্মান—কালেভদ্রে; ফরাসী প্রভৃতি কস্মিন্ কালেও না!!! স্পেন ইতালী অতি গরম দেশ, সে আরও নয়—রাশীকৃত লশুন খাওয়া, দিনরাত ঘর্মাক্ত, আর সাত জন্মে জলস্পর্শও না! সে গায়ের গন্ধে ভূতের চৌদ্দপুরুষ পালায়—ভূত তো ছেলেমানুষ! ‘স্নান’ মানে কি—মুখটি মাথাটি ধোয়া, হাত ধোয়া—যা বাহিরে দেখা যায়। আবার কি! প্যারিস, সভ্যতার রাজধানী প্যারিস, রঙ-ঢঙ ভোগবিলাসের ভূস্বর্গ প্যারিস, বিদ্যা-শিল্পের কেন্দ্র প্যারিস, সেই প্যারিসে এক বৎসর এক বড় ধনী বন্ধু নিমন্ত্রণ করে আনলেন। এক প্রাসাদোপম মস্ত হোটেলে নিয়ে তুললেন—রাজভোগ খাওয়া-দাওয়া, কিন্তু স্নানের নামটি নেই। দুদিন ঠায় সহ্য করে—শেষে আর পারা গেল না। শেষে বন্ধুকে বলতে হল—দাদা, তোমার এ রাজভোগ তোমারই থাকুক, আমার এখন ‘ছেঁড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ হয়েছে। এই দারুণ গরমিকাল, তাতে স্নান করবার যো নেই, হন্যে কুকুর হবার যোগাড় হয়েছে। তখন বন্ধু দুঃখিত হয়ে চটে বললেন যে, এমন হোটেলে থাকা হবে না, চল ভাল জায়গা খুঁজে নিইগে। বারোটা প্রধান প্রধান হোটেলে খোঁজা হল, স্নানের স্থান কোথাও নেই। আলাদা স্নানাগার সব আছে, সেখানে গিয়ে ৪।৫ টাকা দিয়ে একবার স্নান হবে। হরিবোল হরি! সে দিন বিকালে কাগজে পড়া গেল—এক বুড়ী স্নান করতে টবের মধ্যে বসেছিল, সেইখানেই মারা পড়েছে!! কাজেই জন্মের মধ্যে একবার বুড়ী চামড়ার সঙ্গে জলস্পর্শ হতেই কুপোকাত!! এর একটি কথা অতিরঞ্জিত নয়। রুশ-ফুশগুলো তো আসল ম্লেচ্ছ, তিব্বত থেকেই ও ঢঙ আরম্ভ। আমেরিকায় অবশ্য প্রত্যেক বাসাবাড়ীতে একটা করে স্নানের-ঘর ও জলের পাইপের বন্দোবস্ত আছে।
কিন্তু তফাত দেখ! আমরা স্নান করি কেন?—অধর্মের ভয়ে; পাশ্চাত্যেরা হাত-মুখ ধোয়—পরিষ্কার হবে বলে। আমাদের জল ঢাললেই হল, তা তেলই বেড়-বেড় করুক আর ময়লাই লেগে থাকুক! আবার দক্ষিণী ভায়া স্নান করে এমন লম্বা চওড়া তেলক কাটলেন যে, ঝামারও সাধ্য নয় তাকে ঘষে তোলে। আবার আমাদের স্নান সোজা কথা, যেখানে হোক ডুব লাগালেই হল। ওদের—সে এক বস্তা কাপড় খুলতে হবে তার বন্ধনই বা কি! আমাদের গা দেখাতে লজ্জা নেই, ওদের বেজায়। তবে পুরুষে পুরুষে কিছুমাত্র নেই, বাপ বেটার সামনে উলঙ্গ হবে—দোষ নেই। মেয়েছেলের সামনে আপাদমস্তক ঢাকতে হবে।
‘বহিরাচার’ অর্থাৎ পরিষ্কার থাকাটা, অন্যান্য আচারের ন্যায়, কখনও কখনও অত্যাচার বা অনাচার হয়ে পড়ে। ইওরোপী বলে যে, শরীর-সম্বন্ধী সমস্ত কার্য অতি গোপনে করা উচিত। উত্তম কথা। এই শৌচাদি তো দূরের কথা; লোকমধ্যে থুথু ফেলা একটা মহা অভদ্রতা! খেয়ে আঁচানো সকলের সামনে অতি লজ্জার কথা, কেন না কুলকুচো করা তায় আছে। লোকলজ্জার ভয়ে খেয়ে দেয়ে মুখটি মুছে বসে থাকে—ক্রমে দাঁতের সর্বনাশ হয়। সভ্যতার ভয়ে অনাচার। আমাদের আবার দুনিয়ার লোকের সামনে রাস্তায় বসে বমির নকল করতে করতে মুখ ধোওয়া, দাঁত মাজা, আঁচানো—এটা অত্যাচার। ও-সমস্ত কার্য গোপনে করা উচিত নিশ্চিত, তবে না করাও অনুচিত।
আবার দেশভেদে যে সকল কার্য অনিবার্য, সেগুলো সমাজ সয়ে নেয়! আমাদের গরম দেশে খেতে বসে আধ ঘড়াই জল খেয়ে ফেলি—এখন ঢেঁকুর না তুলে যাই কোথা; কিন্তু ঢেঁকুর তোলা পাশ্চাত্য দেশে অতি অভদ্রের কাজ। কিন্তু খেতে খেতে রুমাল বার করে দিব্যি নাক ঝাড়ো—তত দোষের নয়; আমাদের দেশে ঘৃণার কথা। এ ঠাণ্ডা দেশে মধ্যে মধ্যে নাক না ঝেড়ে থাকা যায় না।
ময়লাকে অত্যন্ত ঘৃণা করে আমরা ময়লা হয়ে থাকি অনেক সময়। ময়লায় আমাদের এত ঘৃণা যে ছুঁলে নাইতে হয়; সেই ভয়ে স্তূপাকৃতি ময়লা দোরের পাশে পচতে দিই। না ছুঁলেই হল! এদিকে যে নরককুণ্ডে বাস হচ্ছে, তার কি? একটা অনাচারের ভয়ে আর একটা মহাঘোর অনাচার। একটা পাপ এড়াতে গিয়ে, আর একটা গুরুতর পাপ করছি। যার বাড়ীতে ময়লা সে পাপী, তাতে আর সন্দেহ কি? তার সাজাও তাকে মরে পেতে হবে না, অপেক্ষাও বড় বেশী করতে হবে না।
আমাদের রান্নার মত পরিষ্কার রান্না কোথাও নেই। বিলেতী খাওয়ার শৃঙ্খলার মত পরিষ্কার পদ্ধতি আমাদের নেই। আমাদের রাঁধুনী স্নান করছে, কাঁপড় বদলেছে; হাঁড়িপত্র, উনুন—সব ধুয়ে মেজে সাফ করেছে; নাকে মুখে গায়ে হাত ঠেকলে তখনি হাত ধুয়ে তবে আবার খাদ্যদ্রব্যে হাত দিচ্ছে। বিলাতী রাঁধুনীর চৌদ্দ-পুরুষে কেউ স্নান করেনি; রাঁধতে রাঁধতে চাখছে, আবার সেই চামচে হাঁড়িতে ডোবাচ্ছে।
রুমাল বার করে ফোঁৎ করে নাক ঝাড়লে, আবার সেই হাতে ময়দা মাখলে। শৌচ থেকে এল—কাগজ ব্যবহার করে, সে হাত ধোবার নামটিও নেই—সেই হাতে রাঁধতে লাগল। কিন্তু ধপধপে কাপড় আর টুপি পরেছে। হয়তো একটা মস্ত কাঠের টবের মধ্যে দুটো মানুষ উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে রাশীকৃত ময়দার উপর নাচছে—কিনা ময়দা মাখা হচ্ছে। গরমি কাল—দরবিগলিত ঘাম পা বেয়ে সেই ময়দায় সেঁধুচ্ছে। তারপর তার রুটি তৈয়ার যখন হল, তখন দুগ্ধফেননিভ তোয়ালের উপর চীনের বাসনে সজ্জিত হয়ে পরিষ্কার চাদর বিছানো টেবিলের উপর, পরিষ্কার কাপড় পরা কনুই পর্যন্ত সাদা দস্তানা-পরা চাকর এনে সামনে ধরলে! কোন জিনিষ হাত দিয়ে পাছে ছুঁতে হয়, তাই কনুই পর্যন্ত দস্তানা।
আমাদের স্নান-করা বামুন, পরিষ্কার বাসনে পরিষ্কার হাঁড়িতে, শুদ্ধ হয়ে রেঁধে গোময়সিক্ত মাটির উপর থালসুদ্ধ অন্নব্যঞ্জন ঝাড়লে; বামুনের কাপড়ে খামছে ময়লা উঠছে। হয়তো মাটি ময়লা গোবর আর ঝোল কলাপাতা ছেঁড়ার দরুন একাকার হয়ে এক অপূর্ব আস্বাদ উপস্থিত করলে!!
আমরা দিব্যি স্নান করে একখানা তেলচিটে ময়লা কাপড় পরলুম, আর ইওরোপে ময়লা গায়ে, না নেয়ে একটা ধপধপে পোষাক পরলে। এইটি বেশ করে বোঝ, এইটি আগাগোড়ার তফাত—হিঁদুর সেই অন্তদৃষ্টি, তা আগাপাস্তলা সমস্ত কাজে। হিঁদু—ছেঁড়া ন্যাতা মুড়ে কোহিনুর রাখে; বিলাতী—সোনার বাক্সয় মাটির ডেলা রাখে! হিঁদুর শরীর পরিষ্কার হলেই হল, কাপড় যা তা হোক! বিলাতীর কাপড় সাফ থাকলেই হল, গায়ে ময়লা রইলই বা! হিঁদুর ঘর দোর ধুয়ে মেজে সাফ, তার বাইরে নরককুণ্ড থাকুক না কেন! বিলাতীর মেজে কার্পেটে মোড়া ঝকঝকে, ময়লা সব ঢাকা থাকলেই হল!! হিঁদুর পয়োনালী রাস্তার উপর—দুর্গন্ধে বড় এসে যায় না। বিলাতীর পয়োনালী রাস্তার নীচে—টাইফয়েড ফিভারের বাসা!! হিঁদু করছেন ভেতর সাফ। বিলাতী করছেন বাইরে সাফ।
চাই কি?—পরিষ্কার শরীরে পরিষ্কার কাপড় পরা। মুখধোয়া দাঁতমাজা—সব চাই, কিন্তু গোপনে। ঘর পরিষ্কার চাই। রাস্তাঘাটও পরিষ্কার চাই। পরিষ্কার রাঁধুনী, পরিষ্কার হাতের রান্না চাই। আবার পরিষ্কার মনোরম স্থানে পরিষ্কার পাত্রে খাওয়া চাই—‘আচারঃ প্রথমো ধর্মঃ।’ আচারের প্রথম আবার পরিষ্কার হওয়া।—সব রকমে পরিষ্কার হওয়া আচার-ভ্রষ্টের কখনও ধর্ম হবে? অনাচারীর দুঃখ দেখছ না, দেখেও শিখছ না? এত ওলাউঠা, এত মহামারী, ম্যালেরিয়া—কার দোষ? আমাদের দোষ। আমরা মহা অনাচারী!!!
আহার শুদ্ধ হলে মন শুদ্ধ হয়, মন শুদ্ধ হলে আত্মসম্বন্ধীয় অচলা স্মৃতি হয়—এ শাস্ত্রবাক্য আমাদের দেশের সকল সম্প্রদায়ই মেনেছেন। তবে শঙ্করাচার্যের মতে১১ ‘আহার’ শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয়জ্ঞান আর রামানুজাচার্যের মতে ভোজ্যদ্রব্য। সর্ববাদিসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, দুই অর্থই ঠিক। বিশুদ্ধ আহার না হলে ইন্দ্রিয়সকল যথাযথ কার্য কি করেই বা করে? কদর্য আহারে ইন্দ্রিয়সকলের গ্রহণশক্তির হ্রাস হয় বা বিপর্যয় হয়, এ-কথা সকলেরই প্রত্যক্ষ। অজীর্ণ দোষে এক জিনিষকে আর এক বলে ভ্রম হওয়া এবং আহারের অভাবে দৃষ্টি আদি শক্তির হ্রাস সকলেই জানেন। সেই প্রকার কোন বিশেষ আহার বিশেষ শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা উপস্থিত করে, তাও ভূয়োদর্শনসিদ্ধ। আমাদের সমাজে যে এত খাদ্যাখাদ্যের বাছবিচার, তার মূলেও এই তত্ত্ব; যদিও অনেক বিষয়ে আমরা বস্তু ভুলে আধারটা নিয়েই টানা-হেঁচড়া করছি এখন।
রামানুজাচার্য ভোজ্যদ্রব্য সম্বন্ধে তিনটি দোষ বাঁচাতে বলছেন। জাতিদোষ অর্থাৎ যে দোষ ভোজ্যদ্রব্যের জাতিগত; যেমন প্যাঁজ লশুন ইত্যাদি উত্তেজক দ্রব্য খেলে মনে অস্থিরতা আসে অর্থাৎ বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়। আশ্রয়দোষ অর্থাৎ যে দোষ ব্যক্তিবিশেষের স্পর্শ হতে আসে; দুষ্ট লোকের অন্ন খেলেই দুষ্টবুদ্ধি আসবেই, সতের অন্নে সদ্বুদ্ধি ইত্যাদি। নিমিত্তদোষ অর্থাৎ ময়লা কদর্য কীট-কেশাদি-দুষ্ট অন্ন খেলেও মন অপবিত্র হবে। এর মধ্যে জাতিদোষ এবং নিমিত্তদোষ থেকে বাঁচবার চেষ্টা সকলেই করতে পারে, আশ্রয়দোষ হতে বাঁচা সকলের পক্ষে সহজ নয়। এই আশ্রয়দোষ থেকে বাঁচবার জন্যই আমাদের দেশে ছুঁৎমার্গ—‘ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না।’ তবে অনেক স্থলেই ‘উল্টা সমঝ্লি রাম’ হয়ে যায় এবং মানে না বুঝে একটা কিম্ভূতকিমাকার কুসংস্কার হয়ে দাঁড়ায়। এস্থলে লোকাচার ছেড়ে লোকগুরু মহাপুরুষদের আচারই গ্রহণীয়। শ্রীচৈতন্যদেব প্রভৃতি জগদ্গুরুদের জীবনী পড়ে দেখ, তাঁরা এ সম্বন্ধে কি ব্যবহার করে গেছেন। জাতিদুষ্ট অন্নভোজন সম্বন্ধে ভারতবর্ষের মত শিক্ষার স্থল এখনও পৃথিবীতে কোথাও নেই। সমস্ত ভূমণ্ডলে আমাদের দেশের মত পবিত্র দ্রব্য আহার করে, এমন আর কোন দেশ নেই। নিমিত্ত-দোষ সম্বন্ধে বর্তমান কালে বড়ই ভয়ানক অবস্থা দাঁড়িয়েছে; ময়রার দোকান, বাজারে খাওযা, এ সব মহা অপবিত্র দেখতেই পাচ্ছ, কিরূপ নিমিত্তদোষে দুষ্ট ময়লা আবর্জনা পচা পক্কড় সব ওতে আছেন—এর ফল হচ্ছে তাই। এই যে ঘরে ঘরে অজীর্ণ, ও ঐ ময়রার দোকানে—বাজারে খাওয়ার ফল। এই যে প্রসাবের ব্যারামের প্রকোপ, ও-ও ঐ ময়রার দোকান। ঐ যে পাড়াগেঁয়ে লোকের তত অজীর্ণদোষ, প্রস্রাবের ব্যারাম হয় না, তার প্রধান কারণ হচ্ছে লুচি কচুরি প্রভৃতি ‘বিষলড্ডকে’র অভাব। এ-কথা বিস্তার করে পরে বলছি।
এই তো গেল খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে প্রাচীন সাধারণ নিয়ম। এ নিয়মের মধ্যে আবার অনেক মতামত প্রাচীন কালে চলেছে এবং আধুনিক কালে চলছে। প্রথম—প্রাচীনকাল হতে আধুনিক কাল পর্যন্ত এক মহা বিবাদ—আমিষ আর নিরামিষ। মাংসভোজন উপকারক কি অপকারক? তা ছাড়া জীবহত্যা ন্যায় বা অন্যায়, এ এক মহা বিতণ্ডা চিরদিনের। এক পক্ষ বলছেন—কোন কারণে হত্যারূপ পাপ করা উচিত নয়; আর এক পক্ষ বলছেন—রাখ তোমার কথা, হত্যা না করলে প্রাণধারণই হয় না। শাস্ত্রবাদীদের ভেতর মহাগোল। শাস্ত্রে একবার বলছেন, যজ্ঞস্থলে হত্যা কর; আবার বলছেন, জীবঘাত কর না। হিঁদুরা সিদ্ধান্ত করছেন যে, যজ্ঞ ছাড়া অন্যত্র হত্যা করা পাপ। কিন্তু যজ্ঞ করে সুখে মাংস ভোজন কর। এমন কি, গৃহস্থের পক্ষে অনেকগুলি নিয়ম আছে যে, সে-সে স্থলে হত্যা না করলে পাপ—যেমন শ্রাদ্ধাদি। সে-সকল স্থলে নিমন্ত্রিত হয়ে মাংস না খেলে পশুজন্ম হয়, মনু বলছেন। অপর দিকে জৈন বৌদ্ধ বৈষ্ণব বলছেন যে, তোমার শাস্ত্র মানিনি, হত্যা করা কিছুতেই হবে না। বৌদ্ধ সম্রাট্ অশোক, যে যজ্ঞ করবে বা নিমন্ত্রণ করে মাংস খাওয়াবে, তাকে সাজা দিচ্ছেন।
আধুনিক বৈষ্ণব পড়েছেন কিছু ফাঁপরে, তাঁদের ঠাকুর রাম বা কৃষ্ণ মদ-মাংস দিব্যি ওড়াচ্ছেন, রামায়ণ-মহাভারতে রয়েছে। সীতাদেবী গঙ্গাকে মাংস, ভাত আর হাজার কলসী মদ মানছেন!১২ বর্তমান কালে শাস্ত্রও শুনবে না, মহাপুরুষ বলেছেন বললেও শোনে না।পাশ্চাত্যদেশে এরা লড়ছে যে, মাংস খেলে রোগ হয়, নিরামিষাশী নিরোগ হয় ইত্যাদি। এক পক্ষ বলছেন যে, মাংসাহারীর যত রোগ; অপর পক্ষ বলছেন, ও গল্পকথা, তাহলে হিঁদুরা নীরোগ হত, আর ইংরেজ আমেরিকান প্রভৃতি প্রধান প্রধান মাংসাহারী জাত রোগে লোপাট হয়ে যেত এত দিনে। এক পক্ষ বলছেন যে, ছাগল খেলে ছাগুলে বুদ্ধি হয়, শূয়োর খেলে শূয়োরের বুদ্ধি হয়, মাছ খেলে মেছো বুদ্ধি হবে। অপর পক্ষ বলছেন যে, কপি খেলে কোপো বুদ্ধি, আলু খেলে আলুয়ো বুদ্ধি এবং ভাত খেলে ভেতো বুদ্ধি। জড়বুদ্ধির চেয়ে চৈতন্যবুদ্ধি হওয়া ভাল। এক পক্ষ বলছেন, ভাত-ডালে যা আছে, মাংসেও তাই; অপর পক্ষ বলছেন যে, হাওয়াতেও তাই, তবে তুমি হাওয়া খেয়ে থাক। এক পক্ষ বলছেন, ভাত-ডালে যা আছে, মাংসেও তাই; অপর পক্ষ বলছেন, হাওয়াতেও তাই, তবে তুমি হওয়া খেয়ে থাক। এক পক্ষ বলছেন, হাওয়াতে তাই, তবে তুমি হাওয়া খেয়ে থাক। এক পক্ষ বলছেন যে, নিরামিষ খেয়েও লোকে কত পরিশ্রম করতে পারে; অপর পক্ষ বলছেন, তা হলে নিরামিষাশী জাতিই প্রধান হত; চিরকাল মাংসাশী জাতিই বলবান্ ও প্রধান। মাংসাহারী বলছে, হিঁদু চীনে দেখ, খেতে পায় না, ভাত খেয়ে শাক-পাতড়া খেয়ে মরে, ওদের দুর্দশা দেখ—আর জাপানীরাও ঐ ছিল; মাংসাহার আরম্ভ করে অবধি ওদের ভোল ফিরে গেছে।ভারতবর্ষে দেড় লাখ হিন্দুস্থানী সেপাই, এদের মধ্যে কয়জন নিরামিষ খায় দেখ। উত্তম সেপাই গোরখা বা শিখ কে কবে নিরামিষাশী দেখ। এক পক্ষ বলছেন যে, মাংসাহারে বদহজম, আর এক পক্ষ বলছেন—সব ভুল, নিরামিষাশীগুলোরই যত পেটের রোগ। এক পক্ষ বলছেন, তোমার কোষ্ঠশুদ্ধিরোগ শাক-পাতড়া খেয়ে জোলাপবৎ ভাল হয়ে যায়, তা বলে কি দুনিয়াসুদ্ধকে তাই করতে চাও? ফলকথা, চিরকালই মাংসাশী জাতিরাই যুদ্ধবীর, চিন্তাশীল ইত্যাদি। মাংসাশী জাতেরা বলছেন যে, যখন যজ্ঞের ধুম দেশময় উঠত, তখনই হিঁদুর মধ্যে ভাল ভাল মাথা বেরিয়েছে, এ বাবাজীডৌল হয়ে পর্যন্ত একটাও মানুষ জন্মাল না। এ বিধায় মাংসাশীরা ভয়ে মাংসাহার ছাড়তে চায় না। আমাদের দেশে আর্যসমাজী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিবাদ উপস্থিত। এক পক্ষ বলছেন যে, মাংস খাওয়া একান্ত আবশ্যক; আর পক্ষ বলছেন, একান্ত অন্যায়। এই তো বাদ-বিবাদ চলছে।
সকল পক্ষ দেখে শুনে আমার তো বিশ্বাস দাঁড়াচ্ছে যে, হিঁদুরাই ঠিক, অর্থাৎ হিঁদুদের ঐ যে ব্যবস্থা যে জন্ম-কর্ম-ভেদ আহারাদি সমস্তই পৃথক্, এইটিই সিদ্ধান্ত। মাংস খাওয়া অবশ্য অসভ্যতা, নিরামিষ-ভোজন অবশ্যই পবিত্রতর। যার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র ধর্মজীবন, তাঁর পক্ষে নিরামিষ; আর যাকে খেটেখুটে এই সংসারের দিবারাত্রি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে জীবনতরী চালাতে হবে, তাকে মাংস খেতে হবে বৈকি। যতদিন মনুষ্য-সমাজে এই ভাব থাকবে—‘বলবানের জয়’, ততদিন মাংস খেতে হবে বা অন্য কোন রকম মাংসের ন্যায় উপযোগী আহার আবিষ্কার করতে হবে। নইলে বলবানের পদতলে দুর্বল পেষা যাবেন! রাম কি শ্যাম নিরামিষ খেয়ে ভাল আছেন বললে চলে না—জাতি জাতির তুলনা করে দেখ।
আবার নিরামিষাশীদের মধ্যেও হচ্ছে কোঁদল। এক পক্ষ বলছেন যে ভাত, আলু, গম, যব, জনার প্রভৃতি শর্করাপ্রধান খাদ্যও কিছুই নয়, ও-সব মানুষে বানিয়েছে, ঐ সব খেয়েই যত রোগ। শর্করা-উৎপাদক (starchy) খাবার রোগের ঘর। ঘোড়া গরুকে পর্যন্ত ঘরে বসে চাল গম খাওয়ালে রোগী হয়ে যায়, আবার মাঠে ছেড়ে দিলে কচি ঘাস খেয়ে তাদের রোগ সেরে যায়। ঘাস শাক পাতা প্রভৃতি হরিৎ সব্জিতে শর্করা-উৎপাদক পদার্থ বড্ড কম।বনমানুষ জাতি বাদাম ও ঘাস খায়, আলু, গম ইত্যাদি খায় না; যদি খায় তো অপক্ব অবস্থায় যখন স্টার্চ (starch) অধিক হয়নি। এই সমস্ত নানাপ্রকার বিতণ্ডা চলছে। এক পক্ষ বলছেন, শূল্য মাংস আর যথেষ্ট ফল এবং দুগ্ধ—এইমাত্র ভোজনই দীর্ঘ জীবনের উপযোগী। বিশেষ ফল ফলাহারী অনেক দিন পর্যন্ত যুবা থাকবে, কারণ ফলের খাট্টা হাড়-গোড়ে জং ধরতে দেয় না।
এখন সর্ববাদিসম্মত মত হচ্ছে যে, পুষ্টিকর অথচ শীঘ্র হজম হয়, এমন খাওয়া দাওয়া। অল্প আয়তনে অনেকটা পুষ্টি অথচ শীঘ্র পাক হয়, এমন খাওয়া চাই। সে খাওয়ায় পুষ্টি কম, তা কাজেই এক বস্তা খেতে হয়, কাজেই সারাদিন লাগে তাকে হজম করতে; যদি হজমেই সমস্ত শক্তিটুকু গেল, বাকী আর কি কাজ করবার শক্তি রইল?
ভাজা জিনিষগুলো আসল বিষ। ময়রার দোকান যমের বাড়ী। ঘি তেল গরম দেশে যত অল্প খাওয়া যায়, ততই কল্যাণ। ঘিয়ের চেয়ে মাখন শীঘ্র হজম হয়। ময়দায় কিছুই নাই, দেখতেই সাদা। গরমে সমস্ত ভাগ যাতে আছে, এমন আটাই সুখাদ্য। আমাদের বাঙলা দেশের জন্য এখনও দূর পল্লীগ্রামে যে সকল আহারের বন্দোবস্ত আছে, তাই প্রশস্ত। কোন্ প্রাচীন বাঙালী কবি লুচি-কচুরির বর্ণনা করছেন? ও লুচি-কচুরি এসেছে পশ্চিম থেকে। সেখানেও কালেভদ্রে লোকে খায়। উপরি উপরি ‘পাকি রসুই’ খেয়ে থাকে এমন লোক তো দেখিনি! মথুরার চোবে কুস্তিগীর লুচি-লড্ডুকপ্রিয়; দু-চার বৎসরেই চোবের হজমের সর্বনাশ হয়, আর চোবেজী চূরণ খেয়ে খেয়ে মরেন।
গরীবরা খাবার জোটে না বলে অনাহারে মরে, ধনীরা অখাদ্য খেয়ে অনাহারে মরে। যা তা পেটে পোরার চেয়ে উপবাস ভাল। ময়রার দোকানের খাবারের খাদ্যদ্রব্যে কিছুই নেই, একদম উল্টো আছেন বিষ—বিষ—বিষ। পূর্বে লোকে কালেভদ্রে ঐ পাপগুলো খেত; এখন শহরের লোক, বিশেষ বিদেশী যারা শহরে বাস করে, তাদের নিত্য ভোজন হচ্ছে ঐ। এতে অজীর্ণরোগে অপমৃত্যু হবে তায় কি বিচিত্র! খিদে পেলেও কচুরি জিলিপি খানায় ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাও—সস্তাও হবে, কিছু খাওয়ায় হবে। ভাত, ডাল, আটার রুটি, মাছ, শাক, দুধ যথেষ্ট খাদ্য। তবে ডাল দক্ষিণীদের মত খাওয়া উচিত, অর্থাৎ ডালের ঝোলমাত্র, বাকীটা গরুকে দিও। মাংস খাবার পয়সা থাকে, খাও; তবে ও পশ্চিমী নানাপ্রকার গরম মসলাগুলো বাদ দিয়ে। মসলাগুলো খাওয়া নয়—ওগুলো অভ্যাসের দোষ। ডাল অতি পুষ্টিকর খাদ্য, তবে বড়ই দুষ্পাচ্য। কচি কলাইশুঁটির ডাল অতি সুপাচ্য এবং সুস্বাদ; প্যারিস রাজধানীর ঐ সূপ একটি বিখ্যাত খাওয়া। কচি কলাইশুঁটি খুব সিদ্ধ করে, তারপর তাকে পিষে জলের সঙ্গে মিশিয়ে ফেল। তারপর একটা দুধছাঁকনির মত তারের ছাঁকনিতে ছাঁকলেই খোসাগুলো বেরিয়ে আসবে। এখন হলুদ ধনে জিরে মরিচ লঙ্কা, যা দেবার দিয়ে সাঁতলে নাও—উত্তম সুস্বাদ সুপাচ্য ডাল হল। যদি একটা পাঁঠার মুড়ি বা মাছের মুড়ি তার সঙ্গে থাকে তো উপাদেয় হয়।
ঐ যে এত প্রস্রাবের রোগের ধুম দেশে, ওর অধিকাংশই অজীর্ণ, দু-চার জনের মাথা ঘামিয়ে, বাকী সব বদহজম। পেটে পুরলেই কি খাওয়া হল? যেটুকু হজম হবে, সেইটুকুই খাওয়া। ভুঁড়ি নাবা বদহজমের প্রথম চিহ্ন। শুকিয়ে যাওয়া বা মোটা হওয়া দুটোই বদহজম। পায়ের মাংস লোহার মত শক্ত হওয়া চাই। প্রস্রাবে চিনি বা আলবুমেন (Albumen) দেখা দিয়েছে বলেই ‘হাঁ’ করে বস না। ও-সব আমাদের দেশের কিছুই নয়। ও গ্রাহ্যের মধ্যেই এনো না। খাওয়ার দিকে খুব নজর দাও, অজীর্ণ না হতে পায়। ফাঁকা হাওয়ায় যতক্ষণ সম্ভব থাকবে। খুব হাঁটো আর পরিশ্রম কর। যেমন করে পার ছুটে নাও, আর বদরিকাশ্রম তীর্থযাত্রা কর। হরিদ্বার থেকে পায়ে হেঁটে ১০০ ক্রোশ ঠেলে পাহাড় চড়াই করে বদরিকাশ্রম যাওয়া-আসা একবার হলেই ও প্রস্রাবের ব্যারাম-ফ্যারাম ভূত ভাগবে। ডাক্তার-ফাক্তার কাছে আসতে দিও না, ওরা অধিকাংশ—‘ভাল করতে পারব না, মন্দ করব, কি দিবি তা বল্’। পারতপক্ষে ওষুধ খেও না। রোগে যদি এক আনা মরে, ওষুধে মরে পনর আনা! পার যদি প্রতি বৎসর পূজার বন্ধের সময় হেঁটে দেশে যাও। ধন [ধনী] হওয়া, আর কুড়ের বাদশা হওয়া—দেশে এক কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাকে ধরে হাঁটাতে হয়, খাওয়াতে হয়, সেটা জীবন্ত রোগী, সেটা তো হতভাগা। যেটা লুচির ফুলকো ছিঁড়ে খাচ্ছে, সেটা তো মরে আছে। যে একদমে দশক্রোশ হাঁটতে পারে না, সেটা মানুষ, না কেঁচো? সেধে রোগ অকালমৃত্যু ডেকে আনলে কে কি করবে?
আবার ঐ যে পাঁউরুটি, উনিও হচ্ছেন বিষ, ওঁকে ছুঁয়ো না একদম। খাম্বীর মিশলেই ময়দা এক থেকে আর হয়ে দাঁড়ান। কোন খাম্বীরদার জিনিষ খাবে না, এ বিষয়ে আমাদের শাস্ত্রে যে সর্বপ্রকার খাম্বীরদার জিনিষের নিষেধ আছে, এ বড় সত্য। শাস্ত্রে যে-কোন জিনিষ মিষ্টি থেকে টকেছে, তার নাম ‘শুক্ত’; তা খেতে নিষেধ—কেবল দই ছাড়া। দই অতি উপাদেয়—উত্তম জিনিষ। যদি একান্ত পাঁউরুটি খেতে হয় তো তাকে পুনর্বার খুব আগুনে সেঁকে খাও।
অশুদ্ধ জল আর অশুদ্ধ ভোজন রোগের কারণ। আমেরিকায় এখন জলশুদ্ধির বড়ই ধুম। এখন ঐ যে ফিলটার, ওর দিন গেছে চুকে। অর্থাৎ ফিলটার জলকে ছেঁকে দেয় মাত্র, কিন্তু রোগের বীজ যে সকল কীটাণু তাতে থাকে, ওলাউঠা প্লেগের বীজ তা যেমন তেমনি থাকে; অধিকন্তু ফিলটারটি স্বয়ং ঐ সকল বীজের জন্মভূমি হয়ে দাঁড়ান। কলকেতায় যখন প্রথম ফিলটারকরা জল হল, তখন পাঁচ বৎসর নাকি ওলাউঠা হয় নাই; তারপর যে কে সেই, অর্থাৎ সে ফিলটার মশাই এখন স্বয়ং ওলাউঠা বীজের আবাস হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। ফিলটারের মধ্যে দিশী তেকাঠার ওপর ঐ যে তিন-কলসীর ফিলটার উনিই উত্তম, তবে দু-তিন দিন অন্তর বালি বা কয়লা বদলে দিতে হবে বা পুড়িয়ে নিতে হবে। আর ঐ যে একটু ফটকিরি দেওয়া—গঙ্গাতীরস্থ গ্রামের অভ্যাস, ঐটি সকলের চেয়ে ভাল। ফটকিরির গুঁড়ো যথাসম্ভব মাটি ময়লা ও রোগের বীজ সঙ্গে নিয়ে আস্তে আস্তে তলিয়ে যান। গঙ্গাজল জালায় পুরে একটু ফটকিরির গুঁড়ো দিয়ে থিতিয়ে যে আমরা ব্যবহার করি, ও তোমার বিলিতী ফিলটার-মিলটারের চোদ্দপুরুষের মাথায় ঝাঁটা মারে, কলের জলের দুশো বাপান্ত করে। তবে জল ফুটিয়ে নিতে পারলে নির্ভয় হয় বটে। ফটকিরি-থিতোন জল ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে ব্যবহার কর, ফিলটার-মিলটার খানায় ফেলে দাও। এখন আমেরিকায় বড় বড় যন্ত্রযোগে জলকে একদম বাষ্প করে দেয়, আবার সেই বাষ্পকে জল করে; তারপর আর একটা যন্ত্র দ্বারা বিশুদ্ধ বায়ু তার মধ্যে পুরে দেয়, যে বায়ুটা বাষ্প হবার সময় বেরিয়ে যায় [তার পরিবর্তে]। সে জল অতি বিশুদ্ধ; ঘরে ঘরে এখন দেখছি তাই।
যার দু-পয়সা আছে আমাদের দেশে, সে ছেলেপিলেগুলোকে নিত্য কচুরি মণ্ডা মেঠাই খাওয়াবে!! ভাত রুটি খাওয়া অপমান!! এতে ছেলেপিলেগুলো নড়ে-ভোলা পেটমোটা আসল জানোয়ার হবে না তো কি? এত বড় ষণ্ডা জাত ইংরেজ, এরা ভাজাভুজি মেঠাইমণ্ডার নামে ভয় খায়, যাদের বরফান দেশে বাস, দিনরাত কসরত! আর আমাদের অগ্নিকুণ্ডে বাস, এক ঘর থেকে আর এক ঘরে নড়ে বসতে চাইনি, আর আহার লুচি কচুরি মেঠাই—ঘিয়েভাজা, তেলেভাজা!! সেকেলে পাড়াগেঁয়ে জমিদার এক কথায় দশ ক্রোশ হেঁটে দিত, দুকড়ি কই মাছ কাঁটাসুদ্ধ চিবিয়ে ছাড়ত, ১০০ বৎসর বাঁচত। তাদের ছেলেপিলেগুলো কলকেতায় আসে, চশমা চোখে দেয়, লুচি কচুরি খায়, দিনরাত গাড়ী চড়ে, আর প্রসাবের ব্যামো হয়ে মরে; ‘কলকেত্তা’ই হওয়ার এই ফল!! আর সর্বনাশ করেছে ঐ পোড়া ডাক্তার- বদ্দিগুলো। ওরা সবজান্তা, ওষুধের জোরে ওরা সব করতে পারে। একটু পেট গরম হয়েছে তো অমনি একটু ওষুধ দাও; পোড়া বদ্দিও বলে না যে, দূর কর্ ওষুধ, যা, দুক্রোশ হেঁটে আস্গে যা। নানান্ দেশ দেখছি, নানান্ রকমের খাওয়াও দেখছি। তবে আমাদের ভাত-ডাল ঝোল-চচ্চড়ি শুক্তো মোচার ঘণ্টের জন্য পুনর্জন্ম নেওয়াও বড় বেশী কথা মনে হয় না। দাঁত থাকতে তোমরা যে দাঁতের মর্যাদা বুঝছ না, এই আপসোস। খাবার নকল কি ইংরেজের করতে হবে—সে টাকা কোথায়? এখন আমাদের দেশের উপযোগী যথার্থ বাঙালী খাওয়া, উপাদেয় পুষ্টিকর ও সস্তা খাওয়া পূর্ব-বাঙলায়, ওদের নকল কর যত পার। যত পশ্চিমের দিকে ঝুঁকবে, ততই খারাপ; শেষ কলাইয়ের ডাল আর মাছের টক মাত্র—আধা-সাঁওতালী বীরভূম বাঁকড়োয় দাঁড়াবে!! তোমরা কলকেতার লোক, ঐ যে এক সর্বনেশে ময়দার তালে হাতে-মাটি দেওয়া ময়রার দোকানরূপ সর্বনেশে ফাঁদ খুলে বসেছে, ওর মোহিনীতে বীরভূম বাঁকড়ো ধামাপ্রমাণ মুড়ি দামোদরে ফেলে দিয়েছে, কলায়ের ডাল গেছেন খানায়, আর পোস্তবাটা দেওয়ালে লেপ দিয়েছে, ঢাকা বিক্রমপুরও ঢাঁইমাছ কচ্ছপাদি জলে ছেড়ে দিয়ে ‘সইভ্য’ হচ্ছে!! নিজেরা তো উৎসন্ন গেছ, আবার দেশসুদ্ধকে দিচ্ছ, এই তোমরা বড্ড সভ্য, শহুরে লোক! তোমাদের মুখে ছাই! ওরাও এমনি আহাম্মক যে, ঐ কলকেতার আবর্জনাগুলো খেয়ে উদরাময় হয়ে মর-মর হবে, তবু বলবে না যে, এগুলো হজম হচ্ছে না, বলবে—নোনা লেগেছে!! কোন রকম করে শহুরে হবে!!
খাওয়া দাওয়া সম্বন্ধে তো এই মোট কথা শুনলে। এখন পাশ্চাত্যরা কি খায় এবং তাদের আহারের ক্রমশঃ কেমন পরিবর্তন হয়েছে, তাও কিছু বলি।
গরীব অবস্থায় সকল দেশের খাওয়াই ধান্যবিশেষ; এবং শাক-তরকারি মাছ-মাংস বিলাসের মধ্যে এবং চাটনির মত ব্যবহৃত হয়। যে দেশে যে শস্য প্রধান ফসল, গরীবের প্রধান খাওয়া তাই; অন্যান্য জিনিষ আনুষঙ্গিক। যেমন বাঙলা ও উড়িষ্যায়, মান্দ্রাজ উপকূলে ও মালাবার উপকূলে ভাত প্রধান খাদ্য; তার সঙ্গে ডাল তরকারি, কখনও কখনও মাছ মাংস চাটনিবৎ।
ভারতবর্ষের অন্যান্য সর্বদেশে অবস্থাপন্ন লোকের জন্য গমের রুটি ও ভাত; সাধারণ লোকের নানাপ্রকার বজরা, মড়ুয়া, জনার, ঝিঙ্গোরা প্রভৃতি ধান্যের রুটি প্রধান খাদ্য।
শাক, তরকারি, ডাল, মাছ, মাংস, সমস্তেরই—সমগ্র ভারতবর্ষে ঐ রুটি বা ভাতকে সুস্বাদ করবার জন্য ব্যবহার, তাই ওদের নাম ব্যঞ্জন। এমন কি পাঞ্জাব, রাজপুতানা ও দাক্ষিণাত্য দেশে অবস্থাপন্ন আমিষাশী লোকেরা—এমন কি রাজারাও—যদিও নিত্য নানাপ্রকার মাংস ভোজন করেন, তথাপি রুটি বা ভাতই প্রধান খাদ্য। যে ব্যক্তি আধ সের মাংস নিত্য খায়, সে এক সের রুটি তার সঙ্গে নিশ্চিত খায়।
পাশ্চাত্যদেশে এখন যে সকল গরীব দেশ আছে [তাদের] এবং ধনী দেশের গরীবদের মধ্যে ঐ প্রকার রুটি এবং আলুই প্রধান খাদ্য; মাংসের চাটনি মাত্র—তাও কালেভদ্রে। স্পেন, পোর্তুগাল, ইতালী প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত উষ্ণদেশে যথেষ্ট দ্রাক্ষা জন্মায় এবং দ্রাক্ষা-ওয়াইন অতি সস্তা। সে সকল ওয়াইনে মাদকতা নাই (অর্থাৎ পিপে-খানেক না খেলে তো আর নেশা হবে না এবং তা কেউ খেতে পারে না) এবং যথেষ্ট পুষ্টিকর খাদ্য। সে দেশের দরিদ্র লোকে এজন্য মাছ-মাংসের জায়গায় ঐ দ্রাক্ষারস দ্বারা পুষ্টি সংগ্রহ করে। কিন্তু উত্তরাঞ্চল—যেমন রুশিয়া, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশে দরিদ্র লোকের আহার প্রধানতঃ রাই-নামক ধান্যের রুটি ও এক-আধ টুকরো সুঁটকি মাছ ও আলু।
ইওরোপের অবস্থাপন্ন লোকের এবং আমেরিকার আবালবৃদ্ধবনিতার খাওয়া আর এক রকম—অর্থাৎ রুটি ভাত প্রভৃতি চাটনি এবং মাছ-মাংসই হচ্ছে খাওয়া। আমেরিকায় রুটি-খাওয়া নাই বললেই হয়। মাছ মাছই এল, মাংস মাংসই এল, তাকে অমনি খেতে হবে, ভাত-রুটির সংযোগে নয়। এবং এজন্য প্রত্যেক বারেই থালা বদলান হয়। যদি দশটা খাবার জিনিষ থাকে তো দশবার থালা বদলাতে হয়। যেমন মনে কর, আমাদের দেশে প্রথমে শুধু শুক্তো এল, তারপর থালা বদলে শুধু ডাল এল, আবার থালা বদলে শুধু ঝোল এল, আবার থালা বদলে দুটি ভাত, নয় তো দুখান লুচি ইত্যাদি। এর লাভের মধ্যে এই যে, নানা জিনিষ অল্প অল্প খাওয়া হয়, পেট বোঝাই করা হয় না।
ফরাসী চাল—সকালবেলা ‘কফি’ এবং এক-আধ টুকরো রুটি-মাখম; দুপুরবেলা মাছ মাংস ইত্যাদি মধ্যবিৎ; রাত্রে লম্বা খাওয়া। ইতালী, স্পেন প্রভৃতি জাতিদের ঐ এক রকম; জার্মানরা ক্রমাগতই খাচ্ছে—পাঁচ বার, ছ-বার, প্রত্যেক বারেই অল্পবিস্তর মাংস। ইংরেজরা তিনবার—সকালে অল্প, কিন্তু মধ্যে মধ্যে কফি-যোগ, চা-যোগ আছে। আমেরিকানদের তিনবার—উত্তম ভোজন, মাংস প্রচুর।
তবে এ সকল দেশেই ‘ডিনার’টা প্রধান খাদ্য—ধনী হলে তার ফরাসী রাঁধুনী এবং ফরাসী চাল। প্রথমে একটু আধটু নোনা মাছ বা মাছের ডিম, বা কোন চাটনি বা সবজি। এটা হচ্ছে ক্ষুধাবৃদ্ধি। তারপর সূপ, তারপর আজকাল ফ্যাশন—একটা ফল, তারপর মাছ, তারপর মাংসের একটা তরকারি, তারপর থান-মাংস শূল্য, সঙ্গে কাঁচা সবজি; তারপর আরণ্য মাংস মৃগপক্ষ্যাদি, তারপর মিষ্টান্ন, শেষ কুলপি—‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’। ধনী হলে প্রায় প্রত্যেক বার থাল বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে মদ বদলাচ্ছে—শেরি, ক্ল্যারেট, শ্যামপাঁ ইত্যাদি এবং মধ্যে মধ্যে মদের কুলপি একটু আধটু। থাল বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে কাঁটা-চামচ সব বদলাচ্ছে; আহারান্তে ‘কফি’—বিনা-দুগ্ধ, আসবমদ্য—খুদে খুদে গ্লাসে, এবং ধূমপান। খাওয়ার রকমারীর সঙ্গে মদের রকমারী দেখাতে পারলে তবে ‘বড়োমানুষি চাল’ বলবে। একটা খাওয়ায় আমাদের দেশের একটা মধ্যবিৎ লোক সর্বস্বান্ত হতে পারে, এমন খাওয়ার ধূম এরা করে।
আর্যরা একটা পীঠে বসত, একটা পীঠে ঠেসান দিত এবং জলচৌকির উপর থালা রেখে এক থালাতেই সকল খাওয়া খেত। ঐ চাল এখনও পাঞ্জাব, রাজপুতানা, মহারাষ্ট্র ও গুর্জর দেশে বিদ্যমান। বাঙালী, উড়ে, তেলিঙ্গী, মালাবারী প্রভৃতি মাটিতেই ‘সাপড়ান’। মহীশূরের মহারাজও মাটিতে আঙট পাতে ভাত ডাল খান। মুসলমানেরা চাদর পেতে খায়। বর্মি, জাপানী প্রভৃতি উপু হয়ে বসে মাটিতে থাল রেখে খায়। চীনেরা টেবিলে খায়; চেয়ারে বসে, কাটি ও চামচ-যোগে খায়। রোমান ও গ্রীকরা কোচে শুয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাত দিয়ে খেত। ইওরোপীরা টেবিলের ওপর হতে কেদারায় বসে—হাত দিয়ে পূর্বে খেত, এখন নানাপ্রকার কাঁটা-চামচ।
চীনের খাওয়াটা কসরত বটে—যেমন আমাদের পানওয়ালীরা দুখানা সম্পূর্ণ আলাদা লোহার পাতকে হাতের কায়দায় কাঁচির কাজ করায়, চীনেরা তেমনি দুটো কাটিকে ডান হাতের দুটো আঙুল আর মুঠোর কায়দায় চিমটের মত করে শাকাদি মুখে তোলে। আবার দুটোকে একত্র করে একবাটি ভাত মুখের কাছে এনে, ঐ কাটিদ্বয়নির্মিত খোন্তাযোগে ঠেলে ঠেলে মুখে পোরে।
সকল জাতিরই আদিম পুরুষ নাকি প্রথম অবস্থায় যা পেত তাই খেত। একটা জানোয়ার মারলে, সেটাকে এক মাস ধরে খেত; পচে উঠলেও তাকে ছাড়ত না। ক্রমে সভ্য হয়ে উঠল, চাষ বাস শিখলে; আরণ্য পশুকুলের মত একদিন বেদম খাওয়া, আর দু-পাঁচ দিন অনশন—ঘুচল; আহার নিত্য জুটতে লাগল; কিন্তু পচা জিনিষ খাবার চাল একটা দাঁড়িয়ে গেল। পচা দুর্গন্ধ একটা যা হয় কিছু, আবশ্যক ভোজ্য হতে নৈমিত্তিক আদরের চাটনি হয়ে দাঁড়াল।
এস্কুইমো জাতি বরফের মধ্যে বাস করে। শস্য সে দেশে একদম জন্মায় না; নিত্য ভোজন—মাছ মাংস; ১০।৫ দিনে অরুচি বোধ হলে একটুকরো পচা মাংস খায়— অরুচি সারে।
ইওরোপীরা এখনও বন্য পশু পক্ষীর মাংস না পচলে খায় না। তাজা পেলেও তাকে টাঙিয়ে রাখে—যতক্ষণ না পচে দুর্গন্ধ হয়। কলকেতায় পচা হরিণের মাংস পড়তে পায় না; রসা ভেটকির উপাদেয়তা প্রসিদ্ধ। ইংরেজদের পনীর যত পচবে, যত পোকা কিলবিল করবে, ততই উপাদেয়। পলায়মান পনীর-কীটকেও তাড়া করে ধরে মুখে পুরবে—তা নাকি বড়ই সুস্বাদ!! নিরামিষাশী হয়েও প্যাঁজ-লশুনের জন্য ছোঁক ছোঁক করবে, দক্ষিণী বামুনের প্যাঁজ-লশুন নইলে খাওয়াই হবে না। শাস্ত্রকারেরা সে পথও বন্ধ করে দিলেন। প্যাঁজ, লশুন, গেঁয়ো শোর, গেঁয়ো মুরগী খাওয়া এক জাতের [পক্ষে] পাপ, সাজা—জাতিনাশ। যারা শুনলে এ কথা তারা ভয়ে প্যাঁজ-লশুন ছাড়লে, কিন্তু তার চেয়ে বিষমদুর্গন্ধ হিং খেতে আরম্ভ করলে! পাহাড়ী গোঁড়া হিঁদু লশুনে-ঘাস প্যাঁজ-লশুনের জায়গায় ধরলে। ও-দুটোর নিষেধ তো আর পুঁথিতে নেই!!
সকল ধর্মেই খাওয়া-দাওয়ার একটা বিধি-নিষেধ আছে; নাই কেবল ক্রিশ্চানী ধর্মে। জৈন-বৌদ্ধয় মাছ মাংস খাবেই না। জৈন আবার যা মাটির নীচে জন্মায়, আলু মূলো প্রভৃতি—তাও খাবে না; খুঁড়তে গেলে পোকা মরবে, রাত্রে খাবে না—অন্ধকারে পাছে পোকা খায়।
য়াহুদীরা যে মাছে আঁশ নেই তা খাবে না, শোর খাবে না, যে জানোয়ার দ্বিশফ১৩ নয় এবং জাবর কাটে না, তাকেও খাবে না। আবার বিষম কথা, দুধ বা দুগ্ধোৎপন্ন কোন জিনিষ যদি হেঁশেলে ঢোকে যখন মাছ মাংস রান্না হচ্ছে, তো সে সব ফেলে দিতে হবে। এ বিধায় গোঁড়া য়াহুদী অন্য কোন জাতির রান্না খায় না। আবার হিঁদুর মত য়াহুদীরা বৃথা-মাংস১৪ খায় না। যেমন বাঙলা দেশে ও পাঞ্জাবে মাংসের নাম ‘মহাপ্রসাদ’। য়াহুদীরা সেই প্রকার ‘মহাপ্রসাদ’ অর্থাৎ যথানিয়মে বলিদান না হলে মাংস খায় না। কাজেই হিঁদুর মত য়াহুদীদেরও যে-সে দোকান হতে মাংস কেনবার অধিকার নেই। মুসলমানরা য়াহুদীদের অনেক নিয়ম মানে, তবে অত বাড়াবাড়ি করে না; দুধ, মাছ, মাংস একসঙ্গে খায় না এইমাত্র, ছোঁয়াছুঁয়ি হলেই যে সর্বনাশ, অত মানে না। য়াহুদীদের আর হিঁদুদের অনেক সৌসাদৃশ্য—খাওয়া সম্বন্ধে; তবে য়াহুদীরা বুনো শোরও খায় না, হিঁদুরা খায়। পাঞ্জাবে মুসলমান-হিঁদুর বিষম সংঘাত থাকায়, বুনো শোর আবার হিঁদুদের একটা অত্যাবশ্যক খাওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজপুতদের মধ্যে বুনো শোর শিকার করে খাওয়া একটা ধর্মবিশেষ। দক্ষিণ-দেশে ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্যান্য জাতের মধ্যে গেঁয়ো শোরও যথেষ্ট চলে। হিঁদুরা বুনো মুরগী খায়, গেঁয়ো খায় না। বাঙলা দেশ থেকে নেপাল ও আকাশ্মীর হিমালয়—এক রকম চালে চলে। মনূক্ত খাওয়ার প্রথা এই অঞ্চলে সমধিক বিদ্যমান আজও।
কিন্তু কুমায়ুন হতে আরম্ভ করে কাশ্মীর পর্যন্ত—বাঙালী, বেহারী, প্রয়াগী ও নেপালীর চেয়েও মনুর আইনের বিশেষ প্রচার। যেমন বাঙালী মুরগী বা মুরগীর ডিম খায় না, কিন্তু হাঁসের ডিম খায়, নেপালীও তাই; কিন্তু কুমায়ুন হতে তাও চলে না। কাশ্মীরীরা বুনো হাঁসের ডিম পেলে সুখে খায়, গ্রাম্য নয়।
এলাহাবাদের পর হতে, হিমালয় ছাড়া, ভারতবর্ষের অন্য সমস্ত দেশে—যে ছাগল খায়, সে মুরগীও খায়।
এই সকল বিধি-নিষেধের মধ্যে অধিকাংশই যে স্বাস্থ্যের জন্য, তার সন্দেহ নেই। তবে সকল জায়গায় সমান পারে না। শোর মুরগী যা তা খায়, অতি অপরিষ্কার জানোয়ার, কাজেই নিষেধ; বুনো জানোয়ার কি খায় কে দেখতে যায় বল। তা ছাড়া রোগ—বুনো জানোয়ারের কম!
দুধ—পেটে অম্লাধিক্য হলে একেবারে দুষ্পাচ্য, এমন কি একদমে এক গ্লাস দুধ খেয়ে কখনও কখনও সদ্য মৃত্যু ঘটেছে। দুধ—যেমন শিশুতে মাতৃস্তন্য পান করে, তেমনি ঢোকে ঢোকে খেলে তবে শীঘ্র হজম হয়, নতুবা অনেক দেরী লাগে। দুধ একটা গুরুপাক জিনিষ, মাংসের সঙ্গে হজম আরও গুরুপাক, কাজেই এ নিষেধ য়াহুদীদের মধ্যে। মূর্খ মাতা কচি ছেলেকে জোর করে ঢক ঢক করে দুধ খাওয়ায়, আর দু-ছ মাসের মধ্যে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদে!! এখনকার ডাক্তারেরা পূর্ণবয়স্কদের জন্যও এক পোয়া দুধ আস্তে আস্তে আধ ঘণ্টায় খাওয়ার বিধি দেন; কচি ছেলেদের জন্য ‘ফিডিং বটল্’ ছাড়া উপায়ান্তর নেই। মা ব্যস্ত কাজে—দাসী একটা ঝিনুকে করে ছেলেটাকে চেপে ধরে সাঁ সাঁ দুধ খাওয়াচ্ছে!! লাভের মধ্যে এই যে, রোগা-পটকাগুলো আর বড় ‘বড়’ হচ্ছে না, তারা ঐখানেই জন্মের শোধ দুধ খাচ্ছে; আর যেগুলো এ বিষম খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে ঠেলে ঠুলে উঠছে, সেগুলো প্রায় সুস্থকায় এবং বলিষ্ঠ।
সেকেলে আঁতুড় ঘর, দুধ খাওয়ানো প্রভৃতির হাত থেকে যে ছেলেপিলেগুলো বেঁচে উঠত, সেগুলো এক রকম সুস্থ সবল আজীবন থাকত! মা ষষ্ঠীর সাক্ষাৎ বরপুত্র না হলে কি আর সেকালে একটা ছেঁলে বাঁচত!! সে তাপসেঁক, দাগাফোঁড়া প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বেঁচে ওঠা, প্রসূতি ও প্রসূত—উভয়েরই পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। হরিল্লুঠের তুলসীতলার খোকা ও মা—দুই প্রায় বেঁচে যেত, সাক্ষাৎ যমরাজের দূত চিকিৎসকদের হাত এড়াত বলে।
সকল দেশেই কাপড়ে চোপড়ে কিছু না কিছু ভদ্রতা লেগে থাকে। ‘ব্যাতন না জানলে বোদ্র অবোদ্র বুঝবো ক্যামনে?’ শুধু ব্যাতনে নয়, ‘কাপড় না দেখলে ভদ্র অভদ্র বুঝবো ক্যামনে’ সর্বদেশে কিছু না কিছু চলন। আমাদের দেশে শুধু গায়ে ভদ্রলোক রাস্তায় বেরুতে পারে না, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে আবার পাগড়ি মাথায় না দিয়ে কেউই রাস্তায় বেরোয় না। পাশ্চাত্য দেশে ফরাসীরা বরাবর সকল বিষয়ে অগ্রণী—তাদের খাওয়া, তাদের পোষাক সকলে নকল করে। এখনও ইওরোপের ভিন্ন ভিন্ন দেশে বিশেষ বিশেষ পোষাক বিদ্যমান; কিন্তু ভদ্র হলেই, দুপয়সা হলেই অমনি সে পোষাক অন্তর্ধান হন, আর ফরাসী পোষাকের আবির্ভাব। কাবুলী পাজামা-পরা ওলন্দাজী চাষা, ঘাগরা-পরা গ্রীক, তিব্বতী-পোষাক-পরা রুশ যেমন ‘বোদ্র’ হয়, অমনি ফরাসী কোট প্যাণ্টালুনে আবৃত হয়। মেয়েদের তো কথাই নেই, তাদের পয়সা হয়েছে কি, পারি রাজধানীর পোষাক পরতে হবেই হবে। আমেরিকা, ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও জার্মানী এখন ধনী জাত; ও-সব দেশে সকলেরই একরকম পোষাক—সেই ফরাসী নকল। তবে আজকাল পারি অপেক্ষা লণ্ডনে পুরুষদের পোষাক ভব্যতর, তাই পুরুষদের পোষাক ‘লণ্ডন মেড’ আর মেয়েদের পারিসিয়েন নকল। যাদের বেশী পয়সা, তারা ঐ দুই স্থান হতে তৈয়ারী পোষাক বারমাস ব্যবহার করে। আমেরিকা বিদেশী আমদানী পোষাকের উপর ভয়ানক মাসুল বসায়, সে মাসুল দিয়েও পারি-লণ্ডনের পোষাক পরতে হবে। এ কাজ একা আমেরিকানরা পারে—আমেরিকা এখন কুবেরের প্রধান আড্ডা!
প্রাচীন আর্যজাতিরা ধুতি-চাদর পরত; ক্ষত্রিয়দের ইজার ও লম্বা জামা—লড়ায়ের সময়। অন্য সময় সকলেরই ধুতি-চাদর। কিন্তু পাগড়িটা ছিল। অতি প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে মেয়ে-মদ্দে পাগড়ি পড়ত। এখন যেমন বাঙলা ছাড়া অন্যান্য প্রদেশে কপনি-মাত্র থাকলেই শরীর ঢাকার কাজ হল, কিন্তু পাগড়িটা চাই; প্রাচীনকালেও তাই ছিল—মেয়ে-মদ্দে। বৌদ্ধদের সময়ের যেসকল ভাস্কর্যমূর্তি পাওয়া যায়, তারা মেয়ে-মদ্দে কৌপীন-পরা। বুদ্ধদেবের বাপ কপনি পরে বসেছেন সিংহাসনে; তদ্বৎ মাও বসেছেন—বাড়ার ভাগ, এক-পা মল ও এক-হাত বালা; কিন্তু পাগড়ি আছে!! সম্রাট্ ধর্মাশোক ধুতি পরে, চাদর গলায় ফেলে, আদুড় গায়ে একটা ডমরু-আকার আসনে বসে নাচ দেখছেন! নর্তকীরা দিব্যি উলঙ্গ; কোমর থেকে কতকগুলো ন্যাকড়ার ফালি ঝুলছে। মোদ্দা পাগড়ি আছে। নেবু টেবু সব ঐ পাগড়িতে। তবে রাজসামন্তরা ইজার ও লম্বা জামা পরা—চোস্ত ইজার ও চোগা। সারথি নলরাজ এমন রথ চালালেন যে, রাজা ঋতুপর্ণের চাদর কোথায় পড়ে রইল; রাজা ঋতুপর্ণ আদুড় গায়ে বে করতে চললেন। ধুতি-চাদর আর্যদের চিরন্তন পোষাক, এইজন্যই ক্রিয়াকর্মের বেলায় ধুতি-চাদর পরতেই হয়।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমানদের পোষাক ছিল ধুতি-চাদর; একথান বৃহৎ কাপড় ও চাদর—নাম ‘তোগা’, তারি অপভ্রংশ এই ‘চোগা’। তবে কখনও কখনও একটা পিরানও পরা হত। যুদ্ধকালে ইজার জামা। মেয়েদের একটা খুব লম্বাচৌড়া চারকোণা জামা, যেমন দুখানা বিছানার চাদর লম্বালম্বি সেলাই করা, চওড়ার দিক্ খোলা। তার মধ্যে ঢুকে কোমরটা বাঁধলে দুবার—একবার বুকের নীচে, একবার পেটের নীচে। তারপর উপরের খোলা দুপাট দুহাতের উপর দু জায়গায় তুলে মোটা ছুঁচ দিয়ে আটকে দিলে যেমন—উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ীরা কম্বল পরে। সে পোষাক অতি সুন্দর ও সহজ। ওপরে একখান চাদর।
কাটা কাপড় এক ইরানীরা প্রাচীনকাল হতে পরত। বোধ হয় চীনেদের কাছে শেখে। চীনেরা হচ্ছে সভ্যতার অর্থাৎ ভোগবিলাসের সুখস্বচ্ছন্দতার আদিগুরু। অনাদিকাল হতে চীনে টেবিলে খায়, চেয়ারে বসে যন্ত্র তন্ত্র কত খাওয়ার জন্য, এবং কাটা পোষাক নানা রকম, ইজার-জামা টুপিটাপা পরে।
সিকন্দর শা ইরান জয় করে, ধুতি-চাদর ফেলে ইজার পরতে লাগলেন। তাতে তাঁর স্বদেশী সৈন্যরা এমন চটে গেল যে বিদ্রোহ হবার মত হয়েছিল। মোদ্দা সিকন্দর নাছাড় পুরুষ—ইজার-জামা চালিয়ে দিলেন।
গরমদেশে কাপড়ের দরকার হয় না। কৌপীনমাত্রেই লজ্জানিবারণ, বাকী কেবল অলঙ্কার। ঠাণ্ডা দেশে শীতের চোটে অস্থির, অসভ্য অবস্থায় জানোয়ারের ছাল টেনে পরে, ক্রমে কম্বল পরে, ক্রমে জামা-পাজামা ইত্যাদি নানানখানা হয়। তারপর আদুড় গায়ে গয়না পরতে গেলেই তো ঠাণ্ডায় মৃত্যু, কাজেই অলঙ্কার-প্রিয়তাটা ঐ কাপড়ের উপর গিয়ে পড়ে। যেমন আমাদের দেশে গয়নার ফ্যাশন বদলায়, এদের তেমনি ঘড়ি ঘড়ি বদলাচ্ছে কাপড়ের ফ্যাশন।
ঠাণ্ডা দেশমাত্রেই এজন্য সর্বদা সর্বাঙ্গ না ঢেকে কারু সামনে বেরুবার যো নেই। বিলেতে ঠিক ঠিক পোষাকটি না পরে ঘরের বাইরে যাবার যো নেই। পাশ্চাত্য দেশের মেয়েদের পা দেখান বড়ই লজ্জা, কিন্তু গলা ও বুকের খানিকটা দেখান যেতে পারে। আমাদের দেশে মুখ দেখান বড়ই লজ্জা; কিন্তু সে ঘোমটা টানার চোটে শাড়ী কোমরে ওঠেন উঠুন, তায় দোষ নেই। রাজপুতানার ও হিমাচলের অষ্টাঙ্গ ঢেকে তলপেট দেখানো!
পাশ্চাত্য দেশের নর্তকী ও বেশ্যারা লোক ভুলাবার জন্য অনাচ্ছিদিত। এদের নাচের মানে, তালে তালে শরীর অনাবৃত করে দেখানো। আমাদের দেশের আদুড় গা ভদ্রলোকের মেয়ের; নর্তকী বেশ্যা সর্বাঙ্গ ঢাকা। পাশ্চাত্য দেশে মেয়ে ছেলে সর্বদাই গা ঢাকা, গা আদুড় করলে আকর্ষণ বেশী হয়; আমাদের দেশে দিনরাত আদুড় গা, পোষাক পরে ঢেকেঢুকে থাকলেই আকর্ষণ অধিক। মালাবার দেশে মেয়ে-মদ্দের কৌপীনের উপর বহির্বাসমাত্র, আর বস্ত্রমাত্রই নেই। বাঙালীরও তাই, তবে কৌপীন নাই এবং পুরুষদের সাক্ষাতে মেয়েরা গা-টা মুড়ি-ঝুড়ি দিয়ে ঢাকে।
পাশ্চাত্য দেশে পুরুষে পুরুষে সর্বাঙ্গ অক্লেশে উলঙ্গ হয়—আমাদের মেয়েদের মত। বাপ-ছেলেয় সর্বাঙ্গ উলঙ্গ করে স্নানাদি করে, দোষ নেই। কিন্তু মেয়েদের সামনে, বা রাস্তা-ঘাটে, বা নিজের ঘর ছাড়া—সর্বাঙ্গ ঢাকা চাই।
এক চীনে ছাড়া সর্বদেশেই এ লজ্জা সম্বন্ধে অনেক অদ্ভুত বিষয় দেখছি—কোন বিষয়ে বেজায় লজ্জা, আবার তদপেক্ষা অধিক লজ্জাকর বিষয়ে আদতে লজ্জা নেই। চীনে মেয়ে-মদ্দে সর্বদা আপাদমস্তক ঢাকা। চীনে কনফুছের চেলা, বুদ্ধের চেলা, বড় নীতি-দুরস্ত; খারাপ কথা, চাল, চলন—তৎক্ষণাৎ সাজা। ক্রিশ্চান পাদ্রী গিয়ে চীনে ভাষায় বাইবেল ছাপিয়ে ফেললে। এখন বাইবেল-পুরাণ হচ্ছেন হিঁদুর পুরাণের চোদ্দ পুরুষ—সে দেবতা-মানুষের অদ্ভুত কেলেঙ্কার পড়ে চীনে তো চটে অস্থির। বললে, ‘এই বই কিছুতেই এ দেশে চালানো হবে না, এ তো অতি অশ্লীল কেতাব’; তার উপর পাদ্রিনী বুকখোলা সান্ধ্য পোষাক পরে, পর্দার বার হয়ে চীনেদের নিমন্ত্রণে আহ্বান করলেন। চীনে মোটাবুদ্ধি, বললে—‘সর্বনাশ! এই খারাপ বই পড়িয়ে, আর এই মাগীদের আদুড় গা দেখিয়ে, আমাদের ছোঁড়া বইয়ে দিতে এ ধর্ম এসেছে।’ এই হচ্ছে চীনের ক্রিশ্চানের উপর মহাক্রোধ। নতুবা চীনে কোন ধর্মের উপর আঘাত করে না। শুনছি যে, পাদ্রীরা এখন অশ্লীল অংশ ত্যাগ করে বাইবেল ছাপিয়েছে; কিন্তু চীনে তাতে আরও সন্দিহান।
আবার এ পাশ্চাত্য দেশে দেশবিশেষে লজ্জাঘেন্নার তারতম্য আছে। ইংরেজ ও আমেরিকানের লজ্জা-শরম একরকম; ফরাসীর আর একরকম; জার্মানের আর একরকম। রুশ আর তিব্বতী বড় কাছাকাছি; তুরস্কের আর এক ডোল; ইত্যাদি।
আমাদের দেশের চেয়ে ইওরোপে ও আমেরিকায় মলমূত্রাদি ত্যাগে বড়ই লজ্জা। আমরা হচ্ছি নিরামিষভোজী—এক কাঁড়ি ঘাস পাতা আহার। আবার বেজায় গরম দেশ, এক দমে লোটা-ভর জল খাওয়া চাই। পশ্চিমী চাষা সেরভর ছাতু খেলে; তারপর পাতকোকে পাতকোই খালি করে ফেললে জল খাওযার চোটে। গরমিকালে আমরা বাঁশ [বাঁশের নল] বার করে দিই লোককে জল খাওয়াতে। কাজেই সে সব যায় কোথা, বল? দেশ বিষ্ঠামূত্রময় না হয়ে যায় কোথা? গরুর গোয়াল, ঘোড়ার আস্তাবল, আর বাঘ-সিঙ্গির পিঁজরার তুলনা কর দিকি!
কুকুর আর ছাগলের তুলনা কর দিকি! পাশ্চাত্যদেশের আহার মাংসময়, কাজেই অল্প; আর ঠাণ্ডা দেশে জল খাওয়া নেই বললেই হয়। ভদ্রলোকের খুদে খুদে গ্লাসে একটু মদ খাওয়া। ফরাসীরা জলকে বলে ব্যাঙের রস, তা কি খাওয়া চলে? এক আমেরিকান জল খায় কিছু বেশী, কারণ ওদের দেশ গরমিকালে ভয়ঙ্কর গরম, নিউ ইয়র্ক কলকেতার চেয়েও গরম। আর জার্মানরা বড্ড ‘বিয়র’ পান করে—কিন্তু সে খাবার সঙ্গে নয় বড়।
ঠাণ্ডা দেশে সর্দি লাগবার সদাই সম্ভাবনা; গরম দেশে খেতে বসে ঢক ঢক জল। এরা কাজেই না হেঁচে যায় কোথা, আর আমরা ঢেঁকুর না তুলেই বা যাই কোথা? এখন দেখ নিয়ম—এ দেশে খেতে বসে যদি ঢেঁকুর তুলেছ, তো সে বেয়াদবির আর পার নেই। কিন্তু রুমাল বার করে তাতে ভড় ভড় করে সিকনি ঝাড়ো, এদের তায় ঘেন্না হয় না। আমাদের ঢেঁকুর না তুললে নিমন্ত্রক খুশীই হন না; কিন্তু পাঁচ জনের সঙ্গে খেতে খেতে ভড় ভড় করে সিকনি ঝাড়াটা কেমন?
ইংলণ্ডে, আমেরিকায় মলমূত্রের নামটি আনবার যো নেই মেয়েদের সামনে। পায়খানায় যেতে হবে চুরি করে। পেট গরম হয়েছে, বা পেটের কোন প্রকার অসুখের কথা মেয়েদের সামনে বলবার যো নেই, অবশ্য বুড়ী-টুড়ি আলাপী আলাদা কথা। মেয়েরা মলমূত্র চেপে মরে যাবে, তবুও পুরুষের সামনে ও-নামটিও আনবে না।
ফরাসী দেশে অত নয়। মেয়েদের মলমূত্রের স্থানের পাশেই পুরুষদের; এরা এ-দোর দিয়ে যাচ্ছে, ওরা ও-দোর দিয়ে যাচ্ছে; অনেক স্থানে এক দোর, ঘর আলাদা। রাস্তার দু ধারে মাঝে মাঝে প্রসাবের স্থান, তা খালি পিঠটা ঢাকা পড়ে মাত্র, মেয়েরা দেখছে, তায় লজ্জা নাই—আমাদের মত। অবশ্য মেয়েরা অমন অনাবৃত স্থানে যায় না। জার্মানদের আরও কম।
ইংরেজ ও আমেরিকানরা কথাবার্তায়ও বড় সাবধান, মেয়েদের সামনে। সে ‘ঠ্যাঙ’ বলবার পর্যন্ত যো নেই। ফরাসীরা আমাদের মত মুখখোলা; জার্মান রুশ প্রভৃতি সকলের সামনে খিস্তি করে।
কিন্তু প্রেম-প্রণয়ের কথা অবাধে মায় ছেলে, ভায়ে বোনে বাপে—তা চলেছে। বাপ মেয়ের প্রণয়ীর (ভবিষ্যৎ বরের) কথা নানা রকম ঠাট্টা করে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করছে। ফরাসীর মেয়ে তায় অবনতমুখী, ইংরেজের মেয়ে ব্রীড়াশীলা, আর মার্কিনের মেয়ে চোটপাট জবাব দিচ্ছে। চুম্বন, আলিঙ্গনটা পর্যন্ত দোষাবহ নয়, অশ্লীল নয়। সে সব কথা কওয়া চলে। আমেরিকায় পরিবারের পুরুষবন্ধুও আত্মীয়তা হলে বাড়ীর যুবতী মেয়েদেরও শেকহ্যাণ্ডের স্থলে চুম্বন করে। আমাদের দেশে প্রেম-প্রণয়ের নামগন্ধটি পর্যন্ত গুরুজনের সামনে হবার যো নেই।
এদের অনেক টাকা। অতি পরিষ্কার এবং কেতাদুরস্ত কাপড় না পরলে সে ছোটলোক—তার সমাজে যাবার যো নেই। প্রত্যহ ধোপদস্ত কামিজ, কলার প্রভৃতি দুবার তিনবার বদলাতে হবে ভদ্রলোককে! গরীবরা অত শত পারে না; ওপরের কাপড়ে একটি দাগ, একটি কোঁচকা থাকলেই মুশকিল। নখের কোণে, হাতে, মুখে একটু ময়লা থাকলেই মুশকিল। গরমিতে পচেই মর আর যাই হোক, দস্তানা পরে যেতেই হবে, নইলে রাস্তায় হাত ময়লা হয় এবং সে হাত কোন স্ত্রীলোকের হাতে দিয়ে সম্ভাষণ করাটা অতি অভদ্রতা। ভদ্রসমাজে থুথু ফেলা বা কুলকুচো করা বা দাঁত খোঁটা ইত্যাদি করলে তৎক্ষণাৎ চণ্ডালত্ব-প্রাপ্তি!!
ধর্ম এদের শক্তিপূজা, আধা বামাচার রকমের; পঞ্চ মকারের শেষ অঙ্গগুলো বাদ দিয়ে। ‘বামে বামা ... দক্ষিণে পানপাত্রং ... অগ্রে ন্যস্তং মরীচসহিতং শূকরস্যোষ্ণমাংসং ... কৌলো ধর্মঃ পরমগহনো যোগিনামপ্যগম্যঃ’।১৫ প্রকাশ্য, সর্বসাধারণ, শক্তিপূজা বামাচার—মাতৃভাবও যথেষ্ট। প্রটেষ্টাণ্ট তো ইওরোপে নগণ্য—ধর্ম তো ক্যাথলিক। সে-ধর্মে যিহোবা যীশু ত্রিমূর্তি—সব অন্তর্ধান, জেগে বসছেন ‘মা’! শিশু যীশু-কোলে ‘মা’। লক্ষ স্থানে, লক্ষ রকমে, লক্ষ রূপে অট্টালিকায়, বিরাট মন্দিরে, পথপ্রান্তে, পর্ণকুটিরে ‘মা’ ‘মা’ ‘মা’ ! বাদশা ডাকছে ‘মা’, জঙ্গ বাহাদুর (Field-marshal) সেনাপতি ডাকছে ‘মা’, ধ্বজাহস্তে সৈনিক ডাকছে ‘মা’, পোতবক্ষে নাবিক ডাকছে ‘মা’, জীর্ণবস্ত্র ধীবর ডাকছে ‘মা’, রাস্তার কোণে ভিখারী ডাকছে ‘মা’। ‘ধন্য মেরী’, ‘ধন্য মেরী’—দিনরাত এ ধ্বনি উঠছে।
আর মেয়ের পুজো। এ শক্তিপুজো কেবল কাম নয়, কিন্তু যে শক্তিপুজো কুমারী-সধবা পুজো আমাদের দেশে কাশী কালীঘাট প্রভৃতি তীর্থস্থানে হয়, বাস্তবিক প্রত্যক্ষ, কল্পনা নয়—সেই শক্তিপুজো। তবে আমাদের পুজো ঐ তীর্থস্থানেই, সেইক্ষণ মাত্র; এদের দিনরাত, বার মাস। আগে স্ত্রীলোকের আসন, আগে শক্তির বসন, ভূষণ, ভোজন, উচ্চ স্থান, আদর, খাতির। এ যে-সে স্ত্রীলোকের পুজো, চেনা-অচেনার পুজো, ভদ্রকুলের তো কথাই নাই, রূপসী যুবতীর তো কথাই নাই। এ পুজো ইওরোপে আরম্ভ করে মূরেরা—মুসলমান আরবমিশ্র মূরেরা—যখন তারা স্পেন বিজয় করে আট শতাব্দী রাজত্ব করে, সেই সময়। তাদের থেকে ইওরোপে সভ্যতার উন্মেষ, শক্তিপূজার অভ্যুদয়। মূর ভুলে গেল, শক্তিহীন শ্রীহীন হল। স্বস্থানচ্যুত হয়ে আফ্রিকার কোণে অসভ্যপ্রায় হয়ে বাস করতে লাগল, আর সে শক্তির সঞ্চার হল ইওরোপে, ‘মা’ মুসলমানকে ছেড়ে উঠলেন ক্রিশ্চানের ঘরে।
এ ইওরোপ কি? কালো, আদকালা, হলদে, লাল, এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকার সমস্ত মানুষ এদের পদানত কেন? এরা কেনই বা এ কলিযুগের একাধিপতি?
এ ইওরোপ বুঝতে গেলে পাশ্চাত্য ধর্মের আকর ফ্রাঁস থেকে বুঝতে হবে। পৃথিবীর আধিপত্য ইওরোপে, ইওরোপের মহাকেন্দ্র পারি। পাশ্চাত্য সভ্যতা, রীতিনীতি, আলোক-আঁধার, ভাল-মন্দ, সকলের শেষ পরিপুষ্ট ভাব এইখানে—এই পারি নগরীতে।
এ পারি এক মহাসমুদ্র—মণি মুক্তা প্রবাল যথেষ্ট, আবার মকর কুম্ভীরও অনেক। এই ফ্রাঁস ইওরোপের কর্মক্ষেত্র। সুন্দর দেশ—চীনের কতক অংশ ছাড়া এমন দেশ আর কোথাও নেই। নাতিশীতোষ্ণ, অতি উর্বরা, অতিবৃষ্টি নাই, অনাবৃষ্টিও নাই, সে নির্মল আকাশ, মিঠে রৌদ্র, ঘাসের শোভা, ছোট ছোট পাহাড়, চিনার বাঁশ প্রভৃতি গাছ, ছোট ছোট নদী, ছোট ছোট প্রস্রবণ—সে জলে রূপ, স্থলে মোহ, বায়ুতে উন্মত্ততা, আকাশে আনন্দ। প্রকৃতি সুন্দর, মানুষও সৌন্দর্যপ্রিয়। আবালবৃদ্ধবনিতা, ধনী, দরিদ্র তাদের ঘোর-দোর ক্ষেত-ময়দান ঘষে মেজে, সাজিয়ে গুজিয়ে ছবিখানি করে রাখছে। এক জাপান ছাড়া এ ভাব আর কোথাও নাই। সেই ইন্দ্রভুবন অট্টালিকাপুঞ্জ, নন্দনকানন উদ্যান, উপবন—মায় চাষার ক্ষেত, সকলের মধ্যে একটু রূপ—একটু সুচ্ছবি দেখবার চেষ্টা এবং সফলও হয়েছে। এই ফ্রাঁস প্রাচীনকাল হতে গোলওয়া (Gauls), রোমক, ফ্রাঁ (Franks) প্রভৃতি জাতির সংঘর্ষভূমি; এই ফ্রাঁ জাতি রোমসম্রাজ্যের বিনাশের পর ইওরোপে একাধিপত্য লাভ করলে, এদের বাদশা শার্লামাঞন (Charlemagne) ইওরোপে ক্রিশ্চান ধর্ম তলওয়ারের দাপটে চালিয়ে দিলেন এই ফ্রাঁ জাতি হতেই এশিয়াখণ্ডে ইওরোপের প্রচার, তাই আজও ইওরোপী আমাদের কাছে ফ্রাঁকি, ফেরিঙ্গী, প্লাঁকি, ফিলিঙ্গ ইত্যাদি।
সভ্যতার আকর প্রাচীন গ্রীস ডুবে গেল। রাজচক্রবর্তী রোম বর্বর (Barbars) আক্রমণ-তরঙ্গে তলিয়ে গেল। ইওরোপের আলো নিবে গেল, এদিকে আর এক অতি বর্বরজাতি এশিয়াখণ্ডে প্রাদুর্ভাব হল—আরবজাতি। মহাবেগে সে আরব-তরঙ্গ পৃথিবী ছাইতে লাগল। মহাবল পারস্য আরবের পদানত হল, মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে হল, কিন্তু তার ফলে মুসলমান ধর্ম আর এক রূপ ধারণ করলে; সে আরবী ধর্ম আর পারসিক সভ্যতা সম্মিলিত হল।
আরবের তলওয়ারের সঙ্গে সঙ্গে পারস্য সভ্যতা ছড়িয়ে পড়তে লাগল, যে পারস্য সভ্যতা প্রাচীন গ্রীস ও ভারতবর্ষ হতে নেওয়া। পূর্ব পশ্চিম দুদিক হতে মহাবলে মুসলমান তরঙ্গ ইওরোপের উপর আঘাত করলে, সঙ্গে সঙ্গে বর্বর অন্ধ ইওরোপে জ্ঞানালোক ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রাচীন গ্রীকদের বিদ্যা বুদ্ধি শিল্প বর্বরাক্রান্ত ইতালীতে প্রবেশ করলে, ধরা-রাজধানী রোমের মৃত শরীরে প্রাণস্পন্দন হতে লাগল—সে স্পন্দন ফ্লরেন্স নগরীতে প্রবল রূপ ধারণ করলে, প্রাচীন ইতালী নবজীবনে বেঁচে উঠতে লাগল, এর নাম রেনেসাঁ (Renaissance)—নবজন্ম। কিন্তু সে নবজন্ম হল ইতালীর। ইওরোপের অন্যান্য অংশের তখন প্রথম জন্ম। সে ক্রিশ্চানী ষোড়শ শতাব্দীতে—যখন আকবর, জাহাঁগীর, শাজাহাঁ প্রভৃতি মোগল সম্রাট্ ভারতে মহাবল সাম্রাজ্য তুলেছেন, সেই সময় ইওরোপের জন্ম হল।
ইতালী বুড়ো জাত, একবার সাড়াশব্দ দিয়ে আবার পাশ ফিরে শুলো। সে সময় নানা কারণে ভারতবর্ষও জেগে উঠেছিল কিছু, আকবর হতে তিন পুরুষের রাজত্বে বিদ্যা বুদ্ধি শিল্পের আদর যথেষ্ট হয়েছিল, কিন্তু অতি বৃদ্ধ জাত নানা কারণে আবার পাশ ফিরে শুলো।
ইওরোপে ইতালীর পুনর্জন্ম গিয়ে লাগলো বলবান্ অভিনব নূতন ফ্রাঁ জাতিতে। চারিদিক হতে সভ্যতার ধারা সব এসে ফ্লরেন্স নগরীতে একত্র হয়ে নূতন রূপ ধারণ করলে; কিন্তু ইতালী জাতিতে সে বীর্যধারণের শক্তি ছিল না, ভারতের মত সে উন্মেষ ঐখানেই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু ইওরোপের সৌভাগ্য, এই নূতন ফ্রাঁ জাতি আদরে সে তেজ গ্রহণ করলে। নবীন রক্ত, নবীন জাত সে তরঙ্গে মহাসাহসে নিজের তরণী ভাসিয়ে দিলে, সে স্রোতের বেগ ক্রমশই বাড়তে লাগল, সে এক ধারা শতধারা হয়ে বাড়তে লাগল; ইওরোপের আর আর জাতি লোলুপ হয়ে খাল কেটে সে জল আপনার আপনার দেশে নিয়ে গেল এবং তাতে নিজেদের জীবনীশক্তি ঢেলে তার বেগ, তার বিস্তার বাড়াতে লাগল, ভারতে এসে সে তরঙ্গ লাগল; জাপান সে বন্যায় বেঁচে উঠল, সে জল পান করে মত্ত হয়ে উঠল; জাপান এশিয়ার নূতন জাত।
পারি ও ফ্রাঁস
এই পারি নগরী সে ইওরোপী সভ্যতা-গঙ্গার গোমুখ। এ বিরাট রাজধানী মর্ত্যের অমরাবতী, সদানন্দ-নগরী। এ ভোগ, এ বিলাস, এ আনন্দ—না লণ্ডনে, না বার্লিনে, না আর কোথায়। লণ্ডনে, নিউ ইয়র্কে ধন আছে; বার্লিনে বিদ্যাবুদ্ধি যথেষ্ট, নেই সে ফরাসী মাটি, আর সর্বাপেক্ষা নেই সে ফরাসী মানুষ। ধন থাক, বিদ্যাবুদ্ধি থাক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও থাক—মানুষ কোথায়? এ অদ্ভুত ফরাসী চরিত্র প্রাচীন গ্রীক মরে জন্মেছে যেন—সদা আনন্দ, সদা উৎসাহ, অতি ছ্যাবলা আবার অতি গম্ভীর, সকল কাজে উত্তেজনা, আবার বাধা পেলেই নিরুৎসাহ। কিন্তু সে নৈরাশ্য ফরাসী মুখে বেশীক্ষণ থাকে না, আবার জেগে ওঠে।
এই পারি বিশ্ববিদ্যালয় ইওরোপের আদর্শ। দুনিয়ার বিজ্ঞান সভা এদের একাডেমির নকল; এই পারি ঔপনিবেশ-সাম্রাজ্যের গুরু, সকল ভাষাতেই যুদ্ধ-শিল্পের সংজ্ঞা এখনও অধিকাংশ ফরাসী; এদের রচনার নকল সকল ইওরোপী ভাষায়; দর্শন বিজ্ঞান শিল্পের এই পারি খনি, সকল জায়গায় এদের নকল।
এরা হচ্ছে শহুরে, আর সব জাত যেন পাড়াগেঁয়ে। এরা যা করে তা ৫০ বৎসর, ২৫ বৎসর পরে জার্মান ইংরেজ প্রভৃতি নকল করে, তা বিদ্যায় হোক বা শিল্পে হোক, বা সমাজনীতিতেই হোক। এই ফরাসী সভ্যতা স্কটল্যাণ্ডে লাগল, স্কটরাজ ইংলণ্ডের রাজা হলেন, ফরাসী সভ্যতা ইংলণ্ডকে জাগিয়ে তুললে; স্কটরাজ স্টুয়ার্ট বংশের সময় ইংলণ্ডে রয়াল সোসাইটি প্রভৃতির সৃষ্টি।
আর এই ফ্রাঁস স্বাধীনতার আবাস। প্রজাশক্তি মহাবেগে এই পারি নগরী হতে ইওরোপ তোলপাড় করে ফেলেছে, সেই দিন হতে ইওরোপের নূতন মূর্তি হয়েছে। সে ‘এগালিতে, লিবার্তে, ফ্রাতের্নিতে’র (Egalite’, Liberte, Fraternite—সাম্য, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব) ধ্বনি ফ্রাঁস হতে চলে গেছে; ফ্রাঁস অন্য ভাব, অন্য উদ্দেশ্য অনুসরণ করছে, কিন্তু ইওরোপের অন্যান্য জাত এখনও সেই ফরাসী বিপ্লব মক্শ করছে।
একজন স্কটল্যাণ্ড দেশের প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক পণ্ডিত আমায় সেদিন বললেন যে, পারি হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র; যে দেশ যে পরিমাণে এই পারি নগরীর সঙ্গে নিজেদের যোগ স্থাপন করতে সক্ষম হবে, সে জাত তত পরিমাণে উন্নতি লাভ করবে। কথাটা কিছু অতিরঞ্জিত সত্য; কিন্তু এ-কথাটাও সত্য যে, যদি কারু কোন নূতন ভাব এ জগৎকে দেবার থাকে তো এই পারি হচ্ছে সে প্রচারের স্থান। এই পারিতে যদি ধ্বনি ওঠে তো ইওরোপ অবশ্যই প্রতিধ্বনি করবে। ভাস্কর, চিত্রকর, গাইয়ে, নর্তকী—এই মহানগরীতে প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারলে আর সব দেশে সহজেই প্রতিষ্ঠা হয়।
আমাদের দেশে এই পারি নগরীর বদনামই শুনতে পাওয়া যায়, এ পারি মহাকদর্য বেশ্যাপূর্ণ নরককুণ্ড। অবশ্য এ-কথা ইংরেজরাই বলে থাকে, এবং অন্য দেশের যে সব লোকের পয়সা আছে এবং জিহ্বোপস্থ ছাড়া দ্বিতীয় ভোগ জীবনে অসম্ভব, তারা অবশ্য বিলাসময় জিহ্বোপস্থের উপকরণময় পারিই দেখে!
কিন্তু লণ্ডন, বার্লিন, ভিয়েনা, নিউ ইয়র্কও ঐ বারবনিতাপূর্ণ, ভোগের উদ্যোগপূর্ণ; তবে তফাত এই যে, অন্য দেশের ইন্দ্রিয়চর্চা পশুবৎ, প্যারিসের—সভ্য পারির ময়লা সোনার পাতমোড়া; বুনো শোরের পাঁকে লোটা, আর ময়ূরের পেখমধরা নাচে যে তফাত, অন্যান্য শহরের পৈশাচিক ভোগ আর এ প্যারিস-বিলাসের সেই তফাত।
ভোগ-বিলাসের ইচ্ছা কোন্ জাতে নেই বল? নইলে দুনিয়ায় যার দু-পয়সা হয়, সে অমনি পারি-নগরী অভিমুখে ছোটে কেন? রাজা-বাদশারা চুপিসাড়ে নাম ভাঁড়িয়ে এ বিলাস-বিবর্তে স্নান করে পবিত্র হতে আসেন কেন? ইচ্ছা সর্বদেশে, উদ্যোগের ত্রুটি কোথাও কম দেখি না; তবে এরা সুসিদ্ধ হয়েছে, ভোগ করতে জানে, বিলাসের সপ্তমে পৌঁছেছে।
তাও অধিকাংশ কদর্য নাচ-তামাসা বিদেশীর জন্য। ফরাসী বড় সাবধান, বাজে খরচ করে না। এই ঘোর বিলাস, এই সব হোটেল কাফে, যাতে একবার খেলে সর্বস্বান্ত হতে হয়, এ-সব বিদেশী আহাম্মক ধনীদের জন্য। ফরাসীরা বড় সুসভ্য, আদব-কায়দা বেজায়, খাতির খুব করে, পয়সাগুলি সব বার করে নেয়, আর মুচকে মুচকে হাসে।
তা ছাড়া, আর এক তামাসা এই যে, আমেরিকান জার্মান ইংরেজ প্রভৃতির খোলা সমাজ, বিদেশী ঝাঁ করে সব দেখতে শুনতে পায়। দু-চার দিনের আলাপেই আমেরিকান বাড়ীতে দশ দিন বাস করবার নিমন্ত্রণ করে; জার্মান তদ্রূপ; ইংরেজ একটু বিলম্বে। ফরাসী এ বিষয়ে বড় তফাত, পরিবারের মধ্যে অত্যন্ত পরিচিত না হলে আর বাস করতে নিমন্ত্রণ করে না। কিন্তু যখন বিদেশী ঐ প্রকার সুবিধা পায়, ফরাসী পরিবার দেখবার জানবার অবকাশ পায়, তখন আর এক ধারণা হয়। বলি, মেছবাজার দেখে অনেক বিদেশী যে আমাদের জাতীয় চরিত্র সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করে—সেটা কেমন আহাম্মকি? তেমনি এ পারি। অবিবাহিতা মেয়ে এদেশে আমাদের দেশের মত সুরক্ষিতা, তারা সমাজে প্রায় মিশতে পায় না। বে-র পর তবে নিজের স্বামীর সঙ্গে সমাজে মেশে; বে-থা মায়ে বাপে দেয়, আমাদের মত। আর এরা আমোদপ্রিয়, কোন বড় সামাজিক ব্যাপার নর্তকীর নাচ না হলে সম্পূর্ণ হয় না। যেমন আমাদের বে পুজো—সর্বত্র নর্তকীর আগমন। ইংরেজ ওলবাটা-মুখ, অন্ধকার দেশে বাস করে, সদা নিরানন্দ, ওদের মতে এ বড় অশ্লীল, কিন্তু থিয়েটারে হলে আর দোষ নেই। এ-কথাটাও বলি যে, এদের নাচটা আমাদের চোখে অশ্লীল বটে, তবে এদের সয়ে গেছে। নেংটি নাচ সর্বত্র, ও গ্রাহ্যের মধ্যেই নয়। কিন্তু ইংরেজ আমেরিকান দেখতেও ছাড়বে না, আর ঘরে গিয়ে গাল দিতেও ছাড়বে না।
স্ত্রী-সম্বন্ধী আচার পৃথিবীর সর্বদেশেই একরূপ, অর্থাৎ পুরুষ-মান্ষের অন্য স্ত্রীসংসর্গে বড় দোষ হয় না, কিন্তু স্ত্রীলোকের বেলাটায় মুশকিল। তবে ফরাসী পুরুষ একটু খোলা, অন্য দেশের ধনী লোকেরা যেমন এ সম্বন্ধে বেপরোয়া, তেমনি। আর ইওরোপী পুরুষসাধারণ ও-বিষয়টা অত দোষের ভাবে না। অবিবাহিতের ও-বিষয়ে পাশ্চাত্য দেশে বড় দোষের নয়; বরং বিদ্যার্থী যুবক ও-বিষয়ে একান্ত বিরত থাকলে অনেক স্থলে তার মা-বাপ দোষাবহ বিবেচনা করে, পাছে ছেলেটা ‘মেনিমুখো’ হয়। পুরুষের এক গুণ পাশ্চাত্য দেশে চাই—সাহস; এদের ‘ভার্চু’ (virtue) শব্দ আর আমাদের ‘বীরত্ব’ একই শব্দ। ঐ শব্দের ইতিহাসেই দেখ, এরা কাকে পুরুষের সততা বলে। মেয়েমানুষের পক্ষে সতীত্ব অত্যাবশ্যক বটে।
এ সকল কথা বলবার উদ্দেশ্য এই যে, প্রত্যেক জাতির এক-একটা নৈতিক জীবনোদ্দেশ্য আছে, সেইখানটা হতে সে জাতির রীতিনীতি বিচার করতে হবে। তাদের চোখে তাদের দেখতে হবে। আমাদের চোখে এদের দেখা, আর এদের চোখে আমাদের দেখা—এ দুই ভুল।
আমাদের উদ্দেশ্য এ বিষয়ে এদের ঠিক উল্টা, আমাদের ব্রহ্মচারী (বিদ্যার্থী) শব্দ আর কামজয়িত্ব এক। বিদ্যার্থী আর কামজিৎ একই কথা।
আমাদের উদ্দেশ্য মোক্ষ। ব্রহ্মচর্য বিনা তা কেমনে হয়, বল? এদের উদ্দেশ্য ভোগ, ব্রহ্মচর্যের আবশ্যক তত নাই; তবে স্ত্রীলোকের সতীত্ব নাশ হলে ছেলেপিলে জন্মায় না এবং সমগ্র জাতির ধ্বংস। পুরুষ-মান্ষে দশ গণ্ডা বে করলে তত ক্ষতি নাই, বরং বংশবৃদ্ধি খুব হয়। স্ত্রীলোকের একটা ছাড়া আর একটা একসঙ্গে চলে না—ফল বন্ধ্যাত্ব। কাজেই সকল দেশে স্ত্রীলোকের সতীত্বের উপর বিশেষ আগ্রহ, পুরুষের বাড়ার ভাগ। ‘প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি।’১৬
যাক, মোদ্দা এমন শহর আর ভূমণ্ডলে নাই। পূর্বকালে এ শহর ছিল আর একরূপ, ঠিক আমাদের কাশীর বাঙালীটোলার মত। আঁকাবাঁকা গলি রাস্তা, মাঝে মাঝে দুটো বাড়ী এক-করা খিলান, দ্যালের গায়ে পাতকো, ইত্যাদি। এবারকার এগজিবিশনে একটা ছোট পুরানো পারি তৈরী করে দেখিয়েছি। সে পারি কোথায় গেছে, ক্রমিক বদলেছে, এক-একবার লড়াই-বিদ্রোহ হয়েছে, কতক অংশ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, আবার পরিষ্কার নূতন ফর্দা১৭ পারি সেই স্থানে উঠেছে।
বর্তমান পারি অধিকাংশই তৃতীয় ন্যাপোলেঅঁর (Napoleon III) তৈরী। তু-ন্যাপোলেঅঁর মেরে কেটে জুলুম করে বাদশা হলেন। ফরাসীজাতি সেই প্রথম বিপ্লব (French Revolution) হওয়া অবধি সতত টলমল; কাজেই বাদশা প্রজাদের খুশী রাখবার জন্য, আর পারি নগরীর সতত-চঞ্চল গরীব লোকদের কাজ দিয়ে খুশী করবার জন্য ক্রমাগত রাস্তা ঘাট তোরণ থিয়েটার প্রভৃতি গড়তে লাগলেন। অবশ্য—পারির সমস্ত পুরাতন মন্দির তোরণ স্তম্ভ প্রভৃতি রইল; রাস্তা ঘাট সব নূতন হয়ে গেল। পুরানো শহর—পগার পাঁচিল সব ভেঙে বুলভারের (boulevards) অভ্যুদয় হতে লাগল। এবং তা হতেই শহরের সর্বোত্তম রাস্তা, পৃথিবীতে অদ্বিতীয় শাঁজেলিজে (Champs Elypsees)। রাস্তা তৈরী হল। এ রাস্তা এত বড় চওড়া যে, মধ্যখানে এবং দুপাশ দিয়ে বাগান চলেছে এবং একস্থানে অতি বৃহৎ গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়েছে—তার নাম ‘প্লাস্ দ লা কনকর্দ’ (Place de la Concorde) এই ‘প্লাস্ দ লা কনকর্দে’র চারিদিকে প্রায় সমান্তরালে ফ্রাঁসের প্রত্যেক জেলার এক এক যান্ত্রিক নারীমূর্তি। তার মধ্যে একটি মূর্তি হচ্ছে ষ্ট্রাসবুর্গ নামক জেলার। ঐ জেলা এখন ডইচ১৮(জার্মান)-রা ১৮৭২ সালের লড়ায়ের পর হতে কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সে দুঃখ ফ্রাঁসের আজও যায় না, সে মূর্তি দিনরাত প্রেতোদ্দিষ্ট ফুলমালায় ঢাকা। যে রকমের মালা লোকে আত্মীয়-স্বজনের গোরের ওপর দিয়ে আসে, সেই রকম বৃহৎ মালা দিনরাত সে মূর্তির উপর কেউ না কেউ দিয়ে যাচ্ছে।
দিল্লীর চাঁদনি-চৌক কতক অংশে এই ‘প্লাস্ দ লা কনকর্দের’ মত এককালে ছিল বলে বোধ হয়। স্থানে স্থানে জয়স্তম্ভ, বিজয়তোরণ আর বিরাট নরনারী সিংহাদি ভাস্কর্যমূর্তি। মহাবীর প্রথম ন্যাপোলেঅঁর স্মারক এক সুবৃহৎ ধাতুনির্মিত বিজয়স্তম্ভ। তার গায়ে ন্যাপোলেঅঁর সময়ের যুদ্ধ-বিজয় অঙ্কিত। ওপরে তাঁর মূর্তি। আর একস্থানে প্রাচীন দুর্গ বাস্তিল (Bastille) ধ্বংসের স্মারক চিহ্ন। তখন রাজাদের একাধিপত্য ছিল, যাকে তাকে যখন তখন জেলে পুরে দিত। বিচার না, কিছু না, রাজা এক হুকুম লিখে দিতেন; তার নাম ‘লেটর দ ক্যাশে’ (Lettre de Cachet)—মানে, রাজ-মুদ্রাঙ্কিত লিপি। তারপর সে ব্যক্তি আর কি করেছে কিনা, দোষী কি নির্দোষ, তার আর জিজ্ঞাসা-পড়া নেই, একেবারে নিয়ে পুরলে সেই বাস্তিলে; সেখান থেকে বড় কেউ আর বেরুত না। রাজাদের প্রণয়িনীরা কারু উপর চটলে রাজার কাছ থেকে ঐ শীলটা করিয়ে নিয়ে সে ব্যক্তিকে বাস্তিলে ঠেলে দিত। পরে যখন দেশসুদ্ধ লোক এ সব অত্যাচারে ক্ষেপে উঠল, ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা’, ‘সব সমান’, ‘ছোট বড় কিছুই নয় ‘—এ ধ্বনি উঠল, পারির লোক উন্মত্ত হয়ে রাজারাণীকে আক্রমণ করলে, সে সময় প্রথমেই এ মানুষের অত্যাচারের ঘোর নিদর্শন বাস্তিল ভূমিসাৎ করলে, সে স্থানটায় এক রাত ধরে নাচগান আমোদ করলে। তারপর রাজা পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে ধরে ফেললে, রাজার শ্বশুর অষ্ট্রীয়ার বাদশা জামায়ের সাহায্যে সৈন্য পাঠাচ্ছেন শুনে, প্রজারা ক্রোধে অন্ধ হয়ে রাজারাণীকে মেরে ফেললে, দেশসুদ্ধ লোকে ‘স্বাধীনতা সাম্যের’ নামে মেতে উঠল, ফ্রাঁস প্রজাতন্ত্র (republic) হল; অভিজাত ব্যক্তির মধ্যে যাকে ধরতে পারলে তাকেই মেরে ফেললে, কেউ কেউ উপাধি-টুপাধি ছেড়ে প্রজার দলে মিশে গেল। শুধু তাই নয়, বললে ‘দুনিয়াসুদ্ধ লোক, তোমরা ওঠ, রাজা-ফাজা অত্যাচারী সব মেরে ফেল, সব প্রজা স্বাধীন হোক, সকলে সমান হোক!’ তখন ইওরোপসুদ্ধ রাজারা ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল—এ আগুন পাছে নিজেদের দেশে লাগে, পাছে নিজেদের সিংহাসন গড়িয়ে পড়ে যায় তাই তাকে নেবাবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে চারিদিক থেকে ফ্রাঁস আক্রমণ করলে। এদিকে প্রজাতন্ত্রের কর্তৃপক্ষেরা ‘লা পাত্রি আ দাঁজে’—জন্মভূমি বিপদে—এই ঘোষণা করে দিলে; সে ঘোষণা আগুনের মত দেশময় ছড়িয়ে পড়ল। ছেলেবুড়ো, মেয়েমদ্দ ‘মার্সাইএ’ মহাগীত (La Marseillaise) গাইতে গাইতে—উৎসাহপূর্ণ ফ্রাঁসের মহাগীত গাইতে গাইতে, দলে দলে, জীর্ণবসন, সে শীতে নগ্নপদ, অত্যল্পান্ন ফরাসী প্রজা-ফৌজ বিরাট সমগ্র ইওরোপীয় চমুর সম্মুখীন হল, বড় ছোট ধনী দরিদ্র—সব বন্দুক ঘাড়ে বেরুল, ‘পরিত্রাণায় ... বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্’১৯ বেরুল। সমগ্র ইওরোপ সে বেগ সহ্য করতে পারলে না। ফরাসী জাতির অগ্রে সৈন্যদের স্কন্ধে দাঁড়িয়ে এক বীর—তাঁর অঙ্গুলি-হেলনে ধরা কাঁপতে লাগল, তিনি ন্যাপোলেঅঁর।
স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—বন্দুকের নালমুখে, তলওয়ারের ধারে ইওরোপের অস্থিমজ্জার প্রবেশ করিয়ে দিলে, তিন-রঙা ককার্ডের (Cocarde) জয় হল। তারপর ন্যাপোলেঅঁ ফ্রাঁস মহারাজ্যকে দৃঢ়বদ্ধ সাবয়ব করবার জন্য বাদশা হলেন। তারপর তাঁর কার্য শেষ হল; ছেলে হল না বলে সুখ-দুঃখের সঙ্গিনী ভাগ্যলক্ষী রাজ্ঞী জোসেফিনকে ত্যাগ করলেন, অষ্ট্রীয়ার বাদশার মেয়ে বে করলেন। জোসেফিনের সঙ্গে সঙ্গে সে ভাগ্য ফিরল, রুশ জয় করতে গিয়ে বরফে তাঁর ফৌজ মারা গেল। ইওরোপ বাগ পেয়ে তাঁকে জোর করে সিংহাসন ত্যাগ করিয়ে একটা দ্বীপে পাঠিয়ে দিলে, পুরানো রাজার বংশের একজনকে তক্তে বসালে।
মরা সিঙ্গি সে দ্বীপ থেকে পালিয়ে আবার ফ্রাঁসে হাজির হল, ফ্রাঁসসুদ্ধ লোক আবার তাঁকে মাথায় করে নিলে, রাজা পালাল। কিন্তু অদৃষ্ট ভেঙেছে, আর জুড়ল না—আবার ইওরোপসুদ্ধ পড়ে তাঁকে হারিয়ে দিলে, ন্যাপোলেঅঁ ইংরেজদের এক জাহাজে উঠে শরণাগত হলেন; ইংরেজরা তাঁকে ‘সেণ্ট হেলেনা’ নামক দূর একটা দ্বীপে বন্দী রাখলে—আমরণ। আবার পুরানো রাজা এল, তার ভাইপো রাজা হল। আবার ফ্রাঁসের লোক ক্ষেপে উঠল, রাজা-ফাজা তাড়িয়ে দিলে, আবার প্রজাতন্ত্র হল। মহাবীর ন্যাপোলেঅঁর এক ভাইপো এ-সময়ে ক্রমে ফ্রাঁসের প্রীতি-পাত্র হলেন, ক্রমে একদিন ষড়যন্ত্র করে নিজেকে বাদশা ঘোষণা করলেন। তিনি ছিলেন তৃতীয় ন্যাপোলেঅঁ; দিন কতক তাঁর খুব প্রতাপ হল। কিন্তু জার্মান-যুদ্ধে হেরে তাঁর সিংহাসন গেল, আবার ফ্রাঁস প্রজাতন্ত্র হল। সেই অবধি প্রজাতন্ত্র চলেছে।
যে পরিমাণবাদ ভারতের প্রায় সকল সম্প্রদায়ের মূলভিত্তি, এখন সে পরিণামবাদ ইওরোপী বহির্বিজ্ঞানে প্রবেশ করেছে। ভারত ছাড়া অন্যত্র সকল দেশের ধর্মে ছিল এই যে—দুনিয়াটা সব টুকরা টুকরা, আলাদা আলাদা। ঈশ্বর একজন আলাদা, প্রকৃতি একটা আলাদা, মানুষ একটা আলাদা, ঐ রকম পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা, মাটি, পাথর ধাতু প্রভৃতি—সব আলাদা আলাদা! ভগবান্ ঐ রকম আলাদা আলাদা করে সৃষ্টি করেছেন।
জ্ঞান মানে কিনা, বহুর মধ্যে এক দেখা। যেগুলো আলাদা, তফাত বলে আপাততঃ বোধ হচ্ছে, তাদের মধ্যে ঐক্য দেখা। যে সম্বন্ধ এই ঐক্য মানুষ দেখতে পায়, সেই সম্বন্ধটাকে ‘নিয়ম’ বলে; এরই নাম প্রাকৃতিক নিয়ম।
পূর্বে বলেছি যে, আমাদের বিদ্যা বুদ্ধি চিন্তা সমস্ত আধ্যাত্মিক, সমস্ত বিকাশ ধর্মে। আর পাশ্চাত্যে ঐ সমস্ত বিকাশ বাইরে, শরীরে, সমাজে। ভারতবর্ষে চিন্তাশীল মনীষীরা ক্রমে বুঝতে পারলেন যে, ও আলাদা ভাবটা ভুল; ও-সব আলাদার মধ্যে সম্বন্ধ রয়েছে; মাটি, পাথর, গাছপালা, জন্তু, মানুষ, দেবতা, এমন কি ঈশ্বর স্বয়ং—এর মধ্যে ঐক্য রয়েছে। অদ্বৈতবাদী এর চরম সীমায় পৌঁছুলেন, বললেন যে সমস্তই সেই একের বিকাশ। বাস্তবিক এই অধ্যাত্ম ও অধিভূত জগৎ এক, তার নাম ‘ব্রহ্ম’ আর ঐ যে আলাদা আলাদা বোধ হচ্ছে, ওটা ভুল, ওর নাম দিলেন ‘মায়া’, ‘অবিদ্যা’ অর্থাৎ অজ্ঞান। এই হল জ্ঞানের চরম সীমা।
ভারতবর্ষের কথা ছেড়ে দাও, বিদেশে যদি এ-কথাটা এখন কেউ বুঝতে না পারে তো তাকে আর পণ্ডিত কি করে বলি। মোদ্দা, এদের অধিকাংশ পণ্ডিতই এটা এখন বুঝেছে, এদের রকম দিয়ে—জড় বিজ্ঞানের ভেতর দিয়ে। তা সে ‘এক’ কেমন করে হল, এ কথা আমরাও বুঝি না, এরাও বোঝে না। আমরাও সিদ্ধান্ত করে দিয়েছি যে ওখানটা বুদ্ধির অতীত, এরাও তাই করেছে। তবে সে ‘এক’ কি কি রকম হয়েছে, কি কি রকম জাতিত্ব ব্যক্তিত্ব পাচ্ছে, এটা বোঝা যায় এবং এটার খোঁজের নাম বিজ্ঞান (Science)।
কাজেই এখন এদেশে প্রায় সকলেই পরিণামবাদী—Evolutionist. যেমন ছোট জানোয়ার বদলে বদলে বড় জানোয়ার হচ্ছে, বড় জানোয়ার কখনও কখনও ছোট হচ্ছে, লোপ পাচ্ছে; তেমনি মানুষ যে একটা সুসভ্য অবস্থায় দুম করে জন্ম পেলে, এ কথা আর কেউ বড় বিশ্বাস করছে না। বিশেষ এদের বাপ-দাদা কাল না পরশু বর্বর ছিল, তা থেকে অল্পদিনে এই কাণ্ড। কাজেই এরা বলছে যে, সমস্ত মানুষ ক্রমে ক্রমে অসভ্য অবস্থা থেকে উঠেছে এবং উঠছে। আদিম মানুষ কাঠ-পাথরের যন্ত্রতন্ত্র দিয়ে কাজ চালাত, চামড়া বা পাতা পরে দিন কাটাত, পাহাড়ের গুহায় বা পাখীর বাসার মত কুঁড়েঘরে গুজরান করত। এর নিদর্শন সর্বদেশের মাটির নীচে পাওয়া যাচ্ছে এবং কোন কোন স্থলে সে অবস্থার মানুষ স্বয়ং বর্তমান। ক্রমে মানুষ ধাতু ব্যবহার করতে শিখলে, সে নরম ধাতু—টিন আর তামা। তাকে মিশিয়ে যন্ত্রতন্ত্র অস্ত্রশস্ত্র করতে শিখলে। প্রাচীন গ্রীক, বাবিল, মিসরীরাও অনেকদিন পর্যন্ত লোহার ব্যবহার জানত না—যখন তারা অপেক্ষাকৃত সভ্য হয়েছিল, বই পত্র পর্যন্ত লিখত, সোনা রুপো ব্যবহার করত, তখন পর্যন্ত। আমেরিকা মহাদ্বীপের আদিম নিবাসীদের মধ্যে মেক্সিকো পেরু মায়া প্রভৃতি জাতি অপেক্ষাকৃত সুসভ্য ছিল, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মন্দির নির্মাণ করত, সোনা রুপোর খুব ব্যবহার ছিল (এমন কি ঐ সোনা-রুপোর লোভেই স্পানি লোকেরা তাদের ধ্বংস সাধন করলে)। কিন্তু সে সমস্ত কাজ চকমকি পাথরের অস্ত্রদ্বারা অনেক পরিশ্রমে করত, লোহার নাম-গন্ধও জানত না।
আদিম অবস্থায় মানুষ তীর ধনুক বা জালাদি উপায়ে জন্তু জানোয়ার মাছ মেরে খেত, ক্রমে চাষবাস শিখলে, পশুপালন করতে শিখলে। বনের জানোয়ারকে বশে এনে নিজের কাজ করতে লাগল। অথবা সময়মত আহারেরও জন্য জানোয়ার পালতে লাগল। গরু, ঘোড়া, শূকর, হাতী, উট, ভেড়া, ছাগল, মুরগী প্রভৃতি পশু-পক্ষী মানুষের গৃহপালিত হতে লাগল! এর মধ্যে কুকুর হচ্ছেন মানুষের আদিম বন্ধু।
আবার চাষবাস আরম্ভ হল। যে ফল-মূল শাক-সবজি ধান-চাল মানুষে খায়, তার বুনো অবস্থা আর এক রকম। এ মানুষের যত্নে বুনো ফল বুনো ঘাস নানাপ্রকার সুখাদ্য বৃহৎ ও উপাদেয় ফলে পরিণত হল। প্রকৃতিতে আপনি-আপনি দিনরাত অদলবদল তো হচ্ছেই। নানাজাতের বৃক্ষলতা পশুপক্ষী শরীর সংসর্গে দেশ-কাল-পরিবর্তনে নবীন নবীন জাতির সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু মানুষ-সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত প্রকৃতি ধীরে ধীরে তরুলতা, জীবজন্তু বদলাচ্ছিলেন, মানুষ জন্মে অবধি সে হুড়মুড় করে বদলে দিতে লাগল। সাঁ সাঁ করে এক দেশের গাছপালা জীবজন্তু অন্য দেশে মানুষ নিয়ে যেতে লাগল, তাদের পরস্পর মিশ্রণে নানাপ্রকার অভিনব জীবজন্তুর, গাছপালার জাত মানুষের দ্বারা সৃষ্ট হতে লাগল।
আদিম অবস্থায় বিবাহ থাকে না, ক্রমে ক্রমে যৌনসম্বন্ধ উপস্থিত হল। প্রথম বৈবাহিক সম্বন্ধ সর্বসমাজে মায়ের উপর ছিল। বাপের বড় ঠিকানা থাকত না। মায়ের নামে ছেলেপুলের নাম হত। মেয়েদের হাতে সমস্ত ধন থাকত ছেলে মানুষ করবার জন্য। ক্রমে ধন-পত্র পুরুষের হাতে গেল, মেয়েরাও পুরুষের হাতে গেল। পুরুষ বললে, ‘যেমন এ ধনধান্য আমার’ আমি চাষবাস করে বা লুঠতরাজ করে উপার্জন করেছি, এতে যদি কেউ ভাগ বসায় তো আমি বিরোধ করব’, তেমনি বললে, ‘এ মেয়েগুলো আমার, এতে যদি কেউ হস্তার্পণ করে তো বিরোধ হবে।’ বর্তমান বিবাহের সূত্রপাত হল। মেয়েমানুষ—পুরুষের ঘটি বাটি গোলাম প্রভৃতি অধিকারের ন্যায় হল। প্রাচীন রীতি—একদলের পুরুষ অন্যদলে বে করত। সে বিবাহও জবরদস্তি—মেয়ে ছিনিয়ে এনে। ক্রমে সে কাড়াকাড়ি বদলে গেল, স্বেচ্ছায় বিবাহ চলল; কিন্তু সকল বিষয়ের কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ আভাস থাকে। এখনও প্রায় সর্বদেশে বরকে একটা নকল আক্রমণ করে। বাঙলাদেশে, ইওরোপে চাল দিয়ে বরকে আঘাত করে, ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে কনের আত্মীয় মেয়েরা বরযাত্রীদের গালিগালাজ করে, ইত্যাদি।
সমাজ সৃষ্টি হতে লাগল। দেশভেদে সমাজের সৃষ্টি। সমুদ্রের ধারে যারা বাস করত, তারা অধিকাংশই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত; যারা সমতল জমিতে, তাদের—চাষবাস; যারা পার্বত্য দেশে, তারা ভেড়া চরাত; যারা মরুময় দেশে, তারা ছাগল উট চরাতে লাগল; কতকদল জঙ্গলের মধ্যে বাস করে, শিকার করে খেতে লাগল। যারা সমতল দেশ পেলে, চাষবাস শিখলে, তারা পেটের দায়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে চিন্তা করবার অবকাশ পেলে, তারা অধিকতর সভ্য হতে লাগল। কিন্তু সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে শরীর দুর্বল হতে লাগল। যাদের শরীর দিনরাত খোলা হাওয়ায় থাকে, মাংসপ্রধান আহার তাদের; আর যারা ঘরের মধ্যে বাস করে, শস্যপ্রধান আহার তাদের; অনেক পার্থক্য হতে লাগল! শিকারী বা পশুপাল বা মৎসজীবী আহারে অনটন হলেই ডাকাত বা বোম্বেটে হয়ে সমতলবাসীদের লুঠতে আরম্ভ করলে। সমতলবাসীরা আত্মরক্ষার জন্য ঘনদলে সন্নিবিষ্ট হতে লাগল, ছোট ছোট রাজ্যের সৃষ্টি হতে লাগল।
দেবতারা ধান চাল খায়, সুসভ্য অবস্থা, গ্রাম নগর উদ্যানে বাস, পরিধান—বোনা কাপড়; আর অসুরদের পাহাড় পর্বত মরুভূমি বা সমুদ্রতটে বাস; আহার বন্য জানোয়ার, বন্য ফলমূল; পরিধান ছাল; আর [আহার] বুনো জিনিষ বা ভেড়া ছাগল গরু, দেবতাদের কাছ থেকে বিনিময়ে যা ধান-চাল। দেবতার শরীর শ্রম সইতে পারে না, দুর্বল। অসুরের২০ শরীর উপবাস, কৃচ্ছ, কষ্ট-সহনে বিলক্ষণ পটু।
অসুরের আহারাভাব হলেই দল বেঁধে পাহাড় হতে, সমুদ্রকূল হতে গ্রাম নগর লুঠতে এল। কখনও বা ধনধান্যের লোভে দেবতাদের আক্রমণ করতে লাগল। দেবতারা বহুজন একত্র না হতে পারলেই অসুরের হাতে মৃত্যু; আর দেবতার বুদ্ধি প্রবল হয়ে নানাপ্রকার যন্ত্রতন্ত্র নির্মাণ করতে লাগল। ব্রহ্মাস্ত্র, গরুড়াস্ত্র, বৈষ্ণবাস্ত্র, শৈবাস্ত্র—সব দেবতাদের; অসুরের সাধারণ অস্ত্র, কিন্তু গায়ে বিষম বল। বারংবার অসুর দেবতাদের হারিয়ে দেয়, কিন্তু অসুর সভ্য হতে জানে না, চাষবাস করতে পারে না, বুদ্ধি চালাতে জানাতে না। বিজয়ী অসুর যদি বিজিত দেবতাদের স্বর্গে রাজ্য করতে চায় তো সে কিছুদিনের মধ্যে দেবতাদের বুদ্ধিকৌশলে দেবতাদের দাস হয়ে পড়ে থাকে। নতুবা অসুর লুঠ করে পরে আপনার স্থানে যায়। দেবতারা যখন একত্রিত হয়ে অসুরদের তাড়ায়, তখন হয় তাদের সমুদ্রমধ্যে তাড়ায়, না হয় পাহাড়ে, না হয় জঙ্গলে তাড়িয়ে দেয়। ক্রমে দু-দিকেই দল বাড়তে লাগল লক্ষ লক্ষ দেবতা একত্র হতে লাগল, লক্ষ লক্ষ অসুর একত্র হতে লাগল। মহাসংঘর্ষ, মেশামেশি, জেতাজিতি চলতে লাগল।
এ সব রকমের মানুষ মিলেমিশে বর্তমান সমাজ, বর্তমান প্রথাসকলের সৃষ্টি হতে লাগল, নানা রকমে নূতন ভাবের সৃষ্টি হতে লাগল, নানা বিদ্যার আলোচনা চলল। একদল লোক ভোগোপযোগী বস্তু তৈয়ার করতে লাগল—হাত দিয়ে বা বুদ্ধি করে। একদল সেই সব ভোগ্যদ্রব্য রক্ষা করতে লাগল। সকলে মিলে সেই সব বিনিময় করতে লাগল, আর মাঝখান থেকে একদল ওস্তাদ এ-জায়গার জিনিষটা ও-জায়গায় নিয়ে যাবার বেতনস্বরূপ সমস্ত জিনিষের অধিকাংশ আত্মসাৎ করতে শিখলে। একজন চাষ করলে, একজন পাহারা দিলে, একজন বয়ে নিয়ে গেল, আর একজন কিনলে। যে চাষ করলে, সে পেলে ঘোড়ার ডিম; সে পাহারা দিলে, সে জুলুম, করে কতকটা আগ ভাগ নিলে। অধিকাংশ নিলে ব্যবসাদার, যে বয়ে নিয়ে গেল। যে কিনলে, সে এ সকলের দাম দিয়ে মলো!! পাহারাওয়ালার নাম হল রাজা, মুটের নাম হল সওদাগর। এ দু-দল কাজ করলে না—ফাঁকি দিয়ে মুড়ো মারতে লাগল। সে জিনিষ তৈরী করতে লাগল, সে পেটে হাত দিয়ে ‘হা ভগবান্’ ডাকতে লাগল।
ক্রমে এই সকল ভাব—প্যাঁচাপেঁচি, মহা গেরোর উপর গেরো, তস্য গেরো হয়ে বর্তমান মহা জটিল সমাজ উপস্থিত হলেন। কিন্তু ছিট মরে না। যেগুলো পূর্ব জন্মে২১ ভেড়া চরাত, মাছ ধরে খেত, সেগুলো সভ্য-জন্মে বোম্বেটে ডাকাত প্রভৃতি হতে লাগল। বন নেই যে সে শিকার করে, কাছে পাহাড় পর্বতও নেই যে ভেড়া চড়ায়; জন্মের দরুন শিকার বা ভেড়া চড়ানো বা মাছ ধরা কোনটারই সুবিধা পায় না—সে কাজেই ডাকাতি করে, চুরি করে; সে যায় কোথায়? সে ‘প্রাতঃস্মরণীয়া’দের কালের মেয়ে, এ জন্মে তো আর এক সঙ্গে অনেক বর বে করতে পায় না, কাজেই হয় বেশ্যা। ইত্যাদি রকমে নানা ঢঙের, নানা ভাবের, নানা সভ্য-অসভ্য, দেবতা-অসুর জন্মের মানুষ একত্র হয়ে সমাজ। কাজেই সকল সমাজে এই নানারূপে ভগবান্ বিরাজ করছেন—সাধু নারায়ণ, ডাকাত-নারায়ণ ইত্যাদি। আবার যে সমাজে যে দলে সংখ্যায় অধিক, সে সমাজের চরিত্র সেই পরিমাণে দৈবী বা আসুরী হতে লাগল।
জম্বুদ্বীপের তামাম সভ্যতা—সমতল ক্ষেত্রে, বড় বড় নদীর উপর, অতি উর্বর ভূমিতে উৎপন্ন—ইয়ংচিকিয়ং, গঙ্গা, সিন্ধু, ইউফ্রেটিস-তীর। এ সকল সভ্যতারই আদি ভিত্তি চাষবাস। এ সকল সভ্যতাই দেবতাপ্রধান। আর ইওরোপের সকল সভ্যতাই প্রায় পাহাড়ে, না হয় সমুদ্রময় দেশে জন্মেছে—ডাকাত আর বোম্বেটে এ সভ্যতার ভিত্তি, এতে অসুরভাব অধিক।
বর্তমান কালে যতদূর বোঝা যায়, জম্বুদ্বীপের মধ্যভাগ ও আরবের মরুভূমি অসুরের প্রধান আড্ডা। ঐ স্থান হতে একত্র হয়ে পশুপাল মৃগয়াজীবী অসুরকুল সভ্য দেবতাদের তাড়া দিয়ে দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিয়েছে।
ইওরোপখণ্ডের আদিমনিবাসী এক জাত অবশ্য ছিল। তারা পর্বতগহ্বরে বাস করত; যারা ওর মধ্যে একটু বুদ্ধিমান, তারা অল্প গভীর তলাওয়ের জলে খোঁটা পুঁতে মাচান বেঁধে, সেই মাচানের উপর ঘর-দোর নির্মাণ করে বাস করত। চকমকি পাথরের তীর, বর্শার ফলা, চকমকির ছুরি ও পরশু দিয়ে সমস্ত কাজ চালাত।
ক্রমে জম্বুদ্বীপের নরস্রোত ইওরোপের উপর পড়তে লাগল। কোথাও কোথাও অপেক্ষাকৃত সভ্য জাতের অভ্যুদয় হল; রুশদেশান্তর্গত কোন জাতির ভাষা ভারতের দক্ষিণী ভাষার অনুরূপ।
কিন্তু এ-সকল জাত বর্বর, অতি বর্বর অবস্থায় রইল। এশিয়া মাইনর হতে একদল সুসভ্য মানুষ সন্নিকট দ্বীপপুঞ্জে উদয় হল, ইওরোপের সন্নিকট স্থান অধিকার করলে, নিজেদের বুদ্ধি আর প্রাচীন মিসরের সাহায্যে এক অপূর্ব সভ্যতা সৃষ্টি করলে; তাদের আমরা বলি যবন, ইওরোপীরা বলে গ্রীক।
পরে ইতালীর রোমক (Romans) নামক অন্য এক বর্বর জাতি ইট্রস্কান্ (Etruscans) নামক সভ্য জাতিকে পরাভূত করে, তাদের বুদ্ধিবিদ্যা সংগ্রহ করে নিজেরা সভ্য হল। ক্রমে রোমকেরা চারিদিক অধিকার করলে; ইওরোপখণ্ডের দক্ষিণ পশ্চিম ভাগের যাবতীয় অসভ্য মানুষ তাদের প্রজা হল। কেবল উত্তরভাগে বনজঙ্গলে বর্বর-জাতিরা স্বাধীন রইল। কালবশে রোম ঐশ্বর্যবিলাসপরতায় দুর্বল হতে লাগল; সেই সময় আবার জম্বুদ্বীপ অসুরবাহিনী ইওরোপের উপর নিক্ষেপ করলে। অসুর-তাড়নায় উত্তর-ইওরোপী বর্বর রোমসাম্রাজ্যের উপর পড়ল! রোম উৎসন্ন হয়ে গেল। জম্বুদ্বীপের তাড়ায় ইওরোপের বর্বর আর ইওরোপের ধ্বংসাবশিষ্ট রোমক-গ্রীক মিলে এক অভিনব জাতির সৃষ্টি হল; এ সময় য়াহুদীজাতি রোমের দ্বারা বিজিত ও বিতাড়িত হয়ে ইওরোপময় ছড়িয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে তাদের নূতন ধর্ম ক্রিশ্চানীও ছড়িয়ে পড়ল। এই সকল বিভিন্ন জাত, মত, পথ নানাপ্রকারের অসুরকুল, মহামায়ার মুচিতে,২২ দিবারাত্র যুদ্ধ মারকাটের আগুনে গলে মিশতে লাগল; তা হতেই এই ইওরোপী জাতের সৃষ্টি।
হিঁদুর কালো রঙ থেকে, উত্তরে দুধের মত সাদা রঙ, কালো, কটা, লাল বা সাদা চুল, কালো চোখ, কটা চোখ, নীল চোখ, দিব্যি হিঁদুর মত নাক মুখ চোখ, বা জাঁতামুখো চীনেরাম—এই সকল আকৃতিবিশিষ্ট এক বর্বর, অতি বর্বর ইওরোপী জাতির সৃষ্টি হয়ে গেল। কিছুকাল তারা আপনা আপনি মারকাট করতে লাগল; উত্তরের গুলো বোম্বেটেরূপে বাগে পেলেই অপেক্ষাকৃত সভ্যগুলোর উৎসাদন করতে লাগল। মাঝখান থেকে ক্রিশ্চান ধর্মের দুই গুরু ইতালীর পোপ (ফরাসী ও ইতালী ভাষায় বলে ‘পাপ’), আর পশ্চিমে কনষ্টাণ্টিনোপলসের পাট্রিয়ার্ক, এরা এই জন্তুপ্রায় বর্বর বাহিনীর উপর, তাদের রাজারাণী—সকলের উপর কর্তাত্তি চালাতে লাগল।
এদিকে আবার আরব মরুভূমে মুসলমানী ধর্মের উদয় হল। বন্যপশুপ্রায় আরব এক মহাপুরুষের প্রেরণাবলে অদম্য তেজে, অনাহত বলে পৃথিবীর উপর আঘাত করলে। পশ্চিম পূর্ব দুপ্রান্ত হতে সে তরঙ্গ ইওরোপে প্রবেশ করলে। সে স্রোতমুখে ভারত ও প্রাচীন গ্রীসের বিদ্যাবুদ্ধি ইওরোপে প্রবেশ করতে লাগল।
তাতার জাতি
জম্বুদ্বীপের মাঝখান হতে সেলজুক তাতার (Seljuk Tartars) নামক অসুর জাতি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে এশিয়া-মাইনর প্রভৃতি স্থান দখল করে ফেললে। আরবরা ভারতবর্ষ জয়ের অনেক চেষ্টা করেও সফল হয়নি; মুসলমান-অভ্যুদয় সমস্ত পৃথিবী বিজয় করেও ভারতবর্ষের কাছে কুণ্ঠিত হয়ে গেল। সিন্ধুদের একবার আক্রমণ করেছিল মাত্র, কিন্তু রাখতে পারেনি; তারপর থেকে আর উদ্যম করেনি।
কয়েক শতাব্দীর পর যখন তুর্ক প্রভৃতি তাতার জাতি বৌদ্ধধর্ম ছেড়ে মুসলমান হল, তখন এই তুর্কীরা সমভাবে হিন্দু, পার্শী, আরাব, সকলকে দাস করে ফেললে। ভারতবর্ষের সমস্ত মুসলমান বিজেতার মধ্যে একদলও আরবী বা পার্শী নয়, সব তুর্কাদি তাতার। রাজপুতানার সমস্ত আগন্তুক মুসলমানের নাম তুর্ক—তাই সত্য, ঐতিহাসিক। রাজপুতানার চারণ যে গাইলেন, ‘তুরুগণকো বঢ়ি জোর’ তাই ঠিক। কুতুবউদ্দিন হতে মোগল বাদশাই পর্যন্ত ও-সব তাতার—যে জাত তিব্বতী, সেই জাত; কেবল হয়েছেন মুসলমান, আর হিঁদু পার্শী বে করে বদলেছেন চাকামুখ। ও সেই প্রাচীন অসুরবংশ। আজও কাবুল, পারস্য, আরব্য, কনষ্টাণ্টিনোপলে সিংহাসনে বসে রাজত্ব করছেন সেই অসুর তাতার; গান্ধারী,২৩ ফারসী আরাব সেই তুরস্কের গোলামী করছেন। বিরাট চীনসাম্রাজ্যও সেই তাতার মাঞ্চুর (Manchurian Tartars) পদতলে, তবে সে মাঞ্চু নিজের ধর্ম ছাড়েনি মুসলমান হয়নি, মহালামার (Grand Lama) চেলা। এ অসুর জাত কস্মিন্কালে বিদ্যাবুদ্ধির চর্চা করে না, জানে মাত্র লড়াই। ও রক্ত না মিশলে যুদ্ধবীর্য বড় হয় না। উত্তর ইওরোপ, বিশেষ রুশের প্রবল যুদ্ধবীর্য—সেই তাতার। রুশ তিন হিস্যে তাতার রক্ত। দেবাসুরের লড়াই এখনও চলবে অনেক কাল। দেবতা অসুরকন্যা বে করে, অসুর দেবকন্যা ছিনিয়ে নেয়—এই রকম করে প্রবল খিচুড়ি জাতের সৃষ্টি হয়।
তাতাররা আরবী খলিফার সিংহাসন কেড়ে নিলে, ক্রিশ্চানদের মহাতীর্থ জিরুসালেম প্রভৃতি স্থান দখল করে ক্রিশ্চানদের তীর্থযাত্রা বন্ধ করে দিলে, অনেক ক্রিশ্চান মেরে ফেললে। ক্রিশ্চান ধর্মের গুরুরা ক্ষেপে উঠল; ইওরোপময় তাদের সব বর্বর চেলা; রাজা প্রজাকে ক্ষেপিয়ে তুললে—পালে পালে ইওরোপী বর্বর জিরুসালেম উদ্ধারের জন্য এশিয়া- মাইনরে চলল। কতক নিজেরাই কাটাকাটি করে মলো, কতক রোগে মলো, বাকী মুসলমানে মারতে লাগল। সে ঘোর বর্বর ক্ষেপে উঠেছে—মুসলমানেরা যত মারে, তত আসে। সে বুনোর গোঁ। আপনার দলকেই লুঠছে, খাবার না পেলে মুসলমান ধরেই খেয়ে ফেললে। ইংরেজ রাজা রিচার্ড মুসলমান-মাংসে বিশেষ খুশী ছিলেন, প্রসিদ্ধ আছে।
বুনো মানুষ আর সভ্য মানুষের লড়ায়ে যা হয়, তাই হল—জিরুসালেম প্রভৃতি অধিকার করা হল না। কিন্তু ইওরোপ সভ্য হতে লাগল। সে চামড়া-পরা, আম-মাংসখেকো২৪ বুনো ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান প্রভৃতি এশিয়ার সভ্যতা শিখতে লাগল। ইতালী প্রভৃতি স্থানের নাগা ফৌজ দার্শনিক মত শিখতে লাগল; একদল ক্রিশ্চান নাগা (Knights-Templars) ঘোর অদ্বৈতবেদান্তী হয়ে উঠল; শেষে তারা ক্রিশ্চানীকে ঠাট্টা করতে লাগল, এবং তাদের ধনও অনেক সংগৃহীত হয়েছিল; তখন পোপের হুকুমে, ধর্মরক্ষার ভানে ইওরোপী রাজারা তাদের নিপাত করে ধন লুটে নিলে।
এদিকে মুর নামক মুসলমান জাতি স্পান (Spain) দেশে অতি সুসভ্য রাজ্য স্থাপন করলে, নানাবিদ্যার চর্চা করলে, ইওরোপে প্রথম ইউনিভার্সিটি হল; ইতালী, ফ্রাঁস, সুদূর ইংলণ্ড হতে বিদ্যার্থী বিদ্যা শিখতে এল; রাজারাজড়ার ছেলেরা যুদ্ধবিদ্যা আচার কায়দা সভ্যতা শিখতে এল। বাড়ী ঘর দোর মন্দির সব নূতন ঢঙে বনতে লাগল।
কিন্তু সমগ্র ইওরোপ হয়ে দাঁড়াল এক মহা সেনা-নিবাস—সে ভাব এখনও। মুসলমানেরা একটা দেশ জয় করে, রাজা—আপনার এক বড় টুকরা রেখে বাকী সেনাপতিদের বেঁটে দিতেন। তারা খাজনা দিত না, কিন্তু রাজার আবশ্যক হলেই এতগুলো সৈন্য দিতে হবে। এই রকমে সদা-প্রস্তুত ফৌজের অনেক হাঙ্গামা না রেখে, আবশ্যককালে হাজির প্রবল ফৌজ প্রস্তুত রইল। আজও রাজপুতানায় সে ভাব কতক আছে; ওটা মুসলমানেরা এদেশে আনে। ইওরোপীরা মুসলমানের এ-ভাব নিলে। কিন্তু মুসলমানদের ছিল রাজা, সামন্তচক্র, ফৌজ ও বাকী প্রজা। ইওরোপে রাজা আর সামন্তচক্র বাকী সব প্রজাকে করে ফেললে এক রকম গোলাম। প্রত্যেক মানুষ কোন সামন্তের অধিকৃত মানুষ হয়ে তবে জীবিত রইল—হুকুম মাত্রেই প্রস্তুত হয়ে যুদ্ধযাত্রায় হাজির হতে হবে।
ইওরোপী সভ্যতা নামক বস্ত্রের এই সব হল উপকরণ। এর তাঁত হচ্ছে—এক নাতিশীতোষ্ণ পাহাড়ী সমুদ্রতটময় প্রদেশ; এর তুলো হচ্ছে—সর্বদা যুদ্ধপ্রিয় বলিষ্ঠ নানা-জাতের মিশ্রণে এক মহা খিচুড়ি-জাত। এর টানা হচ্ছে—যুদ্ধ, আত্মরক্ষার জন্য, ধর্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ। সে তলওয়ার চালাতে পারে, সে হয় বড়; যে তলওয়ার না ধরতে পারে, সে স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে কোন বীরের তলওয়ারের ছায়ায় বাস করে, জীবনধারণ করে। এর পোড়েন—বাণিজ্য। এ সভ্যতার উপায় তলওয়ার, সহায় বীরত্ব, উদ্দেশ্য ইহ-পারলৌকিক ভোগ।
আমাদের কথাটা কি? আর্যরা শান্তিপ্রিয়, চাষবাস করে, শস্যাদি উৎপন্ন করে শান্তিতে স্ত্রী-পরিবার পালন করতে পেলেই খুশী। তাতে হাঁপ ছাড়বার অবকাশ যথেষ্ট; কাজেই চিন্তাশীলতার, সভ্য হবার অবকাশ অধিক। আমাদের জনক রাজা স্বহস্তে লাঙ্গল চালাচ্ছেন এবং সে কালের সর্বশ্রেষ্ট আত্মাবিৎও তিনি। ঋষি, মুনি, যোগীর অভ্যুদয়—গোড়া থেকে; তাঁরা প্রথম হতেই জেনেছেন যে, সংসারটা ধোঁকা, লড়াই কর আর লুঠই কর, ভোগ বলে যা খুঁজছ তা আছে শান্তিতে; শান্তি আছেন শারীরিক ভোগ-বিসর্জনে; ভোগ আছেন মননশীলতায়, বুদ্ধিচর্চায়; শরীরচর্চায় নেই। জঙ্গল আবাদ করা তাদের কাজ। তারপর, প্রথমে সে পরিষ্কৃত ভূমিতে নির্মিত হল যজ্ঞ বেদী, উঠল সে নির্মল আকাশে যজ্ঞের ধূম, সে বায়ুতে বেদমন্ত্র প্রতিধ্বনিত হতে লাগল, গবাদি পশু নিঃশঙ্কে চরতে লাগল। বিদ্যা ও ধর্মের পায়ের নীচে তলওয়ার রইল। তার একমাত্র কাজ ধর্মরক্ষা করা, মানুষ ও গবাদি পশুর পরিত্রাণ করা, বীরের নাম আপৎ-ত্রাতা ক্ষত্রিয়। লাঙ্গল, তলওয়ার সকলের অধিপতি রক্ষক রইলেন ধর্ম। তিনি রাজার রাজা, জগৎ নিদ্রিত হলেও তিনি সদা জাগরূক। ধর্মের আশ্রয়ে সকলে রইল স্বাধীন।
ঐ যে ইওরোপী পণ্ডিত বলছেন যে, আর্যেরা কোথা হতে উড়ে এসে ভারতের ‘বুনো’ দের মেরে-কেটে জমি ছিনিয়ে নিয়ে বাস করলেন—ও-সব আহাম্মকের কথা। আমাদের পণ্ডিতরাও দেখছি সে গোঁয়ে গোঁ—আবার ঐ সব বিরূপ মিথ্যা ছেলেপুলেদের শোনানো হচ্ছে। এ অতি অন্যায়।
আমি মূর্খ মানুষ, যা বুঝি তাই নিয়েই এ পারি-সভায় বিশেষ প্রতিবাদ করেছি। এদেশী এবং স্বদেশী পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করেছি। সময় পেলে আরও সংশয় ওঠাবার আশা আছে। এ কথা তোমাদেরও বলি—তোমরা পণ্ডিত-মনিষ্যি, পুঁথি-পাতড়া খুঁজে দেখ।
ইওরোপীরা যে দেশে বাগ পান, আদিম মানুষকে নাশ করে নিজেরা সুখে বাস করেন, অতএব আর্যরাও তাই করেছে!! ওরা হা-ঘরে, ‘হা-অন্ন হা-অন্ন’ করে, কাকে লুঠবে মারবে বলে ঘুরে বেড়ায়—আর্যরাও তাই করেছে!! বলি, এর প্রমাণটা কোথায়—আন্দাজ? ঘরে তোমার আন্দাজ রাখগে।
কোন্ বেদে, কোন্ সূক্তে, কোথায় দেখছ যে, আর্যরা কোন বিদেশ থেকে এদেশে এসেছে? কোথায় পাচ্ছ যে, তাঁরা বুনোদের মেরে কেটে ফেলেছেন? খামকা আহাম্মকির দরকারটা কি? আর রামায়ণ পড়া তো হয়নি, খামকা এক বৃহৎ গল্প—রামায়ণের উপর—কেন বানাচ্ছ?
রামায়ণ কিনা আর্যদের দক্ষিণী বুনো-বিজয়!! বটে—রামচন্দ্র আর্য রাজা, সুসভ্য; লড়ছেন কার সঙ্গে?—লঙ্কার রাবণ রাজার সঙ্গে। সে রাবণ, রামায়ণ পড়ে দেখ, ছিলেন রামচন্দ্রের দেশের চেয়ে সভ্যতায় বড় বৈ কম নয়। লঙ্কার সভ্যতা অযোধ্যার চেয়ে বেশী ছিল বরং, কম তো নয়ই। তারপর বানরাদি দক্ষিণী লোক বিজিত হল কোথায়? তারা হল সব শ্রীরামচন্দ্রের বন্ধু মিত্র। কোন্ গুহকের, কোন্ বালির রাজ্য রামচন্দ্র ছিনিয়ে নিলেন—তা বল না?
হতে পারে দু-এক জায়গায় আর্য আর বুনোদের যুদ্ধ হয়েছে, হতে পারে দু-একটা ধূর্ত মুনি রাক্ষসদের জঙ্গলের মধ্যে ধুনি জ্বালিয়ে বসেছিল। মটকা মেরে চোখ বুজিয়ে বসেছে, কখন রাক্ষসেরা ঢিলঢেলা হাড়গোড় ছোঁড়ে। যেমন হাড়গোড় ফেলা, অমনি নাকিকান্না ধরে রাজাদের কাছে গমন। রাজারা লোহার জামাপরা, লোহার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘোড়া চড়ে এলেন; বুনো হাড় পাথর ঠেঙ্গা নিয়ে কতক্ষণ লড়বে? রাজারা মেরে ধরে চলে গেল। এ হতে পারে; কিন্তু এতেও বুনোদের জঙ্গল কেড়ে নিয়েছে, কোথায় পাচ্ছ?
অতি বিশাল নদনদীপূর্ণ, উষ্ণপ্রধান সমতল ক্ষেত্র—আর্যসভ্যতার তাঁত। আর্যপ্রধান, নানাপ্রকার সুসভ্য, অর্ধসভ্য, অসভ্য মানুষ—এ বস্ত্রের তুলো, এর টানা হচ্ছে—বর্ণাশ্রমাচার,২৫ এর পোড়েন—প্রাকৃতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ নিবারণ।
তুমি ইওরোপী, কোন্ দেশকে কবে ভাল করেছ? অপেক্ষাকৃত অবনত জাতিকে তোলবার তোমার শক্তি কোথায়? যেখানে দুর্বল জাতি পেয়েছ. তাদের সমূলে উৎসাদন করেছ, তাদের জমিতে তোমরা বাস করছ, তারা একেবারে বিনিষ্ট হয়ে গেছে। তোমাদের আমেরিকার ইতিহাস কি? তোমাদের অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিলণ্ড, প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জ—তোমাদের আফ্রিকা?
কোথা সে সকল বুনো জাত আজ? একেবারে নিপাত, বন্য পশুবৎ তাদের তোমরা মেরে ফেলেছ; যেখানে তোমাদের শক্তি নাই, সেথা মাত্র অন্য জাত জীবিত।
আর ভারতবর্ষ তা কস্মিন্কালেও করেননি। আর্যেরা অতি দয়াল ছিলেন। তাঁদের অখণ্ড সমুদ্রবৎ বিশাল হৃদয়ে, অমানব-প্রতিভাসম্পন্ন মাথায় ওসব আপাতরমণীয় পাশব প্রণালী কোন কালেও স্থান পায়নি। স্বদেশী আহাম্মক! যদি আর্যেরা বুনোদের মেরে ধরে বাস করত, তা হলে এ বর্ণাশ্রমের সৃষ্টি কি হত?
ইওরোপের উদ্দেশ্য—সকলকে নাশ করে আমরা বেঁচে থাকব। আর্যদের উদ্দেশ্য—সকলকে আমাদের সমান করব, আমাদের চেয়ে বড় করব। ইওরোপের সভ্যতার উপায়—তলওয়ার; আর্যের উপায়—বর্ণবিভাগ। শিক্ষা সভ্যতার তারতম্যে, সভ্যতা শেখবার সোপান—বর্ণ-বিভাগ। ইওরোপে বলবানের জয়, দুর্বলের মৃত্যু; ভারতবর্ষের প্রত্যেক সামাজিক নিয়ম দুর্বলকে রক্ষা করবার জন্য।
ইওরোপীরা যার এত বড়াই করে, সে ‘সভ্যতার উন্নতি’র (Progress of Civilization) মানে কি? তার মানে এই যে, উদ্দেশ্যসিদ্ধি—অনুচিত উপায়কে উচিত করে। চুরি, মিথ্যা এবং ফাঁসি অথবা ষ্টানলি (Stanley) দ্বারা তাঁর সমভিব্যাহারী ক্ষুধার্ত মুসলমান রক্ষীদের—এক গ্রাস অন্ন চুরি করার দরুন চাবকানো, এ-সকলের ঔচিত্য বিধান করে; ‘দূর হও, আমি ওথায় আসতে চাই’-রূপ বিখ্যাত ইওরোপী নীতি, যার দৃষ্টান্ত—যেথায় ইওরোপী-আগমন, সেথাই আদিম জাতির বিনাশ—সেই নীতির ঔচিত্য বিধান করে! এই সভ্যতার অগ্রসরণ লণ্ডন নগরীতে ব্যভিচারকে, পারিতে স্ত্রীপুত্রাদিকে অসহায় অবস্থায় ফেলে পালানোকে এবং আত্মহত্যা করাকে ‘সামান্য দৃষ্টান্ত’ জ্ঞান করে—ইত্যাদি।
এখন ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীব্যাপী ক্ষিপ্র সভ্যতাবিস্তারের সঙ্গে ক্রিশ্চানধর্মের প্রথম তিন শতাব্দীর তুলনা কর। ক্রিশ্চানধর্ম প্রথম তিন শতাব্দীতে জগৎসমক্ষে আপনাকে পরিচিত করতে সমর্থ হয়নি, এবং যখন কনষ্টাণ্টাইন (Constantine)-এর তলওয়ার একে রাজ্যমধ্যে স্থান দিলে, সেদিন থেকে কোন্ কালে ক্রিশ্চানী ধর্ম আধ্যাত্মিক বা সাংসারিক সভ্যতাবিস্তারের কোন্ সাহায্য করেছে? যে ইওরোপী পণ্ডিত প্রথম প্রমাণ করেন যে পৃথিবী সচলা, ক্রিশ্চানধর্ম তাঁর কি পুরস্কার দিয়েছিল? কোন্ বৈজ্ঞানিক কোন্ কালে ক্রিশ্চানী ধর্মের অনুমোদিত? ক্রিশ্চানী সঙ্ঘের সাহিত্য কি দেওয়ানী বা ফৌজদারী বিজ্ঞানের, শিল্প বা পণ্য-কৌশলের অভাব পূরণ করতে পারে? আজ পর্যন্ত ‘চর্চ’ প্রোফেন (ধর্ম ভিন্ন অন্য বিষয়াবলম্বনে লিখিত) সাহিত্য-প্রচারে অনুমতি দেন না। আজ যে মনুষ্যের বিদ্যা এবং বিজ্ঞানে প্রবেশ আছে, তার কি অকপট ক্রিশ্চান হওয়া সম্ভব? নিউ টেষ্টামেণ্ট (Testament)-এ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন বিজ্ঞান বা শিল্পের প্রশংসা নেই। কিন্তু এমন বিজ্ঞান বা শিল্প নেই যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোরান বা হদিসের বহু বাক্যের দ্বারা অনুমোদিত এবং উৎসাহিত নয়। ইওরোপের সর্বপ্রধান মনীষিগণ—ইওরোপের ভলটেয়ার, ডারউইন, বুকনার, ফ্লমারিয়ঁ, ভিক্টর হুগো-কুল বর্তমানকালে ক্রিশ্চানী দ্বারা কটুভাষিত এবং অভিশপ্ত, অপরদিকে এই সকল পুরুষকে ইসলাম বিবেচনা করেন যে, এই সকল পুরুষ আস্তিক, কেবল ইহাদের পয়গম্বর-বিশ্বাসের অভাব। ধর্মসকলের উন্নতির বাধকত্ব বা সহায়কত্ব বিশেষরূপে পরীক্ষিত হোক; দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায়ই আদিমনিবাসীদের রক্ষা করেছে। সে-সব জাত সেথায় বর্তমান। তাদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান।
ক্রিশ্চানধর্ম কোথায় এমন কাজ দেখাতে পারে? স্পেনের আরাব, অষ্ট্রেলিয়ার এবং আমেরিকার আদিমনিবাসীরা কোথায়? ক্রিশ্চানেরা ইওরোপী য়াহুদীদের কি দশা এখন করছে? এক দানসংক্রান্ত কার্যপ্রণালী ছাড়া ইওরোপের আর কোন কার্যপদ্ধতি, গস্পেলের (Gospel) অনুমোদিত নয়—গস্পেলের বিরুদ্ধে সমুত্থিত। ইওরোপে যা কিছু উন্নতি হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই ক্রিশ্চানধর্মের বিপক্ষে বিদ্রোহ দ্বারা। আজ যদি ইওরোপে ক্রিশ্চানীর শক্তি থাকত, তাহলে ‘পাস্তের’ (Pasteur) এবং ‘কক’-এর (Koch) ন্যায় বৈজ্ঞানিকসকলকে জীবন্ত পোড়াত এবং ডারউইন-কল্পদের শূলে দিত। বর্তমান ইওরোপে ক্রিশ্চানী আর সভ্যতা—আলাদা জিনিষ। সভ্যতা এখন তার প্রাচীন শত্রু ক্রিশ্চানীর বিনাশের জন্য পাদ্রীকুলের উৎসাদনে এবং তাদের হাত থেকে বিদ্যালয় এবং দাতব্যালয়সকল কেড়ে নিতে কটিবদ্ধ হয়েছে। যদি মূর্খ চাষার দল না থাকত, তাহলে ক্রিশ্চানী তার ঘৃণিত জীবন ক্ষণমাত্র ধারণ করতে সমর্থ হত না এবং সমূলে উৎপাটিত হত; কারণ নগরস্থিত দরিদ্রবর্গ এখনই ক্রিশ্চানী ধর্মের প্রকাশ্য শত্রু! এর সঙ্গে ইসলামের তুলনা কর। মুসলমান-দেশে যাবতীয় পদ্ধতি ইসলাম ধর্মের উপরে সংস্থাপিত এবং ইসলামের ধর্মশিক্ষকেরা সমস্ত রাজকর্মচারীদের বহুপূজিত এবং অন্য ধর্মের শিক্ষকেরাও সম্মানিত।
পাশ্চাত্য দেশে লক্ষী-সরস্বতীর এখন কৃপা একত্রে। শুধু ভোগের জিনিষ সংযোগ হলেই এরা ক্ষান্ত নয়, কিন্তু সকল কাজেই একটু সুচ্ছবি চায়। খাওয়া-দাওয়া ঘর-দোর সমস্তই একটু সুচ্ছবি দেখতে চায়। আমাদের দেশেও ঐ ভাব একদিন ছিল, যখন ধন ছিল! এখন একে দারিদ্র, তার ওপর আমরা ‘ইতোনষ্টস্ততোভ্রষ্টঃ’ হয়ে যাচ্ছি। জাতীয় যে গুণগুলি ছিল, তাও যাচ্ছে—পাশ্চাত্য দেশেরও কিছুই পাচ্ছি না! চলা-বসা কথাবার্তায় একটা সেকেলে কায়দা ছিল, তা উৎসন্ন গেছে, অথচ পাশ্চাত্য কায়দা নেবারও সামর্থ্য নেই। পূজা পাঠ প্রভৃতি যা কিছু ছিল, তা তো আমরা বানের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছি, অথচ কালের উপযোগী একটা নূতন রকমের কিছু এখনও হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, আমরা এই মধ্যরেখার দুর্দশায় এখন পড়ে।
ভবিষ্যৎ বাঙলাদেশ এখনও পায়ের উপর দাঁড়ায়নি। বিশেষ দুর্দশা হয়েছে শিল্পের। সেকেলে বুড়ীরা ঘরদোর আলপনা দিত, দেওয়ালে চিত্রবিচিত্র করত। বাহার করে কলাপাতা কাটত, খাওয়া-দাওয়া নানাপ্রকার শিল্পচাতুরীতে সাজাত, সে সব চুলোয় গেছে বা যাচ্ছে শীঘ্র শীঘ্র!! নূতন অবশ্য শিখতে হবে, করতে হবে, কিন্তু তা বলে কি পুরানোগুলো জলে ভাসিয়ে দিয়ে না কি? নূতন তো শিখেছ কচুপোড়া, খালি বাক্যিচচ্চড়ি!! কাজের বিদ্যা কি শিখেছ? এখনও দূর পাড়াগাঁয়ে পুরানো কাঠের কাজ, ইঁটের কাজ দেখে এস গে। কলকেতার ছুতোর এক জোড়া দোর পর্যন্ত গড়তে পারে না! দোর কি আগড় বোঝবার যো নেই!!! কেবল ছুতোরগিরির মধ্যে আছে বিলিতী যন্ত্র কেনা!! এই অবস্থা সর্ববিষয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের যা ছিল, তা তো সব যাচ্ছে; অথচ বিদেশী শেখবার মধ্যে বাকী-যন্ত্রণা মাত্র!! খালি পুঁথি পড়ছ আর পুঁথি পড়ছ! আমাদের বাঙালী আর বিলেতে আইরিশ, এ দুটো এক ধাতের জাত। খালি বকাবকি করছে। বক্তৃতায় এ দু-জাত বেজায় পটু। কাজের—এক পয়সাও নয়, বাড়ার ভাগ দিনরাত পরস্পরে খেয়োখেয়ি করে মরছে!!!
পরিষ্কার সাজান-গোজান এ দেশের (পাশ্চাত্যে) এমন অভ্যাস যে, অতি গরীব পর্যন্তরও ও-বিষয়ে নজর। আর নজর কাজেই হতে হয়—পরিষ্কার কাপড়-চোপড় না হলে তাকে যে কেউ কাজ-কর্মই দেবে না। চাকর-চাকরানী, রাঁধুনী সব ধপধপে কাপড়—দিবারাত্র। ঘরদোর ঝেড়েঝুড়ে, ঘষেমেজে ফিটফাট। এদের প্রধান শায়েস্তা এই যে, যেখানে সেখানে যা তা কখনও ফেলবে না! রান্নাঘর ঝকঝকে—কুটনো-ফুটনো যা ফেলবার তা একটা পাত্রে ফেলছে, তারপর সেখান হতে দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। উঠানেও ফেলে না। রাস্তায়ও ফেলে না।
যাদের ধন আছে তাদের বাড়ীঘর তো দেখবার জিনিষ—দিনরাত সব ঝকঝক! তার ওপর নানাপ্রকার দেশবিদেশের শিল্পদ্রব্য সংগ্রহ করেছে! আমাদের এখন ওদের মত শিল্প-সংগ্রহে কাজ নেই, কিন্তু যেগুলো উৎসন্ন যাচ্ছে, সেগুলোকে একটু যত্ন করতে হবে, না—না? ওদের মত চিত্র বা ভাস্কর্য-বিদ্যা হতে আমাদের এখনও ঢের দেরী! ও দুটো কাজে আমরা চিরকালই অপুট। আমাদের ঠাকুরদেবতা সব দেখ না, জগন্নাথেই মালুম!! বড্ড জোর ওদের (ইওরোপীয়দের)। নকল করে একটা আধটা রবিবর্মা দাঁড়ায়!! তাদের চেয়ে দিশী চালচিত্রি-করা পোটো ভাল—তাদের কাজে তবু ঝকঝকে রঙ আছে। ওসব রবিবর্মা-ফর্মা চিত্রি দেখলে লজ্জায় মাথা কাটা যায়!! বরং জয়পুরে সোনালী চিত্রি, আর দুর্গাঠাকুরের চালচিত্রি প্রভৃতি আছে ভাল। ইওরোপী ভাস্কর্য চিত্র প্রভৃতির কথা বারান্তরে উদাহরণ সহিত বলবার রইল। সে এক প্রকাণ্ড বিষয়।
বৈদিক পুরোহিতের মন্ত্রবলে বলীয়ান্, দেবগণ তাঁহার মন্ত্রবলে আহূত হইয়া পান-ভোজন গ্রহণ করেন ও যজমানকে অভীপ্সিত ফল প্রদান করেন। ইহলৌকিক মঙ্গলের কামনায় প্রজাবর্গ, রাজন্যবর্গও তাঁহার দ্বারস্থ। রাজা সোম১ পুরোহিতের উপাস্য, বরদ ও মন্ত্রপুষ্ট; আহুতিগ্রহণেপ্সু দেবগণ কাজেই পুরোহিতের উপর সদয়; দৈববলের উপর মানব-বল কি করিতে পারে? মানব-বলের কেন্দ্রীভূত রাজাও পুরোহিতবর্গের অনুগ্রহপ্রার্থী। তাঁহাদের কৃপাদৃষ্টিই যথেষ্ট সাহায্য; তাঁহাদের আশীর্বাদ সর্বশ্রেষ্ট কর; কখনও বিভীষিকা-সংকুল আদেশ, কখনও সহৃদয় মন্ত্রণা, কখনও কৌশলময় নীতিজাল-বিস্তার রাজশক্তিকে অনেক সময়েই পুরোহিতকুলের নির্দেশবর্তী করিয়াছে। সকলের উপর ভয়-পিতৃপুরুষদিগের নাম, নিজের যশোলিপি পুরোহিতের লেখনীর অধীন। মহাতেজস্বী, জীবদ্দশায় অতি কীর্তিমান্, প্রজাবর্গের পিতৃমাতৃস্থানীয় হউন না কেন, মহাসমুদ্রে শিশিরবিন্দুপাতের ন্যায় কালসমুদ্রে তাঁহার যশঃসূর্য চিরদিন অস্তমিত; কেবল মহাসত্রানুষ্ঠায়ী, অশ্বমেধযাজী, বর্ষার বারিদের ন্যায় পুরোহিতগণের উপর অজস্র-ধন-বর্ষণকারী রাজগণের নামই পুরোহিত-প্রসাদে জাজ্বল্যমান। দেবগণের প্রিয়, প্রিয়দর্শী ধর্মাশোক ব্রাহ্মণ্য-জগতে নাম-মাত্র-শেষ; পরীক্ষিত জনমেজয় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার চিরপরিচিত।
রাজ্য-রক্ষা, নিজের বিলাস, বন্ধুবর্গের পুষ্টি ও সর্বাপেক্ষা পুরোহিতকুলের তুষ্টির নিমিত্ত রাজরবি প্রজাবর্গকে শোষণ করিতেন। বৈশ্যেরা রাজার খাদ্য, তাঁহার দুগ্ধবতী গাভী।
কর-গ্রহণে, রাজ্য-রক্ষায় প্রজাবর্গের মতামতের বিশেষ অপেক্ষা নাই—হিন্দুজগতেও নাই, বৌদ্ধজগতেও তদ্রূপ। যদিও যুধিষ্ঠির বারণাবতে বৈশ্য-শূদ্রেরও গৃহে পদার্পণ করিতেছেন, প্রজারা রামচন্দ্রের যৌবরাজ্যে অভিষেক প্রার্থনা করিতেছেন, সীতার বনবাসের জন্য গোপন মন্ত্রণা করিতেছে, কিন্তু সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ-সম্বন্ধে রাজ্যের প্রথা-স্বরূপ, প্রজাদের কোন বিষয়ে উচ্চবাচ্য নাই। প্রজাশক্তি আপনার ক্ষমতা অপ্রত্যক্ষভাবে বিশৃঙ্খলরূপে প্রকাশ করিতেছে। সে শক্তির অস্তিত্বে প্রজাবর্গের এখনও জ্ঞান হয় নাই। তাহাতে সমবায়ের উদ্যোগ বা ইচ্ছাও নাই; সে কৌশলেরও সম্পূর্ণ অভাব, যাহা দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিপুঞ্জ একীভূত হইয়া প্রচণ্ড বল সংগ্রহ করে।
নিয়মের [যে] অভাব—তাহাও নহে; নিয়ম আছে, প্রণালী আছে, নির্ধারিত অংশ আছে, কর-সংগ্রহ ও সৈন্যচালনা বা বিচার-সম্পাদন বা দণ্ড-পুরস্কার সকল বিষয়েরই পুঙ্খানুপুঙ্খ নিয়ম আছে, কিন্তু তাহার মূলে ঋষির আদেশ, দৈবশক্তি, ঈশ্বরাবেশ। তাহার স্থিতিস্থাপকত্ব একেবারেই নাই বলিলেই হয় এবং তাহাতে প্রজাবর্গের সাধারণ মঙ্গলকর কার্য-সাধোনোদ্দেশে সহমতি হইবার বা সমবেত বুদ্ধিযোগে রাজগৃহীত প্রজার ধনে সাধারণ স্বত্ববুদ্ধি ও তাহার আয়-ব্যয়-নিয়মনের শক্তিলাভেচ্ছার কোন শিক্ষার সম্ভাবনা নাই।
আবার ঐ সকল নির্দেশ—পুস্তকে। পুস্তকাবদ্ধ নিয়ম ও তাহার কার্য-পরিণতি, এ দুয়ের মধ্যে দূর—অনেক। একজন রামচন্দ্র শত শত অগ্নিবর্ণের২ পরে জন্মগ্রহণ করেন! চণ্ডাশোকত্ব অনেক রাজাই আজন্ম দেখাইয়া যান, ধর্মাশোকত্ব৩ অতি অল্পসংখ্যক। আকবরের ন্যায় প্রজারক্ষকের সংখ্যা আরঙ্গজীবের ন্যায় প্রজাভক্ষকের অপেক্ষা অনেক অল্প।
হউন যুধিষ্ঠির বা রামচন্দ্র বা ধর্মাশোক বা আকবর, পরে যাহার মুখে সর্বদা অন্ন তুলিয়া দেয়, তাহার ক্রমে নিজের অন্ন উঠাইয়া খাইবার শক্তি লোপ পায়। সর্ব বিষয়ে অপরে যাহাকে রক্ষা করে, তাহার আত্মরক্ষা শক্তির স্ফূর্তি কখনও হয় না। সর্বদাই শিশুর ন্যায় পালিত হইলে অতি বলিষ্ঠ যুবাও দীর্ঘকায় শিশু হইয়া যায়। দেবতুল্য রাজা দ্বারা সর্বতোভাবে পালিত প্রজাও কখনও স্বায়ত্তশাসন শিখে না; রাজমুখাপেক্ষী হইয়া ক্রমে নির্বীর্য ও নিঃশক্তি হইয়া যায়। ঐ ‘পালিত’ ‘রক্ষিত’ই দীর্ঘস্থায়ী হইলে সর্বনাশের মূল।
মহাপুরুষদিগের অলৌকিক প্রাতিভ-জ্ঞানোৎপন্ন শাস্ত্রশাসিত সমাজের শাসন রাজা, প্রজা, ধনী, নির্ধন, মূর্খ, বিদ্বান্—সকলের উপর অব্যাহত হওয়া অন্ততঃ বিচারসিদ্ধ, কিন্তু কার্যে কতদূর হইয়াছে বা হয়, পূর্বেই বলা হইয়াছে। শাসিতগণের শাসনকার্যে অনুমতি—যাহা আধুনিক পাশ্চাত্য জগতের মূলমন্ত্র এবং যাহার শেষ বাণী আমেরিকার শাসনপদ্ধতি-পত্রে অতি উচ্চরবে ঘোষিত হইয়াছে, ‘এ দেশে প্রজাদিগের শাসন প্রজাদিগের দ্বারা এবং প্রজাদিগের কল্যাণের নিমিত্ত হইবে’, [তাহা] যে একেবারেই ভারতবর্ষে ছিল না তাহাও নহে। যবন৪ পরিব্রাজকেরা অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীনতন্ত্র এদেশে দেখিয়াছিলেন, বৌদ্ধদিগের গ্রন্থেও স্থলে স্থলে নিদর্শন পাওয়া যায়, এবং প্রকৃতি৫ দ্বারা অনুমোদিত শাসনপদ্ধতির বীজ যে নিশ্চিত গ্রাম্য পঞ্চায়েতে বর্তমান ছিল এবং এখনও স্থানে স্থানে আছে, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। কিন্তু সে বীজ যে স্থানে উপ্ত হইয়াছিল, অঙ্কুর সেথায় উদ্গত হইল না; এ ভাব ঐ গ্রাম্য পঞ্চায়েত ভিন্ন সমাজমধ্যে কখনও সম্প্রসারিত হয় নাই।
ধর্মসমাজে ত্যাগীদের মধ্যে, বৌদ্ধ যতিগণের মঠে ঐ স্বায়ত্ত-শাসনপ্রণালী বিশেষরূপে পরিবর্ধিত হইয়াছিল, তাহার নিদর্শন যথেষ্ট আছে এবং অদ্যাপি নাগা সন্ন্যাসীদের মধ্যে ‘পঞ্চে’র ক্ষমতা ও সম্মান, প্রত্যেক নাগার সম্প্রদায়মধ্যে অধিকার ও উক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সমবায়-শক্তির কার্য দেখিলে চমৎকৃত হইতে হয়।
বৌদ্ধোপপ্লাবনের সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিতের শক্তির ক্ষয় ও রাজন্যবর্গের শক্তির বিকাশ।
বৌদ্ধযুগের পুরোহিত সর্বত্যাগী, মঠাশ্রয়, উদাসীন। ‘শাপেন চাপেন বা’৬ রাজকুলকে পদানত করিয়া রাখিতে তাঁহাদের উৎসাহ বা ইচ্ছা নাই। থাকিলেও আহুতিভোজী দেবকুলের অবনতির সহিত তাঁহাদের প্রতিষ্ঠাও নিম্নাভিমুখী; কত শত ব্রহ্মা-ইন্দ্রাদি বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত নরদেবের চরণে প্রণত এবং এই বুদ্ধত্বে মনুষ্যমাত্রেরই অধিকার।
কাজেই রাজশক্তিরূপ মহাবল যজ্ঞাশ্ব আর পুরোহিত-হস্তধৃত-দৃঢ়সংযত-রশ্মি নহে; সে এবার আপন বলে স্বচ্ছন্দচারী। এ যুগের শক্তিকেন্দ্র সামগায়ী যজুর্যাজী পুরোহিতে নাই, রাজশক্তিও ভারতের বিকীর্ণ ক্ষত্রিয়বংশ-সম্ভূত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মণ্ডলীপতিতে সমাহিত নহে; এ যুগের দিগ্দিগন্তব্যাপী অপ্রতিহতশাসন আসমুদ্রক্ষিতীশগণই মানবশক্তিকেন্দ্র। এ যুগের নেতা আর বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ নহেন, কিন্তু সম্রাট্ চন্দ্রগুপ্ত, ধর্মাশোক প্রভৃতি। বৌদ্ধযুগের একচ্ছত্র পৃথিবীপতি সম্রাড়গ্ণের ন্যায় ভারতের গৌরববৃদ্ধিকারী রাজগণ আর কখনও ভারত-সিংহাসনে আরূঢ় হন নাই, এ যুগের শেষে আধুনিক হিন্দুধর্ম ও রাজপুতাদি জাতির অভ্যুত্থান। ইঁহাদের হস্তে ভারতের রাজদণ্ড পুনর্বার অখণ্ড প্রতাপ হইতে বিচ্যুত হইয়া শতখণ্ড হইয়া যায়। এই সময়ে ব্রাহ্মণ্যশক্তির পুনরভ্যুত্থান রাজশক্তির সহিত সহকারিভাবে উদ্যুক্ত হইয়াছিল।
এ বিপ্লবে—বৈদিক কাল হইতে আরদ্ধ হইয়া জৈন ও বৌদ্ধ-বিপ্লবে বিরাটরূপে স্ফুটীকৃত পুরোহিতশক্তি ও রাজশক্তির যে চিরন্তন বিবাদ, তাহা মিটিয়া গিয়াছে। এখন এ দুই মহাবল পরস্পর সহায়ক, কিন্তু সে মহিমান্বিত ক্ষাত্রবীর্যও নাই, ব্রহ্মবীর্যও লুপ্ত। পরস্পরের স্বার্থের সহায়, বিপক্ষ পক্ষের সমূল উৎকাষণ৭, বৌদ্ধবংশের সমূলে নিধন ইত্যাদি কার্যে ক্ষয়িতবীর্য এ নূতন শক্তিসঙ্গম নানাভাবে বিভক্ত হইয়া, প্রায় গতপ্রাণ হইয়া পড়িল; শোণিত-শোষণ, বৈর-নির্যাতন, ধনহরণাদি ব্যাপারে নিয়ত নিযুক্ত হইয়া, পূর্ব রাজন্যবর্গের রাজসূয়াদি যজ্ঞের হাস্যোদ্দীপক অভিনয়ের অঙ্কপাতমাত্র করিয়া, ভাটচারণাদি-চাটুকার-শৃঙ্খলিত-পদ ও মন্ত্রতন্ত্রের মহাবাগ্জাল-জড়িত হইয়া পশ্চিমদেশাগত মুসলমান ব্যাধনিচয়ের সুলভ মৃগয়ায় পরিণত হইল।
যে পুরোহিতশক্তির সহিত রাজশক্তির সংগ্রাম বৈদিক কাল হইতেই চলিতেছিল, ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের অমানব প্রতিভা স্বীয় জীবদ্দশায় যাহার ক্ষত্রপ্রতিবাদিতা প্রায় ভঞ্জন করিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছিল, যে ব্রাহ্মণ্যশক্তি জৈন ও বৌদ্ধ উপপ্লাবনে ভারতের কর্মক্ষেত্র হইতে প্রায় অপসৃত হইয়াছিল, অথবা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের আজ্ঞানুবর্তী হইয়া কথঞ্চিৎ জীবনধারণ করিতেছিল, যাহা মিহিরকুলাদির৮ ভারতাধিকার হইতে কিছুকাল প্রাণপণে পূর্বপ্রাধান্য স্থাপন করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, এবং ঐ প্রাধান্যস্থাপনের জন্য মধ্য-এশিয়া হইতে সমাগত ক্রূরকর্মা বর্বরবাহিনীর পদানত হইয়া, তাহাদের বীভৎস রীতিনীতি স্বদেশে স্থাপন করিয়া, বিদ্যাবিহীন বর্বর ভুলাইবার সোজা পথ মন্ত্রতন্ত্র-মাত্র-আশ্রয় হইয়া, এবং তজ্জন্য নিজে সর্বতোভাবে হতবিদ্য, হতবীর্য, হতাচার হইয়া আর্যাবর্তকে একটি প্রকাণ্ড বাম-বীভৎস ও বর্বরাচারের আবর্তে পরিণত করিয়াছিল, এবং যাহা কুসংস্কার ও অনাচারের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ সারহীন ও অতি দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল, পশ্চিম হইতে সমুত্থিত মুসলমানাক্রমণরূপ প্রবল বায়ুর স্পর্শমাত্রেই তাহা শতধা ভগ্ন মৃত্তিকায় পতিত হইল। পুনর্বার কখনও উঠিবে কি, কে জানে?
মুসলমান-রাজত্বে অপরদিকে পৌরোহিত্যশক্তির প্রাদুর্ভাব অসম্ভব। হজরত মহম্মদ সর্বতোভাবে ঐ শক্তির বিপক্ষে ছিলেন এবং যথাসম্ভব ঐ শক্তির একান্ত বিনাশের জন্য নিয়মাদি করিয়া গিয়াছেন। মুসলমান-রাজত্বে রাজাই স্বয়ং প্রধান পুরোহিত; তিনিই ধর্মগুরু; এবং সম্রাট্ হইলে [তিনি] প্রায়ই সমস্ত মুসলমান জগতের নেতা হইবার আশা রাখেন। য়াহুদী বা ঈশাহী৯ মুসলমানের নিকট সম্যক্ ঘৃণ্য নহে, তাহারা অল্পবিশ্বাসী মাত্র; কিন্তু কাফের১০ মূর্তিপূজাকারী হিন্দু এ জীবনে বলিদান ও অন্তে অনন্ত নরকের ভাগী। সেই কাফেরের ধর্মগুরুদিগকে—পুরোহিতদিগকে—দয়া করিয়া কোন প্রকারে জীবনধারণ করিতে আজ্ঞামাত্র মুসলমান রাজা দিতে পারেন, তাহাও কখনও কখনও; নতুবা রাজার ধর্মানুরাগ একটু বৃদ্ধি হইলেই কাফের হত্যারূপ মহাযজ্ঞের আয়োজন!
এক দিকে রাজশক্তি ভিন্নধর্মী ভিন্নাচারী প্রবল রাজগণে সঞ্চারিত; অপর দিকে পৌরোহিতশক্তি সমাজ-শাসনাধিকার হইতে সর্বতোভাবে বিচ্যুত। মন্বাদি ধর্মশাস্ত্রের স্থানে কোরানোক্ত দণ্ডনীতি, সংস্কৃত ভাষার স্থানে পারসী আরবী। সংস্কৃত ভাষা বিজিত ঘৃণিত হিন্দুদের ধর্মমাত্র-প্রয়োজন রহিল, অতএব পুরোহিতের হস্তে যথাকথঞ্চিৎ প্রাণধারণ করিতে লাগিল, আর ব্রাহ্মণ্যশক্তি বিবাহাদি রীতিনীতি-পরিচালনেই আপনার দুরাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করিতে রহিল, তাহাও যতক্ষণ মুসলমান রাজার দয়া।
বৈদিক ও তাহার সন্নিহিত উত্তরকালে পৌরোহিত্যশক্তির পেষণে রাজশক্তির স্ফূর্তি হয় নাই। বৌদ্ধবিপ্লবের পর ব্রাহ্মণ্যশক্তির বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের রাজশক্তির সম্পূর্ণ বিকাশ আমরা দেখিয়াছি। বৌদ্ধ সাম্রাজ্যের বিনাশ ও মুসলমান সাম্রাজ্য-স্থাপন—এই দুই কালের মধ্যে রাজপুত জাতির দ্বারা রাজশক্তির পুনরুদ্ভাবনের চেষ্টা যে বিফল হইয়াছিল তাহারও কারণ পৌরোহিত্যশক্তির নবজীবনের চেষ্টা।
পদদলিত-পৌরোহিত্যশক্তির মুসলমান রাজা বহু পরিমাণে মৌর্য, গুপ্ত, আন্ধ্র, ক্ষাত্রপাদি১১ সম্রাড়্বর্গের গৌরবশ্রী পুনরুদ্ভাসিত করিতে সক্ষম হইয়াছিল।
এই প্রকারে কুমারিল্ল হইতে শ্রীশঙ্কর ও শ্রীরামানুজাদিপরিচালিত, রাজপুতাদিবাহু, জৈনবৌদ্ধ-রূধিরাক্তকলেবর, পুনুরভ্যুত্থানেচ্ছু ভারতের পৌরোহিত্যশক্তি মুসলমানাধিকার-যুগে চিরদিনের মত প্রসুপ্ত রহিল। যুদ্ধবিগ্রহ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এ যুগে কেবল রাজায় রাজায়। এ যুগের শেষে যখন হিন্দুশক্তি মহারাষ্ট্র বা শিখবীর্যের মধ্যগত হইয়া হিন্দুধর্মের কথঞ্চিৎ পুনঃস্থাপনে সমর্থ হইয়াছিল, তখনও তাহার সঙ্গে পৌরোহিত্যশক্তির বিশেষ কার্য ছিল না; এমন কি, শিখেরা প্রকাশ্যভাবে ব্রাহ্মণ-চিহ্নাদি পরিত্যাগ করাইয়া, স্বধর্মলিঙ্গে ভূষিত করিয়া ব্রাহ্মণসন্তানকে স্বসম্প্রদায়ে গ্রহণ করে।
এই প্রকারে বহু ঘাত-প্রতিঘাতের পর, রাজশক্তির শেষ জয়—ভিন্ন-ধর্মাবলম্বী রাজন্যবর্গের নামে কয়েক শতাব্দী ধরিয়া ভারত-আকাশে প্রতিধ্বনিত হইল। কিন্তু এই যুগের শেষভাগে ধীরে ধীরে একটি অভিনব শক্তি ভারত-সংসারে আপনার প্রভাব বিস্তার করিতে লাগিল।
এ শক্তি এত নূতন, ইহার জন্ম-কর্ম ভারতবাসীর পক্ষে এমন অভাবনীয়, ইহার প্রভাব এমনই দুর্ধর্ষ যে, এখনও অপ্রতিহতদণ্ডধারী হইলেও মুষ্টিমেয় মাত্র ভারতবাসী বুঝিতেছে, এ শক্তিটি কি। আমরা ইংলণ্ডের ভারতাধিকারের কথা বলিতেছি।
অতি প্রাচীনকাল হইতেই ধনধান্যপূর্ণ ভারতের বিশাল ক্ষেত্র প্রবল বিদেশীর অধিকারস্পৃহা উদ্দীপিত করিয়াছে। বারংবার ভারতবাসী বিজাতির পদদলিত হইয়াছে। তবে ইংলণ্ডের ভারতাধিকার-রূপ বিজয়-ব্যাপারকে এত অভিনব বলি কেন?
অধ্যাত্মবলে মন্ত্রবলে শাস্ত্রবলে বলীয়ান্, শাপাস্ত্র, সংসারস্পৃহাশূন্য তপস্বীর ভ্রূকুটি-সম্মুখে দুর্ধর্ষ রাজশক্তিকে কম্পান্বিত হইতে ভারতবাসী চিরকালই দেখিয়া আসিতেছে। সৈন্যসহায়, মহাবীর, শস্ত্রবল রাজগণের অপ্রতিহত বীর্য ও একাধিপত্যের সম্মুখে প্রজাকুল—সিংহের সম্মুখে অজাযূথের ন্যায়, নিঃশব্দে আজ্ঞাবহন করে, তাহাও দেখিয়াছে; কিন্তু যে বৈশ্যকুল—রাজগণের কথা দূরে থাকুক, রাজকুটম্বগণের কাহারও সম্মুখে মহাধনশালী হইয়াও সর্বদা বদ্ধহস্ত ও ভয়ত্রস্ত—মুষ্টিমেয় সেই বৈশ্য, একত্রিত হইয়া ব্যাপার-অনুরোধে১২ নদী সমুদ্র উল্লঙ্ঘন করিয়া কেবল বুদ্ধি ও অর্থবলে ধীরে ধীরে চিরপ্রতিষ্ঠিত হিন্দু-মুসলমান রাজগণকে আপনাদের ক্রীড়া পুত্তলিকা করিয়া ফেলিবে, শুধু তাহাই নহে, স্বদেশীয় রাজন্যগণকেও অর্থবলে আপনাদের ভৃত্যত্ব স্বীকার করাইয়া তাঁহাদের শৌর্যবীর্য ও বিদ্যাবলকে নিজেদের ধনাগমের প্রবল যন্ত্র করিয়া লইবে ও যে দেশের মহাকবির অলৌকিক তুলিকায় উন্মেষিত, গর্বিত লর্ড একজন সাধারণ ব্যক্তিকে বলিতেছেন, ‘পামর, রাজসামন্তের পবিত্র দেহ স্পর্শ করিতে সাহস করিস’,—অচিরকাল মধ্যে ঐ দেশের প্রবল সামন্তবর্গের উত্তরাধিকারীরা যে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী নামক বণিকসম্প্রদায়ের আজ্ঞাবহ ভৃত্য হইয়া ভারতবর্ষে প্রেরিত হওয়া মানব-জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার শেষ সোপান ভাবিবে, [ইহা] ভারতবাসী কখনও দেখে নাই!
সত্ত্বাদি গুণত্রয়ের বৈষম্য-তারতম্যে প্রসূত ব্রাহ্মণাদি চতুবর্ণ সনাতন কাল হইতেই সকল সভ্য সমাজে বিদ্যমান আছে। কালপ্রভাবে আবার দেশভেদে ঐ চতুর্বর্ণের কোন কোনটির সংখ্যাধিক্য যা প্রতাপাধিক্য ঘটিতে থাকে, কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস-আলোচনায় বোধ হয় যে, প্রাকৃতিক নিয়মের বশে ব্রাহ্মণাদি চারি জাতি যথাক্রমে বসুন্ধরা ভোগ করিবে।
চীন, সুমের,১৩ বাবিল,১৪ মিসরী, খল্দে,১৫ আর্য, ইরানী,১৬ য়াহুদী, আরাব—এই সমস্ত জাতির মধ্যেই সমাজ-নেতৃত্ব প্রথম যুগে ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত-হস্তে। দ্বিতীয় যুগে ক্ষত্রিয়কুল অর্থাৎ রাজসমাজে বা একাধিকারী রাজার অভ্যুদয়।
বৈশ্য বা বাণিজ্যের দ্বারা ধনশালী সম্প্রদায়ের সমাজ-নেতৃত্ব কেবল ইংলণ্ডপ্রমুখ আধুনিক পাশ্চাত্য জাতিদিগের মধ্যেই প্রথম ঘটিয়াছে।
যদ্যপি প্রাচীন টায়র, কার্থেজ এবং অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন কালে ভেনিসাদি বাণিজ্যপ্রাণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য বহু প্রতাপশালী হইয়াছিল, কিন্তু তথায়ও যথার্থ বৈশ্যের অভ্যুদয় ঘটে নাই।
প্রাচীন রাজকুলের বংশধরেরাই সাধারণ ব্যক্তি ও আপনাদিগের দাসবর্গের সহায়তায় ঐ বাণিজ্য করাইতেন এবং তাহার উদ্বৃত্ত ভোগ করিতেন। দেশ-শাসনাদি কার্যে সেই কতিপয় পুরুষ সওয়ায়১৭ অন্য কাহারও কোন বাঙ্নিষ্পত্তির অধিকার ছিল না। মিসরাদি প্রাচীন দেশসমূহে ব্রাহ্মণ্যশক্তি অল্প দিন প্রাধান্য উপভোগ করিয়া রাজন্যশক্তির অধীন ও সহায় হইয়া বাস করিয়াছিল। চীনদেশে কুংফুছের১৮ প্রতিভায় কেন্দ্রীভূত রাজশক্তি, সার্ধদ্বিসহস্র বৎসরেরও অধিককাল পৌরোহিত্যশক্তিকে আপন ইচ্ছানুসারে পালন করিতেছে এবং গত দুই শতাব্দী ধরিয়া সর্বগ্রাসী তিব্বতীয় লামারা রাজগুরু হইয়াও সর্বপ্রকারে সম্রাটের অধীন হইয়া কালযাপন করিতেছেন।
ভারতবর্ষে রাজশক্তির জয় ও বিকাশ অন্যান্য প্রাচীন সভ্য জাতিদের অপেক্ষা অনেক পরে হইয়াছিল এবং তজ্জন্যই চীন মিসর বাবিলাদি জাতিদিগের অনেক পরে ভারতে সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থান। এক য়াহুদী জাতির মধ্যে রাজশক্তি বহু চেষ্টা করিয়াও পৌরোহিত্যশক্তির উপর আধিপত্যবিস্তারে সম্পূর্ণ অক্ষম হইয়াছিল। বৈশ্যবর্গও সে দেশে কখনও ক্ষমতা লাভ করে নাই। সাধারণ প্রজা—পৌরোহিত্যবন্ধনযুক্ত হইবার চেষ্টা করিয়া অভ্যন্তরে ঈশাহী ইত্যাদি ধর্মসম্প্রদায়-সংঘর্ষে ও বাহিরে মহাবল রোমক রাজ্যের পেষণে উৎসন্ন হইয়া গেল।
যে প্রকার প্রাচীন যুগে রাজশক্তির পরাক্রমে ব্রাহ্মণ্যশক্তি বহু চেষ্টা করিয়াও পরাজিত হইয়াছিল, সেই প্রকার এই যুগে নবোদিত বৈশ্যশক্তির প্রবলাঘাতে কত রাজমুকুট ধূল্যবলুণ্ঠিত হইল, কত রাজদণ্ড চিরদিনের মত ভগ্ন হইল। যে কয়েকটি সিংহাসন সুসভ্যদেশে কথঞ্চিৎ প্রতিষ্ঠিত রহিল, তাহাও তৈল, লবণ, শর্করা বা সুরাব্যবসায়ীদের পণ্যলব্ধ প্রভূত ধনরাশির প্রভাবে, আমীর ওমরা সাজিয়া নিজ নিজ গৌরববিস্তারের আস্পদ বলিয়া।
যে নূতন মহাশক্তির প্রভাবে মুহূর্তমধ্যে তড়িৎপ্রবাহ এক মেরুপ্রান্ত হইতে প্রান্তান্তরে বার্তা বহন করিতেছে, মহাচালের ন্যায় তুঙ্গতরঙ্গায়িত মহোদধি যাহার রাজপথ, যাহার নির্দেশে এক দেশের পণ্যচয় অবলীলাক্রমে অন্য দেশে সমানীত হইতেছে এবং যাহার আদেশে সম্রাটকুলও কম্পমান, সংসারসমুদ্রের সর্বজয়ী এই বৈশ্যশক্তির অভ্যুত্থানরূপ মহাতরঙ্গের শীর্ষস্থ শুভ্র ফেনরাশির মধ্যে ইংলণ্ডের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত।
অতএব ইংলণ্ডের ভারতাধিকার বাল্যে শ্রুত ঈশামসি বা বাইবেলপুস্তকের ভারতজয়ও নহে, পাঠান-মোগলাদি সম্রাড়্গণের ভারতবিজয়ের ন্যায়ও নহে। কিন্তু ঈশামসি, বাইবেল, রাজপ্রাসাদ, চতুরঙ্গবলের ভূকম্পকারী পদক্ষেপ, তুরীভেরীর নিনাদ, রাজসিংহাসনের বহু আড়ম্বর—এ সকলের পশ্চাতে বাস্তব ইংলণ্ড বিদ্যমান। সে ইংলণ্ডের ধ্বজা-কলের চিমনী, বাহিনী—পণ্যপোত, যুদ্ধক্ষেত্র—জগতের পণ্যবীথিকা, এবং সম্রাজ্ঞী—স্বয়ং সুবর্ণাঙ্গী শ্রী।
এইজন্যই পূর্বে বলিয়াছি, এটি অতি অভিনব ব্যাপার—ইংলণ্ডের ভারতবিজয়। এ নূতন মহাশক্তির সংঘর্ষে ভারতে কি নূতন বিপ্লব উপস্থিত হইবে ও তাহার পরিণামে ভারতের কি পরিবর্তন প্রসাধিত হইবে, তাহা ভারতেতিহাসের গত কাল হইতে অনুমিত হইবার নহে।
পূর্বে বলিয়াছি, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্র, বৈশ্য, শূদ্র চারি বর্ণ পর্যায়ক্রমে পৃথিবী ভোগ করে। প্রত্যেক বর্ণেরই রাজত্বকালে কতকগুলি লোকহিতকর এবং অপর কতকগুলি অহিতকর কার্যের অনুষ্ঠান হয়।
পৌরোহিত্যশক্তির ভিত্তি বুদ্ধিবলের উপর, বাহুবলের উপর নহে; এজন্য পুরোহিতদিগের প্রাধান্যের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাচর্চার আবির্ভাব! অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক জগতের বার্তা ও সহায়তার জন্য সর্বমানবপ্রাণ সদাই ব্যাকুল। সাধারণের সেথায় প্রবেশ অসম্ভব; জড়ব্যূহ ভেদ করিয়া ইন্দ্রিয়সংযমী অতীন্দ্রিয়দর্শী সত্ত্বগুণপ্রধান পুরুষেরাই সে রাজ্যে গতিবিধি রাখেন, সংবাদ আনেন এবং অন্যকে পথ প্রদর্শন করেন। ইঁহারাই পুরোহিত, মানবসমাজের প্রথম গুরু, নেতা ও পরিচালক।
দেববিৎ পুরোহিত দেববৎ পূজিত হয়েন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া আর তাঁহাকে অন্নের সংস্থান করিতে হয় না। সর্বভোগের অগ্রভাগ দেবপ্রাপ্য, দেবতাদের মুখাদি পুরোহিত-কুল। সমাজ তাঁহাকে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে যথেষ্ট সময় দেয়, কাজেই পুরোহিত চিন্তাশীল হয়েন এবং তজ্জন্যই পুরোহিত-প্রাধান্যে প্রথম বিদ্যার উন্মেষ। দুর্ধর্ষ ক্ষত্রিয়-সিংহের এবং ভয়কম্পিত প্রজা-অজাযূথের মধ্যে পুরোহিত দণ্ডায়মান। সিংহের সর্বনাশেচ্ছা পুরোহিতহস্তধৃত অধ্যাত্মরূপ কশার তাড়নে নিয়মিত। ধনজনমদোন্মত্ত ভূপালবৃন্দের যথেচ্ছা-চাররূপ অগ্নিশিখা সকলকেই ভস্ম করিতে সক্ষম, কেবল ধনজনহীন দরিদ্র তপোবলসহায় পুরোহিতের বাণীরূপ জলে সে অগ্নি নির্বাপিত। পুরোহিতপ্রাধান্যে সভ্যতার প্রথম আবির্ভাব, পশুত্বের উপর দেবত্বের প্রথম বিজয়, জড়ের উপর চেতনের প্রথম অধিকার-বিস্তার, প্রকৃতির ক্রীতদাস জড়পিণ্ডবৎ মনুষ্যদেহের মধ্যে অস্ফুটভাবে যে অধীশ্বরত্ব লুক্কায়িত, তাহার প্রথম বিকাশ। পুরোহিত জড়-চৈতন্যের প্রথম বিভাজক, ইহ-পরলোকের সংযোগ-সহায়, দেব-মনুষ্যের বার্তাবহ, রাজা-প্রজার মধ্যবর্তী সেতু। বহুকল্যাণের প্রথমাঙ্কুর তাঁহারই তপোবল, তাঁহারই বিদ্যানিষ্ঠায়, তাঁহারই ত্যাগমন্ত্রে, তাঁহারই প্রাণসিঞ্চনে সমুদ্ভূত; এজন্যই সর্বদেশে প্রথম পূজা তিনিই পাইয়াছিলেন, এজন্যই তাঁহাদের স্মৃতিও আমাদের পক্ষে পবিত্র।
দোষও আছে; প্রাণ-স্ফূর্তির সঙ্গে সঙ্গেই মৃতবীজ উপ্ত। অন্ধকার আলোর সঙ্গে সঙ্গে চলে। প্রবল দোষও আছে, যাহা কালে সংযত না হইলে সমাজের বিনাশসাধন করে। স্থূলের মধ্য দিয়া শক্তির বিকাশ সর্বজনীন প্রত্যক্ষ, অস্ত্রশস্ত্রের ছেদ-ভেদ, অগ্ন্যাদির দাহিকাদি শক্তি, স্থূল প্রকৃতির প্রবল সংঘর্ষ সকলেই দেখে, সকলেই বুঝে। ইহাতে কাহারও সন্দেহ হয় না, মনেও দ্বিধা থাকে না। কিন্তু যেখানে শক্তির আধার ও বিকাশকেন্দ্র কেবল মানসিক, যেখানে বল কেবল শব্দবিশেষে, উচ্চারণবিশেষে, জপবিশেষে বা অন্যান্য মানসিক প্রয়োগবিশেষে, সেথায় আলোয় আঁধার মিশিয়া আছে; বিশ্বাসে সেথায় জোয়ার-ভাঁটা স্বাভাবিক, প্রত্যক্ষেও সেথায় কখনও কখনও সন্দেহ হয়। যেথায় রোগ, শোক, ভয়, তাপ, ঈর্ষা, বৈরনির্যাতন-সমস্তই উপস্থিত বাহুবল ছাড়িয়া, স্থূল উপায় ছাড়িয়া ইষ্টসিদ্ধির জন্য কেবল স্তম্ভন, উচ্চাটন, বশীকরণ, মারণাদির আশ্রয় গ্রহণ করে, স্থূল-সূক্ষ্মের মধ্যবর্তী এই কুজ্ঝটিকাময় প্রহেলিকাময় জগতে যাঁহারা নিয়ত বাস করেন, তাঁহাদের মধ্যেও যেন একটা ঐ প্রকার ধূম্রময়ভাব আপনা আপনি প্রবিষ্ট হয়! সে মনের সম্মুখে সরল রেখা প্রায়ই পড়ে না, পড়িলেও মন তাহাকে বক্র করিয়া লয়। ইহার পরিণাম অসরলতা—হৃদয়ের অতি সঙ্কীর্ণ, অতি অনুদার ভাব; আর সর্বাপেক্ষা মারাত্মক, নিদারুণ ঈর্ষাপ্রসূত অপরাসহিষ্ণুতা। যে বলে, আমার দেবতা বশ, রোগাদির উপর আধিপত্য, ভূতপ্রেতাদির উপর বিজয়, যাহার বিনিময়ে আমার পার্থিব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ঐশ্বর্য, তাহা অন্যকে কেন দিব? আবার তাহা সম্পূর্ণ মানসিক। গোপন করিবার সুবিধা কত! এ ঘটনাচক্রমধ্যে মানবপ্রকৃতির যাহা হইবার তাহাই হয়; সর্বদা আত্মগোপন অভ্যাস করিতে করিতে স্বার্থপরতা ও কপটতার আগমন ও তাহার বিষময় ফল। কালে গোপনেচ্ছার প্রতিক্রিয়াও আপনার উপর আসিয়া পড়ে। বিনাভ্যাসে বিনা বিতরণে প্রায় সর্ববিদ্যার নাশ; যাহা বাকী থাকে, তাহাও অলৌকিক দৈব উপায়ে প্রাপ্ত বলিয়া আর তাহাকে মার্জিত করিবারও (নূতন বিদ্যার কথা তো দূরে থাকুক) চেষ্টা বৃথা বলিয়া ধারণ হয়। তাহার পর বিদ্যাহীন, পুরুষকারহীন, পূর্বপুরুষদের নামমাত্রধারী পুরোহিতকুল পৈতৃক অধিকার পৈতৃক সম্মান, পৈতৃক আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য ‘যেন তেন প্রকারণে’ চেষ্টা করেন; অন্যান্য জাতির সহিত কাজেই বিষম সংঘর্ষ।
প্রাকৃতিক নিয়মে জরাজীর্ণের স্থানে নব প্রাণোন্মেষের প্রতি-স্থাপনের১৯ স্বাভাবিক চেষ্টায় উহা সমুপস্থিত হয়। এ সংগ্রামে জয়বিজয়ের ফলাফল পূর্বেই বর্ণিত হইয়াছে।
উন্নতির সময় পুরোহিতের যে তপস্যা, যে সংযম, যে ত্যাগ সত্যের অনুসন্ধানে সম্যক্ প্রযুক্ত ছিল, অবনতির পূর্বকালে তাহাই আবার কেবলমাত্র ভোগ্যসংগ্রহে বা আধিপত্য-বিস্তারে সম্পূর্ণ ব্যয়িত। যে শক্তির আধারত্বে তাঁহার মান, তাঁহার পূজা, সেই শক্তিই এখন স্বর্গধাম হইতে নরকে সমানীত। উদ্দেশ্য-হারা খেই-হারা পৌরোহিত্যশক্তি ঊর্ণাকীটবৎ আপনার কোষে আপনিই বদ্ধ; যে শৃঙ্খল অপরের পদের জন্য পুরুষানুক্রমে অতি যত্নের সহিত বিনির্মিত, তাহা নিজের গতিশক্তিকে শত বেষ্টনে প্রতিহত করিয়াছে; যে সকল পুঙ্খানুপুঙ্খ বহিঃশুদ্ধির আচার-জাল সমাজকে বজ্রবন্ধনে রাখিবার জন্য চারিদিকে বিস্তৃত হইয়াছিল, তাহারই তন্তুরাশিদ্বারা আপাদমস্তক-বিজড়িত পৌরোহিত্যশক্তির হতাশ হইয়া নিদ্রিত। আর উপায় নাই, এ জাল ছিঁড়িলে আর পুরোহিতের পৌরোহিত্য থাকে না। যাঁহারা এ কঠোর বন্ধনের মধ্যে স্বাভাবিক উন্নতির বাসনা অত্যন্ত প্রতিহত দেখিয়া এ জাল ছিঁড়িয়া অন্যান্য জাতির বৃত্তি-অবলম্বনে ধন-সঞ্চয়ে নিযুক্ত, সমাজ তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের পৌরোহিত্য-অধিকার কাড়িয়া লইতেছেন। শিখাহীন টেড়িকাটা, অর্ধ-ইওরোপীয় বেশভূষা-আচারাদি-সুমণ্ডিত ব্রাহ্মণের ব্রহ্মণ্যে সমাজ বিশ্বাসী নহেন। আবার—ভারতবর্ষে যেথায় এই নবাগত ইওরোপীয় রাজ্য, শিক্ষা এবং ধনাগমের উপায় বিস্তৃত হইতেছে, সেথায়ই পুরুষানুক্রমাগত পৌরোহিত্য-ব্যবসা পরিত্যাগ করিয়া দলে দলে ব্রাহ্মণযুবকবৃন্দ অন্যান্য জাতির বৃত্তি অবলম্বন করিয়া ধনবান্ হইতেছে এবং সঙ্গে সঙ্গেই পুরোহিত-পূর্বপুরুষদের আচার-ব্যবহার একেবারে রসাতলে যাইতেছে।
গুর্জরদেশের ব্রাহ্মণজাতির মধ্যে প্রত্যেক অবান্তর সম্প্রদায়েই দুইটি করিয়া ভাগ আছে—একটি পুরোহিত-ব্যবসায়ী, অপরটি অপর কোন বৃত্তি দ্বারা জীবিকা করে। এই পুরোহিত-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ই উক্ত প্রদেশে ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত এবং অপর সম্প্রদায় একই ব্রাহ্মণকুলপ্রসূত হইলেও পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা তাঁহাদের সহিত যৌন-সম্বন্ধে আবদ্ধ হন না। যথা ‘নাগর ব্রাহ্মণ’ বলিলে উক্ত ব্রাহ্মণজাতির মধ্যে যাঁহারা ভিক্ষাবৃত্ত পুরোহিত, তাঁহাদিগকেই কেবল বুঝাইবে। ‘নাগর’ বলিলে উক্ত জাতির যাঁহারা রাজকর্মচারী বা বৈশ্যবৃত্ত, তাঁহাদিগকে বুঝায়। কিন্তু এক্ষণে দেখা যাইতেছে যে, উক্ত প্রদেশসমূহেও এ বিভাগ আর বড় চলে না। নাগর ব্রাহ্মণের পুত্রেরাও ইংরেজী পড়িয়া রাজকর্মচারী হইতেছে, অথবা বাণিজ্যাদি ব্যাপার অবলম্বন করিতেছে। টোলের অধ্যাপকেরা সকল কষ্ট সহ্য করিয়া আপনাপন পুত্রদিগকে ইংরেজী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট করাইতেছেন এবং বৈদ্য-কায়স্থাদির বৃত্তি অবলম্বন করাইতেছেন। যদি এই প্রকার স্রোত চলে, তাহা হইলে বর্তমান পুরোহিত-জাতি আর কতদিন এদেশে থাকিবেন, বিবেচ্য বিষয় সন্দেহ নাই। যাঁহারা সম্প্রদায়বিশেষ বা ব্যক্তিবিশেষের উপর ব্রাহ্মণজাতির অধিকার-বিচ্যুতি-চেষ্টারূপ দোষারোপ করেন, তাঁহাদের জানা উচিত যে, ব্রাহ্মণজাতি প্রাকৃতিক অবশ্যম্ভাবী নিয়মের অধীন হইয়া আপনার সমাধিমন্দির আপনিই নির্মাণ করিতেছেন। ইহাই কল্যাণপ্রদ, প্রত্যেক অভিজাত জাতির স্বহস্তে নিজের চিতা নির্মাণ করাই প্রধান কর্তব্য।
শক্তিসঞ্চয় যে প্রকার আবশ্যক, তাহার বিকিরণও সেইরূপ বা তদপেক্ষা অধিক আবশ্যক। হৃৎপিণ্ডে রুধিরসঞ্চয় অত্যাবশ্যক, তাহার শরীরময় সঞ্চালন না হইলেই মৃত্যু। কুলবিশেষে বা জাতিবিশেষে সমাজের কল্যাণের জন্য বিদ্যা বা শক্তি কেন্দ্রীভূত হওয়া এককালের জন্য অতি আবশ্যক, কিন্তু সেই কেন্দ্রীভূত শক্তি কেবল সর্বতঃ সঞ্চারের জন্য পুঞ্জীকৃত। যদি তাহা না হইতে পায়, সে সমাজ-শরীর নিশ্চয়ই ক্ষিপ্র মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
অপরদিকে রাজ-সিংহে মৃগেন্দ্রের গুণদোষরাশি সমস্তই বিদ্যমান। একদিকে আত্মভোগেচ্ছায় কেশরীর করাল নখরাজি তৃণগুল্মভোজী পশুকুলের হৃৎপিণ্ড-বিদারণে মুহূর্তও কুঞ্চিত নহে; আবার কবি বলিতেছেন, ক্ষুৎক্ষাম জরাজীর্ণ হইলেও ক্রোড়াগত জম্বুক সিংহের ভক্ষ্যরূপে কখনই গৃহীত হয় না। প্রজাকুল রাজ-শাদূর্লের ভোগেচ্ছার বিঘ্ন উপস্থিত করিলেই তাহাদের সর্বনাশ; বিনীত হইয়া রাজাজ্ঞা শিরোধার্য করিলেই তাহারা নিরাপদ। শুধু তাহাই নহে; সমান প্রযত্ন, সমান আকূতি,২০ সাধারণ স্বত্বরক্ষার্থ ব্যক্তিগত স্বার্থত্যাগ পুরাকালের কি কথা, আধুনিক সময়েও কোন দেশে সম্যক্রূপে উপলব্ধ হয় নাই। রাজরূপ কেন্দ্র তজ্জন্যই সমাজ দ্বারা সৃষ্ট। শক্তিসমষ্টি সেই কেন্দ্রে পুঞ্জীকৃত এবং তথা হইতেই চারিদিকে সমাজশরীরে প্রসৃত।ব্রাহ্মণাধিকারে যে প্রকার জ্ঞানেচ্ছার প্রথম উদ্বোধন ও শৈশবাবস্থায় যত্নে পরিপালন, ক্ষত্রিয়াধিকারে সেই প্রকার ভোগেচ্ছার পুষ্টি এবং তৎসহায়ক বিদ্যানিচয়ের সৃষ্টি ও উন্নতি।
মহিমান্বিত লোকেশ্বর কি পর্ণকুটীরে উন্নত মস্তক রাখিতে পারেন, বা জনসাধারণলভ্য ভোজ্যাদি তাঁহার তৃপ্তিসাধনে সক্ষম?
নরলোকে যাঁহার মহিমার তুলনা নাই, দেবত্বের যাঁহাতে আরোপ, তাঁহার উপভোগ্য বস্তুর উপর অপর সাধারণের দৃষ্টিক্ষেপই মহাপাপ, লাভেচ্ছার তো কথাই নাই। রাজশরীর সাধারণ শরীরের ন্যায় নহে, তাহাতে অশৌচাদি দোষ স্পর্শে না, অনেক দেশে সে শরীরের মৃত্যু হয় না। অসূর্যস্পশ্যরূপা রাজদারাগণও এই ভাব হইতে সর্বতোভাবে লোকলোচনের সাক্ষাতে আবরিত। কাজেই পর্ণকুটীরের স্থানে অট্টালিকার সমুত্থান, গ্রাম্যকোলাহলের পরিবর্তে মধুর কৌশলকলাবিশিষ্ট সঙ্গীতের ধরাতলে আগমন। সুরম্য আরাম, উপবন, মনোমোহন আলেখ্যনিচয়, ভাস্কর্যরত্নাবলী, সুকুমার কৌষেয়াদি বস্ত্র—শনৈঃ পদসঞ্চারে প্রকৃতিক কানন, জঙ্গল, স্থূল বেশভূষাদির স্থান অধিকার করিতে লাগিল। লক্ষ লক্ষ বুদ্ধিজীবী পরিশ্রমবহুল কৃষিকার্য ত্যাগ করিয়া অল্পশ্রমসাধ্য ও সূক্ষ্মবুদ্ধির রঙ্গভূমি শত শত কলায় মনোনিবেশ করিল। গ্রামের গৌরব লুপ্ত হইল; নগরের আবির্ভাব হইল।
ভারতবর্ষে আবার বিষয়ভোগতৃপ্ত মহারাজগণ অন্তে অরণ্যাশ্রয়ী হইয়া অধ্যাত্মবিদ্যার প্রথম গভীর আলোচনায় প্রবৃত্ত হন। অত ভোগের পর বৈরাগ্য আসিতেই হইবে। সে বৈরাগ্য এবং গভীর দার্শনিক চিন্তার ফলস্বরূপ অধ্যাত্মতত্ত্বে একান্ত অনুরাগ এবং মন্ত্রবহুল ক্রিয়াকাণ্ডে অত্যন্ত বিতৃষ্ণা—উপনিষদ্, গীতা এবং জৈন ও বৌদ্ধদের গ্রন্থে বিস্তৃতরূপে প্রচারিত। এস্থানেও ভারতে পৌরোহিত্য ও রাজন্যশক্তিদ্বয়ের বিষম কলহ। কর্মকাণ্ডের বিলোপে পুরোহিতের বৃত্তিনাশ, কাজেই স্বভাবতঃ সর্বকালের সর্বদেশের পুরোহিত প্রাচীন রীতিনীতির রক্ষায় বদ্ধপরিকর, অপর দিকে ‘শাপ ও চাপ’-উভয়হস্ত২১ জনকাদি ক্ষত্রিয়কুল; সে বিষম দ্বন্দ্বের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে।
পুরোহিত যে প্রকার সর্ববিদ্যা কেন্দ্রীভূত করিতে সচেষ্ট, রাজা সেই প্রকার সকল পার্থিবশক্তি কেন্দ্রীভূত করিতে যত্নবান্। উভয়েরই উপকার আছে। উভয় বস্তুই সময় বিশেষে সমাজের কল্যাণের জন্য আবশ্যক, কিন্তু সে কেবল সমাজের শৈশবাবস্থায়। যৌবনপূর্ণদেহ সমাজকে বালোপযোগী বস্ত্রে বলপূর্বক আবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিলে, হয় সমাজ স্বীয় তেজে বন্ধন ছিন্ন করিয়া অগ্রসর হয় ও যথায় তাহা করিতে অক্ষম, সেথায় ধীরে ধীরে পুনর্বার অসভ্যাবস্থায় পরিণত হয়।
রাজা প্রজাদিগের পিতামাতা, প্রজারা তাঁহার শিশুসন্তান। প্রজাদের সর্বতোভাবে রাজমুখাপেক্ষী হইয়া থাকা উচিত এবং রাজা সর্বদা নিরপেক্ষ হইয়া আপন ঔরসজাত সন্তানের ন্যায় তাহাদিগকে পালন করিলেন। কিন্তু যে নীতি গৃহে প্রয়োজিত, তাহা সমগ্র দেশেও প্রচার২২। সমাজ—গৃহের সমষ্টিমাত্র। ‘প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে’ যদি প্রতি পিতার পুত্রকে মিত্রের ন্যায় গ্রহণ করা উচিত, সমাজশিশু কি সে ষোড়শবর্ষ কখনই প্রাপ্ত হয় না? ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, সকল সমাজই এক সময়ে উক্ত যৌবনদশায় উপনীত হয় এবং সকল সমাজেই সাধারণ ব্যক্তিনিচয়ের সহিত শক্তিমান্ শাসনকারীদের সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। এ যুদ্ধের জয়পরাজয়ের উপর সমাজের প্রাণবিকাশ ও সভ্যতা নির্ভর করে।
ভারতবর্ষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মই এ দেশের ভাষা এবং সকল উদ্যোগের লিঙ্গ২৩। বারংবার এ বিপ্লব ভারতেও ঘটিতেছে, কেবল এ দেশে তাহা ধর্মের নামে সংসাধিত। চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধ, শঙ্কর, রামানুজ, কবীর, নানক, চৈতন্য, ব্রাহ্মসমাজ, আর্যসমাজ ইত্যাদি সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্মুখে ফেনিল বজ্রঘোষী ধর্মতরঙ্গ, পশ্চাতে সমাজনৈতিক অভাবের পূরণ। অর্থহীন শব্দনিচয়ের উচ্চারণে যদি সর্বকামনা সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে কে আর রসনাতৃপ্তির জন্য কষ্টসাধ্য পুরুষকারকে অবলম্বন করিবে? সমগ্র সমাজ-শরীরে যদি এই রোগ প্রবেশ করে, সমাজ একেবারে উদ্যমবিহীন হইয়া বিনাশপ্রাপ্ত হইবে। কাজেই প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকদিগের ত্বঙ্মাংসভেদী শ্লেষের আবির্ভাব। পশুমেধ, নরমেধ, অশ্বমেধ ইত্যাদি বহুল কর্মকাণ্ডের প্রাণ-নিষ্পীড়ক ভার হইতে সমাজকে সদাচার ও জ্ঞানমাত্রাশ্রয় জৈন এবং অধিকৃত২৪ জাতিদিগের নিদারুণ অত্যাচার হইতে নিম্নস্তরস্থ মনুষ্যকুলকে বৌদ্ধবিপ্লব ভিন্ন কে উদ্ধার করিত? কালে যখন বৌদ্ধধর্মের প্রবল সদাচার মহা অনাচারে পরিণত হইল ও সাম্যবাদের আতিশয্যে স্বগৃহে প্রবিষ্ট নানা বর্বরজাতির পৈশাচিক নৃত্যে সমাজ টলটলায়মান হইল, তখন যথাসম্ভব পূর্বভাব-পুনঃস্থাপনের জন্য শঙ্কর ও রামানুজের চেষ্টা। আবার কবীর, নানক, চৈতন্য, ব্রাহ্মসমাজ ও আর্যসমাজ না জন্মগ্রহণ করিলে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমান ও ক্রিশ্চীয়ানের সংখ্যা যে ভারতে অনেক অধিক হইত, তাহাতে সন্দেহমাত্রও নাই। ভোজ্যদ্রব্যের ন্যায় নানাধাতুবিশিষ্ট শরীর ও অনন্তভাবতরঙ্গশালী চিত্তের আর কি প্রকৃষ্ট উপাদান? কিন্তু যে খাদ্য দেহরক্ষা ও মনের বলসমাধানে একান্ত আবশ্যক, তাহারই শেষাংশ যথাসময়ে শরীর হইতে বহিষ্কৃত হইতে না পারিলে সকল অনর্থের মূল হয়।
সমষ্টির জীবনে ব্যষ্টির জীবন, সমষ্টির সুখে ব্যষ্টির সুখ, সমষ্টি ছাড়িয়া ব্যষ্টির অস্তিত্বই অসম্ভব, এ অনন্ত সত্য—জগতের মূল ভিত্তি। অনন্ত সমষ্টির দিকে সহানুভূতিযোগে তাহার সুখে সুখ, দুঃখে দুঃখ ভোগ করিয়া শনৈঃ অগ্রসর হওয়াই ব্যষ্টির একমাত্র কর্তব্য। শুধু কর্তব্য নহে, ইহার ব্যতিক্রমে মৃত্যু—পালনে অমরত্ব। প্রকৃতির চক্ষে ধূলি দিবার শক্তি কাহার? সমাজের চক্ষে অনেক দিন ঠুলি দেওয়া চলে না। উপরে আবর্জনারাশি যতই কেন সঞ্চিত হউক না, সেই স্তূপের তলদেশে প্রেমস্বরূপ নিঃস্বার্থ সামাজিক জীবনের প্রাণস্পন্দন হইতেছে। সর্বংসহা ধরিত্রীর ন্যায় সমাজ অনেক সহেন, কিন্তু একদিন না একদিন জাগিয়া উঠেন এবং সে উদ্বোধনের বীর্যে যুগযুগান্তরের সঞ্চিত মলিনতা ও স্বার্থপরতারাশি দূরে নিক্ষিপ্ত হয়।
তমসাচ্ছন্ন পাশবপ্রকৃতি মানুষ আমরা সহস্রবার ঠেকিয়াও এ মহান্ সত্যে বিশ্বাস করি না, সহস্রবার ঠকিয়াও আবার ঠকাইতে যাই—উন্মত্তবৎ কল্পনা করি যে, আমরা প্রকৃতিকে বঞ্চনা করিতে সক্ষম। অত্যল্পদর্শী—মনে করি, যে কোন প্রকারে হউক, নিজের স্বার্থসাধনই জীবনের চরম উদ্দেশ্য।
বিদ্যা, বুদ্ধি, ধন, জন, বল, বীর্য—যাহা কিছু প্রকৃতি আমাদের নিকট সঞ্চিত করেন, তাহা পুনর্বার সঞ্চারের জন্য; একথা মনে থাকে না—গচ্ছিত ধনে আত্মবুদ্ধি হয়, অমনিই সর্বনাশের সূত্রপাত।
প্রজাসমষ্টির শক্তিকেন্দ্ররূপ রাজা অতি শীঘ্রই ভুলিয়া যান যে, তাহাতে শক্তিসঞ্চয় কেবল ‘সহস্রগুণমুৎস্রষ্টুং’। বেণ২৫-রাজার ন্যায় তিনি সর্ব-দেবত্বের আরোপ আপনাতে করিয়া অপর পুরুষে কেবল হীন মনুষ্যত্ব-মাত্র দেখেন! সু হউক বা কু হউক, তাঁহার ইচ্ছার ব্যাঘাতই মহাপাপ। পালনের স্থানে কাজেই পীড়ন আসিয়া পড়ে—রক্ষণের স্থানে ভক্ষণ। যদি সমাজ নির্বীর্য হয়, নীরবে সহ্য করে, রাজা ও প্রজা উভয়েই হীন হইতে হীনতর অবস্থায় উপস্থিত হয় এবং শীঘ্রই বীর্যবান্ অন্য জাতির ভক্ষ্যরূপে পরিণত হয়। যেথায় সমাজশরীর বলবান্, শীঘ্রই অতি প্রবল প্রতিক্রিয়া উপস্থিত হয় এবং তাহার আস্ফালনে ছত্র, দণ্ড, চামরাদি অতি দূরে বিক্ষিপ্ত ও সিংহাসনাদি চিত্রশালিকারক্ষিত প্রাচীন দ্রব্যবিশেষের ন্যায় হইয়া পড়ে।
যে মহাশক্তির ভ্রূভঙ্গে ‘থরথরি রক্ষনাথ কাঁপে লঙ্কাপুরে,’ যাহার হস্তধৃত সুবর্ণভাণ্ডরূপ বকাণ্ড-প্রত্যাশায় মহারাজ হইতে ভিক্ষুক পর্যন্ত বকপঙ্ক্তির ন্যায় বিনীতমস্তকে পশ্চাদ্গমন করিতেছে, সেই বৈশ্যশক্তির বিকাশই পূর্বোক্ত প্রতিক্রিয়ার ফল।
ব্রাহ্মণ বলিলেন, বিদ্যা সকল বলের বল, ‘আমি সেই বিদ্যা-উপজীবী, সমাজ আমার শাসনে চলিবে’—দিনকতক তাহাই হইল। ক্ষত্রিয় বলিলেন, ‘আমার অস্ত্রবল না থাকিলে বিদ্যাবল-সহিত কোথায় লোপ পাইয়া যাও, আমিই শ্রেষ্ঠ’। কোষমধ্যে অসি-ঝনৎকার হইল, সমাজ অবনতমস্তকে [উহা] গ্রহণ করিল। বিদ্যার উপাসকও সর্বাগ্রে রাজোপাসকে পরিণত হইলেন! বৈশ্য বলিতেছেন, “উন্মাদ! ‘অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরং’ তোমরা যাঁহাকে বল, তিনিই এই মুদ্রারূপী অনন্তশক্তিমান্ আমার হস্তে। দেখ, ইঁহার কৃপায় আমিও সর্বশক্তিমান্। হে ব্রাহ্মণ, তোমার তপ, জপ, বিদ্যাবুদ্ধি-ইঁহারই প্রসাদে আমি এখনই ক্রয় করিব। হে মহারাজ, তোমার অস্ত্রশস্ত্র, তেজবীর্য—ইঁহার কৃপায় আমার অভিমতসিদ্ধির জন্য প্রযুক্ত হইবে। এই যে অতিবিস্তৃত, অত্যুন্নত কারখানাসকল দেখিতেছ, ইহারা আমার মধুক্রম। ঐ দেখ, অসংখ্য মক্ষিকারূপী শূদ্রবর্গ তাহাতে অনবরত মধুসঞ্চয় করিতেছে, কিন্তু সে মধু পান করিবে কে?—আমি। যথাকালে আমি পশ্চাদ্দেশ হইতে সমস্ত মধু নিষ্পীড়ন করিয়া লইতেছি।”
ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়াধিপত্যে যে প্রকারে বিদ্যা ও সভ্যতার সঞ্চয়, বৈশ্যাধিকার সেই প্রকার ধনের। যে টঙ্কঝঙ্কার চাতুর্বর্ণ্যের মনোহরণ করিতে সক্ষম, বৈশ্যের বল সেই ধন। সে ধন পাছে ব্রাহ্মণ ঠকায়, পাছে ক্ষত্রিয় বলাৎকার দ্বারা গ্রহণ করে, বৈশ্যের সদাই এই ভয়। আত্মরক্ষার্থ সেজন্য শ্রেষ্ঠিকুল একমতি। কুসীদ-কশাহস্ত বণিক—সকলের হৃৎকম্প-উৎপাদক। অর্থবলে রাজশক্তিকে সংকীর্ণ করিতে বণিক সদাই ব্যস্ত। যাহাতে রাজশক্তি বৈশ্যবর্গের ধনধান্য-সঞ্চয়ের কোন বাধা না জন্মাইতে পারে, সে জন্য বণিক সদাই সচেষ্ট। কিন্তু শূদ্রকুলে সে শক্তি সঞ্চার হয়—বণিকের এ ইচ্ছা আদৌ নাই।
‘বণিক কোন্ দেশে না যায়?’ নিজে অজ্ঞ হইয়াও ব্যাপারের অনুরোধে একদেশের বিদ্যাবুদ্ধি, কলা-কৌশল বণিক অন্যদেশে লইয়া যায়। যে বিদ্যা, সভ্যতা ও কলা-বিলাসরূপ রূধির ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়াধিকারে সমাজ-হৃৎপিণ্ডে পুঞ্জীকৃত হইয়াছিল, বণিকের পণ্যবীথিকাভিমুখী পন্থানিচয়রূপ ধমনী-যোগে তাহা সর্বত্র সঞ্চারিত হইতেছে। এ বৈশ্য-প্রাদুর্ভাব না হইলে আজ এক প্রান্তের ভক্ষ্য-ভোজ্য, সভ্যতা, বিলাস ও বিদ্যা অন্য প্রান্তে কে লইয়া যাইত?
আর যাহাদের শারীরিক পরিশ্রমে ব্রাহ্মণের আধিপত্য, ক্ষত্রিয়দের ঐশ্বর্য ও বৈশ্যের ধনধান্য সম্ভব, তাহারা কোথায়? সমাজের যাহারা সর্বাঙ্গ হইয়াও সর্বদেশে সর্বকালে ‘জঘন্যপ্রভবো হি সঃ’ বলিয়া অভিহিত, তাহাদের কি বৃত্তান্ত? যাহাদের বিদ্যালাভেচ্ছারূপ গুরুতর অপরাধে ভারতে ‘জিহ্বাচ্ছেদ শরীরভেদাদি’ দয়াল দণ্ডসকল প্রচারিত ছিল, ভারতের সেই ‘চলমান শ্মশান’, ভারতেতর দেশের ‘ভারবাহী পশু’ সে-শূদ্রজাতির কি গতি?
এদেশের কথা কি বলিব? শূদ্রদের কথা দূরে থাকুক; ভারতের ব্রহ্মণ্য এক্ষণে অধ্যাপক গৌরাঙ্গে, ক্ষত্রিয়ত্ব রাজচক্রবর্তী ইংরেজ, বৈশ্যত্বও ইংরেজের অস্থিমজ্জায়, ভারতবাসীর কেবল ভারবাহী পশুত্ব, কেবল শূদ্রত্ব। দুর্ভেদ্য তমসাবরণ এখন সকলকে সমানভাবে আচ্ছন্ন করিয়াছে। এখন চেষ্টায় তেজ নাই, উদ্যোগে সাহস নাই, মনে বল নাই, অপমানে ঘৃণা নাই, দাসত্বে অরুচি নাই, হৃদয়ে প্রীতি নাই, প্রাণে আশা নাই; আছে প্রবল ঈর্ষা, স্বজাতিদ্বেষ, আছে দুর্বলের ‘যেন তেন প্রকারণে’ সর্বনাশসাধনে একান্ত ইচ্ছা, আর বলবানের কুক্কুরবৎ পদলেহনে। এখন তৃপ্তি ঐশ্বর্য-প্রদর্শনে, ভক্তি স্বার্থসাধনে, জ্ঞান অনিত্যবস্তুসংগ্রহে, যোগ পৈশাচিক আচারে, কর্ম পরের দাসত্বে, সভ্যতা বিজাতীয় অনুকরণে, বাগ্মিত্ব কটুভাষণে, ভাষার উৎসর্গ ধনীদের অত্যদ্ভুত চাটুবাদে বা জঘন্য অশ্লীলতা-বিকিরণে; এ শূদ্রপূর্ণ দেশের শূদ্রদের কা কথা! ভারতেতর দেশের শূদ্রকুল যেন কিঞ্চিৎ বিনিদ্র হইয়াছে। কিন্তু তাহাদের বিদ্যা নাই, আর আছে শূদ্রসাধারণ স্বজাতিদ্বেষ। সংখ্যায় বহু হইলে কি হয়? যে একতাবলে দশ জনে লক্ষ জনের শক্তি সংগ্রহ করে, সে একতা শূদ্রে এখনও বহুদূর; শূদ্রজাতিমাত্রেই এজন্য নৈসর্গিক নিয়মে পরাধীন।
কিন্তু আশা আছে। কালপ্রভাবে ব্রাহ্মণাদি বর্ণও শূদ্রের নিম্নাসনে সমানীত হইতেছে এবং শূদ্রজাতিও উচ্চস্থানে উত্তোলিত হইতেছে। শূদ্রপূর্ণ রোমকদাস ইওরোপ ক্ষত্রবীর্যে পরিপূর্ণ। মহাবল চীন আমাদের সমক্ষেই দ্রুতপদসঞ্চারে শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হইতেছে, নগণ্য জাপান খধূপতেজে শূদ্রত্ব দূরে ফেলিয়া ক্রমশঃ উচ্চবর্ণাধিকার আক্রমণ করিতেছে। আধুনিক গ্রীস ও ইতালীর ক্ষত্রতাপত্তি ও তুরস্ক-স্পেনাদির নিম্নাভিমুখ পতনও এস্থলে বিবেচ্য।
তথাপি এমন সময়ে আসিবে, যখন শূদ্রত্বসহিত শূদ্রের প্রাধান্য হইবে, অর্থাৎ বৈশ্যত্ব ক্ষত্রিয়ত্ব লাভ করিয়া শূদ্রজাতি যে প্রকার বলবীর্য বিকাশ করিতেছে তাহা নহে, শূদ্রধর্মকর্ম-সহিত সর্বদেশের শূদ্রেরা সমাজে একাধিপত্য লাভ করিবে। তাহারই পূর্বাভাসচ্ছটা পাশ্চাত্য জগতে ধীরে ধীরে উদিত হইতেছে এবং সকলে তাহার ফলাফল ভাবিয়া ব্যাকুল। সোস্যালিজম্, এনার্কিজম্, নাইহিলিজম্২৬ প্রভৃতি সম্প্রদায় এই বিপ্লবের অগ্রগামী ধ্বজা। যুগযুগান্তরের পেষণের ফলে শূদ্রমাত্রেই হয় কুক্কুরবৎ পদলেহক, নতুবা হিংস্র-পশুবৎ নৃশংস। আবার চিরকালই তাহাদের বাসনা নিষ্ফল; এজন্য দৃঢ়তা ও অধ্যবসায় তাহাদের একেবারেই নাই।
পাশ্চাত্য দেশে শিক্ষাবিস্তার সত্ত্বেও শূদ্রজাতির অভ্যুত্থানের একটি বিষম প্রত্যবায় আছে, সেটি গুণগত জাতি। ঐ গুণগত জাতি প্রাচীনকালে এতদ্দেশেও প্রচার থাকিয়া শূদ্রকুলকে দৃঢ়বন্ধনে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল। শূদ্রজাতির একে বিদ্যার্জন বা ধনসংগ্রহের সুবিধা বড়ই অল্প, তাহার উপর যদি কালে দুই-একটি অসাধারণ পুরুষ শূদ্রকুলে উৎপন্ন হয়, অভিজাত সমাজ তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে উপাধিমণ্ডিত করিয়া আপনাদের মণ্ডলীতে তুলিয়া লন। তাঁহার বিদ্যার প্রভাব, তাঁহার ধনের ভাগ অপর জাতির উপকারে যায়, আর তাঁহার নিজের জাতি তাঁহার বিদ্যা, বুদ্ধি, ধনের কিছুই পায় না। শুধু তাহাই নহে, উপরিতন জাতির আবর্জনারাশিরূপ অকর্মণ্য মনুষ্যসকল শূদ্রবর্গের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়।
বেশ্যাপুত্র বশিষ্ঠ২৭ ও নারদ, দাসীপুত্র সত্যকাম জাবাল, ধীবর২৮ ব্যাস, অজ্ঞাতপিতা কৃপ-দ্রোণ-কর্ণাদি সকলেই বিদ্যা বা বীরত্বের আধার বলিয়া ব্রাহ্মণত্বে বা ক্ষত্রিয়ত্বে উত্তোলিত হইল; তাহাতে বারাঙ্গনা, দাসী, ধীবর বা সারথিকুলের কি লাভ হইল বিবেচ্য। আবার ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যকুল হইতে পতিতেরা সততই শূদ্রকুলে সমানীত হইত।
আধুনিক ভারতে শূদ্রকুলোৎপন্ন মহাপণ্ডিতের বা কোটীশ্বরের স্বসমাজত্যাগের অধিকার নাই। কাজেই তাহাদের বিদ্যাবুদ্ধির ও ধনের প্রভাব স্বজাতিগত হইয়া স্বীয় মণ্ডলীর উন্নতিকল্পে প্রযুক্ত হইতেছে। এই প্রকার ভারতের জন্মগত জাতি, মর্যাদা অতিক্রমে অসমর্থ হইয়া বৃত্তমধ্যগত লোকসকলের ধীরে ধীরে উন্নতিবিধান করিতেছে। যতক্ষণ ভারতে জাতিনির্বিশেষে দণ্ডপুরস্কার-সঞ্চারকারী রাজা থাকিবেন, ততক্ষণ এই প্রকার নীচ জাতির উন্নতি হইতে থাকিবে।
সমাজের নেতৃত্ব বিদ্যাবলের দ্বারাই অধিকৃত হউক, বা বাহুবলের দ্বারা, বা ধনবলের দ্বারা, সে শক্তির আধার—প্রজাপুঞ্জ। সে নেতৃসম্প্রদায় যত পরিমাণে এই শক্ত্যাধার হইতে আপনাকে বিশ্লিষ্ট করিবে, তত পরিমাণে তাহা দুর্বল। কিন্তু মায়ার এমনই বিচিত্র খেলা—যাহাদের নিকট হইতে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ছল-বল-কৌশল বা প্রতিগ্রহের দ্বারা এই শক্তি পরিগৃহীত হয়, তাহারা অচিরেই নেতৃসম্প্রদায়ের গণনা হইতে বিদূরিত হয়। পৌরোহিত্যশক্তি কালক্রমে শক্ত্যাধার প্রজাপুঞ্জ হইতে আপনাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করিয়া তাৎকালিক প্রজাসহায় রাজশক্তির নিকট পরাভূত হইল; রাজশক্তিও আপনাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার করিয়া, প্রজাকুল ও আপনার মধ্যে দুস্তর পরিখা খনন করিয়া অপেক্ষাকৃত অধিক পরিমাণে সাধারণ-প্রজাসহায় বৈশ্যকুলের হস্তে নিহত বা ক্রীড়াপুত্তলিকা হইয়া গেল। এক্ষণে বৈশ্যকুল আপনার স্বার্থসিদ্ধি করিয়াছে; অতএব প্রজার সহায়তা অনাবশ্যক জ্ঞানে আপনাদিগকে প্রজাপুঞ্জ হইতে সম্পূর্ণ বিভিন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছেন; এই স্থানে এ শক্তিরও মৃত্যুবীজ উপ্ত হইতেছে।
সাধারণ প্রজা সমস্ত শক্তির আধার হইয়াও পরস্পরের মধ্যে অনন্ত ব্যবধান সৃষ্টি করিয়া আপনাদের সমস্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত রহিয়াছে, এবং যতকাল এইভাব থাকিবে ততকাল রহিবে। সাধারণ বিপদ ও ঘৃণা এবং সাধারণ প্রীতি—সহানুভূতির কারণ। মৃগয়াজীবী২৯ পশুকুল যে নিয়মাধীনে একত্রিত হয়, মনুজবংশও সেই নিয়মাধীনে একত্রিত হইয়া জাতি বা দেশবাসীতে পরিণত হয়।
একান্ত স্বজাতি-বাৎসল্য ও একান্ত ইরান-বিদ্বেষ গ্রীকজাতির, কার্থেজ-বিদ্বেষ রোমের, কাফের-বিদ্বেষ আরবজাতির, মুর-বিদ্বেষ স্পেনের, স্পেন-বিদ্বেষ ফ্রান্সের, ফ্রান্স-বিদ্বেষ ইংলণ্ড ও জার্মানীর এবং ইংলণ্ড-বিদ্বেষ আমেরিকার উন্নতির (প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমাধান করিয়া) এক প্রধান কারণ নিশ্চিত।
স্বার্থই স্বার্থত্যাগের প্রধান শিক্ষক। ব্যষ্টির স্বার্থরক্ষার জন্য সমষ্টির কল্যাণের দিকে প্রথম দৃষ্টিপাত। স্বজাতির স্বার্থে নিজের স্বার্থ; স্বজাতির কল্যাণে নিজের কল্যাণ। বহুজনের সহায়তা ভিন্ন অধিকাংশ কার্য কোনমতে চলে না, আত্মরক্ষা পর্যন্ত অসম্ভব। এই স্বার্থরক্ষার্থ সহকারিত্ব সর্বদেশে সর্বজাতিতে বিদ্যমান। তবে স্বার্থের পরিধির তারতম্য আছে। প্রজোৎপাদন ও ‘যেন তেন প্রকারেণ’ উদরপূতির অবসর পাইলেই ভারতবাসীর সম্পূর্ণ স্বার্থ-সিদ্ধি; আর উচ্চবর্ণের—ইহার উপর ধর্মের বাধা না হয়। এতদপেক্ষা বর্তমান ভারতে দুরাশা আর নাই; ইহাই ভারতজীবনের উচ্চতম সোপান।
ভারতবর্ষের বর্তমান শাসনপ্রণালীতে কতকগুলি দোষ বিদ্যমান, কতকগুলি প্রবল গুণও আছে। সর্বাপেক্ষা কল্যাণ ইহা যে, পাটলিপুত্র-সাম্রাজ্যের অধঃপতন হইতে বর্তমান কাল পর্যন্ত, এ প্রকার শক্তিমান্ ও সর্বব্যাপী শাসনযন্ত্র অস্মদ্দেশে পরিচালিত হয় নাই। বৈশ্যাধিকারের যে চেষ্টায় এক প্রান্তের পণ্যদ্রব্য অন্য প্রান্তে উপনীত হইতেছে, সেই চেষ্টারই ফলে দেশ-দেশান্তরের ভাবরাশি বলপূর্বক ভারতের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করিতেছে। এই সকল ভাবের মধ্যে কতকগুলি অতি কল্যাণকর, কতকগুলি অমঙ্গলস্বরূপ, আর কতকগুলি পরদেশবাসীর—এ দেশের যথার্থ কল্যাণনির্ধারণে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
কিন্তু গুণদোষরাশি ভেদ করিয়া সকল ভবিষ্যৎ মঙ্গলের প্রবল লিঙ্গ৩০ দেখা যাইতেছে যে, এই বিজাতীয় ও প্রাচীন স্বজাতীয় ভাবসংঘর্ষে অল্পে অল্পে দীর্ঘসুপ্ত জাতি বিনিদ্র হইতেছে। ভুল করুক, ক্ষতি নাই; সকল কার্যেই ভ্রমপ্রমাদ আমাদের একমাত্র শিক্ষক। যে ভ্রমে পতিত হয়, ঋতপথ তাহারই প্রাপ্য। বৃক্ষ ভুল করে না, প্রস্তরখণ্ড ভ্রমে পতিত হয় না, পশুকুলে নিয়মের বিপরীতাচরণ অত্যল্পই দৃষ্ট হয়; কিন্তু ভূদেবের উৎপত্তি ভ্রম-প্রমাদপূর্ণ নরকুলেই। দন্তধাবন হইতে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত কর্ম, নিদ্রাভঙ্গ হইতে শয্যাশ্রয় পর্যন্ত সমস্ত চিন্তা—যদি অপরে আমাদের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নির্ধারিত করিয়া দেয় এবং রাজশক্তির পেষণে ঐ সকল নিয়মের বজ্রবন্ধনে আমাদের বেষ্টিত করে, তাহা হইলে আমাদের আর চিন্তা করিবার কি থাকে? মননশীল বলিয়াই না আমরা মনুষ্য, মনীষী, মুনি? চিন্তাশীলতার লোপের সঙ্গে সঙ্গে তমোগুণের প্রাদুর্ভাব, জড়ত্বের আগমন। এখনও প্রত্যেক ধর্মনেতা, সমাজনেতা সমাজের জন্য নিয়ম করিবার জন্য ব্যস্ত!!! দেশে কি নিয়মের অভাব? নিয়মের পেষণে যে সর্বনাশ উপস্থিত, কে বুঝে?
সম্পূর্ণ স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী অধীনে বিজিত জাতি বিশেষ ঘৃণার পাত্র হয় না। অপ্রতিহতশক্তি সম্রাটের সকল প্রজারই সমান অধিকার অর্থাৎ কোন প্রজারই রাজশক্তির নিয়মনে কিছুমাত্র অধিকার নাই। সে স্থলে জাত্যভিমানজনিত বিশেষাধিকার অল্পই থাকে। কিন্তু যেখানে প্রজানিয়মিত রাজা বা প্রজাতন্ত্র বিজিত জাতির শাসন করে, সে স্থানে বিজয়ী ও বিজিতের মধ্যে অতি বিস্তীর্ণ ব্যবধানে নির্মিত হয়, এবং যে শক্তি বিজিতদিগের কল্যাণে সম্পূর্ণ নিযুক্ত হইলে অত্যল্পকালে বিজিত জাতির বহুকল্যাণসাধনে সমর্থ, সে শক্তির অধিকাংশ ভাগই বিজিত জাতিকে স্ববশে রাখিবার চেষ্টায় ও আয়োজনে প্রযুক্ত হইয়া বৃথা ব্যয়িত হয়। প্রজাতন্ত্র রোমাপেক্ষা সম্রাড়ধিষ্ঠিত রোমক-শাসনে বিজাতীয় প্রজাদের সুখ অধিক এজন্যই হইয়াছিল। এজন্যই বিজিত-য়াহুদীবংশসম্ভূত হইয়াও খ্রীষ্টধর্মপ্রচারক পৌল (St. Paul) কেশরী (Caesar) সম্রাটের৩১ সমক্ষে আপনার অপরাধ-বিচারের ক্ষমতা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ব্যক্তিবিশেষ ইংরেজ কৃষ্ণবর্ণ বা ‘নেটিভ’ অর্থাৎ অসভ্য বলিয়া আমাদিগকে অবজ্ঞা করিল, ইহাতে ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই। আমাদের আপনার মধ্যে তদপেক্ষা অনেক অধিক জাতিগত ঘৃণাবুদ্ধি আছে; এবং মূর্খ ক্ষত্রিয় রাজা সহায় হইলে ব্রাহ্মণেরা যে শূদ্রদের ‘জিহ্বাচ্ছেদ, শরীরভেদাদি’ পুনরায় করিবার চেষ্টা করিবেন না, কে বলিতে পারে? প্রাচ্য আর্যাবর্তে সকল জাতির মধ্যে যে সামাজিক উন্নতিকল্পে কিঞ্চিৎ সদ্ভাব দৃষ্ট হইতেছে, মহারাষ্ট্রদেশে ব্রাহ্মণেরা ‘মারাঠা’ জাতির যে সকল স্তবস্তুতি আরম্ভ করিয়াছেন, নিম্ন জাতিদের—এখনও তাহা নিঃস্বার্থভাব হইতে সমুত্থিত বলিয়া ধারণা হইতেছে না। কিন্তু ইংরেজ-সাধারণের মনে ক্রমশঃ এক ধারণা উপস্থিত হইতেছে যে, ভারতসাম্রাজ্য তাঁহাদের অধিকারচ্যুত হইলে ইংরেজজাতির সর্বনাশ উপস্থিত হইবে। অতএব ‘যেন তেন প্রকারেণ’ ভারতে ইংলণ্ডাধিকার প্রবল রাখিতে হইবে। এই অধিকার-রক্ষার প্রধান উপায় ভারতবাসীর বক্ষে ইংরেজজাতির ‘গৌরব’ সদা জাগরূক রাখা। এই বুদ্ধির প্রাবল্য ও তাহার সহযোগী চেষ্টার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি দেখিয়া যুগপৎ হাস্য ও করুণরসের উদয় হয়। ভারতনিবাসী ইংরেজ বুঝি ভুলিয়া যাইতেছেন যে, যে বীর্য অধ্যবসায় ও স্বজাতির একান্ত সহানুভূতিবলে তাঁহারা এই রাজ্য অর্জন করিয়াছেন, যে সদাজাগরূক বিজ্ঞান-সহায় বাণিজ্য-বুদ্ধিবলে সর্বধনপ্রসূ ভারতভূমিও ইংলণ্ডের প্রধান পণ্যবীথিকা হইয়া পড়িয়াছে, যতদিন জাতীয় জীবন হইতে এই সকল গুণ লোপ না হয়, ততদিন তাঁহাদের সিংহাসন অচল। এই সকল গুণ যতদিন ইংরেজের থাকিবে এমন ভারতরাজ্য—শত শত লুপ্ত হইলেও শত শত আবার অর্জিত হইবে। কিন্তু যদি ঐ সকল গুণপ্রবাহের বেগ মন্দীকৃত হয়, বৃথা গৌরবঘোষণে কি সাম্রাজ্য শাসিত হইবে? এজন্য এ সকল গুণের প্রাবল্য সত্ত্বেও অর্থহীন ‘গৌরব’-রক্ষার জন্য এত শক্তিক্ষয় নিরর্থক। উহা প্রজার কল্যাণে নিয়োজিত হইলে শাসক ও শাসিত উভয় জাতিরই নিশ্চিত মঙ্গলপ্রদ।
পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, বাহ্য জাতির সংঘর্ষে ভারত ক্রমে বিনিদ্র হইতেছে। এই অল্প জাগুরূকতার ফলস্বরূপ স্বাধীন চিন্তার কিঞ্চিৎ উন্মেষ। একদিকে প্রত্যক্ষশক্তি-সংগ্রহরূপ-প্রমাণ-বাহন, শতসূর্য-জ্যোতি, আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিপ্রতিঘাতিপ্রভা; অপরদিকে স্বদেশী বিদেশী বহুমনীষী-উদ্ঘাটিত, যুগযুগান্তরের সহানুভূতিযোগে সর্বশরীরে ক্ষিপ্রসঞ্চারী, বলদ, আশাপ্রদ, পূর্বপুরুষদিগের অপূর্ব বীর্য, অমানব প্রতিভা ও দেবদুর্লভ অধ্যাত্মতত্ত্বকাহিনী। একদিকে জড়বিজ্ঞান, প্রচুর ধনধান্য, প্রভূত বলসঞ্চয়, তীব্র ইন্দ্রিয়সুখ বিজাতীয় ভাষায় মহাকোলাহল উত্থাপিত করিয়াছে; অপরদিকে এই মহাকোলাহল ভেদ করিয়া ক্ষীণ অথচ মর্মভেদী স্বরে পূর্বদেবদিগের৩২ আর্তনাদ কর্ণে প্রবেশ করিতেছে। সম্মুখে বিচিত্র যান, বিচিত্র পান, সুসজ্জিত ভোজন, বিচিত্র পরিচ্ছদে লজ্জাহীনা বিদুষী নারীকুল, নূতন ভাব, নূতন ভঙ্গী অপূর্ব বাসনার উদয় করিতেছে; আবার মধ্যে মধ্যে সে দৃশ্য অন্তর্হিত হইয়া ব্রত-উপবাস, সীতা-সাবিত্রী, তপোবন-জটাবল্কল, কাষায়-কৌপীন, সমাধি-আত্নানুসন্ধান উপস্থিত হইতেছে। একদিকে পাশ্চাত্য সমাজের স্বার্থপর স্বাধীনতা, অপরদিকে আর্যসমাজের কঠোর আত্ম-বলিদান। এ বিষম সংঘর্ষে সমাজ যে আন্দোলিত হইবে—তাহাতে বিচিত্রতা কি? পাশ্চাত্যে উদ্দেশ্য—ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ভাষা—অর্থকরী বিদ্যা, উপায়—রাষ্ট্রনীতি। ভারতে উদ্দেশ্য—মুক্তি, ভাষা—বেদ, উপায়—ত্যাগ। বর্তমান ভারত একবার যেন বুঝিতেছে, বৃথা ভবিষ্যৎ অধ্যাত্মকল্যাণের মোহে পড়িয়া ইহলোকের সর্বনাশ করিতেছি; আবার মন্ত্রমুগ্ধবৎ শুনিতেছেঃ ‘ইতি সংসারে স্ফুটতরদোষঃ। কথমিহ মানব তব সন্তোষঃ!!’৩৩
একদিকে নব্যভারত-ভারতী বলিতেছেন—পতিপত্মী-নির্বাচনে আমাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা হওয়া উচিত, কারণ যে বিবাহে আমাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ-দুঃখ, তাহা আমরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হইয়া নির্বাচন করিব; অপরদিকে প্রাচীন ভারত আদেশ করিতেছেন—বিবাহ ইন্দ্রিয়সুখের জন্য নহে, প্রজোৎপাদনের জন্য। ইহাই এ দেশের ধারণা। প্রজোৎপাদন দ্বারা সমাজের ভাবী মঙ্গলামঙ্গলের তুমি ভাগী, অতএব যে প্রণালীতে বিবাহ করিলে সমাজের সর্বাপেক্ষা কল্যাণ সম্ভব, তাহাই সমাজে প্রচলিত; তুমি বহুজনের হিতের জন্য নিজের সুখভোগেচ্ছা ত্যাগ কর।
একদিকে নব্যভারত বলিতেছেন—পাশ্চাত্য ভাব, ভাষা, আহার, পরিচ্ছদ ও আচার অবলম্বন করিলেই আমরা পাশ্চাত্য জাতিদের ন্যায় বলবীর্যসম্পন্ন হইব; অপরদিকে প্রাচীন ভারত বলিতেছেন—মূর্খ! অনুকরণ দ্বারা পরের ভাব আপনার হয় না, অর্জন না করিলে কোন বস্তুই নিজের হয় না; সিংহ-চর্মে আচ্ছাদিত হইলেই কি গর্দভ সিংহ হয়?
একদিকে নব্যভারত বলিতেছেন—পাশ্চাত্য জাতিরা যাহা করে তাহাই ভাল; ভাল না হইলে উহারা এত প্রবল কি প্রকারে হইল? অপরদিকে প্রাচীন ভারত বলিতেছেন—বিদ্যুতের আলোক অতি প্রবল, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী; বালক, তোমার চক্ষু প্রতিহত হইতেছে, সাবধান।
তবে কি আমাদের পাশ্চাত্য জগৎ হইতে শিখিবার কিছুই নাই? আমাদের কি চেষ্টা-যত্ন করিবার কোন প্রয়োজন নাই? আমরা কি সম্পূর্ণ? আমাদের সমাজ কি সর্বতোভাবে নিশ্ছিদ্র? শিখিবার অনেক আছে, যত্ন আমরণ করিতে হইবে, যত্নই মানবজীবনের উদ্দেশ্য। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, ‘যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি।’ যে ব্যক্তি বা যে সমাজের শিখিবার কিছুই নাই, তাহা মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। [শিখিবার] আছে,—কিন্তু ভয়ও আছে।
কোন অল্পবুদ্ধি বালক, শ্রীরামকৃষ্ণের সমক্ষে সর্বদাই শাস্ত্রের নিন্দা করিত। একদা সে গীতার অত্যন্ত প্রশংসা করে। তাহাতে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, ‘বুঝি, কোন ইংরেজ পণ্ডিত গীতার প্রশংসা করিয়াছে, তাহাতে এও প্রশংসা করিল।’
হে ভারত, ইহাই প্রবল বিভীষিকা। পাশ্চাত্য-অনুকরণ-মোহ এমনই প্রবল হইতেছে যে, ভালমন্দের জ্ঞান আর বুদ্ধি বিচার শাস্ত্র [বা] বিবেকের দ্বারা নিষ্পন্ন হয় না। শ্বেতাঙ্গ যে ভাবের, যে আচারের প্রশংসা করে, তাহাই ভাল; তাহারা যাহার নিন্দা করে, তাহাই মন্দ। হা ভাগ্য, ইহা অপেক্ষা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় কি?
পাশ্চাত্য নারী স্বাধীনভাবে বিচরণ করে, অতএব তাহাই ভাল; পাশ্চাত্য নারী স্বয়ংবরা, অতএব তাহাই উন্নতির উচ্চতম সোপান; পাশ্চাত্য পুরুষ আমাদের বেশ-ভূষা অশন-বসন ঘৃণা করে, অতএব তাহা অতি মন্দ; পাশ্চাত্যেরা মূর্তিপূজা দোষাবহ বলে; মূর্তিপূজা দূষিত, সন্দেহ কি?
পাশ্চাত্যেরা একটি দেবতার পূজা মঙ্গলপ্রদ বলে, অতএব আমাদের দেবদেবী গঙ্গাজলে বিসর্জন দাও। পাশ্চাত্যেরা জাতিভেদ ঘৃণিত বলিয়া জানে, অতএব সর্ব বর্ণ একাকার হও। পাশ্চাত্যেরা বাল্যবিবাহ সর্ব দোষের আকর বলে, অতএব তাহাও অতি মন্দ—নিশ্চিত।
আমরা এই সকল প্রথা রক্ষণোপযোগী বা ত্যাগযোগ্য—ইহার বিচার করিতেছি না; তবে যদি পাশ্চাত্যদিগের অবজ্ঞাদৃষ্টিমাত্রই আমাদের রীতিনীতির জঘন্যতার কারণ হয়, তাহার প্রতিবাদ অবশ্য কর্তব্য।
বর্তমান লেখকের পাশ্চাত্য সমাজের কিঞ্চিৎ প্রত্যক্ষ জ্ঞান আছে; তাহাতে ইহাই ধারণা হইয়াছে যে, পাশ্চাত্য সমাজ ও ভারত সমাজের মূল গতি ও উদ্দেশ্যের এতই পার্থক্য যে, পাশ্চাত্য অনুকরণে গঠিত সম্প্রদায়মাত্রই এদেশে নিষ্ফল হইবে। যাঁহারা পাশ্চাত্য সমাজে বসবাস না করিয়া, পাশ্চাত্য সমাজের স্ত্রীজাতির পবিত্রতারক্ষার জন্য স্ত্রী-পুরুষ-সংমিশ্রণের যে সকল নিয়ম ও বাধা প্রচলিত আছে, তাহা না জানিয়া স্ত্রী-পুরুষের অবাধ সংমিশ্রণ প্রশ্রয় দেন, তাঁহাদের সহিত আমাদের অণুমাত্রও সহানুভূতি নাই। পাশ্চাত্য দেশেও দেখিয়াছি, দুর্বল জাতির সন্তানেরা ইংলণ্ডে যদি জন্মিয়া থাকে, আপনাদিগকে স্পানিয়ার্ড, পোর্তুগীজ, গ্রীক ইত্যাদি না বলিয়া, ইংরেজ বলিয়া পরিচয় দেয়।
বলবানের দিকে সকলে যায়; গৌরবান্বিতের গৌরবচ্ছটা নিজের গাত্রে কোন প্রকারে একটুও লাগে—দুর্বলমাত্রেরই এই ইচ্ছা। যখন ভারতবাসীকে ইওরোপী বেশ-ভূষা-মণ্ডিত দেখি, তখন মনে হয়, বুঝি ইহারা পদদলিত বিদ্যাহীন দরিদ্র ভারতবাসীর সহিত আপনাদের স্বজাতীয়ত্ব স্বীকার করিতে লজ্জিত!! চতুর্দশশত বর্ষ যাবৎ হিন্দুরক্তে পরিপালিত পার্সী এক্ষণে আর ‘নেটিভ’ নহেন। জাতিহীন ব্রাহ্মণম্মন্যের ব্রহ্মণ্যগৌরবের নিকটে মহারথী কুলীন ব্রাহ্মণের বংশমার্যাদা বিলীন হইয়া যায়। আর পাশ্চাত্যেরা এক্ষণে শিক্ষা দিয়াছে যে, ঐ যে কটিতটমাত্র-আচ্ছাদনকারী অজ্ঞ, মূর্খ, নীচজাতি, উহারা অনার্যজাতি!! উহারা আর আমাদের নহে!!
হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা—এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে? এই লজ্জাকর কাপুরুষতাসহায়ে তুমি বীরভোগ্যা স্বাধীনতা লাভ করিবে? হে ভারত, ভুলিও না—তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী; ভুলিও না—তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শঙ্কর; ভুলিও না—তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয়সুখের—নিজের ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে; ভুলিও না—তুমি জন্ম হইতেই ‘মায়ের’ জন্য বলিপ্রদত্ত; ভুলিও না—তোমার সমাজ সে বিরাট মহামায়ার ছায়ামাত্র; ভুলিও না—নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই! হে বীর, সাহস অবলম্বন কর; সদর্পে বল—আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল—মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই; তুমিও কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত হইয়া, সদর্পে ডাকিয়া বল—ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারাণসী; বল ভাই—ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ; আর বল দিন-রাত, ‘হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ কর।’
(১)
ওঁ হ্রীং ঋতং ত্বমচলো গুণজিৎ গুণেড্যঃ
ন-ক্তন্দিবং সকরুণং তব পাদপদ্মম্।
মো-হঙ্কষং বহুকৃতং ন ভজে যতোঽহং
তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো! ১
ওঁ হ্রীং তুমি সত্য, স্থির, ত্রিগুণজয়ী অথচ নানাপ্রকার গুণের দ্বারা স্তবের যোগ্য। যেহেতু তোমার মোহনিবারক পূজনীয় পাদপদ্ম আমি ব্যাকুলভাবে দিনরাত্রি ভজনা করি না, সেজন্য হে দীনবন্ধো! তুমিই আমার আশ্রয়। ১
ভ-ক্তির্ভগশ্চ ভজনং ভবভেদকারি
গ-চ্ছন্ত্যলং সুবিপুলং গমনায় তত্ত্বম্।
বক্ত্রোদ্ধৃতোঽপি হৃদয়ে ন মে ভাতি কিঞ্চিৎ১
তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো!২
সংসার-বন্ধন-নাশকারী ভজন, ভক্তি ও বৈরাগ্যাদি ষড়ৈশ্বর্য সেই অতি মহান্ ব্রহ্মতত্ত্বপ্রাপ্তির পক্ষে যথেষ্ট—এই কথা মুখে উচ্চারিত হইলেও আমার অন্তঃকরণে কিছুমাত্র প্রতিভাত হইতেছে না। অতএব হে দীনবন্ধো! তুমিই আমার আশ্রয়।২
তে-জস্তরন্তি ত্বরিতং ত্বয়ি তৃপ্ততৃষ্ণাঃ২
রা-গং কৃতে ঋতপথে ত্বয়ি রামকৃষ্ণে।
৩ ম-র্ত্যামৃতং তব পদং মরণোর্মিনাশং
তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো! ৩
হে রামকৃষ্ণ! সত্যের পথস্বরূপ তোমাতে যাহারা অনুরক্ত, তোমাকে পাইয়াই তাহাদের সমুদয় কামনা পূর্ণ হয়, সুতরাং তাহারা শীঘ্র রজোগুণকে অতিক্রম করে। মরণশীল নরলোকে অমৃতস্বরূপ তোমার পাদপদ্ম মৃত্যুরূপ তরঙ্গকে নাশ করে। অতএব হে দীনবন্ধো! তুমিই আমার আশ্রয়। ৩
কৃ-ত্যং করোতি কলুষং কুহকান্তকারি
ষ্ণা-ন্তং শিবং সুবিমলং তব নাম নাথ।
য-স্মাদহং ত্বশরণো জগদেকগম্য
তস্মাত্ত্বমেব শরণং মম দীনবন্ধো!৪
হে প্রভো! মায়াদূরকারী মঙ্গলময় অতি পবিত্র তোমার ‘ষ্ণান্ত’ (রামকৃষ্ণ) নাম পাপকেও পুণ্যে পরিণত করে। হে জগতের একমাত্র লভ্য, যেহেতু আমি নিরাশ্রয়, সেজন্য হে দীনবন্ধো! তুমিই আমার আশ্রয়।৪
(২)
আচণ্ডালাপ্রতিহতরয়ো যস্য প্রেমপ্রবাহঃ
লোকাতীতোঽপ্যহহ ন জহৌ লোককল্যাণমার্গম্।
ত্রৈলোক্যেঽপ্যপ্রতিমমহিমা জানকীপ্রাণবন্ধঃ
ভক্ত্যা জ্ঞানং বৃতবরবপুঃ সীতায় যো হি রামঃ॥ ১
স্তব্ধীকৃত্য প্রলয়কলিতং বাহবোত্থং মহান্তং
হিত্বা রাত্রিং প্রকৃতিসহজামন্ধতামিস্রমিশ্রাম্।
গীতং শান্তং মধুরমপি যঃ সিংহনাদং জগর্জ
সোঽয়ং জাতঃ প্রথিতপুরুষো রামকৃষ্ণস্ত্বিদানীম্॥ ২
যাঁহার প্রেমস্রোত চণ্ডাল পর্যন্ত অপ্রতিহতবেগে প্রবাহিত অর্থাৎ চণ্ডালোকেও যিনি ভালবাসিতে কুণ্ঠিত হন নাই, আহা! যিনি অতিমানব-স্বভাব হইয়াও লোকের কল্যাণের পথ পরিত্যাগ করেন নাই, স্বর্গ মর্ত্য পাতাল—এই তিনলোকেই যাঁহার মহিমার তুলনা নাই, যিনি সীতার প্রাণস্বরূপ, যিনি ভক্তির সহিত শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের কল্যাণমূর্তি ধারণ করিয়াছিলেন;১
কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের সময় যে ভয়ানক প্রলয়তুল্য হুহুঙ্কার উঠিয়াছিল, তাহাকে স্তব্ধ করিয়া এবং(অর্জুনের) ঘোরতর স্বাভাবিক অন্ধতম-স্বরূপ অজ্ঞান-রজনীকে দূর করিয়া দিয়া, শান্ত ও মধুর গীত (গীতাশাস্ত্র) যিনি সিংহনাদরূপে গর্জন করিয়া বলিয়াছিলেন—সেই বিখ্যাত পুরুষই এক্ষণে রামকৃষ্ণরূপে জন্মিয়াছেন। ২
(শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী-কৃত পদ্যানুবাদ)
প্রেমের প্রবাহ যাঁর আচণ্ডালে প্রবাহিত,
লোকহিতে রত সদা, হয়ে যিনি লোকাতীত,
জানকীর প্রাণবন্ধ, উপমা নাহিক যাঁর,
ভক্ত্যাবৃত জ্ঞানবপু—যিনি রাম অবতার;
স্তব্ধ করি কুরুক্ষেত্র-প্রলয়ের হুহুঙ্কার,
দূর করি সহজাত মহামোহ-অন্ধকার,
সুগভীর উঠেছিল গীতসিংহনাদ যাঁর,
সেই এবে রামকৃষ্ণ খ্যাতনামা ত্রিসংসার।
(৩)
নরদেব দেব জয় জয় নরদেব
শক্তিসমুদ্রসমুত্থতরঙ্গং
দর্শিতপ্রেমবিজৃম্ভিতরঙ্গং
সংশয়রাক্ষসনাশমহাস্ত্রং
যামি গুরুং শরণং ভববৈদ্যং
নরদেব দেব জয় জয় নরদেব॥ ১
অদ্বয়তত্ত্বসমাহিতচিত্তং
প্রোজ্জ্বলভক্তিপটাবৃতবৃত্তং
কর্মকলেবরমদ্ভুতচেষ্টং
যামি গুরুং শরণং ভববৈদ্যং
নরদেব দেব জয় জয় নরদেব॥ ২
হে নরদেব দেব! তোমার জয় হউক। যিনি শক্তিরূপ সমুদ্র হইতে উত্থিত তরঙ্গস্বরূপ, যিনি প্রেমের নানা লীলা দেখাইয়াছেন, যিনি সন্দেহরূপ রাক্ষস বিনাসের মহাস্ত্রস্বরূপ, সংসাররূপ রোগের চিকিৎসক সেই গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি। হে নরদেব দেব! তোমার জয় হউক। ১
যাঁহার চিত্ত অদ্বয় ব্রহ্মে সমাহিত, যাঁহার চরিত্র অতি শ্রেষ্ঠ ভক্তিরূপ বস্ত্রের দ্বারা আচ্ছাদিত—অর্থাৎ যাঁহার ভিতরে জ্ঞান এবং বাহিরে ভক্তি, যিনি দেহের দ্বারা ক্রমাগত লোকহিতার্থ কর্ম করিয়াছেন, যাঁহার কার্যকলাপ অদ্ভুত, সংসাররূপ রোগের চিকিৎসক সেই গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি। হে নরদেব দেব! তোমার জয় হউক। ২
(৪)
সামাখ্যাদ্যৈর্গীতিসুমধুরৈর্মেঘগম্ভীরঘোষৈ-
র্যজ্ঞধ্বান-ধ্বনিতগগনৈর্ব্রাহ্মণৈর্জ্ঞাতবেদৈঃ।
বেদান্তাখৌঃ সুবিহিত-মখোদ্ভিন্ন-মোহান্ধকারৈঃ
স্তুতো গীতো য ইহ সততং তং ভজে রামকৃষ্ণম্॥
বেদতত্ত্বজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞস্থলে মন্ত্রোচ্চারণ দ্বারা আকাশ বাতাস মুখরিত করিতেন, বিধিপূর্বক যজ্ঞ সম্পাদন করার ফলে তাঁহাদের শুদ্ধ হৃদয় হইতে বেদান্তবাক্যদ্বারা ভ্রম ও অজ্ঞানের অন্ধকার দূরীভূত হইয়াছিল; তাঁহারা মেঘের মত গম্ভীর সুমধুর সুরে সামবেদ প্রভৃতি দ্বারা যাঁহার স্তব করিয়াছেন, যাঁহার মহিমা কীর্তন করিয়াছেন—আমি সর্বদা সেই শ্রীরামকৃষ্ণের ভজনা করি।*
শ্রীরামকৃষ্ণপ্র ণামঃ
স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিণে।
অবতারবরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ॥
ধর্মের সংস্থাপক, সকলধর্মস্বরূপ, অবতারগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হে রামকৃষ্ণ, তোমাকে প্রণাম করি।
ওঁ নমঃ শিবায়
নিখিলভুবনজন্মস্থেমভঙ্গপ্ররোহাঃ
অকলিতমহিমানঃ কল্পিতা যত্র তস্মিন্।
সুবিমলগগনাভে ত্বীশসংস্থেঽপ্যনীশে
মম ভবতু ভবেঽস্মিন্ ভাসুরো ভাববদ্ধঃ॥ ১
যাঁহাতে সমুদয় জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয়ের অঙ্কুরসমূহ অসংখ্য বিভূতিরূপে কল্পিত, যিনি সুনির্মল আকাশের তুল্য, যিনি জগতের ঈশ্বররূপে অবস্থিত, যাঁহার কোন নিয়ন্তা নাই—সেই মহাদেব আমার প্রেমবন্ধন দৃঢ় ও উজ্জ্বল হউক। ১
নিহতনিখিলমোহে ঽধীশতা যত্র রূঢ়া
প্রকটিতপরপ্রেম্না যো মহাদেবসংজ্ঞঃ।
অশিথিলপরিরম্ভঃ প্রেমরূপস্য যস্য
হৃদি প্রণয়তি বিশ্বং ব্যাজমাত্রং বিভুত্বম্॥ ২
যিনি সমুদয় মোহ নাশ করিয়াছেন, যাঁহাতে ঈশ্বরত্ব স্বাভাবিক ভাবে অবস্থিত, যিনি (হলাহল পান করিয়া জগতের জীবগণের প্রতি) পরম প্রেম প্রকাশ করায় ‘মহাদেব’ নামে অভিহিত হইয়াছেন, প্রেমস্বরূপ যাঁহার গাঢ় আলিঙ্গনে সমুদয় ঐশ্বর্যই আমাদের হৃদয়ে শুধু মায়া বলিয়া প্রতিভাত হয়, সেই মহাদেবে আমার প্রেমবন্ধন দৃঢ় হউক। ২
বহতি বিপুলবাতঃ পূর্বসংস্কাররূপঃ
বিদলতি৪ বলবৃন্দং ঘূর্ণিতেবোর্মিমালা।
প্রচলিত খলু যুগ্মং যুষ্মদস্মৎপ্রতীতম্
অতিবিকলিতরূপং নৌমি চিত্তং শিবস্থম্॥ ৩
পূর্বসংস্কাররূপ প্রবল বায়ু প্রবাহিত হইতেছে, উহা ঘূর্ণায়মান তরঙ্গসমূহের মত বলবান্ ব্যক্তিদিগকেও দলিত করিতেছে। ‘তুমি-আমি’-রূপে প্রতিভাত দ্বন্দ্ব চলিতেছে। সেই শিবে সংস্থাপিত অতি বিকারশীল অস্থির চিত্তকে আমি বন্দনা করি।৩
জনকজনিতভাবো বৃত্তয়ঃ সংস্কৃতাশ্চ
অবগণনবহুরূপা যত্র চৈকো যথার্থঃ।
শমিতবিকৃতিবাতে যত্র নান্তর্বহিশ্চ
তমহহ হরমীড়ে চিত্তবৃত্তের্নিরোধম্॥ ৪
কার্যকারণভাব এবং নির্মল বৃত্তিসমূহ অসংখ্য নানারূপ হইলেও যেখানে একবস্তুই সত্য, বিকাররূপ বায়ু শান্ত হইলে যেখানে ভিতর ও বাহির থাকে না, আহা! সেই চিত্তবৃত্তির নিরোধস্বরূপ মহাদেবকে আমি বন্দনা করি। ৪
গলিততিমিরমালঃ শুভ্রতেজঃপ্রকাশঃ
ধবলকমলশোভঃ জ্ঞানপুঞ্জাট্টহাসঃ।
যমিজনহৃদিগম্যো নিষ্কলো ধ্যায়মানঃ
প্রণতমবতু মাং সঃ মানসো রাজহংসঃ॥ ৫
যাঁহা হইতে অজ্ঞানরূপ অন্ধকারসমূহ নষ্ট হইয়াছে, শুভ্র জ্যোতির মত যাঁহার প্রকাশ, যিনি শ্বেতবর্ণ পদ্মের ন্যায় শোভা ধারণ করিয়াছেন, জ্ঞানরাশি যাঁহার অট্টহাস্যস্বরূপ (যাঁহার অট্টহাসিতে জ্ঞানরাশি ছড়াইয়া পড়িতেছে), যিনি সংযমী ব্যক্তির হৃদয়ে লভ্য, যিনি অখণ্ডস্বরূপ, মনোরূপ সরোবরে অবস্থিত সেই রাজহংসরূপী শিব, আমার দ্বারা ধ্যাত হইয়া প্রণত আমাকে রক্ষা করুন। ৫
দুরিতদলনদক্ষং দক্ষজাদত্তদোষং
কলিতকলিকলঙ্কং কম্রকহ্লারকান্তম্।
পরহিতকরণায় প্রাণপ্রচ্ছেদপ্রীতং৫
নতনয়ননিযুক্তং নীলকণ্ঠং নমামঃ॥৬
যিনি পাপনাশ করিতে সমর্থ, দক্ষকন্যা সতী—যাঁহাকে করকমল দান করিয়াছেন, যিনি কলির দোষসমূহ নাশ করেন, যিনি সুন্দর কহ্লারপুষ্পের মত মনোহর, পরের কল্যাণের জন্য প্রাণত্যাগ করিতে যাঁহার সদাই প্রীতি, প্রণত ব্যক্তিগণের মঙ্গলের জন্য সর্বদা যাঁহার দৃষ্টি রহিয়াছে—সেই নীলকণ্ঠ মহাদেবকে আমরা প্রণাম করি। ৬
কা ত্বং শুভে শিবকরে সুখদুঃখহস্তে
আঘূর্ণিতং ভবজলং প্রবলোর্মিভঙ্গৈঃ।
শান্তিং বিধাতুমিহ কিং বহুধা বিভগ্নাং
মাতঃ প্রযত্নপরমাসি সদৈব বিশ্বে॥ ১
হে কল্যাণকারিণী মাতঃ, তোমার দুই হাতে সুখ ও দুঃখ। কে তুমি? সংসাররূপ জল প্রবল তরঙ্গসমূহ দ্বারা ঘূর্ণায়মান হইতেছে। তুমি কি সর্বদাই নানাপ্রকারে ভগ্ন শান্তিতে জগতে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য যত্নপর হইতেছ? ১
সম্পাদয়ন্ত্যবিরতং ত্ববিরামবৃত্তা
যা বৈ স্থিতা কৃতফলং ত্বকৃতস্য নেত্রী।
সা মে ভবত্বনুদিনং বরদা ভবানী
জানাম্যহং ধ্রুবমিয়ং ধৃতকর্মপাশা॥ ২
যে নিয়তক্রিয়াশীলা দেবী সর্বদা কৃতকর্মের ফল সংযোজনা করিয়া অবস্থিতা, যাঁহাদের কর্মক্ষয় হইয়া গিয়াছে, তাঁহাদিগকে যিনি মোক্ষপদে লইয়া যান, সেই ভবানী আমাকে সর্বদা বর প্রদান করুন। আমি নিশ্চয়ই জানি, তিনি কর্মরূপ রজ্জু ধারণ করিয়া আছেন। ২
কিং বা কৃতং কিমকৃতং৬ ক্ব কপাললেখঃ
কিং কর্ম বা ফলমিহাস্তি হি যাং বিনা ভোঃ৭।
ইচ্ছাগুণৈর্নিয়মিতা৮ নিয়মাঃ স্বতন্ত্রৈঃ
যস্যাঃ সদা৯ ভবতু সা শরণং মমাদ্যা॥ ৩
এ জগতে যাঁহা ব্যতীত ধর্ম বা অধর্ম অথবা কপালের লেখা বা কর্ম বা (তাহার) ফল, এ সকল কিছুই হইতে পারে না, যাঁহার স্বাধীন ইচ্ছারূপ রজ্জু দ্বারা নিয়মসমূহ পরিচালিত, সেই আদিকারণস্বরূপা দেবী সর্বদা আমার আশ্রয়স্বরূপা হউন। ৩
সন্তানয়ন্তি জলধিং জনিমৃত্যুজালং
সম্ভাবয়ন্ত্যবিকৃতং বিকৃতং বিভগ্নম্।
যস্যা বিভূতয় ইহামিতশক্তিপালাঃ
নাশ্রিত্য তাং বদ কুতঃ শরণং ব্রজামঃ॥ ৪
এই সংসারে যাঁহার অপরিমিতশক্তিশালী বিভূতিসমূহ জন্মমৃত্যু-জালরূপ সমুদ্র বিস্তার করিতেছে এবং অবিকারী বস্তুকে বিকৃত ও ভগ্ন করিতেছে, বল, তাঁহার আশ্রয় না লইয়া কাহার শরণাপন্ন হইব? ৪
মিত্রে রিপৌ ত্ববিষমং তব পদ্মনেত্রং
স্বস্থেঽসুখে ত্ববিতথস্তব১০ হস্তপাতঃ।
ছায়া মৃতেস্তব দয়া ত্বমৃতঞ্চ মাতঃ১১
মুঞ্চন্তু মাং ন১২ পরমে শুভদৃষ্টয়স্তে॥ ৫
তোমার পদ্মনেত্রের দৃষ্টি—শত্রু-মিত্র উভয়ের প্রতিই সমভাবে পতিত হইতেছে, সুখী দুঃখী উভয়কে তুমি একই ভাবে স্পর্শ করিতেছ। হে মাতঃ, মৃত্যুচ্ছায়া ও জীবন—উভয়ই তোমার দয়া। হে মহাদেবী, তোমার শুভদৃষ্টিসমূহ আমাকে যেন পরিত্যাগ না করে। ৫
ক্বাম্বা শিবা ক্ব গৃণনং মম হীনবুদ্ধেঃ
দোর্ভ্যাং বিধর্তুমিব যামি জগদ্বিধাত্রীম্১৩।
চিন্ত্যং শ্রিয়া১৪ সুচরণং ত্বভয়প্রতিষ্ঠং
সেবাপরৈরভিনুতং১৫ শরণং প্রপদ্যে॥ ৬
সেই মঙ্গলময়ী মাতাই বা কোথায় এবং হীনবুদ্ধি আমার এই স্তববাক্যই বা কোথায়? আমি আমার এই ক্ষুদ্র দুই হস্ত দ্বারা জগতের বিধাত্রীকে যেন ধরিতে উদ্যত হইয়াছি। লক্ষ্মী যাঁহার চিন্তা করেন, যাঁহার সুন্দর পাদপদ্মে মুক্তি প্রতিষ্ঠিত, সেবাপরায়ণ জনগণ যাঁহার বন্দনা করেন, আমি সেই জগন্মাতার আশ্রয় লইলাম। ৬
যা মাং চিরায়১৬ বিনয়ত্যতিদুঃখমার্গৈঃ
আসংসিদ্ধেঃ স্বকলিতৈর্ললিতৈর্বিলাসৈঃ।
যা মে মতিং১৭ সুবিদধে সততং ধরণ্যাং
সাম্বা শিবা১৮ মম গতিঃ সফলেঽফলে বা॥ ৭
সিদ্ধিলাভ না হওয়া পর্যন্ত চিরদিন যিনি আমাকে নিজকৃত মনোহর লীলাদ্বারা অতি দুঃখময় পথ দিয়া লইয়া যাইতেছেন, যিনি সর্বদা পৃথিবীতে আমার বুদ্ধিকে উত্তমরূপে পরিচালিত করিতেছেন, আমি সফলই হই আর বিফলই হই, সেই কল্যাণময়ী জননীই আমার গতি। ৭
(স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ-কৃত পদ্যানুবাদ)
তুলি ঘোর ঊর্মিভঙ্গে,  মহাবর্ত তার সঙ্গে
এ ভবসাগরে কে মা, খেলিতেছ বল না?
শিবময়ী মূর্তি তোর  শুভঙ্করি, একি ঘোর,
সুখ দুঃখ ধরি করে কর সবে ছলনা।
এতই কি তোর কাজ,  সদা ব্যস্ত বিশ্বমাঝ,
অশান্ত ধরায় কি গো শান্তিদান বাসনা? ১
যে ছিঁড়েছে কর্মপাশ,  তারে করি চিরদাস
নিত্যশান্তি সুধারাশি পিয়াতেছ, জননী,
কার্য করি ফল চায়,  কৃত ফল দিতে তায়
সদাই আকুল তুমি, ওগো হরঘরণী,
জানি মা, তোমায় আমি,  কর্মপাশে বাঁধো তুমি
বেঁধো না বরদে, মোরে, নাশো দুঃখরজনী! ২
কি কারণে কার্যচয়,   জগতে প্রকট হয়,
সুকৃত দুষ্কৃত কিম্বা ললাট-লিখিত রে,
কেহ না দেখিয়া কূল,   কহয়ে অদৃষ্ট-মূল,
ধর্মাধর্মে সুখ-দুঃখ এ নহে নিশ্চিত রে,
স্বতন্ত্র বিধান যাঁর,   বদ্ধ আছে এ সংসার,
সে মূল শক্তির আমি সদাই আশ্রিত রে। ৩
যাঁহার বিভূতিচয়,   লোকপাল সমুদয়,
যাঁদের অমিত শক্তি কোন বাধা মানে না,
জন্ম মৃত্যু জরা ব্যাধি,   যে সাগরে নিরবধি
সে অনন্ত জলনিধি যাঁহাদের রচনা,
প্রকৃতি-বিকৃতিকারী  এই সব কর্মচারী,
যাঁর বলে বলীয়ান্, কর তাঁরি অর্চনা। ৪
মা তোমার কৃপাদৃষ্টি   সমভাবে সুধাবৃষ্টি,
শত্রু মিত্র সকলের উপরেই কর গো,
সমভাবে ধনী দীনে,   রক্ষা কর নিশিদিনে,
মৃত্যু বা অমৃত, দুয়ে তব কৃপা ঝরে গো,
যাচি পদে, নিরুপমে,  ভুল না মা, এ অধমে,
শুভদৃষ্টি তব যেন সর্বতাপ হরে গো। ৫
বিশ্বপ্রসবিনী তুমি,   ক্ষুদ্রবুদ্ধি জীব আমি,
করিব তোমার স্তুতি বৃথা এই কল্পনা।
সীমাহীন দেশকালে,  ধরে আছ বিশ্বজালে,
তোমায় ধরিতে হাতে উন্মাদের বাসনা,
অকিঞ্চন ভক্তিধন,   রমাভাব্য যে চরণ,
সে পদে শরণ পাই, এই মাত্র কামনা।৬
স্বচরিত লীলাগার,   মনোহর এ সংসার,
সুখ দুঃখ লয়ে সদা নানা খেলা খেলিছ,
পূর্ণ জ্ঞান দিবে তাই,  জন্ম হতে সুখ নাই,
দুঃখপথ দিয়া মোর করে ধরি চলিছ,
সফল নিষ্ফল হই,  কভু বুদ্ধিহারা নই,
তোমারি প্রসাদে তুমি সদা মোরে রাখিছ,
তুমি গতি মোর, তাই স্নেহে মাগো পালিছ। ৭
মিশ্র—চৌতাল
খণ্ডন-ভব-বন্ধন, জগ-বন্দন বন্দি তোমায়।
নিরঞ্জন, নররূপধর, নির্গুণ, গুণময়॥
মোচন-অঘদূষণ ১৯ জগভূষণ, চিদ্ঘনকায়।
জ্ঞানাঞ্জন-বিমল-নয়ন বীক্ষণে মোহ যায়॥
ভাস্বর ভাব-সাগর চির-উন্মাদ প্রেম-পাথার।
ভক্তার্জন-যুগলচরণ, তারণ-ভব-পার॥
জৃম্ভিত-যুগ-ঈশ্বর ২০, জগদীশ্বর, যোগসহায়।
নিরোধন, সমাহিত মন, নিরখি তব কৃপায়॥
ভঞ্জন-দুঃখগঞ্জন ২১ করুণাঘন, কর্মকঠোর২২।
প্রাণার্পণ-জগত-তারণ, কৃন্তন-কলিডোর২৩॥
বঞ্চন-কামকাঞ্চন, অতিনিন্দিত-ইন্দ্রিয়-রাগ।
ত্যাগীশ্বর, হে নরবর, দেহ পদে অনুরাগ॥
নির্ভয়, গতসংশয়, দৃঢ়নিশ্চয়মানসবান্ ।
নিষ্কারণ-ভকত-শরণ, ত্যজি জাতিকুলমান২৪॥
সম্পদ তব শ্রীপদ, ভব গোষ্পদ-বারি যথায়।
প্রেমার্পণ, সমদরশন, জগজন-দুঃখ যায়॥
[পূর্বে এই ভজনটি নিম্নলিখিতভাবে রচিত হইয়াছিল; পরে স্বামীজী উহার পূর্বোক্তরূপে পরিবর্তন করেন।]
খণ্ডন্-ভব-বন্ধন, জগ-বন্দন, বন্দি তোমায়।
নিরঞ্জন, নররূপধর, নির্গুণ, গুণময়॥
নমো নমো প্রভু বাক্যমনাতীত
মনোবচনৈকাধার,
জ্যোতির জ্যোতি উজল হৃদিকন্দর
তুমি তমভঞ্জনহার২৫।
ধে ধে ধে, লঙ্গ রঙ্গ ভঙ্গ, বাজে অঙ্গ সঙ্গ মৃদঙ্গ,
গাইছে ছন্দ ভকতবৃন্দ, আরতি তোমার॥
শিব-সঙ্গীত
(১)
কর্ণাটি—একতালা
তাথেইয়া তাথেইয়া নাচে ভোলা,বম্ বব বাজে গাল।
ডিমি ডিমি ডিমি ডমরু বাজে, দুলিছে কপাল মাল।
গরজে গঙ্গা জটামাঝে, উগরে অনল ত্রিশূল রাজে,
ধক্ ধক্ ধক্ মৌলিবন্ধ জ্বলে শশাঙ্ক-ভাল।
(২)
তাল—সুর ফাঁকতাল
হর হর হর ভূতনাথ পশুপতি।
যোগেশ্বর মহাদেব শিব পিনাকপাণি॥
ঊর্ধ্ব জ্বলত জটাজাল, নাচত ব্যোমকেশ ভাল,
সপ্ত ভুবন ধরত তাল, টলমল অবনী॥
শ্রীকৃষ্ণ-সঙ্গীত
মুলতান—ঢিমা ত্রিতালী
মুঝে বারি বনোয়ারী সেঁইয়া, যানেকো দে।
যানেকো দে রে সেঁইয়া, যানেকো দে (আজু ভালা)।
মেরা বনোয়ারী, বাঁদি তুহারি
ছোড়ে চতুরাই সেঁইয়া, যানেকো দে (আজু ভালা)
(মোরে সেঁইয়া)
যমুনাকি নীরে, ভরোঁ গাগরিয়া
জোরে২৬ কহত সেঁইয়া, যানেকো দে॥
খাম্বাজ—চৌতাল
একরূপ, অ-রূপ-নাম-বরণ, অতীত-আগামী-কাল-হীন,
দেশহীন, সর্বহীন, ‘নেতি নেতি’ বিরাম যথায়॥২৭
সেথা হতে বহে কারণ-ধারা
ধরিয়ে বাসনা বেশ উজালা,
গরজি গরজি উঠে তার বারি,
‘অহমহমিতি’ সর্বক্ষণ॥
সে অপার ইচ্ছা-সাগরমাঝে,
অযুত অনন্ত তরঙ্গ রাজে,
কতই রূপ, কতই শকতি,
কত গতি স্থিতি, কে করে গণন॥
কোটি চন্দ্র—কোটি তপন
লভিয়ে সেই সাগরে জনম,
মহাঘোর রোলে ছাইল গগন,
করি দশ দিক জ্যোতিমগন॥
তাহে বসে২৮ কত জড় জীব প্রাণী,
সুখ দুঃখ জরা জনম মরণ,
সেই সূর্য, তারি কিরণ; সেই সূর্য, সেই কিরণ॥২৯
বাগেশ্রী—আড়া
নাহি সূর্য, নাহি জ্যোতিঃ, নাহি শশাঙ্ক সুন্দর,
ভাসে ব্যোমে ছায়াসম ছবি বিশ্ব চরাচর॥
অস্ফুট মন-আকাশে, জগতসংসার ভাসে,
ওঠে ভাসে ডোবে পুনঃ অহং-স্রোতে নিরন্তর॥
ধীরে ধীরে ছায়াদল, মহালয়ে প্রবেশিল,
বহে মাত্র ‘আমি’ ‘আমি’—এই ধারা অনুক্ষণ॥
সে ধারাও বদ্ধ হল, শুন্যে মিলাইল,
‘অবাঙ্মনসোগোচরম্’, বোঝে—প্রাণ বোঝে যার॥
আঁধারে আলোক-অনুভব, দুঃখে সুখ, রোগে স্বাস্থ্যভান;
প্রাণ-সাক্ষী শিশুর ক্রন্দন, হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান্?
দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে অনিবার, পিতা পুত্রে নাহি দেয় স্থান;
‘স্বার্থ’ ‘স্বার্থ’ সদা এই রব, হেথা কোথা শান্তির আকার?
সাক্ষাৎ নরক স্বর্গময়—কেবা পারে ছাড়িতে সংসার?
কর্ম-পাশ গলে বাঁধা যার—ক্রীতদাস বল কোথা যায়?
যোগ-ভোগ, গার্হস্থ্য-সন্ন্যাস, জপ-তপ, ধন-উপার্জন,
ব্রত ত্যাগ তপস্যা কঠোর, সব মর্ম দেখেছি এবার;
জেনেছি সুখের নাহি লেশ, শরীরধারণ বিড়ম্বন;
যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিহ নিশ্চয়।
হৃদিবান্ নিঃস্বার্থ প্রেমিক! এ জগতে নাহি তব স্থান;
লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত, মর্মর-মূরতি তা কি সয়?
হও জড়প্রায়, অতি নীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল—
সত্যহীন, স্বার্থপরায়ণ, তবে পাবে এ সংসারে স্থান।
বিদ্যাহেতু করি প্রাণপণ, অর্ধেক করেছি আয়ুক্ষয়—
প্রেমহেতু উন্মাদের মত, প্রাণহীন ধরেছি ছায়ায়;
ধর্ম তরে করি কত মত, গঙ্গাতীর শ্মশানে আলয়,
নদীতীর পর্বতগহ্বর, ভিক্ষাশনে কত কাল যায়।
অসহায়-ছিন্নবাস ধরে দ্বারে দ্বারে উদরপূরণ—
ভগ্নদেহ তপস্যার ভারে, কি ধন করিনু উপার্জন?
শোন বলি মরমের কথা, জেনেছি জীবনে সত্য সার—
তরঙ্গ-আকুল ভবঘোর, এক তরী করে পারাপার—
মন্ত্র-তন্ত্র, প্রাণ-নিয়মন, মতামত, দর্শন-বিজ্ঞান,
ত্যাগ-ভোগ—বুদ্ধির বিভ্রম; ‘প্রেম’ ‘প্রেম’—এই মাত্র ধন।
জীব ব্রহ্ম, মানব ঈশ্বর, ভূত-প্রেত-আদি দেবগণ,
পশু-পক্ষী কীট-অণুকীট—এই প্রেম হৃদয়ে সবার।
‘দেব’ ‘দেব’—বল আর কেবা? কেবা বল সবারে চালায়?
পুত্র তরে মায়ে দেয় প্রাণ, দস্যু হরে—প্রেমের প্রেরণ!!
হয়ে বাক্য-মন-অগোচর, সুখ-দুঃখে তিনি অধিষ্ঠান,
মহাশক্তি কালী মৃত্যুরূপা, মাতৃভাবে তাঁরি আগমন।
রোগ-শোক, দারিদ্র্য-যাতনা, ধর্মাধর্ম, শুভাশুভ ফল,
সব ভাবে তাঁরি উপাসনা, জীবে বল কেবা কিবা করে?
ভ্রান্ত সেই যেবা সুখ চায়, দুঃখ চায় উন্মাদ সে জন—
মৃত্যু মাঙ্গে সেও যে পাগল, অমৃতত্ব বৃথা আকিঞ্চন।
যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,
এই সেই সংসার-জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্তন।
পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার
বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম—অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।
ভিক্ষুকের কবে বল সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল?
দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
‘দাও’, ‘দাও’—যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।
ফুল্ল ফুল সৌরভে আকুল, মত্ত অলিকুল গুঞ্জরিছে আশে পাশে।
শুভ্র শশী যেন হাসিরাশি, যত স্বর্গবাসী বিতরিছে ধরাবাসে॥
মৃদুমন্দ মলয়পবন, যার পরশন, স্মৃতিপট দেয় খুলে।
নদী, নদ, সরসী-হিল্লোল, ভ্রমর চঞ্চল, কত বা কমল দোলে॥
ফেনময়ী ঝরে নির্ঝরিণী—তানতরঙ্গিণী—গুহা দেয় প্রতিধ্বনি।
স্বরময় পতত্রিনিচয়, লুকায়ে পাতায়, শুনায় সোহাগবাণী॥
চিত্রকর, তরুণ ভাস্কর, স্বর্ণতুলিকর, ছোঁয় মাত্র ধরাপটে।
বর্ণখেলা ধরাতল ছায়, রাগপরিচয় ভাবরাশি জেগে ওঠে॥
মেঘমন্দ্র কুলিশ-নিস্বন, মহারণ, ভুলোক-দ্যুলোক-ব্যাপী।
অন্ধকার উগরে আঁধার, হুহুঙ্কার শ্বসিছে প্রলয়বায়ু॥
ঝলকি ঝলকি তাহে ভায়, রক্তকায় করাল বিজলীজ্বালা।
ফেনময় গর্জি মহাকায়, ঊর্মি ধায় লঙ্ঘিতে পর্বতচূড়া॥
ঘোষে ভীম গম্ভীর ভূতল, টলমল রসাতল যায় ধরা।
পৃথ্বীচ্ছেদি উঠিছে অনল, মহাচল চূর্ণ হয়ে যায় বেগে॥
শোভাময় মন্দির-আলয়, হ্রদে নীল পয়, তাহে কুবলয়শ্রেণী।
দ্রাক্ষাফল-হৃদয়-রুধির, ফেনশুভ্রশির, বলে মৃদু মৃদু বাণী॥
শ্রুতিপথে বীণার ঝঙ্কার, বাসনা বিস্তার, রাগ তাল মান লয়ে।
কতমত ব্রজের উচ্ছ্বাস, গোপী-তপ্তশ্বাস, অশ্রুরাশি পড়ে বয়ে॥
বিম্বফল যুবতী-অধর, ভাবের সাগর—নীলোৎপল দুটি আঁখি।
দুটি কর—বাঞ্ছাঅগ্রসর, প্রেমের পিঞ্জর, তাহে বাঁধা প্রাণপাখী॥
ডাকে ভেরী, বাজে ঝর্র্ ঝর্র্ দামামা নক্কাড়, বীর দাপে কাঁপে ধরা।
ঘোষে তোপ বব-বব-বম্, বব-বব-বম্ বন্দুকের কড়কড়া॥
ধূমে ধূমে ভীম রণস্থল, গরজি অনল বমে শত জ্বালামুখী।
ফাটে গোলা লাগে বুকে গায়, কোথা উড়ে যায় আসোয়ার ঘোড়া হাতী॥
পৃথ্বীতল কাঁপে থরথর, লক্ষ অশ্ববরপৃষ্ঠে বীর ঝাঁকে রণে।
ভেদি ধূম গোলাবরিষণ গুলি স্বন্ স্বন্, শত্রুতোপ আনে ছিনে॥
আগে যায় বীর্য-পরিচয় পতাকা-নিচয়, দণ্ডে ঝরে রক্তধারা।
সঙ্গে সঙ্গে পদাতিকদল, বন্দুক প্রবল, বীরমদে মাতোয়ারা॥
ঐ পড়ে বীর ধ্বজাধারী, অন্য বীর তারি ধ্বজা লয়ে আগে চলে।
তলে তার ঢের হয়ে যায় মৃত বীরকায়, তবু পিছে নাহি টলে॥
দেহ চায় সুখের সঙ্গম, চিত্ত-বিহঙ্গম সঙ্গীত-সুধার ধার।
মন চায় হাসির হিন্দোল, প্রাণ সদা লোল যাইতে দুঃখের পার॥
ছাড়ি হিম শশাঙ্কচ্ছটায়, কেবা বল চায়, মধ্যাহ্নপতন-জ্বালা।
প্রাণ যার চণ্ড দিবাকর, স্নিগ্ধ শশধর, সেও তবু লাগে ভাল॥
সুখতরে সবাই কাতর, কেবা সে পামর দুঃখে যার ভালবাসা?
সুখে দুঃখ, অমৃতে গরল, কণ্ঠে হলাহল, তবু নাহি ছাড়ে আশা॥
রুদ্রমুখে সবাই ডরায়, কেহ নাহি চায় মৃত্যুরূপা এলোকেশী।
উষ্ণধার, রুধির-উদ্গার, ভীম তরবার খসাইয়ে দেয় বাঁশী॥
সত্য তুমি মৃত্যরূপা কালী, সুখবনমালী তোমার মায়ার ছায়া।
করালিনি, কর মর্মচ্ছেদ, হোক মায়াভেদ, সুখস্বপ্ন দেহে দয়া॥
মুণ্ডমালা পরায়ে তোমায়, ভয়ে ফিরে চায়, নাম দেয় দয়াময়ী।
প্রাণ কাঁপে, ভীম অট্টহাস, নগ্ন দিক্বাস, বলে মা দানবজয়ী॥
মুখে বলে দেখিবে তোমায়, আসিলে সময় কোথা যায় কেবা জানে।
মৃত্যু তুমি, রোগ মহামারী বিষকুম্ভ ভরি, বিতরিছ জনে জনে॥
হে উন্মাদ, আপনা ভুলাও, ফিরে নাহি চাও, পাছে দেখ ভয়ঙ্করা।
দুখ চাও, সুখ হবে বলে, ভক্তিপূজাছলে স্বার্থ-সিদ্ধি মনে ভরা॥
ছাগকণ্ঠ রুধিরের ধার, ভয়ের সঞ্চার, দেখে তোর হিয়া কাঁপে।
কাপুরুষ! দয়ার আধার! ধন্য ব্যবহার! মর্মকথা বলি কাকে?
ভাঙ্গ বীণা—প্রেমসুধাপান, মহা আকর্ষণ—দূর কর নারীমায়া।
আগুয়ান, সিন্ধুরোলে গান, অশ্রুজলপান, প্রাণপণ, যাক্ কায়া॥
জাগো বীর, ঘুচায়ে স্বপন, শিয়রে শমন, ভয় কি তোমার সাজে?
দুঃখভার, এ ভব-ঈশ্বর, মন্দির তাহার প্রেতভূমি চিতামাঝে॥
পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা।
চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা॥
গাই গীত শুনাতে তোমায়,
ভাল মন্দ নাহি গণি,
নাহি গণি লোকনিন্দা যশকথা।
দাস তোমা দোঁহাকার,
সশক্তিক নমি তব পদে।
আছ তুমি পিছে দাঁড়াইয়ে,
তাই ফিরে দেখি তব হাসিমুখ।
ফিরে ফিরে গাই, কারে না ডরাই,
জন্মমৃত্যু মোর পদতলে।
দাস তব জনমে জনমে দয়ানিধে!
তব গতি নাহি জানি,
মম গতি—তাহাও না জানি।
কেবা চায় জানিবারে?
ভুক্তি মুক্তি ভক্তি আদি যত,
জপ-তপ সাধন-ভজন,
আজ্ঞা তব, দিয়েছি তাড়ায়ে;
আছে মাত্র জানাজানি-আশ,
তাও প্রভু কর পার।
চক্ষু দেখে অখিল জগৎ,
না চাহে দেখিতে আপনায়,
কেন বা দেখিবে?
দেখে নিজরূপ দেখিলে পরের মুখ।
তুমি আঁখি মম, তব রূপ সর্ব ঘটে।
ছেলেখেলা করি তব সনে,
কভু ক্রোধ করি তোমা ’পরে,
যেতে চাই দূরে পলাইয়ে;
শিয়রে দাঁড়ায়ে তুমি রেতে,
নির্বাক আনন, ছল ছল আঁখি,
চাহ মম মুখপানে।
অমনি যে ফিরি, তব পায়ে ধরি,
কিন্তু ক্ষমা নাহি মাগি।
তুমি নাহি কর রোষ।
পুত্র তব, অন্য কে সহিবে প্রগল্ভতা?
প্রভু তুমি, প্রাণসখা তুমি মোর।
কভু দেখি আমি তুমি, তুমি আমি।
বাণী তুমি, বীণাপাণি কণ্ঠে মোর,
তরঙ্গে তোমার ভেসে যায় নরনারী।
সিন্ধুরোলে তব হুহুঙ্কার,
চন্দ্রসূর্যে তোমারি বচন,
মৃদুমন্দ পবন—আলাপ,
এ সকল সত্য কথা।
কিন্তু মানি—অতি স্থূল ভাব,
তত্ত্বজ্ঞের এ নহে বারতা।
সূর্যচন্দ্র চলগ্রহতারা,
কোটি কোটি মণ্ডলীনিবাস
ধূমকেতু বিজলি আভাস,
সুবিস্তৃত অনন্ত আকাশ—মন দেখে।
কাম ক্রোধ লোভ মোহ আদি
ভঙ্গ যথা তরঙ্গ-লীলার
বিদ্যা-অবিদ্যার ঘর,
জন্ম জরা জীবন মরণ,
সুখ-দুঃখ-দ্বন্দ্বভরা,
কেন্দ্র যার ‘অহমহমিতি’,
ভূজদ্বয়—বাহির অন্তর,
আসমুদ্র আসূর্যচন্দ্রমা,
আতারক অনন্ত আকাশ,
মন বুদ্ধি চিত্ত অহঙ্কার,
দেব যক্ষ মানব দানব,
পশু পক্ষী কৃমি কীটগণ,
অণুক দ্ব্যণুক জড়জীব—
সেই সমক্ষেত্রে অবস্থিত।
স্থূল অতি এ বাহ্য বিকাশ,
কেশ যথা শিরঃপরে।
মেরুতটে হিমানীপর্বত,
যোজন যোজন সে বিস্তার;
অভ্রভেদী নিরভ্র আকাশে
শত উঠে চূড়া তার।
ঝকমকি জ্বলে হিমশিলা
শত শত বিজলি-প্রকাশ!
উত্তর অয়নে বিবস্বান্,
একীভূত সহস্রকিরণ,
কোটি বজ্রসম করধারা
ঢালে যবে তাহার উপর,
শৃঙ্গে শৃঙ্গে মূর্ছিত ভাস্কর,
গলে চূড়া শিখর গহ্বর,
বিকট নিনাদে খসে পড়ে গিরিবর,
স্বপ্নসম জলে জল যায় মিলে।
সর্ব বৃত্তি মনের যখন
একীভূত তোমার কৃপায়
কোটি সূর্য অতীত প্রকাশ,
চিৎসূর্য হয় হে বিকাশ,
গলে যায় রবি শশী তারা,
আকাশ পাতাল তলাতল,
এ ব্রহ্মাণ্ড গোষ্পদ-সমান।
বাহ্যভূমি অতীত গমন,
শান্ত ধাতু, মন আস্ফালন নাহি করে,
শ্লথ হৃদয়ের তন্ত্রী যত,
খুলে যায় সকল বন্ধন,
মায়ামোহ হয় দূর,
বাজে তথা অনাহত ধ্বনি—তব বাণীঃ
—শুনি সসম্ভ্রমে, দাস তব প্রস্তুত সতত
সাধিতে তোমার কাজ।—
‘আমি বর্তমান।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড গ্রাসি যবে
প্রলয়ের কালে
জ্ঞান জ্ঞেয় জ্ঞাতা লয়,
অলক্ষণ অতর্ক্য জগৎ,
নাহি থাকে রবি শশী তারা,
সে মহানির্বাণ, নাহি কর্ম করণ কারণ,
মহা অন্ধকার ফেরে অন্ধকার-বুকে,
আমি বর্তমান।
‘আমি বর্তমান।
প্রলয়ের কালে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড গ্রাসি যবে
জ্ঞান জ্ঞেয় জ্ঞাতা লয়,
অলক্ষণ অতর্ক্য জগৎ,
নাহি থাকে রবি শশী তারা,
মহা অন্ধকার ফেরে অন্ধকার-বুকে,
ত্রিশূন্য জগৎ শান্ত সর্বগুণভেদ,
একাকার সূক্ষ্মরূপ শুদ্ধ পরমাণুকায়,
আমি বর্তমান।
‘আমি হই বিকাশ আবার।
মম শক্তি প্রথম বিকার,
আদি বাণী প্রণব ওঙ্কার
বাজে মহাশূন্যপথে,
অনন্ত আকাশ শোনে মহানাদ-ধ্বনি,
ত্যজে নিদ্রা কারণমণ্ডলী,
পায় নব প্রাণ অনন্ত অনন্ত পরমাণু;
লম্ফঝম্প আবর্ত উচ্ছ্বাস
চলে কেন্দ্র প্রতি—দূর অতি দূর হতে;
চেতন-পবন তোলে ঊর্মিমালা
মহাভূত-সিন্ধু ’পরে;
পরমাণু আবর্ত বিকাশ,
আস্ফালন পতন উচ্ছ্বাস,
মহাবেগে ধায় সে তরঙ্গরাজি।
অনন্ত অনন্ত খণ্ড তার
উৎসারিত প্রতিঘাত-বলে,
ছোটে শূন্যপথে খগোলমণ্ডলরূপে
ধায় গ্রহ-তারা,
ফেরে পৃথ্বী মনুষ্য-আবাস।
‘আমি আদি কবি,
মম শক্তি বিকাশ-রচনা
জড় জীব আদি যত
আমি করি খেলা শক্তিরূপা মম মায়া সনে
একা আমি হই বহু দেখিতে আপন রূপ।
‘আমি আদি কবি,
মম শক্তি বিকাশ-রচনা
জড় জীব আদি যত।
মম আজ্ঞাবলে
বহে ঝঞ্ঝা পৃথিবী উপর,
গর্জে মেঘ অশনি-নিনাদ;
মৃদুমন্দ মলয়-পবন
আসে যায় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসরূপে;
ঢালে শশী হিম করধারা,
তরুলতা করে আচ্ছাদন ধরাবপু;
তোলে মুখ শিশিরমার্জিত
ফুল্ল ফুল রবি-পানে।’
নীলাকাশে ভাসে মেঘকুল,
শ্বেত কৃষ্ণ বিবিধ বরণ—
তাহে তারতম্য তারল্যের
পীত ভানু মাঙ্গিছে বিদায়।
রাগচ্ছটা জলদ দেখায়।
বহে বায়ু আপনার মনে,
প্রভঞ্জন করিছে গঠন—
ক্ষণে গড়ে, ভাঙ্গে আর ক্ষণে—
কতমত সত্য অসম্ভব—
জড়, জীব, বর্ণ, রূপ, ভাব।
ঐ আসে তূলারাশি সম,
পরক্ষণে হের মহানাগ,
দেখ সিংহ বিকাশে বিক্রম,
আর দেখ প্রণয়িযুগল;
শেষে সব আকাশে মিলায়।
নীচে সিন্ধু গায় নানা তান;
মহীয়ান্ সে নহে, ভারত!
অম্বুরাশি বিখ্যাত তোমার;
রূপরাগ হয়ে জলময়
গায় হেথা, না করে গর্জন।
পত্রাবলী
১
[শ্রীযুক্ত প্রমদাদাস মিত্রকে লিখিত]
বৃন্দাবন
১২ অগষ্ট, ১৮৮৮
মান্যবরেষু,
শ্রীঅযোধ্যা হইয়া শ্রীবৃন্দাবনধামে পৌঁছিয়াছি। কালাবাবুর কুঞ্জে আছি—শহরে মন কুঞ্চিত হইয়া আছে। শুনিয়াছি রাধাকুণ্ডাদি স্থান মনোরম। তাহা শহর হইতে কিঞ্চিৎ দূরে। শীঘ্রই হরিদ্বার যাইব, বাসনা আছে। হরিদ্বারে আপনার আলাপী কেহ যদি থাকেন, কৃপা করিয়া তাঁহার উপর এক পত্র দেন, তাহা হইলে বিশেষ অনুগ্রহ করা হয়। আপনার এস্থানে আসিবার কি হইল? শীঘ্র উত্তর দিয়া কৃতার্থ করিবেন। অলমধিকেনেতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
২
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
শ্রীশ্রীদুর্গা শরণম্
বৃন্দাবন
২০ অগষ্ট, ১৮৮৮
ঈশ্বরজ্যোতি মহাশয়েষু,
আমার এক বৃদ্ধ গুরুভ্রাতা সম্প্রতি কেদার ও বদরিকাশ্রম দেখিয়া ফিরিয়া বৃন্দাবনে আসিয়াছেন, তাঁহার সহিত গঙ্গাধরের সাক্ষাৎ হয়। গঙ্গাধর দুইবার তিব্বত ও ভূটান পর্যন্ত গিয়াছিল। অতি আনন্দে আছে। তাঁহাকে দেখিয়া কাঁদিয়া আকুল হয়। শীতকালে কনখলে ছিল। আপনার প্রদত্ত করোয়া তাহার হস্তে আজিও আছে। সে ফিরিয়া আসিতেছে—এই মাসেই বৃন্দাবন আসিবে। আমি তাহাকে দেখিবার প্রত্যাশায় হরিদ্বার গমন কিছুদিন স্থগিত রাখিলাম। আপনার সমীপচারী সেই শিবভক্ত ব্রাহ্মণটিকে আমার কোটি সাষ্টাঙ্গ প্রণাম দিবেন ও আপনি জানিবেন। অলমিতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
বরাহনগর মঠ
৫ অগ্রহায়ণ, সোমবার, ১২৯৫
(১৯ নভেম্বর, ১৮৮৬)
পূজ্যপাদ মহাশয়,
আপনার প্রেরিত পুস্তকদ্বয় প্রাপ্ত হইয়াছি এবং আপনার অত্যুদার হৃদয়ের উপযুক্ত পরিচায়ক অদ্ভুত স্নেহরসাপ্লুত লিপি পাঠ করিয়া আনন্দে পূর্ণ হইয়াছি। মহাশয় আমার ন্যায় একজন ভিক্ষাজীবী উদাসীনের উপর এত অধিক স্নেহ প্রকাশ করেন, ইহা আমার প্রাক্তনের সুকৃতিবশতঃ সন্দেহ নাই। ‘বেদান্ত’ প্রেরণ দ্বারা মহাশয় কেবল আমাকে নয়, পরন্তু ভগবান্ রামকৃষ্ণের সমুদায় সন্ন্যাসিশিষ্যমণ্ডলীকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়াছেন। তাঁহারা অবনতমস্তকে আপনাকে প্রণিপাত জানাইয়াছেন। পাণিনির ব্যাকরণ কেবল আমার নিমিত্ত প্রার্থনা করি নাই, প্রত্যুত এ মঠে সংস্কৃত শাস্ত্রের বহুল চর্চা হইয়া থাকে। বঙ্গদেশে বেদশাস্ত্রের একেবারে অপ্রচার বলিলেই হয়। এই মঠের অনেকেই সংস্কৃতজ্ঞ এবং তাঁহাদের বেদের সংহিতাদি ভাগ সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করিবার একান্ত অভিলাষ। তাঁহাদিগের মত, যাহা করিতে হইবে বৈদিক ভাষায় সম্পূর্ণ করিব। অতএব, পাণিনিকৃত সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাকরণ আয়ত্ত না হইলে বৈদিক ভাষায় সম্পূর্ণ জ্ঞান হওয়া অসম্ভব, এই বিবেচনায় উক্ত ব্যাকরণের আবশ্যক। ‘লঘু’ অপেক্ষা আমাদের বাল্যাধীত ‘মুগ্ধবোধ’ অনেকাংশে উৎকৃষ্ট। যাহা হউক, মহাশয় অতি পণ্ডিত ব্যক্তি এবং এ বিষয়ে আমাদের সদুপদেষ্টা, আপনি বিবেচনা করিয়া যদি এ বিষয়ে ‘অষ্টাধ্যায়ী’ সর্বোৎকৃষ্ট হয়, তাহাই (যদি আপনার সুবিধা এবং ইচ্ছা হয়) দান করিয়া আমাদিগকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিবেন। এ মঠে অতি তীক্ষ্ণবুদ্ধি, মেধাবী এবং অধ্যবসায়শীল ব্যক্তির অভাব নাই। গুরুর কৃপায় তাঁহারা অল্পদিনেই ‘অষ্টাধ্যায়ী’ অভ্যাস করিয়া বেদশাস্ত্র বঙ্গদেশে পুনরুজ্জীবিত করিতে পারিবেন—ভরসা করি। মহাশয়কে আমার গুরুমহারাজের দুইখানি ফটোগ্রাফ এবং তাঁহার গ্রাম্য ভাষায় উপদেশের কিয়দংশ—কোন ব্যক্তি সঙ্কলিত করিয়া [যাহা] মুদ্রিত করিয়াছেন, তাহা দুই খণ্ড প্রেরণ করিলাম। আশা করি গ্রহণ করিয়া আমাদিগকে আনন্দিত করিবেন। আমার শরীর অনেক সুস্থ হইয়াছে—ভরসা দুই-তিন মাসের মধ্যে মহাশয়ের চরণ দর্শন করিয়া সার্থক হইব। কিমধিকমিতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৪
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
শ্রীশ্রীদুর্গা
বরাহনগর, কলিকাতা
২৮ অগষ্ট, ১৮৮৮
প্রণাম নিবেদনমিদং—
মহাশয়ের প্রেরিত ‘পাণিনি’ পুস্তক প্রাপ্ত হইয়াছি, আমাদিগের বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিবেন। আমি পুনরায় জ্বরে পড়িয়াছিলাম—তজ্জন্য শীঘ্র উত্তর দিতে পারি নাই। ক্ষমা করিবেন। শরীর অত্যন্ত অসুস্থ। মহাশয়ের শারীরিক এবং মানসিক কুশল মহামায়ীর১ নিকট প্রার্থনা করি। ইতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৫
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর
২৩ মাঘ
৪ ফেব্রুআরী, ১৮৮৯
নমস্য মহাশয়,
কতকগুলি কারণবশতঃ অদ্য আমার মন অতি সঙ্কুচিত ও ক্ষুব্ধ হইয়াছিল, এমন সময়ে আপনার (আমাকে) অপার্থিব বারাণসীপুরীতে আবাহনপত্র আসিয়া উপস্থিত। ইহা আমি বিশ্বেশ্বরের বাণী বলিয়া গ্রহণ করিলাম। সম্প্রতি আমার গুরুদেবের জন্মভূমিদর্শনার্থ গমন করিতেছি, তথায় কয়েক দিবসমাত্র অবস্থিতি করিয়া ভবৎসমীপে উপস্থিত হইব। কাশীপুরী ও কাশীনাথদর্শনে যাহার মন বিগলিত না হয়, সে নিশ্চিত পাষাণে নির্মিত। আমার শরীর এক্ষণে অনেক সুস্থ। জ্ঞানানন্দকে আমার প্রণাম। যত শীঘ্র পারি মহাশয়ের সান্নিধ্যে উপস্থিত হইব। পরে বিশ্বেশ্বরের ইচ্ছা। কিমধিকমিতি। সাক্ষাতে সমুদয় জানিবেন ।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৬*
[শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে (মাষ্টার মহাশয়) লিখিত]
আঁটপুর,২ হুগলী জেলা
২৬ মাঘ, ১২৯৫
(৭ ফেব্রুআরী, ১৮৮৯)
প্রিয় ম—,
মাষ্টার মহাশয়, আমি আপনাকে লক্ষ লক্ষ বার ধন্যবাদ দিতেছি। আপনি রামকৃষ্ণকে ঠিক ঠিক ধরিয়াছেন। হায়, অতি অল্পলোকেই তাঁহাকে বুঝিতে পারিয়াছে!
আপনার
নরেন্দ্রনাথ
পুঃ—যে উপদেশামৃত ভবিষ্যতে জগতে শান্তি বর্ষণ করিবে, কোন ব্যক্তিকে যখন তাহার ভিতর সম্পূর্ণ ডুবিয়া থাকিতে দেখি, তখন আমার হৃদয় আনন্দে নৃত্য করিতে থাকে এবং আমি যে আনন্দে একেবারে উন্মত্ত হইয়া যাই না কেন—তাহাই আশ্চর্য!
৭
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর
১১ ফাল্গুন
(২১ ফেব্রুআরী, ১৮৮৯)
মহাশয়,
৺কাশীধামে যাইবার সংকল্প ছিল এবং আমার গুরুদেবের জন্মভূমি পরিদর্শনানন্তর কাশীধামে পৌঁছিব—এইরূপ কল্পনা ছিল; কিন্তু আমার দুরদৃষ্টবশতঃ উক্ত গ্রামে যাইবার পথে অত্যন্ত জ্বর হইল এবং তৎপরে কলেরার ন্যায় ভেদবমি হইয়াছিল। তিন-চারি দিনের পর পুনরায় জ্বর হইয়াছে; এক্ষণে শরীর এ প্রকার দুর্বল যে, দুই কদম চলিবার সামর্থ্যও নাই। অতএব বাধ্য হইয়া এক্ষণে পূর্বোক্ত সংকল্প পরিত্যাগ করিতে হইল। ভগবানের কি ইচ্ছা জানি না, কিন্তু আমার শরীর এ পথের নিতান্ত অনুপযুক্ত। যাহা হউক, শরীর বিশেষ বড় কথা নহে। কিছুদিন এস্থানে থাকিয়া কিঞ্চিৎ সুস্থ হইলেই মহাশয়ের চরণ দর্শন করিবার অভিলাষ আছে। বিশ্বেশ্বরের ইচ্ছা যাহা, তাহাই হইবে, আপনিও আশীর্বাদ করুন। জ্ঞানানন্দ ভায়াকে আমার প্রণাম, মহাশয়ও জানিবেন। ইতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বাগবাজার, কলিকাতা
২১ মার্চ, ১৮৮৯
পূজনীয় মহাশয়,
কয়েক দিবস হইল আপনার পত্র পাইয়াছি—কোন বিশেষ কারণবশতঃ উত্তর প্রদান করিতে পারি নাই, ক্ষমা করিবেন। শরীর এক্ষণে অত্যন্ত অসুস্থ, মধ্যে মধ্যে জ্বর হয়, কিন্তু প্লীহাদি কোন উপসর্গ নাই—হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করাইতেছি। অধুনা কাশী যাইবার সংকল্প একেবারেই পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে, পরে শরীর-গতিক দেখিয়া ঈশ্বর যাহা করিবেন, হইবে। জ্ঞানানন্দ ভায়ার সহিত যদি সাক্ষাৎ হয়, অনুগ্রহ করিয়া বলিবেন—যেন তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করিয়া বসিয়া না থাকেন। আমার যাওয়া বড়ই অনিশ্চিত। আপনি আমার প্রণাম জানিবেন ও জ্ঞানানন্দকে দিবেন। ইতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৯
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
শ্রীশ্রীদুর্গা শরণম্
বরাহনগর
২৬ জুন, ১৮৮৯
পূজ্যপাদ মহাশয়,
বহুদিন আপনাকে নানা কারণে কোন পত্রাদি লিখিতে পারি নাই, তজ্জন্য ক্ষমা করিবেন। অধুনা গঙ্গাধরজীর সংবাদ পাইয়াছি এবং আমার কোন গুরুভ্রাতার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ায় তাঁহারা দুইজনে উত্তরাখণ্ডে রহিয়াছেন। আমাদের এ স্থান হইতে চারি জন উত্তরাখণ্ডে রহিয়াছেন, গঙ্গাধরকে লইয়া পাঁচ জন। শিবানন্দ নামক আমার একজন গুরুভ্রাতার সহিত ৺কেদারনাথের পথে শ্রীনগর নামক স্থানে গঙ্গাধরের সাক্ষাৎ হয়। গঙ্গাধর এই স্থানে দুইখানি পত্র লিখিয়াছেন। তিনি প্রথম বৎসর তিব্বত প্রবেশের অনুমতি পান নাই, পরের বৎসর পাইয়াছিলেন। লামারা তাঁহাকে অত্যন্ত ভালবাসে। তিনি তিব্বতী ভাষা শিক্ষা করিয়াছেন। তিনি বলেন, তিব্বতের শতকরা ৯০ জন লামা, কিন্তু তাহারা এক্ষণে তান্ত্রিক মতের উপাসনাই অধিক করে। অত্যন্ত শীতল দেশ; আহারীয় অন্য কিছু নাই—কেবল শুষ্ক মাংস। গঙ্গাধর তাহাই খাইতে খাইতে গিয়াছিল! আমার শরীর মন্দ নাই, কিন্তু মনের অবস্থা অতি ভয়ঙ্কর!
দাস
নরেন্দ্রনাথ
১০
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বাগবাজার, কলিকাতা
৪ জুলাই, ১৮৮৯
পূজ্যপাদ মহাশয়,
কল্য আপনার পত্রে সবিশেষ অবগত হইয়া পরম আনন্দিত হইলাম। আপনাকে পত্র লিখিতে—গঙ্গাধরকে অনুরোধ করিতে যে আপনি লিখিয়াছেন, তাহার কোন সম্ভাবনা দেখি না, কারণ তাঁহারা আমাদের পত্র দিতেছেন, কিন্তু তাঁহারা ২।৩ দিবস কোথাও রহিতেছেন না, অতএব আমাদের কোন পত্রাদি পাইতেছেন না। আমার পূর্ব অবস্থার কোন আত্মীয় সিমুলতলায় (বৈদ্যনাথের নিকট) একটি বাংলো (bungalow) ক্রয় করিয়াছেন। ঐ স্থানের জলবায়ু স্বাস্থ্যকর বিধায় আমি সেস্থানে কিছুদিন ছিলাম। কিন্তু গ্রীষ্মের আতিশয্যে অত্যন্ত উদরাময় হওয়ায় পলাইয়া আসিলাম।
৺কাশীধামে গমন করিয়া মহাশয়ের চরণ দর্শন করিয়া এবং সদালাপে অবস্থানপূর্বক আত্মাকে চরিতার্থ করিব—এই ইচ্ছা যে অন্তরে কত বলবতী, তাহা বাক্য বর্ণনা করিতে পারে না, কিন্তু সকলই তাঁহার হাত। কে জানে মহাশয়ের সহিত জন্মান্তরীণ কি হৃদয়ের যোগ, নহিলে এই কলিকাতায় বহু ধনী মানী লোক আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন, তাহাদের সঙ্গ আমার সাতিশয় বিরক্তিকর বোধ হয়, আর মহাশয়ের সহিত এক দিবসের আলাপেই প্রাণ এবম্প্রকার মুগ্ধ হইয়াছে যে, আপনাকে হৃদয় পরমাত্মীয় এবং ধর্মবন্ধুভাবে গ্রহণ করিয়াছে। মহাশয় ভগবানের প্রিয় সেবক, এই একটি কারণ। আর একটি বোধ হয়—‘তচ্চেতসা স্মরতি নূনমবোধপূর্বং ভাবস্থিরাণি জননান্তর-সৌহৃদানি।’৩
ভূয়োদর্শন এবং সাধনের ফলস্বরূপ মহাশয়ের যে উপদেশ, তজ্জন্য আমি আপনার নিকট ঋণী রহিলাম। নানা প্রকার অভিনব মত মস্তিষ্কে ধারণ জন্য যে সময়ে সময়ে ভুগিতে হয়, ইহা অতি যথার্থ এবং অনেক সময়ে দেখিয়াছি।
কিন্তু এবার অন্যপ্রকার রোগ। ঈশ্বরের মঙ্গলহস্তে বিশ্বাস আমার যায় নাই এবং যাইবারও নহে—শাস্ত্রে বিশ্বাসও টলে নাই। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছায় গত ৫।৭ বৎসর আমার জীবন ক্রমাগত নানাপ্রকার বিঘ্নবাধার সহিত সংগ্রামে পরিপূর্ণ। আমি আদর্শ শাস্ত্র পাইয়াছি, আদর্শ মনুষ্য চক্ষে দেখিয়াছি, অথচ পূর্ণভাবে নিজে কিছু করিয়া উঠিতে পারিতেছি না, ইহাই অত্যন্ত কষ্ট। বিশেষ, কলিকাতার নিকটে থাকিলে হইবারও কোন উপায় দেখি না। আমার মাতা এবং দুইটি ভ্রাতা কলিকাতায় থাকে। আমি জ্যেষ্ঠ, মধ্যমটি এইবার ফার্ষ্ট আর্টস পড়িতেছে, আর একটি ছোট।
ইঁহাদের অবস্থা পূর্বে অনেক ভাল ছিল, কিন্তু আমার পিতার মৃত্যু পর্যন্ত বড়ই দুঃস্থ, এমন কি কখনও কখনও উপবাসে দিন যায়। তাহার উপর জ্ঞাতিরা—দুর্বল দেখিয়া পৈতৃক বাসভূমি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিল; হাইকোর্টে মকদ্দমা করিয়া যদিও সেই পৈতৃক বাটীর অংশ পাইয়াছেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হইয়াছেন—যে প্রকার মকদ্দমার দস্তুর।
কখনও কখনও কলিকাতার নিকট থাকিলে তাঁহাদের দুরবস্থা দেখিয়া রজোগুণের প্রাবল্যে অহঙ্কারের বিকার-স্বরূপ কার্যকরী বাসনার উদয় হয়, সেই সময়ে মনের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ বাধে, তাহাতেই লিখিয়াছিলাম, মনের অবস্থা বড়ই ভয়ঙ্কর। এবার তাঁহাদের মকদ্দমা শেষ হইয়াছে। কিছুদিন কলিকাতায় থাকিয়া, তাঁহাদের সমস্ত মিটাইয়া এদেশ হইতে চিরদিনের মত বিদায় হইতে পারি, আপনি আশীর্বাদ করুন।—‘আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ &c.’৪
আশীর্বাদ করুন যেন আমার হৃদয় মহা ঐশবলে বলীয়ান হয় এবং সকলপ্রকার মায়া আমা হইতে দূরপরাহত হইয়া হয়—For 'we have taken up the cross, Thou hast laid it upon us, and grant us strength that we bear it unto death, Amen.'৫—Imitation of Christ.
আমি এক্ষণে কলিকাতায় আছি। আমার ঠিকানা—বলরাম বসুর বাটী, ৫৭ নং রামকান্ত বসুর ষ্ট্রীট, বাগবাজার, কলিকাতা।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
১১
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
সিমলা, কলিকাতা
১৪ জুলাই, ১৮৮৯
পূজ্যপাদ মহাশয়,
মহাশয়ের পত্র পাইয়া পরম প্রীত হইলাম। এরূপস্থলে অনেকেই সংসারের দিকে টলিতে উপদেশ দেন। মহাশয় সত্যগ্রাহী এবং বজ্রসারসদৃশ হৃদয়বান্—আপনার উৎসাহবাক্যে পরম আশ্বাসিত হইলাম। আমার এ স্থানের গোলযোগ প্রায় সমস্ত মিটিয়াছে, কেবল একটি জমি বিক্রয় করিবার জন্য দালাল লাগাইয়াছি, অতি শীঘ্রই বিক্রয় হইবার আশা আছে। তাহা হইলেই নিশ্চিন্ত হইয়া একেবারে ৺কাশীধামে মহাশয়ের সন্নিকট যাইতেছি।
আপনি ২০৲ টাকার এক কেতা নোট পাঠাইয়াছিলেন। আপনি অতি মহৎ; কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য—মহাশয়ের প্রথমোদ্দেশ্য পালনে আমার মাতা ভ্রাতাদির সাংসারিক অহঙ্কার প্রতিবন্ধক হইল; কিন্তু দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অর্থাৎ আমার কাশী যাইবার জন্য ব্যবহার করিয়া চরিতার্থ হইব। ইতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
১২
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর, কলিকাতা
৭ অগষ্ট, ১৮৮৯
পূজ্যপাদেষু,
প্রায় এক সপ্তাহের অধিক হইল আপনার পত্র পাইয়াছি, সেই সময়ে পুনরায় জ্বর হওয়ায় উত্তরদানে অসমর্থ ছিলাম, ক্ষমা করিবেন। মধ্যে মাস দেড়েক ভাল ছিলাম, কিন্তু পুনরায় ১০|১২ দিন হইল জ্বর হইয়াছিল, এক্ষণে ভাল আছি। গুটিকতক প্রশ্ন আছে, মহাশয়ের বিস্তৃত সংস্কৃতশাস্ত্রজ্ঞান—উত্তর দিয়া বাধিত করিবেন।—
১। সত্যকাম জাবালি এবং জনশ্রুতির কোন উপাখ্যান ছান্দোগ্য উপনিষদ্ সওয়ায়৬ বেদের অন্য কোন অংশে আছে কি না?
২। শঙ্করাচার্য বেদান্তভাষ্যে অধিকাংশ স্থলেই স্মৃতি উদ্ধৃত করিতে গেলেই মহাভারতের প্রমাণ প্রয়োগ করেন। কিন্তু বনপর্বে অজগরোপাখ্যানে এবং উমামহেশ্বর-সংবাদে, তথা ভীষ্মপর্বে, যে গুণগত জাতিত্ব অতি স্পষ্টই প্রমাণিত, তৎসম্বন্ধে তাঁহার কোন পুস্তকে কোন কথা বলিয়াছেন কি না?
৩। পুরুষসূক্তের জাতি পুরুষানুগত নহে—বেদের কোন্ কোন্ অংশে ইহাকে ধারাবাহিক পুরুষানুগত করা হইয়াছে?
৪। আচার্য, ‘শূদ্র যে বেদ পড়িবে না’—এ প্রকার কোন প্রমাণ বেদ হইতে দিতে পারেন নাই। কেবল ‘যজ্ঞেঽনবকঌপ্তঃ’ ইহাই উদ্ধৃত করিয়া বলিতেছেন যে, যখন যজ্ঞে অধিকার নাই, তখন উপনিষদাদি পাঠেও অধিকার নাই। কিন্তু ‘অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’—এস্থলে ঐ আচার্যই বলিতেছেন যে, অথ শব্দ ‘বেদাধ্যয়নাদনন্তরম্’—এ প্রকার অর্থ নহে, কারণ মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ না পড়িলে যে উপনিষদ্ পড়া যায় না, ইহা অপ্রামাণ্য; এবং কর্মকাণ্ডের শ্রুতি এবং জ্ঞানকাণ্ডের শ্রুতিতে কোন পূর্বাপর ভাব নাই। অতএব যজ্ঞাত্মক বেদ না পড়িয়াই উপনিষদ্পাঠে ব্রহ্মজ্ঞান হইতে পারে। যদি যজ্ঞে ও জ্ঞানে পৌর্বাপর্য না থাকিল, তবে শূদ্রের বেলা কেন ‘ন্যায়পূর্বকম্’ ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা আচার্য আপনার বাক্যকে ব্যাহত করিতেছেন? কেন শূদ্র উপনিষদ্ পড়িবে না?
মহাশয়কে একখানি—কোন খ্রীষ্টিয়ান সন্ন্যাসীর লিখিত—'Imitation of Christ' নামক পুস্তক পাঠাইলাম। পুস্তকখানি অতি আশ্চর্য। খ্রীষ্টিয়ানদিগের মধ্যেও এ প্রকার ত্যাগ বৈরাগ্য ও দাস্যভক্তি ছিল দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়। বোধ হয় আপনি এ পুস্তক পড়িয়া থাকিবেন, না পড়িয়া থাকেন তো পড়িয়া আমাকে চিরকৃতার্থ করিবেন। ইতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
১৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর
১৭ অগষ্ট, ১৮৮৯
পূজ্যপাদেষু,
মহাশয়ের শেষ পত্রে—আপনাকে উক্ত অভিধান দেওয়ায় কিছু কুণ্ঠিত হইয়াছেন! কিন্তু তাহা আমার দোষ নহে, মহাশয়ের গুণের। পূর্বে এক পত্রে আপনাকে লিখিয়াছিলাম যে, মহাশয়ের গুণে আমি এত আকৃষ্ট যে, বোধ হয় আপনার সহিত জন্মান্তরীণ কোন সম্বন্ধ ছিল। আমি গৃহস্থও বুঝি না, সন্ন্যাসীও বুঝি না; যথার্থ সাধুতা এবং উদারতা এবং মহত্ত্ব যথায়, সেই স্থানেই আমার মস্তক চিরকালই অবনত হউক—শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। প্রার্থনা করি, আজিকালিকার মানভিখারী, পেটবৈরাগী এবং উভয়ভ্রষ্ট সন্ন্যাসীশ্রমীদের মধ্যে লক্ষের মধ্যেও যেন আপনার ন্যায় মহাত্মা একজন হউন। আপনার গুণের কথা শুনিয়া আমার সকল ব্রাহ্মণজাতীয় গুরুভ্রাতাও আপনাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত জানাইতেছেন।
মহাশয় আমার প্রশ্ন-কয়েকটির যে উত্তর দিয়াছেন, তাহার মধ্যে একটি সম্বন্ধে আমার ভ্রম সংশোধিত হইল। মহাশয়ের নিকট তজ্জন্য আমি চিরঋণবদ্ধ রহিলাম। আর একটি প্রশ্ন ছিল যে, ভারতাদি পুরাণোক্ত গুণগত জাতি সম্বন্ধে আচার্য কোন মীমাংসাদি করিয়াছেন কি না? যদি করিয়া থাকেন, কোন্ পুস্তকে? এতদ্দেশীয় প্রাচীন মত যে বংশগত, তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই, এবং স্পার্টানরা যে প্রকার হেলট্ [দের উপর ব্যবহার করিত] অথবা মার্কিনদেশে কাফ্রীদের উপর যে প্রকার ব্যবহার হইত, সময়ে সময়ে শূদ্রেরা যে তদপেক্ষাও নিগৃহীত হইত, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। আর জাত্যাদি সম্বন্ধে আমার কোন পক্ষে পক্ষপাতিত্ব নাই। কারণ আমি জানি, উহা সামাজিক নিয়ম—গুণ এবং কর্ম-প্রসূত। যিনি নৈষ্কর্ম ও নিগুর্ণত্বকে প্রাপ্ত হইতে ইচ্ছা করেন, তাঁহার জাত্যাদি ভাব মনে আনিলেও সমূহ ক্ষতি। এই সকল বিষয়ে গুরুকৃপায় আমার এক প্রকার বুদ্ধি আছে, কিন্তু মহাশয়ের মতামত জানিলে কোন স্থানে সেই সকলকে দৃঢ় এবং কোন স্থানে সংশোধিত করিয়া লইব। চাকে খোঁচা না মারিলে মধু পড়ে না—অতএব আপনাকে আরও কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিব; আমাকে বালক এবং অজ্ঞ জানিয়া যথাযথ উত্তর দিবেন, রুষ্ট হইবেন না।
১। বেদান্তসূত্রে যে মুক্তির কথা কহে, তাহা এবং অবধূত-গীতাদিতে যে নির্বাণ আছে, তাহা এক কি না?
২। ‘সৃষ্টিবর্জ’—সূত্রে এই ভাবের পুরো ভগবান্ কেহই হয় না, তবে নির্বাণ কি?
৩। চৈতন্যদেব পুরীতে সার্বভৌমকে বলিয়াছিলেন যে ব্যাসসূত্র আমি বুঝি, তাহা দ্বৈতবাদ; কিন্তু ভাষ্যকার অদ্বৈত করিতেছেন, তাহা বুঝি না—ইহা সত্য নাকি? প্রবাদ আছে যে, চৈতন্যদেবের সহিত প্রকাশানন্দ সরস্বতীর এ বিষয়ে অনেক বিচার হয়, তাহাতে চৈতন্যদেব জয়ী হন। চৈতন্যের কৃত এক ভাষ্য নাকি উক্ত প্রকাশানন্দের মঠে ছিল।
৪। আচার্যকে তন্ত্রে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলিয়াছে। ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ নামক বৌদ্ধদের (মহাযান) গ্রন্থের মতের সহিত আচার্য-প্রচারিত বেদান্তমতের সম্পূর্ণ সৌসাদৃশ্য আছে। ‘পঞ্চদশী’কারও বলিতেছেন যে, বৌদ্ধ [দের] শূন্য ও আমাদিগের ব্রহ্ম একই ব্যাপার—ইহার অর্থ কি?
৫। বেদান্তসূত্রে বেদের কোন প্রমাণ কেন দেওয়া হয় নাই? প্রথমেই বলা হইয়াছে, ঈশ্বরের প্রমাণ বেদ এবং বেদ প্রামাণ্য ‘পুরুষ-নিঃশ্বসিতম্’ বলিয়া; ইহা কি পাশ্চাত্য ন্যায়ে যাহাকে argument in a circle৭ বলে, সেই দোষদুষ্ট নহে?
৬। বেদান্ত বলিলেন—বিশ্বাস করিতে হইবে, তর্কে নিষ্পত্তি হয় না। তবে যেখানে ন্যায় অথবা সংখ্যাদির অণুমাত্র ছিদ্র পাইয়াছেন, তখনই তর্কজালে তাহাদিগকে সমাচ্ছন্ন করা হইয়াছে কেন? আর বিশ্বাসই বা করি কাকে? যে যার আপনার মতস্থাপনেই পাগল; এত বড় ‘সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ’, তিনিই যদি ব্যাসের মতে অতি ভ্রান্ত, তখন ব্যাস যে আরও ভ্রান্ত নহেন, কে বলিল? কপিল কি বেদাদি বুঝিতেন না?
৭। ন্যায়-মতে ‘আপ্তোপদেশবাক্যঃ শব্দঃ’; ঋষিরা আপ্ত এবং সর্বজ্ঞ। তাঁহারা তবে সূর্যসিদ্ধান্তের দ্বারা সামান্য সামান্য জ্যোতিষিক তত্ত্বে অজ্ঞ বলিয়া আক্ষিপ্ত কেন হইতেছেন? যাঁহারা বলেন—পৃথিবী ত্রিকোণ, বাসুকি পৃথিবীর ধারয়িতা ইত্যাদি, তাঁহাদের বুদ্ধিকে ভবসাগরপারের একমাত্র আশ্রয় কি প্রকারে বলি?
৮। ঈশ্বর সৃষ্টিকার্যে যদি শুভাশুভ কর্মকে অপেক্ষা করেন, তবে তাঁহার উপাসনায় আমার লাভ কি? নরেশচন্দ্রের একটি সুন্দর গীত আছে—
‘কপালে যা আছে কালী, তাই যদি হবে, (মা)
জয় দুর্গা শ্রীদুর্গা বলে কেন ডাকা তবে॥’
৯। সত্য বটে, বহু বাক্য এক-আধটির দ্বারা নিহত হওয়া অন্যায্য। তাহা হইলে চিরপ্রচলিত মধুপর্কাদি প্রথা৮ ‘অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্’ ইত্যাদি৯ দুই-একটি বাক্যের দ্বারা কেন নিহত হইল? বেদ যদি নিত্য হয়, তবে ইহা দ্বাপরের, ইহা কলির ধর্ম ইত্যাদি বচনের অর্থ এবং সাফল্য কি?
১০। যে ঈশ্বর বেদ-বক্তা, তিনিই বুদ্ধ হইয়া বেদ নিষেধ করিতেছেন। কোন্ কথা শুনা উচিত? পরের বিধি প্রবল, না, আগের বিধি প্রবল?
১১। তন্ত্র বলেন—কলিতে বেদমন্ত্র নিষ্ফল; মহেশ্বরেরই বা কোন্ কথা মানিব?
১২। বেদান্তসূত্রে ব্যাস বলেন যে, বাসুদেব সঙ্কর্ষণাদি চতুর্ব্যূহ উপাসনা ঠিক নহে—আবার সেই ব্যাসই ভাগবতাদিতে উক্ত উপাসনার মাহাত্ম্য বিস্তার করিতেছেন; ব্যাস কি পাগল?
আরও এই প্রকার অনেক সন্দেহ আছে, মহাশয়ের প্রসাদে ছিন্নদ্বৈধ হইব আশা করিয়া পরে সেগুলি লিখিব। এ সকল কথা সাক্ষাৎ না হইলে সমস্ত বলা যায় না এবং আশানুরূপ তৃপ্তিও হয় না। গুরুর কৃপায় শীঘ্রই ভবৎ-চরণসমীপে উপস্থিত হইয়া সমস্ত নিবেদন করিবার বাসনা রহিল। ইতি
শুনিয়াছি, বিনা সাধনায় শুদ্ধ যুক্ত্যাদি-বলে এ সকল বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না, কিন্তু কতক পরিমাণে আশ্বস্ত হওয়া প্রথমেই বোধ হয় আবশ্যক। কিমধিকমিতি—
দাস
নরেন্দ্রনাথ
১৪
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়
বাগবাজার, কলিকাতা
২ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৯
পূজ্যপাদেষু,
মহাশয়ের দুইখানি পত্র কয়েক দিবস হইল পাইয়াছি। মহাশয়ের অন্তরে জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সম্মিলন দেখিয়া বড়ই আনন্দিত হইয়াছি। আপনি যে তর্কযুক্তি পরিত্যাগ করিতে উপদেশ দেন, তাহা অতি যথার্থ বটে এবং প্রত্যেক জীবনেরই উদ্দেশ্য তাহাই—‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিঃ’ ইত্যাদি ১০। তবে কি না আমার গুরুমহারাজ যে প্রকার বলিতেন যে, কলসী পুরিবার সময় ভকভক ধ্বনি করে, পূর্ণ হইলে নিস্তব্ধ হইয়া যায়, আমার পক্ষে সেইরূপ জানিবেন। বোধ হয়, দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব—ঈশ্বর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। ইতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
১৫
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বাগবাজার, কলিকাতা
৩ ডিসেম্বর, ১৮৮৯
পূজ্যপাদেষু,
অনেকদিন আপনার কোন পত্রাদি পাই নাই; ভরসা করি, শারীরিক ও মানসিক কুশলে আছেন। সম্প্রতি আমার দুইটি গুরুভ্রাতা ৺কাশীধামে যাইতেছেন। একটির নাম রাখাল ও অপরটির নাম সুবোধ। প্রথমোক্ত মহাশয় আমার গুরুদেবের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং সর্বদা তাঁহার সঙ্গে থাকিতেন। যদি সুবিধা হয়, ইঁহারা যে কয়েকদিন উক্ত ধামে অবস্থান করেন, কোন সত্রে বলিয়া দিয়া অনুগৃহীত করিবেন। আমার সকল সংবাদ ইঁহাদের নিকট পাইবেন। আমার অসংখ্য প্রণামের সহিত।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
পুঃ—গঙ্গাধর এক্ষণে কৈলাসাভিমুখে যাইতেছেন। পথে তিব্বতীরা তাঁহাকে ফিরিঙ্গীর চর মনে করিয়া কাটিতে আসে, পরে কোন কোন লামা অনুগ্রহ করিয়া ছাড়িয়া দেয়—এ সংবাদ তিব্বতযাত্রী কোন ব্যবসায়ী হইতে পাইয়াছি। লাসা না দেখিলে আমাদের গঙ্গাধরের রক্ত শীতল হইবে না। লাভের মধ্যে শারীরিক কষ্টসহিষ্ণুতা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়াছে—একরাত্রি তিনি অনাচ্ছাদনে বরফের উপর শয়ন করিয়াছিলেন, তাহাতেও বিশেষ কষ্ট হয় নাই ।
ইতি
নরেন্দ্র
১৬
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর, কলিকাতা
১৩ ডিসেম্বর, ১৮৮৯
পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র পাইয়া সবিশেষ অবগত হইলাম—পরে রাখালের পত্রে তাঁহার আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে, তাহাও জানিলাম। আপনার রচিতpamphlet (পুস্তিকা) পাইয়াছি। Theory of Conservation of Energy (শক্তির নিত্যতা—এই মতবাদ) আবিষ্কারের পর হইতে ইওরোপে এক প্রকার Scientific (বৈজ্ঞানিক) অদ্বৈতবাদ প্রচারিত হইতেছে, কিন্তু তাহা পরিণামবাদ। আপনি ইহার সহিত শঙ্করের বিবর্তবাদের যে পার্থক্য দেখাইয়াছেন, তাহা অতি উত্তম। জার্মান Transcendentalist-দের১১ উপর স্পেন্সারের যে বিদ্রূপ উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা বুঝিলাম না; তিনি স্বয়ং উহাদের প্রসাদভোজী। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী গাফ্ (Gough) সম্যক্রূপে হেগেল বুঝেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। যাহা হউক, আপনার উত্তর অতি pointed (তীক্ষ্ণ) এবং thrashing (সম্পূর্ণরূপে বিপক্ষযুক্তি-খণ্ডনকারী)।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
১৭
[শ্রীযুক্ত বলরাম বসুকে লিখিত]
রামকৃষ্ণো জয়তি
বৈদ্যনাথ
২৪ ডিসেম্বর, ১৮৮৯
নমস্কারপূর্বকম্—
বৈদ্যনাথে পূর্ণবাবুর বাসায় কয়েকদিন আছি। শীত বড় নাই, শরীরও বড় ভাল নহে—হজম হয় না, বোধ হয় জলে লৌহাধিক্যের জন্য। কিছুই ভাল লাগিল না—স্থান, কাল ও সঙ্গ। কাল কাশী চলিলাম। দেওঘরে অচ্যুতানন্দ ‘—’র বাসায় ছিল। সে আমাদের সংবাদ পাইয়াই বিশেষ আগ্রহ করিয়া রাখিবার জন্য বড় জিদ করে। শেষে আর একদিন দেখা হইয়াছিল—ছাড়ে নাই। সে বড় কর্মী, কিন্তু সঙ্গে ৭।৮ টা স্ত্রীলোক বুড়ী, ‘জয় রাধে কৃষ্ণ’ই অধিক—রুচি ভাল, শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গের মহিমা! তাহার কর্মচারীরাও আমাদের অত্যন্ত ভক্তি করে। তাহারা কেহ কেহ উহার উপর বড় চটা, তাহারা তাহার নানাস্থানের দুষ্কর্মের কথা কহিতে লাগিল।
প্রসঙ্গক্রমে আমি ‘—’র কথা পাড়িলাম। তোমাদের তাঁহার সম্বন্ধে অনেক ভ্রম বা সন্দেহ আছে, তজ্জন্যই বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া লিখিতেছি। তাঁহাকে এখানকার বৃদ্ধ কর্মচারীরাও বড় মান্য ও ভক্তি করে। তিনি অতি বালিকা-অবস্থায় ‘—’র কাছে আসিয়াছিলেন, বরাবর স্ত্রীর ন্যায় ছিলেন। এমন কি, ‘—’র মন্ত্রগুরু ভগবানদাস বাবাজীও জানিতেন যে, তিনি উহার স্ত্রী। তাহারা বলে, উঁহার মা তাঁহাকে ‘—’র কাছে দিয়া গিয়াছিল। যাহা হউক, তাঁহার এক পুত্র হয় ও মরিয়া যায় এবং সেই সময়ে ‘—’কোথা হইতে একটা ‘জয় রাধে কৃষ্ণ’ বামনী আনিয়া ঘরে ঢোকায়, এই সকল কারণে তিনি তাহাকে ফেলিয়া পলান। যাহা হউক, সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, তাঁহার চরিত্রে কখনও কোন দোষ ছিল না, তিনি অতি সতী বরাবর ছিলেন এবং কখনও স্ত্রী-স্বামী ভিন্ন ‘—’র সহিত অন্য কোন ব্যবহার বা অন্য কাহারও প্রতি কু-ভাব ছিল না। এত অল্প বয়সে আসিয়াছিলেন যে, সে সময়ে অন্য পুরুষ-সংসর্গ সম্ভবে না। তিনি ‘—’র নিকট হইতে পলাইয়া যাইবার পর তাহাকে লেখেন যে, আমি কখনও তোমাকে স্বামী ভিন্ন অন্য ব্যবহার করি নাই, কিন্তু বেশ্যাসক্ত ব্যক্তির সহিত আমার বাস করা অসম্ভব। ইহার পুরাতন কর্মচারীরাও ইহাকে শয়তান ও তাঁহাকে দেবী বলিয়া বিশ্বাস করে ও বলে, ‘তিনি যাবার পর হইতেই ইহার মতিচ্ছন্ন হইয়াছে।’
এ সকল লিখিবার উদ্দেশ্য এই যে, তাঁহার বাল্যকালসম্বন্ধী গল্পে আমি পূর্বে বিশ্বাস করিতাম না। এ সকল ভাব, সমাজে যাহাকে বিবাহ বলে না, তাহার মধ্যে এত পবিত্রতা—আমি romance (কাল্পনিক) মনে করিতাম, কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধানে জানিয়াছি, সকল ঠিক। তিনি অতি পবিত্র, আবাল্য পবিত্র, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ঐ সকল সন্দেহের জন্য আমরা সকলেই তাঁহার নিকট অপরাধী। আমি তাঁহাকে অসংখ্য প্রণাম করিতেছি ও অপরাধের জন্য ক্ষমা চাহিতেছি। তিনি মিথ্যাবাদিনী নহেন। তাঁহার ধর্মে ঐকান্তিকী আস্থাও চিরকাল ছিল, এ কথাও শুনিলাম। এক্ষণে ইহাই শিখিলাম, ঐ প্রকার তেজ মিথ্যাবাদিনী ব্যাভিচারিণীতে সম্ভবে না।
আপনার পীড়া এখনও আরাম হইতেছে না। এখানে খুব পয়সা খরচ না করিতে পারিলে রোগীর বিশেষ সুবিধা বুঝি না। যাহা হয় বিবেচনা করিবেন। সকল দ্রব্যই অন্যত্র হইতে আনাইয়া লইতে হইবে।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
১৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বৈদ্যনাথ
২৬ ডিসেম্বর, ১৮৮৯
পূজ্যপাদেষু,
বহু দিবস চেষ্টার পর বোধ হয় এতদিনে ভবৎসমীপে উপস্থিত হইতে সমর্থ হইলাম। দুই-এক দিনেই ৺কাশীধামে ভবৎ-চরণসমীপে উপস্থিত হইব।
এ স্থানে কলিকাতার একজন বাবুর বাসায় কয়েক দিবস আছি, কিন্তু কাশীর জন্য মন অত্যন্ত ব্যাকুল।
ইচ্ছা আছে, তথায় কিছুদিন থাকিব এবং আমার মন্দ ভাগ্যে বিশ্বনাথ এবং অন্নপূর্ণা কি করেন, দেখিব। এবার ‘শরীরং বা পাতয়ামি, মন্ত্রং বা সাধয়ামি’ প্রতিজ্ঞা করিয়াছি—কাশীনাথ সহায় হউন।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
১৯
[বলরামবাবুকে লিখিত]
রামকৃষ্ণো জয়তি
এলাহাবাদ
৩০ ডিসেম্বর, ১৮৮৯
শ্রীচরণেষু,
গুপ্ত১২ আসিবার সময় একটা শ্লিপ ফেলিয়া আসিয়াছিল এবং পরদিবসে একখানি যোগেনের পত্র পাইয়া সমস্ত অবগত হইয়া তৎক্ষণাৎ এলাহাবাদে যাত্রা করি। পরদিবস পৌঁছিয়া দেখিলাম, যোগেন ১৩ সম্পূর্ণ আরোগ্য হইয়াছে। পানিবসন্ত (দুই-একটা ‘ইচ্ছা’ ও ছিল) হইয়াছিল। ডাক্তারবাবু অতি সাধু ব্যক্তি এবং তাঁহাদের একটি সম্প্রদায় আছে। ইঁহারা অতি ভক্ত ও সাধুসেবাপরায়ণ। ইঁহাদের বড় জিদ—আমি এ স্থানে মাঘ মাস থাকি, আমি কিন্তু কাশী চলিলাম। গোলাপ-মা, যোগীন-মা এখানে কল্পবাস করিবেন, নিরঞ্জনও১৪ বোধ হয় থাকিবে, যোগেন কি করিবে জানি না। আপনি কেমন আছেন?
ঈশ্বরের নিকট সপরিবার আপনার মঙ্গল প্রার্থনা করি। তুলসীরাম, চুনীবাবু প্রভৃতিকে আমার নমস্কারাদি দিবেন। কিমধিকমিতি—
দাস
নরেন্দ্রনাথ
২০
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
৺প্রয়াগধাম
১৭ পৌষ
৩০ ডিসেম্বর, ১৮৮৯
পূজ্যপাদেষু,
দুই-এক দিনের মধ্যে কাশী যাইতেছি বলিয়া আপনাকে এক পত্র লিখিয়াছিলাম, কিন্তু বিধাতার নির্বন্ধ কে খণ্ডাইবে? যোগেন্দ্র নামক আমার একটি গুরুভ্রাতা চিত্রকূট ওঙ্কারনাথাদি দর্শন করিয়া এস্থানে আসিয়া বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়াছেন সংবাদ পাই, তাহাতে তাঁহার সেবা করিবার জন্য এস্থানে আসিয়া উপস্থিত হই। আমার গুরুভাই সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছেন। এখানের কয়েকটি বাঙালী বাবু অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ও অনুরাগী, তাঁহারা আমাকে অত্যন্ত যত্ন করিতেছেন এবং তাঁহাদিগের বিশেষ আগ্রহ যে, আমি এই স্থানে মাঘ মাসে ‘কল্পবাস’ করি। আমার মন কিন্তু ‘কাশী কাশী’ করিয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়াছে এবং আপনাকে দেখিবার জন্য মন অতি চঞ্চল। দুই-চারি দিবসের মধ্যে ইঁহাদের নির্বন্ধাতিশয় এড়াইয়া যাহাতে বারাণসীপুরপতির পবিত্র রাজ্যে উপস্থিত হইতে পারি—তাহার বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। অচ্যুতানন্দ সরস্বতী নামক আমার কোন গুরুভ্রাতা সন্ন্যাসী যদি আপনার নিকটে আমার তত্ত্ব লইতে যান, বলিবেন যে শীঘ্রই আমি কাশী যাইতেছি। তিনি অতি সজ্জন এবং পণ্ডিত লোক, তাঁহাকে বাধ্য হইয়া বাঁকীপুরে ফেলিয়া আসিয়াছি। রাখাল ও সুবোধ কি এখনও কাশীতে আছেন? এ বৎসর কুম্ভের মেলা হরিদ্বারে হইবে কি না, ইহার তথ্য লিখিয়া অনুগৃহীত করিবেন। কিমধিকমিতি।
অনেক স্থানে অনেক জ্ঞানী, ভক্ত, সাধু ও পণ্ডিত দেখিলাম, অনেকেই অত্যন্ত যত্ন করেন, কিন্তু ‘ভিন্নরুচির্হি লোকঃ’, আপনার সঙ্গে কেমন প্রাণের টান আছে—অত ভাল আর কোথাও লাগে না। দেখি কাশীনাথ কি করেন।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
ঠিকানা—ডাক্তার গোবিন্দচন্দ্র বসুর বাটী, চক, এলাহাবাদ।
২১
[বলরাম বাবুকে লিখিত]
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণো জয়তি
এলাহাবাদ
৫ জানুআরী, ১৮৯০
নমস্কার নিবেদনঞ্চ—
মহাশয়ের পত্রে আপনার পীড়ার সমাচার জ্ঞাত হইয়া বিশেষ দুঃখিত হইলাম। বৈদ্যনাথ change (বায়ুপরিবর্তন) সম্বন্ধে আপনাকে যে পত্র লিখি তাহার সার কথা এই যে, আপনার ন্যায় দুর্বল অথচ অত্যন্ত নরম-শরীর লোকের অধিক অর্থব্যয় না করিলে উক্ত স্থানে চলা অসম্ভব। যদি পরিবর্তনই আপনার পক্ষে বিধি হয় এবং যদি কেবল সস্তা খুঁজিতে এবং গয়ংগচ্ছ করিতে করিতে এতদিন বিলম্ব করিয়া থাকেন, তাহা হইলে দুঃখের বিষয় সন্দেহ নাই। ...
বৈদ্যনাথ—হাওয়া সম্বন্ধে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট, কিন্তু জল ভাল নহে, পেট বড় খারাপ করে, আমার প্রত্যহ অম্বল হইত। ইতঃপূর্বে আপনাকে এক পত্র লিখি—তাহা কি আপনি পাইয়াছেন, না bearing (বিনা মাশুলে প্রেরিত) দেখিয়া the devil take it করিয়াছেন?১৫ আমি বলি change (বায়পরিবর্তন) করিতে হয় তো শুভস্য শীঘ্রং। রাগ করিবেন না—আপনার একটি স্বভাব এই যে ক্রমাগত ’বামুনের গরু’ খুঁজিতে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ জগতে সকল সময়ে তাহা পাওয়া যায় না—আত্মানং সততং রক্ষেৎ। Lord have mercy (ঈশ্বর করুণা করুন) ঠিক বটে, কিন্তু He helps him who helps himself (যে উদ্যমী, ভগবান্ তাহারই সহায় হন)। আপনি খালি টাকা বাঁচাতে যদি চান, Lord (ভগবান্) কি বাবার ঘর হইতে টাকা আনিয়া আপনাকে change (বায়ুপরিবর্তন) করাইবেন? যদি এতই Lord-এর উপর নির্ভর করেন, ডাক্তার ডাকিবেন না। ... যদি আপনার suit না করে (সহ্য না হয়) কাশী যাইবেন—আমিও এতদিন যাইতাম, এখানকার বাবুরা ছাড়িতে চাহে না, দেখি কি হয়।...
কিন্তু পুনর্বার বলি, change-এ (বায়ুপরিবর্তনে) যদি যাওয়া হয়, কৃপণতার জন্য ইতস্ততঃ করিবেন না। তাহা হইলে তাহার নাম আত্মঘাত। আত্মঘাতীর গতি ভগবান্ও করিতে পারেন না। তুলসী বাবু প্রভৃতি সকলকে আমার নমস্কারাদি দিবেন। ইতি—
দাস
নরেন্দ্রনাথ
২২
[শ্রীযজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্যকে লিখিত]
এলাহাবাদ
৫ জানুআরী, ১৮৯০
প্রিয় ফকির,
একটি কথা তোমাকে বলি, উহা সর্বদা স্মরণ রাখিবে, আমার সহিত তোমাদের আর দেখা না হইতে পারে—নীতিপরায়ণ ও সাহসী হও, হৃদয় যেন সম্পূর্ণ শুদ্ধ থাকে। সম্পূর্ণ নীতিপরায়ণ ও সাহসী হও—প্রাণের ভয় পর্যন্ত রাখিও না। ধর্মের মতামত লইয়া মাথা বকাইও না। কাপুরুষেরাই পাপ করিয়া থাকে, বীর কখনও পাপ করে না—মনে পর্যন্ত পাপচিন্তা আসিতে দেয় না। সকলকেই ভালবাসিবার চেষ্টা করিবে। নিজে মানুষ হও, আর রাম প্রভৃতি যাহার সাক্ষাৎ তোমার তত্ত্বাবধানে আছে, তাহাদিগকেও সাহসী, নীতিপরায়ণ ও সহানুভূতিসম্পন্ন করিবার চেষ্টা করিবে। হে বৎসগণ, তোমাদের জন্য নীতিপরায়ণতা ও সাহস ব্যতীত আর কোন ধর্ম নাই, ইহা ব্যতীত ধর্মের আর কোন মতামত তোমাদের জন্য নহে। যেন কাপুরুষতা, পাপ, অসদাচরণ বা দুর্বলতা একদম না থাকে, বাকী আপনা-আপনি আসিবে। রামকে কখনও থিয়েটার বা কোনরূপ চিত্তদৌর্বল্যকারক আমোদ-প্রমোদে লইয়া যাইও না বা যাইতে দিও না।
তোমার
নরেন্দ্রনাথ
২৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
এলাহাবাদ
৫ জানুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
প্রিয় রাম, কৃষ্ণময়ী ও ইন্দু,
বৎসগণ, মনে রাখিও কাপুরুষ ও দুর্বলগণই পাপাচরণ করে ও মিথ্যা কথা বলে। সাহসী ও সবলচিত্ত ব্যক্তিগণ সদাই নীতিপরায়ণ। নীতিপরায়ণ, সাহসী ও সহানুভূতিসম্পন্ন হইবার চেষ্টা কর। ইতি
তোমাদের
নরেন্দ্রনাথ
২৪
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাটী
গোরাবাজার, গাজীপুর
শুক্রবার, ২৪ জানুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
অদ্য তিন দিন যাবৎ গাজীপুরে পৌঁছিয়াছি। এস্থানে আমার বাল্যসখা শ্রীযুক্ত বাবু সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বাসাতে আছি; স্থানটি অতি মনোরম। অদূরে গঙ্গা আছেন, কিন্তু স্নানের বড় কষ্ট—পথ নাই, এবং বালির চড়া ভাঙ্গিতে বড় কষ্ট হয়। আমার বন্ধুর পিতা শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয়—যে মহানুভবের কথা আমি আপনাকে বলিয়াছিলাম—এ স্থানে আছেন। অদ্য ইনি ৺কাশীধামে যাইতেছেন, কাশী হইয়া কলিকাতা যাইবেন। আমার বড় ইচ্ছা ছিল, ইঁহার সঙ্গে পুনর্বার কাশী যাই। কিন্তু যে জন্য আসিয়াছি—অর্থাৎ বাবাজীকে১৬ দেখা—তাহা এখনও হয় নাই। অতএব দুই-চারি দিন বিলম্ব হইবে। এস্থানের সকলই ভাল, বাবুরা অতি ভদ্র, কিন্তু বড় westernized (পাশ্চাত্যভাবাপন্ন); আর দুঃখের বিষয় যে, আমি western idea (পাশ্চাত্যভাব) মাত্রেরই উপর খড়্গহস্ত। কেবল আমার বন্ধুর ও-সকল idea (ভাব) বড়ই কম। কি কাপুড়ে সভ্যতাই ফিরিঙ্গী আনিয়াছে! কি materialistic (জড়ভাবের) ধাঁধাই লাগাইয়াছে! বিশ্বনাথ এই সকল দুর্বলহৃদয়কে রক্ষা করুন। পরে বাবাজীকে দেখিয়া বিশেষ বৃত্তান্ত লিখিব। ইতি
দাস
বিবেকানন্দ
পুঃ—ভগবান্ শুকের জন্মভূমিতে আজি বৈরাগ্যকে লোকে পাগলামি ও পাপ মনে করে! অহো ভাগ্য!
২৫
[বলরাম বাবুকে লিখিত]
শ্রীরামকৃষ্ণো জয়তি
গাজীপুর
৩০ জানুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আমি এক্ষণে গাজীপুরে সতীশবাবুর নিকট রহিয়াছি। যে কয়েকটি স্থান দেখিয়া আসিয়াছি, তন্মধ্যে এইটি স্বাস্থ্যকর। বৈদ্যনাথের জল বড় খারাপ, হজম হয় না। এলাহাবাদ অত্যন্ত ঘিঞ্জি—কাশীতে যে কয়েকদিন ছিলাম দিনরাত জ্বর হইয়া থাকিত—এত ম্যালেরিয়া! গাজীপুরের বিশেষতঃ আমি যে স্থানে থাকি, জলবায়ু অতি স্বাস্থ্যকর। পওহারী বাবার বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছি। চারিদিকে উচ্চ প্রাচীর, ইংরেজী বাঙলার মতন, ভিতরে বাগান আছে, বড় বড় ঘর, chimney &c. (চিমনি ইত্যাদি)। কাহাকেও ঢুকিতে দেন না, ইচ্ছা হইলে দ্বারদেশে আসিয়া ভিতর থেকে কথা কন মাত্র। একদিন যাইয়া বসিয়া বসিয়া হিম খাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি। রবিবারে কাশী যাইব। ইতোমধ্যে বাবাজীর সহিত দেখা হইল তো হইল—নহিলে এই পর্যন্ত। প্রমদাবাবুর বাগান সম্বন্ধে কাশী হইতে স্থির করিয়া লিখিব। কালী ভট্টাচার্য যদি একান্ত চাহে তো আমি কাশীতে রবিবার যাইলে যেন আসে—না আসিলেই ভাল। কাশীতে দুই-চারিদিন থাকিয়া শীঘ্রই হৃষীকেশ চলিতেছি—প্রমদাবাবুর সঙ্গে যাইলেও যাইতে পারে। আপনারা এবং তুলসীরাম সকলে আমার যথাযোগ্য নমস্কারাদি জানিবেন ও ফকির, রাম, কৃষ্ণময়ী প্রভৃতিকে আমার আশীর্বাদ।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
আমার মতে আপনি কিছুদিন গাজীপুরে আসিয়া থাকিলে বড় ভাল, এখানে সতীশ বাঙলা ঠিক করিয়া দিতে পারিবে ও গগনচন্দ্র রায় নামক একটি বাবু—আফিম আফিসের Head (বড়বাবু), তিনি যৎপরোনাস্তি ভদ্র, পরোপকারী ও social (মিশুক)। ইঁহারা সব ঠিক করিয়া দিবেন। বাড়ী ভাড়া ১৫৲।২০৲ টাকা; চাউল মহার্ঘ, দুগ্ধ ১৬।২০ সের, আর সকল অত্যন্ত সস্তা। আর ইঁহাদের তত্ত্বাবধানে কোন ক্লেশ হইবার সম্ভাবনা নাই, কিন্তু কিছু expensive (বেশী খরচ)। ৪০৲।৫০৲ টাকার উপর পড়িবে। কাশী বড় damned malarious (অত্যন্ত ম্যালেরিয়াপূর্ণ)।
প্রমদাবাবুর বাগানে কখনও থাকি নাই—তিনি কাছ-ছাড়া করিতে চান না। বাগান অতি সুন্দর বটে, খুব furnished (সাজান গোজান) এবং বড় ও ফাঁকা। এবার যাইয়া থাকিয়া দেখিয়া মহাশয়কে লিখিব। ইতি
নরেন্দ্র
২৬
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বরাহনগর, কলিকাতা
১৩ ডিসেম্বর, ১৮৮৯
পূজ্যপাদেষু,
বাবাজীর সহিত দেখা হওয়া বড় মুশকিল, তিনি বাড়ীর বাহিরে আসেন না, ইচ্ছা হইলে দ্বারে আসিয়া ভিতর হইতে কথা কন। অতি উচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যান-সমন্বিত এবং চিমনীদ্বয়-শোভিত তাঁহার বাটী দেখিয়া আসিয়াছি, ভিতরে প্রবেশের ইচ্ছা নাই। লোকে বলে, ভিতরে গুফা অর্থাৎ তয়খানা গোছের ঘর আছে, তিনি তন্মধ্যে থাকেন; কি করেন তিনিই জানেন, কেহ কখনও দেখে নাই। একদিন যাইয়া অনেক হিম খাইয়া বসিয়া বসিয়া চলিয়া আসিয়াছি, আরও চেষ্টা দেখিব। রবিবার ৺কাশীধামে যাত্রা করিব—এখানকার বাবুরা ছাড়িতেছেন না, নহিলে বাবাজী দেখিবার সখ আমার গুটাইয়াছে। অদ্যই চলিয়া যাইতাম; যাহা হউক, রবিবার যাইতেছি। আপনার হৃষীকেশ যাইবার কি হইল?
দাস
নরেন্দ্রনাথ
পুঃ—গুণের মধ্যে স্থানটি বড় স্বাস্থ্যকর।
২৭
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ওঁ বিশ্বেশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্রও পাইয়াছি এবং বহু ভাগ্যফলে বাবাজীর সাক্ষাৎ হইয়াছে। ইনি অতি মহাপুরুষ—বিচিত্র ব্যাপার, এবং এই নাস্তিকতার দিনে ভক্তি এবং যোগের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার অদ্ভুত নিদর্শন। আমি ইঁহার শরণাগত হইয়াছি, আমাকে আশ্বাসও দিয়াছেন, সকলের ভাগ্যে ঘটে না। বাবাজীর ইচ্ছা—কয়েক দিবস এই স্থানে থাকি, তিনি উপকার করিবেন। অতএব এই মহাপুরুষের আজ্ঞানুসারে দিন কয়েক এ স্থানে থাকিব। ইহাতে আপনিও আনন্দিত হইবেন, সন্দেহ নাই। পত্রে লিখিলাম না, কথা অতি বিচিত্র, সাক্ষাতে জানিবেন। ইঁহাদের লীলা না দেখিলে শাস্ত্রে বিশ্বাস পুরা হয় না।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
পুঃ—এ পত্রের বিষয় গোপন রাখিবেন। ইতি
২৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
বিশ্বেশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৭ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
বএইমাত্র আপনার পত্র পাইয়া সাতিশয় প্রীতি প্রাপ্ত হইলাম। বাবাজী আচারী বৈষ্ণব; যোগ, ভক্তি এবং বিনয়ের মূর্তি বলিলেই হয়। তাঁহার কুটীর চতুর্দিকে প্রাচীর দেওয়া, তাহার মধ্যে কয়েকটি দরজা আছে। এই প্রাচীরের মধ্যে এক অতি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ আছে, তন্মধ্যে ইনি সমাধিস্থ হইয়া পড়িয়া থাকেন; যখন উপরে আসেন, তখনই লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা কহেন। কি খান, কেহই জানে না, এইজন্যই ‘পওহারী বাবা’ বলে। মধ্যে একবার ৫ বৎসর—একবারও গর্ত হইতে উঠেন নাই, লোকে জানিয়াছিল যে, শরীর ছাড়িয়াছেন; কিন্তু আবার উঠিয়াছেন। এবার কিন্তু দেখা দেন না, তবে দ্বারের আড়াল হইতে কথা কহেন। এমন মিষ্ট কথা আমি কখনও শুনি নাই। কোন direct (সোজাসুজি) প্রশ্নের উত্তর দেন না, বলেন ‘দাস ক্যা জানে?’ তবে কথা কহিতে কহিতে আগুন বাহির হয়। আমি খুব জিদাজিদি করাতে বলিলেন যে, ‘আপনি কিছুদিন এ স্থানে থাকিয়া আমাকে কৃতার্থ করুন।’ এ প্রকার কখনও কহেন না; ইহাতেই বুঝিলাম, আমাকে আশ্বাস দিলেন এবং যখনই পীড়াপীড়ি করি, তখনই বলেন, ‘কিছুদিন থাকুন।’ এই আশায় আছি। ইনি অতি পণ্ডিত ব্যক্তি, কিন্তু কিছুই প্রকাশ পায় না, আবার কর্মকাণ্ডও করেন—পূর্ণিমা হইতে সংক্রান্তি পর্যন্ত হোম হয়। অতএব ইহার মধ্যে গর্তে যাইবেন না নিশ্চিত। অনুমতি কি লইব, direct (স্পষ্ট) উত্তর দিবেন না। ‘দাসকে ভাগ্য’ ইত্যাদি ঢের বলিবেন। আপনার ইচ্ছা থাকে, পত্রপাঠ চলিয়া আসুন। ইঁহার শরীর যাইলে বড় আপসোস থাকিবে—দুদিনে দেখা অর্থাৎ আড়াল হইতে কথা কহিয়া যাইতে পারিবেন। আমার বন্ধু সতীশবাবু অতি সমাদরে আপনাকে গ্রহণ করিবেন। আপনি পত্রপাঠ চলিয়া আসুন, ইতোমধ্যে আমি বাবাজীকে বলিব।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
পুঃ—ইঁহার সঙ্গ না হইলেও এ প্রকার মহাপুরুষের জন্য কোন কষ্টই বৃথা হইবে না নিশ্চিত। অলমতিবিস্তরেণ।
২৯
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
১৩ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার শারীরিক অসুস্থতা শুনিয়া চিন্তিত রহিলাম। আমারও কোমরে একপ্রকার বেদনা হইয়া রহিয়াছে, সম্প্রতি অত্যন্ত বাড়িয়াছে এবং যাতনা দিতেছে। বাবাজীকে দুই দিন দেখিতে যাইতে পারি নাই, তজ্জন্য তাঁহার নিকট হইতে আমার খবর লইতে এক ব্যক্তি আসিয়াছিল—অতএব আজ যাইব। আপনার অসংখ্য প্রণাম দিব। আগুন বাহির হয়, অর্থাৎ অতি অদ্ভুত গূঢ় ভক্তির কথা এবং নির্ভরের কথা বাহির হয়—এমন অদ্ভুত তিতিক্ষা এবং বিনয় কখনও দেখি নাই। কোন মাল যদি পাই, আপনার তাহাতে ভাগ আছে নিশ্চিত জানিবেন। কিমধিকমিতি—
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৩০
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
১৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
গতকল্য আপনাকে যে পত্র লিখিয়াছি, তাহাতে শরৎ-ভায়ার পত্রখানি পাঠাইতে—বলিতে ভুলিয়াছি বোধ হয়; অনুগ্রহ করিয়া পাঠাইয়া দিবেন। গঙ্গাধর ভায়ার একখানি পত্র পাইয়াছি। তিনি এক্ষণে কাশ্মীর, রামবাগ সমাধি, শ্রীনগরে আছেন। আমি lumbagoতে (কোমরের বাতে) বড় ভুগিতেছি। ইতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
পুঃ—রাখাল ও সুবোধ ওঁকার, গির্নার, আবু, বোম্বে, দ্বারকা দেখিয়া এক্ষণে বৃন্দাবনে আছে।
নরেন্দ্র
৩১
[বলরাম বাবুকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
C/o সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
গোরাবাজার, গাজীপুর
১৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার আপসোস-পত্র পাইয়াছি। আমি শীঘ্র এ স্থান পরিত্যাগ করিতেছি না, বাবাজীর অনুরোধ এড়াইবার যো নাই।
সাধুদের সেবা করিয়া কি হইল বলিয়া আপসোস করিয়াছেন। কথা ঠিক বটে, অথচ নহে বটে। Ideal bliss-এর (আদর্শ আনন্দ) দিকে চাহিতে গেলে এ কথা সত্য বটে, কিন্তু যে স্থান ছাড়িয়া আসিয়াছেন সে দিকে তাকাইলেই দেখিতে পাইবেন—ছিলেন গরু, হইয়াছেন মানুষ, হইবেন দেবতা এবং ঈশ্বর। পরন্তু ঐ প্রকার ‘কি হইল’, ‘কি হইল’ অতি ভাল—উন্নতির আশাস্বরূপ, নহিলে কেহ উঠিতে পারে না। ‘পাগড়ি বেঁধেই ভগবান্’ যে দেখে, তাহার ঐখানেই খতম। আপনার সর্বদাই যে মনে পড়ে ‘কি হইল’, আপনি ধন্য নিশ্চিত জানিবেন—আপনার মার নাই।
গিরিশবাবুর সহিত মাতাঠাকুরাণীকে আনিবার জন্য আপনার কি মতান্তর হইয়াছে, গিরিশবাবু লিখিয়াছেন—সে বিষয়ে আমার বলিবার কিছুই নাই। তবে আপনি অতি বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি, কার্যসিদ্ধির প্রধান উপায় যে ধৈর্য—এ আপনি ঠিক বুঝেন, সে বিষয়ে চপলমতি আমরা আপনার নিকট বহু শিক্ষার উপযুক্ত, সন্দেহ নাই। কাশীতে আমি—যোগীন-মাতার ঘাড় না ভাঙা যায় এবিষয়ে একদিন বাদানুবাদচ্ছলে কহিয়াছিলাম। তৎসওয়ায় আর আমি কোন খবর জানি না এবং জানিতে ইচ্ছাও রাখি না। মাতাঠাকুরাণীর যে প্রকার ইচ্ছা হইবে, সেই প্রকারই করিবেন। আমি কোন্ নরাধম, তাঁহার সম্বন্ধে কোন বিষয়ে কথা কহি? যোগীন-মাতাকে যে বারণ করিয়াছিলাম, তাহা যদি দোষের হইয়া থাকে, তজ্জন্য লক্ষ লক্ষ ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। আপনি সদ্বিবেচক—আপনাকে কি বলিব? কান দুটো, কিন্তু মুখ একটা; বিশেষতঃ আপনার মুখ বড় কড়া এবং ফস ফস করিয়া large promises (বেশী বেশী অঙ্গীকার-বাক্য) বাহির হয় না বলিয়া আপনার উপর অনেক সময় বিরক্ত হই, কিন্তু বিচার করিয়া দেখি যে, আপনিই সদ্বিবেচনার কার্য করেন।—'Slow but sure' (ধীর, কিন্তু নিশ্চিত)।
What is lost in power, is gained in speed (শক্তি যে পরিমাণ ব্যয়িত হয়, গতিবৃদ্ধিতে তাহা পোষাইয়া যায়), যাহাই হউক, সংসারে কথা লইয়াই কাজ। কথার ছাল ছাড়াইয়া (তাতে আপনার কৃপণতার আবরণ—এত ছাড়াইয়া) অন্তর্দৃষ্টি সকলের হয় না এবং বহু সঙ্গ না করিলে কোন ব্যক্তিকে বুঝা যায় না। ইহা মনে করিয়া এবং শ্রীশ্রীগুরুদেব এবং মাতাঠাকুরাণীকে স্মরণ করিয়া—নিরঞ্জন যদি আপনাকে কিছু কটুকাটব্য বলিয়া থাকে ক্ষমা করিবেন। ‘ধর্ম—দলে নহে, হুজুগে নহে’, ৺গুরুদেবের এই সকল উপদেশ ভুলিয়া যান কেন? আপনার যা করিবার সাধ্য করুন, কিন্তু তাহার কি ব্যবহার হইল, কি না হইল, ভাল মন্দ বিচার করার অধিকার আমাদের বোধ হয় নাই। ... গিরিশবাবু যে আঘাত পাইয়াছেন, তাহাতে এ সময়ে মাতাঠাকুরাণীর সেবায় তাঁহার বিশেষ শান্তিলাভ হইবে। তিনি অতি তীক্ষ্ণবুদ্ধি, তাঁহার সম্বন্ধে আমি কি বিচার করিব! আর ৺গুরুদেব আপনার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেন। আপনার বাটী ভিন্ন কোথাও অন্নাদি গ্রহণ করিতেন না এবং শুনিয়াছি, মাতাঠাকুরাণীও আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন—এই সকল মনে করিয়া আমাদের ন্যায় চপলমতি বালকদিগের (নিজ পুত্রের কৃত অপরাধের ন্যায়) সকল অপরাধ সহ্য ও ক্ষমা করিবেন—অধিক কি লিখিব।
জন্মোৎসব কবে হইবে পত্রপাঠ লিখিবেন। আমার কোমরে একটা বেদনায় বড় অসুস্থ করিয়াছে। আর দিনকয়েক বাদে এ স্থানে বড় শোভা হইবে—ক্রোশ-ক্রোশব্যাপী গোলাপফুলের মাঠে ফুল ফুটিবে। সেই সময়ে সতীশ কতকগুলো তাজাফুল ও ডাল মহোৎসব উপলক্ষে পাঠাইবে বলিতেছে। যোগেন কোথায়, কেমন আছে? বাবুরাম কেমন আছে? সারদা কি এখন তেমনি চঞ্চলচিত্ত? গুপ্ত কি করিতেছে? তারক-দাদা, গোপাল-দাদা প্রভৃতিকে আমার প্রণাম। মাষ্টারের ভাইপো কতদূর পড়িল? রাম ও ফকির ও কৃষ্ণময়ীকে আমার আশীর্বাদাদি দিবেন। তাহারা পড়াশুনা কেমন করিতেছে? ভগবান্ করুন, আপনার ছেলে যেন ‘মানুষ’ হয়—না-মরদ না হয়। তুলসীবাবুকে আমার লক্ষ লক্ষ সাদর সম্ভাষণ দিবেন এবং এবারে একলা সাণ্ডেলও নিজের খাটনি খাটিতে পারিবে কিনা? চুনীবাবু কেমন আছেন?
বলরামবাবু, মাতাঠাকুরাণী যদি আসিয়া থাকেন, আমার কোটি কোটি প্রণাম দিবেন ও আশীর্বাদ করিতে বলিবেন—যেন আমার অটল অধ্যবসায় হয়, কিম্বা এ শরীরে যদি তাহা অসম্ভব, যেন শীঘ্রই ইহার পতন হয়।
(পরের পত্রখানি) গুপ্তকে দেখাইবেন।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৩২
[স্বামী সদানন্দকে লিখিত]
১৪ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
কল্যাণবরেষু,
বোধ করি শারীরিক কুশলে আছ। আপনার জপতপ সাধন ভজন করিবে ও আপনাকে দাসানুদাস জানিয়া সকলের সেবা করিবে। তুমি যাঁহাদের কাছে আছ, আমিও তাঁহাদের দাসানুদাস ও চরণরেণুর যোগ্য নহি—এই জানিয়া তাঁহাদের সেবা ও ভক্তি করিবে। ইঁহারা গালি দিলে বা খুন করিলেও ক্রুদ্ধ হইও না। কোন স্ত্রীসঙ্গে যাইও না—hardy (কষ্টসহিষ্ণু) হইবার অল্প অল্প চেষ্টা করিবে এবং সইয়ে সইয়ে ক্রমে ভিক্ষা দ্বারা শরীর ধারণ করিবার চেষ্টা করিবে। যে কেহ রামকৃষ্ণের দোহাই দেয়, সেই তোমার গুরু জানিবে। কর্তাত্ব সকলেই পারে—দাস হওয়া বড় শক্ত। বিশেষতঃ তুমি শশীর কথা শুনিবে। গুরুনিষ্ঠা, অটল ধৈর্য ও অধ্যবসায় ব্যতিরিক্ত কিছুই হইবে না—নিশ্চিত, নিশ্চিত জানিবে। Strict morality (কঠোর নীতিপরায়ণতা) চাহি—একটুকু এদিক ওদিক হইলে সর্বনাশ। ইতি
নরেন্দ্রনাথ
৩৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
১৯ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
গঙ্গাধর ভায়াকে আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে নিষেধ করিয়া ও কোন স্থানে বসিয়া যাইতে পরামর্শ দিয়া এবং তিব্বতে কি কি সাধু দেখিয়াছেন এবং তাঁহাদের আচার-ব্যবহার কি প্রকার, সবিশেষ লিখিতে এক পত্র লিখিয়াছিলাম। তদুত্তরে তিনি যে পত্র লিখিয়াছেন, তাহা অত্র পত্রের সহিত আপনার নিকট পাঠাইতেছি। কালী (অভেদানন্দ) ভায়ার হৃষীকেশে পুনঃপুনঃ জ্বর হইতেছে, তাঁহাকে এ স্থান হইতে এক টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছি; উত্তরে যদি আমার যাওয়ার আবশ্যক তিনি বিবেচনা করেন, এ স্থান হইতে একেবারেই হৃষীকেশে যাইতে বাধ্য হইব, নতুবা দুই-এক দিনের মধ্যেই ভবৎসকাশে উপস্থিত হইতেছি। মহাশয় হয়তো এই মায়ার প্রপঞ্চ দেখিয়া হাসিবেন—কথাও তাই বটে। তবে কি না লোহার শিকল ও সোনার শিকল—সোনার শিকলের অনেক উপকার আছে, তাহা [সেই উপকার] হইয়া গেলে আপনা-আপনি খসিয়া যাইবে। আমার গুরুদেবের পুত্রগণ আমার অতি সেবার পাত্র—এই স্থানেই একটু duty (কর্তব্য)-বোধ আছে। সম্ভবতঃ কালীভায়াকে এলাহাবাদে অথবা যে স্থানে সুবিধা হয়, পাঠাইয়া দিব। আপনার চরণে আমার শত শত অপরাধ রহিল, পুত্রস্তেঽহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্ (আমি আপনার পুত্র, শরণাগত, আমায় শাসন করুন, শিক্ষা দিন)। কিমধিকমিতি
দাস
নরেন্দ্র
৩৪
[স্বামী অখণ্ডানন্দ বা ‘গঙ্গাধর’কে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
ফেব্রুআরী, ১৮৯০
প্রাণাধিকেষু,
তোমার পত্র পাইয়া অতি প্রীত হইলাম। তিব্বত সম্বন্ধে যে কথা লিখিয়াছ, তাহা অতি আশাজনক, আমি সে স্থানে যাইবার একবার চেষ্টা করিব, সংস্কৃতে তিব্বতকে ‘উত্তরকুরুবর্ষ’ কহে—উহা ম্লেচ্ছভূমি নহে। পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উচ্চ ভূমি—এজন্য শীত অত্যন্ত, কিন্তু ক্রমে ক্রমে সহিয়া যাইতে পারে। তিব্বতী লোকদিগের আচার-ব্যবহার তুমি তো কিছুই লিখ নাই; যদি এত আতিথেয়, তবে কেন তোমাকে যাইতে দিল না? সবিশেষ লিখিবে—সকল কথা খুলিয়া একখান বৃহৎ পত্রে। তুমি আসিতে পারিবে না জানিয়া দুঃখিত হইলাম। তোমাকে দেখিবার বড় ইচ্ছা ছিল। তোমাকে সমধিক ভালবাসি বলিয়া বোধ হয়। যাহাই হউক, এ মায়াও আমি কাটাইবার চেষ্টা করিব।
তিব্বতীদের যে তন্ত্রাচারের কথা কহিয়াছ, তাহা বৌদ্ধধর্মের শেষ দশায় ভারতবর্ষেই হইয়াছিল। আমার বিশ্বাস যে, আমাদিগের যে সকল তন্ত্র প্রচলিত আছে, বৌদ্ধেরাই তাহার আদিম স্রষ্টা। ঐ সকল তন্ত্র আমাদিগের বামাচারবাদ হইতে আরও ভয়ঙ্কর (উহাতে ব্যভিচার অতি মাত্রায় প্রশ্রয় পাইয়াছিল), এবং ঐ প্রকার immorality (চরিত্রহীনতা) দ্বারা যখন (বৌদ্ধগণ) নির্বীর্য হইল, তখনই [তাহারা] কুমারিল ভট্ট দ্বারা দূরীকৃত হইয়াছিল। যে প্রকার সন্ন্যাসীরা শঙ্করকে ও বাউলরা মহাপ্রভুকে secret (গোপনে) স্ত্রীসম্ভোগী, সুরাপায়ী ও নানাপ্রকার জঘন্য আচরণকারী বলে, সেই প্রকার modern (আধুনিক) তান্ত্রিক বৌদ্ধেরা বুদ্ধদেবকে ঘোর বামাচারী বলে এবং ‘প্রজ্ঞাপারমিতো’ক্ত তত্ত্বগাথা প্রভৃতি সুন্দর সুন্দর বাক্যকে কুৎসিত ব্যাখ্যা করে; ফল এই হইয়াছে যে, এক্ষণে বৌদ্ধদের দুই সম্প্রদায়; বর্মা ও সিংহলের লোক প্রায় তন্ত্র মানে না ও সেই সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুর দেবদেবীও দূর করিয়াছে, এবং উত্তরাঞ্চলের বৌদ্ধেরা যে ‘অমিতাভ বুদ্ধম্’ মানে, তাঁহাকেও ঢাকীসুদ্ধ বিসর্জন দিয়াছে। ফল কথা এই, উত্তরের লোকেরা যে ‘অমিতাভ বুদ্ধম্’ ইত্যাদি মানে, তাহা ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’দিতে নাই, কিন্তু দেবদেবী অনেক মানা আছে। আর দক্ষিণীরা জোর করিয়া শাস্ত্র লঙ্ঘন করিয়া দেবদেবী বিসর্জন করিয়াছে। যে everything for others (‘যাহা কিছু সব পরের জন্য’—এই মত) তিব্বতে বিস্তৃত দেখিতেছ, ঐ phase of Buddhism (বৌদ্ধর্মের ঐ ভাব) আজকাল ইওরোপকে বড় strike করিয়াছে (ইওরোপের বড় মনে লাগিয়াছে)। যাহা হউক, ঐ phase (ভাব) সম্বন্ধে আমার বলিবার অনেক আছে, এ পত্রে তাহা হইবার নহে। যে ধর্ম উপনিষদে জাতিবিশেষে বদ্ধ হইয়াছিল, বুদ্ধদেব তাহারই দ্বার ভাঙিয়া সরল কথায় চলিত ভাষায় খুব ছড়াইয়াছিলেন। নির্বাণে তাঁহার মহত্ত্ব বিশেষ কি? তাঁহার মহত্ত্ব in this unrivalled sympathy (তাঁহার অতুলনীয় সহানুভূতিতে)। তাঁহার ধর্মে যে সকল উচ্চ অঙ্গের সমাধি প্রভৃতির গুরুত্ব, তাহা প্রায় সমস্তই বেদে আছে; নাই তাঁহার intellect (বুদ্ধি) এবং heart (হৃদয়), যাহা জগতে আর হইল না।
বেদের যে কর্মবাদ, তাহা jew (য়াহুদী) প্রভৃতি সকল ধর্মের কর্মবাদ, অর্থাৎ যজ্ঞ ইত্যাদি বাহ্যোপকরণ দ্বারা অন্তর শুদ্ধি করা—এ পৃথিবীতে বুদ্ধদেব the first man (প্রথম ব্যক্তি), যিনি ইহার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হয়েন। কিন্তু ভাব ঢঙ সব পুরাতনের মত রহিল, সেই তাঁহার অন্তঃকর্মবাদ—সেই তাঁহার বেদের পরিবর্তে সূত্রে বিশ্বাস করিতে হুকুম। সেই জাতিও ছিল, তবে গুণগত হইল (বুদ্ধের সময় জাতিভেদ যায় নাই), সেই যাহারা তাঁহার ধর্ম মানে না, তাহাদিগকে ‘পাষণ্ড’ বলা। ‘পাষণ্ড’টা বৌদ্ধদের বড় পুরানো বোল, তবে কখনও বেচারীরা তলওয়ার চালায় নাই, এবং বড় toleration (উদারভাব) ছিল। তর্কের দ্বারা বেদ উড়িল, কিন্তু তোমার ধর্মের প্রমাণ?—বিশ্বাস কর!!—যেমন সকল ধর্মের আছে, তাহাই। তবে সেই কালের জন্য বড় আবশ্যক ছিল এবং সেই জন্যই তিনি অবতার হন। তাঁহার মায়াবাদ কপিলের মত। কিন্তু শঙ্করের how far more grand and rational (কত মহত্তর এবং অধিকতর যুক্তিপূর্ণ)! বুদ্ধ ও কপিল কেবল বলেন—জগতে দুঃখ দুঃখ, পালাও পালাও। সুখ কি একেবারেই নাই? যেমন ব্রাহ্মরা বলেন, সব সুখ—এও সেই প্রকার কথা। দুঃখ, তা কি করিব? কেহ যদি বলে যে সহিতে সহিতে অভ্যাস হইলে দুঃখকেই সুখ বোধ হইবে? শঙ্কর এ দিক্ দিয়ে যান না—তিনি বলেন, ‘সন্নাপি অসন্নাপি, ভিন্নাপি অভিন্নাপি’—আছে অথচ নেই, ভিন্ন অথচ অভিন্ন এই যে জগৎ, এর তথ্য আমি জানিব—দুঃখ আছে কি কী আছে; জুজুর ভয়ে আমি পালাই না। আমি জানিব, জানিতে গেলে যে অনন্ত দুঃখ তা তো প্রাণভরে গ্রহণ করিতেছি; আমি কি পশু যে ইন্দ্রিয়জনিত সুখদুঃখ-জরামরণ-ভয় দেখাও? আমি জানিব—জানিবার জন্য জান দিব। এ জগতে জানিবার কিছুই নাই, অতএব যদি এই relative-এর (মায়িক জগতের) পার কিছু থাকে—যাকে শ্রীবুদ্ধ ‘প্রজ্ঞাপারম্’ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন—যদি থাকে, তাহাই চাই। তাহাতে দুঃখ আসে বা সুখ আসে I do not care (আমি গ্রাহ্য করি না)। কি উচ্চভাব! কি মহান্ ভাব! উপনিষদের উপর বুদ্ধের ধর্ম উঠেছে, তার উপর শঙ্করবাদ। কেবল শঙ্কর বুদ্ধের আশ্চর্য heart (হৃদয়) অণুমাত্র পান নাই; কেবল dry intellect (শুষ্ক জ্ঞানবিচার)—তন্ত্রের ভয়ে, mob-এর (ইতরলোকের) ভয়ে ফোড়া সারাতে গিয়ে হাতসুদ্ধ কেটে ফেললেন, এ সকল সম্বন্ধে গেলে পুঁথি লিখতে হয়; আমার তত বিদ্যা ও আবশ্যক—দুইয়েরই অভাব।
বুদ্ধদেব আমার ইষ্ট, আমার ঈশ্বর। তাঁহার ঈশ্বরবাদ নাই—তিনি নিজে ঈশ্বর, আমি খুব বিশ্বাস করি। কিন্তু ‘ইতি’ করিবার শক্তি কাহারও নাই। ঈশ্বরেরও আপনাকে limited (সীমাবদ্ধ) করিবার শক্তি নাই। তুমি যে ‘সূত্তনিপাত’ হইতে গণ্ডারসূত্ত তর্জমা লিখিয়াছ, তাহা অতি উত্তম। ঐ গ্রন্থে ঐ প্রকার আর একটি ধনীর সূত্ত আছে, তাহাতেও প্রায় ঐ ভাব। ‘ধম্মপদ’-মতেও ঐ প্রকার অনেক কথা আছে। কিন্তু সেও শেষে যখন ‘জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ’১৭—যাহার শরীরের উপর অণুমাত্র শারীর বোধ নাই, তিনি মদমত্ত হস্তীর ন্যায় ইতস্ততঃ বিচরণ করিবেন। আমার ন্যায় ক্ষুদ্র প্রাণী এক জায়গায় বসিয়া সাধন করিয়া সিদ্ধ হইলে তখন ঐ প্রকার আচরণ করিবে—সে দূর—বড় দূর।
চিন্তাশূন্যমদৈন্যভৈক্ষ্যমশনং পানং সরিদ্বারিষু
স্বাতন্ত্র্যেণ নিরঙ্কুশা স্থিতিরভীর্নিদ্রা শ্মশানে বনে।
বস্ত্রং ক্ষালনশোষণাদিরহিতং দিগ্বাস্তু শয্যা মহী
সঞ্চারো নিগমান্তবীথিষু বিদাং ক্রীড়া পরে ব্রহ্মণি॥
বিমানমালম্ব্য শরীরমেতদ্
ভুনক্ত্যশেষান্ বিষয়ানুপস্থিতান্।
পরেচ্ছয়া বালবদাত্মবেত্তা
যোঽব্যক্তলিঙ্গোঽননুষক্তবাহ্যঃ॥
দিগম্বরো বাপি চ সাম্বরো বা
ত্বগম্বরো বাপি চিদম্বরস্থঃ।
উন্মত্তবদ্বাপি চ বালবদ্বা
পিশাচবদ্বাপি চরত্যবন্যাম্॥১৮
ব্রহ্মজ্ঞের ভোজন, চেষ্টা বিনা উপস্থিত হয়—যেথায় জল, তাহাই পান। আপন ইচ্ছায় ইতস্ততঃ তিনি পরিভ্রমণ করিতেছেন—তিনি ভয়শূন্য, কখনও বনে, কখনও শ্মশানে নিদ্রা যাইতেছেন; যেখানে বেদ শেষ হইয়াছে, সেই বেদান্তের পথে সঞ্চরণ করিতেছেন। আকাশের ন্যায় তাঁহার শরীর, বালকের ন্যায় পরের ইচ্ছাতে পরিচালিত; তিনি কখনও উলঙ্গ, কখনও উত্তমবস্ত্রধারী, কখনও জ্ঞানমাত্রই আচ্ছাদন, কখনও বালকবৎ, কখনও উন্মত্তবৎ, কখনও পিশাচবৎ ব্যবহার করিতেছেন।
গুরুচরণে প্রার্থানা করি যে তোমার তাহাই হউক এবং তুমি গণ্ডারবৎ ভ্রমণ কর। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৫
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
২৫ ফেব্রুআরী, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
Lumbago (কোমরের বাতে) বড় ভোগাইতেছে, নহিলে ইতিপূর্বেই যাইবার চেষ্টা দেখিতাম। এস্থানে আর মন তিষ্ঠিতেছে না। তিন দিন বাবাজীর স্থান হইতে আসিয়াছি, কিন্তু তিনি দয়া করিয়া প্রায় প্রত্যহই আমার খবর লয়েন। কোমর একটু সারিলেই বাবাজীর নিকট বিদায় লইয়া যাইতেছি। আমার অসংখ্য প্রণাম জানিবেন। ইতি
দাস
নরেন্দ্রনাথ
৩৬
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
মার্চ, ১৮৯০
প্রাণাধিকেষু,
কল্য তোমার পত্র পাইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছি। এখানে পওহারীজী নামক যে অদ্ভুত যোগী ও ভক্ত আছেন, এক্ষণে তাঁহারই কাছে রহিয়াছি। ইনি ঘরের বাহির হন না—দ্বারের আড়াল হইতে কথাবার্তা কহেন। ঘরের মধ্যে এক গর্ত আছে, তন্মধ্যে বাস করেন। শুনিতে পাই, ইনি মাস মাস সমাধিস্থ হইয়া থাকেন। ইঁহার তিতিক্ষা বড়ই অদ্ভুত। আমাদের বাঙলা ভক্তির দেশ ও জ্ঞানের দেশ, যোগের বার্তা একেবারে নাই বলিলেই হয়। যাহা কিছু আছে, তাহা কেবল বদখত দমটানা ইত্যাদি হঠযোগ—তা তো gymnastics (কসরত)। এইজন্য এই অদ্ভুত রাজযোগীর নিকট রহিয়াছি—ইনি কতক আশাও দিয়াছেন। এখানে একটি বাবুর একটি ছোট্ট বাগানে একটি সুন্দর বাংলা-ঘর আছে; ঐ ঘরে থাকিব এবং উক্ত বাগান বাবাজীর কুটীরের অতি নিকট। বাবাজীর একজন দাদা ঐখানে সাধুদের সৎকারের জন্য থাকে, সেই স্থানেই ভিক্ষা করিব। অতএব এ রঙ্গ কতদূর গড়ায়, দেখিবার জন্য এক্ষণে পর্বতারোহণ-সংকল্প ত্যাগ করিলাম। এবং কোমরে দুমাস ধরিয়া একটা বেদনা—বাত (lumbago)—হইয়াছে, তাহাতেও পাহাড়ে উঠা এক্ষণে অসম্ভব। অতএব বাবাজী কি দেন, পড়িয়া পড়িয়া দেখা যাউক।
আমার motto (মূলমন্ত্র) এই যে, যেখানে যাহা কিছু উত্তম পাই, তাহাই শিক্ষা করিব। ইহাতে বরাহনগরের অনেকে মনে করে যে, গুরুভক্তির লাঘব হইবে। আমি ঐ কথা পাগল এবং গোঁড়ার কথা বলিয়া মনে করি। কারণ, সকল গুরুই এক এবং জগদ্গুরুর অংশ ও আভাসস্বরূপ।
তুমি যদি গাজীপুরে আইস, গোরাবাজারের সতীশবাবু অথবা গগনবাবুর নিকট আসিলেই আমার সন্ধান পাইবে। অথবা পওহারী বাবা এত প্রসিদ্ধ ব্যক্তি যে, ইঁহার নামমাত্রেই সকলে বলিবে, এবং তাঁহার আশ্রমে যাইয়া পরমহংসজীর খোঁজ করিলেই সকলে বলিয়া দিবে। মোগলসরাই ছাড়াইয়া দিলদারনগর ষ্টেশনে নামিয়া Branch Railway (শাখা রেল) একটু আছে; তাহাতে তারিঘাট—গাজীপুরের আড়পারে নামিয়া গঙ্গা পার হইয়া আসিতে হয়।
এক্ষণে আমি গাজীপুরে কিছুদিন রহিলাম; দেখি বাবাজী কি করেন। তুমি যদি আইস, দুইজনে উক্ত কুটীরে কিছুদিন থাকিয়া পরে পাহাড়ে বা যেথায় হয়, যাওয়া যাইবে। আমি গাজীপুরে আছি, একথা বরাহনগরে কাহাকেও লিখিও না। আমার আশীর্বাদ জানিবে।
সতত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী
নরেন্দ্র
৩৭
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৩ মার্চ, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র এইমাত্র পাইলাম। আপনি জানেন না—কঠোর বৈদান্তিক মত সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত নরম প্রকৃতির লোক। উহাই আমার সর্বনাশ করিতেছে। একটুকুতেই এলাইয়া যাই, কত চেষ্টা করি যে, খালি আপনার ভাবনা ভাবি। কিন্তু বারংবার পরের ভাবনা ভাবিয়া ফেলি। এবার বড় কঠোর হইয়া নিজের চেষ্টার জন্য বাহির হইয়াছিলাম—এলাহাবাদে এক ভ্রাতার পীড়ার সংবাদ পাইয়া অমনি ছুটিতে হইল। আবার এই হৃষীকেশের খবর—মন ছুটিয়াছে। শরৎকে এক টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছি, আজিও উত্তর আইসে নাই—এমন স্থান, টেলিগ্রাম আসিতেও এত দেরী! কোমরের বেদনা কিছুতেই ছাড়িতে চায় না, বড় যন্ত্রণা হইতেছে। পওহারীজীর সঙ্গে আর দেখা করিতে কয়েক দিন যাইতে পারি নাই, কিন্তু তাঁহার বড় দয়া, প্রত্যহ লোক পাঠাইয়া খবর নেন। কিন্তু এখন দেখিতেছি ‘উল্টা সমঝ্লি রাম!’—কোথায় আমি তাঁহার দ্বারে ভিখারী, তিনি আমার কাছে শিখিতে চাহেন! বোধ হয়—ইনি এখনও পূর্ণ হয়েন নাই, কর্ম এবং ব্রত এবং আচার অত্যন্ত, এবং বড় গুপ্তভাব। সমুদ্র পূর্ণ হইলে কখনও বেলাবদ্ধ থাকিতে পারে না, নিশ্চিত। অতএব অনর্থক ইঁহাকে উদ্বেজিত করা ঠিক নহে স্থির করিয়াছি; এবং বিদায় লইয়া শীঘ্রই প্রস্থান করিব। কি করি, বিধাতা নরম করিয়া যে কাল করিয়াছেন! বাবাজী ছাড়েন না, আবার গগনবাবু (ইঁহাকে আপনি বোধ হয় জানেন, অতি ধার্মিক, সাধু এবং সহৃদয় ব্যক্তি) ছাড়েন না। টেলিগ্রামে যদ্যপি আমার যাইবার আবশ্যক হয়, যাইব; যদ্যপি না হয়, দুই-চারি দিনে কাশীধামে ভবৎসকাশে উপস্থিত হইতেছি। আপনাকে ছাড়িতেছি না—হৃষীকেশে লইয়া যাইবই, কোন ওজর আপত্তি চলিবে না। শৌচের কথা কি বলিতেছেন? পাহাড়ে জলের অভাব—স্থানের অভাব? তীর্থ এবং সন্ন্যাসী—কলিকালের? টাকা খরচ করিলে সত্রওয়ালারা ঠাকুর ফেলিয়া দিয়া ঘর ছাড়িয়া দেয়, স্থানের কা কথা!! কোন গোল নাই, এতদিনে গরম আরম্ভ হইয়াছে, তবে কাশীর গরম হইবে না—সে তো ভালই। রাত্রে বেশ ঠাণ্ডা চিরকাল, তাহাতে নিদ্রা উত্তমরূপ হইবারই কথা।
আপনি অত ভয় পান কেন? আমি guarantee (দায়ী), আপনি নিরাপদে ঘরে ফিরিবেন এবং কোন কষ্ট হইবে না। ব্রিটিশ রাজ্যে কষ্ট ফকিরের, গৃহস্থের কোন কষ্ট নাই, ইহা আমার experience (অভিজ্ঞতা)।
সাধ করে বলি—আপনার সঙ্গে পূর্বের সম্বন্ধ? এক চিঠিতে আমার সকল resolution (সংকল্প) ভেসে গেল, আবার সব ফেলে গুটি গুটি কাশী চলিলাম। ইতি
গঙ্গাধর ভায়াকে ফের এক চিঠি লিখিয়াছি, এবার তাঁহাকে মঠে যাইতে বলিয়াছি। যদি যান, অবশ্যই কাশী হইয়া যাইবেন ও আপনার সহিত দেখা হইবে। আজকাল কাশীর স্বাস্থ্য কেমন? এ স্থানে থাকিয়া আমার ম্যালেরিয়া সম্বন্ধে সকল (উপসর্গ) সারিয়াছে, কেবল কোমরের বেদনায় অস্থির, দিন রাত কনকন করে এবং জ্বালাতন করিতেছে—কেমন করিয়া বা পাহাড়ে উঠিব, ভাবিতেছি। বাবাজীর তিতিক্ষা অদ্ভুত, তাই কিছু ভিক্ষা করিতেছি, কিন্তু উপুড় হস্তের নামটি নাই, খালি গ্রহণ! খালি গ্রহণ! অতএব আমিও প্রস্থান।
দাস
নরেন্দ্রনাথ
পুঃ—আর কোন মিঞার কাছে যাইব না—
‘আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারু ঘরে,
যা চাবি তাই বসে পাবি, খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।
পরম ধন এই পরশমণি, যা চাবি তাই দিতে পারে,
এমন কত মণি পড়ে আছে চিন্তামণির নাচদুয়ারে।’
এখন সিদ্ধান্ত এই যে—রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নাই, সে অপূর্ব সিদ্ধি, আর সে অপূর্ব অহেতুকী দয়া, সে intense sympathy (প্রগাঢ় সহানুভূতি) বদ্ধ-জীবনের জন্য—এ জগতে আর নাই। হয়, তিনি অবতার—যেমন তিনি নিজে বলিতেন, অথবা বেদান্তদর্শনে যাহাকে নিত্যসিদ্ধ মহাপুরুষ ‘লোকহিতায় মুক্তোঽপি শরীরগ্রহণকারী’ বলা হইয়াছে, নিশ্চিত নিশ্চিত ইতি মে মতিঃ, এবং তাঁহার উপাসনাই পাতঞ্জলোক্ত ‘মহাপুরুষ-প্রণিধানাদ্বা।’১৯
তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি কখনও আমার প্রার্থনা গরমঞ্জুর করেন নাই—আমার লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিয়াছেন—এত ভালবাসা আমার পিতামাতায় কখনও বাসেন নাই। ইহা কবিত্ব নহে, অতিরঞ্জিত নহে, ইহা কঠোর সত্য এবং তাঁহার শিষ্যমাত্রেই জানে। বিপদে, প্রলোভনে ‘ভগবান্ রক্ষা কর’ বলিয়া কাঁদিয়া সারা হইয়াছি—কেহই উত্তর দেয় নাই—কিন্তু এই অদ্ভুত মহাপুরুষ বা অবতার বা যাই হউন, নিজ অন্তর্যামিত্বগুণে আমার সকল বেদনা জানিয়া নিজে ডাকিয়া জোর করিয়া সকল অপহৃত করিয়াছেন। যদি আত্মা অবিনাশী হয়—যদি এখনও তিনি থাকেন, আমি বারংবার প্রার্থনা করি—হে অপারদয়ানিধে, হে মমৈকশরণদাতা রামকৃষ্ণ ভগবান্, কৃপা করিয়া আমার এই নরশ্রেষ্ঠ বন্ধুবরের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কর। আপনার সকল মঙ্গল—এ জগতে কেবল যাঁহাকে অহেতুকদয়াসিন্ধু দেখিয়াছি—তিনিই করুন। শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।
দাস নরেন্দ্র
পুনঃ—পত্রপাঠ উত্তর দিবেন। নরেন্দ্র
৩৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৮ মার্চ, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র পাইলাম, অতএব আমিও প্রয়াগ যাইতেছি। আপনি প্রয়াগে কোথায় থাকিবেন, অনুগ্রহ করিয়া লিখিবেন। ইতি
দাস
নরেন্দ্র
পুঃ—দুই-এক দিনের মধ্যে অভেদানন্দ যদ্যপি আইসেন, তাঁহাকে কলিকাতায় রওনা করিয়া দিলে অত্যন্ত অনুগৃহীত হইব।
নরেন্দ্র
৩৯
নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
১১ মার্চ, ১৮৯০
বলরামবাবু,
Receipt (রসিদ) পাইবামাত্র লোক পাঠাইয়া Fairlie Place (ফেয়ার্লি প্লেস) রেলওয়ে গুদাম হইতে গোলাপ ফুল আনাইয়া শশীকে পাঠাইয়া দিবেন। আনাইতে বা পাঠাইতে বিলম্ব না হয়।
বাবুরাম Allahabad (এলাহাবাদ) যাইতেছে শীঘ্র—আমি আর এক জায়গায় চলিলাম।
নরেন্দ্র
P.S. দেরী হলে সব খারাপ হইয়া যাইবে—নিশ্চিত জানিবেন।
নরেন্দ্র
৪০
[বলরামবাবুকে লিখিত]
রামকৃষ্ণো জয়তি
গাজীপুর
১৫ মার্চ, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র কল্য পাইয়াছি। সুরেশবাবুর পীড়া অত্যন্ত কঠিন শুনিয়া অতি দুঃখিত হইলাম। অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহাই হইবে। আপনারও পীড়া হইয়াছে, দুঃখের বিষয়। ‘অহং’-বুদ্ধি যতদিন থাকে, ততদিন চেষ্টার ত্রুটি হইলে তাহাকে আলস্য এবং দোষ এবং অপরাধ বলা যায়। যাঁহার উক্ত বুদ্ধি নাই, তাঁহার সম্বন্ধে তিতিক্ষাই ভাল। জীবাত্মার বাসভূমি এই শরীর কর্মের সাধনস্বরূপ—ইহাকে যিনি নরককুণ্ড করেন, তিনি অপরাধী এবং যিনি অযত্ন করেন, তিনিও দোষী। যেমন সামনে আসিবে, খুঁত খুঁত কিছু মাত্র না করিয়া তেমনই করিয়া যাউন।
‘নাভিনন্দেত মরণং নাভিনন্দেত জীবিতম্।
কালমেব প্রতীক্ষেত নিদেশং ভূতকো যথা॥’
যেটুকু সাধ্য সেটুকু করা, মরণও ইচ্ছা না করিয়া এবং জীবনও ইচ্ছা না করিয়া—ভৃত্যের ন্যায় আজ্ঞা প্রতীক্ষা করিয়া থাকাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
কাশীতে অত্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জা হইতেছে—প্রমদাবাবু প্রয়োগে গিয়াছেন। বাবুরাম হঠাৎ এ স্থানে আসিয়াছে, তাহার জ্বর হইয়াছে—এমন অবস্থায় বাহির হওয়া ভাল হয় নাই। কালীকে২০ ১০৲ টাকা পাঠানো গিয়াছে—সে বোধ হয় গাজীপুর হইয়া কলিকাতাভিমুখে যাইবে। আমি কল্য এস্থান হইতে চলিলাম। কালী আসিয়া আপনাদের পত্র লিখিলে যাহা হয় করিবেন। আমি লম্বা। আর পত্র লিখিবেন না, কারণ আমি এস্থান হইতে চলিলাম। বাবুরাম ভাল হইয়া যাহা ইচ্ছা করিবেন।
ফুল—বোধ হয় রিসিট (রসিদ) প্রাপ্তিমাত্রই আনাইয়া লইয়াছেন। মাতাঠাকুরাণীকে আমার অসংখ্য প্রণাম।
আপনারা আশীর্বাদ করুন যেন আমার সমদৃষ্টি হয়—সহজাত বন্ধন ছাড়াইয়া পাতানো বাঁধনে আবার যেন না ফাঁসি। যদি কেহ মঙ্গলকর্তা থাকেন এবং যদি তাঁহার সাধ্য এবং সুবিধা হয়, আপনাদের পরম মঙ্গল হউক—ইহাই আমার দিবারাত্র প্রার্থনা। কিমধিকমিতি—
দাস
নরেন্দ্র
৪১
গাজীপুর
১৫ মার্চ, ১৮৯০
অতুলবাবু,২১
আপনার মনের অবস্থা খারাপ জানিয়া বড়ই দুঃখিত হইলাম—যাহাতে আনন্দে থাকেন তাহাই করুন।
যাবজ্জননং তাবন্মরণং
তাবজ্জননীজঠরে শয়নং
ইতি সংসারে স্ফুটতরদোষঃ
কথমিহ মানব তব সন্তোষঃ।২২
দাস
নরেন্দ্র
পুঃ—আমি কল্য এস্থান হইতে চলিলাম—দেখি অদৃষ্ট কোথায় লইয়া যায়।
৪২
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
মার্চ, ১৮৯০
প্রাণাধিকেষু,
এইমাত্র তোমার আর একখানি পত্র পাইলাম—হিজিবিজি বহু কষ্টে বুঝিলাম। পূর্বের পত্রে সমস্ত লিখিয়াছি। তুমি পত্রপাঠ চলিয়া আসিবে। তুমি যে নেপাল হইয়া তিব্বতের পথ বলিয়াছ, তাহা আমি জানি। যে প্রকার তিব্বতে সহজে কাহাকেও যাইতে দেয় না, ঐপ্রকার নেপালেও কাটামুণ্ড রাজধানী ও দুই-এক তীর্থ ছাড়া কাহাকেও কোথাও যাইতে দেয় না। কিন্তু আমার একজন বন্ধু এক্ষণে নেপালের রাজার ও রাজার স্কুলের শিক্ষক—তাঁহার কাছে শুনিয়াছি যে, বৎসর বৎসর যখন নেপাল হইতে চীন দেশে রাজকর যায়, সে সময় লাসা হইয়া যায়। একজন সাধু—যোগাড় করিয়া ঐ রকমে লাসা, চীন এবং মাঞ্চুরিয়ায় (উত্তর চীন)—তারাদেবীর পীঠ পর্যন্ত গিয়াছিল। উক্ত বন্ধু চেষ্টা করিলে আমরাও মান্য ও খাতিরের সহিত তিব্বত, লাসা, চীন সব দেখিতে পারিব। অতএব তুমি অবিলম্বে গাজীপুরে চলিয়া আইস। এথায় আমি বাবাজীর কাছে কিছুদিন থাকিয়া, উক্ত বন্ধুকে চিঠি পত্র লিখিয়া নেপাল হইয়া নিশ্চিত তিব্বতাদি যাইব। কিমধিকমিতি। দিলদারনগর ষ্টেশনে নামিয়া গাজীপুরে আসিতে হয়। দিলদারনগর মোগলসরাই ষ্টেশনের তিন-চার ষ্টেশনের পর। এথায় ভাড়া যোগাড় করিতে পারিলে পাঠাইতাম; অতএব তুমি যোগাড় করিয়া আইস। গগনবাবু—যাঁহার আশ্রয়ে আমি আছি—এত ভদ্র, উদার এবং হৃদয়বান্ ব্যক্তি যে কি লিখিব! তিনি কালীর জ্বর শুনিয়া হৃষীকেশে তৎক্ষণাৎ ভাড়া পাঠাইলেন এবং আমার জন্য আরও অনেক ব্যয় করিয়াছেন। এ অবস্থায় আবার তাঁহাকে কাশ্মীরের ভাড়ার জন্য ভারগ্রস্ত করা সন্ন্যাসীর ধর্ম নহে জানিয়া নিরস্ত হইলাম। তুমি যোগাড় করিয়া পত্রপাঠ চলিয়া আইস। অমরনাথ দেখিবার বাতিক এখন থাক। ইতি
নরেন্দ্র
৪৩
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
গাজীপুর
৩১ মার্চ, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আমি কয়েক দিবস এস্থানে ছিলাম না এবং অদ্যই পুনর্বার চলিয়া যাইব। গঙ্গাধর ভায়াকে এস্থানে আসিতে লিখিয়াছি। যদি আইসেন, তাহা হইলে তৎসহ আপনার সন্নিধানে যাইতেছি। কতকগুলি বিশেষ কারণবশতঃ এস্থানের কিয়দ্দুরে এক গ্রামে গুপ্তভাবে কিছুদিন থাকিব, সে স্থান হইতে পত্র লিখিবার কোন সুবিধা নাই। এইজন্যই আপনার পত্রের উত্তর দিতে পারি নাই। গঙ্গাধর-ভায়া বোধ করি আসিতেছেন, না হইলে আমার পত্রের উত্তর আসিত। অভেদানন্দ-ভায়া কাশীতে প্রিয় ডাক্তারের নিকট আছেন। আর একটি গুরুভাই আমার নিকটে ছিলেন, তিনি অভেদানন্দের নিকট গিয়াছেন। তাঁহার পৌঁছানো সংবাদ পাই নাই। তাঁহারও শরীর ভাল নহে, তজ্জন্য অত্যন্ত চিন্তিত আছি। তাঁহার সহিত আমি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছি, অর্থাৎ আমার সঙ্গ ত্যাগ করিবার জন্য তাঁহাকে অত্যন্ত বিরক্ত করিয়াছি। কি করি, আমি বড়ই দুর্বল, বড়ই মায়াসমাচ্ছন্ন—আশীর্বাদ করুন, যেন কঠিন হইতে পারি। আমার মানসিক অবস্থা আপনাকে কি বলিব, মনের মধ্যে নরক দিবারাত্রি জ্বলিতেছে—কিছুই হইল না, এ জন্ম বুঝি বিফলে গোলমাল করিয়া গেল; কি করি, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। বাবাজী মিষ্ট মিষ্ট বুলি বলেন, আর আটকাইয়া রাখেন। আপনাকে কি বলিব, আমি আপনার চরণে শত শত অপরাধ করিতেছি—অন্তর্যাতনায় ক্ষিপ্ত ব্যক্তির কৃত বলিয়া সে সকল মার্জনা করিবেন। অভেদানন্দের রক্তামাশয় হইয়াছে। কৃপা করিয়া যদি তাঁহার তত্ত্ব লন এবং যিনি এস্থান হইতে গিয়াছেন, তাঁহার সঙ্গে যদি মঠে ফিরিয়া যাইতে চান, পাঠাইয়া দিলে বিশেষ অনুগৃহীত হইব। আমার গুরু ভ্রাতারা আমাকে অতি নির্দয় ও স্বার্থপর বোধ করিতেছেন। কি করি, মনের মধ্যে কে দেখিবে? আমি দিবারাত্রি কি যাতনা ভুগিতেছি, কে জানিবে? আশীর্বাদ করুন, যেন অটল ধৈর্য ও অধ্যবসায় আমার হয়। আমার শতকোটি প্রণাম জানিবেন।
দাস
নরেন্দ্র
পুঃ—প্রিয়বাবু ডাক্তারের বাটী সোনারপুরাতে অভেদানন্দ আছেন। আমার কোমরের বেদনা সেই প্রকারই আছে।
দাস নরেন্দ্র
৪৪
[স্বামী অভেদানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
গাজীপুর
২ এপ্রিল, ১৮৯০
ভাই কালী,
তোমার, প্রমদাবাবুর ও বাবুরামের হস্তাক্ষর পাইয়াছি। আমি এ স্থানে একরকম মন্দ নাই। তোমার আমাকে দেখিবার ইচ্ছা হইয়াছে, আমারও বড় ঐরূপ হয়, সেই ভয়েই যাইতে পারিতেছি না—তার উপর বাবাজী বারণ করেন। দুই-চারি দিনের বিদায় লইয়া যাইতে চেষ্টা করিব। কিন্তু ভয় এই তাহা হইলে একেবারে, হৃষীকেশী টানে পাহাড়ে টেনে তুলবে—আবার ছাড়ানো বড় কঠিন হইবে, বিশেষ আমার মত দুর্বলের পক্ষে। কোমরের বেদনাটাও কিছুতেই সারে না—cadaverous (জঘন্য)। তবে অভ্যাস পড়ে আসছে। প্রমদাবাবুকে আমার কোটি কোটি প্রণাম দিবে, তিনি আমার শরীর ও মনের বড় উপকারী বন্ধু ও তাঁহার নিকট আমি বিশেষ ঋণী। যাহা হয় হইবে। ইতি
শুভাকাঙ্ক্ষী
নরেন্দ্র
৪৫
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
গাজীপুর
২ এপ্রিল, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
মহাশয়, বৈরাগ্যাদি সম্বন্ধে আমাকে যে আজ্ঞা করিয়াছেন, আমি তাহা কোথায় পাইব? তাহারই চেষ্টায় ভবঘুরেগিরি করিতেছি। যদি কখনও যথার্থ বৈরাগ্য হয়, মহাশয়কে বলিব; আপনিও যদি কিছু পান, আমি ভাগীদার আছি—মনে রাখিবেন। কিমধিকমিতি—
দাস নরেন্দ্র
৪৬
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
রামকৃষ্ণো জয়তি
গাজীপুর
১০ মে, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
বহুবিধ গোলমালে এবং পুনরায় জ্বর হওয়ায় আপনাকে পত্র লিখিতে পারি নাই। অভেদানন্দের পত্রে আপনার কুশল অবগত হইয়া বিশেষ আনন্দিত হইলাম। গঙ্গাধর ভায়া বোধ হয় এতদিনে ৺কাশীধামে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন। এ স্থানে এ সময়ে যমরাজ বহু বন্ধু এবং আত্মীয়কে গ্রাস করিতেছেন, তজ্জন্য বিশেষ ব্যস্ত আছি। নেপাল হইতে আমার কোন পত্রাদি বোধ হয় আইসে নাই। বিশ্বনাথ কখন এবং কিরূপে আমাকে rest (বিশ্রাম) দিবেন, জানি না। একটু গরম কমিলেই এ স্থান হইতে পলাইতেছি, কোথা যাই বুঝিতে পারিতেছি না। আপনি আমার জন্য ৺বিশ্বনাথ-সকাশে প্রার্থনা করিবেন, শূলী যেন আমাকে বল দেন। আপনি ভক্ত, এবং ‘মদ্ভক্তানাঞ্চ যে ভক্তাস্তে মে ভক্ততমা মতাঃ’ ইতি ভগবদ্বাক্য স্মরণ করিয়া আপনাকে বিনয় করিতেছি। কিমধিকমিতি—
দাস
নরেন্দ্র
৪৭
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
৫৭, রামকান্ত বসু ষ্ট্রীট
বাগবাজার, কলিকাতা
২৬ মে, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
বহু বিপদ্ঘটনার আবর্ত এবং মনের আন্দোলনের মধ্যে পড়িয়া আপনাকে এই পত্র লিখিতেছি; বিশ্বনাথের নিকট প্রার্থনা করিয়া ইহার যুক্তিযুক্ততা এবং সম্ভবাসম্ভবতা বিবেচনা করিয়া উত্তর দিয়া কৃতার্থ করিবেন।
১। প্রথমেই আপনাকে বলিয়াছি যে, আমি রামকৃষ্ণের গোলাম—তাঁহাকে ‘দেই তুলসী তিল দেহ সমর্পিনুঁ’ করিয়াছি। তাঁহার নির্দেশ লঙ্ঘন করিতে পারি না। সেই মহাপুরুষ যদ্যপি ৪০ বৎসর যাবৎ এই কঠোর ত্যাগ, বৈরাগ্য এবং পবিত্রতা এবং কঠোরতম সাধন করিয়া ও অলৌকিক জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম ও বিভূতিমান্ হইয়াও অকৃতকার্য হইয়া শরীর ত্যাগ করিয়া থাকেন, তবে আমাদের আর কি ভরসা? অতএব তাঁহার বাক্য আপ্তবাক্যের ন্যায় আমি বিশ্বাস করিতে বাধ্য।
২। আমার উপর তাঁহার নির্দেশ এই যে, তাঁহার দ্বারা স্থাপিত এই ত্যাগিমণ্ডলীর দাসত্ব আমি করিব, ইহাতে যাহা হইবার হইবে, এবং স্বর্গ বা নরক বা মুক্তি যাহাই আসুক, লইতে রাজী আছি।
৩। তাঁহার আদেশ এই যে, তাঁহার ত্যাগী সেবকমণ্ডলী যেন একত্রিত থাকে এবং তজ্জন্য আমি ভারপ্রাপ্ত। অবশ্য কেহ কেহ এদিক ওদিক বেড়াইতে গেল, সে আলাদা কথা—কিন্তু সে বেড়ানো মাত্র, তাঁহার মত এই ছিল যে এক পূর্ণ সিদ্ধ—তাঁহার ইতস্ততঃ বিচরণ সাজে। তা যতক্ষণ না হয়, এক জায়গায় বসিয়া সাধনে নিমগ্ন হওয়া উচিত। আপনা-আপনি যখন সকল দেহাদি ভাব চলিয়া যাইবে, তখন যাহার যে প্রকার অবস্থা হইবার হইবে, নতুবা প্রবৃত্ত সাধকের পক্ষে ক্রমাগত বিচরণ অনিষ্টজনক।
৪। অতএব উক্ত নির্দেশক্রমে তাঁহার সন্ন্যাসিমণ্ডলী বরাহনগরে একটি পুরাতন জীর্ণ বাটীতে একত্রিত আছেন, এবং সুরেশচন্দ্র মিত্র এবং বলরাম বসু নামক তাঁহার দুইটি গৃহস্থ শিষ্য তাঁহাদের আহারাদি নির্বাহ এবং বাটী ভাড়া দিতেন।
৫। ভগবান্ রামকৃষ্ণের শরীর নানা কারণে (অর্থাৎ খ্রীষ্টিয়ান রাজার অদ্ভুত আইনের জ্বালায়) অগ্নিসমর্পণ করা হইয়াছিল। এই কার্য যে অতি গর্হিত তাহার আর সন্দেহ নাই। এক্ষণে তাঁহার ভস্মাবশেষ অস্থি সঞ্চিত আছে, উহা গঙ্গাতীরে কোন স্থানে সমাহিত করিয়া দিতে পারিলে উক্ত মহাপাপ হইতে কথঞ্চিৎ বোধ হয় মুক্ত হইব। উক্ত অবশেষ এবং তাঁহার গদির এবং প্রতিকৃতি যথানিয়মে আমাদিগের মঠে প্রত্যহ পূজা হইয়া থাকে এবং আমার এক ব্রাহ্মণকুলোদ্ভব গুরুভ্রাতা উক্ত কার্যে দিবারাত্র লাগিয়া আছেন, ইহা আপনার অজ্ঞাত নহে। উক্ত পূজাদির ব্যয়ও উক্ত দুই মহাত্মা করিতেন।
৬। যাঁহার জন্মে আমাদিগের বাঙালীকুল পবিত্র ও বঙ্গভূমি পবিত্র হইয়াছে—যিনি এই পাশ্চাত্য বাক্ছটায় মোহিত ভারতবাসীর পুনরুদ্ধারের জন্য অবতীর্ণ হইয়াছিলেন—যিনি সেই জন্যই অধিকাংশ ত্যাগী শিষ্যমণ্ডলী University men (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ) হইতেই সংগ্রহ করিয়াছিলেন, এই বঙ্গদেশে তাঁহার সাধনভূমির সন্নিকটে তাঁহার কোন স্মরণচিহ্ন হইল না, ইহার পর আর আক্ষেপের কথা কি আছে?
৭। পূর্বোক্ত দুই মহাত্মার নিতান্ত ইচ্ছা ছিল যে, গঙ্গাতীরে একটি জমি ক্রয় করিয়া তাঁহার অস্থি সমাহিত করা হয় এবং তাঁহার শিস্যবৃন্দও তথায় বাস করেন এবং সুরেশবাবু তজ্জন্য ১০০০৲ টাকা দিয়াছিলেন; এবং আরও অর্থ দিবেন বলিয়াছিলেন, কিন্তু ঈশ্বরের গূঢ় অভিপ্রায়ে তিনি কল্য রাত্রে ইহলোকে ত্যাগ করিয়াছেন। বলরামবাবু মৃত্যুসংবাদ আপনি পূর্ব হইতেই জানেন।
৮। এক্ষণে তাঁহার শিষ্যেরা তাঁহার এই গদি ও অস্থি লইয়া কোথায় যায়, কিছুই স্থিরতা নাই। (বঙ্গদেশের লোকের কথা অনেক, কাজে এগোয় না, আপনি জানেন।) তাঁহারা সন্ন্যাসী; তাঁহারা এইক্ষণেই যথা ইচ্ছা যাইতে প্রস্তুত; কিন্তু তাঁহাদিগের এই দাস মর্মান্তিক বেদনা পাইতেছে, এবং ভগবান্ রামকৃষ্ণের অস্থি সমাহিত করিবার জন্য গঙ্গাতীরে একটু স্থান হইল না, ইহা মনে করিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে।
৯। ১০০০৲ টাকায় কলিকাতার সন্নিকটে গঙ্গাতীরে জমি এবং মন্দির হওয়া অসম্ভব, অন্যূন ৫।৭ হাজার টাকার কমে জমি হয় না।
১০। আপনি এক্ষণে রামকৃষ্ণের শিষ্যদিগের একমাত্র বন্ধু এবং আশ্রয় আছেন। পশ্চিম দেশে আপনার মান এবং সম্ভ্রম এবং আলাপও যথেষ্ট; আমি প্রার্থনা করিতেছি যে যদি আপনার অভিরুচি হয়, উক্ত প্রদেশের আপনার আলাপী ধার্মিক ধনবানদিগের নিকট চাঁদা করিয়া এই কার্যনির্বাহ হওয়ানো আপনার উচিত কি না, বিবেচনা করিবেন। যদি ভগবান্ রামকৃষ্ণের সমাধি এবং তাঁহার শিষ্যদিগের বঙ্গদেশে গঙ্গাতটে আশ্রয়স্থান হওয়া উচিত বিবেচনা করেন, আমি আপনার অনুমতি পাইলেই ভবৎসকাশে উপস্থিত হইব এবং এই কার্যের জন্য, আমার প্রভুর জন্য এবং প্রভুর সন্তানদিগের জন্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নহি। বিশেষ বিবেচনা করিয়া এবং বিশ্বনাথের নিকট প্রার্থনা করিয়া এই কথা অনুধাবন করিবেন। আমার বিবেচনায় যদি এই অতি অকপট, বিদ্বান্, সৎকুলোদ্ভুত যুবা সন্ন্যাসিগণ স্থানাভাবে এবং সাহায্যাভাবে রামকৃষ্ণের ideal (আদর্শ) ভাব লাভ করিতে না পারেন, তাহা হইলে আমাদের দেশের ‘অহো দুর্দৈবম্’।
১১। যদি বলেন, ‘আপনি সন্ন্যাসী, আপনার এ সকল বাসনা কেন?’—আমি বলি, আমি রামকৃষ্ণের দাস—তাঁহার নাম তাঁহার জন্ম ও সাধন-ভূমিতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করিতে ও তাঁহার শিষ্যগণের সাধনের অণুমাত্র সহায়তা করিতে যদি আমাকে চুরি ডাকাতি করিতে হয়, আমি তাহাতেও রাজী। আপনাকে পরমাত্মীয় বলিয়া জানি, আপনাকে সকল বলিলাম। এইজন্যই কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম। আপনাকে বলিয়া আসিয়াছি, আপনার বিচারে যাহা হয় করিবেন।
১২। যদি বলেন যে ৺কাশী-আদি স্থানে আসিয়া করিলে সুবিধা হয়, আপনাকে বলিয়াছি যে, তাঁহার জন্মভূমে এবং সাধনভূমে তাঁহার সমাধি হইবে না, কি পরিতাপ! এবং বঙ্গভূমির অবস্থা বড়ই শোচনীয়। ‘ত্যাগ’ কাহাকে বলে এদেশের লোকে স্বপ্নেও ভাবে না, কেবল বিলাস, ইন্দ্রিয়পরতা ও স্বার্থপরতা এদেশের অস্থিমজ্জা ভক্ষণ করিতেছে। ভগবান্ এদেশে বৈরাগ্য ও অসংসারিত্ব প্রেরণ করুন। এদেশের লোকের কিছুই নাই, পশ্চিম দেশের লোকের, বিশেষ ধনীদিগের, এ সকল কার্যে অনেক উৎসাহ—আমার বিশ্বাস। যাহা বিবেচনায় হয়, উত্তর দিবেন। গঙ্গাধর আজিও পৌঁছান নাই, কালি হয়তো আসিতে পারেন। তাঁহাকে দেখিতে বড় উৎকণ্ঠা।ইতি—দাস
নরেন্দ্র
পুনঃ—উল্লিখিত ঠিকানায় পত্র দিবেন।
৪৮
[প্রমদাবাবুকে লিখিত]
ঈশ্বরো জয়তি
বাগবাজার, কলিকাতা
৪ জুন, ১৮৯০
পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র পাইয়াছি। আপনার পরামর্শ অতি বুদ্ধিমানের পরামর্শ, তদ্বিষয়ে সন্দেহ কি; তাঁহার যাহা ইচ্ছা তাহাই হইবে—বড় ঠিক কথা। আমরাও এ স্থানে ও স্থানে দুই চারিজন করিয়া ছড়াইতেছি। গঙ্গাধর-ভায়ার পত্র দুইখানি আমিও পাইয়াছি—ইনফ্লুয়েঞ্জা হইয়া গগনবাবুর বাটীতে আছেন এবং গগনবাবু তাঁহার বিশেষ সেবা ও যত্ন করিতেছেন। আরোগ্য হইয়াই আসিবেন। আপনি আমাদের সংখ্যাতীত দণ্ডবৎ জানিবেন। ইতি
দাস
নরেন্দ্র
অভেদানন্দ প্রভৃতি সকলে ভাল আছেন। ইতি
নরেন্দ্র
৪৯*
[স্বামী সারদানন্দকে লিখিত]
বাগবাজার, কলিকাতা
৬ জুলাই,১৮৯০
প্রিয় শরৎ ও কৃপানন্দ,
তোমাদের পত্র যথাসময়ে পাইয়াছি। শুনিতে পাই, আলমোড়া এই সময়েই সর্বাপেক্ষা স্বাস্থ্যকর, তথাপি তোমার জ্বর হইয়াছে; আশা করি, ম্যালেরিয়া নহে। গঙ্গাধরের নামে যাহা লিখিয়াছ, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সে যে তিব্বতে যাহা তাহা খাইয়াছিল, তাহা সর্বৈব মিথ্যা কথা। ... আর টাকা তোলার কথা লিখিয়াছ—সে ব্যাপারটা এইঃ তাহাকে মাঝে মাঝে ‘উদাসী বাবা’ নামে এক ব্যক্তির জন্য ভিক্ষা করিতে এবং তাহার রোজ বার আনা, এক টাকা করিয়া ফলাহার যোগাইতে হইত। গঙ্গাধর বুঝিতে পারিয়াছে যে, সে ব্যক্তি একজন পাকা মিথ্যাবাদী, কারণ সে যখন ঐ ব্যক্তির সহিত প্রথম যায়, তখনই সে তাহাকে বলিয়াছিল যে, হিমালয়ে কত আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিষ দেখিতে পাওয়া যায়। আর গঙ্গাধর এই সকল আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিষ এবং স্থান না দেখিতে পাইয়া তাহাকে পুরাদস্তুর মিথ্যাবাদী বলিয়া জানিয়াছিল, কিন্তু তথাপি তাহার যথেষ্ট সেবা করিয়াছিল ‘তা—’ইহার সাক্ষী। বাবাজীর চরিত্র সম্বন্ধেও সে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ পাইয়াছিল। এই সকল ব্যাপার এবং তার সহিত শেষ সাক্ষাৎ হইতেই সে উদাসীর উপর সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হইয়াছিল এবং এই জন্যই উদাসী প্রভুর এত রাগ। আর পাণ্ডারা—সে পাজীগুলো একেবারে পশু; তুমি তাহাদের এতটুকুও বিশ্বাস করিও না।
আমি দেখিতেছি যে, গঙ্গাধর এখনও সেই আগেকার মত কোমলপ্রকৃতির শিশুটিই আছে, এই সব ভ্রমণের ফলে তাহার ছটফটে ভাবটা একটু কমিয়াছে; কিন্তু আমাদের এবং আমাদের প্রভুর প্রতি তাহার ভালবাসা বাড়িয়াছে বৈ কমে নাই। সে নির্ভীক, সাহসী, অকপট এবং দৃঢ়নিষ্ঠ। শুধু এমন একজন লোক চাই, যাহাকে সে আপনা হইতে ভক্তিভাবে মানিয়া চলিবে, তাহা হইলেই সে একজন অতি চমৎকার লোক হইয়া দাঁড়াইবে।
এবারে আমার গাজীপুর পরিত্যাগ করিবার ইচ্ছা ছিল না, অথবা কলিকাতা আসিবার মোটেই ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কালীর পীড়ার সংবাদে আমাকে কাশী আসিতে হইল এবং বলরামবাবুর আকস্মিক মৃত্যু আমায় কলিকাতায় টানিয়া আনিল। সুরেশবাবু ও বলরাম বাবু দুই জনেই ইহলোক হইতে চলিয়া গেলেন! গিরিশচন্দ্র ঘোষ মঠের খরচ চালাইতেছেন এবং আপাততঃ ভালয় ভালয় দিন গুজরান হইয়া যাইতেছে। আমি শীঘ্রই (অর্থাৎ ভাড়ার টাকাটা যোগাড় হইলেই) আলমোড়া যাইবার সঙ্কল্প করিয়াছি। সেখান হইতে গঙ্গাতীরে গাড়োয়ালের কোন এক স্থানে গিয়া দীর্ঘকাল ধ্যানে মগ্ন হইবার ইচ্ছা; গঙ্গাধর আমার সঙ্গে যাইতেছে। বলিতে কি, আমি শুধু এই বিশেষ উদ্দেশ্যেই তাহাকে কাশ্মীর হইতে নামাইয়া আনিয়াছি।
আমার মনে হয়, তোমাদের কলিকাতা আসিবার জন্য অত ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাই। ঘোরা যথেষ্ট হইয়াছে। উহা ভাল বটে; কিন্তু দেখিতেছি, তোমরা এ পর্যন্ত একমাত্র যে জিনিষটি তোমাদের করা উচিত ছিল, সেইটিই কর নাই, অর্থাৎ কোমর বাঁধো এবং বৈঠ্ যাও। আমার মতে জ্ঞান জিনিষটা এমন কিছু সহজ জিনিষ নয় যে, তাকে ‘ওঠ ছুঁড়ী, তোর বে’ বলে জাগিয়ে দিলেই হল। আমার দৃঢ় ধারণা যে, কোন যুগেই মুষ্টিমেয় লোকের অধিক কেহ জ্ঞান লাভ করে না; এবং সেই হেতু আমাদের ক্রমাগত এ বিষয়ে লাগিয়া পড়িয়া থাকা এবং অগ্রসর হইয়া যাওয়া উচিত; তাহাতে মৃত্যু হয়, সেও স্বীকার। এই আমার পুরানো চাল, জানই তো। আর আজকালকার সন্ন্যাসীদের মধ্যে জ্ঞানের নামে যে ঠকবাজী চলিতেছে, তাহা আমার বিলক্ষণ জানা আছে। সুতরাং তোমরা নিশ্চিন্ত থাক এবং বীর্যবান্ হও। রাখাল লিখিতেছে যে, দক্ষ২৩ তাহার সঙ্গে বৃন্দাবনে আছে এবং সে সোনা প্রভৃতি তৈয়ার করিতে শিখিয়াছে, আর একজন পাকা ‘জ্ঞানী’ হইয়া উঠিয়াছে! ভগবান্ তাহাকে আশীর্বাদ করুন এবং তোমরাও বল, শান্তিঃ! শান্তিঃ!
আমার স্বাস্থ্য এখন খুব ভাল, আর গাজীপুর থাকার ফলে যে উন্নতি হইয়াছে, তাহা কিছুকাল থাকিবে বলিয়াই আমার বিশ্বাস। গাজীপুর হইতে যে সকল কাজ করিব বলিয়া এখানে আসিয়াছি, তাহা শেষ করিতে কিছুকাল লাগিবে। সেই আগেও যেরূপ বোধ হইত, আমি এখানে যেন কতকটা ভীমরুলের চাকের মধ্যে রহিয়াছি। এক দৌড়ে আমি হিমালয়ে যাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছি। এবার আর পওহারী বাবা ইত্যাদি কাহারও কাছে নহে, তাহারা কেবল লোককে নিজ উদ্দেশ্য হইতে ভ্রষ্ট করিয়া দেয়। একেবারে উপরে যাইতেছি।
আলমোড়ার জল-হাওয়া কিরূপ লাগিতেছে? শীঘ্র লিখিও। সারদানন্দ, বিশেষ করিয়া তোমার আসিয়া কাজ নাই। একটা জায়গায় সকলে মিলিয়া গুলতোন করায় আর আত্মোন্নতির মাথা খাওয়ায় কি ফল? মূর্খ ভবঘুরে হইও না, কিন্তু বীরের মত অগ্রসর হও। ‘নির্মানমোহা জিতসঙ্গদোষাঃ’২৪ ইত্যাদি। ভাল কথা, তোমার আগুনে ঝাঁপ দিবার ইচ্ছা হইল কেন? যদি দেখ যে, হিমালয়ে সাধনা হইতেছে না, আর কোথাও যাও না।
এই যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করিয়াছ, ইহাতে—তুমি যে নামিয়া আসিবার জন্য উতলা হইয়াছ, শুধু মনের এই দুর্বলতাই প্রকাশ পাইতেছে। শক্তিমান্, ওঠ এবং বীর্যবান্ হও। ক্রমাগত কাজ করিয়া যাও, বাধা-বিপত্তির সহিত যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হও। অলমিতি।
এখানকার সমস্ত মঙ্গল, শুধু বাবুরামের একটু জ্বর হইয়াছে।
তোমাদেরই
বিবেকানন্দ
৫০*
[লালা গোবিন্দ সহায়কে লিখিত]
আজমীঢ়
১৪ এপ্রিল, ১৮৯১
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
... পবিত্র এবং নিঃস্বার্থ হইতে চেষ্টা করিও—উহাতেই সমগ্র ধর্ম নিহিত। ...
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
৫১*
আবু পাহাড়
৩০ এপ্রিল, ১৮৯১
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
তুমি কি সেই ব্রাহ্মণ বালকটির উপনয়ন সম্পন্ন করিয়াছ? তুমি সংস্কৃত পড়িতেছ কি? কতদূর অগ্রসর হইলে? আশা করি প্রথমভাগ নিশ্চয়ই শেষ করিয়া থাকিবে। ... তুমি শিবপূজা সযত্নে করিতেছ তো? যদি না করিয়া থাক তো করিতে চেষ্টা করিও। ‘তোমরা প্রথমে ভগবানের রাজ্য অন্বেষণ কর, তাহা হইলেই সব পাইবে।’ ভগবানকে অনুসরণ করিলেই তুমি যাহা কিছু চাও পাইবে। ... কম্যাণ্ডার সাহেবদ্বয়কে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাইবে; তাঁহারা উচ্চপদস্থ হইয়াও আমার ন্যায় একজন দরিদ্র ফকিরের প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করিয়াছিলেন। বৎসগণ, ধর্মের রহস্য শুধু মতবাদে নহে, পরন্তু সাধনার মধ্যে নিহিত। সৎ হওয়া এবং সৎ কর্ম করাতেই সমগ্র ধর্ম পর্যবসিত। “যে শুধু ‘প্রভু প্রভু’ বলিয়া চীৎকার করে সে নহে, কিন্তু যে সেই পরমপিতার ইচ্ছানুসারে কার্য করে, সেই ধার্মিক।” তোমরা আলোয়ারবাসী যে কয়জন যুবক আছ, তোমরা সকলেই চমৎকার লোক, এবং আশা করি যে অচিরেই তোমাদের অনেকেই সমাজের অলঙ্কারস্বরূপ এবং জন্মভূমির কল্যাণের হেতুভূত হইয়া উঠিবে। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুঃ—যদিই বা মাঝে মাঝে সংসারে এক-আধটু ধাক্কা খাও, তথাপি বিচলিত হইও না; নিমিষেই উহা চলিয়া যাইবে এবং পুনরায় সব ঠিকঠাক হইয়া যাইবে।
৫২*
আবু পাহাড়, ১৮৯১
প্রিয় গোবিন্দ সহায়,
মন যে দিকেই যাউক না কেন, নিয়মিত জপ করিতে থাকিবে। হরবক্সকে বলিও যে, সে যেন প্রথমে বাম নাসায়, পরে দক্ষিণ নাসায়, এবং পুনরায় বাম নাসায়, এইক্রমে প্রাণায়াম করে। বিশেষ পরিশ্রমের সহিত সংস্কৃত শিখিবে। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
৫৩*
[শ্রীযুক্ত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
১৮৯১
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,২৫
আমার স্বাস্থ্য ও সুখ-সুবিধার সংবাদ লইতে আপনি যে একজন লোক পাঠাইয়াছেন, ইহা আপনার অপূর্ব সহৃদয়তা ও পিতৃসুলভ চরিত্রের একটুখানি পরিচয় মাত্র। আমি এখানে বেশ আছি। আপনার সহৃদয়তায় এখানে আর আমার কিছুরই অভাব নাই। আমি দু-চার দিনের মধ্যে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব বলিয়া আশা করি। এখান হইতে নামিবার সময় আমার কোন যানবাহনের প্রয়োজন নাই। অবরোহণ কষ্টসাধ্য; কিন্তু অধিরোহণ আরও কষ্টসাধ্য এবং এ কথা জগতের সব কিছু সম্বন্ধেই সমভাবে সত্য। আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করিবেন। ইতি
চির বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
৫৪*
বরোদা
২৬ এপ্রিল, ১৮৯২
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার প্রীতিপূর্ণ পত্রখানি এখানেই পেয়ে ভারী আনন্দ হল। নাড়িয়াদ ষ্টেশন থেকে আপনার বাড়ী যেতে আমার মোটেই অসুবিধা হয়নি। আপনার ভাইদের কথা কি আর বলব? আপনার ভাইদের যেমনটি হওয়া উচিত, তাঁরা ঠিক তাই! ভগবান্ আপনার পরিবারের উপর তাঁর অশেষ আশীর্বাদ বর্ষণ করুন। আমার সমস্ত পরিব্রাজক জীবনে এমন পরিবার তো আর দেখলাম না। আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মণিভাই আমার সব রকম সুবিধা করে দিয়েছেন; কিন্তু তাঁর সঙ্গে মেলামেশার এইটুকু সুযোগ হয়েছে যে, আমি তাঁকে মাত্র দুবার দেখেছি—একবার এক মিনিটের জন্য, আর একবার খুব বেশী হয়তো দশ মিনিটের জন্য। দ্বিতীয়বারে তিনি এই অঞ্চলের শিক্ষাপ্রণালীর আলোচনা করেছিলেন। তবে আমি পুস্তকালয় ও রবিবর্মার ছবি দেখেছি; আর এখানে দেখবার মত এই তো আছে! সুতরাং আজ বিকালে বোম্বে চলে যাচ্ছি। এখানকার দেওয়ানজীকে (বা আপনাকেই) তাঁর সদয় ব্যবহারের জন্য আমার ধন্যবাদ জানাবেন। বোম্বে হতে সবিশেষ লিখিব। ইতি
আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—নাড়িয়াদে শ্রীযুক্ত মণিলাল নাভুভাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি অতি বিদ্বান্ ও সাধুপ্রকৃতির ভদ্রলোক। তাঁর সাহচর্যে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।
৫৫*
পুনা
১৫ জুন, ১৮৯২
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার শেষ চিঠি পাবার পর দীর্ঘকাল কেটে গেল; আশা করি, আমি আপনার কোনরূপ বিরাগ ঘটাইনি। আমি ঠাকুরসাহেবের সহিত মহাবালেশ্বর হতে এখানে এসেছি এবং তাঁরই বাড়ীতে আছি। এখানে আরও দু-এক সপ্তাহ থাকবার ইচ্ছা আছে; তারপর হায়দরাবাদ হয়ে রামেশ্বর যাব।
ইতোমধ্যে জুনাগড়ে আপনার পথের সমস্ত বাধা হয়তো দূর হয়ে গেছে—অন্ততঃ আমার আশা তাই। আপনার স্বাস্থ্যের সংবাদ পেতে বিশেষ আগ্রহ হয়—বিশেষতঃ সেই মচকানোটার।
ভবনগরের রাজকুমারের শিক্ষক ও আপনার বন্ধু সেই সুরতি [সুরাটি?] ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে—তিনি অতি সজ্জন। তাঁর পরিচয়লাভে আমি নিজেকে ভাগ্যবান্ মনে করি; তিনি বড়ই অমায়িক ও উদারপ্রকৃতির লোক।
আপনার মহামনা সহোদরগণকে এবং আমাদের ওখানকার বন্ধুবর্গকে আমার অকৃত্রিম অভিনন্দন জানাবেন। বাড়ীতে পত্র লেখার সময় দয়া করে শ্রীযুক্ত নাভুভাইকে আমার ঐকান্তিক শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করবেন। আশা করি, সত্বর উত্তর দিয়ে কৃতার্থ করবেন।
আপনাকে ও পরিবারস্থ সকলকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং সকলের মঙ্গল কামনা করছি। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
৫৬*
বোম্বে
১৮৯২
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
এই পত্রের বাহক বাবু অক্ষয়কুমার ঘোষ আমার বিশেষ বন্ধু। সে কলিকাতার একটি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। তার পরিবারকে আমি যদিও পূর্ব হতেই জানি, তবু তাকে দেখতে পাই খাণ্ডোয়াতে এবং সেখানেই আলাপ-পরিচয় হয়।
সে খুব সৎ ও বুদ্ধিমান্ ছেলে এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আণ্ডারগ্রাজুয়েট। আপনি জানেন যে, আজকাল বাঙলাদেশের অবস্থা কি কঠিন; তাই এই যুবকটি চাকরির অন্বেষণে বেরিয়েছে। আমি আপনার স্বভাবসুলভ সহৃদয়তার সহিত পরিচিত আছি; তাই মনে হয় যে, এ যুবকটির জন্য কিছু করতে অনুরোধ করে আমি নিশ্চয়ই আপনাকে উত্ত্যক্ত করছি না। অধিক লেখা নিষ্প্রয়োজন। আপনি দেখতে পাবেন যে, সে সৎ ও পরিশ্রমী। কোন মানুষের প্রতি একটু দয়া দেখালে তার জীবন সুখময় হয়ে উঠতে পারে, এ বালক সেই দয়ার উপযুক্ত পাত্র; আপনি মহৎ ও দয়ালু, আপনাকে একথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বোধ করি না।
আশা করি, আমার এই অনুরোধে আপনি বিব্রত বা উত্ত্যক্ত হচ্ছেন না। এই আমার প্রথম ও শেষ অনুরোধ এবং বিশেষ ঘটনাচক্রে এটা করতে হল। এখন আপনার দয়ালু প্রাণই আমার আশা ও ভরসা। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
৫৭*
বোম্বে
২২ অগষ্ট, ১৮৯২
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার পত্র পেয়ে খুবই কৃতার্থ হলাম—বিশেষতঃ তাহাতে আমার প্রতি আপনার পূর্বের মত স্নেহের প্রমাণ পেয়ে।
আপনার ইন্দোরের বন্ধুর ... সহৃদয়তা ও সৌজন্য সম্বন্ধে বেশী কিছু না বলাই ভাল। তবে অবশ্য সব দক্ষিণীই কিছু সমান নয়। আমি শঙ্কর পাণ্ডুরঙ্গকে যখন পত্রে জানিয়েছিলাম যে, আমি লিমডির ঠাকুরসাহেবের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেছি, তখন তিনি তার উত্তরে মহাবালেশ্বরে আমায় যা লিখেছিলেন, তা উদ্ধৃত করলেই আপনি বিষয়টা বুঝতে পারবেনঃ
‘আপনি লিমডির ঠাকুরকে ওখানে পেয়েছেন জেনে বড়ই খুশী হলাম; নতুবা আপনাকে বড়ই মুশকিলে পড়তে হত; কারণ আমরা—মারাঠারা গুজরাতীদের মত তেমন অতিথিপরায়ণ নই।’ ...
আপনার গাঁটের ব্যথা এখন প্রায় সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়েছে জেনে খুব সুখী হলাম। দয়া করে আপনার ভাইকে আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য মাপ করতে বলবেন। আমি এখানে কিছু সংস্কৃত বই পেয়েছি এবং অধ্যায়নের সাহায্যও জুটেছে। অন্যত্র এরূপ পাবার আশা নাই; সুতরাং শেষ করে যাবার আগ্রহ হয়েছে। কাল আপনার বন্ধু শ্রীযুক্ত মনঃসুখারামের সঙ্গে দেখা হল; তিনি তাঁর এক সন্ন্যাসী বন্ধুকে বাড়ীতে রেখেছেন। তিনি আমার প্রতি খুব সহৃদয়; তাঁর পুত্রও তাই।
এখানে পনর-কুড়ি দিন, থেকে রামেশ্বর যাবার বাসনা আছে। ফিরে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করব নিশ্চিত।
আপনার ন্যায় উচ্চমনা, মহাপ্রাণ ও দয়ালু ব্যক্তিদের দ্বারাই জগতের প্রকৃত উন্নতি হয়। অন্যেরা সংস্কৃত কবির ভাষায় ‘জননীযৌবন-বনকুঠারাঃ।’
আমার প্রতি আপনার পিতৃসুলভ স্নেহ ও যত্ন আমি মোটেই ভুলতে পারি না; আবার আমার মত একজন ফকির আপনার ন্যায় একজন মহাশক্তিমান্ মন্ত্রীর উপকারের কী প্রতিদান দিতে পারে? আমি শুধু এইটুকু প্রার্থনা করতে পারি যে, সর্বমঙ্গলবিধাতা ভগবান্ আপনাকে ইহলোকে বাঞ্ছিত সমস্ত ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ করুন; আর আপনাকে অতি দীর্ঘায়ু দান করে অবশেষে তাঁর অনন্ত মঙ্গল ও শান্তিময় পবিত্র কোলে টেনে নিন। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—একটি বিষয় অতি দুঃখের সহিত উল্লেখ করছি—এ অঞ্চলে সংস্কৃত ও অন্যান্য শিক্ষার সম্পূর্ণ অভাব। এতদঞ্চলের লোকদের মধ্যে ধর্মের নামে পানাহার ও শৌচাদি বিষয়ে একরাশ কুসংস্কারপূর্ণ দেশাচার আছে—আর এগুলিই যেন তাদের কাছে ধর্মের শেষ কথা!
হায় বেচারারা! দুষ্ট ও চতুর পুরুতরা যত সব অর্থহীন আচার ও ভাঁড়ামিগুলোকেই বেদের ও হিন্দুধর্মের সার বলে তাদের শেখায় (কিন্তু মনে রাখবেন যে, এসব দুষ্ট পুরুতগুলো বা তাদের পিতৃ-পিতামহগণ গত চারশ-পুরুষ ধরে একখণ্ড বেদও দেখেনি); সাধারণ লোকেরা সেগুলি মেনে চলে আর নিজেদের হীন করে ফেলে। কলির ব্রাহ্মণরূপী রাক্ষসদের কাছ থেকে ভগবান্ তাঁদের বাঁচান!
আমি আপনার কাছে একটি বাঙালী ছেলেকে পাঠিয়েছি। আশা করি, তার প্রতি একটু সদয় ব্যবহার করবেন। ইতি
বি
৫৮*
ঈশ্বরো জয়তি
বোম্বাই
২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯২
প্রিয় পণ্ডিতজী মহারাজ,
আমি যথাসময়ে আপনার পত্র পাইয়াছি। আমি প্রশংসার উপযুক্ত না হইলেও, আমাকে কেন যে প্রশংসা করা হয়, তাহা বুঝিতে পারি না। প্রভু যীশুর কথায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, ‘ভাল একজন মাত্রই আছেন—স্বয়ং প্রভু ভগবানই একমাত্র ভাল।’ অপর সকলে তাঁহারই হস্তের যন্ত্রমাত্র। ‘মহতো মহীয়ান্’ পরমধামে অধিষ্ঠিত ঈশ্বর এবং উপযুক্ত ব্যক্তিগণই মহিমামণ্ডিত হউন, আমার ন্যায় অনুপযুক্ত ব্যক্তি নয়। বর্তমান ক্ষেত্রে ‘ভৃত্যটি মজুরিলাভের উপযুক্তই নহে’; বিশেষতঃ ফকিরের কোনরূপ প্রশংসালাভের অধিকার নাই। আপনার ভৃত্য যদি শুধু তাহার নির্দিষ্ট কর্তব্য করে, তবে কি সেজন্য আপনি তাহাকে প্রশংসা করেন?
আশা করি, আপনি সপরিবারে সর্বাঙ্গীন কুশলে আছেন। পণ্ডিত সুন্দরলালজী ও মদীয় অধ্যাপক২৬ যে অনুগ্রহপূর্বক আমাকে স্মরণ করিয়াছেন, সেজন্য তাঁহাদের নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ।
এখন আপনাকে আমি অন্য এক বিষয় বলিতে চাইঃ হিন্দুগণ চিরকালই সাধারণ সত্য হইতে বিশেষ সত্যে উপনীত হইতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু কখনই বিশেষ বিশেষ ঘটনা ও সত্যের বিচার দ্বারা সাধারণ সত্যে উপনীত হইবার চেষ্টা করেন নাই। আমাদের সকল দর্শনেই দেখিতে পাই—প্রথমে একটি সাধারণ ‘প্রতিজ্ঞা’ ধরিয়া লইয়া, তারপর চুলচেরা বিচার চলিতেছে; কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞাটিই হয়তো সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক ও বালকোচিত। কেহই এই সকল সাধারণ প্রতিজ্ঞার সত্যাসত্য জিজ্ঞাসা অথবা অনুসন্ধান করে নাই। সুতরাং আমাদের স্বাধীন চিন্তা একরূপ নাই বলিলেই হয়। সেইজন্যই আমাদের দেশে পর্যবেক্ষণ ও সামান্যীকরণ২৭ প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ বিজ্ঞানসমূহের অত্যন্ত অভাব দেখিতে পাই। ইহার কারণ কি? ইহার দুইটি কারণঃ প্রথমতঃ এখানে গ্রীষ্মের অত্যন্ত আধিক্য আমাদিগকে কর্মপ্রিয় না করিয়া শান্তি ও চিন্তা-প্রিয় করিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা কখনই দূরদেশে ভ্রমণ অথবা সমুদ্রযাত্রা করিতেন না। সমুদ্রযাত্রা বা দূরভ্রমণ করিবার লোক ছিল বটে, তবে তাহারা প্রায় সবই ছিল বণিক; পৌরোহিত্যের অত্যাচার ও তাহাদের নিজেদের ব্যবসায়ে লাভের আকাঙ্ক্ষা, তাহাদের মানসিক উন্নতির সম্ভাবনা একেবারে রুদ্ধ করিয়াছিল। সুতরাং তাহাদের পর্যবেক্ষণের ফলে মনুষ্যজাতির জ্ঞানভাণ্ডার বর্ধিত না হইয়া উহার অবনতিই হইয়াছিল। কারণ, তাহাদের পর্যবেক্ষণ দোষযুক্ত ছিল, এবং তাহাদের প্রদত্ত বিবরণ এতই অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিক হইত যে, বাস্তবের সঙ্গে তাহার মোটেই মিল থাকিত না।
সুতরাং আপনি বুঝিতেছেন, আমাদিগকে ভ্রমণ করিতেই হইবে, আমাদিগকে বিদেশে যাইতেই হইবে। আমাদিগকে দেখিতে হইবে, অন্যান্য দেশে সমাজ-যন্ত্র কিরূপে পরিচালিত হইতেছে। আর যদি আমাদিগকে যথার্থই পুনরায় একটি জাতিরূপে গঠিত হইতে হয়, তবে অপর জাতির চিন্তার সহিত আমাদের অবাধ সংস্রব রাখিতে হইবে। সর্বোপরি আমাদিগকে দরিদ্রের উপর অত্যাচার বন্ধ করিতে হইবে। আমরা এখন কি হাস্যকর অবস্থাতেই না উপনীত হইয়াছি! ভাঙ্গীরূপে যদি কোন ভাঙ্গী কাহারও নিকট উপস্থিত হয়, সংক্রামক রোগের ন্যায় সকলে তাহার সঙ্গ ত্যাগ করে; কিন্তু যখনই পাদ্রী সাহেব আসিয়া মন্ত্র আওড়াইয়া তাহার মাথায় খানিকটা জল ছিটাইয়া দেয়, আর সে একটা জামা (যতই ছিন্ন ও জর্জরিত হউক) পরিতে পায়, তখনই সে খুব গোঁড়া হিন্দুর বাড়ীতেই প্রবেশাধিকার পায়! আমি তো এমন লোক দেখি না, যে তখন তাহাকে একখানা চেয়ার আগাইয়া না দিতে ও তাহার সহিত সপ্রেম করমর্দন না করিতে সাহস করে! ইহার চেয়ে আর অদৃষ্টের পরিহাস কতদূর হইতে পারে? এখন এই পাদ্রীরা দক্ষিণে কি করিতেছে, দেখিবেন—আসুন দেখি। উহারা লাখ লাখ নীচ জাতকে খ্রীষ্টান করিয়া ফেলিতেছে—আর পৌরোহিত্যের অত্যাচার ভারতের সর্বাপেক্ষা যেখানে বেশী, সেই ত্রিবাঙ্কুরে, যেখানে ব্রাহ্মণগণ সমুদয় ভূমির স্বামী, এবং স্ত্রীলোকেরা—এমন কি রাজবংশীয়া মহিলাগণ পর্যন্ত—ব্রাহ্মণগণের উপপত্নীরূপে বাস করা খুব সম্মানের বিষয় জ্ঞান করিয়া থাকে, তথাকার সিকি ভাগ খ্রীষ্টান হইয়া গিয়াছে। আর আমি তাহাদের দোষও দিতে পারি না। তাহাদের আর কোন্ বিষয়ে কি অধিকার আছে বলুন? হে প্রভু, কবে মানুষ অপর মানুষকে ভাইয়ের ন্যায় দেখিবে?
আপনারই
বিবেকানন্দ
৫৯
[হরিপদ মিত্রকে লিখিত]
মাড়গাঁও, ১৮৯৩
কল্যাণবরেষু,
আপনার এক পত্র এইমাত্র পাইলাম। আমি এ স্থানে নিরাপদে পৌঁছিয়া ও তদনন্তর পঞ্জেম প্রভৃতি কয়েকটি গ্রাম ও দেবালয় দর্শন করিতে যাই—অদ্য ফিরিয়া আসিয়াছি। গোকর্ণ, মহাবালেশ্বর প্রভৃতি দর্শন করিবার ইচ্ছা এক্ষণে পরিত্যাগ করিলাম। কল্য প্রাতঃকালের ট্রেনে ধারবাড় যাত্রা করিব। ষষ্টি আমি লইয়া আসিয়াছি। ডাক্তার যুগড়েকরের মিত্র আমার অতিশয় যত্ন করিয়াছেন। ভাটেসাহেব ও অন্যান্য সকল মহাশয়কে আমার যথাযোগ্য সম্ভাষণ জানাইবেন। ঈশ্বর আপনার ও আপনার পত্নীর সকল কল্যাণ করুন। পঞ্জেম শহর বড় পরিষ্কার। এখানকার খ্রীষ্টিয়ানেরা অনেকেই কিছু কিছু লেখাপড়া জানে। হিন্দুরা প্রায় সকলেই মূর্খ। ইতি
সচ্চিদানন্দ২৮
৬০*
C/o বাবু মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়
সুপারিণ্টেণ্ডিং ইঞ্জিনিয়র
খার্তাবাদ, হায়দরাবাদ
২১ ফেব্রুআরী, ১৮৯৩
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমার বন্ধু সেই গ্রাজুয়েট যুবকটি ষ্টেশনে আমাকে নিতে এসেছিলেন—একটি বাঙালী ভদ্রলোকও এসেছিলেন। এখন আমি ঐ বাঙালী ভদ্রলোকটির কাছেই রয়েছি—কাল তোমার যুবক বন্ধুটির কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব; তারপর এখানকার দ্রষ্টব্য জিনিষগুলি দেখা হয়ে গেলে কয়েক দিনের মধ্যেই মান্দ্রাজে ফিরছি। কারণ আমি অত্যন্ত দুঃখের সহিত তোমায় জানাচ্ছি যে, আমি এখন আর রাজপুতানায় ফিরে যেতে পারব না—এখানে এখন থেকেই ভয়ঙ্কর গরম পড়েছে; জানি না রাজপুতানায় আরও কি ভয়ানক গরম হবে, আর গরম আমি আদপে সহ্য করতে পারি না। সুতরাং এরপর আমাকে বাঙ্গালোরে যেতে হবে, তারপর উতকামণ্ডে গ্রীষ্মটা কাটাতে যাব। গরমে আমার মাথার ঘিটা যেন ফুটতে থাকে।
তাই আমার সব মতলব ফেঁসে চুরমার হয়ে গেল; আর এই জন্যই আমি গোড়াতেই মান্দ্রাজ থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিলাম। সে ক্ষেত্রে আমায় আমেরিকা পাঠাবার জন্য আর্যাবর্তের কোন রাজাকে ধরবার যথেষ্ট সময় হাতে পেতাম। কিন্তু হায়, এখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। প্রথমতঃ এই গরমে আমি ঘুরে বেড়াতে পারব না—তা করতে গেলে মারা যাব, দ্বিতীয়তঃ আমার রাজপুতানার ঘনিষ্ঠ বন্ধুগণ আমাকে পেলে তাঁদের কাছেই ধরে রেখে দেবেন, পাশ্চাত্য দেশে যেতে দেবেন না। সুতরাং আমার মতলব ছিল, আমার বন্ধুদের অজ্ঞাতসারে কোন নূতন লোককে ধরা। কিন্তু মান্দ্রাজে এই বিলম্ব হওয়ার দরুন আমার সব আশাভরসা চুরমার হয়ে গেছে; এখন আমি অতি দুঃখের সহিত ঐ চেষ্টা ছেড়ে দিলাম—ঈশ্বরের যা ইচ্ছা, তাই পূর্ণ হোক। এ আমারই প্রাক্তন—অপর কারও দোষ নেই। তবে তুমি এক রকম নিশ্চিতই জেনো যে, কয়েক দিনের মধ্যেই দু-এক দিনের জন্য মান্দ্রাজে গিয়ে তোমাদের সঙ্গে দেখা করে বাঙ্গালোরে যাব, আর সেখান থেকে উতকামণ্ডে গিয়ে দেখব, যদি ম—মহারাজ আমায় পাঠায়। ‘যদি’ বলছি তার কারণ, আমি ‘—’রাজার অঙ্গীকারবাক্যে বড় নিশ্চিত ভরসা রাখি না। তারা তো আর রাজপুত নয়, রাজপুত বরং প্রাণ দেবে, কিন্তু কখনও কথার খেলাপ করবে না। যাই হোক, ‘যাবৎ বাঁচি, তাবৎ শিখি’—অভিজ্ঞতাই জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
‘স্বর্গে যেরূপ মর্ত্যেও তদ্রূপ তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক, কারণ অনন্তকালের জন্য তোমারই মহিমা জগতে ঘোষিত হচ্ছে এবং সবই তোমারই রাজত্ব।’২৯
তোমরা সকলে আমার শুভেচ্ছা জানবে। ইতি
তোমাদের
সচ্চিদানন্দ
৬১*
[ডাঃ নাঞ্জুণ্ড রাওকে লিখিত]
খেতড়ি, রাজপুতানা
২৭ এপ্রিল, ১৮৯৩
প্রিয় ডাক্তার,
এইমাত্র আপনার পত্র পাইলাম। অযোগ্য হইলেও আমার প্রতি আপনার প্রীতির জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিবেন। বালাজী বেচারার পুত্রের মৃত্যু-সংবাদে বড়ই দুঃখিত হইলাম। ‘প্রভুই দিয়া থাকেন, আবার প্রভুই গ্রহণ করেন—প্রভুর নাম ধন্য হউক।’ আমরা কেবল জানি, কিছুই নষ্ট হয় না বা হইতে পারে না। আমাদিগকে সম্পূর্ণ শান্তভাবে তাঁহার নিকট হইতে যাহাই আসুক না কেন, মাথা পাতিয়া লইতে হইবে। সেনাপতি যদি তাঁহার অধীন সৈন্যকে কামানের মুখে যাইতে বলেন, তাহাতে তাহার অভিযোগ করিবার বা ঐ আদেশ পালন করিতে এতটুকু ইতস্ততঃ করিবার অধিকার নাই। বালাজীকে প্রভু এই শোকে সান্ত্বনা দান করুন, আর এই শোক যেন তাহাকে সেই পরম করুণাময়ী জননীর বক্ষের নিকট হইতে নিকটে লইয়া যায়।
মান্দ্রাজ হইতে জাহাজে উঠিবার প্রস্তাব সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, উহা এক্ষণে আর হইবার যো নাই, কারণ আমি পূর্বেই বোম্বাই হইতে উঠিবার বন্দোবস্ত করিয়াছি। ভট্টাচার্য মহাশয়কে বলিবেন, রাজা৩০ অথবা আমার গুরুভাইগণ আমার সংকল্পে বাধা দিবেন, তাহার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। রাজাজীর তো আমার প্রতি অগাধ ভালবাসা।
একটা কথা—চেটির উত্তরটি মিথ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। আমি বেশ ভাল আছি। দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি বোম্বাই রওনা হইতেছি।
সেই সর্বশুভবিধাতা আপনাদের সকলের ঐহিক ও পারত্রিক মঙ্গল বিধান করুন, ইহাই সচ্চিদানন্দের নিরন্তর প্রার্থনা।
পুঃ—আমি জগমোহনকে আপনার নমস্কার জানাইয়াছি। তিনিও আমাকে বলিতেছেন, আপনাকে তাঁহার প্রতিনমস্কার জানাইতে।
৬২*
[শ্রীযুক্ত বালাজী রাওকে লিখিত]
১৮৯৩
প্রিয় বালাজী,
‘আমরা মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হই উলঙ্গ অবস্থায়, ইহলোক হইতে বিদায় হইবার সময় যাইও উলঙ্গ অবস্থায়; প্রভু দিয়াছিলেন, তিনিই আবার গ্রহণ করিলেন; প্রভুর নাম ধন্য হউক!’ যখন সেই প্রাচীন য়াহুদী-বংশসম্ভূত মহাত্মা—মনুষ্যের অদৃষ্টচক্রে যতদূর দুঃখ-কষ্ট আসিতে পারে, তাহার চূড়ান্ত ভোগ করিতেছিলেন, তখন তাঁহার মুখ দিয়া ঐ বাণী নির্গত হইয়াছিল, আর তিনি মিথ্যা বলেন নাই। তাঁহার এই বাণীর মধ্যেই জীবনের গূঢ় রহস্য নিহিত। সমুদ্রের উপরিভাগে উত্তালতরঙ্গমালা নৃত্য করিতে পারে, প্রবল ঝটিকা গর্জন করিতে পারে, কিন্তু উহার গভীরতম প্রদেশে অনন্ত স্থিরতা, অনন্ত শান্তি, অনন্ত আনন্দ বিরাজমান। ‘শোকার্তেরা ধন্য, কারণ তাহারা সান্ত্বনা পাইবে’; কারণ ঐ মহাবিপদের দিনে, যখন পিতামাতার কাতর ক্রন্দনে উদাসীন করাল কালের পেষণে হৃদয় বিদীর্ণ হইতে থাকে, যখন গভীর দুঃখ ও নিরাশায় পৃথিবী অন্ধকার বোধ হয়, তখনই আমাদের অন্তরের চক্ষু উন্মীলিত হয়। যখন দুঃখ বিপদ নৈরাশ্যের ঘনান্ধকারে চারিদিক একেবারে আচ্ছন্ন বোধ হয়, তখনই যেন সেই নিবিড় অন্ধকারের মধ্য হইতে হঠাৎ জ্যোতিঃ ফুটিয়া উঠে, স্বপ্ন যেন ভাঙিয়া যায়, আর তখন আমরা প্রকৃতির মহান্ রহস্য সেই অনন্ত সত্তাকে দিব্যচক্ষে দেখিতে থাকি।
যখন জীবনভার এত দুর্বহ হয় যে, তাহাতে অনেক ক্ষুদ্রকায় তরী ডুবাইয়া দিতে পারে, তখনই প্রতিভাবান্ বীরহৃদয় ব্যক্তি সেই অনন্ত পূর্ণ নিত্যানন্দময় সত্তামাত্রস্বরূপকে দেখে, যে অনন্ত পুরুষ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে অভিহিত ও পূজিত; তখনই যে শৃঙ্খল তাহাকে এই দুঃখময় কারায় আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা যেন ক্ষণকালের জন্য ভাঙিয়া যায়। তখন সেই বন্ধনমুক্ত আত্মা ক্রমাগত উচ্চ হইতে উচ্চতর ভূমিতে আরোহণ করিয়া শেষে সেই প্রভুর সিংহাসনে সমীপবর্তী হয়, ‘যেখানে অত্যাচারীর উৎপীড়ন সহ্য করিতে হয় না, যেখানে পরিশ্রান্ত ব্যক্তি বিশ্রাম লাভ করে।’
ভ্রাতঃ! দিবারাত্র তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিতে ভুলিও না; দিবারাত্র বলিতে ভুলিও না, ‘তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক।’
‘কেন’ প্রশ্নে আমাদের নাই অধিকার।
কাজ কর, করে মর—এই হয় সার॥
হে প্রভো! তোমার নাম—তোমার পবিত্র নাম ধন্য হউক এবং তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক। হে প্রভো! আমরা জানি যে, আমাদিগকে তোমার ইচ্ছার অধীনে চলিতে হইবে—জানি প্রভো, মায়ের হাতেই মার খাইতেছি; কিন্তু মন বুঝিলেও প্রাণ যে বুঝে না! হে প্রেমময় পিতঃ! তুমি যে একান্ত আত্মসমর্পণ শিক্ষা দিতেছ, হৃদয়ের জ্বালা তো তাহা করিতে দিতেছে না।
হে প্রভো! তুমি তোমার চক্ষের সমক্ষে তোমার সব আত্মীয়স্বজনকে মরিতে দেখিয়াছিলে এবং শান্তচিত্তে বক্ষে হস্তার্পণ করিয়া নিশ্চিন্তভাবে বসিয়াছিলে; তুমি আমাদিগকে বল দাও। এস প্রভো, এস হে আচার্যচূড়ামণি! তুমি আমাদিগকে শিখাইয়াছ; সৈনিককে কেবল আজ্ঞা পালন করিতে হইবে, তাহার কথা কহিবার অধিকার নাই। এস প্রভো, এস হে পার্থসারথি! অর্জুনকে তুমি যেমন একসময় শিখাইয়াছিলে যে, তোমার শরণ লওয়াই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য, তেমনি, আমাকেও শিখাও—যেন প্রাচীনকালের মহাপুরুষগণের সহিত আমিও দৃঢ়তা ও শরণাগতির সহিত বলিতে পারি ‘ওঁ শ্রীকৃষ্ণার্পণমস্তু’। প্রভু আপনার হৃদয়ে শান্তি দিন, ইহাই দিবারাত্র সচ্চিদানন্দের প্রার্থনা ।
৬৩*
খেতড়ি
২৮ এপ্রিল, ১৮৯৩
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,২৫
ইচ্ছা ছিল যে, এখানে আসার পথে নাড়িয়াদে আপনার ওখানে যাব, এবং আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করব। কিন্তু কয়েকটি ঘটনাতে বাধা পড়ল, তার মধ্যে প্রধান এই যে, আপনি ওখানে ছিলেন না—হ্যামলেটের ভূমিকা বাদ দিয়ে ‘হ্যামলেট’ অভিনয় করা হাস্যকর ব্যাপার মাত্র! আর আমার নিশ্চিত জানা আছে যে, আপনি দিন-কয়েকের মধ্যেই নাড়িয়াদে ফিরবেন। অধিকন্তু আমি দিন-বিশেকের মধ্যেই যখন বোম্বে যাচ্ছি, তখন আপনার ওখানে যাওয়াটা পেছিয়া দেওয়াই উচিত মনে করলাম।
খেতড়ির রাজাজী আমায় দেখবার জন্য বিশেষ আগ্রহান্বিত হয়েছিলেন এবং তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীকে মান্দ্রাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন; সুতরাং আমাকে খেতড়ি আসতেই হল। কিন্তু গরম অসহ্য; অতএব আমি শীঘ্রই পালাচ্ছি।
ভাল কথা, আমার প্রায় সকল দক্ষিণী রাজার সঙ্গেই আলাপ হয়েছে, আর বহু জায়গায় বহু অদ্ভুত দৃশ্যও দেখেছি। আবার দেখা হলে সে-সব সবিশেষ বলব। আমি জানি আপনি আমায় খুবই ভালবাসেন এবং আপনার ওখানে না যাওয়ার অপরাধ নেবেন না। যা হোক, কিছুদিনের মধ্যেই আসছি।
আর এক কথা। এখন কি জুনাগড়ে আপনার কাছে সিংহের বাচ্চা আছে? রাজার জন্য একটি কি আমায় ধার দিতে পারেন? এর বদলে আপনার পছন্দ হলে তিনি রাজপুতানার কোন জানোয়ার আপনাকে দিতে পারেন।
ট্রেনে রতিলাল ভাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি ঠিক সেই সুন্দর অমায়িক মানুষটিই আছেন। আর দেওয়ানজী সাহেব, আপনার জন্য কি আর প্রার্থনা করব? করুণাময় জগৎপিতার এতগুলি পুত্রকন্যার সেবায় নিরত থেকে আপনার যে পবিত্র জীবন সকলের প্রশংসা ও সম্মান অর্জন করেছে, তার শেষভাগে ভগবান্ আপনার সর্বস্ব হোন। ওম্
আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৬৪*
বোম্বে
২২ মে, ১৮৯৩
দেওয়ানজী সাহেব,
কয়েকদিন হয় বোম্বে পৌঁছিয়াছি। আবার দুই-চার দিনের মধ্যে এখান হইতে বাহির হইব। আপনার যে বেনিয়া বন্ধুটির নিকট আমার থাকিবার স্থানের জন্য লিখিয়াছিলেন, পত্রযোগে তিনি জানাইয়াছেন যে, পূর্ব হইতেই তাঁহার বাটী অতিথি-অভ্যাগতে ভর্তি এবং তন্মধ্যে অনেকে আবার অসুস্থ; সুতরাং আমার জন্য স্থানসঙ্কুলান হওয়া সেখানে সম্ভব নয়—সেজন্য তিনি দুঃখিত। তবে আমরা বেশ একটি সুন্দর ও খোলা জায়গা পাইয়াছি। ... খেতড়ির মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারী ও আমি বর্তমানে একত্র আছি। আমার প্রতি তাঁহার ভালবাসা ও সহৃদয়তার জন্য আমি যে কত কৃতজ্ঞ, তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারি না। রাজপুতানার জনসাধারণ যে শ্রেণীর লোককে ‘তাজিমি সর্দার’ বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকে এবং যাঁহাদের অভ্যর্থনার জন্য স্বয়ং রাজাকেও আসন ত্যাগ করিয়া উঠিতে হয়, ইনি সেই সর্দারশ্রেণীর লোক। অথচ ইনি এত অনাড়ম্বর এবং এমনভাবে আমার সেবা করেন যে, আমি সময় সময় অত্যন্ত লজ্জা বোধ করি। ...
এই ব্যাবহারিক জগতে এরূপ ঘটনা প্রায়ই ঘটিতে দেখা যায় যে, যাঁহারা খুব সৎলোক তাঁহারাও নানাপ্রকার দুঃখ ও কষ্টের মধ্যে পতিত হন। ইহার রহস্য দুর্জ্ঞেয় হইতে পারে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, এ জগতের সব কিছুই মূলতঃ সৎ—উপরের তরঙ্গমালা যে-রূপই হউক, তাহার অন্তরালে, গভীরতম প্রদেশে প্রেম ও সৌন্দর্যের এক অনন্ত বিস্তৃত স্তর বিরাজিত। যতক্ষণ সেই স্তরে আমরা পৌঁছিতে না পারি, ততক্ষণই অশান্তি; কিন্তু যদি একবার শান্তিমণ্ডলে পৌঁছানো যায়, তবে ঝঞ্ঝার গর্জন ও বায়ুর তর্জন যতই হউক—পাষাণ-ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত গৃহ তাহাতে কিছুমাত্র কম্পিত হয় না।
আর আমি এ কথা সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি যে, আপনার ন্যায় পবিত্র ও নিঃস্বার্থ ব্যক্তি, যাঁহার সমগ্র জীবন অপরের কল্যাণসাধনেই নিযুক্ত হইয়াছে, তিনি—গীতামুখে শ্রীভগবান্ যাহাকে ‘ব্রাহ্মী স্থিতি’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন—সেই দৃঢ় ভূমিতে অবশ্যই স্থিতি লাভ করিয়াছেন।
যে আঘাত আপনি পাইয়াছেন, তাহা আপনাকে তাঁহার সমীপবর্তী করুক—যিনি ইহলোকে এবং পরলোকে একমাত্র প্রেমের আস্পদ। আর তাহা হইলেই তিনি যে সর্বকালে সব কিছুর ভিতর অধিষ্ঠিত এবং যাহা কিছু আছে, যাহা কিছু হারাইয়া গিয়াছে, সব কিছু আপনি তাঁহাতেই উপলব্ধি করুন।
আপনার স্নেহের
বিবেকানন্দ
৬৫*
খেতড়ি
মে, ১৮৯৩
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনি পত্র লেখার পূর্বে আমার পত্র নিশ্চয়ই পৌঁছায়নি। আপনার পত্র পড়ে যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদ হল। হর্ষ এ জন্য যে, আপনার ন্যায় হৃদয়বান্ শক্তিমান্ ও পদমর্যাদাশালী একজনের স্নেহলাভের সৌভাগ্য আমার ঘটেছে; আর বিষাদ এ জন্য যে, আমার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আপনার আগাগোড়াই ভুল ধারণা হয়েছে। আপনি বিশ্বাস করুন যে, আমি আপনাকে পিতার ন্যায় ভালবাসি ও শ্রদ্ধা করি এবং আপনার ও আপনার পরিবারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অসীম। সত্য কথা এইঃ আপনার হয়তো স্মরণ আছে যে, আগে থেকেই আমার চিকাগো যাবার অভিলাষ ছিল; এমন সময় মান্দ্রাজের লোকেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এবং মহীশূর ও রামনাদের মহারাজার সাহায্যে আমাকে পাঠাবার সব রকম আয়োজন করে ফেলল। আপনার আরও স্মরণ থাকতে পারে যে, খেতড়ির রাজা ও আমার মধ্যে প্রগাঢ় প্রেম বিদ্যমান। তাই কথাচ্ছলে তাঁকে লিখেছিলাম যে, আমি আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। এখন খেতড়ির রাজা মনে করলেন যে, যাবার পূর্বে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাবই; আরও বিশেষ কারণ এই যে, ভগবান্ তাঁকে সিংহাসনের একটি উত্তরাধিকারী দিয়াছেন এবং সেজন্য এখানে খুব আমোদ আহ্লাদ চলেছে। অধিকন্তু আমার আসা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবার জন্য তিনি তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীকে অত দূর মান্দ্রাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আসতে আমাকে হতই। ইতোমধ্যে নাড়িয়াদে আপনার ভাইকে টেলিগ্রাম করে জানতে চাইলাম যে, আপনি সেখানে আছেন কি না; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উত্তর পেলাম না। এদিকে বেচারা প্রাইভেট সেক্রেটারীর মান্দ্রাজ যাতায়াতে খুবই কষ্ট হয়েছিল, আর তার নজর ছিল শুধু একটা জিনিষের দিকে—জলসার আগে আমরা খেতড়ি না পৌঁছালে রাজা খুব দুঃখিত হবেন; তাই সে তখনি জয়পুরের টিকেট কিনে ফেলে। পথে রতিলালের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় এবং তিনি আমাকে জানালেন যে, আমার টেলিগ্রাম পৌঁছেছিল, যথাকালে উত্তরও দেওয়া হয়েছিল, আর শ্রীযুক্ত বিহারীদাস আমার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। এখন আপনিই বিচার করুন; কারণ এ যাবৎ আপনি সর্বদা সুবিচার করাকেই নিজের কর্তব্যরূপে গ্রহণ করেছেন। আমি এ বিষয়ে কী করতে পারতাম, আর কী করা উচিত ছিল? আমি পথে নেমে পড়লে খেতড়ির উৎসবে যথাসময়ে যোগ দিতে পারতাম না এবং আমার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভুল ধারণার সৃষ্টি হত। কিন্তু আমি আপনার ও আপনার ভায়ের ভালবাসা জানি; তা-ছাড়া আমার এও জানা ছিল যে, চিকাগো যাবার পথে আমাকে দিন কয়েকের মধ্যেই বোম্বে যেতে হবে। ভেবেছিলাম যে, আপনার ওখানে যাওয়াটা আমার ফেরার পথের জন্য মুলতবী রেখে দেওয়াই উত্তম হবে। আপনি যে মনে করছেন আপনার ভাইরা আমার দেখাশোনা না করায় আমি অপমানিত হয়েছি—এটা আপনার একটা অভিনব আবিষ্কার বটে! আমি তো এ কথা স্বপ্নেও ভাবিনি; অথবা আপনি হয়তো মানুষের মনের কথা জানার বিদ্যা শিখে ফেলেছেন—ভগবান্ জানেন! ঠাট্টা ছেড়ে দিলেও দেওয়ানজী সাহেব, আমার কৌতুকপরায়ণতা ও দুষ্টামি আগের মতই আছে; কিন্তু আপনাকে আমি ঠিক বলছি যে, জুনাগড়ে আমায় যেরূপ দেখেছিলেন আমি এখনও সেই সরল বালকই আছি এবং আপনার প্রতি আমার ভালবাসাও পূর্ববৎই আছে—বরং শতগুণ বর্ধিত হয়েছে; কারণ আপনার ও দক্ষিণদেশের প্রায় সকল দেওয়ানের মধ্যে মনে মনে তুলনা করার সুযোগ আমি পেয়েছি এবং ভগবান্ জানেন, আমি দক্ষিণদেশের প্রত্যেক রাজদরবারে শতমুখে আপনার কিরূপ প্রশংসা করেছি। অবশ্য আমি জানি যে, আপনার সদ্গুণরাশি ধারণা করতে আমি অতি অযোগ্য। এতেও যদি ব্যাপারটার যথেষ্ট ব্যাখ্যা না হয়ে থাকে, তবে আপনাকে অনুনয় করছি যে, আপনি আমাকে পিতার ন্যায় ক্ষমা করুন; আমি আপনার ন্যায় উপকারীর প্রতি কখনও অকৃতজ্ঞ হয়েছি—এই ধারণার কবলে পড়ে আমি যেন উৎপীড়িত না হই। ইতি
ভবদীয়
বিবেকানন্দ
পুঃ—আপনার ভায়ের মনে যে ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে, তা দূর করবার ভার আপনার ওপর দিচ্ছি। আমি যদি স্বয়ং শয়তানও হই, তবু তাঁদের দয়া ও আমার প্রতি বহু প্রকার উপকারের কথা আমি ভুলতে পারি না।
অপর যে দুজন স্বামীজী গতবারে জুনাগড়ে আপনার নিকট গিয়েছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, তাঁরা আমার গুরুভাই এবং তাঁদের একজন আমাদের নেতা। তাঁদের সঙ্গে তিন বৎসর পরে দেখা হয় এবং আমরা সকলে আবু পর্যন্ত একসঙ্গে এসে ওখানেই ওঁদের ছেড়ে এসেছি। আপনার অভিলাষ হলে বোম্বে যাবার পথে আমি তাঁদের নাড়িয়াদে নিয়ে যেতে পারি। ভগবান্ আপনার ও আপনার পরিবারের সকলের মঙ্গল করুন।
বি
৬৬
[শ্রীমতী ইন্দুমতী মিত্রকে লিখিত]
বোম্বে
২৪ মে, ১৮৯৩
কল্যাণীয়াসু,
মা, তোমার ও হরিপদ বাবাজীর পত্র পাইয়া পরম আহ্লাদিত হইলাম। সর্বদা পত্র লিখিতে পারি নাই বলিয়া দুঃখিত হইও না। সর্বদা শ্রীহরির নিকট তোমাদের কল্যাণ প্রার্থনা করিতেছি। বেলগাঁওয়ে এক্ষণে যাইতে পারি না, কারণ ৩১ তারিখে এখান হইতে আমেরিকায় রওনা হইবার সকল বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে। আমেরিকা ও ইওরোপ পরিভ্রমণ করিয়া আসিয়া প্রভুর ইচ্ছায় পুনরায় তোমাদের দর্শন করিব। সর্বদা শ্রীকৃষ্ণে আত্মসমর্পণ করিবে। সর্বদা মনে রাখিবে যে, প্রভুর হস্তে আমরা পুত্তলিকামাত্র। সর্বদা পবিত্র থাকিবে। কায়মনোবাক্যেও যেন অপবিত্র না হও এবং সদা যথাসাধ্য পরোপকার করিতে চেষ্টা করিবে। মনে রাখিও, কায়মনোবাক্যে পতিসেবা করা স্ত্রীলোকের প্রধান ধর্ম। নিত্য যথাশক্তি গীতাপাঠ করিও। তুমি ইন্দুমতী ‘দাসী’ কেন লিখিয়াছ? ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ‘দেব’ ও ‘দেবী’ লিখিবে, বৈশ্য ও শূদ্রেরা ‘দাস’ ও ‘দাসী’ লিখিবে। অপিচ জাতি ইত্যাদি আধুনিক ব্রাহ্মণ-মহাত্মারা করিয়াছেন। কে কাহার দাস? সকলেই হরির দাস, অতএব আপনাপন গোত্রনাম অর্থাৎ পতির নামের শেষভাগ বলা উচিত, এই প্রাচীন বৈদিক প্রথা, যথা—ইন্দুমতী মিত্র ইত্যাদি। আর কি লিখিব মা, সর্বদা জানিবে যে, আমি নিরন্তর তোমাদের কল্যাণ প্রার্থনা করিতেছি। প্রভুর নিকট প্রার্থনা করি, তুমি শীঘ্রই পুত্রবতী হও। আমেরিকা হইতে সেখানকার আশ্চর্যবিবরণপূর্ণ পত্র আমি মধ্যে মধ্যে তোমায় লিখিব। এক্ষণে আমি বোম্বেতে আছি। ৩১ তারিখ পর্যন্ত থাকিব। খেতড়ি মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারী আমায় জাহাজে তুলিয়া দিতে আসিয়াছেন। কিমধিকমিতি—
আশীর্বাদক
সচ্চিদানন্দ
৬৭*
ওরিয়েণ্টাল হোটেল
ইয়োকোহামা
১০ জুলাই, ১৮৯৩
প্রিয় আলাসিঙ্গা, বালাজী, জি. জি. ও অন্যান্য মান্দ্রাজী বন্ধুগণ,
আমার গতিবিধি সম্বন্ধে তোমাদের সর্বদা খবর দেওয়া আমার উচিত ছিল, আমি তা করিনি, সেজন্য আমায় ক্ষমা করবে। এরূপ দীর্ঘ ভ্রমণে প্রত্যহই বিশেষ ব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়। বিশেষতঃ আমার তো কখনও নানা জিনিষপত্র সঙ্গে নিয়ে ঘোরা অভ্যাস ছিল না। এখন এই সব যা সঙ্গে নিতে হয়েছে, তার তত্ত্বাবধানেই আমার সব শক্তি খরচ হচ্ছে। বাস্তবিক, এ এক বিষম ঝঞ্ঝাট!
বম্বাই ছেড়ে এক সপ্তাহের মধ্যে কলম্বো পৌঁছলাম। জাহাজ প্রায় সারাদিন বন্দরে ছিল। এই সুযোগ আমি নেমে শহর দেখতে গেলাম। গাড়ী করে কলম্বোর রাস্তা দিয়ে চলতে লাগলাম। সেখানকার কেবল বুদ্ধ-ভগবানের মন্দিরটির কথা আমার স্মরণ আছে; তথায় বুদ্ধদেবের এক বৃহৎ পরিনির্বাণ-মূর্তি শয়ান অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরের পুরোহিতগণের সহিত আলাপ করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাঁরা সিংহলী ভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষা জানেন না বলে আমাকে আলাপের চেষ্টা ত্যাগ করতে হল। ওখান থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে সিংহলের মধ্যদেশে অবস্থিত কাণ্ডি শহর সিংহলী বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র, কিন্তু আমার সেখানে যাবার সময় ছিল না। এখানকার গৃহস্থ বৌদ্ধগণ—কি পুরুষ কি স্ত্রী—সকলেই মৎস্যমাংস-ভোজী, কেবল পুরোহিতগণ নিরামিষাশী। সিংহলীদের পরিচ্ছদ ও চেহারা তোমাদের মান্দ্রাজীদেরই মত। তাদের ভাষা সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না; তবে উচ্চারণ শুনে বোধ হয়, উহা তোমাদের তামিলের অনুরূপ।
পরে জাহাজ পিনাঙে লাগল; উহা মালয় উপদ্বীপে সমুদ্রের উপরে একটি ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ড মাত্র। উহা খুব ক্ষুদ্র শহর বটে, কিন্তু অন্যান্য সুনির্মিত নগরীর ন্যায় খুব পরিষ্কার-ঝরিষ্কার। মালয়বাসিগণ সবই মুসলমান। প্রাচীনকালে এরা ছিল সওদাগরি জাহাজসমূহের বিশেষ ভীতির কারণ—বিখ্যাত জলদস্যু। কিন্তু এখনকার বুরুজওয়ালা যুদ্ধজাহাজের প্রকাণ্ড কামানের চোটে মালয়বাসিগণ অপেক্ষাকৃত কম হাঙ্গামার কাজ করতে বাধ্য হয়েছে।
পিনাং থেকে সিঙ্গাপুর চললাম। পথে দূর হতে উচ্চশৈল-সমন্বিত সুমাত্রা দেখতে পেলাম; আর কাপ্তেন আমাকে প্রাচীনকালে জলদস্যুগণের কয়েকটি আড্ডা অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখাতে লাগলেন। সিঙ্গাপুর প্রণালী-উপনিবেশের (Straits Settlement) রাজধানী। এখানে একটি সুন্দর উদ্ভিদ্-উদ্যান আছে, তথায় অনেক জাতীয় ভাল ভাল ‘পাম’ সংগৃহীত। ‘ভ্রমণকারীর পাম’ (Traveller's Palm) নামক সুন্দর তালবৃন্তবৎ পাম এখানে অপর্যাপ্ত জন্মায়, আর ‘রুটিফল’ (bread fruits) বৃক্ষ তো এখানে সর্বত্র। মান্দ্রাজে যেমন আম অপর্যাপ্ত, এখানে তেমন বিখ্যাত ম্যাঙ্গোষ্টিন অপর্যাপ্ত, তবে আমের সঙ্গে আর কিসের তুলনা হতে পারে? এখানকার লোকে মান্দ্রাজীদের অর্ধেক কালোও হবে না, যদিও এ স্থান মান্দ্রাজ অপেক্ষা বিষুবরেখার নিকটবর্তী। এখানে একটি সুন্দর যাদুঘরও (Museum) আছে। এখানে পানদোষ ও লাম্পট্য বেশী মাত্রায় বিরাজমান, এটাই এখানকার ইওরোপীয় ঔপনিবেশিকগণের যেন প্রথম কর্তব্য। আর প্রত্যেক বন্দরেই জাহাজের প্রায় অর্ধেক নাবিক নেমে এরূপ স্থানের অন্বেষণ করে, যেখানে সুরা ও সঙ্গীতের প্রভাবে নরক রাজত্ব করে। থাক সে কথা।
তারপর হংকং। সিঙ্গাপুর মালয় উপদ্বীপের অন্তর্গত হলেও সেখান থেকেই মনে হয় যেন চীনে এসেছি—চীনের ভাব সেখানে এতই প্রবল। সকল মজুরের কাজ, সকল ব্যবসা-বাণিজ্য বোধ হয় তাদেরই হাতে। আর হংকং তো খাঁটি চীন; যাই জাহাজ কিনারায় নোঙর করে, অমনি শত শত চীনে নৌকা এসে ডাঙায় নিয়ে যাবার জন্য তোমায় ঘিরে ফেলবে। এই নৌকাগুলো একটু নূতন রকমের—প্রত্যেকটিতে দুটি করে হাল। মাঝিরা সপরিবারে নৌকাতেই বাস করে। প্রায়ই দেখা যায়, মাঝিরা স্ত্রীই হালে বসে থাকে, একটি হাল দু হাত দিয়ে ও অপর হাল এক পা দিয়ে চালায়। আর দেখা যায় যে, শতকরা নব্বই জনের পিঠে একটি কচি ছেলে এরূপভাবে একটি থলির মত জিনিষ দিয়ে বাঁধা থাকে, যাতে সে হাত-পা অনায়াসে খেলাতে পারে। চীনে-খোকা কেমন মায়ের পিঠে সম্পূর্ণ শান্তভাবে ঝুলে আছে, আর ওদিকে মা—কখনও তাঁর সব শক্তি প্রয়োগ করে নৌকা চালাচ্ছেন, কখনও ভারী ভারী বোঝা ঠেলছেন, অথবা অদ্ভুত তৎপরতার সঙ্গে এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় লাফিয়ে যাচ্ছেন—এ এক বড় মজার দৃশ্য! আর এত নৌকা ও ষ্টীম-লঞ্চ ভীড় করে ক্রমাগত আসছে যাচ্ছে যে, প্রতিমুহূর্তে চীনে-খোকার টিকি-সমেত ছোট মাথাটি একেবারে গুঁড়ো হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে; খোকার কিন্তু সে দিকে খেয়ালই নেই। তার পক্ষে এই মহাব্যস্ত কর্মজীবনের কোন আকর্ষণ নাই। তার পাগলের মত ব্যস্ত মা মাঝে মাঝে তাকে দু-এক খানা চালের পিঠে দিচ্ছেন, সে ততক্ষণ তার গঠনতন্ত্র (anatomy) জেনেই সন্তুষ্ট।
চীনে-খোকা একটি রীতিমত দার্শনিক। যখন ভারতীয় শিশু হামাগুড়ি দিতেও অক্ষম, এমন বয়সে সে স্থিরভাবে কাজ করতে যায়। সে বিশেষরূপেই প্রয়োজনীয়তার দর্শন শিখেছে। চীন ও ভারতবাসী যে ‘মমিতে’ পরিণতপ্রায় এক প্রাণহীন সভ্যতার স্তরে আটকে পড়েছে, অতি দারিদ্র্যই তার অন্যতম কারণ। সাধারণ হিন্দু বা চীনবাসীর পক্ষে তার প্রাত্যহিক অভাব এতই ভয়ানক যে, তাকে আর কিছু ভাববার অবসর দেয় না।
হংকং অতি সুন্দর শহর—পাহাড়ের ঢালুর উপর নির্মিত; পাহাড়ের উপরেও অনেক বড়লোক বাস করে; ইহা শহর অপেক্ষা অনেক ঠাণ্ডা। পাহাড়ের উপরে প্রায় খাড়াভাবে ট্রাম-লাইন গিয়েছে; তারের দড়ির সংযোগে এবং বাষ্পীয় বলে ট্রামগুলি উপরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।
আমরা হংকঙে তিন দিন ছিলাম। সেখানে থেকে ক্যাণ্টন দেখতে গিয়েছিলাম, হংকং থেকে একটি নদী ধরে ৮০ মাইল উজিয়ে ক্যাণ্টনে যেতে হয়। নদীটি এত চওড়া যে, খুব বড় বড় জাহাজ পর্যন্ত যেতে পারে। অনেকগুলো চীনে জাহাজ হংকং ও ক্যাণ্টনের মধ্যে যাতায়াত করে। আমরা বিকেলে একখানি জাহাজে চড়ে পরদিন প্রাতে ক্যাণ্টনে পৌঁছলাম। প্রাণের স্ফূর্তি ও কর্মব্যস্ততা মিলে এখানে কি হইচই! নৌকার ভীড়ই বা কি! জল যেন ছেয়ে ফেলেছে! এ শুধু মাল ও যাত্রী নিয়ে যাবার নৌকা নয়, হাজার হাজার নৌকা রয়েছে গৃহের মত বাসোপযোগী। তাদের মধ্যে অনেকগুলো অতি সুন্দর, অতি বৃহৎ। বাস্তবিক সেগুলো দুতলা তেতলা বাড়ীর মত, চারিদিকে বারাণ্ডা রয়েছে, মধ্যে দিয়ে রাস্তা গেছে; কিন্তু সব জলে ভাসছে!!
আমরা যেখানে নামলাম, সেই জায়গাটুকু চীন গভর্ণমেণ্ট বৈদেশিকদের বাস করবার জন্য দিয়েছেন; এর চতুর্দিকে, নদীর উভয় পার্শ্বে অনেক মাইল জুড়ে এই বৃহৎ শহর অবস্থিত—এখানে অগণিত মানুষ বাস করছে, জীবন-সংগ্রামে একজন আর একজনকে ঠেলে ফেলে চলেছে—প্রাণপণে জীবন-সংগ্রামে জয়ী হবার চেষ্টা করছে। মহা কলরব—মহা ব্যস্ততা! কিন্তু এখানকার অধিবাসিসংখ্যা যতই হোক, এখানকার কর্মপ্রবণতা যতই হোক, এর মত ময়লা শহর আমি দেখিনি। তবে ভারতবর্ষের কোন শহরকে যে হিসেবে আবর্জনাপূর্ণ বলে, সে হিসেবে বলছি না, চীনেরা তো এতটুকু ময়লা পর্যন্ত বৃথা নষ্ট হতে দেয় না; চীনেদের গা থেকে যে বিষম দুর্গন্ধ বেরোয়, তার কথাই বলছি, তারা যেন ব্রত নিয়েছে, কখনও স্নান করবে না।
প্রত্যেক বাড়ীখানি এক একখানি দোকান—লোকেরা উপরাতলায় বাস করে। রাস্তাগুলো এত সরু যে, চলতে গেলেই দুধারের দোকান যেন গায়ে লাগে। দশ পা চলতে না চলতে মাংসের দোকান দেখতে পাবে; এমন দোকানও আছে, যেখানে কুকুর-বেড়ালের মাংস বিক্রয় হয়। অবশ্য খুব গরীবেরাই কুকুর-বেড়াল খায়।
আর্যাবর্তনিবাসিনী হিন্দু মহিলাদের যেমন পর্দা আছে, তাদের যেমন কেউ কখনও দেখতে পায় না, চীনা মহিলাদেরও তদ্রূপ। অবশ্য শ্রমজীবী স্ত্রীলোকেরা লোকের সামনে বেরোয়। এদের মধ্যেও দেখা যায়, এক একটি স্ত্রীলোকের পা তোমাদের ছোট খোকার পায়ের চেয়ে ছোট; তারা হেঁটে বেড়াচ্ছে ঠিক বলা যায় না. খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে থপ থপ করে চলছে।
আমি কতকগুলি চীনে মন্দির দেখতে গেলাম। ক্যাণ্টনে যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ মন্দিরটি আছে, তা প্রথম বৌদ্ধ সম্রাট্ এবং সর্বপ্রথম ৫০০ জন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর স্মরণার্থে উৎসর্গীকৃত। অবশ্য স্বয়ং বুদ্ধদেব প্রধান মূর্তি; তাঁর নীচেই সম্রাট্ বসেছেন, আর দুধারে শিষ্যগণের মূর্তি—সব মূর্তিগুলিই কাঠে সুন্দররূপে খোদিত।
ক্যাণ্টন হতে আমি হংকঙে ফিরলাম। সেখান থেকে জাপানে গেলাম। নাগাসাকি বন্দরে প্রথমেই কিছুক্ষণের জন্য আমাদের জাহাজ লাগল। আমরা কয়েক ঘণ্টার জন্য জাহাজ থেকে নেমে শহরের মধ্যে গাড়ী করে বেড়ালাম। চীনের সহিত কি প্রভেদ! পৃথিবীর মধ্যে যত পরিষ্কার জাত আছে, জাপানীরা তাদের অন্যতম। এদের সবই কেমন পরিষ্কার! রাস্তাগুলো প্রায় সবই চওড়া সিধে ও বরাবর সমানভাবে বাঁধানো। খাঁচার মত এদের ছোট ছোট দিব্যি বাড়ীগুলো, প্রায় প্রতি শহর ও পল্লীর পশ্চাতে অবস্থিত চিড়গাছে ঢাকা চিরহরিৎ ছোট ছোট পাহাড়গুলো, বেঁটে সুন্দরকায় অদ্ভুত-বেশধারী জাপ, তাদের প্রত্যেক চালচলন অঙ্গভঙ্গী হাবভাব—সবই ছবির মত। জাপান ‘সৌন্দর্যভূমি’। প্রায় প্রত্যেক বাড়ীর পেছনে এক-একখানি বাগান আছে—তা জাপানী ফ্যাশনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুল্মতৃণাচ্ছাদিত ভূমিখণ্ড, ছোট ছোট কৃত্রিম জলপ্রণালী এবং পাথরের সাঁকো দিয়ে ভালরূপে সাজান।
নাগাসাকি থেকে কোবি গেলাম। কোবি গিয়ে জাহাজ ছেড়ে দিলাম, স্থলপথে ইয়োকোহামায় এলাম—জাপানের মধ্যবর্তী প্রদেশসমূহ দেখবার জন্য। আমি জাপানের মধ্যপ্রদেশে তিনটি বড় বড় শহর দেখেছি। ওসাকা—এখানে নানা শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত হয়; কিয়োটা—প্রাচীন রাজধানী; টোকিও—বর্তমান রাজধানী; টোকিও কলিকাতার প্রায় দ্বিগুণ হবে। লোকসংখ্যাও প্রায় কলিকাতার দ্বিগুণ।
ছাড়পত্র ছাড়া বিদেশীকে জাপানের ভিতরে ভ্রমণ করতে দেয় না।
দেখে বোধ হয়—জাপানীরা বর্তমানকালে কি প্রয়োজন, তা বুঝেছে; তারা সম্পূর্ণরূপে জাগরিত হয়েছে। ওদের সম্পূর্ণরূপে শিক্ষিত ও সুনিয়ন্ত্রিত স্থল-সৈন্য আছে। ওদের যে কামান আছে, তা ওদেরই একজন কর্মচারী আবিষ্কার করেছেন। সকলেই বলে, উহা কোন জাতির কামানের চেয়ে কম নয়। আর তারা তাদের নৌবলও ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। আমি একজন জাপানী স্থপতি-নির্মিত প্রায় এক মাইল লম্বা সকটি সুড়ঙ্গ (tunnel) দেখেছি।
এদের দেশলাই-এর কারখানা একটা দেখবার জিনিষ। এদের যে-কোন জিনিষের অভাব, তাই নিজের দেশে করবার চেষ্টা করছে। জাপানীদের নিজেদের একটি ষ্টীমার লাইনের জাহাজ চীন ও জাপানের মধ্যে যাতায়াত করে; আর এরা শীঘ্রই বোম্বাই ও ইয়োকোহামার মধ্যে জাহাজ চালাবে, মতলব করছে।
আমি এদের অনেকগুলি মন্দির দেখলাম। প্রত্যেক মন্দির কতকগুলি সংস্কৃত মন্ত্র প্রাচীন বাঙলা অক্ষরে লেখা আছে। মন্দিরে পুরোহিতদের মধ্যে অল্প কয়েকজন সংস্কৃত বোঝে। কিন্তু এরা বেশ বুদ্ধিমান্। বর্তমানকালে সর্বত্রই যে একটা উন্নতির জন্য প্রবল তৃষ্ণা দেখা যায়, তা পুরোহিতদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে। জাপানীদের সম্বন্ধে আমার মনে কত কথা উদিত হচ্ছে, তা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠির মধ্যে প্রকাশ করে বলতে পারি না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে, আমাদের দেশের যুবকেরা দলে দলে প্রতি বৎসর চীন ও জাপানে যাক। জাপানে যাওয়া আবার বিশেষ দরকার; জাপানীদের কাছে ভারত এখনও সর্বপ্রকার উচ্চ ও মহৎ পদার্থের স্বপ্নরাজ্যস্বরূপ।
আর তোমরা কি করছ? সারা জীবন কেবল বাজে বকছ। এস, এদের দেখে যাও, তারপর যাও—গিয়ে লজ্জায় মুখ লুকাও গে। ভারতের যেন জরাজীর্ণ অবস্থা হয়ে ভীমরতি ধরছে! তোমরা—দেশ ছেড়ে বাইরে গেলে তোমাদের জাত যায়!! এই হাজার বছরের ক্রমবর্ধমান জমাট কুসংস্কারের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বসে আছ, হাজার বছর ধরে খাদ্যাখাদ্যের শুদ্ধাশুদ্ধতা বিচার করে শক্তিক্ষয় করছ! পৌরোহিত্যরূপ আহাম্মকির গভীর ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছ! শত শত যুগের অবিরাম সামাজিক অত্যাচারে তোমাদের সব মনুষ্যত্বটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে—তোমরা কী বল দেখি? আর তোমরা এখন করছই বা কি? আহাম্মক, তোমরা বই হাতে করে সমুদ্রের ধারে পায়চারি করছ! ইওরোপীয় মস্তিস্কপ্রসূত কোন তত্ত্বের এক কণামাত্র—তাও খাঁটি জিনিষ নয়—সেই চিন্তার বদহজম খানিকটা ক্রমাগত আওড়াচ্ছ, আর তোমাদের প্রাণমন সেই ৩০৲ টাকার কেরানিগিরির দিকে পড়ে রয়েছে; না হয় খুব জোর একটা দুষ্ট উকিল হবার মতলব করছ। ইহাই ভারতীয় যুবকগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা। আবার প্রত্যেক ছাত্রের আশেপাশে একপাল ছেলে—তাঁর বংশধরগণ—‘বাবা, খাবার দাও, খাবার দাও’ করে উচ্চ চীৎকার তুলেছে!! বলি, সমুদ্রে কি জলের অভাব হয়েছে যে, তোমাদের বই, গাউন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা প্রভৃতি সমেত তোমাদের ডুবিয়ে ফেলতে পারে না?
এস, মানুষ হও। প্রথমে দুষ্ট পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। কারণ এই মস্তিষ্কহীন লোকগুলো কখনও শুধরোবে না। তাদের হৃদয়ের কখনও প্রসার হবে না। শত শত শতাব্দীর কুসংস্কার ও অত্যাচারের ফলে তাদের উদ্ভব; আগে তাদের নির্মূল কর। এস, মানুষ হও। নিজেদের সংকীর্ণ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখ, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে। তোমরা কি মানুষকে ভালবাসো? তোমরা কি দেশকে ভালবাসো? তা হলে এস, আমরা ভাল হবার জন্য—উন্নত হবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি। পেছনে চেও না—অতি প্রিয় আত্মীয়স্বজন কাঁদুক; পেছনে চেও না, সামনে এগিয়ে যাও।
ভারতমাতা অন্ততঃ সহস্র যুবক বলি চান। মনে রেখো—মানুষ চাই, পশু নয়। প্রভু তোমাদের এই বাঁধাধরা সভ্যতা ভাঙবার জন্য ইংরেজ গভর্ণমেণ্টকে প্রেরণ করেছেন, আর মান্দ্রাজের লোকই ইংরেজদের ভারতে বসবার প্রধান সহায় হয়। এখন জিজ্ঞাসা করি, সমাজের এই নূতন অবস্থা আনবার জন্য সর্বান্তঃকরণে প্রাণপণ যত্ন করবে, মান্দ্রাজ এমন কতকগুলি নিঃস্বার্থ যুবক দিতে কি প্রস্তুত—যারা দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হবে, তাদের ক্ষুধার্তমুখে অন্ন দান করবে, সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করবে, আর তোমাদের পূর্বপুরুষগণের অত্যাচার যারা পশুপদবীতে উপনীত হয়েছে, তাদের মানুষ করবার জন্য আমরণ চেষ্টা করবে?
... কুক কোম্পানী, চিকাগো—এই ঠিকানায় আমাকে পত্র লিখবে।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—ধীর, নিস্তব্ধ অথচ দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হবে। খবরের কাগজে হুজুক করা নয়। সর্বদা মনে রাখবে, নামযশ আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
বি
৬৮*
ব্রিজি মেডোজ
মেটকাফ, মাসাচুসেটস
২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
কাল তোমার পত্র পাইলাম। তুমি বোধ হয় এত দিনে জাপান হইতে [লেখা] আমার পত্র পাইয়াছ। জাপান হইতে আমি বঙ্কুবরে৩১ (Vancouver) পৌঁছিলাম। প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরাংশ দিয়া আমাকে যাইতে হইয়াছিল। খুব শীত ছিল। গরম কাপড়ের অভাবে বড় কষ্ট পাইতে হইয়াছিল। যাহা হউক, কোনরূপে বঙ্কুবরে পৌঁছিয়া তথা হইতে কানাডা দিয়া চিকাগোয় পৌঁছিলাম। তথায় আন্দাজ বার দিন রহিলাম। এখানে প্রায় প্রতিদিনই মেলা দেখিতে যাইতাম। সে এক বিরাট ব্যাপার। অন্ততঃ দশ দিন না ঘুরিলে সমুদয় দেখা অসম্ভব। বরদা রাও যে মহিলাটির সঙ্গে আমার আলাপ করাইয়া দিয়াছিলেন, তিনি ও তাঁহার স্বামী চিকাগো সমাজের মহা গণামান্য ব্যক্তি। তাঁহারা আমার প্রতি খুব সদ্ব্যবহার করিয়াছিলেন। কিন্তু এখানকার লোকে বিদেশীকে খুব যত্ন করিয়া থাকে, কেবল অপরকে তামাসা দেখাইবার জন্য; অর্থসাহায্য করিবার সময় প্রায় সকলেই হাত গুটাইয়া লয়। এবার এখানে বড় দুর্বৎসর, ব্যবসায়ে সকলেরই ক্ষতি হইতেছে, সুতরাং আমি চিকাগোয় অধিক দিন রহিলাম না। চিকাগো হইতে আমি বষ্টনে আসিলাম। লালুভাই বষ্টন পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনিও আমার প্রতি খুব সহৃদয় ব্যবহার করিয়াছিলেন। ...
এখানে আমার খরচ ভয়ানক হইতেছে। তোমার স্মরণ আছে তুমি আমায় ১৭০ পাউণ্ড নোট ও নগদ ৯ পাউণ্ড দিয়াছিলেন। এখন দাঁড়াইয়াছে ১৩০ পাউণ্ড। গড়ে আমার এক পাউণ্ড করিয়া প্রত্যহ খরচ পড়িতেছে। এখানে একটা চুরুটের দামই আমাদের দেশের আট আনা। আমেরিকানরা এত ধনী যে, তাহারা জলের মত টাকা খরচ করে, আর তাহারা আইন করিয়া সব জিনিষের মূল্য এত বেশী রাখিয়াছে যে, জগতের অপর কোন জাতি যেন কোনমতে এ দেশে ঘেঁষিতে না পারে। সাধারণ কুলি গড়ে প্রতিদিন ৯৲।১০৲ টাকা করিয়া রোজগার করে ও উহা খরচ করিয়া থাকে। এখানে আসিবার পূর্বে যে-সব সোনার স্বপন দেখিতাম, তাহা ভাঙিয়াছে। এক্ষণে অসম্ভবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে হইতেছে। শত শত বার মনে হইয়াছে, এ দেশ হইতে চলিয়া যাই; কিন্তু আবার মনে হয়, আমি একগুঁয়ে দানা, আর আমি ভগবানের নিকট আদেশ পাইয়াছি। আমি কোন পথ দেখিতে পাইতেছি না, কিন্তু তাঁহার চক্ষু তো সব দেখিতেছে। মরি বাঁচি, উদ্দেশ্য ছাড়িতেছি না।
তুমি অনুগ্রহপূর্বক থিওজফিষ্টদের সম্বন্ধে আমাকে যে সাবধান করিয়াছ, তাহা ছেলেমানুষি বলিয়া বোধ হয়। এ গোঁড়া খ্রীষ্টানের দেশ—এখানে কেহ উহাদের খোঁজ খবর রাখে না বলিলেই হয়। এখনও পর্যন্ত কোন থিওজফিষ্টের সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই, আর দু-এক বার অপরকে—কথাপ্রসঙ্গে উহাদের বিষয় অতিশয় ঘৃণার সহিত উল্লেখ করিতে শুনিয়াছি। আমেরিকানরা উহাদিগকে জুয়াচোর বলিয়া মনে করে।
আমি এক্ষণে বষ্টনের এক গ্রামে এক বৃদ্ধা মহিলার অতিথিরূপে বাস করিতেছি। ইঁহার সহিত রেলগাড়ীতে হঠাৎ আলাপ হয়। তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করিয়া তাঁহার নিকট রাখিয়াছেন। এখানে থাকায় আমার এই সুবিধা হইয়াছে যে, প্রত্যহ এক পাউণ্ড করিয়া যে খরচ হইতেছিল, তাহা বাঁচিয়া যাইতেছে; আর তাঁহার লাভ এই যে, তিনি তাঁহার বন্ধুগণকে নিমন্ত্রণ করিয়া ভারতাগত এক অদ্ভুত জীব দেখাইতেছেন!!! এ সব যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইবেই। আমাকে এখন অনাহার, শীত, অদ্ভুত পোষাকের দরুন রাস্তার লোকের বিদ্রূপ—এইগুলির সহিত যুদ্ধ করিয়া চলিতে হইতেছে। প্রিয় বৎস! জানিবে, কোন বড় কাজই গুরুতর পরিশ্রম ও কষ্টস্বীকার ব্যতীত হয় নাই। আমার মহিলাবন্ধুর এক জ্ঞাতিভাই আজ আমাকে দেখিতে আসিবেন। তিনি তাঁহার ভগিনীকে লিখিতেছেন, ‘প্রকৃত হিন্দু সাধককে দেখিয়া বিশেষ আনন্দ ও শিক্ষা হইতে পারে সন্দেহ নাই, তবে আমি এখন বুড়া হইয়াছি। এসোটেরিক বৌদ্ধগণ আমাকে আর ঠকাইতে পারিতেছে না।’ এই তো এখানে থিয়োজফির প্রভাব এবং উহার প্রতি ইহাদের শ্রদ্ধা! ‘মো—’র এক সময় বষ্টনের একটি খুব ধনী মহিলার কাছে বিশেষ খাতির ছিল, কিন্তু ‘মো-’র দরুনই বিশেষ উহাদের সব পসার মাটি হইয়াছে। এখন উক্ত মহিলা ‘এসোটেরিক বৌদ্ধধর্ম’ ও ঐরূপ সমুদয় ব্যাপারের প্রবল শত্রু হইয়া দাঁড়াইয়াছেন।
জানিয়া রাখো, এই দেশ খ্রীষ্টানের দেশ। এখানে আর কোন ধর্ম বা মতের প্রতিষ্ঠা কিছুমাত্র নাই বলিলেই হয়। আমি জগতে কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার ভয় করি না। আমি এখানে মেরী-তনয়ের সন্তানগণের মধ্যে বাস করিতেছি; প্রভু ঈশাই আমাকে সাহায্য করিবেন। একটি জিনিষ দেখিতে পাইতেছি; ইঁহারা আমার হিন্দুধর্মসম্বন্ধীয় উদার মত ও নাজারেথের অবতারের প্রতি ভালবাসা দেখিয়া খুব আকৃষ্ট হইতেছেন। আমি তাঁহাদিগকে বলিয়া থাকি যে, আমি সেই গালিলীয় মহাপুরুষের বিরুদ্ধে কিছুমাত্র বলি না, কেবল তাঁহারা যেমন যীশুকে মানেন, সেই সঙ্গে ভারতীয় মহাপুরুষগণকেও মানা উচিত। এ কথা ইঁহারা আদরপূর্বক গ্রহণ করিতেছেন। এখন আমার কার্য এইটুকু হইয়াছে যে, লোকে আমার সম্বন্ধে কতকটা জানিতে পারিয়াছে ও বলাবলি করিতেছে। এখানে এইরূপেই কার্য আরম্ভ করিতে হইবে। ইহাতে দীর্ঘ সময় ও অর্থের প্রয়োজন। এখন শীত আসিতেছে। আমাকে সকল রকম গরম কাপড় যোগাড় করিতে হইবে, আবার এখানকার অধিবাসী অপেক্ষা আমাদের অধিক কাপড়ের আবশ্যক হয়। ... বৎস! সাহস অবলম্বন কর। ভগবানের ইচ্ছায় ভারতে আমাদের দ্বারা বড় বড় কার্য সম্পন্ন হইবে। বিশ্বাস কর, আমরাই মহৎ কর্ম করিব, এই গরীব আমরা—যাহাদের লোকে ঘৃণা করে, কিন্তু যাহারা লোকের দুঃখ যথার্থ প্রাণে প্রাণে বুঝিয়াছে। রাজারাজড়াদের দ্বারা মহৎ কার্য হইবার আশা অতি অল্প।
চিকাগোয় সম্প্রতি একটা বড় মজা হইয়া গিয়াছে। কপুরতলার রাজা এখানে আসিয়াছিলেন, আর চিকাগো সমাজের কতকাংশ তাঁহাকে কেষ্ট-বিষ্টু করিয়া তুলিয়াছিল। মেলার জায়গায় এই রাজার সঙ্গে আমার দেখা হইয়াছিল, কিন্তু তিনি বড় লোক, আমার মত ফকিরের সঙ্গে কথা কহিবেন কেন? এখানে একটি পাগলাটে, ধুতিপরা মারাঠী ব্রাহ্মণ মেলায় কাগজের উপর নখের সাহায্যে প্রস্তুত ছবি বিক্রয় করিতেছিল। এ লোকটা খবরের কাগজের রিপোর্টারদের নিকট রাজার বিরুদ্ধে নানা কথা বলিয়াছিল; সে বলিয়াছিল—এ ব্যক্তি খুব নীচ জাতি, এই রাজারা ক্রীতদাসস্বরূপ, ইহারা দুর্নীতিপরায়ণ ইত্যাদি; আর এই সত্যবাদী (?) সম্পাদকেরা—যাহার জন্য আমেরিকা বিখ্যাত—এই লোকটার কথায় কিছু গুরুত্ব-আরোপের ইচ্ছায় তার পরদিন সংবাদপত্রে বড় বড় স্তম্ভ বাহির করিল, তাহারা ভারতাগত একজন জ্ঞানী পুরুষের বর্ণনা করিল—অবশ্য আমাকেই লক্ষ্য করিয়াছিল। আমাকে স্বর্গে তুলিয়া দিয়া আমার মুখ দিয়া তাহারা এমন সকল কথা বাহির করিল, যাহা আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবি নাই; তারপর এই রাজার সম্বন্ধে মারাঠী ব্রাহ্মণটি যাহা যাহা বলিয়াছিল, সব আমার মুখে বসাইল। আর তাহাতেই চিকাগো সমাজ একটা ধাক্কা খাইয়া তাড়াতাড়ি রাজাকে পরিত্যাগ করিল। এই মিথ্যাবাদী সম্পাদকেরা আমাকে দিয়া আমার দেশের লোককে বেশ ধাক্কা দিলেন। যাহা হউক—ইহাতে বুঝা যাইতেছে যে, এই দেশে টাকা অথবা উপাধির জাঁকজমক অপেক্ষা বুদ্ধির আদর বেশী।
কাল নারী-কারাগারের অধ্যক্ষা মিসেস্ জন্সন্ মহোদয়া এখানে আসিয়াছিলেন; এখানে কারাগার বলে না, বলে—সংশোধনাগার। আমেরিকায় যাহা যাহা দেখিলাম, তাহার মধ্যে ইহা এক অতি অদ্ভুত জিনিষ। কারাবাসিগণের সহিত কেমন সহৃদয় ব্যবহার করা হয়, কেমন তাহাদের চরিত্র সংশোধিত হয়, আবার তাহারা ফিরিয়া গিয়া সমাজের আবশ্যকীয় অঙ্গরূপে পরিণত হয়! কি অদ্ভুত, কি সুন্দর! না দেখিলে তোমাদের বিশ্বাস হইবে না। ইহা দেখিয়া তারপর যখন দেশের কথা ভাবিলাম, তখন আমার প্রাণ অস্থির হইয়া উঠিল। ভারতবর্ষে আমরা গরীবদের, সামান্য লোকদের, পতিতদের কি ভাবিয়া থাকি! তাহাদের কোন উপায় নাই, পালাইবার কোন রাস্তা নাই, উঠিবার কোন উপায় নাই। ভারতের দরিদ্র, ভারতের পতিত, ভারতের পাপিগণের সাহায্যকারী কোন বন্ধু নাই। সে যতই চেষ্টা করুক, তাহার উঠিবার উপায় নাই। তাহারা দিন দিন ডুবিয়া যাইতেছে। রাক্ষসবৎ নৃশংস সমাজ তাহাদের উপর ক্রমাগত যে আঘাত করিতেছে, তাহার বেদনা তাহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছে, কিন্তু তাহারা জানে না—কোথা হইতে ঐ আঘাত আসিতেছে। তাহারাও যে মানুষ, ইহা তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে। ইহার ফল দাসত্ব ও পশুত্ব। চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ কিছুদিন হইতে সমাজের এই দুরবস্থা বুঝিয়াছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁহারা হিন্দুধর্মের ঘাড়ে এই দোষ চাপাইয়াছেন। তাঁহারা মনে করেন, জগতের মধ্যে এই মহত্তর ধর্মের নাশই সমাজের উন্নতির একমাত্র উপায়। শোন বন্ধু, প্রভুর কৃপায় আমি ইহার রহস্য আবিষ্কার করিয়াছি। হিন্দুধর্মের কোন দোষ নাই। হিন্দুধর্ম তো শিখাইতেছেন—জগতে যত প্রাণী আছে, সকলেই তোমার আত্মারই বহু রূপ মাত্র। সমাজের এই হীনাবস্থার কারণ, কেবল এই তত্ত্বকে কার্যে পরিণত না করা, সহানুভূতির অভাব, হৃদয়ের অভাব। প্রভু তোমাদের নিকট বুদ্ধরূপে আসিয়া শিখাইলেন তোমাদিগকে গরীবের জন্য, দুঃখীর জন্য, পাপীর জন্য প্রাণ কাঁদাইতে, তাহাদের সহিত সহানুভূতি করিতে; কিন্তু তোমরা তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিলে না। তোমাদের পুরোহিতগণ—ভগবান্ ভ্রান্তমত-প্রচার দ্বারা অসুরদিগকে মোহিত করিতে আসিয়াছিলেন, এই ভয়ানক গল্প বানাইলেন। সত্য বটে, কিন্তু অসুর আমরা; যাহারা বিশ্বাস করিয়াছিল, তাহারা নহে। আর যেমন য়াহুদীরা প্রভু যীশুকে অস্বীকার করিয়া আজ সমগ্র জগতে গৃহশূন্য ভিক্ষুক হইয়া সকলের দ্বারা অত্যাচারিত ও বিতাড়িত হইয়া বেড়াইতেছে, সেইরূপ তোমরাও যে-কোন জাতি ইচ্ছা করিতেছে, তাহাদেরই ক্রীতদাস হইতেছ। অত্যাচারিগণ! তোমরা জান না যে, অত্যাচার ও দাসত্ব এক জিনিষেরই এপিঠ ওপিঠ। দুই-ই এক কথা।
বালাজী ও জি.জি-র স্মরণ থাকিতে পারে, একদিন সায়ংকালে পণ্ডিচেরীতে এক পণ্ডিতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক হইতেছিল। তাহার সেই বিকট ভঙ্গী ও তাহার ‘কদাপি ন’ (কখনও না)—এই কথা চিরকাল আমার স্মরণ থাকিবে। ইহাদের অজ্ঞতার গভীরতা দেখিয়া অবাক হইতে হয়। তাহারা জানে না, ভারত জগতের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ, আর সমুদয় জগৎ এই ত্রিশ কোটি লোককে অতি ঘৃণার চক্ষে দেখিয়া থাকে। তাহারা দেখে, এরা কীটতুল্য, ভারতের মনোরম ক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছে, এবং এ উহার উপর অত্যাচার করিবার চেষ্টা করিতেছে। সমাজের এই অবস্থাকে দূর করিতে হইবে ধর্মকে বিনষ্ট করিয়া নহে, পরন্তু হিন্দুধর্মের মহান্ উপদেশসমূহ অনুসরণ করিয়া এবং তাহার সহিত হিন্দুধর্মের স্বাভাবিক পরিণতিস্বরূপ বৌদ্ধধর্মের অদ্ভুত হৃদয়বত্তা লইয়া। লক্ষ লক্ষ নরনারী পবিত্রতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া, ভগবানে দৃঢ় বিশ্বাসরূপ বর্মে সজ্জিত হইয়া দরিদ্র পতিত ও পদদলিতদের প্রতি সহানুভূতিজনিত সিংহবিক্রমে বুক বাঁধুক এবং মুক্তি, সেবা, সামাজিক উন্নয়ন ও সাম্যের মঙ্গলময়ী বার্তা দ্বারে দ্বারে বহন করিয়া সমগ্র ভারতে ভ্রমণ করুক।
হিন্দুধর্মের ন্যায় আর কোন ধর্মই এত উচ্চতানে মানবাত্মার মহিমা প্রচার করে না, আবার হিন্দুধর্ম যেমন পৈশাচিকভাবে গরীব ও পতিতের গলায় পা দেয়, জগতে আর কোন ধর্ম এরূপ করে না। ভগবান্ আমাকে দেখাইয়া দিয়াছেন, ইহাতে ধর্মের কোন দোষ নাই। তবে হিন্দুধর্মের অন্তর্গত আত্মাভিমানী কতকগুলি ভণ্ড ‘পারমার্থিক ও ব্যাবহারিক’৩২ নামক মত দ্বারা সর্বপ্রকার অত্যাচারের আসুরিক যন্ত্র ক্রমাগত আবিষ্কার করিতেছে।
নিরাশ হইও না। স্মরণ রাখিও, ভগবান্ গীতায় বলিতেছেন, ‘কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়।’ কোমর বাঁধো, বৎস, প্রভু আমাকে এই কাজের জন্য ডাকিয়াছেন। সারা জীবন আমার নানা দুঃখযন্ত্রণার মধ্যেই কাটিয়াছে। আমি প্রাণপ্রিয় আত্মীয়গণকে একরূপ অনাহারে মরিতে দেখিয়াছি। লোকে আমাকে উপহাস ও অবজ্ঞা করিয়াছে, জুয়াচোরে বদমাশ বলিয়াছে (মান্দ্রাজের অনেকে এখনও আমাকে এইরূপ ভাবিয়া থাকে)। আমি এ সমস্তই সহ্য করিয়াছি তাহাদেরই জন্য, যাহারা আমাকে উপহাস ও ঘৃণা করিয়াছে। বৎস! এই জগৎ দুঃখের আগার বটে, কিন্তু ইহা মহাপুরুষগণের শিক্ষালয়স্বরূপ। এই দুঃখ হইতেই সহানুভূতি, সহিষ্ণুতা, সর্বোপরি অদম্য দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হয়, যে শক্তিবলে মানুষ সমগ্র জগৎ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেলেও একটু কম্পিত হয় না। যাহারা আমাকে ভণ্ড বিবেচনা করে, তাহাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। তাহাদের কিছু দোষ নাই। তাহারা শিশু, অতি শিশু, যদিও সমাজে তাহারা মহাগণ্যমান্য বলিয়া বিবেচিত। তাহাদের চক্ষু নিজেদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিসীমার বাহিরে আর কিছু দেখিতে পায় না। তাহাদের নিয়মিত কার্য—আহার, পান, অর্থোপার্জন ও বংশবৃদ্ধি—যেন গণিতের নিয়মে অতি সুশৃঙ্খলভাবে পর পর সম্পাদিত হইয়া চলিয়াছে। ইহার অতিরিক্ত আর কিছু তাহারা জানে না। বেশ সুখী তাহারা! তাহাদের ঘুমের ব্যাঘাত কিছুতেই হয় না। শত শত শতাব্দীর পাশব অত্যাচারের ফলে সমুত্থিত শোক, তাপ, দৈন্য ও পাপের যে কাতরধ্বনিতে ভারতাকাশ সমাকুল হইয়াছে, তাহাতেও তাহাদের জীবন সম্বন্ধে দিবাস্বপ্নের ব্যাঘাত হয় না! সেই শত শত যুগব্যাপী মানসিক, নৈতিক ও দৈহিক অত্যাচারের কথা যাহাতে ভগবানের প্রতিমাস্বরূপ মানুষকে ভারবাহী গর্দভে এবং ভগবতীর প্রতিমারূপা নারীকে সন্তান ধারণ করিবার দাসীস্বরূপা করিয়া ফেলিয়াছে এবং জীবন বিষময় করিয়া তুলিয়াছে, এ কথা তাহাদের স্বপ্নেও মনে উদিত হয় না। কিন্তু অন্যান্য অনেকে আছেন, যাঁহারা দেখিতেছেন, প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছেন, হৃদয়ের রক্তময় অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন; যাঁহারা মনে করেন, ইহার প্রতিকার আছে, আর প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া যাঁহারা ইহার প্রতিকারে প্রস্তুত আছেন। ‘ইহাদিগকে লইয়াই স্বর্গরাজ্য বিরচিত।’ ইহা কি স্বাভাবিক নহে যে, উচ্চস্তরে অবস্থিত এই সকল মহাপুরুষের—ঐ বিষোদ্গিরণকারী ঘৃণ্য কীটগণের প্রলাপবাক্য শুনিবার মোটেই অবকাশ নাই?
গণ্যমান্য, উচ্চপদস্থ অথবা ধনীর উপর কোন ভরসা রাখিও না। তাহাদের মধ্যে জীবনীশক্তি নাই—তাহারা একরূপ মৃতকল্প বলিলেই হয়। ভরসা তোমাদের উপর—পদমর্যাদাহীন, দরিদ্র, কিন্তু বিশ্বাসী—তোমাদের উপর। ভগবানে বিশ্বাস রাখো। কোন চালাকির প্রয়োজন নাই; চালাকি দ্বারা কিছুই হয় না। দুঃখীদের ব্যথা অনুভব কর, আর ভগবানের নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর—সাহায্য আসিবেই আসিবে। আমি দ্বাদশ বৎসর হৃদয়ে এই ভার লইয়া ও মাথায় এই চিন্তা লইয়া বেড়াইয়াছি। আমি তথাকথিত অনেক ধনী ও বড়লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়াছি, তাহারা আমাকে কেবল জুয়াচোর ভাবিয়াছে। হৃদয়ের রক্তমোক্ষণ করিতে করিতে আমি অর্ধেক পৃথিবী অতিক্রম করিয়া এই বিদেশে সাহায্যপ্রার্থী হইয়া উপস্থিত হইয়াছি। আর আমার স্বদেশের লোকেরাই যখন আমায় জুয়াচোর ভাবে, তখন আমেরিকানরা এক অপরিচিত বিদেশী ভিক্ষুককে অর্থ ভিক্ষা করিতে দেখিলে কত কী-ই না ভাবিবে? কিন্তু ভগবান্ অনন্তশক্তিমান্; আমি জানি, তিনি আমাকে সাহায্য করিবেন। আমি এই দেশে অনাহারে বা শীতে মরিতে পারি; কিন্তু হে মান্দ্রাজবাসী যুবকগণ, আমি তোমাদের নিকট এই গরীব, অজ্ঞ, অত্যাচার-পীড়িতদের জন্য সহানুভূতি, এই প্রাণপণ চেষ্টা—দায়স্বরূপ অর্পণ করিতেছি। যাও, এই মুহূর্তে সেই পার্থসারথির মন্দিরে—যিনি গোকুলের দীনদরিদ্র গোপগণের সখা ছিলেন, যিনি গুহক চণ্ডালকে আলিঙ্গন করিতে সঙ্কুচিত হন নাই, যিনি তাঁহার বুদ্ধ-অবতারে রাজপুরুষগণের আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করিয়া এক বেশ্যার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়াছিলেন; যাও, তাঁহার নিকট গিয়া সাষ্টাঙ্গে পড়িয়া যাও, এবং তাঁহার নিকট এক মহা বলি প্রদান কর; বলি—জীবন-বলি তাহাদের জন্য, যাহাদের জন্য তিনি যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাহাদের তিনি সর্বাপেক্ষা ভালবাসেন, সেই দীন দরিদ্র পতিত উৎপীড়িতদের জন্য। তোমরা সারা জীবন এই ত্রিশকোটি ভারতবাসীর উদ্ধারের জন্য ব্রত গ্রহণ কর, যাহারা দিন দিন ডুবিতেছে।
এ এক দিনের কাজ নয়। পথ ভীষণ কণ্টকপূর্ণ। কিন্তু পার্থসারথি আমাদের সারথি হইতেই প্রস্তুত, তাহা আমরা জানি। তাঁহার নামে, তাঁহার প্রতি অনন্ত বিশ্বাস রাখিয়া ভারতের শতশতযুগসঞ্চিত পর্বতপ্রমাণ অনন্ত দুঃখরাশিতে অগ্নিসংযোগ করিয়া দাও, উহা ভস্মসাৎ হইবেই হইবে।
তবে এস, ভ্রাতৃগণ! সমস্যাটির অন্তস্তলে প্রবেশ করিয়া ভাল করিয়া দেখ! এ ব্রত গুরুতর, আমরাও ক্ষুদ্রশক্তি। কিন্তু আমরা জ্যোতির তনয়, ভগবানের তনয়। ভগবানের জয় হউক—আমরা সিদ্ধিলাভ করিবই করিব। শত শত লোক এই চেষ্টায় প্রাণ ত্যাগ করিবে, আবার শত শত লোক উহাতে ব্রতী হইতে প্রস্তুত থাকিবে। প্রভুর জয়! আমি এখানে অকৃতকার্য হইয়া মরিতে পারি, আর একজন এই ভার গ্রহণ করিবে! রোগ কি বুঝিলে, ঔষধ কি তাহাও জানিলে, কেবল বিশ্বাসী হও। আমরা ধনী বা বড়লোককে গ্রাহ্য করি না। আমরা হৃদয়শূন্য মস্তিষ্কসার ব্যক্তিগণকে ও তাহাদের নিস্তেজ সংবাদপত্রের প্রবন্ধসমূহও গ্রাহ্য করি না। বিশ্বাস, বিশ্বাস, সহানুভূতি, অগ্নিময় বিশ্বাস, অগ্নিময় সহানুভূতি। জয় প্রভু, জয় প্রভু। তুচ্ছ জীবন, তুচ্ছ মরণ, তুচ্ছ ক্ষুধা, তুচ্ছ শীত। জয় প্রভু! অগ্রসর হও, প্রভু আমাদের নেতা। পশ্চাতে চাহিও না। কে পড়িল দেখিতে যাইও না। এগিয়ে যাও, সম্মুখে, সম্মুখে। এইরূপেই আমরা অগ্রগামী হইব—একজন পড়িবে, আর একজন তাহার স্থান অধিকার করিবে।
এই গ্রাম হইতে কাল আমি বষ্টনে যাইতেছি। সেখানে একটি বৃহৎ মহিলাসভায় বক্তৃতা করিতে হইবে। ইহারা (খ্রীষ্টান) রমাবাইকে সাহায্য করিতেছে। বষ্টনে গিয়া আমাকে প্রথমে কাপড় কিনিতে হইবে। সেখানে যদি বেশী দিন থাকিতে হয়, তবে আমার এ অপূর্ব পোষাক চলিবে না। রাস্তায় আমায় দেখিবার জন্য শত শত লোক দাঁড়াইয়া যায়। সুতরাং আমাকে কালো রঙের লম্বা জামা পড়িতে হইবে। কেবল, বক্তৃতার সময় গেরুয়া আলখাল্লা ও পাগড়ি পরিব। কি করিব? এখানকার মহিলাগণ এই পরামর্শ দিতেছেন। তাঁহারাই এখানকার সর্বময় কর্ত্রী; তাঁহাদের সহানুভূতি না পাইলে চলিবে না। এই পত্র তোমার নিকট পৌঁছিবার পূর্বে আমার সম্বল দাঁড়াইবে ৬০।৭০ পাউণ্ড। অতএব কিছু টাকা পাঠাইবার বিশেষ চেষ্টা করিবে। এদেশে প্রভাব বিস্তার করিতে হইলে কিছুদিন এখানে থাকা দরকার। আমি ভট্টাচার্য মহাশয়ের জন্য ফনোগ্রাফ দেখিতে যাইতে পারি নাই; কারণ, তাঁহার পত্র এখানে আসিয়া পাইলাম। যদি আবার চিকাগোয় যাই, তবে উহার জন্য চেষ্টা করিব। আমি চিকাগোয় আর যাইব কি না, জানি না। আমার তথাকার বন্ধুগণ আমাকে ভারতের প্রতিনিধি হইতে বলিয়াছিলেন, আর বরদা রাও যে ভদ্রলোকটির সহিত আলাপ করাইয়া দিয়াছিলেন, তিনি চিকাগো মেলার একজন কর্তা। কিন্তু আমি প্রতিনিধি হইতে অস্বীকার করি, কারণ চিকাগোয় এক মাসের অধিক থাকিতে গেলে আমার সামান্য সম্বল ফুরাইয়া যাইত।
কানাডা ব্যতীত সমগ্র আমেরিকায় রেলগাড়ীতে ভিন্ন ভিন্ন ক্লাস নাই। সুতরাং আমাকে ফার্ষ্ট ক্লাসে ভ্রমণ করিতে হইয়াছে, কারণ উহা ছাড়া আর ক্লাস নাই। আমি কিন্তু উহার পুলমান গাড়ীতে (Pullmans) চড়িতে ভরসা করি না। এগুলি খুব আরামপ্রদ; এখানে আহার, পান. নিদ্রা, এমন কি স্নানের পর্যন্ত সুবন্দোবস্ত আছে। তুমি যেন হোটেলে রহিয়াছ, বোধ করিবে। কিন্তু ইহাতে বেজায় খরচ।
এখানে সমাজের মধ্যে ঢুকিয়া তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া মহা কঠিন ব্যাপার। বিশেষতঃ এখন কেহ শহরে নাই, সকলেই গ্রীষ্মাবাসে গিয়াছে। শীতে আবার সব শহরে আসিবে, তখন তাহাদিগকে পাইব। সুতরাং আমাকে এখানে কিছুদিন থাকিতে হইবে। এত চেষ্টার পর আমি সহজে ছাড়িতেছি না। তোমরা কেবল যতটা পার, আমায় সাহায্য কর। আর যদি তোমরা নাই পার, আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করিয়া দেখিব। আর যদিই আমি এখানে রোগে, শীতে বা অনাহারে মরিয়া যাই, তোমরা এই ব্রত লইয়া উঠিয়া পড়িয়া লাগিবে। পবিত্রতা, সরলতা ও বিশ্বাস! আমি যেখানেই থাকি না কেন, আমার নামে যে-কোন চিঠি বা টাকা আসিবে, কুক কোম্পানীকে তাহা আমার নিকট পাঠাইতে বলিয়া দিয়াছি। ‘রোম এক দিনে নির্মিত হয় নাই।’ যদি তোমরা টাকা পাঠাইয়া আমাকে অন্ততঃ ছয় মাস এখানে রাখিতে পার, আশা করি—সব সুবিধা হইয়া যাইবে। ইতোমধ্যে আমিও যে-কোন কাষ্ঠখণ্ড সম্মুখে পাই, তাহাই ধরিয়া ভাসিতে চেষ্টা করিতেছি। যদি আমার ভরণপোষণের কোন উপায় করিতে পারি, তৎক্ষণাৎ তোমায় তার করিব।
প্রথমে আমেরিকায় চেষ্টা করিব; এখানে অকৃতকার্য হইলে ইংলণ্ডে চেষ্টা করিব। তাহাতেও কৃতকার্য না হইলে ভারতে ফিরিব ও ভগবানের পুনরাদেশের প্রতীক্ষা করিব। ‘রা—’র পিতা ইংলণ্ডে গিয়াছেন। তিনি বাড়ী যাইবার জন্য বিশেষ ব্যস্ত। তাঁহার অন্তরটা খুব ভাল, উপরটায় কেবল বেনিয়াসুলভ কর্কশতা। চিঠি পৌঁছিতে বিশ দিনের অধিক সময় লাগিবে।
এই নিউ ইংলণ্ডে এখনই এত শীত যে, প্রত্যহ প্রাতে ও রাত্রে আগুন জ্বালাইয়া রাখিতে হয়। কানাডায় আরও শীত। কানাডায় যত নীচু পাহাড়ে বরফ পড়িতে দেখিয়াছি, আর কোথাও সেরূপ দেখি নাই।
আমি আবার এই সোমবারে সেলেমে এক বৃহৎ মহিলাসভায় বক্তৃতা দিতে যাইতেছি। তাহাতে আরও অনেক সভাসমিতির সঙ্গে আমার পরিচয় হইবে। এইরূপে ক্রমশঃ পথ করিতে পারিব। কিন্তু এরূপ করিতে হইলে এই ভয়ানক মহার্ঘ দেশে অনেক দিন থাকিতে হয়। ভারতে টাকার (Rupee) দর চড়িয়া যাওয়ায় লোকের মনে মহা আশঙ্কার উদয় হইয়াছে। অনেক মিল বন্ধ হইয়াছে। সুতরাং এখন সাহায্যের চেষ্টা বৃথা। আমাকে এখন কিছুদিন অপেক্ষা করিতে হইবে।
এইমাত্র দরজীর কাছে গিয়াছিলাম, কিছু শীতবস্ত্রের অর্ডার দিয়া আসিলাম। তাহাতে ৩০০৲ টাকা বা তাহারও বেশী পড়িবে। ইহা যে খুব ভাল কাপড় হইবে, তাহা মনে করিও না, অমনি চলনসই গোছের হইবে। এখানকার স্ত্রীলোকেরা পুরুষের পোষাক সম্বন্ধে বড় খুঁতখুঁতে, আর এদেশে তাহাদেরই প্রভুত্ব। মিশনরীরা ইহাদের ঘাড় ভাঙিয়া যথেষ্ট অর্থ আদায় করে। ইহারা প্রতি বৎসর রমাবাইকে খুব সাহায্য করিতেছে। যদি তোমরা আমাকে এখানে রাখিবার জন্য টাকা পাঠাইতে না পার, এ দেশ হইতে চলিয়া যাইবার জন্য কিছু টাকা পাঠাইও। ইতোমধ্যে যদি অনুকূল কিছু ঘটে, লিখিব বা তার করিব। ‘কেব্ল্’ (তার) করিতে প্রতি শব্দে পড়ে ৪৲ টাকা।
তোমাদেরই
বিবেকানন্দ
৬৯*
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]
সেলেম
৩০ অগষ্ট, ’৯৩
প্রিয় অধ্যাপকজী,৩৩
আজ এখান থেকে আমি চলে যাচ্ছি। মনে হয় চিকাগো থেকে আপনি কিছু উত্তর পেয়েছেন। মিঃ স্যানবর্ন-এর কাছ থেকে পূর্ণ নির্দেশসহ আমন্ত্রণ পেয়েছি। সুতরাং সোমবার সারাটোগায় যাচ্ছি। আপনার গৃহিণীকে আমার শ্রদ্ধা জানাবেন। অষ্টিন ও অন্য শিশুদের ভালবাসা দেবেন। আপনি সত্যই মহাত্মা এবং শ্রীমতী রাইট অতুলনীয়া।
প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৭০*
সেলেম
শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩
প্রিয় অধ্যাপকজী,
আপনার প্রদত্ত পরিচয়পত্র পেয়েই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। চিকাগোর মিঃ থেলিস্ এর কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছি, যাতে মহাসভার কয়েকজন প্রতিনিধির নাম এবং অন্যান্য সংবাদ আছে।
মিস্ স্যানবর্ন-এর কাছ থেকে প্রেরিত চিঠিতে আপনার সংস্কৃতের অধ্যাপক আমাকে পুরুষোত্তম যোশী বলে ভুল করেছেন, এবং ঐ চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন যে, বষ্টনে এমন একটি সংস্কৃত গ্রন্থাগার আছে, যার তুল্য কিছু ভারতে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। গ্রন্থাগারটি দেখতে পেলে আমি কতই না খুশী হব!
‘মিঃ স্যানবর্ন আমাকে সোমবার সারাটোগায় আসতে বলেছেন এবং সেইমত আমি সেখানে যাচ্ছি। সেখানে আমি ‘স্যানাটোরিয়াম’ নামক বোর্ডিঙ হাউসে থাকব। যদি ইতোমধ্যে চিকাগো থেকে কোন সংবাদ আসে, আশা করি অনুগ্রহ করে তা সারাটোগা স্যানাটোরিয়ামে পাঠিয়ে দেবেন।
আপনি, আপনার মহীয়সী পত্নী এবং শিশুসন্তানগুলি আমার মনে এমন ছাপ রেখেছেন, যা কিছুতেই মুছে যাবার নয়। আমি যখন আপনাদের সঙ্গে থাকি, তখন সত্যি মনে হয়—স্বর্গের কাছাকাছি আছি। যিনি সব কিছুর দাতা, তিনি আপনার উপর তাঁর শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ বর্ষণ করুন।
কয়েক লাইন লিখে পাঠাচ্ছি—কবিতার মত করে। এই অত্যাচারটুকু আপনি ভালবেসে ক্ষমা করবেন, এই আশায়।
আপনার চিরবন্ধু
বিবেকানন্দ
পাহাড়ে পর্বতে উপত্যকায়
গীর্জায়, মন্দিরে, মসজিদে—
বেদ বাইবেল আর কোরানে
তোমাকে খুঁজেছি আমি ব্যর্থ ক্রন্দনে।
মহারণ্যে পথভ্রান্ত বালকের মত
কেঁদে কেঁদে ফিরেছি নিঃসঙ্গ,—
তুমি কোথায়—কোথায়—আমার প্রাণ, ওগো ভগবান্?
নাই, প্রতিধ্বনি শুধু বলে, নাই।
দিন, রাত্রি, মাস, বর্ষ কেটে যায়,
আগুন জ্বলতে থাকে শিরে,
কিভাবে দিন রাত্রি হয় জানি না,
হৃদয় ভেঙে যায় দুভাগ হয়ে।
গঙ্গার তীরে লুটিয়ে পড়ি বেদনায়,
রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি,
ধূলিকে সিক্ত করে তপ্ত অশ্রু,
হাহাকার মিশে যায় জনকলরবে;
সকল দেশের সকল মতের মহাজনদের
নাম নিয়ে ডেকে উঠি অধীর হয়ে,
বলি, আমাকে পথ দেখাও, দয়া কর,
ওগো, তোমরা যারা পৌঁছেছ পথের প্রান্তে।
কত বর্ষ কেটে গেল করুণ আর্তনাদে,
মুহূর্ত মনে হয় যুগ যেন,
তখন—একদিন আমার হাহাকারের মধ্যে
কে যেন ডাকল আমাকে আমারি নাম ধরে।
মৃদু মধু আস্বাদের মত এক স্বর—
‘পুত্র! আমার পুত্র! পুত্র মোর!’
সে কণ্ঠ বাজল হৃদয়ে একটি সুরে—
আত্মার প্রতিটি তন্ত্রী উঠল ঝঙ্কার দিয়ে।
উঠে দাঁড়াই। কোথায় সেই স্বর
যা ডাকছে আমায়—এমন ক’রে?
খুঁজে ফিরি এখানে, ওখানে—সেখানে,
বারে বারে—পথে ও প্রান্তে।
ঐ ঐ আবার সেই দৈবী স্বর!
ঐ তো শুনছি আমি, আমারি আহ্বান!
আবেগে আনন্দে নিরুদ্ধ হৃদয়
ডুবে গেল পরমা শান্তিতে।
জ্বলে উঠল আত্মা পরম জ্যোতিতে
খুলে গেল হৃদয়ের দ্বার,
আনন্দ! আনন্দ! একি অপরূপ!
প্রিয় মোর, প্রাণ মোর, সর্বস্ব আমার,
তুমি এখানে, এত কাছে,—আমারি হৃদয়ে?
আমারি হৃদয়ে তুমি নিত্যকাল রাজার গৌরবে!
সেইদিন থেকে যখনি যেখানে যাই
বুঝেছি হৃদয়ে, তুমি আছ পাশে পাশে
পর্বতে—উপত্যকায়—শিখরে—সানুতে
—
দূরে বহু দূরে, ঊর্ধ্বে আরও ঊর্ধ্বে।
চাঁদের কোমল আলো, তারকার দ্যুতি,
দিবসের মহান্ উদ্ভাস—
সবার অন্তর-জ্যোতিরূপে প্রকাশিত;
তাঁর শক্তি সকল আলোর প্রাণ!
মহিমার ঊষা তিনি, সন্ধ্যা বিগলিত,
অনন্ত অশান্ত তিনি সমুদ্র,
প্রকৃতির সুষমায়, পাখীর সঙ্গীতে
শুধু তিনি, একমাত্র তিনি।
ঘোর দুর্বিপাকে যখন জড়িয়ে পড়ি,
অবসন্ন প্রাণ, ক্লান্ত ও কাতর,
যখন প্রকৃতি আমাকে চূর্ণ করে
ক্ষমাহীন তার নিয়মে—
শুনেছি তোমারি স্বর তখনি হে প্রিয়!
বলেছ গোপনে মৃদুভাষে ‘আমি এসেছি’,
জেগেছি সেই স্বরে; তোমার সঙ্গে
সহস্র মৃত্যুর মুখে আমি যে নির্ভয়।
তুমি আছ মায়ের গানে, যা শুনে
কোলের শিশু ঘুমিয়ে পড়ে মায়ের কোলে,
তুমি আছ শিশুর হাসিতে ও খেলায়,
দাঁড়িয়ে থাকো তাদের মাঝে আলো করে।
পবিত্রহৃদয় বন্ধুরা যখন মিলিত হয়
তাদেরও মাঝে দাঁড়িয়ে থাকো তুমি।
সুধা ঢেলে দাও তুমি মায়ের চুমোয়,
তুমি সুর দাও শিশুর মা-মা ডাকে।
প্রাচীন ঋষির তুমি ভগবান্,
সকল মতের তুমি চিরন্তন উৎস,
বেদ, বাইবেল আর কোরান গাইছে
তোমারি নাম উচ্চকণ্ঠে—সমস্বরে।
আছ, আছ, তুমি আছ,
ধাবমান জীবনে তুমি আত্মার আত্মা,
ওঁ তৎ সৎ ওঁ,৩৪—আমার ঈশ্বর তুমি,
প্রিয় আমার, আমি তোমার, আমি তোমারি।
৭১*
চিকাগো
২ অক্টোবর, ’৯৩
প্রিয় অধ্যাপকজী,
আমার দীর্ঘ নীরবতার বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন জানি না। প্রথমতঃ মহাসভায় আমি শেষ মুহূর্তে একেবারে বিনা প্রস্তুতিতে হাজির হয়েছিলাম। কিছু সময় তার জন্য নিদারুণভাবে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ মহাসভায় প্রায় প্রতিদিন আমাকে বক্তৃতা করতে হয়েছে, ফলে লিখবার কোন সময়ই করে উঠতে পারিনি। শেষ কথা এবং সবচেয়ে বড় কথা এই যে, হে হৃদয়বান্ বন্ধু, আপনার কাছে আমি এমনই ঋণী যে, তাড়াহুড়ো করে—চিঠির উত্তর দেবার জন্যেই—কিছু একটা লিখে পাঠালে তা আপনার অহেতুক সৌহার্দ্যের অমর্যাদা হত। মহাসভার পাট এখন চুকেছে।
প্রিয় ভ্রাতা, সেই মহাসভায়, যেখানে সারা পৃথিবীর বিশিষ্ট বক্তা ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা উপস্থিত, সেখানে তাঁদের সামনে দাঁড়াতে এবং বক্তৃতা দিতে আমার যে কী ভয় হচ্ছিল! কিন্তু প্রভু আমাকে শক্তি দিয়েছেন। প্রায় প্রতিদিন আমি বীরের মত (?) সভাকক্ষে শ্রোতাদের সম্মুখীন হয়েছি। যদি আমি সফল হয়ে থাকি, তিনিই শক্তিসঞ্চার করেছেন; যদি আমি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়ে থাকি—তা যে হব আমি আগে থেকেই জানতাম—তার কারণ আমি নিতান্ত অজ্ঞান।
আপনার বন্ধু অধ্যাপক ব্রাডলি আমার প্রতি খুবই দয়া প্রকাশ করেছেন এবং সব সময় আমাকে উৎসাহিত করেছেন। আহা! সকলে আমার প্রতি—আমার মত নগণ্যের প্রতি কী না প্রীতিপরায়ণ, ভাষায় তা প্রাকাশ করা যায় না! প্রভু ধন্য, জয় হোক তাঁর, তাঁর কৃপাদৃষ্টিতে ভারতের দরিদ্র অজ্ঞ এক সন্ন্যাসী এই মহাশক্তির দেশে পণ্ডিত ধর্মযাজকদের সমতুল্য গণ্য হয়েছে। প্রিয় ভ্রাতা, জীবনের প্রতিটি দিনে আমি যেভাবে প্রভুর করুণা পাচ্ছি, আমার ইচ্ছা হয়, ছিন্নবস্ত্রে ও মুষ্টিভিক্ষায় যাপিত লক্ষ লক্ষ যুগব্যাপী জীবন দিয়ে তাঁর কাজ করে যাই—কাজের মধ্যে দিয়েই তাঁর সেবা করে যাই।
আহা, আমি কী ভাবেই না চেয়েছি, আপনি এখানে এসে ভারতের কয়েকজন মধুরচরিত্র ব্যক্তিকে দেখে যান—কোমলপ্রাণ বৌদ্ধ ধর্মপালকে, বাগ্মী মজুমদারকে; অনুভব করবেন, সেই সুদূর দরিদ্র ভারতেও এমন মানুষ আছেন, যাঁদের হৃদয় এই বিশাল শক্তিশালী দেশের মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে সমতালে স্পন্দিত হয়।
আপনার পুণ্যবতী পত্নীকে আমার অসীম শ্রদ্ধা। আপনার মধুর সন্তানগুলিকে আমার অনন্ত ভালবাসা ও আশীর্বাদ।
যথার্থ উদারমনা কর্ণেল হিগিন্সন আমাকে বলেছেন যে, আপনার কন্যা তাঁর কন্যাকে আমার বিষয়ে কিছু লিখেছেন। কর্ণেল আমার প্রতি খুবই সহানুভূতিপরায়ণ। আমি আগামী কাল এভানষ্টনে যাচ্ছি। সেখানে অধ্যাপক ব্রাডলিকে দেখব, আশা করি।
প্রভু আমাদের সকলকে পবিত্র থেকে পবিত্রতর করুন, যাতে আমরা এই পার্থিব দেহটা ছুঁড়ে ফেলে দেবার আগেই পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করতে পারি।
বিবেকানন্দ
(পৃথক্ একটি কাগজে লিখিত পত্রের পরের অংশ)
আমি এখন এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছি। সমস্ত জীবন সকল অবস্থাকে তাঁরই দান বলে গ্রহণ করেছি এবং শান্তভাবে চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। আমেরিকায় প্রথম দিকে আমার অবস্থা ছিল ডাঙায় তোলা মাছের মত। আমি প্রভুর দ্বারা চালিত হয়ে এসেছি—আমার আশঙ্কা হল, সেই এতদিনের অভ্যস্ত জীবনের ধারা এবার বোধহয় ত্যাগ করতে হবে, এবার বোধহয় নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে—এই ধারণাটা কী জঘন্য অন্যায় আর অকৃতজ্ঞতা! আমি এখন স্পষ্ট বুঝেছি যে, যিনি আমাকে হিমালয়ের তুষার-শৈলে কিম্বা ভারতের দগ্ধ প্রান্তরে পথ দেখিয়েছেন, তিনিই এখানে পথ দেখাবেন, সাহায্য করবেন। তাঁর জয় হোক, অশেষ জয় হোক। সুতরাং আমি আবার আমার পুরাতন রীতিতে শান্তভাবে গা ঢেলে দিয়েছি। কেউ এগিয়ে এসে আমাকে খেতে দেয়, হয়তো কেউ দেয় আশ্রয়, কেউ বলে—তাঁর কথা শোনাও আমাদের। আমি জানি তিনিই তাদের পাঠিয়েছেন—আমি শুধু নির্দেশ পালন করে যাব। তিনি আমাকে সব যোগাচ্ছেন। তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পযুর্পাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্॥ গীতা, ৯।২২
এমনি এশিয়াতে, এমনি ইওরোপে, এমনি আমেরিকায়, ভারতের মরুভূমির মধ্যেও একই জিনিষ। আমেরিকার বাণিজ্য-ব্যস্ততার মধ্যেও অন্য কিছু নয়। কারণ তিনি কি এখানেও নেই? আর যদি তিনি আমার পাশে সত্যি এখানে না থাকেন, তাহলে নিশ্চিত ধরে নেব, তিনি চান যে, এই তিন মিনিটের মাটির শরীর আমি যেন ছেড়ে দিই;—হ্যাঁ, তাহলে তাই তিনি চান, এবং আমি তা সানন্দে পালন করবার ভরসা রাখি।
ভ্রাতঃ, আমাদের সাক্ষাৎ আর হতেও পারে, নাও পারে, তিনিই জানেন। আপনি বিদ্বান্, মহান্ ও পুণ্যবান্। আপনাকে বা আপনার পত্নীকে কিছু শোনাবার স্পর্ধা আমি করি না। তবে আপনার সন্তানদের জন্যঃ
প্রিয় বাছারা, পিতামাতার চেয়েও তিনি তোমাদের নিকটতর। তোমরা ফুলের মত পবিত্র ও নির্মল। সেভাবেই থাকো। তাহলেই তিনি নিজেকে প্রকাশ করবেন তোমাদের কাছে। বাছা অষ্টিন, যখন তুমি খেলা কর, তখন তোমার সঙ্গে খেলে যান আর এক খেলুড়ে, যাঁর থেকে আর কেউ তোমাকে বেশী ভালবাসেন না। আহা, কি যে মজায় ভরা তিনি। খেলা বৈ তিনি নেই। কখনও মস্ত মস্ত গোলা নিয়ে তিনি খেলা করেন, যেগুলোকে আমরা বলি পৃথিবী বা সূর্য। কখনও খেলেন তোমারি মত ছোট ছেলের সঙ্গে, হেসে হেসে খেলে যান কত রকমের খেলা। তাঁকে খুঁজে নিয়ে খেলতে পারলে কেমন মজা, একবার সেটি ভেবে দেখ।
প্রিয় অধ্যাপকজী, সম্প্রতি আমি ঘোরাফেরা করছি। চিকাগোয় এলেই আমি মিঃ ও মিসেস লায়নকে দেখতে যাই। আমার দেখা মহত্তম দম্পতিদের অন্যতম এঁরা। যদি অনুগ্রহ করে আমাকে কিছু লেখেন, দয়া করে তা ‘মিঃ জন্ বি. লায়ন, ২৬২ মিশিগান এভিনিউ, চিকাগো,’—এই ঠিকানায় পাঠাবেন।
যং শৈবাঃ সমুপাসতে শিব ইতি ব্রহ্মেতি বেদান্তিনো।
বৌদ্ধা বুদ্ধ ইতি প্রমাণপটবঃ কর্তেতি নৈয়ায়িকাঃ॥
অর্হন্নিত্যথ জৈনশাসনরতাঃ কর্মেতি মীমাংসকাঃ
সোঽয়ং বো বিদধাতু বাঞ্ছিতফলং ত্রৈলোক্যনাথো হরিঃ॥
নৈয়ায়িক বা দ্বৈতবাদী বিখ্যাত দার্শনিক উদয়নাচার্য এই শ্লোকটি রচনা করেছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘কুসুমাঞ্জলি’র প্রথমেই এই আশীর্বাণী উচ্চারিত হয়েছে। এই শ্লোকে তিনি চেষ্টা করেছেন সৃষ্টিকর্তা ও পরমপ্রেমিক নীতিনিয়ন্তার প্রকাশনিরপেক্ষ সত্তাকে প্রতিপাদন করতে।
আপনার সদাকৃতজ্ঞ বন্ধু
বিবেকানন্দ
৭২*
চিকাগো,
১০ অক্টোবর, ১৮৯৩
প্রিয় মিসেস উডস,
গতকাল আপনার চিঠি পেয়েছি। এখন আমি চিকাগোর বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছি—আমার বিবেচনায় তা বেশ ভালই হচ্ছে। ৩০ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে প্রতি বক্তৃতায় পাওয়া যাচ্ছে; সম্প্রতি ধর্মমহাসভার দরুন চিকাগোয় আমার নাম এমনই ছড়িয়ে পড়েছে যে, এই ক্ষেত্রটি ত্যাগ করা বর্তমানে যুক্তিযুক্ত হবে না। মনে হয়, এ ব্যাপারে আপনিও নিশ্চয় একমত হবেন। যাই হোক, আমি শীঘ্রই বষ্টনে যেতে পারি; ঠিক কবে, তা অবশ্য বলতে পারি না। গতকাল ষ্ট্রীটর থেকে ফিরেছি, সেখানে একটি বক্তৃতায় ৮৭ ডলার মিলেছে। এই সপ্তাহে প্রতিদিনই আমার বক্তৃতা আছে। সপ্তাহের শেষে আরও আমন্ত্রণ আসবে বলে আমার বিশ্বাস। মিঃ উডসকে আমার প্রীতি, এবং সকল বন্ধুকে শুভেচ্ছাদি।
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
৭৩*
C/o J. B. Lyon
২৬২ মিশিগান এভিনিউ, চিকাগো
২৬ অক্টোবর, ’৯৩
প্রিয় অধ্যাপকজী,
আপনি শুনে খুশী হবেন যে, এখানে আমার কাজ ভালই চলছে এবং এখানে প্রায় সকলেই আমার প্রতি খুব সহৃদয়, অবশ্য নিতান্ত গোঁড়াদের বাদ দিয়ে। নানা দূরদেশ থেকে বহু মানুষ এখানে বহু পরিকল্পনা, ভাব ও আদর্শ প্রচার করবার উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছে, এবং আমেরিকাই একমাত্র স্থান, যেখানে সব কিছুর সাফল্যের সম্ভাবনা আছে। তবে আমার পরিকল্পনার বিষয়ে একদম আর কিছু না বলাই ঠিক করেছি। সেই ভাল। ... পরিকল্পনার জন্য একাগ্রভাবে খেটে যাওয়াই আমার ইচ্ছা, পরিকল্পনাটা থাকবে আড়ালে, বাইরে কাজ করে যাব, অন্যান্য বক্তার মত।
আমাকে যিনি এখানে এনেছেন এবং এখনও পর্যন্ত যিনি আমাকে ত্যাগ করেননি, তিনি নিশ্চয় যে অবধি আমি এখানে থাকব, আমাকে ত্যাগ করবেন না। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে, আমি ভালই করছি—এবং টাকাকড়ি পাওয়ার ব্যাপার যদি বলেন, খুবই ভাল করার আশা রাখি। অবশ্য আমি এ ব্যাপারে একেবারেই কাঁচা, কিন্তু শীঘ্রই এ ব্যবসার কৌশল শিখে নেব। চিকাগোয় আমি খুবই জনপ্রিয়, সুতরাং এখানে আরও কিছু সময় থাকতে ও টাকা সংগ্রহ করতে চাই।
আগামী কাল শহরের সবচেয়ে প্রভাবসম্পন্ন মহিলাদের ‘ফর্টনাইটলি ক্লাব’-এ বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা করতে যাব। হৃদয়বান্ বন্ধু! আপনাকে কিভাবে ধন্যবাদ জানাব জানি না; এবং জানি না কিভাবে তাঁকে ধন্যবাদ জানাব, যিনি আপনার সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। এখন যে আমার কাছে পরিকল্পনার সাফল্য সম্ভব বোধ হচ্ছে, সেটা আপনারই জন্য।
ইহজগতে অগ্রগতির প্রতি পদক্ষেপে আনন্দ ও শান্তি লাভ করুন। আপনার সন্তানদের জন্য আমার প্রীতি ও আশীর্বাদ।
সদা প্রীতিবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৭৪*
চিকাগো
২ নভেম্বর, ১৮৯৩
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
কাল তোমার পত্র পাইলাম। আমার এক মুহূর্তের অবিশ্বাস ও দুর্বলতার জন্য তোমরা সকলে এত কষ্ট পাইয়াছ, তাহার জন্য অতিশয় দুঃখিত। যখন ছবিলদাস আমাকে ছাড়িয়া চলিয়া গেল, তখন নিজেকে এত অসহায় ও নিঃসম্বল বোধ করিলাম যে, নিরাশ হইয়া তোমাদিগকে তার করিয়াছিলাম। তারপর হইতে ভগবান্ আমাকে অনেক বন্ধু ও সহায় দিয়াছেন। বষ্টনের নিকটবর্তী এক গ্রামে ডক্টর রাইটের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীকভাষার অধ্যাপক। তিনি আমার প্রতি অতিশয় সহানুভূতি দেখাইলেন, ধর্মমহাসভায় যাইবার বিশেষ আবশ্যকতা বুঝাইলেন—তিনি বলিলেন, উহাতে সমুদয় আমেরিকান জাতির সহিত আমার পরিচয় হইবে। আমার সহিত কাহারও আলাপ ছিল না, সুতরাং ঐ অধ্যাপক আমার জন্য সকল বন্দোবস্ত করিবার ভার স্বয়ং লইলেন। অবশেষে আমি পুনরায় চিকাগোয় আসিলাম। এখানে এক ভদ্রলোকের গৃহে—ধর্মমহাসভার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সকল প্রতিনিধির সহিত আমারও থাকিবার ব্যবস্থা হইল।
আপনার স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
‘মহাসভা’ খুলিবার দিন প্রাতে আমরা সকলে ‘শিল্পপ্রাসাদ’ (Art Place) নামক বাটীতে সমবেত হইলাম। সেখানে মহাসভার অধিবেশনের জন্য একটি বৃহৎ ও কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থায়ী হল নির্মিত হইয়াছিল। এখানে সর্বজাতীয় লোক সমবেত হইয়াছিলেন। ভারতবর্ষ হইতে আসিয়াছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ও বোম্বাই-এর নগরকার; বীরচাঁদ গান্ধী জৈনসমাজের প্রতিনিধিরূপে এবং এনি বেসাণ্ট ও চক্রবর্তী থিওসফির প্রতিনিধি রূপে আসিয়াছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে মজুমদারের সহিত আমার পূর্বে পরিচয় ছিল, আর চক্রবর্তী আমার নাম জানিতেন। বাসা হইতে ‘শিল্পপ্রাসাদ’ পর্যন্ত খুব শোভাযাত্রা করিয়া যাওয়া হইল এবং আমাদের সকলকেই প্লাটফর্মের উপর শ্রেণীবদ্ধভাবে বসানো হইল। কল্পনা করিয়া দেখ, নীচে একটি হল, আর উপরে এক প্রকাণ্ড গ্যালারি; তাহাতে আমেরিকার সুশিক্ষিত সমাজের বাছা বাছা ৬।৭ হাজার নরনারী ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া উপবিষ্ট, আর প্লাটফর্মের উপর পৃথিবীর সর্বজাতীয় পণ্ডিতের সমাবেশ। আর আমি, যে জীবনে কখনও সাধারণের সমক্ষে বক্তৃতা করে নাই, সে এই মহাসভায় বক্তৃতা করিবে! সঙ্গীত, বক্তৃতা প্রভৃতি অনুষ্ঠান যথারীতি ধুমধামের সহিত সম্পন্ন হইবার পর সভা আরম্ভ হইল। তখন একজন একজন করিয়া প্রতিনিধিকে সভার সমক্ষে পরিচিত করিয়া দেওয়া হইল; তাঁহারাও অগ্রসর হইয়া কিছু কিছু বলিলেন। অবশ্য আমার বুক দুরদুর করিতেছিল ও জিহ্বা শুষ্কপ্রায় হইয়াছিল। আমি এতদূর ঘাবড়াইয়া গেলাম যে, পূর্বাহ্নে বক্তৃতা করিতে ভরসা করিলাম না। মজুমদার বেশ বলিলেন, চক্রবর্তী আরও সুন্দর বলিলেন। খুব করতালিধ্বনি হইতে লাগিল। তাঁহারা সকলেই বক্তৃতা প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছিলেন। আমি নির্বোধ, কিছুই প্রস্তুত করি নাই। দেবী সরস্বতীকে প্রণাম করিয়া অগ্রসর হইলাম। ডক্টর ব্যারোজ আমার পরিচয় দিলেন। আমার গৈরিক বসনে শ্রোতৃবৃন্দের চিত্ত কিছু আকৃষ্ট হইয়াছিল, আমেরিকাবাসীদিগকে ধন্যবাদ দিয়া এবং আরও দু-এক কথা বলিয়া একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা করিলাম। যখন আমি ‘আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ’ বলিয়া সভাকে সম্বোধন করিলাম, তখন দুই মিনিট ধরিয়া এমন করতালিধ্বনি হইতে লাগিল যে, কানে যেন তালা ধরিয়া যায়। তারপর আমি বলিতে আরম্ভ করিলাম; যখন আমার বলা শেষ হইল, তখন হৃদয়ের আবেগে একেবারে যেন অবশ হইয়া বসিয়া পড়িলাম। পরদিন সব খবরের কাগজে বলিতে লাগিল, আমার বক্তৃতাই সেই দিন সকলের প্রাণে লাগিয়াছিল; সুতরাং তখন সমগ্র আমেরিকা আমাকে জানিতে পারিল। সেই শ্রেষ্ঠ টীকাকার শ্রীধর সত্যই বলিয়াছেন, ‘মূকং করোতি বাচালং’—ভগবান্ বোবাকেও মহাবক্তা করিয়া তোলেন। তাঁহার নাম জয়যুক্ত হউক! সেই দিন হইতে আমি একজন বিখ্যাত লোক হইয়া পড়িলাম, আর যে দিন হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে আমার বক্তৃতা পাঠ করিলাম, সেই দিন ‘হল’-এ এত লোক হইয়াছিল যে, আর কখনও সেরূপ হয় নাই। একটি সংবাদপত্র হইতে আমি কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছিঃ
‘মহিলা—মহিলা—কেবল মহিলা—সমস্ত জায়গা জুড়িয়া, কোণ পর্যন্ত ফাঁক নাই, বিবেকানন্দের বক্তৃতা হইবার পূর্বে অন্য যে সকল প্রবন্ধ পঠিত হইতেছিল, তাহা ভাল না লাগিলেও কেবল বিবেকানন্দের বক্তৃতা শুনিবার জন্যই অতিশয় সহিষ্ণুতার সহিত বসিয়াছিল, ইত্যাদি।’ যদি সংবাদপত্রে আমার সম্বন্ধে যে-সকল কথা বাহির হইয়াছে, তাহা কাটিয়া পাঠাইয়া দিই, তুমি আশ্চর্য হইবে। কিন্তু তুমি তো জানই, নাম-যশকে আমি ঘৃণা করি। এইটুকু জানিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যখনই আমি প্লাটফর্মে দাঁড়াইতাম, তখনই আমার জন্য কর্ণবধিরকারী করতালি পড়িয়া যাইত। প্রায় সকল কাগজেই আমাকে খুব প্রশংসা করিয়াছে। খুব গোঁড়াদের পর্যন্ত স্বীকার করিতে হইয়াছে, ‘এই সুন্দরমুখ বৈদ্যুতিকশক্তিশালী অদ্ভুত বক্তাই মহাসভায় শ্রেষ্ঠ আসন অধিকার করিয়াছেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এইটুকু জানিলেই তোমাদের যথেষ্ট হইবে যে, ইহার পূর্বে প্রাচ্যদেশীয় কোন ব্যক্তিই আমেরিকান সমাজের উপর এরূপ প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন নাই।
আমেরিকানদের দয়ার কথা কি বলিব। আমার এক্ষণে আর কোন অভাব নাই। আমি খুব সুখে আছি, আর ইওরোপ যাইতে আমার যে খরচ লাগিবে, তাহা আমি এখান হইতেই পাইব। অতএব তোমাদের আর আমাকে কষ্ট করিয়া টাকা পাঠাইবার আবশ্যক নাই। একটা কথা—তোমরা কি একসঙ্গে ৮০০৲ টাকা পাঠাইয়াছিলে? আমি কুক কোম্পানীর নিকট হইতে কেবল ৩০ পাউণ্ড পাইয়াছি। যদি তুমি ও মহারাজ পৃথক্ পৃথক্ টাকা পাঠাইয়া থাকো, তাহা হইলে বোধ হয় কতকটা টাকা এখনও আমার নিকট পৌঁছায় নাই। যদি একত্র পাঠাইয়া থাকো, তবে একবার অনুসন্ধান করিও।
নরসিংহাচার্য নামে একটি বালক আমাদের নিকট আসিয়া জুটিয়াছে। সে গত তিন বৎসর ধরিয়া চিকাগো শহরে অলসভাবে কাটাইতেছে। ঘুরিয়া বেড়াক বা যাহাই করুক, আমি তাহাকে ভালবাসি। কিন্তু যদি তাহার সম্বন্ধে তোমার কিছু জানা থাকে, তাহা লিখিবে। সে তোমাকে জানে। যে বৎসর পারি একজিবিশন হয়, সেই বৎসর সে ইওরোপে আসে। আমার পোষাক প্রভৃতির জন্য যে গুরুতর ব্যয় হইয়াছে, তাহা সব দিয়া আমার হাতে এখন ২০০ শত পাউণ্ড আছে। আর আমার বাড়ীভাড়া বা খাইখরচের জন্য এক পয়সাও লাগে না। কারণ ইচ্ছা করিলেই এই শহরের অনেক সুন্দর সুন্দর বাড়ীতে আমি থাকিতে পারি। আর আমি বরাবরই কাহারও না কাহারও অতিথি হইয়া রহিয়াছি। এই জাতির এত অনুসন্ধিৎসা! তুমি আর কোথাও এরূপ দেখিবে না। ইহারা সব জিনিষ জানিতে ইচ্ছা করে, আর ইহাদের নারীগণ সকল দেশের নারী অপেক্ষা উন্নত; আবার সাধারণতঃ আমেরিকান নারী আমেরিকান পুরুষ অপেক্ষা অধিক শিক্ষিত ও উন্নত। পুরুষে অর্থের জন্য সারা জীবনটাকেই দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়া রাখে, আর স্ত্রীলোকেরা অবকাশ পাইয়া আপনাদের উন্নতির চেষ্টা করে; ইহারা খুব সহৃদয় ও অকপট। যে-কোন ব্যক্তির মাথায় কোনরূপ খেয়াল আছে, সেই এখানে তাহা প্রচার করিতে আসে; আর আমায় লজ্জার সহিত বলিতে হইতেছে, এখানে এইরূপে যে সমস্ত মত প্রচার করা হয়, তাহার অধিকাংশই যুক্তিসহ নয়। ইহাদের অনেক দোষও আছে। তা কোন্ জাতির নাই? আমি সংক্ষেপে জগতের সমুদয় জাতির কার্য ও লক্ষণ এইরূপে নির্দেশ করিতে চাইঃ এশিয়া সভ্যতার বীজ বপন করিয়াছিল, ইওরোপ পুরুষের উন্নতি বিধান করিয়াছে, আর আমেরিকা নারীগণের এবং সাধারণ লোকের উন্নতি বিধান করিতেছে। এ যেন নারীগণের ও শ্রমজীবিগণের স্বর্গস্বরূপ। আমেরিকার নারী ও সাধারণ লোকের সঙ্গে আমাদের দেশের তুলনা করিলে তৎক্ষণাৎ তোমার মনে এই ভাব উদিত হইবে। আর এই দেশ দিন দিন উদারভাবাপন্ন হইতেছে। ভারতে যে ‘দৃঢ়চর্ম খ্রীষ্টান’ (ইহা ইহাদেরই কথা৩৫) দেখিতে পাও, তাহাদের দেখিয়া ইহাদিগের বিচার করিও না। তাহারা এখানেও আছে বটে; কিন্তু তাহাদের সংখ্যা দ্রুত কমিয়া যাইতেছে। আর যে আধ্যাত্মিকতা হিন্দুদের প্রধান গৌরবের বস্তু, এই মহান্ জাতি দ্রুত তাহার দিকে অগ্রসর হইতেছে।
হিন্দু যেন কখনও তাহার ধর্ম ত্যাগ না করে। তবে ধর্মকে উহার নির্দিষ্ট সীমার ভিতর রাখিতে হইবে, আর সমাজকে উন্নতির স্বাধীনতা দিতে হইবে। ভারতের সকল সংস্কারই এই গুরুতর ভ্রমে পড়িয়াছেন যে, পৌরোহিত্যের সর্ববিধ অত্যাচার ও অবনতির জন্য তাঁহারা ধর্মকেই দায়ী করিয়াছেন; সুতরাং তাঁহারা হিন্দুর ধর্মরূপ এই অবিনশ্বর দুর্গকে ভাঙিতে উদ্যত হইলেন। ইহার ফল কি হইল?—নিষ্ফলতা! বুদ্ধ হইতে রামমোহন রায় পর্যন্ত সকলেই এই ভ্রম করিয়াছিলেন যে, জাতিভেদ একটি ধর্মবিধান; সুতরাং তাঁহারা ধর্ম ও জাতি উভয়কেই একসঙ্গে ভাঙিতে চেষ্টা করিয়া বিফল হইয়াছিলেন। এ বিষয়ে পুরোহিতগণ যতই আবোল-তাবোল বলুন না কেন, জাতি একটি অচলায়তনে পরিণত সামাজিক বিধান ছাড়া কিছুই নহে। উহা নিজের কার্য শেষ করিয়া এক্ষণে ভারতগগনকে দুর্গন্ধে আচ্ছন্ন করিয়াছে। ইহা দূর হইতে পারে, কেবল যদি লোকের হারানো সামাজিক স্বাতন্ত্র্যবুদ্ধি ফিরাইয়া আনা যায়। এখানে যে-কেহ জন্মিয়াছে, সেই জানে—সে একজন মানুষ। ভারতে যে-কেহ জন্মায়, সেই জানে—সে সমাজের একজন ক্রীতদাস মাত্র। স্বাধীনতাই উন্নতির একমাত্র সহায়ক। স্বাধীনতা হরণ করিয়া লও, তাহার ফল অবনতি। আধুনিক প্রতিযোগিতা প্রবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কত দ্রুতবেগে জাতিভেদ উঠিয়া যাইতেছে। এখন উহাকে নাশ করিতে হইলে কোন ধর্মের আবশ্যকতা নাই। আর্যাবর্তে ব্রাহ্মণ দোকানদার, জুতাব্যবসায়ী ও শুঁড়ী খুব দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার কারণ কেবল প্রতিযোগিতা। বর্তমান গভর্ণমেণ্টের অধীনে কাহারও আর জীবিকার জন্য যে-কোন বৃত্তি আশ্রয় করিতে কোনরূপ বাধা নাই। ইহার ফল প্রবল প্রতিযোগিতা! এইরূপে সহস্র সহস্র ব্যক্তি—জড়ের মত নীচে পড়িয়া না থাকিয়া, যে উচ্চ সম্ভাবনা লইয়া তাহারা জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহা পাইবার চেষ্টা করিয়া সেই স্তরে উপনীত হইতেছে।
আমি এই দেশে অন্ততঃ শীতকালটা থাকিব, তারপর ইওরোপ যাইব। আমার যাহা কিছু আবশ্যক, ভগবানই সব যোগাইয়া দিবেন, আশা করি। সুতরাং এখন সে বিষয়ে তোমাদের কোন দুশ্চিন্তার কারণ নাই। আমার প্রতি ভালবাসার জন্য তোমাদের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমার অসাধ্য।
আমি দিন দিন বুঝিতেছি, প্রভু আমার সঙ্গে সঙ্গে রহিয়াছেন, আর আমি তাঁহার আদেশ অনুসরণ করিবার চেষ্টা করিতেছি। তাঁহার ইচ্ছাই পূর্ণ হইবে। এই পত্রখানি খেতড়ির মহারাজাকে পাঠাইয়া দিও, আর ইহা প্রকাশ করিও না। আমরা জগতের জন্য অনেক মহৎ কার্য করিব, আর উহা নিঃস্বার্থভাবে করিব, নামযশের জন্য নহে।
“ ‘কেন’ প্রশ্নে আমাদের নাহি অধিকার। কাজ কর, করে মর—এই হয় সার॥’ সাহস অবলম্বন কর, আমাদ্বারা ও তোমাদের দ্বারা বড় বড় কাজ হইবে, এই বিশ্বাস রাখো। ভগবান্ বড় বড় কাজ করিবার জন্য আমাদিগকে নির্দিষ্ট করিয়াছেন, আর আমরা তাহা করিব। নিজদিগকে প্রস্তুত করিয়া রাখো; অর্থাৎ পবিত্র, বিশুদ্ধস্বভাব এবং নিঃস্বার্থপ্রেমসম্পন্ন হও। দরিদ্র, দুঃখী, পদদলিতদিগকে ভালবাস; ভগবান্ তোমাদিগকে আশীর্বাদ করিবেন। সময়ে সময়ে রামনাদের রাজা ও আর আর সকল বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ করিবে এবং যাহাতে তাঁহারা ভারতের সাধারণ লোকের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হন, তাহার চেষ্টা করিবে। তাঁহাদিগকে বল, তাঁহারা তাহাদের উন্নতির প্রতিবন্ধকস্বরূপ হইয়া আছেন, আর যদি তাঁহারা উহাদের উন্নতির চেষ্টা না করেন, তবে তাঁহারা মনুষ্য-নামের যোগ্য নহেন। ভয় ত্যাগ কর, প্রভু তোমাদের সঙ্গেই রহিয়াছেন; তিনি নিশ্চয়ই ভারতের লক্ষ লক্ষ অনশনক্লিষ্ট ও অজ্ঞানান্ধ জনগণকে উন্নত করিবেন। এখানকার একজন রেলের কুলি তোমাদের অনেক যুবক এবং অধিকাংশ রাজা-রাজড়া হইতে অধিক শিক্ষিত। আমরাও কেন না উহাদের মত শিক্ষিত হইব? অবশ্যই হইব। অধিকাংশ ভারতীয় নারী যতদূর শিক্ষার উন্নতি কল্পনা করিতে পারে, প্রত্যেকটি মার্কিন নারী তদপেক্ষা অনেক অধিক শিক্ষিতা। আমাদের মহিলাগণকেও কেন না ঐরূপ শিক্ষিতা করিব? অবশ্যই করিতে হইবে।
মনে করিও না, তোমরা দরিদ্র। অর্থই বল নহে; সাধুতাই—পবিত্রতাই বল। আসিয়া দেখ, সমগ্র জগতে ইহাই প্রকৃত বল কি না। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুনঃ—ভাল কথা, তোমার কাকার প্রবন্ধের মত অদ্ভুত ব্যাপার আমি আর কখনও দেখি নাই। এ যেন ব্যবসাদারের জিনিষের ফর্দ; সুতরাং উহা ধর্ম মহাসভায় পাঠের যোগ্য বিবেচিত হয় নাই। তাই নরসিংহাচার্য একটা পাশের হলে উহা হইতে কতক কতক অংশ পাঠ করিল; কিন্তু কেহই উহার একটা কথাও বুঝিল না। তাঁহাকে এ বিষয়ে কিছু বলিও না। অনেকটা ভাব খুব অল্প কথার ভিতর প্রকাশ করা একটা বিশেষ শিল্পকলা বলিতে হইবে। এমনি কি, মণিলাল দ্বিবেদীর প্রবন্ধও অনেক কাটছাঁট করিতে হইয়াছিল। প্রায় এক হাজারের অধিক প্রবন্ধ পড়া হইয়াছিল, সুতরাং তাহাদের ওরূপ আবোল-তাবোল বক্তৃতা শুনিবার সময়ই ছিল না। অন্যান্য বক্তাদিগকে সাধারণতঃ যে আধ ঘণ্টা সময় দেওয়া হইয়াছিল, তাহা অপেক্ষা আমাকে অনেকটা অধিক সময় দেওয়া হইয়াছিল, কারণ শ্রোতৃবৃন্দকে ধরিয়া রাখিবার জন্য সর্বাপেক্ষা লোকপ্রিয় বক্তাদিগকে সর্বশেষে রাখা হইত। আর আমার প্রতি ইহাদের কি সহানুভূতি! এবং ইহাদের ধৈর্যই বা কত! ভগবান্ তাহাদিগকে আশীর্বাদ করুন। প্রাতে বেলা দশটা হইতে রাত্রি দশটা পর্যন্ত তাহারা বসিয়া থাকিত, মধ্যে কেবল খাইবার জন্য আধ ঘণ্টা ছুটি—ইতোমধ্যে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ পাঠ হইত, তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই বাজে ও অসার, কিন্তু তাহারা তাহাদের প্রিয় বক্তাদের বক্তৃতা শুনিবার অপেক্ষায় এতক্ষণ বসিয়াই থাকিত। সিংহলের ধর্মপালও তাহাদের অন্যতম প্রিয় বক্তা ছিলেন। তিনি বড়ই অমায়িক, আর এই মহাসভার অধিবেশনের সময় আমাদের খুব ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল।
পুনা হইতে আগত মিস সোপরাবজী নাম্নী জনৈকা খ্রীষ্টান মহিলা আর জৈনধর্মের প্রতিনিধি মিঃ গান্ধী এদেশে আরও কিছুদিন থাকিয়া বক্তৃতা দিয়া ঘুরিয়া অর্থোপাজনের চেষ্টা করিবেন। আশা করি, তাঁহাদের উদ্দেশ্য সফল হইবে। এ দেশে বক্তৃতা করা খুব লাভজনক ব্যবসা, অনেক সময় ইহাতে প্রচুর টাকা পাওয়া যায়। তুমি যে পরিমাণে লোক আকর্ষণ করিতে পারিবে, তাহার উপরই টাকা নির্ভর করিবে। মিঃ ইঙ্গারসোল প্রতি বক্তৃতায় ৫০০ হইতে ৬০০ ডলার পর্যন্ত পাইয়া থাকেন। তিনি এ দেশের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ বক্তা। আমি খেতড়ির মহারাজাকে আমার আমেরিকার ফটোগ্রাফ পাঠাইয়াছি। ইতি
আশীর্বাদক
বি—
৭৫*
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
১৯ নভেম্বর, ১৮৯৩
প্রিয় মিসেস উডস,
চিঠির উত্তর দিতে আমার দেরীর জন্য মাফ করবেন। কবে আপনার সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ করতে পারব জানি না। আগামী কাল ম্যাডিসন এবং মিনিয়াপোলিস রওনা হচ্ছি। যে ইংরেজ ভদ্রলোকটির কথা আপনি বলেছিলেন, তিনি হলেন লণ্ডনের ডাঃ মমেরি, লণ্ডনের দরিদ্রদের মধ্যে কর্মী হিসাবে সুপরিচিত—অতি মধুর চরিত্রের লোক। আপনি বোধ হয় জানেন না, ইংলিশ চার্চই পৃথিবীতে এক মাত্র ধর্মীয় সংস্থা, যা এখানে প্রতিনিধি পাঠায়নি; এবং ক্যাণ্টারবেরীর আর্কবিশপ ধর্মমহাসভাকে প্রকাশ্যে নিন্দা করা সত্ত্বেও ডাঃ মমেরি মহাসভায় এসেছিলেন।
হে সহৃদয় বন্ধু, আপনাকে ও আপনার কৃতী পুত্রকে ভালবাসা জানাচ্ছি—আমি সর্বদা আপনাদের চিঠি লিখি আর না লিখি, কিছু এসে যায় না।
আপনি কি আমার বইগুলি এবং ‘কভার-অল’টিকে মিঃ হেলের ঠিকানায় এক্সপ্রেস-যোগে পাঠাতে পারেন? ওগুলি আমার দরকার। এক্সপ্রেসের দাম এখানে মিটিয়ে দেওয়া হবে। আপনাদের সকলের উপর প্রভুর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক।
আপনার সদাবন্ধু
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—মিস স্যানবর্ন বা পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য বন্ধুদের যদি আপনি কখনও চিঠি লেখেন, তাহলে অনুগ্রহ করে তাঁদের আমার গভীর শ্রদ্ধা জানাবেন।
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
৭৬
(হরিপদ মিত্রকে লিখিত)
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
C/o G. W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৩
কল্যাণবরেষু,
বাবাজী, তোমার পত্র কাল পাইয়াছি। তোমরা যে আমাকে মনে রাখিয়াছ, ইহাতে আমার পরমানন্দ। ভারতবর্ষের খবরের কাগজে চিকাগোবৃত্তান্ত হাজির—বড় আশ্চর্যের বিষয়, কারণ আমি যাহা করি, গোপন করিবার যথোচিত চেষ্টা করি। এ দেশে আশ্চর্যের বিষয় অনেক। বিশেষ এদেশে দরিদ্র ও স্ত্রী-দরিদ্র নাই বলিলেই হয় ও এ দেশের স্ত্রীদের মত স্ত্রী কোথাও দেখি নাই! সৎপুরুষ আমাদের দেশেও অনেক, কিন্তু এদেশের মেয়েদের মত মেয়ে বড়ই কম। ‘যা শ্রীঃ স্বয়ং সুকৃতিনাং ভবনেষু’৩৬—যে দেবী সুকৃতী পুরুষের গৃহে স্বয়ং শ্রীরূপে বিরাজমানা। এ কথা বড়ই সত্য। এ দেশের তুষার যেমন ধবল, তেমনি হাজার হাজার মেয়ে দেখেছি। আর এরা কেমন স্বাধীন! সকল কাজ এরাই করে। স্কুল-কলেজ মেয়েতে ভরা। আমাদের পোড়া দেশে মেয়েছেলের পথ চলিবার যো নাই। আর এদের কত দয়া! যতদিন এখানে এসেছি, এদের মেয়েরা বাড়ীতে স্থান দিতেছে, খেতে দিচ্ছে—লেকচার দেবার সব বন্দোবস্ত করে, সঙ্গে করে বাজারে নিয়ে যায়, কি না করে বলিতে পারি না। শত শত জন্ম এদের সেবা করলেও এদের ঋণমুক্ত হব না।
বাবাজী, শাক্ত শব্দের অর্থ জান? শাক্ত মানে মদ-ভাঙ্ নয়, শাক্ত মানে যিনি ঈশ্বরকে সমস্ত জগতে বিরাজিত মহাশক্তি বলে জানেন এবং সমগ্র স্ত্রী-জাতিতে সেই মহাশক্তির বিকাশ দেখেন। এরা তাই দেখে; এবং মনু মহারাজ বলিয়াছেন যে, ‘যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ’৩৭—যেখানে স্ত্রীলোকেরা সুখী, সেই পরিবারের উপর ঈশ্বরের মহাকৃপা। এরা তাই করে। আর এরা তাই সুখী, বিদ্বান্, স্বাধীন, উদ্যোগী। আর আমরা স্ত্রীলোককে নীচ, অধম, মহা হেয়, অপবিত্র বলি। তার ফল—আমরা পশু, দাস, উদ্যমহীন, দরিদ্র।
এ দেশের ধনের কথা কি বলিব? পৃথিবীতে এদের মত ধনী জাতি আর নাই। ইংরেজরা ধনী বটে, কিন্তু অনেক দরিদ্র আছে। এ দেশে দরিদ্র নাই বলিলেই হয়। একটা চাকর রাখতে গেলে রোজ ৬ টাকা—খাওয়া-পরা বাদ—দিতে হয়। ইংলণ্ডে এক টাকা রোজ। একটা কুলি ৬ টাকা রোজের কম খাটে না। কিন্তু খরচও তেমনি। চার আনার কম একটা খারাপ চুরুট মেলে না। ২৪৲ টাকায় এক জোড়া মজবুত জুতো। যেমন রোজগার তেমনি খরচ। কিন্তু এরা যেমন রোজগার করিতে, তেমনি খরচ করিতে।
আর এদের মেয়েরা কি পবিত্র! ২৫ বৎসর ৩০ বৎসরের কমে কারুর বিবাহ হয় না। আর আকাশের পক্ষীর ন্যায় স্বাধীন। বাজার-হাট, রোজগার, দোকান, কলেজ, প্রোফেসর—সব কাজ করে, অথচ কি পবিত্র! যাদের পয়সা আছে, তারা দিনরাত গরীবদের উপকারে ব্যস্ত! আর আমরা কি করি? আমার মেয়ে ১১ বৎসরে বে না হলে খারাপ হয়ে যাবে! আমরা কি মানুষ, বাবাজী? মনু বলেছেন, ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিতিষত্নতঃ’—ছেলেদের যেমন ৩০ বৎসর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য করে বিদ্যাশিক্ষা হবে, তেমনি মেয়েদেরও করিতে হইবে। কিন্তু আমরা কি করছি? তোমাদের মেয়েদের উন্নতি করিতে পার? তবে আশা আছে। নতুবা পশুজন্ম ঘুচিবে না।
দ্বিতীয় দরিদ্র লোক। যদি কারুর আমাদের দেশে নীচকুলে জন্ম হয়, তার আর আশা ভরসা নাই, সে গেল। কেন হে বাপু? কি অত্যাচার! এদেশের সকলের আশা আছে, ভরসা আছে, opportunities (সুবিধা) আছে। আজ গরীব, কাল সে ধনী হবে, বিদ্বান্ হবে, জগৎমান্য হবে। আর সকলে দরিদ্রের সহায়তা করিতে ব্যস্ত। গড়ে ভারতবাসীর মাসিক আয় ২৲ টাকা। সকলে চেঁচাচ্ছেন, আমরা বড় গরীব, কিন্তু ভারতের দরিদ্রের সহায়তা করিবার কয়টা সভা আছে? ক-জন লোকের লক্ষ লক্ষ অনাথের জন্য প্রাণ কাঁদে? হে ভগবান্, আমরা কি মানুষ! ঐ যে পশুবৎ হাড়ী-ডোম তোমার বাড়ীর চারিদিকে, তাদের উন্নতির জন্য তোমরা কি করেছ, তাদের মুখে এক-গ্রাস অন্ন দেবার জন্য কি করেছ, বলতে পার? তোমরা তাদের ছোঁও না, ‘দূর দূর’ কর। আমরা কি মানুষ? ঐ যে তোমাদের হাজার হাজার সাধু-ব্রাহ্মণ ফিরছেন, তাঁরা এই অধঃপতিত দরিদ্র পদদলিত গরীবদের জন্য কি করছেন? খালি বলছেন, ‘ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না।’ এমন সনাতন ধর্মকে কি করে ফেলেছে! এখন ধর্ম কোথায়? খালি ছুঁৎমার্গ—আমায় ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না।
আমি এদেশে এসেছি, দেশ দেখতে নয়, তামাসা দেখতে নয়, নাম করতে নয়, এই দরিদ্রের জন্য উপায় দেখতে। সে উপায় কি, পরে জানতে পারবে, যদি ভগবান্ সহায় হন।
এদের অনেক দোষও আছে। ফল এই, ধর্মবিষয়ে এরা আমাদের চেয়ে অনেক নীচে, আর সামাজিক সম্বন্ধে এরা অনেক উচ্চে। এদের সামাজিক ভাব আমরা গ্রহণ করিব, আর এদের আমাদের অদ্ভুত ধর্ম শিক্ষা দিব।
কবে দেশে যাব জানি না, প্রভুর ইচ্ছা বলবান্। তোমরা সকলে আমার আশীর্বাদ জানিবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৭৭*
[মান্দ্রাজী ভক্তদিগকে লিখিত]
C/o G. W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২২ অগষ্ট, ১৮৯২
প্রিয় বন্ধুগণ,
তোমাদের পত্র পাইয়াছি। আমি আশ্চর্য হইলাম যে, আমার সম্বন্ধে অনেক কথা ভারতে পৌঁছিয়াছে। ‘ইণ্টিরিয়র’ পত্রিকার যে সমালোচনার উল্লেখ করিয়াছ, তাহা সমুদয় আমেরিকাবাসীর ভাব বলিয়া বুঝিও না; এই পত্রিকা এখানে কেহ জানে না বলিলেই হয়, আর ইহাকে এখানকার লোক ‘নীলনাসিক প্রেসবিটেরিয়ান’দের কাগজ বলে। এ সম্প্রদায় খুব গোঁড়া। অবশ্য এই নীলনাসিকগণ সকলেই যে অভদ্র, তা নয়। সাধারণে যাহাকে আকাশে তুলিয়া দিতেছে, তাহাকে আক্রমণ করিয়া একটু বিখ্যাত হইবার ইচ্ছায় এই পত্রিকা ঐরূপ লিখিয়াছিল। আমেরিকাবাসী জনসাধারণ এবং পুরোহিতগণের অনেকেই আমাকে খুব যত্ন করিতেছেন। কোন বড় লোককে গালাগালি দিয়া পত্রিকাগুলির খ্যাতনামা হইবার ওই কৌশল এখানকার সকলেই জানে; সুতরাং এখানকার লোকে উহা কিছু গ্রাহ্য করে না। অবশ্য ভারতীয় মিশনরিগণ যে ইহা লইয়া একটা হুজুক করিবার চেষ্টা করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহাদিগকে বলিও—‘হে য়াহুদী, লক্ষ্য কর, তোমার উপর এখন ঈশ্বরের দণ্ড নামিয়া আসিয়াছে।’ তাহাদের প্রাচীন গৃহের ভিত্তি পর্যন্ত এক্ষণে যায় যায় হইয়াছে, আর তাহারা পাগলের মত যতই চীৎকার করুক না কেন, উহা ভাঙিবেই ভাঙিবে। মিশনরীদের জন্য অবশ্য আমার দুঃখ হয়। প্রাচ্যদেশবাসিগণ এখানে দলে দলে অনেক আসাতে—তাহাদের ভারতে গিয়া বড়মানুষি করিবার উপায় অনেক কমিয়া আসিয়াছে। কিন্তু ইহাদের প্রধান প্রধান পুরোহিতগণের মধ্যে একজনও আমার বিরোধী নহেন। যাই হোক, যখন পুকুরে নামিয়াছি, তখন ভাল করিয়াই স্নান করিব।
তাহাদের সম্মুখে আমি আমাদের ধর্মের যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাঠ করিয়াছিলাম, তৎসম্বন্ধে একটি সংবাদপত্র হইতে কাটিয়া পাঠাইয়া দিলাম। আমার অধিকাংশ বক্তৃতাই মুখে মুখে। আশা করি এদেশ হইতে চলিয়া যাইবার পূর্বে পুস্তকাকারে সেগুলিকে গ্রথিত করিতে পারিব। ভারত হইতে কোন সাহায্যের আর আবশ্যক নাই, এখানে আমার যথেষ্ট আছে। বরং তোমাদের নিকট যে টাকা আছে, তাহা দ্বারা এই ক্ষুদ্র বক্তৃতাটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত কর এবং বিভিন্ন দেশীয়-ভাষায় অনুবাদ করিয়া চারিদিকে উহার প্রচার কর। ইহা জাতির সম্মুখে আমাদের আদর্শ জাগরূক রাখিবে। আর সেই কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের কথা এবং উহা হইতে ভারতের চতুর্দিকে শাখা-বিদ্যালয় সংস্থাপনের কথাও ভুলিও না। আমি এখানে প্রাণপণে সাহায্য-লাভের জন্য চেষ্টা করিতেছি, তোমরা ভারতেও চেষ্টা কর। খুব দৃঢ়ভাবে কার্য কর। ‘রামনাথ’ বা যে-কোন ‘নাথ’কে পাও, তাহাকেই ধরিয়া তাহার সাহায্যে এই কার্যের জন্য ধীরে ধীরে টাকা সঞ্চয় করিতে থাকো। যদিও এখানে এবার অর্থের বড়ই অনটন, তথাপি আমার যতদূর সাধ্য করিতেছি। এখানে এবং ইওরোপে ভ্রমণ করিবার সমুদয় খরচ আমার যথেষ্ট যোগাড় হইয়া যাইবে।
আমি কিডির পত্র পাইয়াছি। জাতিভেদ উঠিয়া যাইবে কি থাকিবে, এ সম্বন্ধে আমার কিছুই করিবার নাই। আমার উদ্দেশ্য এই যে, ভারতে বা ভারতের বাহিরে মনুষ্যজাতি যে মহৎ চিন্তারাশি উদ্ভাবন করিয়াছে, তাহা অতি হীন, অতি দরিদ্রের নিকট পর্যন্ত প্রচার করা। তারপর তারা নিজেরা ভাবুক। জাতিভেদ থাকা উচিত কি না, স্ত্রীলোকদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া উচিত কি না, এ বিষয়ে আমার মাথা ঘামাইবার দরকার নাই। ‘চিন্তা ও কার্যের স্বাধীনতার উপরেই নির্ভর করে জীবন, উন্নতি এবং কল্যাণ।’ ইহার অভাবে মানুষ, বর্ণ ও জাতির পতন অবশ্যম্ভাবী।
জাতিভেদ থাকুক বা নাই থাকুক, কোন মতবাদ প্রচলিত থাকুক বা নাই থাকুক, যে-কোন ব্যক্তি, শ্রেণী, বর্ণ, জাতি বা সম্প্রদায় যদি অপর কোন ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তার ও কার্যের শক্তিতে বাধা দেয় (অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ শক্তি কাহারও অনিষ্ট না করে) তাহা অতি অন্যায়, এবং যে ঐরূপ করে—তাহার পতন অবশ্যম্ভাবী।
আমার জীবনে এই একমাত্র আকাঙ্ক্ষা যে, আমি এমন একটি যন্ত্র চালাইয়া যাইব—যাহা প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট উচ্চ উচ্চ ভাবরাশি বহন করিয়া লইয়া যাইবে। তারপর পুরুষই হউক আর নারীই হউক—নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য রচনা করিবে। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এবং অন্যান্য জাতি জীবনের গুরুতর সমস্যাসমূহ সম্বন্ধে কি চিন্তা করিয়াছেন, তাহা সকলে জানুক। বিশেষতঃ তাহারা দেখুক—অপরে এক্ষণে কি করিতেছে। তারপর তাহারা কি করিবে, স্থির করুক। রাসায়নিক দ্রব্যগুলি আমরা এক সঙ্গে রাখিয়া দিব মাত্র, উহারা প্রকৃতির নিয়মে দানা বাঁধিবে। আমেরিকার মহিলাগণ সম্বন্ধে বক্তব্য এই—তাঁহারা আমার খুব বন্ধু। শুধু চিকাগোয় নয়, সমগ্র আমেরিকায়। তাঁহাদের দয়ার জন্য আমি যে কতদূর কৃতজ্ঞ, তাহা প্রকাশ করা আমার সাধ্য নয়। প্রভু তাঁহাদিগকে আশীর্বাদ করুন। এই দেশে মহিলাগণ সমুদয় জাতীয় কৃষ্টির প্রতিনিধিস্বরূপ। পুরুষেরা কার্যে এত ব্যস্ত যে আত্মোন্নতির সময় পায় না। এখানকার মহিলাগণ প্রত্যেকে বড় বড় আন্দোলনের প্রাণস্বরূপ।
ভট্টাচার্য মহাশয়কে অনুগ্রহপূর্বক বলিবে, আমি তাঁহার ফনোগ্রাফের কথা বিস্মৃত হই নাই। তবে এডিসন ৩৮ সম্প্রতি ইহার উন্নতিসাধন করিয়াছেন; যতদিন না তাহা বাহির হইতেছে, ততদিন আমি উহা ক্রয় করা যুক্তিসঙ্গত মনে করি না।
দৃঢ়ভাবে কার্য করিয়া যাও, অবিচলিত অধ্যবসায়শীল হও এবং প্রভুর উপর বিশ্বাস রাখো; কাজে লাগো। দুইদিন আগেই হউক বা পরেই হউক, আমি আসিতেছি। আমাদের কার্যের এই মূল কথাটা সর্বদা মনে রাখিবে—‘ধর্মে একবিন্দুও আঘাত না করিয়া জনসাধারণের উন্নতিবিধান।’ মনে রাখিবে, দরিদ্রের কুটীরেই আমাদের জাতীয় জীবন স্পন্দিত হইতেছে। কিন্তু হায়, কেহই ইহাদের জন্য কিছুই করে নাই। আমাদের আধুনিক সংস্কারকগণ বিধবা-বিবাহ লইয়া বিশেষ ব্যস্ত। অবশ্য সকল সংস্কারকার্যেই আমার সহানুভূতি আছে, কিন্তু বিধবাগণের স্বামীর সংখ্যার উপরে কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না; উহা নির্ভর করে—জনসাধারণের অবস্থার উপর। তাহাদিগকে উন্নত করিতে পার? তাহাদের স্বাভাবিক আধ্যাত্মিক প্রকৃতি নষ্ট না করিয়া তাহাদিগকে আপনার পায়ে দাঁড়াইতে শিখাইতে পার? তোমরা কি সাম্য, স্বাধীনতা, কার্য ও উৎসাহে ঘোর পাশ্চাত্য এবং ধর্ম-বিশ্বাস ও সাধনায় ঘোর হিন্দু হইতে পার? ইহাই করিতে হইবে এবং আমরাই ইহা করিব। তোমরা সকলে ইহা করিবার জন্যই আসিয়াছ। আপনাতে বিশ্বাস রাখো। প্রবল বিশ্বাসই বড় বড় কার্যের জনক। এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও। মৃত্যু পর্যন্ত গরীব, পদদলিতদের উপর সহানুভূতি করিতে হইবে—ইহাই আমাদের মূলমন্ত্র। এগিয়ে যাও, বীরহৃদয় যুবকবৃন্দ!
তোমাদের কল্যাণাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
পুঃ—একটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া সাধারণ লোকের উন্নতি-বিধানের চেষ্টা করিতে হইবে এবং এই বিদ্যালয়ে শিক্ষিত প্রচারকগণের দ্বারা গরীবের বাড়ীতে বাড়ীতে যাইয়া তাহাদের নিকট বিদ্যা ও ধর্মের বিস্তার—এই ভাবগুলি প্রচার করিতে থাকো। সকলেই যাহাতে এ বিষয়ে সহানুভূতি করে, তাহার চেষ্টা কর।
আমি তোমাদের নিকট সবচেয়ে উঁচুদরের কতকগুলি কাগজ হইতে স্থানে স্থানে কাটিয়া পাঠাইতেছি। ইহাদের মধ্যে ডাঃ টমাসের লেখাটি বিশেষ মূল্যবান্, কারণ তিনি সর্বাগ্রণী না হইলেও আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মযাজক বটে। 'ইণ্টিরিয়র' কাগজটার অতিরিক্ত গোঁড়ামি ও আমাকে গালাগালি দিয়া একটা নাম জাহির করিবার চেষ্টা সত্ত্বেও উহাদের স্বীকার করিতে হইয়াছিল যে, আমি সর্বসাধারণের প্রিয় বক্তা ছিলাম। আমি উহা হইতেও কয়েক পঙক্তি কাটিয়া পাঠাইতেছি। ইতি
বি
৭৮*
[শ্রীযুক্ত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
চিকাগো
২৯ জানুআরী, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
কয়েক দিন হয় আপনার শেষ চিঠিখানা পাইয়াছি। আপনি আমার দুঃখিনী মা ও ছোটভাইদের দেখিতে গিয়াছিলেন জানিয়া সুখী হইয়াছি। কিন্তু আপনি আমার অন্তরের একমাত্র কোমল স্থানটি স্পর্শ করিয়াছেন। আপনার জানা উচিত যে, আমি নিষ্ঠুর পশু নই। এই বিপুল সংসারে আমার ভালবাসার পাত্র যদি কেহ থাকেন, তবে তিনি আমার মা। তথাপি এ বিশ্বাস আমি দৃঢ়ভাবে পোষণ করিয়া আসিতেছি এবং এখনও করি যে, যদি আমি সংসার ত্যাগ না করিতাম, তবে আমার মহান্ গুরু পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে বিরাট সত্য প্রচার করিতে জগতে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, তাহা প্রকাশিত হইতে পারিত না। আর তাহা ছাড়া যে-সকল যুবক বর্তমান যুগের বিলাসিতা ও বস্তুতান্ত্রিকতার তরঙ্গাভিঘাত প্রতিহত করিবার জন্য সুদৃঢ় পাষাণভিত্তির মত দাঁড়াইয়াছে—তাহাদেরই বা কী অবস্থা হইত? ইহারা ভারতের, বিশেষ করিয়া বাঙলার অশেষ কল্যাণসাধন করিয়াছে। আর এই তো সবে আরম্ভ। প্রভুর কৃপায় ইহারা এমন কাজ করিয়া যাইবে, যাহার জন্য সমস্ত জগৎ যুগের পর যুগ ইহাদিগকে আশীর্বাদ করিবে। সুতরাং একদিকে ভারতের ও বিশ্বের ভাবী ধর্মসম্বন্ধীয় আমার পরিকল্পনা, এবং যে উপেক্ষিত লক্ষ লক্ষ নরনারী দিন দিন দুঃখের তমোময় গহ্বরে ধীরে ধীরে ডুবিতেছে, যাহাদিগকে সাহায্য করিবার কিম্বা যাহাদের বিষয় চিন্তা করিবারও কেহ নাই, তাহাদের জন্য আমার সহানুভূতি ও ভালবাসা, আর অন্যদিকে আমার যত নিকট আত্মীয় স্বজন আছেন, তাঁহাদের দুঃখ ও দুর্গতির হেতু হওয়া—এই দুইটির মধ্যে প্রথমটিকেই আমি ব্রতরূপে গ্রহণ করিয়াছি, বাকী যাহা কিছু তাহা প্রভুই সম্পন্ন করিবেন। তিনি যে আমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। আমি যতক্ষণ খাঁটি আছি, ততক্ষণ কেহই আমাকে প্রতিরোধ করিতে সমর্থ হইবে না; কারণ তিনিই আমার সহায়। ভারতের অসংখ্য নরনারী আমাকে বুঝিতে পারে নাই। আর কিরূপেই বা পারিবে? বেচারীদের চিন্তাধারা দৈনন্দিন খাওয়া-পরার ধরাবাঁধা নিয়মকানুনের গণ্ডিই যে কখনও অতিক্রম করিতে পারে না! কেবল আপনার ন্যায় মহৎ-অন্তঃকরণ-বিশিষ্ট মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র আমার গুণগ্রাহী। ভগবান্ আপনাকে আশীর্বাদ করুন! আমার সমাদর হউক আর নাই হউক—আমি এই যুবকদলকে সঙ্ঘবদ্ধ করিতেই জন্মগ্রহণ করিয়াছি। আর শুধু ইহারাই নহে, ভারতের নগরে নগরে আরও শত শত যুবক আমার সহিত যোগ দিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে। ইহারা দুর্দমনীয় তরঙ্গাকারে ভারতভূমির উপর দিয়া প্রবাহিত হইবে, এবং যাহারা সর্বাপেক্ষা দীন হীন ও পদদলিত—তাহাদের দ্বারে দ্বারে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, নীতি, ধর্ম ও শিক্ষা বহন করিয়া লইয়া যাইবে—ইহাই আমার আকাঙ্ক্ষা ও ব্রত, ইহা আমি সাধন করিব কিম্বা মৃত্যুকে বরণ করিব।
আমাদের দেশের লোকের না আছে ভাব, না আছে সমাদর করিবার ক্ষমতা। পরন্তু সহস্র বৎসরের পরাধীনতার ফলে উৎকট পরশ্রীকাতরতা ও সন্দিগ্ধ প্রকৃতির বশে ইহারা যে-কোন নূতন ভাবধারারই বিরোধী হইয়া উঠে। এতৎসত্ত্বেও প্রভু মহান্।
আরতি ও অন্যান্য বিষয়ে আপনি যাহা লিখিয়াছেন—ভারতবর্ষের সর্বত্র প্রত্যেক মঠেই সে-সকল প্রথা প্রচলিত আছে দেখা যায় এবং ‘গুরুপূজা’ সাধনার প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়াই বেদে উক্ত হইয়াছে। ইহার ভালমন্দ উভয় দিকই আছে সত্য, কিন্তু এ কথাও স্মরণ রাখিবেন—আমাদের সম্প্রদায়ের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য এই যে, নিজের মতামত বা বিশ্বাস অন্যের উপর চাপাইবার কোন অধিকার আমরা রাখি না। আমাদের মধ্যে অনেকে কোনপ্রকার মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নহে, কিন্তু তাই বলিয়া অপরের সেই বিশ্বাসে বাধা দিবারও কোন অধিকার তাহাদের নাই, কারণ তাহা হইলে আমাদের ধর্মের মূলতত্ত্বই লঙ্ঘন করা হইবে। অধিকন্তু শুধু মানুষের মধ্য দিয়াই ভগবানকে জানা সম্ভব। যেমন আলোক-স্পন্দন সর্বত্র, এমন কি অন্ধকার কোণেও বিদ্যমান, কেবলমাত্র প্রদীপের মধ্যেই উহা লোকচক্ষুর গোচর হইয়া থাকে, সেইরূপ যদিও ভগবান্ সর্বত্র বিরাজিত, তথাপি তাঁহাকে আমরা কেবল এক বিরাট মানুষরূপেই কল্পনা করিতে পারি। করুণাময়, রক্ষক, সহায়ক প্রভৃতি ভগবৎসম্বন্ধীয় ভাবগুলি—মানবীর ভাব; মানুষ স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গী দিয়াই ভগবানকে দেখে বলিয়া ঐ সকল ভাবের উদ্ভব হইয়াছে। কোন মনুষ্যবিশেষকে আশ্রয় করিয়াই এই সকল গুণের বিকাশ হইতে বাধ্য—তাঁহাকে গুরুই বলুন, ঈশ্বর-প্রেরিত পুরুষই বলুন আর অবতারই বলুন। নিজদেহের সীমা আপনি যেমন উল্লম্ফনে অতিক্রম করিতে পারেন না, মানুষও তেমনি নিজ প্রকৃতির সীমা লঙ্ঘন করিতে পারে না। যে গুরু আপনাদের ইতিহাসে বর্ণিত সমুদয় অবতারপ্রথিত পুরুষগণ অপেক্ষা শত শত গুণে অধিক পবিত্র—সেই প্রকার গুরুকে যদি কেহ আনুষ্ঠানিকভাবে পূজাই করে, তবে তাহাতে কী ক্ষতি হইতে পারে? যদি খ্রীষ্ট, কৃষ্ণ কিম্বা বুদ্ধকে পূজা করিলে কোন ক্ষতি না হয়, তবে যে পুরুষপ্রবর জীবনে চিন্তায় বা কর্মে লেশমাত্র অপবিত্র কিছু করেন নাই, যাঁহার অন্তদৃষ্টিপ্রসূত তীক্ষ্ণবুদ্ধি অন্য সকল একদেশদর্শী ধর্মগুরু অপেক্ষা ঊর্ধ্বতর স্তরে বিদ্যমান—তাঁহাকে পূজা করিলে কী ক্ষতি হইতে পারে? দর্শন বিজ্ঞান অপর কোন বিদ্যার সহায়তা না লইয়া এই মহাপুরুষই জগতের ইতিহাসে সর্বপ্রথম এই তত্ত্ব প্রচার করিলেন যে, ‘সকল ধর্মেই সত্য নিহিত আছে, শুধু ইহা বলিলেই চলিবে না, প্রত্যুত সকল ধর্মই সত্য। আর এই সত্যই জগতের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করিতেছে।
কিন্তু এ মতও আমরা জোর করিয়া কাহারও উপর চাপাই না; আমার গুরুভাইদের মধ্যে কেহই আপনাকে এমন কথা বলে নাই যে, সকলকে তাঁহার গুরুকেই পূজা করিতে হইবে—ইহা কখনই হইতে পারে না। পক্ষান্তরে—যদি কেহ ঐরূপ পূজা করে, তবে তাহাকে বাধা দিবার অধিকারও আমাদের নাই। কেনই বা থাকিবে? তাহা হইলে পৃথিবীতে অদৃষ্টপূর্ব অতুলনীয় এই সমাজটি—যেখানে দশজন মানুষ দশ প্রকার ভিন্ন মত ও ভাব অবলম্বন করিয়া পরিপূর্ণ সাম্যের মধ্যে বাস করিতেছে—বিনষ্ট হইয়া যাইবে। দেওয়ানজী, ঈশ্বর মহান্ ও করুণাময়—ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করুন, আরও বহু কিছু দেখিতে পাইবেন।
আমরা যে প্রত্যেকটি ধর্মমতকে শুধু সহ্য করি তাহা নহে, পরন্তু উহাদিগকে গ্রহণ করিয়া থাকি এবং সেই তত্ত্বই প্রভুর সহায়তায় জগতে প্রচার করিতে আমি চেষ্টা করিতেছি।
বড় হইতে গেলে কোন জাতির বা ব্যক্তির পক্ষে তিনটি বস্তুর প্রয়োজনঃ
(১) সাধুতার শক্তিতে প্রগাঢ় বিশ্বাস।
(২) হিংসা ও সন্দিগ্ধভাবের একান্ত অভাব।
(৩) যাহারা সৎ হইতে কিম্বা সৎ কাজ করিতে সচেষ্ট, তাহাদিগের সহায়তা।
কি কারণে হিন্দুজাতি তাহার অদ্ভুত বুদ্ধি এবং অন্যান্য গুণাবলী সত্ত্বেও ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল? আমি বলি, হিংসা। এই দুর্ভাগা হিন্দুজাতি পরস্পরের প্রতি যেরূপ জঘন্যভাবে ঈর্ষান্বিত এবং পরস্পরের খ্যাতিতে যেভাবে হিংসাপরায়ণ, তাহা কোন কালে কোথাও দেখা যায় নাই। যদি আপনি কখনও পাশ্চাত্য দেশে আসেন, তবে এতদ্দেশবাসীর মধ্যে এই হিংসার অভাবই সর্বপ্রথম আপনার নজরে পড়িবে। ভারতবর্ষে তিন জন লোকও পাঁচ মিনিট কাল একসঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া কাজ করিতে পারে না। প্রত্যেকেই ক্ষমতার জন্য কলহ করিতে শুরু করে—ফলে সমগ্র প্রতিষ্ঠানটিই দুরবস্থায় পতিত হয়। হায় ভগবান্! কবে আমরা হিংসা না করিবার শিক্ষা লাভ করিব!
এইরূপ একটি জাতির মধ্যে, বিশেষ করিয়া বাঙলাদেশে এমন একদল লোক সৃষ্টি করা, যাহারা মতের বিভিন্নতা সত্ত্বেও পরস্পরের সহিত অবিচ্ছেদ্য স্নেহ-ভালবাসার সূত্রে আবদ্ধ থাকিবে—ইহা কি বিস্ময়কর নহে? এই দলের সংখ্যা ক্রমশঃ বর্ধিত হইবে, এই অদ্ভুত উদারভাব অপ্রতিহতবেগে সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়াইয়া পড়িবে, এবং এই দাসজাতির উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত উৎকট অজ্ঞতা, ঘৃণা, প্রাচীন মূর্খতা, জাতিবিদ্বেষ ও হিংসা প্রভৃতি সত্ত্বেও সমগ্র দেশকে বিদ্যুৎশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিবে।
সর্বব্যাপী বদ্ধতার এই মহাসমুদ্রের মধ্যে যে কয়েকটি মহাপ্রাণ মনীষী শৈলের মত মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন—আপনি তাঁহাদের অন্যতম। ভগবান্ আপনাকে নিরন্তর আশীর্বাদ করুন। ইতি
চিরবিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
৭৯*
৫৪১ ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
৩ মার্চ, ১৮৯৪
প্রিয় কিডি,
তোমার সব চিঠিই পেয়েছিলাম; কিন্তু কী জবাব দেব, ভেবে পাইনি। তোমার শেষ চিঠিখানিতে আশ্বস্ত হলাম। ... বিশ্বাসে যে অদ্ভুত অন্তর্দৃষ্টি লাভ হয় এবং একমাত্র বিশ্বাসই যে মানুষকে পরিত্রাণ করতে পারে, এই পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আমি একমত; কিন্তু এতে আবার গোঁড়ামি আসবার ও ভবিষ্যৎ উন্নতির দ্বার রুদ্ধ হবার আশঙ্কা আছে।
জ্ঞানমার্গ খুব ঠিক, কিন্তু এতে আশঙ্কা এই—পাছে উহা শুষ্ক পাণ্ডিত্যে পর্যবসিত হয়। প্রেম ভক্তি খুব বড় ও ভাল জিনিষ, কিন্তু নিরর্থক ভাবপ্রবণতায় আসল জিনিষই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এগুলির সামঞ্জস্যই দরকার। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন এরূপ সমন্বয়পূর্ণ ছিল। কিন্তু এরূপ মহাপুরুষ কালেভদ্রে জগতে এসে থাকেন। তবে তাঁর জীবন ও উপদেশ আদর্শ-স্বরূপ সামনে রেখে আমরা এগোতে পারি। আমাদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে হয়তো একজনও সেই পূর্ণতা লাভ করতে পারবে না; তবু আমরা পরস্পরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান, ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য বিধান এবং পরস্পরের অভাব পরিপূর্ণ করার মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে ঐ পূর্ণতা পেতে পারি। এতে প্রত্যেকের জীবনেই সমন্বয়ভাবের প্রকাশ হল না বটে, কিন্তু কতকগুলি লোকের মধ্যে একটা সমন্বয় হল, আর সেটা অন্যান্য প্রচলিত ধর্মমত হতে সুনিশ্চিত অগ্রগতি, তাতে সন্দেহ নেই।
কোন ধর্মকে ফলপ্রসূ করতে হলে তাই নিয়ে একেবারে মেতে যাওয়া দরকার; অথচ যাতে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক ভাব না আসে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এইজন্য আমরা একটি ‘অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়’ হতে চাই। সম্প্রদায়ের যে-সকল উপকারিতা তাও তাতে পাব, আবার তাতে সার্বভৌম ধর্মের উদারভাবও থাকবে।
ভগবান্ যদিও সর্বত্র আছে বটে, কিন্তু তাঁকে আমরা জানতে পারি কেবল মানবচরিত্রের মধ্য দিয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণের মত এত উন্নত চরিত্র কোন কালে কোন মহাপুরুষের হয় নাই; সুতরাং তাঁকেই কেন্দ্র করে আমাদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে; অথচ প্রত্যেকের তাঁকে নিজের ভাবে গ্রহণ করার স্বাধীনতা থাকবে—কেউ আচার্য বলুক, কেউ পরিত্রাতা, কেউ ঈশ্বর, কেউ আদর্শ পুরুষ, কেউ বা মহাপুরুষ—যার যা খুশী।
আমরা সামাজিক সাম্যবাদ বা বৈষম্যবাদ কিছুই প্রচার করি না। তবে বলি যে, শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সকলেরই সমান অধিকার, আর তাঁর শিষ্যদের ভেতরে যাতে—কি মতে, কি কার্যে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে, এইটির দিকেই আমাদের বিশেষ দৃষ্টি। সমাজ আপনার ভাবনা আপনি ভাবুক গে। আমরা কোন মতাবলম্বীকেই বাদ দিতে চাই না—তা সে নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী হোক বা ‘সর্বং ব্রহ্মময়ং জগৎ’ এই মতে বিশ্বাসবান্ হোক, অদ্বৈতবাদী হোক বা বহুদেবে বিশ্বাসী হোক, অজ্ঞেয়বাদী হোক বা নাস্তিক হোক। কিন্তু শিষ্য হতে গেলে তাকে কেবল এটুকু করতে হবে যে, তাকে এমন চরিত্র গঠন করতে হবে, তা যেমনি উদার তেমনি গভীর।
অপরের অনিষ্টকর না হলে আচার-ব্যবহার, চরিত্রগঠন বা পানাহার সম্বন্ধেও আমরা কোন বিশেষ নৈতিক মতের উপর জোর দিই না। এইটুকু বলে আমরা লোককে তার নিজের বিচারের উপর নির্ভর করতে বলি। ‘যা উন্নতির বিঘ্ন করে বা পতনের সহায়তা করে, তাই পাপ বা অধর্ম; আর যা উন্নত ও সমন্বয়-ভাবাপন্ন হবার সাহায্য করে, তাই ধর্ম।’
তারপর কোন্ পথ তার ঠিক উপযোগী, কোন্টাতে তার উপকার হবে, সে বিষয় প্রত্যেকে নিজে নিজে বেছে নিয়ে সেই পথে যাক; এ বিষয়ে আমরা সকলকে স্বাধীনতা দিই। যথা একজনের হয়তো মাংস খেলে সহজে উন্নতি হতে পারে, আর একজনের হয়তো ফলমূল খেয়ে হয়। যার যা নিজের ভাব, সে তা করুক। কিন্তু একজন যা করছে তা যদি অপরে করে, তার ক্ষতি হতে পারে, কারও কোন অধিকার নেই যে, সে অপরকে গাল দেবে, তাকে নিজের মতে নিয়ে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করা তো দূরের কথা। কতকগুলি লোকের পক্ষে হয়তো দারপরিগ্রহ উন্নতির খুব সহায়ক হতে পারে, অপরের পক্ষে হয়তো তা বিশেষ ক্ষতিকর। তা বলে অবিবাহিত ব্যক্তির বিবাহিত শিষ্যকে বলবার কোন অধিকার নেই যে, সে ভুল পথে যাচ্ছে, জোর করে তাকে নিজের মতে আনবার চেষ্টা করা তো দূরের কথা।
আমাদের বিশ্বাস—সব প্রাণীই ব্রহ্মস্বরূপ। প্রত্যেক আত্মাই যেন মেঘে ঢাকা সূর্যের মত; একজনের সঙ্গে আর একজনের তফাত কেবল এই—কোথাও সূর্যের উপর মেঘের আবরণ ঘন, কোথাও এই আবরণ একটু পাতলা; আমাদের বিশ্বাস—জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ইহা সকল ধর্মেরই ভিত্তিস্বরূপ; আর শারীরিক, মানসিক বা আধ্যাত্মিক স্তরে মানবের উন্নতির সমগ্র ইতিহাসের সার কথাটাই এই—এক আত্মাই বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে আপনাকে প্রকাশ করছেন।
আমাদের বিশ্বাস—এই হল বেদের সার রহস্য।
আমাদের বিশ্বাস—প্রত্যেক ব্যক্তির অপর ব্যক্তিকে এইভাবে অর্থাৎ ঈশ্বর বলে চিন্তা করা উচিত ও তার সহিত তেমনভাবে ব্যবহারও করা উচিত, কাকেও ঘৃণা করা বা কোনরূপে কারও নিন্দা বা অনিষ্ট করা উচিত নয়। আর এ যে শুধু সন্ন্যাসীর কর্তব্য তা নয়, সকল নর-নারীরই কর্তব্য।
আমাদের বিশ্বাস—আত্মাতে লিঙ্গভেদ বা জাতিভেদ নাই বা তাঁতে অপূর্ণতা নেই।
আমাদের বিশ্বাস—সমুদয় বেদ, দর্শন, পুরাণ ও তন্ত্ররাশির ভিতর কোথাও এ কথা নাই যে, আত্মায় লিঙ্গ, ধর্ম বা জাতিভেদ আছে। এই হেতু যাঁরা বলেন, ‘ধর্ম আবার সমাজসংস্কার সম্বন্ধে কি বলবে?’ তাঁদের সহিত আমরা একমত; কিন্তু তাঁদের আবার আমাদের এ কথা মানতে হবে যে, ধর্মের কোনরূপ সামাজিক বিধান দেবার বা সকল জীবের মধ্যে বৈষম্যবাদ প্রচার করবার কোন অধিকার নেই, কারণ ধর্মের লক্ষ্যই হচ্ছে—এই কাল্পনিক ও ভয়ানক বৈষম্যকে একেবারে নাশ করে ফেলা।
যদি এ কথা বলা হয়, এই বৈষম্যের ভিতর দিয়ে গিয়েই আমরা চরমে সমত্ব ও একত্বভাব লাভ করব, তাতে আমাদের উত্তর এই—তাঁরা যে ধর্মের দোহাই দিয়ে পূর্বোক্ত কথাগুলো বলছেন, সেই ধর্মেই পুনঃপুনঃ বলেছে, ‘পাঁক দিয়ে পাঁক ধোয়া যায় না।’ বৈষম্যের ভিতর দিয়ে সমত্বে যাওয়া কি রকম?—না, যেন অসৎকার্য করে সৎ হওয়া।
সুতরাং সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সামাজিক বিধানগুলো সমাজের নানা প্রকার অবস্থা-সংঘাত হতে উৎপন্ন—ধর্মের অনুমোদনে। ধর্মের ভয়ানক ভ্রম হয়েছে যে, সামাজিক ব্যাপারে তিনি হাত দিলেন; কিন্তু এখন আবার ভণ্ডামি করে এবং নিজেই নিজের খণ্ডন করে বলছেন, ‘সমাজসংস্কার ধর্মের কাজ নয়।’ ঠিক কথা! এখন দরকার—ধর্ম যেন সমাজসংস্কার করতে না যান, আমরা সেজন্যই এ কথাও বলি, ধর্ম যেন সমাজের বিধানদাতা না হন। অপরের অধিকারে হাত দিতে যেও না, আপনার সীমার ভিতর আপনাকে রাখো, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
১। শিক্ষা হচ্ছে, মানুষের ভিতর যে পূর্ণতা প্রথম থেকেই বিদ্যমান, তারই প্রকাশ।
২। ধর্ম হচ্ছে, মানুষের ভিতর যে ব্রহ্মত্ব প্রথম থেকেই বিদ্যমান, তারই প্রকাশ।
সুতরাং উভয় স্থলেই শিক্ষকের কার্য কেবল পথ থেকে সব অন্তরায় সরিয়ে দেওয়া। আমি যেমন সর্বদা বলে থাকিঃ ‘অপরের অধিকারে হাত দিও না, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ আমাদের কর্তব্য, রাস্তা সাফ করে দেওয়া। বাকী সব ভগবান্ করেন।
সুতরাং তোমরা যখন বার বার ভাব যে, ধর্মের কাজ কেবল আত্মাকে নিয়ে, সামাজিক বিষয়ে তার হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই, তখন তোমাদের এ কথাও মনে রাখা উচিত, যে-অনর্থ আগে থেকেই হয়ে গিয়েছে সে-সম্বন্ধেও এ কথা সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য। এ কি রকম জান? যেন কোন লোক জোর করে একজনের বিষয় কেড়ে নিয়েছে; এখন বঞ্চিত ব্যক্তি যখন তার বিষয় পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে, তখন প্রথম ব্যক্তি নাকী সুরে চীৎকার শুরু করলে, আর ‘মানুষের অধিকার’রূপ মতবাদ যে কত পবিত্র, তা প্রচার করতে লাগল!
সমাজের প্রত্যেক খুঁটিনাটি বিষয়ে পুরুতগুলোর অত গায়ে পড়ে বিধান দেবার কি দরকার ছিল? তাতেই তো লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন কষ্ট পাচ্ছে!
তোমরা মাংসাহারী ক্ষত্রিয়দের কথা বলছ। ক্ষত্রিয়েরা মাংস খাক আর নাই খাক, তারাই হিন্দুধর্মের ভিতর যা কিছু মহৎ ও সুন্দর জিনিষ রয়েছে, তার জন্মদাতা। উপনিষদ্ লিখেছিলেন কারা? রাম কি ছিলেন? কৃষ্ণ কি ছিলেন? বুদ্ধ কি ছিলেন? জৈনদের তীর্থঙ্করেরা কি ছিলেন? যখনই ক্ষত্রিয়েরা ধর্ম উপদেশ দিয়েছেন, তাঁরা জাতিবর্ণনির্বিশেষে সবাইকে ধর্মের অধিকার দিয়েছেন; আর যখনই ব্রাহ্মণেরা কিছু লিখেছেন, তাঁরা অপরকে সকল রকম অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। আহাম্মক, গীতা আর ব্যাসসূত্র পড় অথবা আর কারও কাছে শুনে নাও। গীতায় সকল নরনারী, সকল জাতি, সকল বর্ণের জন্য পথ উন্মুক্ত রয়েছে; আর ব্যাস গরীব শূদ্রদের বঞ্চিত করবার জন্য বেদের স্বকপোলকল্পিত মানে করছেন। ঈশ্বর কি তোমাদের মত ভীরু আহাম্মক যে, এক টুকরো মাংসে তাঁর দয়া-নদীতে চড়া পড়ে যাবে? যদি তাই হয়, তবে তাঁর মূল্য এক কানাকড়িও নয়। যাক, ঠাট্টা থাক। কি প্রণালীতে তোমাদের চিন্তাকে নিয়মিত করতে হবে, এ চিঠিতে তার গোটাকতক সঙ্কেত দিলাম।
আমার কাছ থেকে কিছু আশা কর না। তোমাকে পূর্বেই লিখেছি ও বলেছি, আমার স্থির বিশ্বাস—মান্দ্রাজীদের দ্বারাই ভারতের উদ্ধার হবে। তাই বলছি, হে মান্দ্রাজবাসী যুবকবৃন্দ, তোমাদের মধ্যে গোটাকতক লোক এই নূতন ভগবান্ রামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে এই নূতনভাবে একেবারে মেতে উঠতে পার কি? ভেবে দেখো; উপাদান সংগ্রহ করে একখানা সংক্ষিপ্ত রামকৃষ্ণ-জীবনী লেখো দেখি। সাবধান, যেন তার মধ্যে কোন অলৌকিক ঘটনাসমাবেশ কর না—অর্থাৎ জীবনীটি লেখা হবে তাঁর উপদেশের উদাহরণস্বরূপ। তার মধ্যে কেবল তাঁর কথা থাকবে। খবরদার, এর মধ্যে আমাকে বা অন্য কোন জীবিত ব্যক্তিকে যেন এনো না। প্রধান লক্ষ্য থাকবে তাঁর শিক্ষা, তাঁর উপদেশ জগৎকে দেওয়া, আর জীবনীটি তাঁরই উদাহরণস্বরূপ হবে। তাঁর জীবনের অন্যান্য ঘটনা সাধারণের জন্য নয়। আমি অযোগ্য হলেও আমার উপর একটি কর্তব্য ন্যস্ত ছিল—যে রত্নের কৌটা আমার হাতে দেওয়া হয়েছিল, তা মান্দ্রাজে নিয়ে এসে তোমাদের হাতে দেওয়া।
কপট, হিংসুক, দাসভাবাপন্ন, কাপুরুষ, যারা কেবল জড়ে বিশ্বাসী, তারা কখনও কিছু করতে পারে না। ঈর্ষাই আমাদের দাসসুলভ জাতীয় চরিত্রের কলঙ্কস্বরূপ। ঈর্ষা থাকলে সর্বশক্তিমান্ ভগবানও কিছু করে উঠতে পারেন না।
আমার সম্বন্ধে মনে কর, যা কিছু করবার ছিল সব শেষ করেছি; এইটি ভাব যে, সব কাজের ভার তোমাদের ঘাড়ে। হে মান্দ্রাজবাসী যুবকবৃন্দ, ভাব যে তোমরা এই কাজ করবার জন্য বিধাতা কর্তৃক নির্দিষ্ট। তোমরা কাজে লাগো, ঈশ্বর তোমাদের আশীর্বাদ করুন। আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ভুলে যাও, কেবল রামকৃষ্ণকে প্রচার কর; তাঁর উপদেশ, তাঁর জীবনী প্রচার কর। কোন লোকের বিরুদ্ধে, কোন সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে কিছু বল না। জাতিভেদের স্বপক্ষে বিপক্ষে কিছু বল না, অথবা সামাজিক কোন কুরীতির বিরুদ্ধেও কিছু বলবার দরকার নেই। কেবল লোককে বল, ‘গায়ে পড়ে কারও অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে যেও না,’ তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আলাসিঙ্গা, জি. জি, বালাজী ও ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা কর, তারা এটা পারবে কি না। সাহসী, দৃঢ়নিষ্ঠ, প্রেমিক যুবকবৃন্দ, তোমরা সকলে আমার আশীর্বাদ জানবে। ইতি
তোমাদেরই
বিবেকানন্দ
৮০*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
১২ মার্চ, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনীগণ,
আমি এখন মিঃ পামারের অতিথি। ইনি বড় চমৎকার লোক। পরশু রাত্রে ভোজ দিলেন এঁর একদল প্রাচীন বন্ধুকে; তাঁদের প্রত্যেকেরই বয়স ষাটের উপর। দলটিকে ইনি বলেন—‘পুরানো বন্ধুদের আড্ডা।’ এক নাট্যশালায় বক্তৃতা দিলাম আড়াই ঘণ্টা; সকলেই খুব খুশী। এইবার বষ্টন আর নিউ ইয়র্কে যাচ্ছি। এখানকার আয় দিয়েই ওখানকার খরচ কুলিয়ে যাবে। ফ্ল্যাগ ও অধ্যাপক রাইটের ঠিকানা মনে নাই। মিশিগানে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি না। মিঃ হলডেন আজ প্রাতে খুব বোঝাচ্ছিলেন আমাকে—মিশিগানে বক্তৃতা দেবার জন্য। আমার কিন্তু এখন বষ্টন ও নিউ ইয়র্ক একটু ঘুরে দেখবার আগ্রহ। সত্য কথা বলতে কি, যতই আমি জনপ্রিয় হচ্ছি এবং আমার বাগ্মিতার উৎকর্ষ হচ্ছে, ততই আমার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। এ-যাবৎ যতগুলি বক্তৃতা দিয়েছি, তার মধ্যে শেষেরটাই সবচেয়ে ভাল। শুনে মিঃ পামার তো আনন্দে আত্মহারা; আর শ্রোতারা এমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান যে, বক্তৃতা শেষ হয়ে যাবার পর আমি জানতে পারলাম—এত দীর্ঘকাল ধরে বলেছি। শ্রোতার অমনোযোগ বা চাঞ্চল্য বক্তার অগোচর থাকে না। যাক, এ সব বাজে জিনিষ থেকে ভগবান্ আমাকে রক্ষা করুন—আমার আর এ সব ভাল লাগে না। ঈশ্বর করেন তো বষ্টন বা নিউ ইয়র্কে বিশ্রামের অভিপ্রায়। তোমরা সকলে আমার প্রীতি জেনো। চিরসুখী হও। ইতি।
তোমাদের স্নেহের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
৮১*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
১৫ মার্চ, ১৮৯৪
স্নেহের খুকীরা,
বুড়ো পামারের সঙ্গে আমার বেশ জমেছে। বৃদ্ধ সজ্জন ও সদানন্দ। আমার বক্তৃতার জন্য মাত্র একশো সাতাশ ডলার পেয়েছি। সোমবার আবার ডেট্রয়েটে বক্তৃতা দেব। তোমাদের মা আমাকে বলেছেন—লীনের (Lynn) এক মহিলাকে চিঠি দিতে। আমি তো তাঁকে কখনও দেখিওনি। বিনা পরিচয়ে লেখা ভদ্রতাসঙ্গত হবে কি? মহিলাটির নামে বরং ডাকে একটি ছোট পরিচয়পত্র আমাকে পাঠিয়ে দিও। আর লীনই বা কোথায়? হাঁ, আমার সম্বন্ধে সব চেয়ে মজার কথা লিখেছে এখানকার এক সংবাদপত্রঃ ঝঞ্ঝা-সদৃশ হিন্দুটি এখানে মিঃ পামারের অতিথি, মিঃ পামার হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছেন, ভারতবর্ষে যাচ্ছেন; তবে তাঁর জেদ, দুইটি বিষয়ে কিছু অদল-বদল চাই—জগন্নাথদেবের রথ টানবে তাঁর লগ্ হাউস ফার্মের ‘পারচেরন্’ জাতীয় অশ্ব, আর তাঁর জার্সি গাভীগুলিকে হিন্দুর গোদেবী-সম্প্রদায়ভুক্ত করে নিতে হবে। এই জাতীয় অশ্ব ও গাভী মিঃ পামারের লগ্ হাউস ফার্মে বহু আছে এবং এগুলি তাঁর খুব আদরের।
প্রথম বক্তৃতা সম্পর্কে বন্দোবস্ত ঠিক হয়নি। হলের ভাড়াই লেগেছিল একশো পঞ্চাশ ডলার। হলডেনকে ছেড়ে দিয়েছি। অন্য একজন জুটেছে, দেখি এর ব্যবস্থা ভাল হয় কি না। মিঃ পামার আমায় সারাদিন হাসান। আগামী কাল ফের এক নৈশভোজ হবে। এ পর্যন্ত সব ভালই চলেছে, কিন্তু জানি না কেন, এখানে আসা অবধি আমার মন বড় ভারাক্রান্ত হয়ে আছে।
বক্তৃতা প্রভৃতি বাজে কাজে একেবারে বিরক্ত হয়ে উঠেছি। শত বিচিত্র রকমের মনুষ্যনামধারী কতকগুলি জীবের সহিত মিশে মিশে উত্ত্যক্ত হয়ে পড়েছি। আমার বিশেষ পছন্দের বস্তুটি যে কি, তা বলছিঃ আমি লিখতেও পারি না, বক্তৃতা করতেও পারি না; কিন্তু আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি, আর তার ফলে যখন উদ্দীপ্ত হই, তখন বক্তৃতায় অগ্নি বর্ষণ করতে পারি; কিন্তু তা অল্প—অতি অল্পসংখ্যক বাছাই-করা লোকের মধ্যেই হওয়া উচিত। তাদের যদি ইচ্ছা হয়তো আমার ভাবগুলি জগতে প্রচার করুক—আমি কিছু করব না। কাজের এ একটা যুক্তিযুক্ত বিভাগ মাত্র। একই ব্যক্তি চিন্তা করে, তারপর সেই চিন্তালব্ধ ভাব প্রচার করে কখনও সফল হতে পারেনি। ঐরূপে প্রচারিত ভাবের মূল্য কিছুই নয়। চিন্তা করবার, বিশেষ করে আধ্যাত্মিক চিন্তার জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার প্রয়োজন। স্বাধীনতার এই দাবী, এবং মানুষ যে যন্ত্রবিশেষ নয়—এই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাই যেহেতু সব ধর্মচিন্তার সার কথা, অতএব বিধিবদ্ধ যান্ত্রিক ধারা অবলম্বন করে এই চিন্তা অগ্রসর হতে পারে না। যন্ত্রের স্তরে সব কিছুকে টেনে নামাবার এই প্রবৃত্তিই আজ পাশ্চাত্যকে অপূর্ব সম্পদ্শালী করেছে সত্য, কিন্তু এই প্রবৃত্তিই আবার তার সব রকম ধর্মকে বিতাড়িত করেছে। যৎসামান্য যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তাকেও পাশ্চাত্য পদ্ধতিমত কসরতে পর্যবসিত করেছে।
আমি বাস্তবিকই ‘ঝঞ্ঝাসদৃশ’ নই, বরং ঠিক তার বিপরীত। আমার যা কাম্য, তা এখানে লভ্য নয় এবং এই ‘ঝঞ্ঝাবর্তময়’ আবহাওয়াও আমি আর সহ্য করতে পারছি না। পূর্ণত্বলাভের পথ এই যে, নিজে ঐরূপ চেষ্টা করতে হবে এবং অন্যান্য স্ত্রী-পুরুষ যারা সচেষ্ট, তাদের যথাশক্তি সাহায্য করতে হবে। বেনাবনে মুক্তা ছড়িয়ে সময়, স্বাস্থ্য ও শক্তির অপব্যয় করা আমার কর্ম নয়—মুষ্টিমেয় কয়েকটি মহামানব সৃষ্টি করাই আমার ব্রত।
এইমাত্র ফ্ল্যাগের এক পত্র পেলাম। বক্তৃতা-ব্যাপারে তিনি আমাকে সাহায্য করতে অক্ষম। তিনি বলেন, ‘আগে বষ্টনে যান।’ যাক, বক্তৃতা দেবার সাধ্য আর আমার নেই। এই যে আমাকে দিয়ে ব্যক্তি বা শ্রোতা বিশেষকে খুশী করবার চেষ্টা—এটা আমার মোটেই ভাল লাগছে না। যা হোক, এ দেশ থেকে চলে যাবার আগে অন্ততঃ দু-এক দিনের জন্যও চিকাগোয় ফিরে যাব। ঈশ্বর তোমাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন।
আপনার সদাকৃতজ্ঞ বন্ধু
বিবেকানন্দ
৮২*
[মিস ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
১৭ মার্চ, ’৯৪
প্রিয় ভগিনী,
তোমার প্যাকেটটি গতকাল পেয়েছি। সেই মোজাগুলি পাঠাতে হয়েছে বলে দুঃখিত—এখানে আমি নিজেই কিছু যোগাড় করে নিতে পারতাম। তবে ব্যাপারটি তোমার ভালবাসার পরিচায়ক বলে আমি খুশী। যা হোক আমার ঝুলি এখন ঠাসা ভর্তি। কিভাবে যে বয়ে বেড়াব জানি না!
মিঃ পামারের সঙ্গে বেশী সময় থাকার ব্যাপারে মিসেস ব্যাগলি ক্ষুণ্ণ হওয়ায় আজ তাঁর বাড়ীতে ফিরেছি। পামারের বাড়ীতে বেশ ভালই কেটেছে। পামার সত্যি আমুদে দিলখোলা মজলিশী লোক, ‘ঝাঁঝালো স্কচ’-এর ভক্ত; নিতান্ত নির্মল আর শিশুর মত সরল।
আমি চলে আসাতে তিনি খুব দুঃখিত হলেন। কিন্তু আমার অন্য কিছু করবার ছিল না। এখানে এক সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে আমার দু-বার সাক্ষাৎ হয়েছে। তার নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না। যেমন তার বুদ্ধি, তেমনি রূপ, তেমনি ধর্মভাব; সংসারের ছোঁয়ার মধ্যে একেবারে নেই। প্রভু তাকে কৃপা করুন। সে আজ সকালে মিসেস ম্যাক্ডুভেলের সঙ্গে এসেছিল এবং এমন চমৎকারভাবে কথাবার্তা বলল, এমন গভীর ও আধ্যাত্মিকভাবে—আহা, আমি একেবারে মোহিত হয়ে গেলাম! যোগীদের বিষয়ে তার সব-কিছু জানা আছে, আর ইতোমধ্যে যোগাভ্যাসে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে!
বিবেকানন্দ
৮৩*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
১৮ মার্চ, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী মেরী,
কলিকাতার চিঠিখানা আমাকে পাঠানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানবে। গুরুদেব সম্বন্ধে অনেক কথাই তুমি আমার কাছে শুনেছ। তাঁরই জন্মতিথি অনুষ্ঠানের একটি নিমন্ত্রণপত্র কলিকাতার গুরুভায়েরা আমাকে লিখেছেন। সুতরাং পত্রটি তোমাকে ফেরত পাঠাচ্ছি। পত্রে আরও লিখেছেন, ‘ম—’ কলিকাতায় ফিরে গিয়ে রটাচ্ছে যে বিবেকানন্দ আমেরিকায় সব রকমের পাপ কাজ করছে। ... এই তো তোমাদের আমেরিকার ‘অপূর্ব আধ্যাত্মিক পুরুষ!’ তাদেরই বা দোষ কি? যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানী না হওয়া পর্যন্ত—অর্থাৎ আত্মার স্বরূপ প্রত্যক্ষ না করলে, আধ্যাত্মিক রাজ্যের সঠিক সন্ধান না পেলে মানুষ বস্তু ও অবস্তুর, বাগাড়ম্বর ও জ্ঞানগাম্ভীর্যের এবং এ জাতীয় অপরাপর বিষয়ের পার্থক্য ধরতে পারে না। ‘ম—’ বেচারীর এতদূর অধঃপতনে আমি বিশেষ দুঃখিত। ভগবান্ ভদ্রলোককে কৃপা করুন।
পত্রে সম্বোধনাংশ ইংরেজীতে। নামটি আমার বহু আগেকার; লেখক শৈশবের এক সাথী; এখন আমার মত সন্ন্যাসী। বেশ কবিত্বপূর্ণ নাম! নামের অংশমাত্র লিখেছে, সবটা হচ্ছে ‘নরেন্দ্র’, অর্থাৎ ‘মানুষের সেরা’ (‘নর’ মানে মানুষ, আর ‘ইন্দ্র’ মানে রাজা, অধিপতি)—হাস্যাস্পদ নয় কি? আমাদের দেশে নাম, সব এই রকমের। নাচার! আমি কিন্তু নামটি যে ছাড়তে পেরেছি, তাতে খুব খুশী।
বেশ ভাল আছি। আশা করি তোমাদের কুশল। ইতি তোমার ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
৮৪
[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
C/o George W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ
চিকাগো, ১৯ মার্চ, ১৮৯৪
কল্যাণবরেষু,
এদেশে আসিয়া অবধি তোমাদের পত্র লিখি নাই। কিন্তু হরিদাস ভাই-এর৩৯ পত্রে সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। G. C. Ghose৪০ এবং তোমরা যে হরিদাস ভাই-এর যথোচিত খাতির করিয়াছ, তাহা বড়ই ভাল।
এদেশে আমার কোন অভাব নাই; তবে ভিক্ষা চলে না, পরিশ্রম অর্থাৎ উপদেশ করিতে হয় স্থানে স্থানে। এদেশে যেমন গরম তেমনি শীত। গরমি কলিকাতা অপেক্ষা কোন অংশে কম নহে। শীতের কথা কি বলিব, সমস্ত দেশ দু হাত তিন হাত কোথাও ৪।৫ হাত বরফে ঢাকা। দক্ষিণভাগে বরফ নাই! বরফ তো ছোট জিনিষ। যখন পারা জিরোর উপর ৩২ দাগ থাকে, তখন বরফ পড়ে। কলিকাতায় কদাচ ৬০ হয়—জিরোর উপর, ইংলণ্ডে কদাচ জিরোর কাছে যায়। এখানে পারার পো জিরোর নীচে ৪০।৫০ তক নেবে যান। উত্তরভাগে কানাডায় পারা জমে যায়। তখন আলকোহল থার্মোমিটার ব্যবহার করিতে হয়। যখন বড্ড ঠাণ্ডা, অর্থাৎ যখন পারা জিরোর উপর ২০ ডিগ্রীরও নীচে থাকে, তখন বরফ পড়ে না। আমার বোধ ছিল—বরফ পড়া একটা বড় ঠাণ্ডা। তা নয়, বরফ অপেক্ষাকৃত গরম দিনে পড়ে। বেজায় ঠাণ্ডায় এক রকম নেশা হয়। গাড়ী চলে না, শ্লেজ চক্রহীন—ঘসড়ে যায়! সব জমে কাঠ—নদী নালা লেকের (হ্রদের) উপর হাতী চলে যেতে পারে! নায়াগারার প্রচণ্ড প্রবাহশালী বিশাল নির্ঝর জমে পাথর!!! আমি কিন্তু বেশ আছি। প্রথমে একটু ভয় হয়েছিল তার পর গরজের দায়ে একদিন রেলে করে কানাডার কাছে, দ্বিতীয় দিন দক্ষিণ আমেরিকা [যুক্তরাষ্ট্র] লেকচার করে বেড়াচ্চি! গাড়ী ঘরের মত, steam pipe (নলবাহিত বাষ্প)-যোগে খুব গরম, আর চারিদিকে বরফের রাশি ধপধপে সাদা, সে অপূর্ব শোভা!
বড় ভয় ছিল যে, আমার নাক কান খসে যাবে, কিন্তু আজিও কিছু হয় নাই। তবে রাশীকৃত গরম কাপড়, তার উপর সলোম চামড়ার কোট, জুতো, জুতোর উপর পশমের জুতো ইত্যাদি আবৃত হয়ে বাইরে যেতে হয়। নিঃশ্বাস বেরুতে না বেরুতেই দাড়িতে জমে যাচ্চেন। তাতে তামাসা কি জান? বাড়ীর ভেতর জলে এক ডেলা বরফ না দিয়ে এরা পান করে না। বাড়ীর ভেতর গরম কিনা, তাই। প্রত্যেক ঘরে, সিঁড়িতে steam pipe গরম রাখছে। কলা-কৌশলে এরা অদ্বিতীয়, ভোগে বিলাসে এরা অদ্বিতীয়, পয়সা রোজগারে অদ্বিতীয়, খরচে অদ্বিতীয়। কুলীর রোজ ৬৲ টাকা, চাকরের তাই, ৩৲ টাকার কম ঠিকা গাড়ী পাওয়া যায় না। চারি আনার কম চুরুট নাই। ২৪৲ টাকায় মধ্যবিৎ জুতো একজোড়া। ৫০০৲ টাকায় একটা পোষাক। যেমন রোজগার, তেমনই খরচ। একটা লেকচার ২০০।৩০০।৫০০।২০০০।৩০০০৲ পর্যন্ত। আমি ৫০০৲ টাকা৪১ পর্যন্ত পাইয়াছি। অবশ্য—আমার এখানে এখন পোয়াবারো। এরা আমায় ভালবাসে, হাজার হাজর লোক আমার কথা শুনিতে আসে।
প্রভুর ইচ্ছায় মজুমদার মশায়ের সঙ্গে এখানে দেখা। প্রথমে বড়ই প্রীতি, পরে যখন চিকাগোসুদ্ধ নরনারী আমার উপর ভেঙে পড়তে লাগল তখন মজুমদার ভায়ার মনে আগুন জ্বলল! ... দাদা, আমি দেখেশুনে অবাক্! বল্ বাবা, আমি কি তোর অন্নে ব্যাঘাত করেছি? তোর খাতির তো যথেষ্ট এ দেশে। তবে আমার মত তোমাদের হল না, তা আমার কি দোষ? ... আর মজুমদার পার্লামেণ্ট অব্ রিলিজিয়নের পাদ্রীদের কাছে আমার যথেষ্ট নিন্দা করে, ‘ও কেউ নয়, ঠক জোচ্চোর; ও তোমাদের দেশে এসে বলে—আমি ফকির’ ইত্যাদি বলে তাদের মন আমার উপর যথেষ্ট বিগড়ে দিলে। ব্যারোজ প্রেসিডেণ্টকে এমনি বিগড়ালে যে, সে আমার সঙ্গে ভাল করে কথাও কয় না। তাদের পুস্তকে প্যাম্ফলেটে যথাসাধ্য আমায় দাবাবার চেষ্টা; কিন্তু গুরু সহায় বাবা! মজুমদার কি বলে? সমস্ত আমেরিকান নেশন যে আমাকে ভালবাসে, ভক্তি করে, টাকা দেয়, গুরুর মত মানে—মজুমদার করবে কি? পাদ্রী-ফাদ্রীর কি কর্ম? আর এরা বিদ্বানের জাত। এখানে ‘আমরা বিধবার বে দিই, আর পুতুলপূজা করি না’—এ সব আর চলে না—পাদ্রীদের কাছে কেবল চলে। ভায়া, এরা চায় ফিলসফি, learning (বিদ্যা), ফাঁকা গপ্পি আর চলে না।
ধর্মপাল ছোকরা বেশ, ... ভাল মানুষ। তার এদেশে যথেষ্ট আদর হয়েছিল। দাদা, মজুমদারকে দেখে আমার আক্কেল এসে গেল। বুঝতে পারলুম, ‘যে নিঘ্নন্তি পরহিতং নিরর্থকং তে কে ন জানীমহে’—ভর্তৃহরি।৪২
ভায়া, সব যায়, ওই পোড়া হিংসেটা যায় না। আমাদের ভিতরও খুব আছে। আমাদের জাতের ঐটে দোষ, খালি পরনিন্দা আর পরশ্রীকাতরতা। হাম্বড়া, আর কেউ বড় হবে না।
এ দেশের মেয়ের মত মেয়ে জগতে নাই। কি পবিত্র, স্বাধীন, স্বাপেক্ষ, আর দয়াবতী—মেয়েরাই এদেশের সব। বিদ্যে বুদ্ধি সব তাদের ভেতর। ‘যা শ্রীঃ সুকৃতিনাং স্বয়ং ভবনেষু' (যিনি পুণ্যবানদের গৃহে স্বয়ং লক্ষ্মীস্বরূপিণী) এ দেশে, আর ‘পাপাত্মনাং হৃদয়েষ্বলক্ষ্মীঃ’ (পাপাত্মগণের হৃদয়ে অলক্ষ্মীস্বরূপিণী) আমাদের দেশে, এই বোঝ। হরে, হরে, এদের মেয়েদের দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম। ‘ত্বং শ্রীস্ত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীঃ’ ইত্যাদি—(তুমিই লক্ষ্মী, তুমিই ঈশ্বরী, তুমি লজ্জাস্বরূপিণী)। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ (যে দেবী সর্বভূতে শক্তিরূপে অবস্থিতা) ইত্যাদি। এদেশের বরফ যেমনি সাদা, তেমনি হাজার হাজার মেয়ে আছে, যাদের মন পবিত্র। আর আমাদের দশ বৎসরের বেটা-বিউনিরা!!! প্রভো, এখন বুঝতে পারছি। আরে দাদা, ‘যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ’ (যেখানে স্ত্রীলোকেরা পূজিতা হন, সেখানে দেবতারাও আনন্দ করেন)—বুড়ো মনু বলেছে। আমরা মহাপাপী; স্ত্রীলোককে ঘৃণ্যকীট, নরকমার্গ ইত্যাদি বলে বলে অধোগতি হয়েছে। বাপ, আকাশপাতাল ভেদ!! ‘যাথাতথ্যতোঽর্থান্ ব্যদধাৎ’৪৩ (যথোপযুক্তভাবে কর্মফল বিধান করেন)। প্রভু কি গপ্পিবাজিতে ভোলেন? প্রভু বলেছেন, ‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী’ ইত্যাদি—(তুমিই স্ত্রী, তুমিই পুরুষ, তুমিই বালক ও তুমিই বালিকা)।৪৪ আর আমরা বলছি—‘দূরমপসর রে চণ্ডাল’ (ওরে চণ্ডাল, দূরে সরিয়া যা), ‘কেনৈষা নির্মিতা নারী মোহিনী’ ইত্যাদি (কে এই মোহিনী নারীকে নির্মাণ করিয়াছে?)। ওরে ভাই, দক্ষিণ দেশে যা দেখেছি, উচ্চজাতির নীচের উপর যে অত্যাচার! মন্দিরে যে দেবদাসীদের নাচার ধুম! যে ধর্ম গরীবের দুঃখ দূর করে না, মানুষকে দেবতা করে না, তা কি আবার ধর্ম? আমাদের কি আর ধর্ম? আমাদের ‘ছুঁৎমার্গ’, খালি ‘আমায় ছুঁয়ো না, আমায় ছুঁয়ো না’। হে হরি? যে দেশের বড় বড় মাথাগুলো আজ দু-হাজার বৎসর খালি বিচার করছে—ডান হাতে খাব, কি বাম হাতে; ডান দিক্ থেকে জল নেব, কি বাঁ দিক্ থেকে এবং ফট্ ফট্ স্বাহা, ক্রাং ক্রুং হুঁ হুঁ করে, তাদের অধোগতি হবে না তো কার হবে? ‘কালঃ সুপ্তেষু জাগর্তি কালো হি দুরতিক্রমঃ’ (সকলে নিদ্রিত হয়ে থাকলেও কাল জাগরিত থাকেন, কালকে অতিক্রম করা বড় কঠিন)। তিনি জানছেন, তাঁর চক্ষে কে ধুলো দেয় বাবা!
যে দেশে কোটি কোটি মানুষ মহুয়ার ফুল খেয়ে থাকে, আর দশবিশ লাখ সাধু আর ক্রোর দশেক ব্রাহ্মণ ঐ গরীবদের রক্ত চুষে খায়, আর তাদের উন্নতির কোন চেষ্টা করে না, সে কি দেশ না নরক! সে ধর্ম, না পৈশাচ নৃত্য! দাদা, এটি তলিয়ে বোঝ—ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে দেখেছি। এ দেশ দেখেছি। কারণ বিনা কার্য হয় কি? পাপ বিনা সাজা মিলে কি? ‘সর্বশাস্ত্রপুরাণেষু ব্যাসস্য বচনদ্বয়ম্। পরোপকারঃ পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম্॥ (সমুদয় শাস্ত্র ও পুরাণে ব্যাসের দুইটি বাক্য—পরোপকার করিলে পুণ্য ও পরপীড়ন করিলে পাপ উৎপন্ন হয়)। সত্য নয় কি?
দাদা, এই সব দেখে—বিশেষ দারিদ্র্য আর অজ্ঞতা দেখে আমার ঘুম হয় না; একটা বুদ্ধি ঠাওরালুম Cape Comorin (কুমারিকা অন্তরীপে) মা কুমারীর মন্দিরে বসে, ভারতবর্ষের শেষ পাথর-টুকরার উপর বসে—এই যে আমরা এতজন সন্ন্যাসী আছি, ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, লোককে metaphysics (দর্শন) শিক্ষা দিচ্ছি, এ সব পাগলামি। ‘খালি পেটে ধর্ম হয় না’—গুরুদেব বলতেন না? ঐ যে গরীবগুলো পশুর মত জীবন যাপন করছে, তার কারণ মূর্খতা; পাজি বেটারা চার যুগ ওদের চুষে খেয়েছে, আর দু পা দিয়ে দলেছে।
“ মনে কর, কতকগুলি সন্ন্যাসী যেমন গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে—কোন্ কাজ করে?—তেমনি কতকগুলি নিঃস্বার্থ পরহিতচিকীর্ষু সন্ন্যাসী—গ্রামে গ্রামে বিদ্যা বিতরণ করে বেড়ায়, নানা উপায়ে নানা কথা, map, camera, globe (মানচিত্র, ক্যামেরা, গোলক) ইত্যাদির সহায়ে আচণ্ডালের উন্নতিকল্পে বেড়ায়, তাহলে কালে মঙ্গল হতে পারে কি না। এ সমস্ত প্ল্যান আমি এইটুকু চিঠিতে লিখতে পারি না। ফলকথা—If the mountain does not come to Mahomet, Mahomet must come to the mountain৪৫. গরীবেরা এত গরীব, তারা স্কুল- পাঠশালে আসতে পারে না, আর কবিতা-ফবিতা পড়ে তাদের কোন উপকার নাই। We as a nation have lost our individuality and that is the cause of all mischief in India. We have to give back to the nation its lost individuality and raise the masses. The Hindu, the Mahommedan, the Christian, all have trampled them under foot. Again the force to raise them must come from inside, i.e., from the orthodox Hindus. In every country the evils exist not with but against religion. Religion, therefore, is not to blame, but men.৪৬
এই করতে গেলে প্রথম চাই লোক, দ্বিতীয় চাই পয়সা। গুরুর কৃপায় প্রতি শহরে আমি ১০।১৫ জন লোক পাব। পয়সার চেষ্টায় তার পর ঘুরলাম। ভারতবর্ষের লোক পয়সা দেবে!!! Fools and dotards and Selfishness personified৪৭—তারা দেবে! তাই আমেরিকায় এসেছি, নিজে রোজগার করব, করে দেশে যাব and devote the rest of my life to the realization of this one aim of my life.৪৮
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
যেমন আমাদের দেশে social virtue-র (সমাজ-হিতকর গুণের) অভাব, তেমনি এ দেশে spirituality (আধ্যাত্মিকতা) নাই, এদের sprituality দিচ্ছি, এরা আমায় পয়সা দিচ্ছে। কত দিনে সিদ্ধকাম হব জানি না, আমাদের মত এরা hypocrite (কপট) নয়, আর jealousy (ঈর্ষা) একেবারে নাই। হিন্দুস্তানের কারও উপর depend (নির্ভর) করি না। নিজে প্রাণপণ করে রোজগার করে নিজের plans carry out (উদ্দেশ্য কার্যে পরিণত) করব or die in the attempt (কিম্বা ঐ চেষ্টায় মরব)। ‘সন্নিমিত্তে বরং ত্যাগো বিনাশে নিয়তে সতি’—(যখন মৃত্যু নিশ্চিত, তখন সৎ উদ্দেশ্যে দেহত্যাগ করাই ভাল)।
তোমরা হয়তো মনে করতে পার, কি Utopian nonsense (অসম্ভব বাজে কথা)। You little know what is in me (আমার ভিতর কি আছে, তোমরা মোটেই জান না)। আমাদের ভেতর যদি কেউ আমার সহায়তা করে in my plan (আমার পরিকল্পনা সফল করতে)—all right (খুব উত্তম); নইলে কিন্তু গুরুদেবwill show me the way out (আমাকে পথ দেখাইবেন)। ইতি।
মাকে আমার কোটি কোটি সাষ্টাঙ্গ দিবে। তাঁর আশীর্বাদে আমার সর্বত্র মঙ্গল। এই পত্র বাহিরের লোকের নিকট পড়বার আবশ্যক নাই। এটি সকলকে বলিও, সকলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করিও—সকলে jealousy ত্যাগ করে এককাট্টা হয়ে থাকতে পারবে কি না। যদি না পারে, যারা হিংসুটেপনা না করে থাকতে পারে না, তাদের ঘরে যাওয়াই ভাল, আর সকলের কল্যাণের জন্য। ঐটে আমাদের জাতের দোষ, national sin (জাতিগত পাপ)!!! এদেশে ঐটে নাই, তাই এরা এত বড়।
আমাদের মত কূপমণ্ডুক তো দুনিয়ায় নাই। কোন একটা নূতন জিনিষ কোন দেশ থেকে আসুক দিকি, আমেরিকা সকলের আগে নেবে। আর আমরা? আমাদের মত দুনিয়ায় কেউ নেই, ‘আর্যবংশ’!!! কোথায় বংশ তা জানি না! ... এক লাখ লোকের দাবানিতে ৩০০ মিলিয়ান (ত্রিশ কোটি) কুকুরের মত ঘোরে, আর তারা ‘আর্যবংশ’!!!
কিমধিকমিতি—বিবেকানন্দ
৮৫*
[রেভারেণ্ড হিউমকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
২৯ মার্চ, ১৮৯৪
প্রিয় ভ্রাতা,
আপনার পত্র সদ্য এখানে আমার কাছে পৌঁছেছে। আমি ব্যস্ত আছি, সুতরাং আপনার পত্রের মাত্র কয়েকটি বিষয় সংশোধনের সুযোগ নিচ্ছি বলে ক্ষমা করবেন।
প্রথমতঃ পৃথিবীর কোন ধর্ম অথবা ধর্মসংস্থাপকের বিরুদ্ধে আমার কোন কিছুই বলবার নেই, থাকতে পারে না; আমাদের ধর্ম সম্পর্কে আপনারা যা খুশী ভাবুন না কেন। সব ধর্মই আমার কাছে অতি পবিত্র। দ্বিতীয়তঃ মিশনরীরা আমাদের মাতৃভাষাগুলি শিক্ষা করে না, এমন কথা আমি বলিনি; কিন্তু আমার এই অভিমতে আমি এখনও সুদৃঢ় যে, তাঁদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যকই (সত্যি যদি কেউ থাকেন) সংস্কৃতের প্রতি কোনপ্রকার মনোযোগ দেন। তাছাড়া একথাও সত্য নয় যে, আমি কোন ধর্মসংস্থার বিরুদ্ধে কিছু বলেছি, যদিও এখনও আমি আমার অভিমতের উপর জোর দিচ্ছি যে, সমগ্র ভারতবর্ষকে কখনও খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা সম্ভব হবে না; খ্রীষ্টধর্মের দ্বারা নিম্নশ্রেণীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে—এ কথাও আমি অস্বীকার করছি; এবং সেই সঙ্গে এ কথাও যোগ করে দিচ্ছি—দক্ষিণ ভারতে ভারতীয় খ্রীষ্টানেরা কেবল যে ক্যাথলিক তাই নয়, তাদের নিজেদের উক্তি অনুযায়ী তারা হল ‘জাতিমানা খ্রীষ্টান’, অর্থাৎ তারা ঘনিষ্ঠভাবে তাদের জাতিকে আঁকড়ে থাকে, এবং আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি—যদি হিন্দুসমাজ তার বর্জননীতি পরিহার করে, তাহলে ওদের শতকরা নব্বুই ভাগ বহু ত্রুটিপূর্ণ এই হিন্দুধর্মেই অবিলম্বে ফিরে আসবে।
পরিশেষে আমাকে ‘স্বদেশবাসী’ বলে সম্বোধন করার জন্য আমি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই সর্বপ্রথম কোন বিদেশী ইওরোপীয় একজন ঘৃণ্য নেটিভকে ঐ ভাষায় সম্বোধন করতে সাহসী হলেন—তিনি ভারতে জাত বা মিশনরী, যাই হোন না কেন। বন্ধুবর, ঐ একইভাবে ভারতবর্ষেও কি আমাকে সম্বোধন করতে আপনি সাহস করবেন? ভারতে জাত মিশনরীদের অনুগ্রহ করে বলুন, তাঁরা ঐভাবেই যেন আমাদের সম্বোধন করেন, এবং যাঁরা ভারতে জন্মাননি, তাঁদের বলুন তাঁরা যেন ভারতবাসীকে সমপর্যায়ের মানুষ বলে গণ্য করেন। আর বাকী সব বিষয়ে—আপনি নিজেই আমাকে আহাম্মক মনে করবেন, যদি আমি কতকগুলো পৃথিবী-পর্যটক বা অলীক কাহিনীকারের বিবরণ অনুযায়ী আমাদের ধর্ম বা সমাজের বিচার হতে পারে বলে স্বীকার করে নিই। ভ্রাতঃ, ক্ষমা করবেন, ভারতে জন্মালেও আমাদের সমাজ বা ধর্মের বিষয়ে আপনি জানেনই বা কি? কেননা সমাজের দ্বার যেভাবে বন্ধ, কিছু জানা অসম্ভব। সর্বোপরি, সকলেই তার পূর্ব ধারণার মাপকাঠিতে কোন জাতি বা ধর্মের বিচার করে থাকে—করে না কি? প্রভু আপনাকে আশীর্বাদ করুন, আপনি আমাকে ‘স্বদেশবাসী’ বলেছেন। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে প্রেম ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক এখনও সম্ভব।
ভ্রাতৃপ্রেমবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৮৬*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
ডেট্রয়েট
৩১ মার্চ, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
তুমি ও মাদার চার্চ টাকা পেয়েছ জানিয়ে যে চিঠি দুখানি লিখেছ, তা এইমাত্র একসঙ্গে পেলাম। খেতড়ির পত্রটি পেয়ে সুখী হলাম; তোমাকে ওটি ফেরত পাঠাচ্ছি। পড়ে দেখো—লেখক চাইছেন খবরের কাগজের কিছু কাটিং! ডেট্রয়েটের কাগজগুলি ছাড়া আর কিছু আমার কাছে নেই, তাই পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমিও কিছু সংগ্রহ করতে পারলে পাঠিয়ে দিও—যদি অবশ্য সুবিধা হয়। ঠিকানা জান তো?—
H. H. The Maharaja of Khetri, Rajputana, India.
চিঠিখানা কিন্তু তোমাদের ধার্মিক পরিবারের মধ্যেই যেন থাকে। মিসেস ব্রীড প্রথমে আমায় এক কড়া ঝাঁঝালো চিঠি দেন। আজ টেলিগ্রামে এক সপ্তাহের জন্য তাঁর আতিথ্যগ্রহণের নিমন্ত্রণ পেলাম। এর আগে নিউ ইয়র্ক থেকে মিসেস স্মিথের এক পত্র পেয়েছি—তিনি, মিস হেলেন গোল্ড ও ডাক্তার—আমাকে নিউ ইয়র্কে আহ্বান করেছেন। আবার আগামী মাসে ১৭ তারিখে লীন ক্লাবের (Lynn Club) নিমন্ত্রণ আছে। প্রথমে নিউ ইয়র্কে যাব, তারপর লীনে তাদের সভায় যথাসময়ে উপস্থিত হব।
ইতোমধ্যে যদি আমি চলে না যাই—মিসেস ব্যাগলির আগ্রহও তাই, তাহলে আগামী গ্রীষ্মে সম্ভবতঃ এনিস্কোয়ামে (Annisquam) যাব। মিসেস ব্যাগলি সেখানে এক সুন্দর বাড়ী বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। মহিলাটি বেশ ধর্মপ্রাণা (spiritual), মিঃ পামার কিন্তু বেশ একটু পানাসক্ত (spirituous)—তাহলেও সজ্জন। অধিক আর কি? আমি শারীরিক ও মানসিক বেশ ভাল আছি। স্নেহের ভগিনীগণ! তোমরা সুখী—চিরসুখী হও। ভাল কথা, মিসেস শার্মান নানা রকমের উপহার দিয়েছেন—নখ কাটবার ও চিঠি রাখবার সরঞ্জাম, একটি ছোট ব্যাগ, ইত্যাদি ইত্যাদি—যদিও ওগুলি নিতে আমার আপত্তি ছিল, বিশেষ করে ঝিনুকের হাতলওয়ালা শৌখীন নখকাটা সরঞ্জামটার বিষয়ে, তবুও তাঁর আগ্রহের জন্য নিতে হল। ঐ ব্রাশ নিয়ে কি যে করব, তা জনি না। ভগবান্ ওদের রক্ষা করুন। তিনি এক উপদেশও দিয়েছেন—আমি যেন এই আফ্রিকী পরিচ্ছদে ভদ্রসমাজে না যাই। তবে আর কি! আমিও একজন ভদ্রসমাজের সভ্য! হা ভগবান্, আরও কি দেখতে হবে! বেশী দিন বেঁচে থাকলে কত অদ্ভুত অভিজ্ঞতাই না হয়!
তোমাদের ধার্মিক পরিবারের সকলকে অগাধ স্নেহ জানাচ্ছি। ইতি
তোমার ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
৮৭*
[মান্দ্রাজী ভক্তদিগকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৯ এপ্রিল, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তোমার শেষ পত্রখানি কয়েকদিন আগে পেয়েছি। দেখ, আমাকে এখানে এত বেশী ব্যস্ত থাকতে হয় আর প্রত্যহ এতগুলো চিঠি লিখতে হয় যে, তুমি আমার কাছ থেকে ঘন ঘন পত্র পাবার আশা করতে পার না। যা হোক, এখানে যা কিছু হচ্ছে, তা যাতে তুমি মোটামুটি জানতে পার, তার জন্য আমি বিশেষ চেষ্টা করে থাকি। আমি ধর্মমহাসভা-সম্বন্ধীয় একখানি বই তোমায় পাঠাবার জন্য চিকাগোয় লিখব। ইতোমধ্যে তুমি নিশ্চয় আমার দুটি ক্ষুদ্র বক্তৃতা পেয়েছ।
সেক্রেটারী সাহেব আমায় লিখেছেন, আমার ভারতে ফিরে যাওয়া অবশ্য কর্তব্য—কারণ ভারতই আমার কর্মক্ষেত্র। এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু হে ভ্রাতৃগণ, আমাদিগকে এমন একটি প্রকাণ্ড মশাল জ্বালতে হবে, যা সমগ্র ভারতে আলো দেবে। অতএব ব্যস্ত হয়ো না, ঈশ্বরেচ্ছায় সময়ে সবই হবে। আমি আমেরিকায় অনেক বড় বড় শহরে বক্তৃতা দিয়েছি এবং ওতে যে টাকা পেয়েছি, তাতে এখানকার অত্যধিক খরচ বহন করেও ফেরবার ভাড়া যথেষ্ট থাকবে। আমার এখানে অনেক ভাল ভাল বন্ধু হয়েছে—তার মধ্যে কয়েকজনের সমাজে যথেষ্ট প্রতিপত্তি। অবশ্য গোঁড়া পাদ্রীরা আমার বিপক্ষে, আর তাঁরা আমার সঙ্গে সোজা রাস্তায় সহজে পেরে উঠবেন না দেখে আমাকে গালমন্দ নিন্দাবাদ করতে আরম্ভ করেছেন, আর ‘ম—’বাবু তাঁদের সাহায্য করছেন। তিনি নিশ্চয় হিংসায় পাগল হয়ে গেছেন। তিনি তাঁদের বলেছেন, আমি একটা ভয়ানক জোচ্চোর ও বদমাশ, আবার কলিকাতায় গিয়ে সেখানকার লোকদের বলেছেন, আমি ঘোর পাপে মগ্ন, বিশেষতঃ আমি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছি!!! প্রভু তাঁকে আশীর্বাদ করুন। ভ্রাতৃগণ, কোন ভাল কাজই বিনা বাধায় সম্পন্ন হয় না। কেবল যারা শেষ পর্যন্ত অধ্যবসায়ের সহিত লেগে থাকে, তারাই কৃতকার্য হয়। আমি তোমার ভগিনীপতির৪৯ লিখিত পুস্তিকাগুলি এবং তোমার পাগলা বন্ধুর আর একখানি পত্র পেয়েছি। ‘যুগ’ সম্বন্ধে প্রবন্ধটি বড় সুন্দর—তাতে যুগের যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাই তো ঠিক ব্যাখ্যা; তবে আমি বিশ্বাস করি, সত্যযুগ এসে পড়েছে—এই সত্যযুগে এক বর্ণ, এক বেদ হবে এবং সমগ্র জগতে শান্তি ও সমন্বয় স্থাপিত হবে। এই সত্যযুগের ধারণা অবলম্বন করেই ভারত আবার নবজীবন পাবে। এতে বিশ্বাস স্থাপন কর।
একটা জিনিষ করা আবশ্যক—যদি পার। মান্দ্রাজে একটা প্রকাণ্ড সভা আহ্বান করতে পার? রামনাদের রাজা বা ঐরূপ একজন বড় লোক কাকেও সভাপতি করে ঐ সভায় একটা প্রস্তাব করিয়ে নিতে পার যে, আমি আমেরিকায় হিন্দুধর্ম যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছি, তাতে তোমরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়েছ (—অবশ্য যদি তোমরা সত্যই ঐরূপ হয়ে থাক)। তারপর সেই প্রস্তাবটি ‘চিকাগো হেরাল্ড’, ‘ইণ্টার-ওশ্যান’ (Inter-Ocean), ‘নিউ ইয়র্ক সান’ এবং ডেট্রয়েট (মিশিগান) থেকে প্রকাশিত ‘কমার্শিয়াল এডভাটাইজার’ কাগজে পাঠিয়ে দিতে হবে। চিকাগো ইলিনয় রাষ্ট্রে। ‘নিউ ইয়র্ক সান’-এর আর বিশেষ ঠিকানার কোন আবশ্যক নাই। প্রস্তাবের কয়েকটি কপি ধর্ম-মহাসভার সভাপতি ডাঃ ব্যারোজকে চিকাগোয় পাঠাবে—আমি তাঁর বাড়ীর নম্বরটা ভুলে গেছি, রাস্তাটার নাম ইণ্ডিয়ানা এভিনিউ। এক কপি ডেট্রয়েটের মিসেস জে. জে. ব্যাগলির নামে পাঠাবে—তাঁর ঠিকানা ওয়াশিংটন এভিনিউ। এই সভাটা যত বড় হয়, তার চেষ্টা করবে। যত বড় বড় লোককে পার, ধরে নিয়ে এসে এই সভায় যোগ দেওয়াবার চেষ্টা করবে; তাঁদের ধর্মের জন্য, দেশের জন্য তাঁদের এতে যোগ দেওয়া উচিত। মহীশূরের মহারাজ ও তাঁর দেওয়ানের নিকট হতে সভা ও তার উদ্দেশ্যের সমর্থন করে চিঠি নেবার চেষ্টা কর—খেতড়ির মহারাজের নিকট থেকেও ঐরূপ চিঠি নেবার চেষ্টা কর—মোটের উপর সভাটা যত প্রকাণ্ড হয় ও তাতে যত বেশী লোক হয়, তার চেষ্টা কর।
উঠ বৎসগণ—এই কাজে লেগে যাও। যদি তোমরা এটা করতে পার, তবে ভবিষ্যতে আমরা অনেক কাজ করতে পারব নিশ্চয়।
প্রস্তাবটি এমন ধরনের হবে যে, মান্দ্রাজের হিন্দুসমাজ, যাঁরা আমাকে এখানে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা আমার এখানকার কাজে সম্পূর্ণ সন্তোষ প্রকাশ করছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
যদি সম্ভব হয়, এইটির জন্য চেষ্টা কর—এ তো আর বেশী কাজ নয়। সব জায়গা থেকে যতদূর পার আমাদের কাজে সহানুভূতি-প্রকাশক পত্রও যোগাড় কর, ঐগুলি ছাপাও, আর যত শীঘ্র পার মার্কিন সংবাদপত্রসমূহে পাঠাও। বৎসগণ, এতে অনেক কাজ হবে। ‘ব্রা—’ সমাজের লোকেরা এখানে যা তা বলছে। যত শীঘ্র হয়, তাদের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে। সনাতন হিন্দুধর্মের জয় হোক। মিথ্যাবাদী ও পাষণ্ডেরা পরাভূত হোক। উঠ, উঠ বৎসগণ, আমরা নিশ্চিত জয়লাভ করব। আমার পত্রগুলির প্রকাশ সম্বন্ধে বক্তব্য এই—যতদিন না আমি ভারতে ফিরছি, ততদিন এইগুলির যতটা অংশ প্রকাশ করা উচিত, ততটা আমাদের বন্ধুগণের নিকট প্রকাশ করা যেতে পারে। একবার কাজ করতে আরম্ভ করলে খুব হুজুকে মেতে যাবে, কিন্তু আমি কাজ না করে বাঙালীর মত কেবল লম্বা লম্বা কথা কইতে চাই না।
ঠিক বলতে পারি না, তবে বোধ হয়, কলিকাতার গিরিশ ঘোষ আর মিত্র মহাশয় আমার গুরুদেবের ভক্তদের দিয়ে কলিকাতায় ঐরূপ সভা আহ্বান করাতে পারেন। যদি পারেন তো খুব ভালই হয়। সম্ভব হলে কলিকাতার সভায় ঐ একই রকম প্রস্তাব পাস করিয়ে নিতে বলবে। কলিকাতায় হাজার হাজার লোক আছে, যারা আমাদের কাজের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। ...
আর বিশেষ কিছু লিখিবার নেই। আমাদের সকল বন্ধুকে আমার সাদর সম্ভাষণাদি জানাবে—আমি সতত তাঁদের কল্যাণ প্রার্থনা করছি। ইতি
আশীর্বাদক
বিবেকানন্দ
পুনঃ—সাবধান, পত্র লিখিবার সময় আমার নামের আগে ‘His Holiness’ লিখো না। এখানে উহা অত্যন্ত কিম্ভূতকিমাকার শুনায়। ইতি
বি
৮৮*
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২৫ এপ্রিল, ’৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
আপনার আমন্ত্রণের জন্য গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। ৭ই মে যাচ্ছি। বিছানা?—বন্ধু, আপনার ভালবাসা এবং মহৎ প্রাণ পাথরকেও পাখীর পালকের মত কোমল করতে পারে।
সেলেমে লেখকদের প্রাতরাশে যোগ দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
৭ই ফিরছি।
আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
৮৯*
[মিস ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২৬ এপ্রিল
প্রিয় ভগিনী,
গতকাল তোমার চিঠি পেয়েছি। তুমি ঠিকই বলেছ, আমি ‘ইণ্টিরিয়র’-৫০ এর পাগলামিতে খুব মজা বোধ করছি। কিন্তু তুমি ভারতের কাগজপত্রের যে ডাক গতকাল পাঠিয়েছ, তা মাদার চার্চ যেমন বলেছেন—দীর্ঘ বিরতির পর সত্যি সুসংবাদ। ওর মধ্যে দেওয়ানজীর একটি চমৎকার পত্র আছে। বৃদ্ধ লোকটি—প্রভু তাঁকে আশীর্বাদ করুন, যথারীতি সাহায্যের প্রস্তাব করেছেন। ওর মধ্যে কলিকাতায় প্রকাশিত আমার সম্বন্ধে একটি ছোট্ট পুস্তিকা আছে, যাতে দেখা গেল—‘প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তি’ তাঁর নিজ দেশে মর্যাদা পেলেন; আমার জীবনে অন্তত একবারের জন্য এটা দেখতে পেলাম। আমেরিকান ও ভারতীয় পত্র-পত্রিকা থেকে সংগৃহীত আমার বিষয়ক অংশগুলি তার মধ্যে রয়েছে। কলিকাতার পত্রাদির অংশগুলি বিশেষভাবে তৃপ্তিকর, কিন্তু প্রশংসাবাহুল্যের জন্য সেগুলি তোমাকে পাঠাব না। তারা আমার সম্বন্ধে ‘অপূর্ব’, ‘অদ্ভুত’, ‘সুবিখ্যাত’ এইসব নানা আজে-বাজে কথা বলেছে, কিন্তু তারা বহন করে এনেছে সমগ্র জাতির হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা। এখন আমি লোকের কথা আর গ্রাহ্য করি না, আমার নিজের দেশের লোক বললেও না—কেবল একটি কথা। আমার বুড়ী মা এখনও বেঁচে আছেন, সারা জীবন তিনি অসীম কষ্ট পেয়েছেন, সে-সব সত্ত্বেও মানুষ আর ভগবানের সেবায় আমাকে উৎসর্গ করবার বেদনা তিনি সহ্য করেছেন। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ আশার, তাঁর সবচেয়ে ভালবাসার যে ছেলেটিকে তিনি দান করেছেন, সে দূরদেশে গিয়ে—কলিকাতায় মজুমদার যেমন রটাচ্ছে তেমনিভাবে—জঘন্য নোংরা জীবন যাপন করছে, এ সংবাদ তাঁকে একেবারে শেষ করে দেবে। কিন্তু প্রভু মহান্, তাঁর সন্তানের ক্ষতি কেউ করতে পারে না।
ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে—আমি না চাইতেই। ঐ সম্পাদকটি কে জান?—আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্রের সম্পাদক, যিনি আমার অত প্রশংসা করেছেন এবং আমেরিকায় আমি হিন্দুধর্মের পক্ষ-সমর্থনে এসেছি বলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তিনি মজুমদারের সম্পর্কিত ভাই!! হতভাগ্য মজুমদার! ঈর্ষায় জ্বলে মিথ্যা কথা বলে নিজের উদ্দেশ্যেরই ক্ষতি করলে। প্রভু জানেন, আমি আত্মসমর্থনের কিছুমাত্র চেষ্টা করিনি।
‘ফোরাম’-এ মিঃ গান্ধীর রচনা এর পূর্বেই আমি পড়েছি। যদি গতমাসের ‘রিভিউ অফ রিভিউজ’টা পাও, তাহলে সেটা মায়ের কাছে পাঠ কর। তাতে আফিং-সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারতীয় চরিত্র সম্পর্কে বৃটিশ ভারতের জনৈক সর্বোচ্চ রাজকর্মচারীর অভিমত পাবে। তিনি ইংরেজদের সঙ্গে হিন্দুদের তুলনা করে হিন্দুদের আকাশে তুলেছেন। আমাদের জাতির একজন চরমতম শত্রু ঐ স্যার লেপেল্ গ্রিফিন্! তাঁর এই মত-পরিবর্তনের কারণ কি?
বষ্টনে মিসেস ব্রীড-এর বাড়ীতে আমার সময় কেটেছে চমৎকার। অধ্যাপক রাইটের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়েছে। আমি আবার বষ্টনে যাচ্ছি। দরজীরা আমার নূতন গাউন তৈরী করছে। কেম্ব্রিজ (হার্ভার্ড) ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা দিতে যাব। সেখানে অধ্যাপক রাইটের অতিথি হব। বষ্টনের কাগজপত্রে আমাকে বিরাট করে স্বাগত জানিয়েছে।
এই সব আজে-বাজে ব্যাপারে আমি পরিশ্রান্ত। মে মাসের শেষের দিকে চিকাগোয় যাব। সেখানে কয়েকদিন কাটিয়ে আবার ফিরব পূর্বদিকে।
গত রাত্রে ওয়ালডর্ফ হোটেলে বক্তৃতা দিয়েছি। মিসেস স্মিথ প্রতি টিকিট দু-ডলার করে বেচেছেন। ঘর-ভর্তি শ্রোতা পেয়েছিলাম, যদিও ঘরটি বেশী বড় ছিল না। টাকাকড়ির দর্শন এখনও পাইনি। আজকের মধ্যে পাবার আশা রাখি।
লীন-এ যে এক-শ ডলার পেয়েছি, তা পাঠালাম না, কারণ নূতন গাউন তৈরী ইত্যাদি বাজে ব্যাপারে খরচ করতে হবে।
বষ্টনে টাকার ভরসা নেই। তবু আমেরিকার মস্তিষ্কটিকে স্পর্শ করতেই হবে, তাতে নাড়া দিতেই হবে, দেখি যদি পারি।
তোমার প্রিয় ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
৯০*
[মিস ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
২ (যথার্থতঃ ১) মে, ’৯৪
প্রিয় ভগিনী,
পুস্তিকাটি তোমাকে এখনই পাঠাতে পারব বলে মনে হয় না, তবে গতকাল ভারত থেকে সংবাদপত্রের যে-সব অংশ এসেছে, তা তোমায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেগুলো পড়ে অনুগ্রহ করে মিসেস ব্যাগলির কাছে পাঠিয়ে দিও। ঐ সংবাদপত্রটির সম্পাদক হচ্ছেন মিঃ মজুমদারের আত্মীয়। বেচারা মজুমদারের জন্য এখন আমার দুঃখ হয়!!
আমার কোটের ঠিক কমলা রঙটি এখানে খুঁজে বার করতে পারলাম না। সুতরাং তার কাছাকাছি ভাল রঙ যা মিলল—পীতাভ রক্তিম—তাতেই খুশী থাকতে হল। কয়েকদিনের মধ্যেই কোটটি তৈরী হয়ে যাবে।
সেদিন ওয়ালডর্ফের বক্তৃতা থেকে ৭০ ডলার পেয়েছি। আগামীকালের বক্তৃতা থেকে আরও কিছু পাবার আশা রাখি। ৭ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত বষ্টনে বক্তৃতাদি আছে, তবে সেখানে তারা খুব কমই পয়সা দেয়।
গতকাল ১৩ ডলার দিয়ে একটা পাইপ কিনেছি—দোহাই, ফাদার পোপকে কথাটি বল না যেন। কোটের খরচ পড়বে ৩০ ডলার। খাবার-দাবার ঠিকই মিলছে ... এবং যথেষ্ট টাকা। আশা হয়, আগামী বক্তৃতার পরেই অবিলম্বে ব্যাঙ্কে কিছু রাখতে পারব।
... সন্ধ্যায় এক নিরামিষ নৈশভোজে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি!
ঠিক, আমি নিরামিষাশী ... কারণ যখন নিরামিষ জোটে, তখন তাই আমার পছন্দ। লাইম্যান অ্যাবট-এর কাছে আগামী পরশু মধ্যাহ্ন-ভোজের আর একটি নিমন্ত্রণ আছে। সময় মোটের উপর চমৎকার কাটছে। বষ্টনেও তেমনি সুন্দর কাটবে আশা হয়—কেবল ঐ জঘন্য, অতি জঘন্য বিরক্তিকর বক্তৃতা বাদে। যা হোক, ১৯ তারিখ পার হলেই এক লাফে বষ্টন থেকে ... চিকাগোয়, ... তারপরে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেব, আর টানা বিশ্রাম—দু-তিন সপ্তাহের। তখন গ্যাঁট হয়ে বসে শুধু গল্প করব—আর পাইপ টানব।
ভাল কথা, তোমার নিউ ইয়র্কীরা লোক খুবই ভাল, কেবল তাদের মগজের চেয়ে টাকা বেশী।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে বক্তৃতা দিতে যাব। বষ্টনে তিনটি বক্তৃতা এবং হার্ভার্ডে তিনটি—সকলেরই ব্যবস্থা করেছেন মিসেস ব্রীড। এখানেও ওরা কিছু ব্যবস্থা করছে। সুতরাং চিকাগোর পথে আমি আর একবার নিউ ইয়র্কে আসব—কিছু কড়া বাণী শুনিয়ে টাকাকড়ি পকেটস্থ করে সাঁ করে চিকাগোয় চলে যাব।
চিকাগোয় পাওয়া যায় না এমন কিছু যদি নিউ ইয়র্ক বা বষ্টন থেকে তোমার দরকার থাকে, সত্বর লিখবে। আমার এখন পকেট-ভর্তি ডলার। যা তুমি চাইবে এক মুহূর্তে পাঠিয়ে দেব। এতে অশোভন কিছু হবে—কখনও মনে কর না। আমার কাছে বুজরুকি নেই। আমি যদি তোমার ভাই হই তো ভাই-ই! পৃথিবীতে একটি জিনিষই আমি ঘৃণা করি—বুজরুকি।
তোমার স্নেহময় ভাই
বিবেকানন্দ
৯১*
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৪ মে, ১৮৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
আপনার সহৃদয় লিপি এখনই পেলাম। আপনার কথামত কাজ করে আমি যে খুবই সুখী হব, তা বলাই বাহুল্য।
কর্ণেল হিগিন্সনের চিঠিও পেয়েছি। তাকে উত্তর পাঠাচ্ছি। আমি রবিবার (৬ই মে) বষ্টনে যাব। মিসেস হাউ-এর উইমেন্স্ ক্লাবে সোমবার বক্তৃতা দেবার কথা।
আপনার সদা বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ
৯২*
১৭ বীকন ষ্ট্রীট, বষ্টন
মে, ১৮৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
ইতোমধ্যে আপনি পুস্তিকা এবং চিঠিগুলি পেয়ে গেছেন। যদি আপনি চান, তাহলে চিকাগো থেকে ভারতীয় রাজা ও রাজমন্ত্রীদের কয়েকখানি চিঠি পাঠাতে পারি। ঐ মন্ত্রীদের একজন ভারতের রাজকীয় কমিশনের অধীন বিগত ‘আফিং কমিশন’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন। আমি যে প্রতারক নই, তা আপনাকে বিশ্বাস করবার জন্য তাদের আপনার কাছে লিখতে বলব, আপনি যদি এটা পছন্দ করেন। কিন্তু ভ্রাতঃ, এ সব বিষয়ে গোপনতা ও অপ্রতিকারই আমাদের জীবনের আদর্শ।
আমাদের কর্তব্য শুধু ত্যাগ—গ্রহণ নয়। যদি আমার মাথায় খেয়াল না চাপত, তাহলে আমি কখনই এখানে আসতাম না। এতে আমার কাজের সহায়তা হবে, এই আশায় আমি ধর্মমহাসভায় যোগদান করেছি, যদিও আমার দেশবাসী যখন আমাকে পাঠাতে চেয়েছিল, তখন আমি সর্বদা আপত্তি করেছি। আমি তাদের বলে এসেছি, ‘আমি মহাসভায় যোগদান করতে পারি বা নাও পারি, তোমাদের যদি খুশী হয়, আমাকে পাঠাতে পার।’ তাঁরা আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। বাদ-বাকী আপনি করেছেন।
হে সহৃদয় বন্ধু, সর্বপ্রকারে আপনার সন্তোষ বিধান করতে ন্যায়তঃ আমি বাধ্য। আর বাকী পৃথিবীকে—তাদের বাতচিতকে আমি গ্রাহ্য করি না। আত্মসমর্থন সন্ন্যাসীর কাজ নয়। আপনার কাছে তাই আমার প্রার্থনা, আপনি ঐ পুস্তিকা ও চিঠিপত্রাদি কাউকে দেখাবেন না বা ছাপাবেন না। বুড়ো মিশনরীগুলোর আক্রমণকে আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি না। কিন্তু আমি দারুণ আঘাত পেয়েছি মজুমদারের ঈর্ষার জ্বালা দেখে। প্রার্থনা করি, তাঁর যেন চৈতন্য হয়। তিনি উত্তম ও মহান্ ব্যক্তি, সারা জীবন অপরের মঙ্গল করতে চেয়েছেন। অবশ্য এর দ্বারা আমার গুরুদেবের একটি কথাই আবার প্রমাণিত হল—‘কাজলের ঘরে থাকলে তুমি যত সেয়ানাই হও না কেন, গায়ে ছিটেফোঁটা কালি লাগবেই।’ সাধু পবিত্র হবার যত চেষ্টাই কেউ করুক না কেন, মানুষ যতক্ষণ এই পৃথিবীতে আছে তার স্বভাব কিছু পরিমাণে নিম্নগামী হবেই।
ভগবানের দিকে যাবার পথ সাংসারিক পথের ঠিক বিপরীত। ঈশ্বর ও ধনৈশ্বর্য একই সঙ্গে কেউ কখনও পেয়েছে?
আমি কোনদিন ‘মিশনরী’ ছিলাম না, কোনদিন হবও না—আমার স্বস্থান হিমালয়ে। পূর্ণ বিবেকের সঙ্গে পরিতৃপ্ত হৃদয়ে অন্ততঃ এই কথা আজ আমি বলতে পারি, ‘হে প্রভু, আমার ভ্রাতৃগণের ভয়ঙ্কর যাতনা আমি দেখেছি, যন্ত্রণামুক্তির পথ আমি খুঁজেছি এবং পেয়েছি—প্রতিকারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক, প্রভু।’
তাঁর আশীর্বাদ অনন্তকাল ধরে আপনাদের উপর বর্ষিত হোক।
আপনার স্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগোঃ
আমি আগামীকাল কিম্বা পরশু চিকাগো যাচ্ছি।
আপনাদের বি.
৯৩*
[স্বামী সারদানন্দকে লিখিত]
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
২০ মে, ১৮৯৪
প্রিয় শরৎ,
আমি তোমার পত্র পাইলাম ও শশী আরোগ্যলাভ করিয়াছে জানিয়া সুখী হইলাম। আমি তোমাকে একটি আশ্চর্য ব্যাপার বলিতেছি, শুন। যখনই তোমাদের মধ্যে কেহ অসুস্থ হইয়া পড়িবে, তখন সে নিজে অথবা তোমাদের মধ্যে অপর কেহ তাহাকে মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করিবে। ঐরূপে দেখিতে দেখিতে মনে মনে বলিবে ও দৃঢ়ভাবে কল্পনা করিবে যে, সে সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছে। ইহাতে সে শীঘ্র আরোগ্যলাভ করিবে। অসুস্থ ব্যক্তিকে না জানাইয়াও তুমি এরূপ করিতে পার। সহস্র মাইলের ব্যবধানেও এই কার্য চলিতে পারে। এইটি সর্বদা মনে রাখিয়া আর কখনও অসুস্থ হইও না।
* * *
সান্যাল তাহার কন্যাগণের বিবাহের জন্য ভাবিয়া ভাবিয়া এত অস্থির হইয়াছে কেন, বুঝিতে পারি না। মোদ্দা কথা তো এই যে, সে নিজে যে সংসার হইতে পলায়নে ইচ্ছুক, তাহার কন্যাগণকে সেই পঙ্কিল সংসারে নিমগ্ন করিতে চাহে!!! এ বিষয়ে আমার একটি মাত্র সিদ্ধান্ত থাকিতে পারে—নিন্দা! বালক বালিকা—যাহারই হউক না কেন, আমি বিবাহের নাম পর্যন্ত ঘৃণা করি। তুমি কি বলিতে চাও, আমি একজনের বন্ধনের সহায়তা করিব? কি আহাম্মক তুমি! যদি আমার ভাই মহিন আজ বিবাহ করে, আমি তাহার সহিত কোন সংস্রব রাখিব না। এ বিষয়ে আমি স্থিরসংকল্প। এখন বিদায়—
তোমাদের
বিবেকানন্দ
৯৪*
[অধ্যাপক রাইটকে লিখিত]
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২৪ মে, ’৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
এই সঙ্গে আমি আপনাকে রাজপুতানার অন্যতম শাসক মহামান্য খেতড়ির মহারাজের পত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেই সঙ্গে ভারতের অন্যতম বৃহৎ দেশীয় রাজ্য জুনাগড়ের প্রাক্তন মন্ত্রীর পত্রও পাঠালাম। ইনি আফিং কমিশনের একজন সদস্য এবং ‘ভারতের গ্লাডষ্টোন’ নামে খ্যাত। মনে হয় এগুলি পড়লে আপনার বিশ্বাস হবে যে—আমি প্রতারক নই।
একটা জিনিষ আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি কখনই মিঃ মজুমদারের 'নেতা’র৫১ মতাবলম্বী হইনি। যদি মজুমদার তেমন কথা বলে থাকেন, তিনি সত্য বলেননি।
চিঠিগুলো পাঠের পর আশা করি অনুগ্রহ করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। পুস্তিকাটির কোন দরকার নেই, ওটার কোন মূল্য দিই না।
প্রিয় বন্ধু, আমি যে যথার্থই সন্ন্যাসী, এ বিষয়ে সর্বপ্রকারে আপনাকে আশ্বস্ত করতে আমি দায়বদ্ধ। কিন্তু সে কেবল ‘আপনাকেই’। বাকী নিকৃষ্ট লোকেরা কি বলে না বলে, আমি তার পরোয়া করি না।
‘কেউ তোমাকে বলবে সাধু, কেউ বলবে চণ্ডাল, কেউ বলবে উন্মাদ, কেউ বলবে দানব, কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের পথে চলে যাও’—এই কথা বলেছিলেন বার্ধক্যে সন্ন্যাসগ্রহণকারী রাজা ভর্তৃহরি—ভারতের একজন প্রাচীন সম্রাট্ ও মহান্ সন্ন্যাসী।
ঈশ্বরের চিরন্তন আশীর্বাদ আপনার উপর বর্ষিত হোক। আপনার সকল সন্তানের জন্য আমার ভালবাসা, এবং আপনার মহীয়সী পত্নীর উদ্দেশ্যে আমার শ্রদ্ধা।
আপনার সদাবান্ধব
বিবেকানন্দ
পুনশ্চঃ পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর দলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সে কেবল সমাজসংস্কারের ব্যাপারে।—কে আমি সব সময় আন্তরিকতাহীন বলে মনে করেছি, এবং এখনও সে-মত পরিবর্তনের কোন কারণ ঘটেনি। ধর্মীয় ব্যাপারে অবশ্য আমার বন্ধু পণ্ডিতজীর সঙ্গেও আমার বিশেষ মতপার্থক্য রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল—আমার কাছে সন্ন্যাস সর্বোচ্চ আদর্শ, তাঁর কাছে পাপ। সুতরাং ব্রাহ্মসমাজীরা সন্ন্যাসী হওয়াকে পাপ বলে মনে তো করবেই!!
আপনার বি.
ব্রাহ্মসমাজ আপনাদের দেশের ‘ক্রিশ্চান সায়েন্স’ দলের মত কিছু সময়ের জন্য কলিকাতায় বিস্তৃতিলাভ করেছিল, তারপর গুটিয়ে গেছে। এতে আমি সুখীও নই, দুঃখিতও নই। তার কাজ সে করেছে, যেমন সমাজসংস্কার। তার ধর্মের দান এক কানাকড়িও নয়। সুতরাং এ জিনিষ লোপ পেয়ে যাবে। যদি ম— মনে করেন আমি সেই মৃত্যুর অন্যতম কারণ, তিনি ভুল করেছেন। আমি এখনও ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারকার্যের প্রতি প্রভূত সহানুভূতিপূর্ণ। কিন্তু ঐ ‘অসার’ ধর্ম প্রাচীন ‘বেদান্ত’-এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। আমি কি করব? সেটা কি আমার দোষ? ম—কে বুড়ো বয়সে ছেলেমিতে পেয়েছে, এবং তিনি যে ফন্দি নিয়েছেন, তা আপনার খ্রীষ্টান মিশনরীদের ফন্দিবাজির চেয়ে একচুল কম নয়। প্রভু তাঁকে কৃপা করুন এবং শুভপথ দেখান।
আপনাদের
বিবেকানন্দ
আপনি কবে এনিষ্কোয়ামে যাচ্ছেন? অষ্টিন এবং বাইমকে আমার ভালবাসা, আপনার পত্নীকে আমার শ্রদ্ধা। আপনার জন্য গভীর প্রেম ও কৃতজ্ঞতা, যা ভাষায় প্রকাশে আমি অসমর্থ।
সদাপ্রেমবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৯৫*
চিকাগো
২৮ মে, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আমি তোমার পত্রের উত্তর পূর্বে দিতে পারি নাই, কারণ আমি নিউ ইয়র্ক ও বষ্টনের মধ্যে ক্রমাগত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম আর আমি ন—র পত্রের অপেক্ষা করিতেছিলাম। আমার সম্বন্ধে কিছু লিখিবার পূর্বে তোমাকে ন—র কথা কিছু বলিব। সে সকলকে নিরাশ করেছে। কতকগুলো বিটকেল দুষ্ট পুরুষ ও মেয়ের সঙ্গে মিশিয়া যে একেবারে গোল্লায় গিয়াছে—এখন কেউ তাহাকে কাছে ঘেঁষিতে দেয় না। যাহা হউক, অধোগতির চরম সীমায় পৌঁছিয়া সে আমাকে সাহায্যের জন্য লেখে। আমিও তাহাকে যথাসাধ্য সাহায্য করিব। যাহা হউক, তুমি তাহার আত্মীয়স্বজনকে বলিবে, তাহারা যেন শীঘ্র তাহাকে দেশে ফিরিয়া যাইবার জন্য ভাড়া পাঠায়। তাহারা কুক কোম্পানীর নামে টাকা পাঠাইতে পারে—তাহারা ওকে নগদ টাকা না দিয়া ভারতের একখানা টিকিট দিবে। আমার বোধ হয়, প্রশান্ত মহাসাগরের পথে যাওয়াই তাহার পক্ষে ভাল—ঐ পথে কোথাও নামিয়া পড়িবার প্রলোভন কিছু নেই। বেচারা বিশেষ কষ্টে পড়িয়াছে—অবশ্য যাহাতে সে অনশনক্লেশ না পায়, সেই দিকে আমি দৃষ্টি রাখিব। ফটোগ্রাফ-সম্বন্ধে বক্তব্য এই, এখন আমার নিকট একখানাও নাই—খানকতক পাঠাইবার জন্য অর্ডার দিব। খেতড়ির মহারাজকে আমি কয়েকখানি পাঠাইয়াছিলাম এবং তিনি তাহা হইতে কতকগুলি ছাপাইয়াছিলেন—ইতোমধ্যে তুমি তাহা হইতে কতকগুলি পাঠাইবার জন্য লিখিতে পার।
জানি না, কবে ভারতে যাইব। সমুদয় ভার তাঁহার উপর ফেলিয়া দেওয়া ভাল, তিনি আমার পশ্চাতে থাকিয়া আমাকে চালাইতেছেন।
আমাকে ছাড়িয়া কাজ করিবার চেষ্টা কর, মনে কর, যেন আমি কখনও ছিলাম না। কোন ব্যক্তির বা কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করিও না। যাহা পার করিয়া যাও, কাহারও উপর কোন আশা রাখিও না। ধর্মপাল যে তোমাদের বলিয়াছিল, আমি এ দেশ হইতে যত ইচ্ছা টাকা পাইতে পারি, সে কথা ঠিক নয়। এ বছরটা এ দেশে বড়ই দুর্বৎসর—ইহারা নিজেদের দরিদ্রদেরই সব অভাব দূর করিতে পারিতেছে না। যাহা হউক, এরূপ সময়েও আমি যে উহাদের নিজেদের বক্তাদের অপেক্ষা অনেক সুবিধা করিতে পারিয়াছি, তাহার জন্য উহাদিগকে ধন্যবাদ দিতে হয়।
কিন্তু এখানে ভয়ানক খরচ হয়। যদিও প্রায় সর্বদাই ও সর্বত্রই আমি ভাল ভাল ও বড় বড় পরিবারের মধ্যে আশ্রয় পাইয়াছি, তথাপি টাকা যেন উড়িয়া যায়।
আমি বলিতে পারি না, আগামী গ্রীষ্মকালে এদেশ হইতে চলিয়া যাইব কিনা; খুব সম্ভবতঃ না। ইতোমধ্যে তোমরা সঙ্ঘবদ্ধ হইতে এবং আমাদের কাজ যাহাতে অগ্রসর হয়, তাহার চেষ্টা কর। বিশ্বাস কর যে তোমরা সব করিতে পার। জানিয়া রাখো যে, প্রভু আমাদের সঙ্গে রহিয়াছেন, আর অগ্রসর হও, হে বীরহৃদয় বালকগণ!
আমার দেশ আমাকে যথেষ্ট আদর করিয়াছে। আদর করুক আর নাই করুক, তোমরা ঘুমাইয়া থাকিও না, তোমরা শিথিল-প্রযত্ন হইও না। মনে রাখিবে যে, আমাদের উদ্দেশ্যের এক বিন্দুও এখনও কার্যে পরিণত হয় নাই। শিক্ষিত যুবকগণের মধ্যে কার্য কর, তাহাদিগকে একত্র করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ কর। বড় বড় কাজ কেবল খুব স্বার্থত্যাগ দ্বারাই হইতে পারে। স্বার্থের আবশ্যকতা নাই, নামেরও নয়, যশেরও নয়—তা তোমারও নয়, আমারও নয় বা আমার গুরুর পর্যন্ত নয়। ভাব ও সঙ্কল্প যাহাতে কার্যে পরিণত হয়, তাহার চেষ্টা কর; হে বীরহৃদয় মহান্ বালকগণ! উঠে পড়ে লাগো! নাম, যশ বা অন্য কিছু তুচ্ছ জিনিষের জন্য পশ্চাতে চাহিও না। স্বার্থকে একেবারে বিসর্জন দাও ও কার্য কর। মনে রাখিও—‘তৃণৈর্গুণত্বমাপন্নৈর্বধ্যন্তে মত্তদন্তিনঃ’—অনেকগুলি তৃণগুচ্ছ একত্র করিয়া রজ্জু প্রস্তুত হইলে তাহাতে মত্ত হস্তীকেও বাঁধা যায়। তোমাদের সকলের উপর ভগবানের আশীর্বাদ বর্ষিত হউক! তাঁহার শক্তি তোমাদের সকলের ভিতর আসুক—আমি বিশ্বাস করি, তাঁহার শক্তি তোমাদের মধ্যেই রহিয়াছে। বেদ বলিতেছেন, ‘ওঠ, জাগো, যত দিন না লক্ষ্যস্থলে পঁহুছিতেছ, থামিও না। জাগো, জাগো, দীর্ঘ রজনী প্রভাতপ্রায়। দিনের আলো দেখা যাইতেছে। মহাতরঙ্গ উঠিয়াছে। কিছুতেই উহার বেগ রোধ করিতে পারিবে না। আমি পত্রের উত্তর দিতে দেরী করিলে বিষণ্ণ হইও না বা নিরাশ হইও না। লেখায়—আঁচড় কাটায় কি ফল? উৎসাহ, বৎস, উৎসাহ—প্রেম, বৎস, প্রেম। বিশ্বাস, শ্রদ্ধা। আর ভয় করিও না, সর্বাপেক্ষা গুরুতর পাপ—ভয়!
সকলকে আমার আশীর্বাদ। মান্দ্রাজের যে সকল মহানুভব ব্যক্তি আমাদের কার্যে সহায়তা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সকলকেই আমার অনন্ত কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা জানাইতেছি। কিন্তু আমি তাঁহাদের নিকট প্রার্থনা করি, যেন তাঁহারা কার্যে শৈথিল্য না করেন। চারিদিকে ভাব ছড়াইতে থাকো। গর্বিত হইও না। গোঁড়াদের মত জোর করিয়া কাহাকেও কিছু বিশ্বাস করিবার জন্য পীড়াপীড়ি করিও না, কোন কিছুর বিরুদ্ধেও বলিও না। আমাদের কাজ কেবল ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য একত্র রাখিয়া দেওয়া। প্রভু জানেন, কিরূপে ও কখন তাহারা নির্দিষ্ট আকার ধারণ করিবে। সর্বোপরি আমার বা তোমাদের কৃতকার্যতায় গর্বিত হইও না, বড় বড় কাজ এখনও করিতে বাকী। যাহা ভবিষ্যতে হইবে, তাহার সহিত তুলনায় এই সামান্য সিদ্ধি অতি তুচ্ছ। বিশ্বাস কর, বিশ্বাস কর, প্রভুর আজ্ঞা—ভারতের উন্নতি হইবেই হইবে, জনসাধারণকে এবং দরিদ্রদিগকে সুখী করিতে হইবে; আর আনন্দিত হও যে, তোমরাই তাঁহার কার্য করিবার নির্বাচিত যন্ত্র। ধর্মের বন্যা আসিয়াছে। আমি দেখিতেছি, উহা পৃথিবীকে ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে—অদম্য, অনন্ত, সর্বগ্রাসী। সকলেই সম্মুখে যাও, সকলের শুভেচ্ছা উহার সহিত যোগ দাও। সকল হস্ত উহার পথের বাধা সরাইয়া দিক্! জয়! প্রভুর জয়!!
শ্রীযুক্ত সুব্রহ্মণ্য আয়ার, কৃষ্ণস্বামী আয়ার, ভট্টাচার্য এবং আমার অন্যান্য বন্ধুগণকে আমার গভীর শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাইবে। তাঁহাদিগকে বলিবে, যদিও সময়াভাবে কিছু লিখিতে পারি না, কিন্তু হৃদয় তাঁহাদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট আছে। আমি তাঁহাদিগের ঋণ কখনও পরিশোধ করিতে পারিব না। প্রভু তাঁহাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন।
আমার কোন সাহায্যের আবশ্যকতা নাই। তোমরা কিছু অর্থ সংগ্রহ করিয়া একটি ফণ্ড খুলিবার চেষ্টা কর। শহরের সর্বাপেক্ষা দরিদ্রগণের যেখানে বাস, সেখানে একটি মৃত্তিকানির্মিত কুটীর ও হল প্রস্তুত কর। গোটাকতক ম্যাজিক লণ্ঠন, কতকগুলি ম্যাপ, গ্লোব এবং কতকগুলি রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি যোগাড় কর। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় সেখানে গরীব অনুন্নত, এমন কি, চণ্ডালগণকে পর্যন্ত জড়ো কর; তাহাদিগকে প্রথমে ধর্ম উপদেশ দাও, তারপর ঐ ম্যাজিক লণ্ঠন ও অন্যান্য দ্রব্যের সাহায্যে জ্যোতিষ, ভূগোল প্রভৃতি চলিত ভাষায় শিক্ষা দাও। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত একদল যুবক গঠন কর। তোমাদের উৎসাহাগ্নি তাহাদের ভিতর জ্বালিয়া দাও। আর ক্রমশঃ এই সঙ্ঘ বাড়াইতে থাকো—উহার পরিধি বাড়িতে থাকুক। তোমরা যতটুকু পার, কর। যখন নদীতে জল কিছুই থাকিবে না, তখন পার হইব বলিয়া বসিয়া থাকিবে না। পত্রিকা, সংবাদপত্র প্রভৃতির পরিচালন ভাল, সন্দেহ নাই; কিন্তু চিরকাল চীৎকার ও কলমপেশা অপেক্ষা প্রকৃত কার্য—যতই সামান্য হউক, অনেক ভাল। ভট্টাচার্যের গৃহে একটি সভা আহ্বান কর। কিছু টাকা সংগ্রহ করিয়া পূর্বে আমি যাহা বলিয়াছি, সেইগুলি ক্রয় কর। একটি কুটীর ভাড়া লও এবং কাজে লাগিয়া যাও। পত্রিকাদি গৌণ, ইহাই মুখ্য। যে কোনরূপেই হউক, সাধারণ দরিদ্রলোকের মধ্যে আমাদের প্রভাব বিস্তার করিতেই হইবে। কার্যের সামান্য আরম্ভ দেখিয়া ভয় পাইও না, কাজ সামান্য হইতেই বড় হইয়া থাকে। সাহস অবলম্বন কর। নেতা হইতে যাইও না, সেবা কর। নেতৃত্বের এই পাশব প্রবৃত্তি জীবনসমুদ্রে অনেক বড় বড় জাহাজ ডুবাইয়াছে। এই বিষয়ে বিশেষ সতর্ক হও অর্থাৎ মৃত্যুকে পর্যন্ত তুচ্ছ করিয়া নিঃস্বার্থ হও এবং কাজ কর। আমার যাহা বলিবার ছিল, তোমাদিগকে সব লিখিতে পারিলাম না। হে বীরহৃদয় বালকগণ! প্রভু তোমাদিগকে সব বুঝাইয়া দিবেন। লাগো, লাগো, বৎসগণ! প্রভুর জয়! কিডিকে আমার ভালবাসা জানাইবে। আমি সেক্রেটারী সাহেবের পত্র পাইয়াছি।
তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ
৯৬*
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ
১৮ জুন, ’৯৪
প্রিয় অধ্যাপকজী,
অন্য চিঠিগুলো পাঠাতে দেরী হল বলে ক্ষমা করবেন। আমি সেগুলো আগে খুঁজে পাইনি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে নিউ ইয়র্কে যাচ্ছি।
এনিষ্কোয়ামে যেতে পারব কিনা, ঠিক জানি না। আমি পুনরায় না লিখিলে চিঠিগুলো আমার কাছে পাঠাবার দরকার নেই। বষ্টনের কাগজে আমার বিরুদ্ধে লেখা সেই রচনাটি দেখে মিসেস ব্যাগলি খুবই বিচলিত হয়েছেন। তিনি ডেট্রয়েট থেকে আমার কাছে তার একটা কপি পাঠিয়েছেন এবং চিঠিপত্র লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রভু তাঁকে আশীর্বাদ করুন, তিনি আমার প্রতি সব সময়ই খুব সদয় ছিলেন।
ভ্রাতঃ, আপনার মত বলিষ্ঠ হৃদয় সহজে মেলে না। এটা একটা আজব জায়গা—আমাদের এই দুনিয়াটা। তবে এই দেশে যেখানে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত, সামান্য ‘পরিচয়পত্র’ও যেখানে আমার নেই, সেখানে এখানকার মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণে সহৃদয়তা পেয়েছি, তার জন্য সব জড়িয়ে আমি ঈশ্বরের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। শেষ পর্যন্ত সব কিছু মঙ্গলমুখী।
সদাকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—ছেলেদের জন্য ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ষ্ট্যাম্প পাঠালাম, যদি তাদের কাজে লাগে।
৯৭*
[শ্রীযুত হরিদাস বিহারীদাস দেশাইকে লিখিত]
C/o. G. W. Hale
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ
চিকাগো
২০ জুন, ১৮৯৪
প্রিয় দেওয়ানজী সাহেব,
আপনার অনুগ্রহলিপি আজ পাইলাম। আপনার মত মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে বিবেচনাহীন কঠোর মন্তব্য দ্বারা দুঃখ দিয়াছি বলিয়া আমি অত্যন্ত বেদনা বোধ করিতেছি। আপনার অল্প স্বল্প সংশোধন আমি নতমস্তকে মানিয়া লইলাম। ‘শিষ্যস্তেঽহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্।’ কিন্তু দেওয়ানজী সাহেব, এ কথা আপনি ভালভাবেই জানেন যে, আপনাকে ভালবাসি বলিয়াই ঐরূপ কথা বলিয়াছিলাম। অসাক্ষাতে যাহারা আমার দুর্নাম রটাইয়াছে, তাহারা পরোক্ষভাবে আমার উপকার তো করেই নাই, পরন্তু আমাদের হিন্দু সমাজের পক্ষ হইতে আমেরিকার জনসাধারণের নিকট আমার প্রতিনিধিত্ব-বিষয়ে একটি কথাও উক্ত না হওয়াতে ঐ সকল দুর্নাম যথেষ্ট ক্ষতির কারণই হইয়াছে। আমার দেশবাসী কেহ—আমি যে তাহাদের প্রতিনিধি—এ বিষয়ে কি একটি কথাও লিখিয়াছিল? কিম্বা আমার প্রতি আমেরিকাবাসীদের সহৃদয়তার জন্য ধন্যবাদজ্ঞাপক একটি বাক্যও কি তাহারা প্রেরণ করিয়াছে? পক্ষান্তরে—আমেরিকাবাসীর নিকট তারস্বরে এই কথাই ঘোষণা করিয়াছে যে, আমি একটি পাকা ভণ্ড এবং আমেরিকায় পদার্পণ করিয়াই আমি প্রথম গেরুয়া ধারণ করিয়াছি। অভ্যর্থনার ব্যাপারে অবশ্য এই সকল প্রচারের ফলে আমেরিকায় কোন ক্ষতি হয় নাই; কিন্তু অর্থসাহায্যের ব্যাপারে এই ভয়াবহ ফল ঘটিয়াছে যে, আমেরিকাবাসিগণ আমার কাছে একেবারে হাত গুটাইয়া ফেলিয়াছে। এই যে এক বৎসর যাবৎ আমি এখানে আছি—এর মধ্যে ভারতবর্ষের একজন খ্যাতনামা লোকও এ দেশবাসীকে এ কথাটি জানানো উচিত মনে করেন নাই যে, আমি প্রতারক নহি। ইহার উপর আবার মিশনরী সম্প্রদায় সর্বদা আমার ছিদ্রানুসন্ধানে তৎপর হইয়াই আছে এবং ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান পত্রিকাগুলিতে আমার বিরুদ্ধে যাহা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি সংগ্রহ করিয়া এখানকার কাগজে ছাপা হইয়াছে। আর আপনারা এইটুকু জানিয়া রাখুন যে, এদেশের জনসাধারণ—ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান ও হিন্দুতে যে কি পার্থক্য, তাহার খুব বেশী সংবাদ রাখে না।
আমার এখানে আসিবার মুখ্য উদ্দেশ্য—নিজের একটি বিশেষ কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। আমি সমস্ত বিষয়টি পুনর্বার সবিস্তার আপনাকে বলিতেছি।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মূল পার্থক্য এই যে, পাশ্চাত্য দেশে জাতীয়তাবোধ আছে, আর আমাদের তাহা নাই। অর্থাৎ শিক্ষা ও সভ্যতা এখানে (পাশ্চাত্যে) সর্বজনীন—জনসাধারণে অনুপ্রবিষ্ট। ভারতবর্ষের ও আমেরিকার উচ্চবর্ণের মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য নাই সত্য, কিন্তু উভয় দেশের নিম্মবর্ণের মধ্যে বিশাল পার্থক্য বিদ্যমান। ভারতবর্ষ জয় করা ইংরেজের পক্ষে এত সহজ হইয়াছিল কেন? যেহেতু তাহারা একটি সঙ্ঘবদ্ধ জাতি ছিল, আর আমরা তাহা ছিলাম না। আমাদের দেশে একজন মহৎ লোক মারা গেলে বহু শতাব্দী ধরিয়া আর একজনের আবির্ভাবের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতে হয়, আর এদেশে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে স্থান পূর্ণ হইয়া যায়। আপনি মারা গেলে (ভগবান্ আমার দেশের সেবার জন্য আপনাকে দীর্ঘায়ু করুন) আপনার স্থান পূর্ণ করিতে দেশ যথেষ্ট অসুবিধা বোধ করিবে; তাহা এখনই প্রতীয়মান হইতেছে, কারণ আপনাকে অবসর গ্রহণ করিতে দেওয়া হইতেছে না। বস্তুতঃ দেশে মহৎ ব্যক্তির অভাব ঘটিয়াছে। কেন তাহা হইয়াছে? কারণ এ দেশে কৃতী পুরুষগণের উদ্ভবক্ষেত্র অতি বিস্তৃত, আর আমাদের দেশে অতি সঙ্কীর্ণক্ষেত্র হইতে তাঁহাদের উদ্ভব হইয়া থাকে। এ দেশের শিক্ষিত নরনারীর সংখ্যা অত্যন্ত বেশী। তাই ত্রিশকোটি অধিবাসীর দেশ ভারতবর্ষ অপেক্ষা তিন চার কিম্বা ছয় কোটি নরনারী-অধ্যুষিত এ সকল দেশে কৃতী পুরুষগণের উদ্ভবক্ষেত্র বিস্তৃততর। আপনি সহৃদয় বন্ধু, আমাকে ভুল বুঝিবেন না। আমাদের জাতীয় জীবনে ইহা একটি বিশেষ ত্রুটি এবং ইহা দূর করিতে হইবে।
জনসাধারণকে শিক্ষিত করা এবং তাহাদিগকে উন্নত করাই জাতীয় জীবন-গঠনের পন্থা। আমাদের সমাজসংস্কারকগণ খুঁজিয়া পান না—ক্ষতটি কোথায়। বিধবা-বিবাহের প্রচলন দ্বারা তাঁহারা জাতিকে উদ্ধার করিতে চাহেন। আপনি কি মনে করেন যে, বিধবাগণের স্বামীর সংখ্যার উপর কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে? আমাদের ধর্মের কোন অপরাধ নাই, কারণ মূর্তিপূজায় বিশেষ কিছু আসিয়া যায় না। সমস্ত ত্রুটির মূলই এইখানে যে, সত্যিকার জাতি—যাহারা কুটীরে বাস করে, তাহারা তাহাদের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলিয়া গিয়াছে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান—প্রত্যেকের পায়ের তলায় পিষ্ট হইতে হইতে তাহাদের মনে এখন এই ধারণা জন্মিয়াছে যে, ধনীর পদতলে নিষ্পেষিত হইবার জন্যই তাহাদের জন্ম। তাহাদের লুপ্ত ব্যক্তিত্ববোধ আবার ফিরাইয়া দিতে হইবে। তাহাদিগকে শিক্ষিত করিতে হইবে। মূর্তিপূজা থাকিবে কি থাকিবে না, কতজন বিধবার পুনর্বার বিবাহ হইবে, জাতিভেদ-প্রথা ভাল কি মন্দ, তাহা লইয়া মাথা ঘামাইবার আমার প্রয়োজন নাই। প্রত্যেককেই তাহার নিজের মুক্তির পথ করিয়া লইতে হইবে। রাসায়নিক দ্রব্যের একত্র সমাবেশ করাই আমাদের কর্তব্য—দানাবাঁধার কার্য ঐশ্বরিক বিধানে স্বতই হইয়া যাইবে। আসুন, আমরা তাহাদের মাথায় ভাব প্রবেশ করাইয়া দিই—বাকীটুকু তাহারাই নিজেরাই করিবে। ইহার অর্থ, জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করিতে হইবে। কিন্তু তাহাতেও অসুবিধা আছে। দেউলিয়া গভর্ণমেণ্ট কোন সহায়তা করিবে না, করিতে সক্ষমও নহে; সুতরাং সেদিক হইতে সহায়তার কোন আশা নাই।
ধরুন, যদি আমরা গ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় খুলিতে সক্ষমও হই, তবু দরিদ্রঘরের ছেলেরা সে সব স্কুলে পড়িতে আসিবে না; তাহারা বরং ঐ সময় জীবিকার্জনের জন্য হালচাষ করিতে বাহির হইয়া পড়িবে। আমাদের না আছে প্রচুর অর্থ—না আছে ইহাদিগকে শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করিবার ক্ষমতা। সুতরাং সমস্যাটি নৈরাশ্যজনক বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু আমি ইহারই মধ্যে একটি পথ বাহির করিয়াছি। তাহা এই—যদি পর্বত মহম্মদের নিকট নাই আসে তবে মহম্মদকেই পর্বতের নিকট যাইতে হইবে।৫২ দরিদ্র লোকেরা যদি শিক্ষার নিকট পৌঁছিতে না পারে (অর্থাৎ নিজেরা শিক্ষালাভে তৎপর না হয়), তবে শিক্ষাকেই চাষীর লাঙ্গলের কাছে, মজুরের কারখানায় এবং অন্যত্র সব স্থানে যাইতে হইবে। প্রশ্ন হইতে পারে যে, কিরূপে তাহা সাধিত হইবে? আপনি আমার গুরুভ্রাতাগণকে দেখিয়া থাকিবেন। এক্ষণে ঐরূপ নিঃস্বার্থ, সৎ ও শিক্ষিত শত শত ব্যক্তি সমগ্র ভারতবর্ষ হইতে আমি পাইব। ইহাদিগকে গ্রামে গ্রামে, প্রতি দ্বারে দ্বারে শুধু ধর্মের নহে, পরন্তু শিক্ষার আলোকও বহন করিয়া লইয়া যাইতে হইবে। আমাদের মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিধবাদিগকে শিক্ষয়িত্রীয় কাজে লাগাইবার গোড়াপত্তন আমি করিয়াছি।
মনে করুন, কোন একটি গ্রামের অধিবাসিগণ সারাদিনের পরিশ্রমের পর গ্রামে ফিরিয়া আসিয়া কোন একটি গাছের তলায় অথবা অন্য কোন স্থানে সমবেত হইয়া বিশ্রম্ভালাপে সময়াতিপাত করিতেছে। সেই সময় জন-দুই শিক্ষিত সন্ন্যাসী তাহাদের মধ্যে গিয়া ছায়াচিত্র কিম্বা ক্যামেরার সাহায্যে গ্রহনক্ষত্রাদি সম্বন্ধে কিম্বা বিভিন্ন জাতি বা বিভিন্ন দেশের ইতিহাস সম্বন্ধে ছবি দেখাইয়া কিছু শিক্ষা দিল। এইরূপে গ্লোব, মানচিত্র প্রভৃতির সাহায্যে মুখে মুখে কত জিনিষই না শেখানো যাইতে পারে দেওয়ানজী! চক্ষুই যে জ্ঞানলাভের একমাত্র দ্বার তাহা নহে, পরন্তু কর্ণদ্বারাও শিক্ষার কার্য যথেষ্ট হইতে পারে। এইরূপে তাহারা নূতন চিন্তার সহিত পরিচিত হইতে পারে, নৈতিক শিক্ষা লাভ করিতে পারে এবং ভবিষ্যৎ অপেক্ষাকৃত ভাল হইবে বলিয়া আশা করিতে পারে। ঐটুকু পর্যন্ত আমাদের কর্তব্য—বাকীটুকু উহারা নিজেরাই করিবে।
এক্ষণে প্রশ্ন হইতে পারে যে, সন্ন্যাসিগণ কিসের জন্য এ জাতীয় ত্যাগব্রত গ্রহণ করিবে এবং কেনই বা এ প্রকারের কাজ করিতে অগ্রসর হইবে? উত্তরে আমি বলিব—ধর্মের প্রেরণায়! প্রত্যেক নূতন ধর্ম-তরঙ্গেরই একটি নূতন কেন্দ্র প্রয়োজন। প্রাচীন ধর্ম শুধু নূতন কেন্দ্র-সহায়েই নূতনভাবে সঞ্জীবিত হইতে পারে। গোঁড়া মতবাদ সব গোল্লায় যাউক—উহাদের দ্বারা কোন কাজই হয় না। একটি খাঁটি চরিত্র, একটি সত্যিকার জীবন, একটি শক্তির কেন্দ্র—একজন দেবমানবই পথ দেখাইবেন। এই কেন্দ্রেই বিভিন্ন উপাদান একত্র হইবে এবং প্রচণ্ড তরঙ্গের মত সমাজের উপর পতিত হইয়া সব কিছু ভাসাইয়া লইয়া যাইবে, সমস্ত অপবিত্রতা মুছিয়া দিবে। আবার দেখুন, একটি কাষ্ঠখণ্ডকে উহার আঁশের অনুকূলেই যেমন সহজে চিরিয়া ফেলা যায়, তেমনি হিন্দুধর্মের দ্বারাই প্রাচীন হিন্দুধর্মের সংস্কার করিতে হইবে, নব্য সংস্কার-আন্দোলন দ্বারা নহে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারকগণকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়দেশের সংস্কৃতিধারা নিজ জীবনে মিলিত করিতে হইবে। সেই মহা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র প্রত্যক্ষ করিতেছেন বলিয়া মনে হয় কি? ঐ তরঙ্গের আগমনসূচক মৃদু গম্ভীর ধ্বনি শুনিতে পাইতেছেন কি? সেই শক্তিকেন্দ্র—সেই পথপ্রদর্শক দেবমানব ভারতবর্ষেই জন্মিয়াছিলেন। তিনি সেই মহান্ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস এবং তাঁহাকেই কেন্দ্র করিয়া এই যুবকদল ধীরে ধীরে সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া উঠিতেছে। তাহারাই এ মহাব্রত উদ্যাপন করিবে।
এ কার্যের জন্য সঙ্ঘের প্রয়োজন এবং অন্ততঃ প্রথম দিকটায় সামান্য কিছু অর্থেরও প্রয়োজন। কিন্তু ভারতবর্ষে কে আমাদিগকে অর্থ দিবে? ... দেওয়ানজী সাহেব, আমি সেইজন্যই আমেরিকায় আসিয়াছি। আপনার স্মরণ থাকিতে পারে, আমি সমস্ত অর্থ দরিদ্রগণের নিকট হইতেই সংগ্রহ করিয়াছিলাম; ধনী-সম্প্রদায়ের দান আমি গ্রহণ করিতে পারি নাই, কারণ তাহারা আমার ভাব বুঝিতে পারে নাই। এ দেশে এক বৎসর ক্রমান্বয়ে বক্তৃতা দিয়াও আমি বিশেষ কিছু করিতে পারি নাই—অবশ্য আমার ব্যক্তিগত কোন অভাব নাই, কিন্তু আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যের জন্য অর্থসংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারি নাই। তাহার প্রথম কারণ, এবার আমেরিকায় বড় দুর্বৎসর চলিতেছে, হাজার হাজার গরীব বেকার। দ্বিতীয়তঃ মিশনরীরা এবং ‘—’ গণ আমার মতবাদ ধ্বংস করিতে চেষ্টা করিতেছে। তৃতীয়তঃ একটি বৎসর অতীত হইয়া গেল, কিন্তু আমার দেশের কেহ এই কথাটুকু আমেরিকাবাসিগণকে বলিতে পারিল না যে, আমি সত্যই সন্ন্যাসী, প্রতারক নই এবং আমি হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি। শুধু এই কয়টি কথামাত্র, তাহাও তাহারা বলিতে পারিল না! আমার দেশবাসিগণকে সেজন্য আমি ‘বাহবা’ দিতেছি। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও দেওয়ানজী সাহেব, আমি তাহাদিগকে ভালবাসি। মানুষের সাহায্য আমি অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করি। যিনি গিরিগুহায়, দুর্গম বনে ও মরুভূমিতে আমার সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন—আমার বিশ্বাস, তিনি আমার সঙ্গেই থাকিবেন। আর যদি তাহা না হয়, তবে আমা অপেক্ষা শক্তিমান্ কোন পুরুষ কোন দিন ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করিয়া এই মহৎ কার্য সম্পন্ন করিবেন। আজ সব কথাই আপনাকে খুলিয়া বলিলাম। হে মহাপ্রাণ বন্ধু, আমার দীর্ঘ পত্রের জন্য আমাকে মার্জনা করিবেন; যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন আমার প্রকৃত দরদী আর আমার প্রতি সদয়, আপনি তাঁহাদেরই একজন; আপনি আমার এই দীর্ঘ পত্রের জন্য ক্ষমা করিবেন। হে বন্ধু, আপনি আমাকে স্বপ্নবিলাসী কিম্বা কল্পনাপ্রিয় বলিয়া অবশ্য মনে করিতে পারেন, কিন্তু এইটুকু অন্ততঃ বিশ্বাস করিবেন যে, আমি সম্পূর্ণ অকপট; আর আমার চরিত্রের সর্বপ্রধান ত্রুটি এই যে, আমি আমার দেশকে ভালবাসি, বড় একান্তভাবেই ভালবাসি।
হে মহাপ্রাণ বন্ধুবর, ভগবানের আশীর্বাদ আপনার ও আপনার আত্মীয়স্বজনের উপর নিরন্তর বর্ষিত হউক, তাঁহার অঙ্গচ্ছায়া আপনার সকল প্রিয়জনকে আবৃত করিয়া রাখুক। আমার অনন্ত কৃতজ্ঞতা আপনি গ্রহণ করুন। আপনার নিকট আমার ঋণ অপরিসীম, কারণ আপনি শুধু বন্ধু নহেন, পরন্তু আজীবন ভগবান্ ও মাতৃভূমির সেবা সমভাবে করিয়া আসিতেছেন। ইতি
চিরকৃতজ্ঞ
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—আপনার নিকট একটু অনুগ্রহ ভিক্ষা করি। আমি নিউ ইয়র্কে ফিরিয়া যাইতেছি। এই [হেল] পরিবারটি আমায় সর্বদা আশ্রয় দিয়াছে এবং আমাকে নিজ সন্তানের ন্যায় স্নেহ করিয়াছে। আর আমাদের স্বদেশীয়দের ও নিজেদের পুরোহিতকুলের কুৎসা সত্ত্বেও, এবং আমি তাহাদের নিকট কোন প্রকার প্রমাণলিপি পরিচয়পত্র বা ঐরূপ কোন কিছু না লইয়া আসা সত্ত্বেও তাহারা পশ্চাৎপদ হয় নাই। আপনি যদি আগ্রা ও লাহোরে প্রস্তুত দুই-তিনখানি গালিচা আমায় পাঠাইয়া দিতে পারেন, তবে তাহাদিগকে সামান্য কিছু উপহার দিবার সাধ আছে। ইহারা ঘরের মেঝেতে ভারতীয় গালিচা পাতিয়া রাখিতে খুব ভালবাসে—ইহা একটা বিশেষ বিলাসের বস্তু। ... ইহাতে যদি অত্যধিক খরচ হয়, তবে আমি চাই না। আমি নিজে বেশ আছি। খাওয়া-দাওয়া ও বাড়ীভাড়া দেওয়ার মত এবং যখন খুশী ফিরিয়া যাওয়ার মত অর্থ আমার যথেষ্ট আছে।
আপনার
বি
৯৮*
(মহীশূরের মহারাজাকে লিখিত)
চিকাগো
২৩ জুন, ১৮৯৪
মহারাজ,
শ্রীনারায়ণ আপনার ও আপনার পরিবারবর্গের কল্যাণ করুন। আপনি অনুগ্রহপূর্বক সাহায্য করিয়াছিলেন বলিয়াই আমি এদেশে আসিতে সমর্থ হইয়াছি। তারপর আমাকে এ দেশে সকলে বিশেষরূপে জানিতে পারিয়াছে। আর এ দেশের অতিথিপরায়ণ ব্যক্তিগণ আমার সমুদয় অভাব পূরণ করিয়া দিয়াছেন। অনেক বিষয়ে এ এক আশ্চর্য দেশ ও এক অদ্ভুত জাতি! প্রথমতঃ জগতের মধ্যে কলকারখানার উন্নতিবিষয়ে এ জাতি সর্বশ্রেষ্ঠ। এ দেশের লোক নানাপ্রকার শক্তিকে যেমন কাজে লাগায়, অন্য কোথাও তদ্রূপ নহে—এখানে কেবল কল আর কল! আবার দেখুন, ইহাদের সংখ্যা সমুদয় জগতের লোকসংখ্যার বিশ ভাগের এক ভাগ হইবে, কিন্তু ইহারা জগতের ধনরাশির পুরা এক-ষষ্ঠাংশ অধিকার করিয়া বসিয়া আছে। ইহাদের ঐশ্বর্যবিলাসের সীমা নাই, আবার সব জিনিষই এখানে অতিশয় দুর্মূল্য। এখানে শ্রমিকের মজুরী জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক, তথাপি শ্রমজীবী ও মূলধনীদের মধ্যে নিত্য বিবাদ চলিয়াছে।
তারপর আমেরিকান মহিলাগণের অবস্থার প্রতি সহজেই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। পৃথিবীর আর কোথাও স্ত্রীলোকের এত অধিকার নাই। ক্রমশঃ তাহারা সব আপনাদের হাতে লইতেছে; আর আশ্চর্যের বিষয়, এখানে শিক্ষিতা মহিলার সংখ্যা শিক্ষিত পুরুষ অপেক্ষা অধিক। অবশ্য খুব উচ্চ প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিরা অধিকাংশই পুরুষ। এই পর্যন্ত ইহাদের ভাল দিক্ বলা গেল। এখন ইহাদের দোষের কথা বলি। প্রথমতঃ মিশনরিগণ ভারতবর্ষে তাঁহাদের দেশের লোকের ধর্মপ্রবণতা সম্বন্ধে যতই বাজে গল্প করুন না কেন, প্রকৃতপক্ষে এ দেশের ছয় কোটি ত্রিশ লক্ষ লোকের ভিতর জোর এক কোটি নব্বই লক্ষ লোকে একটু- আধটু ধর্ম করিয়া থাকে। অবশিষ্ট লোকে কেবল পানভোজন ও টাকা-রোজগার ছাড়া আর কিছুর জন্য মাথা ঘামায় না। পাশ্চাত্যেরা আমাদের জাতিভেদ সম্বন্ধে যতই তীব্র সমালোচনা করুন না কেন, তাঁহাদের আবার আমাদের অপেক্ষা জঘন্য জাতিভেদ আছে—অর্থগত জাতিভেদ। আমেরিকানরা বলে ‘সর্বশক্তিমান্ ডলার’ এখানে সব করিতে পারে। এদিকে আবার গরীবেরা নিঃস্ব। নিগ্রোদের (যাহাদের অধিকাংশ দক্ষিণ দিকে বাস করে) উপর ইহাদের ব্যবহার সম্বন্ধে বক্তব্য এই—উহা পৈশাচিক। সামান্য অপরাধে তাহাদিগকে বিনা বিচারে জীবিত অবস্থায় চামড়া ছাড়াইয়া মারিয়া ফেলে। এদেশে যতই আইন-কানুন, অন্য কোন দেশে এত নাই, আবার এদেশের লোকে আইনের যত কম মর্যাদা রাখিয়া চলে, তত আর কোন দেশেই নয়।
মোটের উপর আমাদের দরিদ্র হিন্দুরা এদের চেয়ে অনেক নীতিপরায়ণ। ইহাদের ধর্ম হয় ভণ্ডামি, না হয় গোঁড়ামি। পণ্ডিতেরা নাস্তিক, আর যাঁহারা একটু স্থিরবুদ্ধি ও চিন্তাশীল, তাঁহারা তাঁহাদের কুসংস্কার ও দুর্নীতিপূর্ণ ধর্মের উপর একেবারে বিরক্ত, তাঁহারা নূতন আলোকের জন্য ভারতের দিকে তাকাইয়া আছেন। মহারাজ, আপনি না দেখিলে বুঝিতে পারিবেন না, ইহারা পবিত্র বেদের গভীর চিন্তারাশির অতি সামান্য অংশও কত আগ্রহের সহিত গ্রহণ করিয়া থাকে, কারণ আধুনিক বিজ্ঞান ধর্মের উপর যে পুনঃ পুনঃ তীব্র আক্রমণ করিতেছে, বেদই কেবল উহাকে বাধা দিতে পারে এবং ধর্মের সহিত বিজ্ঞানের সামঞ্জস্য বিধান করিতে পারে। ইহাদের—শূন্য হইতে সৃষ্টি, সৃষ্ট আত্মা, স্বর্গনামক স্থানে সিংহাসনে উপবিষ্ট অত্যাচারী ঈশ্বর, অনন্ত নরকাগ্নি প্রভৃতি মতবাদে সকল শিক্ষিত ব্যক্তিই বিরক্ত হইয়াছেন; আর সৃষ্টির অনাদিত্ব এবং আত্মার নিত্যত্ব ও আত্মায় পরমাত্মার স্থিতি সম্বন্ধে বেদের গভীর উপদেশসকল কোন-না-কোন আকারে ইঁহারা অতি দ্রুত গ্রহণ করিতেছেন। পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে জগতের সমুদয় শিক্ষিত ব্যক্তিই আমাদের পবিত্র বেদের শিক্ষানুযায়ী আত্মা ও সৃষ্টি—উভয়েরই অনাদিত্বে বিশ্বাসবান্ হইবেন, আর ঈশ্বরকে আমাদেরই সর্বোচ্চ পূর্ণ অবস্থা বলিয়া বুঝিবেন। এখন হইতেই ইহাদের সকল বিদ্বান্ পুরোহিতই এইভাবে বাইবেলের ব্যাখ্যা করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। ভারতবর্ষে যে সকল মিশনরী দেখিতে পান, তাহারা কোনরূপেই খ্রীষ্টধর্মের প্রতিনিধি নহে। আমার সিদ্ধান্ত এই—পাশ্চাত্যগণের আরও ধর্মশিক্ষার প্রয়োজন, আর আমাদের আরও ঐহিক উন্নতির প্রয়োজন।
ভারতের সমুদয় দুর্দশার মূল—জনসাধারণের দারিদ্র্য। পাশ্চাত্যদেশের দরিদ্রগণ পিশাচপ্রকৃতি, তুলনায় আমাদের দরিদ্রগণ দেবপ্রকৃতি। সুতরাং আমাদের পক্ষে দরিদ্রের অবস্থার উন্নতিসাধন অপেক্ষাকৃত সহজ। আমাদের নিম্নশ্রেণীর জন্য কর্তব্য এই, কেবল তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া এবং তাহাদের বিনষ্টপ্রায় ব্যক্তিত্ববোধ জাগাইয়া তোলা। আমাদের জনগণ ও রাজন্যগণের সম্মুখে এই এক বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র পড়িয়া রহিয়াছে। এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই চেষ্টা করা হয় নাই। পুরোহিতশক্তি ও পরাধীনতা তাহাদিগকে শত শত শতাব্দী ধরিয়া নিষ্পেষিত করিয়াছে, অবশেষে তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে যে তাহারাও মানুষ। তাহাদিগকে ভাল ভাল ভাব দিতে হইবে। তাহাদের চক্ষু খুলিয়া দিতে হইবে, যাহাতে তাহারা জানিতে পারে—জগতে কোথায় কি হইতেছে। তাহা হইলে তাহারা নিজেদের উদ্ধার নিজেরাই সাধন করিবে। প্রত্যেক জাতি, প্রত্যেক নরনারী নিজের উদ্ধার নিজেই সাধন করিয়া থাকে। তাহাদের এইটুকু সাহায্য করিতে হইবে—তাহাদিগকে কতকগুলি উচ্চ ভাব দিতে হইবে। অবশিষ্ট যাহা কিছু, তাহা উহার ফলস্বরূপ আপনিই আসিবে। আমাদের কর্তব্য কেবল রাসায়নিক উপাদানগুলিকে একত্র করা—অতঃপর প্রাকৃতিক নিয়মেই উহা দানা বাঁধিবে। সুতরাং আমাদের কর্তব্য—কেবল তাহাদের মাথায় কতকগুলি ভাব প্রবিষ্ট করাইয়া দেওয়া, বাকী যাহা কিছু তাহারা নিজেরাই করিয়া লইবে।
ভারতে এই কাজটি করা বিশেষ দরকার। এই চিন্তা অনেক দিন হইতে আমার মনে রহিয়াছে। ভারতে ইহা কার্যে পরিণত করিতে পারি নাই, সেইজন্য এদেশে আসিয়াছি। দরিদ্রদিগকে শিক্ষাদানের প্রধান বাধা এইঃ মনে করুন, মহারাজ, গ্রামে গ্রামে গরীবদের জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন, তথাপি তাহাতে কোন উপকার হইবে না, কারণ ভারতে দারিদ্র্য এত অধিক যে, দরিদ্র বালকেরা বিদ্যালয়ে না গিয়া বরং মাঠে গিয়া পিতাকে তাহার কৃষি-কার্যে সহায়তা করিবে, অথবা অন্য কোনরূপে জীবিকা-অর্জনের চেষ্টা করিবে; সুতরাং যেমন পর্বত মহম্মদের নিকট না যাওয়াতে মহম্মদই পর্বতের নিকট গিয়াছিলেন, সেইরূপ দরিদ্র বালক যদি শিক্ষালয়ে আসিতে না পারে, তবে তাহাদের নিকট শিক্ষা পৌঁছাইয়া দিতে হইবে।
আমাদের দেশে সহস্র দৃঢ়চিত্ত নিঃস্বার্থ সন্ন্যাসী আছেন, তাঁহারা এখন গ্রামে গ্রামে যাইয়া লোককে ধর্ম শিখাইতেছেন। যদি তাঁহাদের মধ্যে কতকগুলিকে সাংসারিক প্রয়োজনীয় বিদ্যাসমূহের শিক্ষকরূপে সংগঠন করা যায়, তবে তাঁহারা এখন যেমন এক স্থান হইতে অপর স্থানে, লোকের দ্বারে দ্বারে গিয়া ধর্মশিক্ষা দিয়া বেড়াইতেছেন, তাহার সঙ্গে সঙ্গে লৌকিক বিদ্যাও শিখাইবেন। মনে করুন, এইরূপ দুইজন লোক একখানি ক্যামেরা, একটি গোলক ও কতকগুলি ম্যাপ প্রভৃতি লইয়া কোন গ্রামে গেলেন। এই ক্যামেরা ম্যাপ প্রভৃতির সাহায্যে তাঁহারা অজ্ঞ লোকদিগকে জ্যোতিষ ও ভূগোলের অনেক তত্ত্ব শিখাইতে পারেন! তারপর যদি বিভিন্ন জাতির—জগতের প্রত্যেক দেশের লোকের বিবরণ গল্পচ্ছলে তাঁহাদের নিকট বলা যায়, তবে সমস্ত জীবন বই পড়িয়া তাহারা যাহা না শিখিতে পারে, তদপেক্ষা শতগুণে অধিক এইভাবে মুখে মুখে শিখিতে পারে। ইহা করিতে হইলে একটি সঙ্ঘ গঠনের আবশ্যক হয়, তাহাতে আবার টাকার দরকার। ভারতে এইজন্য কাজ করিবার যথেষ্ট লোক আছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় টাকা নাই। একটি চাকা গতিশীল করিতে প্রথমে অনেক কষ্ট; একবার ঘুরিতে আরম্ভ করিলে উহা উত্তরোত্তর অধিকতর বেগে ঘুরিতে থাকে। আমি আমার স্বদেশে এই বিষয়ের জন্য যথেষ্ট সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছি; কিন্তু ধনিগণের নিকট আমি এ সম্বন্ধে কিছুমাত্র সহানুভূতি পাই নাই। মহামান্য মহারাজের সাহায্যে আমি এখানে আসিয়াছি। ভারতের দরিদ্রেরা মরুক বাঁচুক, আমেরিকানদের সে বিষয়ে খেয়াল নাই। আর আমাদের দেশের লোকেই যখন নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু ভাবে না, তখন ইহারাই বা ভাবিবে কেন?
হে মহামনা রাজন্! এই জীবন ক্ষণভঙ্গুর, জগতের ধন মান ঐশ্বর্য—সকলই ক্ষণস্থায়ী। তাহারাই যথার্থ জীবিত, যাহারা অপরের জন্য জীবনধারণ করে। অবশিষ্ট ব্যক্তিগণ বাঁচিয়া নাই, মরিয়া আছে। মহারাজের ন্যায় মহামনা একজন রাজবংশধর ইচ্ছা করিলে ভারতকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করাইয়া দিতে পারেন, তাহাতে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ শ্রদ্ধার সহিত আপনার নাম স্মরণ করিবে। ঈশ্বর করুন, যেন আপনার মহৎ অন্তঃকরণ অজ্ঞতায় নিমগ্ন লক্ষ লক্ষ আর্ত ভারতবাসীর জন্য গভীরভাবে অনুভব করে। ইহাই প্রার্থনা—
বিবেকানন্দ
৯৯*
[রাও বাহাদুর নরসিংহাচারিয়াকে লিখিত]
চিকাগো
২৩ জুন, ১৮৯৪
প্রিয় মহাশয়,
আপনি আমাকে বরাবর যে অনুগ্রহ করিয়া থাকেন, তাহাতেই আমি আপনার নিকট একটি বিশেষ অনুরোধ করিতে সাহসী হইতেছি। মিসেস পটার পামার যুক্তরাজ্যের প্রধানা মহিলা। তিনি মহামেলার মহিলানেত্রী ছিলেন। সমগ্র জগতের স্ত্রীলোকদের অবস্থার যাহাতে উন্নতি হয়, সে বিষয়ে তিনি বিশেষ উৎসাহী, মেয়েদের একটি বিরাট প্রতিষ্ঠানের পরিচালিকা। তিনি লেডি ডফরিনের বিশেষ বন্ধু এবং তাঁহার ধন ও পদমর্যাদাগুণে ইওরোপীয় রাজপরিবারসমূহের নিকট হইতে অনেক অভ্যর্থনা পাইয়াছেন। এ দেশে তিনি আমার প্রতি বিশেষ সদয় ব্যবহার করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি চীন, জাপান, শ্যাম ও ভারত সফরে বাহির হইতেছেন। অবশ্য ভারতের শাসনকর্তারা এবং বড় বড় লোকেরা তাঁহার আদর অভ্যর্থনা করিবেন। কিন্তু ইংরেজ রাজকর্মচারীদের সাহায্য ছাড়াই আমাদের সমাজ দেখিবার জন্য তিনি বিশেষ উৎসুক। আমি অনেক সময় তাঁহাকে ভারতীয় নারীদের অবস্থা উন্নত করিবার জন্য আপনার মহতী চেষ্টার এবং মহীশূরে আপনার চমৎকার কলেজটির কথা বলিয়াছি। আমার মনে হয়, আমাদের দেশের লোক আমেরিকায় আসিলে ইঁহারা যেরূপ সহৃদয় ব্যবহার করেন, তাহার প্রতিদানস্বরূপ এইরূপ ব্যক্তিদিগকে একটু আতিথেয়তা দেখানো কর্তব্য। আমি আশা করি, আপনারা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা করিবেন ও আমাদের স্ত্রীলোকদের যথার্থ অবস্থা একটু দেখাইতে সাহায্য করিবেন। তিনি মিশনরী বা গোঁড়া খ্রীষ্টান নহেন—আপনি সে ভয় করিবেন না। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে তিনি সমগ্র জগতের স্ত্রীলোকদের অবস্থার উন্নতির চেষ্টাই করিতে চান। তাঁহার উদ্দেশ্যসাধনে এইরূপে সহায়তা করিলে এদেশে আমাকেও অনেকটা সাহায্য করা হইবে। প্রভু আপনাকে আশীর্বাদ করুন।
ভবদীয় চিরস্নেহাস্পদ
বিবেকানন্দ
১০০*
[মিস মেরী ও হ্যারিয়েট হেলকে লিখিত]
চিকাগো
২৬ জুন, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনীগণ,
শ্রেষ্ঠ হিন্দী কবি তুলসীদাস তাঁর রামায়ণের মঙ্গলাচরণে বলেছেন, ‘আমি সাধু অসাধু উভয়েরই চরণ বন্দনা করি; কিন্তু হায়, উভয়েই আমার নিকট সমভাবে দুঃখপ্রদ—অসাধু ব্যক্তি আমার নিকট আসা মাত্র আমাকে যাতনা দিতে থাকে, আর সাধু ব্যক্তি ছেড়ে যাবার সময় আমার প্রাণ হরণ করে নিয়ে যান।’৫৩
আমি বলি ‘তথাস্তু’। আমার কাছে—ভগবানের প্রিয় সাধু ভক্তগণকে ভালবাসা ছাড়া সুখের ও ভালবাসার জিনিষ আর কিছুই নাই; আমার পক্ষে তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ মৃত্যুতুল্য। কিন্তু এ সব অনিবার্য। হে আমার প্রিয়তমের বংশীধ্বনি! তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে চল, আমি অনুগমন করছি। হে মহৎস্বভাবা মধুরপ্রকৃতি সহৃদয়া পবিত্রস্বভাবগণ! হায়, আমি যদি ষ্টোয়িক (Stoic) দার্শনিকগণের মত সুখদুঃখে নির্বিকার হতে পারতাম!
আশা করি তোমরা সুন্দর গ্রাম্য দৃশ্য বেশ উপভোগ করছ।
‘যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ॥’—গীতা
... সমস্ত প্রাণীর পক্ষে যা রাত্রি, সংযমী তাতে জাগ্রত থাকেন; আর প্রাণিগণ যাতে জাগ্রত থাকে, আত্মজ্ঞানী মুনির পক্ষে তা রাত্রিস্বরূপ।
এই জগতের ধূলি পর্যন্ত যেন তোমাদের স্পর্শ করতে না পারে; কারণ, কবিরা বলে থাকেন, জগৎটা হচ্ছে একটা পুষ্পাচ্ছাদিত শব মাত্র। তাকে স্পর্শ কর না। তোমরা হোমা পাখীর বাচ্চা—এই মলিনতার পঙ্কিল পল্বলস্বরূপ জগৎ স্পর্শ করবার পূর্বেই তোমরা আকাশের দিকে আবার উড়ে যাও।
‘যে আছ চেতন ঘুমায়ো না আর!’
‘জগতের লোকের ভালবাসার অনেক বস্তু আছে—তারা সেগুলি ভালবাসুক; আমাদের প্রেমাস্পদ একজন মাত্র—সেই প্রভু। জগতের লোক যাই বলুক না, আমরা সে সব গ্রাহ্যের মধ্যেই আনি না। তবে যখন তারা আমাদের প্রেমাস্পদের ছবি আঁকতে যায় ও তাঁকে নানারূপ কিম্ভূতকিমাকার বিশেষণে বিশেষিত করে, তখনই আমাদের ভয় হয়। তাদের যা খুশী তাই করুক, আমাদের নিকট তিনি কেবল প্রেমাস্পদ মাত্র—তিনি আমার প্রিয়তম—প্রিয়তম—প্রিয়তম, আর কিছুই নন।’
‘তাঁর কত শক্তি, কত গুণ আছে—এমন কি আমাদের কল্যাণ করবারও কত শক্তি আছে, তাই বা কে জানতে চায়? আমরা চিরদিনের জন্য বলে রাখছি আমরা কিছু পাবার জন্য ভালবাসি না। আমরা প্রেমের দোকানদার নই, আমরা কিছু প্রতিদান চাই না, আমরা কেবল দিতে চাই।’
‘হে দার্শনিক! তুমি আমায় তাঁর স্বরূপের কথা বলতে আসছ, তাঁর ঐশ্বর্যের কথা—তাঁর গুণের কথা বলতে আসছ? মূর্খ, তুমি জান না, তাঁর অধরের একটি মাত্র চুম্বনের জন্য আমাদের প্রাণ বের হবার উপক্রম হচ্ছে। তোমার ও-সব বাজে জিনিষ পুঁটলি বেঁধে তোমার বাড়ী নিয়ে যাও—আমাকে আমার প্রিয়তমের একটি চুম্বন পাঠিয়ে দাও—পার কি?’
‘মূর্খ, তুমি কার সামনে নতজানু হয়ে ভয়ে প্রার্থনা করছ? আমি আমার গলার হার নিয়ে বকলসের মত তাঁর গলায় পরিয়ে দিয়ে তাতে একগাছি সুতো বেঁধে তাঁকে আমার সঙ্গে সঙ্গে টেনে নিয়ে যাচ্ছি—ভয়, পাছে এক মুহূর্তের জন্য তিনি আমার নিকট থেকে পালিয়ে যান। ঐ হার—প্রেমের হার, ঐ সূত্র—প্রেমের জমাটবাঁধা ভাবের সূত্র। মূর্খ, তুমি তো সূক্ষ্ম তত্ত্ব বোঝ না যে, যিনি অসীম অনন্তস্বরূপ, তিনি প্রেমের বাঁধনে পড়ে আমার মুঠোর মধ্যে ধরা পড়েছেন। তুমি কি জান না যে, সেই জগন্নাথ প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়েন—তুমি কি জান না যে, যিনি এত বড় জগৎটাকে চালাচ্ছেন, তিনি বৃন্দাবনের গোপীদের নূপুর-ধ্বনির তালে তালে নাচতেন?’
এই যে পাগলের মত যা-তা লিখলাম, তার জন্য আমায় ক্ষমা করবে। অব্যক্তকে ব্যক্ত করবার ব্যর্থপ্রয়াসরূপ আমার এই ধৃষ্টতা মার্জনা করবে—এ কেবল প্রাণে প্রাণে অনুভব করবার জিনিষ। সদা আমার আশীর্বাদ জানবে।
তোমাদের ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১০১*
[জনৈক মান্দ্রাজী শিষ্যকে লিখিত]
৫৪১, ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো
২৮ জুন, ১৮৯৪
প্রিয়—,
সেদিন মহীশূর থেকে জি. জি—র এক পত্র পেলাম। দুঃখের বিষয় জি. জি আমাকে সর্বজ্ঞ মনে করে; তা না হলে সে চিঠির মাথায় তার অদ্ভুত কানাড়া ঠিকানাটা আর একটু পরিষ্কার করে লিখত। তারপর—চিকাগো ছাড়া অন্য কোন জায়গায় আমাকে চিঠি পাঠানো বড্ড ভুল। অবশ্য গোড়ায় আমারই ভুল হয়েছিল—আমারই ভাবা উচিত ছিল, আমার বন্ধুদের সূক্ষ্ম বুদ্ধির কথা—তাঁরা তো আমার চিঠির মাথায় একটা ঠিকানা দেখলেই যেখানে খুশী আমার নামে চিঠি পাঠাচ্ছেন। আমাদের মান্দ্রাজ-বৃহস্পতিদের বল, তারা তো বেশ ভাল করেই জানত যে, তাদের চিঠি পৌঁছবার পূর্বেই হয়তো আমি সেখান থেকে এক হাজার মাইল দূরে চলে গেছি, কারণ আমি ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছি। চিকাগোয় আমার একজন বন্ধু আছেন, তাঁর বাড়ী হচ্ছে আমার প্রধান আড্ডা। এখানে আমার কাজের প্রসারের আশা প্রায় শূন্য বললেই হয়। কারণ—যদিও প্রসারের খুব সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু নিম্নোক্ত কারণে সে আশা একেবারে নির্মূল হয়েছেঃ
ভারতের খবর আমি যা কিছু পাচ্ছি, তা মান্দ্রাজের চিঠি থেকে। তোমাদের পত্রে ক্রমাগত শুনছি, ভারতে আমাকে সকলে খুব সুখ্যাতি করছে, কিন্তু সে তো—তুমি জেনেছ আর আমি জানছি, কারণ আলাসিঙ্গার প্রেরিত একটা তিন বর্গ-ইঞ্চি কাগজের টুকরো ছাড়া আমি একখানা ভারতীয় খবরের কাগজে আমার সম্বন্ধে কিছু বেরিয়েছে, তা দেখিনি। অন্যদিকে ভারতের খ্রীষ্টানরা যা কিছু বলছে, মিশনরীরা তা খুব সযত্নে সংগ্রহ করে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করছে এবং বাড়ী বাড়ী গিয়ে আমার বন্ধুরা যাতে আমায় ত্যাগ করেন, তার চেষ্টা করছে। তাদের উদ্দেশ্য খুব ভালরকমেই সিদ্ধ হয়েছে, যেহেতু ভারত থেকে কেউ একটা কথাও আমার জন্য বলছে না। ভারতের হিন্দু পত্রিকাগুলো আমাকে আকাশে তুলে দিয়ে প্রশংসা করতে পারে, কিন্তু তার একটা কথাও আমেরিকায় পৌঁছয়নি। তার জন্য এদেশের অনেকে মনে করছে, আমি একটা জুয়াচোর। একে তো মিশনরীরা আমার পিছু লেগেছে, তার উপর এখানকার হিন্দুরা হিংসা করে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে; এক্ষেত্রে আমার একটা কথাও জবাব দেবার নেই। এখন মনে হচ্ছে, কেবল মান্দ্রাজের কতকগুলি ছোকরার পীড়াপীড়ির জন্য ধর্মমহাসভায় যাওয়া আমার আহাম্মকি হয়েছিল, কারণ তারা তো ছোকরা বৈ আর কিছুই নয়। অবশ্য আমি অনন্ত কালের জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ, কিন্তু তারা তো গুটিকতক উৎসাহী যুবক ছাড়া আর কিছু নয়—কাজের ক্ষমতা তাদের যে একদম নেই। আমি কোন নিদর্শনপত্র নিয়ে আসিনি, আর যখন কারও অর্থসাহায্যের আবশ্যক হয়, তার নিদর্শনপত্র থাকা দরকার, তা না হলে মিশনরী ও ব্রাহ্মসমাজের বিরুদ্ধাচরণের সামনে—আমি যে জুয়াচোর নই, তা কি করে প্রমাণ করব? মনে করেছিলাম, গোটাকতক বাক্য ব্যয় করা ভারতের পক্ষে বিশেষ কঠিন কাজ হবে না। মনে করেছিলাম, মান্দ্রাজে ও কলিকাতায় কয়েকজন ভদ্রলোক জড়ো করে এক-একটা সভা করে আমাকে এবং আমেরিকাবাসিগণকে আমার প্রতি সহৃদয় ব্যবহার করবার জন্য ধন্যবাদ সহ প্রস্তাব পাস করিয়ে, সেই প্রস্তাবটা দস্তুরমত নিয়মানুযায়ী অর্থাৎ সেই সভার সেক্রেটারীকে দিয়ে, আমেরিকায় ডাঃ ব্যারোজের কাছে পাঠিয়ে তাঁকে তথাকার বিভিন্ন কাগজে ছাপাতে অনুরোধ করা। ঐরূপ বষ্টন, নিউ ইয়র্ক ও চিকাগোর বিভিন্ন কাগজে পাঠানো বিশেষ কঠিন কাজ হবে না। এখন দেখছি, ভারতের পক্ষে এই কাজটা বড়ই গুরুতর ও কঠিন, এক বছরের ভেতর ভারত থেকে কেউ আমার জন্য একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত করলে না, আর এখানে সকলেই আমার বিপক্ষে। তোমরা নিজেদের ঘরে বসে আমার সম্বন্ধে যা খুশী বল না কেন, এখানে তার কে কি জানে? দু-মাসেরও উপর হল আলাসিঙ্গাকে আমি এ বিষয়ে লিখেছিলাম, কিন্তু সে আমার পত্রের জবাব পর্যন্ত দিলে না। আমার আশঙ্কা হয়, তার উৎসাহ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সুতরাং তোমায় বলছি, আগে এ বিষয়টি বিবেচনা করে দেখ, তারপর মান্দ্রাজীদের এই চিঠি দেখিও। এদিকে আমার গুরুভাইরা ছেলেমানুষের মত কেশব সেন সম্বন্ধে অনেক বাজে কথা বলছে, আর মান্দ্রাজীরা থিওসফিষ্টদের সম্বন্ধে আমি চিঠিতে যা কিছু লিখছি, তাই তাদের বলছে—এতে শুধু শত্রুর সৃষ্টি করা হচ্ছে। হায়! যদি ভারতে একটা মাথাওয়ালা কাজের লোক আমার সহায়তা করবার জন্য পেতাম! কিন্তু তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হবে, আমি এদেশে জুয়াচোর বলে গণ্য হলাম। আমারই আহাম্মকি হয়েছিল, কোন নিদর্শনপত্র না নিয়ে ধর্মমহাসভায় যাওয়া—আশা করেছিলাম, অনেক জুটে যাবে। এখন দেখছি, আমাকে একলা ধীরে ধীরে কাজ করতে হবে। মোটের ওপর, আমেরিকানরা হিন্দুদের চেয়ে লাখোগুণ ভাল, আর আমি অকৃতজ্ঞ ও হৃদয়হীনদের দেশ অপেক্ষা এখানে অনেক ভাল কাজ করতে পারি। যাই হোক, আমাকে কর্ম করে আমার প্রারব্ধ ক্ষয় করতে হবে। আমার আর্থিক অবস্থার কথা যদি বলতে হয়, তবে বলি, আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছলই আছে এবং সচ্ছলই থাকবে। সমগ্র আমেরিকায় বিগত আদমসুমারিতে থিওসফিষ্টদের সংখ্যা সর্বসুদ্ধ মাত্র ৬২৫ জন—তাদের সঙ্গে মিশলে আমার সাহায্য হওয়া দূরে থাক, মুহূর্তের মধ্যে আমার কাজ চুরমার হয়ে যাবে। আলাসিঙ্গা বলছে, লণ্ডনে গিয়ে মিঃ ওল্ডের সঙ্গে দেখা করতে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ও কি বাজে আহাম্মকের মত বকছে! বালক—ওরা কি বলছে, তা নিজেরাই বোঝে না। আর এই মান্দ্রাজী খোকার দল—নিজেদের ভেতর একটা বিষয়ও গোপন রাখতে পারে না!! সারাদিন বাজে বকা আর যেই কাজের সময় এল, অমনি আর কারও পাত্তা পাবার যো নেই!!! বোকারামেরা পঞ্চাশটা লোক জড়ো করে, কয়েকটা সভা করে আমার সাহায্যের জন্য গোটাকতক ফাঁকা কথা পাঠাতে পারলে না—তারা আবার সমগ্র জগৎকে শিক্ষা দেব বলে লম্বা কথা কয়!
আমি তোমাকে ফনোগ্রাফ সম্বন্ধে লিখেছি। এখানে এক রকম বৈদ্যুতিক পাখা আছে—দাম বিশ ডলার—বড় সুন্দর চলে। এই ব্যাটারিতে ১০০ ঘণ্টা কাজ হয়, তারপর যে-কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্র থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে নিলেই হল।
বিদায়, হিন্দুদের যথেষ্ট দেখা গেল। এখন তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক—যা আসুক অবনত মস্তকে স্বীকার করছি। যাই হোক, আমাকে অকৃতজ্ঞ ভেবো না, মান্দ্রাজীরা আমার জন্য যতটা করেছে, আমি ততটা পাবারও উপযুক্ত ছিলাম না; আর তাদের ক্ষমতায় যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশী তারা করেছে। আমারই আহাম্মকি হয়েছিল—ক্ষণকালের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমরা হিন্দুরা এখনও মানুষ হয়নি—ক্ষণকালের জন্য আত্মনির্ভরতা হারিয়ে হিন্দুদের উপর নির্ভর করেছিলাম—তাতেই এই কষ্ট পেলাম। প্রতি মুহূর্তে আমি আশা করেছিলাম, ভারত থেকে কিছু আসবে, কিন্তু কিছুই এল না। বিশেষতঃ গত দুমাস প্রতি মুহূর্তে আমার উদ্বেগ ও যন্ত্রণার সীমা ছিল না—ভারত থেকে একখানা খবরের কাগজ পর্যন্ত এল না!! আমার বন্ধুরা মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে লাগল, কিছুই এল না—একটা আওয়াজ পর্যন্ত এল না; কাজেই অনেকের উৎসাহ চলে গেল, অনেকে আমায় ত্যাগ করলে। কিন্তু এ আমার মানুষের উপর—পশুধর্মী মানুষের উপর নির্ভর করার শাস্তি, আমার স্বদেশবাসীরা এখনও মানুষ হয়নি। তারা নিজেদের প্রশংসাবাদ শুনতে খুব প্রস্তুত আছে, কিন্তু তাদের একটা কথামাত্র কয়ে সাহায্য করবার যখন সময় আসে, তখন তাদের আর টিকি দেখতে পাবার যো নাই। মান্দ্রাজী যুবকগণকে আমার অনন্তকালের জন্য ধন্যবাদ—প্রভু তাদের সদাসর্বদা আশীর্বাদ করুন। কোন ভাব প্রচার করবার পক্ষে আমেরিকাই জগতের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ক্ষেত্র—তাই আমি শীঘ্র আমেরিকা ত্যাগ করবার কল্পনা করছি না। কেন? এখানে খেতে পরতে পাচ্ছি, অনেকে সহৃদয় ব্যবহার করছেন, আর দু-দশটা ভাল কথা বলেই এই সব পাচ্ছি! এমন উন্নতমনা জাতকে ছেড়ে পশুপ্রকৃতি, অকৃতজ্ঞ, মস্তিষ্কহীন অনন্ত যুগের কুসংস্কারে বদ্ধ, দয়াহীন, মমতাহীন হতভাগাদের দেশে কি করতে যাব? অতএব আবার বলি—বিদায়। এই পত্রখানি একটু বিবেচনা করে লোককে দেখাতে পার। মান্দ্রাজীরা, এমন কি আলাসিঙ্গা পর্যন্ত, যার ওপর আমি এতটা আশা করেছিলাম—বড় সুবিবেচনার কাজ করেছে বলে মনে হয় না। ভাল কথা, তুমি মজুমদারের লেখা ‘রামকৃষ্ণ পরমহংসের সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত’৫৪ খানকতক চিকাগোয় পাঠাতে পার? কলিকাতায় অনেক আছে। আমার ঠিকানা ৫৪১ নং ডিয়ারবর্ন এভিনিউ (ষ্ট্রীট নহে), চিকাগো, অথবা C/o টমাস কুক, চিকাগো, ভুলো না যেন। অন্য কোন ঠিকানা দিলে অনেক দেরী ও গোলমাল হবে, কারণ আমি এখন ক্রমাগত ঘুরছি আর চিকাগোই আমার প্রধান আড্ডা; কিন্তু এই বুদ্ধিটুকুও আমার মান্দ্রাজী বন্ধুদের মাথায় ঢোকেনি। অনুগ্রহপূর্বক জি. জি., আলাসিঙ্গা, সেক্রেটারী ও আর আর সকলকে আমার অনন্তকালের জন্য আশীর্বাদ জানাবে—আমি সর্বদা তাদের কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আমি তাদের উপর কিছুমাত্র অসন্তুষ্ট হইনি—আমি নিজেরই প্রতি অসন্তুষ্ট। আমি জীবনে এই একবার অপরের সাহায্যে নির্ভর করা-রূপ ভয়ানক ভুল করেছি; আর তার শাস্তিভোগও করেছি। এ আমারই দোষ, তাদের কিছু দোষ নেই। প্রভু মান্দ্রাজীদের আশীর্বাদ করুন—তাদের হৃদয়টা বাঙালীদের চেয়ে অনেক উন্নত। বাঙালীরা কেবল বাক্যসার—তাদের হৃদয় নেই, তারা অসার। বিদায়, বিদায়, আমি এখন সমুদ্রবক্ষে আমার তরণী ভাসিয়েছি—যা হবার হোক। কঠোর সমালোচনার জন্য আমাকে ক্ষমা কর। বাস্তবিক তো আমার কোন দাবী-দাওয়া নেই। আমার যতটা পাবার অধিকার, তোমরা তার চেয়ে অনন্তগুণ আমার জন্য করেছ। আমার যেরূপ কর্ম, আমি তেমনই ফল পাব, আর যা ঘটুক আমাকে চুপটি করে মুখ বুজে সয়ে যেতে হবে। প্রভু তোমাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন। ইতি
বিবেকানন্দ
পুঃ—আমার বোধ হয় আলাসিঙ্গার কলেজ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু আমি তার কোন খবর পাইনি, আর সে আমাকে তার বাড়ীর ঠিকানাও দেয়নি।
ইতি বি
আমার আশঙ্কা হচ্ছে, কিডি সরে পড়েছে।
১০২
[মঠের সকল গুরুভ্রাতাকে লক্ষ্য করিয়া স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
১৮৯৪ [গ্রীষ্মকাল]
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমাদের পত্র পাইয়া সকল সমাচার জ্ঞাত হইলাম। বলরামবাবুর স্ত্রীর শোকসংবাদে দুঃখিত হইলাম। প্রভুর ইচ্ছা। এ কার্যক্ষেত্র—ভোগক্ষেত্র নহে, সকলেই কাজ ফুরুলে ঘরে ফিরবে—কেউ আগে কেউ পাছে। ফকির গেছে, প্রভুর ইচ্ছা।
মহোৎসব বড়ই ধুমধামে হয়েছে, বেশ কথা, তাঁর নাম যতই ছড়ায় ততই ভাল। তবে একটি কথা—মহাপুরুষেরা বিশেষ শিক্ষা দিতে আসেন, নামের জন্যে নহে, কিন্তু চেলারা তাঁদের উপদেশ বানের জলে ভাসাইয়া নামের জন্য মারামারি করে—এই তো পৃথিবীর ইতিহাস। তাঁর নাম লোকে নেয় বা না নেয়, আমি কোন খাতিরে আনি না, তবে তাঁর উপদেশ জীবন শিক্ষা যাতে জগতে ছড়ায়, তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে প্রস্তুত। আমার মহাভয় শশীর ঐ ঠাকুরঘর। ঠাকুরঘর মন্দ নয়, তবে ঐটি all in all (সর্বস্ব) করে সেই পুরানো ফ্যাশনের nonsense (বাজে ব্যাপার) করে ফেলবার একটা tendency (ঝোঁক) শশীর ভিতর আছে, আমার তাই ভয়। আমি জানি শশী ও নিরঞ্জন কেন ঐ পুরানো ছেঁড়া ceremonial (অনুষ্ঠানপদ্ধতি) নিয়ে ব্যস্ত। ওদের spirit (অন্তরাত্মা) চায় work (কাজ), কোন outlet (বাহির হবার পথ) নেই, তাই ঘণ্টা নেড়ে energy (শক্তি) খরচ করে।
শশী, তোকে একটা নূতন মতলব দিচ্ছি। যদি কার্যে পরিণত করিতে পারিস তবে জানব তোরা মরদ, আর কাজে আসবি। হরমোহন, ভবনাথ, কালীকৃষ্ণ বাবু, তারক-দা প্রভৃতি সকলে মিলে একটা যুক্তি কর। গোটাকতক ক্যামেরা, কতকগুলো ম্যাপ, গ্লোব, কিছু chemicals (রাসায়নিক দ্রব্য) ইত্যাদি চাই। তারপর একটা মস্ত কুঁড়ে চাই। তারপর কতকগুলো গরীব-গুরবো জুটিয়ে আনা চাই। তারপর তাদের Astronomy, Geography (জ্যোতিষ, ভূগোল) প্রভৃতির ছবি দেখাও আর ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ উপদেশ কর—কোন্ দেশে কি হয়, কি হচ্ছে, এ দুনিয়াটা কি, তাদের যাতে চোখ খুলে, তাই চেষ্টা কর—সন্ধ্যার পর, দিন-দুপুরে—কত গরীব মূর্খ বরানগরে আছে, তাদের ঘরে ঘরে যাও—চোখ খুলে দাও। পুঁথি-পাতড়ার কর্ম নয়—মুখে মুখে শিক্ষা দাও। তারপর ধীরে ধীরে centre extend (কেন্দ্রের প্রসার) কর—পার কি? না, শুধু ঘণ্টা নাড়া?
তারক-দার কথা মান্দ্রাজ হইতে সকল পাইয়াছি। তারা তাঁর উপর বড়ই প্রীত। তারক-দা, তুমি যদি কিছুদিন মান্দ্রাজে গিয়ে থাক, তাহলে অনেক কাজ হয়। কিন্তু প্রথমে এই কাজটা বরানগরে শুরু করে যাও। যোগীন-মা, গোলাপ-মা কতকগুলি বিধবা চেলা বানাতে পারে না কি? আর তোমরা তাদের মাথায় কিঞ্চিৎ বিদ্যে-সাদ্যি দিতে পার না কি? তারপর তাদের ঘরে ঘরে ‘রামকৃষ্ণ’ ভজাতে আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যে শেখাতে পাঠিয়ে দিতে পার না কি? ...
উঠে পড়ে লেগে যাও দিকি। গপ্প মারা ঘণ্টা নাড়ার কাল গেছে হে বাপু, কার্য করিতে হইবেক। দেখি বাঙালীর ধর্ম কতদূর গড়ায়। নিরঞ্জন লিখছে যে লাটুর গরম কাপড় চাই। এরা গরম কাপড় ইওরোপ আর ইণ্ডিয়া থেকে আনায়। যে দামে এখানে গরম কাপড় কিনব, তার সিকি দামে সেই কাপড় কলিকাতায় মিলবে। লাটুর আক্ষেপ শীঘ্রই দূর করিব। কবে ইওরোপ যাব জানি না, আমার সকলই অনিশ্চিত—এদেশে এক রকম চলছে, এই পর্যন্ত।
এ বড় মজার দেশ। গরমি পড়েছে—আজ সকালবেলা আমাদের বৈশাখের গরমি, আর এখন এলাহাবাদের মাঘ মাসের শীত!! চার ঘণ্টার ভেতর এত পরিবর্তন! এখানের হোটেলের কথা কি বলিব! নিউ ইয়র্কে এক হোটেল আছেন, যেখানে ৫০০০৲ টাকা পর্যন্ত রোজ ঘরভাড়া, খাওয়া-দাওয়া ছাড়া। ভোগবিলাসের দেশ ইওরোপেও এমন নাই—এরা হল পৃথিবীর মধ্যে ধনী দেশ—টাকা খোলামকুচির মত খরচ হয়ে যায়। আমি কদাচ হোটেলে থাকি, আমি প্রায়ই এদের বড় বড় লোকের অতিথি—আমি এদের একজন নামজাদা মানুষ এখন। মুলুকসুদ্ধ লোকে আমায় জানে, সুতরাং যেখানে যাই, আগ বাড়িয়ে আমায় ঘরে তুলে নেয়। মিঃ হেল, যাঁর বাড়ীতে চিকাগোয় আমার centre (কেন্দ্র), তার স্ত্রীকে আমি ‘মা’ বলি, আর তাঁর মেয়েরা আমাকে ‘দাদা’ বলে; এমন মহা পবিত্র দয়ালু পরিবার আমি তো আর দেখি না। আরে ভাই, তা নইলে কি এদের উপর ভগবানের এত কৃপা? কি দয়া এদের! যদি খবর পেলে যে, একজন গরীব ফলানা জায়গায় কষ্টে রয়েছে, মেয়েমদ্দে চলল—তাকে খাবার, কাপড় দিতে, কাজ জুটিয়ে দিতে! আর আমরা কি করি!
এরা গরমিকালে বাড়ী ছেড়ে বিদেশে অথবা সমুদ্রের কিনারায় যায়। আমিও যাব একটা কোন জায়গায়—এখনও ঠিক করি নাই। আর সকল—যেমন ইংরেজদের দেখছ, তেমনি আর কি। বইপত্র সব আছে বটে, কিন্তু মহা মাগ্গি, সে দামে ৫ গুণ সেই জিনিষ কলিকাতায় মেলে অর্থাৎ এরা বিদেশী মাল দেশে আসতে দেবে না। মহা কর বসিয়ে দেয়—কাজেই আগুন হয়ে দাঁড়ায়। আর এরা বড় একটা কাপড়-চোপড় বানায় না—এরা যন্ত্র-আওজার আর গম, চাল, তুলা ইত্যাদি তৈয়ার করে—তা সস্তা বটে।
ভাল কথা, এখানে ইলিস মাছ অপর্যাপ্ত আজকাল। ভরপেট খাও, সব হজম। ফল অনেক—কলা, নেবু, পেয়ারা, আপেল, বাদাম, কিসমিস, আঙ্গুর যথেষ্ট, আরও অনেক ফল ক্যালিফোর্নিয়া হতে আসে। আনারস ঢের—তবে আম, নিচু ইত্যাদি নাই।
এক রকম শাক আছে, Spinach—যা রাঁধলে ঠিক আমাদের নটে শাকের মত খেতে লাগে, আর যেগুলোকে এরা Asparagus (এষ্পারেগাস) বলে, তা ঠিক যেন কচি ডেঙ্গোর ডাঁটা, তবে ‘গোপালের মার চচ্চড়ি’ নেই বাবা। কলায়ের দাল কি কোন দাল নেই, এরা জানেও না। ভাত আছে, পাঁউরুটি আছেন, হর-রঙের নানা রকমের মাছমাংস আছেন। এদের খানা ফরাসীদের মত। দুধ আছেন, দই কদাচ, ঘোল অপর্যাপ্ত। মাঠা (cream) সর্বদাই ব্যবহার। চায়ে, কাফিতে, সকল তাতেই ঐ মাঠা (cream)—সর নয়, দুধের মাঠা। আর মাখন তো আছেন, আর বরফ-জল—শীত কি গ্রীষ্ম, দিন কি রাত্রি, ঘোর সর্দি কি জ্বর—এন্তের৫৫ বরফ-জল। এরা scientific (বৈজ্ঞানিক) মানুষ, সর্দিতে বরফ-জল খেলে বাড়ে শুনলে হাসে। খুব খাও, খুব ভাল। আর কুলপি এন্তের নানা আকারের।
নায়াগারা falls (জলপ্রপাত) হরির ইচ্ছায় ৭।৮ বার তো দেখলুম। খুব grand (উচ্চভাবোদ্দীপক) বটে, তবে যত শুনেছ, তা নয়। একদিন শীতকালে Aurora Borealis ৫৬ হয়েছিল। আর কিছুই লেখবার মত খুঁজে পাচ্ছি না। এ-সব চিঠি বাজার কর না।
মা-ঠাকুরাণীর খরচপত্র কেমন চলছে, তোমরা তা তো কিছুই লেখ নাই। খালি childish prattle (আবোলতাবোল)!! ও-সকল জানবার আমার এ জন্মে বড় একটা সময় নাই, next time-এ (আগামী বারে) দেখা যাবে।
যোগেন বোধ হয় এতদিনে বেশ সেরে গেছে। সারদার ঘুরঘুরে রোগ এখনও শান্তি হয় নাই। একটা power of organisation (সঙ্ঘ চালাবার শক্তি) চাই—বুঝেছ? তোমাদের ভিতর কারুর মাথায় ততটুকু ঘি আছে কি? যদি থাকে তো বুদ্ধি খেলাও দিকি—তারক দাদা, শরৎ, হরি—এরা পারবে। শশীর originality (মৌলিকতা) ভারী কম, তবে খুব good workman, perservering (ভাল কাজের লোক—অধ্যবসায়শীল), সেটা বড়ই দরকার, শশী খুব executive (কাজের লোক), বাদবাকী—এরা যা বলে, তাই শুনে চলো। কতকগুলো চেলা চাই—fiery young men (অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত যুবক), বুঝতে পারলে? Intelligent and brave (বুদ্ধিমান্ ও সাহসী), যমের মুখে যেতে পারে, সাঁতার দিয়ে সাগর পারে যেতে প্রস্তুত, বুঝলে? Hundreds (শত শত) ঐ রকম চাই, মেয়ে-মদ্দ both (দুই)—প্রাণপণে তারই চেষ্টা কর—চেলা বনাও আর আমাদের purity drilling (পবিত্রতার সাধন) যন্ত্রে ফেলে দাও।
তোমাদের আক্কেল বুদ্ধি এক পয়সাও নাই। Indian Mirrorকে ‘পরমহংস মশায় নরেনকে হেন বলতেন, তেন বলতেন’ কেন বলতে গেলে? আর আজগুবি ফাজগুবি যত—পরমহংস মশায়ের বুঝি আর কিছুই ছিল না? খালি thought-reading (পরের মনের কথা বলতে পারা) আর nonsense (বাজে) আজগুবি! দু-পয়সার brain (মস্তিষ্ক)-গুলো! ঘৃণা হয়ে যায়! তোদের নিজের বুদ্ধি বড় একটা খেলাতে হবে না—সাদা বাঙলা কয়ে যা দিকি।
বাবুরামের লম্বা পত্র পড়লাম। বুড়ো বেঁচে আছে—বেশ কথা! তোমাদের আড্ডাটা নাকি বড় malarious (ম্যালেরিয়াগ্রস্ত)—রাখাল আর হরি লিখছেন। রাজাকে আর হরিকে আমার বহুত বহুত দণ্ডবৎ লাট্টিবৎ ইষ্টিকবৎ ছতরীবৎ দিবে। বাবুরাম অনেক delirium (প্রলাপ) বকেছে। সাণ্ডেল আনাগোনা করছে, বেশ বেশ। গুপ্তকে তোমরা চিঠিপত্র লেখ—আমার ভালবাসা জানিও ও যত্ন কর। সব ঠিক আসবে ধীরে ধীরে। আমার বহুত চিঠি লেখবার সময় বড় একটা হয় না। Lecture ফেক্চার (বক্তৃতা) তো কিছু লিখে দিই না, একটা লিখে দিয়েছিলুম, যা ছাপিয়েছি। বাকী সব দাঁড়াঝাঁপ, যা মুখে আসে গুরুদেব জুটিয়ে দেন। কাগজপত্রের সঙ্গে কোন সম্বন্ধই নাই। একবার ডেট্রয়েটে তিন ঘণ্টা ঝাড়া বুলি ঝেড়েছিলুম। আমি নিজে অবাক্ হয়ে যাই সময়ে সময়ে; ‘মধো, তোর পেটে এতও ছিল!!’ এরা সব বলে, পুঁথি লেখ; একটা এইবার লিখতে ফিকতে হবে দেখছি। ঐ তো মুশকিল, কাগজ কলম নিয়ে কে হাঙ্গাম করে বাবা!
কোন চিঠি বাজার গুজব করিসনি, খবরদার! চ্যাঙড়ামো নাকি? যা করতে বলছি পার তো কর, না পার তো মিছে ফেচাং কর না। তোমাদের বাড়ীতে কটা ঘর আছে, কেমন করে চলছে, রাঁধুনী-ফাঁধুনী আছে কিনা—সব লিখবে। মা ঠাকুরাণীকে আমার বহুত বহুত সাষ্টাঙ্গ দিবে। তারকদাদা আর শরতের বুদ্ধি নিয়ে যে কাজটা করতে বলেছি—করবার চেষ্টা করবে—দেখব কেমন বাহাদুর। এইটুকু যদি না করতে পার তাহলে তোমাদের ওপর হতে আমার সব বিশ্বাস আর ভরসা চলে যাবে। মিছামিছি কর্তাভজার দল বাঁধতে আমার ইচ্ছা নাই—I will wash my hands off you for ever (তোমাদের সঙ্গে কোন সম্বন্ধই আমি আর রাখব না)।
সমাজকে, জগৎকে electrify (বৈদ্যুতিকশক্তিসম্পন্ন) করতে হবে। বসে বসে গপ্পবাজির আর ঘণ্টা নাড়ার কাজ? ঘণ্টা নাড়া গৃহস্থের কর্ম, মহীন্দ্র মাষ্টার, রামবাবু করুন গে। তোমাদের কাজ distribution and propagation of thought currents (ভাবপ্রবাহ বিস্তার)। তাই যদি পার তবে ঠিক, নইলে বেকার। রোজকার করে খাওগে। মিছে eating the begging bread of idleness is of no use (অনায়াসলব্ধ ভিক্ষান্ন খাওয়া নিরর্থক) বুঝলে বাপু? কিমধিকমিতি
নরেন্দ্র
Character formed (চরিত্র গঠিত) হয়ে যাক, তারপর আমি আসছি, বুঝলে? দু হাজার, দশ হাজার, বিশ হাজার সন্ন্যাসী চাই, মেয়ে-মদ্দ—বুঝলে? গৌর-মা, যোগেন-মা, গোলাপ-মা কি করছেন? চেলা চাই at any risk (যে-কোন রকমে হোক)। তাঁদের গিয়ে বলবে আর তোমরা প্রাণপণে চেষ্টা কর। গৃহস্থ চেলার কাজ নয়, ত্যাগী—বুঝলে? এক এক জনে ১০০ মাথা মুড়িয়ে ফেল, young educated men—not fools (শিক্ষিত যুবক—আহাম্মক নয়), তবে বলি বাহাদুর। হুলস্থুল বাঁধাতে হবে, হুঁকো ফুঁকো ফেলে কোমর বেঁধে খাড়া হয়ে যাও। তারকদাদা, মান্দ্রাজ কলিকাতার মাঝে বিদ্যুতের মত চক্র মারো দিকি, বার কতক। জায়গায় জায়গায় centre (কেন্দ্র) কর, খালি চেলা কর, মায়ে মেয়ে-মদ্দ, যে আসে দে মাথা মুড়িয়ে, তারপর আমি আসছি। মহা spriritual tidal wave (আধ্যাত্মিক বন্যা) আসছে—নীচ মহৎ হয়ে যাবে, মূর্খ মহাপণ্ডিতের গুরু হয়ে যাবে তাঁর কৃপায়—‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।’
Life is ever expanding, contraction is death (জীবন হচ্ছে সম্প্রসারণ, সঙ্কোচনই মৃত্যু)। যে আত্মম্ভরি আপনার আয়েস খুঁজছে, কুঁড়েমি করছে, তার নরকেও জায়গা নাই। যে আপনি নরক পর্যন্ত গিয়ে জীবের জন্য কাতর হয়, চেষ্টা করে, সেই রামকৃষ্ণের পুত্র—ইতরে কৃপণাঃ (অপরে কৃপার পাত্র)। যে এই মহা সন্ধিপূজার সময় কোমর বেঁধে খাড়া হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে তাঁর সন্দেশ বিতরণ করবে, সেই আমার ভাই, সেই তাঁর ছেলে, বাকী যে তা না পার—তফাত হয়ে যাও এই বেলা ভালয় ভালয়।
এই চিঠি তোমরা পড়বে—যোগেন-মা, গোলাপ-মা সকলকে শুনাবে। এই test (পরীক্ষা), যে রামকৃষ্ণের ছেলে, সে আপনার ভাল চায় না, ‘প্রাণাত্যয়েঽপি পরকল্যাণচিকীর্ষবঃ’ (প্রাণ দিয়েও পরের কল্যাণাকাঙ্ক্ষী) তারা। যারা আপনার আয়েস চায়, কুঁড়েমি চায়, যারা আপনার জিদের সামনে সকলের মাথা বলি দিতে রাজী, তারা আমাদের কেউ নয়, তারা তফাত হয়ে যাক, এই বেলা ভালয় ভালয়। তাঁর চরিত্র, তাঁর শিক্ষা, ধর্ম চারিদিকে ছড়াও—এই সাধন, এই ভজন; এই সাধন, এই সিদ্ধি। উঠ, উঠ, মহাতরঙ্গ আসছে, Onward, onward (এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও)। মেয়ে-মদ্দে আচণ্ডাল সব পবিত্র তাঁর কাছে—Onward, onward, নামের সময় নাই, যশের সময় নাই, মুক্তির সময় নাই, ভক্তির সময় নাই, দেখা যাবে পরে। এখন এ জন্মে অনন্ত বিস্তার, তাঁর মহান্ চরিত্রের, তাঁর মহান্ জীবনের, তাঁর অনন্ত আত্মার। এই কার্য—আর কিছু নাই। যেখানে তাঁর নাম যাবে, কীটপতঙ্গ পর্যন্ত দেবতা হয়ে যাবে, হয়ে যাচ্ছে, দেখেও দেখছ না? এ কি ছেলেখেলা, এ কি জ্যাঠামি, এ কি চ্যাংড়ামি—‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’—হরে হরে। তিনি পিছে আছেন। আমি আর লিখতে পারছি না—Onward, এই কথাটি খালি বলছি, যে যে এই চিঠি পড়বে, তাদের ভিতর আমার spirit (শক্তি) আসবে, বিশ্বাস কর। Onward, হরে হরে। চিঠি বাজার কর না। আমার হাত ধরে কে লেখাচ্ছে। Onward, হরে হরে। সব ভেসে যাবে—হুঁশিয়ার—তিনি আসছেন। যে যে তাঁর সেবার জন্য—তাঁর সেবা নয়—তাঁর ছেলেদের—গরীব-গুরবো, পাপী-তাপী, কীট-পতঙ্গ পর্যন্ত, তাদের সেবার জন্য যে যে তৈরী হবে, তাদের ভেতর তিনি আসবেন—তাদের মুখে সরস্বতী বসবেন, তাদের বক্ষে মহামায়া মহাশক্তি বসবেন। যেগুলো নাস্তিক, অবিশ্বাসী, নরাধম, বিলাসী—তারা কি করতে আমাদের ঘরে এসেছে? তারা চলে যাক।
আমি আর লিখতে পারছি না, বাকী তিনি নিজে বলুন গে।
ইতি নরেন্দ্র
পুঃ—একটা বড় খাতা রাখবে এবং তাহাতে যখন যে স্থান হইতে কোন পত্র আসে তাহার একটা চুম্বক লিখিয়া রাখিবে। তাহা হইলে উত্তর দিবার বেলায় ভুলচুক হইবে না। Organisation (সঙ্ঘ) শব্দের অর্থ division of labour (শ্রমবিভাগ)—প্রত্যেকে আপনার আপনার কাজ করে এবং সকল কাজ মিলে একটা সুন্দর ভাব হয়। ...
বিশেষ অনুধাবন করে যা যা লিখলাম তা করিবে। আমার কবিতা৫৭ কপি করে রেখো, পরে আরও পাঠাব।
১০৩*
[মিসেস হেলকে লিখিত]
C/o. ডাঃ ই. গার্নসি
Fishkill Landing, N. Y.
জুলাই, ১৮৯৪
মা,
কাল এখানে এসেছি। কয়েক দিন থাকব। নিউ ইয়র্কে আপনার এক পত্র পেয়েছিলাম, কিন্তু ‘ইণ্টিরিয়র’ পাইনি। তাতে খুশীই হয়েছি; কারণ আমি এখনও নিখুঁত হইনি; আর প্রেসবিটেরিয়ন ধর্মযাজকদের—বিশেষতঃ ‘ইণ্টিরিয়র’দের—আমার প্রতি যে নিঃস্বার্থ ভালবাসা আছে, তা জেনে পাছে এই ‘প্রেমিক’ খ্রীষ্টান মহোদয়গণের উপর আমার বিদ্বেষ উদ্বুদ্ধ হয়, এই জন্য তফাতেই থাকতে চাই। আমাদের ধর্মের শিক্ষা—ক্রোধ সঙ্গত (সমর্থনযোগ্য) হলেও মহাপাপ। নিজ নিজ ধর্মই অনুসরণীয়। ‘সাধারণ’ ও ‘ধর্মসংক্রান্ত’ ভেদে ক্রোধ, হত্যা, অপবাদ প্রভৃতির মধ্যে কোন তফাত করতে পারি না—শত চেষ্টা সত্ত্বেও। এই সূক্ষ্ম নৈতিক পার্থক্যবোধ যেন আমার স্বজাতীয়গণের মধ্যে কখনও প্রবেশ না করে। ঠাট্টা থাক, শুনুন মাদার চার্চ, আপনাকে বলছি—এরা যে কপট, ভণ্ড, স্বার্থ ও প্রতিষ্ঠাপ্রিয়—তা বেশ স্পষ্ট দেখে আমি এদের উন্মত্ত আস্ফালন মোটেই গ্রাহ্য করি না।
এইবার ছবির কথা বলিঃ প্রথমে মেয়েরা কয়েকটি আনে, পরে আপনি কয়েক কপি আনেন। আপনি তো জানেন মোট ৫০ কপি দেবার কথা। এ বিষয়ে ভগিনী ইসাবেল আমার চেয়ে বেশী জানেন।
আপনি ও ফাদার পোপ আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা প্রীতি জানবেন। ইতি
আপনাদের
বিবেকানন্দ
পুঃ—গরম কেমন উপভোগ করেছেন? এখানকার তাপ আমার বেশ সহ্য হচ্ছে। সমুদ্রতীরে সোয়াম্স্কটে (Swampscot) যাবার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন এক অতি ধনী মহিলা; গত শীতে নিউ ইয়র্কে এঁর সঙ্গে আলাপ হয়। ধন্যবাদ সহ প্রত্যাখান জানিয়েছি। এ দেশে কারও আতিথ্যগ্রহণ-বিষয়ে আমি এখন খুব সতর্ক—বিশেষ করে ধনী লোকের। খুব ধনবান্দের আরও কয়েকটি নিমন্ত্রণ আসে, সেগুলিও প্রত্যাখ্যান করেছি। এতদিনে এদের কার্যকলাপ বেশ বুঝলাম। আন্তরিকতার জন্য ভগবান্ আপনাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন; হায়, জগতে ইহা এতই বিরল!
আপনার স্নেহের
বি
১০৪*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
নিউ ইয়র্ক
৯ জুলাই, ১৮৯৪
ভগিনীগণ,
জয় জগদম্বে! আমি আশারও অধিক পেয়েছি। মা আপন প্রচারককে মর্যাদায় অভিভূত করেছেন। তাঁর দয়া দেখে আমি শিশুর মত কাঁদছি। ভগিনীগণ! তাঁর দাসকে তিনি কখনও ত্যাগ করেন না। আমি যে চিঠিখানি তোমাদের পাঠিয়েছি, তা দেখলে সবই বুঝতে পারবে। আমেরিকার লোকেরা শীঘ্রই ছাপা কাগজগুলি পাবে। পত্র যাঁদের নাম আছে, তাঁরা আমাদের দেশের সেরা লোক। সভাপতি ছিলেন কলিকাতার এক অভিজাতশ্রেষ্ঠ, অপর ব্যক্তি মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন কলিকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ও ভারতীয় ব্রাহ্মণ-সমাজের শীর্ষস্থানীয়। তাঁর এই মর্যাদা গভর্ণমেণ্টেরও অনুমোদিত। ভগিনীগণ! আমি কি পাষণ্ড! তাঁর এত দয়া প্রত্যক্ষ করেও মাঝে মাঝে বিশ্বাস প্রায় হারিয়ে ফেলি। সর্বদা তিনি রক্ষা করছেন দেখেও মন কখনও কখনও বিষাদগ্রস্ত হয়। ভগিনীগণ! ভগবান্ একজন আছেন জানবে, তিনি পিতা, তিনি মাতা; তাঁর সন্তানদের তিনি কখনও পরিত্যাগ করেন না—না, না, না। নানা রকম বিকৃত মতবাদ ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে সরল শিশুর মত তাঁর শরণাগত হও। আমি আর লিখতে পারছি না, মেয়েদের মত কাঁদছি।
জয় প্রভু, জয় ভগবান্!
তোমাদের স্নেহের
বিবেকানন্দ
৯৫*
U. S. A
১১ জুলাই, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
তুমি ৫৪১ নং ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো ছাড়া আর কোন ঠিকানায় আমায় পত্র লিখো না। তোমার শেষ চিঠিখানা সারা দেশ ঘুরে আমার কাছে পৌঁছেছে—আর পত্রটা যে শেষে পৌঁছল, মারা গেল না, তার কারণ এখানে আমার কথা সকলে বেশ ভালরকম জানে। সভার খানকতক প্রস্তাব ডাঃ ব্যারোজকে পাঠাবে—তার সঙ্গে একখানা পত্র লিখে আমার প্রতি সহৃদয় ব্যবহারের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দেবে এবং উহা আমেরিকার কতকগুলি সংবাদপত্রে প্রকাশ করবার জন্য অনুরোধ করবে। মিশনরীরা আমার নামে এই যে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে যে, আমি কারও প্রতিনিধি নই—ঐতেই তার উত্তম প্রতিবাদ হবে। বৎস, কি করে কাজ করতে হয়, শেখো। এইভাবে দস্তুরমত প্রণালীতে কাজ করতে পারলে আমরা খুব বড় বড় কাজ করতে নিশ্চিতই সমর্থ হব। গত বছর আমি কেবল বীজ বপন করেছি—এই বছর ফসল কাটতে চাই। ইতোমধ্যে ভারতে যতটা সম্ভব আন্দোলন চালাও। কিডি নিজের ভাবে চলুক—সে ঠিক পথে দাঁড়াবে। আমি তার ভার নিয়েছি—সে নিজের মতে চলুক, এ বিষয়ে তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। তাকে আমার আশীর্বাদ জানাবে। পত্রিকাখানা বার কর—আমি মাঝে মাঝে প্রবন্ধ পাঠাব। বষ্টনের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাইট (Wright)-কে একখানা প্রস্তাব পাঠাবে, আর সঙ্গে সঙ্গে একখানা পত্র লিখে এই বলে তাঁকে ধন্যবাদ দেবে যে, তিনি সর্বপ্রথম আমেরিকায় আমার বন্ধুরূপে দাঁড়িয়েছিলেন, আর তাঁকেও ঐটি কাগজে ছাপাতে অনুরোধ করবে; তা হলে মিশনরীদের (আমি যে কারু প্রতিনিধি হয়ে আসিনি) এ কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে। ডেট্রয়েটের বক্তৃতায় আমি ৯০০ ডলার অর্থাৎ ২৭০০৲ টাকা পেয়েছিলাম। অন্যান্য বক্তৃতায় একটাতে এক ঘণ্টায় আমি ২৫০০ ডলার অর্থাৎ ৭৫০০৲ টাকা রোজগার করি, কিন্তু পাই মাত্র ২০০ ডলার। একটা জুয়াচোর বক্তৃতা কোম্পানী আমায় ঠকিয়েছিল। আমি তাদের সংস্রব ছেড়ে দিয়েছি। এখানে খরচও হয়ে গেছে অনেক টাকা—হাতে আছে মাত্র ৩০০০ ডলার। আসছে বছরে আবার আমায় অনেক জিনিষ ছাপাতে হবে।
আমি এইবার নিয়মিতভাবে কাজ করব মনে করছি। কলিকাতায় লেখ, তারা আমার ও আমার কাজ সম্বন্ধে কাগজে যা কিছু বেরোয়, কিছুমাত্র বাদ না দিয়ে যেন পাঠায়, তোমরাও মান্দ্রাজ থেকে পাঠাতে থাক। খুব আন্দোলন চালাও। কেবল ইচ্ছাশক্তিতেই সব হবে। কাগজ ছাপানো ও অন্যান্য খরচের জন্য মাঝে মাঝে তোমাদের কাছে টাকা পাঠাবার চেষ্টা করব। সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তোমাদের একটা সমিতি স্থাপন করতে হবে—তার নিয়মিত অধিবেশন হওয়া চাই, আর আমাকে যত পার, সব খবরাখবর লিখবে। আমিও যাতে নিয়মিতভাবে কাজ করতে পারি, তার চেষ্টা করছি। এই বছরে অর্থাৎ আগামী শীত ঋতুতে আমি অনেক টাকা পাব—সুতরাং আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে তোমরা এগিয়ে চল। তোমরা পল কেরসকে (Dr. Paul Carus) একখানা পত্র লিখো, আর যদিও তিনি আমার বন্ধুই আছেন, তথাপি তোমরা তাঁকে আমাদের জন্য কাজ করবার অনুরোধ কর। মোট কথা যতদূর পার আন্দোলন চালাও—কেবল সত্যের অপলাপ না হয়, এ বিষয়ে লক্ষ্য রেখো। বৎসগণ, কাজে লাগো—তোমাদের ভিতর আগুন জ্বলে উঠবে। মিসেস হেল (Mrs. G. W. Hale) আমার পরম বন্ধু—আমি তাঁকে ‘মা’ বলি এবং তাঁর কন্যাদের ‘ভগিনী’ বলি। তাঁকেও একখানা প্রস্তাব পাঠিয়ে দিও—আর একখানা পত্র লিখে তোমাদের তরফ থেকে তাঁকে ধন্যবাদ দিও। সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজ করবার ভাবটা আমাদের চরিত্রে একেবারে নাই, এটা যাতে আসে—তার চেষ্টা করতে হবে। এটি করবার রহস্য হচ্ছে ঈর্ষার অভাব। সর্বদাই তোমার ভ্রাতার মতে মত দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে—সর্বদাই যাতে মিলে মিশে শান্তভাবে কাজ হয়, তার চেষ্টা করতে হবে। এটাই সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজ করবার সমগ্র রহস্য। সাহসের সহিত যুদ্ধ কর। জীবন তো ক্ষণস্থায়ী—একটা মহৎ উদ্দেশ্যে জীবনটা সমর্পণ কর।
তুমি নরসিংহ সম্বন্ধে কিছু লেখনি কেন? সে এক রকম অনশনে দিন কাটাচ্ছে। আমি তাকে কিছু দিয়েছিলাম, তারপর সে কোথায় যে চলে গেল, কিছু জানি না; সে আমায় কিছু লেখে না। অক্ষয় ভাল ছেলে, আমি তাকে খুব ভালবাসি। থিওসফিষ্টদের সঙ্গে বিবাদ করবার আবশ্যক নেই। আমি যা কিছু লিখি, তাদের কাছে গিয়ে সব বল না। আহাম্মক! থিওসফিষ্টরা আগে এসে আমাদের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে—জান তো? জজ৫৮ হচ্ছেন হিন্দু আর কর্ণেল অলকট বৌদ্ধ। জজ এখানকার একজন খুব উপযুক্ত ব্যক্তি। এখন হিন্দু থিওসফিষ্টদের বল, তারা যেন জজকে সমর্থন করে। এমন কি, যদি তোমরা তাঁকে সমধর্মাবলম্বী বলে সম্বোধন করে এবং তিনি আমেরিকায় হিন্দুধর্মপ্রচারের জন্য যে পরিশ্রম করেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ দিয়ে এক পত্র লিখতে পার, তাতে তাঁর বুকটা দশ হাত হয়ে উঠবে। আমরা কোন সম্প্রদায়ে যোগ দেব না, কিন্তু সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করব ও সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করব।
এটা স্মরণ রেখো যে, আমি এখন ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছি, সুতরাং ‘৫৪১ ডিয়ারবর্ন এভিনিউ, চিকাগো’ হচ্ছে আমার কেন্দ্র। সর্বদা ঐ ঠিকানাতেই পত্র দেবে, আর ভারতে যা কিছু হচ্ছে—সব খুঁটিনাটি আমাকে জানাবে আর কাগজে আমাদের সম্বন্ধে যা কিছু বার হচ্ছে, তার একটা টুকরো পর্যন্ত পাঠাতে ভুলো না। আমি জি. জি.-র কাছ থেকে একখানি সুন্দর পত্র পেয়েছি। প্রভু এই বীরহৃদয় ও আদর্শচরিত্র বালকদের আশীর্বাদ করুন। বালাজী, সেক্রেটারী এবং আমাদের সকল বন্ধুকে আমার ভালবাসা জানাবে। কাজ কর, কাজ কর—সকলকে তোমার ভালবাসার দ্বারা জয় কর। আমি মহীশূরের রাজাকে একখানা পত্র লিখেছি ও কয়েকখানা ফটোগ্রাফ পাঠিয়েছি। তোমাদের কাছে যে ফটো পাঠিয়েছি, তা নিশ্চয়ই এতদিনে পেয়েছ। একখানা রামনাদের রাজাকে উপহার দিও—তাঁর ভেতর যতটা ভাব ঢোকাতে পার, চেষ্টা কর। খেতড়ির রাজার সঙ্গে সর্বদা পত্রব্যবহার রাখবে। বিস্তারের চেষ্টা কর। মনে রেখো, জীবনের একমাত্র চিহ্ন হচ্ছে গতি ও উন্নতি। আমি তোমার চিঠি আসতে বিলম্ব দেখে প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম—এখন দেখছি, তোমার আহাম্মকিতেই এত দেরী হয়েছে। বুঝতে পারছ তো, আমি ক্রমাগত ঘুরছি আর চিঠি-বেচারাকে ক্রমাগত নানাস্থান খুঁজে তবে আমাকে বার করতে হয়। আরও তোমাদের এটি বিশেষ করে মনে রাখতে হবে যে, সব কাজ দস্তুরমত নিয়ম-মাফিক করতে হবে। যে প্রস্তাবগুলি সভায় পাস হয়েছে, সেগুলি ধর্মমহাসভার সভাপতি, চিকাগো, ডাঃ ব্যারোজ (Dr. J. H. Barrows)-কে পাঠাবে এবং তাঁকে অনুরোধ করবে যে, ঐ প্রস্তাব ও পত্র যেন তিনি খবরের কাগজে ছাপান।
ডাঃ ব্যারোজকে ও ডাঃ পল কেরসকে ঐগুলি ছাপার জন্য অনুরোধ-পত্রও যেন ঐরূপ সভার প্রতিনিধিস্থানীয় কারও কাছ থেকে যায়। বিশ্ব মহামেলার (ডেট্রয়েট, মিশিগান) সভাপতি, সেনেটার পামার (Palmer)-কে পাঠাবে—তিনি আমার প্রতি বড়ই সহৃদয় ব্যবহার করেছিলেন। মিসেস ব্যাগ্লি (J. J. Bagley)-কে ওয়াশিংটন এভিনিউ, ডেট্রয়েট, এই ঠিকানায় একখানা পাঠাবে, আর তাঁকে অনুরোধ করবে যে, সেটা যেন কাগজে প্রকাশ করা হয় ইত্যাদি। খবরের কাগজ প্রভৃতিতে দেওয়া গৌণ—দস্তুর মাফিক পাঠানোই হচ্ছে আসল অর্থাৎ ব্যারোজ প্রভৃতি প্রতিনিধিকল্প ব্যক্তিগণের হাত দিয়ে আসা চাই, তবেই সেটি একটি নিদর্শনরূপে গণ্য হবে। খবরের কাগজে অমনি অমনি কিছু বেরুলে সেটি নিদর্শনরূপে গণ্য হয় না। সব চেয়ে নিয়ম অনুযায়ী উপায় হচ্ছে ডাঃ ব্যারোজকে পাঠানো ও তাঁকে কাগজে প্রকাশ করতে অনুরোধ করা। আমি এসব কথা লিখছি, তার কারণ এই যে, আমার মনে হয়, তোমরা অন্য জাতের আদব-কায়দা জান না। যদি কলিকাতা থেকেও বড় বড় নাম দিয়ে—এ রকম সব আসে, তাহলে আমেরিকানরা যাকে বলে ‘boom’, তাই পাব (আমার স্বপক্ষে খুব হুজুক মেচে যাবে) আর যুদ্ধের অর্ধেক জয় হয়ে যাবে। তখন ইয়াঙ্কিদের বিশ্বাস হবে যে, আমি হিন্দুদের যথার্থ প্রতিনিধি, আর তখনই তারা তাদের গাঁট থেকে পয়সা বার করবে। স্থিরভাবে লেগে থাকো—এ পর্যন্ত আমরা অদ্ভুত কার্য করেছি। হে বীরগণ, এগিয়ে যাও, আমরা নিশ্চয় জয়লাভ করব। মান্দ্রাজ থেকে যে কাগজখানা বার হবার কথা হচ্ছিল, তার কি হল? সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে সভাসমিতি স্থাপন করতে থাকো, কাজে লেগে যাও—এই একমাত্র উপায়। কিডিকে দিয়ে লেখাতে থাকো, তাতেই তার মেজাজ ঠিক থাকবে। এ সময়টা বেশী বক্তৃতা করবার সুবিধা নেই, সুতরাং এখন আমাকে কলম ধরে বসে লিখতে হবে। অবশ্য সর্বক্ষণই আমাকে কঠিন কার্যে নিযুক্ত থাকতে হবে, তারপর শীত ঋতু এলে লোকে যখন তাদের বাড়ী ফিরবে, তখন আবার বক্তৃতাদি শুরু করে এবার সভাসমিতি স্থাপন করতে থাকব। সকলকে আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা। খুব খাটো। সম্পূর্ণ পবিত্র হও—উৎসাহাগ্নি আপনিই জ্বলে উঠবে।
শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ
পুঃ—সকলকে আমার ভালবাসা। আমি কাকেও কখনও ভুলি না। তবে নেহাত অলস বলে সকলকে আলাদা আলাদা লিখতে পারি না। প্রভু তোমাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন।
বি
পুঃ—তোমার ট্রিপ্লিকেনের ঠিকানা অথবা যদি কোন সভাসমিতি স্থাপন করে থাকো, তার ঠিকানা আমায় পাঠাবে।
বি
১০৬*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
সোয়াম্স্কট্
২৬ জুলাই, ১৮৯৪
প্রিয় খুকীরা
দেখো, আমার চিঠিগুলো যেন নিজেদের বাইরে না যায়। ভগিনী মেরীর এক সুন্দর পত্র পেয়েছি। দেখছ তো সমাজে আমি কি রকম বেড়ে চলেছি। এ সব ভগিনী জিনীর (Jeany) শিক্ষার ফলে। খেলা দৌড়ঝাঁপে সে ধুরন্ধর, মিনিটে ৫০০ হিসাবে ইতরভাষা ব্যবহারে দক্ষ, কথার তোড়ে অদ্বিতীয়, ধর্মের বড় ধার ধারে না, তবে ঐ যা একটু-আধটু। সে আজ বাড়ী গেল, আমি গ্রীনএকারে যাচ্ছি। মিসেস ব্রীডের কাছে গিয়েছিলাম, মিসেস স্টোন সেখানে ছিলেন। মিসেস পুলম্যান প্রভৃতি আমার এখানকার হোমরাচোমরা বন্ধুগণ মিসেস স্টোনের কাছে আছেন। তাঁদের সৌজন্য আগের মতই। গ্রীনএকার থেকে ফেরবার পথে কয়েক দিনের জন্য এনিসস্কোয়ামে যাব মিসেস ব্যাগলির সঙ্গে দেখা করবার জন্য। দূর ছাই, সব ভুলে যাই; সমুদ্রে স্নান করছি ডুবে ডুবে মাছের মত—বেশ লাগছে। ‘প্রান্তর মাঝে’ ... (‘dans la plaine’) ইত্যাদি কি ছাইভস্ম গানটি হ্যারিয়েট আমায় শিখিয়েছিল; জাহান্নমে যাক! এক ফরাসী পণ্ডিত আমার অদ্ভুত অনুবাদ শুনে হেসে কুটিপাটি। এইরকম করে তোমরা আমায় ফরাসী শিখিয়েছিলে, বেকুফের দল। তোমরা ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছ তো? বেশ হয়েছে, গরমে ভাজা হয়ে যাচ্ছ। আঃ এখানে কেমন সুন্দর ঠাণ্ডা! যখন ভাবি তোমরা চার জনে গরমে ভাজা পোড়া সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছ, আর আমি এখানে কি তোফা ঠাণ্ডা উপভোগ করছি, তখন আমার আনন্দ শতগুণ বেড়ে যায়। আ হা হা হা।
নিউ ইয়র্ক প্রদেশের কোন স্থানে মিস ফিলিপ্সের পাহাড় হ্রদ নদী জঙ্গলে ঘেরা সুন্দর একটি স্থান আছে। আর কি চাই! আমি যাচ্ছি স্থানটিকে হিমালয়ে পরিণত করে সেখানে একটি মঠ খুলতে—নিশ্চয়ই। তর্জন গর্জন, লাথি ঝগড়ায় তোলপাড় এই আমেরিকায় ধর্মের মতভেদের আবর্তে আর একটি নূতন বিরোধের সৃষ্টি না করে এদেশ থেকে যাচ্ছি না।
ভ্রাতঃ, আপনার মত বলিষ্ঠ হৃদয় সহজে মেলে না। এটা একটা আজব জায়গা—আমাদের এই দুনিয়াটা। তবে এই দেশে যেখানে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত, সামান্য ‘পরিচয়পত্র’ও যেখানে আমার নেই, সেখানে এখানকার মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণে সহৃদয়তা পেয়েছি, তার জন্য সব জড়িয়ে আমি ঈশ্বরের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। শেষ পর্যন্ত সব কিছু মঙ্গলমুখী।
হ্রদটির ক্ষণিক স্মৃতি কখনও কখনও তোমাদের মনে জাগে নিশ্চয়। দুপুরের গরমে ভাববে হ্রদের একেবারে নীচে তলিয়ে যাচ্ছ, যতক্ষণ না বেশ স্নিগ্ধ বোধ কর। তারপর সেই তলদেশে স্নিগ্ধতার মাঝে চুপ করে পড়ে থাকবে—তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে, কিন্তু নিদ্রাভিভূত হবে না—স্বপ্ন-বিজড়িত অর্ধচেতন অবস্থায়। ঐ যেমন আফিমের নেশায় হয়—অনেকটা সেই রকম। ভারী চমৎকার। তার উপর খুব বরফ-ঠাণ্ডা জলও খেতে থাকো। মাংসপেশীতে এক একবার এমন খিল ধরে যাতে হাতী পর্যন্ত কাবু হয়ে পড়বে; ভগবান্ আমাকে রক্ষা করুন। আর আমি ঠাণ্ডা জলে নাবচি না।
স্নেহের আধুনিকারা! তোমরা সকলে সুখী হও—সর্বদা এই প্রার্থনা করি।
বিবেকানন্দ
১০৭*
[মিস মেরী ও মিস হ্যরিয়েট হেলকে লিখিত]
গ্রীনএকার ইন, ইলিয়ট, মেন
৩১ জুলাই, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনীগণ,
আমি অনেকদিন তোমাদের কোন পত্রাদি লিখিনি, লিখবারও বড় কিছু ছিল না। এটা একটা বড় সরাই ও খামার বাড়ী; এখানে ক্রিশ্চান সায়েণ্টিস্টরা৫৯ তাদের সমিতির বৈঠক বসিয়েছে। যে মহিলাটির মাথায় এই বৈঠকের কল্পনাটা প্রথমে আসে, তিনি গত বসন্তকালে নিউ ইয়র্কে আমাকে এখানে আসবার জন্য নিমন্ত্রণ করেন, তাই এখানে এসেছি। এ জায়গাটি বেশ সুন্দর ও ঠাণ্ডা, তাতে কোন সন্দেহ নাই, আর আমার চিকাগোর অনেক পুরাতন বন্ধু এখানে রয়েছেন। মিসেস মিল্স্ ও মিস স্টকহ্যামের কথা তোমাদের স্মরণ থাকতে পারে। তাঁরা এবং আর কতকগুলি ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা নদীতীরে খোলা জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে বাস করছেন। তাঁরা খুব স্ফূর্তিতে আছেন এবং কখনও কখনও তাঁরা সকলেই সারাদিন, যাকে তোমরা বৈজ্ঞানিক পোষাক বল, তাই পরে থাকেন। বক্তৃতা প্রায় প্রত্যহই হয়। বষ্টন থেকে মিঃ কলভিল নামে একজন ভদ্রলোক এসেছেন। লোকে বলে, তিনি প্রত্যহ ভাবাবিষ্ট হয়ে বক্তৃতা করে থাকেন—‘ইউনিভার্সাল ট্রুথ’-এর সম্পাদিকা, যিনি ‘জিমি মিল্স্’ প্রাসাদের উপর তলায় থাকতেন—এখানে এসে বসবাস করছেন। তিনি উপাসনা পরিচালনা করছেন আর মনঃশক্তিবলে সব রকমের ব্যারাম ভাল করবার শিক্ষা দিচ্ছেন—মনে হয়, এঁরা শীঘ্রই অন্ধকে চক্ষুদান এবং এই ধরনের নানা কর্ম সম্পাদন করবেন! মোট কথা, এই সম্মিলনটি এক অদ্ভুত রকমের। এরা সামাজিক বাঁধাবাঁধি নিয়ম বড় গ্রাহ্য করে না—সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ও বেশ আনন্দে আছে। মিসেস মিল্স্ বেশ প্রতিভাসম্পন্না, অন্যান্য অনেক মহিলাও তদ্রূপ। ... ডেট্রয়েটবাসিনী আর একটি উচ্চশিক্ষিতা মহিলা সমুদ্রতীর থেকে পনর মাইল দূরবর্তী একটি দ্বীপে আমায় নিয়ে যাবেন—আশা করি তথায় আমাদের পরমানন্দে সময় কাটবে। মিস আর্থার স্মিথ এখানে রয়েছেন। মিস গার্নসি সোয়াম্স্কট থেকে বাড়ী গেছেন। আমি এখান থেকে এনিস্কোয়াম যেতে পারি বোধ হয়।
এ স্থানটি সুন্দর ও মনোরম—এখানে স্নান করার ভারি সুবিধা। কোরা স্টকহ্যাম আমার জন্য একটি স্নানের পোষাক করে দিয়েছেন—আমিও ঠিক হাঁসের মত জলে নেমে স্নান করে মজা করছি—এমন কি জল-কাদায় যারা বাস করে (যেমন হাঁস-ব্যাঙ) তাদের পক্ষেও বেশ উপভোগ্য।
আর বেশী কিছু লেখবার পাচ্ছি না—আমি এখন এত ব্যস্ত যে, মাদার চার্চকে পৃথক্ভাবে লেখবার আমার সময় নেই। মিস হাউ-কে আমার শ্রদ্ধা ও প্রীতি জানাবে।
বষ্টনের মিঃ উড্ এখানে রয়েছেন—তিনি তোমাদের সম্প্রদায়ের একজন প্রধান পাণ্ডা। তবে ‘হোয়ার্লপুল’ মহোদয়ার৬০ সম্প্রদায়ভুক্ত হতে তাঁর বিশেষ আপত্তি—সেই জন্য তিনি দার্শনিক-রাসায়নিক-ভৌতিক-আধ্যাত্মিক আরও কত কি বিশেষণ দিয়ে নিজেকে একজন মনঃশক্তি-প্রভাবে আরোগ্যকারী বলে পরিচিত করতে চান। কাল এখানে একটা ভয়ানক ঝড় উঠেছিল—তাতে তাঁবুগুলোর উত্তমমধ্যম ‘চিকিৎসা’ হয়ে গেছে। যে বড় তাঁবুর নীচে তাঁদের এইসব বক্তৃতা চলছিল, ঐ ‘চিকিৎসার’ চোটে সেটির এত আধ্যাত্মিকতা বেড়ে উঠেছিল যে, সেটি মর্ত্যলোকের দৃষ্টি হতে সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়েছে, আর প্রায় দুশ’ চেয়ার আধ্যাত্মিক ভাবে গদ্গদ হয়ে জমির চারিদিকে নৃত্য আরম্ভ করেছিল। মিল্স্ কোম্পানীর মিসেস ফিগ্স্ প্রত্যহ প্রাতে একটা করে ক্লাস করে থাকেন আর মিসেস মিল্স্ ব্যস্তসমস্ত হয়ে সমস্ত জায়গাটায় যেন লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন—ওরা সকলেই খুব আনন্দে মেতে আছে। আমি বিশেষতঃ কোরাকে দেখে ভারী খুশী হয়েছি, গত শীত-ঋতুতে ওরা বিশেষ কষ্ট পেয়েছে—একটু আনন্দ করলে ওর পক্ষে ভালই হবে।
তাঁবুতে ওরা যে রকম স্বাধীনভাবে রয়েছে, শুনলে তোমরা বিস্মিত হবে। তবে এরা সকলেই বড় ভাল ও শুদ্ধাত্মা, একটু খেয়ালী—এই যা।
আমি এখানে আগামী শনিবার পর্যন্ত আছি—সুতরাং তোমরা যদি পত্র পাওয়া মাত্র জবাব দাও, তবে এখান থেকে চলে যাবার পূর্বেই পেতে পারি। এখানে একটি যুবক রোজ গান করে—সে পেশাদার; তার ভাবী পত্নী ও বোনের সঙ্গে এখানে আছে; ভাবী পত্নীটি বেশ গাইতে পারে, পরমা সুন্দরী। এই সেদিন রাত্রিতে ছাউনির সকলে একটা পাইন গাছের তলায় শুতে গিয়েছিল—আমি রোজ প্রাতে ঐ গাছতলাটায় হিন্দু ধরনে বসে এদের উপদেশ দিয়ে থাকি। অবশ্য আমিও তাদের সঙ্গে গেছলাম—তারকাখচিত আকাশের নীচে জননী ধরিত্রীর কোলে শুয়ে রাতটা বড় আনন্দেই কেটেছিল—আমি তো এই আনন্দের সবটুকু উপভোগ করেছি।
এক বৎসর হাড়ভাঙা খাটুনির পর এই রাত্রিটা যে কি আনন্দে কেটেছিল—মাটিতে শোওয়া, বনে গাছতলায় বসে ধ্যান—তা তোমাদের কি বলব! সরাইয়ে যারা রয়েছে তারা অল্পবিস্তর অবস্থাপন্ন, আর তাঁবুর লোকেরা সুস্থ সবল শুদ্ধ অকপট নরনারী। আমি তাদের সকলকে ‘শিবোঽহং’ করতে শেখাই, আর তারা তাই আবৃত্তি করতে থাকে—সকলেই কি সরল ও শুদ্ধ এবং অসীম সাহসী! সুতরাং এদের শিক্ষা দিয়ে আমিও পরম আনন্দ ও গৌরব বোধ করছি। ভগবানকে ধন্যবাদ যে তিনি আমাকে নিঃস্ব করেছেন; ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, তিনি এই তাঁবুবাসীদের দরিদ্র করেছেন। শৌখীন বাবুরা ও শৌখীন মেয়েরা রয়েছেন হোটেলে; কিন্তু তাঁবুবাসীদের স্নায়ুগুলি যেন লোহা দিয়ে বাঁধানো, মন তিন-পুরু ইস্পাতে তৈরী আর আত্মা অগ্নিময়। কাল যখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল আর ঝড়ে সব উল্টে পাল্টে ফেলছিল, তখন এই নির্ভীক বীরহৃদয় ব্যক্তিগণ আত্মার অনন্ত মহিমায় বিশ্বাস দৃঢ় রেখে ঝড়ে যাতে উড়িয়ে না নিয়ে যায়, সেজন্য তাদের তাঁবুর দড়ি ধরে কেমন ঝুলছিল, তা দেখলে তোমাদের হৃদয় প্রশস্ত ও উন্নত হত। আমি এদের জুড়ি দেখতে ৫০ ক্রোশ যেতে প্রস্তুত আছি। প্রভু তাদের আশীর্বাদ করুন। আশা করি, তোমরা তোমাদের সুন্দর পল্লীনিবাসে বেশ আনন্দে আছ। আমার জন্য এক মুহূর্তও ভেব না—আমাকে তিনি দেখবেনই দেখবেন, আর যদি না দেখেন নিশ্চিত জানব, আমার যাবার সময় হয়েছে—আমি আনন্দে চলে যাব।
‘হে মাধব, অনেকে তোমায় অনেক জিনিষ দেয়—আমি গরীব—আমার আর কিছু নেই, কেবল এই শরীর মন ও আত্মা আছে—এইগুলি সব তোমার পাদপদ্মে সমর্পণ করলাম—হে জগদ্ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর, দয়া করে এইগুলি গ্রহণ করতেই হবে—নিতে অস্বীকার করলে চলবে না।’ আমি তাই আমার সর্বস্ব চিরকালের জন্য দিয়েছি। একটা কথা—এরা কতকটা শুষ্ক ধরনের লোক, আর সমগ্র জগতে খুব কম লোকই আছে, যারা শুষ্ক নয়। তারা ‘মাধব’ অর্থাৎ ভগবান্ যে রসস্বরূপ, তা একেবারে বোঝে না। তারা হয় জ্ঞানচচ্চড়ি অথবা ঝাড়ফুঁক করে রোগ আরাম করা, টেবিলে ভূত নাবানো, ডাইনী-বিদ্যা ইত্যাদির পিছনে ছোটে। এ দেশে যত প্রেম, স্বাধীনতা, তেজের কথা শোনা যায়, আর কোথাও তত শুনিনি, কিন্তু এখানকার লোকে এগুলি যত কম বোঝে, তত আর কোথাও নয়। এখানে ঈশ্বরের ধারণা—হয় ‘সভয়ং বজ্রমুদ্যতং’ অথবা রোগ-আরামকারী শক্তিবিশেষ অথবা কোন প্রকার স্পন্দন, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রভু এদের মঙ্গল করুন। এরা আবার দিনরাত তোতা পাখীর মত ‘প্রেম প্রেম প্রেম’ করে চেঁচাচ্ছে!
এবার তোমাদের সৎ কল্পনা এবং শুভ চিন্তার সামগ্রী খানিকটা দিচ্ছি। তোমরা সুশীলা ও উন্নতহৃদয়া। এদের মত চৈতন্যকে জড়ের ভূমিতে টেনে না এনে—জড়কে চৈতন্যে পরিণত কর, অন্ততঃ প্রত্যহ একবার করে সেই চৈতন্যরাজ্যের—সেই অনন্ত সৌন্দর্য, শান্তি ও পবিত্রতার রাজ্যের একটু আভাস পাবার এবং দিনরাত সেই ভাবভূমিতে বাস করবার চেষ্টা কর। অস্বাভাবিক অলৌকিক কিছু কখনও খুঁজো না, ওগুলি পায়ের আঙুল দিয়েও যেন স্পর্শ কর না। তোমাদের আত্মা দিবারাত্র অবিচ্ছিন্ন তৈলধারার ন্যায় তোমাদের হৃদয়সিংহাসনবাসী সেই প্রিয়তমের পাদপদ্মে গিয়ে সংলগ্ন হতে থাকুক, বাকী যা কিছু অর্থাৎ দেহ প্রভৃতি—তাদের যা হবার হোক গে।
জীবনটা ক্ষণস্থায়ী স্বপ্নমাত্র, যৌবন ও সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়; দিবারাত্র বল, ‘তুমি আমার পিতা, মাতা, স্বামী, দয়িত, প্রভু, ঈশ্বর—আমি তোমা ছাড়া আর কিছু চাই না, আর কিছুই চাই না, আর কিছুই না। তুমি আমাতে, আমি তোমাতে—আমি তুমি, তুমি আমি।’ ধন চলে যায়, সৌন্দর্য বিলীন হয়ে যায়, জীবন দ্রুতগতিতে চলে যায়, শক্তি লোপ পেয়ে যায়, কিন্তু প্রভু চিরদিনই থাকেন—প্রেম চিরদিনই থাকে। যদি এই দেহযন্ত্রটাকে ঠিক রাখতে পারায় কিছু গৌরব থাকে, তবে দেহের অসুখের সঙ্গে সঙ্গে আত্মাতে অসুখের ভাব আসতে না দেওয়া আরও গৌরবের কথা। জড়ের সঙ্গে কোন সম্পর্ক না রাখাই—তুমি যে জড় নও তার একমাত্র প্রমাণ।
ঈশ্বরে লেগে থাকো—দেহে বা অন্য কোথাও কি হচ্ছে, কে গ্রাহ্য করে? যখন নানা বিপদ দুঃখ এসে বিভীষিকা দেখাতে থাকে, তখন বল, ‘হে আমার ভগবান্, হে আমার প্রিয়’; যখন মৃত্যুর ভীষণ যাতনা হতে থাকে, তখনও বল, ‘হে আমার ভগবান্, হে আমার প্রিয়’; জগতে যত রকম দুঃখ বিপদ আসতে পারে তা এলেও বল, ‘হে ভগবান্, হে আমার প্রিয়, তুমি এইখানেই রয়েছ, তোমাকে আমি দেখছি, তুমি আমার সঙ্গে রয়েছ, তোমাকে আমি অনুভব করছি। আমি তোমার, আমায় টেনে নাও, প্রভু; আমি এই জগতের নই, আমি তোমার—তুমি আমায় ত্যাগ কর না।’ হীরার খনি ছেড়ে কাঁচখণ্ডের অন্বেষণে যেও না। এই জীবনটা একটা মস্ত সুযোগ—তোমরা কি এই সুযোগ অবহেলা করে সংসারের সুখ খুঁজতে যাবে? তিনি সকল আনন্দের প্রস্রবণ—সেই পরম বস্তুর অনুসন্ধান কর, সেই পরম বস্তুই তোমাদের জীবনের লক্ষ্য হোক, তা হলে নিশ্চয়ই সেই পরম বস্তু লাভ করবে। সর্বদা আমার আশীর্বাদ জানবে।
বিবেকানন্দ
১০৮*
[হেল ভগিনীগণকে লিখিত]
গ্রীনএকার
১১ অগষ্ট, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনীগণ,
এ যাবৎ গ্রীনএকারেই আছি। জায়গাটি বেশ লাগল। সকলেই খুব সহৃদয়। কেনিলওয়ার্থের মিসেস প্র্যাট-নাম্নী চিকাগোবাসিনী মহিলা আমার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হয়ে পাঁচশত ডলার দিতে চান। আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। আমায় কিন্তু কথা দিতে হয়েছে যে, অর্থের প্রয়োজন হলেই তাঁকে জানাব। আশা করি, ভগবান্ আমাকে সেরূপ অবস্থায় ফেলবেন না। একমাত্র তাঁর সহায়তাই আমার পক্ষে পর্যাপ্ত। মায়ের বা তোমাদের কোন পত্র আমি পাইনি; কলিকাতা থেকে ফনোগ্রাফটির পৌঁছানো সংবাদও আসেনি।
আমার চিঠিতে যদি পীড়াদায়ক কোন কিছু থাকে, আশা করি তোমরা বুঝতে পারবে যে, সেটা স্নেহের ভাব থেকেই লেখা হয়েছিল। তোমাদের দয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা-প্রকাশ অনাবশ্যক। ভগবান্ তোমাদিগকে সুখী করুন। তাঁহার অশেষ আশীর্বাদ তোমাদের ও তোমাদের প্রিয়জনের উপর বর্ষিত হোক। তোমাদের পরিবারবর্গের নিকট আমি চিরঋণী। তোমরা তো তা জানই এবং অনুভব কর। আমি কথায় তা প্রকাশ করতে অক্ষম। রবিবার বক্তৃতা দিতে যাচ্ছি প্লিমাথে কর্ণেল হিগিনসনের ‘Sympathy of Religions’-এর অধিবেশনে। কোরা স্টকহ্যাম্ গাছতলায় আমাদের দলের ছবি তুলেছিলেন, তারই একটি এই সঙ্গে পাঠাচ্ছি। এটা কিন্তু কাঁচা প্রতিলিপিমাত্র, আলোতে অস্পষ্ট হয়ে যাবে। এর চেয়ে ভাল এখন কিছু পাচ্ছি না। অনুগ্রহ করে মিস হাউকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও প্রীতি জানিও। আমার প্রতি তাঁর অশেষ দয়া। বর্তমানে আমার কোন কিছুর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলে সানন্দে জানাব। মনে করছি, মাত্র দু-দিনের জন্য একবার প্লিমাথ থেকে ফিশকিলে যাব। সেখান থেকে তোমাদের আবার পত্র দেব। আশা করি—আশা করি কেন, জানিই তোমরা সুখে আছ, কারণ পবিত্র সজ্জন কখনও অসুখী হয় না। অল্প যে কয় সপ্তাহ এখানে থাকব, আশা করি আনন্দেই কাটবে। আগামী শরৎকালে নিউ ইয়র্কে থাকব। নিউ ইয়র্ক চমৎকার জায়গা। সেখানকার লোকের যে অধ্যবসায়, অন্যান্য নগরবাসিগণের মধ্যে তা দেখা যায় না। মিসেস পটার পামারের এক চিঠি পেয়েছি; অগষ্ট মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য লিখেছেন। মহিলাটি বেশ সহৃদয়, উদার ইত্যাদি। অধিক আর কি? ‘নৈতিক অনুশীলন সমিতি’র (Ethical Culture Society) সভাপতি নিউ ইয়র্কনিবাসী আমার বন্ধু ডাক্তার জেন্স্ এখানে রয়েছেন। তিনি বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেছেন। আমি তাঁর বক্তৃতা শুনতে অবশ্য যাব। তাঁর সঙ্গে আমার মতের খুবই ঐক্য আছে। তোমরা চিরসুখী হও।
তোমাদের চিরশুভার্থী ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
১০৯*
[মিস ইসাবেল ম্যাক্কিণ্ডলিকে লিখিত]
এনিস্কোয়াম্
২০ অগষ্ট, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
তোমার অত্যন্ত সহৃদয় লিপিখানি এনিস্কোয়ামে আমার কাছে যথাসময়ে এসে পৌঁছেছে। আমি পুনরায় ব্যাগলিদের সঙ্গে আছি। তাঁরা যথারীতি সহৃদয়। অধ্যাপক রাইট এখানে ছিলেন না। তবে গত পরশু তিনি এসেছেন এবং একসঙ্গে আমাদের খুব ভাল কাটছে। এভানস্টনের মিঃ ব্রাডলি, যাঁর সঙ্গে তোমার এভানস্টনে সাক্ষাৎ হয়েছিল, এখানে ছিলেন। কয়েকদিন বেশ নৌকাভ্রমণ করা গেছে এবং একদিন সন্ধ্যায় নৌকা উল্টিয়ে কাপড় জামা ও সবকিছু ভিজে একশেষ।
গ্রীনএকারে আমার চমৎকার কেটেছে। তাঁরা সকলেই নিষ্ঠাপরায়ণ ও সহৃদয়। ফ্যানি হার্টলি (Fanny Hartley) ও মিসেস মিল্স্ (Mrs. Mills) মনে হয় এতদিনে বাড়ী ফিরে গিয়েছেন।
ভাবছি এখান থেকে নিউ ইয়র্ক ফিরে যাব, অথবা বষ্টনে মিসেস ওলি বুলের কাছেও যেতে পারি। সম্ভবতঃ তুমি এ দেশের বিখ্যাত বেহালা-বাদক মিঃ ওলি বুলের কথা শুনেছ। ইনি তাঁর বিধবা পত্নী। মহিলাটি খুবই ধর্মশীলা। তিনি কেম্ব্রিজে বাস করেন এবং ভারত থেকে আনা কারুকার্যময় কাঠ দিয়ে তৈরী একখানা সুন্দর বৈঠকখানা তাঁর আছে। তিনি চান আমি যে-কোন সময়ে তাঁর কাছে যাই এবং তাঁর বৈঠকখানাটি বক্তৃতার জন্য ব্যবহার করি। বষ্টন অবশ্য সব-কিছুর জন্যই একটি বৃহৎ ক্ষেত্র, কিন্তু বষ্টনের লোকেরা কোনকিছু যেমন তৎপরতার সঙ্গে গ্রহণ করে, আবার তেমনি তৎপরতার সঙ্গে ত্যাগ করে। অন্য দিকে নিউ ইয়র্কবাসীরা একটু ঢিলে হলেও যখন তারা কোন জিনিষ ধরে, তখন খুব শক্ত করেই ধরে।
আমার স্বাস্থ্য বরাবর বেশ ভাল যাচ্ছে এবং আশা করি, ভবিষ্যতেও যাবে। আমার সঞ্চয় থেকে খরচ করবার কোন কারণ এখনও ঘটেনি, তবু আমি বেশ ভালভাবেই কাটাচ্ছি। অর্থকরী সকল পরিকল্পনা আমি ত্যাগ করেছি, এখন শুধু এক-টুকরো খাদ্য ও মাথার উপর একটু আচ্ছাদন পেলেই সম্পূর্ণ তৃপ্ত থাকব এবং কাজ করে যাব।
আশাকরি গ্রীষ্মাবাসে আনন্দ উপভোগ করছ। দয়া করে আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মিস হাউ (Miss Howe) এবং মিঃ ফ্র্যাঙ্ক হাউকে জানিও।
সম্ভবতঃ পূর্বের চিঠিতে তোমাকে বলা হয়নি যে, আমি কেমন করে গাছের নীচে ঘুমিয়েছি, থেকেছি এবং ধর্মপ্রচার করেছি এবং অন্ততঃ কয়েকদিনের জন্য আর একবার স্বর্গীয় পরিবেশের মধ্যে নিজেকে পেয়েছি।
খুব সম্ভবতঃ আগামী শীতে নিউ ইয়র্ককেই আমার কেন্দ্র করব; এবং তা স্থির করেই তোমাকে জানাব। এ দেশে আরও থাকার বিষয়ে এখনও কিছু স্থির করতে পারিনি। আমি এ সকল ব্যাপার স্থির করতে পারি না। সময়ের অপেক্ষায় থাকব। প্রভু তোমাদের সকলকে চিরকাল আশীর্বাদ করুন, এই হল তোমাদের সদা-স্নেহশীল ভ্রাতার নিরন্তর প্রার্থনা—
বিবেকানন্দ
১১০*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
এনিস্কোয়াম্
মিসেস ব্যাগলির বাটী
৩১ অগষ্ট, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
মান্দ্রাজীদের পত্রখানি কালকের ‘বষ্টন ট্রান্সক্রিপ্ট্’ পত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তোমাকে এক কপি পাঠাবার ইচ্ছা আছে। চিকাগোর কোন কাগজে হয়তো দেখে থাকবে। কুক এণ্ড সন্সের অফিসে আমার চিঠিপত্র থাকবে। অন্ততঃ আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত এখানে আছি, ঐদিন এখানে বক্তৃতা দেব।
দয়া করে কুকের অফিসে আমার পত্রাদি এসেছে কিনা সন্ধান নিও এবং এলে পর এখানে পাঠিয়ে দিও।
কিছুদিন হল তোমাদের কোন খবর পাইনি। মাদার চার্চকে কাল দুখানি ছবি পাঠিয়েছি। আশা করি তোমাদের ভাল লাগবে। ভারতবর্ষের চিঠিপত্রাদির জন্য আমি বিশেষ উদ্বিগ্ন। সকলকে ভালবাসা।
তোমার চিরস্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পুঃ—তোমরা কোথায় আছ, না জানায় আরও যা কিছু পাঠাবার আছে, তা পাঠাতে পারছি না।
বি
১১১*
যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা
৩১ অগষ্ট, ১৮৯৪
প্রিয় আলাসিঙ্গা,
এইমাত্র আমি ‘বষ্টন ট্রান্সক্রিপ্ট’-এ মান্দ্রাজের সভার প্রস্তাবগুলি অবলম্বন করে একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ দেখলাম। আমার নিকট ঐ প্রস্তাবগুলির কিছুই পৌঁছায়নি। যদি তোমরা ইতিপূর্বেই পাঠিয়ে থাকো, তবে শীঘ্রই পৌঁছবে। প্রিয় বৎস, এ পর্যন্ত তোমরা অদ্ভুত কর্ম করেছ। কখনও কখনও একটু ঘাবড়ে গিয়ে যা লিখি, তাতে কিছু মনে কর না। মনে করে দেখ, দেশ থেকে ১৫,০০০ মাইল দূরে একলা রয়েছি—গোঁড়া শত্রুভাবাপন্ন খ্রীষ্টানদের সঙ্গে আগাগোড়া লড়াই করে চলতে হয়েছে—এতে কখনও কখনও একটু ঘাবড়ে যেতে হয়। হে বীরহৃদয় বৎস, এইগুলি মনে রেখে কাজ করে যাও। বোধ হয় ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছ থেকে শুনেছ, জি. জি.-র কাছ থেকে একখানি সুন্দর পত্র পেয়েছিলাম। এমন করে ঠিকানাটা লিখেছিল যে, আমি মোটেই বুঝতে পারিনি। তাইতে তার কাছে সাক্ষাৎভাবে জবাব দিতে পারিনি। তবে সে যা যা চেয়েছিল, আমি সব করেছি—আমার ফটোগ্রাফগুলি পাঠিয়েছি ও মহীশূরের রাজাকে পত্র লিখেছি। আমি খেতড়ির রাজাকে একটা ফনোগ্রাফ পাঠিয়েছি, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্তিস্বীকার-পত্র এখনও পাইনি। খবরটা নিও তো। আমি কুক এণ্ড সন্স, র্যামপার্ট রো, বোম্বাই ঠিকানায় তা পাঠিয়েছি। ঐ সম্বন্ধে সব খবর জিজ্ঞাসা করে রাজাকে একখানা পত্র লিখো। ৮ই জুন তারিখে লেখা রাজার একখানা পত্র পেয়েছি। যদি ঐ তারিখের পর কিছু লিখে থাকেন, তা এখনও পাইনি।
আমার সম্বন্ধে ভারতের কাগজে যা কিছু বেরোবে সেই কাগজখানাই আমায় পাঠাবে। আমি কাগজটাতেই তা পড়তে চাই—বুঝলে? চারুচন্দ্রবাবু, যিনি আমার প্রতি খুব সহৃদয় ব্যবহার করেছেন, তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখবে। তাঁকে আমার হৃদয়ের ধন্যবাদ জানাবে, কিন্তু—(চুপি চুপি বলছি) দুঃখের বিষয় তাঁর কথা আমার কিছু মনে পড়ছে না। তুমি তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ আমায় জানাবে কি? থিওসফিষ্টরা এখন আমায় পছন্দ করছে বটে, কিন্তু এখানে তাদের সংখ্যা সর্বসুদ্ধ ৬৫০ জন মাত্র। তারপর ক্রিশ্চান সায়েণ্টিস্টরা আছেন, তাঁরা সকলেই আমায় পছন্দ করেন। তাঁদের সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ হবে। আমি উভয় দলের সঙ্গেই কাজ করি বটে, কিন্তু কারও দলে যোগ দিই না, আর ভগবৎকৃপায় উভয় দলকেই ঠিক পথে গড়ে তুলব, কারণ তারা কতকগুলো আধা-উপলব্ধ সত্য কপচাচ্ছে বৈ তো নয়।
এই পত্র তোমার কাছে পৌঁছবার পূর্বেই আশা করি নরসিংহ টাকাকড়ি ইত্যাদি সব পাবে।
আমি ‘ক্যাটের’ কাছ থেকে এক পত্র পেলাম, কিন্তু তার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে একখানা বই লিখতে হয়, সুতরাং তোমার এই পত্রের মধ্যেই তাকে আশীর্বাদ জানাচ্ছি, আর তোমায় স্মরণ করিয়ে দিতে বলছি যে, আমাদের উভয়ের মতামত বিভিন্ন হলেও তাতে কিছু এসে যাবে না—সে একটা বিষয় একভাবে দেখছে, আমি না হয় আর একভাবে দেখছি, এই এক জিনিষকে বিভিন্নভাবে দেখা স্বীকার করে নিলেই তো আমাদের উভয়ের ভাবের এক রকম সমন্বয় হল। সুতরাং বিশ্বাস সে যাই করুক, তাতে কিছু এসে যায় না—কাজ করুক।
বালাজী, জি. জি., কিডি, ডাক্তার ও আমাদের সব বন্ধুকে আমার ভালবাসা জানাবে, আর যে-সকল স্বদেশহিতৈষী মহাত্মা তাঁদের দেশের জন্য মতবিভিন্নতা গ্রাহ্য না করে সাহসের ও মহৎ অন্তঃকরণের পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদেরও আমার হৃদয়ের অগাধ ভালবাসা জানাবে।
একটি ছোটখাট সমিতি প্রতিষ্ঠা কর, তার মুখপত্রস্বরূপ একখানা সাময়িক পত্র বার কর—তুমি তার সম্পাদক হও। কাগজটা বার করবার ও কাজটা আরম্ভ করে দেবার জন্য খুব কমপক্ষে কত খরচা পড়ে, হিসেব করে আমায় জানাবে, আর সমিতিটার নাম ও ঠিকানা জানাবে। আমি তা হলে তার জন্যে টাকা পাঠাব—শুধু তাই নয়, আমেরিকার আরও অনেককে ধরে তাঁরা যাতে বছরে মোটা চাঁদা দেন, তা করব। কলিকাতায়ও ঐ রকম করতে বল। আমাকে ব—র ঠিকানা পাঠাবে। সে বেশ ভাল ও মহৎ লোক। সে আমাদের সঙ্গে মিশে বেশ সুন্দর কাজ করবে।
তোমাকে সমস্ত জিনিষটার ভার নিতে হবে, সর্দার হিসাবে নয়, সেবকভাবে—বুঝলে? এতটুকু কর্তৃত্বের ভাব দেখালে লোকের মনে ঈর্ষার ভাব জেগে উঠবে—তাতে সব মাটি হয়ে যাবে। যে যা বলে, তাইতে সায় দিয়ে যাও; কেবল চেষ্টা কর—আমার সব বন্ধুদের একসঙ্গে জড়ো করে রাখতে। বুঝলে? আর আস্তে আস্তে কাজ করে তার উন্নতির চেষ্টা কর। জি.জি. ও অন্যান্য যাদের এখনই রোজগার করবার প্রয়োজন নেই, তারা এখন যেমন করছে তেমনি করে যাক অর্থাৎ চারিদিকে ভাব ছড়াক। জি.জি. মহীশূরে বেশ কাজ করছে। এই রকমই তো করতে হবে। মহীশূর কালে আমাদের একটা বড় আড্ডা হয়ে দাঁড়াবে।
আমি এখন আমার ভাবগুলি পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ করব ভাবছি—তারপর আগামী শীতে সারা দেশটা ঘুরে সমিতি স্থাপন করব। এ একটা মস্ত কার্যক্ষেত্র, আর এখানে যত কাজ হতে থাকবে, ততই ইংলণ্ড এই ভাব গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবে। হে বীরহৃদয় বৎস, এতদিন পর্যন্ত বেশ কাজ করেছ। প্রভু তোমাদের ভেতর সব শক্তি দিবেন।
আমার হাতে এখন ৯০০০৲ টাকা আছে—তার কতকটা ভারতের কাজ আরম্ভ করে দেবার জন্য পাঠাব, আর এখানে অনেককে ধরে তাদের দিয়ে বাৎসরিক ও ষাণ্মাসিক বা মাসিক হিসাবে টাকাকড়ি পাঠাবার বন্দোবস্ত করব। এখন তুমি সমিতিটা খুলে ফেল ও কাগজটা বের করে দাও এবং আর আর আনুষঙ্গিক বা আবশ্যক, তার তোড়জোড় কর। এ ব্যাপারটা খুব অল্প লোকের ভেতর গোপন রেখো; সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু মান্দ্রাজে একটা মন্দির করবার জন্য মহীশূর ও অন্যান্য স্থান থেকে টাকা তোলবার চেষ্টা কর—তাতে একটা পুস্তকালয় থাকবে, অফিস ও ধর্মপ্রচারকদের অর্থাৎ যদি কোন সন্ন্যাসী বা বৈরাগী এসে পড়ে, তাদের জন্য কয়েকটা ঘর থাকবে। এইরূপে আমরা ধীরে ধীরে কাজে অগ্রসর হব।
সদা স্নেহাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
পুঃ—তুমি তো জান টাকা রাখা—এমন কি, টাকা ছোঁয়া পর্যন্ত আমার পক্ষে বড় মুশকিল। উহা আমার পক্ষে বেজায় বিরক্তিকর আর ওতে মনকে বড় নীচু করে দেয়। সেই কারণে কাজের দিকটা এবং টাকাকড়ি-সংক্রান্ত ব্যাপারটার বন্দোবস্ত করবার জন্য তোমাদিগকে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে একটা সমিতি স্থাপন করতেই হবে। এখানে আমার যে-সব বন্ধু আছেন, তাঁরাই আমার সব টাকাকড়ির বন্দোবস্ত করে থাকেন—বুঝলে? এই ভয়ানক টাকাকড়ির হাঙ্গামা থেকে রেহাই পেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচব। সুতরাং যত শীঘ্র তোমরা সঙ্ঘবদ্ধ হতে পার এবং তুমি সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ হয়ে আমার বন্ধু ও সহায়কদের সঙ্গে সাক্ষাৎভাবে পত্রাদি ব্যবহার করতে পার, ততই তোমাদের ও আমার—উভয় পক্ষের মঙ্গল। এইটি শীগগির করে ফেলে আমাকে লেখো। সমিতির একটা অসাম্প্রদায়িক নাম দিও—আমার মনে হচ্ছে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামটা হলে মন্দ হয় না। ঐ নামটা দিলে তাতে হিন্দুদের মনে কোন আঘাত না দিয়ে বৌদ্ধদেরও আমাদের দিকে আকৃষ্ট করবে। ‘প্রবুদ্ধ’ শব্দটার ধ্বনিতেই (‘প্র+বুদ্ধ’) ‘বুদ্ধের’ অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে ‘ভারত’ জুড়লে হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্মিলন বোঝাতে পারে। যাই হোক, আমাদের সকল বন্ধুদের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ কর—তাঁরা যা ভাল বিবেচনা করেন।
মঠে আমার গুরুভাইদেরও এইরূপে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজকর্ম করতে বলবে, তবে টাকাকড়ির কাজ সব তোমাকেই করতে হবে। তাঁরা সন্ন্যাসী, তাঁরা টাকাকড়ি ঘাঁটা পছন্দ করবেন না। আলাসিঙ্গা, জেনে রেখো ভবিষ্যতে তোমায় অনেক বড় বড় কাজ করতে হবে। অথবা তুমি যদি ভাল বোঝ, কতকগুলি বড়লোককে ধরে তাদের রাজী করিয়ে সমিতির কর্মকর্তারূপে তাদের নাম প্রকাশ করবে। আসল কাজ করতে হবে তোমাকে—তাদের নামে অনেক কাজ হবে। তোমার যদি সাংসারিক কাজকর্ম খুব বেশী থাকে এবং তার দরুন যদি এ-সব করবার তোমার সময় না থাকে, তবে জি. জি. সমিতির এই বৈষয়িক দিকটার ভার নিক—আর আমি আশা করি, পেট চালাবার জন্যে যাতে কলেজের কাজের ওপর তোমায় নির্ভর না করতে হয়, তার চেষ্টা করব। তা হলে তুমি নিজে উপোস না করে আর পরিবারদের উপোস না করিয়ে সর্বান্তঃকরণে এই কাজে নিযুক্ত হতে পারবে। কাজে লাগো, বৎস, কাজে লাগো। কাজের কঠিন ভাগটা অনেকটা সিধে হয়ে এসেছে। এখন প্রতি বৎসর কাজ গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাবে। আর তোমরা যদি কোনরকমে কাজটা চালিয়ে যেতে পার, তাহলে আমি ভারতে ফিরে গেলে কাজের দ্রুত উন্নতি হতে থাকবে। তোমরা যে এতদূর করেছ, এই ভেবে খুব আনন্দ কর। যখন মনে নিরাশ ভাব আসবে, তখন ভেবে দেখো, এক বছরের ভেতর কত কাজ হয়েছে। আমরা নগণ্য অবস্থা থেকে উঠেছি—এখন সমগ্র জগৎ আমাদের দিকে আশায় চেয়ে রয়েছে। শুধু ভারত নয়, সমগ্র জগৎ আমাদের কাছ থেকে বড় বড় জিনিষ আশা করছে। নির্বোধ মিশনরীরা, ম— ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিগণ কেহই সত্য, প্রেম ও অকপটতার শক্তিকে বাধা দিতে পারবে না। তোমাদের কি মন মুখ এক হয়েছে? তোমরা কি মৃত্যুভয় পর্যন্ত তুচ্ছ করে নিঃস্বার্থভাবে থাকতে পার? তোমাদের হৃদয়ে প্রেম আছে তো? যদি এইগুলি তোমাদের থাকে, তবে তোমাদের কোন কিছুকে—এমন কি মৃত্যুকে পর্যন্ত ভয় করবার দরকার নেই। এগিয়ে যাও, বৎসগণ। সমগ্র জগৎ জ্ঞানালোক চাইছে—উৎসুক নয়নে তার জন্য আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেবল ভারতেই সে জ্ঞানালোক আছে—ইন্দ্রজাল, মূক অভিনয় বা বুজরুকিতে নয়, আছে প্রকৃত ধর্মের মর্মকথায়, উচ্চতম আধ্যাত্মিক সত্যের মহিমময় উপদেশে। জগৎকে সেই শিক্ষার ভাগী করবার জন্যই প্রভু এই জাতটাকে নানা দুঃখদুর্বিপাকের মধ্যে দিয়েও আজ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছেন। এখন সময় হয়েছে। হে বীরহৃদয় যুবকগণ, তোমরা বিশ্বাস কর যে, তোমরা বড় বড় কাজ করবার জন্য জন্মেছ। কুকুরের ‘ঘেউ ঘেউ’ ডাকে ভয় পেও না—এমন কি আকাশ থেকে প্রবল বজ্রাঘাত হলেও ভয় পেও না—খাড়া হয়ে ওঠ, ওঠ, কাজ কর।
তোমাদের
বিবেকানন্দ
১১২*
[মিঃ ল্যাণ্ডস্বার্গকে৬১ লিখিত]
বেল ভিউ হোটেল, বষ্টন
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
অভিন্নহৃদয়েষু,
তুমি কিছু মনে করিও না, গুরু হিসাবে তোমাকে উপদেশ দিবার অধিকার আমার আছে বলিয়াই আমি জোর করিয়া বলিতেছি যে, তুমি নিজের ব্যবহারের জন্য কিছু বস্ত্রাদি অবশ্য ক্রয় করিবে, কারণ এগুলির অভাব এদেশে কোন কাজ করার পক্ষে তোমার প্রতিবন্ধকস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইবে। একবার কাজ শুরু হইয়া গেলে অবশ্য তুমি ইচ্ছামত পোষাক পরিধান করিতে পার, তাহাতে কেহ কোন আপত্তি করিবে না।
আমাকে ধন্যবাদ দিবার কোন প্রয়োজন নাই, কারণ ইহা আমার কর্তব্যমাত্র। হিন্দু আইন অনুসারে শিষ্যই সন্ন্যাসীর উত্তরাধিকারী, যদি সন্ন্যাসগ্রহণের পূর্বে তাহার কোন পুত্রও জন্মিয়া থাকে, তথাপি সে উত্তরাধিকারী নহে। এ সম্বন্ধ খাঁটি আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ—ইয়াঙ্কির ‘অভিভাবকগিরি’ ব্যবসা নহে, বুঝিতেই পারিতেছ।
তোমার সাফল্যের জন্য প্রার্থনা ও আশীর্বাদ করি। ইতি
তোমাদের
বিবেকানন্দ
১১৩*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
হোটেল বেল ভিউ
বীকন ষ্ট্রীট, বষ্টন
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
প্রিয় ভগিনী,
আজ সকালে তোমার প্রীতিপূর্ণ পত্রখানি পেলাম। প্রায় সপ্তাহখানেক হল এই হোটেলে আছি। আরও কিছুকাল বষ্টনে থাকব। গাউন তো এতগুলো রয়েছে, সেগুলি বয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। এনিস্কোয়ামে যখন খুব ভিজে যাই, তখন পরনে ছিল সেই ভাল কালো পোষাক—যেটি তোমার খুব পছন্দ। মনে হয়, এটি আর নষ্ট হচ্ছে না; আমার নির্গুণ ব্রহ্মধ্যান এর ভিতরেও প্রবিষ্ট হয়েছে! গ্রীষ্মকাল খুব আনন্দে কাটিয়েছ জেনে বিশেষ খুশী হলাম। আমি তো ভবঘুরের মত ঘুরেই বেড়াচ্ছি। এবহিউ-লিখিত তিব্বতদেশীয় ভবঘুরে লামাদের বর্ণনা সম্প্রতি পড়ে খুব আমোদ পেলাম—আমাদের সন্ন্যাসী-সম্প্রদায়ের যথার্থ চিত্র। লেখক বলেন এরা অদ্ভুত লোক, খুশীমত এসে হাজির হয়, যার সঙ্গে হোক, খায়—নিমন্ত্রিত বা অনিমন্ত্রিত। যেখানে খুশী থাকবে, যেখানে খুশী চলে যাবে। এমন পাহাড় নেই যা তারা আরোহণ করেনি, এমন নদী নেই যা তারা অতিক্রম করেনি। তাদের অবিদিত কোন জাতি নেই, অকথিত কোন ভাষা নাই। লেখকের অভিমত, যে শক্তিবশে গ্রহগুলি সদা ঘূর্ণায়মান তারই কিয়দংশ ভগবান্ এদের দিয়ে থাকবেন। আজ এই ভবঘুরে লামাটি লেখবার আগ্রহ দ্বারা আবিষ্ট হয়ে সোজা একটি দোকানে গিয়ে লেখবার যাবতীয় উপকরণ সহ বোতাম-লাগানো কাঠের ছোট দোয়াত সমেত একটি পোর্টফোলিও কিনে এনেছে। শুভ সঙ্কল্প। মনে হয়, গত মাসে ভারত হতে প্রচুর চিঠিপত্র এসেছে। আমার দেশবাসিগণ আমার কাজের এরূপ তারিফ করায় খুব খুশী হলাম। তারা যথেষ্ট করেছে। আর কিছু তো লেখবার দেখতে পাচ্ছি না। অধ্যাপক রাইট, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা খুব খাতির যত্ন করেছিলেন, সর্বদা যেমন করে থাকেন। ভাষায় তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারছি না। এ পর্যন্ত সবই ভাল যাচ্ছে। তবে একটু বিশ্রী সর্দি হয়েছিল। এখন প্রায় নেই। অনিদ্রার জন্য ক্রিশ্চান সায়েন্স অনুসরণ করে বেশ ফল পেয়েছি। তোমরা সুখী হও। ইতি
চিরস্নেহশীল ভ্রাতা
বিবেকানন্দ
পুঃ—মাকে জানিও, এখন আর কোট চাই না।
বি
১১৪*
[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]
হোটেল বেল ভিউ
বীকন ষ্ট্রীট, বষ্টন
১৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪
মা সারা,
আমি তোমাকে মোটেই ভুলে যাইনি। তুমি কি মনে কর, আমি কখনও এতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারি? তুমি আমাকে তোমার ঠিকানা দাওনি, তবু মিস ফিলিপ্স্ ল্যাণ্ডসবার্গকে প্রেরিত সংবাদ থেকে তোমার খবর পাচ্ছি। বোধ হয় মান্দ্রাজ থেকে আমায় যে অভিনন্দন পাঠিয়েছে, তা তুমি দেখেছ। আমি তোমাকে পাঠাবার জন্য খানকতক পাঠাচ্ছি ল্যাণ্ডসবার্গের কাছে।
হিন্দু সন্তান কখনও মাকে টাকা ধার দেয় না, সন্তানের ওপর মায়ের সর্ববিধ অধিকার আছে, সন্তানেরও মায়ের ওপর। সেই তুচ্ছ ডলার কটি আমাকে ফিরিয়ে দেবার কথা বলাতে তোমার ওপর আমার বড় রাগ হয়েছে। তোমার ধার আমি কোন কালে শুধতে পারব না।
এখন আমি বষ্টনের কয়েক জায়গায় বক্তৃতা দিচ্ছি। এখন চাই এমন একটা জায়গা, যেখানে বসে আমার ভাবরাশি লিপিবদ্ধ করতে পারি। বক্তৃতা যথেষ্ট হল, এখন আমি লিখতে চাই। আমার বোধ হয়, তার জন্য আমাকে নিউ ইয়র্কে যেতে হবে। মিসেস গার্নিস আমার প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করেছিলেন এবং তিনি সদাই আমায় সাহায্য করতে ইচ্ছুক। আমি মনে করছি, তাঁর ওখানে গিয়ে বসে বসে বই লিখব।
তোমার সদা স্নেহাস্পদ
বিবেকানন্দ
পুঃ—অনুগ্রহ করে আমায় লিখবে, গার্নসিরা শহরে ফিরেছে, না এখনও ফিশকিলে আছে। ইতি
বি
১ | Paramahamsa Ramakrishna—(Theistic Quarterly Review, Oct. 1879) |
২ | Asiatic Quarterly Review. |
৩ | পুনর্জন্মবাদ |
৪ | আলোচ্য গ্রন্থ—The Life and Sayings of Ramakrishna by Prof. Max Müller Pp. 1 and 2. |
৫ | ‘A Real Mahatman in Nineteenth Century, August, 1896 |
৬ | আলোচ্য গ্রন্থ—Pp. 10 and 11 |
৭ | আলোচ্য গ্রন্থ—p. 65 |
৮ | আপ্তঃখলু সাক্ষাৎকৃতধর্মা যথাদৃষ্টস্য … ঋষ্যার্যম্লেচ্ছানাং সমানাং লক্ষণম্ ...। বাৎস্যায়ন ভাষ্য। [১।১।৭] |
৯ | He that followeth me &c.—যোহন, ৮।১২
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া। মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে॥—গীতা, ৭।১৪ আমার সত্ত্বাদি ত্রিগুণময়ী মায়া নিতান্ত দুরতিক্রম; যে-সকল ব্যক্তি কেবল আমারই শরণাগত হইয়া ভজনা করে, তাহারাই কেবল এই সুদুস্তর মায়া হইতে উত্তীর্ণ হইয়া থাকে। |
১০ | ধ্যাত্বৈবাত্মানমহর্নিশং মুনিঃ।
তিষ্ঠেৎ সদা মুক্তসমস্তবন্ধনঃ॥—রামগীতা মুনি এই প্রকারে অহর্নিশ পরমাত্মার ধ্যান দ্বারা সমস্ত সংসারবন্ধন হইতে মুক্ত হন। |
১১ | ইস্রায়েলরা যখন মরুভূমিতে আহারাভাবে কষ্ট পাইয়াছিল, সেই সময় ঈশ্বর তাহাদের নিমিত্ত একপ্রকার খাদ্য বর্ষণ করেন—তাহার নাম ‘মান্না’ (manna)। |
১২ | শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ।—গীতা শ্রবণ করিয়াও অনেকে ইহাকে বুঝিতে পারে না। ন গচ্ছতি বিনা পানং ব্যাধিরৌষধশব্দতঃ বিনাঽপরোক্ষানুভবং ব্রহ্মশব্দৈর্ন মুচ্যতে॥—বিবেকচূড়ামণি, ৬৪ ঔষধ কথাটিতেই ব্যাধি দূর হয় না, অপরোক্ষানুভব ব্যতিরেকে ‘ব্রহ্ম ব্রহ্ম’ বলিলেই মুক্তি হইবে না। শ্রুতেন কিং যো ন চ ধর্মমাচরেৎ।—মহাভারত যদি ধর্ম আচরণ না কর, বেদ পড়িয়া কি হইবে? |
১৩ | খ্রীষ্টিয়ান মতে জনকেশ্বর (পিতা), পবিত্র আত্মা এবং তনয়েশ্বর (পুভ্র)—ইনি একে তিন, তিনে এক। |
১৪ | বাগ্বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্রব্যাখ্যানকৌশলম্ ।
বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বদ্ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে॥—বিবেকচূড়ামণি, ৬০ নানাবিধ বাক্যবিন্যাস এবং শব্দচ্ছটা যে প্রকার শাস্ত্রব্যাখ্যার কেবল কৌশলমাত্র, সেই প্রকার পণ্ডিতদিগের পাণ্ডিত্যপ্রকর্ষ কেবল ভোগের নিমিত্ত, মুক্তির নিমিত্ত নহে। |
১৫ | কোরিন্থিয়ান, ১৩।২ |
১৬ | Vanity of vanities, all is vanity, &c.-—ইক্লিয়াজিয়াষ্টিক, ১।২
কে সন্তি সন্তোঽখিলবীতরাগাঃ। অপাস্তমোহাঃ শিবতত্ত্বনিষ্ঠাঃ॥—মণিরত্নমালা, শঙ্করাচার্য যাঁহারা তাবৎ সাংসারিক বিষয়ে আশাশূন্য হইয়া একমাত্র শিবতত্ত্বে নিষ্ঠাবান্, তাঁহারাই সাধু। |
১৭ | ইক্লিজিয়াষ্টিক্, ১।৮ |
১৮ | ন জাতু কামঃ কামানামূপভোগেন শাম্যতি।
হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবর্ধতে।।—মহাভারত কাম্যবস্তুর উপভোগের দ্বারা নিবৃত্তি হয় না, পরন্তু অগ্নিতে ঘৃতদানের ন্যায় উহা অত্যন্ত বর্ধিত হয়। |
১৯ | খ্রীষ্টিয় মতে—মহাপ্রলয়ের দিনে ঈশ্বর সকলের বিচার করিবেন এবং পাপ অথবা পুণ্যানুসারে নরক অথবা স্বর্গ প্রদান করিবেন। |
২০ | ইনিই ঈশারূপে অবতার হন। |
২১ | ‘নৈষা তর্কেণ মতিরাপনেয়া’—কঠ উপঃ, ১।২।৯
তর্কের দ্বারা ভগবৎ-সম্বন্ধীয় জ্ঞানলাভ করা যায় না। |
২২ | আদর্দীত শুভাং বিদ্যাং প্রযত্নাদবরাদপি।—মনু নীচের নিকট হইতেও যত্নপূর্বক উত্তম বিদ্যা গ্রহণ করিবে। |
২৩ | ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোঽনুবিধীয়তে ।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি॥—গীতা, ২।৬৭ সঞ্চরমাণ ইন্দ্রিয়দিগের মধ্যে মন যাহারই পশ্চাৎ গমন করে, সেইটিই—বায়ু জলে যে প্রকারে নৌকাকে মগ্ন করে তদ্রূপ—তাহার প্রজ্ঞা বিনাশ করে। |
২৪ | ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে ।
সঙ্গাৎ সংজায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোঽভিজায়তে॥ ক্রোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ। স্মৃতিভ্রংশাৎ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি॥—গীতা, ২।৬২-৬৩ বাহ্য বস্তুর চিন্তা করিলে তাহাদের সঙ্গ উপস্থিত হয়, তাহা হইতে বাসনা এবং অতৃপ্ত বাসনায় ক্রোধ উপস্থিত হয়। ক্রোধ হইতে মোহ এবং মোহ হইতে স্মৃতিধ্বংস হয়। স্মৃতিধ্বংস হইলে নিত্যানিত্য-বিবেক নষ্ট হয় এবং তাহা দ্বারা সম্পূর্ণ পতন উপস্থিত হয়। |
২৫ | যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ।
ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ॥—গীতা, ২।৬০ যে-সকল দৃঢ় পুরুষ সংযমী হইবার জন্য যত্ন করিতেছেন, অতি বলবান্ ইন্দ্রিয়গ্রাম তাঁহাদেরও মনকে হরণ করে। |
২৬ | বৈবাহিক |
২৭ | ঊর্ধ্বগামিনী ও অধোগামিনী। |
২৮ | Zoroaster বা Zarathustra কুলগত নাম; স্পিতামা (=শ্বেত) ইঁহার নাম, ইনি পারসীদিগের প্রাচীন গুরু। |
২৯ | দ্বিরাগমন |
৩০ | অগষ্ট, ১৯০০ |
১ | Sea-sickness—জাহাজের দুলুনিতে মাথাঘোরা এবং বমনাদি হওয়া। |
২ | তুলসীদাসের দোঁহার মধ্যে এই বাক্যটি আছে। |
৩ | আড়কাটী—যিনি বন্দর হইতে সমুদ্র পর্যন্ত জলের গভীরতাদি জানেন এবং বন্দরের নিকটে জাহাজ চালাইবার ভার লন; pilot. |
৪ | ঐতিহাসিক ইলিয়টের মতে লালবেগীদের (ঝাড়ুদার মেথর সম্প্রদায়বিশেষ) উপাস্য আদিপুরুষ বা কুলদেবতা লালবেগ ও উত্তরপশ্চিমের লালগুরু (রাক্ষস অরণ্য কিরাত) অভিন্ন। বারাণসীবাসী লালবেগীদের মতে পীর জহরই (চিস্তিয়া সাধু সৈয়দ সাহ্ জুহুর) লালবেগ। |
৫ | দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশের্ধারানিবদ্ধেব কলঙ্করেখা॥—রঘুবংশ। |
৬ | কাশ্মীর ভ্রমণ এবং ঐ দেশের পুরাবৃত্ত পাঠ করিয়া পরে স্বামীজীর এই বিষয়ে মত পরিবর্তিত হইয়াছিল। মহাকবি কালিদাস অনেক দিন পর্যন্ত কাশ্মীর দেশের শাসনকর্তার পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন—এ কথা ঐ দেশের ইতিহাসপাঠে অবগত হওয়া যায়। রঘুবংশাদি-বিবৃত হিমালয়-বর্ণনা কাশ্মীরখণ্ডের হিমালয়ের দৃশ্যের সহিত অনেক স্থলে মিলে। কিন্তু কালিদাস কখনও সমুদ্র দেখিয়াছিলেন কিনা, সে বিষয়ে কোন প্রমাণ আমরা এ পর্যন্ত পাই নাই। |
৭ | শ্রীমৎশঙ্করাচার্যকৃত ‘শিবাপরাধভঞ্জনস্তোত্র’। |
৮ | জলাঙ্গী নদী নবদ্বীপ হইতে কিছু দূরে ভাগীরথীর সহিত মিলিত হইয়াছে। এই সঙ্গমের পর হইতেই ভাগীরথীর নাম হুগলি হইয়াছে। |
৯ | মজওয়ার কাহারওয়া জাল বিনুরে।
দিন্কো মারে মছলি, রাতকো বিনু জাল। এয়সা দিকদারি কিয়া জিউকা জঞ্জাল॥ —ইত্যাদি গানটি গাড়োয়ানরা প্রায়ই গাহিত। |
১০ | Unionist Party. |
১১ | বি. আই. এস. এন. কোম্পানীর একখানি জাহাজের নাম। ঐ জাহাজে স্বামীজী দ্বিতীয়বার বিলাত যাত্রা করেন। |
১২ | সমুদ্রের যেখানে কোন দিকের কুলকিনারা দেখা যায় না, অথবা যেখান হইতে নিকটবর্তী উপকূল দুই-তিন দিনের পথ। |
১৩ | গুরুজীর জয়, গুরুই ধন্য হউন, গুরুই জয়যুক্ত হউন। উহা পঞ্জাব প্রদেশের শিখ-সম্প্রদায়ের উৎসাহবাক্য এবং রণসঙ্কেত। |
১৪ | অতিরিক্ত ঝাল-তেঁতুল-সংযুক্ত অড়হর দালের ঝোল বিশেষ। উহা দক্ষিণীদের প্রিয় খাদ্য। ‘মুড়গ্’ অর্থে কালো মরিচ ও ‘তন্নি’ অর্থে দাল। |
১৫ | নয়মার্গ—নীতিমার্গ। |
১৬ | কাহারও কাহারও মতে বেদভাষ্যকার সায়ণ বিদ্যারণ্যমুনির ভ্রাতা। |
১৭ | স্বামীজীর অন্যতম শিষ্য স্বামী নির্ভয়ানন্দ। |
১৮ | হাইপেশিয়া(Hypatia) |
১৯ | যবন, গ্রীক |
২০ | Histoire Anciene Oriental |
২১ | সওয়ায়—(আরবী শব্দ) ব্যতীত, ছাড়া। |
২২ | হরপ্পা এবং মহেঞ্জোডারো গ্রামে ভূগর্ভে খ্রীঃ পূঃ ৩৩০০ বৎসর পূর্বেকার সভ্যতার নিদর্শনসকল পাওয়া গিয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ইহাকে সিন্ধু-উপত্যকার সভ্যতা বলিয়াছেন। |
২৩ | Rosetta Stone |
২৪ | Hieroglyphics |
২৫ | Baal, Moloch, Istarte,Damuzi |
২৬ | Adunoi or Adonis |
২৭ | Yave-Moloch |
২৮ | Israel, Ephraim |
২৯ | Josephus, Philo |
৩০ | Hillel |
৩১ | Monsieur Jules Bois |
৩২ | Mademoiselle Calve |
৩৩ | Sarah Bernhardt |
৩৪ | পরে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড |
৩৫ | Jean de Reszke, Plancon |
৩৬ | Pere Hyacinthe |
৩৭ | Monsieur Loyson |
৩৮ | পাশ্চাত্য জাতির মধ্যে একটি রীতি এই—একটি দলের মধ্যে সকলেই যে ভাষা জানেন, একত্র অবস্থানকালে সেই ভাষায় কথা না কওয়া অসভ্যতার পরিচায়ক। |
৩৯ | Germanised |
৪০ | চীনের যুদ্ধক্ষেত্র |
৪১ | Dejeuner |
৪২ | The sick man of Europe |
৪৩ | Sardou |
৪৪ | L’aiglon (the Young Eagle) |
৪৫ | Asia Minor |
৪৬ | Rumania |
১ | গয়াসুর ও বুদ্ধদেবের অভিন্নত্ব সম্বন্ধে স্বামীজীর মত পরে পরিবর্তিত হয়। তিনি দেহত্যাগের অল্পদিন পূর্বে কাশীধাম হইতে জনৈক শিষ্যকে যে পত্র লেখেন, তাহাতে একস্থানে বলিয়াছেনঃ অগ্নিপুরাণে গয়াসুর সম্বন্ধে যে উল্লেখ আছে, তাহাতে (যেমন ডাঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মত) বুদ্ধদেবকে লক্ষ্য করা হয় নাই, উহা কেবল পূর্ব হইতে প্রচলিত একটি উপাখ্যান মাত্র। ... বুদ্ধ যে গয়শীর্ষ পর্বতে বাস করিতে গিয়াছিলেন, তাহাতে ঐ স্থান পূর্ব হইতেই ছিল, প্রমাণিত হইতেছে।—উদ্বোধন, ৮ম বর্ষ, ৫৮৮ পৃঃ। |
২ | গুরুং বা বালবৃদ্ধৌ বা ব্রাহ্মণং বা বহুশ্রুতম্। আততায়িনমায়ান্তং হন্যাদেবাবিচারয়ন্॥—মনু, ৮, ৩৫০ আততায়ী ছয় প্রকারঃ অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ। ক্ষেত্রদারপহারী চ ষড়েতে হ্যাততায়িনঃ॥—শুক্রনীতি |
৩ | জৈমিনিসূত্র, ১।২।১ |
৪ | শঙ্করাচার্য-কৃত ‘মোহমুদ্গর’ ৫ |
৫ | গীতা, ৩।২৪ |
৬ | Forty-one Years in India, Lord Roberts—Chapters 30 & 31 |
৭ | ‘গড্ডলিকা-প্রবাহ’—যেমন একটি মেষের অনুকরণে অপর মেষসমূহ তদনুরূপ কার্য করিতে প্রবৃত্ত হয়। |
৮ | দুগ্ধ গলিতে গলিতে ফেরি করিতে হয়, কিন্তু সুরা এক স্থানে বসিয়াই বিক্রয় হয়। সতী নারীর পরিধানে বস্ত্র জুটে না, অসতী সুবেশ পরিধান করে।—তুলসীদাস |
৯ | তুলসীদাসের দোঁহা |
১০ | সঙ্কর-জাতি |
১১ | আহ্রিয়ত ইত্যাহারঃ, শব্দাদির্বিষয়জ্ঞানম্ ভোক্তুর্ভোগায় আহ্রিয়তে।—শঙ্করভাষ্য, ছান্দোগ্য উপনিষদ্ ৭।২৬ |
১২ | সীতামাদায় বাহুভ্যাং মধুমৈরেয়কং শুচি।
পায়য়ামাস কাকুৎস্থঃ শচীমিন্দ্রো যথামৃতম্॥ মাংসানি চ সুমৃষ্টানি বিবিধানি ফলানি চ। রামস্যাভ্যবহারার্থং কিঙ্করাস্তূর্ণমাহরন্॥—রামায়ণ, উত্তর ৫২ সুরাঘটসহস্রেণ মাংসভূতৌদনেন চ। যক্ষ্যে ত্বাং প্রীয়তাং দেবী পুরীং পুনরুপাগতা॥—রামায়ণ, অযোধ্যা ৫৫ উভৌ মধ্বাসবক্ষিপ্তৌ উভৌ চন্দনচর্চিতৌ। উভৌ পর্যঙ্করথিনৌ দৃষ্টৌ মে কেশবার্জুনৌ॥—মহাভারত, আদিপর্ব |
১৩ | খণ্ডিত-খুর |
১৪ | দেবতার উদ্দেশে যাহা নিবেদিত নয়। |
১৫ | আনন্দস্তোত্রম্ |
১৬ | গীতা, ৩।৩৩ |
১৭ | ফাঁকা |
১৮ | Deutsch |
১৯ | গীতা, ৪।৮ |
২০ | ‘দেবতা’ ও ‘অসুর’ এখানে গীতার ১৬শ অধ্যায়ে বর্ণিত দৈবী ও আসুরী সম্পদের প্রাধান্যযুক্ত মানব (জাতি) সম্বন্ধে ব্যবহৃত। |
২১ | সভ্য হইবার পূর্বে |
২২ | ধাতু গলাইবার পাত্র, crucible |
২৩ | কান্দাহারের অধিবাসী |
২৪ | কাঁচা বা আরাঁধা মাংসাহারী |
২৫ | প্রাচীন আর্য সমাজব্যবস্থায় চারি বর্ণ—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র; চারি আশ্রম—ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। |
* | প্রাচীন আর্য সমাজব্যবস্থায় চারি বর্ণ—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র; চারি আশ্রম—ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। |
১ | সোমলতা—বেদে উহা ‘রাজা সোম’ নামে উক্ত। |
২ | অগ্নিবর্ণ—সূর্যবংশীয় রাজা-বিশেষ। ইনি প্রজাগণের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া দিবারাত্র অন্তঃপুরে কাটাইতেন। অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়পরদোষে যক্ষ্মারোগে ইঁহার মৃত্যু হয়। |
৩ | ধর্মাশোক—ভারতবর্ষের একচ্ছত্র সম্রাট্ অশোক। ভ্রাতৃহত্যা প্রভৃতি নৃশংস কার্যের দ্বারা সিংহাসন লাভ করাতে ইনিপূর্বে চণ্ডাশোক নামে খ্যাত ছিলেন। কথিত আছে, সিংহাসনলাভের প্রায় নয় বংসর পরে, বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হইয়া তাঁহার স্বভাবের অদ্ভুত পরিবর্তন হয়—ভারত ও ভারতেতর দেশে বৌদ্ধধর্মের বহুল প্রচার তাঁহার দ্বারাই সাধিত হয়। ভারত, কাবুল, পারস্য ও পালেস্তাইন প্রভৃতি দেশে অদ্যাবধি আবিষ্কৃত স্তূপ, স্তম্ভ এবং পর্বতগাত্রে খোদিত শাসনাদি ঐ বিষয়ে ভূরি সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। এই প্রকার ধর্মানুরাগ এবং প্রজারঞ্জনের জন্যই ইনি পরে ‘দেবানাং পিয়ো পিয়োদিশি’ (দেবতাদের প্রিয় প্রিয়দর্শন) ধর্মাশোক বলিয়া প্রসিদ্ধ হন। |
৪ | গ্রীক |
৫ | প্রজা |
৬ | মন্ত্র বা অস্ত্র দ্বারা |
৭ | উৎসাদন |
৮ | মিহিরকুল—হূনজাতীয় রাজা |
৯ | খ্রীষ্টান |
১০ | (ইসলামে) অবিশ্বাসী |
১১ | আর্যাবর্ত ও গুজরাটের পারস্যদেশীর সম্রাড়্গণ (Satraps) |
১২ | ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য |
১৩ | খল্দিয়ার আদিম নিবাসী, Sumerians |
১৪ | প্রাচীন বাবিলন-নিবাসী, Babylonians |
১৫ | খল্দিয়া-নিবাসী, Chaldeans |
১৬ | প্রাচীন পারস্য-নিবাসী, Iranians |
১৭ | ব্যতীত |
১৮ | Confucious—চীনদেশীয় ধর্ম ও নীতি-সংস্কারক |
১৯ | পুনরায় স্থাপন |
২০ | অভিপ্রায় |
২১ | ক্ষাত্র ও মন্ত্রশক্তি সহায় যাহার |
২২ | প্রযোজ্য |
২৩ | চিহ্ন |
২৪ | বিশেষ অধিকারভোগী |
২৫ | বেণ—ভাগবতোক্ত রাজা-বিশেষ। কথিত আছে, ইনি আপনাকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর-আদি দেবগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ এবং পূজনীয় বলিয়া প্রচার করিতেন। ঋষিগণ তাঁহার এ অহঙ্কার দূর করিবার জন্য কোন সময়ে সদুপদেশ দিতে আসিলে তিনি তাঁহাদের তিরস্কার করেন এবং আপনাকেই পূজা করিতে বলায় তাঁহাদের কোপানলে নিহত হন। ভগবান্ বিষ্ণুর অবতার বলিয়া গণ্য মহারাজ পৃথু এই বেণ-রাজার বাহুমন্থনে উৎপন্ন। |
২৬ | সমাজতন্ত্রবাদ, নৈরাজ্যবাদ, নাস্তিবাদ |
২৭ | বশিষ্ঠের জন্মবৃত্তান্ত—ঋগ্বেদ, ৭।৩৩।১১-১৩ |
২৮ | ধীবরজননীর পুত্র |
২৯ | পশু শিকার করিয়া জীবনধারণ করে যে। |
৩০ | চিহ্ন |
৩১ | রোমক সম্রাট সীজার |
৩২ | প্রাচীন দেবগণের |
৩৩ | ‘মোহমুদ্গর’, শঙ্করাচার্য |
১ | পাঠান্তর—বক্ত্রোদ্ধৃতন্তু হৃদি মে ন চ ভাতি কিঞ্চিৎ |
২ | পাঠান্তর—তেজস্তরন্তি তরসা ত্বয়ি তৃপ্ততৃষ্ণাঃ |
৩ | পাঠান্তর—রাগে কৃতে ঋতপথে ইত্যাদি |
* | শ্রীরামকৃষ্ণ-বিষয়ক আরও তিনটি স্তবক পাওয়া যায় ২৫শে সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ খ্রীঃ লিখিত পত্রে। উহা পত্রাবলী অংশে দ্রষ্টব্য। |
৪ | পাঠান্তর—প্রমথতি |
৫ | পাঠান্তর—প্রাণবিচ্ছেদসুৎকং |
৬ | পাঠান্তর—কো বা ধর্মঃ কিমকৃতং ... । |
৭ | পাঠান্তর—কিম্বাদৃষ্টং ফলমিহান্তি হি যদ্বিনা ভোঃ। |
৮ | পাঠান্তর—ইচ্ছাপাশৈর্নিয়মিতা |
৯ | পাঠান্তর—যস্যা নেত্রী |
১০ | পাঠান্তর—স্বস্থে দুঃস্থে ত্ববিতথং তব |
১১ | পাঠান্তর—মৃত্যুচ্ছায়া তব দয়া অমৃতঞ্চ মাতঃ |
১২ | পাঠান্তর—মা মাং মুঞ্চন্তু |
১৩ | পাঠান্তর—ধর্তুং দোর্ভ্যামিব মতির্জগদেকধাত্রীম্ |
১৪ | পাঠান্তর—শ্রীসঞ্চিন্ত্যং ... |
১৫ | পাঠান্তর—সেবাসারৈরভিনুতং |
১৬ | পাঠান্তর—যা মামাজন্ম ... |
১৭ | পাঠান্তর—যা মে বুদ্ধিং ... |
১৮ | পাঠান্তর—সাম্বা সর্বা ... |
১৯ | মানুষকে দূষিত করে এমন যে সকল অঘ অর্থাৎ পাপ, তাহা যিনি মোচন করেন। |
২০ | যিনি যুগের ঈশ্বররূপে প্রকাশিত |
২১ | যিনি দুঃখের গঞ্জনাকে দূর করিয়াছেন |
২২ | কর্মবীর |
২৩ | যিনি কলির বন্ধনকে ছেদন করিয়াছেন |
২৪ | জাতি-কুল-মান না দেখিয়া যিনি বিনা কারণে ভক্তকে আশ্রয়দান করেন |
২৫ | অজ্ঞানদূরকারী |
২৬ | করজোড়ে |
২৭ | এক সত্তা, যাঁহার নাম রূপ বর্ণ কিছুই নাই, যিনি দেশকালের অতীত, যেখানে ‘নেতি নেতি’ বিচার শেষ হইয়াছে। |
২৮ | পাঠান্তর—ওঠে |
২৯ | তিনি সূর্য, কিরণজাল তাঁহারই; যিনি সূর্য, তিনিই কিরণ। |
১ | মহামায়া, মহামাঈ |
* | ইংরেজী হইতে অনূদিত পত্র তারকাচিহ্নিত |
২ | স্বামী প্রেমানন্দের জন্মভূমি |
৩ | পূর্বজন্মের প্রীতির স্মৃতিই পরজন্মে সহজ আকর্ষণরূপে দেখা দেয়।—অভিজ্ঞানশকুন্তলম্, ৫, কালিদাস |
৪ | গীতা, ২।৭০ |
৫ | —কারণ আমরা জগতের দুঃখকষ্টরূপ ক্রুশ ঘাড়ে করিয়াছি; হে পিতঃ, তুমি উহা আমাদিগের স্কন্ধে অর্পণ করিয়াছ। এক্ষণে আমাদিগকে বল দাও—যেন আমরা উহা আমরণ বহন করিতে পারি। ওঁ শান্তিঃ! —ঈশা-অনুসরণ |
৬ | (আরবী শব্দ)—ব্যতীত |
৭ | ‘চক্রক’—যাহার বলে সিদ্ধান্ত করা হইবে, তাহাকেই সিদ্ধান্ত দ্বারা সমর্থন করা। |
৮ | মধুপর্ক বৈদিক প্রথা—ইহাতে গোবধের প্রয়োজন হইত। |
৯ | অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্।
দেবরেণ সুতোৎপত্তিং কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ॥ অশ্বমেধ, গোবধ, সন্ন্যাস, শ্রাদ্ধে মাংসনিবেদন এবং দেবরের দ্বারা পুত্রোৎপাদন—কলিকালে এই পাঁচটি ক্রিয়া বর্জন করিবে। |
১০ | ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ। ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে॥—মুণ্ডকোপনিষৎ, ২, ২।৮ |
১১ | যাঁহারা বলেন ইন্দ্রিয়জন্য-জ্ঞান-নিরপেক্ষ স্বতঃসিদ্ধ আরও একপ্রকার জ্ঞান আছে। |
১২ | স্বামী সদানন্দ |
১৩ | স্বামী যোগানন্দ |
১৪ | স্বামী নিরঞ্জনানন্দ |
১৫ | ভাবার্থঃ গ্রহণ না করিয়া ফেরত দিয়াছেন। |
১৬ | গাজীপুরের বিখ্যাত যোগী পওহারী বাবা। |
১৭ | গীতা ৬।৮ |
১৮ | শঙ্করাচার্যকৃত ‘বিবেকচূড়ামণি’, ৫৩৮-৪০ |
১৯ | পাতঞ্জল যোগসূত্রে ‘বীতরাগবিষয়ং বা চিত্তং’ সূত্রটির তাৎপর্য এইরূপ। |
২০ | স্বামী অভেদানন্দ |
২১ | নাট্যকার গিরিশ ঘোষের ভ্রাতা শ্রীঅতুলচন্দ্র ঘোষ |
২২ | শঙ্করাচার্যকৃত ‘মোহমুদগর’ |
২৩ | স্বামী জ্ঞানানন্দ |
২৪ | গীতা, ১৫।৫ |
২৫ | স্বামীজী শ্রীযুক্ত দেশাইকে ‘দেওয়ানজী সাহেব’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। |
২৬ | খেতড়িতে পণ্ডিত নারায়ণ দাসের নিকট স্বামীজী পতঞ্জলিকৃত ‘পাণিনিসূত্রের মহাভাষ্য’ শিক্ষা করেন। তাঁহাকেই স্বামীজী ‘অধ্যাপক’ বলিতেছেন। |
২৭ | Generalisation—বিশেষ বিশেষ সত্য হইতে এক সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। |
২৮ | আমেরিকা যাত্রার কিছু পূর্বে স্বামীজী ‘সচ্চিদানন্দ’ নামে নিজেকে পরিচিত করিতেন। |
২৯ | Lord's Prayer.—Bible |
৩০ | খেতড়ির রাজা |
৩১ | কানাডার সন্নিকট প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপ ও বন্দর। |
৩২ | পারমার্থিক ও ব্যাবহারিকঃ যখন লোককে বলা যায়, ‘তোমাদের শাস্ত্রে আছে, সকলের ভিতর এক আত্মা আছেন, সুতরাং সকলের প্রতি সমদর্শী হওয়া এবং কাহাকেও ঘৃণা না করা শাস্ত্রের আদেশ’, লোকে তখন এই ভাব কার্যে পরিণত করিবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করিয়াই উত্তর দেয়, ‘পারমার্থিক দৃষ্টিতে সব সমান বটে, কিন্তু ব্যাবহারিক দৃষ্টিতে সব পৃথক্।’ এই ভেদদৃষ্টি দূর করিবার চেষ্টা না করাতেই আমাদের পরস্পরের মধ্যে এত দ্বেষ-হিংসা রহিয়াছে। |
৩৩ | বষ্টনের অধ্যাপক J. H. Wright স্বামীজীকে চিকাগোর ধর্মমহাসভায় পরিচিত করাইয়া দেন। স্বামীজী তাঁহাকে Adhyapakji বলিতেন, চিঠিতেও ঐরূপ লিখিতেন। |
৩৪ | ‘তৎ সৎ’: সেই সৎস্বরূপ [স্বামীজীর টীকাঃ 'Tat Sat' means That only Real Existence] |
৩৫ | Hard-shelled Christians |
৩৬ | চণ্ডী, ৪।৫ |
৩৭ | মনুসংহিতা, ৩।৫৬ |
৩৮ | আবিষ্কারক Thomas Alva Edison |
৩৯ | হরিদাস বিহারীদাস দেশাই |
৪০ | গিরিশচন্দ্র ঘোষ |
৪১ | বিখ্যাত চিকাগো বক্তৃতার পর স্বামীজী একটি Lecture Bureau-র (বক্তৃতা কোম্পানী) সহিত মিলিত হইয়া কিছুদিন আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা করেন। এই কোম্পানী ভাল ভাল বক্তা সংগ্রহ করিয়া তাহাদের দ্বারা বক্তৃতা দেওয়াইয়া থাকে এবং বক্তৃতার সমুদয় বন্দোবস্ত করে। টিকিট বিক্রয় করিয়া যে টাকা পায়, তাহার কতকাংশ ঐ বক্তাকে দিয়া থাকে। এই সময়ে অনেকে স্বামীজীকে এইরূপ বুঝাইয়া দিয়াছিল যে, পয়সা না লইলে তথায় কেহ বক্তৃতা শুনে না। কিন্তু পরে যখন তিনি দেখিলেন, ইহাতে স্বাধীনভাবে কার্য করা অসম্ভব, তখন ইহাদের সহিত সমুদয় সংস্রব পরিত্যাগ করিয়া বক্তৃতালব্ধ অর্থের অধিকাংশ ভারতের নানা সৎকার্যে দান করিয়া বিনা পয়সায় বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেন। |
৪২ | যাহারা নিরর্থক পরের অনিষ্টসাধন করে, তাহারা যে কিরূপ লোক, তাহা বলিতে পারি না। |
৪৩ | ঈশ উপনিষদ্ |
৪৪ | শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ |
৪৫ | পাহাড় যদি মহম্মদের নিকট না যায়, মহম্মদ পাহাড়ের নিকট যাবেন। অর্থাৎ গরীবের ছেলেরা যদি স্কুলে এসে লেখাপড়া শিখতে না পারে, বাড়ী বাড়ী গিয়ে তাদের শেখাতে হবে। |
৪৬ | আমাদের জাতটা নিজেদের বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলেছে, সেইজন্যই ভারতে এত দুঃখকষ্ট। সেই জাতীয় বিশেষত্বের বিকাশ যাতে হয়, তাই করতে হবে—নীচ জাতকে তুলতে হবে। হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান সকলেই তাদের পায়ে দলেছে। আবার তাদের উঠাবার যে শক্তি, তাও আমাদের নিজেদের ভেতর থেকে আনতে হবে—গোঁড়া হিন্দুদেরই এ কাজ করতে হবে। সব দেশেই যা কিছু দোষ দেখা যায়, তা তাদের ধর্মের দোষ নয়, ধর্ম ঠিক ঠিক পালন না করার দরুনই এই সব দোষ দেখা যায়। সুতরাং ধর্মের কোন দোষ নাই, লোকেরই দোষ। |
৪৭ | মূর্খ, ভীমরতিগ্রস্ত ও স্বার্থপরতার মূর্তি। |
৪৮ | আর আমার বাকী জীবন এই এক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য নিয়োজিত করব। |
৪৯ | অধ্যাপক রঙ্গাচার্য |
৫০ | চিকাগো ইণ্টিরিয়র—প্রেসবিটেরিয়ান সংবাদপত্র, এরা স্বামীজীর বিরোধিতা করিত। |
৫১ | স্পষ্টতই কেশবচন্দ্র সেন |
৫২ | প্রবাদ আছে—মহম্মদ একবার ঘোষণা করিয়াছিলেন, ‘আমি পর্বতকে আমার নিকট ডাকিলে উহা আমার নিকট উপস্থিত হইবে।’ এই অলৌকিক ব্যাপার দেখিবার জন্য মহা জনতা হয়। মহম্মদ পর্বতকে পুনঃ পুনঃ ডাকিতে লাগিলেন, তথাপি পর্বত একটুও বিচলিত হইল না। তাহাতে মহম্মদ কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘পর্বত যদি মহম্মদের নিকট না আসে, মহম্মদ পর্বতের নিকট যাইবে।’ তদবধি উহা একটি প্রবাদবাক্যস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। |
৫৩ | বন্দৌঁ সন্ত অসন্তন চরণা।
দুখপ্রদ উভয় বীচ কছু বরণা॥ বিছুরত এক প্রাণ হরি লেই। মিলত এক দারুণ দুখ দেই॥ |
৫৪ | Paramahamsa Ramakrishna by Protap Chandra Majumdar |
৫৫ | অজস্র |
৫৬ | Aurora Boorealis—(সুমেরু-জ্যোতি) পৃথিবীর উত্তরভাগে রাত্রিকালে (তথায় ছয় মাস ক্রমাগত রাত্রি) কখনও কখনও নভোমণ্ডলে এক প্রকার কম্পমান বৈদ্যুতিক আলো দেখা যায়। উহা নানা আকারের এবং নানা বর্ণের। ইহাকেই অরোরা বোরিয়ালিস বলে। |
৫৭ | এই পত্রের সঙ্গে ‘গাই গীত শুনাতে তোমায়’ কবিতাটির কিছু অংশ লিখিত দেখা যায়। |
৫৮ | ইনি থিওসফিক্যাল সোসাইটির আমেরিকা-বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন। |
৫৯ | Christian Scientist—আমেরিকার একটি সম্প্রদায়। ইঁহারা যীশুখ্রীষ্টের ন্যায় অলৌকিক উপায়ে রোগ আরাম করিতে পারেন বলিয়া দাবী করেন। |
৬০ | ক্রিশ্চান সায়াণ্টিস্ট সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাত্রী মিসেস এডিকে স্বামীজী রঙ্গ করে Mrs. Whirlpool (ঘূর্ণাবর্ত) বলতেন—কারণ Eddy ও Whirlpool সমার্থক। |
৬১ | স্বামীজীর আমেরিকান সন্ন্যাসী শিষ্য স্বামী কৃপানন্দ। |
৬২ | কলিকাতা ডাকঘরের ছাপ ২০. ২. ৯০ |
৬৩ | কলিকাতা মেছুয়াবাজার কীর্তি সিনেমার সম্মুখে। |